১২. গোপন বিদ্রোহী

 তখনও ভোরের আলো ফুটে উঠেনি, হাবশীরা একেবারে নীরব হয়ে গেল। তারা মাটির তলের ফেরাউনের মহলগুলোতে গিয়ে লুকালো। মিশরীয় বাহিনী সে সব গোপন কক্ষে তল্লাশী চালিয়ে বহু কষ্টে তাদের বিতাড়িত ও বন্দী করলো।

 সকাল হলো।

 আলকিন্দির লাশ পাওয়া গেল মাঠের এক কোনায়। কোন তীর বা তলোয়ারের আঘাতে মারা যায়নি সে, নিজের তলোয়ার দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

 কয়েকজন সুদানী কমান্ডার ও খৃষ্টান উপদেষ্টা ধরা পড়লো। হাবশী যুদ্ধ বন্দীর সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশী।সুলতান তকিউদ্দিন যুদ্ধের ময়দান থেকেই সুলতান আইয়ুবীর কাছে এ সাফল্যের সংবাদ দিয়ে এক কাসেদকে পাঠিয়ে দিলেন। তাকে বললেন, ‘ সুলতান নিশ্চয়ই খুব পেরেশান আছেন। তাকে জলদি গিয়ে এখানকার সংবাদ দাও। বলবে, আল্লাহ্‌ তার বান্দাদের বিজয় দান করেছেন’।

 মুসলিম বিশ্বের যে এলাকায় আজ সিরিয়ার এক শ্রেনীর মুসলমান লেবাননী খৃষ্টানদের সাথে মিলে ফিলিস্তিনের স্বাধিনতাকামীদের সামরিক শক্তি বলে স্তব্ধ করে দিতে চাচ্ছে, সেখানে আটশ বছর আগে এক শ্রেণীর মুসলমান শাসক সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর নয় বছরের সন্তানকে সামনে রেখে খৃষ্টানদের সাহায্য ও সহযোগিতায় সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সামরিক জোট গঠন করেছিল। অথচ নুরুদ্দিন জংগীর একমাত্র অনুসারী মুসলিম হিতৈষী ছিলেন সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী।

 সুলতান আইয়ুবী মুসলমানদের সেই প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাসকে খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে জিহাদে নেমেছিলেন। তাঁর মনে দুর্মর স্বপ্ন, মসজিদুল আকসায় দু’রাকাত নামাজ পড়া।

 খৃষ্টানরা তাঁর জিহাদের মোকাবেলায় ফিলিস্তিন ধরে রাখতে পারতো না। কিন্তু ফিলিস্তিন উদ্ধারের পথে মুসলমানরাই তার বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো।

 ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামীরা বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সিরিয়ার মুসলমানরা তাদেরকে তোপের তলায় গুড়িয়ে দিয়েছিল। আজও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। খৃষ্টান সমর্থিত ইহুদীদের কবল থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করার জন্য জেহাদরত মুজাহিদরা মুসলিম বিশ্বের শাসকদের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত। পরাশক্তি আমেরিকার জুজুর ভয়ে কাঁপছে সব ভেড়ার দল। অথচ একদিনের জন্য যদি মুসলিম বিশ্ব এক হতে পারতো তবে পাল্টে যেতো পৃথিবীর চেহারা। বিশ্বের মুসলমানদের দুর্ভাগ্য, তারা এমন লোককে শাসক বানায়, যারা আল্লাহ্‌র চাইতে আমেরিকাকেই ভয় করে বেশী।

 ১১৭৫ সালের মার্চ মাস। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী পার্বত্য এলাকা ‘আর রিস্তান’ পর্বতমালার এক জায়গায় ক্যাম্প করে তাঁর সামরিক উপদেষ্টা ও কমান্ডারদের নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কিভাবে কোথায় নেয়া যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করছিলেন।

 তিনি হলবের অবরোধ উঠিয়ে খৃষ্টান সম্রাট রিমান্ডের মোকাবেলা করতে ছুটে এসেছিলেন এখানে। কিন্তু আইয়ুবীর সাথে যুদ্ধ না করেই কৌশলে সরে যায় রিমান্ড। হলববাসী তাদের আমীরদের মিথ্যা প্রচারে বিশ্বাস করে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। রিমান্ড ফিরে যাওয়ায় সুলতান আইয়ুবী আবার হলব আক্রমণ করে গাদ্দারদের ঘাঁটি ভেঙ্গে দেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, এমন সময় মিশর থকে সংবাদ আসে, তাঁর সেনাপতি আলকিন্দি খৃষ্টান ও সুদানীদের সাহায্য নিয়ে গোপনে মিশর আক্রমণের প্রতস্তুতি নিচ্ছে।

 এ খবর পেয়ে সুলতান নতুন অভিযানে বেরোনোর আগে মিশরের অবস্থা কোন দিকে যায় বুঝার চেষ্টা করছিলেন। ফলে আর রিস্তান থেকে সৈন্য চালনায় বিরত থাকেন তিনি। সুলতান আইয়ুবীর ভাই সুলতান তকিউদ্দিন আলকিন্দিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছেন এবং আলকিন্দি আত্মহত্যা করেছে এ খবর তখনও সুলতানের কাছে এসে পৌঁছেনি। সে জন্য তিনি আর রিস্তান পর্বতমালায় তাঁর হেডকোয়ার্টারে অস্থির ভাবে বসে ছিলেন।

