৯. উপকূলে সংঘর্ষ

দিনের বেলা যে জেলে খৃস্টানদের সংবাদ পৌছিয়ে দিয়েছিল সে জেলে ছি আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগের এক চৌকস গোয়েন্দা। জেলে মারফত খৃস্টান নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন যে তথ্য জেনেছিল, সে তথ্যগুলো ছি সম্পূর্ণ ভুল ও বানোয়াট। তবে জেলে একটি তথ্য ঠিকই দিয়েছিল, মিশরের নৌবহর সেখান থেকে আসলেই অনেক দূরে ছিল। আশেপাশে নৌবাহিনীর অস্তিত্ব নেই দেখেই খৃস্টান কমান্ডার জেলের বক্তব্য বিশ্বাস করেছিল।

আইয়ুবী তার এডমিরালকে বলে রেখেছিলো, ‘সাগরের দিকে কড়া দৃষ্টি রেখো। যে কোন সময় খৃস্টান বাহিনী এসে পৌছতে পারে। বিশাল বাহিনী নিয়ে তাদের আমি আক্রমণ করতে চাই না। যত বড় বাহিনীই আসুক, তাদের মোকাবেলা করবে কমান্ডো বাহিনী দিয়ে।’

এডমিরাল সেই মতই সতর্ক দৃষ্টি রেখে সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিল। যথাসময়েই তিনি খবর পেয়েছিলেন খৃস্টান নৌবাহিনীর আগমনের। তিনি তার মেনজানিক ও গোলা বারুদপূর্ণ জাহাজগুলো বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। জাহাজের পাল নামিয়ে ফেলেছিলেন দূর থেকে যেন জাহাজগুলো চোখে না পড়ে সে জন্য। জাহাজের প্রতি দাঁড়ে দু’জন করে মাল্লা নিযুক্ত করে রেখেছিলেন তিনি যাতে সময়মত জাহাজের গতি দ্রুত করা যায়।

সন্ধ্যার পরে যখন খৃস্টানদের যুদ্ধ জাহাজগুলো সাগরের কূলে ভিড়লো, তখন এডমিরাল তার জাহাজগুলোতে মাস্তুল ও পাল তুলে দিলেন। মাল্লাদের বললেন, ‘জাহাজ দ্রুত আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে নিয়ে চলো।’

মাল্লারা দ্রুত পৌছার জন্য জোরে জোরে দাঁড় টানতে লাগলো এবং সময় মতই খৃস্টানদের জাহাজগুলোর পিছনে এসে পোউছল। যখন খৃস্টানরা জাহাজগুলো একসাথে বেঁধে রেখে শহরে চড়াও হলো তখন সন্তর্পনে আইয়ুবীর জাহাজ ভিড়ল সেই বেঁধে রাখা জাহাজের পাশে।

এরপর আইয়ুবীর কমান্ডোরা খৃস্টানদের জন্য কেয়ামত ডেকে আনলো। যে খৃস্টানরা আইয়ুবীকে কৌশলে ধ্বংশ করার মতলব এঁটেছিল, আইয়ুবীর কৌশলের কাছে মার খেয়ে তারাই এখন ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছিল।

জেলারা যখন খৃস্টান কমান্ডারকে রিপোর্ট করেছিল, আলেকজান্দ্রিয়া শহরে কোন সৈন্য মোতায়েন নেই, তখন শহরের সমদ্র তীরবর্তী বাড়ীগুলো ছিল মুসলিম সৈন্যে ভর্তি। নগরবাসীদেরকে আইয়ুবী আগেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

সুলতান আইয়ুবীর এডমিরাল অল্প ক’টি জাহাজ নিয়ে তাদের মোকাবেলায় গিয়েছিলেন। তিনি তাদের যথেষ্ট ক্ষতি করলেও শত্রুদের কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জাহাজে আগুন দেখেই ওরা বুঝে ফেলেছিল, ওরা আইয়ুবীর ফাঁদে পড়েছে। এর পরিনতি কি হতে পারে তা আন্দাজ করতে ওদের মোটেও বিলম্ব হয়নি। ওরা সংগী খৃস্টান সৈন্যদের রক্ষা করার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের জান নিয়ে তখনি সটকে পড়ে।

আগুন লাগা জাহাজগুলোর আলোতে সমদ্রের বুক দিনের মত ফর্সা হয়ে গিয়েছিল। সেই আলোতে সুলতান আইয়ুবীর জাহাজগুলোও দেখতে পাচ্ছিল শত্রু বাহিনী। এক সাহসি ক্যাপ্টেন যখন বুঝলো, তারা চরম ভাবে আক্রান্ত হয়েছে তখন সে তার জাহাজের মেনজানিকের নল ঘুরিয়ে দিল মুসলিম জাহাজগুলোর দিকে। তারপর জানের পরোয়া না করে অবিশ্রান্ত গোলা বর্ষণ শুরু করলো।

তার দেখাদেখি আরো কয়েকটি জাহাজের নল ঘুরে গেল মুসলিম রণতরীর দিকে। সেই বর্ষণের প্রচণ্ডতায় আইয়ুবীর বাহিনীর এডমিরাল তার জাহাজ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। কারণ শত্রুসেনাদের অক্ষত জাহাজের পরিমাণ তখনো কম নয়, তারা মুসলমানদের জাহাজগুলো ঘিরে ফেলার চেষ্টা করতে পারে।

তিনি যখন পিছু হটছিলেন তখনি আলেকজান্দ্রিয়া শহরে সুলতান আইয়ুবীর নিবেদিতপ্রাণ সৈন্যরা ভীষণ বেগে আক্রমণ চালালো সমদ্র তীরে। তারা উপকূল থেকে জাহাজের ওপর তীর ও অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করতে লাগলো। এই জানবাজ সৈন্যদের অধিকাংশই ছিল মিশরীয়। সুলতান আইয়ুবী এদেরকে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে প্রথমিক যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। এরা বেসামরিক পোষাকে সাধারণ নাগরিকের মত আলেকজান্দ্রিয়া শহরের বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। অত্যন্ত গোপনে এদেরকে শহরের এসব বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধ ছিল বুদ্ধি ও কৌশলের খেলা। তিনি যতটুকু সম্ভব কম সংখ্যক সৈন্য ক্ষয় করে যুদ্ধে জয় লাভ করতে চাচ্ছিলেন। তাই যথেষ্ট পরিমাণ সৈন্য তিনি আত্র নিজ কমান্ডে রেখে দিয়েছিলেন।

সসারা রাত এ যুদ্ধ চললো। রাতভর সমুদ্রের মাঝে একের পর এক জাহাজ জ্বললো। জাহাজগুলোতে তখন কিয়ামতের বিভীষিকা। খৃস্টানদের জাহাজ ছিল অনেক বেশী। তারা একাধিকবার মুসলমানদের জাহাজ ঘিরে ফেলতে চেষ্টা করলো। প্রতিবারই ব্যাপারটা প্রায় অবরোধের পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার প্রাক্কালে কেমন করে যেন ভণ্ডুল হয়ে গেল। কোন না কোন ফাঁক-ফোকড় গলে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হলো আইয়ুবীর রণতরী।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নিয়োজিত সেনাপতিই তখনো পর্যন্ত যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। আইয়ুবী তার বাহিনী নিয়ে দূর থেকে দেখছিলেন যুদ্ধের গতিবিধি।

মধ্যরাতের পর সুলতান তার জিম্মায় রাখা জাহাজগুলোকে আদেশ দিলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পুড় এলাকা টহল দেয়া শুরু করো। নিজেদের নিরাপদ রেখে যতদূর সম্ভব শত্রুর জাহাজগুলোকে বিরক্ত ও ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। কোথাও আমাদের কোন জাহাজ অবরোধের মধ্যে পড়ে গেলে তাকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দেয়া তোমাদের দায়িত্ব।’

