৬. আবারো সংঘাত

 ক্রাক অবরোধের দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। খৃস্টানদের পক্ষ থেকে আক্রমণ বা আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তারা দুর্গের মধ্যে বসে আত্মরক্ষামূলক লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল। আইয়ুবী রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলেও তাতে ওদের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। আইয়ুবী ক্রাক অবরোধ করতে আসছে শুনেই দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মত প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও রসদের মজুত তারা গড়ে তুলেছিল দুর্গের ভেতর।

 দুর্গের ভেতরে আইয়ুবীর যে কমান্ডো বাহিনী আগেই ঢুকে পড়েছিল তাদের একজন আইয়ুবীকে এ সংবাদ সরবরাহ করল।

 একটা তীরের মাথায় চিঠি বেঁধে সে তীর ছুঁড়ে মারল মুসলিম বাহিনীর দিকে। সে চিঠিতে লেখা ছিলঃ ভেতরে এদের খাদ্য এবং রসদপত্রের কোন ঘাটতি নেই। খৃস্টানরা এখানকার মুসলমানদের ওপর কড়া নজর রাখছে। মুসলমানরা এখন জানে, দেয়ালেরও কান আছে। ফলে ভেতর থেকে কোন কিছু কড়া এখন সম্ভব নয়। সুযোগ পেলে ভেতরের মুসলমানরা তাদের রসদপত্র ধ্বংস করে দিতে পারত, কিন্তু এখনো এমন কোন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি।’

 রাতের নির্জন প্রহরে তীরের সাথে চিঠি বেঁধে এভাবে মাঝেমধ্যেই সংবাদ পাঠাতো ভেতরের গোয়েন্দারা। সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ ছিল, এমন কোন তীর এলে যেন সাথে সাথেই কমান্ডারের কাছে পৌঁছে দেয়।

 খৃস্টানরা চাচ্ছিল, অবরোধ দীর্ঘতর হোক। এতে সুলতান আইয়ুবীর শক্তি ক্ষয় হবে। সুলতান আইয়ুবী তাদের এ চাল বুঝতে পারলেন। ফলে তিনি যুদ্ধের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলেন।

 এর আগে বাইরে থেকে আক্রমণের যে পরিকল্পনা তাদের ছিলও তাও তিনি যথাসময়ে জানতে পেরেছিলেন এবং কৌশলে সে আক্রমণ ব্যর্থ করেননি বরং যে বাহিনী এ অভিযানে অংশ নিয়েছিল তাদেরকে এক নাজুক জায়গায় আজো ঘেরাও করে রেখেছেন। ক্রুসেড বাহিনীর এই দলটি দীর্ঘ দেড় মাস ধরে ঘেরাওয়ের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। তারা ঘেরাও থেকে বের হওয়ার জন্য যতবার চেষ্টা করেছে ততবারই বিপুল ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।

 ঘেরাওয়ের মধ্যে আটকেপড়া সৈন্যরা খাদ্যাভাবে কাতর হয়ে পড়ল। এ অভাব দূর করার জন্য তারা তাদের কোন পশু মারা গেলে ফেলে না দিয়ে কেয়ে ফেলতো। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হলো না। হাজার হাজার ঘোড়া ও উটের জন্য চরণভূমি ছিল সংকীর্ণ। পানিরে জন্য সেখানে কোন নদী বা কোন ঝর্ণা ছিল না। তিন চারটি নালা ছিল পানি পাওয়ার একমাত্র সম্বল। তা এ কদিন ব্যবহারের ফলে শুকিয়ে গেল।

 এসব দেখে আটকেপড়া সৈন্যদের মধ্যে হতাশা ও নৈরাশ্যের মেঘ জমতে শুরু করল। এর সাথে দেখা দিল আরেক নতুন বিপদ। রাতের বেলা মুসলিম কমান্ডোরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাদের ব্যাপক ক্ষতি করতে শুরু করল। কয়েকদিনের মধিয়ে এ সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেল। খেতে না পেয়ে তাদের পশুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ল। এ বাহিনীর প্রধান রিমান্ত প্রচণ্ড অশান্তি ও অস্থিরতার মধ্যে সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছিল। একই অশান্তি ও অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করছিল বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা। কখন মিত্ররা এসে সুলতান আইয়ুবীর বেষ্টনী থেকে বের করে নেবে তাদের, এই আশায় তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কিন্তু এই অপেক্ষা তাদের হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেয় না।

