১২. গোপন বিদ্রোহী

 আল কিন্দির জন্য আমার বড় আফসোস হচ্ছে। ইসলামের ভবিষ্যত নিয়েও আমি খুবই পেরেশান। আমাদের ভাইয়েরা আজ সামান্য সুখ সুবিধার জন্য খৃষ্টানদের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সাধারন মুসলমানদের এক বিরাট অংশের মধ্যে কোন চেতনাই নাই। তারা নামাজ পড়ে, রোজা করে অথচ এদিকে যে ইসলামের বারোটা বেজে যাচ্ছে সে খেয়ালই নেই তাদের। ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষায় তাদেরও কিছু করণীয় থাকতে পারে, এ অনুভূতিটুকু যদি ওদের থাকতো তবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

 অন্যদিকে আছে ইসলামের মুখোশধারীদের দল। তারা রাতভর গাছের গোঁড়া কাটে, দিনভর পানি ঢালে সে গাছের গোঁড়ায়। একদিকে ইসলামের বারোটা বাজানোর জন্য শত্রুর ক্রীয়নক হয়ে কাজ করে, অন্যদিকে ভাব দেখায় তারা ইসলামের খুব ভক্ত। লোক দেখনো হাজী হয়, মাজারে সিজদা দিয়ে পড়ে থাকে আর সমস্ত অনৈতিক ও অপকর্মের নেতৃত্ব দিয়ে সমাজে সৃষ্টি করে ফেতনা ফাসাদ।

 আজ আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে আমাদের ভাইদের বিরদ্ধে। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ, কিন্তু এই ফেতনার বিরুদ্ধে লড়াই করা সত্যি খুব কঠিন। খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে ডাক দিলে সমাজের প্রতিটি সচেতন মানুষ সে ডাকে সাড়া দেবে, কিন্তু আলকিন্দির বিরুদ্ধে যখন লড়াই করবে তখন ডাক দিলে দেখবে, কিছু মুসলমানের সমর্থন সেও পাবে। কারণ, সে তো আর কাফের নয়! কিন্তু তার এ বিদ্রোহ যে ইসলামের ধ্বংস ও বিনাশ ডেকে আনছে সে কথা অনেকেই বুঝতে পারবে না।

 আমাদের নেতা ও সরদার সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গী এ দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। আমিও শীঘ্রই দুনিয়া থকে বিদায় নেব। তারপর কি হবে? এ প্রশ্নই আমাকে অধীর করে তুলছে।

 একটি কথা সব সময় স্মরণ রাখবে, যতক্ষণ বেঁচে থাকবো ইসলামের জন্যই বেঁচে থাকবো, আর মরতে হলেও ইসলামের জন্যই মরবো, এই আমাদের শপথ, এই আমাদের পণ। এ শপথের কথা কখনো বিস্মৃত হয়ো না। নিয়মিত সব সংবাদ আমাকে পৌঁছে দিও। আল্লাহ্‌ তোমাদের সহায় হোন’। আলীর পাঠানো সামরিক অফিসার সুলতানের উপদেশ ও নির্দেশ নিয়ে বিদায় নিলেন।

 মিশরের সৈন্যরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা হন্য হয়ে খুঁজে ফিরছিল শত্রুদের আড্ডা। তারা কায়রোর আশেপাশে শত্রুদের খোঁজে ফিরছে,সে সময় তাদের সীমান্ত ফাঁড়ির কমান্ডার শত্রুদের হাতে বন্দী, তার সঙ্গে বন্দী জোহরা নামের এক মেয়ে।

 কয়েকদিন ধরে কমান্ডার নিখোঁজ। সহকারী কমান্ডার চিন্তায় পড়ে গেল। পাশের ফাঁড়ি ও আশেপাশে খোঁজ খবর করে কোনই হদিশ পেল না। এভাবে কাউকে কিছু না বলে কমান্ডার উধাও হয়ে যাওয়া কোন সাধারন ঘটনা নয়। সহকারী কমান্ডার দ্রুত এক সিপাইকে এ খবর দিয়ে কায়রো পাঠিয়ে দিল।

 কাসেদ কায়রো গিয়ে জানালো, ‘আমাদের ফাঁড়ির কমান্ডার কয়েকদিন যাবৎ নিখোঁজ রয়েছেন’। সে আরো জানালো, ‘কিছুদিন আগে আমাদের ফাঁড়িতে নাচ গানের আসর বসেছিল। এক নর্তকী কমান্ডারের তাবুতে রাত কাটায়। তারপর পাশের ফাঁড়িতেও তারা নাচ গানের আসর বসায়। সেখানে মেহমান হিসাবে গিয়েছিল আমাদের কমান্ডার।

 এরপরও দুই রাত সেই নর্তকী আমাদের কমান্ডারের ওখানে আসে। সেই নরতকীর সাথে এক রাতে কমান্ডার বেরিয়ে যায়, কিন্তু আর ফিরে আসেনি। কয়েকদিন হয়ে গেলো, কমান্ডারের কোন খোঁজ না পেয়ে সহকারী কমান্ডার আমাকে এ খবর দিয়ে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছে’।

