১১. চারদিকে চক্রান্ত

খলিফা আল মালেকুস সালেহ ও খৃস্টান সামরিক উপদেষ্টারা
উইণ্ডসারের সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় মিলিত হয়েছেন। উইন্ডসার খৃস্টান সম্রাট রিমাণ্ডের দূত হয়ে এসেছেন হলবে। নৈশভোজের পর আছে জমজমাট নৃত্যানুষ্ঠান। সবাই সমবেত হয়ে অপেক্ষা করছিল উইণ্ডসারের জন্য। তার আসার সময়
পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ । কেন তিনি বিলম্ব করছেন দেখার জন্য অবশেষে মেহমানখানায় লোক পাঠানো হলো।
একটু পর।
উইণ্ডসারকে ডাকতে যাদের পাঠানো হয়েছিল ফিরে এল তারা। উইণ্ডসার নয়, তার বদলে তাদের সাথে আসরে এসে পৌছলো উইণ্ডসারের লাশ ।
উইণ্ডসরের অপেক্ষায় এতক্ষণ যারা পথ চেয়ে বসেছিল, হতবিহবল হয়ে পড়লো তারা। কেমন করে তিনি নিহত হলেন, কেন হলেন, কিছুই তারা বুঝতে পারলো না। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই থ’ বনে গেল।
লাশ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল৷ খৃস্টান উপদেষ্টা ও সামরিক অফিসাররা। তারা উইণ্ডসারকে খুবই বিজ্ঞ এবং ক্ষমতাধর অফিসার হিসাবে জানতো। এ ঘটনাকে তারা সহজভাবে মেনে নিতে পারলো না ।
ক্ষিপ্ত খৃষ্টানরা খলিফা আল মালেকুস সালেহ, তাঁর আমীর, উজির ও সামরিক অফিসারদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে লাগলো। পারে তো তাদের ধরে মারে, এমনি অবস্থা। যে অকথ্য ভাষায় গালাগালি হচ্ছিল, অন্য সময় হলে হয়তো খলিফার সামরিক অফিসাররা ঝাঁপিয়ে পড়তো তাদের ওপর। কিন্তু এ আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওরা বিহবল ও ভেঙ্গে পড়লো। প্ৰতিবাদের সব ভাষা হারিয়ে ওরা বোবা পাথর হয়ে গেল ।
শুধু তাই নয়, এ ঘটনায় তারা ভীত-সন্ত্রস্তও হয়ে পড়লো। কারণ, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মোকাবেলায় তারা খৃষ্টানদেরকে নিজেদের অভিভাবক ও রক্ষক মনে করতো। তাদের ওপর ভরসা করেই তারা আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। খৃস্টান সম্রাটের দূত হত্যার ফলে তারা নিজেদের জীবন নিয়েই শঙ্কিত হয়ে পড়লো।
গদিচ্যুত খলিফা ও আমীররা ছিল মেরুদণ্ডহীন। খৃস্টানদের তোষামোদী করার মধ্যেই খুঁজে ফিরতো নিজেদের স্বার্থ ও সাফল্য। খৃস্টানরা যখন যা বলতো তাই মেনে নিত মাথা নত করে । ,
এ ঘটনায় স্বার্থপর মুসলিম নেতাদের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে উঠল। কোন বড় রকমের অপরাধ করলে চাকর-বাকররা যেমন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে, এরাও তেমনি দাঁড়িয়ে রইল ক্ষিপ্ত খৃস্টানদের সামনে।
কেউ কোন প্ৰতিবাদ না করায় এক সময় কমে এল গালাগালির তোড়। খৃস্টানদের এক সামরিক অফিসার বললো, ‘সন্ধ্যায়। ফটক বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব খুনী রাতের মধ্যে শহর থেকে বেরোতে পারবে না। সকাল হওয়ার আগেই খুনীকে খুঁজে বের করো। প্রয়োজন হলে শহরের প্রতিটি ঘরে তল্লাশী চালাও । পুরো সেনাবাহিনীকে লাগাও এ কাজে ।”
আরেক খৃস্টান অফিসার ধমক দিয়ে বললো, “হা করে দেখছো কি? যাও, মানুষকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ঘরে ঘরে তল্লাশী চালাও। তাদের সাথে এমন ব্যবহার করো, যেনো আতংকগ্ৰস্ত মানুষ ভয়ে স্বেচ্ছায় খুনীকে তুলে দেয় সৈন্যদের হাতে।”
‘জী! জী! যাচ্ছি।” এক মুসলমান আমীর বললো, “আমি সৈন্যদের এখুনি আদেশ দিয়ে দিচ্ছি, ভোরের আগেই যেনো খুনীকে পাকড়াও করা হয়। সমস্ত শহরে যেন এখনি ছড়িয়ে পড়ে সেনাবাহিনী।”
‘না, তা হয় না!” এক কেল্লাধিপতি বললো, “এমন হতে পারে। না। তল্লাশী শুধু সেই বাড়ীতেই নেয়া যেতে পারে, যার ওপর সন্দেহ করা যায়। সাক্ষী নেই, প্রমাণ নেই, অভিযোগ নেই, অথচ শহরের অভিজাত ও সন্ত্রান্ত ঘরগুলোতে আচানক গজবের মত টুটে পড়বে সেনাবাহিনী, তা হয় না।”
এতগুলো গণ্যমান্য অফিসার, খৃস্টানদের সামরিক উপদেষ্টা, আমীর-ওমরা এবং স্বয়ং খলিফা যেখানে উপস্থিত ও নিরব, সেখানে কেউ রিমান্ডের সামরিক অফিসারের হুকুম অমান্য করতে পারে এবং এমন জোরের সাথে তার প্রতিবাদ করতে পারে, এ কথা কেউ কল্পনাও করেনি। সকলেই বিস্মিত হয়ে তাকালো তার দিকে। দেখলো, এ বলিষ্ঠ কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে হেম্মাত দুর্গের অধিপতি জুরদিকের কণ্ঠ থেকে।
ইতিহাস জুরদিকের পুরো নাম উল্লেখ করেনি। তার সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলেছে, তিনি ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বন্ধু ছিলেনI’
কিন্তু এটা সে সময়ের কথা, তখনো তিনি সুলতান আইয়ুবীর বন্ধু হননি। আস সালেহের অনুগত সৈন্য এবং একটা দুর্গের প্ৰধান হিসাবেই এ ভোজসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। সম্মিলিত বাহিনীর পরামর্শ সভারও তিনি সদস্য ছিলেন । সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যেসব পরিকল্পনা তৈরী হচ্ছিল, তাতে তারও অংশ ছিল উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু মুসলমানদের জাত’ ধরে যখন খৃস্টানরা গালাগালি করছিল, তখন তার মধ্যে জেগে উঠলো স্বজাত্যবোধ । রাতের আঁধারে ধনী-গরীব নির্বিশেষে প্রতিটি মুসলমানের ঘরে হানা দেয়ার কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারলেন না। বললেন, “এখানকার অধিকাংশ পরিবার মুসলিম। তারা সবাই পর্দানশীন। আমি তাদের বেইজ্জতি সহ্য করতে পারবো না । এসব ভদ্র ও পর্দানশীন ঘরে সৈন্যরা বেপরোয়া তল্লাশী চালালে তাতে আমাদেরই সন্মানের হানি ঘটবে।”
“খুনী এ শহরেই আছে!” এক খৃস্টান ক্ষীপ্ত কষ্ঠে বললো ,’প্রয়োজনে আমরা সমস্ত শহর তছনছ করে ফেলবো, প্ৰতিশোধ নেবো ।”
“উইণ্ডসার ছিলেন উচ্চ সামরিক অফিসার, তার খুনের বদলা নিতে গিয়ে কারো ইজত সম্মানের দিকে তাকানোর সুযোগ নেই আমাদের।” আরেক উত্তেজিত খৃস্টানের কণ্ঠ।
তাহলে তোমাদের অফিসারের খুনের জন্য আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের ঘর তল্লাশীরও কোন প্রশ্ন আসে না। উইণ্ডসার কত বড় অফিসার ছিলেন তা নিয়ে আমারও কোন পরোয়া নেই।” জুরদিক রাগে কাপতে কাঁপতে বললেন।