 সুলতান আইয়ুবী ইচ্ছা করলে চারদিক থেকে আক্রমণ করে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতেন। কিন্তু আইয়ুবী তা করলেন না। ফাঁদে পড়া ইঁদুর মারার ব্যাপারে তার কোন তাড়াহুড়া নেই, তাঁর চিন্তা দুর্গ জয়ের পথে যারা অবিরাম প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে তাদের নিয়ে। এতে অবশ্য তাঁরও ক্ষতি হচ্ছিল, নিজের বাহিনীর সৈন্যদের ব্যস্ত রাখতে হচ্ছিল তাদের পাহারায়।

 তিনি রিজার্ভ সৈন্যদের নিয়ে চিন্তা করলেন। দুর্গটি ভাঙার কাজে কি তাদের ব্যবহার করবেন? তিনি অবরোধ আর বেশিদিন দীর্ঘ করতে চান না। সে সময় যুদ্ধে বছরের পর বছর অবরোধ দীর্ঘ করার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এ কৌশল তার পছন্দ ছিল না।

 সুলতান আইয়ুবী কোন রাজ্যে লোলুপ সেনাপতি ছিলেন না। তিনি কখনো কোন দেশের রাজধানী অবরোধ করে শহর কর্তৃপক্ষের এ কথা বলেননি, এত পরিমাণ সোনা, হীরা, জহরত, এত হাজার ঘোড়া ও এতগুলো নারী এনে দাও, আমি অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে চলে যাবো।

 সুলতান আইয়ুবী ছিলেন এক মর্দে মুজাহিদ। ইসলামকে বিজয়ী দ্বীন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন তিনি। আরবের মাটি থেকে ইসলাম বিরোধী সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নির্মূল করার জন্য ঝলসে উঠতো তার তলোয়ার। তিনি যা বিশ্বাস করতেন জনগণের সামনে তা অত্যন্ত খোলামেলা ও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতেন। তিনি যা করতে চাইতেন তাই তিনি বলতেন, আর যা তিনি বলতেম তাই করতেন। সব সময় কথা ও কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখাই ছিল তার নীতি। এ ব্যাপারে তার কোন দ্বিধা সংকোচ ছিল না বলেই জনগণও তাঁর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখতো, তাঁকে পছন্দ করতো এবং ভালোবাসতো।

 তিনি বলতেন, ‘এই আরবভূমিতে মহানবী (সা.) ইসলামের যে আলো জ্বেলেছিলেন সে আলো কেবল আরবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিশ্বের দিকদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সেই আরবের পবিত্র ভূমিতে বিকৃত হয়ে পড়েছে ইসলাম। ইহুদী ও খৃস্টানরা ইসলামের আলো নিভিয়ে দেয়ার জন্য একের পর ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। অত্যাচার চালাচ্ছে মুসলমানদের ওপর। এ অবস্থা কিছুতেই চলতে দেয়া যায় না। রাসূল যেমন এক হাতে কোরআন নিয়েছিলেন সত্যের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এবং অন্য হাতে অন্যায় ও অসত্যকে নির্মূল করার জন্য তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র, সেই পথই মুসলমানের চলার পথ। যারা রাসূলের এ সুন্নাতকে অস্বীকার করে অন্য কোন তরীকা গ্রহণ করবে, তাদের সাহায্য সহযোগিতা কড়া কোন মুসলমানের জন্য জাইয়েজ হতে পারে না।’

 তিনি সময়ের গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি। বলতেন, ‘মানুষের জীবন বড়ই সংক্ষিপ্ত। কোন মহান কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য নির্ধারিত হায়াতের বেশি সময় কেউ পাবে না। আই আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কা আমি অল্প সমইয়ে শেষ করতে চাই। প্রতিটি মুহূর্তকে আমি চাই প্রজ্ঞার সাথে এ কাজে ব্যয় করতে।’

 তিনি বলতেন, ‘আমার এ সংগ্রাম কেবল ইহুদী ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে ন্য, সেইসম মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধেও, যারা নিজেদের ক্ষমতা, অর্থ এবং প্রতিপত্তির লোভে এ মাটি বিধর্মীদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে আমি অনড় এবং আপোষহীন। আর কেবলমাত্র আপোষহীনদেরই আমি আমার সঙ্গী হওয়ার আহ্বান জানাই।’