 এ সংবাদে সবার সন্দেহ হলো, নিশ্চয় কমান্ডার শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়েছে আর তারই সাহায্যে শত্রুরা মিশরে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছে।

 আলী বিন সুফিয়ান বললো, ‘যেহেতু ফাঁড়িটি নদী পথ পাহারা দেয়ার জন্যই খোলা হয়েছে, এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শত্রুরা নদী পথে জমা হয়েছে’।

 সিদ্ধান্ত হলো, কোন এক দূরদর্শী ও চালাক কমান্ডারকে সেখানে পাঠানো হবে। তার সাথে যাবে একটি রক্ষী দল। ওরাই ওখানকার সীমান্ত পাহারার দায়িত্ব পালন করবে।

 কমান্ডার ও জোহরাকে হাবশীদের ধর্মীয় নেতার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। কার্যত তারা বন্দী থাকলেও ধর্মীয় নেতা তাদের সাথে খুবই সদয় ব্যবহার করছিল। হাবশীদের ব্যবহারে তারা যে বন্দী টা বুঝা যাচ্ছিল না।

 তাদের পাখীর রং-বেরংয়ের পালকে সজানো পোশাক পরতে দেয়া হলো। ফুল ও পালক দিয়ে সাজানো হলো তাদের কামরাটি। উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হতো তাদের। হাবশীদের নেতা তাদের সামনে সিজদায় পড়ে গিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পাঠ করতো। সাধারন হাবশীদের কোন সুযোগ ছিল না তাদের সামনে আসার।

 একদিন তাদেরকে গাছের ডাল-পাতা দিয়ে বানানো পালকিতে করে নদীতে গোছল করাতে নিয়ে গেল। দু’জনই জানতো, কেন তাদের এত আদর যত্ন করা হচ্ছে। কিন্তু কবে তাদের ‘বলী’ দেয়া হবে এটা তাদের জানা ছিল না।

 রাতে যখন তারা নির্জন কামরায় ঘুমিয়ে থাকতো তখনো বাইরে আট দশজন হাবশী পাহারায় থাকতো সে কামরার। কমান্ডার রাতে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখতো পালানোর কোন সুযোগ আছে কিনা। কিন্তু যতবারই সে বাইরে তাকিয়েছে ততবারই একরাশ হতাশা তার সব আশা আকাঙ্ক্ষা গুড়িয়ে দিয়েছে। পালানোর কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা মোটেই ছিল না সেখানে।

 এক রাতে হাবশীদের দু’জন ধর্মীয় নেতা কামরায় প্রবেশ করলো। কমান্ডার ও জোহরা দু’জনই তখন গভীর ঘুমে বিভোর। তাদেরকে ঘুম থেকে জাগানো হলো। তারা বুঝতে পারলো, তাদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে।

 ধর্মীয় নেতারা তাদের সামনে সিজদায় পড়ে গেল। সিজদা থেকে উঠে তাদেরকে নিয়ে গেল বাইরে। বাইরে দুটো সুসজ্জিত পালকি রাখা। ধর্মীয় নেতারা এক পালকিতে কমান্ডার ও ওপর পালকিতে জোহরাকে বসিয়ে দিল।

 চার বেহারার পালকি। কমান্ডার ও জোহরা পালকিতে চড়ে বসতেই বেহারারা গুন গুন করে গান গাচ্ছিল। প্রতিটি পালকির পেছনেই বর্শা হাতে চলছে দু’জন করে হাবশী প্রহরী।

 কমান্ডার ও জোহরা একদম নীরব। সুবোধ বালকের মত ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশ মেনে চলছে।

 পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে পালকি যাচ্ছিল নদীর দিকে। কমান্ডার দেখলো, আকাশের চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। বুঝলো, অর্ধেকের বেশী পার হয়ে গেছে রাত।

 নদীর পাড়ে গিয়ে বেহারারা পালকি নামালো। ধর্মীয় নেতা পালকি থেকে কমান্ডার ও জোহরাকে নামিয়ে তাদের পোশাক পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবাইকে নির্দেশ দিল, ‘পোশাক পাল্টাবার সময় কেউ ওদের দিকে তাকাবে না’।

 চাঁদের আলোয় কমান্ডার দেখলো, বর্শাধারী দুই রক্ষী ও পালকির হাবশী বেহারারা তাদের দিকে পিছন ফিরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মীয় নেতার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে তারা।

 এই সুযোগ, কমান্ডার বাঘের মত লাফিয়ে চোখের পলকে এক হাবশীর বর্শা কেড়ে নিয়ে সেই বর্শা তার বুকে বিদ্ধ করলো। তারপর মুহূর্তের মধ্যেই টা টেনে বের করে আঘাত করলো পাশের বর্শাধারীকে।

 মুহূর্তের মধ্যে দুই প্রহরী ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। এরপর কমান্ডার জোহরার রক্ষীদের একজনকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল বর্শা। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘জোহরা, পালাও’।

