৬. আবারো সংঘাত

 ‘কিছুই না।’ আরসালান উত্তরে বললো, ‘আমি আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিলাম, আপনার দুটি সন্তান আছে এবং দুজনই যুবক। আর এরাই আপনার একমাত্র বংশধর।’

 আল ইদরিস এ কথার কোন মর্ম উদ্ধার করতে পারলেন না। তিনি তাকে বললেন, ‘শরাব তোমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে।’ এটুকু বলেই তিনি বাইরে চলে গেলেন।

 আরসালানের মহল থেকে বেরিয়ে আল ইদরিস সোজা আলী বিন সুফিয়ানের বাড়িতে চলে এলেন। তিনি তাকে আরসালানের সব কাহিনী খুলে বললেন। আলী বিন সুফিয়ান তাঁকে বললেন, ‘আরসালানের নাম আমার সন্দেহের খাতাতে তালিকাভুক্ত আছে কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাইনি। গোয়েন্দারা তার ওপর নজর রাখছে।’

 আরসালানের মহল থেকে প্রচন্ড অস্থিরতা ও অশান্ত মন নিয়ে বেরিয়েছিলেন আল ইদরিস। আলী বিন সুফিয়ানের সন্দেহভাজনদের তালিকায় তার নাম আছে এ কথা শুনে কিছুটা শান্ত হলেন তিনি। বললেন, ‘কিন্তু আরসালান গাদ্দারী করছে এটা কি কল্পনা করা যায়?’

 আলী বিন সুফিয়ান তাকে বললেন, ‘শুধু সে একলা নয়, দেশে বিশ্বাসঘাতকদের একটি সংঘবদ্ধ দল আছে। আর এর বিষ সেনাবাহিনীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।’

 আলী বিন সুফিয়ানের এ কথায় তার মনে যে প্রশান্তিটুকু এসেছিল তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। আল ইদরিস তাঁকে বললেন, ‘আমি আরসালানকে সুদানের সেনা সেক্টরে রসদ পাঠানোর দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করেছি। রসদ পাঠানোর দায়িত্ব এখন নিজেই পালন করবো ভাবছি। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে জিনিসপত্রের সংকট নিয়ে।’

 আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা অত্যন্ত সকৌশলে দেশের পল্লীর অঞ্চলের খাদ্যশস্য ও দুম্বা-বকরী দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তারাই হাটবাজারে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে।’

 ‘এদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’

 ‘হ্যাঁ, এ জন্য গোয়েন্দা বিভাগকে তথ্য সংগ্রহের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ওরা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এ কাজে। তাদের বলে দেয়া হয়েছে, কেউ খাদ্যশস্যের একটি দানাও বাইরে পাচার করছে দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে যেন তাকে পাকড়াও করা হয়।’

 দীর্ঘ আলোচনার পর ওরা রসদ পাঠাবার এক পথ খুঁজে বের করলেন।

 আল ইদরিস এই কঠিন মিশনের দায়িত্ব পালনে এতটাই মনোনিবেশ করলেন যে, মন থেকে আরসালানের কথাও বেমালুম ভুলে গেলেন। আরসালান বলেছিল, আপনার দু’টি যুবক ছেলে আছে এবং ওরাই আপনার বংশ রক্ষক। কিন্তু কেন সে এ কথা বলেছিল তা তিনি বুঝননি।

 সন্তানের ব্যাপারে আল ইদরিসের কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। কারণ তারা কেউ বখে যাওয়া সন্তান ছিল না। বংশের সম্মান ও মর্যাদা বজায় রেখেই ওরা এতটা বড় হয়েছে। পাড়াপড়শি তাদের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করে। কায়রো শহরের অভিজাত সমাজে তারা সজ্জন হিসাবে সুপরিচিত। তিনি সন্তানদের নিয়ে বরং গর্ব ও গৌরব বোধ করেন।