 ইসলামের এ মহান খাদেম ও অনুসারী সব সময় চারদিকে বিপদ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। কতিপয় মুসলিম শাসক ও আমীর তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক জোট গঠন করে খৃষ্টানদের সহায়তায় তাঁর বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে এসেছিল। তাদের তুলনায় সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। কিন্তু আল্লাহ্‌র ওপর ভরসা করে জেহাদী জজবা নিয়ে তিনি মোকাবেলা করছিলেন তাদের।

 তিনি এমন সব দুঃসাহসিক ও অভাবিত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা কারো ধারনা বা কল্পনায় আসেনি কোনদিন। শুত্রুদের ধারনা ছিল, এ পাহাড়ী এলাকায় এমন শীত ও ঠাণ্ডার মধ্যে যুদ্ধের কোন চিন্তাই তিনি করতে পারবেন না।

 পাহাড়ের চুড়ায় চুড়ায় তখন সাদা বরফের পুরো আস্তরন। এই বরফের রাজ্যে যুদ্ধ করার মত শারীরিক ও মানসিক ট্রেনিং নিয়ই সুলতান আইয়বী ময়দানে নেমেছিলেন। আইয়ুবীর সৈন্যদের এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ প্রতিপক্ষের সৈন্যদের মনে ভয়ের কাঁপন জাগিয়ে দিয়েছিল।

 তাদের একটাই ভরসা, সংখ্যায় তারা বেশী। কিন্তু তারপরও তাদের মনে মাঝে মধ্যে ব্যর্থতার আশংকা জাগতো।

 সুলতান আইয়ুবী আশংকা করছিলেন, সম্রাট রিমান্ড হয়ত রাস্তা পরিবর্তন করে অন্য কোন পথে আক্রমণ চালাতে পারে। আর রিমান্ড আশংকা করছিল, তিনি রাজধানীতে নেই এ খবর পেয়ে সুলতান আইয়ুবী হয়তো তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে বসতে পারে।

 রিমান্ড তার রাজ্যে ফিরে গিয়ে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার দিকে মনোযোগ দিল।

 সুলতান আইয়ুবী যেভাবে তাকে তাড়িয়ে দেন তাতে তিনি সহজেই রিমান্ডের পিছু ধাওয়া করতে পারতেন। কিন্তু সৈন্য সংখ্যা কম থাকায় সামনে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকেন আইয়ুবী। আরেকটি কারণ ছিল, মিশরে সেনাপতি আলকিন্দির বিদ্রোহ।

 তিনি আশংকা করলেন, মিশরের অবস্থা যদি আরও খারাপ হয়ে যায় তবে তাকে মিশরে ফিরে যেতে হতে পারে। এ রকম একটি আশংকা ও ভয় থাকায় তিনি রিমান্ডের পিছু ধাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

 তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, যদি তাকে মিশরে ফিরে যেতে হয় তবে এখানকার মুসলমান গাদ্দার আমীররা আবার খৃষ্টানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পেয়ে যাবে। এ অবস্থায় মিশর থেকে কি সংবাদ আসে তার ওপরই নির্ভর করছিল সবকিছু। তিনি তার সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের সাথে মিশরের এ সমস্যা নিয়েই আলোচনা করছিলেন।

 এ সময় প্রহরী এসে সংবাদ দিলো, ‘কায়রো থেকে কাসেদ এসেছে’।

 তিনি তাকে ভেতরে ডেকে নিতে পারতেন, বরং এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মিশরের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি এতটাই পেরেশান ছিলেন যে, খবর পেয়ে নিজেই ছুটে বেরিয়ে এলেন।

 কায়রোর দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে সুলতানের তাবুর দিকে এগিয়ে আসছিল, সুলতান আইয়ুবী দ্রুত তাবুর বাইরে এসে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাল সংবাদ নিয়ে এসেছো তো?’

 ‘অতি উত্তম সংবাদ এনেছি মোহতারাম সুলতান’!’ কাসেদ মুহূর্তে ক্লান্তি ও অবসাদ ঝেড়ে স্বতঃস্ফূর্ত সতেজ কণ্ঠে বললো, ‘আপনার ভাই মোহাতারাম তকিউদ্দিন সুদানী বাহিনীকে আসোয়ানের পাহাড়ী অঞ্চলে এমন মার দিয়েছে যে, দীর্ঘ দিন সুদানের দিক থেকে আর কোন আশংকা ও ভয়ের কারণ নেই। আলকিন্দি আত্মহত্যা করেছে’।

 সুলতান আইয়ুবী দুই হাত আকাশের পানে তুলে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ্‌র দরবারে শুকরিয়া জানালেন। বললেন, ‘হে পরোয়ারদিগার! তোমার দ্বীনের এ মুজাহিদদের একমাত্র মহাফিজ তুমি। তোমার হাতেই কল্যান ও বিজয়ের চাবিকাঠি। আমাদেরকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল করো। যেসব মুজাহিদ তোমার দ্বীনের পতাকা বুলন্দ করতে গিয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছে, তাদের শাহাদাতকে কবুল করো তুমি’।

 তাবু থেকে সুলতানের পেছন পেছন বেরিয়ে এসেছিলো সুলতানের উপদেষ্টা ও অফিসারেরা। সুলতানের সাথে তারাও হাত তুললেন এবং ‘আমীন’ বলে আল্লাহ্‌র শোকরিয়া আদায় করলেন।

 এরপর কাসেদকে তিনি তাবুর মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানেই তার জন্য নাস্তা-পানির ব্যবস্থা করা হলো। নাস্তা খেতে খেতে যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছিল সে।

 সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের সৈন্যের হতাহতের সংখ্যা কত হবে?’

