২৪. সামনে বৈরুত

বৈরুত।

খৃস্টান বাহিনীর দুর্ভেদ্য দুর্গ। পর পর দু’বার মুসলমানদের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর সম্রাট বিলডন এখনেই এসে আস্তানা গেড়েছেন। প্রথম পরাজিত হয়েছিলেন সুলতান তকিউদ্দিনের কাছে। তারপর সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে প্রান হাতে সেইযে ছুটতে শরু করেছিলেন, বৈরুত পৌঁছার আগ পর্যন্ত আর কোথাও থামার সাহস পাননি।

 সুলতান তকিউদ্দিনের হাতে পরাজিত হওয়ার পর ছত্রভঙ্গ বাহিনীকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে তিনি যখন পালাচ্ছিলেন, রাগে দুঃখে তার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। এই রাগ ও ক্ষোভ দমন করার জন্য তিনি নিরীহ মুসলমানদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের পথ বেছে নিলেন। পালাবার পথে যেসব মুসলমান গ্রাম ও বস্তি পড়লো সেগুলোতে নির্বিচার ধ্বংস চালাতে চালাতে এগুচ্ছিলেন তিনি।

হেমসে সীমাহীন ধ্বংসযঞ্জ চালিয়ে তিনি আরো পূর্বদিকে সরে এলেন। একদিন ইবনে লাউনের দুর্গম এক পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নেয়ার সময় তিনি এক অযাচিত ও অভুতপূর্ব খবরে পুলকিত হয়ে উঠলেন।

 তিনি জানতে পারলেন, সুলতান আইয়ুবী অতর্কিতে এসে ইবনে লাউনের ওপর চড়াও হন এবং ইবনে লাউনকে পরজিত করেন। কিন্তু ইবনে লাউনের বশ্যতা আদায় করে তাকে আবার তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে তিনি এখন এই পাহাড়ের উল্টা পাশে নির্বিঘ্নে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

 সুলতান আইয়ুবীর ওপর প্রতিশোধ নেয়ার এটাই মোক্ষম সুযোগ। কারন সুলতান আইয়বী জানেন, আশেপাশে তাকে চ্যালেন্জ করার মত আর কেউ নেই। পাহাড়ের উল্টো পাশে শত্রুর বাহিনী ওঁৎ পেতে আছে একথা তার জানার কথা নয়। যদি জানতেন তাহলে এমন অলস ভঙ্গিতে এখানে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতেন না।

 বিলডনের এ চিন্তায় কোন ভুল ছিল না। আসলেও সুলতান এদের সম্বন্ধে কিছু জানতেন না। কিন্তু রাখে আল্লাহ, মারে কে? খৃস্টানদেরই এক স্পাই মেয়ের প্রেমের পরিনতি যে এভাবে মুসলমানদের রক্ষা করবে কে জানতো!

 সম্রাট বিলডন মেয়েটির প্রেমিক মুসলিম যুবকটির ওপর যখন নির্যাতন চালাচ্ছিলেন তখন মেয়েটি গোপনে তাকে উদ্ধার করে বলল, ‘যাও! পালিয়ে যাও! পাহাড়ের ওপারে সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী বিশ্রাম নিচ্ছে। তাকে গিয়ে বল, বিলডন তার বাহিনী নিয়ে আপনার উপরে ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজের জাতিকে বাঁচাও, নিজে বাঁচ। যাও এক্ষুনি পালাও তুমি! ‘

 এভাবেই সুলতান আইয়ুবী এক ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে বেঁচে যান। তার পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। সুলতান এমন ফাঁদ পাতলেন যে, তাতে অল্পের জন্য বিলডন প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও তার বাহিনী পুরোপুরি তচনচ ও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

 বৈরুত ফিরেই এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাগল হয়ে হয়ে উঠেন বিলডন। দুশ্চিন্তায় রাতে তার ঘুম হয়না। গভীর রাত জেগে পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা করেন। নিজের শক্তিকে সুসংহত করার জন্য শুরু করেন কুটনৈতিক তৎপরতা। অল্প সময়ের মধ্যেই আস সালেহকে নিজের দলে টেনে নিতে সমর্থ হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, আসসালেহ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অগ্রসর হওয়ার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যান।

