১০. সর্প কেল্লার খুনী

‘না!’সৈনিক জবাব দিলো।

‘তোমার দাদাকে দেখেছো?’

‘না!’

তোমার বাবা জীবিত আছেন?’

‘না!’রক্ষী বললো, ‘আমি যখন দুগ্ধপোষ্য শিশু তখন বাবা মারা যান!’

‘এদের মধ্যে কে বাদশাহ ছিলেন?তোমার বাবা? দাদা? তোমার পর দাদা?’

‘কেউ নয়!’রক্ষী উত্তর দিল, ‘আমি কোন রাজবংশের সন্তান নই। আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর রক্ষী দলের একজন সাধারণ সৈনিকমাত্র!’ আপনার দৃষ্টিভ্রম হতে পারে। আমার চেহারা আপনার কোন পরিচিত জনের মত হতে পারে !’

হুজুর যেন তার কথা শুনতেই পেলেন না, তিনি তার হাত ধরে ডান হাতের তালু গভীরভাবে লক্ষ্য করে রেখাগুলো দেখতে লাগলেন। শেষে চোখে খুশির ঝিলিক এনে, হেসে তার চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বিজ্ঞের মত বললেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এ সিংহাসন কার, এ রাজমুকুট কার লক্ষ্য করছি? তোমার চোখে সেই রাজকীয় শান-শওকত এখনও আছে, যা তুমি দেখতে পাও না।

তোমার দাদার দেহরক্ষীর মধ্যে চল্লিশ জিন যুবক তোমার মাতই সুদর্শন ছিলো। আজ তুমি সেই লোকের দেহরক্ষী হয়েছো, যে তোমার দাদার সিংহাসনে জোরপূর্বক বসে আছে। তোমাকে কে বলেছে, তুমি রাজবংশের সন্তান নও? আমার বিদ্যে আমাকে মিথ্যা বলতে পারে না। আমার চোখ ভুল দেখতে পারে না। তুমি কি বিয়ে করেছো?’

‘না!তবে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে!’

হুজুর বললেন ‘তোমার এ বিয়ে হবে না!’

‘কেনো হবে না?’ উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো যুবক।

‘তোমার আত্মার মিলন অন্য কারো সাথে লেখা আছে!’হুজুর বললেন, ‘ কিন্তু সে এখন কোথাও বন্দী!’

রক্ষী যুবক হুজুরের এ কথায় আরো হতভম্ব হয়ে গেলো। সে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে রইলো হুজুরের দিকে।

‘শোন বন্ধু!তুমি এখন মজলুম। কারোর প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে আছো, তুমি বিভ্রান্ত হয়ে আছো। তোমার ধনরত্নের ওপর সাপ বসে পাহারা দিচ্ছে। সে আসলে সাপ নয়, এক রাজকুমারী। সে তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। সেটি ঠিক কোন জায়গা আমি চিনতে পারছি না। যদি কখনও কেউ তোমাকে বলে দেয়তার সন্ধান, তুমি জীবন বাজী রেখে তাকে মুক্ত করতে চলে যেও!’

হুজুর কথা বন্ধ করে আবারো তার দিকে তাকিয়ে খুশির।ঝিলিকমারা একটি হাসি দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন।

নূরানী চেহারার সেই দরবেশের ছবি গেঁথে রইল যুবকের মনে। কিছুক্ষণ তার কোন হুশ ছিলো না। হঠাত সম্বিত ফিরে আসতেই সে দৌড়ে গিয়ে হুজুরকে থামালো।

‘আপনি আমাকে বলে জান, আমার হাতে, আমার চোখে,আপনি আসলে কি দেখেছেন? আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন আপনি?আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করে, আমার চিত্তকে অশান্ত ও চঞ্চল করেকোথায় চলে যাচ্ছেন?’

‘আমি কিছুই নই!’ হুজুর বললেন, ‘যা কিছু অলৌকিক ক্ষমতা দেখছো, সবই তো আল্লাহ পাকের জাত। তিনি চারটি পবিত্র আত্মা আমাকে দান করেছেন। এগুলো আল্লাহর বড় নেক বান্দাদের আত্মা, যারা অতীতের সংবাদ বলতে পারে, ভবিষ্যতের খবরও বলতে পারে।

আমি প্রতিদিন অজিফা পাঠ করি। একদিন ধ্যান তন্ময় হয়ে অজিফা পাঠ করছি, হঠাত মনে হলো আমি আমার পরিচিত জগতে নেই। আমি চোখ মেললাম। এমন এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের জগতে আবিস্কার করলাম নিজেকে, যা কোনদিন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

আল্লাহর ইশারায় আমি আবার অজিফায় মগ্ন হয়ে গেলাম। তখনই এ আত্মাগুলো পেয়ে গেলাম আমি। এ আত্মাগুলো যখন আমার উপর ভর করে তখন আমি অনেক কিছু বলে দিতে পারি। তখন আমার মধ্যে এক সম্মোহনী শক্তি কাজ করে যে, মানুষের চেহারা ও চোখের দিকে তাকালে তাদের বাপ-দাদা ও পরদাদার ছবিও দেখতে পাই। কিন্তু এই অবস্থা আমার মধ্যে সবসময় থাকে না, মাঝে মধ্যে আসে।

যখন আমি তোমাকে দেখলাম, তখন আমি সেই সম্মোহনী অবস্থাতে ছিলাম। কানের মধ্যে ফিসফিস ধ্বনি শুনতে পেলাম, ‘ঐ যুবকটাকে দেখো, সে একজন শাহাজাদা! রাজকুমার! কিন্তু সে তার ভাগ্যলিপি থেকে অজ্ঞাত। সে তার অতীত ভবিষ্যত কিছুই জানে না। এখন সে এক সাধারণ সৈনিকের বেশে অপরের রক্ষী হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

যুবক, সত্যি কথা বলতে কি, এখন আর আমার মধ্যে সে মোহময় অবস্থা নেই। সে অবস্থা কেটে গেছে আমার। এখন তোমাকে আমি শুধু এক সৈনিকই দেখতে পাচ্ছি!’