রাতের শেষ প্রহর। খৃস্টান বাহিনী প্রাথমিক বিহবলতা কাট্যে উঠে নিজেদের বিশৃংখলা দূর করে অনেকটা সঙ্ঘত অবস্থায় লড়াই করে যাচ্ছে। অনেক জাহাজ পুড়ে যাওয়া এবং কিছু জাহাজ পালিয়ে যাওয়ার পরও সংখ্যায় খৃস্টান বহরের জাহাজ মুসলিম বহরের চাইতে অনেক বেশী। সুলতান তার সংরক্ষিত নৌবহরকে চুড়ান্ত হামলার আদেশ দিলেন। প্রচণ্ড বিক্রমে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল নৌযোদ্ধারা। তারা জাহাজ থেকে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে অন্ধকারে চুপিসারে পৌঁছে যেতো শত্রু জাহাজের কাছে। তারপর তীর ধনুক ও গোলা বারুদ নিয়ে মেতে উঠতো শত্রু নিধনে।

এখন সকাল। টকটকে রক্তচক্ষু মেলে সূর্য উঠল পূর্ব দিগন্তে। তার আলোয় সমদ্রের গভীর নীল জন এখন টকটকে লাল। মনে হয় ভোরের হাওয়ায় আদিগন্ত সমুদ্র জুড়ে বিশাল লাল সামিয়ানা দুলছে ঢেউয়ের তালে তালে।

এডমিরাল নৌকা নিয়ে সাগরের পাড়ে এসে পৌছলেন। তার সাথে নৌবাহিনীর কয়েকজন সামরিক অফিসার। এডমিরালের গায়ের পোষাক রক্তে রঞ্জিত। তার একটি পা আগুনে ঝলসে গেছে। খৃস্টানদের মিনজানিকের গোলার আঘাতে তার জাহাজে আগুন ধরে গিয়েছিল। সে আগুন নেভানো সম্ভব হয়নি। জাহাজটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি কয়েকজন অফিসারসহ নৌকা নিয়ে কোনরকমে কুলে এসে পৌছেছেন।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরের জেটিতে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন যুদ্ধের অবস্থা। এডমিরাল তাড়তাড়ি তার কাছে পৌঁছলেন।

তিনি সংক্ষেপে দ্রুত  সুলতান আইয়ুবীর কাছে যুদ্ধের অবস্থা বঈণনা করে বললেন, ‘আমাদের অর্ধেক জাহাজ এরই মধ্য ধ্বংশ হয়ে গেছে। কিন্তু খৃস্টানদেরও ক্ষতির পরিমাণ কম নয়। যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না।’

সুলতান তাকে বললেন, ‘দুশ্চিন্তা করো না, অবশিষ্ট জাহাজগুলোও এখন যুদ্ধে নেমে পড়েছে।’

নৌবাহিনীর প্রধান আইয়ুবীকে বললেন, ‘খৃস্টান বাহিনীর সবচেয়ে বেশী ক্ষতিসাধন করা গেছে মাল বোঝাই জাহাজগুলোর। এ সব জাহাজে খাদ্যশস্য, ঘোড়া ও অস্ত্রপাতি বোঝাই। বোঝাইয়ের কারণে জাহাজের গতি ছিল মন্থর। ঘোরাতে ফিরাতেও অনেক সময়ের দরকার হতো। আমার জাহাজ ছিল যেমন হালকা তেমনি দ্রুতগতি সম্পন্ন।’

এডমিরাল বা আমীরুল বাহার এত বেশী আহত ছিলেন যে, তার শরীর ও মাথা ঘুরছিল। সুলতান আইয়ুবী তার চিকিৎসককে জলদি ডেকে পাঠালেন। কিন্তু এডমিরাল তার জখমকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না।

সুলতান আইয়ুবীর হেডকোয়ার্টার ছিল সাগর তীরের এক পাহাড়ী উপত্যকায়। তিনি আমীরুল বাহারকে নিয়ে হেডকোয়ার্টারে গেলেন। তাকে চিকিৎসকের হাতে তুলে দিয়ে এক উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে তাকালেন সমুদ্রের দিকে।

সূর্যের প্রথম কিরণে সাগর ও সাগর তীরে এক ভয়ংকর দৃশ্য ফুটে উঠলো। যতদূর দৃষ্টি যায় সমুদ্রের মাঝে জাহাজগুলো উন্মত্ত ষাঁরের মত ধাওয়া করে ফিরছে। অনেক জাহাজে তখনো আগুন জ্বলছিল। কিছু জাহাজের মাস্তুল ভেঙ্গে গিয়ে খান খান। কারো পাল অকেজো হয়ে যাওয়ায় জাহাজগুলো একই জায়গায় টালমাটাল অবস্থায় দুলছিল।

সাগরের মাঝে অসংখ্য লোককে সাতার কাটতে দেখা গেল। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ মৃতদের লাশগুলোকে সাগর তীরে এনে জড়ো করছে। চূড়ান্ত হামলার জন্য সুলতান যে জাহাজগুলো পাঠিয়েছেন সে জাহাজগুলোকে তিনি কোথাও দেখতে পেলেন না।

একটু পর। পশ্চিমে ভু দূরে সাগরের বুকে মাস্তুলের অগ্রভাগ দেখা গেল, পরে পালও দৃষ্টিগোচর হলো। জাহাজগুলো সারিবদ্ধভাবে একে অন্যের সাথে একটা সমান্তরাল দূরত্ব বজায় রেখে যুদ্ধস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সুলতান আইয়ুবী সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাদের জাহাজগুলো ছুটে আসছে।’

প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আমীরুল বাহার বাইরে এসে দেখেন সুলতান সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি সুলতানের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালেন সাগরের দিকে। দেখলেন, মুসলিম নৌসেনারা জাহাজগুলো নিয়ে ছুটে আসছে যুদ্ধের মূল কেন্দ্রের দিকে। তিনি সুলতান আইয়ুবীকে কিছু না বলেই উপত্যকা থেকে নিচে নেমে এলেন।

তিনি একটি নৌকায় চড়ে বসলেন। নৌকাটি দশ দাঁড়ের এক দ্রুতগামী তরী। নৌকার পালে বাতাসের টান পড়লো। ছুটলো যুদ্ধস্থলের দিকে। সহসা সুলতান আইয়ুবীর দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সেই নৌকার ওপর। আহত আমীরুল বাহারকে আবার যুদ্ধের ময়দানে ছুটতে দেখে সুলতান আইয়ুবী চিৎকার করে উঠলেন, ‘সাঈদী!  তুমি ফিরে এসো। তোমার পরিবর্তে আমি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আবু ফরিদকে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

আমীরুল বাহারের নৌকা ততোক্ষণে অনুকূল হাওয়ায় ছুটতে শুরু করেছে। তিনি উচ্চস্বরে হাত নেড়ে বললেন, ‘সামান্য জখমের বাহানায় যুদ্ধের ময়দান থেকে দূরে থাকা ভীরু এবং কাপুরুষদের কাজ। আমাকে ক্ষমা করুন সুলতান, যেখানে আমার সৈনিকরা অকাতরে শহীদ হচ্ছে আমাকে তাদের সাথে শামিল হতে দিন। আল্লাহ হাফেজ।’

আমীরুল বাহারের নৌকাটি দ্রুত সরে যেতে লাগলো উপকূল থেকে। এক সময় দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।

এ সময় এক কাসেদ ছুটে এসে সুলতানকে সালাম দিল। আইয়ুবী তার দিকে তাকিয়ে সালামের জওয়াব দিয়ে বললেন, ‘কি সংবাদ নিয়ে এলে তুমি?’

