১০. সর্প কেল্লার খুনী

মাজেদ লাফিয়ে নামলো ঘোড়ার পিঠ থেকে, তারপর মেয়েটিকেও নামিয়ে আনলো। মাটিতে বসিয়ে তাকে কোলের সাথে চেপে ধরে তীর খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তীর এতো বেশী গভীরে প্রবেশ করেছিল যে, টেনে বের করা সম্ভব হলো না !

ওর টানাটানিতে কাতর হয়ে মেয়েটি বললো, ‘ওটা রেখে দাও ! আমার কথাগুলো আগে শুনে নাও। তারপর তোমার যা ইচ্ছা করো !’

সালেহা ( দুর্বল ) স্বরে বলে চললো স্বামীর কাছ থেকে উদ্ধার করা গোপন তথ্যাবলী। মাজেদ হেজাযী গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো আইয়ুবীকে হত্যা ও তার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর গোপন পরিকল্পনার কথা।

মেয়েটি কথা শেষ করলো এই বলে, ‘আমার ধারণা, কেউ এ কথা চিন্তাও করবে না, আমরা গোপন তথ্য নিয়ে হলব থেকে পালাচ্ছি। রক্ষীদের সবাই জানতো, আমার ও তোমার মধ্যে গোপন সম্পর্ক রয়েছে, যা আমার স্বামীর মনেও সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল। তারা এ কথাই সবাইকে বলবে। বলবে, ভালোবাসার টানে পাগল হয়েই আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়েছি !’

মেয়েটি কথা শেষ করে মাজেদ হেজাযীর হাতে গভীরভাবে চুমু খেলো এবং বললো, ‘আমি শান্তির সঙ্গে মরতে পারবো !’ এরপরই সে জ্ঞান হারালো।

মাজেদ হেজাযী সালেহার ঘোড়া তার ঘোড়ার পিছনে বেঁধে নিলো এবং আহত সালেহাকে নিজের ঘোড়ায় উঠিয়ে পিছনে বসিয়ে এমনভাবে তাকে ধররে রাখলো, যাতে বিদ্ধ তীর তাকে বেশী কষ্ট না দেয়।

কিন্তু তীর তার ক্রিয়া শেষ করেছে। মেয়েটি চলন্ত ঘোড়ার পিঠে মাজেদ হেজাযীর বুকের উপর দেহের সমস্ত ভার চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিলো।

মাজেদ যখন দামেশক কমান্ডার হাসান বিন আব্দুল্লাহর কাছে উপস্থিত হলো, মেয়েটি কম বেশী তার বারো ঘন্টা আগে শহীদ হয়েছে।

মাজেদ হলবের রাজমহলের সমস্ত ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার কথা শোনালো তাকে। বললো, ‘এই বিরাট সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে আল্লাহর এই প্রিয় বান্দীর অপরিসীম ত্যাগ ও সদিচ্ছার ফলে !’

হাসান বিন আবদুল্লাহ তৎক্ষণাৎ মাজেদ হেজাযী ও শহীদ সালেহার লাশ নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে গেলেন ।

সুলতানের প্রশ্নের জবাবে মাজেদ হেজাযী মেয়েটি সম্পর্কে সব কথা খুলে বললো। কেমন করে তার বাবা তাকে জমিদারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। স্বামীর সাথে কেন তার দ্বন্দ্ব হয়েছিল এবং কেন ও কেমন করে এসব তথ্য সংগ্রহ করে মাজেদ কে দিয়েছে, সব কথাই সুলতানকে খুলে বললো সে।

পরে খোজ নিয়ে জানা গেল, মেয়েটির বাবাও দামেশক থেকে পালিয়েছে।

সুলতান আইয়ুবী মেয়েটির লাশ নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন বললেন, ‘এ মেয়ের দাফন সামরিক বিধি মোতাবেক সসম্মানে করা ঘবে !’

মেয়েটি মৃত্যুর আগে মাজেদ হেজাযীকে যে গোপন ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিল, তার সংক্ষিপ্তসার হলো, সুলতান মালেকুস সালেহ সমস্ত মুসলিম রাজ্যগুলোর শাসকবর্গকে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কেবল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবানই জানান নি, তাদের সেনাদলকে একক কমান্ডের অধীনে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোরও অনুরোধ করেছেন।ত্রিপোলীর খ্রিস্টান শাসক রিমাণ্ডের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন।

মেয়েটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী রিমাণ্ড তার সেনাবাহিনীকে মিশর ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে পাঠাতে সম্মত হয়েছে। সেখানে তারা সুলতান আইয়ুবীর যেসব বাহিনী পাবে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং সুলতানের জন্য পাঠানো রসদপত্র লুট করে নেবে, এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তাদের ধারণা, সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধের সময় মিশর থেকে অবশ্যই সাহায্য চেয়ে পাঠাবে। তাছাড়াও রিমাণ্ড সুলতান আইয়ুবীকে অবরোধ করার জন্য তার তেজস্বী অশ্বারোহী বাহিনীকে সব সময় প্রস্তুত রাখবে। যদি প্রয়োজন পড়ে তবে রিমাণ্ড অন্যান্য খ্রিস্টান রাজাদেরও সাহায্য চেয়ে পাঠাবেন।

হাসান বিন সাবাহর আনুসারী ফেদাইন দলের সাথে খলিফার চুক্তি হয়েছে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে হত্যার বিনিময় কি হবে তাও ঠিক করা হয়েছে এ চুক্তিতে। চুক্তি মোতাবেক ফেদাইন গ্রুপ শীঘ্রই দামেশকে অভিযান চালাতে সম্মত হয়েছে।

