১৪. তুমুল লড়াই

হলব, হারান ও মুশালের সেনাবাহিনী মার্চ করে রণাঙ্গণে ছুটে আসছিল। এদিকে সুলতান আইয়ুবীর পক্ষে কায়রো থেকে যে সাহায্য আসার কথা, তাও যে কোন সময় এসে পৌঁছে যেতে পারে। শত্রুদের আক্রমণ আগে হয়, নাকি মিশর থেকে সৈন্য সাহায্য আগে এসে পৌঁছে, এটাই এখন দেখার বিষয়। এ নিয়েই অধীর ছিলেন সুলতান। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন, কায়রোর সাহায্য ছাড়া শত্রুর এ তুমুল অভিযান ঠেকানো যাবে না। কিন্তু সাহায্য আসার আগেই যদি আক্রমণ এসে যায়, তাহলে! এ নিয়েই চরম উৎকণ্ঠা ও পেরেশানীতে ভুগছিলেন তিনি। সময় কাটাচ্ছিলেন নানা রকম চিন্তা ভাবনা ও পরিকল্পনায়। বুদ্ধির শেষ শক্তিটুকুও ব্যয় করছিলেন এ কাজে। যদি সাহায্য আসার আগেই শত্রু আক্রমণ করে বসে, তবে এ সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে কেমন করে যুদ্ধ চালাবেন তার অসম্ভবসব পরিকল্পনা শোনাচ্ছিলেন উচ্ছপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের। তাদের নির্দেশ দিয়ে বলছিলেন, ‘কমান্ডো বাহিনীকে পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুত ও সদা সতর্ক রাখেঅ। কখন সাহায্য এসে পৌঁছবে জানা নেই আমাদের, কিন্তু এদিকে আক্রমণ দ্রুত এগিয়ে আসছে। কমাণ্ডো বাহিনী দিয়েই তাদের আক্রমণ ঠেকাতে হবে’।

সুলতানের পেরেশানী দেখে এক সেনাপতি বললেন, ‘আল্লাহর যা মঞ্জুর তাই হবে। এটা তো দুর্গ নয় যে, আমরা অবরোধের মধ্যে পড়ে যাবো। আমরা পাহাড়ের টিলা ও উপত্যকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করবো, যেন দুশমন সহসা আমাদের দুর্বলতা টের না পায়।

অধিকাংশ সেনাপতি এবং কমাণ্ডোরাও এ নিয়েই ভাবছিলেন।

বাইরে প্রকাশ না করলেও ভেতরে সবার মাঝেই বিরাজ করছিল টান টান উত্তেজনা।

সন্ধ্যার লালিমা মুছে গেল। পাহাড়ের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাবুগুলো ঢেকে গেল রাতের আধাঁরে। দেখতে দেখতে রাত গভীর হলো। মুজাহিদরা শুয়ে পড়লো যে যার তাবুতে। যাদের ডিউটি ছিল তাবু পাহারার, তারা চলে গেল ডিউটিতে। কিন্তু অস্থিরতা ও পেরেশানীর কারণে কেউ ভালমত ঘুমাতে পারলো না। সেনাপতিদের তাঁবুর মধ্যে রাতভর প্রদীপ জ্বলতে থাকল। না ঘুমিয়ে যুদ্ধের নকশা এঁকে চললেন তারা। সুলতানের তাবুতেও প্রদীপ জ্বলছিল। তিনি ময়দান ও সেই পার্বথ্য এলাকার নকশা আঁকলেন, যেখানে মনে মনে মোকাবেলা করবেন বলে ঠিক করেছেন।

জোরার সেহরী খাওয়ার জন্য নাকারা বেজে উঠলো। সৈন্যরা দ্রুত গিয়ে শামিল হলো দস্তরখানে। সুলতানও এসে ওদের সাথে যোগ দিলেন। ঠিক সে সময় দু’জন সংবাদবাহক দু’দিক থেকে এসে পৌঁছলো সুলতাদের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে দু’টি খবরই তিনি এক সাথে পেয়ে গেলেন।

প্রথক কাসেদ জানালো, ‘কায়রোর সৈন্য সাহায্য এসে গেছে। আজ ভোরেই আপনি ওদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করতে পারবেন’।

দ্বিতীয় সাকে বললো, ‘শত্রু সৈন্য রণাঙ্গণ থেকে মাত্র আট-দশ মাইল দূরে এসে অবস্থান নিয়েছে। সম্ভবত: আগামী কাল ওরা আমাদের ওপর চড়াও হবে’।

সুলতান তার গোয়েন্দা বিভাগের কাছে জানতে চাইলেন শত্রুর সর্বশেষ গতিবিধির খবর। গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল কমাণ্ডার শত্রুর গতিবিধির বর্ণতা দিতে গিয়ে বললো, ‘শত্রুরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এক দল সামনে, দ্বিতীয় দল নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মাঝখানে রয়েছে, তৃতীয় দল অনেক পেছনে থেকে অনুসরণ করছে তাদের’।

সুলতান আইয়ুবীর যা জানার দরকার ছিল, তা জেনে গেছেন। তিনি গোয়েন্দা বিভাগের কমাণ্ডারকে বললেন, ‘তুমি গিয়ে কমাণ্ডো দলের কমাণ্ডার ও কায়রো থেকে আসা সেনাদলের হাইকমাণ্ডকে জলদি ডেকে আনো। তাদের বলবে, আম তাদেরকে আমার সাথেই সেহরী খাবার দাওয়াত দিয়েছি’।