 এদিকে সুলতান আইয়ুবীর গতিবিধি ও তৎপরতার খবর নেয়ার জন্য নতুন করে কায়রোতে জাদরেল গোয়েন্দা পাঠালেন বিলডন। ঠিক এই সময় ইসহাক তুর্কী বৈরুত পৌঁছালো।

 ইসহাক বৈরুত পৌঁছেই বিলডনের হাইকমান্ড পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার উপাই খুঁজতে শুরু করলো। কারন বিলডনের মূল পরিকল্পনা জানার এছাড়া আর কোন উপায় নেই।

 তুরস্কের বাসিন্দা ইসহাক তুর্কী ছিল ফর্সা চেহারার এক সুদর্শন স্বাস্হবান যুবক। ঘোড় সওয়ারে সে যেমন পটু ছিল তেমনি তীরন্দাজী এবং তলোয়ার চালনায়ও তার সমকক্ষ লোক খুজে পাওয়া দুস্কর ছিল। সব রকমের কমান্ডো প্রশিক্ষ ছাড়াও তার সহজাত এমন কিছু সহজাত গুন ছিল যা সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। সে ছিল মিষ্টভাষী এবং লোক পটানোয় ওস্তাদ। তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখে এক ধরনের সম্মোহনী শক্তি খেলা করতো, যে কারনে মানুষ সহজেই তার বশীভূত হয়ে যেতো।

 সে তার সঙ্গীদের বলতো ‘মানুষের মাথার চাইতে বড় কোন অস্ত্র আজো আবিষ্কৃত হয়নি। একজন মুজাহিদের সবচে বড় অস্ত্র তার ঈমান ও মগজ। যদি এ দুটো অস্ত্র তুমি ঠিকমত ব্যবহার করতে পারো, তবে দুনিয়ার এমন কোন শক্তি নেই যে, তোমাকে পরাজিত করে।’

 সেই ইসহাক বৈরুত এসেই মানুষের চোখে পড়ে গেল এবং নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে লাগলো। সে নিজেকে দূরের এক মুসলিম অণ্চল থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান বলে পরচয় দিল। এতে লোকের সহানুভূতি আদায় করা তার জন্য সহজ গেল।

 সে বৈরুত পৌঁছেই দেখতে পেল, সেখনে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধর ব্যপক প্রস্তুতি চলছে।নতুন সৈন্য ভর্তির জন্য মহা সমারোহে চলছে নানা ধরনের খেলা সৈন্যরা নানা রকম শারীরিক কসরত, কুস্তি, অসির লড়াই, তীরন্দাজী, বর্শা ছোঁড়ার প্রতিযোগীতা এবব করে যুবকদের আকৃষ্ট করতো সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে।

একদিন ইসহাক তুর্কী তেমনি এক খেলার মাঠে গিয়ে হাজির হল। সেখানে তখন চলছিল অশ্বারোহীদের প্রতিযোগীতা। দুই অশ্বারোহী মাঠের দুই প্রান্তে সংকেতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সংকেত পাওয়ার সাথে সাথেই বর্শা হাতে ছুটে যাবে একে অন্যে দিকে।

 মঞ্চে সম্রাট বিলডনের উর্ধতন সামরিক অফিসাররা বসা। মাঠের এক প্রান্তে মঞ্চ সাজানো হয়েছে।

 যথাসময়ে সংকেত প্রদান করতেই প্রতিযোগীরা পরস্পরের দিকে ছুটে এলো মুক্ত বর্শা উঁচিয়ে। কিন্তু প্রথমবার কেউ কাউকে কাবু করতে পারলনা।

 প্রতিযোগী দুই অশ্বারোহীই লোহার শিরস্ত্রান ও বর্ম পরিহিত। মাঠের চারপাশে লোকে লোকারণ্য। তারা রুদ্ধশ্বাসে উপভোগ করছে এক লোমহর্ষক খেলা।

 প্রথম রাউন্ডে কেউ কাউকে ফেলতে না পেরে উভয়েই পরস্পরকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল কিছু দূর। তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে আবার ছুটল প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে।

