১৩. পাপের ফল

মেয়েদের সাথে ভেতরের কামরায় বসে কথা বলছিলেন শামস বখত ও সাদ বখত। বডিগার্ড এসে খবর দিল, ‘কাজী সাহেব এসেছেন।’ মেয়েদের বসিয়ে রেখে দুই ভাই ড্রইং রুমে চলে এলেন কাজী সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। মধ্য বয়সী লোক কাজী আবুল ফজল ইবনুল খাশিব। হারান প্রদেশের প্রধান কাজী তিনি, গুমাস্তগীনের খুব প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। ওদের প্রবেশ করতে দেখেই কাজী সাহেব উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলেন, ‌‘শুনলাম হলব থেকে দূত এসেছে! সে নাকি খাসা উপহারও এনেছে?’‌ ‘হ্যাঁ!’ সাদ বখত বললেন, ‌‘কেল্লা প্রধান শুয়ে আছেন বলে দূতকে আমরা এখানেই বসিয়ে রেখেছি। উনি উঠলেই ওখানে পাঠিয়ে দেবো।’ ‘ভাল করেছো! আমি খলিফার পাঠানো উপহার দুটোই দেখতে এসেছি।’ ইবনুল খাশিব চোখ টিপে বললেন, ‘ওগুলো এক নজর দেখিয়ে দাও না আমায়।’

দুই ভাই কাজীর স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে ভালই জানতো! গুমাস্তগীনের উপর তার কি রকম প্রভাব তাও অজানা ছিল না ওদের। মেয়ে দু’টিকে না দেখালে সে যে ঝামেলা করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই ঝামেলা এড়াতে শামস বখত মেয়ে দু’জনকে তার সামনে এন দেখালেন। কাজী মেয়েগুলোকে যখন দেখলো তখন তার চোখে অবাক করা ঘোর লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘বাহবা, তোফা! তোফা! এত সুন্দরী!’ শামস বখত মেয়ে দু’টিকে আবার ভেতরের কামরায় পাঠিয়ে দিলেন। কাজী বললেন, ‘এদেরকে আমার কাছে দিয়ে দাও। আমি নিজেই ওদেরকে গুমাস্তগীনের কাছে নিয়ে যাব।’ তার চোখে তখন শয়তান নাচছে।

‘আপনি কাজী মানুষ!’ শামস বখত বললেন, ‘জাতির কাছে আপনার মর্যাদা গুমাস্তগীনের চেয়েও উর্ধে। আপনার হাতে রয়েছে ন্যায় বিচারের মানদন্ড। একি বলছেন আপনি!’

‘তুমি তা এক সামরিক বোকা পাঠা।’ কাজী সাহেব হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘তুমি নগর জীবনের স্বাদ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, আনাড়ি! এসব তুমি বুঝবে না। সেই কাজী বা বিচারক মরে গেছে, যাদের হাতে আল্লাহর আইন, ইনসাফ ও ন্যায়দন্ড ছিল। তারা শাসককে ভয় করতো না, ভয় করতো শুধু আল্লাহকে। বরং শাসকগোষ্ঠীই ভয় পেতো কাজীদের, কখন জনসাধারণের ওপর অন্যায়-অবিচারের জন্য তাদের ধরে বসে! এখন শাসকরা তাকেই কাজী বানায়, যারা সরকারের অন্যায়-অবিচারকেও জায়েয বলে ঘোষনা দিতে পারে। আইনকে নয়, শাসককে খুশী রাখাই এখন কাজীদের কাজ। ভুলে যাচ্ছো কেন, আমি আল্লাহর মনোনীত কাজী নই, আমি কাজী হয়েছি আমার শাসক সম্মানিত গুমাস্তগীনের ইচ্ছায়।’ ‘এ জন্যই তো তোমাদের মন মগজে এখন কুফরী বাসা বেঁধে আছে।’ সাদ বখত বললেন, ‘তোমার আর দোষ কি, শাসকই যেখানে ঈমান বিক্রি করে বসে আছে সেখানে তার কাজী তো ঈমান নিলামে তুলবেই! তোমার মত কাজীও আজ রাসূলের উম্মত, এটাই জাতির দূর্ভাগ্য। তোমাদের মত কাজীদের প্রশ্রয় পেয়েই আমাদের শাসক ও আমীররা আজ মেয়েদের সম্ভ্রম ও সতীত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার পায়।’