দূত বললো, ‘আলেকন্দ্রিয়া বন্দর থেকে তিন মাইল উত্তর-পূর্ব কোণে খৃশ্তান সৈন্য অবতরন করেছে। সেখানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’

সুলতান আইয়ুবী মনযোগ দিয়ে সংবাদ বাহকের কথা শোনলেন। তার কথা শেষ হলে বললেন, ‘তুমি এখনি আবার সেখানে ছুটে যাও। আমি যা যা বলছি, সেনাপতিকে গিয়ে সেই মত কাজ করতে বলবে। বলবে, এটা সুলতানের হুকুম।’

তিনি কিছু নির্দেশনা দিয়ে কাসেদকে পূনরায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।

কাসেদ বিদায় হলে তিনি আবার সমুদ্রের দিকে তাকালেন। সেখানে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলেন যুদ্ধের গতিবিধি। এক পর্যায়ে তিনি দেখতে পেলেন, খৃস্টানদের একটি যুদ্ধ জাহাজ প্রায় সাগরের তীরে এসে গেছে। মুসলিম নৌবহরের একটি জাহাজ তাকে ধাওয়া করে নিয়ে এসেছে এখানে। খৃস্টান জাহাজের দিশেহারা সৈন্যরা ক্রমাগত এলোপাথারি তীর বর্ষণ করে যাচ্ছে। মুসলিম জাহাজের সৈন্য ও মাল্লারা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বেপরোয়াভাবে ছুটছে জাহাজটির দিকে। দেখতে দেখতে, তারা খৃস্টান জাহাজটিকে ধরে ফেলল। একদল লাফিয়ে উঠে পড়ল খৃস্টানদের জাহাজে। শুরু হলো হাতাহাতি যুদ্ধ।

খৃস্টানরা মৃত্যুর পূর্বে শেষ কামড় বসালো মুসলিম সৈন্যদের ওপর। একসাথে কয়েকজন করে ছুটে এলো মুসলিম সৈন্যদের মোকাবেলা করার জন্য। প্রথম দিকে যারা জাহাজে চড়ল তাদের অনেকেই শহীদ হয়ে গেলো। তবে এ অবস্থা বেশীক্ষণ চললো না, আরো কিছু মুসলিম সৈন্য জাহাজে চড়তেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। একটু পরেই জাহাজ মুসলিম অধিকারে চলে এলো। কিন্তু এর জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করলো মুসলিম জানবাজরা তার বর্ণনা দেয়া কোন কলমবাজের পক্ষে সম্ভব নয়।

নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম নৌসেনারা তাদের দেহের শেষ রক্তবিন্দু দ্বীনের জন্য নিঃশেষে ঢেলে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের সীমাহীন সাহস, বীরত্ব, নৈপুণ্য ও কোরবানী দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিল খৃস্টান সৈন্যরা। একসাথে একাধিক জাহাজের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, শত্রু জাহাজে অসংখ্য সৈন্য দেখার পরও তাতে লাফিয়ে চড়ার প্রতিযোগিতা, তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েও সম্মুখে অগ্রসর হওয়া, এসব দেখে খৃস্টান সৈন্যদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেল।

উপায়ন্তর না দেখে খৃস্টানরা তাদের জাহাজ নিয়ে যুদ্ধের আওতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করলো।

খৃস্টান বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গিয়েছিল রাতের অতর্কিত আক্রমণেই। এতক্ষণ তারা যুদ্ধ করছিল অনেকটা নিরুপায় হয়ে, কিছুটা ক্রুশের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের শপথের কথা স্বরণ করে। তা ছাড়া সকাল পর্যন্ত তারা আশা করছিল, সুলতান আইয়ুবী যত বড় যুদ্ধবাজই হোক, সামান্য সংখ্যক নৌশক্তি নিয়ে সে কতটুকুই বা তাদের ক্ষতি করতে পারবে! সকাল হলে দিনের আলোয় আইয়ুবীর জাহাজ একটা একটা গিলে খাবে তারা। ধ্বংস করে দেবে আইয়ুবীর ক্ষুদ্র নৌবহর। চিরতরে মিটিয়ে দেবে যুদ্ধের সাধ।

কিন্তু সূর্যের তাপ যতই বাড়ল, ততই বাড়ল তাদের পালানোর আগ্রহ। দিনের শেষ প্রহরে তাদের অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, তাদের পালানোর আগ্রহও নিঃশেষ হয়ে গেল। ভীতি আর হতাশা গ্রাস করলো তাদের। গুটিকয় মুসলমানের হাতে তাদের বিপুল বিশাল শক্তির শোচনীয় পরাজয় ও ধ্বংস দেখে তাদের হাত-পা যে অসাড় হয়ে গেল। তাদের যে অল্প সংখ্যক সৈন্য সাগর তীরে অবতরণ করেছিল, তাদের অধিকাংশই আলেকজান্দ্রিয়ার রাতের যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। তিন চার মাইল দূরে উত্তর-পূর্ব দিকের যুদ্ধেও পরাজয় বরণ করেছিল তারা। যারা তখনো নিহত হয়নি তারা সকলেই অস্ত্র সমর্পণ করে বন্দীত্বকে কবুল করে নিল।

সুলতান আইয়ুবীর রিজার্ভ বাহিনীর দ্বিতীয় দলটি এখনও যুদ্ধে অংশই নেয়নি। সুলতান আইয়ুবীর নিয়োজিত সংবাদ বাহকরা সামগ্রিক যুদ্ধ পরিস্থিতির খবর নিয়মিত এবং সারাক্ষণই সুলতানকে অবহিত করে যাচ্ছে। এ সংবাদের ওপর ভিত্তি করেই তিনি তার যুদ্ধ পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

যখন তিনি বুঝলেন, খৃস্টান বাহিনীর দম ফুরিয়ে এসেছে, এখন তারা যে যুদ্ধ চালাচ্ছে তা ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন তিনি দ্বিতীয় দলকে অনুমতি দিলেন যুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ার।

ইমরানের সংবাদ অনুসারে বায়তুল মোকাদ্দাস থেকেও শত্রু সৈন্যের বহর আসার কথা। সে দিকে নূরুদ্দিন জঙ্গী ওঁত পেতে বসে আছেন। সুলতান আইয়ুবীও সে দিকে লক্ষ্য রেখে প্রতিরক্ষার জন্য সৈন্য সমাবেশ করলেন। যখন তিনি দেখলেন খৃস্টান নোইবাহিনী সমুদ্র পথে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি তৃতীয় যে দলটিকে নিজের কমান্ডে রিজার্ভ রেখেছিলেন, তাদেরকে বললেন, ‘পলায়নপর খৃস্টান সৈন্যদের ধাওয়া করো এবং শত্রু সেনাদের ধরে আনো।’

সূর্য ডোবার শেষ কিরণ এস পড়ল সাগর জলে। রক্তলাল পানিতে কচুরিপানার মত ভেসে বেড়াচ্ছে লাশ আর লাশ। সুলতান আইয়ুবী তাকিয়ে দেখলেন, সাগরের যুদ্ধভূমি এখন ফাঁকা। খৃস্টান নৌবাহিনীর প্রায় সমস্ত জাহাজই জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে গেছে। সে সব জাহাজের অধিকাংশই ডুবে গেছে সাগর জলে। এখনও যেগুলো ডুবেনি তাও ডুবোডুবো করছে। পলায়নরত যে সব জাহাজ ধরে আনার জন্য পাঠানো হয়েছে একটু আগে, দূর থেকে সেগুলোর মাস্তুল ও বাদাম দেখা যাচ্ছে। ক্রমশ সেগুলোও দূরে চলে যাচ্ছে।

যুদ্ধে লিপ্ত মুসলিম নৌবহরের যেগুলো ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছে, সেগুলো ফিরে আসছে কূলে। সুলতান অনুমান করলেন, তার অর্ধেক নৌবহর মিশরের জন্য কোরবান হয়ে গেছে। জাহাজের ডিঙ্গি নৌকাগুলোও ফিরে আসছে সাগর তীরে। তাতে উপচে পড়া মুসলিম নোউবাহিনীর আহত ও ক্লান্ত সৈনিক।

সুলতান আইয়ুবী উপকূলে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলেন। একটি নৌকা সুলতান যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার কাছে এসে ভিড়লো। নৌকার ওপ্র একটি লাশ কাপড় দিয়ে ঢাকা। সুলতান আইয়ুবী উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কার লাশ?’

