২৩. ইহুদী কন্যা

এ দৃশ্য তার নৈরাশ্য আরও বারিয়ে তুলল। তার শরীরের শেষ শক্তিটুকু যেন নিঃশেষ হয়ে এলো এবার।

সে এ লোকদের ডাক দেয়া বৃথা মনে করলো। কারণ মরুভূমির ধাঁধাঁ কখনো কথা বলে না। এই ধাঁধাঁ মুসাফিরদের আকৃষ্ট করে টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। মানুষ তাদের পিছনে ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়ে অবশ হয়ে লুটিয়ে পড়ে বালির উপর। তখন তাদের দেহের মাংস ও রস চুষে খায় মরুভূমি। তাদের অস্থি ও কংকালটুকুই পড়ে থাকে বালির উপর।

ইসহাক তুর্কীর মন বলছিল, এরা মানুষ নয়, মরুভূমির ধাঁধাঁ। বাঁচতে চাইলে এদের কাছ থেকে পালিয়ে যাও।

এ কথা মনে হতেই ইসহাক তুর্কী তাদের দিকে না এগিয়ে আরও কিছু সময় বাঁচার আশায় পিছু সরে আস্তে চাইল।

সে তার অবশ ও দুর্বল দেহতিকে ঘুরিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। কিন্তু তখন তার আর হাঁটার কোন শক্তি ছিল না। তার সংজ্ঞা লোপ পেল। চোখের সামনে মরুভূমি, মরীচিকা ও ধা ধা সবই গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সুলতান আইয়ূবীর জন্য বয়ে নিয়ে যাওয়া মুল্যবান খবরসহ সে লুটিয়ে পড়লো বালির উপর।

যখন তার সংজ্ঞা ফিরে এলো, অতখন তারকানে ভেসে এলো মানুষের কথোপকথন। এতে সে খুবই অবাক হলো এবং ব্যাপার কি বুঝার জন্য কান পাতল গভীর ভাবে। না, ভুল নয়, সত্যি মানুষের কথা এবং সেই কথা সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।

‘লোকটিকে ওখানেই মরতে দেয়া উছিত ছিল।’ এক পুরুষের কণ্ঠস্বর, ‘তোমার যত বাড়াবাড়ি। অযথা বাড়তি ঝামেলা বাড়ানোর কোন মানে হয়? কোথাকার কোন পথ ভোলা মুসাফির!’এ লোক কোন সাধারণ মুসাফির নয়। আগে ওর জ্ঞান গিরতে দাও।’ শব্দটি এক মেয়ের, ‘সিনাই মরুভূমিতে নিতান্ত দরকার ছাড়া কেউ পা রাখেনা। এ লোক পাগল বা ডাকাত নয়, অন্ততঃ তার চেহারা তাই বলছে। লোকটির পরিচয় জানা জরুরী। তোমরা ওর প্রলাপ শোননি।

এ লোক যদিও খুব নিচু স্বরে এবং জড়িত কণ্ঠে প্রলাপ বকছিল, তবু আমি তার অনেকটাই উদ্ধার করতে পেরেছি বলে মনে হয়। এ লোক বলছিল, কায়রো…… কায়রো আর কত দূর? সুলতান… সুলতান আইয়ূবী আপনি খুব সাবধানে কায়রো থেকে বের হবেন। ……… আমি অতি গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে এসেছি।’

চোখ বন্ধ রেখেই কথা শুনছিল ইসহাক তুর্কী। তার মনে হলো, এটাও মরুভূমির ছলনা। কিন্তু তাই বা কি করে হয়! আমার মাথা তো এখন ঠিকমতই কাজ করছে। মনে হচ্ছে আমি যাদেরকে দেখে মরুভূমির ধাঁধাঁ মনে করেছিলাম তারা প্রকৃতই মানুষ! ধাঁধাঁ নয়। মেয়েটি তো এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করে ফেলেছে!

‘তুমি ওর পাশে বসো।’ এক লোক বলল, ‘জ্ঞান ফিরলে ওকে পানি পান করাবে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে লোকটি ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। ওকে কিছু খেতে দিয়ে ওর পরিচয় জানতে চেষ্টা করবে।’

কথা শেষ করে লোক দুটি সেখান থেকে চলে গেল, ওদের পায়ের আওয়াজ শুনেই তা বুঝতে পারল ইসহাক তুর্কী। ইসহাক ধীরে ধীরে চোখ খুললো। সহসা তার কানে ভেসে এলো ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি। মুহূর্তে সে জেগে উঠে বসে পড়লো এবং সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ঘোড়ার ডাক শুনতে পাচ্ছি! এই ঘোড়াটি আমাকে দাও।’

‘আগে একটু পানি পান করে নাও।’ মেয়েটি কোমল কণ্ঠে বললো। সে তার মুখের কাছে একটু পেয়ালা এগিয়ে ধরে বললো, ‘সামান্য একটু পান করো। এক সাথে বেশী পান করলে মারা যাবে।’

কে তাকে পানি দিচ্ছে দেখার মত অবকাশ ছিল না তার। সে সঙ্গে সঙ্গে পানির পেয়ালা টেনে নিয়ে জলদি দু’তিন ঢোক পানি পান করে ফেললো। মেয়েটি দ্রুত পেয়ালা টেনে নিয়ে বললো, ‘করো কি! মারা পড়বে তো!’

