২৪. সামনে বৈরুত

 কৌতুহলী দাসী যুবকের আরো কাছে গিয়ে ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ ফেললো যুবকের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেললো ইসহাককে। ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো দাসী। ইসহাক বললো, ‘তাড়াতাড়ি শোন, হাতে বেশি সময় নেই।’

 দাসী আরো কয়েক কদম এগিয়ে বললো, ‘ভয় নেই, ভেতরে চলে আসুন এবং আমাকে অনুসরণ করুন।

 এই বলে দাসী আর দাঁড়াল না, একদিকে হাঁটা দিল। ইসহাক এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে বাগানে ঢুকে গেল এবং কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাসীর পিছে পিছে হাঁটতে লাগলো।

 দাসী রাজিয়া খাতুনের কাছে গিয়ে আস্তে বললো, ‘এদিকে আসুন।’

 ওর কন্ঠস্বরে চমকে গেলেন রাজিয়া খাতুন। কিন্তু প্রশ্ন না করে তাকে অনুসরণ করলেন।

 সন্ধা হয়ে গিয়েছিল ৲ গাছের ছায়ায় জমা হচ্ছিল চাপ চাপ অন্ধকার। দাসী তেমনি এক অন্ধকার ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গেল রাজিয়া খাতুনকে। ওখানেই অপেক্ষা করছিল ইসহাক তুর্কী।

 রাজিয়া খাতুনকে অনুসরণ করে শামসুন নেছা এবং আমের বিন উসমানও সেখানে পৌঁছে গেল। দাসী বললো, ‘এই হচ্ছে ইসহাক তুর্কী, যার কথা াপনাকে আগেও বলেছি।’

 রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘বসো বাছা। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।’

 ওরা সেখানে সবাই বসে পড়লো। জায়গাটার চারদিকে ছোট বড় বেশ কয়েকটি ঝোঁপ। দূর থেকে তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। ওরা বাগানের সেই অন্ধকার কোণে বসে আলাপ শুরু করলো।

 ইসহাক তুর্কী বললো, ‘আমি জানতাম না আপনি এখানে। এখানে এসেই শুনতে পেলাম, আপনি হলব থেকে মুশেল চলে এসেছেন। তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আপনার সাথে দেখা না করে যাবো না আমি। যাক, সহজেই আপনার সাক্ষাত পেয়ে গেলাম, সে জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করছি। এবার বলুন, আমার জন্য আপনার কি হুকুম।’

 ‘তোমাকে হুকুম করবো তেমন অবস্হা আমার নেই। তুমি জানো না, আমি এখন কিভাবে দিন তাটাচ্ছি। মরহুম নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর কাউকে আমি বিয়ে করবো এমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু আমাকে যখন বলা হলো, ইয়াজউদ্দীনকে সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য আমার তাকে বিয়ে করা দরকার, কেবল ইসলামের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই আমি সে প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম।

 কিন্তু আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। আমি বুঝতে পারিনি, ইয়াজউদ্দীন বিয়ের নামে আমাকে বন্দি করার ফন্দি এঁটেছে। তার সে ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। সে আমাকে তার হেরেমে এনে বন্গি করেছে, যাতে আমি আর দামেশকর জনগনকে জিহাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে না পারি।

 মরহুম নুরুদ্দীন জঙ্গী ইসলামকে বিজয়ী করার যে স্বপ্ন দেখতেন, ইয়াজউদ্দীনকে সেই স্বপ্ন পূরনের সেনাপতি বানানোর সংকল্প নিয়ে তার ঘরে এসেই আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম।

 ইয়াজউদ্দীন সুলতান আইয়ুবীর সামরিক জোটে থাকলেও তলে তলে সে যে গাদ্দারীর খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে, তা আমি বা সুলতান কেউ জানতাম না। তার হেরেমে বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি এসবের কিছুই জানতাম না। যখন জানলাম তখন আমার আর কিছুই করার ছিল না। তবু আল্লাহর শোকর আদায় করি, এই দাসী আইয়ুবীর গোয়েন্দা থাকার ফলে দ্বীনের সামান্য খেদমত করার পথ সে আমার জন্য খুলে দিয়েছে।’

 রাজিয়া খাতুনের গলা ধরে এসেছিল। তিনি একটু বিরতি নিয়ে আবার বলতে নুরু করলেন, ‘ইচ্ছে ছিল, ইযাজউদ্দীনকে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর দক্ষিণ হস্ত বানাবো। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর সফল ুত্তরাধিকারী বানাবো।

 কিন্তু সে সপ্নের যেদিন মৃত্যু ঘটল, সেদিন নিজেকে সামলাতে পারলাম না, যদি আইয়ুবীর এই গোয়েন্দার সাক্ষাত না পেতাম। আমি তোমাকে এখানকার অবস্হা বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি। দ্রুত এ খবর আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দাও, যাতে আমার মত তাকেও ধোঁকায় পড়তে না হয়।’

 এরপর তিনি মুশেলের সামগ্রিক পরিস্হিতি ইসহাক তুর্কীর সামে তুলে ধরলেন।

 ‘আপনি ইয়াজউদ্দীন ও ইমামউদ্দীনের ওপর কোন ভরসা করবেন না। এরা আমাদের কোন সাহায্য করবে না। আপনি সুলতান আইয়ুবীকে বলবেন, ‘বৈরুত অবরোধের আগে সুলতান যেন হলব ও মুশেলে অভিযান চালিয়ে এইসব গাদ্দারদের আগে শায়েস্তা করেন। এতেই ইসলামের বিরাট খেদমত হবে।’ রাজিয়া খাতুনের কথা শেষ হলে উদ্বিগ্ন শামসুন নেছা আক্ষেপের সুরে বলল।