‘আমীরুল বাহার সা’দী বিন সাঈদীর!’ এক মাল্লা বললো।

সুলতান আইয়ুবী দৌড়ে নৌকার কাছে ছুটে গেলেন। লাশের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখলেন, এডমিরালের লাশ রক্তে রঞ্জিত।

একজন নৌ অফিসার সুলতানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিষাদ্মাখা কন্ঠে তিনি বললেন, ‘মাননীয় সুলতান, মুসলিম জাতির অভিভাবকদের জন্য আমীরুল বাহার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন। সংকটময় মুহূর্তে যে জাতির কর্ণধারগণ সবার আগে এগিয়ে যায় জীবন বিলিয়ে দিতে সে জাতির কোন সন্তান জাতির প্রয়োজনের চাইতে নিজের জীবনকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারবে না কোনদিন।

আমাদেরকে আমীরুল বাহার শিখিয়েছেন কিভাবে নিঃশঙ্কচিত্তে লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। শত্রুদের এক জাহাজের কাছে গিয়ে তিনি নিজে সবার আগে শত্রু জাহাজে লাফিয়ে উঠে পড়লেন।

তাকে জাহাজে লাফিয়ে পড়তে দেখে শত্রুদের প্রচণ্ড বাঁধা উপেক্ষা করে আমাদের বীর মুজাহিদগণ তাকে অনুসরণ করে। জাহাজে উঠেই তিনি অসীম বিক্রমে বেপরোয়া আক্রমণ চালান। খৃস্টানরা টিকতে না পেরে হাতিয়ার ফেলে সারেন্ডার করলে তিনি জাহাজে মুসলিম পতাকা উড়িয়ে দেন। এ সময় খৃস্টানদের চারটি জাহাজ আমাদের ঘেরাও করে ফেলে। আমরা আমীরুল বাহারের নেতৃত্বে শত্রুদের দু’টি জাহাজ পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হই। কিন্তু অন্য দু’টি জাহাজ আমাদের ওপর গজব ঢেলে দেয়। তাদের সম্মিলিত আক্রমনে আমাদের জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। আমীরুল বাহারসহ আমাদের অধিকাংশ সাথী শহীদ হয়ে যান। আমরা কয়েকজন কোন রকমে তার লাশ ডিঙ্গি নায়ে তুলতে সমর্থ হই।’

সুলতান আইয়ুবী আমীরুল বাহারের লাশের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি সেই হাতে চুমু দিয়ে বললেন, ‘বন্ধু আমার! ভাই আমার! তোমার জিম্মাদারী তুমি সবোর্চ্চ সাফল্যের সাথেই পালন করেছো। আমাদের এ বিজয়ের মহানায়ক তুমি, তুমিই সাগর বিজেতা আমীরুল বাহার। ইতিহাস বলবে, এ বিজয়ের কৃতিত্ব আমার। কিন্তু হে আল্লাহ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এ বিজয়ের সকল কৃতিত্ব এই সব শহীদ এবং শাহাদাতের জন্য পাগলপারা জিন্দাদীল মুজাহিদের।’

তিনি তৎক্ষণাৎ আদেশ দিলেন, যত নৌকা আছে সমস্ত নৌকা নিয়ে সাগর চষে বেড়াও। যেখানে যত শহীদের লাশ আছে খুঁজে বের করো। আদবের সাথে সেই সব লাশ নিয়ে এসো এই উপকূলে। কোন শহীদের লাশ যেন সমুদ্রে পড়ে না থাকে। সমস্ত শহীদদেরকে এই সমুদ্র তীরে দাফন করা হবে। সাগরের সুশীতল স্নিগ্ধ হাওয়া তাদের কবরগুলোকে চিরকাল যে সুশীতল করে রাখে।’

উপস্থিত মুজাহিদরা সাথে সাথে নৌকা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল সুবিশাল সমুদ্রবক্ষে। এ যুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ছিল অসংখ্য।

o

বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে খৃস্টান বাহিনীর যে বিরাট সৈন্যদল স্থল পথে মিশরের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল, অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে এলো তারা। খৃস্টান নৌবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের কোন খবর তাদের কানে পৌঁছেনি। ফলে অহংকার ও আনন্দের দ্যুতি খেলা করছিল তাদের চেহারায়। এই স্থল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন খৃস্টান জগতে মশহুর যোদ্ধা বীর শ্রেষ্ট সম্রাট রিজনেল্ট।

তিনি তার বাহিনীকে তিনটি দলে বিভক্ত করলেন। অগ্রাভিযানে পাঠালেন প্রথম দলকে। দ্বিতীয় দলকে মধ্যবর্তী বাহিনী হিসেবে অগ্রগামী বাহিনী থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হওয়ার হুকুম দিলেন। তৃতীয় দলকে বললেন, ‘অনেক দূর দিয়ে মূল বাহিনীর ডান দিক হয়ে অগ্রসর হবে।’

তিন বাহিনীর জন্য তিনজন সেনাপতি নিয়োগ করলেন তিনি। প্রধান সেনাপতি হিসেবে এই সম্মিলিত বাহিনীর মূল নেতৃত্ব ও কমান্ড ছিল রিজনেল্টের হাতেই। তার মনে এ ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, তারা সুলতান আইয়ুবীকে সম্পূর্ণ তার অজ্ঞাতসারে এবং অতর্কিতে হামলা করে খুব সহজেই বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারবে। তার চোখের সামনে ভাসছিল তখন কায়রো শহরের ছবি। সঙ্গে ছিল অসংখ্য ঘোড়া গাড়িতে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য।

আলেকজান্দ্রিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকে বেশ দূরে এক বিস্তীর্ণ বিরাণ এলাকা। এলাকাটিতে জনবসতি নেই বললেই চলে। অসংখ্য উঁচু নিচু টিলা, মাঠ ও কাঁটা ঝোপে পরিপূর্ণ এ মরুভুমির মাঝে ছোট ছোট মরুদ্যান। এ সব মরুদ্যানের পানির কোন অভাব ছিল না। রিজনেল্ট এমনি একটি মরুদ্যানের পাশে ক্যাম্প করলেন। অগ্রবাহিনীকে বললেন আরো এগিয়ে গিয়ে ক্যাম্প করতে। তার ডানের সৈন্য দলটি পরিকল্পনামাফিক বেশ পেছনে ও দূরে ছিল। তখন রাত দ্বি-প্রহর। রিজনেল্টের ক্যাম্পের সৈনিকরা ঘুমে বিভোর। হঠাত সেখানে শুরু হয়ে গেল কিয়ামতের বিভীষিকা। রজনেল্টের ঘুম ভেঙ্গে গেল সৈনিকদের চিৎকার ও চেঁচামেচিতে। ক্যাম্প জুড়ে কেন এত চিৎকার, চেঁচামেচি তিনি তার কিছুই বুঝতে পারলেন না। হঠাত এ কিয়ামত কোথেকে নাজিল হলো? আকাশ থেকে নামলো, নাকি তার সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছে? এমনি অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন তিনি।

রিজিনেল্ট কল্পনাও করতে পারেননি এত বড় বিশাল বাহিনী কারো দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মরুচারী বেদুঈনরা ছোটখাট কাফেলা আক্রমণ করে লুটপাট করে, তাদের পক্ষে সেনাবাহিনীর ওপর চড়াও হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। সুলতান আইয়ুবীর এখন আলেকজান্দ্রিয়ায় খৃস্টান নৌসেনাদের হাতে নাস্তানাবুদ হওয়ার কথা, নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাকে, তাহলে কে তাদের ওপর এমন ভয়ানক গজব নাজিল করলো?

