২৩. ইহুদী কন্যা


’কেন গাইবো না? তোমাদের তুলনায় মুসলমানরা অনেক ভাল এবং বুদ্ধিমান। তারা গোয়েন্দাগিরি করার জন্য মেয়েদের ব্যবহার করে না।
আমাদের কমান্ডার প্রথমে আমাকে ভালবাসার লোভ দেখিয়েছে। যেহেতু মেরিনা বেশি চালাক এবং ধুরন্ধর, সে জন্য সে কমান্ডারকে মুঠোর মধ্যে পুর নিয়েছে। তুমি আমার উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছো। ফলে আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমরা একে অন্যকে শত্রু বানিয়ে নিয়েছি। তাই তো ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে এখন আমাদের বৈরুত ফিরে যেতে হচ্ছে।’
’ব্যর্থতা আর সফলতা দুই বন। এরা সবসময় গলাগলি ধরে থাকে। সামান্য ব্যর্থতা দেখে তোমার নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। এই আমরাই আবার সাফল্য ছিনিয়ে আনবো।’
’আমি নিরাশ, কারণ তোমরা ব্যর্থতার কারণ দেখতে পাও না। যদি আমরা দুটি মেয়ে তোমাদের সাথে না থাকতাম, তবে তোমরা তোমাদের দায়িত্ব সাহস ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারতে। পুরুষের মাঝে মেয়েদের অবস্থান করার অর্থই হল শত্রুতা সৃষ্টি করা, ঝগড়া বিবাদের সূত্রপাত করা। আমাদের সঙ্গে রাখার কারনেই আজ তোমাদের মাঝে এই ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। যদি কেউ বলে, যত নষ্টের গোড়া এই দুই মেয়ে, আমি তা অস্বীকার করতে পারবো না।’
’এ কারনেই তো আমরা মুসলমানদের মাঝে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের রেখে দেই।’ মার্টিন বলল। ‘তাদের মধ্যে পরস্পর শত্রুতা সৃষ্টি করাই আমাদের কাজ। আমরা সে কাজ এজন্য করি যাতে ইসলামের অবক্ষয় সৃষ্টি হয় আর বিশ্বব্যাপী খৃষ্টানদের আধিপত্য কায়েম হয়।’
মার্টিন বারবারাকে তার দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘এত সুন্দর চাঁদনী রাতকে এমন নিরস কোথায় ব্যর্থ করে দিও না বারবারা। এসো বাইরে যাই। দেখো তো চাঁদনী কতো সুন্দর!’
‘আমার মন ভেঙ্গে গেছে।’ বারবারা বলল, ‘আমি ব্যর্থতার গ্লানিতে ভুগছি। তোমাদের সবার প্রতি আমার ঘেন্না জমে গেছে। আমি কোথাও যাব না, তুমি একাই যাও।’
এবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মার্টিন। বলল, ‘একদিন তুমি আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদবে বারবারা! আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে, মার্টিন, আমাকে বাঁচাও! দেখো, এরা আমাকে কুকুরের মাঝে ছেড়ে দিচ্ছে। তখন কিন্তু আমি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারবো না।’
‘আমি এখনো কুকুরদের মাঝেই আছি।’ বারবারা ঘৃণা ভরে বললো, ‘আমি তোমার সাহায্য কোনদিন চাইবো না। এবার তুমি এখান থেকে যাও।’
ক্ষিপ্ত মার্টিন রাগে উঠে দাঁড়ালো এবং গরগর করতে করতে চলে গেল।
সে তাবুর পর্দা সরিয়ে মার্টিনের চলে যাওয়া দেখলো। মার্টিন চলে যেতেই আবার তার মন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু তখনি বিছানা ছেড়ে উঠলো না সে, অপেক্ষা করতে লাগলো মার্টিনের ঘুমিয়ে পড়ার।
সে ধারণা করলো, কমান্ডার ও মেরিনার ফিরতে অনেক দেরী হবে। তারা ফিরে আসার অনেক আগেই সে ইসহাকের সঙ্গে দেখা করতে চাইলো।
কিছুক্ষণ পড়।
তাবুর বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো বারবারা, কোন তাবুর বাইরেই কেউ দাঁড়িয়ে নেই। মার্টিন ঘুমিয়ে না পড়লেও নিশ্চয়ই সে তার তাবুতে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
হামাগুড়ি দিয়ে নিজের তাবু থেকে বেরিয়ে এলো বারবারা। দাঁড়ালো না, ক্রল করে পিছিয়ে গেল। সামনে একটু গর্ত মত জায়গা ছিল, সেখানে নেমে উঠে বসলো। তারপর সেখান থেকে উঠে তাবুগুলো থেকে দূরে সরে গেল আস্তে ধীরে।