 ‘তিনশ সাতাশ জন শহীদ হয়েছেন!’ কাসেদ উত্তর দিল, ‘পাচশ’রও বেশী আহত। শত্রুদের সমস্ত সামরিক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হাতে এসেছে। সুদানী কমান্ডার ও খৃষ্টান উপদেষ্টা ছাড়াও এক হাজার দু’শ দশজন হাবশী সৈন্য যুদ্ধবন্দী হয়েছে’।

 এরপর কাসেদ সুলতানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘মুহতারাম তকি জানতে চেয়েছেন, যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আপনার আদেশ কি?’

 ‘খৃষ্টান উপদেষ্টা ও সুদানী সেনাপতিদের কয়েদখানায় রাখো। আর হাবশী বন্দীদের আসোয়ানের পাহাড়ে যেখানে যত লুকানোর স্থান আছে, সেসব কামরা ও গুহা পাথর দিয়ে ভরাট করাও। পাহাড় কেটে ফেরাউনরা যেসব মাটির মহল বানিয়েছিল, সেগুলোও ভরিয়ে দাও।

 এসব কাজে ব্যবহার করো হাবশী বন্দীদের। যদি কোথাও পাহাড় কাটা বা খোদাই করার প্রয়োজন হয়, সে কাজও হাবশীদের দিয়ে করিয়ে নাও, যাতে পাহাড়ে কোন গহবর ও ভিতরে কোন মহল না থাকে।

 তকিউদ্দিঙ্কে বলবে, কয়েদীদের সাথে যেন মানবিক ব্যবহার করে। যে যতটুকু কাজ করতে সক্ষম, তাকে ঠিক ততটুকু কাজে খাটাবে। ওরা বন্দী, শুধু এ জন্যই ওদের সাথে কর্কশ আচরণ ও মন্দ ব্যবহার করবে না।

 আসোয়ান পাহাড়ের পাদদেশে তাবু টানিয়ে উন্মুক্ত বন্দীখানা বানিয়ে নাও। ওদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করো সেখানে। আর যদি সুদানীরা যুদ্ধবন্দী ফেরত চায় তবে আমাকে জানাবে। আমি নিজেই ওদের সাথে বিনিময় মূল্য ও শর্ত নির্ধারণ করবো’।

 এরপর সুলতান কাসেদকে বললেন, ‘তকিউদ্দিনকে বলবে, আমার বিশেষ সেনা সাহায্য প্রয়োজন। এ জন্য নতুন সৈন্য ভর্তির কাজ দ্রুত ও জোরদার করতে বলবে। সামরিক ট্রেনিং পুরোদমে চালিয়ে যাবে। চারদিকে গোয়েন্দাদের জাল বিছিয়ে রাখতে বলবে আলীকে।

 আলকিন্দির মতো যোগ্য ও বিশ্বাসী সেনাপতি যদি বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, তবে যে কেউ, যে কোন সময় গাদ্দার হয়ে যেতে পারে। শয়তান বসে নেই। আমাকেও গাদ্দার বানানোর জন্য সে সব সময় চেষ্টা করবে। তাই সব সময় সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। কারো উপরই ভরসা করে চোখ কান বন্ধ রাখা যাবে না। এ ব্যাপারে আলী বিন সুফিয়ান কে আরো সতর্ক ও সাবধান থাকতে বলবে’।

 ‘মিশর থেকে সৈন্য সাহায্য না আসা পর্যন্ত কোন বিরাট ঝুঁকি না নেয়াই উত্তম হবে’। সুলতান আইয়ুবী কাসেদকে ফেরত পাঠানোর পর তাঁর সেনাপতিদের বললেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা সে সফলতা পেয়েছি তার প্রতিরক্ষার দিকে নজর দেয়া দরকার। বর্তমানে তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু তোমাদের ভাই। হলবে আল মালেকুস সালেহ তোমাদের গর্দান কাতার জন্য বসে আছে। এই তিন শক্তি এক হয়ে যদি আমাদের বিরুদ্ধে ময়দানে নামে, আমাদের পক্ষে তাদের মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে যাবে।

 রাজা রিমান্ডকে আমরা পিছু হটিয়ে দিয়েছি, কিন্তু সে তো এই অপেক্ষায়ই বসে আছে, মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে শক্তি ক্ষয় করুক, তারপর সে ওখান থেকে ফায়দা লুটবে’।

 ‘আল মালেকুস সালেহ, সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীনকে ইসলামের সঠিক পথে আনা যায় কিনা তার একটা চেষ্টা করলে কেমন হয়?’ এক সেনাপতি বললো।

 ‘না।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যেসব ব্যক্তি তাদের মন মগজ ও বিবেক সত্য থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ও বিমুখ করে নিয়েছে, আল্লাহ্‌র গজব ও শক্তি ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছু নেই। আমি কি এ বিষয়ে চেষ্টা করিনি? তার উত্তরে তারা আমাকে হুমকি দিয়েছে। আবার যদি আপোষের জন্য দূত পাঠাই, তবে তারা ভাববে ও বলবে, সালাউদ্দিন এখন যুদ্ধ করতে ভয় পাচ্ছে।