কিন্তু তার জানা ছিল না, নূরুদ্দিন জঙ্গী কয়েকদিন আগে থেকেই তার সৈন্যদল নিয়ে জনবসতিহীন টিলার পিছনে, উঁচু নিচু মাঠের গভীরে এবং কাঁটা ঝোপের আড়ালে গোপন আস্তানা গেড়ে ওঁত পেতে বসেছিলেন। তাদের দৃষ্টি ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে আসা মরুভূমির পথের দিকে। নূরুদ্দিন জঙ্গী জানতেন, খৃস্টান বাহিনী পানির জন্য অবশ্যই কোন না কোন মরুদ্যানের পাশে ক্যাম্প করবে। সে জন্য তিনি মরুভূমিতে গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছিলেন। খৃস্টানদের অগ্রবর্তী সৈন্যদলটি দিনের বেলাতেই তাদের চোখের সামনে দিয়ে অগ্রসর হয়ে গেল। জঙ্গী তাদের মোকাবেলায় না নামায় জঙ্গীর কমান্ডাররা বেশ নিরাশ এবং দুঃখ পেয়েছিল। তাদের বলা হলো, ‘একটু অপেক্ষা করো। রাত নামুক, দেখবে এরচে বড় শিকার পাবে। রাতে আমরা তাদের ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালাবো।’

সেখানে কোন ক্যাম্প ছিল না। তাই কি করে জঙ্গী ক্যাম্পে আক্রমণ চালাবেন বুঝতে পারলো না অনেক সৈনিকই।

এক সময় তাদের চোখ অনেক দূরে ধূলিঝড় দেখতে পেল। তারা মনে করলো, মরুভূমিতে ঝড় শুরু হয়েছে। এ মরু ঝড় খুব মারাত্বক হয়ে থাকে। কিন্তু এটা কোন মরু ঝড় ছিল না, এ ছিল খৃস্টান বাহিনীর মধ্যবর্তী মূল সেনাদলের অশ্বখুরের উড়ন্ত ধূলি। তারা মরুদ্যানের কাছে এসে রাত্রী যাপনের জন্য থামলো। নূরুদ্দিন জঙ্গী গোপন অবস্থান থেকে সবই দেখলেন। খৃস্টান বাহিনী মামুলী ভঙ্গিতে তাবু টানালো, কারণ ভোরেই তাদের যাত্রা করতে হবে। পশুগুলোকে পৃথক স্থানে বেঁধে রাখলো। ধীরে ধীরে অস্তাচলে ডুবে গেল সূর্য।

মধ্য রাতে জঙ্গীর সৈন্যরা সালারের নির্দেশে গোপন আস্তানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। এদের সবাই ছিল অশ্বারোহী। ঘুমন্ত খৃস্টান সৈন্যদের ওখানে প্রথমে তারা অন্ধকারে এলোপাথাড়ী তীর বর্ষণ করলো। যখন পাহারারত সৈনিকরা আহত হয়ে ডাক- চিৎকার শুরু করলো, তখন ঘুমন্ত সৈন্যদের ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং তারা বাইরে এসেই তীরের আওতায় পড়ে গেল। তারা যখন ভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল তখন অশ্বারোহী বাহিনী তাদের ঘোড়া তীরবেগে ছুটিয়ে দিল সেই সৈনিকদের ওপর দিয়ে।

তারা অন্ধকারে এলোপাথাড়ি বর্শা ও তলোয়ার চালাতে লাগল। খৃস্টান সৈন্যরা সতর্ক হওয়ার আগেই অশ্বারোহীরা আর এক দফা আক্রমণ চালিয়ে খৃস্টান বাহিনীর বাঁধা ঘোড়াগুলোর রশি কেটে দিলো। ঘোড়াগুলো ছাড়া পেয়েই ছুটে পালালো মরুভূমির বিপু বিস্তারে।

রিজনেল্ট নিরুপায় হয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন এবং ডানের সেনাদলে গিয়ে পৌছলেন। এ দলটি বহু দূরে একস্থানে ক্যাম্প করে বিশ্রাম নিচ্ছিল। নূরুদ্দিন জঙ্গীও রিজনেল্টকে অনুসরণ করে সেখানে গিয়ে পৌছলেন। এই বাহিনীর পিছনেই ছিল সমস্ত রসদপত্র বোঝাই ঘোড়া ও খচ্চরের কাফেলা। এই কাফেলার বন্দোবস্ত করা জন্য নূরদ্দিন জঙ্গী আলাদা বাহিনী নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। তারা এখানে না থেমে এগিয়ে গেল সেদিকে। ভোরের আলো ফুটতেই রসদপত্রের কাফেলা নজরে পড়লো তাদের। বলম্ব না করে তারা ঝাপিয়ে পড়লো কাফেলার ওপর এবং সহজেই কব্জা করে নিলো সব রসদপত্র।

রিজনেল্ট পৌঁছতেই ডান দিকের বাহিনী সতর্ক হয়ে গেল। সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হলো তারা। রিজনেল্ট তাদেরকে নিয়ে ছুটলেন নিজের দলের দিকে। কারণ তিনি সেটাকেই যুদ্ধের ময়দান হিসেবে গণ্য করলেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই সেনাদল নিয়ে তিনি যাত্রা করলেন যেখানে আক্রান্ত হয়েছিলেন সেদিকে। নূরুদ্দিন জঙ্গী সৈন্য গুছিয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষ করতেই দেখলেন খৃস্টান সেনাদল যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। তিনি তাদের ওপর পিছন ও পাশ থেকে তীব্র আক্রমণ চালালেন। তারা বুঝতেই পারলো না, কোথেকে এবং কেমন করে তাদের ওপর এমন কঠিন মুসিবত নেমে এলো। সুলতান আইয়ুবীর মত সুলতান জঙ্গীও সামনাসামনি লড়াইয়ের ঝুঁকি না নিয়ে তাদের ওপর চোরাগুপ্তা হামলা চালালেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল তুফানের মত তাদের একদিক দিয়ে আক্রমণ করে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতো। ফলে খৃস্টান বাহিবীর অটুট শৃংখলা তছনছ হয়ে ভেঙ্গে পড়তো, ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতো খৃস্টানদের সাজানো সারি।

সেই রাতেই তিনি সুলতান আইয়ুবীর কাছে খবর পাঠালেন। কারণ এরা দুই সেনাপতি আগে থেকেই যুদ্ধের নীল-নকশা এঁকে রেখেছিলেন। জঙ্গীর প্রতিটি একশন পরিকল্পনা ছিল শত্রুর পরিকল্পনা ও চিন্তার বাইরে। তিনি তার প্ল্যান অনুসারেই যুদ্ধ চালাচ্ছিলেন। রিজনেল্ট তার নিজ বাহিনীর অগ্রবর্তী দলকে পিছনে সরে আসার সংবাদ পাঠালেন।

চারদিন ধরে রিজনেল্ট ও জঙ্গীর বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ চলতে থাকলো। সুলতান জঙ্গী খৃস্টান বাহিনীকে আক্রমণ করে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। তার পলিসিই ছিল ‘আক্রমণ কর! আর পালাও।’

খৃস্টান অগ্রবর্তী দল যখন  ফিরে এলো, তখন তাদের উপরও পিছন থেকে অতর্কিত আক্রমণ হলো। এই আক্রমণ চালালো সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী।

এই গেরিলা বাহিনী একই রাতে তাদের দু’তিনবার ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ঝড়ের বেগে এক দিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্য দিক দিয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। যাওয়ার আগে তছনছ করে দিয়ে গেল তাদের সাজানো দৃশ্যপট। এভাবেই যুদ্ধ চলতে থাকলো।

খৃস্টান বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধে পারদর্শী হলেও কমান্ডো হামলা প্রতিরোধে ছিল দুর্বল। তারা সামনাসামনি যুদ্ধ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী ও জঙ্গী তাদের এ আশা পূরণ করেননি।

গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি মোটেই সহজ ছিল না। একশ জনের একটি দল আক্রমণে গেলে দেখা যেত বিশ-ত্রিশ জনই শহীদ হয়ে গেছে। প্রতিটি আক্রমণেই শহীদের সংখ্যা অল্প-বিস্তর বাড়তো। এই গেরিলা যুদ্ধের জন্য বিশেষ দক্ষতা, সাহসিকতা, বীরত্ব ও ক্ষীপ্রতার প্রয়োজন হতো। যে গুনগুলোর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন সুলতান আইয়ুবী ও জঙ্গী তাঁদের কমান্ডো বাহিনীকে।