অনেক দূর ঘুরে নিঃশব্দে এগিয়ে এলো ইসহাকের তাবুর দিকে। কোন রকম বাঁধা ও বিপদ ছাড়াই এক সময় সে ইসহাকের তাবুর কাছে পৌঁছে গেল।
ইসহাক তুর্কী বেহুশ হয়ে পড়েছিল তাবুর ভেতর। বারবারা জানতো না, মেরিনা তাকে বেহুশ করে রেখে গেছে। সে খুব সাবধানে তাবুর পর্দা সরিয়ে, পা টিপে টিপে তাবুর মধ্যে প্রবেশ করলো।
তাবুর ভেতর প্রদীপ জ্বলছে। সে ইসহাককে ডাকল, সাড়া দিল না ইসহাক। এবার তার কাঁধ ও বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিল, তাতেও কাজ হল না। নিরুপায় বারবারা তার মাথার ছুল ধরে জোরে টানাটানি করল, কিন্তু ইসহাক তুর্কী এ সবের কিছুই টের পেল না।
‘ওরে হতভাগা ওঠ!’ সে ইসহাকের মুখে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘তুই যে গর্দভের মত ঘুমাচ্ছিস, তুই কি জানিস তুই কি ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়েছিস? আমরা সবাই খৃস্টান ও ইহুদী গোয়েন্দা। এখন পালাতে না পারলে তুই আর কোনদিন কায়রো যেতে পারবি না। বৈরুতের কারাগারের নিষ্ঠুর কক্ষে ভীষণ যন্ত্রনায় ভুগে ভুগে মারা যাবি।’
ইসহাক বেহুশের মত পড়ে রইলো, যেন মারা গেছে। বারবারা তাবুর বাইরে মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেল কিন্তু সে ভয় পেল না। সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়ে, শব্দ কাছে এসে গেল তবু সে ওখানেই বসে রইল।
শব্দ তাবুর আরও কাছে এলে সে বুঝলো, এই কণ্ঠস্বর মেরিনার। সে কমান্ডারকে সাথে নিয়ে বন্দীকে দেখতে আসছে।
‘আমরা সবাই মুসলমান।’ বারবারা ইসহাককে উদ্দেশ্য করে জোরে জোরেই বলছে, ‘আমরা তোমাকে এমন ঘোড়া দেব যে ওই ঘোড়ার সাহায্যে তুমি দুই দিনেই কায়রো পৌঁছে যেতে পারবে।’
‘বারবারা!’ সে তার কমান্ডারের কণ্ঠ শুনতে পেল, পিছন ফিরে দেখল, তাবুর মধ্যে কমান্ডার ও মেরিনা দাঁড়িয়ে আছে। কমান্ডার বলল, ‘তুমি এখন যাও। তোমার আর দায়িত্ব পালন করতে হবে না। একজন বেহুশ মানুষকে তুমি কখনোই তোমার কথা শোনাতে পারবে না।’
‘এটা আনার শিকার বারবারা!’ মেরিনা বিদ্রুপ মেশানো কণ্ঠে বলল, ‘আমিই শুধু জানি তার মুখ থেকে কেমন করে গোপন তথ্য বের করতে হবে।’
কমান্ডার ও মেরিনার বিদ্রুপ গায়ে মাখলো না বারবারা। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বলল, ‘আমি তো আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
‘যাও, আর চেষ্টা করতে হবে না। তুমি তোমার তাবুতে গিয়ে শুয়ে পড়।’
কমান্ডারের হুকুম শিরোধার্য করে সে উঠে দাঁড়ালো এবং মেরিনার দিকে একবার বাঁকা দৃষ্টি হেনে বাইরে চলে গেল।
গোয়েন্দা কমান্ডার ইসহাকের নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলো। তার অবস্থা স্বাভাবিক দেখে মেরিনাকে সঙ্গে নিয়ে কমান্ডার তাবুর বাইরে বেরিয়ে এল।
ইসহাক তুর্কী সুলতান আইয়ুবীর জন্য বয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বুকে নিয়ে বেহুশের মত পড়ে রইল বিছানায়।

‘আলী বিন সুফিয়ান!’ কায়রোতে সুলতান আইয়ুবী তার গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘ওদিক থেকে এখনও কোন সংবাদ এলো না। তার মানে তুমি যদি বলো, সেখানে কোন ঘটনা ঘটেনি, কোন তৎপরতা চলছে না, সেকথা আমি মানতে পারি না।’
‘আর আমিও একথা মানে পারি না যে, সেখানে কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে আর আমরা তা জানতে পারবো না।’