 ঘটনা এত আকস্মিক অ অভাবিত ছিল যে, কেউ এরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। কমান্ডারের আচরণ ছিল খুবই স্বাভাবিক, হাবশীরা ধারনা ও করতে পারেনি, সে এমন মারমুখী হয়ে যাবে। তাই তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই সে তিনজন প্রহরীকে ধরাশায়ী করে অন্য একটি বর্শা কুড়িয়ে নিতে গেল। একজন দক্ষ সৈনিক ও কমান্ডারের দক্ষতা, ক্ষীপ্রতা, সাহসিকতা ও বুদ্ধির দীপ্তি প্রকাশ পাচ্ছিল তার প্রতিটি নড়াচড়ায়।

 কমান্ডারের চিৎকার শুনেই জোহরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তার দিকে। একই সাথে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল অন্য সবাই। বর্শাধারী বর্শা উঁচিয়ে ছুটে গেল কমান্ডারকে আঘাত করতে। জোহরা তার পাশে পড়ে যাওয়া প্রহরীর বর্শা তুলে নিয়ে ছুটল প্রহরীর পেছনে। কমান্ডার বর্শা উঠিয়েই দেখতে পেল ওদের। সে হাতের বর্শা দিয়ে ঠেকিয়ে দিল প্রহরীর আঘাত। প্রহরী দ্বিতীয়বার আঘাত করার করার সুযোগ পেল না, জোহরার হাতের বর্শা প্রহরীর পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

 কমান্ডার বললো, ‘সাবাশ জোহরা সাবাশ! বর্শা হাতে তোমাকে এক মহীয়সী যোদ্ধার মতই লাগছে’।

 যদিও ওরা মাত্র দু’জন এবং প্রতিপক্ষে এখনো দশজন জীবিত, কিন্তু ওই দশজনই নিরস্ত্র। অস্ত্রধারী চার প্রহরীর করুন মৃত্যুর বিভীষিকা তাদের চোখে মুখে।

 ধর্মগুরু দু’জন চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ দেবতার দোহাই! ওদের পালাতে দিওনা। ধরো, ধরো ওদের!’

 কিন্তু ওই চিৎকার পর্যন্তই, তারা নিজেরাও এগিয়ে এলো না, আর তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বেহারারাও এগিয়ে এলো না। একদিকে খালি হাতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দশজন নিরস্ত্র মানুষ, অন্যদিকে বর্শা উঁচিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরুষ ও এক নারী।

 কেউ কারো দিকে এগিয়ে গেল না, নিরাপদ দুরত্বে দুই দল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

 কয়েকটি নিস্তব্ধ মুহূর্ত পার হলো ঘটনাবিহীন। হঠাৎ হাবশীদের ধর্মীয় দুই নেতা পিছন ফিরে দে ছুট। পড়িমড়ি করে পালাতে লাগলো ওরা। তাদের দেখাদেখি ছুটল বেহারারাও।

 কমান্ডার তাদের বেশিদূর যেতে দিল না, বর্শা হাতে ছুতলো তাদের পিছনে। জোহরাও দৌড় দিল তার দেখাদেখি। দু’জন ধর্মীয় নেতাই নিহত হলো। মারা গেল বেহারাদের দু’জন। বাকীরা নদীর পাড়ে জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে পড়লো। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পাওয়া গেল না।কমান্ডার দ্রুত জোহরাকে নিয়ে ছুটল তাদের ফাঁড়ির দিকে। কিছু দূর এগুতেই দেখতে পেল দুই টহল প্রহরী ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাহারা দিতে দিতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। কমান্ডার চিৎকার করে বললো,

 ‘জলদী এদিকে এসো’।

 প্রহরী কমান্ডারের ডাক চিনতে পারলো। দ্রুত ছুটে এলো ওরা। কমান্ডার ওদেরকে বললো, ‘তোমাদের ঘোড়া আমাদের দাও, আমরা এখান থেকেই কায়রো রওনা হয়ে যাবো। তোমরা দু’জন ফাঁড়িতে গিয়ে নতুন ঘোড়া নিয়ে এসো। কেউ খোঁজ করলে বলবে, তোমরা আমাদের দেখোনি’। প্রহরী বললো,

 ‘এ কয়দিন কোথায় ছিলেন আপনারা? এদিকে আমরা আপনাদের খোঁজে হয়রান’!

 ‘এ সব কথা পরে শোনো। এখন ফাঁড়িতে ফিরে যাও’।

 প্রহরী দু’জন পায়ে হেঁটে রওনা দিল ক্যাম্পের দিকে। কমান্ডার ও জোহরা আলাদা আলাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো। কমান্ডার জোহরাকে বললো, ‘ খুব দ্রুত ছুটতে হবে। ভয় পেয়ো না, ঘোড়া তোমাকে ফেলে দেবে না, ভয়ের কোন কারণ নেই’।

 ঘোড়া তাড়া করলো কমান্ডার। কমান্ডারের ঘোড়া যখন প্রচণ্ড জোরে ছুটতে শুরু করলো, জোহরা সে ঘোড়ার গতি দেখেই ভয়ে চিৎকার করে উঠলো।

 কমান্ডার ঘোড়া থামিয়ে ফিরে এলো জোহরার কাছে। তারপর জোহরাকে নিজের ঘোড়ার ওপর বসিয়ে জোহরার ঘোড়ার লাগাম তার ঘোড়ার সাথে বেঁধে নিল। জোহরাকে বললো, ‘ শক্ত করে আমার কোমর ধরে থাকো’।

 অশ্ব আবার পূর্ণ উদ্যমে ছুটে চললো। কমান্ডার পাহাড়ী এলাকা থেকে বহু দূরে দিয়ে ছুটে চললো কায়রোর দিকে। কায়রোর পথ তার নখদর্পণে। তখনো তারা দুই মাইল পথও অতিক্রম করেনি, একদিক থেকে আওয়াজ এলো, ‘দাড়াও থামো! তোমরা কে?’

