২৪. সামনে বৈরুত

 পাল তোল নৌকায় ককে জাহাজ থেকে ক্রমে দূরে যাচ্ছে কাসেদ দু’জন। যতক্ষণ তাদের দেখা গেল, তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন হেশামুদ্দিন ১ এক সময় দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল ওরা। বাতাস বইছিল উপকূল বরাবর। সন্ধার পর বৈরুত থেকে দূরে দক্ষিণের এক সমুদ্রকুলে গিয়ে নৌকা ভিড়ালো কাসেদ দু’জন। সেখানকার সাগরের পাড়টা ছিল এক পাহাড়ের ঢালে।

 ওরা নৌকা থেকে ঘোড় নামালো। নৌকাটা টেনে একদম চরায় তুলে ফেললো। পাহাড়ী এক বৃক্ষের গোড়ায় শক্ত কর বাঁধলো নৌকাটা। তারপর তারা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো।

 সওয়ারী পিঠে চাপতেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া দু’টো রওনা হলো। পাহাড়ের চূড়ায় উঠ গেল তারা। তারপর ঘোড়ার মুখ বৈরুতের দিকে ফিরিয়ে হাওয়ার বেগে ছুটলো সেদিকে।

প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে শেষ রাতের দিকে তারা বৈরুতের উপকন্ঠে পৌঁছলো।

 মুসলিম বাহিনীর নাগাল পেতে বেশী বেগ পেতে হয়নি তাদের। ফজরের আগেই তারা সুলতান আইয়ুবীর সামনে গিয়ে হাজির হলো।

 রাতভর আইয়ুবী সেনাপতিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। খৃস্টানদের তৎপরতা তার কাছে বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে। শহরের ভেতর থেকে যে প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন তিনি, তেমন কোন তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি তাদের মধ্যে। এর একটাই কারণ থাকতে পারে, খৃস্টানরা এবার যুদ্ধের কেন নতুন চীৃালের কথা চিন্তা করছে। কিন্তু কি হতে পারে তাদের সেই নতুন চাল?

 সমস্যাটা ভাবিয়ে তুললো সুলতানকে। এই নিয়েই সারা রাত দরবার করেছেন তিনি। তবে কি আমরা ওদের কোন ফাঁের মধ্য পা দিয়েছি? সারা রাত বৈঠক করেও এর কোন নিশ্চিত জবাব বের করতে পারেননি তিনি।

 তিনি সেনেপতিদের বলছিলেন, ‘বৈরুতকে আমরা অবরোধ করে নিয়েছি। বৈরুত কোন যেনতেন শহর নয়। এটা রক্ষা করার জন্য খৃস্টানদের মরিয়া হয়ে চেষ্টা করার কথা। কিন্তু গতকাল আমি আমার রিজার্ভ ফোর্সের একটি অংশকে পাঠিয়েছিলাম পরীক্ষামূলক আক্রমণ করার জন্য।

 কিন্তু তাদের কথা হচ্ছে, খৃস্টানরা খুব অবহেলার সাথে তাদের মোকাবেলা করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, রিজার্ভ বাহিনী ছাড়াই এ যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা নয়।

 শহরের বাইরে যে যুদ্ধ হচ্ছিল সেখানকার রিপোর্ট হচ্ছে, কমান্ডো বাহিনী আঘাত হানলেই তারা পিছনে সরে যাচ্ছে। কোথাও বড় আকারের সংঘাতের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না তারা। এটাও কোন ভাল লক্ষণ নয়।’

 তখন মধ্য রাত পার হয় গেছে। সুলতানের বৈঠক তখনো চলছিল, এ সময় কমান্ডো বাহিনীর একটি গ্রুপের মাত্র একজন সৈন্য রক্তাক্ত অবস্হায় ছুটে এল সেখানে।

 কমান্ডো বৈঠকের সদস্যদের সামনেই সুলতানকে একটি দুঃসংবাদ শুনালো। বললো, ‘আমরা খৃস্টানদের একটি ক্যাম্পে হানা দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা রাতে বিশ্রামে না গিয়ে যে কোন ধরনের আক্রমণ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল। আমরা হামল করতেই ওরা আমাদেরকে চারদিক থকে ঘিরে ফেলল।

 তারা আমাদের সবাইকে শহীদ কর দিয়েছে। আমি যে তাদের ঘেরাও থেকে বেঁচ আসতে পারবো তেমন কোন সম্ভাবনা ছিল না। হয়তো আপনাকে এখবর জানানোর জন্যই আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’

 এক সেনাপতি বললো, ‘ আমার মনে হয় অবরোধ করতে আসা আমাদের বাহিনী খৃস্টানদের বিরাট অবরোধের মধ্যে পড়ে গেছে।’

এ গটনার একটু পরেই নৌবাহিনীর কাসেদ সেখানে এসে উপস্হিত হলো। তারা সাগরের অবস্হা বর্ণনা করে বললো, ‘এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলু বলছেন, আমরা যে অভিযানে আসছি এ খবর খৃস্টানরা অনেক আগেই পেয়ে গেছে। তাই তারা আমাদের প্রতিরোধ করার জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্হাই নিয়েছে বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে সমুদ্র অভিযান ব্যর্থ কর দেয়ার জন্য তারা শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে। এ অবস্হায় আমার জন্য আপনার কি আদেশ তা কাসেদ মারফত জানিয়ে বাধিত করবেন।’

 ‘খৃস্টানদের এমন সবদিক থেকে সতর্ক ও প্রস্তুত অবস্হায় আমি এর আগ কোন দিন দেখিনি। ‘ সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতিদের বলছিলেন, ‘এখন স্পষ্ট বোঝা গেল, আমাদের পরিকল্পনার খবর সঙ্গে সঙ্গেই গোয়েন্দা মারফত বৈরুতে পৌঁছে গিয়েছিল। যে বৈরুত আমরা গোপনে অবরোধ করতে এসেছি সেখানে কোন গোপনীয়তাই গোপন থাকেনি।’

 ‘এটা জানার পর আমরা ওদের পাতা ফাঁদে পা দিতে পারি না। এই অবরোধ নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবা ইচিৎ।’ বললেন এক সেমাপতি।

 সুলতান এর সাথে একমত হয়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছো। আমরা অবশ্যই নতুন করে যুদ্ধের ছক আঁকবো।’

 তিনি এ্যামিরাল হেশামুদ্দিনের পাঠানো কাসেদদের দিকে পিরে বললেন, ‘হেশামুদ্দিনকে বলবে, তাঁর নৌবহর যেন সে বৈরুতের উপকন্ঠ থেকে সরিয়ে নেয়। সবাইকে নিয়ে তাকে আলেকজান্দ্রিয় ফিরে যেতে বলবে। সৈন্যদেরকে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে অবতরণ করিয়ে তাদেরকে যেন সোজা দামেশকে পাঠিয়ে দেয়।’

 কাসেদরা বিদায় হয়ে গেল। পরদিন ভোরে সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীক মুশেলের দিকে পিছু সরে যেতে আদেশ দিলেন। বললেন, ‘কমান্ডোরা খৃস্টান সৈন্যদের সাথে মোকাবেলা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু মূল বাহিনী দীরে ধীরে পিছু হটে মুশেলের দিকে এগিয়ে যাবে।’

 এই পিছু হটার বিষয়টাও সহজ ব্যাপার ছিল না। পিছু হটতে গিয়েও কমান্ডো বাহিনীর সাহায্য নিতে হলো মূল বাহিনীকে। নইলে খৃস্টানদের লুকিয়ে থাকা বাহিনীর আক্রমণে তাদের নাস্তানাবুদ হতে হতো।

 কমান্ডো বাহিনী তাদের জীবন ও রক্ত দিয়ে সৈন্যদেরকে অবরোধ মুকতত করে আনে। খৃস্টান সম্রাট বিলডনের ধারণা ছিল, সুলতান আইয়ুবী একনো ময়দানে এসে পৌঁছাননি। সময় ক্ষেপনের জন্য মুসলিম বাহিনী জায়গা বদল করছে।তাই তিনি পিছু হটা বাহিনীকে ধাওয় করার আদেশ জারী করেননি।মুসলিম বাহিনীর সৌভাগ্য যে, সম্রাট বিলডন একটি বুলের মধ্যে ছিলেন , নইলে অবস্হা আরো অনেক বেশী নাজুক হতে পারতো।