তিনি আরো বললেন, ‘এ মেয়েরা তোমার মতই কোন মুসলমান ঘরের কন্যা! নিজের কন্যাদের সাথে কেউ অশালীন ব্যবহার করে!’

সেনাপতি শামস বখত যত গুরুত্ব দিয়েই কথাগুলো বলুক না কেন, কাজীর মনে তা কোন রেখাপাত করলো না্। কাজী তার কথাকে হাসি ঠাট্ট্রা দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইলো। শয়তান তাকে এতদূর অগ্রসর করে দিল যে, সে সেনাপতিকে তিরষ্কার করতেও ছাড়লো না। হেসে বললো, ‘হিন্দুস্তানী মুসলমানরা যে এত নিরস জানতাম না। তোমরা ভারতবর্ষ ছেড়ে এখানে মরতে এলে কেন?’ কাজীর এ তিরষ্কারে সত্যি সত্যি আহত হলেন শামস বখত। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘শোন কাজী! আমাকে তিরষ্কার করো আর যা-ই করো, আমার কথাগুলো একটু মন লাগিয়ে শোনো! আমি তোমাকে শুধু এ জন্যই সম্মান করছি, তুমি একজন বিচারক। কিন্তু ভুলে যেওনা, তুমি আমার অধীনস্ত একজন কমান্ডার ছিলে! এই তো তোমার পরিচয়! শুধু তোষামেদ ও চাটুকারিতার জোরে তুমি এই পদে ইন্নতি হয়েছো। আমি তোমার সম্মানকে অক্ষুন্ন রেখেই বলছি, আমরা কেন হিন্দুস্তান থেকে এসেছি তা শুনে নাও।

ছয়শ বছর আগে মুহাম্মদ বিন কাশিম নামে এক যুবক তার এক মুসলিম বোনের আর্ত চিৎকার শুনে সুদূর আরব থেকে ভারতের মাটিতে পদার্পন করে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন। নারীর ইজ্জত ও সতীত্বকে মুসলমান কতটা গুরুত্ব দেয় সেই যুবকের আবেগের দিকে তাকালে তা তুমি বুঝতে পারতে! তুমি কি জান, ভারতবর্ষ এখান থেকে কত দূরে ও কোথায়? তুমি অনুমান করতে পারো, ঐ যুবক কেমন করে তার সৈন্য বাহিনী উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে গিয়ে পৌছেঁছিলো? তুমি তো নিজেও একজন সৈনিক ছিলে! চিন্তা করতে পারো, কেন্দ্র থেকে এত দূরে, কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার যেখানে কোন সুযোগ নেই, খাদ্য ও রসদের কান ব্যবস্থা নেই, সেখানে কোন প্রেরণা ও শক্তি বলে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন? শুধু ছুটে যাননি, যুদ্ধ করে সেখানে বিজয় লাভ করেছিলেন?