 তিনি আরো বলতেন, ‘আমার এ মনোভাবের ফলে খৃস্টানরা আমাকে মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা এটাকে গালি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এক শ্রেণীর মুসলমানও চায় আমি আপোষকামী হয়ে যাই। কিন্তু আমার পক্ষে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি বরং মৌলবাদী হতে পারায় গর্ববোধ করি।

 কারণ, মৌলবাদী হওয়া মানে মূলের অনুগামী হওয়া, মূলের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। মুল কেটে ফেললে বৃক্ষ বাঁচে না, মৌলবাদী না হলে মানবতা বাঁচে না।

 এ পৃথিবীর মূলে আছেন আল্লাহ। এ মূলের সাথে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি না। আমি আল্লাহকে আল্লাহ, রাসূল (সা.)কে নেতা এবং ইসলামকে আমার জীবন বিধান মানি বলেই ওরা আমাকে মৌলবাদী বলছে। তার মানে, ইসলামই যে মানুষের জন্য মৌলিক জীবন বিধান তাঁর সার্টিফিকেট তো ওরাই দিচ্ছে। ওরাই তো স্বীকার করছে, পৃথিবীতে যত মতবাদ আছে তার মধ্যে একমাত্র ইসলামই মৌলিক। আমি মৌলবাদী, কারণ আমি এ মৌলিক সত্যের ধারক, বাহক। আর ওরা যার পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে তা অ-মৌলিক অর্থাৎ ভেজালে পরিপূর্ণ। এ ভাবেই আল্লাহ দুশমনদের মুখ দিয়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।’

 তিনি আরো বলেন, ‘কোন ছেলে কি তার মাকে অস্বীকার করতে পারে? এ পৃথিবীর আলো বাতাসে আমি যে আসতে পেরেছি তার মূলে আছে আমার মা। মৌলবাদীকে অস্বীকার করা মানে এই মা-কে অস্বীকার কড়া। আর মায়ের স্নেহ মমতায় সিক্ত হওয়ার মানে মৌলবাদী হওয়া।

 আল্লাহর বান্দা মৌলবাদী না হলে হয় বেঈমান, সন্তান তার জন্মের মূল না জানলে হয় জারজ সন্তান, দেশের নাগরিক মৌলবাদী না হলে হয় দেশদ্রোহী। আমি এর কোনটাই হতে চাই না। আমি আমার মাটি ও দেশের সাথে সম্পৃক্ত থেকে হতে চাই দ্রেশপ্রেমিক, মায়ের স্নেহ মমতাকে ধারণ করে হতে চাই মানবতাবাদী, আল্লাহর গোলামী কবুল করে হতে চাই ঈমানদার।

 মৌলবাদী হওয়া মানে আল্লাহ ও রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। মানবতার সাথে সম্পৃক্ত থাকা। ইসলামের যে মৌলিক বিধান আছে তাকে যে গ্রহণ করে তাকেই ওরা মৌলবাদী বলছে। আমি আংশিক ইসলামের অনুসারী হতে চাই না। অ-মৌলিক বা দু’নম্বর কোন কিছুও গ্রহণ করতে চাই না। ফলে, যে যাই বলুক, আমি তো আসলেই মৌলবাদী।

 মানুষের মন থেকে মৌলবাদী হওয়ার চেতনা লোপ পাওয়ার ফলেই আজ বিশ্বব্যাপী পশুত্ব ও বর্বরতার বিস্তার ঘটেছে। মানুষের মন থেকে মনুষত্ব লোপ প্যেছে। মানবিকতা লোপ পেয়েছে। কারণ, মৌলবাদীকে অস্বীকার করলে মানবিকতাকে অস্বীকার কড়া হয়, মানবতাকে অস্বীকার করা হয়। কোন মুসলমান, যে নিজেকে আল্লাহর বান্দা বলে দাবী করে, সে কি করে মৌলবাদী হতে অস্বীকার করবে?

 মুসলমান তো বিশ্বাস করে, এই পৃথিবী আল্লাহর এক বিশাল পরিবার। আমরা আল্লাহর খলিফা, মানে তাঁর প্রতিনিধি। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই পৃথিবীর দেখভাল করা। এই অনুভূতির কারণেই আমরা কেবল নিজেদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করি না, চিন্তা করি না কেবল আপনজনের কথা। বরং আমরা কল্যাণ চাই বিশ্বের প্রতিটি মানুষের। কল্যাণ চাই সমস্ত সৃষ্টিকুলের। কারণ, এ সবই আল্লাহত এবং আল্লাহর এ সৃষ্টিকুলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রতিনিধি হিসাবে আমাদের।