“জুরদিক! তুমি চুপ করে!” কিশোর খলিফা আদেশের সুরে বললেন, “এ সামরিক মেহমানরা বহু দূর থেকে আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন। তুমি কি মেহমানদারীও ভুলে গেছে? অকৃতজ্ঞ হয়াে না!! খুনীকে আমাদের ধরতেই হবে।” খলিফার সমর্থনে আরো অনেকেই কণ্ঠ উচ্চকিত করলো।
‘আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে থাকতে পারি এবং আছিও।” জুরদিক বললো, “কিন্তু নিজের জাতির বিরুদ্ধে যেতে পারি না! খলিফাতুল মুসলেমিন! যদি আপনি দেশের নাগরিকদের অপমান ও পেরেশান করেন। তবে নাগরিকরা আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবে। আপনি সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যে রণক্ষেত্র তৈরী করছেন সেটা অকেজো হয়ে যাবে।”
“আমরা কোন জাতির পরোয়া করি না।” রিমাণ্ডের সামরিক উপদেষ্টা বললো, “আমরা খুনীদের খুঁজে বের করবোই। তারা যে বাড়ীতেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, তাদেরকে পাকড়াও করে শুলে চড়াবো। এ হত্যাকাণ্ড নিশ্চয়ই সালাহউদ্দিন আইয়ুবী চালিয়েছে। তার পোষা কুকুরদের কখনো ক্ষমা করবো না আমরা ।’
“হে, আমার বন্ধুগণ!” জুরদিক বললেন, “তোমাদের মাত্র একজন অফিসারের খুন তেমন কোন বড় ব্যাপার নয়। তোমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে হত্যা করতে বহুবার বহু চেষ্টা করেছ। এই সেদিনও ফেদাইনদের পাঠিয়েছিলে তাকে খুন করতে। আমার জানা মতে তারা চার চার বার প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছ।
তোমরা তাকে হত্যা করতে পারোনি, সে ভিন্ন ব্যাপার। সেটা তোমাদের অযোগ্যতা বা অদক্ষতা । আমি তোমাদের সে প্ৰচেষ্টাকে অন্যায় বলবো না। শত্রু যারই হােক, তারা একে অপরকে হত্যা করার চেষ্টা করেই থাকে। যদি উইণ্ডসারকে সুলতান আইয়ুবীই হত্যা করে থাকে, তবে পার্থক্য শুধু এই, তোমরা আইয়ুবীকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে, আর তিনি তোমাদের অফিসারকে হত্যা করতে সফল হয়েছেন। তোমরাও তার এমন অনেক অফিসারকে হত্যা করেছো। কিন্তু তিনি জনগণকে সে জন্য হয়রানী ও কোন পেরেশানিতে ফেলেননি ।”
কিন্তু জুরদিকের এ বক্তৃতায় কোনই কাজ হলো না, না এতে খৃস্টানরা সন্তুষ্ট হলো, না মুসলমানদের বিবেক জাগ্রত হলো। বরং সমস্ত মুসলমান আমীর ও অফিসাররা একযোগে জুরদিকের বিরুদ্ধে কথা বলতে লাগলো। তারা খৃস্টানদের অসন্তুষ্ট করতে চায় না। কিন্তু জুরদিক সকলের সম্মিলিত মতামতকে উপেক্ষা করে তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন ।
তিনি বললেন, “ভদ্রতা ও শালীনতার সীমা অতিক্রম করে। অন্যায়ভাবে নাগরিকদের হয়রানী করার কোন অধিকার নেই আমাদের । তোমরা সবাই বললেই একটা অন্যায় ন্যায় হয়ে যাবে না। সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে তাদের জান-মাল ও ইজত-আব্রুর হেফাজত করার শপথ নিতে হয়েছে আমাকে । সে শপথের কসম, বিনা ওয়ারেন্টে আমি শহরের কোন ঘরেই তল্লাশী চালাতে দেবো না।”
“তবে কি আমরা মনে করবো, তুমি এ খুনের সাথে জড়িত?” এক খৃস্টান বললো, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে, ‘তুমি আইয়ুবীর বেতনভুক কৰ্মচারী!’
হলবের কোন বাড়ীতে অন্যায়ভাবে তল্লাশী চালানোর প্রতিবাদ করার অর্থ যদি হয় সে খুনী, তবে এ অপবাদ মাথায় নিতে আমার কোন আপত্তি নেই।” জুরদিক বললেন, “এবং এ কারণে কেউ যদি আমাকে আইয়ুবীর কর্মচারী ভাবে, তার সে ভাবনা দূর করার জন্য কোন অন্যায় আবদার রক্ষা করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।”
“আমি যতক্ষণ এখানে আছি ততক্ষণ আমার আদেশই চলবে।” খৃস্টান এক সামরিক অফিসার বললো।
তোমাদেরকে আমরা ভাড়া করেছি আমাদের সহযোগিতা করার জন্য। এ জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিকও দেয়া হয়েছে তোমাদের।” জুরদিক বললেন, “এখানে আমাদের আদেশই চলবে। কোন ভাড়াটিয়ার আদেশ মেনে চলতে শিখিনি আমরা ।”
রাগে বিকৃত হয়ে গেল খৃস্টান অফিসারদের চেহারাগুলো। দাঁতে দাঁত চেপে একজন বললো, “আমরা এখানে তোমাদের চাকর হিসাবে আসিনি, এসেছি উপদেষ্টা হিসাবে। আমাদের উপদেশ মেনে চলতে তোমরা বাধ্য ।”
“এটা আমার দেশ। আমরা মুসলমান। অবস্থা আমাদের আপোষে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে। যদি তুমি নি:স্বাৰ্থভাবে এখানে আমাদের সাহায্য করার জন্য এসে থাকো, তবে আমি তোমার সঙ্গে আছি। কিন্তু আমি সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই, আমার জাতির ওপর কোন নিপীড়নমূলক জুলুম চালানো হলে আমি তার প্রতিশোধ নেবাে।”
সুস্থভাবে আলোচনার কোন পরিবেশ ছিল না। সেখানে। এই বাকবিতণ্ডা ও উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য দু’জন প্রভাবশালী আমীর জুরাদিককে ধরে টেনে হিঁচড়ে কামরার বাইরে নিয়ে গেল ।
জুরাদিককে বাইরে নিয়ে যাওয়ার পর খৃষ্টানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অন্য এক আমীর বললো, দয়া করে আপনারা আমার কথা একটু শুনুন। অবস্থা যা, তাতে জুরাদিককে অসন্তুষ্ট করা যাবে না। এ ব্যক্তিকে জোর করে বশ করা সম্ভব নয়। তার কেল্লার সমস্ত সৈন্য তার ইশারায় জীবন দিয়ে দিতেও পিছপা হবে না। শক্তি নয়, তাকে কৌশলে কাবু করতে হবে। আপনারা যদি একটু ধৈর্য ধরেন, তবে তা খুব কঠিন হবে না।’
তারপর সে খৃস্টানদের সামনে তার পরিকল্পনা তুলে ধরলো। খৃস্টানরা নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে জুরাদিককে আবার ভিতরে নিয়ে আসতে বললো । সে এলে তাকে বলা হলো, “ঠিক আছে, জনগণকে হয়রানী করা হবে না। তবে খুনীদেরকে খুঁজে বের করারও প্রচেষ্টা চলবে।”
জুরদিক বললেন, “ঠিক আছে। বাড়াবাড়ি না করলে আমি নিজেও চেষ্টা করবো খুনীকে পাকড়াও করতে।”