মানুষের এ এক প্রাকৃতিক দুর্বলতা যে, প্রত্যেক মানুষই অরথ-সম্পদ, মান সম্মান ও প্রতিপত্তির স্বপ্ন দেখে। এই যুবক যখন অরথ-সম্পদ ও রাজকুমারীর একটু ইশারা পেলো তখন তা পাওয়ার জন্য তার মনে আকাঙ্খ্যার জন্ম হলো।

হুজুর একটু হেসে বললো, ‘আমার জ্যোতিষীর কোন বিদ্যে নেই, আমি কোন ভবিষ্যত বক্তাও নই। আমি শুধু এক আল্লাহ ভক্ত দরবেশ মাত্র। যদি আবার আমার মধ্যে সেই সম্মোহনী শক্তি ভর করে, আমি চেষ্টা করবো তোমার সম্পর্কে আরো কিছু জেনে নি

তে। কিন্তু তোমাকে সে কথা জানাবো কি করে? তোমাকে কোথায় পাবো?’

‘আপনি কষ্ট করে আমাকে সংবাদ দিবেন এমন কথা বলে আমাকে গোনাহগার বানাবেন না। আপনাকে কোথায় পাবো বলেন, আমিই আপনার সাথে দেখা করবো!’

‘আমি যেখানে আসতে বলবো তুমি কি সেখানে আসতে পারবে?’

‘হ্যা, পারবো, অবশ্যই পারবো। আপনি যেখানে বলবেন সেখানে গিয়েই দেখা করবো আমি!’

‘সাপের কেল্লার মধ্যে আসতে পারবে?’

‘অবশ্যই পারবো!’

‘আজ রাতে?’

‘জ্বি!’

হুজুর বললেন, ‘গোসল করে পাক-পবিত্র হয়ে দুনিয়ার খেলার থেকে মনকে মুক্ত করে আসবে। আর মনে রাখবে, এ কথা যেন আর কেউ জানতে না পারে। আমি তোমাকে ডেকেছি ও তোমার সাথে সাক্ষাত করেছি, এ কথা জানাজানি হলে সেই সম্মোহনী শক্তি আর নাও আসতে পারে। রাতে অতি গোপনে তুমি সর্প কেল্লায় চলে আসবে!’

যদি ধনরত্ন, রাজকুমারী, রাজ্য ও রাজকমুকুটের লোভ না হতো, তবে এ সৈনিক যতই সাহসি বীরই হৌক না কেন, রাতের অন্ধকারে ঐ সাপের কেল্লায় কখনও যেত না।

সুলতান আইয়ুবীর পিছন দরজায় সন্ধ্যা রাতে ডিউটি পড়লো তার। মাঝরাতে ডিউটি বদল হলো। ডিউটি শেষে সে আর ব্যারাকে ফিরে গেল না, সেখান থেকেই সবার অলক্ষ্যে বেরিয়ে পড়লো সর্প কেল্লার উদ্দেশ্যে।

সে যখন ভাঙ্গা কেল্লার দরজায় এসে পৌছলো তার মনে অজানা ভয় ও শিহরণ ঢুকে গেল। ভয় তাড়ানোর জন্য সে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, ‘কোথায় আপনি? আমি, আমি এসে গেছি!’

তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটি মশাল জ্বেলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক লোক। লোকটিকে দেখে তার মনের ভয় দূর না হয়ে আরও জেঁকে বসলো।

মশাল উচিয়ে লোকটি তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি সেই লোক, হুজুরের সাথে যার রাস্তায় দেখা হয়েছিল?’

‘হ্যা, আমিই সেই লোক!’ যুবক বললো।

লোকটি তখন বললো, ‘আমার পেছন পেছন এসো!’

‘তুমি কি মানুষ?’ সৈনিক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো তাকে।

তুমি আমাকে যেমন দেখছো, আমি ঠিক তাই। মন থেকে সব ভয় দূর করে দাও। আজগুবি কল্পনা ও সন্দেহ থেকে মনকে মুক্ত করো। নিরবে অনুসরন করো আমাকে!’

‘হুজুর এখন…!’

সে প্রশ্ন শেষ করতে পারলো না, তাকে থামিয়ে দিয়ে মশালনবাহী বললো, ‘অহেতুক প্রশ্ন করবে না, তোমার মনের সব প্রশ্নের জবাব পাবে হুজুরের কাছে!’

আগে আগে চলতে লাগলো মশালধারী, পেছনে যুবক। কেল্লার ভেতর অসংখ্য সরু গলি, পেচানো বারান্দা, সিড়ি অতিক্রম করে তারা এগিয়ে চললো।

‘হুজুরকে আর কোন প্রশ্ন করবে না। তিনি যা আদেশ করেন তাই করবে। এমন কিছু করবে না, যাতে তিনি অসন্তুষ্ট হতে পারেন। অত্যন্ত আবেগ ও ভক্তি সহকারে তার সামনে যাবে!’

ভাঙ্গা দেয়াল ও ছাদ থেকে খসে পড়া ইট সুরকির মধ্য দিয়ে, ঘুটঘুটে অন্ধকার গলিপথে যেখানে এসে থামলো মশালধারী, সেখানে একটি বন্ধ দরজা দেখতে পেল যুবক। মশালধারী লোকটি দরজার কাছে এসে উচ্চস্বরে বললো, ‘ইয়া হযরত! যদি আদেশ দেন তবে ভেতরে আসি। আপনি যাকে আসতে বলেছিলেন, সে এসেছে!’

ভেতর থেকে গুরুগম্ভীর কন্ঠে উত্তর এলো, ‘ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও!’