মুশেলের দিকে এগিয়ে যাওযার পথে হঠাৎ সুলতান আইয়ুবীর সাথে মুশেল থেকে আসা এক গোয়েন্দার সাক্ষাত হলো। ইসহাক তুর্কী বৈরুত থেকে ফিরে এলে এই গোয়েন্দার সাথে তার সাক্ষাত হয়েছিল। ইসহাক কুর্কীর কাছ থেকেই সে শুনেছিল বৈরুতের সর্বশেষ পরিস্হিতি।

 সুলতান আইয়ুবীর কাছে গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কীর কথা উল্লেখ করে বললো, সে আমাদের কাছে বৈরুতের ঘটনা উল্লেখ করে আর দেরা করেনি। আমাদের কাছ থেকে মুশেলে আপনার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তার বিবরণ শুনে পরদিনই কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা করে যায়। এটা বেশ কিছিদিন আগের কথা।’

 ‘মুশেলে আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র হচ্ছে? ‘ প্রশ্ন করলেন সুলতান আইয়ুবী।

 গোয়েন্দা ইয়াজউদ্দিন মাসুদের সমস্ত পরিকল্পনা সুলতানের সামনে তুলে ধরলেন।

 গোয়েন্দার রিপোর্ট শুনে সুলতান আইয়ুবী রাগে লাল হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গ তিনি আদেশ দিলেন, ‘এখনি মুশেল অবরোধ করে তাকে দখল করে নাও।’

 বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার ডাইরিতে লিখেছেন, ‘সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী 10 নভেম্বর 1182 সালে মুশেলের নিকটে এসে পৌঁছেন।

 সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী মুশেল আসছন এ খবরে ইয়াজউদ্দিন মাসুদ বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদ চলে গেলেন খলিফার সাহায্য চাইতে। ইয়াজউদ্দিন মাযুদ আমাকে বলেছেন, ‘সুলতানের আগমনের খবর পেয়ে আমি দজলার স্রোতে দ্রুকগামা নৌকায় চড়ে বাগদাদ পৌঁছে গেলাম। মাত্র দুইদিন দুই ঘন্টায় আমি আমি এ দূরত্ব অতিক্রম করেছিলাম।

 খলিফার কাছে আমি সাহায্যের আবেদন জানালে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি শায়খুল উলামাকে গিয়ে বলো সুলতান আইয়ুবীর সাথে তিনি যেন তোমাকে আপোষ করিয়ে দেন।’ কিন্তু শায়খুল উলামা আমার পক্ষ কথ বলবেন, এমনটা আমি আশা করতে পারিনি বলে সেখান থেকে আমি আজারবাইজান চলে গেলাম তাদের কাছে সাহায্য চাইতে। আজারবাইজানের শাসক সাহায্যের বিনিময়ে যে শর্ত আরোপ করলেন, আমার মনে হলো তার চেয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করা অনেক ভাল। ফলে আমি ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সেখান থকেও ফিরে এলাম।’

 সুলতান মুশেল এসেই ইয়াজউদ্দিন মাসুদের কাছে অস্ত্র সমর্পণের প্রস্তাব পাঠালেন।ইয়াজউদ্দিন মাসুদ সংঘাতে না গিয়ে অস্ত্র সমর্পণের জন্য কয়েকদিন সময় প্রার্থনা করে। পরে বাগদাদের খলিফার পরামর্শ মতে শায়খুল উলামার মধ্যস্হতায় তাদের মধ্যে আপোষ মিমাংসা হয়।

 1182 সালের 15 ডিসেম্বর সুলতান আইয়ুবী মুশেল থেকে অবরোধ উঠিয়ে নাসিবা নামক স্হানে ক্যাম্প করেন। তিনি নাসিবাকে হেড কোয়ার্টার বানিয়ে পরবর্তী যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করে দেন।

‘বৈরুতের অবরোধ খৃস্টানরা ব্যর্থ করেনি, করেছে আমার বেঈমান ভাইয়েরা।’ সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের বললেন, ‘আমি শুধু রক্তক্ষয় থেকে বিরত থাকার জন্যই এই আপসরফা মেনে নিলাম।’

 বৈরুতের অবরোধ ব্যর্থ হওয় সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর দ্বিতীয় নিষ্ফল অভিযান হিসাবে বিবেচিত হয়। এ বর্থতায় তিনি কিছু হারানওনি, কিছু পনওনি। সে কারণেই তার এ অবিযানকে পরাজয় না বলে ঐতিহাসিকরা ব্যর্থতা বলেই চিহ্নিত করেছেন।

 অবশ্য কেউ কেউ এটাকে সুলতান আইয়ুবীর ব্যর্থতা না বলে তার গোয়েন্দা বিবাগের ব্যর্থতা বলেছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কেমন কথা যে, সুলতান বৈরুত অবরোধ করবেম এ কথা আগেই সেখানে পৌঁচে যায়?

 খৃস্টানদের কাছে এ সংবাদ নিশ্চয়ই কায়রো থেকেই পৌঁছেছিল। কিন্তু এটাতো ছিল এক গোপন সংবাদ।সুলতান আইয়ুবীর একান্ত বিশ্বস্ত এবং সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যাযের গুটিকয় সেনাপতি ছাড়া এখবর তো কেউ জানতো না।

 সুলতান আইয়ুবীর পরবর্তী লক্ষস্হল কোথায় এ কথা যারা জানতে পারে, তাহলে তাদের মধ্যেও গাদ্দার আছে? প্রশ্নটা সঙ্গত এবং এর উত্তরও হ্যাঁ-বাচক। তাহলে বলতেই হয় সেই গাদ্দার কে? কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব কার কাছেই ছল না।

 ‘আপনি একে পরাজয় বলবেন না।’ সুলতান আইয়ুবীর চিন্তিত চেহারার দিকে তাকিয়ে এক সেনাপতি বললো, ‘বৈরুত যেখানে ছিল সেখানেই আছে, আর সেখানেই থাকবে। আমরা আবারো সেই শহরে আক্রমণ চালাবো এবং দখল করে মেবো।’

 ‘এত বড় শিকার আমাদের হাত থেকে ছুটে গেল! ‘ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তো সেই শহর অবরোধ করে সেখানে ইসলামের ঝান্ডা উড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখতে পেলাম, আমি নিজেই ওদের অবরোধের মধ্যে পড়ে আছি। যুদ্ধের ছক এমনভাবে পাল্টে গেল যে, অবশেষে নিজেদেরকেই সেই অবরোধ থেকে বের করে আনতে হলো। এটা পরাজয় নয়তো আর কি? ‘

 ‘হ্যাঁ, এভাবে দেখল এটা আমাদের পরাজয়ই। তবে ওদের পেটের মধ্যে ঢুকে আমরা যে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, এটাও কম কথা নয়। ওরা চাইলে ামাদের আরো অনেক ক্ষতি করতে পারতো।’

 ‘এই শান্তনা নিয়েই বসে থাকো। কিন্তু কেন এ ব্যর্থতা বরণ করতে হলো সেটা স্মরণ করলে তোমার চোখের ঘুম হারাম হয় যাওয়ার কথ। দুশমন আমার চাল ব্যর্থ কর েদিয়েছে, এটাকে ামি কখনোই পরাজয় মনে করি না। একবার সে আমার চাল ব্যর্থ করেছে, আমি দশবার তার চাল ব্যর্থ করে দিয়ে এর প্রতিশোধ নিতে পারি। কিন্তু দুশমন তো আমাকে আগাত করার সময়ই পায়নি, তার আগেই তো আমি কুপোকাত হয়ে বসে আছি।’

 তিনি বললেন, ‘আমার ঘরে যে অদৃশ্য সাপ গুরে বেডাচ্ছে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিনা, এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে ? তুমি বলো, আমি বৈরুতে অভিযান চালাতে চাই এ খবর কয়জন জানতো?

 আমি যাদেরকে নিজের চাইতেও বেশী বিশ্বাস করি তারা ছাড়া কোন কাক পক্ষীও তো এ খবর জানতো না। আমি যদি তোমাদের বিশ্বাসই করতে না পারি তবে তোমাদের নিয়ে কোন সাহসে অভিযানে বের হবো? ‘

 পৃথিবীর সবচে তিক্ততম সত্য কথাটিই বেরিয়ে এসেছিল সুলতানের কন্ঠ থেকে। এর কোন জবাব দেয়ার ভাষা ছিল না কারো কাছে। সত্যি তো! সুলতান এখন কাকে নিয়ে পরামর্শ করবেন ? কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে কারো না কারো কাছে তো তা প্রকাশ করতেই হবে।কে সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি, যার কাছে গোপন পরিকল্পনা বলে সুলতান স্বস্হির নিঃশ্বাস ফেলবেন ?