 এবার বর্শায় ঠোকঠুকি হল ঠিকই কিন্তু এবারও কেউ ধরাশায়ী হলোনা।

 তৃতীয় রাউন্ডে দু’জনেই আবার মাঠের দুই প্রান্তে চলে গেল এবং সেখান থেকে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে ছুটে এলো পরস্পরের দিকে। কাছাকাছি হতেই দেখা গেল চওখের পলকে একজন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

দর্শকরা প্রচন্ড হাততালিতে মাতিয়ে তুলল মাঠ। সেনাবাহিনীর অফিসাররাও উল্লসিত।

 দর্শকদের উল্লাস কিছুটা কমলে বিজয়ী অশ্বারোহী বর্শা উঁচিয় বলল, ‘আর কেউ আছো, যে আমাকে চ্যালেন্জ করবে? ‘

 লাফিয়ে মাঠে নামলো আরেকজন। কিন্তু প্রথম রাউন্ডেই সে ধরাশায়ী হলো। এরপর একে একে আরো কয়েকজন তাকে চ্যালেন্জ করে ব্যর্থ হলো।

 এই অশ্বারোহী ছিল বিলডনের এক উচ্ছাভিলাষী নাইট। এবার যখন সে তাকে চ্যালেন্জ করার জন্য আহবান জানালো, তখন কেউ আর মাঠে নামল না।

 বিজয়ীর বেশে অশ্বারোহী এগিয়ে আসছিল মঞ্চের দিকে, এ সময় এক অভাবিত ঘটনা ঘটলো। হাজার হাজার দর্শককে অবাক করে দিয়ে খালি হাতে মাঠে নেমে গেল ইসহাক তুর্কী এবং তাকে চ্যালেন্জ করে বসলো।

 অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সামরিক অফিসার এবং দর্শকবৃন্দ। তারা ভেবে পেল না, মরু বেদুঈনের পোষাক পরা এই বুদ্দু কেন মরতে যাচ্ছে।

 কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক তাকে পাগল ভেবে মাঠ থেকে সরাতে গেল, কিন্তু সে তাদের উপেক্ষা করে বুক টান করে দাঁড়িয়ে গেল সেই অশ্বারোহীর বিরুদ্ধে। দর্শকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘মরতে দাও পাগলটাকে। আমরা ওর খেলা দেখতে চাই।’

অগত্যা স্বেচ্ছাসেবকরা ফিরে গেল। কিন্তু অশ্বারোহী তার চ্যালেন্জ গ্রহন না করেই ফিরে যাচ্ছিল। এ সময় সেই নাইটের বন্ধুদের মধ্য থেকে কোন একজন অফিসার চেঁচিয়ে বলল, ‘এক বুদ্দুর চ্যালেন্জ গ্রহন না করেই ফিরে যাচ্ছ কেন ? ওকে লড়াই করার স্বাদ একটু চাখতে দাও। ওকে বর্শার আগায় গেঁথে নিয়ে এসো।’

 অন্য একজন বললো, ‘সে তোমাকে অপমান করেছে। আমরা চাই তুমি এই অপমানের প্রতিশোধ নাও।’

 ‘তুমি এক বুদ্দুকে ভয় পেলে নাকি? পালাচ্ছকেন?

এবা ফিরে দাঁড়াল অশ্বারোহী। মাঠের মাঝামাঝি থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে মামুলি গতিতে ইহাকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বর্শা দিয়ে তাকে গাঁথতে গেল। কিন্তু একপাশে রে গিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল ইসহাক।

 দর্শকরা হাততালি দিতে গিয়েও গুটিয়ে নিল হাত। অশ্বারোহী আবার ঘোড়া ছুটিয়ে মাঠের মাঝখানে চলে গেল। এবার বেশ জোরেই ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে ইসহাকের দিকে। কিন্তু এবারও অপূর্ব দক্ষতায় আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হল ইসহাক।