গোয়েন্দা বিভাগের কমাণ্ডার বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দু’হাত উপরে তুলে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। উপস্থিত সৈন্যরাও হাত তুলল তাঁর সাথে। মোনাজাত শেষ করে তিনি বললেন, ‘তোমরা খাওয়া শুরু করো, আমি ওদের সাথে পরে বসবো’।

তিনি নিজের তাবুতে ফিরে গেলেন এবং ওরা এসে পৌঁছার আগেই দু’রাকাত নফল নামাজ সেরে নিলেন। নামাজ শেষে তিনি আবার আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছেন, এ সময় কমান্ডো দলের কমান্ডার এসে পৌঁছলো। তার একটু পরেই কায়রো থেকে আসা বাহিনীর সালার এসে ঢুকল তাবুতে।

সেহরীর সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল, সুলতান মেহমানদের সামনে সেহরীর খাবার পরিবেশন করার হুকুম দিলেন। খেতে খেতেই ওদের সাথে আলাপ শুরু করলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। প্রশ্ন করলেন, ‘কায়রো থেকে কত সৈন্য নিয়ে এসছো?’

সালার সৈন্যের পরিমান অবহিত করলো সুলতানকে। প্রয়োজনের তুলনায় এ সাহায্য সেনার পরিমাণ কমই ছিল, কিন্তু তাতে মোটেও বিচলিত হলেন না সুলতান। সংকট মুহুর্তে এটাকেই তিনি আল্লাহর রহমত মনে করলেন। বললেব, ‘আর অস্ত্রশস্ত্র?’

কায়রো থেকে আনা অস্ত্রশস্ত্রের বিবরণ শুণে সুলতানের মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল যথেষ্ট পরিমান ছোট-বড় মিনজানিক কামান, আর সেই সাথে গোলা বারুদও ছিল প্রচুর।

সাহায্য হিসাবে আসা সৈন্যের পরিমাণ কম হলেও এরা সবাই ছিল চৌকস যোদ্ধা। পুরো বাহিনী থেকে বাছাই করে গঠন করা হয়েছিল এ বাহিনী। অভিযানের আগে ওদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। পরিমাণে অল্প হলেও ময়দানে ওরা কি ভয়ংকর তুফান সৃষ্টি করতে পারবে, জানতেন সুলতান। তাঁর শুধু একটিই আফসোস হলো, এ এলাকার পাহাড় ও টিলার প্রতিটি খাজের সাথে ওদের পরিচয় করানোর সময় পেলেন না তিনি।

ইতিমধ্যে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহও এসে পৌঁছলেন সেখানে। তিনি বললেন, ‘এইমাত্র হলব থেকে আমার এক গোয়েন্দা এসেছে। সে খবর এনেছে, খৃস্টানরা সম্মিলিত বাহিনীর তিনটি গ্রুপকেই তীর-ধনুক, গোলা-বারুদ এবং পাঁচশ করে ঘোড়া সাহায্য হিসাবে পাঠিয়েছে। গোয়েন্দা বলেছে, সে ওদের অভিযানে বেরিয়ে পড়তে দেখে এসেছে। তার বর্ণনা অনুযায়ী, গোলা বারুদের ড্রামে উটের পিঠ বোঝাই হয়ে আছে। তবে কাফেলার সৈন্যদের মধ্যে কোনরকম উত্তেজনা ও সতর্কতার ভাব নেই। তারা পথ চলছে এলোমেলো ভাবে, নিরুদ্বিগ্ন মনে। খৃষ্টানরা ওদেরকে কয়েকটি করে মিনজানিক কামানও দিয়েছে। বুঝা যাচ্ছে, শত্রুরা এ যুদ্ধে প্রচুর মিনজানিক কামানও দিয়েছে। বুঝা যাচ্ছে, শত্রুরা এ যুদ্ধে প্রচুর মিনজানিক কামান ব্যবহার করবে। তাদের সাথে প্রচুর গোলা বারুদ এবং অগ্নি নিক্ষেপকারী তীরও রয়েছে।

খাওয়ার পর সুলতান আইয়ুবী কমান্ডো দলের কমান্ডারকে কাছে ডাকলেন। তাকে বললেন, ‘তোমাকে তো সবকিছু আগেই বুঝিয়ে বলেছি। এখন তোমার কাজ কি করে আঞ্জাম দেবে সেটা তুমিই ভাল বুঝবে। তবে পরিকল্পনার সময় মনে রাখবে, যে পর্যন্ত শত্রুরা আক্রমণ না করে, সে পর্যন্ত তাদের ওপর কোন অতর্কিত আক্রমণ চালাবে না। সংবাদ অনুযায়ী তারা সোজা হেম্মাতের পর্বতশ্রেণী ধরে এগিয়ে আসছে। তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে তাদের গতি থেমে যাবে। আমি চাই না তারা ওভাবে মাঝপথে বাঁধাপ্রাপ্ত হোক। তোমাদের জানা দরকার, আমি পাল্টা আক্রমণ করতে চাই না। শত্রুরা আমার আক্রমণ বুঝতে পারবে তখনি, যখন আমি পিছন থেকে তাদের ওপর কেয়ামতের ঝড় তুলবো। আমার এ কথা তোমরা খেয়াল রাখবে’।

তিনি তাকে আরো বললেন, ‘আমাদের মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হবে তখন, যখন শত্রুরা পিছন আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। তারা তখন ভয়ে এদিক-ওদিক পালাতে চেষ্টা করবে। তোমরা লক্ষ্য রাখবে, এ পাহাড়ী এলাকা থেকে যেন শত্রুদের একটি সৈন্যও পালিয়ে যেতে না পারে। তাদের অধিকাংশকে জীবিত ধরে বন্দী করবে। কারণ তারা মুসলমান। যখন ওরা তোমাদের হাতে বন্দী হবে, তখন তারা হক ও বাতিলের পার্থক্য বুঝতে পারবে। অন্তত আমি তাই আশা করি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে এসে যারা তীর ছুঁড়বে এবং আমাদের তীরে বিদ্ধ হয়ে মারা যাবে, তাদের মৃত্যু আমরা ঠেকাতে পারবো না’।

