৮. ফেরাউনের গুপ্তধন

১১৭৪ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। কায়রো থেকে আঠারো মাইল দূরে এক জায়গায় এসে তিনটি উট দাঁড়িয়ে পড়ল। প্ৰত্যেক উটের ওপর একজন করে আরোহী, তাদের শরীর ও মুখ নেকাবে ঢাকা। একজন আরোহী পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করল। তারপর কাগজটির ভাঁজ খুলে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখে সঙ্গীদের বললো, “এই সে জায়গা!’।
সে সঙ্গীদের সামনে অগ্রসর হওয়ার ইশারা করে নিজেও এগিয়ে গেল। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র সঙ্গীরাও তাদের উট সামনে বাড়ালো।
সামনে দুটি টিলা মুখোমুখি দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে। দুই টিলার মাঝখানে চিকন একটি রাস্তা। রাস্তাটি এতই সরু, একটি উটি কোনরকমে যেতে পারে ওই পথে।
তিনজনই লাইন ধরে উটসহ ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরের অবস্থাও একই রকম। দু’পাশে সুউচ্চ দেয়াল। মনে। হয়, কোন পাহাড়ি টিলা নয়, মানুষের তৈরী কোন শক্ত পাঁচিল। পাঁচলটি অনেক দিনের পুরোনো এবং এখানে ওখানে ভাঙা। সেই ভাঙা দিয়ে তাকালে দেখা যায় সীমাহীন বালির সমুদ্র এবং পাহাড়।
অঞ্চলটি তিন-চার মাইলব্যাপী বিস্তৃত। টিলা এবং পাহাড়গুলো কোথাও লম্বা, কোথাও গোল। সর্বত্র ছোট বড় অসংখ্য টিলা • ও পাহাড়ের ছড়াছড়ি। তার মাঝে অল্প কিছু সমতল উপত্যকা।
টিলা ও পাহাড়ে দেবদারু গাছের মত কিছু খাঁড়া স্তম্ভ। স্তম্ভগুলো এত উচু এবং খাড়া যে, মনে হয়, কোথাও কোথাও তা হাজার ফিট উঠে গেছে।
সূর্য্য অস্ত যাওয়ার এখন অনেক বাকী। অথচ এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এখানে, আধার ক্রমেই গ্ৰাস করছে এলাকাটি। স্তম্ভগুলো ভূতের আকৃতি নিতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, অসংখ্য ভূত এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
টিলার খাড়া পাড়গুলো দূর্গম। যেমন উচু তেমন দেয়ালের মত একটানা খাঁড়া। মনে হয়, দিনের বেলায়ও কোথাও কোথাও সূর্যের আলো প্রবেশ করে না।
এই ভূতুড়ে দুৰ্গম পাহাড়ি রাস্তায় অনেক দিন মানুষের পা পড়েনি। কোন কালে কেউ-প্ৰবেশ করেছিল। কিনা তাও ঠিক বুঝা যায় না। মনে হয়, এর ভেতরে কখনও কেউ প্ৰবেশ করার দুঃসাহস করেনি।” ঘাড় ফিরিয়ে সঙ্গীদের বলল ওদের দলনেতা।
কেন করবে? ভেতরে প্রবেশ করার প্রয়োজন হলে তবে তো করবে? মরুভূমিতে যাত্রীদের শুধু পানির প্রয়ােজন হয়। এমন শুকনাে নিরস বালির পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা যেখানে দিনের আলোও ঠিকমত পড়ে না সেখানে পানি খুঁজতে আসবে কোন পাগলে?”
এক সঙ্গী জবাব দিল নেতার প্রশ্নের। আরেকজন বলল জায়গাটা চলাচলের কোন পাশেও পড়ে না। বহু দূর দিয়ে যুওয়ার সময় কোন কাফেলার চোখে পড়লে বলে, কায়রো এখনো আঠারো মাইল দূরে রয়েছে। এই দূরত্ব মাপার কাজ ছাড়া এই মৃত্যু উপত্যকা কোন দিন কারো কাজে লেগেছে?’
লোক মুখে এই এলাকা সম্পর্কে কিছু ভয়ংকর গল্প প্রচলিত আছে। এলাকাটাকে কেউ বলে মৃত্যু উপত্যকা, কেউ বলে শয়তানের পাহাড়। লোকজন বলাবলি করে, এই অঞ্চলে শয়তানের প্ৰেতাত্মারা বাস করে। অভিশপ্ত শয়তানকে যখন আল্লাহ আকাশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তখন শয়তান নাকি এখানে এসে অবতরণ করেছিল। তারপর থেকে শয়তানের প্রেতাত্মারা এই অঞ্চলটিকে তাদের স্থায়ী ঘাঁটি বানিয়ে নেয়।
এই অঞ্চল সামরিক দিক থেকেও এমন কোন গুরুত্ব’ৰ্ণ স্থান নয় যে, সৈন্যদের তা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে, ফলে কখনো কোন সৈন্য বা সেনাবাহিনীও এর ভেতরে প্রশে করেনি।
অঞ্চলটি শুধু দুৰ্গম নয়, নানা কুসংস্কারপূর্ণ গল্পের বারণে ভীতিপ্ৰদও। ফলে মানুষজন কখনাে বালুকারাশিতে পরিপূর্ণ এই মৃত্যু উপত্যকায় আসতে সাহস পায়নি ; মরুভূমির হিংস্র প্রাণী ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই। এই প্রথম তিনজন আগন্তুক এই ভয়ংকর অঞ্চলে প্রবেশ করল। এখানে তাদের কতটা বিপদের মোকাবেলা করতে হবে তার কোন পরোয় করল না তারা।
পায়ে সংকীর্ণ পথে এগিয়ে চলল। কারণ, উট তিনটি নিরূপায়। তাদের চালক যেখানে তাদের চালিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের যেতেই হবে। য : হাজার হাজার বছর আগের পুরোনো একটি নকশা আছে এই অভিযাত্রীদের কাছে। নকশাতে যে জায়গার চিত্র আকা তার সাথে এলাকাটি হুবহু মিলে যায়। শুধু একটি রেখা সামান্য সন্দেহের সৃষ্টি করে। রেখাটি একটি নদীর। কিন্তু তারা প্রচুর ইতিহাস ঘেটে দেখেছে, কোন কালেও এখানে কোন নদী ছিল না।
বিষয়টি তাদের ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়গাটি এক নজর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্যই তাদের আজকের এ অভিযান।
কিছু দূর এগুনাের পর, তারা দেখতে পেল অপেক্ষাকৃত একটি নিচু অঞ্চল লম্বালম্বিভাবে এগিয়ে গেছে। অঞ্চলটি দুই টিলার মধ্যবতী সংকীর্ণ রাস্তা থেকে বেশি দূরে নয়।
একটি ফোকড় গলে সংকীর্ণ জায়গা দিয়ে বেড়িয়ে এল অভিযাত্রী দল। এখন তারা সেই দীর্ঘ নিচু অঞ্চলটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অঞ্চলটি পাশে দশ বারো গজের বেশি নয়।
দলনেতা উটের ওপর থেকে নেমে এল নিচে। হেঁটে নিচু অঞ্চলের বালিয়াড়ির মধ্যে নেমে গেল। সঙ্গী দু’জন উটের ওপর বসে থেকে দেখতে লাগল নেতার কাজকর্ম।
মাঝামাঝি এসে দলনেতা নিচু হয়ে একমুঠো বালি তুলে নিল হাতে। গভীর মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা করল। হাতের বালি ভরে উঠল তার হৃদয়-মন। সে নিশ্চিত, শত শত বছর আগে এখান দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো। এই নিম্নাঞ্চল নিশ্চয়ই কোথাও আটকে না গিয়ে কোন গতিপথ ধরে নীলনদের দিকে চলে গেছে।
সে ফিরে এল উটের কাছে। সঙ্গী আরোহীদের আশ্বস্ত করে বললো, “আমরা ঠিক জায়গায়ই এসে পৌঁছেছি।”
এই আরোহীদের দলনেতা ইটালীর মার্ক লী। সে নিজে এবং সঙ্গী দুজনও খৃস্টান। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিশ্বস্ত কমান্ডার আহমদ দারবীশ গোপনে খৃস্টানদের সাথে হাত মিলিয়ে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর অনুসন্ধানে পাঠিয়েছে|
নকশা অনুযায়ী ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছেছে। ওরা। এই মৃত্যু উপত্যকাতেই আছে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর।