 আল্লাহই আমাদের জানিয়েছেন, এ পৃথিবীতে তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন এর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে কেবলমাত্র মানুষের জন্য। তিনি আরো জানিয়েছেন, আর এই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর এবাদত করার জন্য।

 আল্লহর এবাদত মানে কেবল নামাজ, রোজা নয়, আল্লাহর এবাদত মানে আল্লাহর খলিফার দায়িত্ব পালন করা, তাঁর এ সৃষ্টির সেবা করা, রক্ষণাবেক্ষণ করা। যেখানেই এর ব্যতিক্রম ঘটে সেখানেই বিপর্যয় দেখা দেয়, সেখানেই অশান্তির সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি জুগতের শান্তির স্বার্থেই আল্লাহর বিধানকে আমাদের পরিপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। তাহলেই আর কোথাও অশান্তি থাকবে না, অনৈক্য থাকবে না, অসাম্য থাকবে না।

 আল্লাহর মনোনীত এই একমাত্র দ্বীন ইসলাম ছাড়া আর যত মতবাদ সবই অ-মৌলিক, বিভ্রান্ত বা খন্ডিত মতবাদ। ইসলামের সৌন্দর্য ধার করে পরগাছার মত টিকে থাকে তারা। তা যারা চায় না তারাই মৌলবাদী এবং আমি এ মৌলবাদী হয়েই চিরদিন বেঁচে থাকতে চাই।

 যাদের মনে এ চেতনা ও বিশ্বাস নেই মানবতার কল্যাণের কোন চিন্তা করার দয়াও নেই তাদের। তাদের পক্ষে আত্মসুখে বিভোর হওয়াই স্বাভাবিক। ‘খাও, দাও, ফুর্তি করো, দুনিয়াটা মস্ত বড়ো’ বলে পৃথিবীর যতটুকু পারে নিজের ভাগে নেয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে তারা। অন্যের জন্য ভাববার কি দায় ঠেকেছে তাদের! তাই, যেখানে ইসলাম নেই, সেখানে মানবতা নেই; যেখানে মানবতা নেই, সেখানে মৌলবাদ নেই। মৌলবাদ থাকলে ইসলাম থাকবে, ইসলাম থাকলে মানবতা থাকবে। মৌলবাদ, ইসলাম, মানবতা বৃহত্তর অর্থে এক ও অভিন্ন চেতনার নাম।

 এক রাতে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। কি করে দুর্গে প্রবেশ করা যায় ভাবছিলেন তিনি। অদ্ভুতসব চিন্তা এসে মাথায় ভর করছিল। একবার ভাবলেন, মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খনন করে দুর্গে প্রবেশ করলে কেমন হয়! আবার ভাবলেন, যদি অবরোধ উঠিয়ে সরে পড়ি এবং পড়ে পিছন দিক দিয়ে ঘুরে এসে অতর্কিতে হামলা করি! তিনি যখন এমনি সব ভাবনার রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাবুতে প্রবেশ করলেন আলী বিন সুফিয়ান। তাকে দেখে সুলতান আইয়ুবী খুশি না হয়ে আরও ঘাবড়ে গেলেন। কারণ আগেই খবর পেয়েছিলেন, মিশরের অবস্থা আশংকাজনক।

 সুলতান আইয়ুবী মুখে বিষণ্ন ভাব নিয়ে আলী বিন সুফিয়ানের সাথে কোলাকুলি করলেন এবং বললেন, ‘তুমি আমার কাছে নিশ্চয়ই কোন সুসংবাদ বহন করে আননি?’

 ‘সবটাই অমঙ্গলের নয়।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘কিন্তু সুসংবাদও কিছু নেই।’

 তিনি সুলতান আইয়ুবীর কাছে মিশরের অবস্থা বলা শুরু করলেন। কোন কথাই গোপন করলেন না।

 আলী বিন সুফিয়ানের কাছে আরসালানের বিশ্বাসঘাতকতার কথা ও আল ইদরিসের দুই যুবক ছেলের মৃত্যুর করুণ কাহিনী শুনে সুলতানের চোখে অশ্রু নেলে এলো। যদি আরসালান মরে না যেতো তবে তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা সুলতান আইয়ুবী কখনও বিশ্বাস করতেন না। আলীর কথা শুনে তার মনে পড়ল, আগেও তার দুই বন্ধু এমনিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।