 আমি ওদের আর এমন অভিযোগ করার সুযোগ দেবো না। আমি এখন ওদের উপরে আল্লাহ্‌র গজব ও অভিশাপ হয়ে আঘাত হানতে চাই। আর আল্লাহ্‌র সে গজব হচ্ছো তোমরা ও তোমাদের দুর্ধর্ষ সৈন্যদল’।

 তিনি আফসোস করে বললেন, ‘তোমরা তো হলব অবরোধ করেছিল, দেখেছ হলবের মুসলমান কেমন বীরের মত লড়েছিল? তোমরা কি সে কথা ভুলতে পারবে? তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে কিন্তু তাদের মনোবল দেখে প্রশংসা না করে পাড়ি না। এমন জানকবুল করে যুদ্ধ শুধু মুসলমান জাতিই করতে জানে। হায়, যদি এই শক্তি ইসলামের জন্য ব্যয় হতো তবে কতই না কল্যাণ হতো!

 তোমরা জানো, আমি রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করছি না, আমার উদ্দেশ্য শুধু মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করা। আমি মুসলিম বিশ্বের সম্প্রসারণ চাই, বিস্তৃতি চাই’।

 ‘আমরা এ ব্যাপারে নিরাশ নই’। এক সেনাপতি বললো, ‘নতুন রিক্রুট চলছে। দামেশকের যুবকরাও দলে দলে ভর্তি হচ্ছে ফৌজে। মিশর থেকেও সেনা সাহায্য আসছে। ওদের নিয়ে আমরা আপনার প্রতিটি আশা পুরন করবো ইনশা আল্লাহ্‌!’

 ‘কিন্তু আমি আর কতদিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকবো!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আর তোমরাই বা কতদিন বাঁচবে? তুমি যে নতুন রিক্রুটের কথা বলছো এটা অবশ্যই আশার কথা। কিন্তু দূরদর্শিতা ভিন্ন জিনিস। তোমাকে কেবল নিজের শক্তির দিকে তাকালেই চলবে না, দেখতে হবে প্রতিপক্ষের শক্তিও। শয়তানের দলও বড় হচ্ছে, তাদেরও পরিধি বাড়ছে। আমার সেই প্রিয় বন্ধু, যার ওপর আমার এত বিশ্বাস ও ভরসা ছিল, শেষে সেও খৃষ্টানদের যাদুর ফাঁদে পা দিয়ে শেষ হয়ে গেল! তোমরা তো জানো, আলকিন্দি তোমাদের কত বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল। সেই আলকিন্দি সুদান থেকে হাবশী সৈন্য এনে গোপনে মিশর জয় করে নিজেই তার শাসনকর্তা হতে চাইবে, এটা কি কোনদিন তোমরা ভাবতে পেরেছিল!

 সে আমাকে এটুকু দয়া করেছে, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিজেকে নিজেই শেষ করে প্রায়শ্চিত্য করেছে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কষ্ট আমাকে করতে হয়নি। কিন্তু তার এই করুণ পরিনতি আমদের হৃদয়গুলোকে কি ক্ষত-বিক্ষত করেনি!

 নেতৃত্ব ও ক্ষমতার নেশা খুবই ভয়ংকর ও মারাত্বক নেশা। এ নেশা, প্রতিপত্তি ও ধনের নেশা বা নারী এবং মদের নেশার চেয়েও ভয়ংকর। বহু ভাল ভাল লোক কখন যে এ নেশায় পড়ে অন্ধ হয়ে গেছে, টেরও পায়নি।

 বলতে পারো, ঈমানের ধন হারিয়ে গেলে মুমীন জীবনের আর কি মূল্য থাকে? ঈমান তো আর সোনা রুপা নয় যে, বিক্রি করা যাবে! মেয়ে মানুষ নয় যে ভোগ করা যাবে! ঈমান তো আত্মার সম্পদ! একবার যদি হৃদয়ের বন্ধ করো, ঈমান বেকার বস্তুতে পরিণত হবে। বিবেককে ঢেকে দেবে কালো পর্দার আবরণ।

 যে বীর মুজাহিদরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নিজেদের জাহাজগুলো নিজহাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল, কল্পনা করো তাদের ঈমানের জোর! ঈমান কি অমূল্য সম্পদ তাদের কাছ থেকেই তা আমাদের শিখতে হবে। তারাই জানে ঈমানের মূল্য কি? বিজয় বা শাহাদাত ছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিল না তাদের সামনে। পরাজিত হয়ে ফিরে যাওয়ার কোন ধারনা তাদের মনে স্থান পায়নি।

 অস্ত্রের জোরে নয়, ঈমানের জোরে তারা স্পেন জয় করেছিল। তাদের বিদেহী আত্মা আজো দুনিয়ার পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে চিৎকার করে বলছে, যে হৃদয়ে পলায়নী মনোবৃত্তি ও আপোষকামীতা থাকে সে হৃদয় ঈমানদার নয়। ঈমানদার সেই, যে লোক ভয়শুন্য ও বিচক্ষণ।

 মুসলমানদের শিথিলতার সুযোগে ব্যর্থ হয়ে যায় শত শত শহীদের রক্তদান। আল্লাহ্‌র দরবারে শহীদরা বিজয়ী বীরের মর্যাদা পায় ঠিকই, কিন্তু যাদের সুখ শান্তির জন্য জীবন দেয় ওরা, তাদের জীবনে নেমে আসবে দুর্ভোগ ও জিল্লতি’।