এতে আরোহীদের খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু মার্ক লী খুশি হতে পারলো না। অঞ্চলটি লম্বা এবং প্রস্থ উভয় দিকেই কয়েক মাইল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে কয়েক হাত লম্বা একটি কবর খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।
মার্ক লী তার সঙ্গীদের বললো, “এই সে জায়গা, নিজেকে খোদা বলে দাবী করত যে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্স, তার শেষ আশ্রয়স্থল। তাকিয়ে দেখো এর বিপুল বিস্তৃতি। আহমদ, দরবীশ ও হরমন আমাদেরকে এক ব্যর্থ অভিযানে পাঠিয়ে দিয়েছে। এত বড় এলাকা চষে একটি কবর খুঁজে বের করা কেবল কঠিন নয়, বলতে গেলে অসম্ভব। তারা আমাদেরকে দিয়ে এমন এক অসাধ্য সাধন করতে চায়, হাজার বছর ধরে চেষ্টা করেও মানুষ যা জয় করতে পারেনি।”
সঙ্গীরা অভিযানের গুরুত্ব অনুধাবন করে কেমন বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পড়ল। এ অভিযানে তাদের ব্যক্তিগত কোন আগ্ৰহ ছিল না। তারা চাচ্ছিল ফিরে যেতে। কিন্তু কমাণ্ডারকে এমন কোন পরামর্শ দেয়ার সাহস ছিল না। তাদের। তারা তো হুকুমের গােলাম। মার্ক লী এক কঠিন হৃদয়ের কমাণ্ডার। সহজে হার মানার পাত্র সে নয়। নিজের বুদ্ধি ও সাহসের ওপর যথেষ্ট আস্থা নিয়েই কাজ করে সে। কাজের সময় অহেতুক বাগড়া দেয়াকে সে পছন্দ করে না।
আগে আগে যাচ্ছে মার্ক লী, পেছনে সঙ্গী দু’জন। ওরা যত এগুলো ততই ওরা দেখতে পেলো পার্বত্য অঞ্চলের রূপ ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। এখানকার মাটির রঙ ঘন বাদামী। কোথাও তা পাল্টে গিয়ে দেখা যাচ্ছিল খয়েরী, কোথাও বা লাল মেটে-রঙ।
বালির পাহাড়ের পাশেই কোথাও ছােট্ট একটু উপত্যকা। তার পাশেই হয়ত কোন টিলা সোজা খাড়া হয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে।
ধীর পায়ে এগুচ্ছে দলটি। এগুচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে আশপাশের পরিবেশ।
হঠাৎ ডান দিকে টিলার মাঝখানে একটি ফাটল নজরে পড়ল মার্কালীর। দেখে মনে হয় কোন প্রবল ভূমিকম্প এসে দেয়াল ফাঁক করে দিয়ে গেছে।
মার্ক লী ফাটলটির কাছে এসে বাইরে চােখ রাখল ; দেখল, সে ফাটল একটি সরু গলি তৈরী করেছে। গলিটি বহুদূৰ পৰ্যন্ত চলে গেছে, এত দূর যে শেষ মাথা দেখা যায় না।
গলিটিতে প্ৰবেশ করার সিদ্ধান্ত নিল মার্ক লী। কিন্তু গালিটি এতই চিকন যে, ওই পথে উট নিয়ে প্ৰবেশ করা কষ্টকর।
মার্ক লী কোন বাধাই মানলো না, সে তার উট সেই ফাটলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।
উটের হাটু দুই পাশের দেয়ালে ঘষা খাচ্ছে। মার্ক লী নিজের পা গুটিয়ে উটের পিঠের ওপর তুলে দিল। অন্য আরোহীরাও তাই করল।
আরোহীর নির্দেশে এগিয়ে যাচ্ছে উট, তাতে দেয়ালের গায়ে বার বার ঘষা খাচ্ছে তার শরীর। উটের হাটুর বাড়ি ও গায়ের ঘষার ফলে দেয়ালের মাটি নিচে খসে পড়ছে।
ফাটলের দু’পাশের দেয়াল অনেক উঁচু। উটের ধাক্কা খেয়ে কেঁপে উঠতে লাগল সে দেয়াল। আরোহীদের মনে হতে লাগল, এই বুঝি তা ভেঙে ওদের ঘাড়ের ওপর পড়বে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি।
একবার যদি তাতে ধ্বস নামে। তবে আরোহীসহ পিষে যাবে সবাই। তাই, মার্ক লীসহ সবাই খুব সাবধানে অগ্রসর হতে লাগল।
পথটা ক্রমেই উপরের দিকে উঠে গেছে। যথেষ্ট সতর্কতার সাথে অনেকটা পথ এগুনোর পর ওরা দেখতে পেল, দূরে, অনেক উপরে টিলার দুই পাশ এক হয়ে মিশে গেছে।
দুপাশের দেয়াল উঁচু থাকায় ওদের পথটা ছিল অন্ধকার, তবে উপরের দিকে আলো দেখা যাচ্ছে। এ থেকে তারা বুঝতে পারলো, দিনের আলো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আর যেখানে পথটা শেষ হয়েছে তারপরে নিশ্চয়ই প্ৰশস্ত কোন উপত্যকা আছে।
গলি ক্রমশ: সুড়ঙ্গের আকার ধারণ করলো। উটের পায়ের শব্দ ধ্বনি-প্ৰতিধ্বনি তুলে ভীতিকর আওয়াজে রূপান্তরিত হলো। এতেও মার্ক লী থামলো না, সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়েই চললো। ”
এক সময় অন্ধকার কমে গিয়ে আলোর বিস্তৃতি ঘটতে শুরু। করল। মার্ক লী বুঝল, সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে এসেছে প্ৰায়। একটু পরেই তারা সুরঙ্গের মুখে গিয়ে উপস্থিত হল।
উটের পিঠে থাকায় সুড়ঙ্গের মুখের সমতল জায়গাটি তারা হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে গেল-ৰ সহজেই তারা নেমে এল সেখানে। কিন্তু উটকে উপরে তোলা তত সহজ হলো না। অনেক কসরত করে, রশি দিয়ে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে অনেক কষ্টে উটকে টেনে আনা হল।
মানসিক চাপ ও শারীরিক কসরতের কারণে সবাই খুব কাহিল হয়ে পড়েছিল। তিনজনই বসে পড়ল মাটির ওপর।
একটু সুস্থির হয়ে নজর বুলালো আশপাশে। দেখলো সেখানে একটি বড় দুর্গের দেয়াল এখনাে মাথা খাঁড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।
মার্ক লী দুর্গটির কাছে গেল। এটি কোন মানুষের সৃষ্ট দুর্গ ছিল না, বরং এ ছিল প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এক কেল্লা। চারপাশের পাহাড়ের আকৃতি এমন ছিল যে, বাইরের দিকটা ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। ফলে, চারদিক থেকে আবদ্ধ হয়ে এলাকাটি দুর্গের রূপ নিয়েছে। পাহাড়ের উচু নিচু চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছিল দুর্গের গম্বুজ।
মার্কলী সঙ্গীদেরকে উটগুলো সেখানেই বসিয়ে দেয়ার জন্য বলল।
উটগুলো বসিয়ে দেয়ার পর ওরা পায়ে হেঁটে দুর্গ এলাকাটা ঘুরে দেখতে শুরু করলো।
পাহাড় ঘেরা দুর্গটা গোলাকার। পা টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছে ওদের। কারণ, বালি মিশ্ৰিত মাটিতে পা দিলেই ঢালুর দিকে হড়কে যাচ্ছিল পা। কোন চলাচলের রাস্তা ছিল না। ওখানে। এই বালি ও মাটিই প্ৰমাণ করছে, শত শত বছর ধরে কোন পা পড়েনি এখানে।
আগে আগে চলছে মার্কালী, সঙ্গীরা তার পিছনে। হঠাৎ প্ৰাণ ছ্যাৎ করে উঠল মার্ক লীর। সে কথা বলতে চাইল, কিন্তু কণ্ঠনালী স্তব্ধ হয়ে গেছে তার। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে, পা দুটাে যেন মাটির সাথে গেথে গেছে।
সঙ্গীরাও থমকে দাঁড়াল। মার্ক লী কেন দাঁড়িয়েছে বুঝার চেষ্টা করছে তারা। মার্ক লী যেদিকে অবাক করা চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে তাকাল তারা। দেখল, সামনে, এখান থেকে সোজা নিচের দিকে পাহাড়েরই একটা অংশের ওপাশে একটা মন্দির দাঁড়িয়ে আছে।