 সুলতান আইয়ুবীর অবর্তমানে কায়রো শহরে পাপের যে স্রোত বয়ে যায়, সে স্রোতে কেমন সাধারণ মানুষই ভেসে যায়নি বরং তাদের চেয়েও বেশী ভেসেছে ধনীর দুলাল ও অভিজাত শ্রেণী। বাইরে থেকে দেখতে শহরটা হয়তো সুন্দরই দেখা যেতো, কিন্তু এই আপাত-সুন্দরের অভ্যন্তরে অন্ধকারের যে কুৎসিত একটা বিশাল জগত গড়ে উঠেছিল, সমাজের সৎ ও ভাল লোকদের চোখে তা ধরা না পড়লেও আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বাহিনীর চোখে তা ঠিকই ধরা পড়েছিল।

 গাছে ঝাকি দিলে যেমন টসটসে পাকা ফল টপাটপ নিচে পড়তে থাকে তেমনি যে সব যুবকদের নিয়ে অভিভাবকরা গর্ব করতো সেই সব সোনার ছেলেগুলো টপাটপ ঢুকে যাচ্ছিল এই অন্ধকারের সাম্রাজ্যে। খৃস্টানরা এমনসব জায়গায় এমনসব ফাঁদ পেতে রেখেছিল যে, পতঙ্গের মতই যুবকরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সেই ফাঁদে। মুষ্টিমেয় হুশিয়ার যুবক ছাড়া উঠতি তরুণ ও যুবকরা হারিয়ে যাচ্ছিল যৌবনের মৌ বলে। ভাল ভাল কথা, সৎ উপদেশ, মুরুব্বিদের পরামর্শ এসব এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেতো। কিন্তু সেই কানেই মধু বর্ষণ করতো চুড়ির সামান্য রিনিঝিনি, পানপাত্রের টুং টাং মৃদু আওয়াজ। যৌবন কালটা যে বড় বেয়াড়া ও অন্ধ হয়, সময়মত তাকে নিয়ন্ত্রন না করলে জীবন তছনছ হয়ে যায়, এ কথা তাদের তখন কে বুঝায়!

 দু’তিন বছর আগেও এমনি একটি স্রোত এসেছিল কায়রোয়। তখন সুলতান ছিলেন এখানে। শুরুতেই সুলতানের নজরে পড়ে যায় ব্যাপারটি। মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই সুলতান খুব দ্রুত তা নির্মূল করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ফলে সে স্রোতের গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল।

 কিন্তু আজকের অবস্থা ভিন্ন। সুলতান নেই, সুলতানের ভাই তকিউদ্দিনও নেই। কে রুখে দাঁড়াবে এ স্রোতের বিরুদ্ধে?

 এ স্রোত মহামারীর মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। খেল তামাশার মধ্য দিয়ে সবার অলক্ষ্যে এ মহামারী প্রবেশ করছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাহন হিসাবে ব্যবহার করছে মদ, জুয়া, নাচ, গান এইসব। এ মহামারীর কাজ একটাই, নৈতিকতার বাঁধন শিথিল করা এবং এর মাধ্যমে মুমীনের ঈমান ক্রয় করা।

 নৈতিকতার বাঁধন শিথিল করার এ খলা শুরু হয়েছিল বড় বড় তাবু ও সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে প্রদর্শনী দেখানোর মধ্য দিয়ে। প্রদর্শনীতে হয়তো আপত্তিকর উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু থাকতো না। কিন্তু প্রদর্শনীর পাশে থাকতো নানা রকম জুয়ার আড্ডা। ছড়িয়ে ছিটিতে আসর বসতো গাঁজা ও আফিম সেবলেন। ছামিয়ানার মধ্যে আবার গোপন তাবু থাকতো। সেই সব তাবুতে যুবকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য থাকতো ভ্রাম্যমান দালাল। তারা ইশারা ইঙ্গিতে আহ্বান জানাতো যুবকদের। পয়সার বিনিময়ে তাদের নিয়ে যেতো তাবুর ভেতর। তাবুতে থাকতো কাপড়ের ওপর আঁকা বড় বড় রঙিন ছবি। এসব ছবি থাকতো উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ এবং যৌন আবেদনমূলক। ছবি দেখানোর কাজ করতো মেয়েরা। তাদের মুখে থাকতো হাসি, চোখে প্রচ্ছন্ন আহ্বান। অঙ্গভঙ্গিতে থাকতো যুবকদেরকে পাপের পথে নামানোর ইঙ্গিত।