 অফিসাররা অভিভুত হয়ে শুনছিল সুলতানের কথা।

 তিনি খানিক বিরতি দিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘কোন জাতি যদি তার শহীদদের ভুলে যায়, আল্লাহ্‌ যাদেরকে মৃত নয় বলে ঘোষণা করেছেন, তাদেরকে হারিয়ে ফেলে আপন স্মৃতি থেকে, সে জাতির পতন অনিবার্য। আরো শুনে রাখো, জেহাদের জন্য পরীক্ষিত ও প্রানপাতকারী মুজাহিদদের পরিবর্তে যদি সুবিধাবাদী লোকেরা কোন কাফেলার নেতৃত্বে আসে, তাদের পতনও কেউ রোধ করতে পারে না।

 জেহাদের পথ বেয়ে আমাদের খলিফা ও আমীররা ক্ষমতা লাভ করেনি। তারা ক্ষমতা পেয়েছে উত্তরাধিকার সুত্রে। ফলে দেশ ও জাতির জন্য তাদের সেই মায়া নেই, যে মায়া থাকলে জাতির জন্য ওরা অকাতরে নিজের রক্ত বিলিয়ে দিতে পারতো।

 এক ফোটা রক্তও না বিলিয়ে দেশের কর্তৃত্ব পাওয়ায় ওরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূল্য বুঝে না। বিনামুল্যে ক্ষমতা পেয়েছে বলে দেশের জন্য কোন দরদ নেই ওদের।

 এই জন্যই কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়েও ওরা বিলাসিতা ও সুখের সাগরে হাবুডুবু খেতে পারে। ক্ষমতা ও গদির জন্য নিজের ঈমান বিক্রি করে দিতে পারে। জাতির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের কন্থ রুদ্ধ করার পায়তারা করতে পারে।

 সুলতান বলছিলেন, ‘আমাদের প্রিয় নবী (সা) ও তার প্রিয় সাহাবীরা শরীরের ঘাম ও রক্ত ঝরিয়ে অর্ধ পৃথিবীতে ইসলামের আলো জ্বেলেছিলেন। তাদের উত্তরসূরিরা সেই আলো বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অসীম ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে। কিন্তু আজ? আজ শয়তান আবার আল্লাহ্‌র বান্দাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। অন্যায় ও অসত্যের ফেতনা আবার ছোবল হানতে শুরু করেছে মুসলমানদের মন মগজে। সেই ফেতনার কারনেই আমরা আজ পরস্পরের রক্ত ঝরাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি’।

 সুলতান আবার একটু থামলেন। এই ফাঁকে এক উপদেষ্টা বললো, ‘কাফেরদের আগে গাদ্দারদের নির্মূল করা প্রয়োজন। যদি আমরা সত্যের ওপর থেকে থাকি তবে আল্লাহ্‌ আমাদের অবশ্যই বিজয় দান করবেন। যেহেতু আমাদের চেতনায় সত্য ও সততার আগুন আছে তাই আমরা ব্যর্থ হবো না, হতে পারি না’।

 ‘তুমি ঠিকই বলেছো’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘ এ অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা খৃষ্টানদের হাতেই থাকুক, আর নামধারী মুসলমানদের হাতেই থাকুক, জনগনের ভাগ্যের তাতে কোন পরিবর্তন হবে না। জুলুম, নির্যাতন আর সন্ত্রাসের রক্ত-নদীতেই ডুবে থাকতে হবে তাদের। খৃষ্টানদের আধিপত্য কবুলকারী গাদ্দার মুসলিম শাসকেরা খৃষ্টানদের মতই মজলুম জনতার ওপর শোষণের ষ্টীমরোলার চালাবে’।

 আইয়ুবী ঠিকই বলেছিলেন। পরবর্তীতে ইতিহাসে আমরা তার অসংখ্য নজীর দেখেছি। স্পেনে মুসলমানদের পতন হলো কেন? হয়তো অনেকেই বলবে, কাফেরদের ষড়যন্ত্রের কারণে। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র সফল হলো কিভাবে? সফল হলো, মুসলমানরা নিজেরাই কাফেরদের ষড়যন্ত্রের বস্তু ও অস্ত্রে পরিণত হয়েছিল বলে। মুসলমানরা তাদের দোসর হিসাবে কাজ না করলে, গাদ্দারীর মূল্য ও পুরষ্কার না নিলে, স্পেনে মুসলমানদের পতন হতো না।

 জিন্দাদীল ঈমানদার শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্পেনে যে ইসলামের বিজয় নিশান উড়েছিল, সেই নিশান ধুলায় লুটিয়ে পড়েছিল আবু আব্দুল্লাহর মত গাদ্দারের কারণে।

 কাফের ও খৃষ্টানরা মুসলিম আমীরদেরকে ধন সম্পদ ও ইউরোপের সেরা সুন্দরীদের ভেট দিয়ে তাদেরকে হতগত করেছিল। তাদের প্ররোচনায় তারা নিজেদের সেনাবাহিনীকেও অপ্রয়োজনীয় মনে করেছিল।

 দেশের জনগন ও ঈমানের আলোয় আলোকিত মুজাহিদরা যখন এই আত্মঘাতি পদক্ষেপের বিরোধিতা করলো, তখন সেই বিলাসপ্রিয় নেতারা তাদেরকেই অপরাধী সাব্যস্ত করেছিল। এভাবেই খৃষ্টানরা মুসলমানকে দিয়ে ইসলামের পতাকাবাহী কাফেলাকে স্তব্ধ করে দিয়ে পরে সেই গাদ্দার নেতৃবৃন্দ ও চেতনাহীন মুসলমানদেরকে স্পেনের মাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের রক্ত ধোয়া মাটিতে খৃষ্টান সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে।