 ‘ মুসলিম শাসকদের অবস্হা যদি এই হয়, সামান্য লোভ লালসায় পড়ে যদি তারা গাদ্দারীর খাতায় নাম লিখিয়ে দেয়, তবে আমার ভয় হয়, বায়তুল মুকাদ্দাসেরসমত কাবা শরীফও না জানি কবে ইহুদা ও খৃস্টানরা দখল করে নেয়।’ এবার কথা বললো ামের বিন উসমান।

 ‘এতটা নিরাশ হয়ো না ামের। ইসলামের ইতিহাসে শুধু গাদ্দার নয় মুজাহিদও আছে। নিজের বাপ-দাদাদের ইতিহাসের দিকে তাকাও। যখন শাসকরা দ্বীন ও দেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, মুজাহিদরা বসে থাকেনি নিজের রক্ত ঢেলে তারা জাতির গৌরব রক্ষা করেছে। তারা অকাতরে রক্ত দিয়েছে, আহত হয়েছে, নিহত হয়েছে। কিন্তু জাতির সম্মান ভূলুন্ঠিত তে দেয়নি। এ ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।’

 এবার মুখ খুললেন রাজিয়া খাতুন, সে আমি জানি বেটা। তবু যখন জাতির বিলাস প্রিয় আমির ও শাসকরা শত্রুদের পাঠানো মদ ও সুন্দরী নারীদের খপ্পরে পড়ে ভুলে যায় জাতির কথা, তখন বড় কষ্ট পাই।যখন দেখি ধনরত্ন ও সম্পদের নিচে চাপা পড়ে যায় মুসলমানদের ঈমান, তখন সে কষ্ট আরো বেড়ে যায়।’

 ‘শুধু ওদের কথাই বললেন ! আপনি কি দেখছেন না আল্লাহর সৈনিকরা দুস্তর মরু, সুউচ্চ পাহাড় আর অথৈ সমুদ্রের বাঁধাকেও থোড়াই তোয়াক্কা করছে? আমাদের প্রিয় নেতা সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী তো পুরোটা জীবনই মরুভূমি ও পাহাড়ে যুদ্ধ করে কাটিয়ে দিলেন।’

 ‘হ্যাঁ, আমার প্রথম স্বামীও সারা জীবন শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন। কিন্তু এখন যে শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের জ্ঞাতি ভাইয়েরা! যখন তুমু বেঈমান শাসকদের বিরুদ্ধ অস্ত্র ধরবে তখন তারা তামাদেরকেই জাতির দুষমন ও খুনি বলে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বসবে।’

 ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমরা জানি এগুলো নিত্য নতুন ফেৎনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা এসব ফেৎনা ফাসাদের পরোয়া করি না। খৃস্টান ও ইহুদিরা এসব ফেৎনা সৃষ্টি করে আমাদের দুর্বল করতে চাইছে। আমরা এসব ফেৎনার মূল উপড়ে ফেলে জাতির দৃষ্টি থেকে মিথ্যার আবরণ সরিয়ে দেব, আপনি শুধু আমাদের জন্য দোযা করবেন।’

 ‘সাবাস বেটা ! এই তো চাই। তোমরা এসো, এসো ঞ্ঝার মত উদ্দাম বেগে, এসো মরু সাইমুম হয়ে।তুফানের মত সব বাঁধা মাড়িয়ে তোমরা এসো, এসো রহমতের বৃষ্টি ধারার মত। আমি তোমাদের জন্য কেবল দোয় করবো না। আমিও সেই বৃষ্টি ধারার সামান্য ফোটা হতে চাই।আমি কতা দিচ্ছি, আমি তোমাদের জন্য ময়দান পরিষ্কার করে রাখবো। একানকার প্রতিটি শিশুও তোমার সঙ্গী হবে।’

 প্রচন্ড আবেগে তখন তিনি কাঁপছিলেন। চেহারায় খেলা করছিল সাহস ও প্রেরণার জ্যোতি।

 ইসহাক তুর্কী আর কথা বাড়াল না, সে উঠে দাঁড়িয়ে সাবইকে সালাম করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

 সে সেই ছায়াঘন ায়গা থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছে, মনে হলো ঝোপের ুল্টো দিকে কারো পদধ্বনি। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। অন্ধকার তখন বেশ চেপে বসেছে, তবু তার মনে হলো ঝোপের ওপাশ দিয়ে একটি ছায়া হেঁটে যাচ্ছে। সে গলা বাড়িয়ে দেখতে গেল, ততক্ষনে ছায়াটি ঝোপের মধ্যে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।

 এ নিয়ে সে আর খোঁজাখুঁজি করতে গেল না ইসহাক। কারণ কায়রো যাওয়ার চিন্তা তার মনকে তখন আছন্ন করে রেখেছিল। তার মাথায় তখন একটায় চিন্তা, যে প্রকারেই হোক যত দ্রুত সম্ভব তাকে কায়রো পোঁছতে হবে।

 সে ওখাম থেকে রাস্তায় েসে উঠল। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা রকম চিন্তা, সুলতান আইয়ুবী তো এরই মধ্যে স্বসৈন্যে অভিযানে বেরিয়ে পড়েননি !

