১৫. উমরু দরবেশ

ইসহাকের গাঁয়ের বাড়ী । নিজের বাড়ীতেই তার একাধিক ঘোড়া ছিল, সেখান থেকে দু’টো ঘোড়া প্রস্তুত করা হলো। ইসহাকের গ্রেফতারীর খবর শুনে গ্রামের লোকজন জমা হয়েছিল সেখানে। ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যা প্রস্তুত হয়ে যখন ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করলো তখন বিকেল। গ্রামের লোকজন সুদানী কমান্ডারের কথা বিশ্বাস করে ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যাকে কমান্ডারের সাথে বিদায় জানালো।

দিন থাকতে থাকতেই তারা দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল পার হয়ে এলো। তারা যখন সে অঞ্চলের শেষ প্রান্তে, তখন সন্ধ্যার লালিমা মুছে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে মরুভূমিতে পড়তেই অন্ধকার ফিকে হয়ে এলো। রাতের প্রথম প্রহর। বিরতিহীনভাবে তারা পথ চলছে। নিঃসঙ্গ মরুভূমিতে ক্ষুদ্র এক কাফেলা। তিন জন মাত্র যাত্রী, তাও আবার দু’জন মেয়ে। ক্ষুদ্র কাফেলা নিয়ে মরুভূমিতে পথ চলা খুবই বিপদজনক, কিন্তু সেদিকে কারো খেয়াল নেই। বালিয়াড়ি মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কাফেলা। নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। রাস্তায় কোথাও কেউ নেই।

এক অচেনা পুরুষের সাথে এগিয়ে চলেছে দুই পর্দানসীন মহিলা। স্বামীর চিন্তায় বিভোর ইসহাকের স্ত্রী। আহত বাপের কথা ভাবছে কিশোরী কন্যা। দুনিয়ার আর কোন খেয়াল নেই ওদের। চোখে কোন নিদ্রা নেই। অন্তরে নেই কোন ভয়। পার্বত্য অঞ্চলের মহিলা হওয়ায় অশ্বারোহণেও ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। সে অঞ্চলের প্রতিটি নারী পুরুষ শিশুকাল থেকেই ঘোড় সাওয়ার ও তীরন্দাজী শিখে রাখে। পুরুষের মত সে অঞ্চলের নারীরাও সমান দুঃসাহসী।

তিনটি ঘোড়াই মরুভুমি ধরে এগিয়ে চলেছে। কমান্ডারের মন প্রফুল্ল। তার আনন্দের কারণ, ছলনা করে দুই মুসলিম পর্দানসীন মহিলাকে সে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসতে পেরেছে।

পচাগলা লাশের পাশে ইসহাক তার কামরায় বসেছিল। এ লাশ রাখা হয়েছিলো তাকে অসুস্থ ও দুর্বল করার জন্য। কিন্তু ইসহাকের এ নিয়ে কোন বিকার ছিল না। তার শারীরিক অনুভূতি হারিয়ে গিয়েছিল। সে লাশের সাথে এমনভাবে কথা বলত, যেন লাশটি জীবিত। লাশের দুর্গন্ধের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল।

দৈহিক চেতনা না থাকলেও আত্মার ও চিন্তার শক্তি তার নষ্ট হয়নি। সে ভেবে দেখল, আজ সারাদিন তাকে কামরার বাইরে নেয়া হয়নি। সন্ধ্যার পরও কেউ তাকে বিরক্ত করতে আসেনি। সে খুবই অবাক হলো। এমন বিশ্রাম দেয়ার মানে কি? কেন আজ কোন নির্যাতন করা হলো না? তবে কি সুদানি সেনাপতি নিরাশ হয়ে গেছে? এখন তাহলে ওকে নিয়ে ওরা কি করবে? কামরায় শুয়ে বসে এসবই ভাবছিল সে।

কমান্ডার মেয়ে দু’জনকে সাহস ও শক্তি জোগানোর জন্য ওদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। সে ইসহাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওদের শোনাচ্ছিল বীরত্ব ও সাহসের গল্প। মা ও মেয়ে খুব আগ্রহ সহকারে শুনছিল ওর কথা।

সুদানী সেনাপতিকে তার সঙ্গের অফিসার বললো ‘আপন কন্যা ও স্ত্রীর অপমান কি কেউ সহ্য করতে পারে? আমার বিশ্বাস, কমান্ডার ওদের দু’জনকে নিয়ে আসছে।’