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘সেখানে আমাদের যে লোক কাজ করছে সে কোন সাধারণ গোয়েন্দা নয়। ইসহাক তুর্কীকে আপনিও ভালমত জানেন। সে মাটির তলার গোপন তথ্যও সংগ্রহ করার ক্ষমতা রাখে। তার মত বুদ্ধিমান ও চালাক গোয়েন্দা আমাদের অন্ধকারে রাখবে, এটা ভাবা যায় না। শুধু সে কেন, তার দলের প্রতিটি সদস্যই হুশিয়ার গোয়েন্দা।’
‘খৃস্টানরা তাদের লাভ অবশ্যই খুঁজে বের করবে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘বিলডনের খৃস্টান বাহিনী হলব ও মুশেলের পাশে অযথা ঘুরাঘুরি করছে, এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই।’
‘কিন্তু এখন তো আল মালাকুস সালেহ নেই।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘এখন হলবের শাসনকর্তা ইয়াজউদ্দিন মাসুদ। সে খৃস্টানদের সাথে মিতালী করার লোক নয়।’
‘আলী!’ সুলতান আইয়ুবী বিস্ময়ের সাথে বললেন, ‘তুমিও নিশ্চিত শান্তনায় রয়েছো? তাকে আমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলি বলেই কি তুমি তাকে পাক্কা মুসলমান বলছো? কিন্তু তুমি কি লক্ষ্য কর নি আমি তার সাহায্য ছাড়াই আর্মেনীয়দের অস্র সমর্পণ করতে বাধ্য করলাম আবার শর্ত সাপেক্ষে তাদের হাতে ক্ষমতাও তুলে দিলাম। আমি জানি, তারা চুক্তি ভঙ্গ করতে সাহস পাবে না। কিন্তু আমি আমার মুসলমান শাসকদের বিশ্বাস করতে পারছি না।
ইয়াজউদ্দিন মাসুদ আমার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ঠিক, কিন্তু তার দরবারে এখনো গাদ্দার উজির ও খৃস্টান উপদেষ্টারা রয়ে গেল কিসের ভিত্তিতে? কেন সে তাদের বিদায় করার ব্যবস্থা করলো না? আলী, তুমি তো নিজেই সাক্ষী, তোষামোদকারী উজির ও উপদেষ্টাদের পক্ষে ষড়যন্ত্রকারীদের জালে আটকাতে সময় লাগে না। জাতি ও দেশের স্বার্থকে তারা ব্যক্তি স্বার্থে যে কোন সময় বিকিয়ে দিতে পারে।
আমি কোন উপদেষ্টা রাখার বিরোধী নই। এটা কোরআনেরই নির্দেশ যে, কোন সিদ্ধান্তে আসার আগে পরামর্শ নাও। আল্লাহ্‌ পাক তার প্রিয় রাসুল (সা.)কেও এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু উজির ও উপদেষ্টাদের সে পরামর্শ সঠিক কিনা টা বুঝবার মত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকা দরকার শাসকের।
তাদের উদ্দেশ্য দেশ ও জাতির অনুকূল না প্রতিকূল সে বিষয়টি বুঝতে পারার মত সূক্ষ্ম জ্ঞান না থাকলে সেই শাসক ও নেতা তোষামোদকারীদের হাতের পুতুল হয়ে যায়। চাতুকাররা নেতৃত্ব ও ক্ষমতাকে তাদের নেশায় পরিণত করে দেয়। ইতিহাস সাক্ষী, এ ধরনের শাসকদের সময়ই দেশ ও জাতির ভাগ্যে দুর্ভাগ্য নেমে আসে।
কোনটা সত্য ভাষণ আর কোনটা তোষামোদী যখন বুঝতে পারে না শাসক, তখন আপনাতেই সে তোষামোদকারীদের বেশী প্রিয় ভাবতে থাকে। তাদের মিষ্টি মধুর ঘুম পাড়ানি গানে মজে গিয়ে সত্যভাষণ শোনার ধৈর্য ও যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তোষামোদ-প্রিয়তার কারণেই নিষ্ঠাবান রাজকর্মচারী অপ্রিয় আর ষড়যন্ত্রকারীরা আপন ও প্রিয়ভাজনদের মধ্যে শামিল হয়ে যায়।
যখন কোন নেতা ও শাসক আপন-পর চিনতে এভাবে ভুল করে বসে তখন তার পতন কেউ ঠেকাতে পারে না। ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পড়ে একের পর এক গর্তে পা দেয় আর নামতে নামতে পতনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। এ ধরনের মাথামোটা শাসক যত বড় বীর বা গাজীই হোক না কেন, দেশ ও জাতিকে তারা ডুবিয়েই ছাড়ে। ইয়াজউদ্দিনকে নিয়ে আমার এমন ভয়ই হচ্ছে।’
‘আমি এই ভরসার কথা বলছি যে,নুরুদ্দিন জঙ্গির বিধবা স্ত্রী ইয়াজউদ্দিনের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন।’
