২৩. ইহুদী কন্যা

সুলতান আইয়ুবী ও আলী বিন সুফিয়ান যখন গোয়েন্দাদের কাছ থেকে বৈরুত ও হলবের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন তার আগেই কিছু গুরুতবপূর্ণ ঘটনা ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে দেয়ার আগমনী সংবাদ বয়ে এনেছিল।
আলী বিন সুফিয়ান খৃষ্টান এলাকায় তার ঝানু গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দিয়ে তাদের খবরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হলবেও তিনি অভিজ্ঞ গোয়েন্দা মোতায়েন করে রেখেছিলেন। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর ছেলে আল মালেকুস সালেহের কারণে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে যে গৃহযুদ্ধ চলছিল তার অবসান হয়েছিল। সুলতান আইয়ুবীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরও যে আস সালেহ ক্ষমতার লোভে নতুন করে খৃষ্টানদের সাথে গোপন চুক্তিতে শামিল হয়েছিল সেই সালেহ দু’মাস আগে মারা গেছে।
আস সালেহ মারা যাওয়ার আগে মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে ক্ষমতা অর্পন করে গেলে মাসুদ হলবে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সেই সাথে তিনি সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুনের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এসবই ছিল খৃষ্টান ও সুলতান আইয়ুবী উভয়ের জন্য বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা।
মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্ত্রী অর্থাৎ আস সালেহের মা রাজিয়া খাতুন ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে বিয়ে করার ব্যাপারে মোটেই ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু অনিচ্ছাসতবেও তিনি এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন যে কারণে তা ব্যক্তিগত কোন বিষয় ছিল না, বরং তা ছিল বৃহত্তর জাতীয় সবার্থ রক্ষার তাগিদ।
সুলতান আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিন যখন তাঁর কাছে ইয়াজউদ্দিনের সাথে বিয়ের প্রস্তাব রাখলেন তখন তিনি সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তকিউদ্দিন যখন বললেন, ‘এই বিয়ে দামেশক ও হলবের মধ্যে ঐক্যের ভিত রচনা করবে এবং ভবিষ্যতে গৃহযুদ্ধের সকল সম্ভাবনা নস্যাত” করে দেবে’, তখন বিষয়টি নিয়ে তিনি নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন।
তিনি জানেন, গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা নস্যাত” হয়ে গেলে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা আবার ঐক্যবদ্ধভাবে ময়দানে নামতে পারে তবে তার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী।
তাই রাজিয়া খাতুন এই বলে প্রস্তাবটি মেনে নিয়েছিলেন, ‘আমার নিজসব ইচ্ছা ও পছন্দ বলে কিছু নেই। ইসলামের সবার্থে আমার ব্যপারে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আমি আপনাদের হাতে সোপর্দ করছি। সুলতান আইয়ুবীকে আমি আমার ভাই ও নেতা মনে করি। এ ব্যপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমি তাই মেনে নেবো।’ তিনি অনিচ্ছাসতবেও কেবল ইস্লামের সবার্থেই এ কোরবানী দিয়েছিলেন।
খৃষ্টানদের সক্রিয় প্রভাবের কারণে হলব ও মুশেল দীর্ঘদিন ধরেই ছিল ক্রুসেড বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। যার পরিণামে এ দুটি রাজ্য সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ফলে তিনটি বছর মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত হয় বিপর্যয়কর গৃহযুদ্ধ।
এখন রাজিয়া খাতুন ও ইয়াজউদ্দিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় খৃষ্টানদের মধ্যে এ চিন্তা জাগাই সবাভাবিক, রাজিয়া খাতুন যেহেতু তাদের সবচে শত্রু নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী, সে কারণে তিনি হলব ও মুশেলে খৃষ্টানদের প্রভাব নিঃশেষ করতে চেষ্টা চালাবেন।