স্থূল কামনা বাসনা ত্যাগ করে এর প্রকৃত রহস্যটা একটু বুঝতে চেষ্টা করো! তিনি এমন সব অসুবিধা ও বাঁধা অতিক্রম করে বিজয় লাভ করেছিলেন, যেখানে বিজয়ের কথা চিন্তাই করা করা যায় না! তিনি শুধু বিজয় লাভই করেননি, তিনি ভারতবাসীর মনাো জয় করেছিলেন। আর কোন প্রকার অত্যাচার ও আগ্রাসন ছাড়াই সেই কুফরিস্তানে ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।’ আমরা কেন এখানে এসেছি এবার সেই কথা বলি। যিনি এক বোনের সম্ভ্রম বাঁচাতে ও ইসলামের আলো জ্বালাতে হিন্দুস্তান গিয়েছিলেন আল্লাহর সেই মুজাহিদদের মৃত্যুর পর এলো তাদেঁর উত্তরসূরীদের যুগ। ধীরে ধীরে তাদের ঈমানী চেতনায় ঘুণ ধরলো। মানবতা ও সভ্যতার বাহকরা হয়ে পড়লো অলস ও বিলাসপ্রিয়। এমন লোকেরা ক্ষমতায় চলে এলো, যারা মুসলিম নামধারী কিন্তু ইসলামের অনুসারী নয়। স্বার্থান্ধ বাদশাহদের হাতে ভুলুন্ঠিত হলো মুজাহিদদের আদর্শ। ইসলাম সীমিত হয়ে পড়লো মানুষের ব্যক্তিগত আচার আচরণ। আবার অন্যায় ও অবিচার চেপে বসলো মানুষের কাধেঁ। মানবতা হলো বিপর্যস্ত।

ক্রমে আরো অবনতি ঘটলো সেখানকার। হিন্দু রাজরা অথর্ব মুসলমান শাসকদের ওপর প্রধান্য বিস্তার করলো, যেমন এখানে খৃস্টানরা মুসলমানদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। ইসলামী শাসনের বিলোপ ঘটলো। মুসলিম সাম্রাজ্য ক্রমশঃ দূর্বল থেকে দুর্বলতর হতে লাগলো। যখন আমরা যুবক হলাম, সেখানকার মুসলিম শাসনের অবস্থা দেখে দুঃখ ও হতাশায় ছেয়ে গেল আমাদের মন। মুহাম্মদ বিন কাশিম ও তাঁর সাথীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে ইসলাম বিতাড়িত। বিশ্ব ইসলামী খেলাফতের  সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা শুধু আরবের কেন্দ্রীয় শাসন মুক্ত নয়, ইসলামের সামাজিক ন্যায়নীতি থেকেও মুক্ত হয়ে গেল। সামাজিক সুবিচার ও শান্তি থেকে বঞ্চিত মানুষের আত্মার ক্রন্দন আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। আমরা যোদ্ধা বংশের সন্তান। এসব অনাচার ও অশান্তি যখন আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো, মুহাম্মদ বিন কাশিমের মত আরেকজন সেনাপতির সন্ধানে আমরা দুই ভাই দেশ ছাড়লাম।

আমরা হিন্দুস্তানের সেই নির্যাতীত মানুষের দূত, যারা ব্যাকুল চিত্তে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে কাশিমের মত এক ত্রাণকর্তার।

আরবের সাথে ভারতের মুসলমানদের যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, ভ্রাতৃত্বের দাবী নিয়ে আবার তা জোড়া দিতে এসেছি আমরা। আমরা যখন সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে দেখা করলাম, তিনি বললেন, ‘এখন আমরা হিন্দুস্তানের দিকে কেমন করে অগ্রসর হই? তাকিয়ে দেখো, আরবের ভূমি ভরে গেছে বিশ্বাসঘাতক ও গাদ্দারে। কয়েকটা দিন সবুর করো, এসো এই আরবকে গাদ্দার মুক্ত করে সাচ্চা মুজাহিদদের হাতে তুলে দেই এই শাসনভার। তারপর তোমাদের নিয়ে আমি ছুটে যাব ভারতের সেই মজলুম ভাইদের পাশে।’ কিন্তু আরবে এত বেশী গাদ্দার তৈরী হয়ে গেছে আমাদের জানা ছিল না। নুরুদ্দিন জঙ্গী এক সেক্টরে দুশমনকে পরাজিত করতে না করতেই আরো পাঁচ জায়গায় বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠে। গাদ্দারদের মোকাবেলা করতে গেলে আঘাত হানে কাফের খৃস্টানরা। খৃস্টানদের মোকাবেলা শুরু করলে মাথা তুলে দাঁড়ায় গাদ্দাররা।