‘আমি ইসহাককে বলবো, যতক্ষণ তুমি এবং তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা সুদানী বাহিনীতে যোগ না দেবে, ততক্ষণ তোমার স্ত্রী ও কন্যাকে মুক্তি দেয়া হবে না। তাঁদের ওপরও তোমার মতোই নির্যাতন চালানো হবে। আশা করি, এতে করে ইসহাক তার মত পাল্টাতে বাধ্য হবে’ বললো সেনাপতি।

‘সকাল নাগাদ আমাদের কমান্ডারের ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে’ অফিসার বললো।

‘হয়তো তার আগেও এসে যেতে পারে’ সেনাপতি বললো, ‘এ লোক খুব হুশিয়ার’।

রাত। কারাগারের সেই সিপাহী, যে কমান্ডারের পর ইসহাকের বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলো, সে একাকি মরুভূমির বালির টিলা একের পর এক অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অর্ধেকের বেশি রাস্তা অতিক্রম করে ফেলেছে। বিরামহীন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই পার্বত্য অঞ্চলের দিকে। আকাশে চাঁদ নেই। উন্মুক্ত মরুভূমির রাতের স্বচ্ছতা সম্বল করে পথ চলছে সে। চাঁদ না থাকলেও তারকার আলোতে পথ চলতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। বেশি দূর দেখা যায় না, তবে কোথাও কোন আওয়াজ হলে তা অনেক দূর থেকেও ভেসে আসে।

আনমনে পথ চলছে সে, হঠাৎ দূর থেকে ঘোড়ার পদধ্বনি কানে এলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। খেয়াল করে দেখল, সামনের দিক থেকে একাধিক ঘোড়া এগিয়ে আসছে প্রহরী এক বালির টিলার পেছনে ঘোড়া সমেত লুকিয়ে পড়লো।

একটু পর পদধ্বনি আরো স্পষ্ট হলো, সেই সাথে ভেসে এলো ওদের কথার আওয়াজ। প্রহরী টিলার আড়ালে বসে ওঁৎ পেতে দেখল তিনটি ঘোড়া ধীরে ধীরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে তলোয়ার হাতে নিলো।

ওরা আরো খানিকটা এগিয়ে এলো। এখন সে কমান্ডারের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ইসহাকের ব্যাপারেই আলাপ করছে কমান্ডার। কমান্ডারের কণ্ঠ শুনেই প্রহরী চিনতে পারলো তাকে। ওই তো সেনাপতির পাঠানো কমান্ডার! তাহলে নিশ্চয়ই সাথের দু’জন দরবেশ ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যা!

প্রহরী ভাবছিল, দরবেশের বাড়ী গিয়ে সে ওদের হুশিয়ার করবে। কমান্ডার যে এত তাড়াতাড়ি ওদের বের করে নিয়ে আসতে পারবে, তা ছিল তার ধারণার বাইরে। সে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সংঘর্ষ ছাড়া এখন ওদের মুক্ত করার কোন পথ নেই। কিন্তু মুশকিল হলো, যাদের সে মুক্ত করতে চাচ্ছে, তারা জানেই না সে ওদের হিতাকাঙ্ক্ষী। লড়াই শুরু হলে মেয়ে দু’জনও তার প্রতিপক্ষে লড়বে। কারণ এরা পাহাড়ী নারী। লড়াইকে ওরা ভয় পায় না। একা তিনজনের বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া বোকামী। তার ওপর পুরুষটি কোন সাধারণ লোক নয়, একজন চৌকস কমান্ডার। কিন্তু এ ছাড়া যে আর কোন গত্যন্তর নেই! সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, সে লড়বে। নিশ্চয়ই ভাগ্য তাকে সহায়তা করবে। কারণ সে এক দরবেশ মানুষের পরিবারকে রক্ষা করতে যাচ্ছে। দরবেশের দোয়ার কি কোন মূল্য নেই!

ওরা প্রহরীর একদম কাছে চলে এসেছে। তারার আলোয় সে ওদের ভাল করে লক্ষ করলো। কমান্ডার ওদের নিয়ে নিশ্চিত মনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে কোন সতর্কতার ভাব নেই। তলোয়ারটি অবহেলায় তার কমরে ঝুলছে। মেয়েদের সাথে কোন তলোয়ার নেই, সারা শরীর ও মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকায় খঞ্জর আছে কি না তাও স্পষ্ট বুঝা গেল না।

ওরা ওকে অতিক্রম করে গেল। ঘোড়াসহ আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো প্রহরী। এক মুহূর্তে ভাল করে দেখে নিল ওদের অবস্থান। তারপর পিছু ধাওয়া করে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। তার অশ্বের পদধ্বনি কমান্ডারকে চমকে দিল। সে থমকে দাঁড়িয়ে তাকাল পিছন ফিরে। সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার বের করে পিছনে ঘুরলো। মুহূর্তে কমান্ডারের কাছে পৌঁছে গেল প্রহরী। তার ঘোড়ার গতি ছিল তীব্র। ছুটন্ত অবস্থায় ঘোড়ার ওপর থেকে কমান্ডারকে এমন জোরে আঘাত করলো, ডান হাত কেটে পড়ে গেল কমান্ডারের।

ঘোড়া ঘুরিয়ে সে আবার ফিরে এলো কমান্ডারের কাছে। কমান্ডারের তখন আর লড়াই করার ক্ষমতা নেই। সে চিৎকার করে দয়া ভিক্ষা চাইল, কিন্তু প্রহরী তার ঘাড়ে আবারো তলোয়ারের আঘাত করলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল কমান্ডার।

সঙ্গের একমাত্র পুরুষ মানুষটি ধরাশায়ী হওয়ায় পর্দানসীন মা ও মেয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। ইসহাকের স্ত্রী মেয়েকে বললো, ‘পালাও! ডাকাত মনে হচ্ছে।’

প্রহরী ঘোড়া নিয়ে তাঁদের পথ আতকে দাঁড়ালো এবং বললো, ‘এখানে কোন ডাকাতের দল নেই, আমাকে ভয় পেয়ো না। আমিই বরং তোমাদেরকে এক ডাকাত ও প্রতারকের হাত থেকে রক্ষা করলাম। এক বন্দীকে দেখতে গিয়ে তোমরা নিজেরাই বন্দী হয়ে পড়ো, তা আমি চাই না। এখন আর কারাগারে যাওয়ার দরকার নেই। তোমরা তোমাদের গ্রামের বাড়ীতে ফিরে যাও। আমাকেই যদি ভয়, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি না। যতক্ষণ তোমাদের নিরাপদ মনে না করবো,ততক্ষণ তোমাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে আমি তোমাদের অনুসরণ করবো। আরো বলছি, এখানে আর কেউ নেই, আমি একাই তোমাদেরকে এক ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিলাম। এ লোক বন্দী দরবেশ ইসহাকের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য তোমাদের অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করতে চেয়েছিল।’

মা ও মেয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল! কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা বুঝতে পারলো না। অনেক্ষন পর্যন্ত মা-মেয়ে ওভাবেই অখানে স্তব্ধ বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শেষে ইসহাকের স্ত্রী বললো, ‘কি বলছেন আপনি? আমরা যে এর কিছুই বুঝতে পারছি না! আসল ব্যাপারটা কি খুলে বলুন তো?’ প্রহরী কমান্ডারের ঘোড়ার লাগাম তার ঘোড়ার জীনের সাথে বেঁধে বললো, ‘আগে আপনাদের বাড়ি চলুন, ওখানে গিয়েই সব বলবো। মরুভূমিতে রাত কাটানো নিরাপদ নয়।‘ ওরা ফিরে চললো বাড়ীর দিকে। ইসহাকের স্ত্রী বিস্ময় ও কৌতূহল দমন করতে না পেরে একটু পর বললো, ‘তিনি কি আসলেই বন্দী এবং আহত?’

‘হ্যাঁ, তিনি এখন কারাগারেই আছেন। না, তিনি আহত ছিলেন না, তবে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে। সে নির্যাতনের ধকল সয়ে তিনি এখনো কিভাবে বেঁচে আছেন সে রহস্য আমার জানা নেই। আমরা বিশ্বাস করি, তার কাছে আল্লাহ্‌র অলৌকিক শক্তি আছে।‘

‘তার ওপর এ অকথ্য নির্যাতনের কারণ কি?’

‘তাকে সুদানী সেনাবাহিনীতে নিতে চাইছে সরকার। তাকে বলা হচ্ছে, তুমি বললেই তোমার পাহাড়ি এলাকার মুসলমানরা সুদানী সৈন্য বাহিনীতে ভর্তি হবে। সরকার চাচ্ছে, তিনি এবং তার কবিলার লোকেরা সুদান সরকারের আনুগত্য স্বীকার করুক। কিন্তু তিনি তা মানছেন না।‘

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহ্‌ তাকে হেফাজত করুন। কিন্তু কমান্ডার আমাদের কেন নিতে এসেছিল?’

প্রহরী উত্তরে বললো, ‘তার সামনে তোমাদের সম্ভ্রম নষ্ট করার হুমকি দিয়ে তাকে শর্ত মানতে বাধ্য করাতে চাচ্ছিল সরকার। যাকে আমি হত্যা করেছি, সে এক ফৌজি কমান্ডার। এ উদ্দেশ্যেই সেনাপতি তোমাদেরকে নিতে পাঠিয়েছিল তাকে। আমি বিষয়টি জেনে তার পিছনে লেগেছিলাম। আমি খুশি যে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।‘

‘তুমি কে?’ ইসহাকের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি মুসলমান?’

‘আমি সে কারাগারের প্রহরী।‘ সে উত্তর দিল, ‘না, আমি মুসলমান নই।‘

‘তবে কেন তুমি এ ঝুঁকি নিতে গেলে? আমাদের জন্য তোমার এমন সমবেদনার কারণ কি?’

‘তার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তাতে তার মরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বেহুশও হননি। আমি এবং আমার সঙ্গীদের বিশ্বাস, তার কাছে অলৌকিক শক্তি আছে। তিনি মুক্ত হতে পারলে সে শক্তি দিয়ে আমাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন। কিন্তু তাকে মুক্ত করার কোন উপায় এখনো আমরা বের করতে পারিনি। এর মধ্যেই তোমাদের সর্বনাশ করার জন্য সেনাপতি ষড়যন্ত্র করছে জানতে পেরে আমরা তা বানচাল করার সিদ্ধান্ত নেই। এ কারনেই আমি এখানে ছুটে এসেছি।‘ প্রহরী বললো।

‘মানুষের ভাগ্য একমাত্র আল্লাহই পরিবর্তন করতে পারেন। ভাগ্য পরিবর্তনের অলৌকিক ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। তিনি এমন ওয়াদা করতে পারেন না। আর যদি তিনি এমনটি বলে থাকেন তাহলে ভুল বলেছেন।‘ বললো ইসহাকের স্ত্রী।

‘কি বলছেন আপনি!’ প্রহরী বললো, ‘তার অলৌকিক ক্ষমতা তো আমি নিজের চোখে দেখেছি! এই যে আমাকে দেখুন, আমি মুসলমান নই। কারাগারের সামান্য এক প্রহরী। আমার এমন সাহস বা শক্তি নেই, যা নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। কিন্তু দেখুন, কি দুঃসাহসিক কাজ করলাম? আমাদের সেনাপতির মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার শক্তি আমি কোথায় পেলাম? কি করে সামান্য প্রহরী হয়ে নিজের কমান্ডারকে খুন করলাম? আপনারা ছিলেন তিনজন, তারপরও কি করে আমি আপনাদের আক্রমণ করার সাহস পেলাম? এসবই তার গায়েবী শক্তি। তিনি সত্যি অলৌকিক ক্ষমতাধর। আপনি কেন তাকে আমার কাছ থেকে লুকাচ্ছেন?’

ইসহাকের স্ত্রী এই অন্ধ বিশ্বাসী লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। কি করে সে এ বিশ্বাস ভাঙবে বুঝতে পারলো না।

সকাল বেলা। ইসহাকের বাড়ীর সামনে চারটি ঘোড়া এসে থামলো। ঘোড়া থেকে নেমে দরজার কড়া নাড়ল ইসহাকের বিবি। ইসহাকের বাবা দরজা খুলে সামনে পুত্রবধু, নাতি ও তাঁদের সাথে আরও একজন অপরিচিত লোককে দেখে খুবই আশ্চর্য হলেন। হা করে তিনি তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে।

‘হা করে দেখছ দাদু? আমাদের ঢুকতে দাও।’

নাতনীর কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে সরে দাঁড়ালেন তিনি। ভেতরে ঢুকে বুড়োর প্রশ্নের জবাবে আবারো সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বলতে হলো প্রহরীকে। শুধু বললো না, কারাগারে ইসহাকের ওপর কি নির্যাতন হচ্ছে।

ইসহাকের বাবা তৎক্ষণাৎ কবিলার লোকদের ডেকে পাঠালেন। লোকেরা জড়ো হলে প্রহরী তাদেরকে বললো, ‘পাহাড়ী অঞ্চলের সমস্ত মুসলমান সুদানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে সুদান সরকার ইসহাককে মুক্তি দিতে রাজী হয়েছে। শর্ত একটাই, তোমাদের সবাইকে সুদানের আনুগত্য কবুল করতে হবে।’ লোকেরা বললো, ‘ইসহাক কি বলেছে?’

‘ইসহাক তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তোমরা আমাকে জীবনে শেষ করে ফেললেও আমি আমার জাতির সাথে গাদ্দারি করতে পারবো না, কাউকে তোমাদের আনুগত্য কবুল করতেও বলবো না।’

শুধু ইসহাকের কবিলা নয়, এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর পাহাড়ী অঞ্চলের সমস্ত মুসলমানরাই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সুদান সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো ওরা। একজন বললো, ‘এটা আল্লাহ্‌র জমিন! এখানে নাস্তিক সুদান সরকারের আধিপত্য চলবে না। আমরা ইসহাকের ওপর অত্যাচারের বদলা নেবো।’

‘আমরা কারাগারে আক্রমন চালিয়ে ইসহাককে মুক্ত করে আনবো।’ বললো অন্য একজন।

‘তোমরা তা পারবে না।’ প্রহরী বললো, ‘জেলখানা বড়ই দুর্ভেদ্য, সেখান থেকে কাউকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।’

‘তুমি কারাগারের প্রহরী, তুমি আমাদের সাহায্য করলে আমরা নিশ্চয়ই তাকে মুক্ত করতে পারবো।’ ইসহাকের বাবা বললেন।

‘আমি গরীব ও সাধারন এক প্রহরী মাত্র।’ সে বললো, ‘আমি আপনার বেটাকে মুক্ত করতে কিইবা সাহায্য করতে পারবো? তাকে আমি সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। তার এক নগন্য ভক্ত হিসাবে আমি আমার জীবনও দিতে তার জন্য বিলিয়ে দিতে পারি। এতে যদি আপনাদের কোন উপকার হয়, আমি প্রস্তুত। শুধু আমার গরীব পরিবারকে আপনারা একটু দেখবেন।’

‘তুমি যদি সত্যি তার ভক্ত হয়ে থাকো তবে তার আদর্শকে গ্রহন করো। তাহলে তুমি আমাদের সবার ভাই হয়ে যাবে। ভাইয়ের জন্য এমন কোন কোরবানী নেই, যা আমরা করতে পারিনা। মুসলমান হয়ে যাও, আর এখানে চলে আসো।’ ইসহাকের বাবা তাকে বললেন, ‘আমাদের এ পাহাড়ী অঞ্চলই আমাদের দুনিয়ার জান্নাত। এখানে পানির ঝর্ণাধারা আছে, আছে শস্য-শ্যামল মাঠ ও নানা রকম ফলের গাছ। এখানকার মাটি এমন ফসল দেয়, যে কৃষিকাজ করে না, সেও ক্ষুধার্ত থাকে না। এটা আমাদের ওপর আল্লাহ্‌র এক বিশেষ রহমত। এ পাহাড়ী এলাকা আমাদের কেল্লা! আমাদের দুর্গ! আমরা এখানে সবাই স্বাধীন। তুমি তোমার পরিবার পরিজন নিয়ে আমাদের এখানে চলে আসো, তোমার ভাগ্য বদলে যাবে।’

এ প্রস্তাব প্রহরীর খুবই মনপূত হলো। সে এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ইসহাকের বাবার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ইসলাম কবুল করলো সে। বুড়ো তাকে সন্তানের মর্যাদা দিয়ে তার কাছেই রেখে দিলেন।

ভোরের সূর্য অনেক উপরে উঠে এসেছে। সুদানী সেনাপতি অধীর আগ্রহে কমান্ডারের জন্য প্রতীক্ষা করছিল, কিন্তু তার কোন খবর নেই। ক্রমশঃ সময় গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল, তবু দেখা নেই কমান্ডারের। শংকিত হয়ে উঠলো সেনাপতি, তার কি কোন বিপদ হলো? নাকি সে পথ হারিয়ে ফেলেছে?

অনেক ভেবেচিন্তে শেষে সেনাপতি তার এক অফিসারকে ডাকলো। বললো, ‘কমান্ডার যে পথে গেছে সে পথে যাও, প্রয়োজন হলে ইসহাকের বাড়ী পর্যন্ত চলে যাবে। তারা রওনা না করলে তাদেরকে দ্রুত পাঠিয়ে দেবে, আর পথে থাকলে তাড়াতাড়ি আসতে বলবে। তুমি ওদের সাথে আসার অপেক্ষা না করে খবর নিয়ে আগেই চলে আসবে।’

ইসহাক একা পড়েছিল কামরায়। কামরায় পচা লাশ গলে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কারাগারের প্রহরীরা, যারা কারাগারের দুর্গন্ধে অভ্যস্থ ছিল, তারাও ইসহাকের কামরার কাছ ঘেঁষতো না বিশ্রী গন্ধের ভয়ে। এক প্রহরী নাকে কাপড় বেঁধে ইসহাকের কাছে গিয়ে বললো, ‘আরে আহাম্মক! এ দুর্গন্ধ কেমন করে সহ্য করছো? এরা তোমাকে যা মানতে বলে, মেনে নাও আর এখান থেকে বিদায় হও। এ মরার গন্ধে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।’

‘আমার কোন দুর্গন্ধ লাগছে না।’ ইসহাক বললো, ‘এ তো মরা লাশ নয়, শহীদ! শহীদরা মরে না। আমি রাতে ওর সাথে কত গল্প করি!’

