১২. গোপন বিদ্রোহী

 ‘বন্দী কমান্ডার ও জোহরাকে কি আজই কোরবানি করা হবে?

 ‘সে সিদ্ধান্ত হাবশীরাই নেবে। সম্ভবত তারা দু’চারদিন তাদেরকে পেলে পুষে বশ মানাবে। তাদের কিছু ধর্মীয় নিয়ম পদ্ধতি পালন করাবে’।

তাদের কথার মাঝখানেই কিছু লোকের পদধ্বনি ও হাসির শব্দ কানে এল। ওরা তাকিয়ে দেখলো, আলকিন্দি ও তার চার সাথী এগিয়ে আসছে।

আলকিন্দি কাছে এলে ওরা বললো, ‘একজন পুরুষ ও একজন নারীকে হঠাৎ হাতে পাওয়া গেছে। এ দু’জনকেই বলীর জন্য হাবশীদের হাতে সমর্পণ করা যেতে পারে’।

আলকিন্দি জিজ্ঞেস করলো না, মানুষ দু’টি কে বা কারা। সে মাথা থেকে রাজমুকুট নামিয়ে বন্দীরা যে কামরায় ছিল সেখানে প্রবেশ করল। কমান্ডার ও জোহরা বন্দী অবস্তায় চুপচাপ বসেছিল সেখানে। কমান্ডারের পরণে সামরিক পোশাক ছিল না, আলকিন্দি তাকে চিনতে পারল না। কিন্তু কমান্ডার আলকিন্দিকে ঠিকই চিনতে পারল।

কামরার বাইরে লোক দু’জন যখন ওদের নিয়ে আলাপ করছিল তখনও কয়েকবারই কমান্ডার আল কিন্দির নাম শুনে ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে তাই কমান্ডার খুব অবাক হয়নি, কিন্তু তিনি এখানে কি করছেন সে বুঝতে পারল না।

আলকিন্দি কামরা থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,

‘ঠিক আছে ,ওদেরকে হাবশীদের ধর্মীয় নেতার কাছে তুলে দাও’।

আল কিন্দির এ কথায় কমান্ডার নিশ্চিত হয়ে গেল,তাকে ও জোহরাকে কোরবানী দেয়ার ফায়সালা চূড়ান্ত হয়ে গেছে।

আল কিন্দি বেরিয়ে গেলে একজন বললো, ‘কমান্ডারের ভাগ্যটাই খারাপ, নইলে বলীর পাঠা সেই হতে যাবে কেন?’

‘আরে রাখো, এ তো সবে শুরু। এই বলী যখন হাবশীদের পাগল করে তুলবে রক্তের জন্য, তখন তো কায়রোর সব কমান্ডারই বলীর পাঠা হয়ে যাবে’। বললো তার সঙ্গী। এ কথা শুনে সঙ্গীটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

তিন চারদিন পর।

কায়রোতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিন আলী বিন সুফিয়ানকে ডেকে বললেন, ‘তিন চারদিন যাবত সেনাপতি আলকিন্দির কোন খোঁজ নেই। আমি যখনই তাকে ডেকে পাঠাই তখনি উত্তর আসে, তিনি বাসায় নেই। তার মহলের ভেতর থেকেও উত্তর আসে, তিনি নেই। তবে সে যায় কোথায়? সীমান্ত পরিদর্শনে গেলে, আপনার অনুমতি না নিয়ে যাওয়ার কথা নয়। তাহলে সে গেলো কোথায়?’

আলী বিন সুফিয়ান উত্তর দিলেন, ‘কি বলছেন! তবে কি শত্রুদের সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে ধরা পড়েছে সে!

 ‘ধরা পড়েছে, না নিজেই বিদ্রোহীদের সাথে গিয়ে মিলেছে, কে জানে!’

 ‘এমন সন্দেহ তো কোনদিন হয়নি! আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তার খোঁজখবর নিচ্ছি’।

ওখান থেকে বেরিয়ে আলী বিন সুফিয়ান নিজেই আলকিন্দির বাড়ীতে চলে গেলেন। তার বারোজন বডিগার্ডের সবাই মহলেই ছিল। আলী তাদের কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন,

 ‘সেনাপতি আলকিন্দি কোথায়?’

সে কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না। বডিগার্ডদের জিজ্ঞেস করা হলো, তারাও না জানার ভান করলো। কেউ বলতে পারলো না তিনি কোথায়?

মহলে একজন অতি বৃদ্ধা চাকরানী ছিল, তাকে ডেকে বলা হলো, আলকিন্দির বিবিদের জিজ্ঞেস করে জেনে এসো, আল কিন্দি কোথায় আছে?

বৃদ্ধা চাকরানী তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে নির্জন এক কামরায় বসিয়ে বললো, ‘এ মহল থেকে তার কোন সংবাদ পাবেন না। কেউ বলবে না, তিনি কোথায় আছেন। আমি দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছি, এখানে যেসব কার্যকলাপ চলছে, যা আমি নিজ চোখে দেখেছি, সে সব কথাও আমি আপনাকে বলতে পারছি না’।

আলী বিন সুফিয়ান বৃদ্ধার কথায় রহস্যের গন্ধ পেলেন। অবাক হলেন তিনি। বুঝতে পারলেন, এমন কিছু হচ্ছে এখানে, যার খবর তিনি জানেন না। তিনি বললেন, ‘কিন্তু তোমাকে সব কথাই খুলে বলতে হবে?’

