এ প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি যখন কথা বলা শুরু করলো, তখন দেখা গেলো আলীর লোকটির চেহারা বার বার পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির কথার বিষ মেশানো যাদু ততক্ষণে ঘায়েল করে ফেলেছে যুবককে। কিন্তু অনড় বিশ্বাস ও প্রবল দায়িত্ববোধ থাকায় সে বললো, ‘আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, তোমরা এখানে মুসলমানদের ধোকা দিতে পারবে না। আর যদি তুমি মনেপ্রাণে সততা নিয়ে এই অপকর্ম থেকে বিরত হও, তবে তুমি সৌভাগ্যবতী। আমি কথা দিচ্ছি, সত্য ও সুন্দরের পথে ফিরে এলে তুমি আমার সাথেই থাকবে।’
মেয়েটি আবেগ ও আনন্দের আতিশয্যে তাকে জড়িয়ে ধরলো। লোকটি বললো, ‘আমি আমার কমান্ডারকে বলবো, তোমাকে যেন অন্য মেয়েদের থেকে পৃথক রাখেন আর কোন আমীরের হাতে তুলে না দেন।’
মেয়েটি আনন্দে অধীর হয়ে তার হাতে চুমো খেলো। এ আনন্দ যেমন তার অভিনয় ছিল, তেমনি আলী বিন সুফিয়ানের এত সতর্ক গোয়েন্দাকে এমন চমৎকারভাবে ধোকা দিতে পারার সাফল্যের জন্যও তার আনন্দ হচ্ছিল।
‘একটু থামো।’ মেয়েটি তাকে বললো, ‘আমি দেখে আসি আমার সঙ্গীরা শুয়ে পড়লো কিনা!’
সে তাবু থেকে বের হয়ে গেল।
o
আলী বিন সুফিয়ান সেনাপতি তাওফীক জাওয়াদের কামরায় বসে নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ইসলামের মহান মুজাহিদের বিধবা স্ত্রী দূত মারফত তার মনের কথা সমস্তই সুলতান আইয়ুবীর কাছে লিখে জানিয়েছিলেন। তবুও তাঁর সঙ্গে দেখা করে চিঠিতে লেখা যায়না এমন কোন উপদেশ ও তথ্য থাকলে তা জেনে নেয়া প্রয়োজন।
একটু পরেই সেই সম্মানিতা মহিলা সেখানে এলেন। কিন্তু ছদ্মবেশের কারণে আলী বিন সুফিয়ানকে চিনতে পারলেন না। তাওফীক জাওয়াদ পরিচয় করিয়ে দিতেই অশ্রুতে দু’চোখে ভাসিয়ে তিনি বললেন, ‘হায়! এও আমার ভাগ্যে লিখা ছিল, আপন লোকেরা আজ গোপনে ও ছদ্মবেশে দেখা করতে আসে! তুমি তো এখানে আসতে বীরের বেশে, মাথা উঁচু করে। অথচ আজ এমন অবস্থায় এলে, কেউ যেন তোমাকে চিনতে না পারে! আর আমাকেও ঘএ থেকে এমন সাবধানে বের হতে হলো, কেউ যেন দেখে না ফেলে, আমি কোথায় যাচ্ছি।’
আলী বিন সুফিয়ানের চোখও অশ্রুতে ভারী হয়ে এলো। আবেগের আতিশয্যে অনেকক্ষণ তিনি কোন কথাই বলতে পারেননি। জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর বৈধব্য বেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু।
বেগম জঙ্গী বললেন, ‘আলী! আমি এই বেশ ধারণ করেছি শুধু স্বামীর শোকে নয়, আমি শোকাহত আজ জাতির দুর্যোগে, দুর্ভোগে। স্বার্থপর ছোট ছোট আমীররা আমার সন্তানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জাতির সম্মান ও ইজ্জত খৃস্টানদের পদতলে সোপর্দ করে দিয়েছে। তোমরা এখনো জানো না, এরই মধ্যে আমরা কি হারিয়েছি, কতটা দেউলিয়া হয়েছি!
জঙ্গী যে সমস্ত খৃস্টান কয়েদী ও যুদ্ধবন্দীকে কারারুদ্ধ করেছিল তারা এখন কোথায় তুমি জানো? সম্রাট রিজনেল্ট, যাকে মাত্র কয়েক মাস আগে জঙ্গী তার দলবলসহ বন্দী করেছিল এবং ক্রাক থেকে এখানে নিয়ে এসেছিল, সে এখন আর বন্দী নেই। জঙ্গী সম্রাট রিজনেল্টকে বন্দী করতে পেরে খুবই খুশী ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘আমি খৃস্টানদের সাথে এমন দরকষাকষি করে এ সকল বন্দী বিনিময় করবো, যাতে খৃস্টানদের কোমর ভেঙ্গে যায়।’
জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী বললেন, ‘একজন সম্রাট ও যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি গ্রেফতার হওয়া কোন সাধারণ ঘটনা নয়। আমরা তাঁর বিনিময়ে খৃস্টানদের কাছ থেকে অনেক চড়া শর্ত আদায় করে নোট পারতাম। কিন্তু গতকাল আমার ছেলে আমার কাছে এসে বললো, মা! আমি খৃস্টান সম্রাট ও তার সঙ্গীদের সকলকে বিনা শর্তে মুক্ত করে দিয়েছি।’
এ খবর শুনে আমি মনে এমন প্রচণ্ড আঘাত পেলাম যে, অনেকক্ষণ আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। শেষে যখন হুশ হলো ছেলেকে শুধু বললাম, ‘এই যুদ্ধ বন্দীদের বিনিময়ে তুমি কি তোমার সকল যুদ্ধ বন্দী মুক্ত করে নিয়েছো?’
ছেলে কচি খোকার মত উত্তর দিল, ‘আমি আমার যুদ্ধ বন্দী নিয়ে কি করবো? আমি তো আর কোনদিন কারো সাথে যুদ্ধ করবোনা। আর এদের শুধু শুধু খাইয়ে খরচ বাড়িয়ে কি লাভ?’