 যারা ধনাঢ্য তারা পয়সা দিয়ে ঢুকে যেতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাবুতে। সেখানে তাদেরকে মদ পরিবেশন করা হতো। নর্তকী নাচ দেখাতো, গায়িকারা গান গাইতো আর মনোরঞ্জন করতো সেই ধনী দুলালদের। এসব নির্লজ্জ ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে বাঁধা দেয়ার কেউ ছিল না।

 প্রথম দিকে প্রদর্শনীর নামে ভেতরে আসলে কি ঘটছে সমাজ ও সরকার তা জানতে পারতো না। কারণ যে একবার উলঙ্গ ছবি দেখতো বা মদ খেয়ে বাঈজী নিয়ে ফুর্তি করতো সে ওখানে কি করেছে এ কথা শরমে কাউকে বলতে পারতো না। তবে একবার এই পাপের স্বাদ ও আকর্ষণ যে পেয়েছে সে বার বার ওখানে যেতো। সে বাইরে কারো কাছে এ কথা প্রকাশ করত না এই জন্য যে, যদি ব্যাপারটা সরকারের কানে যায় তবে এ নেশা ও আনন্দ থেকে তাকেই যে চির বঞ্চিত হতে হবে।

 অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই আনন্দ ও নেশার শিকার হতো উঠতি বয়সের কিশোর, এক শ্রেণীর যুবক ও সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য।

 যারা এই কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল তাদের মিশর কি পরিমাণ সাফল্য লাভ করতো তা জার্মান বংশোদ্ভূত যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ক্রুসেড নেতা হরমন তার শাসককে নিয়মিত রিপোর্ট করতো।

 এসব ছবি আসতো স্পেন থেকে। স্পেনের শিল্পীরা এমন সব ছবি বানাতো, যে ছবি কঠিন সংযমী মানুষের সংযমকেও ভেঙে চুরমার করে দিতো। ক্রুসেডের সাথে জড়িত খৃস্টানরা অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসাবে পরিকল্পিতভাবে এসব ছবি তৈরী করিয়ে প্রদর্শনীগুলোতে পাঠাতো।

 একজন শিল্পী একটি যুগল ন্যূদ ছবি নিয়ে এল হরমুনের কাছে। ছবিটি ছিল বেশ বড় সাইজের জলরঙের পেইন্টিং। শিল্পী অত্যন্ত নিপূনভাবে ব্রাশ ও তুলির প্রতিটি আচড়ে ছবিটিকে জীবন্ত করে তুলতে চেয়েছে। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার এবং বিরল একটি অশ্লীল পোজের কারণে ছবিটির দিকে একবার তাকালে সহজে চোখ ফেরানো যেতো না। ছবিটি দেখে খৃস্টান শাসকরা একে অপরের সাথে উলঙ্গ রসিকতা শুরু করে দিল।

 হরমন বললো, ‘আমি এখন এ ধরনের অসংখ্য ছবি বানিয়ে মিশরের বড় বড় শহরগুলোতে গোপন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সেখান থেকে আমাদের কাছে সফলতার সংবাদ আসছে। আমি কায়রোর নব্য যুবকদের মধ্যে নগ্নতা ও পশুত্বের এমন বিস্তার ঘটাবো যেন তারা পাগলপারা হয়ে যায়। এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করবো, যাতে তাদের যাবতীয় মানবিক বোধ-বুদ্ধি, আবেগ ও প্রেরণা ধংস হয়ে যায়। জাতীয় কর্তব্যবোধ, ধর্মীয় নৈতিকতা ও ঐতিহ্যের প্রেরণা- সবকিছু তারা এ আবেগের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে ডুবে থাকবে মওজের মাহফিলে।’