 সুলতান আইয়ুবীপ তাবুর মধ্যে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। নাসিবা নামক স্হানে সেনা ক্যাম্পে বসে ছিলেন তিনি। এখানে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অবস্হান করছেন।

এখানে এভাবে অবস্হান করার নানা কারণ নানা জনে বলে। কেউ বলে, তাঁর সেনাদল বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক সৈন্য আহতও ছল। এই সৈন্যবাহিনা দুর্বার গতিতে পথের সব বাধা বিঘ ন অতিক্রম করে কায়রো থকে বৈরুত পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিল।

 এক মাসের পথ তারা কয়ক দিনে অতিক্রম করেছে।পথের বিশাল দূরত্ব অল্প সময়ে অতিক্রম করে এসেই তারা দুশমনের অবরোধে আটকা পড়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি খৃস্টানদের সেই অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে গিয় তাদের রক্তাক্ত সংগ্রাম করতে হয়েছে।

 অবশেষে অনেক কষ্টে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে নিরাপদ স্হানে ফিরতে হয়ছে তাদের।সুলতান আইয়ুবী এই সব সৈন্যদের পূর্ণ বিশ্রাম দেয়ার জন্যই নাসিবা নামক স্হানে ক্যাম্প করে সৈন্যদের বিশ্রামের ব্যবস্হা করেন।

 কিন্তু এই বিশ্রাম ও ক্লান্তি শুধু সৈন্যদের জন্যই ছিল। সুলতান আইয়ুবীর জন্য ছিল সীমাহীন দুশ্চিন্তা আর নিদ্রাহীন রাত।তিনি নকট বন্ধুদের মধ্যে শত্রু খুঁজতে খুঁজত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। নিরাশার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল তার আশার প্রতিটি স্ফুলিঙ্গ।

 দিনের বেলা তিনি অশান্তভাবে তাবুর মধ্যে পায়চারী করতেন।সেনাপতিরা সেই তাবুর মধ্যে এসে সুলতানের চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কোন কথা বলার সাহস পেত না। তারা দীর্ঘক্ষণ তাবুর মধ্যে বসে থেকে আবার চলে যেতো।

তিনি বিশ্বস্ত সেনাপতিদের সাথে কথ বলতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। একদিন তিনি এমনি অশান্ত চিত্তে তাবুর মধ্যে পায়চারী করছিলেন।এক সেনাপতি তাবুর মধ্যে ঢুকে সাহস করে তাকে শান্তনা দিতে গেলো। বললো, ‘মুহতারাম, একে আপনি পরাজয় মনে করবেন না।’

 সুলতান আইয়ুবী এ কথর কোন উত্তর দিলেন না, তিনি চুপ করে রইলেন।সেনাপতি আর কোন কথা না পেয়ে নিরব হয়ে গেল।

 সুলতান আপন মনে তাবুতে পায়চারী করতে লাগলেন। এ সময় আরো একজন সেনাপতি সেখানে এলো। অনেক্ষণ পর্যন্ত দুই সেনাপতিই চুপ করে তাকিয়ে রইলো সুলতানের দিকে। আইয়ুবীর চেহারায় রাগ বা ক্ষোভ নেই, আছে শুধু দুশ্চিন্তা। এই চিন্তা কি করে দূর করবে ওরা ?

 সহসা তাদের সামনে এসে থামলেন সুলতান। বললেন,তোমরা কিছু বলবে? ‘

 ‘আমর আপনাকে বলতে চাচ্ছি, এটা দুশ্চিন্তা করার সময় নয় সুলতান। আপনি এভাবে দুশ্চিন্ত করতে থাকলে আমর স্বপ্নহীন মানুষে পরিনত হয়ে যাবো।

 অথচ পৃথিবীর নির্যাতীত মানুষের জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আমাদের মাঝে একজন গাদ্দার থাকলে দশজন আছে মোজাহীদ। এইসব মোজাহিদরা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় বসে আছ। আপনি তাদের অনন্তকাল এভাবে নিশ্চল বসিয়ে রাখত পারেন না।’

 তারা সুলতান আইয়ুবীকে আরো বললো, ‘আপনাকে এখন নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই দুশ্চিন্তা আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। আমাদের আবেদন, আপনি আবার গা ঝাড়া দিন। আবার আমাদের ময়দানে নিয়ে চলুন। আমরা কেবল আপনাকে পারাজয়ের কষ্টই দেইনি, বিজয়ের আনন্দও তো দিয়েছি।’ আবেগ ভরা কন্ঠে বললো এক সেনাপতি। আমরা এর আগেও পরাজিত হয়েছি।রমলায় ামাদের যে বিপর্যায় ঘটেছিল সে সময়ও আপনাকে এতটা বিমর্ষ হতে দেখিনি।এবারের ব্যর্থতা রমলা পরাজয়ের চাইতে মারাত্মক তো নয় সুলতান ! রমলার পরাজয়কে যদি আমরা বিজয়ে রুপান্তরিত করতে পারি তবে এবারের ব্যর্থতাকেও আমরা সফলতায় রুপান্তরিত করতে পারবো। আপনি নিজের আবেগকে ঠান্ডা করুন। আবেগ মুক্ত হয়ে পরবর্তী পগক্ষেপ কি হবে নির্ধারণ করুন। আঁধার াতের পর নিশ্চয়ই সোনালী সূর্য উঠবে।’

 আমি চিন্তা করছি, কাফেরেরা তো আমাদের ডালপালা কেটে এবার মূল শিকড় কাটা ধরেছে। এ শিকড় কাটা হয়ে গেলে আমাদের জাতিসত্ত্বা বলে কিছু থকবে ি? আমাদের জাতির অস্তিত্ত্ব বলে কিছু থাকবে কি? ‘

‘মোহতারাম সুলতান ! আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহ নিজেই হেফাজত করবেন। আল্লাহর দ্বীন টিকে থাকলে এ জাতিও টিকে থাকবে। অনন্ত কালের দায়িত্ব আমাদের কাধে বর্তাবে না।আমরা শুধু আমাদের সময়ের জন্য দায়িত্বশীল। জয়-পরাজয়ও আমাদের হাতে নয়, ওটাও আল্লাহই নির্ধারণ করেন।

 ভবিষ্যতে আমাদের চাইতে যোগ্যতর কেও এ জাতির হাল ধরবে না, এমন কথা আমরা বলতে পারিনা। আমরা আমাদের যোগ্যতার যথাযথ ব্যবহার করলাম কিনা, পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন্ সচেষ্ট হলাম কিন্, হায়াতের যে সময় আমাদের আল্লাহ দিয়েছেন সেই সময়ের সঠিক ব্যবহার করলাম কিনা, কাল হাশরে আমাদের কাছে আল্লাহ শুধু তাই জানতে চাইবেন। যদি এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা হ্যাঁ বলতে পারি, তবে আমি মনে করি আমরা আমাদের জীবনকে সফল জীবন হিসাবে গণ্য করতে পারি।’

 ‘আর এ দায়িত্ব কাঁধ নিয়ে আমরা যে গাদ্দারী করি তাকে কি বলবে? যে গাদ্দারীর কারণে আমাদের মুখে কলঙ্কের কালি মাখতে হয় সেই পাপের শাস্তি কে ভোগ করবে? ‘

 ‘মোহতারাম সুলতান! শত কলঙ্কের পরও এখনো আমরা আমাদের মাটিেই দাঁড়িয় আছি। দুশমন আমাদের কব্জা করতে পারেনি , বরং আমরাই এখন আমাদের প্রথম কেবলা ফিলিস্তিন মুক্ত করার স্বপ্ন দেখছি। আমরা এখন খৃস্টানদের সাথে তাদের মাটিতে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করছি।’

 বার বার খৃস্টানরা আমাদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সশস্ত্র আঘাত হেনেছে, আমরা সেইসব আক্রমণের মোকাবেলা করেছি। এই অর্জন আমাদের নয় , আমাদের সততা, আন্তরিকতার ও বিশ্বস্ততার। আল্লাহ আমাদের অন্তর দেখেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের এই সব সফলতা দান করেছেন।আল্লাহর এই দয়ার শোকরিয় আদায় করার উপায় হলো তার কাজে আরো বেশী নিবেদিত হওয়া। দুশ্চিন্তা করে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারবো না।’

 ‘তুমি নির্ভুল ও সময়োচিত কথা বলেছো, এ জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তোমার কাছ থেকে আরো কিছু কথ শুনতে চাই। এ সব প্রশ্নের কিছু জবাব আমার কাছে আছে। তবু আমি তোমার জবাবের সাথে আমার জবাব মিলিয়ে দেখতে চাই।

 জাতির নেতৃত্ব এখন যাদের হাতে আল্লাহর কাছে তো তাদেরও জবাবদিহি করত হবে। মুসলিম মিল্লাতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো এখন তাদেরই কাঁধে। হলবের শাসক ইমামুদ্দিন এবং মুশেলের শাসক ইয়আজউদ্দীন এখন কোথায়? বিভিন্ন পরগণার শাসক ও আমিররা এখন কি করছে ?