 ‘তাহলে আমার জানের নিরাপত্তা থাকবে না’।

 ‘যদি আমি তোমার নিরাপত্তার জিম্মা নিয়ে নিই?’

 ‘তাহলে আমি এমন সব কথা আপনাকে বলতে পারবো, যা আপনার বিশ্বাস হবে না’।

 ‘কিন্তু তার আগে তুমি বলো, কেন তুমি আমাকে এসব কথা বলতে চাও? তুমি নিজে থেকে আমাকে সতর্ক না করলে আমি তো তোমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করতাম না’।

 ‘দেখুন, আমার স্বামী অনেক দিন হলো মারা গেছেন। একটাই মাত্র সন্তান ছিল, সেও সুদানের যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। বাঁচার তাগিদে আমি এখানে চাকরানী হয়েছি।

এরা আমাকে নিস্ব,গরীব ও অসহায় বলেই জানে। সহজ সরল অসহায় এক বৃদ্ধার সামনে কোন কথাই ওদের মুখে আটকায় না। কিন্তু ওরা এটা চিন্তা করে না, আমি একজন শহীদের মা। এই দেশ, জাতি ও ধর্মের প্রতি আমার স্বামী-সন্তানই কেবল দায়বদ্ধ ছিল না, এক বিশ্বস্ত স্ত্রী ও স্নেহশীল মা হিসাবে আমারও কিছুটা দায়িত্ব আছে। যে দেশ ও ধর্মকে ভালবেসে প্রাণ দিয়েছে ওরা, তার প্রতি আমারও রয়েছে গভীর ভালবাসা ও দায়িত্বের বোধ। দেশ, জাতিও ধর্মের বিরদ্ধে আমি কোন ষড়যন্ত্র ও কথা সহ্য করবো, এটা ওরা কল্পনা করে কিভাবে?

আমার একমাত্র কলিজার টুকরা যে আদর্শের জন্য শহীদ হয়েছে, সে আদর্শের বিরুদ্ধে এ মহলে চলছে গভীর ষড়যন্ত্র। এখানে প্রায়ই সন্দেহজনক লোকজন আসা–যাওয়া করে। আমি এক রাতে একজন লোককে ছদ্মবেশে ভেতরে আসতে দেখলাম। আরবী পোশাক ও নকল দাড়ি নিয়ে লোকটি মহলে প্রবেশ করেছিল। আমাকে ভেতরে ডেকে বললো, ‘শরাব নিয়ে এসো’।

অতিথিরা এলেই মালিকের এক নতুন বেগম শরাব পরিবেশন করে তাদের। এ বেগম মিশরী কি সুদানী বোঝা যায় না।

আমি দেখলাম, দাড়িওয়ালা মেহমান দাড়ি খুলে রেখে মালিকের সাথে মদ পান শুরু করলো। এর আগেও এখানে এ ধরনের লোক আসতে দেখেছি, যাদের দেখলেই সন্দেহজনক মনে হয়। আমার কানে এমন কথাও এসেছে, ‘অর্ধেক মিশর সুদানের আর অর্ধেক তোমার’। মালিক তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ‘সময় হলে এক রাতের মধ্যেই কাজ সমাধা করে ফেলবো’।

 ‘এটা কবেকার কথা?’

 ‘সেনাপতি যে রাতে বের হয়েছেন সে রাতের। তখন তার সাথে ছিল দুই আগন্তুক। বেরনোর সময় আমি রক্ষী কমান্ডারের সাথে সেনাপতিকে কানে কানে কথা বলতে দেখেছি’।

আলী বিন সুফিয়ানের প্রশ্নের জবাবে এমন আরও কিছু তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করলো বৃদ্ধা, আলী বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন, সেনাপতি আলকিন্দিকে কেউ অপহরণ করেনি, হত্যা ও করেনি। আর সে কোন সরকারী কাজেও বাইরে যায়নি, বরং নিজেই এক গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।

মিশরে দুষ্কৃতিকারী ও গাদ্দারদের সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, গুটিকয় বিশ্বস্ত লোক ছাড়া কোন ভদ্র পরিবারকেও সন্দেহ না করে উপায় ছিল না। আলকিন্দি সেই বিশ্বস্ত লোকদের একজন হওয়ায় এতদিন তিনি এদিকে নজর দেননি। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের ভাগ্যটাই এমন, কেমন করে যেন ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে যান তিনি। যেখানেই ষড়যন্ত্র সেখানেই তিনি সময় মত পৌঁছে যান। তারপর তথ্য অনুসন্ধান করে মাথার চুল গায়ের পশম আলাদা করে ফেলেন।

কিন্তু একজন জেনারেলের বাড়ীতে স্বাক্ষী প্রমাণ ছাড়া তল্লাশী চালানো সম্ভব ছিল না। সে জন্য মিশরের পদে অধিষ্ঠিত সুপ্রিম কমান্ড তকিউদ্দিনের অনুমতির প্রয়োজন। তিনি দ্রুত স্পেশাল ব্রাঞ্চের কয়েকজন গোয়েন্দাকে ডেকে আলকিন্দির মহলের আশেপাশে কড়া দৃষ্টি রাখার জন্য গোপনে ওঁৎ পাতার ব্যবস্থা করলেন। তাদেরকে নির্দেশ দিলেন, পুরুষ হোক, নারী হোক, মহলের বাইরে কেউ এলে গোপনে তার অনুসরণ করবে’।