যুদ্ধ অনেক দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। খৃস্টান সৈনুওদের মাঝে শুরুতেই জঙ্গী যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছিল তা কাটিয়ে উঠে তারা আর পূনরায় আকতাবদ্ধ হতে পারেনি। তাদের সংখ্যা শক্তির আধিক্য না থাকলে অনেক আগেই তাদের পরাজয় বরণ করতে হতো। কিন্তু বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও সংখ্যাধিক্যের কারণে তারা লড়াই অব্যাহত রাখতে সমর্থ হলো।

খৃস্টানদের রসদপত্র নূরুদ্দিন জঙ্গীর কব্জায় এসে গিয়েছিল। ফলে রসদের সরবরাহ না পাওয়ায় খৃস্টানদের অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করলো। মুসলমানরা গেরিলা পদ্ধতিতে যে যুদ্ধ চালাচ্ছিল সে যুদ্ধের মোকাবেলা করার মত অবস্থাও তাদের ছিল না। ফলে যুদ্ধের গতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো, খৃস্টান সৈন্যরা ময়দান থেকে সটকে পড়ার চিন্তা করতে বাধ্য হলো।

চতুর্থ দিন থেকেই শুরু হলো এ পলায়নের পালা। যে-ই পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলো সে-ই পালিয়ে প্রাণ বাচাল নিজের। আর যে পালানোর সুযোগ পেল না, সে হাতিয়ার ফেলে আত্বসমর্পণ করলো প্রাণের মায়ায়। কিন্তু রিজনেল্ট সহজে পরাজয় স্বীকার করতে নারাজ। তিনি আত্বরক্ষামূলক লড়াই করে সৈন্যদের একত্রিত করার উদ্যেগ নিলেন। নিজের গোয়েন্দা মারফতই খবর নিলেন নূরুদ্দিন জঙ্গী এখন কোথায় আছেন। এভাবে আটঘাট বেঁধে তিনি জঙ্গীর ওপর এক সাড়াশী আক্রমণ চালালেন।

এ আক্রমণ ছিল যেমন মারাত্বক তেমনি অতর্কিত ও বেপরোয়া। খৃস্টানরা জীবন বাজি রেখে লড়াই শুরু করলো। রিজনেল্টের কৌশল এবং সৈন্যদের উপর তার দক্ষ নিয়ন্ত্রন আশাতীত ফল দিল তাদের। কিন্তু পঞ্চম রাতে জঙ্গী কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদকে নিয়ে জীবনকে বাজী রেখে স্বয়ং রিজনেল্টের তাবুতে অতর্কিত আক্রমণ চালালেন। এ আক্রমণ প্রতিরোধ করার সাধ্য ছিল না রিজনেল্টের। রিজনেল্ট বন্দী হলেন।

পরদিন ভোর। খৃস্টানদের সুঃসাহসী সেনাপ্রধান রিজনেল্ট বন্দী অবস্থায় ণুরুদ্দিন জঙ্গীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। সুলতান জঙ্গী তাঁকে শোনাচ্ছেন সন্ধির সব শর্ত।

সুলতান জঙ্গীর বলা শেষ হলে রিজনেল্ট বললেন, ‘আপনার সব শর্তই আমি মেনে নিতে রাজি। শুধু একটি শর্তের ব্যাপারে আমাকে ক্ষমা করবেন। বায়তুল মোকাদ্দাস সম্পর্কে কোন শর্ত মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

জঙ্গী বললেন, ‘বায়তুল মোকাদ্দাস আমাদের দিয়ে দাও, বিনিময়ে তোমরা সকলেই মুক্তি পাবে।’

সন্ধ্যা নাগাদ সুলতান আইয়ুবীও এসে গেলেন। রিজনেল্টকে সসম্মানে রাখা হয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী তার সঙ্গে করমর্দন ও আলিঙ্গন করলেন।

‘আপনি তো এক মহান সৈনিক?’ রিজনেল্ট সুলতান আইয়ুবীকে বললেন।

‘না। একথা বলুন, ইসলাম এক মহান ধর্ম। সৈনিক সেই মহান, যার ধর্ম মহান।’

‘মুহতারাম রিজনেল্ট আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, তার সামুদ্রিক নৌবহর কোথায়? তারা কি এখনো আসেনি? এ ব্যাপারে সঠিক উত্তর তুমিই দিতে পার। আমি তো সেখানে ছিলাম না।’ নূরুদ্দিন জঙ্গী সুলতান আইয়ুবীকে বললেন।

‘আপনার বিশাল নৌবহর খুব জাকজমকের সাথেই এসেছিল।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আপনার অনেক জাহাজ সাগরের অতল তলে আছে। আর যেগুলো ডুবে যায়নি, সেগুলোর পুড়ে যাওয়া কাঠামো সাগর জলে ভাসছে। আমি আপনার সৈন্যদের সমস্ত লাশ সসম্মানে দাফনের ব্যবস্থা করেছি। আর যারা বেচে আছে তারা এখনো আমার হেফাজতেই আছে।’

সুলতান আইয়ুবীর বর্ণনা শুনে রিজনেল্টের চোখে মুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠলো। কারণ এসব কথা কিছুতেই তার সঠিক মনে হচ্ছিল না। তিনি কিছুক্ষণ চুও করে থেকে বললেন, ‘যদি এসব সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, কেমন করে এমন অসম্ভব ঘটনা সম্ভব হলো?’

‘এই গোপন তথ্য সেদিন বলবো, যেদিন ফিলিস্তিন থেকে খৃস্টানদের শেষ সৈন্যটিও বিদায় নেবে।’ নূরুদ্দিন জঙ্গী বললেন, ‘আপনার এই পরাজয় আপনাদের শেষ পরাজয় নয়। কারণ আপনারা এখনো এ মাটি থেকে বিদায় নিতে রাজি নন।’

‘আমি আপনাকে আমাদের বিশাল এলাকা ডান করবো।’ রিজনেল্ট বললেন, ;আমাকে মুক্ত করে দিন। আমি যুদ্ধ নয়, চুক্তি করবো আপনার সাথে। এতে আপনার রাজ্য আরো প্রশস্ত হবে।’

‘আমাদের কোন রাজ্য প্রয়োজন নেই।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমরা শুধু আল্লাহর রাজ্য প্রতিষ্টা করতে চাই। যেখানে মানুষের মৌলিক মানবীয় অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। যেখানে নিরীহ, নিরন্ন, দুঃখী মানুষও পাবে সুন্দরভাবে বাঁচার গ্যারান্টি। সভ্যতা পাবে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠার নিশ্চয়তা। লাঞ্ছিত মানবতা ও বঞ্চিত পৃথিবী কল্যাণের স্পর্শে সজীব ও সুন্দর হিয়ে উঠবে।

আপনাদের উদ্দেশ্য ইসলামকে নিঃশ্চিহ্ন করা, কিন্তু তা মোটেই সম্ভব নয়। এ কাজে আপনারা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে দেখেছেন, নৌশক্তি পরীক্ষা করে দেখেছেন। যুবতী কন্যাদের আমাদের পেছনে লেলিয়া দিয়ে দেখেছেন, আমাদের জাতিকে বিশ্বাসঘাতক গাদ্দার বানিয়ে দেখেছেন। শত শত বছর ধরে আপনাদের এই যে সাধনা, এর মধ্য দিয়ে আপনারা কতটুকু সফলতা লাভ করেছেন?’

‘সুলতান, আমরা একেবারে বিফল হয়েছি এ কথা আপনি বলতে পারেন না। স্বরণ করুন, ইসলাম তো রোম সাগর পার হয়ে ইউরোপেও পৌছে ছিল! কিন্তু স্পেন থেকে ইসলাম কি পিছু সরেনি? রোম আপনাদের অধিকার থেকে কেন মুক্ত হলো? আর সুদান আপনাদের কেনইবা শত্রু হয়ে গেল? শুধু এই কারণে যে, আমরা ইসলামের রক্ষকদেরকে কিনে নিতে পেরেছি। আজও বহু মুসলিম এবং মুসলিম শাসক আমাদের অর্থ স্মপদের কেনা গোলাম। এসব রাজ্যে এখন শুধু মুসলমান পাবেন, কিন্তু ইসলাম পাবেন না। এটা কি আমাদের বিজয় নয়?’