তিন চারদিন পর জুরদিক হলব থেকে যাত্রা করলেন। তিনি তার কেল্লা হেম্মাতে যাচ্ছিলেন। তিনি শহরে থাকা অবস্থায় তার উপস্থিতিতেই খুনীদের ব্যাপারে অনেক অনুসন্ধান ও তল্লাশী চালানো হয়। কিন্তু তার নিষেধ অগ্রাহ্য করে কোন ঘরেই ব্যাপক তল্লাশী চালানো হয়নি দেখে তৃপ্ত মনেই যাচ্ছিলেন তিনি।
খৃস্টানরা সেদিনের অপমানের কথা ভুলেনি। তারা জুরদিকের দিকে লক্ষ্য রাখছিল। আর অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মনে মনে নানা রকম ফন্দি আটছিল ।
জুরদিকের সঙ্গে ছিল দশ বারো জন রক্ষী যোদ্ধা। তারাও জুরদিকের মত অশ্বাপূষ্ঠে সমাসীন। মরুভূমির বালিয়াড়ি মাড়িয়ে ওরা পাহাড়ী এলাকায় উঠে এল। চারপাশের পাহাড় চূড়া ও উচু-নিচু টিলার মাঝখান দিয়ে সরু পাহাড়ী রাস্তা এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে। জুরাদিকরা এগিয়ে চললো সেই সংকীর্ণ পথ ধরে ।
সামনে জুরদিক, পেছনে রক্ষী সেনারা সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ কোথেকে ছুটে এলো দুটি তীর। বিদ্ধ হলো জুরদিকের ঘোড়ার মাথায়।
তীর দুটাে জুরাদিককে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হলেও হঠাৎ ঘোড়া লাফিয়ে উঠে মাথা তোলায় অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন জুরাদিক।
দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলা ঘোড়ার মত বেসামাল ভঙ্গিতে এলোপাথাড়ি ছুটতে লাগলো ঘোড়া। ছুটে এলো আরও দুটাে তীর।
জুরদিকের ভাগ্যই বলতে হবে, এবারও নিশানা ব্যর্থ হলো দুশমনের, তীর দুটাে আগের মতই আঘাত করলো ঘোড়ার গায়ে ।
শূন্যে লাফিয়ে পড়লো ঘোড়া, পিঠ থেকে আরোহীকে ফেলে দেয়ার জন্য শুরু করলো প্ৰচণ্ড দাপাদাপি । ডাইনে বায়ে পা জুড়ে সামাল দিতে চাইল মরণযন্ত্রণা।
জুরদিক অশ্বারোহণে ছিলেন অসম্ভব। পটু। তিনি ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়লেন। মুহুর্তে নিজেকে ছুড়ে দিলেন এক পাথরের আড়ালে।
পলকের জন্য থমকে দাঁড়াল রক্ষীরা। তারপর ক্ষিপ্ৰগতিতে ছুটিল তীরের উৎস সন্ধানে। মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়লো এদিক-ওদিক ।
দু’জন করে পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ওরা।
এলাকাটা এমন জটিল, কাউকে খুঁজে পাওয়া বা ধরা খুবই মুশকিল। জুরদিক বুঝলো, এটা ভাড়াটে খুনীর কাজ। নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করার জন্য এদেরকে খৃস্টানরা লেলিয়ে দিয়েছে।
ওই ঘটনার পর থেকে খৃস্টানরা জুরাদিককে সুলতান আইয়ুবীর বন্ধু বলে সন্দেহ করতে লাগলো। তারা জানে, জুরদিক সাহসী এবং বীর যোদ্ধা । তাকে হত্যা করতে হলে প্রফেশনাল খুনীদেরই নিয়োগ করতে হবে।
জুরদিক সন্তৰ্পনে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে উঠে গেলেন এক টিলার ওপরে। ওখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে মেলে ধরলেন দৃষ্টি। অসংখ্য ছোট ছোট টিলা আর বিবৰ্ণ প্ৰান্তর ছাড়া কোন জন মানুষের ছায়াও চোখে পড়ল না তাঁর ।
রক্ষীরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আততায়ীদের খুঁজে ফিরছিল। হঠাৎ একজন চিৎকার করে বলল, “জলদি এদিকে ছুটে আসো সবাই! আমি ওদের দেখে ফেলেছি। ধরতে হলে ওদের ঘিরে ফেলতে হবে।”
চিৎকার শুনে অন্য রক্ষীরা ছুটলো সেই দিকে। একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়েছিল তিনজন লোক। সবাই মুখোশ পরা। কিন্তু তাদের কাছে কোন তীর ধনুক নেই।
একটু দূরে পাহাড়ের এক খাঁজে তিনটি ঘোড়া ছিল। কিন্তু ঘোড়ায় চড়ে পালানোর কোন চেষ্টা করেনি তারা।
মুখোশের কারণে ওদের চেহারা দেখা যাচ্ছিল না, শুধু দেখা যাচ্ছিল চোখ দুটোর নড়াচড়া। তাদের ধরে নিয়ে এসে জুরদিকের কাছে হাজির করা হলো। “তোমাদের ধনুক ও তীর কোথায়?” জুরদিক প্রশ্ন করলেন।
“আমাদের কাছে কোন তীর ধনুক নেই, অস্ত্র বলতে শুধু তলোয়ার আছে।” একজন বললো।
‘শোন!’ জুরদিক শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘তোমাদের চারটি তীরই লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে, আমাকে হত্যা করতে পারেনি। তোমাদের কপাল খারাপ, তোমরা ধরাও পড়ে গেছে। এখন অযথা মিথ্যা বলে নিজেদের অপরাধ আর বাড়িও না!”
“তীর!” ওরা আশ্চর্য হয়ে বললো, “আমরা কারো ওপর তীর চালাইনি, আমরা নিরীহ মুসাফির! একটু বিশ্রামের জন্য এখানে থেমে ছিলাম। আবার যাত্রা করতে যাবাে এমন সময় এই লোকেরা আমাদের ঘেরাও করে ধরে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে।”
জুরদিক হেসে বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে শত্রু মনে করি না। যদি তা করতাম। তবে তোমাদের তিনজনের গর্দান এতক্ষণে মাটিতে গড়াগড়ি যেত। আমি জানি, তোমরা ভাড়াটে খুনী। আমাকে শুধু বলো, আমাকে হত্যার জন্য তোমাদের কে পাঠিয়েছে? তোমরা সত্য কথা বলে এখান থেকে চলে যাও, তোমাদের কিছুই বলা হবে না।”
দুই মুখোশধারী কসম করে বললো, “আমরা জানিনা কে বা কারা আপনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। এ ব্যাপারে আমাদের কোন ভূমিকা নেই, আমরা নিরপরাধ।”
কিন্তু তৃতীয় মুখোশধারী কোন কথা বললো না, সে নিরবে তাকিয়ে রইল জুরদিকের দিকে।
“তোমরা বোকামী করে নিজেদেরকে বিপদে ফেলো না।” জুরদিক বললেন, “অন্যের জন্য নিজের প্রাণ হারাতে যেয়ো না। আমি তো বলেছি, আমি তোমাদের কোন শাস্তি দেবো। না। সত্য কথা বললে এখনই তোমাদের মুক্ত করে দেবাে।’
মুখোশধারীরা তবুও ইতস্তত: করতে লাগলো, কেউ মুখ খুললো না।
“এদের মুখোশ খুলে দাও।” জুরদিক তার রক্ষীদের বললেন, “এদের দেহ তল্লাশী করো, সব হাতিয়ার কেড়ে নাও।”
দুই মুখোশধারী চোখের পলকে তলোয়ার টেনে বের করে দ্রুত পিছনে হটে গেল। তৃতীয় মুখোশধারী ছুটে গিয়ে লুকালো তাদের পিছনে। কারণ তার কাছে তলোয়ারও ছিল না ।
জুরদিক হাে হাে করে হেসে বললেন, “তোমরা কি এতগুলো রক্ষীর মোকাবেলা করতে চাও? একজনের তো আবার তলোয়ারও নেই! যাক, আমি তোমাদেরকে আরও একবার সুযোগ দিচ্ছি এবং এটাই তোমাদের জন্য সর্বশেষ সুযোগ । এরপর আমি বাধ্য হবো তোমাদের ওপর রক্ষীদের লেলিয়ে দিতে । ওরা তোমাদের হাডিড-মাংস এক করে দিলে আমাকে দোষ দিও না!”