তিনি কমাণ্ডারকে আরো বললেন, ‘তোমরা এ খবরও পেয়েছো, শত্রুরা প্রচুর গোলা-বারুদ বোঝাই করে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে। এগুলো ব্যবহার করার সুযোগ ওদের দেয়া যাবে না। তোমরা দশ-বারো জন দক্ষ কমাণ্ডো নিয়ে ছোট ছোট কয়েকটি গ্রুপ তৈরী করো। তাদের দায়িত্ব হবে গোলা-বারুদের স্তুপে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া। দিনের বেলা ওরা ভাল করে দেখে নেবে গোলা বারুদের স্তুপ কোথায় আছে। তারপর রাতে চুপিসারে ওখানে পৌঁছে আগুণ ধরাতে হবে। সবচে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, শত্রুরা এখনও নদীর কাছে আসেনি। তোমরা তোমাদের ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাইয়ে প্রস্তুত করে রাখো। নিজেদের মশকগুলোও পূর্ণ করে রাখো পানি দিয়ে। আবহাওয়অ এখানে খুব ঠান্ডা। এটা মরুভূমিও নয় যে, কেউ এখানে পিপাসায় মরে যাবে। তবুও এটা যুদ্ধ পলিসির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, পানির অভাব সৈন্যদের দিশেহারা করে ফেলে।

কমাণ্ডারকে বিদায় করে তিনি কায়রো থেকে আসা সৈনিকদের সালারকে উদ্দেশ্য করে বললেব, ‘তোমরা সবসময় মনে রাখবে, এটা মিশরের মরু অঞ্চল নয়। এখানকার পার্বত্য অঞ্চলে শীত খুব বেশী। সূর্য উঠলেও শরীর গরম হয় না। দিনের বেলায়ও শরীর গরম করতে হয় ছুটাছুটি করে। ‘সুযোগ মত আঘাত হানো, আর যে কোন কিদে পালিয়ে যাও’ এই পলিসিতে এখানে তোমাদের যুদ্ধ করতে হবে। এখানে লুকানোর যথেষ্ট সুযোগ ও জায়গা আছে। কি করে অতর্কিত আক্রমন করে দ্রুত পালিয়ে আসতে হয় সে প্রশিক্ষণ তোমরা পেয়েছো। কিন্তু তোমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এখানে ময়দান খুবই সংক্ষিপ্ত ও সীমাবদ্ধ। মরুভূমিতে তোমরা কয়েক মাইল চক্কর দিয়ে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালাতে, ইচ্ছেমত পায়তারা করার জন্য সীমাহীন প্রান্তর পেয়ে যেতে। কিন্তু এখন এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টিলার মাঝখানে সীমাবদ্ধ ময়দানে তোমাদেরকে শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে। এখন আর সে সময় নেই যে, তোমাদেরকে পাহাড়ী অঞ্চলের প্রতিটি টিলা ও সমতলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। তাই এখানে নিজের বুদ্ধি বিবেককে সর্বোত্তম কাজে লাগাতে হবে তোমাদের। তীরন্দাজদেরকে পাথরের আড়ালে থেকেই নিশানা ঠিক করতে বলবে। আর ঘোড়াসওয়ারদের বলবে, ওরা যেন ওদের ঘোড়াগুলোকে কখনও উঁচু স্থানে নিয়ে না যায়। এখানে চড়াই উৎরাই এত বেশী যে, বার বার ওপর-নিচ করতে গেলে ঘোড়াগুলো দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়বে’।

তিনি মিশর থেকে আগত সৈন্যদের সংরক্ষিত অবস্থায় রাখলেন। তাদের নেতৃত্ব দিলেন সুলতাদের সাথে অবস্থানকারী সেনা অফিসারদের হাতে। কারণ এসব সেনাপতিদের হাতেই ছিল বর্তমান যুদ্ধের বিস্তারিত প্ল্যান ও নকশা।

পাহাড়ের চূড়ায় ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়লো আজানের সুমধুর সুর। সুলতান আইয়ুবী পোশাক পাল্টে তাবুর ভেতরই ফজরের সুন্নত আদায় করলেন। তারপর কোষমুক্ত তরবারী তুলে নিলেন হাতে। সুলতানের হাতের মুঠিতে এখন খাপ মুক্ত তলোয়ার। তিনি নিবিষ্ট মনে তলোয়ারের ধার ও চমক দেখতে লাগলেন। সহসা উদ্বেলিত আবেগে নড়ে উঠলো তার হৃদয়তন্ত্রী। তিনি তলোয়ার খাপে ভরে কেবলার দিকে মুখ করে হাত তুললেন আকাশের দিকে। চোখ বন্ধ করে আল্লাহর দরবারে মিনতিমাখা স্বরে বলতে লাগলেন, ‘হে মহান রাজাধিরাজ, হে সর্বশক্তিমান! যদি এ যুদ্ধে আমার পরাজয়ে তুমি সন্তুষ্ট হও, তবে তাতেই আমি রাজি-খুশী। আর যদি এ যুদ্ধে তুমি আমাকে সফলতা দান করো, তবে তা হবে তোমার অপার করুণা। সে ক্ষেত্রে তোমর দরবারে জানাই লাখো শুকরিয়া। আজ এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, যারা তোমার প্রিয় হাবীব রাসূলে মকবুলের উম্মত বলে দাবী করছে নিজেদের। অথচ ইসলামের দুশমনদের প্ররোচনায় তারাই আজ ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। যদি আমার ফয়সালা তোমার দৃষ্টিতে না-জায়েজ হয়, তবে হে আল্লাহ! তুমি তোমার কুদরতি মদদে তা আমাকে জানিয়ে দাও। আমি আমার তলোয়ার খাপে পুরে সরে দাঁড়াবো এ লড়াই থেকে। কারণ তুমি তো আমার অন্তরের খবর জানো, জানো আমার এ লড়াই বীরের খেতাব অর্জন বা রাজ্য জয়ের জন্য নয়!

আমি তো শুধু ঐসব নারী ও শিশুদের আত্মার ক্রন্দন শুনে ছুটে এসেছি ময়দানে, যাদের মান ও সম্ভ্রম লুট করা হয়েছে কেবল এই অপরাধে যে, তারা তোমার রাসূলের উম্মত ছিল। হে আল্লাহ, আমাকে তোমার অসহায় বান্দাগণ ডাকছে। ডাকছে সেইসব বনি আদম, যারা মুসলমান হওয়ার অপরাধে কাফেরদের হাতে এখনো কঠিন উৎপীড়নের শিকার হচ্ছে। আমি তো অস্ত্র ধরেছি তোমার দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্ব ও তোমার প্রিয় হাবীবের উম্মতের মান-সম্ভ্রম রক্ষা করতে। কেবল এ জন্যই আমি অনবরত মরুভূমি, অরণ্য, আর পাহাড়ে, পর্বতে মাথা কুটে করছি। আমি এগিয়ে চলেছি ইসলামের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কাফেরদের অবৈধ অধিকার থেকে মুক্ত করতে, ওখানকার নিগৃহীত মুসলমানদের জান-মাল ও ইজ্জত বাঁচাতে। রাসূলের উম্মতেরই কিছু লোক আমার এ অগ্রযাত্রার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। হে প্রভু! তুমি আমাকে ইঙ্গিতে বলে দাও, তাদের রক্ত প্রবাহ করা আমার জন্য বৈধ না অবৈধ! হে আল্লাহ! আমি পথভ্রষ্টদের কাতারে শামিল হতে চাই না। যা সঠিক, যা সত্য, যা তোমার পছন্দ তুমি আমাকে সে পথে পরিচালিত করো। তোমার আলোর ইশারা দেখাও প্রভু। আর যদি আমার পথই সঠিক হয়ে থাকে, তবে আমাকে শক্তি দাও, সাহস দাও, ধৈর্য ও হিম্মত দান করো’।

তিনি সিজদায় পড়ে গেলেন এবং এ অবস্থায় অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলেন। এক সময় মাথা তুললেন তিনি। দাঁড়িয়ে সহসা তিনি দৃপ্ত পায়ে বাইরে চলে এলেন। তাঁর চলার ভঙ্গিতে ছিল বলিষ্ঠতা ও গাম্ভীর্য। তিন দৃঢ় পদক্ষেপে সেখানে যাচ্ছিলেন, যেখানে অন্যান্য সেনা কমাণ্ডার ও সৈন্যরা জামায়েতে নামাজের জন্য একত্রিত হয়েছিল। ততক্ষণে নামাজের জামায়াত দাঁড়িয়ে শামিল হয়ে গেলেন জামাতে। তাঁর এক পাশে তাঁর বাবুর্চি ও অন্য পাশে এক কমাণ্ডারের আর্দালী এসে দাঁড়িয়ে গেল জামাতে।

নামাজ শেষ করে সুলতান আইয়ুবী হিম্মাত পর্বতশ্রেণীর চূড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। রাস্তায় পর পর চারজন কাসেদের দেখা পেলেন তিনি। তার মৌখিকভাবে সংবাদ পেশ করল সুলতানের কাছে। এরা ছিল তথ্যানুযায়ী দলের সদস্য। এদের দায়িত্ব ছিল হারান, হলব ও মুশালের সম্মিলিত বাহিনীর গতিবিধি ও তৎপরতার সংবাদ বয়ে আনা। এ কাজ রাত দিন অনবরত এগিয়ে চললেন। তার সঙ্গে ছিলেন সেনাপতি শামস বখত। তাঁর ভাই শাদ বখতকে সুলতান অন্যত্র নিয়োগ করে ছিলেন।

‘শত্রুদের সম্পর্কে যে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আপনার কি মনে হয়, আমরা এ সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করতে পারবো? শামস বখত জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমার কাছে এটা কোন সমস্যাই নয় যে, শত্রুরা কত সৈন্য এনেছে ও আমাদের কাছে কত সৈন্য আছে’। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী উত্তর দিলেন, ‘আমি অস্থির হচ্ছি শুধু এই ভেবে, শত্রুরা এখনও কেন আক্রমণ চালাচ্ছে না। আমাদের ঐ মুসলমান ভাইদের কাছে খৃষ্টান উপদেষ্টা ও গোয়েন্দা আছে। খৃষ্টানরা কি এতই আনাড়ী হয়ে গেল যে, তারা জানতেও পারলো না, মিশর থেকে আমাদের সাহায্য আসছে, আর আমরা সাহায্য ছাড়া যুদ্ধ করতে পারবো না? যদি শত্রুরা তৎপর হতো তবে হয়তো এ সমস্যার একটা সমাধান বেরিয়ে আসতো। শত্রুরা কেন এভাবে এসে বসে আছে, আর আমাদেরকে এত সময় দিচ্ছে যে, আমরা সাহায্য পর্যন্ত পেয়ে গেলাম, তাই আমার বুঝে আসছে না। আমরা তাদের গতিবিধির খবর পেয়ে যাচ্ছি, আমাদের সামরিক অশ্বগুলোকে পানি পান করাতে পারছি; এ সুযোগ ওরা কেন দিচ্ছে তাই ভাবছি আমি। আমার সন্দেহ হচ্ছে, শত্রুরা এমন কোন চাল চালবে, যা হয়ত আমরা চিন্তু করতে পারছি না। আমার অবাক লাগছে এ জন্য, এরা তো এখানে খেল তামাশা করতে আসেনি’।

‘যতদূর আমি এদের সম্পর্কে জানি, এদের কাছে কোন চাল নেই’। শামস বখত বললেন, ‘আল্লাহর উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে, আল্লাহই তাদের মন ও মস্তিষ্কে মোহর মেরে দিয়েছেন। কারণ তারা হকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তাদের চোখের ওপর পর্দা পড়ে গেছে। আমি তাদের আচরণে কোন গভীর ও ভয়ংকর বিপদ আছে বলে মনে করি না’।

‘ভাই শামস বখত! সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমারও আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা আছে, কিন্তু আমি অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবটাই দেখে থাকি। সত্যের ওপর মিথ্যাও কখনো কখনো বিজয়ী হয়। যখন সত্যের অনুসারীরা বাতিলের কাছে নতজানু হয় অথবা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভূল করে, বিজয় তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যায় অনেক দূরে। সত্য সব সময় চায় কোরবানী, যদি আমরা কোরবানী দিতে প্রস্তুত থাকি তবে সত্যের জয় অবশ্যই হবে। বাতিলের যে শক্তি আছে, তার মোকাবেলা আমরা যুদ্ধের ময়দানেই করবো। আমাদের দৃষ্টি সব সময় সত্যের দিকে সদা সতর্ক রাখতে হবে। সেই সাথে শরীর ও মনের পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে সত্যকে বিজয়ী করার জন্য। এর পরে যা ঘটে তা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এখন আমাদের যেমন আনন্দিত হওয়া উচিত নয়, তেমনি হতাশ হওয়ারও কোন কারণ নেই’।

তিনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করলেন। সেনাপতি শামস বখত, দু’জন উপদেষ্টা ও রক্ষীরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সুলতানের দেখাদেখি তারাও সবাই অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে পড়লেন। সেনাপতি শামস বখত এবং দু’জন উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একটি উঁচু পাহাড়ী টিলায় পৌঁছলেন। টিলার উল্টো পাশে তাঁদের সামনে এক বিরাট সমতল উপত্যকা। উপত্যকাটি পর্বথ শৃঙ্গের পাশ দিয়ে সামনে প্রশস্ত হয়ে এগিয়ে গেছে। সামনের উপত্যকাটির মতই তাদের পিছনেও সমান্তরাল উচ্চ ভূমি। তার মাঝ দিয়ে একটি গিরিপথ এগিয়ে গেছে এঁকেবেঁকে। টিলার পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মিশেছে সামনের উপত্যকায়। বিশাল মাঠের মত খোলা উপত্যকাটি এতক্ষণ লুকিয়েছিল এই টিলার আড়ালে। সুলতান ও তাঁর সঙ্গীরা টিলায় উঠে দাঁড়াতেই তাঁদের চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই খোলা ময়দান। তাঁরা তাকিয়ে দেখলো, অদূরে ময়দানের মাঝে শত শত তাবু টানানো। একদিকে সৈন্যদের ঘোড়ার সারি বাঁধা। সিপাইরা সেখানে ঘোরাফিরা করছে। কেউ কেউ শুয়ে বাঁধা। সিপাইরা সেখানে ঘোরাফিরা করছে। কেউ কেউ শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। তাদের দেখে হচ্ছিল, তাদের মনে এমন কোন ভয় নেই যে, তাদের ওপর কোন বাহিনী কখনো আক্রমণ করে বসতে পারে। যদি তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতো হবে তাদের তাবু মাটিতে পড়ে থাকতো। তাদের অশ্বপৃষ্ঠে জীন আঁটা থাকতো। ‘এই বাহিনীর সেনাপতি ও কমাণ্ডারদেরেকে আমি যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তোমরা তিনজন তা আবার শুনে নাও’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এমনও হতে পারে, তোমাদের আগেই আমি মারা যেতে পারি। যুদ্ধ শুর হবার শুরুতেই যদি আমি মারা যাই তবে যুদ্ধের দায়িত্বভার তোমরা গ্রহণ করবে। আমি তাদেরকে বলে দিয়েছি, তোমরা তাঁবু টানিয়ে থাকতে পারো, অবসর অবস্থায় তোমরা ঘোরাফেরাও করতে পারো, কিম্বা এদিক-ওদিক বসে বা শুয়ে থাকতে পারো, কিন্তু তাঁবুতে তোমরা সব সময় অস্ত্র প্রস্তুত রাখবে আর ঘোড়ার পিঠে জীন এঁটে রাখবে। শত্রুর গোয়েন্দারা তোমাদের দেখছে। তাদেরকে বুঝিয়ে দাও, তোমরা শত্রুদের কোন খবর রাখো না। যখন শত্রু সৈন্য উপস্থিত হবে, তখন তোমরা এমন ভাব করবে, যেন খুব ভয় পেয়ে গেছো। তোমরা সামনে অগ্রসর হয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করবে না। শত্রু যদি তোমাদের আক্রমণ করে উপত্যকায় চলে আসে, তখন তোমরা যুদ্ধ করতে করতে আস্তে আস্তে পিছু হটে যাবে, যাতে তাদের পুরো সৈন্যদল এ উপত্যকায় এসে যায়। তারপর তারা যখন আমাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে আটকে যাবে তখন শত্রুদের পিছু হটার সুযোগ দিও।

সুলতান আইয়ুবী দুই সমান্তরাল উপত্যকার মাঝামাঝি গিরিপথের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘আমি আমার এ সৈন্যদের বলে দিয়েছি, তারা যেন এ গলির মধ্যে এসে আবার ফিরে যায়। তাদেরকে কোথায় একত্রিত হতে হবে সে স্থানও বলে দিয়েছি। তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে সে জায়গা দেখিয়ে বললেব, ‘এ দলগুলোকে শত্রুদের পিছনে যেতে হবে। এ উপত্যকায় আমরা শত্রুদের অভ্যর্থনার জন্য যে ব্যবস্থা করে রেখেছি, তা তোমরা জানো। বন্ধুগণ! তোমরা স্মরণ রেখো, এখানে আমাদের কোন অঞ্চল অথবা কোন দুর্গ জয় করা লক্ষ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য শুধু শত্রুদেরকে অসহায় ও নিষ্ক্রিয় করা, যাতে তারা আমাদের পথ থেকে সরে দাড়াঁয়।

আমি মুসলমান ভাইদেরকে দুশমন ভাবতে লজ্জাবোধ করি; কিন্তু অবস্থার চাপে আজ তাই করতে বাধ্য হচ্ছি। আমি এদের ধ্বংস করতে চাই না, চাই নিরস্ত্র করতে। আমি নির্দেশ দিয়ে রেখেছি, যতদূর সম্ভব অধিক সংখ্যক শত্রকে জীবিত বন্দী করতে। যুদ্ধ বন্দী হিসেবে আটকানোর পর আমি তাদের বুঝাতে চেষ্টা করবো, তোমরা মুসলমান, তোমরা আল্লাহর সৈনিক। তোমাদের বাদশাহ তোমাদেরকে ইসলামের শত্রুদের খেলার পুতুল বানাতে চাচ্ছে’।

সেনাপতি শামস বখত বললেন, ‘কোন জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে সে জাতির মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দাও’ খৃষ্টানরা এখন এ নীতিকে সফলভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে’।

‘মুসলমান জাতির দৃষ্টান্ত বারুদের মত’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এ জাতির আবেগে ঈমানী আগুন জ্বালাতে হবে। তাদের আবগেরে উত্তপ্ত বারুদের স্তুপে যদি কোন রকমে একবার ঈমানী আগুনের ছোঁয়া লাগানো যায়, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বোমার মত বিস্ফোরণ ঘটবে। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে, বিলাসপ্রিয় রাজা বাদশা আর সাধারণ জনগণ সবার মাঝেই এ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। মানুষের আবেগ বারুদের চাইতেও তীব্রতর হয়ে বিস্ফোরিত হতে পারে। যদি কখনো জাতীয় জীবনে তেমন বিস্ফোরণ ঘটে তবে দুনিয়ার কোন শক্তির সাধ্য নেই তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করে। যদি তাদের আবেগের ঘরে এ আগুন জ্বালানো না যায়, তবে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াভহ পরিণতি। তখন এ জাতির আর কোন সহায় থাকবে না। খৃষ্টানরা তাদেরকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। জাতির নেতা ও আমীররা রাজ্য ও ক্ষমতার লোভে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাবে মৃত্যু ধ্বংসের দিকে। তারা একে অপরকে ধোঁকা দিয়ে নিজেই মুসলিম সাম্রাজ্যের বাদশাহ হতে গিয়ে ধ্বংস হবে নিজেরা, ধ্বংস করবে মিল্লাতকে। আমি এদের রাজ্য লিপ্সা ও ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে সঠিক ইসলামের পথে আনার চেষ্টা করছি মাত্র। আমার সামনে ইসলামের সুরক্ষা ও বিস্তার ঘটানো ছাড়া আর কোন কাজই গুরুত্বপূর্ণ নয়।

হিম্মাত পর্বথ শ্রেণীর অল্প দূরেই হারানের দুর্গ। দুর্গাধিপতি গুমাস্তগীন নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণঅ দিয়েছিলেন। তিনি তার সেনাপতি ও ছোট বড় কমাণ্ডারদের একত্রিত করে বললেন, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খৃষ্টানদের পরাজিত করতে পারেন, কিন্তু যখন তিনি তোমাদের সামনে আসবেন, আমর বিশ্বাস, তখন শিয়ালের সকল চালই ব্যর্থ হয়ে যাবে। তিনি এ দেশের লোক নন, কুর্দিস্তানের বাসিন্দা। তোমরা আরব, পাক্কা মুসলমান। তিনি যত বড় ধূর্ত ও প্রতারকই হোক না কেন, তার প্রতারণার ফাঁদে আমরা পা দিতে পারি না। তিনি এদেশ দখল করে এ অঞ্চলের বাদশাহ হতে চান। আমি তার যুদ্ধের কলা-কৌশল তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি।

তাঁর কাছে বর্তমানে খুব অল্প সৈন্য আছে। তিনি সেই সামান্য সৈন্য নিয়ে পাহাড়ের বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে আছেন। একটু আগে গোয়েন্দা জানিয়েছে, তার সৈন্যরা তাঁবুর মধ্যে শুয়ে আরাম করছে। তাদের ঘোড়াগুলোও যুদ্ধের অবস্থঅয় নেই। এটা দুই কারণে হতে পারে, এক. তাঁর হয়ত বিশ্বাস, আমরা তাঁকে পরাজিত করতে পারবো না। অথবা তাঁর ধারণা, আমরা তার ওপর আক্রমণ করারই সাহস পাবো না। কিছুদিন পর তিনি আমাদের কাছে আপোষের জন্য দূত পাঠাতে পারেন। কিন্তু আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা তাঁর সঙ্গে কোন আপোষ মীমাংসা করবো না। তিনি তো এখন আমাদের হাতে বন্দী। যদি তাকে জীবিত দেখানে না পারি তবে তাঁর লাশ তোমাদেরকে অবশ্যই দেখাবো। তোমাদের সৈন্যদের বলে দাও, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ইমাম মেহেদী নন, কোন পয়গম্বরও নন। আর তার সেনাবাহিনীতে কোন জ্বীন-ভূতও নেই। আমরা তার সৈন্য বাহিনীকে অতর্কিত আক্রমণ করে শেষ করে দেবো। তাদের কাউকে পালানোও সুযোগ দেবো না’।

তিনি তাঁর শ্রোতাদের উত্তেজিত করে নিজের বিশ্রাম কক্ষে চলে গেলেন। তার বিশ্রাম কক্ষ মানে রাজ প্রসাদের মত জমকালো এক তাবু। সে বিশাল কামরা জুড়ে বিছানো ছিল রঙিন গালিচা। গালিচার ওপর শাহী পালঙ্ক পাতা। পালঙ্কের পাশে মদের সুরাহী ও সুদৃশ্য পিয়ালা সাজিয়ে রাখা। ভেতর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল রাজ মহলের কামরা। আশেপাশে আরো অনেক তাঁবু, যেগুলো সৈন্যদের তাঁবু থেকে পৃথক ও মনোরমভাবে সুসজ্জিত ছিল। এগুলোতে নাচ-গানের মেয়েরা থাকতো। এসব তাঁবুর পাহারায় পাহারাদার নিযুক্ত ছিল।

গুমাস্তগীন ভাষণ শেষ করেই দ্রুত তার কামরায় ঢুকে গেলেন। তিনি ভেতরে প্রবেশ করতেই লাইন ধরে সুন্দরী মেয়েরা খাবারের সাজানো ডালি হাতে ভেতরে প্রবেশ করলো। গুমাস্তগীনের ইঙ্গিত পেয়ে ওরা খাবার পরিবেশন শুরু করলো। মদের সুরাহী এলো। গুমাস্তগীন নয়জন মেহমানকে সাথে নিয়ে খেতে বসলেন।

নয়জন মেহমানই খাবার প্লেটের ও পর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তারা গোস্তের বড় বড় টুকরো হাতে নিয়ে গ্রোগ্রাসে গিলতে শুর করলো। সেই সাথে মদও পান করতে লাগলো পানির মত। মদের প্রভাবে খাওয়া শেস হবার আগেই ওদের চোখে নেশার ঘোর লেগে গেল। চোখগুলো হয়ে উঠল রক্তের মত লাল।

তিন চারজন যুবতী তাদের পিয়ালায় মদ ঢেলে দিচ্ছিল। ওরা খাচ্ছিল আর সুযোগ পেলেই মেয়েদের গায়ে হাত দিচ্ছিল। কেউ মেয়েদের বাহু ধরে টেনে নিজের কোলে বসাতে চাচ্ছিল। এভাবে খাওয়া ও মেয়েদের উত্যক্ত করার কাজ একই সাথে চলতে থাকে। ওমাস্তগীন তাদের এ অসভ্য আচরণ দেখে হাসতে থাকেন। কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ না বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল, ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না।

খাওয়ার পর্ব শেষ হলে গুমাস্তগীন মেয়েদের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন এবং মেহমানদের সাথে গল্প-গুজবে মেতে উঠলেন। এক সময় বললেন, ‘এখন আর গল্প করার সময় নেই। এখন তোমাদের যেতে হবে সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর কাছে। খবরদার, এবারের আঘাত যেন শুন্যে না যায়’।

‘আপনি যদি আমাদেরকে থামিয়ে এ মেহমানদারীতে আটকে না রাখতেন, তবে এতক্ষণে আপনি শুনতে পেতেন, সালাহউদ্দীন আইয়ুবী আর এ দুনিয়ায় নেই’। এক ব্যক্তি বললো।

এরা ছিল হাসান বিন সাবাহার সেই নয় ফেদাইন খুনী, যাদেরকে তাদের মুর্শিদ শেখ মান্নান ত্রিপলী থেকে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে পাঠিয়েছিল। এরা প্রকাশ্যে মানুষ হিসেবে পরিটিচত হলেও স্বভাবে ছিল বন্য পশুরও অধম। তারা প্রত্যেকে তাদের ডান হাতের মাঝের আঙ্গুল কেটে দশ ফোটা রক্ত পিয়ালায় রেখে তার সঙ্গে মদ ও হাশিশ মিশিয়ে পান করে নিলো। তারপর তারা গুমাস্তগীনেকে স্বাক্ষী রেখে শপথ করলো, ‘সুলতান আইয়ুবীকে এ যাত্রায় হত্যা করবো আর হত্যা করতে না পারলে কেউ জীবিত ফিরে আসবো না’।

শেখ মান্নান তাদেরকে দুনিয়াত্যাগী দরবেশের পোশাকে পাঠিয়েছিল। তাদের হাতে ছিল তসবীহ, গলায় ছিল কোরআন। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা যেন এই পোশাকে, এই ভঙ্গিতেই সুলতান আইয়ুবীর কাছে গিয়ে পৌঁছায়। সুলতাতের কাছে তাদের বক্তব্য হবে, মুসলমানের বিরুদ্ধে যেন কোন মুসলমান যুদ্ধ না করে। তারা বিবাদমান উভয় দলের মধ্যে আপোষ করার দায়িত্ব নেবে এবং শালিসী করতে গিয়ে এক গোপন বৈঠকে তারা সুলতান আইয়ুবীকে হত্য করবে।