মশালবাহী একদিকে সরে গিয়ে ওকে ইঙ্গিত করলো ভেতরে যেতে।

দুরু দুরু বুকে ভেতরে প্রবেশ করলো রক্ষী। ঢুকেই তার চক্ষূ চরকগাছ, এমন ভয়ংকার ভগ্ন কেল্লার মাঝে এমন রাজকীয় আসবাবপত্রে সাজানো কামরা আছে, এ কথা সে কল্পনাও করেন! মানুষের দৃষ্টি চক্ষুর আড়ালে এ এক আলাদা জগত। মেঝেতে দামী কারপেত, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছেন হুজুর। তিনি চোখ বন্ধ করে তাসবীহ জপছিলেন। সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায়ই তিনি তাকে বসতে ইশারা করলেন।

সে কাম্প্রার এক কোণে বসে গেল। বিচিত্র সুগন্ধে মৌ মৌ করছিল কামরা। যুবক অবাক চোখে তাকিয় রইলো দরবেশের দিকে।

কিছুক্ষণ পর ধ্যানমগ্ন হুজুর চোখ খুলে সিপাহীকে দেখতে পেয়েই হাতের তসবীহ ছুঁড়ে মারলেন তার দিকে। বললেন, ‘এটা গলায় পরে নে!’

যুবক তসবীহতে চুমু দিয়ে আদবের সাথে গলায় পরে নিল। কামরার মধ্যে শামাদানে প্রদীপ জ্বলছিল বিভিন্ন রন্যের।

হুজুর হাততালি দিলো, সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো পাশের কামরার দরজা। সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো এক অনিন্দ্য সুন্দরী।

মেয়েটির চুল খোলা। হাঁটু পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে সে চুল। যুবক এমন রুপসী নারী জীবনে কখনও দেখেছে কিনা মনে করতে পারলো না।

তার হাতে এক সুন্দর পেয়ালা, পিয়ালাটি সে এগিয়ে ধরলো যুবকের দিকে। হুজুর উঠে পাশের কামরায় চলে গেলেন।

যুবক পিয়ালাটি হাতে নিয়ে একবার পিয়ালার দিকে আবার মেয়েটির দিকে তাকাতে লাগলো।

মেয়েটি বললো, ‘হুজুর এইমাত্র ধ্যান ভাঙ্গলেন তো, কিছুক্ষণ বিশ্রাম না নিয়ে তিনি এখানে আসতে পারবেন না। তুমি এ শরবত পান করে আরাম করে বসো!’

মেয়েটির মুখে এমন হাসি, যে হাসিতে ছিলো অন্তরঙ্গতার আমন্ত্রণ। রক্ষী যুবক পিয়ালা হাতে নিয়ে মুখে লাগালো এবং এক ঢোক পান করে আবার মেয়েটির দিকে তাকালো।

‘কি দেখছো যুবক, তোমার মতো এমন সুন্দর সুঠাম যুবককে আমি শরবত পান করাতে পারছি, এ তো আমার সৌভাগ্য!’ মেয়েটি তার কাঁধের ওপর হাত রেখে বললো, ‘পান কর। আমি এই শরবত নিজ হাতে তৈরি করেছি। হুজুর আমাকে বলেছিলেন, ‘আজ রাতে এখানে এক রাজপুত্র আসবে। সেই সুপুরুষ যুবককে প্রাণ ভরে আপ্যায়নের দায়িত্ব তোমার। তাকে খুশি করতে পারবে তো?’

সিপাহী আবার পেয়ালা ঠোঁটে ঠেকাল এবং ঢক ঢক করে সমস্ত শরবত পান করে ফেললো। মেয়েটি তার পাশে বসলো এবং অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো যুবকের দিকে।

তার মনে হলো, সে মেয়েটির দেয়া শরবত পান করছে, আর মেয়েটি পান করছে এক যুবকের সুঠাম দেহের যাদুময় সৌন্দরয।

মেয়েটি তার একান্ত সান্নিধ্যে এসে তার দুটি হাত কাঁধের ওপর তুলে দিল এবং মায়াময় চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি এতো সুন্দর কেন?’

যুবকের সারা শরীর শিহরিত হলো। মনে হলো, শরবতের সাথে মেয়েটির রূপ্সুধাও তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চারিত হয়ে মিশে যাচ্ছে।

ওরা তখনও আলাপে মশগুল, হুজুর োখে তাকিয়ে এসে প্রবেশ করলেন কামরায়। তার হাতে কাঁচের এক গোলক, সাইজে অনেকটা আপেলের মত। তিনি গোলকটি যুবকের হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোমার চোখের সামনে ধরে রাখো আর এর মধ্যে কি আছে গভীর দৃষ্টিতে তা অবলোকন করো!’

যুবক কাঁচের গোলকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অপলক চোখে রইলো। সে দেখপ্তে পেল, বিভিন্ন রঙের অনেকগুলো আলোর শিখা কাঁপছে গোলকের ভেতর।

মেয়েটিও তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল গোলকের দিকে। তার রেশমের মত কোমল চুল যুবকের গাল স্পর্শ করছিলো।

মেয়েটি আরো ভালো করে গোলকের ভেতর কি হচ্ছে তা দেখার জন্য যুবকের কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড়ালো। এতে সে মেয়েটির গায়ের সুগন্ধ ও যৌবনের উষ্ণতা অনুভব করছিল।

একসময় সে অনুভব করলো, গোলকের ভেতর সে আলোর শিখাগুলো আর নেই। আস্তে আস্তে সেখানে ভেসে উঠলো এক সিংহাসন।

সে বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলো, ‘একটা সিংহাসন !’

তেমনি বিড় বিড় করেই হুজুর বললেন, ‘হযরত সোলায়মানের সিংহাসন!’