 এখানকার কাজ তার শেষ। প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সকল সাথীদের সাথেই দেখা হয়েছে। এবার দ্রুত রওনা হতে হয়।

 সে যেখানে তার ঘোড়া রেখেছিল সেখানে পৌঁছে গেল। কালবিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি সামান্য কিছু মুখে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু করলো। গন্তব্য তার কায়রো কিন্তু সুলতান যদি হলবের অবস্হা জানতে চান? তাছাড়া তার কমান্ডার হলবে অবস্হান করছেন।

 হলবের খবর জানা এবং কমান্ডারকে সব জানানো দু’কারণেই তার হলব যাওয়া জরুরী। পথে নেমেই সে সিদ্ধান্ত নিল, হলব হয়েই সে কায়রো যাবে।

 অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে সে হলবে পৌঁছালো। কমান্ডারের দেখা করে সংক্ষেপে খুলে বললো সব কথা। পরিস্হিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে কমান্ডার তাকে বললো, ‘তুমি সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নাও। আমি তোমার ঘোড়া পাল্টাবার ব্যবস্হা করছি।’

 ইসহাক বিশ্রামে গেল। কমান্ডার তার জন্য উন্নত জাতের তাজাদম গোড়া প্রস্তুত করলো। পানির মশক ভরে ঝুলিয়ে দিল ঘোড়ার সাথে। শুকনো খাবার এবংসফরের আরো কিছু টুকিটাকি জিনিস থলিতে বেঁধে ঘোড়ার সাথে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ইসহাক তুর্কীকে ডেকে বললো, ‘তোমার ঘোড়া প্রস্তুত।’

 ইসহাক তুর্কী নতুন ঘোড়ায় চেপে কায়রোর দিকে যাত্রা করলো।

 সে রাতের ঘটনা; যে রাতে ইসহাক তুর্কী সন্ধার অন্ধকারে নিরাপদ শাহী বাগানের নিভৃত কোণে রাজিয়া খাতুনের সাথে সাক্ষাত করেছিল।

 আমেরের রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছা যথাসময়ে মহলে ফিরে এলো সবাই এটাকে প্রতিদিনের মত এক নির্দোষ ভ্রমণ বলেই ধরে নিল। সেখানে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের আদান প্রদান হয়েছে মহলের কারোরই সে কথা জানার কথা নয়।

 সে রাতে ইয়াজউদ্দীন তার দরবারে এক মাহফিলের আয়োজন করেছিল। মাহপিল মানে সমাজের উচ্ছবিত্ত ও উর্দতন সামরিক অফিসারদের নিয়ে একত্রে খানাপিনা করা, গান শোনা, নাচ দেখা এবং একত্রে বসে মৌজ করে মদ পান করা।

 সন্ধার পর থেকেই অতিথিরা আসতে শুরু ককলো। একটু পর নুরু হলো নাচ গান।

 ইয়াজউদ্দীন মাহফিলে আসন গ্রহণ করলেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন অভ্যাগত লোকদের। শিল্পিদের সারির দিকে তাকিয়ে তার মনটা দমে গেল। একটা শুন্যতা হাহাকার করে উঠলো মনের ভেতর।

 উনুশীকে তার খুব পছন্দ। সে শিল্পীদের সারিতে তাকে দেখতে পেল না। ইয়াজউদ্দীন ভাবলো, হয়তো সাজগোছ করতে একটু সময় নিচ্ছে। এসে পড়বে এক্ষুণি।

 অনুষ্ঠান চলছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে অনুষ্ঠানের দিকে মন নেই ইয়াজউদ্দীনের। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো কাটছে তার কষ্টকর এক যন্ত্রণায়। এক সময় অধৈর্য হয়ে তিনি এক রক্ষীকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘উনুশীর কামরায় যাও। সে এখনো এলো না কেন দেখে এসো। তাকে বলবে, আমি তাকে আসতে বলেছি।’

 রক্ষী গেল উনুশীর কামরায়। দেখলোো মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছে উনশী।

 রক্ষী ইয়াজউদ্দীনের ইচ্ছার কথা জানালো তাকে। উনুশী বললো, ‘তাকে গিয়ে বলো, উনুশীর শরীর খারাপ। সে আজ আসতে পারবে না।’

 ফিরে গেল রক্ষী। ইয়াজউদ্দীনকে জানালো উনুশীর কথা। ইয়াজুদ্দীনের মন এতে আরো খারাপ হয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, ববিকেলেও তো ওকে বেশ হাসিখুশি দেখলাম ! চঞ্চল হরিণীর মত গুরে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। হঠাৎ আবার কি হলো তার?

