১৬. টার্গেট ফিলিস্তিন

উমরু দরবেশ, আশী ও দুই কমান্ডো পাহাড়ী অঞ্চল ছেড়ে অনেক দূর চলে এসেছে। তারা যাচ্ছে সুদানের রাজধানী খার্তুমের দিকে। তখনো তীব্র গতিতে ছুটছে তাদের ঘোড়া। উমরু দরবেশ ঘোড়ার গতি না কমিয়ে সেই ছুটন্ত অবস্থাতেই সহযাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আমাদের খুব জলদি সেখানে পৌছতে হবে। আশী! তুমি ক্লান্ত বোধ করলে আমার পিছনে এসে বসতে পারো! কারণ অল্প সময়ে আমি দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিতে চাই। ওদের কোন গোয়েন্দা আমাদের আগেই সেখানে পৌঁছে যাক, তা আমি চাই না। এমন কিছু ঘটে গেলে তার যে খেসারত দিতে হবে, তা আমি সইতে পারবো না’।

উমরু দরবেশের এ আশঙ্কা অমূলক ছিল না। সুদানের এক গোয়েন্দা তখন রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাচ্ছিল সুদানের রাজধানী খার্তুমের দিকে। চোখের সামনে সঙ্গীদের সবাই ধরা পড়ে যেতে দেখে জনতার ভীড় থেকে এই গোয়েন্দা এক পা, এক পা করে নিরাপদ দূরত্বে সরে এসেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল। আলী বিন সুফিয়ানের লোকেরা টের পেয়ে তাকে ধাওয়া করেছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের ধোঁকা দিয়ে কৌশলে যে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

যখন সে বুঝতে পারলো, ধাওয়াকারীদের এ যাত্রা খসাতে পেরেছে, তখনি তার মনে চিন্তা জাগলো, ওরা জানে আমি খার্তুম যাবো। সাবধান করবো সুদান সরকারকে। ফলে খার্তুম পৌঁছার আগ পর্যন্ত ওরা আমাকে ধাওয়া করবে। এ কথা মনে হতেই সে খার্তুমের পথ ছেড়ে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল ঘোড়ার মুখ। উদ্দেশ্য, ধাওয়াকারীদের চোখে ধূলো দিয়ে ঘুর পথে খার্তুমের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

অনেক পথ ঘুরে খার্তুমের পথ ধরায় সে যে উমরু দরবেশের দল থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এ তথ্য তার জানা ছিল না। জানা ছিল না, ভিন্ন এক মিশন নিয়ে আশী এবং উমরু দরবেশও ছুটে চলেছে খার্তুমের পথে।

ছুটে চলেছে সুদানী গোয়েন্দা। সঙ্গীবিহীন একাকী পথ চলছে সে। মনের ভেতর তোলপাড় করছে কত কথা! গতকাল উমরু দরবেশের অভিনয় দেখে ভাবছিল, মিশন শুধু সফলই নয়, আশাতীত সাফল্যের খবর দিতে পারবে সে সুদানী সরকারকে। বলবে, শুধু পাহাড়ী অঞ্চল নয়, সারা দেশেই উমরু দরবেশের এ ভেলকিবাজী দেখানো উচিত। অথচ কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এখন সে খার্তুমই যাচ্ছে, কিন্তু সাফল্যের পরিবর্তে তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে নিজেদের শোচনীয় ব্যর্থতার খবর। তাদের গোপন রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে এ সংবাদ সে কোন্‌ মুখে শোনাবে সরকারকে! এ সংবাদ পেয়ে সরকার বাহাদুর কেমন ব্যবহার করবে তার সাথে!

পথ চলছে সুদানী গোয়েন্দা। তার সব ক্ষোভ ও রাগ গিয়ে পড়লো আশীর ওপর। নিশ্চয়ই এ বিপর্যয়ের পেছনে উমরু দরবেশের ষড়যন্ত্র ও ইন্ধন রয়েছে। উমরু দরবেশকে বিশ্বাস করা যায় না বলেই তো আশীকে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ মেয়ে কি এতই আনাড়ী যে, সে এ ষড়যন্ত্রের কিছুই টের পেলো না! নাকি আশী নিজেও জড়িয়ে পড়েছে এ ষড়যন্ত্রের সাথে! সে সিদ্ধান্ত নিল, উমরু দরবেশ এবং আশীর ব্যাপারে তার সন্দেহের কথাও সে সরকারকে জানাবে।

একই ঘটনার জের ধরে খার্তুম ছুটে যাচ্ছে দুই ভিন্ন কাফেলা। একদল ভাবছে, সেনাপতিকে মিথ্যা সংবাদ জানিয়ে ইসহাককে তারা মুক্ত করবে, পারলে সুদানের কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনবে তাদের সহযোগী বন্ধুদের। অন্যজন ভাবছে, একবার খার্তুম পৌঁছে নেই, উমরু দরবেশ ও আশীকে কারাগারের ভাত না খাইয়ে ছাড়ছি না এবার।