এরপর তিনি আলকিন্দির বডিগার্ড কমান্ডারকে আদেশ দিলেন, ‘নিজের ও সমস্ত রক্ষীদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দাও। আর সবাই আমার সাথে চলো’।

বারোজন রক্ষীকে নিরস্ত্র করে আলী বিন সুফিয়ান তার সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ওদের কারারুদ্ধ করে ছুটে গেলেন দেশের সর্বাধিনায়ক তকউদ্দিনের কাছে। খুলে বললেন সব কথা। তকিউদ্দিন দ্রুত এবং অতর্কিতে আলকিন্দির মহলে তল্লাশী চালাতে আদেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের একটি ক্ষুদ্র দলকে ডাকা হলো তল্লাশী অভিযান চালানোর জন্য।

এদিকে আলকিন্দির মহলে ঘটে গেল এক ভীষণ কাণ্ড। আলী বিন সুফিয়ান মহল থেকে বেরিয়ে যেতেই আলকিন্দির নতুন বিবি চাকরানী কে তার কামরায় ডেকে নিয়ে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আলী বিন সুফিয়ান তোমাকে কি প্রশ্ন করেছেন? আমাকে খুলে বলো, তুমি সে প্রশ্নের কি উত্তর দিয়েছো?’

বৃদ্ধা চাকরানী উত্তরে বললো, ‘তিনি সেনাপতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন, তিনি কোথায়? আমি তাকে বলেছি, আমি গরিব চাকরানী, তিনি কোথায় গেছেন আমি তার কিছুই জানি না’।

 ‘তুমি সবই জানো, তোমার অজানা কিছু নেই’। নতুন বেগম বললো, ‘আর তুমি তাকে অনেক কিছু বলেছো, কারণ অনেক সময় ধরে কথা বলেছো তোমরা। এটুকু কথা বলতে এত সময় লাগার কথা নয়। সত্যি করে বলো, তুমি তাকে কি বলেছো’?

বৃদ্ধা তার দাবীতে অটল থাকলো, কিছুতেই মুখ খুললো না। বেগম এক চাকরকে ডেকে সব কথা তাকে খুলে বললো। তারপর আদেশ দিল, ‘এই অবাঞ্ছিত বৃদ্ধার মুখ থেকে আসল কথা বের করো। আমি নিশ্চিত, সে আলীকে এমন কিছু বলেছে, যা এখন স্বীকার করছে না’।

চাকর বৃদ্ধার মাথার চুল ধরে টান মেরে তাকে নিচে ফেলে দিল। তারপর বৃদ্ধার গলার ওপর পা চেপে ধরে বললো, ‘বল বুড়ি, তুই তাকে কি বলেছিস?

বুড়ির দম বন্ধ হয়ে গেল। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো বাইরে। চাকর গলার ওপর থেকে পা উঠায়ে নিল। বুড়ির তখন উঠে বসার ক্ষমতা আর ছিল না। সে তার অসাড় দেহটি মেঝেতে রেখে তেমনি পড়ে রইলো। চাকর তার কোমরে সজোরে লাথি মারলো। বুড়ি মরার মত গোঙাতে লাগলো। তবুও মুখ না খোলায় চাকর তাকে মারতে লাগলো। মার খেয়ে বুড়ি আধমরা হয়ে গেল।

নতুন বেগম বললো, ‘ওকে একদম জানে মেরে ফেলো’।

এ কথা শুনে বুড়ি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, ‘আমি আমার শহীদ সন্তানের আত্মার সাথে গাদ্দারী করতে পারি না। তোমরা গাদ্দার! তোমরা বেঈমান! তুমি এক বদকার মেয়ে মানুষ!’

‘একে এখান থেকে সরিয়ে নাও! গোপন কামরায় নিয়ে ওকে শেষ করে দাও’। বেগম বললো, রাতে এর লাশ গায়েব করে দেবে। আমাদের সামনে এখন ভয়ানক বিপদ। আলী আমাদের রক্ষীদের নিরস্ত্র করে সঙ্গে নিয়ে গেছে। আমাদের অনেক গোপন কাজের সাক্ষী এই হতভাগী বুড়ি। তাই ওর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। এখনি তাকে হত্যা করে সব গোপন রহস্য মাটির নিচে গোপন করে দাও’।

বুড়ি মেঝের ওপর বেহুশের মত পড়েছিল। যদিও সে পুরোপুরি বেহুশ হয়নি, তখনও তার জ্ঞান ও বুঝার শক্তি কিছুটা হলেও অবশিষ্ট ছিল।

চাকর তাকে কাঁধে উঠিয়ে গোপন কক্ষে নিয়ে যাচ্ছিল! কামরা থেকে বের হয়ে উঠোনে পা দিতেই সহসা আওয়াজ হলো, ‘এই থাম! এক পাও নড়বি না’।

সে চেয়ে দেখলো, সৈন্যরা ছুটে আসছে। সে বোকার মত বুড়িকে কাঁধে নিয়েই ওখানে দাঁড়িয়ে রইলো। আলী বিন সুফিয়ানের আদেশে সৈন্যরা কেউ মহলের মধ্যে, কেউ মহলের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। চাকর পালাবার পথ পেল না।

সৈন্যরা এগিয়ে তার কাঁধ থেকে বুড়িকে নামালো। বুড়ির মুখ থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল। সে চোখ খুলে আলী বিন সুফিয়ান কে সামনে দেখতে পেলো।