‘আমরা সে সব জায়গায় আবার ইসলামকে জীবিত করব বন্ধু।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন।

‘আপনি অলীক স্বপ্ন দেখছেন সালাহউদ্দিন!’ রিজনেল্ট বললেন, ‘আপনারা দ’জন আর কতকাল বেঁচে থাকবেন? আর কতকাল যুদ্ধ চালানোর যোগ্য থাকবেন? আমি আপনাদের দু’জনকে কুর্নিশ করি এ জন্য যে, আপনারা দু’জনই ধর্মের নিঃস্বার্থ এবং যোগ্য খাদেম। আপনাদের মত নিঃস্বার্থ খাদেম হয়তো খুঁজলে আরো পাবেন আপনার জাতির মধ্যে কিন্তু যোগ্য খাদেম তেমন পাবেন না। বরং আপনাদের জাতির মধ্যে ধর্মকে নিলামে তোলার লোকের সংখ্যাই এখন বেশী। আর আমরা সেই নিলামের এক নম্বর খরিদদার।

যদি আপনি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে আপনার জাতিকে বিলাসিতা, লোভ ও আনন্দ-স্ফূর্তির স্বপ্নিল নেশা থেকে রক্ষা করতে পারতেন, তবে আমাদের সাথে আপনার যুদ্ধ করার প্রয়োজনই পড়তো না। আমর আপনাদের মোকাবেলায় একটি দিনও টিকতে পারতাম না। কিন্তু বন্ধু! আপনি তা কখনও পারবেন না। কারণ এ বিলাসিতা ও আনন্দ-স্ফূর্তির নেশায় কেবল সাধারণ মানুষই পড়েনি, সামর্থবান ব্যবসায়ী বা ধনিকশ্রেণীই পড়েনি, আলেম ওলামা এবং জাতির নেতা ও শাসক শ্রেণীও এই বিলাসিতায় ডুবে আছে।

এই বাস্তবতা থেকে আপনি দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে পারেন না। দূর্নীতিপরায়ন শাসক ও নেতৃত্বের মাধ্যমে যে পাপের সৃষ্টি হয়, সে পাপ জাতীয় প্রথা হিসেবে গণ্য হয়ে যায়। সমাজের মাথায় পচন ধরলে সে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড় পাপ। আমরা আপনার শাসন বিভাগে এই পাপের জাল বিস্তার করে চলেছি। আমি আপনাকে বলতে চাই, আপনি আমাকে হত্যা করুন বা আমার মত আরও কিছু খৃস্টান শাসককে হত্যা করুন, তারপরও ইসলাম শেষ হবেই। আমরা যে রোগের বিষ আপনার জাতির দেহে ঢুকিয়ে, সে বিষের ক্রিয়া ক্রমশ বাড়তেই থাকবে, কমবে না।’

তিনি এমন বাস্তবতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন যার সত্যতা নূরুদ্দিন জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবী অস্বীকার করতে পারছিলেন না। এ পর্যন্ত তাঁরা খৃস্টানদের ওপর যে বিরাট বিজয় লাভ করেছেন, যার ফলে এখন খৃস্টান বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড এবং বহু খৃস্টান সৈন্য তাদের যুদ্ধবন্দী, এর সবই সম্ভব হয়েছে মাত্র একজন গোয়েন্দার সঠিক তথ্যের কারণে, যিনি আক্রা থেকে এই আক্রমণের সংবাদ যথাসময়ে নিয়ে এসেছিলেন। সুলতান ভাবছিলেন, একজন গাদ্দারও তো মুসলমানদের জন্য এমনি বপদ ও দুর্দশার কারণ হতে পারে!

o

রিজনেল্ট ও অন্যান্য বন্দীদের সবাইকে নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাকে নিয়ে গেলেন। সুলতান আইয়ুবী তাঁদের বিদায় দিয়ে চলে এলেন কায়রো। তিনি চিন্তাও করতে পারেন নি, এরপর আর কখনও নূরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে তাঁর দেখা হবে না। তিনি এ আনন্দেই বিভোর ছিলেন, নূরুদ্দিন জঙ্গী রিজনেল্টের মত মূল্যবান কয়েদীর বিনিময় মূল্যবান এবং উপযুক্ত শর্ত দিয়েই করবেন।

নূরুদ্দিন জঙ্গীও তাঁর চিন্তায় কিছু পরিকল্পনা তৈরী করে রেখেছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। ১১৭৪ খৃস্টাব্দের মার্চের প্রথম দিকে সিরিয়ায় কঠিন ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পে সাতটি গ্রাম সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। রাজধানী দামেস্কেও অনেক ক্ষতি হয়। ঐতিহাসিকরা এই ভুমিকম্পকে ইতিহাসের সবচে বড় ভুমিকম্প বলে উল্লেখ করেছেন। এতে মুসলিম সালতানাতের প্রচুর ক্ষতি সাধিত হয়।

নূরুদ্দিন জঙ্গীর অন্তরে ছিল নিজের দেশ ও জাতির জন্য অপরিসীম ভালবাসা ও দরদ। ভূমিকম্পের খবর পেয়েই তিনি তাদের সাহায্যের জন্য ক্রাক থেকে দূর্গত এলাকায় চলে এলেন। তিনি তাঁর অনুপস্থিতিতে বন্দীদের ক্রাকে রাখা নিরাপদ মনে করলেন না। ফলে তিনি রিজনেল্ট ও অন্যান্য খৃস্টান বন্দীদেরকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলেন।

তিনি বন্দীদেরকে দামেস্কে রেখে দূর্গত এলাকার দিকে নজর দিলেন। দামেস্ক ও তার আশেপাশের অবস্থা তখন মোটেই ভাল ছিল না। দামেস্ক পৌছেই তিনি দূর্গত এলাকার জনগণকে দেখতে যান। তাদের দেখে তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। দুর্দশাগ্রস্থ লোকদের দুঃখে পীড়িত জঙ্গী রাজধানী থেকে দূরে সে সব গ্রামে ছুটে বেড়াতে লাগলেন। মন-প্রাণ দিয়ে লোকদের সাহায্য ও সেবা করতে লাগলেন তিনি। যেখানে রাত হতো সেখানেই তিনি রাত কাটাতেন। খাবারের দিকেও কোন খেয়াল ছিল না তাঁর। নিজের খাবার কে দিল আর কোথেকে এলো তা নিয়েও তাঁর কোন মাথাব্যাথা ছিল না।

এপ্রিলের শেষের দিকে তিনি দূর্গত এলাকার পুনর্বাসনে হাত দিলেন। এই ব্যস্ততার মাঝে হঠাত একদিন তিনি গলার ভেতর ব্যাথা অনুভব করলেন। ব্যাথা বাড়লে তিনি ডাক্তারকে দেখালেন। বললেন, ‘আমার গলার ভেতর কেন যেন ব্যথা করছে।’

ডাক্তার নানা রকম ঔষধপত্র দিল, কিন্তু গলার ব্যথা বেড়েই চললো তাঁর। হাকীম চিকিৎসায় কোন ত্রুটি করলেন না। কিন্তু রুগীর অবস্থা তবু দিন দিন খারেপের দিকেই এগিয়ে চললো। এক সময় কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেল তাঁর। ১১৭৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে গলা ব্যথায় ভুগতে ভুগতে তিনি চির নিদ্রায় ঢলে পড়লেন।