 কমান্ডার থামলো না, ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে ছুটলো আরো জোরে। সাথে সাথেই চারটি ঘোড়া তাদের পিছু নিলো। কমান্ডার তার ঘোড়ার গতি আরও বাড়িয়ে দিতে চাইল, কিন্তু ঘোড়া দুই সওয়ারী নিয়ে এরচে জোরে আর চলতে পারছিল না। কমান্ডার চেষ্টা করলো, অন্য ঘোড়ায় চড়ে বসতে। কারণ সে এতক্ষণ বাহন ছাড়া থাকায় কম ক্লান্ত ছিল। কিন্তু জোহরাকে নিয়ে অন্য ঘোড়ার পিঠে যাওয়াও সম্ভব ছিল না।

 চাঁদ মাথার ওপর থেকে আরো হেলে পড়েছে। চাঁদের সেই ম্লান আলোতেও বহু দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। চারটি ঘোড়াই তাদের খুব কাছাকাছি চলে এলো।

 দুটি তীর ছুটে এসে কমান্ডারের পাশ কেটে চলে গেল সামনে। সাথে সাথে আওয়াজ এলো, ‘ যদি না থামো তো তীর তোমার মাথার মগজে ঢুকে যাবে’।

 কমান্ডারের মাথায় তখন একটাই ভাবনা, যদি থামি তবে মৃত্যু অবধারিত। এ লোকেরা নিশ্চয়ই আমাদের হাবশীদের হাতে তুলে দেবে। হাবশীরা আমাদের হাতে পেলে আজ রাতেই বলী দিয়ে দেবে ওদের দেবতার সামনে। সুতরাং ধরা দেয়ার চাইতে পালানোই উত্তম। তাতে কিছুটা হলেও বাঁচার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

 সে ঘোড়া ডানে বায়ে ঘুরিয়ে চালাতে লাগলো যাতে তীর লক্ষ্যচুত হয়। কিন্তু এটা ছিল তার মস্তবড় ভুল । ধাওয়াকারীরা এর ফলে দ্রুত তাদের দুরত্ব কমিয়ে আনতে সক্ষম হলো। শেষে তারা এতটা কাছে এসে পড়লো যে, কমান্ডার ও জোহরা তাদের ঘেরের মধ্যে পড়ে গেল।

 কমান্ডারের গায়ে তখনো বিভিন্ন রঙয়ের পাখীর পালকের বিচিত্র পোশাক। জোহরারও তাই।

 ঘেরাওকারীরা ওদের এই বিচিত্র পোশাক দেখে অবাক হলো। ও যে মিশরীয় বাহিনীর এক কমান্ডার পোশাক দেখে তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। ফলে কমান্ডারকে চিনতে পারল না ওরা।

 একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কে?’

 অপরজন বললো, ‘কি জিজ্ঞেস করছো? দেখছোনা না এরা সুদানী, কেমন অদ্ভুত পোশাক পরে আছে?’

 তাদের কোথায় ভুল ভাঙল কমান্ডারের। সে হেসে বললো, ‘বন্ধুগন, আমি তোমাদের বাহিনীর এক কমান্ডার’।

 তারপর সে জোহরার পরিচয় দিলো এবং সমস্ত ঘটনা ওদের খুলে বললো।

 এ চারজন মিশরীয় সৈন্য শত্রুসেনা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সুদানী সৈন্যরা কোথায় লুকিয়ে আছে এবং তাদের আস্তানা কোথায় তা খুঁজে বের করার জন্য যেসব দল চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদেরই একটা দল এরা। তারা কমান্ডার ও জোহরাকে সঙ্গে নিয়ে কায়রোর দিকে যাত্রা করলো।

 দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করে পরের দিন তারা কায়রো গিয়ে পৌঁছলো।

 প্রথমেই তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো আলী বিন সুফিয়ানের কাছে। আলী কমান্ডারের কাছ থেকে পুরো কাহিনী শুনে ওদের নিয়ে গেলেন সুলতান তকিউদ্দিনের কাছে।

 তকিউদ্দিন কে তারা জানালো, ‘ প্রায় দশ হাজার সুদানী হাবশী সৈন্য আবু সাম্বালের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে লুকিয়ে আছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে সেনাপতি আলকিন্দি’।

 তকিউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে সেনা বাহিনীর একটি দলকে সেখানে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিলেন।

 সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনীকে রাখা হলো। এ বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম। তাদের দুই পাশে ও পিছনে রাখা হলো আরো তিনটি দলকে। এদের পেছনে রাখা হলো মূল ফোরস। সবার পেছনে সংরক্ষিত রিজার্ভ বাহিনী।