তার মুখে ফুটে উঠলো হাসি। বললো, ‘আল্লাহ্‌র শোকর তুমি এসে পড়েছো। এরা যে এতটা ভয়ংকর বুঝতে পারিনি, নইলে আগেই তোমাকে খবর দিতাম’।

‘তোমার এ অবস্থা হলো কি করে?’ বিস্মিত আলী প্রশ্ন করলেন।

তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। অনেক কষ্টে কোন রকমে বললো, ‘নতুন বেগম ও তার চাকর আপনার সাথে আমার কি কথা হয়েছে তা বের করার জন্য আমাকে মেরে এই অবস্থা করেছে’।

আলী বিন সুফিয়ান একজন সৈন্যকে বললো, ‘বুড়িমাকে জলদি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও’।

বুড়ি বাঁধা দিয়ে বললো, ‘আমাকে আর কোথাও পাঠাবেন না, আমি আমার শহীদ বেটার সান্নিধ্যে চলেছি’।

তার জবান বন্ধ হয়ে গেল। এর একটু পরই বৃদ্ধা চির নিদ্রায় ঘুমিয়ে গেল।

আল কিন্দির মহলের প্রতিটি কামরায় তন্ন তন্ন করে তল্লাশী চালানো হলো। গোপন কামরায় পাওয়া গেল অস্ত্রের ভাণ্ডার। প্রচুর সোনার ইট ও কাড়ি কাড়ি নগদ টাকা পয়সা পাওয়া গেল মহলের মধ্যে রক্ষিত সিন্দুকে।

আরো পাওয়া গেল অনেক নতুন মুদ্রা, যার ওপর মিশরের সুলতান হিসাবে আলকিন্দির নাম খোদাই কড়া ছিল।

আলকিন্দি বিজয়ের ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে, সে তার নামে মুদ্রা পর্যন্ত তৈরী করে ফেলেছিল। এই মুদ্রাই তার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে সত্য প্রমাণ করলো।

আলকিন্দির মহলে পাওয়া গেল ছয় জন রুপসী নারী, তারা সবাই নিজেদেরকে আলকিন্দির বেগম বলে পরিচয় দিল। পাওয়া গেলো কাড়ি কাড়ি মদের বোতল। মনে হচ্ছিল মদের একটা আস্ত ডিপো এখানে। আল কিন্দি সম্পর্কে সবার ধারনা ছিল, তিনি শরাব পান করেন না। কিন্তু এখন তার মহলে শরাবের ছড়াছড়ি দেখে প্রমাণ হলো, তিনি রাতে মদ পান করতেন।

আলী বিন সুফিয়ান তার বিবিদের আলাদা আলাদা জবানবন্দী নিলেন। তাদের কথা থেকে অনেক নতুন ও প্রয়োজনীয় তথ্য বেরিয়ে এলো।

সব শেষে জবানবন্দী দেয়ার পালা ছোট বেগমের। এই বেগমই তার চাকর দিয়ে বুড়িকে হত্যা করেছে। অন্যান্য বিবিরা সবাই এক বাক্যে বলেছে, সব ষড়যন্ত্রের হোতা ছোট বেগম। সকল গোপন তথ্য একমাত্র সেই জানে। তার সম্পর্কে আরও বলেছে, তার ভাষা মিশরী নয়, সুদানী। বাইরের কোন মেহমান এলে, তাদের সঙ্গে উঠাবসা ও কথাবার্তা একমাত্র সেই বলতো। সে তাদের সাথে একত্রে বসে মদও পান করতো।

নতুন বেগমকে আগেই পৃথক করে রাখা হয়েছিল। বৃদ্ধাকে হত্যার আসামী চাকরকে আলী বিন সুফিয়ান সতর্ক করে বললেন, ‘এখন কোন কিছু গোপন করতে চেষ্টা করো না’।

চাকর ভাল মতই জানতো, যদি সে কিছু না বলে তবে তার ওপর কেমন শাস্তি ও কেয়ামত শুরু হয়ে যাবে। সে কারনে সে তার অপরাধ লুকানোর চেষ্টা করলো না। বললো, ‘আমি শুধু হুকুমের দাস। আমাকে পুরুস্কারের লোভ দেখানো হলে আমি তা সামলাতে পারিনি’।

আলী বিন সুফিয়ান কে সে আরো জনালো, ‘সুদানীদের সাথে আলকিন্দির যোগাযোগ অনেকদিন থেকে। সেদিনও তিনি তাদের সাথে গেছেন। যাওয়ার সময় সাহেব বলে গেছেন, তিনি অনেক দিন পরে আসবেন। আর বলেছেন তার এ অনুপস্থিতির কথা যতদূর সম্ভব গোপন রাখতে। কিন্তু সাহেব কোথায় গেছেন আমি জানি না’।

নতুন বেগমকে আলী বিন সুফিয়ান তাঁর দুই কমান্দোর সাথে নির্যাতন সেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখানকার অনুসন্ধান শেষ করে আলকিন্দির মহলে কড়া পাহারা বসিয়ে তিনি ফিরে এলেন তাঁর কার্যালয়ে। প্রথমে গেলেন আলকিন্দির নিরস্ত্র বডিগার্ডের কাছে। সবাইকে একত্রিত করে বললেন,