এসব তথ্য নিঃসন্দেহে আশংকাজনক। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী এগুলোকে তেমন গুরুত্ত দিলেন না। তিনি গুরুত্ত দিলেন, শীতকালেই যুদ্ধ শুরু করবে, এ খবরটিকে। কারণ এ সময় দামেশকে প্রচন্ড শীত পড়ে। হাল্কা বৃষ্টি এবং প্রচুর বরফও পড়ে। এ আবহাওয়া যুদ্ধের অনুকূল নয়। এ অঞ্চলে কোন দিন কেউ এ মওসুমে যুদ্ধ করে নি।

মেয়েটির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করলেন। সৈন্যদেরকে দুর্গের মধ্যে সমবেত করলেন। সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করলেন এবং আক্রমণের সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন।

শীতকাল শেষ হওয়ার আগেই খ্রিস্টানদের সিরিয়া আক্রমণ করার কথা। এ জন্য খ্রিস্টান রাজা রিমাণ্ডকে যথাযথ অগ্রিম মূল্য দেয়া হয়েছে। এ মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে সোনা ও হীরা দিয়ে। বুদ্ধিমান রিমাণ্ড খলিফার প্রস্তাব এ শর্তেই কবুল করেছিলেন যে, যুদ্ধ পরিচালিনার ব্যয়ভার খলিফাকে বহন করতে হবে এবং যুদ্ধের আগেই তা পরিশোধ করতে হবে। খলিফা আস সালেহ ও তার আমীররা একমত হয়ে সিদ্ধান্ত মোতাবেক সে মূল্য এরই মধ্যে পরিশোধ করে দিয়েছে।

‘মুসলমানদের দুর্ভাগ্য !’ সুলতান আইয়ুবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আজ মুসলমানরা কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছে। ওরা যদি রাসূলের (সাঃ) আত্মার হাহাকার ধ্বনি শুনতে পেতো তবে কতই না মঙ্গল হতো ! আমাদের জন্য এর চেয়ে অদ্গিক কষ্টকর আর কি হতে পারে, যে একই নবীর উম্মত আজ আমরা পরষ্পরের অস্ত্র তুলে নিয়েছি হাতে !’

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তাঁর স্মৃতিচারণ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার প্রিয় বন্ধু সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এতো আবেগময় কখনও হননি, যেমন সে সময় হয়েছিলেন। তাঁকে যখন বলা হলো, ‘আমাদের আশা ছিল, মরহুম জঙ্গীর পূত্র ইসলামের গৌরবের নিদর্শন হবেন। কিন্তু স্বার্থপর আমীরদের খপ্পরে পড়ে তিনি আজ ইসলামের মূল উদ্দেশ্যই ধ্বংস করতে বসেছেন। আফসোস! খ্রিস্টানদেরকে আরব ভূমি থেকে বিতাড়িত করে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটানোর পরিবর্তে এখন তিনি তাদের দোসর হিসেবে কাজ করছেন !’

এ কথা শুনে সুলতান আইয়ুবীর দু’চোখ থেকে অস্রু গড়িয়ে পড়লো। তিনি তার কামরায় পায়চারী করতে করতে আবেগের সাথে বিওলতে লাগলেন, ‘এরা আমার ভাই নয়, দুশমন ! তাদের আমি অবশ্যই হত্যা করবো। দুনিয়ায় আমি বেঁচে থাকতে আমার প্রিয় রাসূলের দ্বীনকে কেউ কলংকিত ও লাঞ্ছিত করবে, এটা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। এমন শাসকের উপর গজব নেমে আসুক, যে শাসক কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ত করেজাতির ক্ষতি করে !’

তিনি আর বললেন, ‘আমি জানি, এরা ক্ষমতা ও অর্থের লালসায় অন্ধ হয়ে গেছে ! এরা নিজেদের ঈমান বিক্রি করে গদি ও ক্ষমতা রক্ষা করতে চায় !’

তিনি তলোয়ারের বাটে হাত রেখে বললেন, ‘তারা শীতকালেই যুদ্ধ করতে চায়। আমি বরফের ময়দানকে ভয় পাই না। শীতকালেই আমি যুদ্ধ করবো, বরফে ঢাকা পাহাড় ও পর্বতের মাঝখানেই আমি কবর রচনা করবো ওদের !’

সালহউদ্দিন আইয়ুবী কল্পনাবিলাসী লোক ছিলেন না, তিনি ছিলেন কঠোর বাসস্তববাদী। কখনও আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করতেন না তিনি। যে কোন সিদ্ধান্ত নিতেন বাস্তবতার আলোকে।

যুদ্ধের ময়দানে, বিপদসংকুল অভিযানে সমস্ত সমস্যা তিনি মোকাবেলে করতে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে। তাঁর নির্দেশনা হতো সংক্ষিপ্ত অথচ স্পষ্ট। তিনি কমান্ডারদেরকে কাগজে রেখা টেনে কিংবা মাটিতে আঙ্গুল দিয়ে দাগ টেনে বুঝিয়ে দিতেন তাঁর নির্দেশনা।

কিন্তু সেদিন তার হৃদয় নদীতে আবেগের ঢেউ উঠলো, তিনি নিজেকে সামাল দিতে পারলেন না। তিনি এমন কথাও বলে ফেললেন, সচরাচর যে কথা তিনি বলেন না। তিনি ভালো করেই জানতেন, এ বৈঠকে যারা আছে তারা খুবই বিশ্বস্ত এবং আন্তরিক। তাদের সামনে মন উজার করে কথা কোন বিপদের আশংকা নেই।

‘তাওফিক জাওয়াদ!’ সুলতান আইয়ুবী দামেশকের প্রধান সেনাপতিকে বললেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত জানতে পারি নি, তোমার সৈন্যরা শীতকালে যুদ্ধ করতে পারবে কিনা ! উত্তর দেয়ার আগে একটু চিন্তা কররে নাও, আমি গভীর রাতে সহসা কমান্ড বাহিনীকে এমন স্থানে আক্রমণ করার জন্য পাঠাবো, তাদেরকে হয়তো পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে, নদী পার হতে হবে, বরফ ও বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে যেতে হবে !’