‘আমি জানি এ অবস্থায় বেশী পান করে উছিত নয়। আনি বিজেই পেয়ালা সরিয়ে দিতাম।’ সে মেয়েতির দিকে তাক্যে বললো।

মেয়েটি এক যুবতী যাযাবর কন্যা। অন্ততঃ তার পোশাক তাই বলছে। কিন্তু তার চেহারা ও বর্ণ যাযাবরদের মত ছিল না। তার চালচলনেও সন্দেহ হচ্ছিল, এই মেয়ে মরুবাসী যাযাবর কন্যা নয়।

কিন্তু এ অঞ্ছলে তো কোন ধনীর দুলালির আধার কথা নয়! মেয়েতিকে দেখে সত্যি ধাঁধায় পড়ে গেল ইসহাক তুর্কী। তার মাথার উপর রুমালে ঢাকা চুলের যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এ মেয়ে যাযাবর কন্যা হতে পারে না।

‘তুমি কোন কাফেলার সাথে এসেছো?’ ইসহাক মেয়েতিকে প্রশ্ন করলো।

‘এটা বণিকদের একটি বাণিজ্য কাফেলা।’ মেয়েটি উত্তর দিল এবং সেই সাথে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কোত্থেকে এসেছো, কোথায় যাবে?’

ইসহাক তুর্কী উত্তর দেয়ার আগে আবার পানির পেয়ালা তুলে নিয়ে মুখে পুরে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিল।

মেয়েটি এই ফাকে আব্র প্রশ্ন করলো, ‘তোমার এই অবস্থা কেন? তোমার ঘোড়া কোথায়? সঙ্গে একটা খেজুর, এক ফোঁটা পানিও নেই কেন? কোন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছিলে?’

পানি পান করে কিছুটা সজীবতা ফিরে এসেছিল ইসহাক তুর্কীর। তার চিন্তা শক্তিও ফিরে এসেছিল। সে ভাবলো, আমি তো সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা! এই মেয়েতিকে সে কথা বলা যাবে না। আমার আসল পরিচয় মেয়েটির কাছ থেকে গোপন করতে হবে।

‘আমিও এক বাণিজ্য কাফেলায় ছিলাম।’ সে উত্তর গুছিয়ে নিয়ে জবাব দিল, ‘বহুদূরে মরুভূমিতে একদিন গভীর রাতে একদল ডাকাত আক্রমণ করলো আমাদের কাফেলা। আমাদের যা কিছু ছিল সবই তারা লুট করে নিয়ে গেল।

উট এবং ঘোড়াও নিয়ে গেল। অনেককে হত্যা করলো। সৌভাগ্যক্রমে আমি সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলাম প্রাণ নিয়ে। কিন্তু তাড়াহুড়োয় পথ ভুলে হারিয়ে গেলাম গভীর মরুভূমিতে। বাঁচার কোন আশা ছিল না। তবে মউত না থাকলে কেউ মরতে পারে না, এখন বুঝতে পারছি।

‘আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।’ মেয়েটি আর কোন প্রশ্ন না করে বাইরে চলে গেল।

ইসহাক তুর্কী যে তাবুর মধ্যে ছিল সেখানে প্রদীপ জ্বলছিল। সে তাবুর নিচ দিয়ে মাথা গলিয়ে গোপনে বাইরে চোখ ফেলল।

চাঁদনী রাত। বাইরে তিন চারজন লোক পাহারা দিচ্ছে তাবুগুলো। মোট কয়টা তাবু আছে বুঝতে পারল না সে। পাহারাদাররা এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে।

সে মেয়েটির হাসির শব্দ শুনতে পেল। তার হাসি ও কথা শুনে বুঝতে পারল মেয়েটি ফিরে আসছে। সে পিছনে সরে তার জায়গায় গিয়ে সুবোধ বালকের মোট বসে রইল। মেয়েটি তার সামনে খাবার এনে রাখলে সে খেতে আরম্ভ করলো।

‘তুমি তো এখন কায়রো যাচ্ছো?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো।

‘না!’ ইসহাক তুর্কী মিথ্যা বলল, ‘আলেকজান্দ্রিয়া যাচ্ছি।’

‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তো এখন কায়রো আছেন।’ মেয়েটি হেসে বললো, ‘আলেকজান্দ্রিয়া গিয়ে কি করবে?’

‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে আমার কি সম্পর্ক?’ ইসহাক বিস্ময়ের ভান করে মেয়েটাকে প্রশ্ন করলো।

‘আমাদের তো আছে!’ মেয়েটি বলল, ‘তিনি তো আমাদেরই সুলতান। আমরা মুসলমান, আমরা তার আদেশে জান কোরবান করতে প্রস্তুত।’

‘কিন্তু তুমি আমাকে কেন বললে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখন কায়রোতে আছে? এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?’ ইসহাক তুর্কী জিজ্ঞেস করলো।

‘তবে শোন।’

মেয়েটি তার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, আমি জানি তোমার ঘোড়ার খুবই প্রয়োজন। সুলতান আইয়ুবীর কাছে তুমি যাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পার সেজন্যই ঘোড়া দরকার তোমার। আমি তোমাকে সাহায্য করবো। তোমার জন্য ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দেব আমি, যাতে তুমি জলদি সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে যেতে পার।’

‘তুমি কি করে জানলে আমি সুলতান আইয়ুবীর কাছে যেতে চাই?’ এবার সত্যি সত্যি বিস্মিত কণ্ঠে বলল ইসহাক তুর্কী।

‘এ কথা আর জিজ্ঞেস করো না।’

মেয়েটি বলল, ‘তুমি তোমার দায়তব পালন করছো। আমাকেও আমার দায়তব পালন করতে দাও। আমি তোমাকে ঘোড়া দিয়ে প্রমান করবো, আমার দায়িত্ব আমি ঠিকমতই পালন করছি। তোমার দরকার ঘোড়া, তুমি ঘোড়া নিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য ছুটে যাও, এর বেশী জানতে চেয়ো না।’

মেয়েটির বলার ভঙ্গি দেখে ইসহাক ভাবল, তবে তো তার কোন সমস্যাই থাকে না। মেয়েটির কি দায়িত্ব আওং সে তা কিভাবে পালন করছে তা নিয়ে খবরদারী করার কি দরকার আমার! তাই সে বললো, ‘হ্যা, তোমার দায়িত্ব নিয়ে আমি কোন প্রশ্ন তুলতে চাই না। আমার একটি ঘোড়া দরকার, তার ব্যবস্থা করে দিলেইয়া মি খুশি।’

‘না বলো যে, সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছানোর জন্য আমার একটা তাজাদম দ্রুতগামী ঘোড়া দরকার। আমি তোমাকে সেরকম একটি ঘরাই দেবো।’

‘হ্যা, তাই দাও এবং দ্রুত দাও।’

‘কেন, এত তাড়া কিসের? সংবাদটি কি খুবই জরুরী?’

‘আমাকে এমন কথা জিজ্ঞেস করবে না।’ ইসহাক বললো, ‘তোমার ব্যাপারে যেমন আমি আগ্রহ প্রকাশ করিনি তেমনি তোমারও উছিত আমার ব্যাপারে বেশী আগ্রহ প্রকাশ না করা।’

‘ঠিক আছে, তোমাকে আর একটি প্রশ্নও জিজ্ঞেস করবো না। তুমি এখন বিশ্রাম নাও। রাত তো কেবল শুরু হয়েছে। রাতের শেষ প্রহরে তোমাকে আমি জাগিয়ে দেবো।’

মেও্যেতি উঠতে উঠতে বলল, ‘আমি তোমার জন্য ঘোড়ার ব্যাবস্থা করছি।’

মেয়েটি তাবু থেকে বের হয়ে গেল। ইশাকেওর শারীরিক অবস্থা এম্নিতেই কাহিল ছিল। ঘোড়ার ব্যবস্থা হয়ায় তার মানসিক পেরেশানীও দূর হয়ে গেল। সে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশান্ত মনে শুয়ে পড়লো।

‘কে বলেছে? তাকে মরতে দেয়া উছিত ছিল?’

মেয়েটি তাবু থেকে বের হয়ে তার লোকদের কাছে এসে বললো, ‘আমাকে এখন উস্তাদ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে শেখো। এ লোক সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা। সে আমাকে অনুরোধ করেছে একটি ঘোড়া দিতে, যাতে সে সুলতান আইয়ুবীর কাছে দ্রুত ছুটে যেতে পারে।’

‘বাহ! কিন্তু এমন তোফা খবর কি করে উদ্ধার করলে? আহাম্মক মনে হয় তোমাকে তার পরিচয় দেবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে বসে ছিল?’

মেয়েটি গরবিত হাসি দিয়ে বলল, ‘যতই টিটকারী করো, আমার তথ্যে কোন ভুল নেই। সে যখন বেহুশ অবস্থায় বিড়বিড় করছিল, তখন আমি কান পেতে শুনেছিলাম। সে বারবার সুলতান আইয়ুবীর নাম নিচ্ছিল আর বলছিল আমি খুব মুল্যবান তথ্য নিয়ে এসেছি।’

মেয়েটি এরপর ইসহাক তুর্কীর সাথে এ কথা হয়েছে সব সঙ্গীদের খুলে ব বলল।

এটা কোন বণিকের কাফেলা ছিল না, এটা ছিল ক্রুসেড বাহিনীর একটা গোয়েন্দা ইউনিট। মিশরে কিছু নাশকতামূলক কাজ সেরে তাড়া ফিরে যাচ্ছিল নিজ এলাকায়। দশ-বারো জনের একটি দল। প্রত্যেকেই গোয়েন্দা করমে দক্ষ।কাফেলায় মেয়ে ছিল দু’জন। মিশনের সফলতার পেছনে তাদের ভুমিকা ছিল পুরুষদের চাইতে উজ্জ্বল।