অপর দিকে মিশরে বসে সুলতান আইয়ুবী চিন্তা করছিলেন, খৃষ্টানদের আধিপত্য বিনষ্টের চেষ্টা শুরু হলে ক্রুসেড বাহিনী হলব ও মুশেলের সশস্র যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারে।
সুলতান আইয়ুবী এটাও চিন্তা করেছিলেন, ওই এলাকার তার অনুপস্থিতির কারণে খৃষ্টানদের ফায়দা লুটের চেষ্টা করতে পারে।
সুলতান আইয়ুবী বর্তমান ও ভবিষ্যত অবস্থা পর্যালোচনা করে করে সিদ্ধান্ত নিলেন, ক্রুসেড বাহিনী যাতে আগেই মুশেল ও হলব অবরোধ করতে না পারে, সে জন্য বিদ্যুত” গতিতে অভিযন চালিয়ে তিনি বৈরুত অবরোধ করে বসবে।
এই প্রেক্ষাপটে দ্রুত অভিযান চালানোর তাগিদ যেমন তীব্র ছিল তেমনি দুশমনের শক্তি ও তত”পরতার রিপোর্ট পাওয়াও সমান জরুরী ও গুরুতবপুর্ণ ছিল। এই সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় তিনি তিনি ছিলেন খুবঈ পেরেশান।
অন্য দিকে তাঁর বাহিনী সর্বপ্রকার প্রস্তুতি নিয়ে তৈরী হয়ে আছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট না নিয়ে তিনি কখনও যুদ্ধ ক্ষেত্রে নামেন না বিধায় তিনি তাদেরকে মার্চ করার হুকুম দিতে পারছিলেন না।
এই পেরেশানীর কারণেই তিনি হলব ও মুশেলের বর্তমান অবস্থা জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। হলবে নতুন কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা, ইয়াজউদ্দিনের বর্তমান মনোভাব কেমন, সেখানে রাজিয়া খাতুনের কোন প্রভাব পড়েছে কিনা, ঘুরে ফিরে তিনি কেবল এসবই চিন্তা করছিলেন।
আলী বিন সুফিয়ান ভাবছিলেন, আমার পাঠানো গোয়েন্দা আনাড়ী বা ভীতু নয়। গোপন তথ্য সংগ্রহ ও তা কায়রো পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার গুরুতবও তাদের অজানা নয়। এ জন্য প্রয়োজনে ওরা নিজের জীবন বাজী রাখবে, কিন্তু দায়িতবে অবহেলা করবে না, এ বিশবাসও আছে আমার। কিন্তু আমার আস্থা ও বিশবাস যে আজ নিঃশেষ হতে বসেছে!
তারা কি জানে না, যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগেই অর্ধেক জয় করতে হয় গোয়েন্দাদের! শুধু একজন গোয়েন্দার একটি ভুল সংবাদ যেমন সমস্ত সেনাবাহিনীকে ধবংস ও বরবাদ করে দিতে পারে তেমনি মাত্র একজন গোয়েন্দার সময়োচিত একটি সঠিক রিপোর্ট শত্রুর বিশাল বাহিনীকে অস্র সমর্পনে বাধ্য করতে পারে!

ইসহাক তুর্কীর ওপর আলী বিন সুফিয়ানের অগাধ আস্থা ও ভরসা ছিল। ইসহাক তুর্কীও সেই বিশবাসের মর্যাদা রক্ষার জন্য গুরুতবপুর্ণ তথ্য নিয়ে দুর্গম সিনাই মরুভূমির ভয়ংকর পথে ছুটছিল কায়রোর দিকে। সে সুলতান আইয়ুবীকে জানাতে চাচ্ছিল, সম্রাট বিলডনের খৃষ্টান সৈন্যরা বৈরুতের আশেপাশে বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। আর হলবে ইয়াজউদ্দিন খৃষ্টানদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
সে সুলতানকে সাবধান করতে চাচ্ছিল, যেন তিনি বৈরুতের দিকে না যান। কিন্তু তারপরও যদি সুলতান বৈরুতে অভিযান চালানোর ব্যাপারে অটল থাকেন, তবে ইসহাক তুর্কী সুলতানকে নকশা করে দেখিয়ে দেবে, খৃষ্টান সৈন্যরা কোথায় কোথায় তাদের শক্তির পরিমাণ কত। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে সে পথেই খৃষ্টান গোয়েন্দাদের ফাঁদে পড়ে আটক হয়ে আছে।

‘তোমাকে তো একটা ভাল ঘোড়াই দিতে হয়।’ খৃস্টান গোয়েন্দা কমান্ডার ইসহাক তুর্কীকে বললো, ‘মেরিনা আমাকে সব বলেছে। তুমি নাকি আমাদের সুলতানের জন্য গুরুতবপুর্ণ সংবাদ নিয়ে যাচ্ছো। তুমি যাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারো সে জন্য সে আমাদের শ্রেষ্ঠ ঘোড়াটি দাবি করেছে। তোমার ব্যস্ততা দেখে আমি তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। তুমি কি কোন খারাপ খবর নিয়ে যাচ্ছো?’