 তিনি তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান শেষ করে উনুশীর কামরায় চলে এলেন।

 ‘মাহফিলে যাওনি কেন সোনা ?’ মোলায়েম কন্ঠে জানতে চাইলেন ইয়াজউদ্দীন মাসুদ।

 উনুশী তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসলো।বললো, শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল, তাই যেতে পারিনি।’

 ইয়াজউদ্দীন উনুশীর ম্লান ও বিষণ্ন চেহারার দিকে তাকালেন। তার দু’চোখে রাজ্যের মায়া ও অবসন্নতা। সে যে কথা বলছে, সেই কথার স্বরও কেমন যেন অস্পষ্ট, বাধো বাধো, অসংলগ্ন।

 ইয়াজউদ্দীন দেরী না করে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার এসে তার নাড়ি পরীক্ষা করে ঔষুধ দিল। উনুশী সেই ঔষুধ এক পাশে সরিয়ে রেখে বললো,আপনারা যান, ঔষুধ আমি নিজেই খেয়ে নেবো। ঔষুধের চেয়ে এখন আমার বিশ্রাম বেশী প্রয়োজন।’

 ডাক্তার এবং ইয়াজউদ্দীন বেরিয়ে গেলেন কামরা থেকে। ইয়াজউদ্দীন হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘হঠাৎ আবার কি হলো মেয়েটির? ‘

 ‘ও কিছু না সেরে যাবে। দুশ্চিন্তা বা অধিক রাত জাগা ও অতিরিক্ত মদ পান করলে েমনটি হতে পারে। হয়তো মেয়েটি শরীরের ওপর বেশী অত্যাচার করছে, তাই এমন হয়েছে।’

 ইয়াজউদ্দীন ও ডাক্তার চলে গেল। উনুশী দরোজা ভেতর থেকে বন্ধ করে শোয়ার পরিবর্তে কামরায় পায়চারী করতে লাগলো।

 উনুশী ছিল খুবই অশান্ত। হঠাৎ একটি ঘটনা জীবনের সবচে ভয়াবহ অবস্হায় এনে ফেলেছে তাকে। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। সে একবার জানালার পাশে যায়, একবার এসে দাঁড়ায় ঘরের মাঝখানে। কখনো জানালায় এসে পর্দা উঠিয়ে বাইরে তাকায়। কিছুক্ষন এভাবে পায়চারী করে হঠাৎ বিছনায় এসে দপ করে বসে পড়লো। তারপর মাথার কাছ থেকে টেনে নিল তার গহনার ছোট্ট বাক্সটা।

 তার এ গহনার ছোট্ট বাক্সটা খুবই সুন্দর। এক আরবী ধনী আমীর এ সৌখিন বাক্সটা তাকে উপহার দিয়েছিল কয়েক বছর আগে।

 সে বাক্সটা খুলে দেখলো। তার ভেতর থেকে বের করলো একটা আঙ্গুরী। সুদানী পরী উনুশী আংটির নকশার দিকে তাকিয়ে রইলো তন্ময় হয়ে।

 এই আংটির নিচটা ভরাট। কী-তে চাপ দিলে খুলে যায় পাল্লাটা। আসলে এটা একটা ছোট্ট কৌটা।

 সে কৌটার মুখটা খুলল। কৌটায় সামান্য সাদা পাউডার। সে বিষন্ন মনে পাউডারের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।

পাউডারের দিকে তাকিয়ে সে মনকে স্হির করতে চেষ্টা করলো। তাতে তার অশান্তি কিছুটা দূর হলো। একটা শান্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো মনে।

 হৃদয়ের অশান্তি ও উদাস ভাব কিছুটা উপশম হলে সে কৌটার মুখ আবার বন্ধ করে উঠে দাড়ালো।

 রাত ততক্ষনে অর্ধেক পার হয়ে গেছে। পাশের কামরায় ঘুমুচ্ছে তার নিজস্ব দাসী। উনুশীর অসুস্হতা দেখে দাসী তার কামরাতেই ছিল অনেক রাত পর্যন্ত। শেষে এক সময় উনুশীই তাকে বললো,’যা, তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আজ রাতে আর কিছু লাগবে না।’

 দাসী তারপরও কিছুক্ষন ছিল, শেষে যখন ঘুমে আর বসে থাকতে পারছিল না তখন উঠে নিজের কামরাই চলে গেল।

 উনুশী রাতের কিছু পর দাসীর কামরায় গিয়ে তাকে জাগিয়ে তুললো। তাকে বললো, ‘যা, আমের বিন উসমানকে ডেকে নিয়ে আয়।’

 দাসী আমের বিন উসমানের সাথে উনুশীর সম্পর্কের কথা জানতো। সে ছিল তাদের গোপন মেলামেশার একমাত্র সহকারী ও সাক্ষী। সে আমের বিন উসমানে কামরায় গিয়ে তাকে ডেকে তুললো। বললো, ‘উনুশী আপনাকে এখুনি একবার যেতে বলেছে।’

 আমেরকে নিয়ে ফিরে এলো দাসী। উনুশী দাসীকে বললো, ‘তুই এখন পাহারা দিবি। বাইরে বসে থাক, আমের না যাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে কোথাও নড়বি না।’

 উনুশী আমেরকে ভেতরে টেনে এনে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল।

 ‘আমের!’ উনুশী এমন স্বরে কথা বললো যে শব্দের সাথে আমেরের পরিচয় ছিল না। ‘তুমি জানো, আমি তে? ‘

 উনুশী এ কথা বলে আমেরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমের বুঝে পেল না, এ প্রশ্নের কি জবাব সে দেবে।

 আমের চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। উনুশী বললো, আজ সন্ধায় যে লোকটা শাহী বাগে তোমাদের সাথে বসেছিল, কে সে? ‘

 ‘কেউ না।’ আমের থতমত খেয়ে না জানার ভান করে উত্তর দিল, ‘আমার কাছে তো কেউ আসেনি!’

 ‘তোমার কাছে কেউ যায় নি, না? ‘ উনুশীর কন্ঠে সাপের হিসহিসানির মত শাসানি।

 ‘আমি তো ওদের সাথে যাই রক্ষী হিসাবে। আমি দূর হতে ওদের অনুসরণ করি মাত্র , আমার কাছে কে আসবে !’

 ‘আমের! ‘ সম্পূর্ণ পাল্টে গেল উনুশীর কন্ঠ। বললো, ‘আমি জানি, তুমি আমার অন্তরের গভীরে যত খবর লুকিয়ে আছে সব সংবাদ জানতে চাও। ঠিক আছে সব খবরই তুমি জেনে নাও। আমি তোমাকে অন্তরের গভীর থেকে ভালবাসি। তাই তোমার চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখবো না।

 কিন্তু তুমি আমাকে মরুভূমির সহজ সরল মেয়ের মত যতটা সহজ ও বোকা মনে করেছো, আমি ততটা বোকা নই। তুমি, রাজিয়া খাতুন, শামসুন নেছা এবং খাদেমা বাগানের ভেতর এক সাথেই বসেছিলে। এক আগন্তুককে নিয়ে ঝোঁপের আড়ালে তোমরা গোপন বৈঠক করেছো। সেখানে অনেক গোপন আলাপ হলো তোমাদের মধ্যে। প্রয়োজনীয় আলাপ সারতে সারতে তোমাদের রাত হয়ে গিয়েছিল। আমি কি এগুলো সব স্বপ্নে দেখেছি ?’

 মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল ামের, কোন জবাব দিল না। উনুশী বললো, ‘আমি কারো কাছ থেকে শুনে এসব কথা বলছি না। আমি নিজে তখন ঝোপের উল্টো পাশে বসেছিলাম। তোমাদের কানাঘুষা সব শুনেছি। তোমার কথাও শুনেছি। তুমি কি বলেছিলে সে কথা আমার কাছ থেকে শুনতে চাও ? বলবো সে কথা? ‘

 আমের চুপ। উনুশী বললো, ‘তোমাদের সবাইকে আমি জানি, চিনি। কিন্তু আগন্তুক লোকটাকে আমি চিনতে পারিনি। তার পরিচয় আমার জানা দরকার। লোকটা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে না পড়লে ঠিকই আমি তার পরিচয় বের করে ফেলতাম। কিন্তি লোকটি সেকান তেকে উঠে চলে গেল। আমিও সেখান থেকে উঠে চলে েলাম বলে তার পরিচয় আর জানা হয়নি।’

 ইসহাক তুর্কী যখন ওখান থেকে উঠে চলে যাচ্ছিল, তখন সে কারো পায়ের চাপা পদধ্বনি শুনেছিল। একটু দূরে একটি ছায়া মূর্তিও আবছা দেখতে পেয়েছিল। সেই পদধ্বনি ও ছায়াটি ছিল উনুশীর। সে-ই রাজিয়া খাতুন, শামসুন নেছা ও আমেরের পিছনে লুকিয়ে তাদের কথোপকথন শুনেছিল।

 আমের বিন উসমানের মুখে আর কোন কথা সরলো না। উনুশী ছিল সুদক্ষ গোয়েন্দা। আমেরের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, তার সন্দেহ যথার্থ। আমেরই তার মতই এখানে কারো হয় গোয়েন্দাগিরি করছে। কিন্তু কার ? প্রশ্নটা জটিল হলেও উত্তর খুবই সোজা। সে আমাদের গোয়েন্দা নয়। হলব ও মুশেলের লোকদের এখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার নেই। তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর একটাই, এ লোক সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর গুপ্তচর। ‘আমের! ‘ অত্যান্ত মোলায়েম কন্ঠে উনুশী বললো, ‘যদি শুধু শামসুন নেছা একা তোমার সাথে বসা থাকতো, তবে আমি বুঝে নিতাম, সে শাহজাদী তোমাকে বশীভূত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা তো অন্য রকম ছিল। যদিও সব কথা আমি স্পষ্ট কর শুনতে পাইনি, কিন্তু এটা তো ঠিক, সবাই মিলে তোমরা কোন গোপন শলাপরামর্শ করছিলে? ‘

 আমের হাসার চেষ্টা করতে করতে বললো, ‘এ সব কথার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে। আমাকে দয় করে ওদের কাছে বসতে দিয়েছে এই তো ঢের। সামান্য রক্ষী হয়ে ওদের রাজকীয় ব্যাপারে নাক গলানো কি আমার শোভা পায়, নাকি ওতে জড়ানো আমার উচিত? ‘

 ‘আমের! ‘ উনুশী রাগের সাথে বললো, ‘ তুমি জানো, আমি কে? আমার ইশারায় এ শহরের ইট দিয়ে আমি ইট ভাঙতে পারি। ভালবাসার পিপাসায় আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে গিয়েছিলাম। মন থেকে তোমাকে ভালবেসেছিলাম। আর সেই সুযোগে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে নিয়েছো। তবুও তোমার জন্য আমার অন্তরে যে অফুরন্ত ভালবাসা জন্মলাভ করেছিল তা আমি নষ্ট হতে দেব না। নইলে এতক্ষনে তুমি পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে না। আমার সামান্য ইশারাতে তুমি কারাগারের অন্ধ কুঠরিতে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে। কারাগারে গোয়েন্দাদের কি কষ্ট দেয়া হয়, কি অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয় সে অভিজ্ঞতা হযতো তোমার নেই। তাই এখনো তুমি আমার সামনে মিথ্যা বলার সাহস পাচ্ছো।