 তারা তো আমাদের সামরিক জোটের অংশীদার, ইসলামের পথে লড়াই করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। তারা কি এখন এই প্রয়োজনের সময় আমাদের সৈন্য ও রসদ দিয়ে সাহায্য করবে? তাদের শিথিল মনোভাব প্রমাণ করছে, তারা এখনও কৃস্টানদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এখনও তাদের খেলার পুতুল যেজে কাজ করছে। তাহলে এখন আমরা কার সাথে লড়াই করবো ? জাতির এইসব গাদ্দারদের বিরুদ্ধে নাকি শত্রুর বিরুদ্ধে? ‘

 ‘আপন বারবার এদেরকে আমাদের ভাই আখ্যায়িত করে এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্ত তাদের কাজ প্রমাণ করছে, দুশমনের চাইতেও এরা মুসলিম জাতিসত্ত্বার অধিক অন্তরায়।

 আমি তাদের মোনাপিক বলতে চাইনা, কারণ ফতোয়াবাজি করা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু কোরআন ও হাদিসে মোনাফিকরা যেসব কাজ করবে বল হয়েছে, এরা এখন তাই করছে। আর হাদিসে আছে, মোনাফিকরা দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্হান করবে। এতে প্রমাণিত হয়, কাফেরের চাইতেও জাতির জন্য তারা অধিক ক্ষতিকর।আপনি যতই ওদের ক্ষমার চোখে দেখেন না কেন, সুযোগ পেলেই ওরা জাতির শিরায় আঘাত হানবেই।’

 সুলতান আইয়ুবী তাবুর মধ্যে পায়চারী করছিলেন। হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। উপরের দিকে মুখ করে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘হায়! আমার প্রিয় রাসুসের উম্মতের মধ্যে আজ একি অবক্ষয় ও অধপতন শুরু হয়ে গেছে !’

তিনি সেনাপতিদের দিকে ফিরে বললেন, ‘যখন বাতিল ধর্মের প্রভাব জাতি গ্রহন করে নেয় তখন তাদের পরিণাম এমনটিই হয়, যেমনটি তোমরা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছো।ইহুদি ও খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে গোলাম ও তাবেদার বানানোর জন্য মানব চরিত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক থেকে আঘাত করছে। এই দুর্বল দিকটার নাম হহলো লালসা।

 এই লালসার আছে বিচিত্র রুপ। স্রোতের টানে দুই পাড় ভেঙ্গে যেমন নালা কেবল বড় হয়, এই লালসার স্রোতও তেমনি। মানুষের আকাঙ্খা ও অতৃপ্তি কেবল তাতে বাড়তেই থাকে।

 মানুষের উপর আধিপত্য করার লালসা, শাসন ক্ষমতা লাভের লালসা, রাজা বা শাসক হওয়ার লালসা, রাজকুমার হওয়রর লালসা, সোমার পালংকে নরম গদিতে থাকার লালসা, লাল গালিচা বিছানো পথ দিয়ে চলার লালসা, এই লালসার কি শেষ আছে ?

 শাসকরা ভাবে , জনগন বালি, কংকর ও কাঁটার মধ্য দিয়ে খালি পায়ে পথ চলবে। তারা পর্ণকুটির ও খড়ের চালার নিচে বসবাস করবে। জীবন ধারনের জন্য নিম্মমানের খাদ্য খেয়ে খুশি থাকবে। কখনো কোন সমস্যায় পড়লে রাজার কাছে মাথা নত করে আবেদন জানাবে।

 প্রিয় বন্ধুরা আমার! যখন মানুষের মনে এমন প্রভূত্ব করার লালসা জেগে উঠে তখন তার অন্তর থেকে ঈমান, ভালবাসা, জাতীয়তাবোধ ও ধর্মবোধ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ক্ষমতা ও সম্পদ মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির উপর এমন কালো পর্দা টেনে দেয় যে, সেই পর্দা ছিন্ন করার কোন শক্তি আর তার মধ্যে থকে না।

 তখন তার মধ্যে ধর্মীয় ও জাতীয় স্বকীয়তা বোধ বলে কিছু থাকে না। এ সবই তখন অর্থহীন হয়ে যায়।

 মানুষের অন্তরে যখন লালসা চরম আকার ধারন করে তখন সে বিশ্বাসঘাতক, গাদ্দার ও প্রতারক সেজে গর্ব বোধ করে। যে যত বড় প্রতারক সমাজ তাকেই তত বড় বুদ্ধিমান গণ্য করে। অত্যাচারীকে মনে করে শক্তিমান।

 ইহুদি ও খৃস্টানরা আমাদের শাসক গোষ্ঠিকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, এখন আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধের কোন কদর নেই তাদের কাছে।

 এইসব শাসকদের কারণেই আজ মুসলিম সমাজ নির্লজ্জতা ও অসভ্যতায় ছেয়ে গেছে। সখন সমাজে সভ্যতা বলে কিছু থাকে না তখন ধর্ম একটি দুর্বল আবরণ মাত্র হয়ে যায়। যে আবরণ যে কোন সময় ছুঁড় ফেলে দেয়া সম্ভব। আবার প্রয়োজনে বা জাতিকে ধোঁকা দেয়ার জন্য যখন তখন তা গায়ে তুলে নেয়াও যায়।’

দুই সেনাপতিই অখন্ড মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর হৃদয় মথিত কথাগুসো।কথা বলতে বলতে তিনি এক সময় নিরব হয়ে গেলেন। সেনাপতিরা তখনো চুপ করে বসা। তাদের চোখগুলো ছেয়ে আছে নির্মম উদাসীনতায়।সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে পতনশীল এক সমাজের দ্রুত পতনের ভয়ার্ত মুহূর্তের শংকিত চিত্র।

দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন সুলতান।বললেন, ‘তোমরা কি মনে করো না, এটাও আমাদেরই ব্যর্থতা? আমরা জনগনকে সজাগ রাখতে পারিনি, শাসকদের ফেরাতে পারিনি অন্ধকারের অরণ্য থেকে? এটাও কি আমাদের পরাজয় নয়, যখন মুজাহিদ বেশে আমাদের রনাঙ্গনে থাকার কথা তখন আমরা নারীর মত তাবুর পর্দার ভেতর দাঁড়িয়ে কথা বলছি ? এখ তো আমাদের বায়তুল মুকাদ্দাসে থাকার কথা ছিল। মসজিদুল আকসায় লুটিয়ে পড়ে অধীর হয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করার কথা ছিল।’ চুপ করলেন সুলতান।

এক সেনাপতি বললো, ‘আমরাও সেই কথাই বলছি সুলতান। আমাদের যে সাথীরা আপন রক্ত দিয়ে ফিলিস্তিনের পথ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছ সেই সব শহীদদের রক্তের প্রতিদান দিতে হবে আমাদের। যারা ফিলিস্তিনের সম্মান ও স্বাধীনতার জন্য জীবন কোরবান করেছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এনে তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে।’

সুলতান আইয়ুবীর চেহারা বেদনায় মলিন হয় গেল। তিনি পায়চারী করতে করতে সেনাপতিদের সামনে এসে দাঁড়িয় বললেন, ‘আমার অস্িরতা দেখে তোমরা পেরেশান হচ্ছো। কিন্তু অস্হির না হয় আমার উপায় কি বলো ? আমি সেই এতিম শিশুদের সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো, যারা আমার আদেশ পালন করত গিয়ে ওদের পিতৃহীন করেছে?