রক্ষীরা তাদের ঘিরে রেখেছিল। ওদের একজন বললো, “আমরাও শেষ বারের মত বলছি, আমরা কেউ তোমাদের ওপর তীর চালাইনি। যে কাজ আমরা করিনি জীবনের মায়ায় তা স্বীকার করলে আসল অপরাধীরা নিস্কৃতি পেয়ে যাবে। আমাদেরকে খুন করলেও তাতে তোমার কোন লাভ হবে না।” রক্ষী কমাণ্ডার তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার কি জানি কি সন্দেহ হলো, সে টান মেরে তৃতীয় মুখোশধারীর মুখোশ খুলে ফেললো ।
তার কাছে কোন তলোয়ার ছিল না। মুখোশ খুলে যেতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তার চেহারা। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল। মুখোশের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক সুন্দরী যুবতীর মুখ।
জুরদিক বললেন, “ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”
দুই মুখোশধারীই বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে পিছনে ঘুরে মেয়েটির পাশে দণ্ডায়মান রক্ষীর বুকে তলোয়ার ধরে চ্যালেঞ্জের সুরে বললো, যতক্ষণ আমাদের কাছে সব কথা খুলে না বলবে এবং আমাদের সমস্ত কথা না শুনবে, ততক্ষণ এই মেয়ে কারো কাছে যেতে পারবে না।”
আরা আরো বললো ‘আমরা জানি, তোমাদের হাতে আমাদের মরতে হবে। আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোমরা এনেছো তাতে আমাদেরকে তোমরা ছাড়বে না। তবে আমরাও তোমাদের বলতে চাই, এই মেয়েকে তোমরা জীবিত পাবে না। আর অন্তত তোমাদের অর্ধেক লোক এই সংঘর্ষে শেষ হয়ে যাবে।”
জুরদিক তখনও শান্ত। তিনি মুখোশধারীদের লক্ষ্য করে বললেন, “তোমরা আমার কাছে আর কি শুনতে চাও? আমার কথা তো আমি পরিস্কার করেই বলেছি, তোমরা ভাড়াটে খুনী, আর এই মেয়েটাকে তোমরা পেয়েছো কাজের অগ্রিম হিসাবে।”
“তোমার দুটি কথাই ভুল।” এক মুখোশধারী বললো, “আমরা যদি অপরাধী হই তবে সে অপরাধ হচ্ছে, একজন খৃস্টান গোয়েন্দা ও তার সহকারী এক খৃস্টান মেয়েকে আমরা হত্যা করেছি। এটাকে আমরা কোন গোনাহের কাজ মনে করি না। আমাদের দুর্ভাগ্য, পালানোর পথে আমরা তোমাদের হাতে ধরা পড়লাম। কিন্তু আমরা খুশী এই কারণে, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি। এক নির্যাতীত মুসলিম বােনকে খৃস্টানদের কবল থেকে উদ্ধার করতে পেরেছি।”
“তোমার এ গল্প সত্য হলে আমাকে বলো, তোমরা কে, কোথেকে এসেছে এবং কোথায় যাচ্ছে?”
“আমরা হিলব থেকে এসেছি এবং আমাদের গন্তব্য এখন দামেশক।”
উইণ্ডসার ও খৃস্টান মেয়েটিকে কি তোমরাই হত্যা করেছাে?” জুরদিক জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু আমার ওপর তীর চালালে কেন তোমরা? আমি তোমাদের শত্ৰু না বন্ধু তাই বা জানলে কি করে?”
“আমি আগেও বলেছি, আমরা তোমার ওপর তীর চালাইনি, তবে তোমাকে আমি ভালমতই চিনি। তোমার নাম জুরাদিক এবং তুমি হেম্মাত দুর্গের অধিপতি।’ মুখোশধারী বললো, “আর এটাও ভাল করে জানি, তুমি সুলতান আইয়ুবীর শত্রু। কিন্তু তাই বলে তোমাকে হত্যা করর কোন প্রয়োজন পড়েনি আমাদের!
আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। তারই সাহায্যে আমরা তোমাদের ওপর বিজয়ী হবো। লড়াইয়ের ময়দানে হয় তোমরা খুন হবে নয়তো আত্মসমৰ্পণ করে বন্দীত্ব বরণ করবে আমাদের। শক্রকে না জানিয়ে আমরা কারো ওপর আঘাত করি না ।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী হাসান বিন সাব্বাহ বা শেখ মান্নান নন। তিনি চ্যালেঞ্জ করে যুদ্ধ করেন, চুরি করে কাউকে হত্যা করেন না।
উইণ্ডসার ও তার সঙ্গী মেয়েটি খুন হয়েছে নিজের দোষে।। ওরা আমাদের চ্যালেঞ্জ না করলে ওদের আমরা হত্যা করতাম না! ওদের খুন হওয়ার পেছনে সুলতান আইয়ুবীর কোন আদেশ বা ইচ্ছা ছিল না।”
সে জুরদিকের ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো, অনতিদূরে ঘোড়াটি মরে পড়ে আছে। তার মাথা ও গায়ে এখনো বিধে আছে আততায়ীর বিষাক্ত তীর । , মুখোশধারী জুরাদিককে লক্ষ্য করে বললো, “আমরা যে তীর ছুড়িনি তা যদি প্রমাণ করতে চাও তাহলে তোমাদের যে কেউ ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে যাও । আমাদের দু’জনের কোন একজনের হাতে তীর-ধনুক দাও। এরপর যত খুশী তীরবেগে অশ্ব চালাও, ডাইনে ও বায়ে এঁকে বেঁকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করো, আমাদের যাকে বলবে সে ছুটন্ত অশ্বপৃষ্ঠ থেকে একটি মাত্র তীর ছুড়বে। যদি সে তীর মিস হয় তবে আমাদের গর্দান উড়িয়ে দিও, আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না। আমরা এমন তীরন্দাজ নই, কোন টার্গেটে তীর ছুড়লে তা ব্যর্থ হবে। আমরা তীর ছুড়লে এখন আমাদের কথা শোনার জন্য তুমি আর বেঁচে থাকতে না।”
“তুমি দেখছি অসাধারণ সৈনিক!” জুরদিক বললেন, “তুমি কি সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনীতে আছো?”
‘সে প্রশ্ন করার কোন অধিকার নেই তোমার।” মুখোশধারী বললো, “তুমি কি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যদলের লোক ছিলে না? তুমি কি ইসলামী জেহাদে বীর মুজাহিদ হিসাবে লড়াই করোনি? সামান্য কেল্লার অধিপতি হওয়ার লোভ তোমার মাথা এমনভাবে বিগড়ে দিয়েছে, এখন তুমি নিজেকে চিনতে পারছো না, তোমার জাতিকে চিনতে পারছে না। ক্ষমতা ও সম্মানের লোভে যে লোক নিজের আত্মার হাহাকার শুনতে পায় না, আমার পরিচয় দিয়ে তার কি কাজ? কাফেরদের সাথে যে নিজের ভবিষ্যত জুড়ে দিয়েছে, সে লোক ইসলামের মুজাহিদদের চিনবে কি করে!” জুরদিক স্তব্ধ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো মুখোশধারীর দিকে। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। বিষাক্ত তীরের চেয়েও বক্তার কথার তীর তার বুক যেন ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। মুখোশধারী থামতেই জমাট নিস্তব্ধতা নেমে এল সেই টিলার চূড়ায়। বাতাসের হাহাকারের ফিসফিসানি শুনতে পেলেও জুরদিকের আত্মার ক্ৰন্দন ও হাহাকার কেউ শুনতে পেল না ।
“তুমি গাছের সেই বিচ্ছিন্ন ডাল, যে ডালের ভাগ্যে ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরা ছাড়া কোন গতি নেই।” অপর মুখোশধারী বলল, “তুমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নও যে, সুলতান আইয়ুবী তোমাকে হত্যা করার জন্য পেরেশান হবেন। তোমাকে মেরে ফেলে মুক্তি দিয়ে লাভ নেই, বরং সারা জীবন বেঁচে থেকে নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্য করলেই তোমার উচিৎ সাজা হবে। যে খৃস্টানদের পুতুল হয়ে কাজ করছে, প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেলে সে খৃস্টানরাই তোমাকে হত্যা করবে।”
“তুমি হলবে গিয়েছিলে শরাব পান করতে, আমোদ-ফুর্তি করতে। গিয়েছিলে এ মেয়ের নাচ দেখে চােখ সার্থক করতে।” প্রথম মুখোশধারী বললো, “কিন্তু একবারও ভাবলে না, এই নর্তকীরা কারা!”