আমি ছেলেকে বললাম, ‘দেখো, তুমি আর কোনদিন তোমার বাবার কবর জিয়ারত করতে যাবে না। তুমি যখন মরবে তখন তোমার লাশ ঐ কবরের পাশে দাফন হবে না, যেখানে তোমার বাবা শুয়ে আছেন। এই কবরস্থানে এমন সব শহীদগণ শুয়ে আছেন,যারা খৃস্টানদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। তোমাকে সেখানে দাফন করা হলে তাঁদের আত্মা কষ্ট পাবে ও তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে।’ কিন্তু আমার ছেলে তো শিশু, সে কিশুই বুঝে না। আমি সেই আমীরদের সাথেও মিশেছি, আমার ছেলে যাদের হাতের পুতুল। তারা আমাকে সম্মান দেখায় কিন্তু আমার কথার কোন মূল্য দেয় না।
খৃস্টানরা তাদের সম্রাট ও যুদ্ধ বন্দীদের মুক্ত করে নিয়ে মুসলমানদের মুখের ওপর চপেটাঘাত করেছে। কিন্তু আমি ভেবে কূল পাইনা, সালাহউদ্দিন কায়রোতে বসে কি করছেন? তিনি কি আসছেন না কেন? আলী বিন সুফিয়ান! বলো, সুলতান আইয়ুবী কি চিন্তা-ভাবনা করছেন? তাঁকে গিয়ে বলবে আপনার এক বোন আপনার জাতির অসম্মান দেখে শোক প্রকাশ করছে। তাঁকে আরও বলবে, আপনার বোন শোকের কালো পোশাক সেই দিন ফেলবে, যেদিন আপনি দামেস্কে উপস্থিত হয়ে মুসলিম বিশ্বের সম্মান বিলাস প্রিয় ও ঈমান বিক্রেতা আমীরদের থেকে ছিনিয়ে নিবেন ও তাঁকে উদ্ধার করবেন! নতুবা তিনি এই পোষাকেই মৃত্যুবরণ করবেন আর অসিয়ত করে যাবেন, তাঁকে যেন এ পোষাকেই দাফন করা হয়। কোন কাফন যেন তাকে পরানো না হয়। এ অবস্থায় আমি কিয়ামতের দিন আমার স্বামী ও আল্লাহর সামনে সাদা কাফনে যেতে চাই না।’
সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর চোখ থেকে তখনো অশ্রু ঝরছিল। আলী বিন সুফিয়ান তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মোহতারেমা, আমি এ আবেগের মূল্য খুব ভাল করেই বুঝি! দয়া করে আমার কথাগুলো একটু শুনুন। সুলতান আইয়ুবীও আপনার মত অধীর ও অশান্তভাবেই প্রহর কাটাচ্ছেন। আপনি জানেন, যুদ্ধ কেবল আবেগ ও উত্তেজনার বশে হয় না। এখানকার সঠিক অবস্থা না জেনে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়া প্রকৃত মুজাহিদের কর্ম নয়। এমন কাজ আইয়ুবী করতে পারেন না।
আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। আইয়ুবী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে দেশে গৃহযুদ্ধ না বাঁধে। গৃহযুদ্ধ বাঁধলে তাতে মিল্লাতে ইসলামিয়ারই ক্ষতি হবে। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, ইসলামের স্বার্থে আমরা এগিয়ে এলে জাতি আমাদের সাথেই থাকবে। সৈন্যদের ব্যাপারেও তাওফীক জাওয়াদ আমাকে এই আশ্বাস দিয়েছেন, এখানকার সৈন্যরা আমাদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াবে না। তবে রক্ষীবাহিনী মোকাবেলায় নামতে পারে।’
‘আমিও আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিচ্ছি, জাতি আপনাদের সাথেই থাকবে।’ জঙ্গীর স্ত্রী বললেন, ‘আমি নারী, যুদ্ধের ময়দানে হয়তো যেতে পারবো না। কিন্তু আমার লড়াই অব্যাহত আছে। আমি আমার সেক্টরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। আমি নারী সমাজের মাঝে জাতীয় চেতনাবোধ এমন তীব্রভাবে সৃষ্টি করে রেখেছি যে, তাদের স্বামী, সন্তান ও ভাইবেরাদর যদি আপনাদের সহযোগীতায় এগিয়ে না যায়, তবে তারা নিজেদের ঘরে কিছুতেই শান্তিতে বসে থাকতে পারবে না।
যদি দরকার হয়, সামর্থবান নারীরা যাতে ময়দানে আপনাদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করতে পারে তারও প্রস্তুতি চলছে। আমার তত্বাবধানে যেসব মেয়েরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তারা এরই মধ্যে তলোয়ার চালনা, তীর নিক্ষেপ প্রভৃতি কাজে নৈপুণ্য অর্জন করেছে। দামেস্কের ঘরে ঘরে এখনো সেইসব মহিলারই আধিপত্য, যারা ঈমানদার, বিশ্বস্ত ও অনুগত। যদি গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি হয়, তবে দামেস্কের প্রতিটি ঘরে মেয়েরা এই অর্বাচীন খলিফার বিরুদ্ধে সামরিক দূর্গ গড়ে তুলবে।
এখনো যদি সুলতান আইয়ুবী সৈন্য নিয়ে এখানে চলে আসে, তবে আমার নাবালেগ সন্তান ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা নিজেদের অসহায় ও নিঃসঙ্গ দেখতে পাবে।’
আবেগদীপ্ত কন্ঠে তিনি বললেন, ‘তুমি জলদি চলে যাও আলী ভাই! দ্রুত ফিরে এসো সৈন্য নিয়ে। এখানকার দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দাও। জাতি তোমাদের পথ আগলে দাঁড়াবে না। যদি বর্তমান খলিফার খুন তোমাদের প্রয়োজন হয়, হত্যা করো তাকে। সে নূরুদ্দিন জঙ্গী ও আমার সন্তান বলে দয়া দেখাতে গিয়ে জাতির সর্বনাশ করো না। আম্মার ছেলের দেহ খণ্ড খণ্ড হয়ে যাক কিন্তু মুসলিম মিল্লাতকে আমি খণ্ড খণ্ড হতে দিতে পারি না।’
খলিফার মায়ের কন্ঠ থেকে এ ধ্বনি উচ্চারিত হওয়ার পর তাওফীক জাওয়াদ ও আলী বিন সুফিয়ানের আর কিছুই বলার ছিল না। তারা যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে বসলো। সিদ্ধান্ত হলো, সুলতান আইয়ুবী অতি গোপনে আসবেন, খলিফা ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা যেন জানতে না পারে।
o
আলী বিন সুফিয়ানের কমান্ডোর কাছ থেকে গোপন তথ্য জেনে নিয়ে খৃস্টান মেয়েটা তাকে বসিয়ে রেখে তার সাথীদের কাছে গেলো। বললো, ‘আমরা ধোকা খেয়েছি। এরা সবাই মিশরের লড়াকু গোয়েন্দা। তাদের কমান্ডার গোয়েন্দা জগতের কিংবদন্তি পুরুষ আলী বিন সুফিয়ান।’
এ সংবাদ শোনার সাথে সাথে তাদের মনে ভয়ানক আতংক সৃষ্টি হলো। এখন কি করবে এই চিন্তায় তারা অধীর হয়ে উঠলো। এখানে থাকা এখন বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ, আবার বেরিয়ে যাওয়াও কঠিন। মেয়েটি বললো, ‘কি করবে জলদি চিন্তা করে বের করো, আমি নাগর সামলাই।’
মেয়েটি ফিরে এলো সেই পাহারাদারের কাছে। নানা ছলাকলায় ভুলিয়ে ভালিয়ে আটকে রাখলো তাকে তাবুতে। খৃস্টানদের তাবু থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো এক লোক। সে আলী বিন সুফিয়ানকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পেল না।
আলী বিন সুফিয়ানকে না পেয়ে খৃস্টানটি আরো ঘাবড়ে গেল। ভাবলো, তবে কি তিনি আমাদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করতে গেছেন?
ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সে ফিরে এলো তার লোকদের কাছে। বললো, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে! আলী বিন সুফিয়ান তার তাবুতে নেই। সম্ভবত আমাদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করতে গেছে। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা ঠিক হবে না। জলদি পালাও সবাই।’
তখন রাত দ্বি-প্রহর। এ শহরে এরা নতুন। এখানকার পথঘাট, পরিবেশ কিছুই তাদের জানা নেই। দিনের বেলা হলে পথ একটা খুঁজে নেয়া তেমন কঠিন ছিল না। তাছাড়া জনারণ্যে মিশে হারিয়ে যাওয়া যেত সহজেই। কিন্তু এই গভীর রাতে মেয়েদের নিয়ে পথে বের হওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। ভেতরে ভেতরে ঘামতে লাগলো সবাই।
একজন পরামর্শ দিল, ‘কোন হোটেলে গিয়ে উঠা যাক। বলবো, আমরা কায়রোর বণিক। বাইরে উন্মুক্ত ময়দানে এভাবে শুয়ে থেকে ধরা দেয়ার কোন মানে হয় না।’
অন্যরাও তার প্রস্তাবে রাজি হলো, ‘সেই ভালো। কোন সরাইখানাইয় গিয়ে রাত কাটাতে পারলে সকালে উঠে গা ঢাকা দেয়া যাবে।’
তারা এক লোককে গোপনে সেই উদ্দেশ্যে বাইরে পাঠিয়ে দিলো। তাবু থেকে বেরিয়ে লোকটি চুপিসারে পাহারাদারের দৃষ্টি এড়িয়ে মাঠ থেকে রাজপথে উঠে গেলো। সরাইখানার খোঁজে সে শহরের গলিপথে হাঁটতে লাগলো।
সে হাঁটছে আর ভাবছে, সরাইখানা পেলে কষ্ট হলেও হয়তো আমরা সেখানে উঠে যেতে পারবো, কিন্তু আসবাবপত্র সরানো বড় সমস্যা হয়ে যাবে! প্রকাশ্যে বণিক হিসাবে আমাদের কাছে থাকার কথা ব্যবসায়ীক পণ্য, কিন্তু মুসলমান আমীর ও সেনাপতিদের জন্য যে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা, হীরা, জহরত ও বিভিন্ন প্রকারের উপঢৌকন আছে তা সরানো সহজ নয়। এগুলো সরাতে গেলেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়! তখন আর বণিকের ছদ্মবেশ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। এমন কোন আমীরের সাথেও এখনো পরিচয় হয়নি যার কাছে সাহায্যের জন্য যাওয়া যায়।
লোকটি জনশূন্য রাস্তা ধরে হাঁটছে। রাস্তার দু’পাশে দোকানপাটের ঝাপ বন্ধ। ডানে-বায়ে, সামনে-পেছনে কোথাও কোন লোককে দেখতে পেল না সে। কোন সরাইখানারও সন্ধান পেল না সে। অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরির পর মনে হলো সামনের দিক থেকে একজন লোক এদিকেই এগিয়ে আসছে। লোকটাকে অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও ক্রমেই একটা মানুষের কাঠামো পরিস্কার ভেসে উঠলো তার সামনে। আরেকটু কাছাকাছি হলে দেখা গেল লোকটার মাথা ও মুখের অর্ধেকটা চাদর দিয়ে ঢাকা। সাহস সঞ্চার করে সে ডাকলো, ‘এই যে ভাই, শুনুন। এদিকে কোন সরাইখানা পাওয়া যাবে?’
‘শহরের এদিকটায় তো ভাই কোন সরাইখানা নেই! আর থাকলেও এত রাতে কোন সরাইখানার মালিক গেট খুলবে না। এত রাতে সরাইখানা খুঁজতে বেড়িয়েছো কেন?’
‘আজই এক বানিজ্য কাফেলা নিয়ে আমরা এখানে পৌছেছি। আমাদের সাথে চারটি মেয়ে আছে, তাদেরকে তাবুতে রাখা ঠিক না, এজন্যই সরাইখানা খুঁজছি।’
অচেনা লোকটি চিন্তিত কন্ঠে বললো, ‘হ্যা।, এটাও একটা প্রশ্ন!’ একটু ভেবে নিয়ে বললো, ‘কিন্তু তোমাকে সন্ধ্যার আগেই সে ব্যবস্থা করতে হতো।’
‘জ্বি, তা ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তা তো করা হয়নি! এখন যে কি করি! এত রাতে……’
‘এসো আমার সঙ্গে, দেখি তোমার কোন উপকার করা যায় কনা! তুমি এক বিদেশী, এখান থেকে গিয়ে আমাদের বদনাম করে বেড়াবে, বলবে, দামেস্কে আমাদের পর্দানশীল মহিলারা খোলা মাঠে পড়েছিল জানার পরও ওখানকার কোন দ্বীনদার ভাই এগিয়ে আসেনি, তা হয় না। আজ রাতের মত ব্যবস্থা না হয় আমিই করে দেবো।’
‘কোথায় যেতে হবে?’