 ‘যদি আরসালান আরও কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতো তবে সে আরও গোপন রহস্য প্রকাশ করতে পারতো।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তার শেষ বাক্য, তা সে পূর্ণ করে যেতে পারেনি তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, মিশরে বিদ্রোহ আসন্ন প্রায়। মিশরে আমাদের যে সৈন্য আছে তাদেরকে মানসিক ও চারিত্রিক দিক থেকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। আমার গোয়েন্দা বিভাগ বলেছে, কমান্ডাররা পর্যন্ত ভুল ধারনা ও অশান্তির শিকার হয়েছে। সেনাবাহিনীর রেশন কমিয়ে দিয়ে তাদেরকে আরো অস্থির করে তোলা হয়েছে। যে সমস্ত খাদ্যশস্য সৈন্যদের জন্য পাঠানো হচ্ছে, তা পাচার করে অর্থ আত্নসাত করছে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মচারী। এইভাবে শত্রুরা ষড়যন্ত্র পূর্ণ করে আনতে চাইছে।’

 ‘শত্রুদের ষড়যন্ত্র সেই দেশেই সফল হয়, যে দেশের প্রশাসনযন্ত্রের কিছু লোক শত্রুদের সাহতে গোপন যোগসাজশ রাখে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যদি আমার এক ভাই শত্রুদের সহকর্মী হয়ে যায় তবে আমরা শত্রুদের কিভাবে মোকাবেলা করতে পারি? আমি যেভাবে আল্লাহ-ভক্ত সেনাবাহিনী নিয়ে খৃস্টানদেরকে যুদ্ধের ময়দানে নাকানী চুবানী খাওয়াচ্ছি, যদি আমার সহকারী অফিসাররাও তাদের মত খাঁটি ঈমানদার হতো তবে আজ মুসলমানদের প্রথম কাবা মুসলমানদেরই হাতে থাকতো। আমাদের আজান আজ ইউরোপের গীর্জাতে ধ্বনিত হতো। কিন্তু এদের দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের কারণে আমি মিশরেই বন্দী হয়ে রইলাম। আমার আবেগ, আমার প্রেরণা, বিরাট বিরাট সংকল্প সবই এই শিকলে আটকা পড়ে গেল।’

 তিনি কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর বললেন, ‘আমাকে সবার আগে গাদ্দারদের শেষ করতে হবে নতুবা এই জাতিকে তারা উঁইপোকার মত খেয়ে শেষ করে ফেলবে।’

 ‘আমি এই পরামর্শ নিয়েই এসেছি, যদু যুদ্ধ ক্ষেত্র আপনাকে পারমিশন দেয় তবে করে মিশর চলুন।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন।

 ‘আলী! আমি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারি না।’ সুলতান আইয়ুবী বল্লেন, ‘কিন্তু আমার আফসোস! আমার হাত যখন খৃস্টানদের ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তখন তাদের মুক্ত করার জন্য এগিয়ে এসেছে আমারই জাতির ভাইয়েরা। আলী, যদি আমি ইসলামের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্বকারী মুসলমানদেরকে এখনি শেষ না করি তবে এই উঁইপোকা আর কখনও শেষ হবে না। আমাদের ইতিহাসকে এই গাদ্দার দল চিরদিনের জন্য লজ্জিত করতে থাকবে। জাতির মধ্যে সব কালেই এই গাদ্দা দল সক্রিয় ও বর্তমান থাকবে, যারা আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলুল্লাহর (সা.) শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করে ইসলামের মূল কেটে শেষ করবে।’

 তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুদানের যুদ্ধ ক্ষেত্রে খবর কি? আমি তকিউদ্দিনকে সংবাদ পাঠিয়েছি যুদ্ধ গুটিয়ে আনতে।’

 ‘মিশরে কেউ জানে না, আপনি এমন আদেশ দান করেছেন।’

 গভীর রাত পর্যন্ত আলীর সাথে আলাপ করলেন তিনি। মাঝ রাতের একটু পর আলীকে বিদায় দিলেন সুলতান। কামরা থেকে আলী বেরিয়ে যেতেই সুলতান আইয়ুবী গার্ডকে ডাকলেন। বললেন, ‘কাতিবকে জলদি ডেকে আনো।’

 কাতিব কাগজ কলম সঙ্গে করে তাবুতে প্রবেশ করলো। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘লেখো’

 ‘মুহতারাম নূরুদ্দিন জঙ্গী ………’