মুখোশধারীর পেছন থেকে এবার কথা বলে উঠল মেয়েটি, “আমি এক মুসলিম মেয়ে। আমাকে জোর করে ধরে এনে খৃষ্টানরা তাদের আসরে আমাকে নাচতে বাধ্য করেছে, আমার শরীর নিয়ে খেলেছে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন, আমি আপনাদেরই এক হতভাগী মেয়ে। আপনারা এতই আত্মবিস্মৃত ও নির্লজ্জ হয়ে গেছেন, নিজের কন্যাকে নষ্ট করতেও আপনাদের বিবেকে বাঁধে না, একটু ঘূণাবােধও জাগে না।’
মেয়েটির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু । সে উদগত কান্নার গমক সামলে আবার মুখ খুললো, “আমি খৃস্টানদের সাথে সাত আট বছর কাটিয়ে এসেছি। দেখেছি তাদের, যাদের আপনারা বন্ধু বানিয়ে দাওয়াত করে খাওয়াতে পারলে গর্ববোধ করেন। আমি তাদের অন্তরের সেইসব গোপন কথা শুনেছি, যা কোনদিন আপনাদের কানে আসে না। তাদের সে অট্টহাসি শুনেছি আমি, যা আপনারা শুনতে পান না। ওরা বন্ধুত্বের কথা বলে মুসলমানদেরকে ধোঁকা দেয়। এক মুসলমানকে লেলিয়ে দেয়। অন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আর আপনারা যখন তাদের উস্কানিতে পরম্পর যুদ্ধে লিপ্ত হন, তখন তারা মদের পেয়ালা হাতে নিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আর আমাদের বলে, ‘নাচো সুন্দরী, নাচো!
পাহাড়ের মতই স্তব্ধ অটল পাথর হয়ে গেছেন জুরাদিক। তার কণ্ঠে কোন ভাষা নেই, চোখে পলক নেই, অঙ্গে নেই জীবন্ত মানুষের স্বাভাবিক নড়াচড়া।
রক্ষীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে । এমন আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন জাদরেল ব্যক্তিত্ব কি করে লোকগুলোর এ রূঢ় তিরস্কার নিরবে সহ্য করছেন?
গভীর চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন স্মৃতি ভেসে উঠছিল মনের পর্দায়। মনে পড়লো, রিমাণ্ডের সামরিক উপদেষ্টাদের সাথে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের কথা। হলবের ঘরে ঘরে তল্লাশীর বিরুদ্ধে তার রুখে দাঁড়ানোর কথা। খলিফা এবং আমীরদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া অগ্রাহ্য করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা।
তিনি শান্ত, ভদ্র ও নম্র সুরে মুখোশধারীদের বললেন, “আমি তোমাদেরকে আমার কেল্লায় নিয়ে যেতে চাই”
‘কয়েদী বানিয়ে?”
জুরদিক সকলকে অবাক করে দিয়ে বললেন, “না! মেহমান হিসাবে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, তোমাদের তলোয়ার তোমাদের কাছেই থাকবে।”
নিশ্চিন্ত মনে ঘোড়ায় চড়ে বসলো সবাই। জুরদিকের ঘোড়া মারা গিয়েছিল, তিনি এক রক্ষীর ঘোড়া নিয়ে তাতে উঠে বসলেন। কাফেলা এগিয়ে চললো হেম্মাত দুর্গের দিকে।
কাফেলা সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে। সরু রাস্তা ধরে দু’তিনটি টিলা অতিক্রম করার পর অকস্মাৎ দুটাে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল। সকলেই চাইল শব্দের উৎসের দিকে। দেখা গেল এক টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে দুটাে ঘোড়া তীব্ৰ বেগে হলবের দিকে ছুটে পালাচ্ছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের সাথে রয়েছে তীর ও ধনুক ।
‘এরাই সম্ভবত তোমাদের খুনী।’ বললো এক মুখোশধারী।
সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধাওয়া করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো ওরা।
মুখোশধারীরাও ছুটলো তাদের পেছনে। দু’জনই কোষবদ্ধ তলোয়ার হাতে তুলে নিয়েছে। মেয়েটিও সঙ্গী হলো কাফেলার ।
রক্ষীরা ঘোড়া ছুটিয়ে ছুটছিল তাদের পিছনে। সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল দুই মুখোশধারী।
সামনে বালির টিলা, টিলার ওপারে বাঁক নিয়েছে রাস্তা। পালিয়ে যাওয়া আরোহীরা মোড় ঘুরে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। ধাওয়াকারীরা এখনো বেশ পেছনে।
মুখোশধারী দু’জন তীব্ৰ গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দূরত্ব অনেক কমিয়ে এনেছিল। কিন্তু তখনো আততায়ীরা ধরা ছোয়ার বাইরে।
মোড় ঘুরেই আততায়ী দু’জন গতি কমিয়ে আনলো ঘোড়ার। কাধ থেকে ধনুক নামিয়ে ধনুকে তীর জুড়ে পিছু ধাওয়াকারীদের ওপর তীর চালাল। ধাওয়াকারীরা তখনো তীরের আওতার বাইরে, তাই লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হয়ে গেল তীর। কিন্তু পিছু ধাওয়াকারীদের জন্য তা বিপদ ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
মুখোশধারী দু’জন ধাওয়াকারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। টিলার কারণে ওদের দেখতে পায়নি আততায়ী। মোড় ঘুরেই ওরা ওদের সামনে পড়ে গেল। মাত্র কয়েক গজের ব্যবধান। দু’পক্ষই পরস্পরকে দেখে ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে গেল। আততায়ী দু’জন তীর চালাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু মুখোশধারীরা তাদের সে সুযোগ দিল না। একজন ঝাপিয়ে পড়ে এক আততায়ীর ঘোড়ার পিছনে তলোয়ারের কোপ বসিয়ে দিল ।
ঘোড়া লাফিয়ে উঠল। শূন্যে। অন্য মুখোশধারীর তলোয়ারের আঘাতে অপর আততায়ীর একটি হাত কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দেহ থেকে। প্রতিরোধ শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল ওদের। রক্ষীরা এলে বন্দী আততায়ীদের তুলে দিল ওদের হাতে।
মুখোশধারীরা এবার তাদের মুখোশ খুলে ফেললো। বললো, “আমরা দু’জন সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দো।”
তাদের একজন ছিল খলিল, অন্যজন তার সাখী। আর যারা পালাতে গিয়ে ধরা পড়লো তারাও ছিল মুসলমান। জুরাদিককে হত্যা করার জন্য তারাই তীর ছুড়েছিল।
এর মধ্যে যার হাত কাটা গিয়েছিল তাঁকে নিৰ্দয়ের মত দূরে ছুঁড়ে ফেলে দ্বিতীয়জনকে হাজির করা হলো জুরদিকের সামনে। তাকে বলা হলো, “যদি জীবিত ফিরে যেতে চাও, তবে জলদি বলো, কে তোমাদের পাঠিয়েছে? নইলে যে হাত দিয়ে তীর ছুড়েছে সে হাত কেটে ফেলা হবে।”
সে বললো, “আমাদের দু’জনকে রিমাণ্ডের এক সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছে। দু’জন মুসলমান আমীরের উপস্থিতিতে আমাদের বলা হয়েছে, অমুক দিন এতটার সময় জুরাদিক হলব থেকে যাত্রা করবে। সে অমুক সময় পাহাড়ী প্রান্তরে গিয়ে পৌছবে।
আমাদের দু’জনকে আশাতীত পুরস্কার দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সেখানে নির্জন প্ৰান্তরে তোমরা লুকিয়ে থাকবে এবং জুরাদিককে তীরবিদ্ধ করে পালিয়ে আসবে।”