 আমি ামার দায়িত্ব ও কর্তব্যের অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করে তোমাকে সেই জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছি। তুমি এও জানো,ইচ্ছে করলেই আমি তোমাকে এমনভাবে গুম করে দিতে পারতাম, যেমন একটি মশাকে টিপে মারার পর কেউ তার হদিস বের করতে পারেনা। শুধু প্রেমের খাতিরে আমি এসব কিছুই করিনি।

 আমের! আমার একমাত্র ভালবাসা! আমার একমাত্র প্রেম! আমার জীবন! আমার মরণ ! তুমি শুধু এইটুকু কথা বলে দাও, যে আগন্তুক এসেছিল,তাকে তোমরা কি তথ্য দিয়েছো এবং এই তথ্য নিয়ে সে কোথায় গেছে ?

 থামল উনুশী। একটু দম নিল। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, ‘ আমার খাঁটি প্রেমের নিদর্শন দেখো, আমি তোমাদের সেই গোয়েন্দাকে বিনা বাধায় যেতে দিয়েছি। আমি ইচ্ছে করলেই তাকে আটকে ফেলতে পারতাম। কিন্তু তোমাকে ভালবাসার কারণে সে বিষও আমাকে হজম করতে হয়েছে।’

 উনুশীর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। সে কাঁদছিল আর বলছিল, ‘আমি যে এক হৃদয়স্পর্শী ধোঁকা। জীবনভর মানুষকে ধোঁকা দিয়ে এসেছি। অথচ যখন তোমাকে সত্যিকার ভালবাসা দিে গেলাম তখন নিজেই কেমন মর্মান্তিক ধোঁকার স্বীকার হয়ে গেলাম। তুমি জিতে গেলে আর আমি হেরে গেলাম।

 আমের, তুমি সত্যি করে বলো! সত্যি কথা বলো। তুমি যে আমার জীবন ! তোমার কোন ভয় নেই। তোমার কোন ক্ষতি হওয়ার আগে আমার ক্ষতি হবে। আমি বেঁচে থাকবো আর তোমার ক্ষতি দেখবো, এমনটি কখনো হবে না।’

 ‘হ্যা, উনুশী।’ আমের বললো, ‘ তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছো। আমিও আমার দায়িত্য পালন করেছি। এবার তুমি আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে দাও। তোমার যা খুশি করো, আমার কিছু বলার নেই।’

 উনুশীর চোখে তখন অশ্রুর বন্যা। কিন্তু সে সজোরেই হেসে উঠলো এবং বললো,’ব্যাস্ আমের! আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছো এবং সত্য কথা বলেছো, এটুকুই আমার দেখার ছিল। তুমি নিঃসংকোচে সত্য উচ্চারণ করেছো, এতেই আমি খুশি। তোমাকে আমি কখনো কারাগারে পাঠাবো না আমি প্রেমের মনোরম পিঞ্জরা থেকে মুক্ত হতে চাই না। আমি বাঁচলে তোমাকে নিয়ে বাঁচবো, মরলে তোমার সাথেই মরবো।’

 আবেগতপ্ত কন্ঠে কথা বলছিল উনুশী। হঠাৎ সে চোখের পানি মুছে ঠোঁটে জড়িয়ে নিল হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করা হাসি। বললো, ‘ আজ আমার জীবনের সবচে সুন্দর দিন। আজ আমার আনন্দের দিন। আমার ভালবাসাকে আজ আমি একান্ত করে পেয়েছি। আজকের এ আনন্দ দিনে তোমাকে আমি কি দিয়ে বরণ করবো ! তুমি তো মদ পান করো না। ঠিক আছে, মদ আমি তোমাকে দেব না। আজ আমি তোমাকে শাহী শরবত দিয়ে বরণ করে নেবো।’

 সে সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালো। ওখানে সাজানো চিল শরবতে পাত্র ও পিয়ালা। তার পিঠ আমেরের দিকে। উনুশী দুটি পিয়ালায় শরবত বানিয়ে নিয়ে আমেরের কাছে এলো। তার আগে আংটির সাথে জড়ানো কৌটাটি খুলে তার ভেতর থেকে সামান্য পাউডার মিশিয়ে নিল শরবতের সাথে।

 আমের সে সব কিছুই দেখছিল না। সে তখন হারিয়ে গিয়েছিল ভাবনার অতল তলে। ভাবছিল,জীবন কি? প্রেম কি? উনুশী যে মহত্ব দেখালো তার বিনিময় কি?