এ মেয়ে দুটিকে দলে নেয়ার পেছনে প্রথম যোগ্যতা হিসেবে কাজ করেছিল তাদের অসাধারণ রূপ। দলে নেয়ার পর তাদেরকে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কি করে শত্রু এলাকায় কাজ করতে হয়, কি করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে দলের অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়, কি করে বশ করতে হয় টার্গেটকে, এসব ছিল ট্রেনিংয়ের প্রথম ধাপ।

তারপর তাদেরকে শেখানো হয় গোয়েন্দাগিরির আরো গোপন ও জটিল সব কৌশল। মেয়ে দুটি এসব প্রশিক্ষণে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে জটিল অপারেশনে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।

এই কাফেলা বণিকের বেশে পথ চলছিল। তাদের কাছে উট ঘোড়া সবই ছিল। সিনাই মরুভূমির পাশ ঘেঁষে পথ চলছিল ওরা। যাত্রা পথে এখানে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এখানে পানি ও ছায়া দেখে থেমে যায় ওরা। সিদ্ধান্ত নেয় রাতের মোট এখানেই তাঁবু গাড়ার। এ সময়ই দূরে সিনাই মরুভূমির ভিতরে এক পথিককে আবিস্কার করে ওরা।

সূর্য দুবতে বসেছে। লোকটি ধীর পায়ে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। সন্ধ্যার একটু পর লোকটি ওদের কাছে এসে পৌঁছল। তাড়া দূর থেকে তাকে আসতে দেখে দু’জন খ্রিষ্টান ও এক ইহুদী মেয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।

তাড়া ভেবেছিল, এই লোককে তাড়া তাদের ক্যাম্পে ঢুকতে দেবে না। কিন্তু তাড়া দেখলো, লোকটির অবস্থা এতই সংকটাপন্ন যে, যে কোন সময় লোকটি মারা যেতে পারে।

ইসহাক তুর্কী এদেরকে দেখেই মরুভূমির ধাঁধাঁ মনে করেছিল।পড়ে সে বেহুশ হয়ে পড়ে গেলে ওরা তারকাছে গেল। মেয়েতাই মুখ খুল্ল প্রথমে, ‘এ কোন সাধারণ লোক বা মুসাফির নয়।’

তার এক সঙ্গী বলল, ‘আমার মনে হয় কোন আনাড়ি পথিক বা পয়াগল। নইলে এর এমন অবস্থা হবে কেন?’

ওপর সঙ্গীও তার সাথে একমত পোষণ করে বলল, ‘মরতে দাও একে। যত সব জঞ্জাল!’

কিন্তু মেয়েটি বেঁকে বসল। বললো, ‘আমি তোমাদের সাথে একমত হতে পারলাম না।এ লোক ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর এবং অমানুষিক পরিস্রমের কারণে এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এর শরীরে একটু দানাপানি ঢুকলেই সে এক বলিষ্ঠ যুবকে পরিণত হবে। তোমরা এর আকৃতি ও শারীরিক গঠন লক্ষ্য করো। এমন শরীর বহু কসরত করে তৈরী করতে হয়।’

‘তুমি কি মনে কর সে কোন কুস্তিগির? মরুভূমির সাথে লড়তে এসে এ অবস্থা করেছে নিজের?’

এ কথা শুনে হেসে উঠলো ওপর সঙ্গী।

মেয়েটি বলল, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে, এ লোক কোন গোয়েন্দা। একে আগে বাচিয়ে তলার ব্যবস্থা করো। আমার সন্দেহ ঠিক হলে এ লোক আমাদের যথেষ্ট কাজে লাগবে।’

‘আর যদি তোমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়?’

‘তাতে তো কোন ক্ষতি দেখছি না। ভুল হলে এ লোক তো আমাদের খেয়ে ফেলবে না!’

যাই হক অনেক বাকবিতণ্ডার পর লোকটিকে তাবুতে তুলতে রাজি হলো ওরা। তবে কিছুটা রসিকতার ছলে। কিছুটা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে।

তাকে উঠিয়ে এনে একটি তাঁবুতে শুইয়ে দেয়া হলো। তারপর তার মুখে কিছু পানি ও মধু একত্রে মিশিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে তুলে দিল মেয়েটি।

এ সময়ই ইসহাক বিড়বিড় করে কিছু বললো। মেয়েটি কান পাতল। অস্পষ্ট কথাগুলো শুনল মনোযোগ দিয়ে।

ইসহাক তখনো বেহুশ অবস্থায় পড়েছিল। অজ্ঞান বা ঘুমন্ত অবস্থায়ও মানুষের আত্মা জেগে থাকে। স্বপ্নের ঘোরে তখন কথা বলে মানুষ। এ জন্যই শত্রু এলাকায় গোয়েন্দাদের ঘুমের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়। এমন কোথাও তাদের ঘুমানো নিষেধ, যেখানে ঘুমন্ত অবস্থায় মনের গোপন কথা অন্যের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে।