সে আরো বললো, ‘নির্দিষ্ট সময়েই আমরা এখানে এসে পৌঁছি এবং রাস্তা থেকে একটু দূরে উচু এক টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আপনাকে আসতে দেখলাম। আমরা সময় মতই তীর ছুড়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ ঘোড়া লাফিয়ে উঠায় আমাদের তীর লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হয়। দুৰ্ভাগ্য আমাদের, দুটাে তীরই ঘোড়ার মাথায় গিয়ে বিধে। লাফালাফির কারণে এবারও আমরা ব্যর্থ হই। এরপর আমরা বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি।”
সে বললো, “এখানে লুকানোর অনেক জায়গা ছিল। আমরা এক জায়গায় ঘোড়া লুকিয়ে রেখে তাদের মুখ বেঁধে দিয়েছিলাম, যাতে ওরা শব্দ করতে না পারে।”
এরপর তীরন্দাজরা কোথায় লুকিয়ে ছিল সে জায়গা রক্ষীদের দেখাল। রক্ষীরা যখন চারদিক ছড়িয়ে পড়ে ওদের খুঁজছিল তখন ওরা সেখান থেকে লুকিয়ে সবই দেখতে পাচ্ছিল।
যখন কেউ একজন চিৎকার করে বললো, ‘এদিকে এসো, ধরে ফেলেছি’। তখন তীরন্দাজরা দেখলো, রক্ষীরা তিনজন মুখোশধারীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারা এতে খুবই খুশী হলো, যাক, আপাততঃ জান তো বাঁচিলো! কিন্তু তবু তারা সেখান থেকে পালানোর সাহস করলো না। কারণ, ধরা পড়ার কোন রিস্ক নিতে চাচ্ছিল না ওরা ।
অনেক পরে যখন জুরদিক তার রক্ষীদের নিয়ে রওনা হলো তখন ওরা ভাবল, বিপদ কেটে গেছে, এবার যাওয়া যাক।
ওরা ওদের ঘোড়ার কাছে গেল। ঘোড়ার মুখ খুলে অশ্বপৃষ্ঠে চেপে ছুটলো হলবের দিকে। তারা বুঝতে পারেনি, জুরাদিক তাদের পলায়ন টের পাবে এবং টের পেলেও সাথে সাথে পিছু ধাওয়া করবে ।
ওদের ধারনা ছিল, খুনী সন্দেহে যাদের জুরদিক বন্দী করেছে তারা অস্বীকার করলেও জুরদিক তাদের বিশ্বাস করবে না। এবং আসল ঘাতকরা ধরা পড়েনি এটা টের পাবে না। কিন্তু দুৰ্ভাগ্য তাদের, তাদের সব ধারনা ও হিসাব ভুল প্রমাণিত করে নিয়তি তাদের ধরিয়ে দিল।
জুরদিক তীরন্দাজকে সঙ্গে নিয়েই হেম্মাতের দিকে রওয়ানা হলেন আবার । অপর তীরন্দাজ ততক্ষণে কাটা বাহুর রক্তক্ষরণে ছটফট করে মারা গেছে।
রাস্তায় জুরদিক খলিল ও হুমায়রার পুরো কাহিনী শুনলো। কেমন করে ওরা উইণ্ডসারকে খুন করেছে খুলে বললো খলিল।
জুরদিক অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, এই ব্যাপক অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে কিভাবে ওরা হলব থেকে নিরাপদে বেরিয়ে এলো! এক সময় বলেই ফেললো, কিন্তু হলব থেকে তোমরা বেরোলে কি করে? ওখানে তোমাদের গরু-খোঁজা করে খোঁজা হচ্ছে টের পাওনি?”
খলিল বললো, “ওখানে আমাদের এক কমাণ্ডার থাকেন। আমি তার নাম-ঠিকানা বলতে চাচ্ছি না, তিনিই আমাদের বেরিয়ে আসার পথ বের করে দিলেন।”
‘কিভাবে?” জানতে চাইলেন জুরাদিক।
‘নবজাতক এক শিশুর মত একটি পুতুলকে কাপড়ে জড়িয়ে লাশ দাফনের জন্য চার পাঁচজন লোক কবরস্থানে রওনা হলো। কমাণ্ডার হুজুর হিসাবে কাফন পরা লাশ হাতে নিলেন। আমি ও আমার এ বন্ধু মুসল্লীর পোষাকে এবং হুমায়রা পুরুষের বেশে অন্য দু’জনের সাথে হুজুরের শিষ্য হিসাবে লাশের পিছনে কবরস্থানে চলে গেল। কবরস্থান শহরের বাইরে থাকায় ফটকে কেউ আমাদের বাঁধা দেয়নি ।
কবরস্থানের পাশে আগে থেকেই তিনটি ঘোড়া রাখা ছিল। হুজুরের অন্য এক শিষ্য সে ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিল কবরস্থান থেকে একটু দূরে।
হলবের সেনাবাহিনীর চোখের সামনে দিয়েই কবরস্থানে গিয়েছিলাম আমরা। জানাজা পড়ানো হলো । লাশ দাফন করে আমরা তিনজন অশ্বগৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে দ্রুত সে এলাকা ত্যাগ করলাম।”
কাফেলা কেল্লায় পৌছতে বেশ রােত হয়ে গেল। খলিল, তার বন্ধু এবং হুমায়রাকে সসম্মানে মেহমান হিসেবে কেল্লায় অভ্যর্থনা জানালেন জুরাদিক। খলিলকে বললেন, “খেল্লাত, আমাকে দুশমন নয়, বন্ধু মনে করো। আমাকে বলো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখন কি করছেন? তিনি কি আস সালেহের ওপর শিঘই অভিযান চালাবেন?”
আমি সুলতান আইয়ুবীর পরিকল্পনা সবটা জানি এমন নয় তবে যেটুকু জানি তাও এখন আপনাকে বলতে চাই না।” খলিল তাকে বললো, “এমনকি আমি হলব থেকে কি কি তথ্য নিয়ে যাচ্ছি তাও আপনাকে জানাতে প্ৰস্তুত নই।”
জুরদিক বললেন, ‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে আমার ব্যক্তিগত শক্রতা ছিল । সেই শক্রতার রেশ ধরেই আমি তার বিরুদ্ধে চলে গেলাম। তার কারণ যাই থাক, আমি যে ভুল করেছিলাম তা এখন বেশ বুঝতে পারছি। আমার এই উপলব্ধি এসেছে দুশমনের তৎপরতা দেখে। আমি খৃস্টানদের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছি। একদিকে তারা আমার সেনাবাহিনী ও আমার দুর্গ ব্যবহার করতে চায়, অন্যদিকে হত্যা করতে চায় আমাকে।
মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর কথাই ঠিক। তিনি সব সময় বলতেন, হেলাল ও ক্রুশের মধ্যে আপোষহীন এক যুদ্ধ চলছে। এটা কোন খৃস্টান রাজা ও মুসলমান সুলতানের লড়াই নয়। অমুসলিম কখনাে মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। যখন অমুসলিম বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় তখন তার হাতে লুকানো থাকে কোন বিষাক্ত ছোবল ।”
“আইয়ুবীও সেই একই আদর্শের অনুসারী। তিনি সব সময় বলেন, যেদিন মুসলমান অমুসলিমের বন্দধুত্ব কবুল করবে, সেদিন থেকে ইসলামের অবক্ষয় ও ধ্বংসের যাত্রা শুরু হবে।” “এখন আমি বুঝতে পারছি, জঙ্গী ও আইয়ুবী দুরদশী বলেই দোস্ত ও দুশমন চিনতে ভুল করেনি ওরা।”
“তবে কি আপনি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে চান?” খলিল বললো, “আমি একজন সাধারণ সিপাই। একজন কেল্লাধিপতিকে প্রশ্ন করার মত দুঃসাহস দেখানো আমার উচিত নয়। কিন্তু মুসলমান হওয়ার কারণে আমারও হক রয়েছে, কোন মুসলমানকে বিভ্রান্ত হতে দেখলে তাকে এ কথা বলা যে, আপনি ভুল পথে যাচ্ছেন।”
“হ্যা।” জুরদিক বললেন, “তোমার এ অধিকার আছে। আমি তোমাকে একটি সংবাদ দিতে চাই। এ সংবাদ তুমি চুপি চুপি কেবল সুলতান আইয়ুবীকেই বলবে। আমি কোন লিখিত চিঠি দিতে পারবো না, কোন দূতও পাঠাতে চাই না। তুমি সুলতান আইয়ুবীকে বলবে, হেম্মাত দুৰ্গকে যেন তিনি আপন দুৰ্গ মনে করেন। তিনি ছাড়া একথা কোন বিশ্বস্ত সেনাপতিকেও বলবে না। আমি এ তথ্য কঠোরভাবে গোপন রাখতে চাই।