 তিনি যখন চিঠি শেষ করলেন তখন রাত প্রায় শেষ।

 পরদিন ভোর। কাসেদকে ডাকলেন সুলতান আইয়ুবী। তাকে বললেন, ‘প্রত্যেক স্টেশনে তোমার জন্য নতুন সজ্জিত ঘোড়া প্রস্তুত থাকবে। ক্লান্ত ঘোড়া দেখে রেখে নতুন ঘোড়া বদলাতে যে সময়টুকু লাগবে তার বেশি কোথাও থামবে না। কোন বিশ্রামের সুযোগ নেই। আহার করবে ঘোড়ার পিঠে বসে। কোথাও যেন ঘোড়ার গতি শ্লথ না হয়ে পড়ে। যদি গভীর রাতেও তুমি বাগদাদ গিয়ে পৌঁছো, সঙ্গে সঙ্গে নূরুদ্দিন জঙ্গীর সামনে গিয়ে হাজির হবে। তিনি ঘুমিয়ে থাকলে দারোয়ানকে বলবে জাগিয়ে দিতে। যদি সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী রাগ করেন, বলবে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বলেছেন, আমরা সবাই জেগে আছি।’

 গত রাতে লেখা চিঠি নিয়ে কাসেদ ছুটল বাগদাদের দিকে। কোন জায়গায় না থেমে পরের রাতের শেষ প্রহরে গিয়ে সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর ঠিকানায় পৌঁছে দিল সে চিঠি।

 কাসেদ যখন নূরুদ্দিন জঙ্গীর দরোজায় গিয়ে উপস্থিত হলো, রক্ষী বাহিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘চিঠি খুব ভোরেই তার কাছে পৌঁছানো হবে।’

 কাসেদ পথে কয়েকবার ঘোড়া বদলালেও এক চুমুক পানি পান করার জন্যও কোথাও থামেনি। পর পর দু’টি রাত জাগা এবং ক্ষুধা-পিপাসায় তার অবস্থা এখন মরার মত। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু শুকনো খরখরে গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও তার লোপ পেল। সে ওখানেই বেসে পড়ে ইশারায় বললো, ‘এটা খুবই জরুরী চিঠি।’

 সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীও সুলতান আইয়ুবীর মত কিছু বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ অফিসার এবং বডিগার্ড রাখতেন, যারা জরুরী অবস্থা বুঝতে পারে এবং গুরুত্ব অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রয়োজন মনে করলে তাঁর ঘুম ও বিশ্রামের চিন্তা না করে তাঁকে যে কোন সময় ডেকে দেয়ার অনুমতি ছিল তাদের।

 কাসেদের এমন করুণ অবস্থা দেখে একজন বডিগার্ড ভেতরে দিয়ে নূরুদ্দিন জঙ্গীর শয়ন কক্ষের দরোজায় খটখট শব্দ করলো। নূরুদ্দিন জঙ্গী বাইরে এসে কাসেদকে দেখে চিঠিসহ তাঁকে ভেতরে বিয়ে গেলেন। কাসেদ ভেতরে প্রবেশ করেই পড়ে গেল। সুলতান জঙ্গী তার চাকর-বাকরকে ডেকে কাসেদের সেবাশুশ্রুষার জন্য তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে চিঠি পড়া শুরু করলেন।

 সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী লিখেছেনঃ

 মুহতারাম নূরুদ্দিন জঙ্গী! আপনার ওপরে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমার চিঠি আপনাকে খুশি করতে পারবে না। কিন্তু খুশি ও সান্ত্বনার বিষয় শুধু এই যে, আমি এখনও আশা ছাড়িনি, আপনার সঙ্গে চুক্তির বিষয় পূর্ণ করছি। আপনি আমার কাছে শুভাগমন করলে আপনাকে বিস্তারিত জানাব। আমি ক্রাক দুর্গ অবরোধ করে রেখেছি। এখনও বিজয় আসেনি, তবে এতটুকু সাফল্য লাভ করেছি যে, খৃস্টানদের এক বিরাট সৈন্যদল সম্রাট রিমান্তের নেতৃত্বে বাইরে থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল, আমি তাদেরকে নিরাপদ আবেস্টনীর মধ্যে আটকে রেখেছি। এ পর্যন্ত তাদের অর্ধেক সৈন্য শেষ হয়ে গেছে। ওদের ক্ষুধার্ত সৈন্যরা এখন ঘোড়া ও উট খেয়ে জীবন ধারণ করছে। আমি সেনাপতি রিমান্তকে জীবিত বন্দী করার চেষ্টায় আছি। কিন্তু ক্রাকের অবরোধ দীর্ঘ হতে চলেছে।