 উনুশী একটি পিয়ালা আমেরের হাতে দিয়ে দ্বিতীয় পিয়ালাটা তুলে নিল নিজের হাতে।

 ‘শুঁকে দেখো।’ উনুশী বললো, ‘এটা মদ নয় শরবত, আমার ভালবাসার শরাবান তহুরা! পান করো।’

 সে পিয়ালা তার নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে নিল। আমেরও তার পিয়ালা ঠোঁটে লাগালো। এক চুমুক পান করে পিয়ালা থেকে ঠোঁট সরিয়ে তাকালো একে অন্যের দিকে। তারপর দু’জনেই পরষ্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার চুমুক দিল। আবারও পিয়ালা থেকে মুখ সরিয়ে মিষ্টি করে হাসলো উনুশী। আমের সে হাসির জবাব দিল হাসি দিয়ে। আবার ওরা চুমুক দিল এবং পিয়ালা শূন্য করে দিল।

 উনুশী আমেরের হাত থেকে পিয়ালা নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর আমেরের গলা জড়িয়ে ধরে আবেগমাখা কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘এখন আমরা মুক্ত, আমের! পৃথিবীর কোন দ্বন্দ সংঘাত, নষ্টামী, স্বর্থপরতা আর আমাদের পরাজিত করতে পারবে না।’

 আমেরের শরীর ঝিম জিম করতে লাগলো।গা অবশ হয়ে এলো। চেতনা নিস্তজ হয়ে গেলো। সে কোন রকমে উনুশীর বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘উনুশী ! আমার যেন কেমন লাগছে। আমার হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। তুমিও কি ক্লান্তি অনুভব করছো? আমরা কি মারা যাচ্ছি উনুশী! ‘

 ‘না আমের! ‘ উনুশী উত্তর দিল , ‘আমরা গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে যাচ্ছি। চির শান্তির ঘুম। বড় আরামের ঘুম। দেখো না, অমাদের চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৃপ্তির ঘুমে ঢলে পড়ছে নশ্বর শরীর। এ ঘুম আর কোন দিন ভাঙবে না। কেউ আমাদের আর জাগাতে পারবে না।

 উনুশীর শেসের দিকের কথাগুলো কেমন জড়িয়ে গেলো।

 ‘উনুশী! এ তুমি কি করলে! আমি যে প্রচন্ড ক্লান্তি বোধ করছি। তোমাকে বাইরে নিয়ে যাবো, ডাক্তার ডাকবোল, সে শক্তিটুকুও যে আমার নেই।’

 ‘আমি তোমার থেকেও অধিক ক্লান্ত আমের। পাপ আমাকে তোমার চেয়েও বেশি ক্লান্ত করে দিয়েছে।বেশি কথা বলার সময় নেই আমের! শুধু শুনে রাখো, তুমি আমার প্রথম ও শেষ ভালবাসা। আমাদের দু’জনকে যে পরকালে একসাথে উঠানো হয় সে জন্য প্রার্থনা করো।’

 ‘হায় উনুশী! পৃথিবীতে এখনো যে অনেক কাজ পড়ে আছে। আইয়ুবীকে সতর্ক করতে হবে। গাদ্দারদের নির্মূল করতে হবে। কে করবে সে কাজ? ‘

 ‘দুঃখ করো না আমের! আমরা আমাদের ফরজ আদায় করেছি। তুমি তোমার ফরজ পূর্ণ করেছো, আমিও আমার ফরজ পূরণ করেছি। আমাদের ফরজ পূর্ণ হওয়ার পর আর কি কাজ বাকী থাকতে পারে ! তাই তো আমি এ শরবতে বিষ মিশিয়েছি। যখন আমাদের মত মেয়েদেরকে কোন দায়িত্ব দিয়ে অন্য দেশে পাঠানো হয় তখনই এই বিষ আমাদের সাথে দিয়ে দেয়া হয়। কাজ শেষ হয়ে গেলে এই বিষ পান করে আমরা শান্তির রাজ্যে চলে যাই। দেখো, এই বিষ কত মধুর ও প্রশান্তিময়। এ বিষ পান করলে কোন কষ্ট ও তিক্ততা বোধ থাকে না।এক মিষ্টি আমেজের মধ্যে আস্তে আস্তে মানুষ চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যায়।’

 আমের উঠে দরজা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। সে চাচ্ছিল, কোনমতে দরজা খুলে দাসীকে বলে, আমরা বিষ খেয়ে ফেলেছি। জলদি ডাক্তার ডাকো। আমাদের বাঁচাও! ‘

 কিন্তু সে উঠে দরজা খুলতে পারলো না, কিছু বলতেও পারলো না।

 উনুশী তাকিয়ে ছিল আমেরের দিকে। আমেরও উনুশীর দিকে তাকিয়ে ছিল। আমেরকে দরজা খোলার চেষ্টা করতে দেখে উনুশী বললো, ‘ পারবে না আমের, পারবে না। আর কেনইবা বেঁচে তাকতে চাও ? এখন বেঁচে থাকলে পৃথিবী তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। তুমি কি সেখানে গিয়ে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে চাও ? আমি বাঁচতে চাই না। কারাগারে তোমাকে যে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে, তা দেখার জন্য আমার বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া বেঁচে থাকলে কোন মেয়ে যদি এসে আমার আমেরকে তার বলে দাবী করে বসে, সে সুযোগ আমি কেন তাকে দেবো?