এই করে করেই তিনি নিঃশেষ হয়ে গেলেন। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো খৃস্টানরা। তাদের মোকাবেলায় জেহাদের ঝান্ডা তুলে ধরলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। এসব দেখে শুনে আমাদের আফসোস ও দীর্ঘশ্বাস আরো দীর্ঘ হলো। ভারতের ভূখন্ডে মুসলমানদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে হিন্দুরা, আর এ ভূখন্ডে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে খৃস্টানরা। মরহুম জঙ্গী আমাদেরকে তাঁর সামরিক বিভাগে ঠাঁই দিয়েছিলেন। যখন গুমাস্তগীন, সাইফুদ্দিন ও আজিম উদ্দিনরা গোপনে খৃস্টানদের সাথে আঁতাত করলো, তখন সুলতান জঙ্গী আমাদের দু’ভাইকে গুমাস্তগীনের সৈন্য বিভাগে পাঠিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য, আমরা যেন তাঁর ওপরে সতর্ক দৃষ্টি রাখি। সে গোপনে কি করে, কাদের সাথে যোগাযোগ রাখে এসব দেখার জন্যই আমরা এখানে আছি। নিশ্চয় ভারতবর্ষ থেকে আমরা কেন এখানে এসেছি এ প্রশ্নের জবাব পেয়েছো তুমি?’ ‘অর্থাৎ তোমরা দুই ভাই এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছো?’ কাজী ইবনুল খাশিবের কন্ঠ থেকে ব্যঙ্গাত্মক সুর ভেসে এলো।

‘কাজী! আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করো।’ শামস বখত ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, আমাদের মুসলমান আমীররা সেই বীর মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, যারা খৃস্টানদের নাগপাশ থেকে মুসলমানদের মুক্ত ও রক্ষা করতে চায়। আজকের দূত মারাত্মক সংবাদ বহন করে এনেছে।’

তিনি চিঠির সারমর্ম তাকে শুনিয়ে বললেন, ‘গুমাস্তগীনের ওপর তোমার প্রভাব রয়েছে, তুমি তাকে বাঁধা দিতে পারো। তুমি যদি আমাদের সাথে একমত হও, তবে এসো, আমরা গুমাস্তগীনকে বুঝাই, তাকে আমাদের মতে ফিরিয়ে আনি। এসো, গাদ্দারদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেয়ে সুলতান আইয়ুবীর সাথে মিলে যাওয়ার জ্ন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করি। তা না হল তাকে এমন পরাজয় বরণ করতে হবে, যার বেদনা তাকে সারা জীবন ভোগ করতে হবে। এমনও হতে পারে, তাকে সারা জীবন কারাগারে বন্দী কাটাতে হবে। এখনও চিন্তা করার সময় আছে। ‘তার আগে আমি তোমাদের দুই ভাইকে সারা জীবনের মত কারারুদ্ধ করবো।’ কাজী ইবনুল খাশিব বললো, ‘মেয়ে দুটিকে আমার কাছে দিয়ে দাও।’ কাজী সেই কামরার দিকে পা বাড়ালো, যেখানে মেয়ে দু’টি বসে ছিল। সাদ বখত তার পথ আগলে দাঁড়ালো। সে সাদ বখতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে ক্ষীপ্ত সাদ বখত রাগে তার মুখে জোরে এক ঘুঁষি মারলো। প্রচন্ড ঘুঁষি খেয়ে উল্টে পড়ে গেল কাজী ইবনুল খাশিব। শামস বখত সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি তার একটি পা কাজীর গলার উপরে চেপে ধরলেন। কাজী কিছুক্ষণ ছটফট করে ঠান্ডা হয়ে গেল। মারা গেল কাজী। কাজীকে হত্যা করার কোন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল না এ দুই ভাইয়ের। কিন্তু ঘটনাক্রমে তাই ঘটে গেল।