মার্কলী বলল, “ওটা কি কোন মন্দিরের চূড়া।”
‘চোখের সামনে জ্বলজ্যান্ত একটা মন্দির দেখেও আপনি জিজ্ঞেস করছেন!’ সঙ্গীদের চোখে অজানা, আশার বিলিক খেলে গেল।
ওরা পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে পা টিপে টিপে চলছিল। বাম দিকে বহু দূর খাড়া নেমে গেছে পাহাড়ের শক্ত দেয়াল। ওদিকে তাকালে মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। অনেক নিচে দেখা যায় এবড়ো থেবেড়ো বালি ও পাথরের স্তুপ। পা পিছলে কোন রকমে সেখানে একবার গড়িয়ে পড়লে হাড়গোড় ছাতু হয়ে যাবে। তাই খাদের উল্টো দিক দিয়ে পা টিপে টিপে এগুচ্ছিল ওরা।
রান্তাটা ভয়ানক দুৰ্গম। বিপদজনকভাবে সরু ও খাড়াভাবে নেমে গেছে বেশ কিছুটা পথ। মার্ক লীর সঙ্গীদের বুকটা দুরুদুরু করে উঠল। একজন তো তাকে জিজ্ঞেসই করে বসলে, “আপনি কি মনে করেন, ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের লাশ এই বিপদসংকুল পথ দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?’,
আহমদ দরবেশের নকক্সা তো তাই বলে, মার্ক লী বললো, “যে পর্যন্ত আমি নকশা বুঝতে পেরেছি। তাতে যাওয়ার রাস্তা। এটিই। রিম্যান্সের লাশের বাক্সটি হয়তো অন্য কোন পথে। পথ থাকতে পারে। সে সব গোপন পথের সন্ধান পরে করবো। আগে নকশার নির্দেশ মত কত দূর যাওয়া যায় দেখতে চাই।”
“এ ধরনের অভিযানে গোপন পথই সাধারণত অভিযাত্রীকে তার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে কেউ গুপ্তধন বয়ে বেড়ায় না।” এক সঙ্গী তার মতামত ব্যক্ত করল।
“আমারও মনে হয় যে, গোপন রাস্তা দিয়েই সম্রাটের লাশ বহন করা হয়েছে। আমাদের তা খুজে পেতে হবে। তাহলেই কেবল তার কবর পর্যন্ত যাওয়ার আশা করতে পারি। আমরা।”
“তোমাদের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি না। তবে মনে রাখতে হবে, শত শত বছর ধরে প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞা এবং বাতাসের তোড়ে পৃথিবীর মানচিত্র অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এতকাল পর সে সব গোপন রাস্তা আন্দেী আছে কি নেই, তাই তো আমরা জানি না! আমি তোমাদের নিয়ে অন্ধের মত মরুভূমিতে সুই খুঁজতে চাই না। তারচে নিশানা ধরে এগিয়ে দেখতে চাই এই সব নকশা আসলেও কোন কাজের কিনা? নকশা ঠিক থাকলে কবর পর্যন্ত আমরা পৌঁছেও যেতে পারি।” বলল মার্ক লী।
“যদি বেঁচে থাকি!” হতাশ কণ্ঠে বলল তার এক সঙ্গী।
‘কোন সন্দেহ নেই।” মার্ক লী বললো, তবে কবর খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকলে আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না।’
একটা পাথরের সাথে রশি বেঁধে, রশি ধরে ঝুলে তারা অনেক কষ্টে সেই বিপদজনক পথটুকু পার হয়ে এল।
আস্তে আস্তে রাস্তার প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়তে লাগল। কিছু দূর নিচে নামার পর রাস্তা আবার ওপর দিকে উঠতে শুরু করল।
এখন তারা পাহাড়ের এমন জায়গা পাড়ি দিচ্ছিল, যেখানে দুটি পাহাড় একত্রে মিশে চূড়ার দিকে এগিয়ে গেছে এবং সেখান থেকে আবার শুরু হয়েছে বিপদজনক ঢাল। মার্ক লী সেখানে পৌঁছে ঢাল বেয়ে সোজা নিচে না নেমে বাম দিকের পাহাড়ে আরোহণ করতে লাগলো।
প্ৰায় একশো গজের মত উপরে উঠার পর তাদের সামনে একটি সুড়ঙ্গ পথ চোখে পড়লো। মার্ক লী সঙ্গীদের নিয়ে সেই সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে পড়ল। পথটি ক্রমশ: নিচের দিকে চলে গেছে।
সুড়ঙ্গ পথে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল ওরা। তারপর সহসাই সুড়ঙ্গ শেষ গেল এবং তারা ছোট একটুখানি ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এল।
ফাঁকা জায়গায় এসেই তারা সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল দূর দূরান্ত পর্যন্ত পাহাড়ের অসংখ্য ছোট বড় স্তম্ভ আকাশের দিকে মুখ ব্যাদান করে দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভগুলো নিরেট পাথরের এবং পরস্পর গায়ের সাথে লাগানো। প্রতিটি স্তম্ভ থেকেই অসংখ্য চােখা মাথা বেরিয়ে আছে। দৃশ্যটা খুবই ভীতিজনক। এসব স্তম্ভ না মাড়িয়ে সামনে এগুনাের আর কোন পথ নেই। অথচ তা মাড়াতে গেলে হাত-পা জখম হওয়ার আশংকা ষোল আনা।
খুবই সতর্কতার সাথে কঠিন পাথরের ফাঁক গলে ওরা ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগলো। কয়েকবার বঁােক ঘুরে ডানদিকে আবার একটু খোলা জায়গা পেল ওরা। জায়গাটুকু গোলাকার। একটা মঞ্চের মত। এখানকার আবহাওয়াই শুধু নয়, পায়ের নিচের মাটিও অসম্ভব গরম বোধ হলো। আশপাশের পাহাড়গুলোতে শেষ বিকেলের রোদ চমকাচ্ছে।
মার্ক লী অনুভব করলো, এখানকার মাটিতে এমন কোন ধাতু মিশ্ৰিত আছে যে কারণে এলাকাটা উত্তপ্ত হয়ে আছে। গোল মঞ্চসদৃশ এই উপত্যকার চারদিকই পাহাড় ঘেরা। এক পাশে কয়েক গজ লম্বা একটি ফোঁকড়া। ওরা সেই ফোঁকড়ের | কাছে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে তিনজনই পিছনে সরে এল। ওরা দেখল, ফোঁকড়ের মুখ পর্যন্ত অনেক গভীর ও বিশাল এক খাদ্য। খাদের তলদেশে উত্তপ্ত বালুকা রাশি চমকাচ্ছে এবং সেখান থেকে একেবেঁকে কম্পমান ধোঁয়া উঠে আসছে উপর দিকে। ইটের ভাটায় আগুন জ্বালাবার সময় যে কাল ধোঁয়া বেরোয় এর ধোঁয়া তেমন কাল নয়, বরং ডায়িং ফ্যাক্টরীর বাম্পের মত সাদা।
এই গভীর খাদের মাঝখানে একটি প্রাকৃতিক দেয়াল। দেয়ালটি চওড়ায় মাত্র এক গজ, নিচে উপরে সমান চওড়া। যদি মার্ক লীদের ওপারে যেতেই হয় তবে এ প্রাচীর পার হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। দু’পাশের পাহাড়চূড়া এত উচু যে তা টপকানোর প্রশ্নই উঠে না।
মার্কালীর মনে হল, সে এখন পুলসিরাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই পথটুকু পার হতে পারলেই সামনে বেহেশত। বেহেশতে তাকে যেতেই হবে এবং পঞ্চাশ গজের মত দীর্ঘ এই দেয়ালঃ পার হতে হবে তাকে।
মার্ক লীর এক সাখী বললো, “এই দেয়ালের ওপর দিয়ে যাওয়ার চেয়ে আমাকে আত্মহত্যার অন্য কোন উপায় বলে দিন।’
‘গুপ্তধনের ভান্ডার রাজপথে পড়ে থাকে না!” মার্ক লী বললো, “আমাদের এ রাস্তা পার হতেই হবে।’
“কিন্তু টুপ করে নিচের জাহান্নামে গিয়ে পড়লে ওই গুপ্তধন খাবে কে?” অপর সঙ্গী বললো।
“আমরা কি পবিত্র ক্রুশ জুয়ে শপথ করিনি, ইসলামের ধ্বংস সাধনের জন্য আমরা এ জীবন উৎসর্গ করবো?” মার্ক লী বললো, ‘যুদ্ধের ময়দানে কি আমাদের সঙ্গীরা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে না?”