‘সে কথা আমি সুলতানকেই বলবো।’
‘তা তো ঠিকই। তবে আমরাও সুলতানের অনুগত এবং ভক্ত কিনা তাই জানার আগ্রহ জেগেছিল। তুমি যখন আমাদের বিশবাস করতে পারছো না তখন এ নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করতে চাই না। তোমার জন্য ঘোড়া তৈরী। ঘোড়া এবং তোমার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় ঘোড়ার সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি তোইরী হয়ে নাও।’
‘আল্লাহ তোমাদের মত অনুগত ও ভক্তদের থেকে সুলতানকে যন রক্ষা করেন।’ ইসহাক তুর্কী কিছুটা ক্ষোভের সাথে বললো, ‘আমি অই মেয়েটাকে বলেছিলাম, মাঝরাতের পর আমাকে যেন জাগিয়ে দেয়। আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কায়রো পৌঁছা দরকার। কিন্তু তোমরা আমাকে জাগাওনি কেন?’
ইসহাক এ প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষা না করেই মুখে বিরক্তি টেনে বললো, ‘ইস! কত বেলা হয়ে গেছে! রাতে ঘোড়া যত দ্রুত ছুটতে পারতো এখন এই গরমে তা কি আর পারবে! খামাখা একগাদা সময় নষ্ট হলো!’
ইসহাকের খেদ ও তিরস্কারে কেউ মন খারাপ করলো না, বরং সহানুভূতির সুরে কমান্ডার বলল, ‘তুমি খুব ক্লান্ত ছিলে, মেরিনা তোমাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো, তুমি গভীর ঘুমে। তার এত মায়া লাগলো যে সে তোমাকে না জানিয়ে ফিরে গিয়ে বলল, এখন তাকে ডাকলে তার ওপর অবিচার করা হবে। চিন্তা করো না, তোমার ঘোড়া খুব ভাল। যেটুকু সময় নষ্ট হয়েচে, এ ঘোড়া তা পুষিয়ে দিতে পারবে।’
ইসহাকের চোখ জুড়ে তখনও ঘুম ঘুম ভাব জড়িয়ে ছিল। সে বুঝতে পারছিল না, এর কারণ কি? তাছাড়া ঘুমের পরে শরীরে যে স্বাভাবিক শক্তি ফিরে আসার কথা সে শক্তিও সে পাচ্ছিল না। কেমন একটা ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব।
সে ভেবে পাচ্ছিল না, এত ঘুম তার কোত্থেকে এলো? তাকে কেউ ঘুমের ঔষুধ প্রয়োগ করেছে এমন চিন্তা তখনও তার মাথায় আসেনি।
যদিও সে যাত্রা করার জন্য অস্থির হুয়ে উঠেছিল কিন্তু যাত্রা করার মত অবস্থা তার ছিল না। রাজ্যের ক্লান্তিতে শরীরটা তার ভেঙ্গে আসছিল।
মধ্যরাতে জেগে উঠার কথা ছিল। কিন্তু সে খেয়াল করে দেখলো, ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সূর্য প্রায় মাথার উপর উঠে এসেছে। এত বেলা পর্যন্ত তার মত একজন মানুষ কখনোই ঘুমাতে পারে না, কিন্তু সে ঘুমিয়েছে। কেন? এ প্রশ্নটা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।
খৃস্টান কমান্ডার ও মেরিনা ঘুম ভাঙ্গার আগেই তার পাশে এসে বসে তার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করছিল। সে যখন চোখ খুললো তখন তারা তার সাথে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলো যে, সে নতুন করে কিছুই ভাবতে পারছিল না।