 সুলতান আইয়ুবী ঈমানী চেতনাদীপ্ত এক মুজাহিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অসম্ভব এক সমর বিশারদও। তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাধর এক সমর বিশারদও। তিনি তার সেনাবাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে রেখেছিলেন, তার দখলকৃত কোন কেল্লাতে শত্রুরা আক্রমণ করার চিন্তাও করতে পারছিল না।

 আইয়ুবীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে প্রতিপক্ষ যেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতানুযায়ী, তেমনি তৎপর ছিলেন সুলতান আইয়ুবীও। কেল্লাতে তিনি অল্প সংখ্যক সৈন্যই মোতায়েন রাখলেন। কারণ তিনি কেল্লার মধ্যে থেকে যুদ্ধ করার পক্ষপাতি ছিলেন না। এর পরিবর্তে পাহাড়ী এলাকার সমস্ত রাস্তায় ও প্রান্তরে এবং পর্বত চুড়ায় তীরন্দাজদের তিনি বসিয়ে রেখেছিলেন।

 যে সব রাস্তা সরু তার পাশে পাহাড় চুড়ায় ভারী পাথর জমিয়ে লোক বসিয়ে রেখেছিলেন, শত্রুরা কাছে এলে তাদের ওপর যেন সে পাথর গড়িয়ে দেয়া যায়। দামেশকসহ বিভিন্ন পথে কমান্ডো সৈন্যদের বসিয়ে রেখেছিলেন শত্রুর সে কোন হামলা মোকাবেলা করার জন্য।

 হিম্মতের সর্বোচ্চ এবং প্রশস্ত শৃঙ্গটি ছিল টিলার মত। টিলার চুড়াটি শিংয়ের মত দু’দিকে বিভক্ত হয়ে গেছে। সেটাকে সুলতান আইয়ুবী একটি ফাঁদ বানালেন। সেনাপতিদের বুঝিয়ে দিলেন, শত্রু বাইরে থেকে যুদ্ধ শুরু করলে কিভাবে এ ফাঁদ ব্যবহার করে শত্রুদের শায়েস্তা করতে হবে।

 সুলতান আইয়ুবী সমগ্র এলাকা এমনভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেন, শত্রুদের ইচ্ছে মত তিনি যে কোন দিকে হাকিয়ে নিতে পারেন। এছাড়া তিনি কমান্ডো বাহিনীকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে দূর দুরান্ত টহলে পাঠিয়ে দিলেন।

 অন্যদিকে সুলতানের গোয়েন্দা বিভাগও ছিল সমান সক্রিয়। সমগ্র এলাকায় যেমন গোয়েন্দারা ছড়িয়েছিল, তেমনি সক্রিয় ছিল শত্রুদের কেল্লার মধ্যেও। তারা দুশমনের প্রতিটি গতিবিধির সংবাদ তাৎক্ষনিকভাবে সুলতানকে পাঠানোর ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

 গোয়েন্দা মারফত তিনি জানতে পেরেছিলেন, তথাকথিত খলিফা আল মালেকুস সালেহ তাঁর গভর্নর হারান কেল্লার অধিপতি গুমাস্তগীন ও মুশালের শাসক সাইফুদ্দিনকে সাহায্যের জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন।

 জানা গেছে, তারা উভয়েই কিছু শর্ত আরোপ করে সাহায্য দিতে রাজী হয়েছে। এসব শর্ত না মানলে তারা খলিফার ডাকে সাড়া দেবে না।

 গোয়েন্দারা এ কথাও জানিয়েছে, এসব মুসলমান শাসক ও আমীর প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও তাদের অন্তরে পরস্পরের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব। প্রত্যেকেই যুদ্ধ করে নিজের রাজ্য ও এলাকা বাড়ানোর চেষ্টায় আছে। আর খৃষ্টানরা তাদেরকে সাহায্য দেয়ার চেয়ে উৎসাহ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে চায়। বিশেষ করে খৃষ্টানদের আগ্রহ হচ্ছে, যে করেই হোক, মুসলমানরা যেন একে অন্যের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে যায়।

 ‘শামস বখত ও সাদ বখতের কোন সংবাদ এখনও আসেনি?’ হাসান বিন আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

 ‘নতুন কোন খবর নেই’। হাসান বিন আব্দুল্লাহ উত্তর দিলেন, ‘ তারা খুব সাফল্যের সাথেই কাজ করছে। গুমাস্তগীন

কোন একশনে গেলে এ দুই সেনাপতিই সামাল দিতে পারবে বলে আমি মনে করি। তাদেরকে সেভাবেই কাজ করতে বলা হয়েছে’।

 আলী নিন সুফিয়ানের সহকারী হাসান বিন আবদুল্লাহ সুলতান আইয়ুবীর বর্তমান অভিযানে গোয়েন্দা প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আলী বিন সুফিয়ানকে সুলতান রেখে এসেছিলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে বিশেষভাবে মিশরের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখার জন্য। মিশরের বাইরে দামেশক ও অধিকৃত অঞ্চলের দায়িত্ব ছিল হাসানের ওপর।

 সুলতান আইয়ুবী হাসানের সাথে যে শামস বখত ও সাদ বখতকে নিয়ে আলাপ করছিলেন, ওরা দু’জনই ছিল গুমাস্তগীনের সেনাপতি।