‘আমি আপনাকে এই আশ্বাস দিতে পারি, আমার সৈন্যরা আপনার হুকুমে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়তে বললে তাই পড়বে, উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বললে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে। তারা জানে, আপনি যে হুকুম দেবেন তা ইসলামের কল্যাণের জন্যে, আর ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তারা আপনার পতাকার তলে সমবেত হয়েছে !’

‘তুমি যা বললে তার কতটা বাস্তব আর কতটা কল্পনা?’

সেনাপতি তাওফিক জাওয়াদ বললেন, ‘ এর পুরোটাই বাস্তব ও সত্যি। তার প্রমাণ তারা আপনার প্রতি আস্থাশীল বলেই স্বয়ং খলিফার হুকুমকে অগ্রাহ্যও অমান্য করেছে। এখনও এ জন্যই তারা আমার সঙ্গে রয়েছে। ইচ্ছে করলেই তারা খলিফা আস সালেহর সাথে পালিয়ে যেতে পারতো, কিমতু তারা যায় নি। এতেই প্রমাণ হয়, আমার সৈন্যরা যুদ্ধের লক্ষ ও উদ্দেশ্য ভালোভাবেই বুঝে, বোঝে কি করলে মিল্লাতের কল্যাণ ও মঙ্গল হবে !’

‘হ্যা, সৈন্যদের মধ্যে ইসলামী জোশ ও প্রেরনা অটুট থাকলে তারা জ্বলন্ত মরুভূমি, জমাট বরফ, এমনকি সমুদ্রের পানির উপরও যুদ্ধ করতে পারে !’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আল্লাহর সৈন্যদের গতি রোধ করতে পারে এমন কোন শক্তি নেই পৃথিবীতে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, তাদের ঈমান হতে হবে মজবুত, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা হতে হবে ওনড়, অটল। যে ঈমান সম্বল করে বদরের প্রান্তরে সমগ্র আরবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাহাবীরা, আমাদের সহায় সেই আল্লাহ। আমরা যপদি সে ঈমান সম্বল করতে পারি, নিশ্চয় সে বিজয়ও আল্লাহ আমাদের দেবেন !’

তিনি সমবেত কমান্ডার ও সেনাপতিদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘ইতিহাস হয়তো আমাকে পাগল বলবে কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়তে পারবো না। ডিসেম্বর মাসেই যুদ্ধ হবে। সে সময় শীতকাল মাত্র শুরু হবে। পাহাড়ের রং ও হয়ে যাবে সাদা। হিমেল বাতাস বইবে। রাতে কাঁপানো শীত পড়বে। তোমরা কি আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারবে?’

সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো, ‘আমরা সুলতানের প্রটিতি আদেশ বিনা প্রশ্নে, বিনা প্রতিবাদে মেনে চলব !’

সুলতানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এরপর তিনি এমন সব আদেশ দিলেন যার মধ্যে আবেগের ছিটেফোটাও ছিলো না। তিনি বললেন, ‘আজ রাত থেকেই প্রতিটি সৈনিক ও সেনাপতি ও সেনাপতি খালি গায়ে শুধু পরণের বস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে শুরু করবে। এশার নামাজের পর সৈন্যরা খালি গায়ে ঝিলের মধ্যে নেমে মার্চ করবে। আমি তোমাদের প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পরিকল্পনা বলে দিচ্ছি। ডাক্তার ও চিকিৎসকরা সৈন্যদের সাথে থাকবে। সৈন্যরা অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাদের সর্দি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত সৈনিককে গরম কাপড় ও ঔষুধ দিয়ে সুস্থ করে তুলবে।

আমি আশা করি আস্তে আস্তে অসুখের মাত্রা কমে যাবে। সহ্য শক্তি বেড়ে যাবে সৈনিকদের। ডাক্তাররা সারাদিন সৈন্যদের দেখাশোনায় ব্যস্ত থাকবে। প্রয়োজনে আমি মিশর থেকে আরো অভিজ্ঞ হেকিম নিয়ে আসবো। এভাবেই এখন থেকে শীতকালীন যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ চলতে থাকবে !’

১১৭৪ খৃস্টাব্দের নভেম্বর মাসের শুরু। বেশ কিছুদিন ধরেই শীত পড়তে শুরু করেছে। রাতে শীতের তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একদিন সুলতান আইয়ুবী রাতের ট্রেনিংযের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।

সমাপনী অনুষ্ঠানে সেনাপতি ও কমান্ডারের সামনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ রাখলেন তিনি। বললেন, ‘আমার সামরিক ভাই ও বন্ধুগণ ! এখন তোম্প্রা যে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছো তাদের দেখে তোমাদের তলোয়ার খাপমুক্ত হতে ইতস্তত করবে। কারণ, তোমাদের মতোই তোমাদের শত্রুরা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে তোমাদের সামনে আসবে। তাদের পতাকাতেও তোমাদের পতাকার মতো চাঁদ তারা যুক্ত থাকবে। তারাও তোমাদের মতো কলেমা পাঠ করবে।