লড়াইয়ের ময়দানে জান দেয়া আর বেহুদা আগুনে ঝাপ দেয়া এক কথা নয়। আমরা ইচ্ছে করলেই এখান থেকে ফিরে গিয়ে আহমদ, দারবীশকে বলতে পারবাে, শত শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এখন আর নকশার রাস্তা খুঁজে পাওয়ার কোন উপায় নেই। সে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে নদী ছিল সেখানে ধুধু বালি ও পাহাড়ী প্রান্তর। আর নক্সার যেখানে পাহাড়ী উপত্যকা দেখানো হয়েছে সেখানে এখন কিছুই নেই।”
“কিন্তু আমি কাপুরুষ হতে পারবো না। মিথ্যা কথাও বলতে পারবো না। এই দেয়াল আমার মনেও ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি সে ভয় তাড়িয়ে দিয়েছি। তোমরাও ভয় ডর মুছে ফেলো মন থেকে। এ প্রাচীর বেয়ে আমি ওপারে যাবােই। আমাকে সঙ্গ না দিলে তােমরা ক্রুশের কাছে প্রতারক বলে সাব্যস্ত হবে। আর প্রতারকদের শাস্তি খুব বেদনাদায়ক হয়। আমি আগে আগে যাচ্ছি, তোমরা আমার্কে অনুসরণ করো। মাথা চক্কর দিলে বা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে বসে পড়ে আত্মরক্ষা করবে। এমনভাবে বসে যাবে, যেন ঘোড়ার পিঠে। চড়ে বসেছে। সাহস ফিরে এলেই আবার এগুতে থাকবে।”
সহসা সেই গরম বাতাস জোরে বইতে শুরু করল। বালি উড়তে লাগলো। সেই সাথে খাদের ভেতর থেকে ভেসে এল মেয়েদের কান্নার স্বর। যেন দু’তিনজন নারী এক সাথে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
মার্কলী ও তার সঙ্গীরা কান খাড়া করে শুনতে লাগলো সে কান্নার ধ্বনি। কান্না শুরু হয়েছিল মিহি সুরে বিলাপের মত, এখন তার পরিবর্তে ভেসে আসতে লাগল বিকট আওয়াজ! মার্ক্স লী ও তাঁর সঙ্গীরা ভয় পেয়ে গেল।
এই জাহান্নামে কোন মানুষই বেঁচে থাকতে পারে না। নিশ্চয়ই এসব প্রেতাত্মার কাণ্ড!” ভয়ে ভয়ে বলল এক সঙ্গী।
না, এ কোন মানুষের কান্না নয়।” মার্ক লী বললো, “কোন প্ৰেত্নাত্মা বা কোন জীবিত প্রাণীর স্বরও নয়! এটা বাতাসের খেলা। বাতাস একটু জোরে বইতে শুরু করায় কোথাও আঘাত খেয়ে ঐ সুরের সৃষ্টি হয়েছে। বাঁশিতে যেমন বাঁশরিয়া ফু দিয়ে সুর তোলে, তেমনি কোথাও এমন কোন ছিদ্র বা সুড়ং আছে যাতে বাতাস ঢুকে এ রকম সুর ও আওয়াজ তুলছে। বাতাস য’ত জৈারে বইবে সুর তত বিকট হবে। এতে ভয় পাবার কিছু নেই।’
মার্ক লীর কথাই সত্যি, এ অঞ্চলের বিভিন্ন টিলার মধ্যে লম্বা লম্বা সুডুং ছিল। বাতাস সে সুডুংগুলোর এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতো। যখন এ বাতাস তোছরাভাবে বইতো তখনি এ ধরনের ধ্বনি শোনা যেতো। দমকা বাতাস প্রবল বেগে বইতে শুরু করলে মনে হতো প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করছে একদল ডাইনী।
নিচে গভীর ও বিস্তৃত খাদ। চারপাশে ভয়ালদৰ্শন উলঙ্গ পাহাড় আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো কান্নার আওয়াজ যে কাউকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মার্ক লীকে তা ভীত সন্ত্রস্ত করতে ব্যর্থ হলো।
কিন্তু তার সাথীদের উপর ভীতি এমন প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করল যে, মার্ক লীর এত কথার পরও তাদের মন থেকে সে। ভয় দূর হলো না। তারা এই আওয়াজকে বাতাসের কারসাজি বলে মানতে পারছিল না। তাদের মনে হচ্ছিল, পাশেই কোথাও নারী ও প্ৰেতাত্মারা ক্ৰন্দন করছে। যে কান্নার ধ্বনি তারা নিজ কানে স্পষ্ট, শুনতে পাচ্ছে। মার্ক লীর যুক্তিতর্ক এ সত্যকে আড়াল করতে পারছে না।
বাতাস প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল কান্নার কোরাস। . বাতাসের তোড়ে উড়ে আসা। ধুলোবালির ঝাপটা লািগছিল ওদের চােখে মুখে। সেই সাথে ছিল স্নায়ুতন্ত্রে আঘাতকারী কুয়াশা রঙের ধোঁয়া। জমিন থেকে দূর দৃষ্টি যাচ্ছিল না। মার্ক লী ও তার সঙ্গীরা এই প্রাকৃতিক দুৰ্যোগ মাথায় নিয়ে ওভাবেই ওখানে দাঁড়িয়ে রইল। ”
বেশ কিছুক্ষণ ওখানে অপেক্ষা করার পরও মার্ক লী যখন দেখল দুৰ্যোগ মােটেই কমছে না। তখন সে সঙ্গীদের বলল, “এখানে বেশীক্ষণ থাকলে তোমরা পাগল হয়ে যাবে। এর থেকে নিস্তার পেতে চাইলে ওপারে চলো।”
এই দুর্যোগের মধ্যেই মার্ক লী দেয়ালের উপর প্রথম পা রাখল। দুর্যোগের ফলে একটা সুবিধা হলো তার, ভয়াবহ খাদের নিচ পর্যন্ত দৃষ্টি গেলে মাথায় যে চক্কর দিত। তার হাত থেকে বেঁচে গেল সে।
মার্ক লী পা দিয়েই বুঝল, দেয়ালটি খুবই কাঁচা এবং দুর্বল। প্রাচীরের বালি ও মাটির মধ্যে পা দেবে গেলো তার। কিন্তু তাতে তার সংকল্পে কোন বিঘ্ন ঘটলো না। সে তার দ্বিতীয় পাটিও তুলে আনলো প্রাচীরের ওপর। নিজের অজান্তেই নিচের দিকে দৃষ্টি চলে গেল তার। খাদের গভীরতার কথা মনে হতেই আপাদমস্তক কেঁপে উঠলো সর্ব শরীর। কিন্তু তলদেশ চোখে না পড়ায় ভয়কে সে তাড়িয়ে দিতে পারলো।
মার্ক লী কয়েক কদম এগিয়ে গেল। ক্ৰন্দনের আওয়াজ আরও বেড়ে গেল মনে হয়। এখন তার পায়ের নিচে ভঙ্গুর দেয়াল, দুই পাশে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন গভীর খাদ। ডানে-বায়ে ধরার মত কোন কিছু নেই। প্রবল বাতাসের ঝাপটা লাগছে মার্ক লীর গায়ে। দমকা হাওয়ার ধাক্কায় একদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে শরীর। দেহের ওজন মনে হচ্ছে কমে যাচ্ছে।
সে ঘাড় ঘুরিয়ে সাখীদের বললো, “ভয় নেই, সাহস করে পা রাখো, দেখবে আমার মতই চলতে পারছো ! ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে অগ্রসর হও! নিচের দিকে মােটেই তাকাবে না। মনে মনে কল্পনা করো, তোমরা মাটির উপর দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে চলছো।’
সঙ্গী দু’জন অসহায়ভাবে একে অন্যের দিকে তাকাল। মার্ক লীকে ছাড়া একাকী ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় হচ্ছিল। ওদের, আবার মার্ক লীর মত দেয়াল পাড়ি দিতেও ওদের বুক। দুরুদুরু করে কাঁপিছিল।
মার্ক লীর তাগাদা পেয়ে একজন অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মত। দেয়ালের উপরে পা তুলে দিল। তার দেখাদেখি অন্যজনও। উঠে এল প্রাচীরের ওপর। কয়েক কদম এগুনোর পর যখন সে। বুঝতে পারল দেয়ালের ওপর উঠে এসেছে তখনই একজনের গা কাঁপুনি শুরু হল। কাঁপতে কাঁপতেই কয়েক কদম অগ্রসর। হয়ে গেল লোকটি। তারপর দুলতে দুলতে যখন মনে হলো। সে পড়ে যাচ্ছে, দেয়ালের ওপর বসে পড়ে আঁকড়ে ধরল।
সঙ্গীর অবস্থা দেখে অন্যজনের মনেও এ ভয় সংক্রামিত হল, সাথে সাথে কাঁপতে কাঁপতে সেও বসে পড়ল প্রাচীরের ওপর। অবস্থাটা এখন আরো নাজুক হয়ে উঠল। সামনে। এখনাে অনেক পথ বাকী, পেছনে ফিরে যাবে সে উপায়ও নেই, কারণ দেয়াল এতই সংকীর্ণ যে এখানে ঘুরে বসার কুঁকিও নিতে পারছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে সঙ্গী দু’জন স্থবির হয়ে মরার মত পড়ে রইল দেয়ালের ওপর।
মার্ক লী তাদের মনোেবল বাড়াতে চাইল। বলল, “ঠিক আছে, তোমাদের আর উঠে দাঁড়াবার দরকার নেই। হামাগুড়ি ওরা সম্মোহিতের মত মার্ক লীর হুকুম তামিল করল। প্ৰায় অর্ধেক পথ এগিয়ে এসেছে ওরা। মাঝামাঝি পৌঁছে, মার্ক লী দেখলো, মাঝখানে দেয়াল একটু ভাঙ্গা ও নিচের দিকে ঢালু হয়ে গেছে। সেখানে চওড়া এত কম যে, দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এবার মার্ক লীও বসে পড়লো।