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, নূরুদ্দিন জঙ্গী কঠিন গলার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ দৃঢ়তার সাথে লিখেছেন, জঙ্গীকে হাসান বিন সাবার ফেদাইন গ্রুপের লোক বিষ প্রয়োগ করেছিল। বিষ প্রয়োগ ঠিক তখন করেছিল, যখন জঙ্গী দূর্গত মানুষের পাশে গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। তখন তার খাবার পরিবেশন ও রান্নায় যে অব্যবস্থা হয়েছিল তারই সুযোগ নিয়েছিল ফেদাইন দলের গুপ্তচরেরা। তারা এমন বিষ খাওয়াতে থাকে, যে বিষের ক্রিয়া শুরু হয় আস্তে আস্তে ও অনেক পরে। ডাক্তার এ বিষের ক্রিয়া বুঝতেই পারেননি। জেনারেল মুহাম্মদ আকবর খান তাঁর ইংরেজী বই ‘গেরিলা ওয়ার’- এ নামকরা বড় বড় ওইতিহাসিকের দলিল পেশ করে এ সত্যতা যাচাই করেছেন যে, নূরুদ্দিন জঙ্গী ফেদাইনদের বিষের শিকার হয়েছিলেন। সামান্য গলা ব্যথা তার মৃত্যুর কারণ হবে, জঙ্গী হয়তো এমনটি ভাবেননি। এজন্যই তিনি কোন অসিয়ত করে যাননি। সুলতান আইয়ুবীকেও তার অসুস্থতার খবর পাঠাননি। সুলতান আইয়ুবীর কাছে তখন এ সংবাদ পৌছে, যখন জঙ্গীর দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে।

এ খবর পাওয়ার কয়েকদিন পর।

দামেস্ক থেকে আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা এসে কায়রো পৌঁছলো। আইয়ুবীর সঙ্গে দেখা করে জানালো, ‘মুসাল ও হলবের গভর্নররা নিজেদেরকে স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। দামেস্কের আমীর ওমরাহ্‌, উজির নাজিররা নূরুদ্দিন জঙ্গীর পুত্র আলমালেকুছ ছালেহ, যার বয়স সবেমাত্র এগারো, তাকেই ইসলামী সাম্রাজ্যের খলিফা নিযুক্ত করেছে।’

সুলতান আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানকে ডাকলেন। তাঁকে বললেন, ‘তুমি পাঁচ মাস আগে জানালে যে আক্রাতে আপনার এক গোয়েন্দা শহীদ হয়েছে, আর অপরজন গ্রেফতার হয়েছে, কেবল তাদের দলনেতা ফিরে আসতে পেরেছে, তখনই আমার মনে হয়েছিল, এই বছরটা ইসলামী জগতের জন্য হবে অমঙ্গল ও কঠিন পরীক্ষার বছর। এই পরীক্ষা দিতে হবে বিভিন্ন সেক্টরে ও বিভিন্ন ভঙ্গিতে। এখন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। সেই পরীক্ষার এক ভয়ংকর লগ্ন আমার সামনে উপস্থিত। আমাকে এখন আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নামতে হবে।’

o

সুলতান আইয়ুবী তাঁর সভাসদদের বৈঠক ডাকলেন। নূরুদ্দিন জঙ্গীর অনুপস্থিতিতে ইসলামীসাম্রাজ্যে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে কিভাবে তার মোকাবেলা করা যায় তাই এ বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয়। এ সময় এক খাদেম এসে সুলতানকে জানাল, ‘দামেস্ক থেকে নূরুদ্দিন জঙ্গীর বেগম এক কাসেদ পাঠিয়েছেন। কাসেদ আপনার জন্য বেগম জঙ্গীর চিঠি নিয়ে এসেছে। সে বলছে, ‘এ চিঠি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনি তা সুলতানের কাছে পেশ করা জরুরী।’

আইয়ুবী বললেন, ‘এখুনি আমি এ সভা মুলতবী করে দিচ্ছি। দরবারীরা বের হলেই ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দিও।’

এর কিছুক্ষণ পর। কাসেদ ভেতরে ঢুকে আদবের সাথে সালাম করে সুলতানের কাছে বেগম জঙ্গীর চিঠি পেশ করলো। চিঠিতে তিনি সুলতান আইয়ুবীকে বলে পাঠিয়েছেন, ‘সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর প্রিয়তম দোস্ত ও সাথী সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী! এখন ইসলামের সম্মান, ইজ্জত ও আবরু আপনার হাতে নির্ভর করছে। আপনি হয়তো জানেন, আমার শিশু সন্তানকে ইসলামী খেলাফতের খলিফা নিযুক্ত করা হয়েছে। সকলেই আমাকে সম্মান ও আনুগত্য দেখাতে শুরু করেছে। কারণ এখন আমি শিশু খলিফার মা। তারা মনে করছে, আমি ভাগ্যবতী মা কিন্তু আমার হ্রদয়ের রক্ত অশ্রু ঝরছে। তারা আমার সন্তানকে খলিফা নিয়োগ করেনি বরং আমার বুক থেকে আমার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে।

মুসালের আমীর ও অন্যান্য আমীররা আমার শিশু সন্তানকে ঘিরে রেখেছে। আমার স্বামীর ভাতিজারাও স্বাধীন শাসক হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিয়েছে। যদি আমার সন্তানকে ঘিরে রাখা আমীরদের মাঝে ইসলামের প্রতি মহব্বত, একতা ও সহনশীলতা থাকতো তবে আমি এতটা পেরেশান হতাম না। এরা একে অপরের দুশমন হয়ে গেছে। এসব আমীরদের কারো কাছ থেকেই আমি কোন মঙ্গলের আশা করতে পারি না।

যদি আপনি মনে করেন আমার সন্তানকে খুন করলে মিল্লাতের উপকার হবে, দ্বীনের তরক্কী হবে, তবে আমি নিজ হাতে আমার সন্তানকে খুন করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমীররা তাকে বলীর পাঠা বানিয়ে নিজেদের আখের গুছাতে চাচ্ছে। তার এ কোরবানী ইসলামী সালতানাত বা মীল্লাতের কোনই কাজে আসবে না। কিন্তু আমার শিশুপুত্র অসহায় ও দুর্বল। ধুরন্ধুর আমীরদের কুটিল জাল ভেদ করে বেরিয়ে আসার সাধ্য তার নেই। তাই আমি এক কঠিন পরিণামের ভয় করছি। আপনার কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, মেহেরবানী করে যত দ্রুত সম্ভব আপনি দামেস্কে চলে আসুন।

সুলতা আইয়ুবী, আপনিই ভাল বুঝবেন, আপনি কিভাবে আসবেন এবং এখানে আসার পর আপনার ভূমিকা কি হবে। আমি শুধু আপনাকে সতর্ক করে দিতে চাই, যদি আপনি এ ব্যাপারে গুরুত্ব না দেন অথবা সময় নষ্ট করেন তবে খৃস্টানরা বায়তুল মোকাদ্দাসের ওপর তো তাদের আধিপত্য বিস্তার করেই আছে, পবিত্র কাবা শরীফেও তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

আমি আপনার কাছে জানতে চাই, তবে কি লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত ব্যর্থ হয়ে যাবে? যারা নূরুদ্দিন জঙ্গী ও আপনার নেতৃত্বে জীবন কোরবানী দিয়েছেন তাদের সে কোরবানী কি বিফলে যাবে? আপনি হয়ত আমাকে প্রশ্ন করবেন, আমি কেন আমার সন্তানকে আমার প্রভাবে রাখতে পারছি না? আমি সে উত্তর প্রথমেই দিয়েছি। আমার সন্তানকে ওমরারা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। তার পিতার মৃত্যুর পর সে মাত্র একবার আমার কাছে আসার যুযোগ পেয়েছিল। এখন তাকে আমার সন্তান বলে মনেই হয় না। আমার ধারণা, তাকে হাশিশ সেবন করিয়ে রাখা হচ্ছে, অথবা সে ওমরাদের কাছে নজরবন্দী আছে। সে হয়তো ভুলেই গেছে, আমি তার মা!

ভাই সালাহউদ্দিন, তুমি জলদি চলে এসো। ইসলামের প্রতি মহব্বত রাখে এমন হাজারো লোক এখনো দামেস্কে আছে। দামেস্কের এই লোকেরা তোমাকে স্বাগতম জানাবে। ভাই আমার! সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করো না। তুমি আমার কাসেদের কাছেই বলে দিও, তুমি কি করবে অথবা কিছুই করতে পারবে না।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top