‘তুমি পাগল হয়ে গেছ। প্রহরী বললো, ‘লাশের এমন দুর্গন্ধে কেউ পাগল না হয়ে পারে!’

ইসহাক হেসে বললো, ‘হবে হয় তো বা!’

সে লাশের পাশে বসে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ঢেলে পবিত্র কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করতে লাগলো।

দিন গড়িয়ে রাত এলো। তারপর সে রাতও অতীত হয়ে গেল। প্রত্যুষে ফিরে এলো সেনাপতির পাঠানো অফিসার। এক দিনেই তার বয়স যেন বেড়ে গেছে দশ বছর। চেহারা বিবর্ণ, মলিন। এক দিকে দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি, অন্যদিকে বর্ণনার অতীত চাক্ষুস এক মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা। সে যা দেখে এসেছে তা বর্ণনা করার ভাষা ছিল না তার।

সেনাপতি বললো, ‘কি হয়েছে খুলে বলো!’

‘পথে মরুভূমির মাঝামাঝি গিয়েছি, মাথার ওপর শকুন চক্কর দিচ্ছিল। এলাকাটা উঁচুনিচু বালুর টিলায় পরিপূর্ণ। আরেকটু এগুতেই দেখতে পেলাম এক স্থানে শকুন মরা খাচ্ছে। মরার পাশে পড়ে আছে তলোয়ার, তার জুতা, ছেঁড়া কাপড়। লাশটি কার চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। কেবল বীভৎস নয়, জঘন্য, কদাকার। আমার মনে সন্দেহ জাগলো। ভয় হলো, এটা আমাদের কমান্ডারের লাশ নয় তো! কৌতূহলের বশে লাশের কাছে এগিয়ে গেলাম। তাড়া করতেই শকুনরা সরে গেল একটু দূরে। তার খঞ্জর ও কোমরবন্ধ দেখে নিশ্চিত হলাম, হ্যাঁ, এটা আমাদের পাঠানো কমান্ডারেরই লাশ। আমি কতক্ষণ থ’ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কিভাবে, কেন তিনি মারা গেলেন সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি পাহাড়ী অঞ্চলের দিকে আরো কিছু পথ এগিয়ে গেলাম। বালিতে তার ঘোড়ার পদচিহ্ন খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলাম, তার ঘোড়া পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিল। ফিরতি পথে তার সাথে ছিল আরো দু’টো ঘোড়া। এতে প্রমাণ হয়, তিনি ইসহাকের পরিজনদের সাথে নিয়েই ফিরছিলেন। আমি কমান্ডারের লাশ পেলেও তার সাথীদের লাশ পাইনি। তার মৃত্যুর কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। ইসহাকের লোকেরা তাকে হত্যা করলে গ্রামেই করতে পারতো, আর তাকে বিশ্বাস না করলে তার কন্যা ও বিবিকে ওর সাথে আসতে দিত না। পথে এক কিশোরী ও এক নারী আমাদের কমান্ডারকে হত্যা করবে, এমনটা কল্পনাও করা যায় না। তাহলে কে তাকে হত্যা করলো? কোন ডাকাত দল পড়েছিল ওদের ওপর, তেমন কোন প্রমাণও পাইনি। সেই থেকে আমি অস্থির।’

সুদানী সেনাপতি বললো, ‘এ নিয়ে এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। নিশ্চয়ই সব কিছুই আমরা জানতে পারবো। সে অঞ্চলে আমাদের যে গোয়েন্দারা কাজ করছে তারা ওই অঞ্চলেরই মুসলমান। সংবাদ সংগ্রহে তারা বেশ দক্ষ। ইসহাক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তারাই সরবরাহ করেছিল। সে অঞ্চলে ইসহাকের অসম্ভব প্রভাব প্রতিপত্তির খবরও তারাই দিয়েছে। একটু সবুর করো, সব খবরই আমরা পেয়ে যাবো।’

হলও তাই। সন্ধ্যার পর দুই গোয়েন্দা এসে উপস্থিত হলো সেনাপতির কাছে। তারা জানালো, ‘কমান্ডার ইসহাকের মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঠিকই রওনা দিয়েছিল। আপনার কারাগারের এক সিপাহী তাকে হত্যা করে মেয়ে দু’জনকে তাদের বাড়ীতে পৌঁছে দেয়।’

‘আমাদের কারাগারের প্রহরী! কি নাম তার?’

‘তার নাম ইরাজ মেহের।’ গোয়েন্দারা বললো সেনাপতিকে।

সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা সুদান সরকারের কাছে তুলে ধরলো। সরকার এ নিয়ে পরামর্শ করলো তাদের খৃস্টান উপদেষ্টাদের সাথে। খৃস্টান উপদেষ্টারা পরামর্শ দিল, ‘এ ব্যাপারে তোমরা নীরব থাকো। এ নিয়ে মুসলমানদের ওপর অভিযান চালানোর বোকামী করো না। তাদেরকে অন্য কোন ভালো পদ্ধতিতে বন্ধু বানাতে চেষ্টা করো। খুব বেশী হলে তোমরা গোপনে শুধু সেই সিপাহীকে হত্যা করতে পারো, যে তোমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। তাতে মুসলমানরা বুঝবে, তোমাদের হাত থেকে কেউ রেহাই পায় না। যদি ইসহাক তোমাদের শর্ত গ্রহণ না করে, তবে অন্য মুসলমান কয়েদীদের মানাও, আর ইসহাকের ওপর উৎপীড়ন অব্যাহত রাখো।’

ইসহাকের ওপর নির্যাতন চলতেই থাকলো। সেনাপতি তার ওপর কমান্ডার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নির্যাতনের মাত্রা এতই বাড়িয়ে দিল যে, জ্ঞান হারাল ইসহাক।

রাতে সে বেহুশ হয়ে পড়েছিল এক কুঠরির মধ্যে। যখন জ্ঞান ফিরলো, কুঠরি অন্ধকার। কামরার বাইরে মশাল জ্বলছে। ইসহাক পাশ ফিরে শুতে গেল, তার হাত গিয়ে পড়লো কারো শরীরে। সে মনে করলো, এটা সেই লাশ, যা কয়েক দিন ধরে পড়ে আছে কামরায়। কিন্তু একটু পর তার মনে হলো, কেউ যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সে ভাবলো, হয়ত মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে তার। তার শরীর অবশ লাগছিল, তাই সে আর উঠে দেখতে চেষ্টা করলো না, আসলেই কামরায় কোন মানুষ আছে কিনা?

একটু পর কামরায় কারো নড়ে উঠার শব্দ হলো। এবার চমকে উঠলো ইসহাক।  চোখ মেলে সে চাইলো কামরার ভেতর। বাইরে থেকে আসা আবছা আলোয় সে পরিষ্কার দেখতে পেলো, তার পাশে কেউ একজন শুয়ে আছে এবং সে লোকটিই নড়াচড়া করছে। ইসহাক লোকটির মুখের উপর ঝুঁকে তার দিকে গভীরভাবে তাকালো। না, এটা কোন লাশ নয়, একজন জ্যান্ত মানুষ। আর এটা তার সেই কামরাও নয়, যেখানে বারবার তাকে রাখা হতো। এটা অন্য কোন কামরা। ইসহাকের মনে হলো, লোকটিও এতক্ষন বেহুশ ছিল, ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরছে। একটু পর লোকটিও চোখ খুললো। অন্ধকারের মধ্যেই ইসহাক তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি?’

লোকটি ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘উমরু দরবেশ!’

‘ও, হো! উমরু দরবেশ!’ ইসহাক অভিভূত হয়ে বললো, ‘আমি ইসহাক!’

সুলতান আইয়ুবী এ পর্যন্ত বলে একটু দম নিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এরা একে অপরকে ভাল করেই চিনতো। উমরু দরবেশও আমার একটি সেনাদলের কমান্ডার ছিল। সেও পাহাড়ী অঞ্চলের মুসলমান কবিলার লোক। উমরু দরবেশ ইসহাকের সাথে একই অভিযানে যুদ্ধবন্দী হয়। ইসহাকের নাম শুনেই সে উঠে বসলো।

‘তোমাকে কি শর্ত দিয়েছে?’ ইসহাক জিজ্ঞেস করলো।

‘বলছে, তুমি আলেম ও হুজুর সেজে দেশে যাও।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘লোকদের নছিহত করো, তাদের বুঝাও, সুলতান আইয়ুবী দেশ ও ইসলামের শত্রু। আরও বলছে, আমরা তোমাকে ট্রেনিং দিয়ে দেবো, তোমাকে রাজার হালে রাখবো। আর আমাদের রঙমহলের যে সুন্দরী মেয়েকে পছন্দ করো তাকে চিরকালের জন্য উপহার দিয়ে দেবো তোমাকে।’

উমরু দরবেশ জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কাছ থেকে কোন শর্ত আদায় করতে চাচ্ছে?’

‘তারা বলছে, তোমরা সম্প্রদায়ের সমস্ত মুসলমানদের সুদান সরকারের অনুগত করে দাও।‘ ইসহাক উত্তর দিল, ‘তার বিনিময়ে আমাকে আমাদের এলাকার আমীর বানিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এরা পাহাড়ী মুসলমানদের সুদানী সেনাবাহিনীতে শামিল করতে চায়।’

‘আমার মনে হয়েছিল, তোমার উপর ওপর খুব নির্যাতন করছে ওরা।‘ উমরু দরবেশ বললো, ‘জানি না আমাদের দু’জনকে কেন একই কামরায় বন্দী করলো। সম্ভবতঃ এতে কোন মঙ্গল নিহীত আছে। আমিও চাচ্ছিলাম, তোমার সাথে আমার দেখা হোক। আমি একটি পথ চিন্তা করেছি; সে কাজ করার আগে তোমার সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল। ভালই হলো, তুমি আমার কাছে এসে গেছো।’

‘কি চিন্তা করেছো?’

‘তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, এরা আমাদের ছাড়বে না।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমরা আর কতদিন নির্যাতন সহ্য করবো? এভাবে হয়তো আরো দু’চার দিন বেঁচে থাকবো, কিন্তু মরণ আমাদের এখানেই হবে। এখানে আরও কিছু সুদানী মুসলমান বন্দী বেঁচে আছে। কেউ না কেউ তাদের জালে আটকাবেই। আমি ভয় পাচ্ছি, আমাদের সাথীদের প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দেবে। পথ একটাই, তা হলো, এদের শর্ত মেনে নেয়া। আমার ইচ্ছা তুমিও এদের শর্ত মেনে নাও। তারপর মুক্ত হয়ে নিজের এলাকায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। নয়তো সুযোগ মতো রাতের আঁধারে সেখান থেকে পালিয়ে মিশর চলে যেও। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে।

এদিকে আমি তাদের কথা মেনে নেই। তারা আমাকে যে শিক্ষা দেয়, তাই গ্রহণ করি। তাদের নির্দেশ মত বহুরূপী সেজে চলে যাই নিজের কবিলার কাছে। তারপর তারা যেন সুদানীদের কোন চক্রান্তে না পড়ে সে জন্য তাদের হুশিয়ার করি। যদি আমি তাদের সাথী হতে পারি, তবে আমি তোমাকে এখান থেকে বের করার চেষ্টা করবো।’ সে আরো বললো, ‘এমনও তো হতে পারে, আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের কবিলার ওপর সুদানীরা আক্রমণ করে বসবে!’

ইসহাক বললো, ‘পাহাড়ী মুসলমানরা সহজে অস্ত্রসমর্পন করার মত নয়।’

‘কিন্তু সৈন্যদের শক্তির কাছে কতদিন ওরা টিকে থাকতে পারবে?’

‘আমাদের কোরবানী ওদের ঈমানকে মজবুত করবে।’ উমরু দরবেশ বলল, ‘কিন্তু বেরোতে পারলে আমরা মিশর থেকে কমান্ডো সাহায্য পাবো। বর্তমানে আমাদের প্রয়োজন, দু’জনের অন্ততঃ একজনের এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া। যদি আমরা দু’জনই তাদের শর্ত মেনে নিয়ে বের হতে পারি, তবে আরও ভাল হয়।‘

‘আমি এখন কারাগারেই থেকে যাই।’ ইসহাক বললো, ‘তুমি একাই তাদের ধোঁকা দাও। আমরা দু’জনই যদি এক সাথে তাদের শর্ত মেনে নেই, তবে তাদের সন্দেহ হতে পারে। তারা চিন্তা করবে, দু’জন রাতে একই কামরায় থেকে এ পরিকল্পনা করেছে। তাই আমার পরামর্শ হচ্ছে, ‘আমি এদের উৎপীড়ন সহ্য করতে থাকি, তুমি মুক্ত হয়ে যাও।’

সকালে কারাগারের দরজা খোলা হলো। এক সেপাই বর্শা দিয়ে ইসহাকের গায়ে খোঁচা মেরে ধমক দিয়ে বললো, ‘এই উল্লুক, উঠ।’

ইসহাক উঠলে তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল প্রহরী। সঙ্গে সঙ্গে কামরার দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

 

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top