 অশ্বারোহী এবার ক্ষেপে গেল। সে ঘোড়া মধ্য মাঠে নিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে এল ইসহাকের দিকে। ইসহাকের কাছে এসেই সে বর্শার আঘাত হানলো ইসহাকের গায়ে। ইসহাক খপ করে বর্শা চেপে ধরে এমনভাবে ঘোড়ার সাথে দৌড়ে গেল যে, লোকজন ভাবল, বর্শাবিদ্ধ হয়েই সে ঘোড়ার সাথে ছুটছে। লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়ে হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্কু সে কেবল ক্ষনিকের জন্য। মুহূর্তেই ওরা দেখল, বর্শার হেঁচকা টান খেয়ে অশ্বারোহী মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।ইসহাক বর্শা মাটিত বিদ্ধ করে রেখ এগিয়ে গিয়ে তাকে টেনে তুলল। অশ্বারোহী উঠেই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দের জন্য। ইসহাক তার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো, সত্যি আমি লড়তে চাই। আমাকে একটি ঘোড়া ও বর্শা দাও।’

 অশ্বারোহীর ইঙ্গিতে এক স্বেচ্ছােবক তার জন্য ঘোড়া ও বর্শা নিয়ে এলো। দর্শকরা রুদ্ধশ্বাে অপেক্ষা করতে লাগল খেলার চূড়ান্ত ফলফলের জন্য।

উভয়ে খেলার নিয়ল নুসারে মাঠের দুই প্রান্তে চলে গেল। একদিকে শিরস্ত্রান ও বর্ম পরিহত এক নাইট, অন্যদিকে আত্মরক্ষার ন্যুনতম সুবিধা বঞ্চিত এক বেদুইন। দর্শরা নিশ্চিত ছিল, এই গ্রাম্য লোকটির আজ অবধআিত মৃত্যু ঘটবে।

 খেলা শুরু হল। সংকেত পাওয়ার সাথে সাথেই দু’জন ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। নাই ইসহাকের কাছকাছি হয়েই তার পেট বরাবর বর্শা দিয়ে আঘাত করলো।

 ইসহাক কৌশলে ঘোড়ার ওপর শুয়ে পড়ে সে আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সামান্য এগিয়েই ঘোড়ার মুুখ ঘুরিয়ে ফিরে এলো। নাইটও আবার হমলা করার জন্য ছুটে এল তার দিকে। কিন্তু ইসহাকের ক্ষিপ্রতার কাছে হার মানতে হলো তাকে।

ইসহাক দ্রুত ছুটে এসে নাইটের পাঁজরে আঘাত করলো। বর্ম থাকায় নাইট তাতে বিদ্ধ হলো না ঠিক, কিন্তু বর্শার প্রচন্ড ধাক্কা সে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল।

 নাইটের একটি পা রেকাবে আটকা পড়ে গিেয়ছিল। ফলে ঘোড়া তাকে টেনে নিয়েই ছেটে যাচ্ছিল। যদি নাইটের গায়ে বর্ম না থাকত তবে রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যেতো।

 ইসহাক চকিতে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নাইটের এ অবস্থা দেখে ছুটে গেল তার কাছে। তারপর ছুটন্ত ঘোড়ার লাগাম টনে ধরে তাকে থমিয়ে দিল। এেপর ইসহাক লাফিয়ে নেমে নাইটকে টেনে তুলল।

 নাইট উঠে দাঁড়িয়ই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, ‘সত্য করে বলো তো, তুমি কে?

 ইসহাক বললো, ‘আমি মুসিম এলাকা থেকে পলাতক এক খৃস্টান। নাম রবার্ট।’

 তুমি কি করো?

‘এখন কিছুকরিনা। তবে আমি মুসলমানদের সেনাবাহীনিতে ছিলাম। আমাদের এলাকায় মুসলমানদের আধিপত্য ছিল। তারা আমাকে এবং আমার মত অন্যান্য খৃস্টান যুবকদের জোর করে সেনাবাহীনিতে ভর্তি করে নিয়েছিল।

 ট্রেনিং শেষে যখন আমাদেরকে খৃস্টান বাহীনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলা হলো তখন এক রাতে মি সেখান পালিয়ে দেশান্তরী হলাম।

 এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলা। একজন নিষ্ঠাবান থৃস্টান হয়ে স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমার পক্ষে যসম্ভব ছিলনা।’

 ‘

‘এখানে কি করছো ?’