 ‘কি রকম সাফল্য পাচ্ছো এ অপারেশনে?’ জানতে চাইল একজন।

 ‘খুবই আশাব্যঞ্জক। এসব ছবি মিশরের স্থানীয় মুসলমান ও সৈনিকদের মানসিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা নিস্ক্রিয় করে দিচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে প্রদর্শনী ততই জমজমাট হয়ে উঠছে। ভীড় বাড়ছে। অনেক যুবক এসব ছবি কিনে নিয়ে ঘর সাজাচ্ছে ওদের। দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি দেখছে আর দল বেঁধে নেশা করছে।

 আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা মরুভূমির বেদে ও যাযাবর মেয়েদেরকে অর্থের বিনিময়ে সমস্ত কায়রো শহরে ছড়িয়ে দিয়েছে। সেনানিবাসের আশেপাশেই ভীড়টা ওদের বেশি। উপশহর ও শহরতলীতে অনেকগুলো বাসা ভাড়া করে দিয়েছি ওদের জন্য। এই মেয়েরা উঁই পোকার মত সুলতান সালাহউদ্দিনের ঈমানদার জাতি ও সেনাবাহিনীকে খেয়ে শেষ করছে।’

 ‘কোন সমস্যা হচ্ছে না?’

 ‘প্রথম দিকে কিছুটা হয়েছিল। আমার এ মিশনে যারা কাজ করছে তাদের কেউ কেউ ধরা পড়েছিল। পরে আমি টেকনিক বদল করি। এখন সেখানকার মুসলমানরাই আমার মিশন চালি রাখতে সাহায্য করছে। যারা এ বিষে একবার আক্রান্ত হয়েছে আমরা এখন তাদের ব্যবহার করছি। এ হচ্ছে এক ছোঁয়াচে রোগ। আর রোগ সব সময়ই মহামারীর মত ছড়িয়ে যায়। কায়রোয় এখন সে মহামারী শুরু হয়েছে।

 কট্টর মৌলবাদী যারা, তাদের ছেলে মেয়েরাও রেহাই পাচ্ছে না এ মহামারীর ছোবল থেকে। নিষিদ্ধ দুনিয়ার আকর্ষণে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাচ্ছে তারাও। তারা এখন মানসিক দিক থেকে এই বিলাসিতার অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মন মগজ থেকেও এই বিষ সব রকম দেশপ্রেম আর ঈমানকে নষ্ট করে দেবে। ওইসব মুসলমানরাই তখন নিজেদের সুখ সম্পদের অন্তরায় ভেবে ইসলামকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির অন্তরায় মনে করে বিরোধিতা করবে ইসলামের। কাজ যা করার ওরাই করবে, আমরা শুধু এ আগুন যাতে নিভে না যায় সে জন্য বাতাস দিয়ে যাবো।’

 ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খুবই হুশিয়ার ব্যক্তি।’ বৈঠকে উপস্থিতদের মধ্যে একজন বললো, ‘তিনি যখন মিশরে উপস্থিত হবেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তোমার মিশন মূলসহ উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করবেন বলে কি তুমি মনে করো?’

 ‘যদি সে মিশরে পৌঁছতে পারে তবে তো!’ হরমন বললো, ‘সে মিশরে আর কোন দিন ফরে আসতে পারবে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর তো আপনাদের কাছে। আমার কাজ তো গোয়েন্দা তৎপরতা আর নাশকতামূলক কাজেই সীমাবদ্ধ। আপনারা যারা সরাসরি আইয়ুবীর মোকাবেলা করছেন তারা কি মনে করেন আমাদের এত পূর্ব প্রস্তুতির পরও সে ক্রাকের অবরোধ থেকে ফিরে আসতে পারবে?’

