৯. উপকূলে সংঘর্ষ

রহিমের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আলিসাকে নিয়ে তার কামরার দিকে এগিয়ে গেল অফিসার দু’জন। কামরার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। আলিসাও দাঁড়াল তাদের সাথে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল অফিসারের দিকে।

অফিসার আবারো তাকে ভাল করে বুঝিয়ে বলল, তাকে কি করতে হবে, বন্দীকে কি কি জিজ্ঞেস করতে হবে। তারপর তাকে ইশারা করল তাকে কামরায় প্রবেশ করার।

আলিসা আলতো পায়ে কামরায় প্রবেশ করলো।

আলিসাকে দেখেই চমকে উঠল রহিম। অধীর হয়ে উঠে দাঁড়ালো। ভাবলো, স্বপ্ন দেখছি না তো!

‘তুমি?’ সে আলিসাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকেও কি গ্রেফতার করা আনা হয়েছে?’

‘হ্যা! গত রাতেই ওরা আমাকে বন্দী করে এখানে নিয়ে এসেছে।’ বললো আলিসা।

‘কিন্তু কেমন করে ওরা তোমাকে বন্দী করলো! আমি তো তোমার উধাও হওয়ার রহস্য কিছুতেই উদ্ধার করতে পারছিলাম না? তুমি পালিয়ে গেছো এটা যেমন মেনে নিতে পারছিলাম না, তেমনি তুমি গ্রেফতার হয়েছো এ কথাও কল্পনা করতে পারছিলাম না।’

‘আমি কেমন করে পালাতে পারি!’ আলিসা বললো, ‘আমার তো বাঁচা মরা তোমার সাথে। তুমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পরও আমার ঘুম আসছিল না তখন আমি উঠে একটু ঘুড়ে বেড়াচ্ছিলাম। জোসনা রাতে ঠান্ডা হাওয়ায় মরুভুমিতে হাঁটতে বেশ ভালই লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে সরে এসেছি, হঠাত কে যেন পিছন থেকে আমার মুখ চেপে ধরলো। তার হাত থেকে ছুটার জন্য অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। চিৎকার করে তোমাকে ডাকতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাও পারলাম না।

ওরা ছিল দু’জন। একজন আমাকে ধরে রাখলো, আরেকজন বেঁধে ফেলল আমার হাত, মুখ। তারপর একজন গিয়ে আমার ঘোড়া নিয়ে এলো। আমার মুখ তখন বন্ধ, তোমাকে ডাকতে গিয়েও পারিনি, ওরা আমাকে সোজা এখানে নিয়ে এলো।’

‘ওদেরকে কে বলেছে আমি ইলিমোর নই, রহিম?’ রহিম বললো, ‘যারা তোমাকে ধরে নিয়ে এলো তারা আমাকে কেন ধরে আনলো না? আমাকে কেন হত্যা করলো না?’

‘আমি এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না।’ আলিসা বললো, ‘আমি নিজেই এখন আসামী। হয়তো তোমার সাথে লড়াই করার সাহস হয়নি ওদের?’

‘তুমি মিথ্যা কথা বলছো আলিসা!’ রহিম বললো, ‘ তোমাকে ধমকিয়ে আমার সম্পর্কে জেনে নিয়েছে, আর তুমি ভয়ে বলে দিয়েছ আমি কে?’ তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি কখনও তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারবো না।’

‘যদি তোমার মনে আমার জন্য এতই দরদ, তবে ওরা যা প্রশ্ন করছে তার সঠিক জবাব দিচ্ছ না কেন? তুমি সঠিক জবাব না দিলে ওরা আমার ওপর টর্চার করবে বলে হুমকি দিচ্ছে। ওরা আরো বলেছে, যদি তুমি ওদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দাও তবে আমার ভালবাসার খাতিরে ওরা তোমাকে মুক্ত করে দেবে এবং আমাদের বিবাহ বন্ধনে সাহায্য করবে।’

‘বাহ আলিসা, বাহ!’ রহিম ব্যঙ্গ করে বললো, ‘তুমি এরই মধ্য এই চুক্তিও করে ফেলেছো যে, আমি সমস্ত কথা বলে দিলে ওরা আমকে মুক্ত করে দেবে আর সেই সঙ্গে তোমার সাথে বিয়েও দিয়ে দেবে?’