 এখনো কিছ করছি না। চাকরীর সন্ধানে আছি। কোথাও রুজি-রোজগারের সামান্য ব্যবস্হা করতে পারলেই দেশ থেকে বিবি বাচ্ছাদের নিয়ে আসবো ভাবছি। ‘

 এই নাইট ছিল সম্রাট বিলডনের সামরিক বিভাগের এক প্রভাবশালী অফিসার। খৃস্টান সামরিক বাহিনীতে নাইট একটি সম্মানিত খেতাব। যারা এই খেতাব অর্জন করে, সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে তারা পায় বিশেষ ধরনেরর শিরস্ত্রান ও বর্ম। সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক তাদের মধ্য থেকেই নির্বাচন করা হয়।

 এসব নাইটরা হয় সাহসী ও বীর যোদ্ধা। সাধারন খৃস্টানরা নাইটদের যেমন অতি সম্মানিত মনে করেন তেমনি সম্রাটও তাদের যথষ্ট মূল্য দেন। তারা কোন ব্যাপারে মতামত দিলে সম্রাট তাকে থেষ্ট গুরুত্বের সাথে নেন, এমনকি কখনো কখনো নিজের মতামত পরিবর্তন করে তাদের পরামর্শ গ্রহন করে নেন।

 ইসহাক তুর্কী বর্ম ও শিরস্ত্রান ছাড়াই এক নাইটকে পরাজিত করায় তার সামরিক যোগ্যতা সম্পর্কে নাইট উচ্চ ধারনা করতে বাধ্য হলো। পৃথিবী চিরকালই বীরভোগ্যা। তাছাড়া সে নাইটকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তাই নাইট তাকে সহজেই বন্ধ হিসাবে গ্রহন করে বললো, ‘চলো, আজ থেকে তুমি আমার মেহমান।’

 নাইট তাকে তার বাড়ীতে নিয়ে গেল। সেখানে তার প্রচুর আপ্যায়র হলো। খাওয়া দাওয়ার পর নাইঠ নতুন বন্ধুর জন্য উৎকৃষ্ট মদ ও মদে পাত্র নিয়ে হাজির হলো ইসহাকের সামনে।

 মুসলমান গোয়ন্দাদের জন্য এটা এক মহা সমস্যা। খৃস্টান অঞ্চলে গিয়ে প্রয়োজনের খাতিরেই তাদেরকে খৃস্টান সাজতে হয়। উর্ধতন সামরিক ও বেসামরিক লোকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর সাথে মেলামেশা করতে হয়। এদের কাছে মদ পানির মতই নির্দোষ পানীয়।

খৃস্টান সমাজে মেহমানদারীর অপরিহার্য অনুসঙ্গ মদ। কিন্তু ইসলামে মদ হারাম। তাই কোন সচেতন মুসলমান মদ স্পর্শও করতে পারেনা। আবার মদ পান না করেও এমন পরিবেশে আত্মরক্ষা করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

 এমন জটিল পরিস্হিতিতে পড়ে অনেক গোয়েন্দাকেই নানা রকম টালবাহানার আশ্রয় নিতে হয়। অনেকে আবার টালবাহানা করতে গিয়ে ধরাও পড়ে যায়। কারন খৃস্টানরা জানে, নিষ্ঠাবান মুসলমানেরা কখনও মদ পান করেনা। কেউ মদ পান করতে অস্বীকৃতি জানালে ওরা সহজেই বুঝে ফেলে, এ লোক মুসলমান।

 বিষয়টি একবার সুলতান আইয়ুবীর গোচরে আনা হয়। সুলতান বললেন, কোন হারাম জিনিসকে হালাল করার সাধ্য আমার নেই। গোয়েন্দা বলেই কাউকে আমি মদ পান করার অনুমতি দিতে পারি না। একবার মদ পান করতে শুরু করলে পরে তা অভ্যসে পরিনত হয়ে যায়। মদ মানুষের স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি লোপ করে দেয়। তাই গোয়েন্দাদের কঠোরভাবে মদ থেকে দূরে থাকতে হবে। তবে জীবনের আশঙ্কা দেখা দিলে সে যদি ততটুুকু পান করে, যতটুকু পান করলে জীবন রক্ষা পায় তাহলে হয়তো আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতেও পারেন।’