 দুর্গের অভ্যন্তরে খৃস্টানদের অবস্থা যথেষ্ট মজবুত। আমি সফলতার জন্য কিছু পদ্ধতি ও কৌশল চিন্তা করেছি। আমার আশা আছে, আমার নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদরা দুর্গের পত্ন ঘটাবেই। তারা যে জযবা নিয়ে লড়াই করছে তা দেখলে আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন।

 কিন্তু আমার ভাই তকিউদ্দিন সুদানের রণাঙ্গনে ব্যর্থ হতে চলেছে। তার ভুল একটাই, সে মরুভূমিতে তার সৈন্যদের ছড়িয়ে দিয়ে এখন দিশহারা হয়ে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে। আমি তাকে রণাঙ্গন থেকে সরে আসতে আদেশ দিয়েছি। মিশরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভাল না। গাদ্দার ও বিশ্বাসঘাতকরা ঈমান বিক্রি করার প্রতিযোগিতা করছে। এর ফলে মিশরে সেনা বিদ্রোহের আশংকা দেখা দিয়েছে। সেনা বিদ্রোহ ঘটলে খৃস্টানদের আক্রমণের পথ সুগম হবে।

 আলী বিন সুফিয়ানকে আপনি ভালমত জানেন। সে নিজেই আমার কাছে এসেছে। আমি তার পরামর্শকে উপেক্ষা করতে পারছি না। তার পরামর্শ, আমি মিশরে ফিরে যাই। এখন আমি কি মিশরে চলে যাবো?

 মুহতারাম! আমি এখন ক্রাক থেকে অবরোধ উঠাতে পারছি না। সালাহউদ্দিন পিছু হটতেও জানে এ কথা বলার সুযোগ আমি খৃস্টানদের দিতে চাই না। এখন শত্রুর ঘাড় গর্দান আমাদের মুঠোর মধ্যে। আসুন, শত্রুদের এই ঘাড় গর্দান আপনি নিজের মুঠোয় ধারণ করুন।

 আপনি আপনার সৈন্যবাহিনী সঙ্গে আনবেন। আমি আমার সৈন্য মিশরে নিয়ে যাব। তা না হলে মিশর বিদ্রোহীদের করতলগত হতে যাবে। আশা করি আমার দ্বিতীয় চিঠির অপেক্ষায় থাকবেন না।

                                                           ইতি

                                                        আপনার বিশ্বস্ত

                                                    সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।

 সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী আর এক মুহূর্তও দেরী করলেন না। তিনি রাতের পোশাকেই বাইরে বেরিয়ে গেলেন। রাতেই সেনাবাহিনীর অফিসার ও উপদেষ্টাদের নিয়ে বসলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ করলেন বৈঠক। সৈন্যদের আদেশ দিলেন প্রস্তুতি নিয়ে ব্যারাক ছাড়তে। বললেন, ‘দুপুরের আগেই ক্রাকের দিকে যাত্রা করবো আমি।’

 কথামত দুপুরের আগেই তাঁর বাহিনী ক্রাকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল।

 সুলতান আইয়ুবী নূরুদ্দিন জঙ্গী সেই মর্দে মুজাহিদ, যার নাম শুনেই কেঁপে উঠতো দুশমনের অন্তর। তিনি ছিলেন রণকুশলী বীর। বুকে ছিল ঈমানের প্রজ্জ্বলিত আলো।

 বাহিনী নিয়ে তিনি রাস্তায় কমই বিশ্রাম নিলেন। সুলতান আইয়ুবীর ধারনাও অনেক আগে তিনি ক্রাকের রণক্ষেত্রে এসে পৌঁছেন। যদি সংবাদ বাহক তাঁকে আগেই না জানাতেন যে, নূরুদ্দিন জঙ্গী আসছেন, তবে বহু দূর থেকে ধূলার মেঘ দেখে মনে করতেন, নতুন কোন ক্রুসেড বাহিনী আসছে।

 সুলতান আইয়ুবী দ্রুতগামী অশ্ব নিয়ে এগিয়ে গিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন। নূরুদ্দিন জঙ্গী সালাহউদ্দিনকে দেখে ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নামলেন। ইসলামের মহান দুই নেতা যখন কোলাকুলি করছিলেন তখন আবেগে সুলতান আইয়ুবীর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো।