তোমরা তাদেরকে মুসলমান বলে দাবি করলেও তারা আসলে ইসলামের দুশমন। তাদের কোমরে তোমরা দেখতে পাবে খ্রিস্টানদের কোষবদ্ধ তলোয়ার। তাদের ধনুকে থাকবে খ্রিস্টানদের দেয়া তীর। তোমরা ধর্মের অনুসারী আর তারা ধর্ম ব্যবসায়ী। তাদের স্বঘোষিত সুলতান আস সালেহ বায়তুল মালের সোনা, রুপা এবং অর্থ সম্পদ সব সঙ্গে নিয়ে গেছে। সে এ অর্থ দিয়ে ত্রিপোলীর খ্রিস্টান শাসকের বন্ধুত্ত ক্রয় করেছে।খ্রিস্টনদের সহায়তা নিয়ে সে স্বপ্ন দেখছে তোমাদের পরাজিত করার। খোদা না করুন, সে সফল হলে পরাজিত হবে তোমরা। তোমাদের এ পরাজয় শুধহু তোমাদেরই পরাজয় হবে না, এ পরাজয় হবে মিল্লাতের, এ পরাজয় শাশ্বস্ত ইসলামের।

আস সালেহ যে অর্থ দিয়ে খ্রিস্টানদের বন্ধুত্ত ক্রয় করেছে সে অর্থ তার নয়, সে অর্থ তোমাদের, সে অর্থ মুসলিম মিল্লাতের।জাতির কষ্টার্জিত অরথ, বিত্তবানদের যাকাতের টাকা সে খরচ করছে শরাব ও বিলাসিতায়, খরচ করছে বন্ধুত্ত ক্রয়ের কাজে। তোমরা কি জাতীয় অর্থ অপচয়কারীকে খলিফা বলে মেনে নিবে?’

সকলের সম্মিলিত ‘না!না!’ ধবনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো।

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি যে নীতিতে আমার সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করতে চাই, সেই নীতির মৌলিক কথা হলো, শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষায় তোমরা তোমাদের ঘরে বসে থাকবে না। এটা কোন নিয়ম নয়, শত্রু তোমাকে আক্রমণ করবে আর তুমি কেবল সে আক্রমণ প্রতিরোধ করে যাবে !’

আল কুরআন যুদ্ধের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে তা হলো, ‘যুদ্ধের মুখোমুখি হলে প্রাণপণ লড়াই করবে। যখন যুদ্ধ থাকবে না তখন সব সময় যুদ্ধের অস্ত্র ও বাহন নিয়ে প্রস্তুত থাকবে। যদি সংবাদ পাও, শত্রু তোমাদের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে চেষ্টা নস্যাৎ করে দিবে।স্মরণ রেখো, যে মুসলমান নয় সে তোমার বন্ধুও নয়। শত্রুকে যে বন্ধু মনে করে তার মতো আহম্মক দুনিয়ায় আর কেউ নেই !’

দ্বিতীয় নীতিমালা হলো, মুসলিম সাম্রাজ্যের অতন্দ্র প্রহরী ও জাতীয় সম্মান ও ইজ্জতের রক্ষক মুসলিম ফৌজ। যদি শাসকশ্রেণী নির্লজ্জ ও বিপথগামী হয়ে যায়, অন্যায় ও অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়ে ধ্বংসের পথে ধাবিত হয়, আর সে সুযোগে শত্রু বিজয়ীর বেশে তোমাদের ওপর ( করত্রিত্ত ) করার আশংকা দেখা দেয়, তখন তাদের প্রতিরোধ করার দায়িত্ব মিল্লাতে ইসলামিয়ার। এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার জন্য জাতির প্রতিটি সদস্যকে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু বিশেষভাবে এ দায়িত্ব বর্তাবে সেনাবাহিনীর উপর।

যদি তোমরা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হও তবে পরবর্তী প্রজন্ম তোমাদের দুর্বল ও অযোগ্য বলে অভিহিত করবে। সরকারের ব্যর্থতা ও তাদের দোষক্রুটির যদি কোন জাতির ক্ষতি হয় তবে তার জন্য প্রথমেই দায়ী হয় সেনাবাহিনী। কারণ, জাতি সেনাবাহিনীর উপরই তাদের নিরাপত্তা ও জানমালের হেফাজতের জিম্মা সোপর্দ করে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে চায়। র জন্যই তারা সেনাবাহিনীর ভরণ-পোষণের খরচ বহন করে। জাতির এতো বড় জিম্মা নিয়ে সাধারণ মানুষের মত ঘুমিয়ে থাকার কোন অধিকার নেই সেনাবাহিনীর কোন সদস্যের।

জয় পরাজয় যুদ্ধের ময়দানেই হয়।আমরা জানি, সরকারের স্বার্থপরতা ও বিলাসিতা সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেয় এবং জাতিকে বিপদগামী করে ফেলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্ত পরাজয়ের গ্লানি সেনাবাহিনীর কাঁধেই চাপিয়ে দেয়া হয়। যে সরকার জাতির স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না, সেনাবাহিনীর আনুগত্য পাওয়ার কোন হক নাই তার। তাহলে তোমরা কিসের জন্য অপেক্ষা করছো? জনগণের স্বার্থ লুন্ঠনকারী অবৈধ ও লুটেরা সরকারকে উতখাত না করে কেন তোমরা জনগণের অভিশাপ কুড়াচ্ছো?’