সেই বিধবাদের আমি কি বলবো, যাদের স্বামীরা আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে আমার সঙ্গে জিহাদে এসেছিল আর তাদের রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে অশ্বপদ তলে পিষে মাংসের পিন্ড হয়ে গেছে? সেই সব সুদর্শন যুবক, যারা কমান্ডো বাহিনীতে শামিল হয়ে শহীদ হয়ে গেছে তাদের আমি কেমন করে ভুলবো ?

তার নিজের দেশ ও জাতি থেকে বহু দূরে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে একাকী লড়াই করেছে, গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে দরা পড়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রনা সহ্য করতে করতে শহীদ হয়ে গেছে, আমি তাদের মায়দের সামনে যেতে ভয় পাই।

 আমি এজন্য ভয় পাই যে, যদি সেই মা আমাকে বলে, আমার বেটাকে ফেরত দাও নইলে যেই মসজিদুল আকসা উদ্ধার করবে বল আমার বেটাকে জেহাদে শরীর হতে বলেছিলে সেই মসজিদে আমাকে নিয়ে চলো। আমি সেই মসজিদ লুটিয়ে পড়ে আমার সন্তানের াত্মার মাগফেরত কামনা করবো, আমি সেই মাকে কি উত্তর দিব?

‘শহীদদের রক্তের দান কোন দিন বৃথা যায় না মুহতারাম সুলতান! কমান্ডো বাহিমীর প্রধান সালেম মিশরী তাবুতে ঢুকে আইয়ুবীর বক্তব্য শুনে বললো, ‘কোন শহীদের মা তার সন্তানের রক্তের হিসাব আপনার কাছে চাইতে আসবে না। যে মায়ের তাদের বুকে আল্লাহর কালাম ও রাসুলের বণী ধারণ করেছে সেই মায়েদের দুধ আব জমজমের মতই পদত্র ও বিশুদ্ধ।

সেই দুধে পালিত সন্তান আপনার আদেশে নয় আল্লাহর হুকুমে যুদ্ধ করেছে। আপনি তাদের রক্তের প্রতিদানের দায়িত্ব নিজে নিত যান কেন? আমরা অবশ্যই তাদের সমবেদনা ও সহানুভূতি জানাবো, কিন্তু সেই রক্তের জন্য কখনো আফসোস করবো না।

আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে তারা এখন আল্লাহর মেহমান হয়ে গেছে। আপনি বরং সেইসব বেঈমান ও গাদ্দারদের কথা বলুন, যাদের গাদ্দারীর কারণে তাদের রক্তের ফসল আমর ঘরে তুলতে পারিনি। আমাদের তলোয়ার এই সব বিশ্বাসঘাতকদের রক্তের পিপাসায় কাতরাচ্ছে। আপনি আমাদের তলোয়ারের পিপাসা নিবারণের ব্যবস্হা করুন।’

‘তুমি আমার চেতনার প্রাণ সঞ্চার করেছো সালেম।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমার এই দুই বন্ধুও আমাকে ঠিক তাই বলেছে। তারাও আমাক বলেছে, আমাদের নিরাশ ও উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই।’

সালেম মিশরী বললেন, ‘তারা টিক কথাই বলেছেন। পরাজয় কোন চিরস্হায়ী জিনিস নয়। আমরা পরাজয়কে বিজয়ে রুপান্তরিত করতে পারি। অতীতেও আমরা এর প্রমাণ দিয়েছি, ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ আমরা পরাজয়কে বিজয়ে পরিনত করে দেখাবো।’

‘যদি এ আলোচনা যুদ্ধের ময়দানের হতো তবে আমার একটি বাহু ছিন্ন হলেও তোমরা আমার মুখে হাসি দেখতে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘ আমার অস্হিরতার কারণ, শত্রু এখন আমার ঘরের মধ্যে বসবাস করছে। ইহুদি ও খৃস্টানরা আমাদের জাতির মধ্যে এমন বিষ ঢুকিয় দিয়েছে, যে বিষের প্রভাব খুবই আকর্ষণীয় ও জাদুময়। এ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা বড়ই কঠিন।

জাতির সৈনিকদের ব্যাপারে আমার ভরসা আছে। সৈনিক ও জনতা এসব কুপ্রভাব থেকে এখনো মুক্ত। সমস্যা হচ্ছে জাতির শাসক, আমীর ও প্রভাবশালী লোকদের নিয়ে। এ কুপ্রভাব তারাই গ্রহণ করে নিচ্ছে। তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছ জাতির ওপর।

শাসক, আমীর ও প্রশাসনের উচ্চস্তরের লোকেরা আরো উর্ধে উঠার জন্য ন্যায়নীতি িসর্জন দিচ্ছে। গাদ্দারীর খাতায়ও তারাই নাম লেখাচ্ছে। সবচে আফসোসের বিষয় হচ্ছে, কতিপয় ধর্মীয় নেতাও শামিল হয়েছে এই ষড়যন্ত্রকারীদের দলে।’

‘হ্যাঁ সুলতান , এই ধর্মীয় নেতারাই এখন ইসলামের সবচে বড় দুশমনে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর কালামকে অল্প মূল্যে বিক্রি করতে নিষেধ করেছে কোরআন। অথচ তারা তাই করছে। কোরআনকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্হাপন না করে তাকে আংশিকভাবে এবং বিকৃতভাবে উপস্হাপন করছে।

আপনার ওপর তারা অসন্তুষ্ট এ কারণে যে, আপনি তাদের রুটি রুজির ওপর হাত দিয়েছেন। কোনরতম কাজকর্ম না করেও এতদিন তাদের সংসার ভালই চলছিল। জনগণ ভক্তিভরে তাদের নজর নিয়াজ দিচ্ছিল। প্রথমে তারা জনগণকে কিছু দোয়া কালাম শিখিয়ে দিচ্ছিল, যাতে তারা পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারে। জনগনও সহজে বেহেশত পাওয়ার পথ পেয়ে তাদের ওপর সন্তুষ্ট ছিল।

কিন্তু আপনি জাতির যুবকদের মনে নতুন চিন্তা ঢুকিয়ে দিলেন। তাদের শোনালেন জেহাদের মন্ত্র। বললেন, কোরআন পড়তে, হাদিস পড়তে এবং দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে জানতে ও গ্রহণ করতে। নতুন জোশ, নতুন আশা ও উদ্দিপনায় উজ্জীবিত হয়ে যুবকরা দলে দলে জেহাদের ঝান্ডা তলে শামিল হলো। ইসলাম যে পরিপূর্ণ জীবন বিধান তারা তা বুঝতে পারলো। জীবনের প্রতিটি কাজ ইসলামের আলোকে সাজিয়ে নেয়ার জন্য জনগণ যখন উদ্যোগী হলো তখন প্রমাদ গুনলেন ধর্মব্যাবসায়ীরা।’

 তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অপর সেনাপতি বললো, ‘এখন তারাও জেহাদের কথা বলে। জনগণকে জেহাদের মর্ম বুঝাতে গিয়ে বলে, জিহাদ ফরজ। কিন্তু এই ফরজ আদায় করতে হলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।

এখন আমাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময়। জিহাদ করতে হলে আমাদের অস্ত্র কিনতে হবে। অস্ত্র কিনতে অর্থের দরকার। অতএব স্ববলম্বী হওয়ার সংগ্রামই এখন আমাদের মূল সংগ্রাম। নজর নিয়াজের পরিবর্তে এভাবেই তারা এখন সম্পদ সংগ্রহ করছে এবং এভাবেই নিজেদের নেতৃত্ব টিকিয় রাখছে।’

‘শুধি তাই নয়।’ বললো অন্য সেনাপতি, ‘এরা গোপনে শত্রির সাথে আঁতাত করে আপনার অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার নামা রকম বুদ্ধি নিচ্ছে। দুশমনও তাদের সাহায্য করতে খুবই আগ্রহী। কারণ দুশমনের পক্ষে যা সম্ভব নয় সেই অসাধ্য তারা সফলতার সাথেই তারা সাধন করছে। গোপনে তাদের সহযোগীতা করছে বিভিন্ন মুসলিম শাসকরাও। কারণ এইসব শাসকরা মনে করছে, তাদের গদি কেবল এইসব আলেমরাই নিরাপদ রাখতে পারে।’

‘শুধি তাই নয়।’ কথা বললো সেনাপতি সালেম মিশরী, ‘বেঈমীন ও গাদ্দাররা সাধারণ লোকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মের ধোঁকা দিয়ে তাদের মধ্যে উম্মাদনা সৃস্টি করছে। মুসলমানদেরকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে উত্তেজিত সংঘাত জিইয় রেখে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে।

ইহুদি ও খৃস্টানরা এইসব আলেমদের বলছে, ‘তোমরা জনগণকে অন্ধের হাতি দেখার মত ইসলাম দেখাবে। কেউ হাতির কান দেখ বলবে, হাতি হচ্ছে কুলার মত, কেউ লেজ দেখে বলবে ঝাড়ুর মত, কেউ পা দেখ বলবে থামের মত। হাতিই দেখাবে তাদের কিন্তু হাতির আসল অবযব যেন তারা কিছুতেই জানতে না পারে।

তোমরা কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই তাদের পথ দেখাবে , কিন্তু ইসলামের প্রাণসত্ত্বার সাথে যেন তাদের কখনো দেখা না হয়। শুধু মুসলমান নয়, মানবতা এবং বিশ্বসভ্যতা রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার ইসলাম, এ কথা যেন মুসলমানরা জানতে না পারে।

তারা যদ জেনে যায়, এ বিশ্ব সংসার আল্লাহর। আল্লাহর বান্দা হিসাবে এ বিশ্ব সংসার দেখার দায়িত্ব মুসলমানদের, তাহলে তাদের মধ্যে যে উদারতা এবং ভালাসা জন্মাবে সেই ভালবাসা দিয়ে তারা সারা বিশ্ব জয় কর নেবে। তখন তোমার বা আমার স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহার করার আর কোন উপায় থাকবে না।’

‘কিন্তু আমরা সবজান্তা নয়।’ এক সেনাপতি তার বক্তব্যের মধ্যে বাধা দিয় বললো, ‘আমর মসজিদের খতিবও নই, ইমামও নই। অস্ত্র ত্যাগ করে জনগনকে ওয়াজ নসিহত করে সৎপথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের নয়।

আপনার কথাগুলো সত্য, কিন্তু দুনিয়ার সব কাজের দায়িত্ব আমরা কাঁধে নিতে পারি না। যে সকল সমস্যা তলোয়ার দিয়ে সমাধান করা যায়, আমাদের দায়িত্ব তার সমাধান করা। অন্যায় যেখানেই হবে এবং যেই করবে আমাদের তলোয়ার সেখানেই ঝলসে উঠতে দ্বিধা করবে না।

মুসলমনারা আজ খৃস্টানদের হাতে নির্যাতীত হচ্ছে, তাই খৃস্টানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছি আমরা। ইহুদীরা আঘাত করছে মুসলমানদের ওপর তাই আমরা ওদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। তেমনি যদি কোন অমুসলমান অঞ্চলে আজ নির্যাতন চলে, তাদের হেফাজত করার জিম্মাও আমাদেরই কাঁধে তুলে নিতে হবে।’

‘তুমি ঠিকই বলেছো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন,’ কোন ব্যক্তি বা ধর্মের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ নয়, আমাদের লড়াই সততা ও নীতির পক্ষে। অন্যায়ের পাথর পিন্ডকে অশ্বখুরের আঘাতে গুঁড়ো করে দিয়ে সরল রাস্তা বানানোই আমাদের কাজ।

তোমাদের দু’জনের চেতনাই কোন পার্থক্য নেই। সালেম মিশরী যাদের কথ বলেছে এ সব লোকেরা কুরআনের বিরোধী।’

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কুরআন স্পষ্ট বলে দিয়েছে, বিধর্মী কাফেরদের তোমর বন্ধু বানিও না। তাদের কথা ও পরাপর্শ গ্রহন করো না। তেমরা জানো না, তাদের মন সর্বদা আমাদের মন্দ ও ক্ষতির চিন্তায় থাকে।’

‘এর শুধু নামে মুসলমান।’ সালেম মিশরী বললো, ‘কুরআন ও সুন্নার সাথ তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এই অবস্হা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কারণ এর এক হাতে কুরআন ধরে রেখেছে অপরদিকে কাফেরদের ইশারায় নাচতে শুরু করেছে।

জাতি সর্বদা এমন নেতা ও ণাসকদের হাতে মার খেয়ে আসছে। কারণ এদের হাতে রয়েছে কোরআন আর অন্তরে রয়েছে ক্রুশ। জাতি তাদের আসল রুপ দেখতে পায় না, তাদের অন্তরের ধ্বনিও শুনতে পায় না। এমন অবস্হার মধ্যে পডেই আমরা বারবার গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হচ্ছি আর একে অপরের রক্ত প্রবাহ করছি। পরবর্তী গৃহযুদ্ধের তলোয়ারও আমাদের ঘাড়ের উপর ঝুলছে।’

‘এই তুফানকে আমাদরর অবশ্যই বাধা দিতে হবে।’ এক সেনাপতি বললো, ‘এ জন্য আমি বলতে চাই, এখন আর কোন আপোষ চুক্তির অবকাশ নেই। এখন গাদ্দারদের খুঁজে বের করতে হবে। জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের মারতে এবং মরতেও প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের।’

এ কথায় সুলতান আইয়ুবীর চেহারা আবার উদাস হয়ে গেল। শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে জমা হচ্ছিল অপরিসীম বেদনা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, কষ্টে তরর বুক ফেটে যাচ্ছে।

তাবুতে অখন্ড নিরবতা বিরাজ করছিল।তিন সেনাপতিই অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল সুলতানের দিকে। তারা সুলতান আইয়ুবীকে চিনতো। জানতো, গৃহযুদ্ধের কথা শুনলেই তিনি উদাস হয়ে যান। তাই তারা চুপ করে রইলো।

‘হে আমার প্রিয় বন্ধুরা! ‘ সুলতান আইয়ুবী বেদনামাখা স্বরে বললেন, ‘আমার চোখে ভাসছে আমাদের প্রিয় নেতা রাসুলে মকবুলের উম্মতের রক্তাক্ত চেহারা। ভবিষ্যতের দিক তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি, রক্তের নদীতে ভাসছে মুসলমানরা। তারা নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ করে নিজেরাই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আর এই াপোসের গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রাখছে িহুদী ও খৃস্টানরা। এ জন্য আজ একে উস্কে দিচ্ছে, তো কাল তাকে। প্রয়োজনে দু’পক্ষকেই সাহায্য ও সহযোগীতা দিতে ওরা প্রস্তুত।

শাসন ক্ষমতা লাভের লোভ দেখিয়ে ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। সেই রক্তে লালে লাল হচ্ছে ফিলিস্তিনের মাটি। আমি দেখতে পাচ্ছি, মুসলিম রাজ্যগুলো খন্ড বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত রাজ্যের শাসকরা সবাই রাজা বাদশাহ বনে যাচ্ছে। তারা বিলাসিতা ও আরাম আয়েসের জীবন বেছে নিয়েছে।

এ অবস্হায় আমি জানি, আমাদের প্রথম কেবলা রাসুলের প্রিয় উম্মতকে ডাকতে থাকবে, কিন্তু সে আহবানে সাড়া দেয়ার প্রয়োজন মনে করবে না কোন মুসলমান। তারা সে ডাক কানেও তুলবে না।

যদি কোন লোক ফিলিস্তিন মুক্ত করার সংকল্প করে তবে তাকে আমাদের মত উন্মাদ হতে হবে। জাতির কিছু লোক যদি স্বাধীনতার জন্য পাগলপারা হতে না পারে তবে সে জাতি কোনদিনই স্বাধীনতার স্বাদ পাবে না।’

‘কিন্তু আজাদী পাগল এই সব মুসলমানদের মুসলিম শাসকরাই ধোঁকা ও প্রতারণায় ফেলে ঠান্ডা কর দেবে। তারা প্রকাশ্যে মিল্লাতের রক্ষাকর্তা সাজবে আর গোপনে বন্ধু হবে ওদের।’

সুলতান আইয়ুবী বললেন, তোমরা বলছো, আমরা এই তুফানকে থামিয়ে দিতে পারবো। আল্লাহ চাইলে হয়তো আমরা সত্যি এ তুফান থামিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু আমাদের মরার পর এই তুফান আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।’

‘পুনরায় আর এক সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম হবে।’ সেনাপতি সালেম মিশরী বললেন, ‘আরও এক নুরুদ্দিন জঙ্গীর জন্ম হবে। মুসলম মায়েরা এমন বীর মুজাহিদ সেনাদের জন্ম দিতেই থাকবে। নিশ্চয়ই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ তার দ্বীনকে হেফাজত করবেন।’