‘আমি সরাইখানাতেই তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করে দেবো। চলো আমার সঙ্গে, তারপর গিয়ে মেয়েদের নিয়ে আসবে।’
‘কিন্তু আমি এ শহরে একেবারেই নতুন। পথঘাট কিছুই চিনিনা। পথ হারানোর ভয়েই মেয়েদের রেখে বেশী দূর যাইনি। চলুন না, মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে একবারেই যাই।’
‘কোন মাঠে বসিয়ে রেখেছো ওদের?’
‘বেশি দূরে নয়। আসুন না, কাছেই।’
অচিন লোকটি তার সাথে চলতে লাগলো। উভয়েই তাবুর কাছে পৌছলে খৃস্টানটি তাঁকে তাবু দেখিয়ে বললো, ‘অই যে আমাদের তাবু। আপনি এখানে একটু দাঁড়ান, আমি ওদের নিয়ে আসি।’
অচিন লোকটিকে দাঁড় করিয়ে রেখে সে তাবুগুলোর দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েকটি তাবুর পরই ছিল খৃস্টানদের তাবু। সে তার সঙ্গীদের কাছে গিয়ে বললো, ‘চলো। যাক বাবা, কপালগুনে লোকটির দেখা পেয়েছিলাম। নইলে সারা রাত পথে পথেই ঘুরতে হতো।’
সবাই উৎসুক হয়ে তাকাল তার দিকে। চোখে মুখে জিজ্ঞাসা। সে সব কথা ওদের খুলে বলে তাড়া দিল তাদের, ‘জলদি করো, লোকটি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। কতক্ষণ তিনি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন? দয়া করে তিনি কোন সরাইখানায় আমাদের থাকার জায়গা করে দিতে রাজি হয়েছেন, এই ত ঢ়ের।’
কিন্তু সঙ্গীদেরকে তার মতো উৎসাহী মনে হলো না। তার কথা শুনে তাদের মনে কেন যেন অজানা ভয় ঢুকে গেল। বললো, ‘কিন্তু এ লোক যদি ধোকা দেয়?’
‘কিন্তু আমরা এমন বিপদে পড়েছি, যার থেকে মুক্তির জন্য কোন না কোন বিপদের ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে।’ বললো সে।
অন্য একটি মেয়ে বললো, ‘আলী বিন সুফিয়ান ছদ্মবেশে জঙ্গী গোয়েন্দা দল নিয়ে কেন এখানে এসেছে আমরা তা জেনে গেছি। খলিফা ও আমীররা খৃস্টানদের বন্ধুত্ব গ্রহন করার কারনেই তাকে এ অভিযানে আসতে হয়েছে। যদি আমরা আলীর এ অভিযানের খবর খলিফা বা অন্তত কোন আমীরের কানেও দিতে পারতাম, তবে আমরা এখন যে বিপদে আছি তারচে বেশী বিপদে পড়তো আলী।’
‘তা ঠিক। এ সংবাদ আমাদের পুতুল সরকারের খলিফাকে রাতেই পৌঁছে দিতে পারলে সরকারের কাছ থেকে মোটা অংকের বখশিশ পাওয়া যেতো।’
‘বখশিশের কথা পরে চিন্তা করো। আগে এ সংবাদ খৃস্টান শাসকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করো, যাতে তারা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর রাস্তা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে পারে।’
অন্য একজন বললো, ‘এসব আলাপ পরে আরো করা যাবে, এখন দ্রুত সব গুছিয়ে নিয়ে চলো বেরিয়ে পড়ি।’
বেরিয়ে পড়ার জন্য ওরা গোছগাছ শুরু করলো। মেয়েটির তাবুতে খবর দিতে গিয়ে দেখা গেল পাহারাদার গভীর ঘুমে অচেতন। সবাই মেয়েটির কাজের উচ্চ প্রশংসা করলো।
আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গীরা তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। পাহারাদার ঘুমিয়ে আছে মেয়েটির তাবুতে। এই অবসরে সকলেই একত্রেই বেরিয়ে এলো তাবু থেকে। আসবাবপত্র, মালামাল ও পশুগুলো পড়ে রইলো ওখানেই।
মালামাল নিয়ে তাদের এখন আর ভাবনা নেই। আগামীকাল যখন ছদ্মবেশী আলী ও তার গোয়েন্দা বাহিনীকে ধরিয়ে দেবে তখন তাদের মালসামান তারা এমনি পেয়ে যাবে।
তারা তাবু থেকে বেরিয়ে এলো। ধীরে পায়ে লোকটিকে যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সেখানে গেল। কিন্তু ওখানে পৌছে লোকটিকে দেখতে পেলো না ওরা। এদিক-ওদিক তাকালো, আশেপাশে কোন জনমানুষের চিহ্নও নেই।
অজানা ভয় ও আতঙ্ক আবার ঘিরে ধরলো ওদের। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। ওরা যখন চরমভাবে বিভ্রান্ত ও দিশেহারা তখন হটাত অন্ধকার থেকে একদল লোক উঠে দাঁড়ালো এবং ঘিরে ফেললো।
তাদেরকে ঘেরাও করে তাবুর ওখানে নিয়ে এলো কমান্ডোরা। মশাল জ্বালিয়ে মশালের সামনে তাদের বসিয়ে রেখে খবর দিল আলী বিন সুফিয়ানকে।
খবর পেয়ে তাবু থেকে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে এলেন আলী বিন সুফিয়ান। তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে?’ তারা মিথ্যা উত্তর দিলে আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘কিন্তু আমি তো জানি তোমরা সরাইখানা তালাশ করছিলে! আমাকে কি বলবে, কে সরাইখানার সন্ধানে ঘুরে মরছিলে?’