এ অথর্ব সরকার আমাদের জাতীয় জীবনের ক্ষতি ও সর্বনাশ করছে। আমি এ সর্বনাশ চোখ বুঝে সহ্য করতে পারি না। তাই আমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছি। জানিনা এর ফলাফল কি হবে, কেমন হবে। শুধু জানি, একটা তুমুল যুদ্ধ হবে। হয় আমরা জিতবো, নয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবো, কিন্তু কিছুতেই গোলামীর শিকল পড়বো না।

এ যুদ্ধকে আমি কঠিন লড়াই বলছি এ জন্য যে, আমি তোমাদের প্রচন্ড শীতের মধ্যে যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দিচ্ছি। তাছাড়া তোমাদের সৈন্য সংখ্যাও কম। এই ঘাটতি তোমাদেরকে পূরণ করতে হবে ঈমানী শক্তি ও শাহাদাতের তামান্না দিয়ে !’

সুলতান আইয়ুবী তাদের আরো বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যদি শত্রুদের গোয়েন্দা থাকে তাদের কিভাবে শনাক্ত করবে এবং তাদের নিয়ে কি করবে সে সম্পর্কে তোমাদের আগেই বলেছি। এখন শুধু বলতে চাই, এ দিকটির প্রতি সব সময় সজাগ ও সচেতন থাকবে !’

‘তোমরা এ কথা বিশ্বাস করো না যে, সুলতান আইয়ুবী মুসলমান ! পয়গম্বরের পরেই খলিফার কদর। সেই খলিফার বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ধরে সে মুরতাদ। নাজমুদ্দিন আইয়ুবীর বেটা সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মুরতাদ হয়ে গেছে। সে খলিফাকে তার মহল থেকে বের করে দিয়েছে। সিরিয়ার ওপর জবর দখল নিয়েছে। সে এখন মিশর ও সিরিয়ার ওপর তার একচ্ছত্র বাদশাহী দাবী করছে। সে আমাদের ধর্মীয় নেতাদের শ্রদ্ধা করে না, পীর মাশায়েখদের বিরোধিতা করে। তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো, সে সর্প কেল্লার পীরকে গ্রেফতার করেছে।

যদি তোমরা আল্লাহর অভিশাপ থেকে বাঁচতে চাও, তপবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে হবে। খলিফাকে তাঁর সম্মান ও ( মরযাদাসহ ) তাঁর সিংহাসনে আবার বহাল করতে হবে !’

হলবের ময়দানে খলিফার সৈন্যদের সামনে এই বক্তৃতা করছিলেন একজন আমীর। তিনি সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সৈন্যদের উত্তেজিত করতে চাচ্ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, ‘এই শীত শেষ হওয়ার আগেই আমরা দামেশকের উপর আক্রমণ করবো। এর মধ্যে আমাদের আরো অনেক সৈন্য বেড়ে যাবে। বিশাল বাহিনী নিয়ে আমরা আঘাত হানবো আইয়ুবীর উপর। তার রাজা হওয়ার লোভ চিরতরে মিটিয়ে দেবো !’

‘ব্যাপক ধবংসযজ্ঞ ও নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি না থাকলে তোমরা যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে না !’ আস সালেহের দরবারে বসে বললেন রাজা রিমান্ডের দূত। তিনি আরো বললেন, ‘আমরা আপনাদের সাথে মিলে কোন শহরে এসে যুদ্ধ করতে পারবো না। মিশর থেকে সুলতান আইয়ুবীর জন্য যে সাহায্য আসবে আমরা সেগুলো পথে আটকাবো, লুট করে নেবো এবং সুযোগ পেলে সুলতান আইয়ুবীর সাহায্যে আসা বাহিনীকে অবরোধ করে রাখবো। আপনারা সৈন্যরা দামেশকের ওপর আক্রমণ চালাবে !’

‘আপনারা এটুকু সাহায্য করলেই চলবে। সুলতানের মোকাবেলা করার জন্য আমাদের বাহিনীই যথেষ্ঠ !’

‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে, শীতকাল পার করে আপনার যুদ্ধ যাত্রা করুন। শীতকালে আপনাদের জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের জন্যও তা কঠিন হবে !’

‘আমরাও প্রায় তেমনটিই ভাবছি। শীত শেষ হয় হয় অবস্থায় আমরা আক্রমণ করতে চাই, যাতে সুলতানের বাহিনীর প্রস্তুতির আগেই আমরা তাদের ধরাশায়ী করতে পারি !’ বললেন এক উপদেষ্টা।

‘কিন্তু আমার মধ্যে একটা আশংকা কাজ করছে। আপনাদের যুদ্ধ হচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে। আপনাদের সৈন্যরা না আবার আপত্তি করে বসেযুদ্ধ করতে!’

‘কি যে বলেন! আইয়ুবীকে খলিফা মুরতাদ বলে ঘোষণা করেছেন। মুরতাদের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রেরণা নিয়েই আমাদের সৈন্যরা লড়াই করবে। এ ব্যাপারে নিয়মিত তাদের ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি!’