খৃস্টানরা বন্ধুত্বের নামে আমাদের এলাকায় প্রভূত্ব বিস্তার করতে চাচ্ছে। এরই মধ্যে এ প্রভুত্বের থাবা তারা অনেক দূর বিস্তার করে ফেলেছে। তিনি যেন শীতের পরপরেই আক্রমণ চালান। এদিক থেকে আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই তাকে অভিযান শুরু করতে বলবে। আর তিনি যদি আগেভাগেই অভিযান শুরু করতে পারেন। তবে যেন হেম্মাতের পথ হয়েই এগিয়ে যান। আমি ইনশাআল্লাহ পুরাতন বন্ধুত্বের দাবী পূরণ করবো ।”
পর দিন ভোরে জুরদিক খলিল, তার সাখী এবং হুমায়রাকে সসম্মানে বিদায় জানালেন কেল্লার ফটকে এসে ।
খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের কমাণ্ডার উইগুসারের খুন হওয়া নি:সন্দেহে একটি আকস্মিক ও বড় রকমের ঘটনা। তিনি সুলতান আইয়ুবীর দুই গোয়েন্দাকে এমন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তাকে হত্যা না করে তাদের কোন উপায় ছিল না ।
ঘটনাটা আকস্মিক হলেও কাজটি ছিল বিরাট। তাকে হত্যার ফলে সুলতান আইয়ুবী বড় রকমের উপকার পেয়েছিলেন। এতে শক্রর গোয়েন্দা বিভাগ যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। উল্টো দিকে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগ হয়েছিল আরো মজবুত এবং শক্তিশালী। তার গোয়েন্দা কমীরা শুধু গোয়েন্দাই ছিল না, সুদক্ষ যোদ্ধাও ছিল। সে জন্য ধরা পড়ার ভয় কম ছিল তাদের। মুখ বন্ধ রেখে কিভাবে তথ্য আদায় করতে হয়, সে প্রশিক্ষণ তিনি ভালমতই দিয়েছিলেন। যোদ্ধা হওয়ায় ধরা পড়লে ফাইট করে শত্রুর হাত থেকে সহজেই তারা বেরিয়ে যেতে পারতো । কাউকে হত্যা করার প্রয়োজন হলেও পিছপা হতো না।
তাদের শারীরিক গঠন হতো মজবুত। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি, ক্ষুধা, পিপাসা ও ক্লান্তি সহ্য করার মত পর্যাপ্ত প্ৰশিক্ষণ দেয়া হতো তাদের।
এসব গুণগুলো খলিল এবং তার সাখীর মধ্যেও ছিল। তারা শুধু খৃস্টানদের বড় এক অফিসারকেই হত্যা করেনি, জুরদিকের মত বীর কেল্লাধিপতির সাথে সাহসের সঙ্গে কথা বলে তার ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছিল, তাকে সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক বানিয়ে এসেছিল।
খলিল সুলতান আইয়ুবীকে হেম্মাত দুৰ্গাধিপতি জুরদিকের সংবাদ শুনালো। সুলতান এ খবর শুনে পরম প্রশান্তি অনুভব করলেন। মরুভূমিতে একটু ঠাণ্ডা বাতাস পেলে মানুষ যেমন শান্তি অনুভব করে, ঠিক তেমনি। তার সামনে তো দুশমন ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। ঘরেও শত্রু, বাইরেও শত্রু। জুরদিকের সংবাদ এ ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক ব্যতিক্রম।
কিন্তু মনে মনে শান্তি পেলেও এতে তিনি আনন্দে উচ্ছসিত হলেন না। সংবাদটা প্রতারণাও তো হতে পারে! সুতরাং তিনি তাঁর আক্রমণের প্ল্যান পরিবর্তন করলেন না। শুধু এটুকু মনে রাখলেন, হেম্মাত থেকে সাহায্যের আশা করা যায়।
হলব থেকে নিয়মিত সংবাদ পাচ্ছিলেন সুলতান। কিন্তু তাতে কোন নতুনত্ব ছিল না। কোন পরিবর্তন নেই দুশমন শিবিরে। আগের মতই সব রুটিন ওয়ার্ক। সেখানকার কমাণ্ডার ও উপদেষ্টারা নিশ্চিন্ত, শীতকালে আক্রমণের কোন সম্ভাবনা নেই।
এর মধ্যে একটি সংবাদ এল এমন, খৃস্টানরা প্রকাশ্যে সকলের সাথে বন্ধুত্বের ভান করলেও গোপনে মুসলিম আমীরদেরকে পরম্পরের বিরুদ্ধে উস্কানী দিচ্ছে। একজনের ওপর বিষিয়ে তুলছে অন্যজনের মন ।
সুলতান আইয়ুবী আগেও জানতেন, আস সালেহের সমস্ত আমীররা একে অপরের শত্রু। তারা শুধু সুলতান আইয়ুবীকে মোকাবেলা করার জন্যই একত্রে সমবেত হয়েছে।
সুলতান আইয়ুবীর সাথে তাদের শত্রুতার কারণ, তিনি সকলকে আরাম ও বিলাসিত ত্যাগ করতে বলেন। নিজের আবেগ উচ্ছাস ও ইচ্ছার দাস হতে নিষেধ করেন। নফসের গোলামী বাদ দিয়ে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের গোলামী করতে বলেন। এসব কারণে তারা সুলতান আইয়ুবীর মিশন পছন্দ করে না। কারণ, এসব আমীরদের মনে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও একে স্থিতিশীল করার কোন আগ্রহ ছিল না। তারা বিলাসিতা, অলসতা ও আরাম-আয়েশের জন্য দুশমনকেও বন্ধু বানিয়ে নিয়েছিল।
সুলতান আইয়ুবী এখন যুদ্ধের জন্য প্ৰস্তৃত। সেনাবাহিনীর সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন রাতের ট্রেনিংয়ে কেউ আর অসুস্থ হয় না।
১১৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু। সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনা কমাণ্ডারদের সাথে শেষ বারের মত মিলিত হলেন । কেন্দ্রীয় কমাণ্ডের সমস্ত অফিসার এবং গ্রুপ কমাণ্ডাররাও এসে সমবেত হলো সেনা ছাউনিতে।
সুলতান আইয়ুবী তাদের বললেন, এই মুহুর্ত থেকে সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে কোন কথা, তা যত কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয়ই হােক না কেন, বাইরের লোকদের কাছে বলা যাবে না। যাদের সাথে বিবি-বাচ্চা আছে, তারা বাড়ীতেও এ বিষয়ে কোন আলোচনা করবেন না ।
সৈন্যদের অভিযানের সময় হয়েছে, এ কথা কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। সবাই জানবে, সৈন্যরা প্রতিদিনের মত কুচকাওয়াজ করতে যাচ্ছে।”
এ নির্দেশের পর তিনি সমবেত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, “আমাদের আরামপ্রিয় বন্ধু ও ঈমান বিক্রেতা ভাইয়েরা ইসলামের ইতিহাসকে এমন স্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে তোমাদের প্রিয় বন্ধু ও আত্মীয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আজ ফরজ হয়ে গেছে। কেউ কোন দিন কি চিন্তা করেছো, আমাদের নেতা নুরুদ্দিন জঙ্গী মরহুমের সন্তানের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করবো? কিন্তু অবস্থা আজ এমন, মা তার বুকের ধন আপনি সন্তানকে বুক থেকে ছুড়ে ফেলেছে দূরে, আর চিৎকার করে অভিশাপের পর অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। তোমরা কি মরহুম জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর আহাজারী শুনতে পাওনি, শুনতে পাওনি তার হাহাকার ধ্বনি, “আমার মুরতাদ বেটা কেন এখনও জীবিত? হে আমার প্রাণপ্ৰিয় ইসলামের মুজাহিদ ভাইয়েরা, কোথায় তোমরা? ইসলামকে বাঁচাও, আমার গাদার সন্তানের হাত থেকে ছিনিয়ে নাও ক্ষমতার দণ্ড ।”