একজন অপরাধীর মত স্বীকার করে বললো, ‘জ্বী, আমি!’
‘আর যাকে তুমি সরাইখানার ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলে, সে ব্যক্তি আমি!’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন।
সবাই বিস্মিত হয়ে তাকাল তাঁর দিকে। মুজাহিদরা ভাবছিলো, একেই বলে আল্লাহর গায়েবী মদদ! নইলে তাওফীক জাওয়াদের ঘর থেকে তাবুতে ফেরার সময় এই লোক তার সামনে পড়বে কেন? আর আলী বিন সুফিয়ানের কাছে সে সরাইখানার রাস্তাই বা খুঁজতে যাবে কেন?
অন্ধকারেও খৃস্টান গোয়েন্দার প্রথম কথাতেই আলী বিন সুফিয়ান বুঝে ফেলেছিলেন, সে কে এবং কি করছে। তিনি জানতেন, এসব খৃস্টান গোয়েন্দার আশ্রয়স্থল হচ্ছে কোন আমীরের মহল। কিন্তু তিনি সে পর্যন্ত তাকে পৌঁছার সুযোগ দিলেন না। লোকটিকে সঙ্গে নিয়েই তিনি তাবু পর্যন্ত চলে এলেন। খৃস্টান গোয়েন্দা যখন তাঁকে একতু দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে তবুর ওখানে গেল রতখন তিনি মনে মনে খুশিই হলেন।
খৃস্টানটি তাবুর ভেতর ঢুকে যেতেই আলী বিন সুফিয়ান দ্রুত ক্যাম্পে গিয়ে কয়েকজন জানবাজকে চুপিসারে ডেকে তোললেন। চটজলদি তাদের বুঝিয়ে বললেন, এখন কি করতে হবে।
প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া শেষ করেই তিনি তাদের তাবু থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন খৃস্টানদের তাবুর ওখানে। ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন তাবুর আড়ালে। চুপ করে শুনতে লাগলেন তাদের কথা। তাদের আলোচনা থেকে তিনি বুঝতে পারলেন, খৃস্টান গোয়েন্দারা তাঁর মিশন সম্পর্কে সব খবরই জেনে ফেলেছে। কিন্তু এসব গোপন তথ্য কেমন করে ফাঁস হলো ভেবে পেলেন না তিনি।
ততক্ষণে মুসলিম কমান্ডরা বর্শা হাতে আলীর নির্দেশিত জায়গায় গিয়ে ওঁত পেতে বসে পড়েছে। খৃস্টানরা যখন সেখানে গিয়ে আলিকে না পেয়ে হতভম্ব, তখন তারা এক যোগে তাদের ঘিরে ধরল এবং বন্দী করে নিয়ে এলো ক্যাম্পে।
‘বন্ধুগণ!’ আলী বিন সুফিয়ান তাদের বললেন, ‘গোয়েন্দা হিসেবে তোমরা খুবই কাঁচা। তোমাদের আরো প্রশিক্ষণের দরকার ছিল। গোয়েন্দারা কি এমন নির্জন রাস্তায় বেখেয়ালে হেঁটে বেড়ায়? গোয়েন্দাগিরি করতে হলে তার কলাকৌশল আমার কাছ থেকে শিখে নাও।’
‘আপনি আপনার কলাকৌশল নিজের লোকদের আগে ভাল করে শিখিয়ে দিন, তাতেই আপনার মঙ্গল হবে। আনাড়ী লোকদের সাথে নিয়ে গোয়েন্দাগিরিতে নামা আসলেই বিপদজনক।’ এক খৃস্টান বললো, ‘আপনার লোকদের কাছ থেকে আপনার সঠিক পরিচয় উদ্ধার করা, আপনার মিশনের খুটিনাটি খোঁজখবর আবিষ্কারের কৃতিত্বটুকু আমরা আমাদের যোগ্যতাবলেই করেছি। আপনার হাতে ধরা পড়েছি, এটা তো একটা ভাগ্যের খেলা। আপনি জিতে গেছেন, আর আমরা হেরে গেছি। যদি আমাদের লিদার মারা না পড়তো, তবে এর উল্টোটিও তো ঘটতে পারতো!’
‘আমাকে কি বলবে, কে তোমাদের কাছে আমাদের গোপন তথ্য ফাঁস করেছে?’ আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন।
‘সে লোক এখন আমার তাবুতে ঘুমাচ্ছে।’ একটি মেয়ে তার তাবুর দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বললো, ‘সে আমার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল।’
কিন্তু আলী আলাপ আর দীর্ঘ করতে চাইলেন না। বললেন, ‘এসব কথা এখন থাক, কায়রো গিয়েই বাকি আলাপ হবে।’
উটের ওপর বাণিজ্য সামগ্রী বোঝাই করা। নানা রকম প্যাকেট, তাবুর বাণ্ডিল, কতকিছু। সেই বাণ্ডিলের মধ্যে আরো কয়েকটি বাণ্ডিল বাড়লো। আলী বিন সুফিয়ান ও তার গুটিকয় কমান্ডো ছাড়া অন্য কেউ জানতেও পারলো ন, জড়ানো তাবুর মধ্যে আছে মেয়ে-পুরুষ মিলে নয়জন খৃস্টান গোয়েন্দা। তাদের কি হাল হলো, তারা দমবন্ধ হয়ে মারা গেল, না বেঁচে আছে, এ নিয়েও যেনো কারো কোন চিন্তা নাই।
কাফেলা দামেস্ক ছেড়ে অনেক দুর চলে এসেছে। পিছনে তাকিয়ে দেখলেন আলী। না, শহরের চিহ্নও আর দেখা যায় না। আশেপাশে কোন লোকালয় চোখে পড়ে না।
আলী কাফেলাকে থামতে বললেন। খৃস্টানদেরকে তাবুর বাণ্ডিল থেকে মুক্ত কলে দেখা গেল সকলেই বেঁচে আছে। তিনি মেয়েদের উটের ওপর এবং পুরুষদেরকে ঘোড়ায় তুলে কাফেলাকে আবার রওনা হতে বললেন।
খৃস্টানরা তাদের মুক্তির জন্য আবেদন করে বললো, ‘আমাদের সমস্ত অর্থ সম্পদ, হীরা-জহরত, সোনার থলি, যেগুলো খলিফা ও আমীরদের উপহার সেয়ার জন্য এনেছিলাম, স আপনাদের দিয়ে দেবো। বিনিময়ে আপনি শুধু আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দিন।’
আলী বিন সুফিয়ান হেসে বললেন, ‘ওসব তো এমনিতেই আমাদের সাথে যাচ্ছে।’
o