‘আরো একটি পদক্ষেপ নিতে পারেন আপনারা। বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যগুলোতে তার বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কিয়ে তুলুন। এই যুদ্ধে কুরআন ও মসজিদকে ব্যবহার করুনাইয়ুবীর বিরুদ্ধে।

আমরা দেখেছি মুসলমানরা ধর্মের ব্যাপারে খুবই দুর্বল। ধর্মের নামে সহজেই তারা উত্তেজিত হয়ে উঠে। খলিফা চাইলে এ কাজে আমাদের সাহায্য নিতে পারেন।

আমাদের বাইবেল সোসাইটির মত একটি কোরআন সোসাইটিও আমরা আপনাদের গড়ে দিতে পারি। যার নেপথ্যে আমরাই থাকবো, কিন্তু পরিচালনায় থাকবে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু মুসলমান আলেম। এই আলেমদের তত্ত্বাবধানে মাঠে ময়দানে যারা কাজ করবে তারা এর মূল কলকাঠি নাড়াচ্ছে, কোত্থেকে নাড়াচ্ছে, কিছুই জানতে পারবে না। তারা সরল মনে ইসলামি জযবা নিয়ে ঘুরে ঘুরে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবে।

কোরানের দোহাই দিয়ে তারা বলবে, খলিফার বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলে ইসলাম তাকে মুরতাদ বলে। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল এই মুরতাদদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য বলেছেন। আইয়ুবী খলিফার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে মুরতাদ হয়ে গেছে। এই মুরতাদের হাত থেকে যারা জাতিকে বাঁচাতে চান, অবিলম্বে জেহাদের খাতায় নাম লেখান তারা!’

‘কিন্তু এতে কি লোকেরা আমাদের দলে নাম লিখাবে?’

আপনাদের দলে কতজন নাম লেখালো সেটা বড় কথা নয়, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে আইয়ুবী। ঈমানদার মুসলমানরাও তাকে বিশ্বাস করবে না, তার দলে নাম লেখাবে না, এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কি চান!’

আইয়ুবী নিজেকে ইসলামের রক্ষক বলে দাবী করছে। তার ডাকে যেন জনগণ সাড়া না দেয় সে জন্য ইসলামের রক্ষক সাজতে হবে আপনাদের। তখন কে যে ইসলামের রক্ষক আর কে নয়, এই নিয়ে জনগণ পড়বে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। এই দ্বন্দ্বের কারণে আইয়ুবীর ডাকে সাড়া দেবে না জনগণ। আপনারা চাইলে এই তৎপরতা আমরা দামেশকেও দেখাতে পারি!’

‘আপনার বুদ্ধি দেখে আমার মাথা লজ্জায় হেট হয়ে গেছে। প্রায় পাঁচ মাস ধরে চেষ্টা করেও আমাদের খুনি গ্রুপ সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারলো না। আপনি যে পথ বাতলেছেন এতে তো সে খুন হয়ে যাবে!’ ফেদাইন খুনি দলের মুরশিদ পীর শেখ মান্নানের কন্ঠ থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ঝরা পড়লো।

‘আরে খুন নয়, এ যে খুনের বাড়া!’ বললো খলিফার এক উজির।

বৈঠকে খুনি চক্র ফেদাইন গ্রুপের নেতা মান্নান জানালো, ‘সুলতান আইয়ুবীকে হত্যার জন্য যাদের পাঠিয়েছিলাম তাদের প্রচেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ব্যর্থই হয় নি, তাদের দুজন নিহত হয়েছে, বন্দী হয়েছে তিন জন। হাসান বিন সাবাহের আত্মা এখন আমার কাছে এর জন্য জবাবদিহি চাচ্ছে!’

‘তোমরা কি তাকে বিষ প্রয়োগেও হত্যা করতে পারলে না? গোপনে কোথাও থেকে তীরের নিশানাও বানাতে পারলে না? তোমরা এতই আনাড়ি, এতই ভীতু?’ দূত ফেদাইন নেতা মান্নানকে তিরস্কার করলো।

মান্নান নত মস্তকে বললো, ‘জানিনা ওরা শপথের কথা ভুলে গেছে কিনা? এত ট্রেনিং দিয়ে, এতসব কায়দা কানুন শিখিয়ে যাদের পাঠালাম তারা সব কি করে এমনভাবে ব্যর্থ হলো বুঝে আসে না। জানিনা, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জীবিত আছেন এ কথা আর কতদিন শুনতে হবে?’

‘তিনি আর বেশী সময় জীবিত থাকবেন না!’ নেতার আক্ষেপ শুনে একজন ফেদাইন কর্মী বললো। সাথে সাথে সায় জানালো তার সাথীরাও।

সুলতান আইয়ুবীর অবশিষ্ট সৈন্যরা মিশরেই অবস্থান করছিল। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল সুলতানের ভাই আদিল। সুলতান আইয়ুবী তাকে হুকুম দিলেন দিয়ে এসেছিলেন, ‘দ্রুত নতুন সৈন্য ভর্তি করো এবং সামরিক ট্রেনিং আরো জোরদার করো!’

তিনি আল আদিলকে সুদানের ব্যাপারেও সাবধান করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘সুদানের তরফ থেকে যদি সামান্য আক্রমণও আসে তবে এমনভাবে তার মোকাবেলা করবে, যেনো আর কখনো এ ধরণের দুঃসাহস করার খায়েশ তাদের না জাগে!’ সুলতান আইয়ুবি আরও বলেছিলেন, ‘সব সময় সৈন্যদের প্রস্তুত রেখো। যে কোন সময় আমি সাহায্য চেয়ে পাঠাতে পারি!’

