৩০. মহাসময়

জেরুজালেম হাত ছাড়া হওয়ার পর পোপ দ্বিতীয় আরবানুসের আহবানে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সমগ্র খৃষ্টান বিশ্ব। তাদের নেতৃত্ব নিলেন জার্মানীর সম্রাট রিচার্ড। শুরু হলো যুদ্ধের এক মহাযজ্ঞ।

প্রথমেই ময়দানে এলেন জার্মানীর সম্রাট ফ্রেডারিক। তিনি দুই লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে। তিনি এত বেশী সৈন্য নিয়ে এলেন যে, এক আইয়ুবীকে শায়েস্তা করার জন্য এরচে বেশী সৈন্যের দরকার মনে করলেন না তিনি। তাই অন্যান্য খৃষ্ট্রান সম্রাটকে সঙ্গী বানানোরও প্রয়োজন অনুভব করলেন না। তিনি তার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী একাই অগ্রসর হলেন এবং বীরদর্পে দামেশকের উপর আক্রমণ করে বসলেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য যে, তিনি সুলতান আইযুবীর যুদ্ধের টেকনিক সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি দুই লক্ষ সৈন্যের দম্ভ নিয়ে সুদূর জার্মানী থেকে ছুটে এলেন আরবের মরুময় ভুখন্ড দখল করতে। ভাবলেন, আইয়ুবীকে পরাজিত করা, এ আর এমন কি কঠিন কাজ!

দীর্ঘ ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাসে এ আক্রমন নিঃসন্দেহে ব্যাপক ও তীব্র ছিল। ঐতিহাসিকরা দামেশকের উপর এই আক্রমণকে ক্রুসেড যুদ্ধের দ্বিতীয বৃহত্তম ও সর্বাত্মক আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছেন।

স¤্রাট ফ্রেডারিক তার বিপুল সৈন্যের দম্ভ নিয়ে ছুটে এলেন। প্রথমেই তিনি টার্গেট করলেন সিরিয়াকে। তিনি সিরিয়ায় এসে কালবিলম্ব না করে দামেশকের ওপর প্রবলবেগে আক্রমণ করে বসলেন। কিন্তু দামেশক কব্জা করা তোত দূরের কথা, তিনি দামেশকের একটি ইটও খসাতে পারলেন না।

স¤্রাট ফ্রেডারিক তার বিপুল সৈন্য নিয়ে যখন দামেশকের কাছে এসে উপস্থিত হলেন তখন তার ধারনা ছিল, সুলতান আইয়ুবী এই বিশাল বাহিনী দেখে যুদ্ধ করার পরিবর্তে আত্মসমর্পনের জন্য ছুটে আসবেন। তাই তিনি তার আগমন জানান দেয়ার জন্য প্রথমে দামেশকের ওপর পরীক্ষামূলক আক্রমণ চালালেন। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা বীর বিক্রমে সে আক্রমণ রুখে দিল।

রাতে ফ্রেডারিকের বাহিনী বিশ্রাম নিচ্ছিল। পরদিন ভোরে নতুন উদ্যমে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে ঝঁপিয়ে পড়তে হবে মুসলিম বাহিনীর ওপর। তাই রাতের বিশ্রামটা ছিল তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দামেশকের আকাশে রাতের অন্ধকারে ছেয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী চুপিসারে বেরিয়ে এলো ক্যাম্প থেকে। এরপর তারা খৃষ্ট্রান সেনাবহিনীর বিশাল ক্যাম্প অতিক্রম করে পৌছে দেল যেখানে এই বাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ, খাদ্যসামগ্রী ও যুদ্ধের অন্যান্য রসদপত্র রেখেছিল সেখানে। পাশেই ছিল ঘোড়ার আস্তাবল। ওখানে ছিল লক্ষ লক্ষ যুদ্ধের ঘোড়া একদল কমান্ডো চলে গেল সেই আস্তাবলের পেছনে।

খৃষ্ট্রান সৈন্যরা ঘুমিয়েছিল তাদের তাবুগুলোতে। সামান্য কিছু সৈন্য পাহারা দিচ্ছিল সেই তাবু। রসদ এবং আস্তাবলের ওখানেও পাহারা ছিল, তবে সবকিছুই ছিল ঢিলাঢালা। এতবড় বিশাল বাহিনীর ওপর রাতের অন্ধকারে আইয়ুবীর বাহিনী হামলা করবে এমনটি তারা কল্পনাই করতে পারেনি।

তখনো রাত তেমন গভীর হয়নি। হঠাৎ একযোগে সুলতানের কমান্ডোরা ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই অস্ত্রভান্ডার, রসদসম্ভার ও আস্তাবলের ওপর। তারা এমন তীব্র ও প্রাণপণ আক্রমণ চালোলো যে, সামান্য ক’জন পাহারাদার মুহূর্তেই ওরা গায়েব করে দিল। তারপর সেই অস্ত্রসম্ভার ও রসদপত্র তাদেরই ঘোড়ার গাড়ীতে তুলে দামেশকের সেনা ক্যাম্পে আনা শুরু করলো।