সঙ্গীরা বসে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছিল, সে তাদের মত বসলো না। ঘোড়ার আরোহীরা যেভাবে দুই, ঠ্যাং দুই দিকে বুলিয়ে দিয়ে বসে সেভাবে দেয়ালের দুদিকে পা বুলিয়ে বসলো সে। দেয়ালের চওড়া ক্রমশ কমে আসছিল। মার্ক লী দুহাত দুদিকে দিয়ে লেংড়া মানুষের মত ঘষটে ঘষটে আস্তে করে নিচে নেমে গেল এবং ভাঙা অংশটুকু পার হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তাকে অনুসরণ করে তার এক সাখীও পার হয়ে এল ভাঙা অংশ। কিন্তু তৃতীয়জন ভাঙা জায়গায় নামতে গিয়ে হঠাৎ পিছলে গেল। তাল সামলাতে গিয়ে পাশ থেকে ছুটে গেল তার হাত। ভয় ও আতংকে আর্ত চিৎকার করে উঠল। লোকটি, মার্ক লী আমাকে ধরে।” |
কিন্তু তার কাছে এগিয়ে যাওয়ার সময় পেল না কেউ। তার আগেই সে একদিকে ছিটকে পড়ল। বাঁচাও” বলে বুক ফাঁটা একটা,আর্ত চিৎকার শুধু শুনতে পেল ওরা, কিন্তু তাকে আর দেখতে পেল না। সেই চিৎকারের শব্দ আস্তে আস্তে নিচের দিকে নেমে গোল এবং ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এক সময় মিলিয়ে গেল।
তারা তার পতনের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে রইল, কিন্তু তেমন কোন শব্দ শুনতে পেল না। বাতাসে ভেসে বেড়ানাে নারী কণ্ঠের আর্ত চিৎকারের নিচে চাপা পড়ে গেল তার পতনের শব্দ। মার্কালী নিচে তাকালো, কিছুই দেখা গোল না।
সঙ্গীর মরণ চিৎকার তখনও কানে বাজছিল ওদের, আতংক গ্রাস করে ফেলেছিল ওদের চিন্তা চেতনা। পড়ন্ত বিকেলের স্নান আলোয় মার্কলী ও তার সঙ্গীটি সেই ভয়ানক খাদের মধ্যে সংকীর্ণ ভঙ্গুর দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে বোবা চােখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল।
“তুমি আমাকে সাথে সাথে রেখো মার্ক লী। তার এখনকার একমাত্র সঙ্গীটি বলল, “আমি এমন মৃত্যু চাই না।’, ভয়ে তার গলা কঁপিছিল।
তার মনোবল বাড়ানো ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না। সে বলল, “সামনে আর কোন বিপদজনক ভাঙা চােখে পড়ছে না। মনে হয় বাকী পথ নিরাপদেই যেতে পারবাে।”
মার্ক লী আবার এগিয়ে যেতে শুরু করলো। তার প্রায় গা ঘেষে চলল তার সঙ্গী। দমকা বাতাসের বেগ আগের চেয়েও তীব্র আকার ধারণ করল। শরীরের ভারসাম্য রক্ষা শেরে পথ। চলা কঠিন হয়ে দাঁড়াল ওদের পক্ষে। বাধ্য হয়ে আবার বসে। পড়ল মার্ক লী। দু’জন ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলো।
এখানে দেয়াল আরেকটু চওড়া। মার্ক লী উঠে দাঁড়াল এবং ঘুরে সঙ্গীর হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। দেয়াল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্ৰাণে আশার আলো জ্বলে উঠল। ওদের ; দুই টিলার মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ একটি রাস্তার মুখে শেষ হয়েছে দেয়াল। ওরা দু’জন সেই সংকীর্ণ রাস্তায় প্রবেশ করলো।
মার্ক লীর সঙ্গী বললো, “জেফ্রে হয়ত মরে গেছে। তার পরিণতির কথা ও অন্তিম চিৎকার আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।”
মার্ক লী তার দিকে তাকাল, দেখল, তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। কিছু না বলে সে সঙ্গীর কাধে হাত রাখল এবং তাকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।
সংকীর্ণ পথ আস্তে আস্তে চওড়া হতে লাগলো। মার্ক লী তার সাখীকে বললো, “আমাদেব ভাগ্য ভাল, যে দিকেই যাই একটাই রাস্তা সামনে পড়ে। একাধিক রাস্তা হলে বিভ্ৰান্তির মধ্যে পড়ে যেতাম।”
এক সময় গলিপথ শেষ হয়ে এল। প্রশস্ত হতে হতে কেবারে মুক্ত ময়দানে এসে পড়ল ওরা। ময়দান পার হয়ে প হাড়ের ঢালে উঠে এল। ঢালটি ক্রমশ উপর দিকে উঠে গেছে। বাতাস তখনও বেগে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এই ভয়াবহ এলাকার কতটুকু গভীরে ওরা চলে এসেছে। এ নিয়ে মাক লীর কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। সে জানতো, দুনিয়ার লোকসমাজ থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অসম্ভব জেনেও সে এ পথে পা বাড়িয়েছে। হয়তো তার সামনে আরো অসংখ্য বিপদ ওঁৎ পেতে আছে। তবু এর শেষ কোথায় সে দেখতে চায়।
জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই এ বিপূদসঙ্কল পথে পা বাড়িয়েছে সে। নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন নয়, ফেরাউনের এ গুপ্তধন প্রয়ােজন তার জাতির জন্য। এখান থেকে উদ্ধারকৃত মহামূল্য সম্পদ সে ব্যবহার করবে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে করে দেবে এ ধনরত্ব। ধূলায় মিশিয়ে দেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর স্বপ্নসাধ। বিশ্বব্যাপী কায়েম হবে খৃস্টান সাম্রাজ্য। এ উদ্দেশ্যেই সে এই অভিযানে বেরিয়েছে।
সে তার ভীতিসন্ত্রস্ত সঙ্গীকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। সামনের দিক থেকে বাতাস আসছিল। পাহাড়টি আগেরগুলোর মত কন্টকাকীর্ণ ও বিপদসংকুল ছিল না। এর চড়াইগুলোও ছিল সহনীয়।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা পাহাড়ের প্রায় চূড়ায় উঠে এল। উপরের। দিকে তাকাল মার্ক লী। নির্মেঘ আকাশ দেখা যাচ্ছে, সে একটু দাঁড়াল। লম্বা করে শ্বাস টেনে বাতাসের গন্ধ নিল। বললো, ‘ওঁকে দেখো, বাতাসে এখন আর মরুভূমির রুক্ষতার গন্ধ নেই।’
“তোমার আসলে মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’ তার সাখী। বললো, মরুভূমিতে মরুভূমির গন্ধ থাকবে না তো কিসের গন্ধ থাকবে? তুমি কি বাতাসে এখন ঝর্ণা, সবুজ ঘাস ও সোঁদা মাটির গন্ধ পাচ্ছে?”
মার্ক লী চােখ বন্ধ কৰে জোরে জোরে শ্বাস টেনে গভীর মনযোগের সাথে বাতাসের ভ্ৰাণ নিচ্ছিল। আর বলছিল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, এ রকম উষর মরুভূমিতে পানির আশা করা যায় না। আমি হয়ত আন্দাজেই খেজুরের বাগান, সবুজ ঘাস ও পানির ঘাণ নিচ্ছি। হয়তো আমার ঘণ নেয়ার অনুভূতি আমাকে ধোকা দিচ্ছে। নইলে এই জাহান্নামে পানির ঘাণ আমি পাবো কেন! কিন্তু আমার ঘাণশক্তি প্ৰবল এবং এই ঘাণ আমার পরীক্ষিত।
মার্ক লী!” সাখী তার হাত টেনে ধরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, ‘আমিও একটি স্বাণ পাচ্ছি, সেটি মৃত্যুর ঘ্ৰাণ। আমার কেবলি মনে হচ্ছে, মৃত্যু দ্রুত এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। এসো বন্ধু, আমরা যেদিক দিয়ে এসেছি, আবার সে পথে ফিরে যাই। যদি তুমি আমাকে ভীরু ও কাপুরুষ ভেবে থাকো, তবে আমাকে যুদ্ধের মাঠে পাঠিয়ে দাও। দেখবে, মরার আগে আমি অন্তত একশ মুসলমানকে হত্যা করেছি।”
মার্ক লী সঙ্গীর মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারছিল। এ অবস্থায় তাকে কিছু বলা সমীচিন মনে করল না। সে সঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে একটু হেসে বললো, অতো ভয় পাচ্ছে কেন? জানো না, ভীরুরাই আগে মরে! জেফ্রে যদি অতো ভয় না পেতো, তবে মরতো না। যত বেশী সাহসী হবে ততই? বাঁচার সম্ভাবনা বাড়বে। পৃথিবীতে যখন এসেছি মরতে আমাদের হবেই। মরার আগে এসো কিছু বড় কাজ করে যাই। যদি কোনদিন ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর আবিষ্কৃত হয়, আমাদের ওরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। আমি একশ সাথে আসো।” .