 ‘তোমরা মিশর সেনাবাহিনীর সদস্য। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করা তোমাদের দায়িত্ব। আলকিন্দি তোমাদের দায়িত্বশীল ছিলেন। তার হুকুম পালন করতে তোমরা বাধ্য ছিলে। সুতরাং তার নির্দেশে তোমরা যা করেছো সে জন্য তোমরা দায়ী নও। কিন্তু এখন আমি যে সব প্রশ্ন করবো তার কোন ভুল জবাব দিলে বা কোন তথ্য গোপন করলে সে অপরাধের কোন ক্ষমা পাবে না। আর এ অপরাধের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’।

প্রথমেই তিনি বডিগার্ডদের কমান্ডারকে সামনে ডাকলেন। বললেন, ‘আলকিন্দির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যা জানো, সব খুলে বলো’।

কমান্ডার যা বললো তাতে আলকিন্দির ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হয়ে গেল। সে স্বীকার করলো, আলকিন্দির কাছে খৃষ্টান ও সুদানীরা আসা-যাওয়া করতো। আলকিন্দি যে গাদ্দারীর পথ অবলম্বন করেছে, তাও তারা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আলকিন্দি এখন কোথায় গেছে তা তার জানা নেই।

মধ্য রাতে আলী বিন সুফিয়ান সেই গোপন কক্ষে গেলেন, যেখানে আল কিন্দির নতুন বেগম সংকীর্ণ এক কুঠরীতে বন্দী ছিল। তাকে আতংকগ্রস্থ করার জন্য সে কুঠরীতে এমন এক কয়েদী এনে রেখেছিল, যে অনবরত কষ্টে ছটফট করছে, মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। এ কয়েদি খৃষ্টানদের গোয়েন্দা ছিল। সে তর সঙ্গীদের নাম ঠিকানা দেয়নি বলে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। নতুন বেগম রাত দ্বি-প্রহর পর্যন্ত তার সাথেই কাটিয়েছে। তার মৃত্যু যন্ত্রনার ছটফটানি দেখেছে।

মধ্য রাতও পার হয়ে গেল। নতুন বেগম শান শওকত ও প্রাচুর্যে মানুষ হয়েছে, এই গোপন সংকীর্ণ কুঠরীতে দুর্গন্ধ ও বিভৎস দৃশ্য তার প্রায় পাগলিনী হবার উপক্রম। কয়েদির শাস্তি দেখে তার রক্ত শুকিয়ে গিয়েছিল।আলী বিন সুফিয়ান তার সামনে উপস্থিত হলেন।

তাকে দেখেই ভয়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল ছোট বেগম। আলী তাকে সেখান থেকে সরিয়ে অন্য এক কামরায় নিয়ে গেল। আগের চাইতেও দেখতে ভয়াবহ এ কুঠরী। সামনে লোহার মোটা গরাদ। ভেতরে এক কালো কুৎসিত নিগ্রো হাবশী বন্দী। তার চেহারা ভয়ংকর মহিষের মত। সে সীমান্তে এক কমান্ডারকে হত্যা করেছিল ।

আলী বিন সুফিয়ান তাকে বললো, ‘অবশিষ্ট অর্ধেক রাত এর সঙ্গেই কাটাতে হবে তোমাকে’।

বেগম চিৎকার দিয়ে আলী বিন সুফিয়ানের পায়ের ওপর আছড়ে পড়লো।

 ‘তুমি আমাকে কি প্রশ্ন করবে বলো, আমি সব বলে দিচ্ছি’। বেগম আলী বিন সুফিয়ানের পা আঁকড়ে ধরে বললো।

 ‘তোমার স্বামী আল কিন্দি কোথায় গেছে, কেন গেছে, কি তার উদ্দেশ্য, সব খুলে বলবে? আর যা বলবে সব সত্যি বলবে?’ আলী বিন সুফিয়ান প্রশ্ন করলেন।

সে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘বলবো ,সব বলবো। আমি যা জানি সব বলবো!’

এরপর সে ভয়ে গড়গড় করে অনেক কথাই বললো, কিন্তু আলকিন্দি কোথায় গেছে তা সেও বলতে পারলো না। তবে সে এমন কিছু তথ্য দিল, যা সত্যি গুরুত্বপূর্ণ । সে বললো, ‘সুদান থেকে বহু হাবশী সৈন্য মিশরে ঢুকানো হয়ে গেছে। এখন যে কোন মুহূর্তে রাতের আঁধারে ওরা অতর্কিতে কায়রো আক্রমন করে মিশর দখল করার সপ্ন দেখছে। সম্ভবত চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করতেই এবার তিনি বাইরে গেছেন’।

আল কিন্দির বাসায় খৃষ্টান ও সুদানীদের নিয়ে যতো গোপন বৈঠক সে সব বৈঠকে খাদ্য ও পানীয় পরিবেশনের দায়িত্ব ছিল তার। স্বদেশী হিসাবে তাদের সাথে ছিল তার গভীর সখ্যতা। সে মেহমানদের সাথে নিঃসংকোচে মিশতো, তাদের সাথে কথা বলতো আর আলকিন্দিও গোপন শলাপরামর্শের সময় তাকে সরিয়ে দেবার প্রয়োজন বোধ করতো না।

এ মেয়ে ছিল সুদানের ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান। সুদানীরা তাকে আলকিন্দির কাছে উপহার স্বরুপ পাঠিয়েছিল। পরে আল কিন্দি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