সে সময় ত্রিপলীর সম্রাট ছিল দ্বিতীয় রিমেন্স। এখনকার লিবিয়ারই আগে নাম ছিল ত্রিপলী, বর্তমানে তা লিবিয়ার রাজধানী। নূরুদ্দিন জঙ্গীর ইন্তেকালে জেরুজালেম ও আশেপাশের শাসকদের মত দ্বিতীয় রিমেন্সও খুশী হয়েছিলেন। সেই খুশী উপভোগের জন্য তিনি বিভিন্ন দেশের সম্রাট ও খৃস্টান সেনাপ্রধানদের এক কনফারেন্স ডাকলেন।
সে সম্মেলনে কি সব গোপন পরিকল্পনা হয়েছিল বাইরের কেউ তা জানতে পারেনি। কিন্তু দেখা গেল সে বৈঠক থেকে ফিরে কয়েকদিন পরই সেরিজ নামে এক ইংরেজ কমান্ডার তার সামরিক বাহিনীকে হলব পর্যন্ত নিয়ে গেলো। সে সময় হলবের আমীর ছিলো শামসুদ্দিন। সেরিজ তাঁকে পয়গাম পাঠালো, ‘হয় হলব আমার হাতে তুলে দাও নতুবা আমার মোকাবেলা করার জন্য তৈরী হও।’
শামসুদ্দিন ভয়ে দামেস্ক ও মুসালের কাছে সাহায্য চাইলো। কিন্তু তারা সাহায্য করার পরিবর্তে নিজেরাই তা দখল করার উদ্দ্যোগ নিল। অবস্থা বেগতিক দেখে শামসুদ্দিন খৃস্টানদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে নিজের প্রাণ রক্ষা করলো। এভাবেই খৃস্টানরা নতুন করে সফলতার সূচনা করলো।
খৃস্টানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, মুসলমান আমীররা একে অন্যকে সাহায্য করার পরিবর্তে অন্য রাজ্য আক্রমণ করতে চায়। সে কারণে তারা যুদ্ধ ছাড়াই কেবল্ভয় দেখিয়ে মুসলিম রাজ্যগুলো দখল করার পায়তারা করতে লাগল। তাদের ভয় শুধু একটি, সালাহউদ্দিন আইয়ূবী। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শক্তি ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে তারা সজাগ ছিল। তাদের ভয়, যদি সুলতান আইয়ুবী তাদের মোকাবেলায় সমস্ত আমীরদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে তবে তাদের আশায় গুড়ে বালি পড়বে। সে জন্য তারা তাদের অনুগত আমীরদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি ও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলো।
রিমেন্স খলিফাতুলমুলক আবু ছালেহ-এর কাছে উপঢৌকন ও দূত পাঠিয়ে জানালো, ‘যদি আপনি প্রয়োজন মনে করেন, তবে আমরা আপনাকে প্রয়োজনীয় সামরিক সাহায্যও দিতে প্রস্তুত আছি।’
সুলতান আইয়ুবী কায়রোতে বসে অধীর আগ্রহে আলী বিন সুফিয়ানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সময় যেন আর যায় না। ভেতরে ভেতরে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। আলী বিন সুফিয়ানের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করছে তার সমস্ত পরিকল্পনা। তিনি মানসিক ভাবে বাগদাদ, দামেস্ক ও ইয়েমেনে সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছেন। কিন্তু একসাথে তা সম্ভব নয়।
এদিকে মিশরের আভ্যন্তরীণ অবস্থা ভাল না। সৈন্য সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। অবস্থা যা তাতে তিনি মিশর থেকে খুব বেশি সৈন্য সঙ্গে নিতে পারবেন না। এটিই ছিল তার বড় ভয় ও শংকার কারণ। এত অল্প সৈন্য নিয়ে তিনি কি সফল হতে পারবেন? অথচ সামরিক অভিযান ছাড়া এ সমস্যার মোকাবেলায় তিনি দ্বিতীয় কোন পদক্ষেপের কথা চিন্তাই করতে পারছেন না।
অপেক্ষার প্রহর বড় যন্ত্রণাময়। প্রতিদিন তিনি দিনে একাধিকবার বাড়ীর ছাদে উঠে যান। দূর দিগন্তে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আলী বিন সুফিয়ানের আসার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
সেদিনও তিনি এমনিভাবে তাকিয়ে ছিলেন দূর দিগন্তে। হটাত তিনি বহু দূরে মেঘ দেখতে পেলেন। ভূমি থেকে ধূলির মেঘ উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। সুলতান আইয়ুবী সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। ধূলির মেঘ ক্রমশঃ এগিয়ে আসতে লাগলো। এক সময় তার মধ্যে থেকে ঘোড়া ও উটের পাল দেখা গেল।
ওটাই ছিল আলী বিন সুফিয়ানের কাফেলা। তাঁরা রাস্তায় খুব কমই বিশ্রাম নিয়েছেন। তাঁদের দৃষ্টিতেও এবার ভেসে উঠলো কায়রোর মিনার। সাথে সাথে তাদের চলার গতি বেড়ে গেল। তীব্র গতিতে ঊট ও ঘোড়া ছুটিয়ে ছুটে আসতে লাগলেন তারা। তাঁরা জানতো, তাদের এ সফরে সময়ের মূল্য কত? সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাঁদের অপেক্ষার কি অধীর প্রহর গুনছেন।
শেষ হলো প্রতীক্ষার প্রহর। ধূলোয় মলিন আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইয়ুবীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। সুলতান আইয়ুবী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেলেন অফিস কক্ষে। তাকে কাপড় ছাড়ারও সুযোগ দিলেন না, অধীর আগ্রহে বললেন, ‘বলো, কি খবর নিয়ে এসেছো?’