সে যেন হুজুরের কথে শুনতেই পায়নি, তার মনে হলো এটা তারই কণ্ঠস্বর। হুজুরের সাথে সাথে সে বলতে লাগলো, ‘আমি হযরত সোলায়মানের সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি!’

সে একই কথে গুণ গুণ করে বার বার বলতে লাগলো। শেষে সে আর স্বাভাবিক জগতের মানুষ থাকলো না। সে ঐ কাঁচের গোলকের জগতেই মগ্ন হয়ে গেল।

সে হযরত সোলায়মানের সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। দেখতে পেলো তার ওপর এক নুরানী চেহারার বাদশাহ বসে আছেন। তার ডানে, বামে এবং পেছনে দু’জন করে মোত ছয়টি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েগুলো অপূর্ব সুন্দরী। দেখে মনে হচ্ছিলো যেন পরীর দল। সে গুণ গুণ করছিল, ‘হাঁ, তখতে সোলায়মান বসে আছেন, বাদশাহ সোলায়মান।…এক্সহয়টি পরী ঘিরে আছে তাকে!’

মেয়েটি তার দেহের ভার যুবকের উপর চাপিয়ে তখনো তাকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়েছিল। বাদশাহ সোলায়মানের জায়গায় এবার অন্য একজন লোককে সে দেখতে পেল।

এমন সময় কথা বলে উঠলেন দরবেশ, ‘কাঁচের গোলকের মধ্যে সিংহাসনে বসা এই বাদশাহ তোমার দাদা, যিনি বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক ছিলেন। সম্রাট সোলায়মানের পরীগণ ও তার জীনেরা তার দরবারে তাকে সিজদা করতো। তোমার দাদাকে চিনে নাও। এগুলো তোমার ওয়ারিসের জিনিস! এ সিংহাসন এবং আশে পাশে যা দেখছো এ সবই তোমার!’

হঠাত সিপাহী হতচকিত হয়ে বললো, ‘হায় হায়!একি! সিংহাসন তো নিয়ে যাচ্ছে! ওরা কারা? এত বড় বড় দৈত্য! এত ভয়ংকর! সিংহাসন উচিয়ে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’

সিংহাসন হারিয়ে গেল। কাঁচের গোলকে ফিরে এলো আবার আলোর শিখা। শিখাগুলো থর থর কাপছে, যেন পাগলা নৃত্য শুরু করেছে ওরা।

আইয়ুবীর রক্ষীবাহিনীর এই সদস্য অনুভব করলো, কামরায় নতুন ধরনের একরকম সুগন্ধি ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে কাঁচের গোলকটি অন্ধকার হয়ে গেল এবং তার চোখের সামনে থেকে সব দৃশ্য অদৃশ্য হয়ে গেল। সে বেহুশের মতো নির্বাক, নিশ্চল হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল।

যখন তার কাধ ধরে ঝাকি দিল এবং তাকে বার বার ডাকতে লাগল তখন তার হুশ ফিরে এলো। সে এতটাই কাহিল হয়ে পড়ল যে, সঙ্গাহীনের মত গালিচার ওপর লুটিয়ে পড়ল।

মেয়েটির ডান হাত তার মাথার নিচে পড়ে ছিল। মেয়েটি ঝুকে পড়ে তাকে উঠে বসার জন্য টানাটানি করতে লাগলো।

সৈনিক উঠে বসলো। বিস্মিত, অভিভুত, শ্রান্ত-ক্লান্ত এই রক্ষীর মুখ থেকে প্রথম যে কথা বের হলো তা হলো, ‘এই সিংহাসন আমার দাদার! আমি এই সিংহাসনের ওয়ারিশ!’

‘হ্যা, হুজুর তো তাই বললেন!’ মেয়েটি অতি কোমল স্বরে বললো।

‘হুজুর এখন কোথায়?’সিপাই জিজ্ঞেস করলো।

‘এখন তাকে পাওয়া যাবে না।’ মেয়েটি উত্তর দিল, ‘তুমি তো বলেছিলে রাতের শেষ প্রহরে তোমার ডিউটি, সে কারণে আমি তোমাকে জাগিয়ে দিলাম। রাত অর্ধেকের বেশী পার হয়ে গেছে। তুমি কি এখন ডিউটিতে যাবে?’

সেখান থেকে বের হতে মন চাচ্ছিল না তার। সে বললো, ‘আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, আমি যা দেখেছি তা স্বপ্ন, না বাস্তব?’

মেয়েটি তাকে উত্তর দিল, ‘কেন, তোমার কি অবিশ্বাস হয়? তুমি তো আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসব দেখোনি যে, এটা স্বপ্ন হবে। হুজুর অলৌকিক ক্ষমতাবলে ভেতর তোমার অতীত তুলে এনেছিলেন। তুমি হুজুরের এ ক্ষমতা অস্বীকার করতে চাও?’

‘না না, তিনি মিথ্যে বলতে যাবেন কেন? কিন্তু…’

‘হুজুরের ওপর হুকুম হচ্ছে, তিনি যেন কোন গোপনীয়তা নিজের কাছে লুকিয়ে না রাখেন। কারও কোন গোপন তথ্য পেলে তা যেন তার কাছে পৌছে দেন। কিন্তু এই অবস্থা হুজুরের সব সময় হয় না। কখনও কখনও অলৌকিকতা তার উপর ভর করে। কেবল তখনই তিনি কারও গোপনীয়তা জানতে পারেন।’

রক্ষী সেনা মেয়েটিকে অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগলো, ‘আমাকে হুজুরের কাছে নিয়ে চলো।’

মেয়েটি বললো, ‘তুমি আমার ওপর ভরসা রাখো। কি করে তুমি তোমার সিংহাসন ফিরে পেতে পারো হুজুরের কাছ থেকে তা আমি নিশ্চয়ই জেনে দেবো। এখন হুজুরের সাথে দেখা করে কোন লাভ হবে না। আমার এই দেহ আর আত্মা সবই তোমাকে দিয়ে দিলাম। তোমার জন্য আমার জীবন পড়ে রইল। আজ বরং তুমি ফিরে যাও।