মেয়েটি ছিল বেশ চালাক চতুর আর হুশিয়ার। সে সুদানের উদ্দেশ্য খুব ভালমতই জানতো। একজন সুদানী হিসাবে সুদানীদের স্বার্থ রক্ষা করাকে সে নিজের দায়িত্ব মনে করতো।

সে আরো প্রচুর নগদ সোনাদানা ও ধন রত্নের সন্ধান দেয়। এসব ধন সম্পদ সুদানীরা তাকে দিয়েছিল যুদ্ধের খরচ মিটানো ও গাদ্দারদের খরিদ করার জন্য। এ মেয়ে জানতো, হাবশী সৈন্যরা কোথায় লুকিয়ে আছে।

সে আলী বিন সুফিয়ানকে বললো, ‘হাবশী সৈন্যরা নীলনদ পাড়ি দিয়ে আপনাদের সীমান্ত চৌকির পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে ‘সামেন’ পাহাড় শ্রেণীর আড়ালে লুকিয়ে আছে’।

আলী বিন সুফিয়ান তকিউদ্দিনকে বিস্তারিত রিপোর্ট দান করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি সৈন্যদের দু’জন, চারজন করে ছোট ছোট দলে ভাগ করে শত্রুর তৎপরতা লক্ষ্য করার জন্য তাদেরকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলেন। সীমান্ত থেকে কায়রো পৌঁছার রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লো তারা।

তিনি সৈন্যদের বললেন, ‘এরই মধ্যে সুদানীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পথচারীর বেশে হয়তো অনেকেই কায়রো বা তার আশেপাশে এসে অবস্থান নিয়েছে। সুদানী সৈন্যদের এসব আড্ডা কোথায় তা খুঁজে বের করো’।

আলী বিন সুফিয়ান এ খবর সুলতান আইয়ুবীকে জানানোর কথা চিন্তা করছিলেন, কিন্তু তকিউদ্দিন বললেন, ‘তার কোন দরকার নেই। কারণ এতে তিনি শুধু পেরেশান হবেন, বাস্তবে কোন উপকার করতে পারবেন না’।

এ কথায় আলী স্বস্তি পেলেন না, তার আশঙ্কা হলো, অবস্থা বেশ জটিল ও খারাপ হয়ে যেতে পারে। তিনি তকিউদ্দিনকে পরিস্থিতির গুরত্ব বুঝানোর চেষ্টা করলেন। আলীর উপর্যুপরি চাপে শেষ পর্যন্ত তকিউদ্দিন রাজি হলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, এত করে যখন বলছেন তখন কাউকে পাঠিয়ে দিন’।

অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথেই আলী সামগ্রিক অবস্থার পুর্ণ বিবরন লিখে এক ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারকে চার বডিগার্ডসহ জরুরী ভিত্তিতে পাঠিয়ে দিলেন। তাদেরকে বলে দিলেন,

 ‘দ্রুত সুলতানের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে প্রত্যেক ফাঁড়ি থেকে ঘোড়া বদল করে নেবে। যতটা সম্ভব কম বিশ্রাম নিয়ে বিরতিহীন ভাবে পথ চলবে’।

যুদ্ধের সময় সুলতান আইয়ুবীর হেড কোয়ার্টার কোন এক জায়গায় নির্দিষ্ট থাকে না। ক্রমাগত জায়গা বদল করেন তিনি। দেখা গেল দিনে এক জায়গায়, রাতে অন্য জায়গায় তার ক্যাম্প সরিয়ে নিয়েছেন। ফলে শত্রুরা সহজে তার নাগাল পেতো না । কিন্তু নিজের বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য তিনি এমন ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, মুহূর্তে ময়দানের সব খবর পৌঁছে যেতো তার কাছে। আবার তিনি কোন সংবাদ পৌঁছাতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই তা পৌঁছে দিতে পারতেন যে কোন জায়গায়। এই ব্যবস্থার ফলে সুলতানের কাছে পৌঁছতে বার্তা বাহকদের কোনই অসুবিধা হতো না ।

কায়রো থেকে রওনা দেয়ার তিন দিন পর।

সুলতানের জন্য আলীর দেয়া চিঠি নিয়ে সেনা কমান্ডার দামেশকে পৌঁছলেন। সুলতান আইয়ুবী তখন আর রিস্তানের পর্বতশৃঙ্গে সম্রাট রিমান্ডের ফিরতি বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছেন।

ঠাণ্ডা একটু বেশিই পড়ছে আজ। তুষারপাত হচ্ছে, বরফ জমেছে পাহাড়ে। সুলতান ও তাঁর সৈন্যরা এরই মাঝে ওঁৎ পেতে বসে আছে।

কায়রো থেকে দামেশক পৌঁছার পথে সেনা অফিসার ও তার রক্ষীরা বলতে গেলে কোথাও তেমন বিশ্রাম নেয়নি। শীতের ঠাণ্ডা ছোট্ট দিন ও দীর্ঘ হিমেল রাতের অধিকাংশ সময় তাদের কেটেছে পথে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে।

দামেশকে যখন পৌঁছলো তখন তাদের জিহবা বেরিয়ে এসেছে, মাথা ঘুরছে, ঘোড়া থেকে পড়ে যায় অবস্থা। তারা দ্রত আইয়ুবীর কাছে পৌঁছতে চাচ্ছিল। দামেশকের কমান্ডার তাদেরকে জোর করে ধরে পানাহার করিয়ে ‘আর রিস্তানের’ পথ দেখিয়ে দিল।