‘হ্যা’ আলিসা বললো, ‘তবে শর্ত হলো তোমাকে খৃস্টান হতে হবে।’

‘তুমি কি এই আশা নিয়েই এখানে এসেছো যে, মুক্তির ওয়াদা পেয়েই আমি আমার সত্য ধর্ম ত্যাগ করবো? আলিসা! আমি সামরিক বিভাগের কোন সাধারন সৈনিক মাত্র নই, আমি একজন প্রশিক্ষন প্রাপ্ত গোয়েন্দা। মাথায় কিছু বুদ্ধিও রাখি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমার বুদ্ধি ও জ্ঞানের ওপর তোমার ভালবাসা কিছু সময়ের জন্য জায়গা করে নিয়েছিল। এটাই আমার পাপ ও ভুল। আর এই ভুলেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করো না। যে ক্রুশের নামে তুমি কদম খাচ্ছো, সেই ক্রুশ গলায় ধারণ করে তুমি আমার সাথে মিথ্যা বলছো! ছি! আলিসা, ছি! তুমি কি অস্বীকার করতে চাও যে, তুমি স্বেচ্ছায় এবং একাকীই সেখান থেকে পালিয়ে আসোনি?

আমি জানি, তোমার অন্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা রয়েছে, সেই ঘৃণাই তোমাকে আমার কাছ থেকে পালিয়ে আসতে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমার প্রতি তোমার আর ভালবাস ও বিশ্বাস বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। ফলে তুমি আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিশাল মরুভুমিতে একাকী ফেলে নিজের ঘোড়া নিয়ে চলে আসতে পেরেছো আর তোমার বুড়ো হবু স্বামীকে আমার সন্ধানে পাঠিয়ে দিয়েছো।

আমি তোমার জাতিকে আমার শত্রু মনে করি। আমার জাতির বিরুদ্ধে তোমার জাতি যে ধ্বংসাত্বক ও ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে তার মোকাবেলা করার জন্য আমি নিজের জীবন কোরবানী করার শপথ নিয়েই এখানে এসেছি। কিন্তু তোমার কারনে আমি আমার কঠিন দায়িত্ব ভুলে গিয়েছিলাম। ভালবাসার দাবী মিটাতে গিয়ে আমি আমার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করেছি, তার বিনিময়ে তুমি গোখরা সাপ হয়ে এসেছো আমাকে দংশন করতে?’

সে এমন ভঙ্গিতে কথা বলছিল যে, আলিসার দম বন্দ হয়ে আসছিল। তার অন্তরে রহিমের জন্য একদিন যে ভালবাসা জমা করেছিল, সেই ভালবাসা এসে ভর করছিল আবার।

রহিম তার চোখে চোখ রেখে ধীরে সুস্থে আবেগদীপ্ত কন্ঠে যখন কথা বলছিল, তখন এই যুবতী তার অন্তরের আবেগ আর চেপে রাখতে পারছিল না।

প্রথমে তার চেহারার রঙ পাল্টে গেল। দাঁত দিয়ে ঠোট চেপে ধরে সে তার কান্না দমন করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা।

সে অস্থির হয়ে রহিমের দু’টি হাত চেপে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ইলিমোর, বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার কোন ঘৃণা নেই। তুমি তোমার ফরজ দায়িত্ব ভুলে গিয়ে যে ভুল করেছো আমার ভুল তার থেকে কোন অংশেই কম নয়। আমি সত্যি অপরাধী, আমিই তোমাকে ধরিয়ে দিয়েছি।

আমি জানি এই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। এর জন্য আমাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। জীবনের প্রথম ভালবাসাকে হারাতে হবে। হয়তো কয়েকদিনের মধ্যই ঐ বৃদ্ধ কমান্ডারের সাথে আমার বিয়ে হবে। সেই বন্য পশুকে নিয়ে জীবন কাটাতে হবে আমার। ইলিমোর! আমাকে বাচাও, খুন করো আমাকে।’

‘আমাকে আর ইলিমোর বলো না, আব্দুর রহিম বলো, আমি আর ইলিমোর নই, আব্দুর রহিম।’

o

অফিসার দুজন পাশের কামরায় বসে শরাব পান করছিল। তাদের বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। এর কারন ছিল আলিসা। অফিসার দুজনের বিশ্বাস, আলিসা একবার এ যুবকের কাছে গেলেই সে মোমের মত গলে যাবে এবং হঠাত করে আলিসাকে কাছে পাওয়ার আনন্দে অতি সহজেই গড়গড় করে সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবে। সকাল হওয়ার আগেই তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে এবং তারা সেই তথ্য অফিসে জমা দিয়ে প্রমাণ করবে, বন্দীর কাছ থেকে তথ্য আদায়ে তারা কতটা পারঙ্গম।

রহিমের কামরার বাইরে দরজার সামনে এক পাহারাদার বসেছিল চুপচাপ। কামরার পিছন দিকটা ছিল অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পা টিপে টিপে একটি ছায়ামুর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো কামরার দিকে। মূর্তিটি ছিল রেজাউলের।

ওদিকে ইমরান গীর্জা সংলগ্ন নিজের কামরায় বসে নির্ঘুম চোখে প্রচন্ড অস্থিরতায় ছটফট করছিল। জেগে জেগে রাত কাটাচ্ছে সে। মাঝে মাঝে সে উঠে পায়চারী করছে। সামান্য একটু আওয়াজ হলেই চমকে উঠে ছুটে যাচ্ছে দরজার দিকে। তার কাছে প্রতিটি শব্দই রেজাউলের শব্দ মনে হচ্ছিল।

গভীর রাত । সে অতি সাবধানে কামরা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। পা টিপে টিপে আস্তাবলে গিয়ে ঢুকল। তিনটি ঘোড়া বাছাই করলো ভাল দেখে। আটটি ঘোড়া বাধা ছিল এক সাথে। তার থেকে ঘোড়া তিনটি আলাদা করলো। জ্বিনগুলোও চুপিচুপি পৃথক করে রাখলো।

সে প্রতি মুহূর্তে আশা করছিল, এই বুঝি রেজাউল ও রহিম চলে এলো। কিন্তু যতই রাত বাড়ছিল ততই তার আশা-আকাঙ্ক্ষা নিরাশার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগল।

এক সময় তার আশা-আকাঙ্ক্ষা মিলিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল। রহিমকে মুক্ত করার জন্য রেজাউলের আবেদন মঞ্জুর করে সে মহা ভুল করেছে। এটা যে একেবারেই অসম্ভব এক প্রচেষ্টা এটা জানার পরও সে কেমন করে রেজাউলের আবেদনে সাড়া দিল! এই ভুলের জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলো সে।

রাত ভোর হয়ে এল প্রায়। এখনি এখান থেকে সরে না পড়লে বিপদে পড়ার সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে। ইমরানের অবচেতন মন তাকে যে কোন একটি ঘোড়া নিয়ে তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়ার জন্য তাগাদা দিতে লাগলো। কিন্তু যখনি সে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে যায় তখনি রেজাউলের কথা মনে পড়ে যায় তার। রেজাউল বলেছিল, সে রাতে অবশ্যই আসবে। রহিমকে মুক্ত করতে না পারলে সে একা হলেও আসবে। তাই বেরোতে গিয়েও তার আর বেরোনো হয়ে উঠে না।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রেজাউল। কালো এক ছায়ামুর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বন্দী রহিমের কামরার জানালার পাশে। এই জানালার ওপাশেই আছে রহিম, হয়তো মাত্র কয়েক হাত দূরে সে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করছে। এই বন্দীশালা থেকে আদৌ কি তাকে মুক্ত করা সম্ভব হবে?

সে জানালায় কান লাগিয়ে ভেতরের কথা শুনতে চেষ্টার করলো। শুনতে পেল এক নারী কন্ঠ বলছে, ‘আমি তোমাকে মুক্ত করতে পারি, যদি তুমি অফিসারদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দাও। এ সব অফিসারদের ওপর আমার বাবার কি রকম প্রভাব তা তুমি ভাল করেই জানো। আমি কথা দিচ্ছি, আমার কথায় রাজি হলে বাবাকে বলে আমি তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করবো।’

রেজাউল আর অপেক্ষা করল না। রহিম এর কি জবাব দেয় তা জানারও চেষ্টাও করল না। কথা যেন আর না এগোয় সে জন্য সে জানালায় সংকেত সূচক মৃদু আওয়াজ করল।

রহিম এই ইঙ্গিত বুঝতে পারলো। সে বুঝতে পারল, তাকে মুক্ত করার জন্য তার কোন সঙ্গী এসেছে। এ ইঙ্গিত রেজাউল বা ইমরান ছাড়া আর কারো জানা নেই। কিন্তু আলিসা এর কিছুই বুঝতে পারলো না।

রহিম থুতু ফেলার ভান করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল এবং জানালা খুলে বাইরে থুতু ফেললো।

রেজাউল জানালার নিচেই লুকিয়ে ছিল। রহিম যখন থুতু ফেলে জানালা আড়াল করে আবার আলিসার সামনে এসে দাঁড়ালো, পিছন থেকে জানালা টপকে সন্তর্পনে ভেতরে প্রবেশ করলো রেজাউল। তারপর কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখের পলকে সে খঞ্জর হাতে আলিসার সামনে লাফিয়ে পড়ল এবং এক হাতে আলিসার মুখ কঠিনভাবে চেপে ধরে অন্য হাতে আলিসার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিল।

আলিসা চিৎকার করার অবকাশও পেল না, তার আগেই সে লাশ হয়ে গেল এবং লুটিয়ে পড়ল মাঝেয়।

রেজাউল ও রহিম জানালা দিয়ে লাফিয়ে বের হয়ে এল এবং অন্ধকারে গা ঢাকা দিল।

রেজাউল এখানকার অলিগলি, ছোট বড় সব রাস্তাই ভালমত চিনতো। সে পায়ে চলা অন্ধকার পথে রহিমের হাত ধরে ছুটতে শুরু করল পালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বারান্দার প্রহরীর কানে আঘাত করল ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ।

সে চকিতে লাফিয়ে উঠে ছুটল আওয়াজ লক্ষ্য করে। মোড় ঘুরেই দেখতে পেল দুটি ছায়া অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।

সে চিৎকার জুড়ে দিল, ‘বন্দী পালিয়েছে! বন্দী পালিয়েছে! তোমরা কে কোথায় আছো জলদি ছুটে এসো।’

তার হাঁকডাকে অন্যসব প্রহরীরা সতর্ক হয়ে গেল। ঘুমন্ত প্রহরী ও সৈনিকদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। চারিদিক থেকে প্রহরীরা আওয়াজ করে জানিয়ে দিল সবাই সজাগ ও সতর্ক আছে।

রেজাউল ও রহিম ছুটা বন্ধ করে বাগান ও বৃক্ষের আড়াল নিয়ে অন্ধকারে সন্তর্পনে পথ চলছে। সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা, তারপরই আবার বাগান শুরু হয়েছে।

সামনে ফা৬কা জায়গা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। রেজাউল বলল, ‘এখানে বসে থাকলে কিছুক্ষনের মধ্যই ধরা পরে যাবো আমরা। জানি, ফাঁকা জায়গাটুকু পার হওয়া বিপদজনক। কিন্তু এখানে অপেক্ষা করা আরো বিপদের।’

‘এ বিপদ আমাদের মাথায় নিতেই হবে। চলো চেষ্টা করি।’ বলল রহিম।

ফাঁকা জায়গায় নেমে এল দুজন। হঠাত অন্ধকার থেকে একটি তীর ছুটে এসে রহিমের বুকের মধ্যে ঢুকে গেল। রহিম ছিল যুবক ও সাহসী এক যোদ্ধা। বুকে তীর নিয়েই সে ছুটল রেজাউলের সাথে এবং ওপাশের বাগানের অন্ধকারে গিয়ে পৌঁছল ওরা। তারপর আবার সন্তর্পনে ছুটতে লাগল প্রাণপণে।

কিন্তু বেশিদুর যেতে পারলো না রহিম, কিছুদুর গিয়েই সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। রেজাউল ঝুকে পড়ে চেষ্টা করল তার বুক থেকে টেনে তীর বের করার। কিন্তু সা সম্ভব ছিল না।

রহিম রেজাউলকে বললো, ‘ভাই আমার, তুই পালিয়ে যা। আমার আশা ছেড়ে দে, আমাকে আর বাচাতে পারবি না। আমার জন্য তুই নিজের জীবন নষ্ট করিস না। মরার সময় এটুকু তৃপ্তি নিয়ে মরতে পারছি যে, আমার ভাইয়েরা ভ্রাতৃত্বের হক পুরোপুরিই আদায় করেছিল।’ রহিম আর কথা বলতে পারছিল না। তার স্বর নিচু হয়ে এল, কন্ঠ জড়িয়ে গেল।

রেজাউল কিছুক্ষণ বন্ধুর গায়ে হাত রেখে চুপচাপ বসে রইল। তারপর তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে গীর্জার দিকে পালিয়ে যেতে লাগলো।

পাহারাদারদের দৌড়াদৌড়ি ও শোরগোল তার কানে আসতে লাগলো। রাস্তা ছেড়ে সে বাগানের মধ্যে ঢুকে গেল। অনুসরণকারীরা প্রতিটি পথে শোরগোল করছিল আর তাদের খুঁজে ফিরছিল। রেজাউলের ভাগ্য ভাল, তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে সেনা অফিসারদের কোয়ার্টারের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে পৌছে গেল।

এ দেয়ালের ওপাশেই মুসলমানদের একটা ছোট বস্তি। গীর্জায় পৌছাতে হলে এ বস্তি পেরিয়ে আরো অন্তত আধা কিলো যেতে হবে। রেজাউল জানে, আক্রার মুসলমানরা কীট পতঙ্গের মত জীবন যাপন করছে। খৃস্টানদের চোখে প্রতিটি মুসলমানই গোয়েন্দা ও সন্দেহজনক ব্যক্তি। নানা ছুতানায় মুসলমানদের ওপর নেমে আসে প্রশাসনিক নির্যাতন। কারো ওপর সন্দেহ হলে সাথে সাথে তাকে বন্দী করে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাদের বাড়ী তল্লাশীর নামে চালানো হয় খোলামেলা লুটপাট।

রেজাউল রহিমকে কাঁধ থেকে নামিয়ে একটু দম নিল। নাড়ি পরীক্ষা করে দেখল এখনো তা ঠিক মতই কাজ করছে।

রহিমকে বাচানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠল রেজাউল। পোশাক খুলে সেই পোশাক পেঁচিয়ে পিঠের সাথে বাঁধল তাকে। তারপর দেয়াল টপকাল।

কোন মুসলমানকে বিপদে ফেলতে চাইল না সে। কিন্তু রহিমের বোঝা পিঠে পাথরের মত এমনভাবে চেপে বসেছে যে, সে আর হাঁটতে পারছে না। তবু বেপরোয়াভাবে সে এগিয়ে চলল। রহিমকে বাচিয়ে তোলার চিন্তা ছাড়া আর সব চিন্তা যেন তার মাথা থেকে গায়েব হয়ে গেছে।

আরো কিছুটা পথ এই অবস্থাতেই এগিয়ে গেল রেজাউল। কিন্তু পিঠের বোঝার চাপে তার হাটু মুড়ে এল। বসে পড়ল রেজাউল। গীর্জা পর্যন্ত পৌঁছার আশা ত্যাগ করল সে। বস্তির এক দরজায় আঘাত করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে ধরল বুরোমত এক লোক। রেজাউল বুড়োর দিকে ফিরেও তাকাল না, আহত রহিমকে কাঁধে নিয়ে সরসর করে ঘরের ভেতরে চলে গেল। বুড়ো হা করে তাকিয়ে রইল এই ক্ষ্যাপা যুবকের দিকে। তার পিঠে ঝুলছে আরেক যুবকের রক্তাক্ত লাশ।

ভয় পেয়ে গেল বুড়ো। ওভাবেই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রেজাউল পিঠ থেকে রহিমকে নামিয়ে বুড়ো লোকটকে কাছে ডাকল। ভয়, আতঙ্ক আর নানা দুশ্চিন্তা নিয়ে এগিয়ে এল বুড়ো। রেজাউল সংক্ষিপ্ত কথায় তার কাছে তাদের পরিচয় দিল। তবে এত কথার বলার দরকার ছিল ন। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট ছিল যে, তারা মুসলমান।

রেজাউল রহিমের প্রত খেয়াল দিল এবার। ততক্ষণে রহম শহীদ হয়ে গেছে।

রেজাউলের কাপড়-চোপর সব রক্তে রঞ্জিত। ভীতবিহব্বল দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল বাড়ীওয়ালা।

রেজাউল তার কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। ইমরানের কথাও বললো তার কাছে।

বুড়ো ছাড়াও বাড়িতে ছিল তার দুই যুবক পুত্র। তাদের ঘর থেকে বুড়ো তাদেরকে ডেকে আনল। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনায় রেজাউল ও এই পরিবার সবাই একাকার হয়ে গেল। তারা রেজাউলের কাপড়-চোপর বদলে দিল। সবাই মিলে পরামর্শ করে রহিমের লাশ সম্পর্কে  সিদ্ধান্ত নিলো, তাকে ঘরের কোন কামরাতেই দাফন করা হবে।

দাফনের দায়িত্ব ওদের হাতে দিয়ে রেজাউল ছুটল ইমরান তার জন্য যেখানে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সেই গীর্জার দিকে।

o

গভীর রাত।

সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ঘুমিয়ে আছে গভীর নিদ্রায়। জাতির গাদ্দাররা শত্রুর দেয়া শরাব ও নারী নিয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছে। আর সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে, নির্বিকার।

তাদের থেকে দূরে, অনেক দূরে, ঈমানের বলে বলীয়ান এক মুসলিম যুবক ইস্লামের সম্মান ও গৌরব রক্ষার জন্য নিজের জীবন বাজী রেখে প্রতীক্ষা করছে বন্ধুদের জন্য। ওরা এলেই আক্রা থেকে গোপনে বেরিয়ে যাবে সবাই। জীবন মরণ  সংগ্রাম চালিয়ে ছুটে যাবে কায়রো। তাদের এ কায়রো পৌছার ওপর নির্ভর করছে মিশরের নিরাপত্তা। নির্ভর করছে মুসলিম বিশ্বের মান-সম্মান ও ইসলামের গৌরব।

তাদের কাছে রয়েছে এমন গোপন তথ্য, এমন পবিত্র আমানত, যার ওপর নির্ভর করছে সমগ্র জাতির ভাগ্য। অথচ তাদের আশেপাশে এমন কেউ নেই, যে তাদের সাহায্যকারী হতে পারে, যে তাদের ভালমন্দ দেখতে পারে। তাদের একমাত্র সহায় এখন আল্লাহ।

এমন সংকটময় মূহুর্তে জাতীয় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার সাথে অপেক্ষা করছে ইমরান।

তার মাথায় কিলবিল করছে নানা চিন্তা, রহিম কি মক্তি পাবে? রেজাউল কি আসতে পারবে? কায়রোয় এ খবর আদৌ কি পৌছানো যাবে? গেলে কখন?

মিশরের ওপর আঘাত হানার জন্য খৃষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে। তাদের বিরাট নৌবহর ভূমধ্য সাগরের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে মিশরের উপকূলে আক্রমন করতে ছুটে যাচ্ছে। এ খবর অনতিবিলম্বে কায়রো পৌঁছানো দরকার। এ জন্যই ইমরানের এত পেরেশানী।

ইমরান দ্রুত ক্রাক বা কায়রো পৌছতে চাচ্ছে, যেন এই মুহুর্তে নূরুদ্দিন জিঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবী অন্য কোন সেক্টরে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত না নিয়ে বসেন। যদি তাদের এমন কোন সিদ্ধান্ত থাকেও, তা থামাতে হবে।

ইমরান এই দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী থেকে মুক্তি জন্য সিজদায় পড়ে গেল। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে নফল নামাজ পড়তে শুরু করল সে।

এ সময় শহরে হৈ চৈ শুরু হইয়ে গেলে প্রহরীদের হাকডাক কানে এল তার। সে নামাজ শেষ করে কান পাতলো। পাহারাদারদের ব্যস্ত তৎপরতা, দৌড়াদৌড়ি, সতর্কতা, এসব দেখে তার অশান্তি ও দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল।

সে আবার জায়নামাজে দাঁড়াল এবং দু’ রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বলতে লাগলো, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের সুযোগ ও ক্ষমতা দান করো। আমি যেন আমার সংগৃহীত তথ্য ঠিকানা মত পৌছে দিতে পারি এ তৌফিক দাও আমায়। এর বিনিময়ে তুমি আমাকে যা দান করেছো তার সব কিছু নিয়ে নাও। প্রয়োজনে আমার পরিবার, আমার খান্দানকেও আমি তোমার হাওলা করে দিচ্ছি। বিনিময়ে শুধু একটি সুযোগ চাই, আমি যেন এ তথ্য তোমার খাদেমদের দরবারে পৌছে দিতে পারি।’

ইমরান চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মালিকের দরবারে তার প্রার্থনা তখনো শেষ করেনি, হঠাত দরজার ঊপরে সাংকেতিক টোকা পড়ল, যেমন পড়েছিল রহিমের জানালায়। ইমরান তাড়াতাড়ি মোনাজাত শেষ করে দরজা খুলে দিল।

রেজাউল দাঁড়িয়ে ছিল দরজার বাইরে। তাকে ভেতরে ডেকে এনে দরজা বন্ধ করে দিল ইমরান। রেজাউল তখন ভীষনভাবে হাঁপাচ্ছিল।

সে ইমরানকে বললো, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে ইমরান। আমাদের ওপর দিয়ে মহা বিপদ বয়ে গেছে। রহিম শহীদ হয়ে গেছে।’

ইমরানের কাছে সব ঘটনা খুলে বলল রেজাউল।

ইমরান যখন শুনলো রহিমের লাশ একজন মুসলমানের বাড়িতে তাদের ঘরের মেঝেতে দাফন করার জন্য রেখে এসেছে রেজাউল, তখন ভীত শংকিত কন্ঠে সে বলে উঠল, ‘একি করেছো তুমি! তাদের ওপর এখন বপদের কি জাহান্নাম নেমে আসবে কল্পনা করতে পারো? আমরা কোনদিন আক্রার কোন মুসলমানদের কারণ হবো, এমনটি আমি কল্পনাও করিনি রেজাউল।’

রেজাউল অভয় দিয়ে তাকে বললো, ‘ঐ পরিবারে তিনজন পুরুষ ও কয়েকজন নারী আছে। এ কাজের জন্য বাইরের কাউকে ডাকতে হবে না তাদের। তারা তখনি কামরার এক কোণে গর্ত খোড়া শুরু করে দিয়েছে। হয়তো এতক্ষণে তারা লাশ দাফনও করে ফেলেছে। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এ খবর তারা বাইরে কাউকে জানাবে না।’

ইমরান সে বাড়িতে যেতে চাইলো। বলল, ‘ তাদের গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা আছ কিনা আমি দেখতে চাই।’

রেজাউল তাকে আশ্বস্ত করলো, ‘তারা খুব সতর্ক লোক মনে হলো। আমার বিশ্বাস তারা সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারবে।’

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top