ডিউটিতে না গেলে তোমার বিপদ হতে পারে। তাই আমার পরামর্শ হচ্ছে, এখন তুমি চলে যাও। কাল রাতে আবার এসো। আমি হুজুরের কাছে আবেদন করবো, তুমি কি করে হারানো রাজ্য ফিরে পেতে পার তিনি যেন তা জেনে দেন। আমার ভালোবাসার দোহাই, এসব কথা তুমি এখন কাউকে বলো না।’

সে যখন কেল্লা থেকে বের হচ্ছিল, তখন তার পা আর হাঁটতে চাচ্ছিল না। তার মাথার মধ্যে তার দাদার সিংহাসন চেপে বসেছিল আর অন্তরে অনুভব করছিল মেয়েটির ভালোবাসা। ভালোবাসার আবেশে অন্ধকার রাতে কেল্লার এই ধবুংসাবশেষেও তার কাছে মনে হচ্ছিল অপূর্ব সুন্দর। সে উৎফুল্ল মনে, ভয় ও ক্লান্তিহীন চিত্তে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ঘরের দিকে এগিয়ে চলল।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সকল তৎপরতা যুদ্ধের পরিকল্পনা ও সেনাবাহিনীর ট্রেনিংযের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি নিজের ও কেন্দ্রীয় সামরিক অফিসারদের আরাম হারাম করে দিয়ে এ কাজে লেগেছিলেন।

গোয়েন্দা (ইনচারয ) হাসান বিন আবদুল্লাহ গোয়েন্দা কর্মীদের নিয়ে মহাব্যস্ত। কিন্তু তার ফাঁকেও খেয়াল করলেন, সুলতান অসম্ভব পরিশ্রম করছেন। নিজের দিকে তার কোন খেয়াল নেই।

সুলতানের দেহরক্ষীরা সব হাসান বিন আবদুল্লাহর নিয়োজিত। তারা কয়েকবার হাসানের কাছে অভিযোগ করেছে, সুলতান কাউকে কিছু না জানিয়ে পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান।

আর এদিকে সুলতান ভিতরে কাজে ব্যস্ত আছেন ভেবে আমরা খালি কামরা পাহারা দিয়ে যাই।’

এ জন্য কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীর সঙ্গে দু চার জন বডীগার্ডকে ছায়ার মত লাগইয়ে রাখতে চাইলেন। কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীকে বললেন, ‘যেখানে ফেদাইনরা আপনাকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে পিছু লেগে আছে, সেখানে এভাবে অরক্ষিত অবস্থায় আপনার চলাফেরা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। মেহেরবানী করে আপনি আরেকটু সতর্ক হোন।’

কিন্তু সুলতান এ কথায় তেমন কর্ণপাত করলেন না, তিনি আগের মতোই সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করতে লাগলেন।

এতে হাসান বিন আবদুল্লাহ খুবই পেরেশানীর মধ্যে পড়ে গেল। সে অনুনয় বিনয় কত্রে সুলতানকে বলতে লাগল, ‘দয়া করে আপনি বডীগার্ড ছাড়া বাইরে যাবেন না।’

সুলতান আইয়ুবী তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘এতো অস্থির হচ্ছো কেন, আমাদের সকলের জীবন একমাত্র আল্লাহর হাতে। দেহরক্ষীদের সামনেই ত আমার ওপর চারবার আক্রমণ এসেছে। বেঁচে গেছি, সে তো আল্লাহর ইচ্ছা। আমি তো আল্লাহর সঠিক রাস্তাতেই আভহি। যদি সেই জাতে বারিতালার আমাকে বাদ দেয়ার ইচ্ছা থাকে, তবে তার ইচ্ছাকে, না আমি বাধা দিতে পারবো, না আমাকে বডিগার্ডরা রক্ষা করতে পারবে।

‘তবুও সুলতানে মুহতারাম!’হাসান বিন আবদুল্লাহ বললো, ‘আপনার এই একীনের ওপর নির্ভর করে আমরা বসে থাকতে পারি না। আমার ক্লাছে ফেদাইনদের যেভ সব রিপোর্ট আসছে তাতে রাতেও আপনার শিয়রে পাহারা রাখা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে আমার ওপর।’

‘আমি তোমার রক্ষীদের ডিউটির প্রশংসা করি হাসান!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন। ‘কিন্তু বডিগার্ড নিয়ে আমার মনে হয়, আমার জাতীর ওপর আমার মোটেই বিশ্বাস নেই। সেই শাসকগোষ্ঠীই তার জাতিকে ভয় পায়, যারা জনগণের স্বার্থ হরণ করে তারা কখনও জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারে না।’

‘ভয় তো জাতিকে নয়!’ হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘আমি ফেদাইনদের কথা বলছি।’

‘ঠিক আছে, আমি সাবধান থাকবো।’ সুলতান আইয়ুবী হেসে বললেন।

সাপের কেল্লা থেকে ফিরে রক্ষী তার ডিউটিতে চলে গেল। মানসিক যাতনার মধ্য দিয়ে তাআর সময় কাটতে লাগলো। বার বার কেবল সেই সিংহাসন ও মেয়েটির কথাই ঘুরপাক খেতে লাগলো তার মাথায়। পুরো দিনটিই এভাবেই এক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল।

সন্ধ্যা থেকেই সে সর্প কেল্লায় যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো। রাত একটু গভীর হতেই পা বাড়ালো সেদিকে। তার অন্তরে এখন আর কোন ভয়ভীতি, শংকা নেই।

সে কেল্লার দরজায় পৌছে অন্ধকারেই ভেতরে ঢুকে গেল। বেশ কিছুদূর এগিয়ে গত রাতের মত হাঁক ছাড়লো, ‘আমি এসেছি, আমি কি সামনে অগ্রসর হবো?’

তাকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, মশালের আলো দেখা গেল। মশালবাহী তার কাছে এসে বললো, ‘তুমি অবশ্যই হুজুরের পায়ে সিজদাহ করবে। তিনি আজ কারো সাথে সাক্ষাত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবু তুমি যখন এসেছো, চলে সেও।’

গত রাতের মত সে অন্ধকার পথ মাড়িয়ে মশালবাহীর পিছনে হুজুরের কামরার পিছনে এসে দাড়ালো। আগের মতোই আগের মতই হুজুর ভিতরে যাওয়ার জন্য হুকুম দিলে সুলতানের গার্ড তার পায়ে গিয়ে মাথা রাখলো এবং আবেদন জানালো, ‘ইয়া হযরত! আপনি আমাকে আমার গোপনীয় তথ্য দান করুন। বলুন, আমি কিভাবে আমার উত্তরাধিকার ফিরে পেতে পারি?’

হুজুর হাতের তালি বাজালো। সঙ্গে সঙ্গে সেই মেয়ে পাশের কামরা থেকে বের হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। তার মুখে সেই অমায়িক মধুর হাসি।

যুবক তাকে নিজের পাশে বসতে বললো। হুজুর মেয়েটিকে বললেন, ‘এ যুবক আজ আবার কেন এসেছে? তাকে তো তার সব অতীত দেখানো হয়েছে। এখন সে আবার কি চায়?’

‘ইয়া হযরত! এই গোনাহগার বান্দা আপনার মুরীদ হতে চায়। তার অতিত অপরাধ আপনি ক্ষমা করে দিন!’মেয়েটি বললো, ‘এই বান্দা অনেক আশা নিয়ে আপনার দরবারে এসেছে।’

মেয়েটির অনুনয়ে পীর সাহেব অগত্যা রাজি হলেন আবার সেই অলৌকিক জগতে প্রবেশ করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কাঁচের গোলকটি তার সামনে ধরা হলো। তার আগেই মেয়েটি তাকে শরবত পান করিয়েছে। গোলকটি চোখের সামনে নিয়ে হুজুরের সুমিষ্ট সুরের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সিপাহী গুণ গুণ করতে লাগলো। তার কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো, ‘আমার সামনে শাহ সোলায়মানের সিংহাসন দেখা যাচ্ছে! আমি সোলায়মানের মহল দেখতে পাচ্ছি!উহু! আমার সামনে এখন আমার পূর্ব পুরুষদের শাহী মহল দেখতে পাচ্ছি। এই মহলেই আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম। হ্যা, এই মহলেই আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম।’

সে বার বার একই ধ্বনি উচ্চারণ করতে লাগলো, ‘আমি এই মহলেই জন্মগ্রহণ করেছিলাম।’ সে অনুভব করতে লাগলো, যেন এই শব্দটি তার অস্তিত্তের সাথে মিশে গেছে। সে এই শব্দের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললো।

সে দেখতে পেল,শাহী মহলের মাঝে প্রশস্ত বাগান। সেই বাগানের মাঝে ছুটাছুটি করছে সে।

তার কাছ থহেকে কাঁচের গোলকের অস্তিত্ত্ব হারিয়ে গেল। এখন এ মহল ও বাগান তার কাছে নিরেট বাস্তব। বাগানের প্রতিটি গাছপালা, ফুল-ফল সব কিছুতেইলেগে আছে তার হাতের স্পর্শ। সে এখন সেই ফুলের সুবাস অনুভব করতে পারছে। সে কোন সাধারণ সিপাই নয়, সে একজন রাজকুমার, শাহজাদা!

কখন এই মহল শুন্যে মিলিয়ে গেছে, কখন সে ঘুলিয়ে পড়েছে, কিছুই মনে করতে পারলো না সে। যখন তার চেতনা এলো, তখন দেখতে পেল, মেয়েটির কোলে পড়ে আছে সে। এরপর মেয়েটির সাথে তার অনেক আলাপ হলো।মেয়েটি তাকে বললো, ‘হুজুর বলে গেছেন, এই শাহজাদা তার রাজ্য ফিরে পাবে, কিন্তু কবে, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। আগে জানতে হবে, তার সিংহাসন ও রাজমুকুট কোথায় আছে, কার অধিকারে আছে। এরপর জানতে হবে, সেই সিংহাসন উদ্ধারের উপায় কি? এর জন্য সময় প্রয়োজন।’

মেয়েটি বললো, ‘হুজুর বলে গেছেন, ‘সবকিছু জানতে সাত আত দিন সময় লাগতে পারে, আর গোলক ব্যবহারের জন্য প্রতিদিনই তোমার দরকার হবে। এখন কি করবে তুমি ভেবে দেখো।’

তার পরের দিনগত রাতেও সে আবার ঐ সাপের কেল্লায় গেল। এবার সে চারদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। মেয়েটি তাকে আগের মতোই শরবত পান করালো। এরপর তার হাতে তুলে দেয়া হলো সেই স্বচ্ছ স্ফটিক গোলক। কেউ কিছু বলার আগেই সে কাচের গোলক চোখের সামনে মেলে ধরলো, আর তাতে প্রদীপ শিখার নাচন দেখতে লাগলো। তার চোখে বিভিন্ন রঙের শিখা ক্রমাগত নেচে বেড়াচ্ছিল।

আইয়ুবীর রক্ষী যখন কাচের গোলকের মধ্যে এসব দেখতো এবং দেখতে দেখতে বেহুশ হয়ে যেত তখন মেয়েটি সিপাহীর হাত থেকে ঐ গোলক সরিয়ে নিয়ে রেখে দিত।

তৃতীয় রাতেও তাই হলো। হুজুর তার সামনে বসে চোখে চোখ রেখে যাদুময় স্বরে আস্তে আস্তে বলতে থাকেন, ‘এই ফুল, এই বাগান, আমি এই বাগানে খেলা করেছি।’