‘আমিও জানি, নিশ্চয়ই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ তার দ্বীনকে হেফাজত করবেন। তবে এই মুজাহিদদের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে বিলাস ও আরাম প্রিয় শাসক।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এমন সময়ও আসবে, সেনাবাহিনীও অলস ও ারাম প্রিয় হয়ে উঠবে। আর তাদের সেনাপতিরা কাফেরদের হাতের খেলার পুতুল হয়ে যাবে।’

সুলতান আইয়ুবী এ কথা বলেই আবার নিরব হয়ে গেলেন। তার চেখ বলছিল, তিনি ভবিষ্যতের সেই অনাগত দুর্যোগময় দিনগুলো যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন।

সালেম মিশরী বললেন, ‘কিন্তু সুলতান, আমরা এমন কথ আর কতকাল বলতে থাকবো ? আমরা চারজন এই তাবুর মধ্যে বসে যতই আলাপ করি না কেন, তাতে সমস্যার কোন সমাধান হবে না।’

‘আল্লাহর সৈনিকদেরকে কথা নয় কাজে পারঙ্গম হতে হবে।’ এক সেনপপতি বললো, ‘সুলতান, ময়দান আমাদের ডাকছে। আমাদের কাজ দিন, আবার আমাদের ময়দানে নিয়ে চলুন।’

সুলতান আইয়ুবী সেই সেনাপতির দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন সালেম মিশরীর দিকে। বললেন, ‘বন্ধু সালেম! তুমি আমার নির্দেশিত স্হানগুলোতে কমান্ডো বাহিনী ছড়িয়ে রেখেছো। তুমি জানো, আমার এই ক্যাম্প কেমন বিপদ ও আশংকাজনক স্থানে আছে।’

‘হ্যাঁ, ভাল করেই জানি সুলতানে মুহতারাম! ‘ সেমাপতি সালেম মিশরী বললেন, ‘আমরা বৈরুতের অবরোধ উঠিয়ে এই দিকে এসেছিলাম। আমাদের আশংকা মতো খৃস্টানরা আমাদের পিছু ধাওয়া করেনি। কিনততু এতে এই খুশিতে বিভোর হওয়া উচিত নয় যে, খৃস্টানরা আমাদের ক্ষমা রে দিয়েছে।

আমি দৃঢ়তার সাথ বলতে পারি, তারা আর আগের মত আমাদের ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ চালাতে আসবে না। এখন থেকে তারাও আমাদের মত অন্ধকারে কমান্ডো আক্রমণ চালাবে। তাদের সেই কমান্ডো আক্রমণ ও অতর্কিত হামলার পর্যায় শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ক্যম্প থেকে বহু দূরে খৃস্টান সৈন্যরা আমাদের প্রহরীদের উপরে ছোট খাটো হামলা করা শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যেই এমন কিছু হামলার সংবাদ আমাদের কানে এসেছে।

আমি আমার কমান্ডো দলগুলোকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছি। আমি খবর পেয়েছি, কাফেরদের তৎপরতা এখন মুশেলেই অধিক লক্ষ করা যাচ্ছে। মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন তাদেরকে আশ্রয় ও সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে।’

‘যদি এ খবর সত্যি হয় তবে এর ব্যবস্থা আমি করবো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যদি মুশেলেই খৃস্টানরা গোপন আড্ডা বানিয়ে থাকে তবে তার ব্যবস্থা করতে আমাদের বেশী বেগ পেতে হবে না।’

তিনি সেনাপতিদের উদ্দেশ্য কর বললেন, ‘তোমাদের সাথে আমি একমত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখন আমাকে সেই সিদ্ধান্তই গ্রহন করতে হবে, যা আমার জন্য কষ্ট ও যাতনার কারণ। আমাদেরকে এখন সেই দূর্গগুলো আগে দখল করতে হবে, যেগুলো মুশেল ও হলবের মধ্যে রয়েছে।

আমি এই দুই শহরকে পরষ্পর বিছিন্ন করে দিতে চাই, যাতে পরে তারা আর একে অন্যকে সাহায্য করার সুযোগ ন পায়। তাদের কাসেদ চলাচলের পথও বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে তারা সংবাদ আদান প্রদান করতে না পারে।’

সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় খেল করছিল সেনাপতিসুলভ দৃঢ়তা। একটু আগের বিষন্নতার জায়গাটুকু দখল করে নিয়েছিল ইস্পাতকঠিন সংকল্প।

তিনি উপস্থিত সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি, আমার তলোয়ার যেন কোন মুসলমান নামধারীর বিরুদ্ধে কোষমুক্ত না হয়। কিন্তু এখন আমি নিরুপায়। আমি আমার ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিতে বাধ্য হচ্ছি। আমি সেই সব আমির ও শাসকদের শেষ দেখে ছাড়বো, যারা খৃস্টান কাফেরদের বন্ধু। আমি নিজে কখনো জাতির জন্য বোঝ হবো না, বোঝা হয়ে কাউকে জাতির ঘাড়ে চেপে থাকতেও দেবো না। যারা জাতিকে বিভ্রান্ত ও বিপদগামী করছে তাদের সে খেলা আমি বন্ধ করে দেবো।’

সুলতান আইয়ুবী তাঁর নতুন প্ল্যান সেনাপতিদের সামনে ব্যাখ্যা করা শুরু করলেন।

বৈরুতে সম্রাট বিলডনের মহল। কয়েকজন খৃস্টান ছাড়াও দাওয়াত পেয়েছেন সেনাবাহিনীর অফিসার, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নাইট, বিভিন্ন বাহিনী প্রধান ও সেনাপতিরা। সুলতান আইয়ুবীর নিষ্ফ আক্রমণের ব্যর্থতাকে সেলিব্রেট করার জন্যই এ বিরাট আয়োজন।

রাজকীয় এ ভোজসভায় নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন অসংখ্য মেহমান। তাদের প্রায় সকলেই সমাজের নেতৃস্থানীয় খৃস্টান। এই অসংখ্য মেহমানের মধ্যে দেখা গেল দু’জন মুসলমানও আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তারা কেবল আমন্ত্রণই পাননি, যথাসময়ে অনুষ্ঠানে হাজিরও হয়েছেন।

উর্বশী মেয়েরা ঘুরেঘুরে মদ পরিবেশন করছিল। মেয়েদের পরনে চুমকি বসানো হালকা রেশমী কাপড়। ফিনফিনে কাপড়ের ভেতর থেকে উপচে পড়ছিল রুপের জৌলুস। মেহমানরা মদের পিয়ালা হাতে করে ঘুরে ঘুরে পরষ্পরের সাথে কুশল বিনিময় করছিল। যতই মদের পরিবেশন বেড়ে চলছিল ম ততই মেহমানদের হাতগুলো জড়িয়ে ধরছিল মেয়েদেরকে। মেয়েরাও ক্রমশ নির্লজ্জ হয়ে উঠছিল।

মুসলমান মেহমান দুজনও খৃস্টানদের চাইতে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। তারাও সমানে মদ পান করছিল। দুটো মেয়ে তাদের ক্রমাগত তাদের মদ ঢেলে দিচ্ছে মনে হচ্ছে, মুসলমান মেহমানদের আদর আপ্যায়নের দিকে বিশেষ নজর রাখার জন্য তাদের ওপর হুকুম রয়েছে। মেয়ে দুজন বিলোল কটাক্ষ হেনে তাদের পাশে ঘুর ঘুর করছিল। যেন তারা এই দুই মেহমানকে মদ পান করাতে বিশেষ মজা পাচ্ছে।

ওরা এই মেহমান দু’জনের সাথে হাসি ঠাট্টা ও রং তামাশা করছে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ওদের গায়ের ওপর, এ সময় এক খৃস্টান এসে ওদের দু’জনকে বললো, ‘সম্রাট বিলডন আপনাদেরকে তাঁর খাস কামরায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’

এই দুই মুসলমান অতিথির পোষাক-পরিচ্ছদ ও চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল এরা কোন শাহী খান্দানের লোক।

মেয়েরা সরে দাঁড়ালো। এই দুই অতিথি সেই খৃস্টানদের সাথে এগিয়ে গেল সম্রাট বিলডনের খাস কামরার দিকে। ওরা সম্রাট বিলডনের কামরায় প্রবেশ করলো। কামরার বাইরে দুই সিপাই বর্শা হাতে পায়চারী করছে। তাদের পোষাক সাধারণ সৈনিকদের মতো নয়। আরো কেতাদুরস্ত ও জমকালো। তাদের কোমরে শোভা পাচ্ছে শাহী তলোয়ার। তলোয়ারের খাপ বিশষভাবে পালিশ করা, তাই সে খাপ চমকাচ্ছে। একই রকম চমকাচ্ছে তাদের মাথার শিরস্ত্রাণ।