শেখ মান্নান পথটি ভালই বেছে নিয়েছিল। কারণ সুলতান আইয়ুবী ধার্মিক ব্যক্তিদেরকে সমাদরে পাশে বসাতেন ও তাদের কথা আগ্রহের সাথে শুনতেন। তার দ্বিতীয় দুর্বলতা ছিল, কেউ মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব নিলে তিনি তাকে স্বাগত জানাতে কখনো কার্পন্য করতেন না। কারণ তিনি মনে করতেন, এতে খৃষ্টানদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও আক্রমণের সুযোগই নষ্ট হবে।

আপোষ রফার জন্য তিনি নিজেও হলব ও অন্যান্য স্থানে দূর পাঠিয়েছিলেন, যারা অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিল। কিন্তু এখন এই জোব্বা পরা সুফী মানুষগুলো, যারা জোব্বার ভেতরে খঞ্জর ও তলোয়ার লুকিয়ে তাকে ধোঁকা দিতে আসছে, তাদেরকে সরল বিশ্বাসে সহজেই সাদর অভ্যর্থনা জানাবেন, এমনটি আশা করা মোটেই অন্যায় ছিল না। আর তিনি এমনটি করলে তাকে তারা সহজেই হত্যা করতে পারবে, এ বিশ্বাসও তাদের চিল। ত্রিপোলী থেকে যাত্রা করে তারা সোজা হারানে গিয়ে পৌঁছেছিল। গুমাস্তগীনকে তার খৃষ্টান উপদেষ্টারা বলেছিল, সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে আসা এ নয় ফেদাইন খুনীকে যেন তিনি সহযোগিতা করেন। এ জন্যই তিনি তাদেরকে সঙ্গে করে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে এসেছেন। যুদ্ধ না করেই যদি সুলতানকে হত্যা করা যায় তবে সে চেষ্টাই আগে করা উচিত।

তাদের বিদায় জানাতে গিয়ে গুমাস্তগীন বললেন, ‘আমি তোমাদের সাফল্য কামনা করছি। কিন্ত সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে তোমাদের যথেষ্ট হুশিয়ার থাকতে হবে। তোমরা যে সুফীর বেশ ধরেছ তাতে তার সন্দেহ হতে পারে। কারণ কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, যা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তিনি এখন আরও সতর্ক থাকবেন। তাঁর সাথে আরও দু’জন হুশিয়ার ব্যক্তি আছে, একজন আলী বিহ সুফিয়ান ও অন্যজন হাসান বিন আবদুল্লাহ। এরা প্রথম দৃষ্টিতেই মানুষের অন্তরের কথা পর্যন্ত পড়ে নিতে পারে। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী আমি জানতে পেরেছি। যদিও আলী বিন সুফিয়ান এখন কায়রোতে অবস্থান করছেন কিন্তু হাসান বিন আবদুল্লাহ তাঁর কাছেই আছে।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে আগন্তুক দেখা করতে এল একাধিক সেনাপতি ও হাসান বিন আবদুল্লাহ তাদেরকে কঠিন জিজ্ঞাসাবাদ করেন। যদি তাদের সন্দেহ হয় তবে তারা দেহ তল্লাশীও নিতে পারে।

সুলতান আইয়ুবী বা হাসান বিন আবদুল্লাহর মনে এমন ধারণা আসতেই পারে, তোমাদের এ প্রস্তাবের পেছনে কোন ষড়যন্ত্র আছে। নয়তো হঠাৎ আজ তোমাদের মনে এ আপোষের চিন্তা এলো কেন? আইয়ুবী আরও জিজ্ঞেস করতে পারেন, যে প্রশ্নের কোন সদুত্তর তোমরা দিতে পারবে না। তাতে তোমাদের মুখোশ খুলে যাবে। তিনি নিজে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। ধর্ম ও ইতিহাসে তার গভীর পাণ্ডিত্যের কথা সবার জানা। তাছাড়া তোমাদের মুখে দাড়ি ছাড়া দরবেশীল আর কোন চিহ্ন নেই। তোমাদের চার জনেরই দাড়ি এখনও ছোট। তাতে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, মাত্র মাসখানেক আগে থেকে তোমরা দাড়ি বাড়ানো শুরু করেছো। তোমাদের চেহারায় মদ হাশিশের নেশা এখনও লেগে আছে। তোমাদের চেহারায় পবিত্রতার এমন কোন লেশ মাত্রও নেই, যা দেখে তিনি প্রভাবিত হবেন। বিদায় জানানোর মুহুর্তে এ কথাগুলো তোমাদের বলে দেয়া আমি জরুরী মনে করেছি। আশা করি আমার এ স্পষ্ট উচ্চারণে তোমরা কেউ অসন্তুষ্ট হওনি’।

কথাগুলো শুনে নয়জনের একজনও কোন প্রতি উত্তর করলো না। তবে তাদের নেতা বললো, ‘হ্যাঁ, আমরা আপনার প্রত্যেকটি কথায় একমত! যদি সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আমাদেরকে সুফী দরবেশ মনে করে আপ্যায়ন করেন, সম্মান করেন এবং তাঁর তাঁবুতে ডেকে নিয়ে যানি, তবে আমার এ সাথীরা তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আমাদের কারোরই সুফী দরবেশদের আদব কায়দা ভাল করে জানা নেই। এ অবস্থায় আপনি কোন পরামর্শ দিলে আমরা তা বিবেচনা করে দেখতে পারি’।

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top