দামেশক্কের ব্যাপারে এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। যুদ্ধ বাঁধলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে বলা মুশকিল। পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে রাখতে হলে আরো সৈন্য প্রয়োজন। তিনি যে পরিকল্পনা করেছেন তা সফল করতে হলে সাহায্যের প্রয়োজন। শহীদ সালেহার রিপোর্ট অনুযায়ী ত্রিপোলীর শাসক রিমাণ্ড মিশর ও সিরিয়ার মধ্যে যোগাযোগের পথে বাঁধার সৃষ্টি করবে। সুলাত্ন আইয়ুবীর জন্য ছুটে আসা সাহায্য সামগ্রী লুট করবে তারা।

এ খবর পেয়ে সুলতান আইয়ুবী সিদ্ধান্ত নিলেন, ওরা এসে পৌঁছার আগেই প্রয়োজনীয় সাহায্য সংগ্রহ করে নিতে হবে। তাছাড়া শীতকালে যুদ্ধ করার মত ট্রেনিং দেয়ার জন্য তাদের আগে ভাগেই দামেশকে নিয়ে আসা দরকার। তিনি দীর্ঘ এক চিঠি লিখলেন ভাইকে। তারপর সে চিঠি কাসেদ মারফত পাঠিয়ে দিলেন কায়রোতে। চিঠিতে তিনি আল আদিলকে জানালেন। কি পরিমাণ পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী পাঠাতে হবে সেই সাথে এও বললেন, ‘সমস্ত সৈন্য একসাথে পাঠাবে না। তাদের পাঠাবে ছোত ছোট দলে ভাগ করে। রাতে অন্ধকারে গোপনে পথ চলতে হবে তাদের। একজন অন্যজন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পথ চলবে। দিনের বেলায় কোন গোপন স্থানে বিশ্রাম করবে। যতদূর সম্ভব সাহায্য সামগ্রী গোপন রাখতে বলবে। সৈনিকদের পোশাকের বদলে ওদের পথ চলতে বলবে সাধারণ মুসাফিরের বেশে।

ছোট ছোট দলে উটের পিঠে সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ওরা যখন পথ চলবে, তখন যেন সোজা ও বড় রাস্তায় না এসে যতটা সম্ভব সংকীর্ণ ও ঘুরপথে আসে। সন্দেহজনক কেউ পথে পড়লে তাকে ভালমত তল্লাশী করতে বলবে। জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রয়োজন মনে করলে তাকে গ্রেফতার করতে হবে।

কয়েকদিন পর। নিরাপদেই দামেশকে এসে পৌছতে লাগলো সাহায্য বহর। সুলতান আইয়ুবী নবাগত সৈন্যদের নৈশ ট্রেনিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। সেই সাথে আরও নতুন সৈন্য ভরতি চলতে থাকলো।

দামেশকের আশেপাশের এলাকা। এলাকাটা পাহাড়, জঙ্গল, খাল ও নালায় পরিপূর্ণ। শহরের বাইরে এক জায়গায় বহু বছরের পুরাতন এক দুর্গের ধবংসাবশেস।

এর মধ্যে অনেকদিন কোন মানুষ প্রবেশ করে নি। রাতে লোকেরা তার পাশ দিয়েও যেত না। ব্যবহারের অযোগ্য সেই দুর্গের দিকে ফিরেও তাকাতো না কেউ। সৈন্যরা সেদিকে নজর দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করতো না। সেই পরাতন কেল্লাকে লোকে ‘নাগু’ কেল্লা বলতো।

লোকমুখে প্রচলিত আছে, সেখানে এক জোড়া নাগ-নাগিনী বাস করে। সেই নাগ নাগিনীর বয়স নাকি প্রায় হাজার বছর। লোকমুখে আরো শুনা যায়, মহাবীর আলেকজান্ডার এই কেল্লা তৈরি করেছিলেন। আবার কেউ বলেন, ইরানের এক বাদশাহ এটা প্রস্তুত করেছিলেন। কেউ আবার একে বনি ইসরাইলীদের তৈরী বলেও মনে করেন।

এ ব্যাপারে সবচেয়ে মাশহুর কাহিনী হচ্ছে, পারস্যের এক বাদশাহ একবার এখানে এসেছিলেন। স্থানটি তার এতোই পছন্দ হয়েছিল যে, এখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণের ইচ্ছা জাগলো তার। ত্নি একটি মনোরম প্রাসাদ তৈঊরী করালেন। তার পাশে তৈরী হলো এক কেল্লা।

কিন্তু সে মহলে বাস করার মতো বাদশাহর কোন বেগম ছিলো না। সে অভাব পূরণের জন্য তিনি একটি মেয়ে খুজতে লাগলেন। এক মেষ পালকের মেয়েকে তার বড় পছন্দ হলো। কিন্তু সেই মেয়ে ছিলো অন্য এক লোকের বাগদত্তা। মেয়েটিও ভালোবাসতো তাকে।

কিন্তু রাজার খায়েশ বলে কথা! তিনি মেয়ের মা-বাবাকে অগাধ ধন সম্পদ দিয়ে মেয়েটিকে কিনে নিলেন।

মেয়েটি প্রেমিক বাদশাহকে বললেন, ‘এ অন্যায় মহারাজ! আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি, আপনি ওকে মুক্তি দিন!’

বাদশাহ তার কথায় কর্ণপাত করলেন না। তখন বাদশাহকে শাসিয়ে বললো, ‘এই মেয়েকে নিয়ে আপনি প্রাসাদে বাস করতে পারবেন না। আমার অভিশাপ এ প্রাসাদকে বিরাণ করে ফেলবে!’

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাদশাহ মেয়েটিকে মুক্তি দেয়ার পরিবর্তে তার প্রেমিককে ধরে নিয়ে মহলের মধ্যে হত্যা করলো। তারপর তাকে পুতে রাখলো মহলের ভেতর।

মেয়েটি বাদশাহকে বললো, ‘আপনি আমার দেহটা খরিদ করতে পারলেও আমার আত্মাকে কোনদিন বশীভূত করতে পারবেন না। আমার হৃদয় ওই যুবকের সম্পদ। সে সম্পদ আমি কাউকে দিতে পারবো না!’

প্রথম রাতে বাদশাহ যখন মেষ পালকের মেয়েকে রাজ পোশাকে সজ্জিত করে মহলের পালংকে নিয়ে গেলেন, তখন সাজানো পালংক মেঝেতে বসে গেলো। প্রাসাদের দেয়াল ও ছাদ ধবসে পড়ে বাদশাহ ও মেয়েটিকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিল।

বাদশাহর সৈন্যরা যখন ইট-সুড়কি সরিয়ে তাদের উদ্ধার করতে গেলো, তখন দেখলো, সেখানে কোন মানুষের হাড়গোড়ও নেই। একজোড়া নাগ-নাগিনী ফনা তুলে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। সৈন্যরা সাপ দু’টোকে মারার জন্য বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে ছুটে গেলো। কিন্তু কোন অস্ত্রই তাদের গায়ে লাগলো না।

সৈন্যরা ভয় পেয়ে কিছুটা দূরে সরে এলো। সেখান থেকে তারা সাপ দু’টোর দিকে তীর ছুড়তে লাগলো। কিন্তু কোন তীরই তাদের গায়ে লাগলো না। সাপ দু’টোর কাছে গিয়েই তীর অন্যদিকে ফিরে যায়। এই দেখে সৈন্যরা ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলো।

এ কথাও লোকমুখে শোনা যায়, রাতে কেল্লার পাশ দিয়ে গেলে একটি সুন্দরী মেয়ে মেষের পাল চরিয়ে বেড়াচ্ছে। কখনো কখনো সেই সুন্দর যুবককেও দেখা যায়। সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে, এ কেল্লায় এখনো জীন-পরী বাস করে।

সুলতান আইয়ুবী যখন খলিফা আস সালেহ ও তার আমীরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত, সে সময় একদিন গুজব শোনা গেলো, ঐ সর্প কেল্লায় একজন বুজুর্গ পীর সাহেব এসেছেন। তিনি যদি দোয়া করেন তবে সকল রোগ দূর হয়ে যায়। আর তিনি ভবিষ্যত বাণীও করতে পারেন।

শহরে তার কেরামতির কথা এ-মুখ ও-মুখ করে সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়লো। কেউ কেউ তাকে ঈমাম মেহেদী বলেও উল্লেখ করলো।

লোকজন সেখানে যাওয়ার জন্য এবং হুজুরকে এক নজর দেখার জন্য খুবই উদগ্রীব। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। ওদের ভয়, হুজুর মেষ পালকের মেয়ের সেই প্রেমিক যুবক বা পারস্যের সেই বাদশাহর প্রেতাত্মা নয় তো! কেউ কেউ আবার ভাবলো, নিশ্চয় এটা জীন বা ভূতের কারবার।

কিন্তু মানুষের কৌতুহল বাড় খারাপ জিনিস। এ জিনিস একবার কাউকে পেয়ে বসলে কৌতুহল নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। তাই লোকজন এক পা, দু পা করে কেল্লার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কেউ কেউ দূরে দাঁড়িয়ে কেল্লের দিকে তাকিয়ে থাকতো।

একদিন তিন চার জন লোক বললো, ‘আমরা কেল্লার পাশ দিয়ে আসছিলাম, দেখলাম, একজন কালো দাড়িওয়ালা লোক সাদা পোশাক পরে কেল্লার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখেই তিনি ভিতরে চলে গেলেন!’

লোকজনের কানে হুজুরের কেরামতির কথা পৌছতে লাগলো। কিন্তু এমন একজনও পাওয়া গেলো না, যে সাহস করে কেল্লার ভিতরে ঢুকবে। অথবা সরাসরি হুজুরের দোয়া নিয়ে এসে এসেছে এমন কায়কে পাওয়া গেল না।

একদিন সুলতানের রক্ষীবাহিনীর এক সৈনিক তার ডিউটি শেষ করে ব্যারাকের বাইরে ঘোরাফেরা করছিলো। এ যুবক ছিলো খুব সাহসি এবং সুপুরুষ।

এই সুদর্শন যুবকের সামনে একজন নূরানী চেহারার লোক এলো, তার মুখে কালো দাড়ি, কিন্তু তা পরিপাটি ও ভালোমতো আঁচড়ানো। তার গায়ের জামাটি ধবধবে সুন্দর এবং মাথেয় আকর্ষণীয় পাগড়ী। তার হাতে একটি তসবীহ এবং অনবরত তিনি তা টিপে চলেছেন।

তিনি রক্ষী বাহিনীর সেই সৈন্যের কাছে এসে থেমে গেলেন। তাকে থামতে দেখে সৈনিকটিও দাঁড়িয়ে পড়লো। তিনি রক্ষীর থুত্নি ধরে মুখখানা একটু উপরে তুলে ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমার তো ভুল হবার কথা নয়! তুমি কোথাকার বাসিন্দা বন্ধু?’

‘বাগদাদের!’যুবক শান্ত উত্তর দিল। ‘আপনি কি আমাকে চেনেন?’

‘হ্যা, বন্ধু! আমি তোমাকে চিনি। কিন্তু তুমি আমাকে চেন না!’

‘যুবক এ কথায় একটু বিস্মিত হলো এবং তার বলার ভঙ্গিতে আকৃষ্টও হলো। নূরানী চেহারার লোকটির দিকে ভালো করে তাকালো যুবক। তার দাড়ি পরিপাটি সুন্দর, পোশাক উজ্জ্বল সাদা। সৈনিকটি তাকে একজন দরবেশ বলে ধরে নিল।

লোকটির চোখে কেমন নেশা ধরানো আলো, যুবক মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে সে দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।

‘তোমার পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে জিছু জানো তুমি? তারা কে ছিলেন, কি ছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করলেন হুজুর।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top