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আপনি তো এ সংবাদ ও পেয়েছেন, মহীয়সী রাজিয়া খাতুন শুধু এই শর্তেই এ বিয়েতে রাজি হয়েছেন জে,মুশেল ও হুলেবের সেনাবাহিনী আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। তাকে সঠিক পথে রাখার উদ্দেশ্য ছাড়া এই মহীয়সী মহিলার এ বিয়েতে রাজি হওয়ার আর কোন কারণ দেখি না।’
‘তবু আমার সন্দেহ আছে তাকে নিয়ে। কেউ নিজে লোভী হলে আপনজনেরা তাকে কতক্ষণ আগলে রাখবে?’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমার সন্দেহের আরো কারণ আছে। ইয়াজউদ্দিন ক্রুসেড বাহিনীর একদম তোপের মুখে। সে নিজেকে নিরাপদ করার জন্য আমার সাহায্য চায়নি। তাহলে তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে দিল? নিশ্চয়ই সে গোপনে খৃস্টানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আছে। সেখানকার অবস্থা আমাকে জলদি জানতে হবে। তুমি আমার চোখ ও কান আলী! তুমি জানো, আমি অন্ধকারে কখনও সামনে চলি না !’
‘আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন সুলতান।’ আলী বিন সুফিয়ানের কন্ঠ।
‘বেশী দিন অপেক্ষা করার মত সময় আমার হাতে নেই।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তুমিতো জানোই, আমি সৈন্যদের প্রস্তুত করে ফেলেছি। নিজের চোখেই দেখতে পাচ্চো, আমি রাতদিন সৈন্যদের যুদ্ধের মহড়া ও কঠোর প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। আনার মনের গহীন গোপনে যে আশা ও সবপ্ন লুকিয়ে আছে তাও তোমাকে বলি, আমি হলব ও মুশেলের দিকে যাবো না। এবার আমার টার্গেট হবে বৈরুত।’
‘বৈরুত?’ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘হ্যাঁ, বৈরুত। আমি আর প্রতিরক্ষা যুদ্ধ করতে রাজি নই। হ্লব ও মুশেলের দিকে যাওয়ার অর্থ, সে এলাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা। কিন্তু এখন আমার লক্ষ্য হলো ঘোরতর যুদ্ধ। যে প্রলয় এর আগে আমি আর কোথাও সৃস্টি করিনি।’
সুলতান যখন কথা বলছিলেন তখন তার দৃষ্টি ছিল দূর দিগন্তে। মনে হচ্ছিল তিনি বৈরুতের অলিতে গলিতে ঘুরছেন। প্রলয় ঝঞ্ছার মত তছনছ করছেন দুশমনের দুর্ভেদ্য ঘাটিঁগুলো। আলী বিন সুফিয়ান এক বুক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিয়ে তাকিয়েছিলেন তার প্রিয় নেতার দিকে। সে দৃষ্টিতে ছিল অপরিসীম মুগ্ধতা।
সুলতান আইয়ুবী আবার মুখ খুললেন, বৈরুত খৃষ্টানদের প্রাণকেন্দ্র। হাত পায়ে আঘাত করার চেয়ে সরাসরি বুকে আঘাত করি না কেন? শত্রুদের কলিজার উপরে একটি মোক্ষম আঘাত হানতে পারলে পৃথিবী মুসলমানদের জন্য অনেক প্রশস্ত হয়ে যাবে।
সেই চূড়ান্ত আঘাত হানার বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তোলার জন্যই এত ট্রেনিং, এত প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনী ও জাতিকে আমি এমনভাবে প্রস্তুত চাই, যেন নির্মম, নিষ্ঠুর ও নির্দয় আক্রমণে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
আমরা কি চিরকাল নিজেদের এলাকাতেই যুদ্ধ করবো? না, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকলে বায়তুল মুকাদ্দাস আমরা কোন দিনই পৌঁছতে পারবো না। বায়তুল মুকাদ্দাস যেতে হলে আমাদেরকে ঘর থেকে বেরোতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে নিজের এলাকার বাইরে গিয়ে।
দুশমন যেভাবে আমাদের ব্যস্ত রেখেছে নিজেদের ঘর সামলানোর কাজে সেই কাজ আমি দুশমনের হাতে তুলে দিতে চাই। এখন আমি এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে চাই, যাতে ওরাই নিজেদের ঘর সামলানোর ব্যস্ত থাকে। এসব কথা একটু ভাবো আলী। তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে, কেন আমি চারদিকের সংবাদের জন্য এত পেরেশান হয়ে আছি।’
‘সুলতান! আপনি ঠিক কি খবর ও তথ্য এ মুহুর্তে জানতে চান?’