নিষ্ঠুর মরুভূমি ইসহাককে অসহায় ও মৃতপ্রায় করে তুলেছিল। অসম্ভব প্রানশক্তির বলেই সে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা আছে। সে সীমা অতিক্রম করে যাওয়ার ইসহাক তুর্কী অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে তখনো অটুট হয়ে বিরাজ করছিল সুলতান আইয়ুবীর কাছে যাওয়ার সংকল্প। সে সংকল্পই প্রলাপের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছিল। যদি অজ্ঞান অবস্থায় তার কথা বন্ধ থাকত তবে তার আসল পরিচয় কেউ জানতে পারতো না।

ইশাকের মত চালাক ও বুদ্ধিমান গোয়েন্দা এভাবে একটি মেয়ের জালে আটকা পড়ে যাবে ভাবা যায় না। কিন্তু ক্রমাগত বিপদ তার মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিল। আর মেয়েটিও ছিল এ লাইনে কুশলী উস্তাদ।

মেয়েটির কথা এত অল্পতে তার বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। সে মেয়েটিকে মুসলমান মনে করে তার গোপন পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে যে যে ভুল করেছে এখন তার মাশুল গোণার পালা।

মেয়েটির কথা শুনে তার সঙ্গীরা বললো, ‘তোমার কথা যদি সত্যি হয়, তবে তো বলতে হয় তুমি এক বিরাট শিকার পাকড়াও করে ফেলেছো।’

কাফেলার কমান্ডার বললো, ‘এখন তার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে, সে কি গোপন তথ্য নিয়ে যাচ্ছে এবং এ গোপন তথ্য সে কোত্থেকে সংগ্রহ করেছে।’

অন্য একজন বললো, ‘তার কাছ থেকে আরো জেনে নিতে হবে তার সঙ্গীদের এখন কি অবস্থা? কে কোথায় আছে?’

‘কিন্তু তাকে কোনক্রমেই জানতে দেয়া যাবে না আমরা কারা?’

কমান্ডার বললো, ‘আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের ভালমতই জানি। তারা মৃত্যু কবুল করবে তবুও মুখ খুলবে না। তাই তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে হবে কৌশলে। শক্তি খাতিয়ে তার কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যাবে না।’

‘আমি মুসল্মান্দের খুব ভালভাবেই জানি।’ মেয়েটি অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো, ‘গোপন তথ্য তো দূরের কথা, সে নিজের খঞ্জর দিয়ে আপন প্রাণ ত্যাগ করবে, তবুও কথা বলবে না। ওরা জীবন দিতে রাজি কিন্তু নিজের ঈমান নষ্ট করতে রাজি নয়।’

‘হ্যা, এটা মুসলমানদের চরিত্রের একটি দিক। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও আছে। তুমি কি সেই মুসলমানদের জানো, যারা রাজ্য, গদি, ক্ষমতা ও অর্থের নেশায় মত্ত হয়ে জাতির সর্বনাশ করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে?’

এক খ্রিষ্টান বললো, ‘এসব মুসলমান খ্যাতি ও প্রতিপত্তির শুধু গোপন তথ্যই তোমাকে দান করবে না, তোমার হুকুমে আপন ভাইদের বুকে ছুরি বসাতেও দ্বিধা করবে না। তাদের কাছে কচুপাতার পানির মতই ঈমান মূল্যহীন। ক্ষমতা আর প্রতিপত্তিই তাদের কাছে একমাত্র সম্পদ।’

পাশেই আরেক খ্রিষ্টান মেয়ে বসেছিল। সে চুপচাপ বপ্সে শুনছিল ওদের কথা। নিজে থেকে কিছুই বলেনি। কমান্ডার তার দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো, ‘তুমি কি এই মুসল্মানের মুখ থেকে কোন গোপন তথ্য বের করতে পারবে বারবারা?’

মেয়েটি তার দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকালো, কোন জবাব দিল না। কমান্ডার বললো, ‘তুমি কায়রোতে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছো। মেরিনার উস্তাদি দেখেছো? তার কাছ থেকে কিছু শেখো। আমি তোমাকে আর কোন সুযোগ দেব না। মেরিনার বুদ্ধির দিকে একটু খেয়াল করো, আমরা তো সকলেই ওই লোককে একজন পথভোলা পথিক মনে করেছিলাম। একজন বেকার ও নিরর্থক লোক ভেবে তাকে ফেলে আসতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু মেরিনা তাকে চিনতে পেরেছিল। এই দৃষ্টি একজন মহিলা গোয়েন্দার থাকা উচিত। তার কাছ থেকে তোমার অনেক কিছু শেখার আছে। তুমি খ্রিষ্টানদের উপকার করার বদলে বরং কিছু ক্ষতি সাধন করেছ। এ জন্যই তোমাকে মিশর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি। এখনো সময় আছে, সাবধান হও। নইলে পরে পস্তাবে।’

‘তোমার পরিণতি খুব খারাপ হবে বারবারা।’ অন্য এক খ্রিষ্টান বললো, ‘তোমাকে এই পেশা থেকে বহিস্কার করা হবে। যেখানে তোমাকে রাজকুমারীর মোট রাখা হয়েছে সেখান থেকে তোমাকে বের করে দেয়া হলে তুমি হবে কারো দাসী বা রক্ষিতা। অথবা তোমার ঠিকানা হবে পতিতালয়। কমান্ডার তোমার মঙ্গলের জন্যই তোমাকে সাবধান হতে বলেছে।’
‘হুম!’ মেরিনা ঘৃণা ভরে বললো, ‘ও তো সেই কাজেরই যোগ্য। এর বেশী আর কি পাবে সে।’
বারবারা মেরিনার দিকে রাগে কটমট করে তাকাল। তার মুখের বর্ণ রাগে লাল হয়ে গেল, কিন্তু তবু সে মুখ খুলল না, তেমনি চুপচাপ বসে থাকলো।
বারবারাও মেরিনার মতই অপূর্ব রূপসী ছিল এবং কাজে কর্মেও চৌকস ছিল। কিন্তু যখন তাকে মিশর পাঠানো হল তখন থেকেইসে কেমন ঠাণ্ডা ও নির্জীব হয়ে গেল। এর কারণ ছিল মেরিনা।
প্রথম দিকে মিশরে গোপন ষড়যন্ত্রে সে খুবই সক্রিয় ছিল। দলনেতার সাথে তার ভাব ছিল খুবই নিবিড়। তাদের দলনেতা ছিল গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার। দেখতে খুবই সুপুরুষ ও সুদর্শন ছিল লোকটি।
ওরা সবাই এক স্থানে মিলিত হতো। দলনেতা তাকে পছন্দ করে এজন্য সে ছিল খুবই খুশী। দলনেতা যে বারবারাকে পছন্দ করে এটা কোন গোপন ব্যাপার ছিল না। দলনেতা তাকে বিয়ে করার আশ্বাসও দিয়েছিল।
দলনেতা কোন গোয়েন্দার পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করলে তার উন্নতি ছিল অবধারিত। বারবারা এতে খুবই খুশী ছিল যে, একদিন তারও যথেষ্ট উন্নতি ঘটবে। কিন্তু মেরিনা কমান্ডারের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করলো যে,কমান্ডারের অন্তর থেকে বারবারা বিদায় হয়ে গেল। সে স্থান দখন করলো মেরিনা।
এখন সে কমান্ডারের উপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করে আছে যে মেরিনা বলতে কমান্ডার অজ্ঞান। সে কমান্ডারের মনে বারবারার বিরুদ্ধে বাজে ধারনা সৃষ্টি করে রেখেছে।
মেরিনা কমান্ডারের সাথে খলামেলা প্রেম শুরু করলে বারবারা আহত হয়। সেই থেকে সে মনমরা ও নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। এখন গোয়েন্দাগিরি করতেও আর তার মন বসে না। কমান্ডার এখন তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। আর এ সবই ঘটছে মেরিনার জন্য।