আলী বিন সুফিয়ান বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করলেন সুলতানের সামনে। নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর আবেগভরা বক্তব্য শোনালেন। সেনাপতি তাওফীক জাওয়াদের সাথে যে আলোচনা হয়েছিল তা শোনালেন। শেষে তিনি বললেন, ‘দামেস্ক থেকে আপনার জন্য কিছু উপহার নিয়ে এসেছি। এ উপহার হচ্ছে, পাঁচজন খৃস্টান পুরুষ ও চারজন মেয়ে। সন্ধ্যার আগেই তারা আপনার জন্য আরো মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করবে বলে আশা রাখি।’
‘তার মানে, আমাকে অভিযানে বেরুতেই হচ্ছে?’ বললেন সুলতান আইয়ুবী।
‘হ্যা সুলতান, এ ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তবে আমি আশা করি গৃহযুদ্ধ হবে না।’
সুলতান আইয়ুবী আরো তাঁর দু’জন উপদেষ্টাকে ডাকলেন, যাদের ওপর তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল। তাঁরা এলে তিনি তাদের বললেন, ‘আমি তোমাদের এখন যে কথা বলবো, তা অন্তরে গেঁথে নেবে। তোমরা দু’জন ছাড়া যে এসব কথা আর জানবে শুধু আলী। এ ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ যেন এই গোপন কথা জানতে না পারে।’
তিনি তাঁদেরকে সামেস্ক ও অন্যান্য মুসলিম রাজ্যের আমীরদের অবস্থা ও বিলাসিতার কথা শোনালেন। আলী বিন সুফিয়ানের সংগৃহীত রিপোর্ট শুনালেন আর বললেন, ‘আল্লাহর সৈনিক আল্লাহর আদেশই পালন করে থাকে। খলিফার আদেশ মান্য করা আমাদের ওপর ততক্ষণ ফরজ যতক্ষণ তাঁরা আল্লাহর বিধানের অনুসারী থাকে। কিন্তু আমীর ও খলিফা যদি আল্লাহর মহান দ্বীন ও রাসূলের (সা.) সুন্নাহর পরিবর্তে নিজের খাহেশের গোলাম হয়ে যায়, তখন আল্লাহর সিপাহীর ওপর ফরজ হয়ে যায় তার বিরোধিতা করা।
যদি আমার অস্তিত্ব মিল্লাতের জন্য বিপদ ও কলংকের কারণ হয়, তোমাদের দায়িত্ব হবে আমার নেতৃত্ব ও ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া। প্রয়োজন হলে আমার পায়ে বেড়ী দিয়ে কয়েদখানায় আটকে রাখবে, প্রয়োজন হলে আমার শির ছিন্ন করবে দেহ থেকে, কিন্তু দেশ থেকে আল্লাহর আইন উৎখাত হতে দেবে না।
সমাজ ও রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন বলবত ও জারি রাখা হলো আল্লাহর সৈনিকদের মূল দায়িত্ব। আল্লাহর সৈনিক তারাই, যারা আল্লাহকে মুনীব ও মালিক বলে স্বীকার করে। অর্থাৎ মুসলমান মাত্রই আল্লাহর সৈনিক, এ দায়িত্বও তাই প্রতিটি মুসলমানের কাঁধে ন্যস্ত।
একজন মুসলমান হিসেবে এ দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যেতে পারিনা। যে খলিফা মিল্লাতের ইজ্জত, সম্মান ও গৌরববোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে শত্রুদের সাথে মিতালি করছে, শত্রুর কাছে সাহায্য ভিক্ষা করছে, তাদের গোয়েন্দাদের আশ্রয় দিচ্ছে, তার কবল থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করা আজ ফরজ হয়ে গেছে।
তার আমীররা আজ খৃস্টানদের আজ্ঞাবাহী, আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার গোলাম। তাদের সহায়তায় মুসলিম রাজ্যেগুলো আজ শত্রুদের অবাধ বিচরন ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে। হালবের আমীর শামসুদ্দিন খৃস্টানদের কাছে অস্ত্র পর্যন্ত সমর্পন করে দিয়েছে। খলিফা এখন মুসলমান নয় খৃস্টান স্বার্থের রক্ষক। পুতুলের মত খলিফাকে চেয়ারে বসিয়ে মুসলিম মিল্লাতের ওপর আধিপত্য চালাচ্ছে খৃস্টানরা। এ অবস্থায় খলিফাকে গদিচ্যুত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা কি আমাদের ওপর ফরজ হয়ে যায়নি? ইসলামের সম্মান রক্ষায় সেনাবাহিনী নিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া কি আমাদের ঈমানের দাবী নয়?’