শহরের প্রধান ফটকসহ সব কয়টি ফটক খুলে দেয়া হলো। শত শত ঘোড়ার গাড়ী লাইন দিয়ে এসে ঢুকতে লাগলো শহরে। সুলতান আইয়ুবী তার পুরো বাহিনী শহর থেকে বের করে মোতায়েন করলেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, যেনো কমান্ডোদের সরবরাহ কাজে কোন বিঘœ না ঘটে।

এ খবর সম্রাট ফ্রেডারিকের ক্যাম্পে পৌঁছাতে দেরি হলো না। তারা দ্রুত তৈরী হয়ে নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে ছুটলো গুদামের দিকে। কিন্তু সে খানে তারা পৌছতে পারলো না, তার আগেই সুলতান আইয়ুবীর নিয়মিত বাহিনী তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

জার্মানীর খৃষ্ট্রান সৈন্যদের জন্য মুরুভূমি ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। তার ওপর দামেশক ছিল তাদের জন্র অপরিচিত ও নতুন জায়গা। রাতভর তারা লড়াই করলো অনিশ্চিতের মতো। কোথায় শত্রু, শত্রুর পরিমাণ কত, কি তাদের অস্ত্র কিছুই জানা নেই তাদের। তারা এক দিকে এগিয়ে যেতে চায়, তখন ছুটে আসে ঝাঁক ঝাঁক তীর। সঙ্গীদের কেউ কেই লটিয়ে পড়ে চোখের সামনে, বাকীরা পিছু হটে আত্মরক্ষা করে।

অন্য দল এগুতে গিয়ে দেখে তাদের সামনে তলোয়ার ও বল্লমের দেয়াল তুলে দাড়িয়ে আছে আইয়ুবীর সৈন্যরা। তারা থমকে দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। সহসা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আইয়ুবীর কোন অশ্বারোহী বাহিনী।

অদৃশ্য শত্রুর এই আক্রমণ ফ্রেডারিকের বাহিনীকে তছনছ করে ফেললো। সৈন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো সেনাপতি ও কমান্ডদের কাছ থেকে। কমান্ডাররা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখলো চারদিকে কেবল অন্ধকার। আকাশের মিটিমিটি অনুজ্জল তারাগুলো হরিয়ে যাচ্ছে ছুটন্ত মেঘের আড়ালে।

তারপরও যুদ্ধ । কারণ দুই লক্ষ সৈন্যের সামনে লিলিপুট। খৃষ্ট্রানদের অস্ত্র ও রসদসম্ভারেরও কোন কমতি ছিল না। রাতভর লুট করেও যেন কোন কূল পাচ্ছিলনা কমান্ডোরা। তারা নিজেদের শৃঙ্খলা অটুট রেখে গাড়ী বোঝাই করে দ্রুত এবং ক্রমাগত মালসামান শহরের অভ্যন্তরে পাঠাতেই থাকলো।

কমান্ডোরা বিভিন্ন গ্রুপ নিজেরদ মধ্যে ভাগ করে নিল বিভিন্ন গুদাম। যারা অস্ত্র লট করছিলে তারা কেবল অস্ত্রই লুট করতে থাকে। যারা গোলাবারুদ তুলছিল তারা গাড়ীর পর গাড়ী বোঝাই করছিল কেবল গোলাবারুদ দিয়ে। আরেক দল খাদ্য সামগ্রী লুট করার কাজে ব্যস্ত রইলো।

সম্রাাট ফ্রেডারিকের ঘোড়ার গাড়ীর পরিমাণ ছিল অজ¯্র। পরিমাণে তা এতই বেশী যে, সবকটা ঘোড়ার গাড়ীতে ঘোড়া জুড়ে চালানোর মতো সৈন্যও পাওয়া গেল না আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনীতে।

তারা গাড়ী শহরে ঢুকিয়ে দিয়ে গাড়ী রেখে খালি ঘোড়া নিয়ে ছুটে যেতো গুদামে। ওখানে নতুন গাড়ীতে আগেই মাল ভরে রাখতে অন্যরা । তারা ঘোড়া রেখে নতুন ঘোড়া ও নতুন গাড়ী নিয়ে ছুটতো শহরের দিকে।

এই ব্যস্ততার মধ্যে কোন ফাঁকে রাত শেষ হয়ে গেলো টের পেল না আইয়ুবীর বাহিনী। তারা তখনো গাড়ী বোঝাই করে অস্ত্র ও খাদ্যসম্ভার  শহরে আনছিল, দেখতে পেলো পূর্ব দিগন্তে আলোর আভাস।