 তাদের জানা ছিল, আবু সাম্বালের পাহাড়ী এলাকাটা বেশ বিস্তৃত। এলাকাটা কেবল দুর্গম নয়, অঞ্চলটা বেশ দুর্ভেদ্য। যাত্রার সময় তকিউদ্দিন সেনাবাহিনীকে বললেন, ‘কেল্লা অবরোধের মত তোমরা পুরো এলাকা ঘেরাও করে ফেলবে। সঙ্গে কমান্ডো বাহিনী নিয়ে রওনা হচ্ছি আমি। পাহাড়ের ওপর ওরাই উঠবে’।

 কমান্ডো বাহিনীকে নিজের কমান্ডে নিয়ে আলকিন্দিকে শায়েস্তা করার জন্য রওনা হয়ে গেলেন সুলতান তকিউদ্দিন।

 ভোর পর্যন্ত ভয়ে জঙ্গলে লুকানো ছয় বেহারার কেউ আর নড়াচড়া করার সাহস পায়নি। যখন ভোর হলো, জঙ্গল থেকে বের হয়ে ছুটল পাহাড়ের দিকে। ওখানে পৌঁছে সোজা গিয়ে ঢুকলো আলকিন্দির কামরায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সব ঘটনা।

 আল কিন্দি সঙ্গে সঙ্গে সুদানী ও খৃষ্টান উপদেষ্টাদের খবর দিল তার কামরায় আসার জন্য। সব শুনে খৃষ্টান উপদেষ্টারা বললো, ‘হাবশীদের কাছ থেকে এ খবর গোপন রাখতে হবে’।

 তারপর উপদেষ্টাদের নিয়ে আলকিন্দি চললো ঘটনাস্থলে। সঙ্গে নিল সেই ছয় বেহারাকে। নদীর পাড়ে পৌঁছলো ক্ষুদ্র দলটি। দুই ধর্মীয় নেতা, চারজন প্রহরী ও দুই বেহারার লাশ পড়েছিল সেখানে।

 সবাই লাশের দিকে তাকিয়ে আছে, এক বেহারা বললো, ‘ কমান্ডার যে এমন বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর, আমরা কেউ তা ভাবতেও পারিনি’।

 ‘কমান্ডার! কোন কমান্ডার?’ আলকিন্দি বিস্মিত হয়ে বললো।

 ‘যাকে বলী দেয়ার জন্য আনা হয়েছিল, সে ওই পাশের ক্যাম্পের সেনা কমান্ডার। নর্তকীসহ তাকেই তো ধরেছিল আমাদের লোকেরা!’

 ‘এখন কোথায় সে?’

 ‘আমাদের প্রহরীর হাত থেকে বর্শা কেড়ে নিয়ে আটজন লোককে হত্যা করে মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে’।

 ভীষণ চমকে উঠলো আলকিন্দি। বললো, বলো কি! সে তো আমাকে দেখে ফেলেছে! আমি তাকে খেয়াল না করলেও সে নিশ্চয় আমাকে ভাল করে দেখেছে এবং আমাকে চিনে ফেলেছে। এখন উপায়?

 ‘ঘাবড়াচ্ছেন কেন? এত মারামারির পর নিশ্চয়ই সে ক্লান্ত হয়ে কোথাও লুকিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমাদের যে শক্তি সে দেখেছে তাতে গর্ত থেকে সহসা সে মুখ বের করবে বলে মনে হয় না’। বললো এক খৃষ্টান উপদেষ্টা।

 ‘আপনি তাকে চেনেন না! সে এক মুহূর্তও কোথাও বিশ্রাম নেবে না। সোজা ছুটে যাবে কায়রো। খোঁজ নিয়ে দেখুন, ইতিমধ্যে সে কায়রোর অনেক পথ এগিয়ে গেছে’।

 ‘ঠিক আছে, আপনার সন্দেহ কতটুকু সত্যি, ফাঁড়িতে খোঁজ নিলেই জানা যাবে’।

 আল কিন্দি বললো, ‘এখন তাঁকে ফাঁড়িতে গিয়ে খোঁজ করা বৃথা। বেহুদা সময় নষ্ট করার কোন অবকাশ নেই আমাদের। আমরা সবার অজান্তে কায়রোতে আক্রমন চালানোর আশা করেছিলাম, কিন্তু আমরা বড্ড দেরী করে ফেলেছি। আক্রমণ করতে হলে এখনই করতে হবে, নইলে আমরা আমাদের অজান্তেই মারা পড়ে যাবো। আমি আমার সেনাবাহিনীর অবস্থা জানি, তারা আমাদের আস্তানার সন্ধান পেলে বাজপাখীর মত উড়ে এসে টুটে পড়বে আমাদের ওপর’।

 উপদেষ্টারা বেহারা ছয়জনকে বললো, ‘তোমরা এক কাজ করো, দ্রুত হাবশীদের লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দাও। যদি হাবশীরা জেনে যায় যে, তাদের ধর্মীয় নেতা ও তাদের রক্ষীরা মারা গেছে, তবে হাবশীরা কায়রো যাওয়ার পরিবর্তে সোজা খারতুম রওনা দেবে’।

 আরেক উপদেষ্টা বললো, ‘ আমরা এখান থেকে ফিরেই হাবশীদের সামনে ঘোষণা করবো, দেবতার নির্দেশে নীলনদের পাড়ে বলীদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। দেবতা হুকুম দিয়েছে, অবিলম্বে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালাতে’।

 তারা ছয় বেহারাকে বললো, ‘খবরদার!কন হাবশী যদি আসল ঘটনা জানতে পাড়ে তবে তোমাদের গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে’।

 অন্য একজন বললো।, ‘উড়িয়ে দেয়া হবে কি, এখনি উড়িয়ে দাও, যাতে কোন ভয় না থাকে!

 বেহারারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বললো, ‘আপনারা আমাদের মা-বাপ। দেবতার কসম, আমরা এ কথা কাউকে বললো না। যদি বলি তো আমাদের এবং আমাদের বউ-বেটিদেরও আপনাদের হাওলা করে দেবো’।

 আল কিন্দি উপদেষ্টাদের নিয়ে আস্তানায় ফিরে গেল। জরুরী সংকেত বাজিয়ে সব হাশীদের সমবেত করা হলো মাঠে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আলকিন্দি ঘোষণা করলো, ‘দেবতার ইচ্ছামত কাল রাতে একজন পুরুষ ও একটি নারীকে নীলনদের পাড়ে বলী দেয়া হয়েছে। দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে আজই আমাদেরকে যুদ্ধ যাত্রা করার নির্দেশ দিয়েছে। তোমাদেরকে একঘণ্টা সময় দেয়া হলো। যারা দেখতে চাও নদীর পাড়ে গিয়ে দেখে আসতে পারো দেবতা বলী গ্রহন করেছেন কি না। ওখান থেকে ফিরেই তোমরা যার যার হাতিয়ার নিয়ে নিজ নিজ দলে শামিল হয়ে যাবে যুদ্ধে রওনা হওয়ার জন্য’।

 হাবশীরা ছুটল নদীর দিকে। নদীর পাড়ে গিয়ে দেখলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্ত, এক পাশে পড়ে আছে দুটো পালকি। একজন সেই রক্তের দিকে ইশারা করে ঘোষণা করলো, ‘এই সেই মনোনীত পুরুষ ও নারীর রক্ত, যাদেরকে এখানে গত রাতে বলীদান করা হয়েছে’।

 হাবশীরা সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে এলো আস্তানায়। রিপোর্ট করলো যার যার কমান্ডারের কাছে গিয়ে।

 হাবশী সৈন্যদের সংখ্যানুপাতে গ্রুপ ভাগ করে ফেলা হলো। তীরন্দাজরা পৃথক হয়ে গেল তাদের দলে। বর্শাধারীরা সমবেত হলো বর্শাধারীদের ওখানে। যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে সাজানো শেষ হলে হাশীদের নিয়ে পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে এলো আলকিন্দি। হাবশীদের নিয়ে ছুটলো কায়রোর দিকে।

 হাবশীরা যুদ্ধের গান গাইতে গাইতে অগ্রসর হচ্ছিল। দশ হাজার নিগ্রোর বিশাল কাফেলা। বীর দর্পে এগিয়ে চলেছে মরুভূমিতে ধূলিঝড় তুলে।

 রাত হয়ে গেলে এক স্থানে ক্যাম্প করে বিশ্রাম নিল ওরা। পরদিন সকালেই আবার শুরু হলো ওদের যুদ্ধ যাত্রা।

 পাহাড়ী অঞ্চল অনেক পিছনে পড়ে রইলো। এগিয়ে চললো কাফেলা। দিনভর পথ চললো ক্লান্তিহীনভাবে। সূর্য অস্ত গেল। কায়রো এখনো অনেক দূর। আরও একটি রাত পথেই কাটাতে হলো তাদের। হাবশী সৈন্যদের ক্যাম্প করতে বলা হলো। তারা খেয়ে দেয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে পড়লো।

 মধ্যরাতের পর।

 হাবশীরা ঘুমিয়েছিল। মিশরের কমান্ডো বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকা সুদানী হাবশী সৈন্যরা কিছু টের পাওয়ার আগেই একদিক থকে কমান্ডো বাহিনীর একটি দল মার মার, কাট কাট করে ঝড়ের বেগে বয়ে গেল তাদের ওপর দিয়ে। বহু হাবশী সৈন্য তাদের ঘোড়ার পদতলে পিষে মারা গেল।

 হাবশীদের মাঝে মহা হুলস্থুল পড়ে গেল। আহতদের আর্ত চিৎকারে ভারী হয়ে উঠল মরুর বাতাস। কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলো না তারা। মাত্র কয়েক মিনিটের একটি ঝড়, তারপর সব সুনসান। কোথাও কোন বাহিনীর ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।