সে এই কথা বার বার বলতে লাগলো, মেয়েটির গা ঘেঁষে বসে তার মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকল।

সিপাহী তন্ময় হয়ে বাগানের দৃশ্য দেখছে। চারদিকে সবুজের সমারোহ, কোথাও উচু, কোথাও নিচু। সেখানে ফুটে আছে রঙ বেরঙ্গের ফুল। সে ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ তাকে যেন পাগল করে দিচ্ছে।

সিপাহী দেখতে পেল, বাগানে একটি মেয়ে গুণগুণ সুরে গান গাইছে। সে মেয়েটি তার পাশে বসা যুবতীর চেয়েও বেশী সুন্দরী।

মেয়েটির পরণে রাজকুমারীর পোশাক। সিপাহী এখন আর এই সাপের কেল্লাতে বসে নেই। সে চলে গেছে সে রাজকন্যার পাশে, বাগানে।

যদিও তার সামনে বসে আছে হুজুর, পাশে সে যুবতী, কিন্তু সে সম্পর্কে তার এখন কোন অনুভূতি নেই।

সে বাগানের মেয়েটির কাছে দৌড়ে গেল। মেয়েটিও দৌড়ে এল তাকে দেখে। ওরা পরস্পর কাছাকাছি হলেমেয়েটি তার গলায় পরিয়ে দিল ফুলের মালা।

মেয়েটির শরীর থেকেও ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছিল। ওরা দু’জন হাত ধরাধরি করেবাগানের এক কোণে চলে গেল। সেখানে ঘাসের ওপর বিছান মখমলের কোমল বিছানা। তাতে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে তাজা ফুল।

ওরা সেখানে বসে পড়লো। মেয়েটি বিছানার কোণে রাখা একটি সুরাহী তুলে নিল হাতে। সেখান থেকে শরাব ঢেলে পিয়ালা পূর্ণ করে এগিয়ে দিল যুবকের দিকে। যুবক ঠোট ছোয়ালো পিয়ালায়। আহ কি মিষ্টি! নেশা জাগানো মধুর শরাব!

শরাবের নেশা মাখানো দৃষ্টি নিয়ে ও আবার তাকালো মেয়েটির দিকে। আগের চেয়েও অন্নেক বেশী সুন্দর ওমোহনীয় লাগছে মেয়েটিকে।

মেয়েটি পটলচেরা চোখে তাকালো রাজপুত্রের দিকে। সুরেরমত মধুর শব্দ তরংগ তুলে বললো, ‘আমি কতকাল ধরে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি! এতোদিন তুমি কোথায় ছিলে?’

যুবক কিছু বলতে যাবে, এমন সময় কয়েকজন মুখোশধারি দৈত্যকার লোক এসে মেয়েটিকে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো। মেয়েটি চিৎকার করে উঠলো ‘বাঁচাও,বাচাও’ বলে।

সে দৌড়ে গেল মেয়েটিকে উদ্ধার করতে। কিন্তু কয়েকজন তাকেও জাপটে ধরে অন্য দিকে সরিয়ে নিতে লাগলো। এই হট্টগোলে হাতের গোলকটি কোথায় ছিটকে পড়লো বলতে পারবে না সে।

সে হঠাত তাদের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে দৌড় দিল বাঁচার তাগিদে। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে সম্বিত ফিরে এলো তার।তখনো মেয়েটির হৃদয় বিদারক চিৎকার তার কানে আঘাত করছিল।

সে রাগে দুঃখে পাগলের মত ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল দরবেশ ও তার সঙ্গী মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

ওদের দেখেই সে চিৎকার করে উঠলো, ‘এসব আমি কি দেখলাম?’

‘তুমি তোমার অতীত জীবনটাই দেখছিলে।’ হুজুর তাকে বললেন, ‘আমি তোমাকে ফিরিয়ে এনেছি।’

‘আমি তো সেখান থেকে ফিরে আসতে চাই নি।’ সে অধীর কণ্ঠে বললো, ‘কেন আপনি আমাকে ফিরিয়ে আনলেন, বলুন, কেন আনলেন?’

সে কাঁদতে লাগলো আর বলতে লাগলো, ‘আমাকে সেখানেই পাঠিয়ে দিন। আপনার পায়ে পড়ি, হুজুর, আপনি আমাকে সেখানেই পাঠিয়ে দিন।’ সে দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলো।

‘সেখানে গিয়ে কি করবে তুমি?’ হুজুর বললেন, ‘ যার জন্য যেতে চাও, সে তো এখন অন্যের অধিকারে। তুমি যতক্ষণ অপহরণকারীকে হত্যা করতে না পারবে, ততক্ষণ তুমি তাকে পাবে না। আমি চাই না, তুমি খুনোখুনির মধ্যে জড়িয়ে পড়ো। আর সে ব্যাক্তি এমন শক্তিশালী যে, তাকে হত্যা করা সহজ ব্যাপার নয়।’

যুবক চিৎকার করে বললো, ‘আপনি শুধু বলুন, সে মেয়েটি এখন কোথায়? কার কাছে আছে?’

‘ওকে এখন আর তুমি খুজে পাবে না। যারা ওকে ছিনিয়ে নিয়েছে তারা তোমার চেয়েও শক্তিশালী। তুমি আর কখনও তাকে দেখতে পাবে না। মেয়েটিকে যে ধরে নিয়ে গেছে সে এখন সিংহাসনে বসে আছে, যে সিংহাসনে তোমার বসার কথা ছিল। তার পিছনে না লাগাই তোমার জন্য উত্তম।’

‘আমি তাকে অবশ্যই খুন করবো।’ চিৎকার করে বললো সে, ‘যত বড় শক্তিমানই হোক আমি তাকে ভয় পাই না। সে যদি আইয়ুবীর চেয়েও শক্তিশালী হয় তিবু তাকে আমার হাতে মরতে হবে। খোদার দোহাই লাগে, আপনি শুধু বলুন, কে সেই ছিনতাইকারী? এখন সে কোথায়?’