সম্্রাট ফ্রেডারিকের সৈন্যরা গজবের একটি রাত পার করলো। তাদের দিকে রক্তচক্ষু মেলে উঠে এলো ভোরের নতুন সূর্য। ফ্রেডারিকের বাহিনী তখন এলোমেলো, বিচ্ছিন্ন। অনিশ্চিত দুঃস্বপ্নের ঘোর তাদের চোখে মুখে। শোচনীয় পরাজয়ের কালিমা নিয়ে ফ্রেডারিক তার বাহিনীকে পিছিয়ে নিয়ে নতুন কারে সংগঠিত করলেন।

তিনি দেখতে পেলেন, বহু সৈন্য হতাহত হওয়ার পরও বিশাল বাহিনী বলে ঘাটতিটা তেমন চোখে পড়ে না। ময়দানে এখনো তার বিপুল সংখ্যক সৈন্য রয়েছে। কিন্তু তাদের মুখে দেয়ার মত খাদ্য নেই তার হাতে।

তিনি পিছু হটে এক স্থানে ক্যাম্প করে নতুন করে যুদ্ধের প্ল্যান করা শুরু করলেন। কিন্তু অচিরেই টের পেলেন, তার বাহিনীতে কেবল খাদ্য নয়, পারিও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোর নিয়ন্ত্রণ তখন মুসলিম বাহিনীর হাতে। ফলে তারা কোথাও থেকে পানি সংগ্রহ করতে পাছে না। নানা বিপদাপদ ও উৎকন্ঠার মধ্যে দিনটি কেটে গেল। ঝুপ কের তাদের সামনে নেমে এলো আকেটি ভয়ংকর রাত। ক্যাম্প অরক্ষিত রেখে ঘুমাতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারলো না কেউ।

একদল ঘুমোবে আরেক দল জেগে পাহারা দেবে ক্যাম্প, এসব যখন ভাবছিল খৃষ্টান সেনাপতি ও কমান্ডাররা, তখনি সৈন্যদের মাঝে হৈ চৈ পড়ে গেল। তারা শুনতে পেলো দূর থেকে ভেসে আসছে ছুটন্ত ঘোড়ার সম্মিলিত খুরধ্বনি।

২২ জিলহজ্জ ৫৮৬ হিজরীর দিবাগত রাত। মুসলিম কমান্ডোরা প্রচন্ড বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লো স¤্রাট ফ্রেডারিকের বাহিনীর ওপর। তাদের বিদ্যুৎগতির আক্রমণে তছনছ হতে লাগলো খৃষ্টান বাহিনীর ক্যাম্প। ওখানে শুরু হয়ে গেল আহতদের আর্তচিৎকার, ভীত সন্ত্রস্ত সৈন্যদের কান্নাকাটি ও শোকের মাতম।

খৃষ্টান বাহিনী যতাটা প্রতিরোধ করছিল তারচে বেশী করছিল বিলাপ। কমান্ডোরা কোথাও থমনেক না দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে ছুটছিল নাঙ্গা তলোয়ার হাতে। এবার আর তাদের নজর সম্পদ বা অস্ত্রের দিকে ছিল না। এবর তারা কচুকাটা করছিল স¤্রাট ফ্রেডারিকের বীর সৈন্যদের।

জার্মানীর সৈন্যরা ক্যাম্পের চারপামে এবং ক্যাম্পের মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় শুকনো কাঠের খড়ি একত্রিত করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল। এতে সুবিধা হচ্ছিল দু’পক্ষেরই, আক্রান্ত হওয়ার আগেই ওরা দেখতে পাচ্ছিল মুসলিম সমান্ডোদের, আবার কমান্ডোরাও দেখেশুনে আঘাত হানতে পারছিল। খৃষ্টানাদের জ্বালানো অগ্নিকুন্ডগুলো দেখে বাইরে থেকে মনে হচ্ছিল, সমস্ত ক্যাম্পই জ্বলছে।

থেকে থেকে হামলা করছিল মুসলিম কমান্ডোরা। দ্রুতগতির ঘোড়া নিয়ে ঢকে পড়ছিল ক্যাম্পের ভেতর। কেউ বাঁধা দিতে এলেই মৃত্যু জাপটে ধরতো তাকে।

আহত খৃষ্টান সৈন্যদের চিৎকারে নরক গুলজার হয়ে উঠলো ক্যাম্পের পরিবেশ। মরুভূমির রাতের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো সে কান্না ও বিলাপের ধ্বনিতে। তাদের নিয়ে চলছিল ছুটাছুট, চিকিৎসা ও ব্যান্ডেজ বাঁধার কাজ।

পরদিন ভোর। জার্মান সেনাকমান্ড তার সৈন্যদের আরো পিছিয়ে নিলেন। তিনি তার সৈন্যদের সামলে নিয়ে সরে গেলেন বেশ খানিকটা দূরে।

ওখানে কাছেই পাওয়া গেল ছোট্ট একটা গ্রাম। তাতে খাবার তেমন না মিললেও পানির অভাব দূর হয়ে গেল। তিনি ওখানেই ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি জানতেন, ফ্রান্সে স¤্রাট ফিলিপ অগাষ্টাস ও ইংল্যান্ডের স¤্রাট রিচার্ড শিঘ্রই বিপুল সৈন্য নিয়ে চলে আসবেন আইয়ুবীকে শায়েস্তা করতে। তারা সমুদ্র পথে নৌবহার নিয়ে আসছেন। তিনি তার সৈন্য দামেশক থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন দূরে। অপেক্ষা করতে লাগলেন স¤্রাট ফিলিপ ও স¤্রাট রিচার্ডের জন্য।

কিছুদিন পর। স¤্রাট ফিলিপ ও রিচার্ডের জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে তিনি ক্রমেই নিজের বাহিনীকে দামেশক থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, বসে না থেকে কাছের শহর আক্রা দখল করে নিলে কেমন হয়!

দামেশক থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি নজর দিলেন ফিলিস্তিনের উপকূলীয় শহর আক্রার দিকে। ফ্রেডারিক তার বাহিনীকে আক্রার দিকে অভিযান চালানোর আদেশ দিয়ে ভাবলেন, আক্রা দখল করতে পারলে পা রাখার মত একটা নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে।

ফ্রেডারিক যখন দামেশক আক্রমণ করেন তখন সুলতান আইয়ুবী দামেশক ছিলেন না। তার অনুপস্থিতিতেই সেখানকার কমান্ডোরা তাকে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল।

সুলতান তখন অবস্থান করছিলেন আক্রাতে। তিনি তাঁর সেনাপতি ও সীমান্ত রক্ষীদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, “যদি কেউ আক্রা আক্রমণ করতে আসে তবে তাকে বাঁধা না দিয়ে সামনে এগুতে দেবে। আক্রা সীমান্ত পেরিয়ে তারা যেন নির্বিঘেœ শহরের কাছাকাছি পৌছতে পারে।”

সুলতানে নির্দেশ অনুসারে ফ্রেডারিকের বাহিনীকে প্রতিরোধ না করে বরং তাদের বিনা বাঁধায় সামনে এগিয়ে যেতে দিল সীমান্ত রক্ষীরা। ফ্রেডারিকের বাহিনী এগিয়ে আসছে খবর পেয়েই তারা সরে গেল পথ থেকে।

বাঁধা না পেয়ে আক্রার সীমান্তের বেশ ভেতরে ঢুকে গেল ফ্রেডারিকের বাহিনী। সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগ পিছু নিল তাদের। তারা ফ্রেডারিকের বাহিনীকে অলক্ষ্যে থেকে অনুসরণ করতে লাগলো এবং ঘন্টায় ঘন্টায় কাসেদ পাঠাতে লাগলো সুলতানের কাছে।

এবার শুরু হলো সুলতান আইয়ুবীর বিশেষ পদ্ধতির যুদ্ধ। সীমান্ত থেকে আক্রা শহর পর্যন্ত সারা রাস্তায় তিনি তার কমান্ডো বাহিনী ছড়িয়ে রেখেছিলেন। একাধিক কমান্ডো বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছিল এ পথটুকু। তাদের প্রত্যেকের জন্য ছিল নির্দিষ্ট এলাকা। সুলতানে আদেশ পায়নি কবলে তারা কেউ আক্রমণ করতে পারছিল না ফ্রেডারিকের বাহিনীর ওপর, তাবে ফ্রেডারিকের প্রতিটি কদমে তারা নজর রাখছিল।

আক্রার শহর তখনো বেশ দূরে। এক রাতের বিশ্রামের জন্য ক্যাম্প করেছে স¤্রাট ফ্রেডারিকের বাহিনী। প্রতি দিনের মত রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে সৈন্যরা। মাঝ রাতের দিকে তাদের ওপর আক্রমণ করে বসলো সুলতানের একদল কমান্ডো। আক্রমণটা তারা করেছিল ফ্রেডারিকের বাহিনীর লেজের দিকে। এই আক্রমণ লেজের দিকের একটা অংশ বিছিন্ন করে দিল মূল বাহিনী থেকে। তারপর সেই অংশটি নিঃশেষ করে দিল।

কমান্ডোদের লক্ষ ছিল শত্রু বাহিনীর শেষ অংশের উপর। প্রথম রাতের পর দ্বিতীয রাতেও একই ঘটনা ঘটলো। দিনে কোন সৈন্যের ছায়াও দেখতে পায়না খৃষ্টান বাহিনী কিন্তু রাতের বেল আক্রান্ত হয় তাদের বাহিনীর পিছন দিকটি। অদৃশ্য গেরিলারা কমান্ডো আক্রমণ চালিয়ে গায়েব করে দেয় স¤্রাট ফ্রেডারিকের বিশাল বাহিনীর একটা নির্দিষ্ট অংশ।