একটু দম নিলেন তিনি। তারপর আবার বলতে লাগলেন, “হে আমার বন্ধুরা! তোমরা যে সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে তোমাদের চাচাতো ভাই থাকবে, মামাতাে-খালাতো ভাই থাকবে। আমার সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন সৈনিকও আছে, যার আপন ভাই ঈমান বিক্রেতাদের দলে শামিল। যদি তোমরা রক্তের সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্কে মনে জায়গা দাও, তবে ইসলামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে তোমার।
যুদ্ধে যাওয়ার আগে ভাল করে চিন্তা করে নাও, কোন সম্পর্ককে তোমরা অগ্ৰাধিকার দেবে? যদি রক্তের সম্পর্কের চাইতে ইসলামের সম্পর্কই তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে তোমাদের শপথ নিতে হবে। প্ৰতিজ্ঞা করতে হবে, সামনে কে আছে সেদিকে তাকিয়ে দেখবাে না, আমাদের দৃষ্টি থাকবে শুধু পতাকার দিকে। অন্তরে এ সত্যই শুধু অটুট থাকবে, সামনে যাকে আমার কালেমা পড়া ভাই মনে হচ্ছে, সে আমার ভাই নয়। ইসলামের দুশমনরা তাকে অন্ত্র হিসাবে বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সামনে। দুশমনের কোন অস্ত্ৰকেই আমরা অটুট ও অক্ষত রাখবো না। সে কখনো আমার ভাই হতে পারে না, যে আমার ধর্মের বিরুদ্ধে শক্ৰদের সাথে মিলে অন্ত্র ধরেছে।”
কথা বলতে বলতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল। তিনি মাথা নত করে গোপনে চােখের অশ্রু মুছে নিলেন। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। উপস্থিত সেনা কমাণ্ডার এবং অফিসারদের মধ্যেও সঞ্চারিত হলো আবেগের জোয়ার।
সুলতান আইয়ুবী মাথা উঠিয়ে দু’হাত আকাশের দিকে তুলে বলতে থাকলেন, “হে। পরোয়ারদিগার! হে রাহমানুর রাহীম! হে আমাদের প্রভু রাব্ববুল আলামীন! তুমি সাক্ষী থেকো, কেবল তোমার নামের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার জন্য, তোমার রাসূলের সম্মানে আজ আমরা নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰ ধারণ করেছি। হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিটি কদমকে তুমি কেবল হকের পথেই অটল রেখো। তুমি আমাদের অন্তরগুলো দেখতে পাচ্ছে, তুমি জানো, দুনিয়ার কোন সম্পদ, নাম বা ক্ষমতার মোহে আমরা এ অস্ত্ৰ হাতে নেইনি। আমরা আমাদের সর্বোত্তম সামর্থ এবং যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েছি। এখন তোমার পথ নির্দেশ ও সাহায্যই আমাদের একমাত্র ভরসা। হে আল্লাহ! আমাদের এ সিদ্ধান্ত যদি ভুল হয়ে থাকে, এখনি তোমার কুন্দরতি হাত দিয়ে থামিয়ে দাও আমাদের। আর যদি এ সিদ্ধান্ত সঠিক হয়ে থাকে, তবে আমাদের সেই হিম্মত, সাহস ও শক্তি দান করো, যে সাহস ও শক্তি দিয়েছিলে বন্দরের পূণ্যবান মুজাহিদদের।”
হাত তুলে রেখেই চুপ করে রইলেন তিনি, যেন আল্লাহর তরফ থেকে ইঙ্গিতের প্রত্যাশা করছেন।
এক সময় হাত নামালেন এবং উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, “আমরা আমাদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদাস মুক্ত করবো। বায়তুল মুকাদাসের পবিত্ৰ মাটি ব্যাকুল চিত্তে ডাকছে আমাদের । আমাদের চলার পথে যদি আমার বাবাও বাঁধা দিতে আসে, তাকে খুন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবো না আমি । যদি আমার সন্তান বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নির্বিচারে তাকে খুন করতে হাত কাঁপবে না আমার।’
আস্তে আস্তে কমে এল তার আবেগ ও উত্তেজনা। তিনি আবার সেই ঠাণ্ডা মাথার সালাহউদ্দিন আইয়ুবী হয়ে গেলেন। কথা বললেন সংক্ষিপ্ত ও প্রয়োজন মাফিক ।
কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘দুদিন সময় দেয়া হলো ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও প্রস্তুতি সম্পন্ননের জন্য। তৃতীয় রাতে সেনাবাহিনী মুভ করবে।
তিনি প্ল্যান অনুসারে সৈন্যদের গ্রুপ ভাগ করলেন। প্রত্যেক গ্ৰন্পের জন্য নিয়োগ করলেন কমাণ্ডার । কমাণ্ডারদের জানিয়ে দিলেন অভিযানের সময় নির্দেশিকা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন তাদের ।
নিয়মিত সৈন্যদের থেকে আলাদা করলেন কমাণ্ডো বাহিনীকে। তাদের জানিয়ে দিলেন মূল সেনা বাহিনী কখন কোন পথ অতিক্রম করবে। এ সময় কমাণ্ডোদের কাজ কি হবে তাও বলে দিলেন তাদের ।
এরপর বিশেষ গোয়েন্দা কমীদের নিয়ে বসলেন তিনি। বুঝিয়ে দিলেন তাদের কাজ। কখন কোথায় কিভাবে তারা রিপোর্ট করবে বললেন তাদের । কোন বাহিনী কোথাও কোন বিপদ বা সমস্যায় পড়লে কিভাবে সুলতানের সাথে যোগাযোগ করবে সকলকে জানিয়ে দিলেন ।
প্ৰথমেই তিনি মিশরের রাস্তা বরাবর সদা সতর্ক ও গতিশীল কমাণ্ডো বাহিনীকে মার্চ করতে বললেন। এর আগে মুসাফির ও যাযাবরের ছদ্মবেশে গােয়েন্দা বিভাগের সৈন্যদের পাঠিয়ে দিলেন ঐ এলাকায়। রিমাণ্ডের আগমন পথে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বললেন তাদের।
বললেন, “মিশরের আশপাশের নিরাপত্তা এবং রিমাণ্ডের সৈন্য আগমনের পথ রুদ্ধ করা তোমাদের দায়িত্ব। রিমাণ্ডের সৈন্যরা এদিকে পা বাড়ালে তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাবে রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে সন্ত্রস্ত করে রাখবে ওদের। প্রয়োজন মনে করলে জলদি সংবাদ পাঠাবে, যাতে খৃষ্টানদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করে দেয়া যায়।’ খাদ্য ও রসদের ব্যাপারে সুলতানের কোন পেরেশানী ছিল না। কমপক্ষে এক বছর মিশর থেকে রসদপত্র আনার প্রয়োজন হবে না। অন্ত্রশস্ত্র এবং উট ঘোড়ার মজুদ যা গড়ে তুলেছেন, তাও মন্দ নয়।
তিনি বিভিন্ন বাহিনীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিমগ্ন হয়ে পড়লেন অতল ভাবনায়। আবারো খতিয়ে দেখতে লাগলেন। পরিকল্পনা ঠিক আছে কি না।
১১৭৪ খৃস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। রাতের প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে প্রথম দলটি দামেশক ত্যাগ করলো। তীব্ৰ শীতের সাথে হাত মিলিয়েছে তুষার ঝড়। কনকনে হীমশীতল ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে কামড় বসাচ্ছে। সৈনিক ও ঘোড়াগুলো এই তুষারপাতের মধ্যেও চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এতদিনের কঠিন প্ৰশিক্ষণের মাহাত্ম এই প্রথম টের পেলো সৈন্যরা।

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top