সে সঙ্গীকে নিয়ে আবার পাহাড়ের গা বয়ে উঠতে লাগলো। পাহাড়ের চূড়া বেশী উচুতে ছিল না। ক্লান্ত পায়ে সেই চূড়ার দিকে এগিয়ে চলল। ওরা। উঠতে উঠতে এক সময় চূড়ায় পৌছে গেল।
বালিতে তাদের চোেখ মুখ একাকার হয়ে গিয়েছিল। মার্ক লী চোখ মুখ মুছে টিলার উপর বসে পড়লো। সঙ্গীও বসলো তার পাশে।।
মার্কলী বললো, “তোমার যদি মরুভূমি সম্পর্কে ভাল রকম পারবে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখো, বলে এটা কি মরীচিকা?”
সঙ্গী তার দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে দেখল। তারপর সে চােখ বন্ধ করলো এবং আবার খুললো। এবারও গভীর ভাবে লক্ষ্য করে বললো, না, এটাকে মরীচিকা মনে হচ্ছে না।’
সত্যি এটা কোন মরীচিকা ছিল না। তাদের চােখের সামনে ছিল। খেজুরের কয়েকটি বাগান। গাছের পাতাগুলো সবুজ ছিল। গাছগুলো ছিল নিম্নাঞ্চলে এবং বেশ দূরে।
মার্ক লী উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল তার সঙ্গীও | সবুজ উদ্যান দেখার সাথে সাথে ক্লান্তি ও ভয় দূর হয়ে গিয়েছিল ওদের।
হাঁটতে গিয়ে পায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ওরা তখন দৌড়াতে শুরু করেছে। আগে আগে দৌড়াচ্ছে মার্ক লী, পেছনে তার সাথী। তাদের চলার পথে অদ্ভুত দর্শন টিলা পড়ছিল। কোনটা বড় আবার কোনটা ছােট। কোনটা এমন যেন কোন লোক হাঁটুতে মাথা গুজে বসে আছে। মার্ক লী এ সবের মধ্য দিয়ে রাস্তা খুঁজে দৌড়াচ্ছে।
সূৰ্য প্রায় ডুবতে বসেছে। মার্ক লীর শ্বাস-প্রশ্বাস জোরে বইছিল, বুক উঠানামা করছিল তার। সঙ্গীর অবস্থাও সঙ্গীন। পা টেনে টেনে চলছিল সে। মার্ক লী আচমকা থমকে দাঁড়াল এবং সন্তৰ্পন ধীরে ধীরে পিছনে সরে আসতে লাগলো। বুঝা যায়, কোন কিছু দেখে সে ভয় পেয়েছে। তার সাখী। থমকে দাঁড়িয়ে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
এখান থেকে হঠাৎ করেই একটি নিম্নাঞ্চল শুরু হয়েছে। কম করেও এক মাইল বিস্তৃত। তার চারপাশে মাটি ও বালির প্রাকৃতিক দেয়াল। অঞ্চলটি গভীর এবং শস্য শ্যামলে পরিপূর্ণ।
সেখানে খেজুরের ছোট বড় অনেক গাছ। স্পষ্টই বুঝা যায়, সেখানে অনেক পানি আছে। এমন কঠিন জাহান্নামে এমন শস্য শ্যামল প্রান্তর কল্পনার অতীত। অভিভূত হয়ে দু’জনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই প্রান্তরের দিকে।
এই সেই প্রান্তর, একটু আগে পাহাড় চূড়া থেকে ওরা যা দেখেছিল এবং যার ঘাণ পেয়েছিল মার্ক লী। এ এক অদ্ভুত এলাকা। একটু আগে ছিল নিরেট পাথুরে পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চল, হঠাৎ করেই সে দুর্ভেদ্য পাহাড়শ্রেণী শেষ হয়ে গেল। এরপর দেখা গেল মাটি ও বালি মিশ্রিত উপত্যকা, যেখানে হাটুতে মাথা খুঁজে বসে আছে অসংখ্য পাথরের মূর্তি।
হঠাৎ করেই আবার এ অঞ্চল শেষ হয়ে শুরু হয়েছে শস্য শ্যামল সবুজ প্রান্তর। অথচ এক জায়গা থেকে আরেক অঞ্চলের সামান্য আচও পাওয়া যায় না, সামান্য কল্পনায়ও আসে না।
মার্ক লী ভয় পেয়েছিল অন্য কারণে। কয়েক কদম পিছিয়ে সে দ্রুত বসে পড়েছিল এবং তার সাথীকেও হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়েছিল। তার চোখের সামনে ধরা পড়েছিল আশ্চর্য দৃশ্য।
ওখানে দু’জন মানুষকে সে এদিকেই হেঁটে আসতে দেখল। লোক দু’জন সম্পূর্ণ উলঙ্গ এবং তাদের গায়ের রং ছিল ঘন বাদামী। তাদের শারীরিক গঠন বেশ সুঠাম ও বলিষ্ঠ।
মার্ক লী তাকিয়ে থাকল। সেই উদ্যানের দিকে। “দেখতে পেল, একজন মেয়ে মানুষ খেজুর গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বাগানের ভেতর দিয়ে আরেক দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভেনাসের মূর্তির মত সেও ছিল আপাদমস্তক নগ্ন।
তার মাথার চুল কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। চেহারা সুরতে এদের হাবশী বা জঙ্গলী মনে হচ্ছিল না।
‘এরা সব প্ৰেতাত্মার দল!” মার্ক লীর সাখী বললো, ‘এরা কখনও মানুষ হতে পারে না! মার্ক লী, সূর্য ডুবে যাচ্ছে, উঠো, এখনো সময় আছে, চলো আমরা পিছনে পালিয়ে যাই। রাতে এরা আমাদেরকে জীবিত রাখবে না?”