 গুমাস্তগীন সম্পর্কে তো আগেই বলা হয়েছে, লক্তা ছিল শয়তান প্রকৃতির। দায়িত্ব ও পদমর্যাদায় সে একাধারে প্রাদেশিক গভর্নর ও হারান দুর্গের অধিপতি।

 আইয়ুবীর অভিযানের খবর পেয়েই সে কেল্লার সৈন্যদের সংহত করে কেল্লার ভেতরে ও বাইরে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ ঘটালো। খেলাফতের অধীন এবং খলিফার আদেশের বাধ্য ও অনুগত হওয়ার পরও সে তার নিজস্ব রাজনীতিতে এতটাই সক্রিয় ছিল যে, রাজনীতিতে তার মত ধুরন্ধর ও দক্ষ সেখানে আর কেউ ছিল না।

 চতুর রাজনীতিবিদ হিসাবে সে এতটাই মশহুর ছিল যে, স্বয়ং খলিফাও তাকে ঘাটাতে সাহস পেতো না। খলিফার অনুমোদন ছাড়াই সে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিত, স্বাভাবিকভাবে যা কোন গভর্নর বা কেল্লা প্রধান নিতে পারে না।

 সে গোপনে খৃষ্টানদের সাথে আলাদাভাবে মৈত্রী চুক্তি করে রেখেছিলো। এ মৈত্রী চুক্তির পিছনে ছিল এক বিরাট ইতিহাস। ভাগ্যের বিরল সহায়তা ছিল এ চুক্তির পেছনে।

 মরহুম নুরুদ্দিন জঙ্গীর ওফাতের সময় রাজা রিজনেল্ট বন্দী ছিলেন তার কেল্লায়। সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর গুমাস্তগীন খৃষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করার আশায় কারো আদেশ ও পরামর্শ ছাড়াই গোপনে সমস্ত খৃষ্টান কয়েদীদের মুক্ত করে দেয়। বিনিময়ে তাদের কাছে দাবী করে শুধু বন্ধুত্ব। বন্দী মুক্তির বিনিময়ে সে মুক্তিপন আদায় করতে পারতো এবং খৃষ্টানরা খুশী মনেই টা দিতে রাজীও হতো। কিন্তু সে টাকা-কড়ি, সোনা-দানা কিছুই না নিয়ে কেবল তাদের বন্ধুত্বের দাবী জানায়। তার আচরণে সম্রাট রিজনেল্ট এবং অন্যান্য বন্দী খৃষ্টানরা সন্তুষ্ট হয়ে অঙ্গীকার করে, আইয়ুবীর মোকাবেলায় যখন তার সাহায্য দরকার হবে তখন তারা তাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে। এ আশ্বাসটুকুই ছিল তার বড় চাওয়া-পাওয়া।

 তার দুই সেনাপতি বুদ্ধি, যোগ্যতা ও রণকৌশলে খুবই পারদর্শী। গুমাস্তগীন তাদের খুব বিশ্বাস করতো। এরা ছিল আপন দুই আপন ভাই। একজনের নাম শামস বখত, অন্য জনের নাম ছিল সাদ বখত। এরা ছিল ভারতীয় মুসলমান।

 ঐতিহাসিক কামালুদ্দিন তার আরবী গ্রন্থ ‘তারিখুল হলব’-এ এদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।তিনি লিখেছেন, ‘এরা দু’জন একই মায়ের সন্তান ছিল। নুরুদ্দিন জঙ্গীর শাসনকালে ভারত থেকে ওরা বাগদাদ আসে। জঙ্গী তাদের যোগ্যতা ও ঈমানদারী দেখে সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে নিয়োগ করেন। জঙ্গীর মৃত্যুর সময়য় ওরা হারান দুর্গে ছিলেন’।

 কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদও তার ডাইরীতে এদের নাম উল্লেখ করেছেন।

 আরবী ভাষায় কারো নামের সাথে পিতার নাম উল্লেখ থাকে। সে জন্য এ দুই ভাইয়ের নাম এভাবে উল্লেখ আছে, শামস ইবনে রেজা ও সাদ ইবনে রেজা। কিন্তু রেজা কে ছিলেন তার কোন উল্লেখ কোন ইতিহাসে নেই।

 ইতিহাসে এদের দু’জনের নাম উল্লেখ করার কারণ একটি বিশেষ ঘটনা। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ছিল সমসাময়িক ইতিহাসে খুবই উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যময়। এ সুবাদেই ট্যাঁরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল।

 ঘটনাটা হচ্ছে, হারানে কার্যত স্বৈরাচারী শাসক গুমাস্তগীনের শাসনই চলতো। সে তার এক তোষামোদী ও কুকর্মের দোসর ইবনুল খবিশ আবুল ফজলকে হারানের প্রধান বিচারকের পদে নিয়োগ করে।

 ইসলামে বিচারক তিনিই হতে পারেন, যিনি বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও ন্যায়বিচারের সাহস ও যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু আবুল ফজল গুমাস্তগীনের সব অন্যায় অবিচারের দোসর ও তোষামোদকারী হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।

 বিচারের নামে তার অবিচারের অসংখ্য কাহিনী সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখত জানতো। কিন্তু তারা সামরিক বিভাগের লোক বলে উভয়েই এ ব্যাপারে নীরব থাকে।

 বিচার বিভাগ তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয় বলে এসব অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের করার কিছু ছিল না। স্বভাবতই তারা তার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু এ ব্যাপারে মুখ ফুটে কখনোই কিছু বলেনি।