‘কিন্তু সে কথা বললে যে আমিও এ খুনীর দায়ে পড়ে যাবো বন্ধু!’ হুজুর বললেন।

সৈনিক যুবক তার পায়ের উপর মাথা কুটে বার বার বলতে লাগলো, ইয়া হযরত! আমার ওপর রহম করুন। একবার শুধু বলুন, সে এখন কোথায়?’ সে হুজুরের পা ধরে কাঁদতেই থাকলো। কিন্তু হুজুর কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না।

মেয়েটি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল নারী ও গদীর জন্য দিওয়ানা এক পাগলের আহাজারি।

অষুধে ধরেছে বলে সে মনে মনে খুশী। কিন্তু সেই ভাব গোপন করে চেহারায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে সেও এবার দরবেশের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘হুজুর আমার মা-বাপ, তাকে আপনি নিরাশ করেবেন না। একটু দয়া করুন, নইলে এ যুবক বাঁচবে না। তখন আপনি একজন নিরপরাধ মানুষ খুনের দায়ে পড়বেন। একটু দয়ে করুন হুজুর।’

যেন ওদের অনুরোধেই মন গললো দরবেশের। তিনি বললেন, এতো করে যখন বলছো, তখন আমি এক কাজ করতে পারি। আবার সেই খ্রিস্টাল বল দাও ওর হাতে। আমি কিছুই বলবো না। যদি তার ভাগ্য ভালো থাকে তবে সে নিজেই দেখতে পাবে রাজকন্যা এখন কোথায় আছে, কে তাকে অপহরণ করেছে।’

ওকে আবার সেই জগতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। শাহী মহল ও শাহী বাগ বাগিচায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় সে বলে উঠলো, ‘এই যে আমার দাদার খুনি, এই আমার বাবার খুনি। এই লোক আমার সিংহাসন ও রাজমুকূট আত্মসাতকারী। আরে! এই লোকই তো আমার ভালোবাসার মেয়েকে বন্দী করে রেখেছে!’

পরক্ষণেই সে আবার আঁতকে উঠে বলতে লাগলো, ‘না, না! এটা হতেই পারে না। এ যে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী! তিনি…তিনি এ কাজ করতে যাবেন কেন?’

তখন কামরায় গম গম করে উঠলো এ অচেনা কন্ঠসর, ‘সত্য বড় নির্মম ও নিষ্ঠুর হয় যুবক!তোমাকে আগেই বলে হয়েছিলো এ পথে তুমি পা বাড়িয়ো না। তুমি সে নির্দেশ শোনো নি। এখন তোমার ভাগ্যের খুনিকে দেখে ভয়ে পালাতে চাচ্ছো!

শোন, এ ব্যক্তি সুলতান হতে পারে না, এ ব্যক্তি আরবী নয়, কুর্দি! তুমি আরব! তুমিই বলো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তোমার দাদার খুনি না হলে সিংহাসন পেল কি করে? কি করে এক কুর্দি আরবদের সুলতান হয়?

এখন সমস্ত রহস্য ও ভেদ তোমার কাছে প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। তুমি যদি প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হও তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এ খমতা তুমি হারাবে। স্বপ্নে সে দেখতে পাবে তোমাকে তার হন্তারকরুপে। তখন সে তোমাকে খুন করবে। এ রহস্য ভেদ হওয়ার পর তোমাদের দুজনের একজনকে খুন হতেই হবে। এখন বলো, কে খুন হবে, সে, না তুমি?’

ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেলো সিপাহীর চেহারা। সে বিড় বিড় করে বলতে লাগলো, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী! হ্যা, এ ব্যাক্তি আমার দাদার খুনী! আমার বাবার খুনী! আমার রাজ্য ও সিংহাসনের অন্যায় অধিকারী! আমার ভাগ্যের খুনী! তাকে হত্যা না করলে সে আমারও খুনী হবে। না না, এ সুযোগ তাকে দেয়া যাবে না। তাকে আমি অবশ্যই খুন করবো। আমি আমার বাবার খুনের বদলা নেবো, আমার দাদার খুনের বদলা নেবো! প্রতিশোধ! হ্যা, চরম প্রতিশোধ নেবো আমি।’

শেষে এমন হলো, তার চোখের সামনে সুলতান আইয়ুবী ছাড়া আর কোন দুশমন রইলো না। তার ধ্যানে, তার চোখের সামনে, কল্পনায় শুধুই এক দুশমন ঘুরপাক খেতে লাগলো, আর সে দুশমন হলো সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।

রক্ষী সেন্নার হাতে আবার কৃস্টাল বল তুলে দেয়া হলো। সে দেখতে পেল, আগে আগে যাচ্ছেন সুলতান আইয়ুবী। পেছনে খঞ্জর হাতে এগিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু সুলতানকে হত্যার কোন সুযোগই পাচ্ছে না। অন্যান্য পাহারাদাররা ঘিরে রেখেছে তাকে।

এক সময় সে মেয়েটিকেও দেখতে পেলো। একটি পাখির পিঞ্জরায় বন্দী করে রাখা হয়েছে তাকে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী পিঞ্জরার পাশে গিয়ে দাড়ালেন। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পাষন্ডের মতো হাসতে লাগলেন তিনি।

মেয়েটি উদাস করুন চোখে তাকিয়ে আছে সিপাহীর দিকে। সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় ক্রমশ নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার ছায়া নেমে আসছে। সিপাহীর কানে কে যেন ফিস ফিস করে বলে যাচ্ছে, ‘এই সে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী! তোমার দাদার খুনী! বাবার খুনী……!’

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top