মার্ক লী এদের প্ৰেতাত্মা ভাবতে পারছিল না। সে বলল, ‘এরা প্ৰেতাত্মা নয়, আমার মনে হয়। এরাও মানুষ।”
কিন্তু তার কণ্ঠে তেমন জোর ছিল না। সে তখন ভাবছিল, এরা আবার কোন জাতি!! এরা তো বাতাসে উড়ছে না, মানুষের মত মাটিতেই হাঁটছে। কৌতুহলের বশে ওরা আবার উকি দিল সবুজ প্রান্তয়ে। খেলছে। একেবারেই মানব শিশুর মত অবয়ব, ও কার্যকলাপ ওদের।
মার্ক লী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল প্ৰান্তরের কিনারা পর্যন্ত। গিয়েই শুয়ে পড়লো। তার সাখীও তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তারা যেখানে শুয়ে দেখছিল, সেখানকার দেয়াল তেমন খাড়া ছিল না। কিছুটা ঢালু হয়ে তা সবুজ প্ৰান্তরের সাথে মিশে গিয়েছিল এবং তা ছিল বালি ভর্তি। ‘
মার্ক লীর সাখী আরও একটু অগ্রসর হয়ে বুকে নিচে দেখার চেষ্টা করলো। হঠাৎ বালি নিচের দিকে গড়িয়ে গেল এবং সে একেবারে নিচে গিয়ে পৌছলো।
সে সেখান থেকে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করলো। কিন্তু যতবার সে বালিতে পা রাখে, ততবারই সেখানকার বালি হড়কে যায় এবং সে আবারো গড়িয়ে পড়ে।
আতঙ্কে সে যেন পাগল হয়ে গেল, সে এখানে ওখানে পাগলের মত বালি খামচাতে লাগল। তার হাত পা অসাড় ও অবশ হয়ে হয়ে পড়ল। অবশেষে নেতিয়ে পড়ে হাল ছেড়ে দিয়ে সেই বালির ওপরই মুখ থুবড়ে পড়ে রইল সে।
মার্ক লী সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখেই জলদি পিছনে সরে গিয়ে একটি ঢিবির আড়ালে আশ্রয় নিল। সেখান থেকে গলা বাড়িয়ে সে নিচে সবই দেখতে পাচ্ছিল।
তার সাখী খৃষ্টান লোকটি গড়িয়ে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ গজ নিচে পড়ে গিয়েছিল। মার্ক লী তার সাথীকে উঠতে দেখলে এবং উপরে উঠার জন্য তার প্রাণপণ চেষ্টা অবলোকন করলো। কিন্তু মার্ক লী তাকে কোন সাহায্যই করতে পারল না।
দুজন উলঙ্গ লোক এদিকে আসছিল। তারা বালিতে মুখ থুবড়ে একটি লোককে পড়ে থাকতে দেখে দীেড়ে সেখানে ছুটে এলো। মার্ক লী উপর থেকে তাদের দেখতে লাগলো।
তার সাখী তাকে দেখতে পাচ্ছিল না, মার্ক লীও ডেকে তাকে সতর্ক করতে পারছিল না। কারণ, সে চাচ্ছিল না, এখানে আরও কেউ আছে জেনে যাক ওই লোকগুলো।
লোক দু’জন এসে মার্ক লীর সাখীকে পিছন থেকে চেপে ধরলো।
তার কাছে খঞ্জর ও একটি ছোট তলোয়ার ছিল। কিন্তু অস্ত্ৰ বের করার সুযোগ সে পেল না। ঐ দুই লোক তাকে নিচে শুইয়ে দিল। সেই মহিলা, যাকে সে একটু আগে দেখেছিল এবং সেই শিশুরা, যাদের সে খেলতে দেখেছিল, দূর থেকে এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে তারাও সেখানে ছুটে এল।
তারা তাদের ভাষায় কাউকে ডাকলে। বাগান থেকে দশ বারোজন লোক ছুটে এল সে ডাক শুনে।
একজন মাটিতে পড়ে থাকা খৃস্টান লোকটির কোমর থেকে তলোয়ার বের করে নিল। আরেকজন তাকে শুইয়ে দিল।
মার্ক লী দেখলো, একজন তাঁর সঙ্গীর ঘাড়ের শাহরগে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং অন্যেরা আনন্দে নাচছে। নৃত্যরত লোকগুলো তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচছে আর হাত তালি দিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় গান গাইছে।
ইতিমধ্যে একজন বুড়োমত লোক এসে হাজির হলো। তার হাতে দেহ সমান লাঠি। তাকে দেখে সবাই একদিকে সরে গেল।
বৃদ্ধের লাঠির মাথায় ফনা তােলা দুইটি সাপের মাথা। ফেরাউনের প্রতি সম্মানের নিদর্শন স্বরূপ এই প্ৰতীক ব্যবহার করা হতো।
বৃদ্ধ মার্ক লীর সাথীর গায়ে হাত দিল। সে এখন আর ছটফট করছিল না। লোকটির পায়ের চাপে এরই মধ্যে সে মারা গিয়েছিল।
বৃদ্ধ এক হাত শূন্যে উচু করলো এবং আকাশের দিকে, তাকিয়ে কিছু বললো। নারী ও শিশুসহ উলঙ্গ মানুষগুলো, সিজদায় পড়ে গেল।
কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে থাকল লোকগুলো। বৃদ্ধ আবার হাত উপরে তুলল এবং কিছু বলল, সকলেই সিজদা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
মার্ক লীর সাখী যেদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল। সে দিকে হাত ইশারা করে একজন বৃদ্ধকে কিছু বলল। মার্ক লী অনুমান করল, লোকটি বলেছে, “এই মানুষটি উপর থেকে এদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে।”
বৃদ্ধের আদেশে লােকেরা মার্ক লী সাথীর লাশটি উঠিয়ে নিয়ে গেল। মার্ক লীর ভয় হলো, এই বন্য লোকেরা ওর সাখীদের খুঁজতে না উপরে উঠে আসে!
সে কিছুক্ষণ ওখানেই বসে থেকে নিচের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলো।
সূর্য ডুবে গেল। নিঃসঙ্গ মার্ক লী ভাবছিল এখন কি করবেঃ বন্ধুর অসহায় মৃত্যুর কথা মনে হলো তার। লোকগুলো তাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, জানতে চায়নি কোখেকে কেন এসেছে সে? কিভাবে এসেছে? বরং ওকে হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়ার সাথে সাথে তাকে হত্যা করেছে। কোন বিচারের ধার ধারেনি, এমনকি সরদার আসার জন্যও অপেক্ষা করেনি। তার মানে ওদের হাতে ধরা পড়া মানেই মৃত্যু।
আবার ভাবছিল, কঠিন জেনেই এ অভিযানের দায়িত্ব কবুল করেছিল সে। এই রহস্যময় লোকগুলো কারা, এখানে ওরা কি করছে, ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবরের সাথে ওদের কোন সম্পর্ক আছে কিনা, এই সব রহস্য উদঘাটন না করে ফিরে যাওয়া মানেই অভিযানের ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা সে মেনে নিতে পারে না। যে অভিযানে তার দুই সাখী প্ৰাণ দিয়েছে, সে অভিযানে হয় সে সফল হবে নয়তো বন্ধুদের মত সেও দেশ ও জাতির নামে প্ৰাণ বিসর্জন দেবে, কিন্তু কিছুতেই ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে না।
রাতের আঁধার গ্রাস করে ফেলেছিল পাহাড়, মরুভূমি, উপত্যকা, প্রান্তর, সমস্ত চরাচর। নিশুতির নিরবতা নেমে এসেছিল উপত্যকার ঢালে, মার্ক লীর চতুর্পাশে। পেছনের বিকটদৰ্শন পাহাড়ের অবয়ব যেমন অদৃশ্য হয়েছিল সে লোভাতুব দৃশ্যও উধাও হয়ে গেছে অনেক আগেই। ”
নিঃসঙ্গ মার্কলী সাখীদের রক্তের কসম খেয়ে উঠে দাঁড়াল। তার এক হাতে খঞ্জর ও অন্য হাতে তলোয়ার। এদিকে ওদিক তাকিয়ে দেখলে সে। তারপর যাত্রা করল অসম্ভব এক অভিযানে, ভয়ংকর মৃত্যুর পথে।
মার্ক লী সেই পথে পা বাড়ােল যে দিকে তারা তার সাখীকে। উবু হয়ে তলোয়ার ও খঞ্জর বালিতে গাঁথিলো। এরপর দ্বিতীয় পা টেনে সামনে বাড়িয়ে তলোয়ার ও খঞ্জর তুলে এনে আবার সামনে গাঁথিলো। এইভাবে তলোয়ার ও খঞ্জারে ভর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে অন্ধকারে পা টিপে টিপে সমতলে। পৌঁছতে তার আধা ঘন্টা পেরিয়ে গেল।
সবুজ প্ৰান্তরে নেমে এল মার্ক লী। সেখানে বিরাজ করছিল কবরের নিস্তব্ধ নিরবতা। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পথ চলছিল সে। ডানে-বামে ও পিছনে লক্ষ্য করছিল বারবার। কোথাও কোন শব্দ নেই! সেই সুনসান নিরবতার ভেতর দিয়ে পদে পদে মৃত্যুর ভয় নিয়ে এগুচ্ছিল সে। খেজুর বাগানের পাশ দিয়ে পথটি চলে গছে পশ্চিম দিকে।
মিনিট পনেরো এভাবে চলার পর দূর থেকে অস্পষ্ট গানের স্বর ভেসে এলে তার কানে। আস্তে আস্তে সে শব্দ জোরালো। হলো। এখন পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, কোথাও গানের আসর বসেছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে নাচ-গানের সুমিষ্ট সুর।