 গুমাস্তগীনের ওপর এ কাজীর যেমন প্রভাব ছিল, তেমনি প্রভাব ছিল এ দুই সেনাপতির। কারণ তাদের যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বই ছিল প্রভাব বিস্তারকারী।

 সুলতান আইয়ুবী নুরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর যখন মাত্র সাতশ অশ্বারোহী নিয়ে মিশরের সাথে সিরিয়াকে একীভুত করলেন, তখনই তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তার ঝানু গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জঙ্গীর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত যেসব দেশ ইসলামী খেলাফতের অধীনে ছিল, তাদের অনেকেই তার মৃত্যুর পর নিজেদেরকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বসে। গুমাস্তগীন কার্যত স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও কার্যত স্বাধীনভাবেই শাসন কার্য নির্বাহ করছিল।

 সুলতান আইয়ুবী যখন আর রিস্তানের পাহাড় চুড়ায়, তখনকার ঘটনা। এ সময় আইয়ুবীর এক তুর্কী গোয়েন্দা আনতানুস হারানে গিয়ে পৌঁছে। সে খুবই সুশ্রী ও সুন্দর চেহারার যুবক ছিল। তুর্কী ভাষা চাড়াও সে ভাল আরবী বলতে পারতো।

 সে গুমাস্তগীনের কাছে গিয়ে বললো, ‘তার পরিবার পরিজন ও বংশের লোকেরা সবাই জেরুজালেম বাস করতো। জেরুজালেম তখন খৃষ্টানদের অধিকারে। খৃষ্টানরা মুসলমানদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার ও উৎপীড়ন শুরু করছিল। যাকে ইচ্ছা ধরে নিয়ে বেগার খাটাচ্ছিল।

 সে বললো, ‘আমার দুটি বোন ছিল অসাধারন সুন্দরী। একদিন খৃষ্টানরা আমার দুই বোনকেই এক সাথে তুলে নিয়ে গেল।

 আমি তখন বাড়ী ছিলাম না। বাড়ী এসে দেখতে পাই, আমার ভাই এবং বাবাকেও ওরা ধরে নিয়ে গেছে বেগার খাটাতে। যখন বুঝলাম, ধরতে পারলে আমাকেও ওরা বেগার ক্যাম্পে নিয়ে যাবে, তখন আমি দেশ থেকে পালিয়ে আসি। এখন আমার কোন আশ্রয় নেই, ঠিকানা নেই, বাঁচার মত কোন সঙ্গতিও নেই। এখন আমার একটি কাজ দরকার’।

 গুমাস্তগীনকে সে আরো বললো, ‘আমার পরিবারের ওপর যে অত্যাচার করা হয়েছে আমি তার প্রতিশোধ নিতে চাই। আমি সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে চাই’।

 তার অবস্থা এমন করুণ দেখাচ্ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল, জেরুজালেম থেকে সে পায়ে হেঁটে এত দূর চলে এসেছে। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে তাকে আধ মরা দেখাচ্ছিল।

 গুমাস্তগীন গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো এই যুবককে। ক্লান্তি ও অবসন্নতার মাঝেও তার সুগঠিত শরীর ও প্রশস্ত বুক বলছিল, সৈনিক হিসাবে এ যুবক খুবই চৌকস হবে।

 তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজীতে কোন অভিজ্ঞতা আছে তোমার?’

 ‘এখন আমার একটু বিশ্রাম ও খাওয়া প্রয়োজন’। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো সে, ‘ ঘুম থেকে উঠে আমি ইনশা আল্লাহ্‌ আপনার সব প্রশ্নেরই সন্তোষজনক জবাব দিতে পারবো আশা করি’।

 গুমাস্তগীন এক প্রহরীকে ডেকে তার খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে বললো। খাওয়া দাওয়ার পর দীর্ঘ এক ঘুম থেকে যখন সে উঠলো, তার চেহারায় ক্লান্তি ও অবসাদের কোন চিহ্ন ছিল না।

 পরদিন গুমাস্তগীন দরবার শেষে তাকে নিয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে গেল। সেখানে আগে থেকেই ঘোড়া ও তীর ধনুক নিয়ে অপেক্ষা করছিল গুমাস্তগীনের এক বডিগার্ড। তিনি ওখান থেকে একটা তীর নিয়ে বললেন, ‘এই নাও, এটা দিয়ে তুমি তোমার পছন্দ মত যে কোন একটা লক্ষ্যভেদ করো’।

 সে তীর হাতে নিয়ে দেখলো, পাশের একটি গাছের ওপর ছোট্ট এক চড়ুই পাখি বসে আছে। সে সেই পাখিকে নিশানা করলো, তীরটি পাখিকে নিয়ে গাছ থেকে একটু দূরে মাটিতে গিয়ে পড়লো।

 সে আরও একটি তীর চাইলো। তীরটি নিয়ে সে অশ্বপৃষ্ঠে উঠলো। বললো, ‘ঘোড়া ছুটিয়ে আমি যখন কাছে আসবো তখন কোন জিনিষ শূন্যে ছুঁড়ে দেবেন’।

 ঘোড়া নিয়ে ময়দানে ছুটে গেল যুবক। গুমাস্তগীনের বডিগার্ড দৌড়ে গিয়ে একটি খাবার প্লেট নিয়ে এলো, প্লেটটা ছিল চিনামাটি্র।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top