এই মহলেরই এক রক্ষী, যার দায়িত্ব ছিল মেহমানদের দেখাশোনা করা, বহিরাগত আগন্তুকদের প্রতি নজর রাখা এবং গোপন দেয়ালের অভ্যন্তরে যেসব মেয়েরা আছে তাদের গতিবিধি লক্ষ রাখা, মেহমানদের পিছু পিছু সেও বিলডনের কামরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।

ঝাড়বাতির আলোকে তার পোষাকও চমকাচ্ছিল। সে সাধারণ সিপাই ছিল না, বরং সে ছিল এক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যোদ্ধা, যার দায়িত্ব ছিল মাহফিলে আগত সকলের নিরাপত্তা বিধন করা।

সে দুজন মুসলমানকে সম্রাট বিলডনের কামরায় নিয়ে যেতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সেখানে। তার গায়ের রং ছিল ফর্সা, বলিষ্ঠ দেহের গড়ন, চেহারায় বুদ্ধির শানিত ছাপ।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দুই অতিথিকে সম্রাট বিলডনের কামরায় প্রবেশ করতে দেখলো। মেহমানরা কামরায় প্রবেশ করতেই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সম্রাটের দুই রক্ষীর একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘হ্যালো জ্যাকোব, এদিকে ঘুরছো কেন? ওদিকে যাও, পরীর নাচ দেখো গিয়ে। যে রসের কপাল নিয়ে জন্মেছো, তাকে সার্থক করে তোল। আমাদের কপাল মন্দ, কখনো এক পাও এদিক ওদিক হতে পারি না।’

জ্যাকব তাদের কৌতুকের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘এই যে দু’জন ভেতরে গেল, এদেরকে তো মুসলমান মনে হয়! এরা কারা? ‘

‘এদের ব্যাপারে এত আগ্রহ দেখরর কি আছে? এর তো আর তোমার নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে যাচ্ছে না! সম্রাট যখন নিজেই তাদের ডেকে এনেছেন, তাদেরকে নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে।’

‘কি বলছো তোমরা! এদের সম্পর্কে আগ্রহ থাকবে না তো কার সম্পর্কে থাকবে? ‘ জ্যাকব বললো, ‘তোমরা কি জানো না, মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমাদের মনে কি প্রচন্ড ঘৃণা কাজ করছে? সমগ্র খৃস্টান সমাজ পারলে তেতো ঔষধর মতোই ওদের গিলে ফেলতো। এর তো অচিরেই কোন ইহুদী বা খৃস্টানের হাতে খুন হয়ে যাবে! এদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, অথচ আমাকে এখনো জানানো হয়নি, এরা সত্যি মুসলমান, নাকি আমাদেরই কোন ভাই মুসলিম এলাকায় থাকে বলে এই ছদ্মবেশ ধারণ করেছে! ‘

‘এরা মুসলমান এবং মুসলিম এলাকাতেই থাকে।’ এক প্রহরী বললো, ‘নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও যতদূর জানি, এরা মুশেল থেকে এসেছে এবং সম্ভবত ইয়াজউদ্দিন মাসুদের দূত।’

‘সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সাহায্য নিতে এসেছে? ‘ জ্যাকব বললো, ‘এই দূতদের বলে দাও, সালাউদ্দিন আইয়ুবী শেষ হয়ে গেছে। রমলার রণক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিল। আবার এসেছিল বৈরুত অবরোধ করতে। কিন্তু আমাদের দেখেই তার আত্মার পানি শুকিয়ে যায়, সাগরের পানিও তার সেই ভয়ের পিপাসা মিটাতে পারেনি। তার সামুদ্রিক নৌবহর কূলে ভেড়ার সাহস পায়নি। সামরিক বাহিনী আঘাত করা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে থাকারও হিম্মত রাখেনি।’

জ্যাকব তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, ‘আমার সব সময়ই এই আফসোস থেকে যাবে, তাঁর পরাজিত সৈন্যদেরকে আমাদের সৈন্যরা কেন পিছু তাড়া করলো না। নইলে আজ সালাউদ্দিন আইয়ুবী আমাদের হাতে বন্দী অবস্থায় থাকতো।’

‘তুমি তোমার কাজ করো বন্ধু! ‘ বিলডনের প্রহরী বিরক্ত হয়ে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী বন্দী হলেও তোমার হাতে রাজ্য আসবে না, সম্রাট বিলডন মারা গেলে বৈরুত শহরের বাদশাহীও তেমার ভাগ্যে জুটবে না।’

জ্যাকব সেখান থেকে সরে এলো বটে কিন্তু মুহূর্তের জন্যও বিলডনের বন্ধ দরজা থেকে চোখ সরালো না। তার সমগ্র অস্তিত্ব আছন্ন করে রেখেছিল দুই মুসলিম দূত।

ওরা দু’জন সত্যি সত্যি ইয়াজউদ্দিন মাসুদের রাজদূত ছিল। সুলতান আইয়ুবী যখন বৈরুতের অবরোধ উঠিয়ে মুশেলের দিকে চলে যান, তখন ইয়াজউদ্দিন মাসুদ বাগদাদের খলিফার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন ভয়ে। বাগদাদের খলিফা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শায়খুল উলামার মাধ্যমে সুলতান আইয়ুবীর সাথে একটা আপোষ রফায় আসতে। শায়খুল উলামার অনুরোধে সুলতান আইয়ুবী ইয়াজউদ্দিন মাসুদক ক্ষমা করে দেন। বিনিময়ে ইয়াজউদ্দিন মাসুদ প্রকাশ্যে সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্র সমার্পনের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু তিনি গোপনে দূতকে খৃস্টান সম্রাট বিলডনের দরবারে পাঠিয়ে দেন। এরাই সে দূত, যারা সম্রাট বিলডনের কামরায় বসেছিল।

‘মুশেলের শাসক বলেছেন, আপনি সুলতান আইয়ুবীর পিছু ধাওয়া না করে একটা বিরাট ভুল করেছেন।’ এক দূত বিলডনকে বললো, ‘আপনি তার সৈন্যদের বিশ্রাম করার সুযোগ করে দিয়েছেন।’ ‘ইয়াজউ ্দিন মাসুদের অভিপ্রায় কি? তিনি কি তোমাদের কোন লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন? ‘ জানতে চাইলেন সম্রাট বিলডন।

‘রাস্তায় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকায় তিনি কোন লিখিত পয়গাম পাঠাতে পারেননি। যা বলার তা আমাদের বুকে গেঁথে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মহামান্য সম্রাট! আমাদের সম্মিলিত দুশমন আবার ময়দানে নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। কিন্তু তার আগের উদ্যম ও সাহস আর নেই। তাই সে বৈরুত অবরোধ করেও পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। তাকে শায়েস্তা করার এটাই উপযুক্ত সময়। আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দামেশকের দিকে অভিযান চালান। এশ শহরই সুলতান আইয়ুবীর শক্তি ও ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু। সুলতান এখন এই শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। এই সুযোগে আপনি যদি শহরটাকে অবরোধ করে আপনার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারেন তবে আমার বিশ্বাস সুলতান আইয়ুবী আর কখনোই দামেশকে উঠতে পারবে না।

মহামান্য সম্রাট! আপনি অভিযান দ্রুত চালাবেন। আপনার দামেশক পৌঁছার সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত আমি চেষ্টা করবো সুলতান আইয়ুবীকে আটকে রাখতে। তিনি এখন মুশেলের কাছে নাসিবা নামক স্থানে ক্যাম্প করে বসে আছেন। আমি সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর ওপর সারাক্ষণ নজর রাখছি।’

সম্রাটের কামরায় বসে কথা বলছিল ওরা। জানালা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল আকাশের চাঁদ। রাতের সেই চাঁদ অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখছিল রাসূলের প্রিয় উম্মতের মদ্য থেকে জন্ম নেয়া দুই বিশ্বাসঘাতকের কর্মকান্ড। চাঁদের কলঙ্কের মতই মুসলিম জাতির মধ্যে কলঙ্ক হয়ে ওরা যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকে, পার্থক্য শুধু এটুকু, চাঁদের কলঙ্ক দেখা যায় কিন্তু জাতির কলঙ্ক সহজে সনাক্ত করা যায় না।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top