সে ওই আওয়াজ লক্ষ্য করে খুব সাবধানে এগিয়ে গেল। একটু এগুতেই বাদিকে এক বিস্তৃত নিম্নভূমিতে সে দেখতে পেল কয়েকটি মশাল জ্বলছে। সেই মশালকে ঘিরে কম করেও বিশ-পঁচিশ জন নারী, পুরুষ ও শিশু বসে আছে। তার নাচ দেখছে আর গান গাইছে। পাশেই আরেক জায়গায় অনেক কাঠখড় দিয়ে একটি অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। সেই অগ্নিকুণ্ডে পোড়ানো হচ্ছে একটি মানুষের লাশ। লাশটির পা ও মাথা বেঁধে আগুনের ওপর ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কয়েকজন তার পাশে দাঁড়িয়ে লাশটি। এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে যাতে ঠিকমত ঝলসালো হয়। এই লাশটি ছিল মার্ক লীর সেই হতভাগ্য সাথীর।’
মার্ক লী এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখছিল আর ভাবছিল নিজের পরিণতির কথা। মানুষ-পোড়া মাংশের গন্ধে ভুরিভুর করছিল এলাকাটা। দুর্গন্ধে তার বমি আসার উপক্রম। সে দেখলো, একদল তরুনী সেখান থেকে মাংশ কেটে সকলকে পরিবেশন করা শুরু করল।
মার্ক লীর মনে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। তার কঠিন হৃদয়েও ফাটল ধরুল। দুঃসাহসের পাহাড় চূৰ্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। ভীত চকিত হরিণীর মত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তার সিংহ হৃদয়। তার অটল সংকল্প ও জাতিপ্ৰেম ভেসে গেল ভয়ের স্রোতে। সে আর এক মুহুৰ্তও সেখান দাঁড়াল না। সোজা ফিরে চলল যে পথে এসেছিল সেই পথে।
সে খুব সতর্ক হয়ে পথ চলছিল। সবুজ প্ৰান্তরের শেষ সীমান্তে এসে পৌঁছে গেল সে। উপত্যকার সেই ঢালের নিচে সে এখন দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে পড়ে যাওয়ার পর তার সাখী। খুন হয়েছিল। নামার সময় তলোয়ার ও খঞ্জরের সাহায্য নিয়ে অনেক কসরত করে নেমেছিল সে কিন্তু কি করে এবার উপরে উঠবে ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ সে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল।
দূর থেকে একাধিক পাহাড়ী জন্তুর চাপা গর্জনের শব্দ ভেসে এল। তার মনে পড়ে গেল খাদে পড়ে যাওয়া দুৰ্ভাগা সাখীর কথা। হয়তো মরুভূমির শৃগাল এখন তাকে খাচ্ছে। আর অন্য সাখীকে তো খাচ্ছে মানুষই। অভিযানে বেরিয়েছিল ওরা তিনজন। দু’জন চিরবিদায় নিয়েছে, এবার কি তার পালা? কোন দিক থেকে আসবে মৃত্যুঃ কখন আসবে? কেমন করে আসবে? ভয়ের সাথে। হতাশা ও অস্থিরতা ঘিরে ধরুল তাকে।
যেভাৰে উপত্যকা থেকে নেমেছিল মার্ক লী, সেভাবেইঅতি সাবধানে উপরে উঠতে শুরু করল সে। রাতের শেষ প্রহরে সে ঐ জায়গায় গিয়ে পৌছলো, যেখানে তাদের উট তিনটি বসেছিল। ওখানে সে এক মুহুৰ্তও দেরী করলো না। উটের গলায় বাধা পানি থেকে কয়েক ঢোক পান করে সে একটি উটের পিঠে উঠে বসলো। অন্য দুটি উট তার সঙ্গে পিছনে পিছনে চললো।

পর দিন সন্ধ্যা। মার্ক লী এক সম্মানিত মিশরীয় বণিকের বেশে আহমদ দরবেশের গৃহে প্রবেশ করল। আহমদ দরবেশ তাকে দেখেই প্রশ্ন করলে, “তুমি একা যে? ওরা দু’জন কোথায়?”

মার্কালী এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। সে ক্লান্ত ও অসহায় ভঙ্গিতে আহমদ দরবেশের সামনে বসে পড়লো। তার জ্ঞান বুদ্ধি তখনও ঠিক মত কাজ করছিল না।
“কি ব্যাপার! তোমাকে এমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন?”
“আমাকে একটু গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ দিন। সব কথাই বলবো আপনাকে ৷”
মুখোমুখি বসলো দু’জন। গুছিয়ে নিয়ে কথা শুরু করল মার্ক লী। প্রতিটি ঘটনা ও কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলো। বর্ণনার সাথে সাথে আহমদ দারবীশের চেহারার রঙ পাল্টে যাচ্ছিল। মার্ক লীর এক সাখীর করুণ মৃত্যুর বিবরণ শুনে আফসোস করলেন তিনি। কিন্তু তাকে যখন শোনানো হল দ্বিতীয় সাখীর মৃত্যুর কাহিনী এবং বলা হলো, “তাকে একদল মানুষ খেকো উলঙ্গ লোক খেয়ে ফেলেছে, তখন আহমদ দারবীশ দু:খ করার পরিবর্তে খুশীতে নেচে উঠলো। ”
‘তুমি কি সচক্ষে দেখেছে, তাদের কারো গায়ে কোন কাপড় ছিল না?”
“আমার কথায় আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না”
‘না, আমি তোমাকে অবিশ্বাস করছি না।” পুলকিত চিত্তে বললেন আহমদ দরবেশ, ‘তবু শুনতে চাচ্ছি, তুমি কি ভাল করে দেখেছাে, বৃদ্ধের লাঠির উপর দুই ফনা তোলা সাপ? তুমি কি শিওর যে, সে লোকেরা তোমার সঙ্গীর গোস্ত খেয়েছে?’।
আলবৎ শিওর! আমি কোন স্বপ্নের বর্ণনা দিতে বসিনি আপনার সামনে।” মার্ক লী বিরক্ত হয়ে বললো, “আমাদের ওপর দিয়ে যা ঘটে গেছে আমি শুধু তাই শুনাচ্ছি। আপনাকে। আর আমি যা বলছি তা নিজ চোখে দেখেই বলছি।”
‘ফেরাউনও এ কথাই বলে গেছে, যা তুমি বর্ণনা করেছে।” আহমদ দরবেশ উঠে মার্ক লীর কাছে গিয়ে তার কাধে হাত রাখলেন এবং আনন্দের আতিশয্যে তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “তুমি রহস্য উদঘাটন করে ফেলেছে। মার্ক লী! এই সেই লোক, যাদের আমরা অনুসন্ধান করছি। এই কবিলা সেখানে ষোলশ’ বছর ধরে বাস করে আসছে। এই লোকেরা চিন্তাও করেনি যে, সময় তাদেরকে মানুষের মাংস খেতে বাধ্য করবে। তুমি নকশার যে লেখাগুলো উদ্ধার করতে পারেনি। আমি তা করে ফেলেছি। এতে লেখা আছে, সাধারণত গুপ্তধনের রক্ষায় সাপের পাহারা বসানো হয়। কিন্তু আমার ধন ও কবরের হেফাজত করবে মানুষ। তাদের হাতে থাকবে ফনা তোলা সাপের আশা (লাঠি)। শত শত বছর পরে তারা নিজেরাই হিংস্ৰ পশু ও সাপের স্বভাব পেয়ে যাবে।
আমাদের সীমানায় যারা আসবে তাদের আমার রক্ষীরা খেয়ে ফেলবে। সভ্যতার সাথে এই রক্ষীদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। যুগ যুগ ধরে তারা এখানে উলঙ্গ জীবন যাপন করবে। বাইরের কোন লোক তাদের নারীদের ওপর কুদৃষ্টি দিতে পারবে না। যে দেবে সে এখান থেকে জীবিত ফিরে যেতে পারবে না।
“আমি জীবিত ফিরে এসেছি।’ বলল মার্ক লী।
‘তুমি নিচে ওদের কাছে যাওনি এবং আমি নিশ্চিত, তুমি কারো দিকে কুনজরে তাকাওনি, তাই তুমি ওখান থেকে জীবিত ফিরে আসতে পেরেছো ৷’’ বললেন দরবেশ আহমদ। ‘তুমি যে কালো রংয়ের পাথুরে পাহাড়ের কথা উল্লেখ করেছে। সে পাহাড়ের কোন এক প্রান্তে ফেরাউন রিম্যান্সের আরক দেয়া লাশ ও তার পূঞ্জিভুত গুপ্তধন লুকানো আছে। যুগ যুগ ধরে এই বিবস্ত্ৰ মানুষেরা সে ধন পাহারা দিয়ে আসছে।’
তার মানে ফেরাউন রিম্যান্সের সময় থেকে তারা বংশানুক্রমে পাহারা দিয়ে আসছে!’
মার্কালীর বিস্মিত কণ্ঠ। ‘হ্যাঁ, ষোল শ’ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করে আসছে তারা।”
“কিন্তু তারা আজো বেঁচে আছে কি করে?”
‘জানিনা তারা কি করে বেঁচে আছে! মনে হয় হিংস্র পশুর মত মরুভূমির পাখি ও পশু শিকার করে খায় তারা। তাছাড়া তুমিই তো বললে, সেখানে পানি ও খেজুরের অভাব নেই। এই পানি ও খেজুর তাদের বাঁচিয়ে রাখলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।”
“কিন্তু এই দুৰ্গম অঞ্চল থেকে তারা সভ্য জগতে ফিরে আসেনা না কেন?’ ‘তারা আজও ফেরাউনকে খোদা মান্য করে। যদি তাদের বিশ্বাসে চিড় ধরতো। তবে তারা অন্য কোথাও চলে যেতো। তুমি তাদের কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র দেখেছ?”
না, দেখিনি।’

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top