‘হ্যা, এটা আমাদের ঈমানী দাবী। খলিফার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের ওপর।’ দু’জন উপদেষ্টা একই সঙ্গে বলে উঠলো।
‘তাহলে কিভাবে এগুনো যায় এসো সেই পরিকল্পনা করি। এ পরিকল্পনার গোপনীয়তার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। আমরা চারজন ছাড়া এ বিষয় আর কেউ জানবে না।’
সুলতান আইয়ুবী উপদেষ্টাদের নিয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন।
খৃস্টান গোয়েন্দা ও মেয়েদের আলী বিন সুফিয়ান এক অন্ধকার গোপন কক্ষে নিয়ে গেলেন। বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সচরাচর তিনি এ কক্ষটিই ব্যবহার করেন।
‘তোমরা এমন এক জাহান্নামে প্রবেশ করেছ, যেখানে তোমরা বাঁচার মত বাঁচতেও পারবে না, আর মরতেও পারবে না। তোমাদের দেহকে কংকালের আকৃতি বানানোর আগেই আমার কাছে সুস্থ্য অবস্থায় সত্য কথা বলে দাও, আর এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করো। আমি তোমাদের চিন্তা করার সুযোগ দিচ্ছি। একটু পরেই আমি আবার আসবো।’
আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে বেড়ী পরানোর আদেশ দিলেন। এক খৃস্টান চিৎকার করে বললো, ‘আমাদের শাস্তি দেওয়ার আগে আমাদের কথা শুনুন। আমরা বেতনভোগী কর্মচারী মাত্র। শাস্তি হওয়া উচিত আমাদের যারা এ কাজে পাঠিয়েছে তাদের। তাদের সম্পর্কে সব কথা আমরা আপনাদের বলে দেবো। দয়া করে আমাদের ওপর রহম করুন। অন্তত এই অবলা মেয়ে কয়টিকে শাস্তি থেকে রেহাই দিন।’
‘তাদের গায়ে কেউ হাতও দেবে না।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তোমরা আমাদের কাজ সহজ করে দাও, তোমাদের মেয়েরা তোমাদের কাছেই থাকবে। এই অন্ধকার কারাগার থেকে সকলকে মুক্তি দেয়া হবে। আমরা মিথ্যা ওয়াদা করি না, সব কথা খুলে বললে তোমাদেরকে বড়জোর সম্মানের সাথে নজরবন্দী রাখা হবে।’
নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর খৃস্টানরা যেসব গোপন পরিকল্পনা করেছিল সন্ধ্যার আগেই আলী বিন সুফিয়ান সে সব তথ্য তাদ্র কাছ থেকে উদ্ধার করে নিলেন। মৃত্যু ভয়ে ভীত খৃস্টান গোয়েন্দারা জানতো গুপ্তচরদের সাথে প্রতিপক্ষ কেমন ব্যবহার করে। আলীর আশ্বাসের ওপর আস্থা রেখে তারা সঠিক তথ্যই দিল আলীকে, যাতে সত্যতা যাচাই করতে গেলে তারা মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত না হয়। তারা আশা করলো এতে তারা কিছুটা হলেও অনুকম্পা চাওয়ার হকদার হবে।
o
তিন দিন পর। মিশরের সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, উত্তর পশ্চিম দিকে মাটির উঁচু উঁচু টিলা ও গিরিপথ সমৃদ্ধ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল। টিলা ও গিরিপথের ফাঁকে মাঝে মাঝে রয়েছে সবুজ মাঠ ও পানির উৎস। সবুজের ছোঁয়া থাকার পরও ছোট বড় অসংখ্য টিলার কারণে অঞ্চলটি দুর্গম। সাধারণ মরু কাফেলা কখনো এ পথে পা বাড়ায় না ভয়ে এবং পথ হারানোর শংকায়।
এ অঞ্চলেই টিলার আড়ালে এক বড়সড় মাঠে দেখা গেল অসংক্য ঘোড়া। তাদের আরোহীরা শুয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, এক জায়গায় ছোট একটি তাবু টানানো। তাবুর ভেতর শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন এক লোক। এ লোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।
ছোট এক তাবুতে শুয়ে আছেন সুলতান আইয়ুবী। এখানে সেখানে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে আইয়ুবীর অশ্বারোহীরা। তাদের সংখ্যা মাত্র সাতশো।
সুলতান আইয়ুবী অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি দামেস্কে যাবেন খুব কম সৈন্য নিয়ে। যদি সুলতান হিসেবে মর্যাদা দিয়ে খলিফা তাকে আলোচনার সুযোগ দেন তবে ভাল, আর যদি বাঁধা দেয়, তবে এ সল্প সৈন্য নিয়েই তিনি মোকাবেলা করবেন তাদের।
তিনি তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর মধ্যে থেকে এমন সাতশো সৈন্য বাছাই করেছেন, যারা বহু যুদ্ধে বার বার বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এর মধ্যে আছে গেরিলা বাহিনীর অশ্বারোহীরা , যারা শত্রুর ওপর ঝটিকা হামলায় পারদর্শী। এরা কেবল কুশলীই নয়, আবেগদীপ্ত, উচ্ছল, প্রাণময়। ক্রুসেডদের নাম শুনলেই এদের চোখ রাগে রক্তলাল হয়ে যায়। সেনাবাহিনীতে এরা ‘ক্রাকের বীর অশ্বারোহী’ গ্রুপ বলে পরিচিত।
অত্যন্ত গোপনে রাতের অন্ধকারে সুলতান আইয়ুবী এদেরকে কায়রো থেকে বের করে নিয়ে আসেন এই দুর্গম অঞ্চলে। সুলতানের নির্দেশ পেয়ে তাঁরা প্রত্যেকেই একা এবং বিচ্ছিন্নভাবে শহর থেকে বেরিয়ে সবার অলক্ষ্যে এখানে এসে সমবেত হয়। নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া পাশের সৈনিকটিও টের পায়নি তার সাথী গোপনে কোন অভিযানে চলে যাচ্ছে।
ওদেরকে এখানে এসে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সুলতান নিজেও কায়রো থেকে গোপনে বেরিয়ে আসেন। শুধু আলী বিন সুফিয়ান ও উপদেষ্টা দু;জন ছাড়া আর কেউ জানেন না সুলতান আইয়ুবী এখন কোথায়? সুলতানের রক্ষী বাহিনী যথারীতি কায়রোতে তার হেড কোয়ার্টার পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। তারাও জানে, সুলতান আইয়ুবী কায়রোতেই আছেন।
কায়রো এবং তার আশেপাশে খৃস্টান গোয়েন্দারা সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল সুলতানের গতিবিধির ওপর। খৃস্টান গোয়েন্দাদের মধ্যে মিশরের কিছু গাদ্দার মুসলমানও ছিল। এদের মধ্যে আবার কিছু ছিল সরকারী চাকুরে। কিন্তু ঘুর্ণাক্ষরেও ওরা কেউ জানতে পারলো না, সুলতান আইয়ুবী সাতশো বাছাইকৃত অশ্বারোহী নিয়ে কায়রো থেকে বেরিয়ে গেছেন।
তিন চারজন লোক টিলার উপরে টহল দিচ্ছে। চারজন পাহারা দিচ্ছে নিচে। সকলের অগোচরে এ বাহিনী রওনা দিয়েছে এক স্পর্শকাতর লড়াইয়ে। খৃস্টানদের তল্লীবাহক খলিফা ও গাদ্দার আমীএদের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা তাদের চোখে মুখে।
পরবর্তী কাহিনীর জন্য পড়ুন এ সিরিজের পরবর্তী বই
ক্রুসেড – ১০
সর্প কেল্লার খুনী
পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »