৬. আবারো সংঘাত

 সন্ধ্যার পর নূরুদ্দিন জঙ্গী তাঁর সেনাবাহিনীকে নিয়ে ক্রাকের কথা ভুলতে পারছেন না তিনি। বার বার পিছন ফিরে দেখছেন, সে চোখে রাজ্যের নৈরাশ্য। নূরুদ্দিন জঙ্গীর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তিনি বললেন, ‘ইতিহাস একথা তো আবার বলবে না যে, আইয়ুবী যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছু হটে গেছে? আমি অবরোধ তো উঠিয়ে নেইনি?’

 ‘না! সালাহউদ্দিন, তুমি উঠাওনি।’ নূরুদ্দিন জঙ্গী তাঁকে বললেন, ‘তুমি কখনও পরাজয় বরণ করোনি, তুমি বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেছো। যুদ্ধ শুরু আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয় না।’

 ‘হে আমার ফিলিস্তিন! আমি আবার আসবো।’ সুলতান আইয়ুবী ক্রাকের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আমি আবার আসবো।’

 তিনি ঘোড়ার লাগাম ধরে নাড়া দিলেন এবং দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেলেন মিশরের দিকে, আর পিছু ফিরে তাকালেন না।

 নূরুদ্দিন জঙ্গী তাঁর পথের দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি যখন তার ঘোড়াসহ দূরে দিগন্তের অন্তরালে হারিয়ে গেলেন, তখন সুলতান নূরুদ্দিন তাঁর নায়েবে সালারকে বললেন, ‘ইসলামের জন্য প্রত্যেক যুগেই সুলতান আইয়ুবীর মোড় মর্দে মুজাহিদ প্রয়োজন।’

 এই ঘটনা ১১৭৩ খৃস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়কার। সে সময় প্রত্যেক যুদ্ধক্ষেত্রে খৃস্টানদের সামরিক শক্তি পাঁচ থেকে দশ গুন বেশি হতো কিন্তু তারা অধিকাংশ সময় মুষ্টিমেয় মুসলমান মুজাহিদদের হাতে পরাজয় বরণ করতো। কখনো তারা পরাজিত না হলেও জয়লাভ করতে পারতো না। তারা জানতো, কুরআনের আদেশ মুসলমানদের মধ্যে এমন এক যুদ্ধের জযবা সৃষ্টি করে যার শক্তি অন্যরকম। তারা আল্লাহর নামে যুদ্ধ করে এবং এ পথে জীবন কুরবানী করাকে সাফল্য মনে করে।

 খৃস্টানদের মধ্যে এমন কিছু জেনারেল ছিল যারা মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় এ জযবাকে প্রতিরোধ করার চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা শুরু করেছিল এবং সে অনুযায়ী কাজও শুরু করে দিয়েছিল। তারা এও জানত, একজন মুসলমান দশজন অমুসলিমের সাথে লড়াই করেও বিজয় লাভ করতে পারে। এটা কোন জ্বীন বা ভূতের কাজ নয় বরং তাদের মধ্যে আল্লাহর শক্তি ও বিশ্বাস কাজ করে বলেই তারা এ সাফল্য লাভ করে। এ সব মুজাহিদরা কোন কিছু পাওয়ার লোভ বা লালসায় যুদ্ধ করে না বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রাণ বিলিয়ে দেয়।

 সুতরাং সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর অনেক আগে থেকেই ইহুদী ও খৃস্টান পণ্ডিতরা মুসলমানদের সামরিক শক্তি ও জেহাদী জযবাকে দুর্বল ও নিঃশেষ করার জন্য যাবতীয় কৌশল ও প্রচেষ্টা শুরু করেছিল। এ প্রচেষ্টার মূল ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের দৃঢ়তা নষ্ট করা এবং ঈমান ও আকিদায় ভেজাল মিশ্রিত করা।

 সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী এ দু’জনের দুর্ভাগ্য ছিল এই, তাঁরা যখন খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন, তার আগেই খৃস্টানরা ক্রুসেডের অভিযান শুরু করে দিয়েছিল এবং তাদের এ অভিযান সফলতা লাভ করতে শুরু করেছিল। ইসলামের শত্রুরা এ অভিযান দু’দিক থেকে শুরু করে। একদিকে শাসক, আমীর, উজির এবং সেনা কমান্ডরা, অন্য দিকে সাধারণ মানুষ। প্রথম শ্রেণীকে ওরা ঘায়েল করতো অর্থ, নারী ও শরাবে ডুবিয়ে, দ্বিতীয় শ্রেণীকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করতো জুয়া, নেশা, লোভ এবং ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ও কুমন্ত্রণা।

 সুলতান জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবী যেমন নিত্যনতুন রণকৌশল আবিষ্কার করতেন তেমনি খৃস্টানরাও তৎপর থাকতো মুসলমানদের বিপথগামী করার অভিনব কৌশল আবিষ্কারে।

 এই আবিষ্কার প্রক্রিয়ায়ই আবিষ্কৃত হয়েছিল এক নতুন কৌশল, যাকে তারা অভিহিত করেছে সাংস্কৃতিক কৌশল বলে, সাংস্কৃতিক কৌশল এতটাই কার্যকরী প্রমাণিত হলো যে, এক স্ময় খৃস্টীয় শাসকবর্গ প্রকাশ্য ময়দানে যুদ্ধ করার পরিবর্তে এ পদ্ধতিকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে লাগল। তারা এই দর্শনের সমর্থক হয়ে গেল যে, যুদ্ধ এমন পদ্ধতিতে কর যেন মুসলমানদের যুদ্ধ করার জযবা ও আবেগ নষ্ট হয়ে যায়। তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রবল আক্রমণ চালাও এবং তাদের মনে এমন সন্দেহ সৃষ্টি করে দাও, যাতে মুসলমানরা তাদের ধর্মভীরুদেরকে ঘৃণা করে এবং মুজাহিদদেরকে যুদ্ধবাজ বলে ভাবতে বাধ্য হয়।

 এ চিন্তাধারার লোকদের মধ্যে প্রথমেই আসে ফিলিপ অগাস্টাসের নাম। সে এই চিন্তাধারায় খৃস্টান শাসকবর্গকে উজ্জীবিত করে তোলে। ফলে এইসব খৃস্টান শাসকরা সৈন্যদেরকে বলতে থাকে, আমাদের যুদ্ধ সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে নয়, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের সাথে।

 এই যুদ্ধের সফলতা আমরা আমাদের জীবনে দেখে যেতে না পারলেও কোন না কোনদিন এর সফলতা আসবেই। সে জন্য প্রয়োজন মুসলমানদের নতুন প্রজন্মকে মানসিক দিক দিয়ে এমনভাবে গড়ে তোলা, যেন তার যৌন উন্মাদনা ও বিলাসিতার জন্য পাগলপারা হয়ে যায়।

 ফিলিপ অগাস্টাস তার মিশনকে সফল করার জন্য যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করে সন্ধি করতেও আপত্তি করেনি। এটা ১১৬৯ খৃস্টাব্দের কথা। এ সময় সে নূরুদ্দিন জঙ্গীর হাতে পরাজিত হয়ে অধিকৃত অঞ্চল সন্ধির মারফতে ফেরত দিয়েছিল এবং নূরুদ্দিন জঙ্গীর দাবী অনুযায়ী জরিমানাও দিয়েছিল। সেই সাহতে আর কোনদিন যুদ্ধ করবে না বলে অঙ্গীকার করে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরও করেছিল। জিজিয়া দিতেও রাজী হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবন্দী মিনিময়ের সময় সে প্রকাশ্যে বন্দী বিনিময় করল ঠিকই, কিন্তু সে এমন সব সৈন্যদেরকে বন্দী হিসাবে দেখাল যারা আর যুদ্ধ করার যোগ্য ছিল না। সুস্থ সবল সৈন্যদের সে হত্যা করে ফেলল। ফলে, তাদের যে সে কখনো বন্দী করেছিল তার আর কোন প্রমাণই রইল না।

 কোন কোন খৃস্টান শাসক ও জেনারেল তাকে সন্দেহের চোখে দেখতো। কেউ কেউ তাকে দোষারোপ করতে লাগল কেটে খাচ্ছে ওরা। এই চক্রান্তের ফলেই মিশরে এখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠছে, যে আগুন ঠান্ডা করতে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে ক্রাক দুর্গের অবরোধ ছেড়ে ছুটে আসতে হলো মিশরে।

 যে আইয়ুবী কখনো বিজয় ছাড়া ময়দান থেকে পা তোলে না, সেই আইয়ুবীকে শেষ পর্যন্ত সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর ওপর অবরোধের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সসৈন্য কায়রো ফিরে আসতে হলো। তিনি কোন দুর্বল হৃদয় মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তবু তাঁর চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল নিরাশার ছায়া।

 সেনাবাহিনী দেশে ফেরার আনন্দে খুশিই ছিল। তাদের ধারনা ছিল, বিশ্রামের জন্যই তাদেরকে কায়রো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞ সালাররা সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধের ধারা বুঝতে পারতেন। তারা সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীকে সৈন্যসহ ডেকে পাঠানোয় অবাক হলেও এটা বুঝেছিলেন, আইয়ুবীর মনে কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা আছে। যিনি বিজয়ের সংকল্প নিয়ে দুর্গ অবরোধ করেছিলেন, বিনা কারণে তিনি সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারেন না।

 মিশরের অবস্থা যে খুব খারাপ এবং সুদানে তকিউদ্দিনের আক্রমণ ব্যর্থ হয়ে গেছে এ কথা সুলতানের দু’একজন ঘনিষ্ঠ সেনাপতি ছাড়া আর কেউ জানতো না। সুলতান আইয়ুবীর সাথে আলী বিন সুফিয়ানকে দেখে অভিজ্ঞ সালাররা কিছু না জানলেও এটুকু অন্তত বুঝেছিলেন, মিশরে কোন গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। (________) যে, সে ভেতরে ভেতরে মুসলমানদের বন্ধু হয়ে গেছে।

 তার এক বন্ধু তার কাছে এ অভিযোগ করলে উত্তরে অগাস্টাস বললো, ‘একজন মুসলমান শাসককে ফাঁসানোর জন্য আমার কুমারী মেয়েকে তার কাছে নিবেদন করতেও আমি আপত্তি করবো না। তোমরা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে যা আদায় করতে পারবে, আমার আনাড়ী এক কুমারী কন্যা তারচে বেশি আদায় করার ক্ষমতা রাখে। তোমরা মুসলমানদের সাথে সন্ধি ও আপোষ চুক্তি করতে ভয় পাও। এতে তোমরা অপমান বোধ কর। কিন্তু তোমরা এ কথা কেন চিন্তা করো না, মুসলমানদেরকে যুদ্ধের ময়দানে মারার চেয়ে সন্ধির মাধ্যমে মারা সহজ। প্রয়োজন হলে তাদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তি চুক্তি কর, আর বাড়ি ফিরে এসে আরামে বসে সে চুক্তির বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকো।

 আমাকে দেখে শেখো। আমি কি ঠিক তাই করছি না? তোমরা জান, আমার দুই মেয়েকে দামেস্কের এক শেখের হেরেমে রেখেছি। সেই শেখের সাথে যুদ্ধ না করেই তোমরা কি তোমাদের সমস্ত অঞ্চল ফেরত পাওনি? সে কি বন্ধুত্বের মূল্য আদায় করেনি? সে আমাকে তার আপন জ্ঞাতি ও বন্ধু মনে করে। অথচ আমি যে তার জীবনের সবচে বড় শত্রু এ কথার প্রমাণ কি তোমরা পাওনি? আমি প্রতিটি খৃস্টানের লামে লামে বলতে চাই, যতো পারো মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তি করো আর সুযোগ মত ধোঁকা দিয়ে নিঃশেষ করে দাও তাদের।’

 সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনী নিয়ে ক্রাক দুর্গ থেকে মার্চ করে কায়রোর দিকে এগিয়ে চলেছেন। রাস্তায় তিনি খুব কমই বিশ্রাম নিলেন এবং সেনাবাহিনীকেও বেশি বিশ্রামের অবকাশ না দিয়ে হাকিয়ে নিয়ে চললেন। এতেও অভিজ্ঞদের মনে সন্দেহ হলো, নিশ্চয়ই মারাত্নক কিছু ঘটেছে মিশরে।

 সারাদিন পথ চলার পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সন্ধ্যার পরও কিছুটা পথ চললেন তারা। এরপর সুলতান সৈন্যদের থামার নির্দেশ দিলেন। আইয়ুবীর জন্য তাবু টানানো হলো। তিনি এশার আযান পর্যন্ত বিশ্রাম নিলেন তাবুতে। নামাজের পর উপদেষ্টা ও অফিসারদের ডেকে পাঠালেন।

 বৈঠকের শুরুতেই তিনি বললেন, ‘আপনাদের মধ্যে অনেকেরই জানা নেই, কেন আমি অবরোধ উঠিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে কায়রো যাচ্ছি। আসলে আমি অবরোধ উঠাইনি। আমরা কী ময়দান ছাড়িনি, বলতে পারেন সাময়িক পিছু হটেছি। কিন্তু কেন আমরা পিছু সরে এসেছি সে কথা শুনলে আপনারা আশ্চর্য হয়ে যাবেন। আপনাদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে আপনাদেরই কিছু ভাই, আপনাদের কিছু বন্ধু!

 তারা এখন ক্রুসেডের বন্ধু হয়ে গেছে। তারা বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করেছে, যদি আলী বিন সুফিয়ান ও তাঁর নায়েব এবং পুলিশ সুপার গিয়াস কামাল সজাগ না থাকতেন তবে আপনারা আজ মিশর ফিরে যেতে পারতেন না। সেখানে এখন খৃস্টান ও সুদানীদের রাজত্ব কায়েম থাকতো। আরসালানের মত হাকিম খৃস্টানদের দালাল হয়ে গিয়েছিল। সে আল ইদরিসের দুই যুবক ছেলেকে হত্যা করেছে। ধরা পড়ার পর নিজেও আত্নহত্যা করেছে। যদি আরসালানের মত লোক গাদ্দার হতে পারে তবে আর কার ওপর ভরসা করা যেতে পারে?

 উপস্থিত সবার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। নীরবতা ছেয়ে গেল সকলের মাঝে। ক্ষোভ ও ক্রোধে শ্রোতাদের চোখে মুখে ফুটে উঠল অস্থিরতা ও অশান্তি। সুলতান আইয়ুবী চুপ করে সবার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন। মোমবাতির কম্পমান আলোতে সকলের চেহারা এমন দেখা যাচ্ছিল, যেন তারা একে অন্যের অপরিচিত। তাদের চোখে কোন পলক ছিল না। সুলতান আইয়ুবীর কথার চেয়ে তারা ভাষার গাম্ভীর্য সকলের মনে ভয় ধরিয়ে দিল, ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল সবাই।

 তিনি বললেন, আমি গাদ্দারদের ক্ষমা চাইতে বলবো না। এ কথাও বলবো না, ইসলাম ও মুসলিম সাম্রাজ্যের অনুগত থাকার জন্য সকলেই কোরআন ছুয়ে শপথ করো। ঈমান বিক্রি করার লোকেরা কোরআন হাতে নিয়ে শপথ করেও বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে। আমি শুধু আপনাদের বলতে চাই, অমুসলমান কখনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। যারা আল্লাহ ও রাসূলের শত্রু তারা আমার আপনারও শত্রু। শত্রু যখন আমাদের সঙ্গে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের ভাব দেখায় তখন তার মধ্যে শত্রুতা গোপন থাকে। অন্তরের গভীরে সে যে শত্রুতা লুকিয়ে রাখে সময় ও সুযোগ মত সে তা ব্যবহার করে। তারা ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়, বন্ধুর ক্ষতি করতে ব্যবহার করে বন্ধুকে। এসব কুচক্রীরা ধর্মের ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করে ধর্মের অনুসারীদের। ইসলামের ক্ষতি করার জন্য তারা বেছে নেয় মুসলমানদের। স্বার্থপর ও লোভীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে ওরা। তারপর এইসব বিশ্বাসঘাতক মুসলমানদের দিয়ে ইসলামের সর্বনাশ করতে থাকে।

 আমরা আমাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যুদ্ধ করছি না, ঈমানের দাবী পূরণের জন্য জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়েছি। নিজস্ব শাসন ক্ষমতা কোন দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য নয়, আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য এ জিহাদ। দুই ভিন্ন মতবাদ ও বিশ্বাসের যুদ্ধ এটা, যার একদিকে ইসলাম অন্য দিকে কুফর। এই যুদ্ধ ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে, যে পর্যন্ত না দুনিয়ার বুক থেকে কুফর মিটে যাবে এবং ইসলাম বিজয়ী হবে।’

 উপস্থিত সালারদের চেহারা তখন টগবগ করে ফুটছিল। অত্যধিক রাগের কারণে কথা বলতে পারছিল না কেউ। শেষে একজন সেনাপতি কোন অমতে নিজকে সংযত করে বললো, ‘আমার বেয়াদবী ক্ষমা করবেন সালারে আজম! যদি মনে করে আমরা বিশ্বাসঘাতক নই, তবে আমাদেরকে মিশরের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। কারা এই গাদ্দার আমরা জানতে চাই।’

 ‘আরসালান সেয়ান বিভাগের কেউ নয়, সে প্রশাসনের হাকিম ছিল। আপনি প্রশাসন বিভাগেই গাদ্দার পাবেন, সেনা বিভাগে নয়।’ বললেন আরেকজন উত্তেজিত সালার।

 ‘ক্রাক দুর্গের অবরোধ আপনি উঠিয়ে নিয়েছেন, আমরা উঠাইনি। সম্মানিত জঙ্গী সাহেবকে আপনিই ডেকে এনেছেন, আমরা নই। আমাদের পরীক্ষা যুদ্ধের ময়দানেই হতে পারে, ঘোরে বসে নয়। আমরা শুধু জানতে চাই, এখন মিশরে কি হচ্ছে?’

 সুলতান আলী বিক সুফিয়ানের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আলী, এদের বলো, সেখানে কি হচ্ছে?’

 আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘গাদ্দাররা শত্রুদের সাথে মিশে সুদানের যুদ্ধ সেক্টরে পাঠানো রসদপত্র লুট করে। হাট বাজার থেকে খাদ্যশস্য উধাও করে ফেলে। পল্লী এলাকায় অচেনা লোক এসে খাদ্যশস্য কিনে নিয়ে যায়। বাজারে গোশত পাওয়া যায় না। অথচ এ অবস্থাও প্রশাসনের লোকেরা খাদ্য ও রসদ সরবরাহের সময় কোন পাহারার ব্যবস্থা রাখে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আগেই শত্রুদেরকে এ সংবাদ জানিয়ে দেয়। ফলে শত্রুরা রাস্তায় কাফেলা থামিয়ে লুট করে নিয়ে যায় সব মালামাল।’

 আলী আরো বললেন, ‘শহর মাজারে নিষিদ্ধ কাজ বেড়ে গেছে। জুয়া খেলা এমন আনন্দদায়ক বিষয় হিসেবে চালু হয়ে গেছে যে, আমাদের যুবকরা সে দিকে ঝুঁকে পড়ছে। পল্লী অঞ্চল থেকে কোন যুবক সেনাবিভাগে ভর্তি হতে আসে না। এদিকে সৈন্যদের মাঝেও অশান্তি বেড়ে গেছে। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংহতি ধ্বংস করার পায়তারা চালাচ্ছে তারা। দেশে ছোট ছোট রাজ্যের শাসকরা স্বাধীন শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাদেরকে এ লচ দেখিয়েছে খৃস্টানরা। এদের কাছে বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ আসছে। কেন্দ্রীয় শাসন ও খেলাফত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে এইসব কুচক্রীরা।

 সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে পল্লী অঞ্চল। পল্লীর সাধারণ জনসাধারণ এমনিতেই মূর্খ, অশিক্ষিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সম্প্রতি তার অদ্ভুত অদ্ভুত আকিদা বিশ্বাসে জড়িয়ে পড়ছে। ওখানে নতুন নতুন পীরের আবির্ভাব ঘটছে। তারাই এইসব অদ্ভুত আকীদা বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে জনগণ অমুসলিমদের মত আচার আচরণ ও চাল চলনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। সবচেয়ে ভয়ের কারণ হচ্ছে, এর ফলে পল্লী এলাকা থেকে যে অগণিত যুবক সৈন্য দলে ভর্তি হতে আসতো তারা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অথচ সেনাবাহিনীতে একদিন এই পল্লী অঞ্চলের যুবকরাই বেশি করে ভর্তি হতো। এখন নানা অমূলক ও অনৈসলামিক ধারণা-বিশ্বাস পল্লী অঞ্চল থেকে ভর্তি হওয়া সৈন্যদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।’

 ‘আপনি এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি?’ একজন উত্তেজিত সালার প্রশ্ন করল।

 ‘নিয়েছি।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমার গোয়েন্দা বিভাগ অপরাধীদের সনাক্ত করা ও ধর পাকড়ে ব্যস্ত আছে। আমার চর প্রত্যন্ত পল্লী এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু শত্রুদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এত বেশি বেড়ে গেছে যে, দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। বেশি অসুবিধা হচ্ছে, মুসলমানরা শত্রুদের গোয়েন্দা এবং দুষ্কৃতিকারীদের সহযোগী হওয়ায়। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন, পল্লী অঞ্চলের কিছু কিছু মসজিদের ইমামও দুষ্কৃতিকারীদের সহযোগী হয়ে পড়েছে।

 একজন অফিসার প্রশ্ন করল, ‘প্রশাসন দুর্নীতিবাজ হয়ে পড়ায় এখন কি সেনাবাহিনীকে সেখানে নেয়া হচ্ছে প্রশাসনিক কাজ করানোর জন্য?’

 ‘না, বেসামরিক কাজে আমি সামরিক লোক নিয়োগ করবো না।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘সৈন্য বিভাগ যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছে তারা সেই দায়িত্বই পালন করবে। এতে রাজ্যের জন্যও মঙ্গল, সৈন্যদের জন্যও মঙ্গল। একজন কোতোয়াল কখনও সেনাপতি হতে পারে না, তেমনি কোন সেনাপতিও কোতোয়ালের দায়িত্ব পালন করতে পারে না।’

 তিনি আরো বললেন, ‘আমাদের উচিৎ প্রশাসন কি কাজ করছে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। তারা দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা ও ক্রুটি করছে কিনা দেখা। বন্ধুগণ! আল্লাহ আমাদেরকে ইতিহাসের এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এ পরীক্ষায় পাশ করতে হলে আমাদেরকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে।

 মিশরের অবস্থা আপনারা শুনেছেন। সুদানের অভিযানও ব্যর্থ হয়েছে। তকিউদ্দিন তার পরিকল্পনার ভুলের জন্য মরুভূমিতে আটকে গেছে। তার সৈন্যদল ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। পিছু হটারও কোন সুযোগ পাচ্ছে না তারা। আমি বলতে পারি না, মুহতারাম নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাক জয় করতে পারবেন কি না। কিন্তু এটাও আমারই ব্যর্থতা বলবো।

 তিনি হয়ত প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকবেন এবং শত্রুদের পরাজিত করতে পারবেন। কিন্তু শত্রুরা যে অদৃশ্য সেক্টরে আমাকে আহ্বান করেছে সে সেক্টরে শত্রুদের পরাজিত করা আসলেই খুব কঠিন হবে। জঙ্গী অস্ত্র ধারণে পটু, মরুভূমির বুক চিরে চিতা বাঘের মত ছুটতে পারেন তিনি, কিন্তু আমি কোথায় ছুটে যাবো, কার ঘাড়ে অস্ত্র চালাবো?’ থামলেন সুলতান।

 একটু বিরতি নিয়ে সুলতান আইয়ুবী আবার বললেন, ‘এখন যে সমস্ত সৈন্য মিশরে আছে, তারা যখন সুবাক রণক্ষেত্রে গিয়েছিল, তখন তাদের মধ্যে ঈমানী জযবা এমনিই ছিল, যেমন আজ আপনাদের মধ্যে আছে। কিন্তু কায়রোর নিরাপদ সেনা ছাউনিতে বসে আজ তারা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এখন অবস্থা এমন যে, এই সৈন্যদের আর বিশ্বাস ও ভরসা করার উপায় নেই।’

 ‘দ্বীনের প্রতি ভালবাসা নেই, জাতির প্রতি দরদ নেই এমন প্রতিটি সৈনিককে আমরা হত্যা করবো।’ একজন অফিসার আবেগে কাঁপতে কাঁপতে বললো।

 ‘আমরা সর্বপ্রথম সেইসব অফিসার ও গাদ্দারদের থেকে পবিত্র হবো যারা দুশমনের জালে পা দিয়ে নিজের ঈমান বিক্রি করে দিয়েছে।’ বললো অন্যজন।

 ‘যদি আমার সন্তানও দুশমনের বন্ধু প্রমাণিত হয়, তবে আমি নিজ হাতে তার মাথা কেটে আপনার পদতলে সমর্পণ করবো।’ একজন বৃদ্ধ সালার বললো।

 বৈঠকে উপস্থিত প্রতিটি চেহারায় প্রত্যয় ও সংকল্পের দৃঢ়তা টগবগ করে ফুটছিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের এসব আবগেময় ও উত্তেজিত কথাবার্তা সমর্থন করতে পারি না।’

 উপস্থিত লোকগুলোর চোখে মুখে দেখা গেল প্রচণ্ড ক্রোধ ও ক্ষোভের চিহ্ন। এরা এমনসব লোক ছিল, সুলতান আইয়ুবীর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও যারা ভয় পেত। কিন্তু এখন তারা আগুন ঝরা চোখ নিয়ে সুলতানের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিটি চোখ যেন বলছে, একদিন যারা আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতো, দ্বীনকে বিজয়ী করার স্বপ্ন দেখতো আমাদেরই মত, সে ঈমানদীপ্ত মোজাহিদদের অন্তরকে যারা কলুষিত করেছে তাদের কোন ক্ষমা নেই।

 তরুণ অফিসারদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হলো সবচে ভয়াবহ। সৈন্যরা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করছে শুনে তাদের মাথায় রাগে আগুন ধরে গেল। একজন তো সুলতানকে বলেই ফেললো, ‘আপনি আমাদেরকে সবসময় ধৈর্য সহকারে চিন্তা করার ও ধীরস্থিরভাবে কাজ করার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। আমরা কখনো আপনার আদেশ অমান্য করিনি এবং উত্তেজিতও হইনি। আমাদেরকে আপনি এই হুকুম দিন, কায়রো পৌঁছার আগ পর্যন্ত আমরা রাস্তায় আর কোথাও থামবো না। আমরা আহার, নিদ্রাম বিশ্রাম ত্যাগ করে লাগাতার পথ চলে কায়রো পৌঁছবো এবং দুষ্কৃতিকারীদের শায়েস্তা করে তবেই ছাউনিতে ঢুকবো।’

 সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পক্ষে এই উত্তেজিত অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। তিনি আরও কিছুক্ষণ তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে বৈঠক শেষ করলেন।

 ভোরে সেনাবাহিনী আবার কায়রোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। এ যাত্রা যথারীতি কমান্ডেই হচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবীও আগের মতই অফিসারদের সাথে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, আলী বিন সুফিয়ান তাঁর সঙ্গে নেই।

 সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈন্যদের দুইবার থামানো হলো। সন্ধ্যার পরও সৈন্যরা চলতেই থাকলো। রাতের প্রথম প্রহর শেষ হয়ে গেলে সুলতান আইয়ুবী বিশ্রামের জন্য সৈন্যদের থামতে বললেন। খেতে বসে সুলতান আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে আলী বিন সুফিয়ানকে তালাশ করলেন, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না।

 খাওয়ার পর তিনি যখন তাবুতে ফিরে এলেন তখন আলী বিন সুফিয়ান এসে সেখানে হাজির হলেন।

 ‘সারাদিন কোথায় ছিলে আলী?’ সুলতান জিজ্ঞেস করলেন।

 ‘গত রাতে আমার মনে একটা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল।’ আলী বিন সুফিয়ান উত্তরে বললেন, ‘সেই সন্দেহ সঠিক কিনা জানার জন্য সারাদিন সৈন্যদের মাঝে ঘোরাফেরা করলাম।’

 ‘কি সন্দেহ হয়েছিল?’

 ‘আপনি কি লক্ষ্য করেননি, আমি যখন মিশরের অবস্থা বর্ণনা করলাম তখন সেনাপতি, কমান্ডার ও সমস্ত অফিসাররা কেমন আগুন হয়ে গিয়েছিল।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছিল, এরা নিজেদের গ্রুপের সৈন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উত্তেজিত করে তুলবে। আমার সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হলো। তারা সত্যি সত্যি তাদের দলের সাধারণ সৈন্যদেরকে মিশরের প্রশাসন ও সৈন্যদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছে। আপনি সৈনিকদের যতটা স্বাভাবিক দেখছেন তারা ততটা স্বাভাবিক নেই। এখনকার এই নিস্তরঙ্গ পরিবেশ আসলে প্রচণ্ড ঝড়েরই পূর্বাভাস। প্রতিটি সৈনিকদের ভেতর এখন প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

 আমি সৈন্যদের বলতে শুনেছি, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ ও আহত হচ্ছে আর আমাদের সাথীরা কায়রোতে আরামে বসে ইসলামের পতাকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চায়? কায়রো গিয়ে প্রথমেই এই গাদ্দারদের শেষ করবো, তারপর রওনা দেবো সুদানে আটকে পড়া সৈন্যদের সাহায্যে। সম্মানিত সুলতান! যদি আমরা পথে আর কোথাও বিশ্রাম ও বিরতি না নিয়ে সোজা কায়রো গিয়ে পৌঁছি, তবে পৌঁছার সাথে সাহতেই সেখানে গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আমাদের সৈন্যরা ক্ষীপ্ত, উত্তেজিত। তারা প্রতিশোধের নেশায় পাগলপারা। আর মিশরে অবস্থানকারী সৈন্যরাও বিদ্রোহের বাহান খুঁজছে। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে একটু চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন।’

 ‘আমি এ বিষয়ে খুবই খুশি যে, আমাদের সৈন্যরা ঈমানী জযবায় এখনো অটুট। তাদের এ আবেগকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।’ সুলতান আইয়ুবী বললে, ‘কিন্তু আমাদের শত্রুরাও এটাই চায়। তারা চায় আমাদের সেনাবাহিনী পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক।

 তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। আলী বললেন। ‘সুলতান, আমাদের এ ফৌজ কায়রো পৌঁছার আগেই মিশরের ব্যারাকে অবস্থানরত সৈন্যদের অন্য রাস্তায় ক্রাকের সেক্টরে যাত্রা করিয়ে দিতে হবে। অবিলম্বে কাসেদ ও দায়িত্বশীল অফিসার পাঠিয়ে এর ব্যবস্থা করুন।’

 সুলতান একটু চিন্তা করলেন। বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছো। তবে দূত পাঠিয়ে আদেশ দিলে হবে না। ভেতরের কথা বলা যাবে না তাদের। ফলে আমার সৈন্য কায়রো পৌঁছার আগেই তাদের বেরিয়ে পড়তে হবে, এমন কোন তাড়া ওদের থাকবে না। এর মধ্যে আমার বাহিনী ওখানে পৌঁছে গেলে পরিস্থিতি আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না। তারচে বরং আমি নিজে সেখানে চলে যাই এবং ওদেরকে ক্রাক যাত্রার নির্দেশ দিয়ে সবকিছু নিজে তদারক করি। আমি নিজে গিয়ে আদেশ দিলে তারা মনে করবে তারা আমার কমান্ডে যাত্রা করেছে।’

 সুলতান উঠে দাঁড়ালেন। ডাকলেন গার্ডকে। বললেন, ‘আমার ঘোড়া তৈরী করো।’ এরপর ডাকলেন নায়েবে সালারকে। বললেন, ‘আলীকে নিয়ে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সকালে বাহিনী নিয়ে তুমি কায়রো রওনা দেবে। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওখানে পুছহেই সৈন্যদের অভিযানে নেমে পড়তে হবে, তাই যতটা সম্ভব বিশ্রামের সুযোগ দেবে ওদের। পথে তোমাদের সাথে আর দেখা হবে না, কায়রোয় তোমাদের জন্য আমি অপেক্ষা করবো।’

 তখন গভীর রাত। আলীকে নিয়ে পথে নামলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। মাথার ওপর ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের ঘোলাটে জোসনা। দূর দিগন্তে আবছা দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়ের চূড়া। বালিয়াড়ি ভেঙে এগিয়ে চলেছে দুটো ঘোড়া, একটিতে সুলতান আইয়ুবী, অন্যটিতে আলী বিন সুফিয়ান।

 সুলতানের দৃষ্টি সামনের দিকে প্রসারিত। চেহারায় চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট। সুলতান ভাবছেন, ‘ক্রাকে নূরুদ্দিন জঙ্গী কি সফল হতে পারবেন? তকিউদ্দিন এখন কেমন আছে, সে কি তার বাহিনীকে সংগঠিত করতে পেরেছে? নাকি এরই মধ্যে সুদানীরা তাদের ঘেরাও করে তাদের ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা শুরু করে দিয়েছে? মিশরের পরিস্থিতি না জানি কি এখন। এরই মধ্যে বিদ্রোহ তো শুরু হয়ে যায়নি! আল ইদরিসের ছেলেদের মত কেউ তো আর খুন হয়নি! তিনি কি প্রশাসনের যে সব গাদ্দাররা ঘাপটি মেরে আছে তাদের সবাইকে সনাক্ত করতে পারবেন? পারবেন কি তাদের কবল থেকে মিশরের জনগণকে রক্ষা করতে? সীমান্ত এলাকায় যে নতুন ফেতনা শুরু হয়েছে কি দিয়ে তিনি তার মোকাবেলা করবেন? যে ক্ষীপ্ত সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে তার পিছনে, কায়রো পৌঁছে তারা কি এমন কোন পদক্ষেপ নেবে যার মোকাবেলা করা তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে? এরকম হাজারটা চিন্তা মাথায় নিয়ে পথ চলেছেন সুলতান। পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে আলী।

 ‘আলী, বিপদ একটা আসলে সামাল দেয়া যায়। চতুর্দিক থেকে বিপদের এমন পাহাড় ভেঙে পড়লে কোনটা রেখে কোনটা সামাল দেবো?’

 ‘এ নিয়ে খুব কি দুশ্চিন্তা করার দরকার আছে সুলতান! বিপদ যত ভয়ংকর হোক, আল্লাহ নিশ্চয়ই তারচে অনেক বেশি সামর্থ্য রাখেন। বিপদের তুফানে পড়ে আপনি কি অসংখ্যবার আল্লাহর সাহায্যে তা থেকে মুক্তি লাভ করেন নি? আগে যেমন তিনি সাহায্য করেছেন এবারও মুশকিল আসান তিনিই করবেন।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

 আরো একটি রাত মরুভূমিতেই কাটলো তাদের। শেষ রাতের দিকে কায়রো শহরের আবছা অবয়ব ভেসে উঠল দূর থেকে। একটু পরই সূর্য উঠলো। আঁধারের বুক চিরে স্পষ্ট হলো কায়রোর শহর। সুলতান ভাবলেন, ঘুমের অতল অল থেকে শহরের (____) নিশ্চয়ই জেগে উঠছে। একটু পরই তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হবে জনপদ। শান্তিপ্রিয় নিরুদ্বিগ্ন এইসব মানুষগুলোকে কিছুতেই কুচক্রীদের দয়ার ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। যে করেই হোক, সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবেলা আমাকে করতেই হবে।

 তিনি স্বগতস্বরে বললেন, ‘ভাইয়েরা আমার! আমি আসছি। ইসলামের আলো দিয়ে আমি দূর করে দেবো সকল আঁধার। পেঁচা আর বাদুর যেমন দ্বীনের আলোয় পালিয়ে যায়, তেমনি পালিয়ে যাবে কুচক্রী দল। ফেতনা ও ফ্যাসাদের মূল আমি ওপড়ে ফেলে দেবো নীল দরিয়ায়। পিড়ামিডের নিচে মাটি চাপা দেবো গাদ্দারদের। একটু অপেক্ষা করো, কটা দিল সময় দাও আমায়।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top