তারা এমনভাবে কথা বলছিল, যেন ইসহাক তুর্কীর মনে তাদের সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহও না জাগে। তারা এমনসব কথা বলছিল, যাতে সে তাদেরকে মুসলমান এবং সুলতান আইয়ুবীর একান্ত ভক্ত মনে করে।
তারা সুলতান আইয়ুবীর কাছে কি খবর নিয়ে যাচ্ছে জানার জন্য নানাভাবে প্রশ্ন করতে লাগলো।
ইসহাক তুর্কী তাদেরকে মুসলমান মনে করলেও গোয়েন্দাসুলভ সতর্কতার কারণে তাদের প্রশ্নের সঠিক জওয়াব দিতে ইতস্ততঃ করছিল।
তার ইতস্ততা লক্ষ্য করে খৃস্টান কমান্ডার চকিতে চাইল মেরিনার দিকে এবং চোখ টিপে ইশারায় কিছু বলে বাইরে চলে গেল।
মেরিনা কমান্ডারের ইঙ্গিত বুঝতে পারল। সে ইসহাকের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বপসে তাকে যৌবনের ফাঁদে আটকানোর জন্য আদিরসাত্মক গল্প জুড়ে দিল। কিন্তু ইসহাক তাতে উত্তেজিত না হয়ে বরং হতভম্ব হয়ে তার দিকে অবাক করা চোখে তাকিয়ে রইল।
মেরিনা বলল, ‘আচ্ছা! তুমি কি জাদু জানো?’
‘কেন?’
‘তোমাকে সে কথা বলতে সাহস হচ্ছে না।‘
‘কেন! আমিও তো ভয়ংকর কেউ নই? খুন বা ডাকাতি করে সিনাই মরুভূমিতে পালাতে আসিনি আমি।কিছু বলার থাকলে তুমি নির্ভয়ে তা বলতে পারো।’
‘তুমি ঠিক বলছো? আমার কথা শুনে আমার সম্পর্কে কোন বাজে ধারণা করবে না তো!’
‘না, অযথা তোমার সম্পর্কে আমি বাজে ধারণা করতে যাব কেন?’
মেরিনা তার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ফিসফিস করে বলল, ‘বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার যে কি হলো আমি বুঝতে পারছি না। রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। তোমাকে দেখার জন্য মন-প্রাণ ছটফট করে উঠলো। আমি উঠে এসে তোমার শিয়রের পাশে বসে রইলাম। সাড়া রাত আমি তোমার পাশেই বসেছিলাম। তোমার কাছ থেকে সরে গিয়ে দেখেছি, আমার কিছুই ভাল লাগে না।’
‘আমার এখন ভালবাসা ও মন দেয়া নেয়ার মত সময় নেই। কায়রো চলো, সেখানে অনেক সময় পাওয়া যাবে।’ ইসহাক বললো, ‘যদি তুমি আমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালই বেসে থাকো তবে আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে সাহায্য করো। আমাকে জলদি ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দাও।’
সে উঠে দাঁড়াল এবং তাবু থেকে বেরিয়ে গেল।
মেরিনা তার পিছু পিছু তাবু থেকে বেরিয়ে তার একটি হাত ধরে বললো, ‘কিছু মুখে দিয়ে নাও। সন্ধ্যেবেলা অসুস্থ শরীরে সেই যে কিছু মুখে দিলে তারপর তো আর পেটে কিছু পড়েনি।’
মেরিনা তাকে হাত ধরে টেনে তাবুতে নিতে নিতে বললো, ‘আমি তোমাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় যেতে দেবো ভাবলে কি করে! আর আমাকে সঙ্গে নিতে চাইলে আমাদের লোকেরা কি তা মেনে নেবে? তাহলে তো আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। পালাতে গেলে কিভাবে পালাবো তার বুদ্ধি বের করতে হবে না?’
