১০. সর্প কেল্লার খুনী

হেমস, হেসাত ও মুসালের শাসনকর্তার কাছেও গেল খলিফার বিশেষ দূত। এসব রাজ্যের আমীরদের কারো দিক থেকে আশাপ্রদ উত্তর পাওয়া গেল, কার কাছ থেকে শুধু পাওয়া গেল সহযোগিতার মৌখিক সমর্থন।

এই জমিদার যখন হলবে এসে পৌছলো তখন খলিফা তাকে খোশ আমদেদ জানালেন। খলিফা সালেহর তিনি অন্যতম যুদ্ধ উপদেষ্টা ছিলেন। তাকে পেয়ে খলিফার উদ্যম আরো বেড়ে গেল। হলবে তাকে একটি পরিপূর্ণ বাড়ি দেয়া হলো বসবাসের জন্য।

এখানে আসার সাথে সাথে তিনি এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, সকালে খলিফার সাথে বের হয়ে যান, আর মধ্যরাতে বাসায় ফিরেন।

এদিকে নিঃসঙ্গ যুবতি স্ত্রী একাকী থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠল। এই একাকীত্ত কাটাতে গিয়ে মাজেদ হেজাযীর সঙ্গে বেশ ( হ্নদ্যতাপূর্ণ ) সম্পর্ক গড়ে উঠল তার।

মাজেদ হেজাযীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ ও মনিব পত্নির প্রতি আন্তরিক সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্যে এক ( আশ্চরযো ) সমন্বয় লক্ষ্য করে বিস্মিত হন জমিদার পত্নি। বডিগার্ড হিসেবেই ষে কেবল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য নয়, পারিবারিক যে কোন কাজেই তার ওপর আস্থা স্থাপন করা যায়।

মাজেদের চমৎকার আচরণ, যাদুর পরশ ছোঁয়া কণ্ঠস্বর, আন্তরিক ব্যবহার, বিশ্বস্ত বন্ধুর ন্যায় সহানুভুতিপূর্ণ আর্দ্র ( হ্নদয় ) খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুবতির হৃদয় মন জয় করে নিল।

মাজেদ তার মিশন সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। ষে মুহূর্তের জন্যেও তার দায়িত্বের কথা থেকে বিস্মৃত হলো না। সঠিকভাবেই তার মিশনের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো।

মেয়েটি তার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য বেছে নিল মাজেদকে। চোখের আড়ালে গেলেই তার ষে মাজেদকে ডেকে নেয় তার কাছে। তার সম্পর্কে গল্প করে কাটিয়ে দেয় সময়।

গল্পচ্ছলেই একদিন মাজেদ তাকে জিজ্ঞেস করলো মনিবের অন্য চারজন স্ত্রীর কথা।

মেয়েটি বললো, ‘তুমি তাদের সম্পর্কে কি জানতে চাও? দেখতে শুনতে তারা কেউ অসুন্দরী নয়। বংশ, (মরযাদা ), ব্যবহার সবই ভালো। স্বামী তাদের অপছন্দ করেছে পুরনো বলে। বয়স কম বলেই আমি স্বামীর প্রিয়ভাজন হতে পেরেছি !’

‘কিন্তু পালাবার সময় কেউ নিজের স্ত্রীদের ফেলে আসে?’

‘আমার মতো যুবতি সঙ্গে থাকলে তার যে অন্য কারী দরকার নেই। কেন বেহুদা ওদের নিয়ে টানাটানি করবেন তিনি?’

‘নিজের প্রয়োজনটাই সব ! তার মানে এমনিভাবে কোন একদিন তোমাকেও ত্যাগ করে তিনি অন্য কাউকে নিয়ে আসবেন?’

‘ধনীদের চরিত্রই এরকম। হাতে যখন টাকা থাকে, বাজারের সেরা জিনিসটাই সব সময় হাত্রত কাছে রাখতে চায় তারা। আমাদের মতো মেয়েদের সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যে তাদের কি এসে যায় !’

‘তুমি এমনভাবে কথা বলছো, যেনো স্বামীকে ঘৃণা করো?’

‘করই তো! যদি আমি তোমাকে আমার মনের কথা বলি, তবে তুমি কি ভাববে আমি জানি না। কিন্তু আমার বলতে খুব ইচ্ছে করছে !’

‘তাহলে বলো ! তোমাকে কে নিষেধ করেছে?’

‘কিন্তু তুমি তা স্বামীর কাছে বলে দিবে না তো?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাকে বিপদে ফেলবে না তো?’

‘আমার স্বভাবে যদি কোন প্রবঞ্ছনা ও ধোকা থাকতো তবে পথেই তোমার স্বামীকে হত্যা করে তোমাদের ধনরত্ন এবং তোমাকে আমি সহজেই ছিনিয়ে নিতে পারতাম !’ মাজেদ হেজাযী বললো, ‘আমি যুবক, কিন্তু আল্লাহকে ভয় করি।কোন নারীকে বিপদে ফেলা সত্যিকার মুসল্মানের স্বভাব নয় !’

‘মাজেদ, আমাকে ক্ষমা করো। আমি আর আমার মনের কথা বেশীক্ষণ গোপন রাখতে পারছি না। তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, তবু আমি বলবো, তোমাকে আমি ভালবাসি !’

মেয়েটি বললো, ‘আর রটাও জেনে রেখো, কোনদিন আমি আমার স্বামীকে ভালবাসিনি, তাকে আমি ঘৃণা করি !’

‘এ তুমি কি বলছো ! একজিন বিবাহিত নারী হয়ে পরপুরূষকে ভালবাসা অন্যায় !’ প্রতিবাদ করে উঠল মাজেদ !