এভাবেই ঘটতে থাকলো ঘটনা। রাতে যখন জার্মান বাহিনী কোথাও ক্যাম্প করতো, তখন সুলতানের কমান্ডো বাহিনী আক্রমণ করতো তাদের। দু’দিনেই শিক্ষা হয়ে গেল ফ্রেডারিকের। তিনি বাহিনীর পেছনের অংশ শক্তিশালী করলেন।

কিন্তু দেখা গেল এবার বিপর্যয় আসছে অন্য দিক থেকে। কমান্ডোরা এবার খৃষ্টানদের তাবু লক্ষ্য করে ছোট মেঞ্জানিক দিয়ে পেট্রোল হাড়ি ও সলতেওয়ালাি তীর বর্ষণ করতে শুরু করলো। এতে জার্মান বাহিনীর সেনা ক্যাম্পে আগুন ধরে গেলো। নিহত ও আহত হলো ঘুমন্ত সৈন্যরা।

পরদিন ফ্রেডারিক ভাবলেন, থাক আর সামনে এগিয়ে কাজ নেই। তিনি সৈন্যদের পিছু হটার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো আইয়ুবীর কমান্ডোরা।

তিনি থেমে গেলেন, থেমে গেল আক্রমণও। আবার তিনি রওনা হতে চাইরৈন পেছন দিকে, আবারও বাঁধার সম্মুখীন হলেন। এভাবে যত বার তিতিন ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন ততোবারই তিনি বাধার সম্মুখীন হলেন।

এরপর তিনি পেছনে ফেরার চিন্তা বাদ দিয়ে আবার সামনে অগ্রসর হওয়া শুরু করলেন। এভাবেই জার্মান বাহিনী একদিন আক্রা শহরের সন্নিকটে গিয়ে পৌছলো।

জার্মান সেনাদল যখন আক্রা পৌঁছলো তখন ফ্রেডারিক দেখতে পেলেন, তার সৈন্য সংখ্যা কমে গিয়ে বিশ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তাদের সৈন্য বাহিনী যখন পবিত্র ভূমিতে পদার্পন করেছিল তখন তাদের সংখ্যা দুই লাক্ষ। একন তাদের মধ্য থেকে এক লক্ষ আশি হাজারই নেই।

তবে তার একলক্ষ আশি হাজার সৈন্যের সবাই যে মারা গিয়েছিল তা নয়। প্রথমে দামেশক আক্রমণের সময় জার্মানীর বিশাল বাহিনীর বহু সৈন্য হাতহত হয়। এরপর সেখান থেকে পিছু হটার সময় ক্ষুধা পিপাসার শিকার হয়ে মারা যায় অনেকে। কিছু মারা যায় অসুখ বিসুখে। একই বিপর্যয় সৈন্যদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। দামেশক থেকে ফেরার পথে এইসব ভীত সৈন্যদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পালিয়ে যায় প্রাণের মায়ায়। এরপর যারা সম্্রাট ফ্রেডারিকের সাঙ্গে ছিল আক্রা আসার পথে সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনীর তীর ও মেঞ্জানিকের নিক্ষেপিত পেট্রোল হাঁড়ির প্রজ্জলিত আগুনে পুড়ে মারা যায় বাকীরা।

 যে বিশাল হাজার সৈন্য আক্রা গিয়ে পৌঁছেছিল তারাও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল। তাদের চোখের সামনে ভাসছিল এক বিশাল বাহিনী, যে বাহিনীর গর্বিত অংশ মনে হতো নিজেকে। সেই বাহিনী ছোট হতে হতে এখন এমন এক ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়েছে, যা দেখে আশাভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়লো তাদের অন্তগুলো। এত তাদের মন তেকে ক্রুশের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নিঃশেষ হয়ে গেলো। এমনকি ক্রুশের প্রতি তারা যে শপথ করেছিল সেই শপথের কথা স্বরণ করার কথাও ভুলে গেল তারা।

ফ্রান্সের স¤্রাট ফিলিপ অগাষ্টাস ও ইংল্যান্ডের স¤্রাট রিচার্ড সমুদ্র পথেে ধেয়ে আসছে, এ খবর আগেই সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা পৌঁছে দিয়েছিল সুলতানকে। তারা জানালো, ইংল্যান্ডের সৈন্য এরই মধ্যে সাইপ্রাসে এসে গেছে।

 এই বাহিনীর সংখ্যা কত সে কথাও গোয়েন্দাদের কাছ থেকে জেনে নিলেন সুলতান। তারা জানালো, ইংল্যান্ডের সৈন্য সংখ্যা ষাট হাজারের মত হবে। ফ্রান্সের সৈন্য সংখ্যাও প্রায় সমপরিমাণ। এদিকে আক্রায় অবস্থান করছিল জার্মানীর বিম হাজার সৈন্য। জেরুজালেম ও আশপাশের খৃষ্টান স¤্রাটদের সৈন্যরাও যুদ্ধ বাঁধওেল তাদের সাথে শামিল হবে এতে সন্দেহ নেই। সুলতান আইয়ুবী ভেবে দেখলেন, খৃষ্টানরা চাইলে তার বিরুদ্ধে এযাবত কালের সবচাইতে বড় সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে পারবে সন্দেহ নেই।

সুলতান আইয়ুবী আরো খবর পেলেন, গে অব লুজিয়ান, যিনি সুলতানের সঙ্গে আর কখনো যুদ্ধে শামিল হবেন না এই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, তিনিও কাউন্ট কোনর‌্যাডকে সঙ্গে নিয়ে পৃথক একটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন। ইতিমধ্যেই এই বাহিনীতে শামিল হয়েছে সাতশো দুর্ধর্ষ নাইট যোদ্ধা, নয় হাজার ফিরিঙ্গী সৈন্য ও বারো হাজার ওলন্দাজ সৈন্য। কিছু ইউরোপীয় সেনা অফিসারও যোগ দিয়েছে এই বাহিনীতে। এভাবে তার সৈন্য সংখ্যাও বাইশ হাজারে দাঁড়িয়ে গেছে।

ছোট ছোট খৃষ্টান স¤্রাটরাও আইয়ুবীর বিরুদ্ধে এটাকে চূড়ান্ত যুদ্ধ গণ্য করে তাদের বাহিনী পাঠাতে শুরু করলো সম্মিলিত বাহিনীতে। মোটামুটি হিসেবে সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনীতে সৈন্র সংখ্যা দাঁড়ালো গিয়ে ছয় লক্ষ।

শুধু ষেন্য সংখ্যা নয়, যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম সব দিব থেকেও ইসলামী সৈন্যদের তুলনায় তারা আশাতীত রকমের শ্রেষ্টত্বের অধিকারী। ফলে এবার সুলতানকে পরাজিত ও নিঃশেস করা সম্ভব হবে এ ব্যাপারে খৃস্টানদের মনে কোন সন্দেহ রইলো না।

অন্যদিকে চিত্র ছিল খুবই করুণ। সুরতানের সৈন্যরা অধিকাংশই ছুটতে বাড়ী চলে গেছে। সুলতান আইয়ুবীর সাথে আছে মাত্র দশ হাজার মামলুক সৈন্য। যদিও এ বাহিনী প্রতিটি সদস্যই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, বিশেষ করে সুলতানে কাছে যুদ্ধের ট্রেনিং পেয়ে নিজেরদ ওপর ছিল তারা পূর্ণ আস্থাশীর, কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে এটা এতই অপ্রতুল যে, এরা কোন হিসাবের মধ্যেই পড়ে না। তবু এদের উপর সুলতানের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। তিনি মনে করতেন, নিবেদিতপ্রাণ দশ হাজার সৈন্য অনায়াসে এক লাখ সৈন্যের মোকাবেলা করে বিজয়ী হতে পারে।

যুদ্ধের জন্য ভৌগলিক কারণে আক্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এখান থেকে স্থলপথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরের সাতে যোগাযোগ রক্ষা করা যেমন সহজ তেমনি সমুদ্র পথ ব্যবহারেরও রয়েছে অবাধ সুযোগ।

আক্রা শহরে সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র দশ হাজার এ সৈন্যের পরিমাণ বাড়ানোর কোন উপায় খুজে পাচ্ছিলেন না তিনি। তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না যে, ছুটি প্রাপ্ত প্রতিটি সৈনিককে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডেকে নেবেন। তার সৈন্য বাহিনীর একটা উল্লেণখযোগ্য অংশ ছড়িয়ে আছে বিজিত অঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে। সুলতানকে ওসব অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন করে রাখতে হচ্ছে এ জন্য যে, ওসব জায়গা থেকে সৈন্য সরালেই তা খৃষ্টানরা পুনরায় দখল করে নেবে।

সুলতান আইয়ুবী বায়তুর মোকাদ্দাসে তাঁর যে বাহিনী আছে তাদের কথা স্বরণ করলেন। ওখান থেকেও কোন সৈন্য সাহায্য পাওয়ার উপায় নেই। ওখান থেকে সৈন্য সরালেই তা আবার দখল করে নেবে ক্রুসেডাররা। সুলতান খবর পেয়েছেন, ক্রুসেড বাহিনী শহরের চারিদিকে একত্রিত হচ্ছে।

সুলতান আইয়ুবী মহা সমস্যায় পড়ে গেলেন। জেরুজালেমের পতনকে বিশ্বের খৃষ্টান সম্প্রদায় তাদের অস্তিত্বের জন্র এক মহা হুমকি বলে গণ্য করছিল। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে রারা দুনিয়া থেকে খৃষ্টানরা এসে একত্রি হচ্ছিল এই মহা সমরে। সুলতানের ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ হানার জন্য যেখানে সমবেত হচ্ছে লাখ লাখ খৃষ্টান সৈন্য, সেখানে সুলতান তার নিজের কোন শহর বা কেল্রা থেকেই কোন সৈন্য সংগ্রহ করতে পারছেন না।