মেরিনা ইসহাকের বুকে নিজের মাথা চেপে ধরে কান্নাকাতর কণ্ঠে বললো, ‘ইসহাক! তুমি কি আমাকে সঙ্গে না নিয়েই এখান থেকে চলে যাবে! তোমাকে না পেলে যে আমি বাঁচবো না!’
মেরিনা ইসহাকের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
ইসহাকের দায়িত্ববোধ তাকে পাথর বানিয়ে রেখেছিল। সে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না।
মেরিনাকে বুক থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘আহ! কি পাগলামো করছো! থামো! থামো! মনকে শান্ত করো, কান্না থামাও। আমাকে একটু ভাবতে দাও।’
মেরিনা চোখ মুছে মুখে হাসি টেনে বলল, ‘ছি! কিছু মনে করো না, তুমি চলে যাচ্ছো ভেবে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।’
তারপর একদম স্বাভাবিক হয়ে তাবুর পর্দা সরিয়ে জোরে ডেকে বললো, ‘জলদি খাবার নিয়ে এসো, সময় বয়ে যাচ্ছে।’
বারবারা খাবার নিয়ে এলো। ইসহাকের সামনে খাবার রেখে মেরিনা পিছনে গিয়ে দাঁড়াল ইসহাকের খাওয়া দেখতে লাগল।
মেরিনার কথা শুনছিল আর খাচ্ছিল ইসহাক। তার দৃষ্টি গেল মেরিনার পিছনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। বারবারা ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে হাত দিয়ে নিজের গলার ক্রুশটি কাপড়ের ভেতর থেকে টেনে বের করল এবং তার সামনে কয়েকবার নাড়াচাড়া করে আবার জামার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল।
মেয়েটির এ সামান্য ইঙ্গিতই একজন গোয়েন্দাকে সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুহূর্তে কেটে গেল তার মাথার জট। সে পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠলো।
সে আবার তাকাল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি তার বুকে হাত রেখে মেরিনার দিকে ইশারা করলো এবং আঙুল দুলিয়ে নিষেধ করলো তার কথা বিশ্বাস করতে। তারপর সে তাবুর বাইরে চলে গেল।
এই ইশারা এত স্পষ্ট ছিল যে, ইসহাক সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে গেল। এরা যে খৃস্টান এবং তার শত্রু একথা বুঝতে আর তার কষ্ট হলো না।
সে ছিল এক সতর্ক গোয়েন্দা। তাই সে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে যেভাবে খাচ্ছিল সেভাবেই খেয়ে চলল। কিন্তু এর মধ্যেই সে তার মনের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।
কেন তারা বার বার সুলতান আইয়ুবীর জন্য কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছে জানতে চাচ্ছিল, বুঝে ফেলল সে। তখন তার মনে পড়লো, ঘুম তো আমাকে কোন দিন এত দুর্বল করতে পারে না? তবে কি তারা আমার ওপর কোন ঔষধ প্রয়োগ করেছে?
নিশ্চয়ই করেছে। নইলে দুপুর পর্যন্ত আমার ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। ঘুম থেকে জেগে উঠার পর কেন তার এত ক্লান্তি লাগছিল এ প্রশ্নেরও উত্তর পেয়ে গেল ইসহাক।
কিন্তু তার এ প্রশ্নের কোন উত্তর সে খুঁজে পেল না। অন্য মেয়েটা কেন তাকে ইশারা করে সতর্ক করে দিয়ে গেল। মেয়েটি কি তবে কন মুসলমানের মেয়ে? সে কি তারই মত তাদের জালে আটকা পড়ে আছে?
মেরিনা তাকে তার কথা ও যাদুময় হাসি দিয়ে, অভিনয় দিয়ে জালে ফাঁসানোর চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিল। আর ইসহাকের মাথায় খেলা করছিল এদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার চিন্তা।
সে এখন কি করবে, কেমন করে এ লোকদের হাত থেকে মুক্তি পাবে চিন্তা করে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছিল না।
মেরিনাকে বলল, ‘পালাবো বললেই কি পালানো যায়! তোমাদের দলে এখন কত লোক আছে?’