 ইসহাক তুর্কী এমনি এক সমস্যায় পড়ে গেল। কিন্তু সে ছিল মজবুত ঈমানের অধিকারী। তাই মদের পেয়ালা হাতে না নিয়ে সে কৌশলের আশ্রয় নিল। বললো, ‘আপনি তো আমার শক্তি ও কৌশল দেখেছেন। এর মূল কারন, আমি মদ পান করি না। আমার ওস্তাদ আমাকে বলেছিলেন, ‘যেদিন তুমি মদ স্পর্শ করবে সেদিনই এ শক্তি ও কৌশল থেকে তুমি বঞ্চিত হবে। তোমার ঘোড়া অনুভব করবে, তার ওৌর বসে আছে এক দুর্বল সওয়ারী। তখন ঘোড়া তোমার আদেশ মানতে শঐৈথিল্য দেখাবে। ‘

 ইসহাক তার গলায় ঝুলানো ক্রুশটি টেনে বের করে তাতে চুমু খেয়ে বললো,’আমি এই ক্রুশ ছুঁয়ে সেদিন শপথ করেছিলাম, জীবে আর কখনো মদ পান করবো না। সেই থেকে মদ পান আমি ছেড়ে দিয়েছি। দয়া করে আমাকে আমার শাথ থকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ করবেন না।’

 ‘তুমি কোথায় থাকো?’

 ‘এখনো কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা জোগাড় করতে পারিনি। প্রভু সহায় হলে অচিরেই কোথাও ঠিকানা একটা জোগাড় করে নিতে পারবো আশা করি।’

 প্রভু তোমার সহায় আছেন। ঠিকানা নিয়ে আর তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার চাকরীর জিম্মা আমি নিচ্ছি।’

 ‘কিসের চাকরী?’ জানতে চাইল ইসহাক।

 ‘তোমাকে আমাদের সেনা বাহিনীতেই দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তা েব না। আমি তোমাকে আমার বন্ধু এবং রক্ষী হিসাবে চাই।’

‘এ তো আমার জন্য এক অভাবিত ব্যাপার! আপনার অশেষ মেহেরবানী যে, আপনি আমাকে আপনার সঙ্গ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।’

 ‘মেহেরবানী বলছো কেন আমাদের মত নাইটদের একাধিক বডিগার্ড রাখার অনুমতি আছে। কিন্তু সজ্জন ব্যক্তির অভাবে এতদিন আমি এক বডিগার্ড দিয়েই কাজ চালিয়ে এসেছি। আমি তোমার মত গুনীর উপযুক্ত সম্মান দিতে চাই। তুমি রাজি থাকলে তুমিই হবে আমার বিশ্বস্ত সহচর ও রক্ষী।

 তোমার থাকা খাওয়া এবং উপযুক্ত বেতন ভাতার ব্যবস্হা করার দায়িত্ব আমার।’

 ‘আপনার মত গুনী ব্যক্তির সান্বিধ্যে থাকতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।’

এভাবেই বৈরুতে ইসহাক তুর্কীর কাজের যাত্রা শুরু হয়।

 সে যুগটা ছিল যোদ্ধাদের। ইসহাকের মত বীর যোদ্ধার কদর ও সম্মান ছিল সর্বত্র। নাইট খুব খুশির সাথেই তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্হা করে দিল। তাকে দিল তেজস্বী আরবী ঘোড়া। দিল প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র ও সরন্জাম। নির্ধারন করলো তার যোগ্যতা অনিযায়ী বেতন-ভাতা, যেন এ নিয়ে তার মনে কোন খেদ না থকে।

 এবা ইসহাক তুর্কীর যোগ্যতা প্রদর্শনের পালা। আল্লাহ তাকে দান করেছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, দূরন্ত সাহস আর চমৎকার মেধা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা। তার অমায়িক ব্যবহার, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও দুর্বার সম্মোহনী শক্তি দু’দিনেই সেই নাইটকে ইসহাকের বিশ্বস্ত ও অনুগত বানিয়ে দিল। এবার নিজের কাজে মন দিল ইসহাক।

 ‘আমার শুধু একটিই আশা।’ একদিন রাতে কথাচ্ছলে সে নাইটকে বললো, ‘ মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস যেমন আজ আমাদের দখলে তেমনি তাদের পবিত্র কাবাঘরও যদি আমরা দখল করে নিতে পারতাম! সারা দুনিয়া জয় করার চেয়েও এটা আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। একবার কাবায় ক্রুশের আধিপত্য কায়েম হলে দুনিয়া হতে ইসলাম এমনিতেই বিলীন হয়ে যাবে।’

 ‘তুমি এক বিরাট স্বপ্নের কথা বলেছ বন্ধু। প্রতিটি ক্রুসেডারের মনেই হয়তো কখনো কখনো এ স্বপ্ন তার চিন্তার অগোচরেই জেগে উঠে।’ নাইট বললো, ‘কিন্তু এ স্বপ্ন সফল করা খুব সহজ নয়। মুসলমানদের পরাজিত করা কতটা কঠিন সে অভিঞ্জতা তোমার নেই, থাকলে এমন কথ বলতে না। কাবায় ক্রুশের পতাকা উড়ুক আমিও চাই। কিন্তু কাবায় আঘাত হানা আত ভিমরুলের চাকে ঢিল ছোঁড়া একই কথা। তুমি জানো না, কাবায় আঘাত হানলে শুধু আরবের মুসলমানরা নয়, সারা দুনিয়ার মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর। এমন স্বপ্ন-বিলাস থাকা ভাল, তবে তা কোথাওপ্রকাশ ো না।

 আমরা সবাই মিলে যেখানে এক সালাউদ্দীন আইয়ুবীকেই পরাজিত করতে পারছিনা, সেখানে সারা দুন্য়ার মুসলিম শক্তিকে ক্ষেপিয়ে তোলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আপাতত এসব ভাববিলাস বাদ দিয়ে আইয়ুবর ব্যাপারটা ফায়সালা করো।’

 ‘আপনারা এখনো মান্ধাতার আমলের ধ্যান-ধারনা নিয়েই বসে আছেন।’ ইসহাক তুর্কী বললো, ‘মুসলমান সমাজের বর্তমান চিত্র জানা থাকলে এমন কথা বলতেন না। এখন আর মুসলমানদের মধ্যে সেই ঐক্যের বাঁধন নেই, যা তাদেরকে অপারাজেয় করে রেখেছিল। সেই ঈমানও নেই, যে ঈমান তাদের নিরাপত্তা ও জামিনের ৱক্ষাকবচ। আমাদের গোয়েন্দারা প্রটিতি মুসলমানের বিক থেকে ঈমানের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বুক ঝাঝরা করে দিয়েছে। খোলস ছাড়া তার ভেতরে কোন প্রানের স্পন্দন নেই।

 কেন, হলবের শাসক ইয়াজউদ্দীন আর মুসেলের শাসক ইমামউদ্দিন কি আমাদের বন্ধু নয়? আমাদের সামান্য সহযোগিতা করার সুযোগ পেলে তারা কি নিজেদের ধন্য মনে করবে না? আমি বর্তমান মুসলিম সমাজের যে ছবি দেখে এসেছি তা যদি আপনাকে বলি আপনি তাজ্জব হয়ে যাবেন। লোভ, লালসা ও পরচর্চায় তারা এমন মশগুল যে, আপনি যদি কাউকে নিজের ভাইয়ের বুকে ছুরি চালাতে বলেন, তাতেও সে রাজি হয়ে যাবে। তাহলে শুনুন, তারা কতটা অধপাে নেমেছে।’

 ইসহাক তুর্কী নাইটের সামনে মুসলিম সমাজের এমন এক ছবি তলে ধরলো যে, নাইট বিস্মিত হয়ে বললো, ‘বলো কি? ‘

 ইসহাক তুর্কী বললো, ‘এ জন্যই তো আমি কাবাঘর দখলের স্বপ্ন দেখি। আপনি যদি আমার পরিকল্পনার কথা শোনেন তাহলে আর আমাকে পাগল ভাববেন না।’

 ‘শুনি তোমার সেই উর্বর পরিকল্পনাটা কি? ‘

 ইসহাক তার সামনে এক অভাবিত পরিকল্পনা পেশ করলো। এ এমন এক পরিকল্পনা, যা কেবল কোন জেনারেল পেশ করলেই মানায়।

 ইসাহকের কথায় নাইটের জবা খুলে গেল। নাইট ভাবল, যে পরিকল্পনা আমরা একদল াইট দীর্ঘদিন বসে বসে সম্মিলিতভাবে করেছি, সেই রকম একটি পরিকল্পনা যে রক্ষী গল্প করতে করতে বলে ফেলতে পারে তাকে অবশ্ই শ্রদ্ধা জানাতে হয়।

 নাইট তার পরিকল্পনা ও পরামর্শ শুনে তাজ্জব হয়ে বললো, ‘ তুনৃমি আমাকে অভিভুত করার মত বুদ্ধি রাখো। আমরা তো এমন একটা পরিকল্পনার কথায় ভাবছিলাম, যার সাথে তামার চিন্তা ও সংকল্প হুবহু মিলে যাচ্ছে।’

 তাহলে আ দেরী করবেন না। সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মত কমান্ডো বাহিনী গঠন করুন। ইলামের উঁচু মাথা ভোতা করে দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়।’

 ‘ঠিক আছে, বিষয়টি নিয়ে আমি সম্রাট বিলডনের সাথে কথাব বলে দেখি।’

 ‘এখানে আর দেখাদেখির কিছু নেই। আমার কথাটা একটু গুরুত্বের সাথে বুঝার চেষ্টা করুন।’ ইসহাক বললো,’আমার হাতে একটি কমান্ডো বাহিনী দিন আমি মসলমানদের সামরিক ঘাঁটির অবস্থান জানি। জানি কোথায় রাখে তারা যুদ্ধের অস্ত্র ও সরন্জাম। আমি তাদের খাদ্য গুদামের খবর জানি। ঘোড়ার আস্তাবল চিনি। এদিকে যেদিন যুদ্ধ শুরু হবে তার পরের দিন ণোনবেন তাদের খাদ্য, অস্ত্রসম্ভার ও বানাদি নিশ্চিন্হ হয়ে গেছে।’

 ‘হ্যাঁ, এমনটিই করা হবে।’ নাইট বললো, ‘আমরা তোমাকে সুযোগ দেবো।’

‘আমি তোমাকে শামসুন নেছার সাথে কথা বলতে দেখেছি।’ উনুশী আমের বিন উসমানকে বলল, ‘এই মেয়েটি কি আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী ?’

ওরা তখন মুশেলে। শামসুন নেছার অনুরোধে আমের পরিকল্পিতভাবে মেয়েটির প্রেমের ফাঁদে পা দেয়ার অভিনয় করছিল। মধ্য রাতের একটু পরে ুনুশী পা টিপে টিপে আমেরের কামরায় এসে প্রবেশ করলো। তার চোখে মুখে অনুযোগের কালিমা।

 ‘ওই মেয়ের কথা আর বলো না! ‘ আমেরও বিরক্তির স্বরে জওয়াব দিল, ‘সে শাহজাদী আমাকে তার চাকর মনে করে। যখন তখন আমার ওপর হুকুম চালায়। সে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আমাকে সেই হুকুম মানতে বাধ্য করে।’

 আমের না থমে বলেই চললো, ‘তোমাকেও আমি ভয় পাই। কারন তোমাকেও আমি শাহজাদীর মতই ক্ষমতাবান মন করি। অবশ্য শান্তনা এতটুকু, ভালবাসার অধিকার দিয়ে তুমু সে ভয় কিছুটা দূর করেছো। তারপরও আমার ভয় যায় না। তক রকম ভয় যে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়!

 কখনো ভাবি, তুমু আমাকে পুতুল বানিয়ে খেলছো না তো? আবার ভাবি, যদি কোন সামরিক অফিসার আমাদের অভিসারের খবর জেনে যায় তাহলে কারাগারের কোন্ অন্ধ প্রকোষ্ঠে আমার ঠিকানা হবে? ‘

 ‘যদি কেউ তোমাকে কারাগারে পাঠায় তবে জেনে রেখো, মুশেলের প্রতিটি ইট তার বুকে গিয়ে আঘাত হানবে।’

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top