 ‘দুদিন আগে হলেও এর উত্তরে আমি কোনরকম চিন্তা ছাড়াই না সূচক জবাব দিতাম। কিন্তু আজ এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলে ভেবেচিন্তে দিতে হবে। আমরা আইয়ুবীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য রিমান্তের নেতৃত্বে যে বিশাল বাহিনী মরুভূমিতে লুকিয়ে রেখে ভাবছিলাম আইয়ুবীর যুদ্ধের নেশা চিরতরে মিটিয়ে দেবে এ বাহিনী, সে আশা আমাদের দুরাশায় পরিণত হয়েছে। আক্রমণ করার মুহূর্তে রিমান্ত হয়তো ভাবছিল, বাগান থেকে খেজুর পাড়ার মত সহজ হবে আইয়ুবীর ঘুমন্ত সৈনিকদের হত্যা করা। কিন্তু তার হয়তো মনে ছিল না, আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে যে আইয়ুবী জয়ী হয়েছে এবারও যুদ্ধ পরিচালনা করছে সে নিজে। এখন ফাঁদে আটকে পড়া ইঁদুরের মত নিজের বাহিনীর একটা বড় অংশকে হারিয়ে পাহাড়ের খাঁজে ভীতবিহবল হয়ে ছুটাছুটি করা ছাড়া রিমান্তের আর কোন কাজ নেই। ওদিকে আইয়ুবী দুর্গের অবরোধ আরো মজবুত করেছে। ফলে বাইরে থেকে দুর্গে খাদ্য ও রসদ পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় অবরোধ দীর্ঘ হলে পরিস্থিতি আমাদের জন্য খারাপ হয়ে উঠতে পারে।’

 ‘কিন্তু এই ঘেরাও এবং অবরোধ তাঁর নিজের জন্যও ক্ষতির কারণ হতে পারে। আপনারা শুধু তাকে কয়েকটা দিন ওখানে আটকে রাখুন, সুদানী বাহিনী তকিউদ্দিনকে তাড়িয়ে নিয়ে ছুটে আসছে মিশরের দিকে। আইয়ুবী ওখানে আটক থাকলে মিশর তার হাত ছাড়া হবে এবার। তখন তার পায়ের তলে আর কোন মাটি থাকবে না।’

 ‘হ্যাঁ, যুদ্ধের মোড় কখন কোন দিকে ঘুরে যায় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। আপনার বিশ্লেষণও সত্য হতে পারে।’

 ‘পারে না শুধু, এটা এবার হতেই হবে। মিশরের জনগণই এবার আইয়ুবীকে গদিচ্যুত করবে। সে পরিবেশ আমরা প্রায় তৈরী করে এনেছি। হাট-বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী উধাও করে দিয়েছি। দেশে দুর্ভিক্ষ লাগতে আর বেশি বাকি নেই। এ জন্য জনগণ আইয়ুবীকেই দায়ী করবে। সেনাবাহিনীর রেশন কমিয়ে দেয়ার ফলে ওখানেও যে কোন সময় বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে।’

 ‘সরকারী আমলা ও অফিসারদের ক্রয় করার ব্যবস্থা কি?’

 ‘আপনাদের দেয়া অর্থের পূর্ণ সদ্ব্যবহার হচ্ছে। আইয়ুবীর অতি প্রিয় ও বিশ্বস্ত হাকিম আরসালান এখন পুরোপুরি আমাদের হয়ে কাজ করছে। সে এ কাজে এরই মধ্যে আরো বেশ কিছু সঙ্গী সাথীও জোগাড় করে নিয়েছে।’

 ‘আরসালানকে কেমন বেতন দেয়া হচ্ছে?’ জানতে চাইল ফিলিপ আগাস্টন।

 ‘একজন মুসলমান হাকিমের মাথা কেনার জন্য যত অর্থ দরকার তা ব্যয় করতে আমরা কার্পণ্য করছি না।’ হরমন উত্তর করলো, ‘মদ, নারী, ধন, সম্পদ ও শাসন ক্ষমতার নেশা যদি কেন মুসলমানের ঈমান খরিদ করতে পারে, তবে আমি তাকে খরিদ করেছি।’

 ‘তাহলে বলতেই হয়, সালাহউদ্দিন যে মিশর দেখে গিয়েছিল সে মিশরের চেহারা এখন আমূল পাল্টে গেছে।’ বলল আরেক নাইট। ‘তিনি যে ভবিষ্যত বংশধরদের নিয়ে গর্ব করতেন, তারা মুসলমান থাকলেও ইসলামের পক্ষে থাকবে না। তার মানে মিশর হয় আমাদের থাকবে অথবা আমরা যাদের মদদ দেবো সেই মুসলমানদের হাতে।’

 ‘জ্বী, আইয়ুবীর সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে আপনাদের বাহিনী বারবার পরাজিত হলেও আমার বাহিনী শুরু থেকেই বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করছে। আমার বাহিনী মুসলমানদের এমন জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে গেলে আপনাদের আর মুখোমুখি লড়াই করার কোন প্রয়োজনই পড়বে না। এরই নাম সাংস্কৃতিক যুদ্ধ, এখানে মুজাহিদদের তীর এবং তলোয়ার কোন কাজে দেবে না।

 আমি আপনাদের হাতে এমন এক মিশর তুলে দেবো যেখানে আদমশুমারীতে লাখ লাখ মুসলমান থাকবে, কিন্তু একজন মানুষ, যে বিশ্বাস ও কাজ করলে তাকে আসলে মুসলমান বলা যায় , ইসলামের ধারক বাহক তেমন কোন মুসলমান আপনারা সহজে খুঁজে পাবেন না। ফলে আপনাদের আর যুদ্ধও করতে হবে না, পরাজয়েরও কোন প্রশ্ন আসবে না।’

 ‘তাহলে তো বলতে হয় আমাদের ছাড়াই আপনি যুদ্ধ শেষ করে এনেছেন! যে মুসলমানের কাছে ইসলাম নেই তার সাথে আমাদের শত্রুতাও নেই, কি বলেন?’

 ‘ঠিক, ঠিক।’ সবাই সমস্বরে সায় জানাল এ কথায়।

 হরমনের এই আশাপ্রদ রিপোর্টে শাসকশ্রেণী খুব খুশি হলো। ফিলিপ আগাস্টাস সেই সংকল্প আবার ব্যক্ত করলো, যে কথা সে আগেও কয়েকবার বলেছে, ‘আমাদের যুদ্ধ সালাহউদ্দিনের সাথে নয়, ইসলামের সাথে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীও মারা যাবে, আমরাও মারা যাব। কিন্তু আমাদের এই আবেগ, প্রচেষ্টা ও উদ্যম চিরদিন সতেজ ও জীবিত থাকা প্রয়োজন। ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মুছে ফেলা এবং সারা বিশ্বে খৃস্টান শাসন প্রতিষ্ঠিত করা ও তা টিকিয়ে রাখার কথা চিন্তা করতে হবে আমাদের। এ কন্য প্রয়োজন এমন সেক্টর খোলা, যেখান থেকে ইসলামী আদর্শের ওপর আঘাত হানা যায়। মুসলমানদের রাখতে হবে ঘুমের জগতে। কি হারিয়েছে তারা, যেন তা টের না পায়। ইসলামের নির্দেশিত পথে না চলেও ওরা যেন ভাবতে পারে ওরা মুসলমান।’

 ‘তাই তো! আসলে মুসলমান তো সে, যে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে নিজের জীবন চালায়। যার ঈমান ও আমলে মিল নেই সে আবার মুসলমান কিসের?’ উল্লসিত হয়ে বলল একজন।

 ‘কিন্তু এ কথা তাদের বলা যাবে না। তাদের বলতে হবে, মুসলমানের কাজ হলো আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং হযরত মুহাম্মদকে ভক্তি করা। ‘ঈমান ও আমল’ ভিন্ন এ কথা বললে তারা ক্ষেপে যেতে পারে, তাদের বলতে হবে ‘ধর্ম আর জীবন আলাদা’, তাহলেই আর কোন সমস্যা থাকবে না।’ বলল ফিলিপ অগাস্টাস।

 ‘হ্যাঁ, বলতে হবে, ধর্ম পালন করা যারা যার ব্যক্তিগত রুচি, সামর্থ্য এবং সময়ের ব্যাপার। এভাবে ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলমান’কে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। কোরআন ও হাদীস থাকবে তাকের ওপর, বড়লোকের শোকেসের শোভা বাড়াবে অসব কিন্তু তার আলোকে জীবন না চালিয়েও দিব্বি মুসলমান থেকে যাবে সবাই।’ বললো এক সেনাপতি।

 ফিলিপ অগাস্টাস বললো, ‘আমি হরমনকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, তিনি যে লড়াই শুরু করেছেন সেটাই আমাদের মূল লড়াই। সাময়িক সাফল্য নয়, এ লড়াইয়ের সাফল্য হবে স্থায়ী ও পরিপূর্ণ।’

 আল ইদরিসের দুই ছেলেই যুবক। একজনের বয়স সতেরো ও অন্য জনের একুশ। আল ইদরিস যেমন জানেন না নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত খৃস্টানদের তৎপরতার খবর, তেমনি জানেন না তার সন্তানরা কেউ অন্ধকার জগতে পা দিয়েছে কিনা! কায়রো শহরের দৃশ্যমান রূপের বাইরে আরো যে একটি রূপ আছে, যে রূপের খবর প্রতিটি যুবকের কাছে নিয়মিত পৌঁছে যায়, সে খবর তার জানা নেই। কেউ কখনো তাকে এ কথাও বলেনি যে, তোমার সন্তানরা আনন্দ স্ফূর্তির নামে পঙ্কিলতার প্লাবনে গা ভাসিয়েছে! ফলে সন্তানদের নিয়ে তিনি বেশ নিশ্চিন্ত আছেন।

 এরই মধ্যে ঘটে গেল এক ভয়ংকর ঘটনা। তার বড় ছেলে হিশাম লেখাপড়া শেষ করে সম্প্রতি ব্যবসায় ঢুকেছে। দুপুরে বাসায় ফিরছিল খাওয়ার জন্য, একটি মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল তার কাছে। বলল, ‘প্লিজ, আমাকে একটু হেল করবেন?’

 মেয়েটির চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা। সে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার! কি করতে পারি আমি আপনার জন্য?’

 ‘একটা লোক আমাকে উত্যক্ত করছে। আমি যেদিকে যাই সে আমার পিছু নিচ্ছে। আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আমাদের বাড়ি খুব দূরে নয়, ওই সাহেব পাড়ায়। আমাকে একটু এগিয়ে দেবেন?’

 ‘ঠিক আছে, চলুন।’

 সাহেব পাড়াটা কায়রোর অভিজাত এলাকা। আল হিশামকে ওই পথেই বাড়ি ফিরতে হয়। মেয়েটি হিশামের পাশাপাশি মাথা নিচু করে হাঁটছিল। হঠাৎ মাথা তুলে বলল, ‘আপনাকে কি বিপদেই না ফেলে দিলাম!’

 ‘না, না, আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আমি তো এ পথেই বাড়ি ফিরছিলাম।’

 ‘আপনার বাসা কোথায়?’

 ‘হাকিম পাড়া।’

 ‘হাকিম পাড়া!’ মেয়েটি উৎসাহিত গলায় বলল, ‘কোন বাড়ি আপনাদের?’

 ‘আমি হাকিম আল ইদরিসের ছেলে।

 ‘আমি শায়লা। আবু আলা আমর আমার আব্বা। আপনি?’

 ‘আমার নাম হিশাম। লেখাপড়া শেষ করে এখন ব্যবসা শুরু করেছি।’

 এভাবেই পরিচয় ঘটে ওদের। আবু আল আমর একজন কূটনীতিবিদ। বিদেশীদের সাথে তার দহরম মহরম। সেই সুবাদে হয়তো ওদের পরিবারে বিদেশী হাওয়া ঢুকেছে। মুসলমান হলেও মেয়েটার বেশভূশা খৃস্টানদের মত, একেবারেই বেপর্দা।

 কথা বলতে বলতে একসময় ওরা শায়লাদের বাড়ির গেটে এসে পৌঁছল। হিশাম বিদায় নিতে চাইলে কিছুতেই ওকে যেতে দিল না শায়লা, হিশামকে নিয়ে অন্দরে ঢুকে গেল। বাড়িটি প্রাসাদোপম। আসবাবপত্র সব জাকজমকপূর্ণ ও জৌলুসময়। সর্বত্র আভিজাত্যের ছোঁয়া।

 শায়লা বলল, ‘আজ আপনি আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছেন। এ জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি খুব স্বাধীন ও খোলামেলা টাইপের মেয়ে। আপনার সাথে আমার কতক্ষণেরই বা পরিভয়, অথচ আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার যুগ যুগান্তরের পরিচিত। আপনার যদি আপত্তি না থাকে আমি আপনার কাছে একটা জিনিস চাইবো।’

 হিশাম অবাক হয়ে বলল, ‘কি জিনিস!’

 ‘মাঝে মধ্যে আপনি আপন মনে করে আমার রখানে আসবেন আর অনুমতি হলে আমি আপনার দোকানে যাবো।’

 ‘এতে আবার অনুমতি লাগে নাকি?’

 পরদিন মেয়েটি তার দোকানে এসে উপস্থিত। বিদায় নেয়ার সময় বলল, ‘বাড়ি যাওয়ার সময় অবশ্যই আমার এখানে একটু ঢু মেরে যাবেন। আপনার জন্য একটি চমৎকার উপহার আছে, ওটি নিয়ে যাবেন।’

 ‘কি উপহার!’ অবাক হয়ে জানতে চাইল হিশাম।

 ‘সেটি বলা যাবে না, আগে আসেন, দেখতে পাবেন।’ বলে চোখে একটা কটাক্ষ হেনে বেরিয়ে গেল শায়লা।

 হিশামের যাওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু মেয়েটির কটাক্ষ ও হাসি বার বার তা হৃদয়ে এসে আঘাত হানল। রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার পথে শায়লাদের বাড়ির কাছে এসে থেমে গেল তার পা। ওই হাসি ও কটাক্ষ দেখার অদম্য একটা লোভ তাকে টেনে নিয়ে গেল শায়লার কামরায়।

 শায়লা আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে ভেতরে টেনে নিল। পরণে তার পাতলা পোশাক। হিশামের সামনে সে পানপাত্র এগিয়ে ধরল। ও বলল, ‘আমি তো মদ খাই না!’

 ‘এটা মদ তোমাকে কে বলল, এ তো ফ্রান্সের সেই বিখ্যাত শরাব, যা কেবল রাজা-বাদশাদের ভাগ্যেই জোটে। এ খেলে তোমার নেশা হবে না, শরীর ও মনে নতুন স্ফূর্তি আসবে। পৃথিবীটা মনে হবে অনেক সুন্দর। যা দেখবে তাই ভাল লাগবে, মনে হবে তোমাকে সুখী করার জন্য সমগ্র প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে সুর মু্‌চ্ছনা। তুমি এক ঢোক খেয়ে দেখো, ভাল না লাগলে আর খেয়ো না।’

 মেয়েটি তার মুখের কাছে তুলে ধরল পানপাত্র, ঠোঁট ফাঁক করল হিশাম।

 ‘কি, কেমন লাগলো?’

 ‘ভাল।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top