সুলতান আইয়ুবীর এর বড় সামরিক অফিসারের পেছনে লাগানো হয়েছিল বারবারাকে। কিন্তু সে কাংখিত ফল লাভ করতে পারেনি। নেতার মনে ধারণা জন্মে গেছে, সে আইয়ুবীর অফিসারকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছে।
বারবারার ব্যাপারে মেরিনা সতীনের মতই আচরণ শুরু করছিল। নেতা ওদের এই বিবাদ মিটাতে না পেরে ফিরে যাচ্ছে কেন্দ্রে। উদ্দেশ্য, পুরানো লোকজন বাদ দিয়ে নতুন করে গ্রুপ তৈরী করা, যাতে গ্রুপের মধ্যে শৃঙ্খলা অটুট থাকে। এরপর তাদের নিয়ে আবার সে মিশরে ফিরে আসবে।
এতে বারবারা মেরিনার উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল। মেরিনার জন্যই এখন নেতা তার শত্রু হয়ে গেছে। মেরিনাও তার সাথে তিরস্কার ও ঘৃণার স্বরে কথা বলতো। এভাবেই তার পরিণাম খারাপ হয়ে গেল।
মেরিনা বললো। ‘গায়ের রঙ ফর্সা হলেই কেউ গোয়েন্দা হতে পারে না। গোয়েন্দা হতে হলে ঘটে কিছু বুদ্ধিও রাখতে হয়। ওর যদি সে যোগ্যতাই থাকে তবে তো সাদা ঘোড়াকেও গোয়েন্দা বলতে হবে!’
এ কথার পরও কোন জবাব দিল না বারবারা, মনে মনে শুধু প্রতিশোধের আগুন নিয়ে জ্বলতে লাগলো।
’এই লকের ভেতর থেকে আমি গোপন তথ্য বের করে নিতে পারবো।’ মেরিনা বললো, ‘এ কাজ করার সাধ্য বারবারার নেই।’
এ কথার পর আর এখানে বসা যায় না। বারবারা রাগে সেখান থেকে উঠে চলে গেল।
’সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা রাতে তো পালিয়ে যাবে না আবার?’ নেতা জিজ্ঞেস করলো।
’এখন তো তার পালাবার কোন কারণ নেই।’
’তবুও সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। তাকে অজ্ঞান করে রাখার ব্যবস্থা করো।’
কিছুক্ষণ পর।
ইসহাক তুর্কী যেখানে শুয়েছিল সে তাবুতে প্রবেস করল মেরিনা। তাবুতে প্রদীপ জ্বলছিল। মেরিনার হাতে একটি রুমাল। সে রুমালে অজ্ঞান করার ঔষুধ মাখানো।
সে আলতো পায়ে ইশাকের কাছে গেল এবং তার শিয়রে বসে হাতের রুমালটি ইসহাকের নাকে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর যখন বুঝল কাজ হয়ে গেছে, রুমাল সরিয়ে নিয়ে বাইরে চলে গেল। কমান্ডারের কাছে গিয়ে বললো, ‘কাল সূর্য উঠার পরেও তাকে ঘুমের মাঝেই পাবেন।’
’ঠিক আছে। আবার তুমিও গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে তাকে সাম্লাবার জন্য আবার তমাকেই ডাকতে হবে।’
’আপনার দাকার দরকার হবে না। তার আগেই আমি আপনার কাছে হাজির হয়ে যাবো।’
কমান্ডার বললো, ‘কাল আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এই গোয়েন্দাকে তার আবদার অনুসারে অবশ্যই ঘোড়া দেবো। কিন্তু সে ওই ঘোড়ার পিঠে চড়ে কায়রো নয়, বৈরুত যাবে।’
’এ লোক আমাদের সহযাত্রী হবে?’ প্রশ্ন করল মেরিনা।
’হ্যা, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এর গোয়েন্দাকে পাকড়াও করা আমাদের জন্য বিরাট সফলতা। এই সাফল্য আমাদের সম্রাট চাক্ষুস দেখতে পেলে আমাদের মর্যাদা কতটা বেড়ে যাবে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’
’সরদার!’ এক গোয়েন্দা বলল, ‘আসুন এই সাফল্যকে আমরা স্মরণীয় করে রাখি মেরিনার হাতের সুধা পান করে।’
কমান্ডারের হুকুমে মদ পরিবেশিত হলো। সবাই মদ পান করে আনন্দ উল্লাস করতে লাগল। মেরিনা তো আনন্দে নাচতে লাগল।
কিন্তু বারবারা সে আনন্দ উৎসবে শামিল হতে পারল না। তার মন আরো উদাসীন হয়ে গেল। মেরিনার প্রতি তার বিষিয়ে উঠা মনে ক্ষোভ আরো একটু বাড়ল এতে। সে উৎসব স্থল থেকে উঠে নিজের তাবুতে চলে গেল।
অনেকক্ষণ পড় যখন সবাই একে একে আপন তাবুতে চলে গেল, কমান্ডার মেরিনাকে বলল, ‘চলো এ আনন্দময় রাতকে আরো আনন্দময় করে তুলি।’
মেরিনা তো এ প্রস্তাবের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘চলো।’
ওরা সেখান থেকে বেরিয়ে হেঁটে বহুদূরে চলে গেল। হারিয়ে গেল সবার দৃষ্টির আড়ালে।

বারবারা তার তাবুতে একা শুয়ে শুয়ে নিজের ব্যর্থতার কথা স্মরণ করছিল। তার মন ডুবেছিল উদাসীনতায়। অন্তরে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। বাইরের আনন্দ স্ফূর্তির শোরগোল তার মনের উদাসীনতাকে আরো উসকে দিচ্ছিল। যখন আনন্দ উল্লাসের রোল শেষ হলো তখন সে উপলব্ধি করল, তার মনের আগুন না নিভে তাকে আরও অস্থির ও উত্তেজিত করে তুলছে।
সে তার তাবুর পরদা সরিয়ে বাইরে তাকাল। দেখলো কমান্ডার ও মেরিনা দূরে এক টিলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চাঁদনী রাত। তারা দু’জন হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে, স্পষ্ট দেখতে পেল বারবারা।
যতক্ষন তাদের দু’জনকে দেখা গেল, অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল বারবারা। তারা দৃষ্টির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলে তার বুক চিড়ে বেরিয়ে এল এক গভীর দীর্ঘশ্বাস।
বারবারার মনে মেরিনার সেই হুল ফুটানো কথাগুলো স্মরণ হলো, ‘গায়ের রঙ ফর্সা হলেই কেউ গোয়েন্দা হতে পারে না। গোয়েন্দা হতে হলে ঘটে কিছু বুদ্ধিও রাখতে হয়। ওর যদি সে যোগ্যতাই থাকে তবে তো সাদা ঘোড়াকেও গোয়েন্দা বলে হবে!’
বারবারা উত্তেজনে দমন করে মনে মনে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলো। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, যে করেই হোক, সে মেরিনার আশা ব্যর্থ করে দেবে।
কিন্তু কিভাবে? বারবারা ভেবে দেখলো, যদি সে ইসহাক তুর্কীকে বলে দেয়, আমরা কোন বণিক কাফেলা নই, আমরা সবাই খ্রিষ্টান গোয়েন্দা, তাহলে সে তার গোপন তথ্য আর ফাঁস করবে না।
সে এ কোথাও চিন্তা করল, পারলে তাকে এখান থেকে পালানোর ব্যবস্থা করে দেবে। তাতে করে মেরিনার আশার গুড়ে ছাই পড়বে।
প্রতিশোধের উপায় হিসেবে সে এসব বিষয় চিন্তা করছিল আর অপেক্ষা করছিল, কখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে।