‘হ্যা, অন্যায়। কিন্তু আমার কাহিনী তুমি জানো না, জানলে এভাবে তুমি বলতে পারতে না। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কাছে আমার বিয়ে দেয়া হয়েছে। বলতে পারো, আমি তার কাছে বিক্রি হওয়া মেয়ে। কতবার আমি আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছি, কিন্তু আমি বড় ভীতু মেয়ে ! আত্মহত্যা করার সাহসটুকুও আমি সঞ্চয় করতে পারিনি !’ কান্না কাতর কন্ঠ মেয়েটির।

‘তোমার স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত লোক। অর্থ-বিত্ত, মান সম্মান,পৌরুষ কোনটারই আত্র কোন অভাব নেই। তুমি তাকে ঘৃণা করতে যাবে কেনো?’

‘আমাদের চিন্তা চেতনা ও আদর্শ ভিন্ন। মরহিম জঙ্গীর স্ত্রী আমার মনে ইসলামের যে আলো জ্বেলে দিয়েছেন, ইসলামের যে শিক্ষায় আমাকে শিক্ষিতো করে তুলেছেন, ষে শিক্ষার প্রতি আমার স্বামীর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। যে লোক আল্লাহর বান্দা হয়ে আল্লাহকেই ভালবাসে না, যে আল্লাহ তাকে এতো সম্মান ও নায়ামত দিয়েছেন তার সোকর আদায় করে না, ষে তো মানুষ নামের অযোগ্য।

আমার স্বামী যা করে বেড়ায় তার সবই সভ্যতা ও মানবতার জন্য অকল্যাণকর। এমন লোককে ঘৃণা ছাড়া আর কিইবা দিতে পারি ! এ লোক আমার জীবন টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। মরণ ছাড়া তাইতো এখন আমার আর চাওয়ার কিছু নেই !’

‘কিন্তু এইনা বললে, আমাকে তুমি ভালবাসো ! আমাকে ভালোবাসো বলেই কি এখন মরতে চাচ্ছো?’

‘না, ষে কারণে নয়। মেয়েটি বললো, ‘মরতে চাচ্ছি আমার বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে বলে !’

আমার মনে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পরকে খুবই উচ্চ ধারণা ছিলো।নুরুদ্দিন জঙ্গীর চেয়েও তার কাছে আমার প্রত্যাশা ছিলো বেশী। তুমি আমার ষে ধারণা ও বিশ্বাস কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছো। সত্যি কি সালাহউদ্দিন এতই খারাপ, যেমন তুমি বলেছো?’

‘সালেহা!’ মাজেদ হেজাযী বললো, ‘তোমার গোপণীয়তা তুমি আমার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছো। বিনিময়ে আমিও তোমাকে কিছু গোপন কথা বলতে চাই। আমি তোমার কাছ থেকে এর জন্য কোন ওয়াদা নিতে চাই না, কিন্তু এটুকু বলতে চাই, যদি আমার গোপন কথা ফাঁস হয়ে যায়, তবে তুমিও বাঁচবে না, তোমার স্বামীও বাচবে না !’

‘ভয় নেই, তুমি নিঃসঙ্কোচে তোমার মনের কথা বলতে পারো। আমার ভালোবাসাই তোমার গোপন কথার জামিন্দার !’ বললো সালেহা।

‘আমি সুলতান আইয়ুবীর সামান্য এক গোয়েন্দা ! আমি তোমাকে এটুকু বলতে পারি, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্বন্ধে তোমার যে ধারণা, তার চেয়েও তিনি অনেক পবিত্র ও মহান।

তিনি সেই আমীর ও বাদশাহদের শত্রু, যারা যুবতি মেয়েদেরকে তাদের অন্দরমহলে বন্দী করে রেখেছে। পুরূষ নারীদের কে শুধু আমোদ- ফুর্তির উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করবে, তিনি এই প্রথার ঘোর বিরোধী। তিনি নারী ও পুরূষের সমতা বিধানের এবং শরীয়ত সম্মত জীবন যাপনএর বিধানে বিশ্বাসী।, এ জন্যই তিনি মেয়েদের কে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের পক্ষে।

আমি তোমার স্বামীর বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য মিথযা কথা বলেছিলাম। আইয়ুবীর সেনাবাহিনী দামেশক থেকে পলাতক লোকদের ওপর লুটতরাজ চালিয়েছে এবং তাদের মেয়েদের ধরে আনার জন্য সৈন্য পাঠিয়েছে, এ তথ্য ডাহা মিথ্যা। তিনি ইসলামের পতাকাবাহি কাফেলার নেতা। ইসলামি কাফেলা কখনো অনযায় করে না, এবং অন্যায় বরদাশত ও করে না । আমি ষে ইসলামেরই এক নগন্য খাদেম। ইসলামের স্বার্থেই সুলতান আইয়ুবীর পক্ষ থেকে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য এসেছি আমি !’

মেয়েটির চোখে মুখে আনন্দের বিদ্যুৎ বয়ে গেলো। ষে মাজেদ হেজাযীর একটি হাত চেপে ধরে বললো, ‘তোমার এ গোপন কথা কোনদিন ফাঁস হবে না।তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না।তুমি এখানে কেনো এসেছো আমি বুঝে গেছি। তোমাকে আমি কি সাহায্য করতে পারি শুধু তাই বলো !’

‘উতলা হয়ো না। তোমাকে কিছু করতে হবে না, যা করার আমিই করছি !’’

‘ভয় পেয়ো না। আমাকে অবলা নারী ভেবো না। আমি সেই দলের মহিলা, যাদেরকে নুরূদ্দিন জঙ্গীর স্ত্রী ট্রেনিং দিয়েছিল যুদ্ধ করার জন্য। জঙ্গী বেচে থাকতেই আমরা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ট্রেনিং পেয়েছিলাম !’

মুহূর্ত খানেক থামলো সালেহা। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, ‘আমার বাবা এসব পছন্দ করতেন না। তিনি খুব লোভী লোক ছিলেন। তার কাছে ক্রুশ ও হেলালে কোন পার্থক্য ছিল না। তিনি ছিলেন টাকার গোলাম। টাকা পেয়ে তিনি আমাকে এই লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি জানি, এই কেনা বেচাকে সমাজ বিবাহ বললেও ইসলাম একে বিবাহ বলে না। ইসলামে নারীর পছন্দ ও সম্মতি ছাড়া বিবাহ হয় না !’

‘ইসলাম মেয়েদের সম্মান, ( মরযাদা ) এবং অধিকার দেয় বলেই অতীতে মহীয়সী মহিলারা যুদ্ধের ময়দানে জেহাদের ঝাণ্ডা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার সাহস দেখিয়েছেন। জাতীয় বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজেই মেয়েরা পুরুষদের তাক লাগিয়ে দিতে পারে, এমনকি যুদ্ধে শত্রুদের গতি স্তব্ধ করে দিতে পারে !’সালেহার কথার রেশ ধরে বললো মাজেদ।

‘তুমি ঠিকই বলেছ।সেই মেয়েদেরকে যদি অন্দরমহলে বন্দী রাখা হয়, তখন ষে বিড়াল হয়ে যায়। যেমন হয়েছে আমার অবস্থা !’ বললো সালেহা, ‘যদি আমার স্বামী সাধারণ কোন লোক হতো তবে অনেক আগেই আমি বিদ্রোহ করতাম। তার থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এ লোকের কাছে অর্থ আছে, শক্তি আছে। খলিফার তিনি সামরিক উপদেষ্টা। খিলিফার রক্ষীবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই তার নিজস্ব। তাদের তিনিই রক্ষী বাহিনীতে ভর্তি করিয়েছেন।

আমি তার ছোত বিবি। যুবতি ও সুন্দরী বলেই আমি তার খেলনার পাত্রী ও সামগ্রী। ইচ্ছে থাক্লেও তার এই বিপুল শিক্তির বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়াতে পারিনি।

কিন্তু তার কাছে এসে আমার আত্মা মরে গেছে। বেঁচে আছে শুধু দেহটা। বাইরের দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এখিন আমি যে দুনিয়াতে বন্দী আছি, সেখানে শুধু শরাব, নাচ ও গানের মাতামাতি। আর আছে আইয়ুবীকে হত্যা করার বিরামহীন চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র !’

কথা কথা বলতে বলতে হঠাত ষে থেমে গেলো সালেহা। মাজেদ হেজাযীকে ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘ তুমি কি আমার কথা শুনছো?’ তুমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা হও বা আমার শামীর গোয়েন্দা হও, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি যদি আমার সামীর গোয়েন্দা হও তবা তাকে সব কথা ঠিকঠাক মত বলে দিও। তিনি আমাকে যেমন খুশি শাস্তি দিক, আমি তার পরোয়া করি না। এখন আমি যে কোন শাস্তি সহ্য করার জন্য প্রস্তুত। আত্মা তো আমার আগেই মরে গেছে, এ পোড়া দেহ আর কতটুকুই বা কষ্ট পাবে !’

‘না, তোমার আত্মা মারা যাউ নি !’ মাজেদ হাজাযী বললো, ‘ আমার দৃষ্টি তোমার আত্মার গভীর তলদেশ ( পরযন্তো ) দেখতে পাচ্ছে।আমি দেখতে পাচ্ছি, সেখানে এক মুজাহিদের সতেজ আত্মা তোলপাড় করছে। এখন নয়, আরো আগেই আমি ষে আত্মার সন্ধান পেয়েছিলাম। সেই ভরসাতেই আমি তোমার কাছে আমার গোপন কথা ব্যক্ত করেছি।

আমি রুপ, যৌবন ও ( সৌন্দরয ) দেখে বশীভূত হওয়ার মতো লোক নই। ইসলামের ( সৌন্দরয ) দেখার পর আর কোন ( সৌন্দরয )দেখার প্রয়োজন নেই আমার। ইসলামের জন্য এ জীবন আমি উৎসর্গ করে দিয়েছি।

তোমার মনে আগ্নেয়গিরির যে লাভা টগবগ করে ফুটছে তা বের হয়ে আস্তে দাও। তোমার যত কথা আছে সব খুলে বলো আমাকে। মনটা হাল্কা করো। আমি মনোযোগ দিয়েই তোমার কথা শুনছি !’

‘না মাজেদ, আমার মনের কষ্ট প্রকাশ করে তোমার আত্মাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার দুঃখের কাহিনী আমার বুকেই কবর হয়ে যাক !’

‘কিন্তু সালেহা ! তোমার এ কাহিনী নতুন কিছু নয়। এটাই যে আজ প্রত্যেক মুসলমান নারীর জীবন কথা, মর্মব্যথা। যে দিন থেকে ইসলামের অধঃপতন শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই মুসলমানদের অন্দরমহলগুলো এ চাপা কান্নায় ভরে উঠেছে।

সুন্দরী মেয়েদের কিনে এনে বন্দী করার (বরব্রতা ) ইসলাম কোন মানুষকে শিখায় নি।

‘অধঃপতনের এখানেই শেষ নয় নয়। তুমি শুনলে অবাক হবে, খ্রিস্টান যুবতীদের নিয়ে এখন আমীর ও বিত্তবানদের হেরেমগুলো ভরে উঠেছে !’

‘জানি, আমরা এ সবই জানি। আমীরদের মহলগুলো খ্রিস্টান যুবতী ও সুন্দরীদের নিয়ে ভরে উঠার পরও তারা কেবল মুসলমানই থাকছে না, এই অসভ্যতার পরও তারা মুসলমানদের নেতা বনে যাচ্ছে !’

‘আমার স্বামীর মহলেও তাই হয়েছে।মেয়েটি বললো, ‘আমার চোখের সামনেই খ্রিস্টান মেয়েরা আমার স্বামীকে নিয়ে আড্ডা মারে, তাকে শরাব পান করায়। তখন কান্না ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকে না !’

‘কিন্তু এতে যে আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীতে ফাটল ধরছে, এই বোধটুকুও নেই আমাদের আমীরদের !’

‘না, ওই মেয়েরা আমার স্বামীকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়েছে, এ জন্যে আমি মোটেও দুঃখিত নই, আমার একমাত্র আফসোস ও দুঃখ হচ্ছে তারা তাকে ইসলাম থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। অথচ ইসলামের জন্যই আমাদের জীবন মরণ। কেবল তারই এবাদত করার জন্য আল্লাহ আমদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন !’

মাজেদ হেজাযী তাকে আর এগুতে দিলো না। বললো, ‘এখন ওসব আবেগের কথা রাখো। যে কাজের জন্য আমি এখানে এসেছি সেই কাজের কথা শুনো !’

মাজেদ হেজাযী তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার স্বামীর ওপর তোমার প্রভাব কেমন? ষে কি তোমাকে বিশ্বাস করে? তার কাছ থেকে তার। মনের গোপন কথা কি তুমি বের করে আনতে পারবে?’

মেয়েটির মুখে তাচ্ছিল্লের হাসি খেলে গেল। বললো, ‘তা না পারার কি আছে ! দুই পেইয়ালা শরাব আর একটু আদর মনের গভীর গহীন থেকে এমন কোন কথা নেই যা বের করে আনা সম্ভব নয় !’ মেয়েটি বললো, ‘তুমিম কি তথ্য জানতে চাও?’

ষে একটু চিন্তা করে হেসে বললো, ‘তুমি আমার ব্যক্তিগত একটি শর্ত মেনে নিবে? আমি যদি তোমার কাজ করে দেই তব্ব কি তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে? এই বন্দীশালা থেকে মুক্তি দেবে আমাকে?’

মাজেদ হেজাযী তার শর্ত মেনে নিলো। বললো, ‘খলিফা আল মালেকুস সালেহ মাত্র এগারো বছরের বালক।তিনি আমীরদের হাতের খেলনা মাত্র। এসব আমীর ও উজিররা সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করে ইসলামি সাম্রাজ্যকে খন্ড বিখন্ড করে একেকজন সেই ক্ষুদ্র অংশের শাসক হতে চায়। খ্রিস্টানরাও তাই চায়। ইসলামী সালতানাত খন্ড বিখন্ড হলে তা গ্রাস করা সহজ হয়ে যাবে তাদের পক্ষে। সহজেই তার ইসলামের নাম নিশানা মুছে দিতে পারবে।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বলেন, ‘যে জাতি তার রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে, ষে জাতি কোন দি বেঁচে থাকতে পারে না !’ আমাদের এ সকল আমীররা খ্রিস্টানদের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছে। খ্রিস্টানরাও নিজেদের স্বার্থেই তাদের সাহায্য করতে এহিয়ে এসেছে।

আমি এ কথা জানার জন্যই এখানে এসেছি, খলিফার দরবারে কি পরিকল্পনা হচ্ছে, খ্রিস্টানরা তাকে কিভাবে এবং কতটুকু সাহায্য দিচ্ছে। জাতীয় স্বার্থে এ সংবাদ জানা খুবই জরুরী। আমাকে অতিসত্তর এ সংবাদ সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌছাতে হবে, যাতে তিনি সেই মোতাবেক প্রস্তুতি নিতে পারেন। নইলে এমনও হতে পারে, সুলতান আইয়ুবী খ্রিস্টানদের আক্রমণের মুখে পড়ে যেতে পারেন !’

‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কি মুসলমান আমীরদের উপরও আক্রমণ চালাবেন?’ মেয়েটি প্রশ্ন করলো।

‘যদি প্রয়োজন হয় তিনি তাতে দ্বিধাবোধ করবেন না !’

এই জবাব শুনে মেয়েটির চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ষে আবেগ তাড়িত কণ্ঠে বললো, ‘হায় ! সেই দিনগুলোও আমাদে দেখতে হলো, একই রাসূলের উম্মতরা আজ শত্রুদের রেখে নিজেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে হাতে !’

‘এ ছাড়া যে আর কোন গতি নেই আমাদের !’ মাজেদ হেজাযী বললো, ‘ সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তো বাদশাহ নন, তিনি আল্লাহর সৈনিক। তিনি বলেন, ‘ দেশ ও জাতিকে ভয় ও আশংকা থেকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব আল্লাহ সৈনিকদের ওপরই ন্যস্ত করেছেন !’

তিনি আরও বলেন, ‘ সেনাবাহিনী সরকারের হাতের খেলার পুতুল হতে পারে না। তাদের দায়িত্ব জাইত্র মান-সম্মান ও আজাদি রক্ষা করা।আর তা করতে গিয়ে যদি গাদ্দার ও ক্ষমতালোভীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়, তাহলে আমাদের তাও ধরতে হবে !’

‘উনি ঠিকই বলেছেন। গায়ের ফোঁড়া না কাটলে তাতে পচন ধরে। সেই পচন কখনো কখনো মৃত্যুর কারণও হতে পারে। জাতির ভাগ্য বিক্রি করে যারা নিজেদের ভাগ্য গড়তে চায় তারা সমাজদেহের বিষাক্ত ফোড়া, এই ফোড়া যত তাড়াতাড়ি সরানো যায় তাতই মঙ্গল ।এখন বলো, ‘এ ক্ষেত্রে আমি তোমাকে কি সাহায্য করতে পারি?’

‘সামরিক বাহিনী সরকারের শক্তির অন্যতম উৎস এ এখন তোমার কাজ হলো, স্বামীর কাছ থেকে তাদের পরিকল্পনা এবং গোপন তথ্য সব জেনে দেওয়া !’

‘আমি গোপন তথ্যও দেবো, আন্তরিক দোয়া ও শুভেচ্ছা ও জানাবো। কিন্তু আমার একটি দাবী আছে, যখন তুমি এখান থেকে দামেশক রওনা হবে, তখন তোমার গোপন তথ্যের সাথে তার সরবরাহকারীকেও রাখতে হবে। এ শর্তের কথা কিন্তু ভুলে যেয়ো না !’ বললো মেয়েটি।

ত্রিপলীর খ্রিস্টান রাজা রিমান্ডের কাছ থেকে খলিফা আল মালেকুস সালেহের পাঠানো দূত যেদিন ফিরে এলো তার পরের দিন।

মেয়েটি মাজেদ হেজাযীকে বললো, ‘আজ রাতে আমি আমার স্বামীর কাছ থেকে অনেক গোপন তথ্য আদায় করেছি। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল তৈরী করছে তারা। আমি যখন তাকে বললাম, ‘তোমরা আসলে কাপুরুষ। নইলে এতো বড় রাজ্যের খলিফা, এত যার সৈন্য সামন্ত, সামান্য কয়েক হাজার সৈন্যের ভয়ে দামেশক থেকে পালিয়ে হলবে এসে আশ্রয় নিয়েছো, আর এমন দেখাচ্ছো, যেনো প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধের ময়দানে কাটাচ্ছো, এত যারা ভীতু তাদের রাজ্য রাজ্য খেলার খেলার কাজ কি?’

স্বামী বললো, ‘দেখো ঠাট্টা করবে না বলে দিচ্ছি। আইয়ুবীর সামনে তো পড়োনি, পড়লে বুঝতে !’

‘ওরে আমার বীর পুরুষ ! এক আইয়ুবীর ভয়েই কম্ম সারা ! যেই খলিফার সামরিক উপদেষ্টার এত সাহস, সেই খলিফার ভাগ্যে কি আছে আল্লা মালুম !’

আমার এ কথায় ভয়ানক ক্ষেপে উঠলেন তিনি। গজর গজর করতে করতে বললেন, ‘বেকায়দায় পড়লে নাকি চামচিকাও হাতির গায়ে লাথি মারে। বলো, ‘ আর কয়দিন বলবে ! আরে, আইয়ুবী তো কয়েক দিনের মেহমান মাত্র ! ফেদাইন গ্রুপের খুনি পীর মান্নানকে দায়িত্ব দিয়েছি। শ্রীঘই সুলতান আইয়ুবীর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মান্নানকে তো চেনো না ! এ কাজে তার মত দক্ষ ব্যক্তি এ তল্লাটে আর নেই !’

‘সেনাবাহিনী রেখে এখন একজন মাত্র খুনীর উপর ভরসা করছো !’

আরে না না! আমাদের সেনাবাহিণি গঠনের কাজ পুরোদমেই চলছে। শীতপকাল এসে গেছে প্রায়। পাহারী এলাকায় বরফ পড়াও শুরু হয়ে গেছে। পুরোমাত্রায় বরফ যখন পড়বে, আমরাও তখন চড়াও হবো আইয়ুবীর উপর। সুলতান আইয়ুবী ও তার সৈন্যরা মরুভূমিতে যত সচ্ছন্দে লড়াই করতে পারে পাহাড়ী এলাকায় এত শীত ও বরফের মধ্যে ততটা দক্ষতা দেখাতে পারবে না !’

এভাবেই শুরু।

নারী ও মদের নেশা একজন পুরুষের বুক থেকে সকল গোপন তথ্য বের করে নিতে পারে। মেয়েটি প্রতি রাতে তার স্বামীর কাছ থেকে সারা দিনের খবরা-খবর জেনে নিতে থাকে, আর পরদিন সকালে এসব গোপন তথ্য মাজেদ হেজাযী তার মনের খাতায় লিপিবদ্ধ করতে থাকে।

কিন্তু এ অবস্থায় বাধা এলো হঠাত করেই। একদিন তার স্বামী মাজেদ হেজাযীকে দেকে বললো, ‘তোমার সম্পর্কে আমার কানে কিছু আপত্তিকর অভিযোগ এসেছে। তুমি নাকি আমার অনুপস্থিতিতে বেশীরভাগ সময় আমার বেগমের কাছে বসে থাকো এবং তোমাদের মেলামেশা আপত্তিকর ( পরযায়ে ) গিয়ে পৌঁছেছে !’

মাজেদ কেঁপে উঠলো। ভাবলো, হয়তো সব গোপন ফাঁস হয়ে গেছে ! ষে মাথা নিচু করে মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

মেয়েটির স্বামী আবার বললো, ‘আমি জানি, আমার তুলনায় তুমি সুন্দর ও বয়সে যুবক। আমার স্ত্রী তোমাকে পছন্দ করে ফেলতে পারে। এমনও হতে পারে, তুমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারো। কিন্তু আমি ষে সুযোগ তোমাকে দেবো না। যদি অভিযোগ সত্য হয় এবং তুমি আমার স্ত্রীর দিকে নজর দিয়ে থাকো, থাহলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো !’

মাজেদ হেজাযী তাকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করলো। বললো, ‘এটা আপনার ভুল ধারণা। উনি আমার মালকিন ! উনার দিকে আমি কুনজর দিতে যাবো কুন সাহসে !’

মাজেদ হেজাযীর কণ্ঠে যাদু ছিলো। মালিক চরম ব্যবস্থা নিতে গিয়েও আর নিলেন না। বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তদন্ত করে দেখছি। মুখ দেখে তোমাকে যতটা নিষ্পাপ মনে হয়, বাস্তবে তার সত্যতা কতটুকূ আমাকে খতিয়ে দেখতে হবে !’

মাজেদ হেজাযী এখান থেকে সরে যেতে চাচ্ছিলো না। এখনও খলিফা সালেহর পূর্ণ পরিকল্পনা তার জানা হয় নি তার। তাই ষে মনিবের দাপট ও ধমক নিরবে সহয করে নিল। অনুনয় বিনয় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। বললো, ‘আমি কোন অপরাধ করিনি, তবু যখন আপনার মনে সন্দেহ জেগেছে, এখন থেকে আরও সতর্ক থাকবো। কোন রকম অভিযোগ করার সুযোগ বিবো না কাউকে !’

মাজেদ যতই তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুক, কারো মনে একবার সন্দেহ দানা বেঁধে উঠলে তা দূর করা কঠিন।

জমিদার মাজেদ হেজাযীকে সাবধান করার সাথে সাথে তার স্ত্রীর ওপরও কড়া নিষেধাজ্ঞা জারী করলো, ‘মাজেদ হেজাযীর সাথে কখনো মেলামেশা করবে নে !’

এতেও সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলো না, সেদিনই সে আরো কয়েকজন নতুন বডিগার্ড নিয়োগ করলো।

ষে যুগে আমীর ও ধনী লোকদের সম্মান নির্ধারণ করা হতো বডিগার্ডের বহর দেখে।

জমিদারের বডিগার্ড সংখ্যা মাজেদ হেজাযীসহ এখন সাতজন।জমিদার তাদের মধ্য থেকে একজনকে কমান্ডার বানিয়ে দিলো। কমান্ডার মাজেদ হেজাযীকে নির্দেশ দিয়ে বললো, ‘যেহেতু মালিক তোমার ওপর খুশী নয়, ষে জন্য মালিকের দরজার কাছেও যাওয়া উচিৎ নয় তোমার। আর রাতে এক মুহূর্তের জন্যেও থাকতে পারবে না !’

মাজেদ বিনয়ের সাথে তার এ আদেশ মেনে নিলো।

এরপর ঘটনাহীনভাবেই কেটে গেল দু’তিন রাত। একদিন দুপুর রাতে মেয়েটি বাড়ির বাইরে এলো। বাইরের গেটে এক গার্ড ছিল পাহারায়। মালিকের স্ত্রীকে দেখেই ষে সালাম করে আদবের সাথে দাঁড়িয়ে রইলো।

মেয়েটি (করত্রিত্তের ) সুরে বললো, ‘তুমি কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে,নাকি বাড়ির চারদিকে পায়চারী করবে?’

ষে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে, মেয়েটি আবার বললো, ‘তুমি নতুন এসেছো, তাই না? নিয়ম কানুন এখনো সব রপ্ত করতে পারো নি। এদিক থেকে দামেশকের প্রহরী খুব হুঁশিয়ার ও সতর্ক ছিলো ! চাকরী করতে হলে তোমাকেও হুশিয়ার ও সতর্ক থাকতে হবে। তোমাদের মালিক খুব কড়া মেজাজের মানুষ। ডেউটিতে কোনরকম গাফলতি দেখলে চাকরী থাকবে না কারো !’

প্রহরী সসম্মানে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।

মেয়েটি বডিগার্ডরা যেখানে থাকে সেদিকে এগিয়ে গেলো। গেটের পাহারাদআর দৌড়ে গিয়ে কমান্ডারকে জানালো, ‘মালকিন আমাদের পাহাড়া তদন্ত করতে এসেছেন !’

কমান্ডার হতভম্বের মত ছুটে এসে তার সামনে মাথা নত করা দাঁড়ালো। মেয়েটি তাকেও কড়া ধমক লাগালো, বাড়ির চারদিকে ডিউটির এ অব্যবস্থা কেনো?’

কমান্ডার ডিয়টি তদারক করতে চলে গেলো।

মেয়েটি অন্য একটি কামরার সামনে এসে দাঁড়ালো এবং গোরে জোরে কথা বলতে লাগলো। মাজেদ হেজাযী এ কামরাতেই শুয়ে ছিলো।মেয়েটির হাক ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। ষে ছুটে বাইরে এলো।

মেয়েটি তার সঙ্গেও কড়া মেজাজে কথা বললো, ‘পাহারাদারদের এতো ঘুমালে চলবে কি করে?’

ততক্ষণে কমান্ডার ডিউটি তদারক শেষে আবার ফিরে এসেছে সেখানে। মেয়েটি কমান্ডারকে আমনে পেয়েই আদেশ করলো, ‘আমার এখুনি খলিফার মহলে যেতে হবে !’ তারপর বিরতি না দিয়েই মাজেদের দিকে ফিরে বললো, ‘তোমার এখন ডিউটি নেই, তাই না? ঠিক আছে তুমিই চলো।

‘যদি মালিক আপনার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেন তবে কি বলবো?’ কমান্ডার তাকে প্রশ্ন করলো।

‘আমি কোন প্রমোদ ভ্রমণে যাচ্ছি না !’ মেয়েটি আরো ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো, ‘মালিকের কাজেই যাচ্ছি ! যাও, জলদি ঘোড়া রেদি করো !’

কমান্ডার এক প্রহরীকে আস্তাবল্র পাঠিয়ে দিল। মাজেদ হেজাযী দ্রুত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিল। মেয়েটি তাকে নিয়ে আস্তাবলের দিকে রওনা দিল।

কমান্ডার তার মালিককে বলে রেখেছিল, ‘মাজেদ হেজাযীর ওপর কড়া দৃষ্টি রাখবে, যেন ষে মহলের ভেতর যেতে না পারে !’ এখন মালকিন নিজেই মাজেদকে বেছে নিলেন। এ অবস্থায় কমান্ডার কি করবে ভেবে পেল না। ষে হতভম্বের মতো তাকিয়ে দেখলো, তারা দুজনেই আস্তাবলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সে একবার ওদের বাঁধা দেবার কথা চিন্তা করলো, কিন্তু পরক্ষণেই তা বাতিল করে দিল এই ভেবে, ‘মালিকের স্ত্রীও মালিক। তার কোন কাজে বাঁধা দেয়ার এখতিয়ার আমার নেই !’

তখনই তার মনে হলো, এ সংবাদ এখনই মালিককে দেয়া দরকার। তিনি যা নির্দেশ সেভাবেই এগুনোই ভালো।

সে ভয়ে চয়ে গেট পেরিয়ে মহলের ভেতরে গেল এবং মালিকের কামরার দরজায় নক করলো। ভেতির থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সে আবারো নক করে দরজা খোলার অপেক্ষা করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ভেতর থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায় সে আস্তে করে দরজায় ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। ভেতরে পা রাখলো কমান্ডার।

ভেতরে প্রদীপ জ্বলছিল।কামরা ভরা শরাবের গন্ধ। সে তার মালিকের দিকে তাকালো। বিছানায় পড়ে আছেন তিনি। মাথা ও একটি হাত পালংকের পাশে ঝুলছে। একটি খঞ্জর বিদ্ধ হয়ে আছে তার বুকে। খঞ্জরটি যেখানে বিঁধে আছে তার আশেপাশে আরো কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন জ্বল জ্বল করছে।

কমান্ডার হাত ধরে তার পালসের গতি দেখলো। সব শেষ, জীবনের কোন স্পন্দন নেই সেখানে। তার কাপড় চোপড়, বিছানা রক্তে ভেজা। কমান্ডার বিষ্ময়ে বিষ্ফোরিত নয়নে সে রক্তের দিকে তাকিয়ে রইলো।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও মেয়েটি স্বামীকে শরাব পান করাচ্ছিল আর তার কাছ থেকে কিভাবে কথা আদায় করা যায় তা ভাবছিলো। অন্যান দিনের তুলনায় স্বামীর চেহারায় সে খুশীর আভা দেখতে পেল। এটা নিয়েই কথা শুরু করলো সে, ‘কি ব্যাপার ! খুব খুশী মনে হচ্ছে আজ তোমাকে?’

‘আরে খুশি হবো না, ফেদাইন গ্রুপের গুপ্তঘাতক আজই রওনা হবে আইয়ুবীর উদ্দেশ্যে।আইয়ুবীর হাত থেকে নিস্তার পাওইয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র !’

খবরটা শোনা মাত্রই শিহরণ খেলে গেল তার দেহে।আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্যে আজই রওনা হবে গুপ্তঘাতক ! এ খবর এখুনি মাজেদকে জানানো দরকার ! দেরি হলে যে কোন মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে !

সে তার স্বামীকে প্রতিদিনের মতো শরাব পান করালো। আজ সে এত বেশী খেয়েছে যে, বেহুশ হয়ে গেল। মেয়েটী তাকে অজ্ঞান অবস্থায়ই ফেলে আসতে পারতো কিন্তু তার মধ্যে জেগে উঠলো প্রচন্ড প্রতিশোধ স্পৃহা। প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে সে খঞ্জর দিয়ে তার বুক ঝাঝরা করে দিলো এবং শেষে খঞ্জর তার বুকে বসিয়ে রেখেই চলে এল ঘরের বাইরে।

মাজেদ হেজাযী এ কাহিনী শুনে মোটেও ভীত হলো না। সে তো প্রতি মুহূর্তে কোন না কোন বিপদ মোকাবেলা করার জন্যই এ জীবন বেছে নিয়েছে।

সে মেয়েটির এ দুঃসাহসিক কাজের প্রশংসা করে তাকে জলদি ঘোড়ায় উঠতে বললো এবিং নিজেও দ্রিত ঘোড়ায় উঠে বসলো।

বিষ্ময়ের ঘোর কাটতেই কমান্ডার দ্রুত বাইরে ছুটে এলো। ছুটে গেল আস্তাবলের দিকে। চিৎকার করে বলতে থাকলো, ‘ওদের ঘড়া দিও না, আটকাও ওদের। মালকিন তার স্বামীকে হত্যা করে পালাচ্ছে !’