 আমের বিন উসমান লুটিয়ে পড়েছিল মেঝের ওপর। উনুশীর কোন কথাই এখন আর সে শুনতে পাচ্ছিল না। তার চোখ দু’টোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

 উনুশীর মাথা তখনো সামান্য দুলছিল। সে তার টলোমলো পা নিয়ে দরোজা পর্যন্ত গেল। খাদেমা কাছেই বসেছিল। উনুশী তাকে ডেকে বললো, ‘আমরা দু’জনেই বিষ পান করেছি। তুমি সবাইকে জানিয়ে দিও, আমরা স্বেচ্ছায় বিষ পান করেছি। আমাদের অন্য কেউ বিষ পান করায়নি। কোন খৃস্টান যদি জিজ্ঞেস করে, তবে তাকে বলবে, সুদানের পরী তার দায়িত্ব পালন করেই মরেছে।’

 সে আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু কন্ঠ দিয়ে আর কোন স্বর এলো না। তার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। সে আমেরের গায়ের ওপরই লুটিয়ে পড়লো।

 খাদেমা দৌড়ে পাহারাদারের কাছে চলে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাহারাদারসহ কয়েকজন লোক ছুটে এলো সেখানে।

 তারা এসে দেখলো ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ফেলল ওরা। কামরায় ঢুকেই দেখতে পেলো, দরজার পাশেই পড়ে আছে আমের বিন উসমানের লাশ। তার উপর কাত হয়ে পড়ে আছে উনুশী। তার মাথা আমেরের বুকের উপর এবং আমেরের মাথার চুলের মধ্যে তার এক হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকানো।

ইসহাক তুর্কী মুশেল থেকে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিল। সে যে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা এ কথা জেনেও উনুশী তাকে ধরিয় দেয়নি বা পিছু নেয়নি। তাকে গ্রেফতার করার’ কথা যখন মনে এলো তখনি আমেরের কথ স্মরণ হলো তার। আমের! এক অলীক হাস্তবতা। উনুশী ভেবে দেখলো, যদিও আমেরের ভালবাসা চলনায় ভরা কিন্তু তার ভালবাসা তো ছলনাবিহীন, নির্ভেজাল। আর আমেররর ছলনাময় ভালবাসার কি কোন মূল্য নেই? যদি এ ছলনাটুকুও সে না দিত তবে কি করতে পারতাম আমি?

 আমেরের এই ছলনাময় ভালবাসার খাতিরেই সে সিদ্ধান্ত নিল, না এই আগন্তুককে আমি রেহাই দেবো।

 ইসহাক তুর্কীর কায়রো পৌঁছতে আরো কয়েকদিনের রাস্তা বাকি ছিল, এই সময় পাহাড়ী সাপে তার ঘোড়াকে দংশন করলো। তারপর কি অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট সয়ে পায়ে হেটে সে এগিয়ে গিয়েছিল সেই বর্ণনা ‘ইহুদী কন্যা’য় বলা হয়েছে।

 ইসহাক তুর্কী খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে কায়রো যাচ্ছিল। ইসলামের সম্মান ও অপমান নির্ভর করছিল এ সংবাদ ঠিক জায়গায় সময় মত পৌঁছানো বা না পৌঁছানোর ওপর।

 সে ছিল নির্ভিক এক মুজাহিদ। তাই এমন ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর মরুভূমি অতিক্রম করে কায়রো পৌঁছানোর জন্য সে একাকীই পথে নেমে এসেছিল। তার ঘোড়াকে সাপে দংশন না করলে ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো।

 কিন্তু সাপে দংশন করার পরও দমে যাওয়ার পাত্র সে ছিল না। পদব্রজে হেঁটেই সে নিষ্ঠুর মরুভূমি পাড়ি দেয়ার সংকল্প নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু মানুষের সহ্য গুনেরও একটি সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম হয়ে গেলে এক সময় সে মরুভূমিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

 যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে খৃস্টানদের এক ক্যাম্পে। ক্যাম্পটি ছিল খৃস্টান গোয়েন্দাদের। বারো জনের এক ছোট্ট কাফেলা। দশজন পুরুষ আর দু’টি মেয়ে কায়রো থেকে যাচ্ছিল বৈরুত। মেয়েদের একজন খৃস্টান, অন্যজন ইহুদী। খৃস্টান কন্যা মেরিনা আর ইহুদী কন্যা বারবারাকে নিয়ে দলে চলছিল এক অঘোষিত যুদ্ধ। ইসহাক তুর্কী বেহুশ অবস্হায় বিড়বিড় করে কথা বলছিল। তার কথা শুনে খৃস্টানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, এ লোক মুসলমান গোয়েন্দা। সে কোন জরুরী সংবাদ নিয়ে কাযরো যাচ্ছে।

 কমান্ডারকে নিয়ে মেরিনা ওবারবারার মধ্যে চলছিল প্রকাশ্য শত্রুতা। প্রত্যেকেই কমান্ডারকে নিজের করায়ত্ত্বে রাখার জন্য সচেষ্ট ছিল। কিন্তু কমান্ডার বারবারার সাথে ছলনা করে মেরিনার সাথে গভীর সখ্যতা গড়ে তুললো।

 বারবারা এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইসহাককে গোপনে সতর্ক করে দেয়।

 সে যে খৃস্টান গোয়েন্দাদের ফাঁদে পড়ে গেছে এ তথ্য জানতে পেরে ইসহাক পড়ে যায় মহা ফাঁপড়ে। কারণ ইসহাক এরই মধ্যে স্বীকার করে ফেলেছিল, সে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা এবং হলব থেকে কায়রো যাচ্ছে।

 খৃস্টান কমান্ডার তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ তুমি কি সংবাদ নিয়ে কায়রো যাচ্ছ? ‘

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top