 আল মালেকুস সালেহকে সাহায্য করতে আসা ত্রিপলীর খৃষ্টান রাজা রিমান্দ-এর ফিরতি পথে সুলতান আইয়ুবী ওঁৎ পেতে বসে থাকায় তিনি অন্যপথে সেখান থেকে বেরিয়ে দেশে ফিরে গেলেন। সুলতান খবর পেয়েও রিমান্ডকে ধাওয়া করলেন না।

 তিনি রিমান্ডের জন্য রসদপত্র নিয়ে আসা কাফেলার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। রিমান্ড যে ফিরে গেছে এ খবর তারা জানতো না। তারা অপেক্ষা করছিল, রিমান্ড এসে সুলতানের বাঁধা অপসারণ করে তাদের অগ্রযাত্রার পথ নিষ্কণ্টক করবে। কিন্তু কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও রিমান্ডের বাহিনীর কোন তৎপরতা দেখতে না পেয়ে তারা ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিল। সুলতান আইয়ুবী রিমান্ডের ফিরতি পথে ধাওয়া না করে তার রসদপত্র ও মালসামান দখল বা ধ্বংস করার জন্য একদল কমান্ডোকে পাঠালেন।

 শীতকালের বিচ্ছিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। খৃষ্টানদের রসদ সম্ভারের কাফেলা ছিল বিশাল। রাতের বেলা। কাফেলার লোকজন ও প্রহরীরা ঠাণ্ডা বাতাস ও বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য রসদ বোজাই ঘোড়াগাড়ীর নিচে আশ্রয় নিল। কমান্ডার বললো,

 ‘রাতটা কাটুক, কাল ভোরেই আমরা ফিরতি পথ ধরবো’।

 প্রহরী ও লোকজন ঘোড়াগাড়ীর নিচে ঘুমিয়েছিল। তারা জানতো না, দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই পাহাড়ের আড়াল থেকে কতকগুলো চোখ তাদের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখছে। রাতের আঁধারে এই কনকনে ঠাণ্ডা, শীত ও বৃষ্টির মধ্যে কেউ তাদের উপর আক্রমন করবে, এমনটি তারা আশা করেনি।

 মধ্য রাতের একটু পর। সহসা তাদের রসদ ক্যাম্পে খুব শোরগোল শোনা গেল। দেখা গেল, চারদিকে মশালের আলো। তাবু জ্বলছে।

 সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ওপর। প্রথমে তারা ছোট মেনজানিক দিয়ে পেট্রোল ভেজা সলতে লাগানো অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করলো। সেই শিখার আলোতে তারা শুরু করলো তীর নিক্ষেপ। পাহাড়ের কোলে একদল দাঁড়িয়ে রইলো বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে। তাবুতে আগুন লাগায় এবং রাতের অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমনে পড়ে ভয়ে বহু খৃষ্টান প্রহরী ও লোকজন ছুটলো পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে লুকানোর জন্য। পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। এ আক্রমণে বহু প্রহরী হতাহত হলো। বাকীরা প্রাণ নিয়ে ফিরে গেল ময়দানে।পাহাড় থেকে তীর বর্ষণের ধারা অব্যাহত রইল। ময়দানে ফিরে গিয়েও তাই নিস্তার পেল না ওরা। বাধ্য হয়ে মালসামান ও গাড়ি ঘোড়ার আড়াল নিয়ে কেউ কেউ পাল্টা তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো।

 রাতভর চললো এ লড়াই। সকালে দেখা গেল, দেড় দুই মাইলের মধ্যে ছড়ানো ক্যাম্পে পোড়া তাবু, আধপোড়া রসদপত্র, বহু লাশ ও আহত লোক পড়ে আছে। লড়াই করার মত কেউ আর নেই সেখানে।

 এ যুদ্ধে অগ্নি গোলার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া বিপুল পরিমান রসদ, ঘোড়া ও ঘোড়াগাড়ী সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের হস্তগত হলো।

 হলবের অবরোধ উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। সুলতান সেই গুরুত্বপূর্ণ শহরকে আরেকবার অবরোধ করার পরিকল্পনা করলেন।

 পরদিন ভোরে কমান্ডো গ্রুপের কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীকে যখন গত রাতের আক্রমনের রিপোর্ট দিচ্ছিল তখন তাবুতে প্রবেশ করলো এক প্রহরী। সালাম দিয়ে সুলতানকে বললো,

 ‘কায়রো থেকে একজন ফৌজি অফিসার এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে এসেছেন তিনি। অবিলম্বে আপনার সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি চাচ্ছেন’।

 ‘কি নাম তার?’

 প্রহরী অফিসারের নাম বলতেই সুলতান আইয়ুবী দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন এবং ত্রস্ত পায়ে বাইরে যেতে যেতে বললেন, ‘ কই সে?’

 খীমার বাইরে দাঁড়িয়েছিল অফিসার। সুলতানকে দেখেই সে সালাম দিল। সুলতান বললেন,

 ‘ কি খবর আরমান? তুমি কি সংবাদ নিয়ে এসেছো! সবকিছু ভাল তো?’