 সম্বিত ফিরে পেয়ে সৈন্যরা আহতদের ব্যান্ডেজ বাঁধতে লেগে গেল। বাকীরা এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে কোত্থেকে এই আকস্মিক ঝড় এলো তাই নিয়ে শঙ্কিত চিত্তে জটলা করছে। এ সময় হঠাৎ অন্য পাশ থেকে বয়ে গেল আরও একটি ঝড়। প্রচণ্ড গতিতে কমান্ডোরা আক্রমণ চালালো ওদের ওপর। অশ্ব পদতলে পিষ্ট হওয়া ছাড়াও বর্শা ও তলোয়ারের আঘাতে ধরাশায়ী হলো অসংখ্য হাবশী সেনা। দশ হাজার হাবশীর বিশাল বাহিনীর একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল মিশরীয় বাহিনী। মুহূর্তে হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে।

 আলকিন্দি দ্রুত অবশিষ্ট ফৌজকে সংগঠিত করে প্রস্তুত হয়ে গেল পরবর্তী হামলা মোকাবেলার জন্য। সুদানী কমান্ডার ও খৃষ্টান উপদেষ্টারা বললো, ‘এ গেরিলা আক্রমণ বলে দিচ্ছে, ‘আমাদের প্রতিটি নড়াচড়া মিশরীয় বাহিনী প্রত্যক্ষ করছে’।

 আলকিন্দি বললো, ‘সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর এ এক বিশেষ ধরনের যুদ্ধ। এখন আমরা সামনেও অগ্রসর হতে পারবো না, পিছাতেও পারবো না। যেদিকেই কদম উঠবো সেদিকেই বিপদের পাহাড় ভেঙ্গে পড়বে।

 তোমরা এখন যতই চেষ্টা করো মিশরের সেনাবাহিনীর সাথে মুক্ত মরুভূমিতে যুদ্ধ করে টিকতে পারবে না। এমনকি তোমরা অক্ষত অবস্থায় পালাতেও পারবে না। আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেছে। কায়রবাসী শুধু সজাগই হয়নি, তারা তাদের সেনাবাহিনীও পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন বাঁচার কোন পথ নেই। তবে পিছিয়ে গিয়ে ওই পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে যদি সেখান থেকে যুদ্ধ করতে পারো, তাহলে হয়তো কিছুটা রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে’।

 ‘কেন, আমরা কি মিশরীয় সৈন্যদের মরুভূমিতে খুঁজে খুঁজে বের করে মারতে পারবো না?’ এক সুদানী কমান্ডার বললো।

 আলকিন্দি বললো, ‘আমি মিশর বাহিনীর সেনাপতি, তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো না, এই সৈন্যদের সাথে কেমন কৌশলে লড়তে হবে’।

 পরদিন ভোরবেলা।

 হাবশী সৈন্যরা দেখলো, তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে সহযোদ্ধাদের অসংখ্য লাশ। সে সব লাশের কোন সৎকার না করেই আলকিন্দির হুকুমে হাবশী সেনাদল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে চললো। পেছনে খোলা মরুভূমিতে পড়ে রইলো বন্ধুদের লাশগুলো।

 আলকিন্দি ঠিকই বলেছিল, ওদের প্রতিটি নড়াচড়া মিশরীয় সৈন্যরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল। মিশর বাহিনীর লক্ষ্য ছিল আলকিন্দির গতিবিধির ওপর।

 হাবশী সৈন্যরা পিছাতে দেখে তকিউদ্দিন তাৎক্ষনিকভাবে বুঝে নিলেন, আলকিন্দি পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করার প্ল্যান করেছে।

 তিনি কাল বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে অশ্বারোহীদের একটি দলকে পাহাড়ী এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন। তাদের পিছন পিছন পাঠালেন তীরন্দাজ ও পদাতিক বাহিনীকে।

 তিনি অধিকাংশ দক্ষ সেনাদের নিজের কাছে রেখে তাদের নিয়ে হাবশী বাহিনীকে অনুসরণ করে বহু দূর দিয়ে পাশাপাশি চলতে লাগলেন।

 রাস্তাতেই রাত হয়ে গেল। হাবশীরা রাতে একস্থানে ক্যাম্প করে রাত কাটানোর ব্যবস্থা নিল।

 আজ আর ওরা অরক্ষিত অবস্থায় ঘুমাতে গেল না। হাবশীদের একটি সেনাদলকে সজাগ রাখা হলো। তারা সবাই দক্ষ তীরন্দাজ। তারা তীর ধনুক নিয়ে সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে রইল।

 রাতে মিশরীয় কমান্ডোরা হামলা করলো। বেপরোয়া তীর চালাতে লাগলো হাবশী তীরন্দাজরা। এতটা প্রতিরআশা করেনি কমান্ডো বাহিনী, ফলে বহু অশ্বারোহী কমান্ডো আহত ও শহীদ হয়ে গেল।

 এ হামলা মিশরীদের ভীষণ ক্ষতি হলো ঠিকই, কিন্তু হাবশীদের মনোবল একবারেই ভেঙ্গে গেল। যুদ্ধ করার সাহস ও শক্তি দুটোই হারিয়ে ফেললো ওরা।