‘আলী! এ মুহুর্তে মাত্র দুটো গোপন বিষয় জানা আমার জরুরী। একটি হলো, বৈরুতে খৃষ্টানদের সামরিক তত”পরতা ও শক্তির একটি নিরেট বাস্তব চিত্র। আর দবিতীয়টি হলো, হলব ও মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদের প্রকৃত মনোভাব ও পরিকল্পনা কি! আমাকে কি আরও একবার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে, নাকি ইসলামের উদার মুক্ত শান্তির বাণী নিয়ে আমি ছুটে যেতে পারবো বিপন্ন মানবতার কাছে?’
‘বৈরুতে ইসহাক তুর্কী আছে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, জরুরী সংবাদ থাকলে সে নিজেই তা নিয়ে ছুটে আসতো। আর নেহায়েত নিজে না পারলে অন্য কাউকে দিয়ে সে খবর সে অবশ্যই পাঠিয়ে দিত। আপনি এখন যা জানতে চাইলেন তা দ্রুত জানার উপায় হলো, এখান থেকে কাউকে এ খবর আনার জন্য এখনি পাঠিয়ে দেয়া। সে যেন জলদি খবর নিয়ে ফিরে আসে সে ব্যাপারে আমি তাকে বিশেষভাবে বলে দেবো।’
‘আমি বেশী দিন অপেক্ষা করতে পারবো না আলী!’
সুলতান আইয়ুবী পেরেশানী নিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে তুমি কাউকে পাঠাবে, সে ওখানে পৌঁছে সেখানকার অবস্থা জানবে, তারপর সেই খবর নিয়ে সে আবার ফিরে আসবে ফিরে আসবে- এ তো দেখছি তিনমাসের লম্বা এক পরিকল্পনা। না আলী না, এত সময় আমি অপেক্ষা করতে পারবো না। আমি তার আগেই সেনাবাহিনী নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে চাই। আমার বাহিনী মার্চ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আমার আদেশের অপেক্ষা করছে।’
‘তবে তো আপনি অন্ধকারেই অভিযান চালাবেন?’
আলী বিন সুফিয়ান সুলতানকে এত তাড়াতাড়ি অভিযান চালানো থেকে বিরত রাখার জন্য বললেন, ‘আপনি চাইলে কমান্ডো বাহিনীকে আমি আপনার পরিকল্পিত পথে অনুসন্ধানের জন্য পাঠিয়ে দিতে পারি। তারা অনেক দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে দুশ্মনের গতিবিধির খোঁজ খবর নেবে। সে খবর আমাদের বেরিয়ে পড়া আপনার উচিত হবে না।’
‘কিন্তু আমার তো প্রস্তুতির কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন বসে সময় অপচয় করার ধৈর্য আমার নেই।’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি আল্লাহর পথের এক সৈনিক। আল্লাহর হুকুম অমান্যকারীদের হাত থেকে আল্লাহর জমিঙ্কে মুক্ত করার কঠিন দায়িতব কাধেঁ নেয়ার পর আমি তো আমার নিরাপত্তা ও আরাম আয়েসের জন্য জন্য মিশরে বসে থাকতে পারি না!’

১১৮২ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাশ।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top