আল্লাহর জ্যোতির রহস্য দেখার অদম্য আগ্রহ মানুষের চোখেমুখে খেলা করছিল। আলী বিন সুফিয়ানের পেছন পেছন দল বেঁধে মশালের আলোতে পাহাড় চূড়ায় উঠছিল লোকগুলো। আলী বিন সুফিয়ানের সাথে তাঁর কমান্ডো এবং সেই ইমাম সাহেবও ছিলেন, যিনি উমরু দরবেশের কাহিনী শুনিয়েছিলেন তাঁকে।

পাহাড়ের চূড়ায় আলীর কমান্ডোরা দুই গোয়েন্দাকে বেঁধে অপেক্ষা করছিল। মশাল নিয়ে লোকজনকে উপরে আসতে দেখলো তারা। এক কমান্ডো নিজের হাতের মশাল উঁচু করে ধরলো, যাতে লোকেরা তাদের দেখতে পায়। ঘটনার‍ আকস্মিকতায় ধৃত দুই গোয়েন্দা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। প্রথমে ভেবেছিল, তারা ভূতের পাল্লায় পড়েছে। কিন্তু লোকজনকে পাহাড়ে চড়তে দেখেই হুশ হলো তাদের। একজন আলীর কমান্ডোদের বললো, ‘আমাদের সাথে চলো। তোমরা যা চাবে তাই দেব। দয়া করে আমাদের ছেড়ে দাও’। ‘তোমরা কি সব মুসলমানকেই গাদ্দার মনে করো? চাইলেই যে কারো ঈমান কিনে নেয়া যায়, দুনিয়া এতই সহজ!’ উত্তরে বললো এক কমান্ডো।

‘দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও দোজখের আগুনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তোমরা নিজের জাতিকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিলে। প্রতারণার জাল বিছিয়ে ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছিলে নিজের ভাই-বেরাদার ও কওমকে। আগে এর বদলা উশুল করি, তারপর তোমাদের আবেদন বিবেচনা করা যাবে’। বললো অপর কমান্ডো।

‘ঐ যে,ওরা আসছে!’ এক গোয়েন্দা ভয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘লোকজন আমাদেরকে হাতের নাগালে পেলে পাথর মেরেই হত্যা করে ফেলবে। আমাদের ওপর রহম করো। মৃত্যু বড় কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক। আমাদের বাঁচাও, বিনিময়ে তোমরা যা চাও তাই দেবো। বলো তো, সারা জনম গোলাম হয়ে থাকবো তোমাদের, তবু আমাদের বাঁচাও! আমাদের কাছে অনেক সোনা-দানা আছে, আমাদেরকে ওপাশ দিয়ে নিচে নিয়ে চলো, সব তোমাদের দিয়ে দেবো’।

মশাল যত উপরে উঠছিল, দুই বন্দীর আতংক ও অস্থিরতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। বন্দীদের সব অনুনয় বিনয় বিফলে গেলে শেষে একজন বললো, ‘তাহলে অন্তত এটুকু দয়া করো, তোমাদের কাছে তলোয়ার আছে, সেই তলোয়ার দিয়ে আমাদের গর্দান উড়িয়ে দাও, তবু আমাদেরকে জনতার আক্রোশ থেকে বাঁচাও’।

‘জনতার আক্রোশ থেকে নয়, আল্লাহর আক্রোশ থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করো। যে পাপ ও অপরাধ তোমরা করেছো, আল্লাহ তোমাদের কি কঠিন শাস্তি দেবেন, সেই চিন্তা করো আগে’।

মশাল নিয়ে জনতা তাদের কাছে এসে থামলো। আলী বিন সুফিয়ান কমান্ডোদের এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দিলেন, যাতে জনতা ওদেরকে হাতের নাগালের মধ্য না পায়। লোকজন ওদের চার পাশ ঘিরে দাঁড়ালো। বন্দী দু’জন দুই হাটুর ফাঁকে এমনভাবে মুখ লুকালো, যেন কেউ ওদের মুখ দেখতে না পায়। ভীড় বেশী দেখে আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘হাত ধরাধরি করে সবাই আরো পেছনে সরে যাও, ঘেরাও আরো বড় করো, যাতে সবাই দেখতে পারে’।

কমান্ডোরা জনতার ভীড়কে আরো পেছনে ঠেলে দিল। এরপর এক কমান্ডার হাতের মশাল বন্দীদের সামনে দুই পাথরের ফাঁকে আটকে দিয়ে এসে দাঁড়াল দুই বন্দীর পেছনে। দুই হাতে মাথার চুল ধরে ঝটকা টানে জনতার সামনে উন্মুক্ত করে দিল তাদের চেহারা। জনগণ লোক দু’জনকে দেখে খুবই বিস্মিত হলো, কারণ তারা দু’জনই এ এলাকার লোক। ‘এই সেই তুরের তাজাল্লি দেখানোর লোক’। আলী বিন সুফিয়ান লোকদের বুঝিয়ে বললেন, ‘এরা কিভাবে সেই জ্যোতি তৈরী করতো এখন নিজেরাই তা তোমাদের করে দেখাবে’।