 যেখানে তাদের প্রত্যাশা ছিল, অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ওরা কায়রো দখল করে নেবে, সেখানে পথেই এ ঝটিকা হামলায় নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাছাড়া ওরা কেউ গেরিলা যোদ্ধা ছিল না, নিয়মিত লড়াই ও সম্মখ যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে কমান্ডোদের মোকাবেলা করতে গিয়ে ওরা নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছিল। এই অভিজ্ঞতা ছিল তাদের চিন্তা ও ধারনার অতীত।

 শত্রু সেনাদের তারা দেখতেই পায় না, অথচ তারা ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে মুহূর্তে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। হাবশীরা মিশরীয় বাহিনীর এই লড়াই পদ্ধতি ও সাথীদের অসংখ্য লাশের স্মৃতি নিয়ে যখন পাহাড়ী এলাকায় এসে পৌঁছলো, সূর্য ডুবে যেতে তখনও বেশ বাকি।

 তারা পাহাড়ী অঞ্চলে প্রবেশ করলো। আলকিন্দি এ বাহিনীকে এক জায়গায় জড়ো না রেখে পাহাড়ের উপরে, নিচে ও পাদদেশে মোতায়েন করে দিলো। হুকুম পাওয়া মাত্র সৈন্যরা নিজ নিজ অবস্থানে পজিশন নিতে শুরু করলো। মাত্র অর্ধেক সৈন্য পাহাড়ের ওপর চড়েছে, তাদের উপরে ওপর থেকে তীর বর্ষণ শুরু হলো।

 মিশরের ক্ষিপ্রগতি সৈন্য দল আগেই সেখানে গিয়ে পজিশন নিয়ে বসেছিল, ওরা তীরের আওতায় আসতেই শুরু করলো তীর বর্ষণ।

 হাবশী সৈন্যরা চিৎকার ও শোরগোল করে পাহাড়ের আড়ালে পালালো। তারপর সেখান থেকেই তারা পাল্টা জবাব দিতে লাগলো তীর ছুঁড়ে। হাবশীদের অর্ধেক সৈন্য তখনও যুদ্ধের বাইরে। তাদেরকে পিছনে সরে যেতে বলা হলো।

 আলকিন্দি যুদ্ধরত সৈন্যদের পাহাড়ের উপরে উঠে ওপর থেকে তীর চালাতে আদেশ দিল, কিন্তু যত বার ওরা উপরে উঠার চেষ্টা করলো ততবারই তকিউদ্দিনের সৈন্যদের তীর বৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো ওরা।

 তকিউদ্দিন তার তীরন্দাজদের বললেন, ‘ওদের যখন উপরে ওঠার এতই শখ , আবার যখন চেষ্টা করবে তাদের একটু সুযোগ দিও,।

তীরন্দাজদের এ হুকুম দিয়েই সরে গেলেন পাশের টিলায়। ওখানেও তার একদল তীরন্দাজ বসেছিল। আলকিন্দির একদল সৈন্য তীর নিক্ষেপ করতে করতে কৌশলে উপরে উঠে গেল। দলটি উপরে উঠে গেলে তকিউদ্দিন সেই টিলার তীরন্দাজদের হুকুম দিলেন , ‘ তীর চালাও!’

 আচমকা উল্টো দিক থেকে তীর ছুটে আসায় পিছন দিক থেকে আক্রান্ত হলো দলটি। তকিউদ্দিন চতুর্দিক থেকে ওদের ঘেরাও করে ফেললেন। অশ্বারোহীদের পাঠিয়ে দিলেন নদীর পাড়ে।

 চতুর্দিক দিয়ে অবরোধের মধ্যে পড়ে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে পড়লো হাবশী সৈন্যরা। তারা প্রানপন চেষ্টা করলো মিশরীয় বাহিনীর মোকাবেলা করতে।

 আসোয়ানের দুর্গম পর্বত শ্রেণী ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। সমতলে, পাহাড় চুড়ায় দু’দলের তীর বর্ষিত হচ্ছিল বৃষ্টির মত।

 এবার ময়দানে নেমে এলো অশ্বারোহী বাহিনী। পাহাড়ের পাদদেশে যুদ্ধের নতুন ময়দানে তৈরী করলো অশ্বারোহীরা।

তারা একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঁধভাঙা জোয়ারের মত।

 এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখতে দেখতে পশ্চিম আকাশের রক্তিম সূর্য এক সময় হারিয়ে গেল অন্ধকারের অতলে। সময়ের স্রোত বেয়ে নেমে এলো রাত। এই রাত হাবশীদের অন্তরে ভয় ও আতঙ্কের এক চরম বিভীষিকা ছড়িয়ে দিল। জড়সড় হয়ে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে গেল ওরা।

 অপরদিকে মিশরীয় বাহিনীকে পেট্রোল ভেজা অগ্নি বোমা নিক্ষেপ করার আদেশ দিলেন তকিউদ্দিন। তারা স্থানে স্থানে অগ্নি বোমা নিক্ষেপ করতে লাগলো।

 এরপর অগ্নি বোমার আলোতে দেখে দেখে শুরু করলো অগ্নি তীর নিক্ষেপ। রাতের অন্ধকারে আলোকিত হয়ে উঠলো চারদিকের অগ্নি শিখায়। এই আলোতেই যুদ্ধ চললো রাতভর।

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top