দুই ভাই চিন্তা করে দেখলো, এখন গ্রেফতার হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাদের। শামস বখত তার দুই অফিসারকে ডাকলেন। একজনকে বললেন, ‘জলদি চারটি ঘোড়া প্রস্তুত করো।’ অন্য জনকে বললেন, ‘ঘোড়া প্রস্তুত হলে মেয়েদেরকে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিও।’ তিনি দ্রুত সাদ বখতের সাথে কিছু জরুরী আলাপ সারলেন। ততক্ষণে চারটি ঘোড়ায় জিন চাপিয়ে সেখানে হাজির করা হলো। অন্য অফিসার মেয়েদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন শামস বখতের দরজায়। ঘোড়া ও মেয়েদের প্রস্তুত দেখে দুই ভাই এগিয়ে গেলেন সেখানে। শামস বখত মেয়েদের বললেন, ‘তোমাদের সাথে আর আলাপ করার সময় নেই। জলদি ঘোড়ায় চড়ে বসো। আমার লোক তোমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেবে।’

মেয়েরা পরিস্থিতির নাজুকতা বুঝতে পারল। তারা কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসলো। দু’জন বিশ্বস্ত কমান্ডোকে তীর-ধনুক ও তলোয়ার নিয়ে অপর দু’টি অশ্বে আরোহন করতে নির্দেশ দিলেন সেনাপতি শামস বখত। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তামিল করলো ওরা। এরপর সেনাপতি শামস বখত ও তার ভাই সাদ বখত তাদের সাথে করে কেল্লার ফটক পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। সেনাপতির নির্দেশে প্রহরীরা কেল্লার ফটক খুলে দিল। পুরো দলটিকে নিয়ে তিনি কেল্লার বাইরে বেরিয়ে এলেন।

প্রহরীদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে তিনি তাদের চারজনকে বিদায় জানালেন। দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তাদের বললেন, ‘তোমরা সোজা সুলতান আইয়ুবীর কাছে চলে যাবে। ওখানে পৌঁছে বলবে, আমি পাঠিয়েছি তোমাদের।’ গুমাস্তগীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতো কমান্ডোরা। চারটি ঘোড়া প্রাণপ্রণে ছুটে চললো আর রিস্তানের দিকে। সেনাপতি দু’জনেরও ওদের সাথেই পালিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু কি চিন্তা করে ওরা আবার দূর্গে ফিরে এলো।

গুমাস্তগীন ততক্ষণে জেগে উঠেছিল। সেনাপতির মহল খালি থাকায় থাকায় খালিফার দূত ওখান থেকে বেরিয়ে চলে এলো গুমাস্তগীনের মহলে। মহলের প্রহরী গুমাস্তগীনকে খবর দিল, ‘এক দূত আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চায়।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘ঠিক আছে, তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’ দূত ভেতরে প্রবেশ করলে গুমাস্তগীন তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি? কোত্থেকে এসেছো?’ দূত তার পরিচয় দিয়ে বললো, ‘আমি মহামান্য খলিফা আল মালেকুস মালেহের দরবার থেকে এসেছি।‌’ সে খলিফার চিঠির কথা বললো এবং সঙ্গে যে সব উপহার সামগ্রী নিয়ে এসেছে সেগুলোর কথাও বললো গুমাস্তগীনকে।

শামস বখত ও সাদ বখত ফিরে এসে গুমাস্তগীনের মহলে গেল। গুমাস্তগীন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়ে দুটি কোথায়?’ শামস বখত জবাব দিলেন, ‘ওরা নিরাপদ স্থানে চলে গেছে।’ গুমাস্তগীন রক্ত চক্ষু মেলে ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললেন, ‘তার মানে?’ ‘তার মানে খুব সোজা। এ দুই মেয়ে ছিল মুসলিম পরিবারের সন্তান। আমি চাইনি ওদের ইজ্জত নষ্ট হোক। তাই আমি ওদেরকে এমন স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছি, যেখানে তাদের ইজ্জত-আবরু রক্ষা পাবে। গুমাস্তগীন রাগে তার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। দূত বললো, ‘শুধু তাই নয়, এ দু’জন মিলে আপনার কাজীকেও খুন করে ফেলেছে!’