 সুলতান আইয়ুবী নূরুদ্দিন জঙ্গীকে যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি, গাদ্দারদের অপতৎপরতা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে শোনালেন। সুলতান জঙ্গী বললেন, ‘সালাহউদ্দিন! ইসলামের জন্য এটা বড়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে, বিশ্বাসঘাতকরা আমাদের জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়ে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, জাতি এই গাদ্দারদের থেকে কোন দিন পরিত্রাণ পাবে না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এখনি এর প্রতিকার না হলে এমন এক সময় আসবে যখন এ গাদ্দাররাই সুকৌশলে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বসবে। তারা জাতিকে ধোঁকা দেয়ার জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাদের মোকাবেলা করার কঠিন সংকল্প ঘোষণা করবে, এমনকি শত্রুদের পদদলিত করার হুংকারও দিতে থাকবে, কিন্তু জাতি গেলেন ক্রাকের অবরোধ স্থলে। সুলতান আইয়ুবীর কাছ থেকে বুঝে নিলেন দায়িত্ব। আইয়ুবীর বাহিনীর স্থলে মোতায়েন করলেন নিজের বাহিনী।

 আইয়ুবীর বাহিনী দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পিছু সরে এসে একত্রিত হলো। তাদেরকে দ্রুত কায়রো যাওয়ার নির্দেশ দিলেন আইয়ুবী।

 এদিকে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। রিমান্তের যে সৈন্য দলকে ঘেরাও করে রেখেছিল আইয়ুবীর বাহিনী সেখান থেকে তার বাহিনী মুসলিম বাহিনীর দুর্বল দিকে হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বেষ্টনী কেটে বেরিয়ে গেল এবং দ্রুত ময়দান ছেড়ে পালিয়ে গেল। অবশিষ্ট সৈন্যরা তখনো ঘেরাওয়ের মধ্যে, কিন্তু যখন তারা জানতে পারলো, সেনাপতি রিমান্ত পালিয়ে গেছে, তখন তারা ভীতবিহবল হয়ে এলোমেলো পালাতে শুরু করলো। তারা জীবন বাঁচানোর আশায় প্রাণপণ লড়াই শুরু করে দিল। এ লড়াইয়ে অনেকে মারা পড়লো, কেউ কেউ বন্দী হলো। পরিস্থিতি যখন মুসলিম বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে এলো ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে, রিমান্ত পালিয়ে গেছে।

 নূরুদ্দিন জঙ্গী এ ক্ষতি মেনে নিয়ে অবরোধ আবার দৃঢ় করলেন। সৈন্যদের সংহত করে দুর্গ অবরোধ ও বাইরের বাহিনীর বেষ্টনী, সর্বত্র মুসলিম বাহিনীর অবস্থান মজবুত করলেন।

 সুলতান আইয়ুবী কায়রোর দিকে যাত্রা করেছেন, কিন্তু জানতেও পারবে না, এই শাসকগোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষে জাতির ও দ্বীনের দুশমনদের সাথে তলে তলে কি গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। শত্রুরা এই কপট মুসলমানদেরকে কখনো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে, কখনো তলোয়ারও বানাভে এবং এই তলোয়ার দিয়েই জাতির ঘাড় ও শিরা কাটবে।

 না, আমি তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য এ কথা বলছি না সালাহউদ্দিন! ভয় পাওয়া মুমিনের কাজ নয়। আমি কেবল বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে তোমাকে সতর্ক করছি। কাফেরের চাইতে ঘরের শত্রু এইসব বিভীষণরা মিল্লাতে ইসলামিয়ার জন্য বেশি ক্ষতিকর। কারণ সামনাসামনি যারা লড়তে আসে জাতি তাদের চিনে এবং তাদের হাত থেকে নিজের দেশ ও ঈমান বাঁচানোর জন্য জীবন বিলিতে দিতেও পিছপা হয় না, আর চিনলেও তাদের বিরুদ্ধে কিছু করার জন্য নৈতিকভাবে সাহসী হয় না।

 না সালাহউদ্দিন, এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। আমরা এ অবস্থার অবসাত ঘটাবো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হবে। তুমি জলদি মিশরে চলে যাও। তকিউদ্দিনকে সহযোগিতা দিয়ে সুদান থেকে বের করে আনো। ডানে-বামে আক্রমণ করে শত্রু সেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখো যাতে তকিউদ্দিনের বাহিনী কোথাও ঘেরাও হয়ে না পড়ে। মিশরে যেসব সৈন্য রয়েছে তাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, আমি তাদের মাথা থেকে বিদ্রোহের পোঁকা বের করে দেবো।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top