চারদিক এখন নিঝুম নিস্তব্ধ। হয়তো সবাই এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে, কমান্ডার ও মেরিনা ছাড়া। বারবারা এসব ভাবছিল কিন্তু তার চোখে গুম ছিল না। এ সময় কেউ একজন তার তাবুর পাশে এসে আস্তে ডাক দিল্ম ‘বারবারা!’
কণ্ঠটি চিনতে পারল বারবারা। কিন্তু কোন জবাব দিল না।
সে আবারও ডাকল, কিন্তু বারবারার জবাব না পেয়ে পর্দা উঠিয়ে আস্তে ভেতরে ঢুকে গেল। আগন্তুক তার কানের কাছে বসে আবার ডাকল, ‘বারবারা!’
’চলে যাও মার্টিন।’
বারবারা রাগে ও দুঃখে হিসহিস করে বললো, ‘তোমাকে তো নিষেধ করেছি, আমার দিকে নজর দিও না। কোন সাহসে তুমি আবার আমার তাবুতে এসে ধুকেছো? যাও, এখান থেকে চলে যাও বলছি।’
মার্টিন চলে যাওয়ার পরিবর্তে তার আরও কাছ ঘেঁষে বসে বললো, ‘আচ্ছা, তোমার হলো তা কি বলতো? তুমি কি ভাবছো আমাদের কমান্ডার মেরিনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! তাকেই মন দিয়ে বসে আছেন তিনি?’
একটু থামল মার্টিন। তারপর খুবই ধীর কণ্ঠে বলল, ‘তুমি জানো না, এরা সবাই বদমাশ। বারবারা, তুমি অযথাই অন্তরে ব্যথা নিয়ে দায়িত্ব পালনে অসাবধান হয়ে পড়েছো। কমান্ডার কাউকেই ভালবাসে না। না তোমাকে, না মেরিনাকে।
তাই মেরিনার সাথে তাকে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে তোমার কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। যদি সত্যিকার ভালবাসা চাও তবে তা আমার কাছেই পাবে। আমি কি কোনদিন তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি, বলতে পারো?’
’তুমি আপাদমস্তক একটা ধোঁকার জাল!’ বারবারা বলল, ‘আমরা সবাই ধোঁকাবাজ। মানুষকে ধোঁকা দেয়াটা আমাদের নেশা, পেশা, সব।’
’যাই বলো, দায়িত্বের ব্যাপারে তোমার এমন উদাসীন হয়ে যাওয়াটা ঠিক নয়।’
’আমি আমার দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীন নই। আসলে আমার অন এ দুনিয়া থেকে উঠে গেছে। তাই কোন কাজ করতে ইচ্ছে করছে না আমার। আমাকে বিরক্ত করো না।’
’বারবারা! এভাবে বলো না। আমরাও তো মানুষ! মানবিক দুর্বলতা আমাদের থাকতেই পারে। সেই দুর্বলতার কথা স্মরণ করে নিজেকে কষ্ট দেয়া ও বঞ্চিত করার কোন মানে হয় না।’
’দেখো, যারা প্রতারক, ধোঁকাবাজ তাদের উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে। আমি আবারও বলছি, আমাকে বিরক্ত করো না।’
’তুমি ধোঁকার কথা বলছ? আরে ওটাতো আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। আমরা আমাদের দুশমনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করি ক্রুশের মর্যাদা রক্ষার জন্য। ওতে কোন পাপ নেই, ওটা কোন অন্যায় নয়।’
’অন্যায় না হলে তুমি হাজার বার ধোঁকা দাও গিয়ে, তবে আমাকে নয়। আমি আর ধোঁকার জালে বন্দী হতে চাই না।’িবারবারা, আমাকে ভুল বুঝ না। আমি কখনো তোমাকে ধোঁকা দেইনি, দেবো না। আমার ভালবাসা মিথ্যে নয়, মিথ্যে হতে পারে না!’
’ভালবাসার অহংকার মানায় না তোমাকে। শিশুকাল থেকে ছলচাতুরীর ট্রেনিং পেয়ে ধোঁকা দেয়াটা চরিত্রের ভূষণ হয়ে গেছে আমাদের। মুসলমানদের ধোঁকা দিতে দিতে আমরা এমন ধকাবাজে পরিণত হয়েছি যে, নিজের সাথে প্রতারণা করতেও আমরা এখন মজা পাই।
আমরা ক্রুশ চিহ্ন গলায় ধারণ করে বদমাইশি করে বেড়াচ্ছি, শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার সাথে সাথে ছলনা করছি নিজের সাথিদের সাথে। আমার এ কথা মিথ্যে নয়, নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো বলছি আমি।’
’বারবারা, চুন খেয়ে মুখ পুড়েছে তোমার। একবার দই খেয়ে দেখো, অনেক ভাল লাগবে।’
’আমাদের কারখানায় দই তৈরীই হয় না, তুমি কোত্থেকে দেবে? যদি মুসলমান হতে, তাও না হয় বিশ্বাস করা যেতো।’
’কি! তুমি মুসলমানদের সাফাই গাইছো?’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top