প্রহরীরা এ চিৎকার শুনে তলোয়ার ও বর্শা হাতে ছুটে এলো। ততক্ষণে মাজেদ ও মেয়েটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে।

প্রহরীরা ছুটলো আস্তাবলের দিকে। আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিয়ে বেরোনোর একটাই রাস্তা, যে রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে প্রহরীরা। মাজেদ সালেহাকে বললো, ‘যদি ঘোড়া চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকে তবে আমার পিছনে উঠে বসো। কারণ ওদের হাত থেকে বাঁচতে হলে প্রাণপণে ঘোড়া ছুটাতে হবে !’

সালেহা আত্ম বিশ্বাস নিয়ে বললো, ‘ভয় পেয়ো না, আমার ট্রেনিং আছে। তুমি ঘোড়া ছুটাও !’

মাজেদ হেজাযী বললো, ‘তবে তুমি আমার পিছনে একদম লেগে থাকবে !’

মাজেদ তলোয়ার হাতে নিলো। ওদিকে বডিগার্ডদের চিৎকার বেড়ে গেল। তারা হৈ চৈ করতে করতে আস্তাবলের দিকে ছুটে আসছিল।

মাজেদ হেজাযী তাদের দিকে মুখ করে প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।তার পিছনেই মেয়েটির ঘোড়া।

কমান্ডারের গর্জন ভাসে এলো, ‘থামো!নইলে মারা পড়বে !’

চাঁদনী রাত। মাজেদ দেখতে পেলো, প্রহরীরা বর্শা উচিয়ে ছুটে আসছে। সে ঘোড়ার তাদের দিকে রেখেই প্রবল বেগে তলোয়ার ঘুরাতে থাকলো।

ঘোড়ার গতি স্বাভাবিকের চেয়ে ছিল দ্রুত।দুই বডিগার্ড বাঁধা দিতে এসে ঘোড়ার পায়ের তলে পিষ্ট হয়ে গেল। একজন বর্শা ছুঁড়ে মারলো তার দিকে, সে তলোয়ার দিয়ে বর্শার গতি ফিরিয়ে দিল।

‘তোমরা তীর ধনুক বের করো !’ চিৎকার জুড়ে দিল কমান্ডার।

প্রহরীদের পেরিয়ে এল ওরা। কিন্তু প্রহরীরাও ছিলো যথেষ্ট পটু। তারা তাড়াতাড়ি তীর বের করে ছুড়ে মারলো। তাড়াহুড়োর কারণে তীর মাজেদ বা মেয়েটি কারো গায়েই লাগলো না। পর পর দুটো তীর ওদের পাশ দিয়ে শা করে চলে গেল।

তীরের নিশানা থেকে বাঁচবার জন্য ওরা এঁকেবেঁকে ঘোড়া ডানে ও বায়ে ছুটিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই তীরের আওতার বাইরে চলে এলো।

মাজেদ ভয় পাচ্ছিলো, গার্ডরা ঘোড়া ছুটিয়ে পিছু ধাওয়া করবে। কিন্তু আরো কিছুদূর যাওয়ার পর তাদের সে ভয় দূর হয়ে গেলো। এখন আর তাদের ধরা পড়ার কোন ভয় নেই ।

আসলে ঘোড়ার পিঠে জীন আটার জন্য যে সময়টুকূ দরকার ছিলো গারডদের, সে সুযোগে তার অনেক দূরে চলে এসেছে।

লোকালয় থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। অনেক দূর যাওয়ার পর দূর থেকে ঘোড়ার পিছু ধাওয়ার শব্দ কানে এলো মাজেদের। সে মেয়েটিকে বললো, ‘বিপদ এখনো পিছু ছাড়ে নি, আমার পাশে পাশে ঘোড়া চালাতে থাকো !’

মেয়েটি ঘোড়া নিয়ে তার পাশাপাশি চলতে লাগলো। মাজেদ হেজাযী বললো, ‘ভয় পাচ্ছো না তো?’

মেয়েটি এর কোন উত্তর না দিয়ে সমান তালে ঘোড়া ছুটিয়ে জোড়ে জোড়ে বলতে লাগলো, ‘আমি আরো অনেক গোপন কথা জানতে পেরেছি। সব কথা তোমার শোনা দরকার !’

মাজেদ বললো, ‘আগে কোথাও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়ে নেই। ওখানে গিয়েই তোমার সব কথা শুনবো !’

কিন্তু মেয়েটির তর সইছিল না, সে ছুটতে ছুটতেই কথা চালিয়ে যেতে লাগলো।

মাজেদ হেজাযী বার বার তাকে চুপ থাকতে বললো। চলন্ত অবস্থায় তার কথা সব বুঝে উঠতে পারছিলো না মাজেদ। ছুতটে ছুটতেই মাজেদ বললো, ‘তোমার সব কথা বুঝতে পারছি না !’

শেষে মেয়েটি ( অধৈরযো ) কন্ঠে বললো, ‘তবে থেমে যাও। আমি আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছি না !’

মাজেদ থামতে ছাচ্ছিল না, কিন্তু মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মাজেদের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলো।

সামনের দিকে জগুকে পড়লো মাজেদ, তখনই তার নজরে পড়লো তীরটি। মেয়েটির বাম দিকে গেঁথে আছে একটি তীর। মেয়েটির চলার সাথে তাল মিলিয়ে দোল খাচ্ছে সামনে, পিছনে। মাজেদ জলদি ঘোড়া থামালো।

মেয়েটি বললো, ‘আমার গায়ে তীর লাগার কারণেই আমি চলন্ত অবস্থায় সব তথ্য তোমাকে দেয়ার জন্যে পেরেশান হয়েছিলাম। মরার আগেই তোমাকে তথ্যগুলো জানানো দরকার। তাই তোমাকে জর করে থামিয়ে দিলাম !’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top