‘হোয়াট?’ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গুমাস্তগীন তার প্রহরীদের ডাকলো। বললো, ‘এদের পাকড়াও করো।’ দূতকে নিয়ে গুমাস্তগীন সেনাপতি শামস বখতের বাসায় গেলো। দেখলো, সত্যি, সেখানে কাজীর লাশ পড়ে আছে। দূত পাশের কামরায় বসে সেনাপতিদের সাথে কাজী সাহেবের যে বদানুবাদ ও আলোচনা শুনেছিল, সে সব কথা গুমাস্তগীনকে খুলে বললো। গুমাস্তগীন সেনাপতি শামস বখত ও তার ভাই সাদ বখতকে সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন। হারানের দূর্গ থেকে বের হয়ে চার অশ্বারোহী যখন প্রানপ্রণে ছুটছিল সুলতান আইয়ুবীর দিকে, সুলতান আইয়ুবী তখন হাসান বিন আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘এখনও হারানের সেনাপতিদের কাছ থেকে কোন সংবাদ এলো না?’

সেনাপতি শামস বখত ও সেনাপতি সাদ বখতের সংবাদের জন্য সুলতান আইয়ুবী যখন পেরেশান, ওরা তখন কাজী ইবনুল খাশিবের হত্যা এবং আস সালেহের দরবার থেকে নিয়ে আসা দুই মেয়েকে দূর্গ থেকে বের করে দেয়ার অপরাধে কারাগারে বন্দী। ঠিক সে সময় আস সালেহের আর একজন দূত মুসাল দূর্গের অধিপতি গাজী সাইফুদ্দিনের কাছে গিয়ে পৌছলো। গাজী সাইফুদ্দিন খেলাফতের অধীনে মুসাল প্রদেশ ও তার আশেপাশের এলাকার শাসক ছিলেন। কিন্তু নুরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে মুসালের স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষনা দেন।

সাইফুদ্দিন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বংশের লোক হলেও তার বিরোধী ছিলো। সাইফুদ্দিন নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষনা করায় মুসাল আর ইসলামী সাম্রাজ্যের অংশ রইল না। নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তিনি সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে পরিচালিত জোটে যোগ দিয়েছিলেন। তার ভাই আজিম উদ্দিন একজন দক্ষ ও পরীক্ষিত জেনারেল। সাইফুদ্দিনের সেনা বাহিনীর হেড অব দ্যা কমান্ড এই আজম উদ্দিন। অন্যান্য মুসলিম আমীরদের মতই সাইফুদ্দিনও ছিলো ভোগ বিলাস প্রিয় এক শাসক। তার হেরেমেও ছিল দেশী বিদেশী সুন্দরী মেয়ের ছড়াছড়ি। ছিল নর্তকী ও গায়িকার দল।

এ ছাড়া তার ছিল পাখী পোষার এক অদ্ভুত শখ। অসংখ্য মেয়ের মত অসংখ্য পাখীতে ভরা ছিল তার মহল। রং-বেরংয়ের বিচিত্র পাখী খাঁচায় সাজিয়ে তাদের সাথে গল্প করতো সে। সুন্দরী নারী ও রং বেরংয়ের পাখী, দুটোই ছিল তার আনন্দ ও চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। আজিম উদ্দিনের সামরিক যোগ্যতা ও নৈপূন্যের ওপর আস্থা ছিল তার। তার আশা ছিল, সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করে তার রাজ্য আরো বাড়িয়ে দিতে পারবে আজিম উদ্দিন। এই আশায় সাইফুদ্দিন ও হারান দূর্গের অধিপতি গুমাস্তগীন এবং তথাকথিত খলিফা আল মালেকুস সালেহের মত খৃস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব রাখতো। খৃস্টানরা সাইফুদ্দিনকে আশ্বাস দিয়েছিলো, সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তারা তাকে সামরিক সাহায্য দিবে যাবে।

এভাবে সুলতান আইয়ুবীর অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌছলো, তার বিরুদ্ধে মুসলানদেরই তিনটি শক্তি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো। হলবে আল মালেকুস সালেহ, হারানে গুমাস্তগীন ও মুসালে সাইফুদ্দিন। এই তিনটি মুসলিম শক্তির কেউ কারো চেয়ে কম ছিল না, সামরিক বিচারে এদের কাউকে উপেক্ষা করার মতও ছিল না। এ তিনটি বৃহৎ শক্তি ছাড়াও এদের প্রভাবাধীন ছোট ছোট শেখদের রাজ্য, মুসলিম নবাবদের পরগনার সংখ্যা ছিল অসংখ্য। এরাও সবাই এই তিন শক্তির সাথে ঐক্যজোটে শামিল হয়েছিল। তারা সবাই ঐক্যজোট হয়েছিল বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই একে অন্যকে ভয় করতো। স্বার্থের ঐক্য তাদের মানসিক দূরত্ব ঘুচাতে পারেনি। তারা কেউ চায়নি, অন্যেরা তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী হোক। তাদের অবস্থা ছিল সেই পুকুরের মাছের মত, যেখানে ছোট বড় সব মাছ একত্রে থাকে ঠিক, কিন্তু ছোট মাছগুলো সব সময় বড় মাছগুলোকে ভয় পায়। কোন সুযোগে কে তাকে গিলে ফেলে এই ভয়ে তটস্ত থাকে সব সময়। আর আশা করে, বেঁচে থাকলে সেও একদিন বিশাল মাছ হবে।

সুলতান আইয়ুবী তার ছড়িয়ে দেয়া গোয়েন্দাদের মাধ্যমে বিরোধীদের এ অনৈক্যের সব খবরই নিয়মিত পেয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি কোন বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজী ছিলেন না বলে সব সময়ই এ সত্যও স্বরণে রাখতেন, তাঁর সামনে তিনটি বড় সামরিক শক্তি দাঁড়িয়ে আছে। তারা আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে। যে কোন মুহূর্তে ওরা একা একা বা এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তার বাহিনীর উপর। এ কথাও সব সময় মনে রাখতেন, এ তিনটি বাহিনীর সেনাপতি, কমান্ডার ও সৈন্যরা সবাই মুসলমান। তাদের সামরিক শিক্ষা, নৈপূন্য ও বীরত্বও একই ধরনের। এ গুনগুলো ওরা মুসলমান বলেই পেয়েছে। এসব গুন ও যোগ্যতা আল্লাহ অন্য কোন জাতিকে দেননি।

চার পাঁচ গুন খৃস্টান বাহিনীকে এ মুসলিম বাহিনীর যে কোন দল পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবে। সেই খৃস্টানরা যতই উন্নত সামরিক অস্ত্র, লৌহ বর্ম, শিরস্ত্রান ও তাজাদম ঘোড়াই ব্যবহার করুক না কেন, তাতেও তাদের পরাজিত হওয়ার কোন আশংকা নেই। সুলতান আইয়ুবী হলব অবরোধ করে মর্মে মর্মে এ সত্য উপলব্ধি করেছেন। এটাই প্রথম ঘটনা, যেখানে মুসলিম সৈন্য মুসলিম সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। হলব শহরের মুসলমান জনসাধারণ ও সৈন্যরা যেখানে যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছে, শহরের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে যেভাবে জীবন উৎসর্গ করেছে, তার নজীর শুধু মুসলমানই দেখাতে পারে। এই বীরত্বের কথা সুলতান আইয়ুবী তার মন থেকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।

 

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top