অপরদিকে ধেয়ে আসছে ইংল্যান্ডের বিশাল নৌবহর। এ বাহিনী কেবল শক্তিশালী নয়, ভয়ংকরও। সুলতান আইয়ুবী ভালভাবেই জানেন, মিশরীয় নৌবহর দিয়ে ইংল্যান্ডের এ বিশাল নৌবাহিনীর সাথে কোনভাবেই মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

সুলতান আইয়ুবীর জন্য এ মহা সমস্যা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেকা দিল। তিনি জানতেন, এ সমস্যার মোকাবেলা তাকে করতেই হবে। কিন্তু কিভাবে মোকাবেলা করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। এ যে বড় অসম সংকেত!

অকেগুলো বিজয় অর্জন করার পরও সুরতানের জন্য সময়টা এখন খুবই খারাপ। বিগত চারটি বছর তাঁর  সৈন্যরা একটানা যুদ্ধ করেছে। তাঁর বিস্বস্ত ও সদা তৎপর কমান্ডো বাহিনীও দীর্ঘদিন ধরে বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে, মরুভূমিতে জীবন বাজি রেখে ক্রমাগত লড়াই করে আসছে। এ সব লড়াইয়ে তারা তাদের জীবন অকাতরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

যুদ্ধের গতি লক্ষ করলে এবং তাদের শারীরিক অবস্থা বিচার করলে তারা আর যুদ্ধ করার উপযোগী নেই। এখন তাদের প্রয়োজন একটু বিশ্রাম, একটু প্রশান্তির জীবন।

এ মহা সমস্যায় পড়ে সুলতান আইয়ুবীর অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ালো যে, তিনি আর রাতে ঘুমাতে পারতেন না। তিনি সব সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। যুদ্ধের নতুন কৌশল উদ্ভাবন, ময়দানের নতুন নকশা আঁকা এসব কাজে তিনি এত বেশী নিমগ্ন হয়ে পড়লেন যে, তাঁর শরীর ক্রমেই ভেঙ্গে পড়তে শুরু করলো। দেখতে দেখতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক তাঁকে নিয়মিত অষুধ পথ্য দিতে লাগলেন। এবাবে কেটে গেল তিন চার দিন। চার দিন অসুখে থাকর পর তিনি ডাক্তারের সেবাযতেœ কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু শরীরে আগের মত বল বা শক্তি পাচ্ছিলেন না।

তার বয়স এখন ৫৪ বছর । কিশোর কালে তিনি যুদ্ধের ময়দানে ছুটে গিয়েছিলেন। সারাটা যৌবন তিনি কাটিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। দুর্গম পাহাড়, গভীর জঙ্গল, কঠিন মুরুভূমি সর্বত্র একের পর এক যুদ্ধ করে তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটা জীবন। বিজয়ের পর বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। কিন্তু শেষ বয়সে এমন কঠিন বিপদে পড়বেন, কল্পনাও করেননি তিনি। তার মনে পড়ে গেল, কৈশোরে তিনি বায়তুর মোকাদ্দাস উদ্ধারের কসম খেয়েছিলেন। সে কসম তিনি পূর্ণ করেছেন। তারপর তিনি মসজিদুল আকসার মিম্বর ধরে শপথ করেছেন, “বেঁচে থাকতে আমি বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে ইসলামী পতাকা সরতে দেবো না”। এ শপথের কথা স্বরণ করেই তিনি এখন গুমাতে পারেন না। বিশ্রাম সারা জীবন তার জন্য হারাম ছিল, এখনো হারাম হয়েই রইলো।

আমেরিকান ঐতিহাসিক এ্যান্থনী জুলিয়েট, হেরাল্ড লিম, লেনপোল, গীবন, আর্নল্ড প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, “সুলতান আইয়ুবী সামান্য সুস্থ হয়েই বললেন, ‘আমাকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে চলো’।

তিনি তাঁর বিশ্বস্ত ও জিন্দাদীল সেনাবাহিনীর দশ হাজার সৈন্য আক্রায় রেখেই বায়তুল মোকাদ্দাসে রওনা হলেন। সঙ্গে নিলেন কেবল নিজের রক্ষী বাহিনী।

সৈন্যদের বললেন, “আক্রার জিম্মা আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমি শপথ নিয়েছিলাম, বেঁচে থাকতে বায়তুল মোকাদ্দাসের ইসলামী পতাকা আমি অবনমিত হতে দেবো না। খৃষ্টানরা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে আমাদের সাথে মোকাবেলা করতে আসছে, আমি দবায়তুল মোকাদ্দাসে তাদের সাথে চূড়ান্ত মোকাবেলা করার জন্য চলে গেলাম। বিজিত প্রতিটি অঞ্চলের হেফাজতের জিম্মা পালন করবে নিজ নিজ এলাকার মুজাহিদ বাহিনী। আক্রা যুদ্ধের কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ন স্থান তোমাদের জীবন থাকতে এখানে ক্রুশের পতাকা উড়বে এ কথা আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত বিশ্বাস করবো না।

তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস রওনা হয়ে গেলেন। কমান্ডো বাহিনীকে আগেই জানানো হয়েছিল, তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস রওনা হয়েছেন। তারা তাঁর জন্য আক্রা থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত রাস্তা পূর্ণ নিরাপদ করার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিল। সুলতান আইয়ুবী নির্বিঘেœ বায়তুল মোকাদ্দাস গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি সোজা গিয়ে মসজিদুল আকসায় উঠলেন। সেখানে সিজদায় পড়ে ছেড়ে দিলেন চোখের পানি। ভারাক্রান্ত কন্ঠে আল্লাহর দরবারে কাতর মিনতি করে বলতে লাগলেন, “হে আমার খোদা! আমাকে এমন ভয়াবহ সংকট মুহূর্তে তোমার গায়েবী মদদ দিয়ে সাহায্য করো। তোমার সৈনিকরা আজ এক কঠিন বিপদের মুখোমুখী। আমাদের আর কোন সহায় নেই যার কাছে আমরা সাহায্য চাইতে পারি।

তুমি আমাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করো। তুমি আমাদের এমন ক্ষমতা দাও যাতে আমরা তোমার দ্বীনের দুশমনদের রুখে দিয়ে তোমার বান্দাদের নিরাপত্তা দিতে পারি, তোমার দ্বীনকে হেফাজত করতে পারি।”

এভাবে তিনি কেঁদে কেঁদে আল্লাহর সাহায্য চাইতে লাগলেন।  ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিতিন সারা দিন মসজিদে পড়ে অঝোরে কান্নাকাটি করলেন। সন্ধ্যার পর তিনি যখন তমসজিদ থেকে বের হলেন, তখন তার মুখে ছিল প্রশান্তি। মনে হচ্ছিল যে দৃঢ়তা ও মনোবল নিয়ে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করেছিলেন, তার চেহারায় আবার ফিরে এসেছে সেই দৃঢ়তা।

রাতে সুলতান আইয়ুবী আবার মসজিদুল আকাসায় চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি সিজদায় পড়ে গেলেন এবং অশ্রু ভেজা কন্ঠে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন। তিনি সারা রাত নফল ইবাদত ও দোয়া দরূদ পাঠ করে ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসেন।

সেই রাতেরই ঘটনা । রাতে তিনি যখন মসজিদে গিয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করছিলেন তখন মসজিদের এক কোণে এক ব্যক্তি সারা শরীর কম্বলে ঢেকে ইবাদত বন্দেগী করছিল। সুলতান সারা রাত মসজিদে অবস্থান করেন এবং এবাদত বন্দেগীতে মশগুল হয়ে কাটিয়ে দেন নির্জন প্রহর। সেই লোকও সারা রাত মসজিদে অবস্থান করলো এবং এবাদত বন্দেগী করে সময় কাটিয়ে দিল।

তার ইবাদতের নিজস্ব কোন নিয়ম কানুন ছিল না। মনে হচ্ছিল লোকটি সুলতানকে অনুসরণ করছে। সুলতান সিজদায় গেলে সেও সিজদায় যায় আবার সুলতান মোনাজাতে বসে গেলে দেখা যায় সে লোকও দু’হাত তুলে মোনাজাত করছে। সুলতান নামাজে দাঁড়ালে সেও নামাজে দাঁড়িয়ে পড়তো। সুলতানকে অজিফা আওড়াতে দেখলে সেও অজিফা আওড়াতে শুরু করতো।

লোকটা মসজিদে এসেই মুসল্লীদের থেকে দূরে গিয়ে বসেছিল। এশার নামাজের সময়ও দেখা গেল লোকটি তার চেহারা কম্বল ঢেকে মসজিদের এক কোণে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে। এতে কৌতুহল জাগলো সুলতানের রক্ষীদের। তারা দূর থেকে লোকটির দিকে নজর রাখতে শুরু করলো।

সকালে মুয়াজ্জিন ফজরের আজান দিলেও লোকটি তার অবস্থান থেকে নড়লো না। ওখানে দাঁড়িয়েই সে ফজরের নামাজ পড়লো। তারপর সুলতান মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলে সেও নিজেকে কম্বলে জড়িয়ে রেকে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলো। লোকটি মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় নামলো। এ সময় এক গোয়েন্দা পিছু নিল তার। লোকটি টের পেয়ে পথের ওপর থেমে গেল। দেখাদেখি থেমে গেল গোয়েন্দাটিও।

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top