 ‘খবর খুবই গুরুত্বপূর্ণ’। কমান্ডার বললো, আল্লাহ পাক আমাদের হেফাজত করুন। আলী বিন সুফিয়ান এই চিঠি দিয়েছেন আপনার জন্য’।

 সুলতান দ্রুত হাত বাড়িয়ে চিঠি নিলেন এবং কমান্ডারকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। চিঠি পড়া শেষ করে সুলতান গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে গেলেন।

 ‘এখনও জানা যায়নি, সুদানী সৈন্যরা মিশরের কোথায় আত্মগোপন করে আছে?’ সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।

 ‘তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্য চারদিকে সৈন্য পাঠানো হয়েছে। সীমান্তবর্তী পাহাড়ী অঞ্চলেও সৈন্য প্রেরন করা হয়েছে। আলকিন্দির বেগমের ভাষ্যমতে নীলনদ পার হয়ে হাবশী সৈন্যরা দুর্গম অঞ্চলেই তাদের ঘাঁটি বানিয়েছে বলে মনে হয়’। কমান্ডার উত্তর দিল।

 ‘আমার আশংকা ছিল, আমার অনুপস্থিতিতে কোন না কোন একটা বিশৃঙ্খলা ঘটবেই’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তকিউদ্দিনকে বলবে, সে যেন ভীত না হয়। কায়রোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেন আরও শক্তিশালী করে’।

 সামান্য বিরতি নিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘শুধু প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতিই এর জন্য যথেষ্ট নয়। তাকে বলবে, সুদক্ষ একদল সৈন্যবাহিনী নিজের কাছে রেখে বাকী সেনা সদস্যদের যেন পাল্টা আক্রমন করার জন্য পৃথক করে ফেলে। তারা শহরেই থাকবে এবং আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ ও প্রতি আক্রমন করবে। এরা যেন বেশী নড়া চড়া না করে এবং শহরের মধ্যে যদ্ধের প্রস্তুতি জাহির না করে। যেন শত্রুরা মনে করে আমাদের ফৌজ অপ্রস্তুত এবং তারা আক্রমন করলে সহজেই শহর দখল করতে পারবে।

 শহরের বাইরের সেনা ছাউনিতে সৈন্যরা প্রস্তুত থাকবে। শত্রুদের দেখতে পেলেই আক্রমন করবে তাদের। কিছুতেই ওদের শহর অবরোধ করার সুযোগ দেবে না। অবরোধ করার আগেই পাল্টা আক্রমন করে বিতাড়িত করবে।

 সবচেয়ে ভাল হয় শত্রুদের আড্ডা খুঁজে পেলে। যদি শত্রুদের আড্ডার সন্ধান পাও তবে অল্প সৈন্য নিয়ে কমান্ডো আক্রমনের মাধ্যমে ওদের ধ্বংস করে দেবে।

 সীমান্তে সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে বলবে, যাতে শত্রু সৈন্য পালাতে ও প্রবেশ করতে না পারে। আমি ভেবে পাচ্ছিনা, এত সৈন্য সীমান্তে সশস্ত্র প্রহরায় থাকতে কেমন করে সুদানী সৈন্য মিশরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। কোন না কোন সীমান্ত ফাঁড়িতে ত্রুটি ও অবহেলা আছে। নইলে এমন হওয়া সম্ভব নয়। আলীকে বলবে, সে যেন ওই ফাঁক খুঁজে বের করে। আল্লাহ্‌ তোমাদের সফলতা দান করুন।

 আরেকটি কথা, শত্রু সৈন্যরা খাদ্য ও সাহায্য ছাড়া যুদ্ধ করতে পারবে না। সীমান্তকে কঠোরভাবে সিল করে রাখবে। ব্যাপকভাবে যুদ্ধ বেঁধে গেলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করবে। তাতে শত্রুরা ক্ষুধায় মারা যাবে। খাদ্য এমন এক অস্ত্র, যার সাথে অন্য কোন অস্ত্রের তুলনাই হয় না।

 অধিক সৈন্যের সাথে অধিক সৈন্য নিয়ে সামনাসামনি যুদ্ধ করা মোটেই উচিৎ হবে না।

 আমার ধারনা ছিল না, আল কিন্দি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তবুও আমি আশ্চর্য হচ্ছি না, বিশ্বাসঘাতকতা ও বেইমানী করতে কোন সময় লাগে না। ক্ষমতা ও নেতৃত্বের লোভ এমন এক সাপ, যে সাপের ছোবল খেলে মুহূর্তে মানুষের ঈমান মারা যায়। ন্যায়-অন্যায় বোধ নিঃশেষ হয়ে সেখানে জন্ম নেয় প্রবল স্বার্থপরতা। এই লোভ এক ভয়ংকর জিনিস। এই সাপ ততক্ষণ মানুস্কে দংশন করতে পারে না, যতক্ষণ কোরআনের আলোকে আলোকিত থাকে কারো হৃদয়। যখন মানুষ কুরআনকে বন্ধ করে নিজের বুদ্ধি বিবেক অনুযায়ী চলতে চায় তখন এমনি হাজারো ভ্রান্তির সাপ ছোবল হানে তার মগজে।

 সবচেয়ে আফসোসের বিষয় কি জানো! কেউ একবার লোভের কবলে পড়ে বেঈমান হয়ে গেলে, কোরআনের খোলা পৃষ্ঠাও আর তাকে হেদায়াত দান করে না। সে তখন কোরআন হাতে নিয়েও ইসলামের অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এসব গাদ্দাররা কোরআন হাতে নিয়ে যখন মানুষকে প্রতারিত করে তখনও আল্লাহ্‌র ভয়ে, পরকালের ভয়ে তার হৃদয় কাপে না।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top