মেরিনা ইসহাকের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি, সে তার দলের লোকদের সংখ্যা বলে দিল।
ইসহাক বলল, ‘ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। চলো, বাইরে চলো। খোলা হাওয়ায় মাথা ঠাণ্ডা করি আর ভেবে দেখি। তাড়াহুড়ো না করে আমাকে একটু ভাবতে দাও।’
সে বাইরে বের হয়ে এলো। দেখতে চাইলো এ কাফেলায় কত লোক আছে। এখান থেকে পালানোর কোন সম্ভাবনা আছে কিনা।
বাইরে বেরিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। তাঁবুগুলোর কাছাকাছি কোন ঘোড়াই নেই! তাকে বলা হয়েছিল, তার জন্য বাইরে ঘোড়া প্রস্তুত। কিন্তু এটা যে মিথ্যা, তখন সে তা ভাবতে পারেনি।
মেরিনা তার পাশে এসে দাঁড়ালো। ইসহাক বললো, ‘আমার জন্য নাকি ঘোড়া প্রস্তুত করে রেখেছো? সে ঘোড়া কোথায়?’
‘আছে। দাঁড়াও, আমি আসছি।’
ইসহাকের সামনে থেকে সরে পড়লো মেরিনা।
‘তুমি ঠিক বলেছো।’ মেরিনা কমান্ডারকে গিয়ে বললো, ‘এ লোক সত্যি পাথর। সে ঘোড়া ছাড়া আর কোন কথাই বলছে না। আইয়ুবীর কাছে কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছে বের করতে চেষ্টা করেছিলাম আমি। কিন্তু সে বড় হুশিয়ার, আমার কথার ধারে-কাছেও যাচ্ছে না সে।’
‘তার মনে তো কোন সন্দেহ দেখা দেয়নি?’
‘দেয়ার কোন কারণ তো দেখি না।’ মেরিনা উত্তর দিল, ‘তবে সে কোন গোপন তথ্য বলবে বলে মনে হয় না।’
‘তার অর্থ হলো, তুমি ব্যর্থ হয়েছো।’ কমান্ডার মেরিনার দিকে তাকিয়ে বলল।
তারা বুঝতে পারেনি, বারবারা তার অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে। সে এটাও প্রমাণ করে দিয়েছে, মেরিনার সকল যাদুই ব্যর্থ হয়েছে।
বারবারা ভেবেছিল, সে সুলতান আইয়ুবীর এই গোয়েন্দাকে মুক্ত করে দেবে। তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে। কিন্তু এখন তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
ইসহাক ক্যাম্পটি ঘুরে দেখতে চাইল। সে তাবুগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পরই সে মেরিনা ও কমান্ডারকে দেখতে পেল এল জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কমান্ডারকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আমার ঘোড়া কোথায়?’
‘কিসের ঘোড়া? ঘোড়া তুমি পাবে না।’
কমান্ডারের কণ্ঠে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর। সে গম্ভীর স্বরে বললো, ‘তুমি কোথাও যেতে পারবে না।’
ইসহাক তার কোমরে হাত রাখলো। সেখানে না তার তলোয়ার আছে, না আছে খঞ্জর।
এরই মধ্যে বারবারার মাধ্যমে সে তাদের পরিচয় জানার পরও বললো, ‘আমি বিস্মিত হচ্ছি, মুসলমান হওয়া সত্বেও তোমরা আমার পথে বাঁধা দিচ্ছো?’
‘যদি তুমি তোমার ভাল চাও তবে বলে দাও, সুলতানের জন্য তুমি কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছো?’ কমান্ডার কঠিন কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করল।
‘সংবাদ তেমন কিছু নয়, আমাদের এক আমীর ইয়াজউদ্দিন মাসুদ সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুনকে বিয়ে করেছে।’ ইসহাক বললো।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top