তাঁর হাতের ইশারায় কমান্ডোরা দুই বন্দীকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। বললো, ‘জনতার আক্রোশ থেকে বাঁচতে চাইলে যা বলছি জলদি করো। নইলে তোমাদেরকে জনতার হাতে ছেড়ে দিতে আমরা বাধ্য হবো। আর যদি আমাদের কথা মত কাজ করো, তাহলে তাদের আক্রোশ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবো আমরা’।

ওরা পাথরের ওপর ওদের ঢেলে দেয়া পেট্রোলের দিকে তাকালো। এখনো তা শুকিয়ে যায়নি। কাছেই পড়ে আছে সেই পাত্রটি, যেটিতে রাখা ছিল সেই তেল।

তাদের একজন এগিয়ে সেই তেলের ওপর মশাল ছোঁয়াতেই দপ করে জ্বলে উঠল আগুন।

আলী বিন সুফিয়ান পাত্রটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘এই পাত্রে সেই জ্বালানি তেল ভর্তি ছিল, যে তেল আমি আগে কাপড়ে ঢেলে দেখিয়েছি। সেই তেল এখানে ঢেলে দেয়া হয়েছে। আমি আমার চারজন লোককে সন্ধ্যার আগেই এখানে গোপনে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারা এখানে এসে লুকিয়ে থাকায় উমরু দরবেশের এ লোকেরা ওদের দেখতে পায়নি। গতকালের মতই এরা অপেক্ষা করছিল, কখন উমরু দরবেশ মশাল উঁচিয়ে ইশারা করবে। উমরু দরবেশের ইশারা পেলেই এরা পাথরের ওপর ঢেলে রাখা এই তেলের আগুন ধরিয়ে দিত। আর তোমরা সেই আলোকে তুরের তাজাল্লি মনে করে বিভ্রান্ত হয়ে বাড়ী ফিরে যেতে। কিন্তু আজ আমার লোকেরা আগুন লাগানোর আগেই এদের বেঁধে ফেলায় উমরু দরবেশ বার বার মশাল নাড়ার পরও পাহাড়ের চূড়ায় তোমরা কোন আলো দেখতে পাওনি’।

‘এরা ছিল তিনজন’। এক কমান্ডো বললো, ‘এদের অন্য একজন আমাদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে এসে নিহত হয়, তার লাশ গাছের নিচে পড়ে আছে’।

আলী বিন সুফিয়ানের ইশারায় নিহত লোকের লাশও সেখানে টেনে নিয়ে এলো কমান্ডোরা। আলী বিন সুফিয়ান ধৃত গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা এ জনপদের মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার মিশন নিয়ে সুদানের কাফের সরকারের পক্ষ থেকে এখানে কাজ করছিলে, একথা অস্বীকার করতে পারবে? বলো, আমি কি মিথ্যা বলছি?’

‘আমাকে ক্ষমা করুন!’ একজন ভীত কম্পিত স্বরে বললো, ‘আপনি যা বলেছেন তা বিলকুল সত্যি’।

‘তোমরা কি এ এলাকার মুসলমান নও?’

‘হ্যাঁ!’ দু’জনই মাথা নত করে সম্মতি জানালো।

‘খৃস্টান ও সুদানী কাফেররা কি তোমাদেরকে এ কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়নি?’

‘হ্যাঁ, তারাই দিয়েছে!’

‘আর তোমরা তোমাদের জাতিকে ধোঁকা দিয়ে এবং নিজের ধর্মকে ধ্বংস করে তাদের কাছ থেকে ভাতা ও পুরস্কার নাও?’

‘হ্যাঁ। আমরা এর বিনিময়ে পুরস্কার ও ভাতা পেয়ে থাকি’।

একজন উত্তর দিল, ‘তবে আজ থেকে তওবা করছি, জীবনে আর কখনো এমনটি করবো না। আপনি দয়া করে এবারের মত আমাদের ক্ষমা করে দিন’।

অপর জন বললো, ‘আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমরা ওয়াদা করছি, এরপর থেকে জাতির জন্য, ধর্মের জন্য আমরা আমাদের জীবনকে বিলিয়ে দেবো’।

এ সময় অকস্মাৎ এক ব্যক্তি জনতার ভিতর থেকে ছুটে এসে তলোয়ারের আঘাতে দুই বেঈমানের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিৎকার করে উঠল, ‘বেঈমান, এখনো ভন্ডামী!’ এরপর তলোয়ার আলীর পায়ের কাছে রেখে দিয়ে বললো, ‘যদি আমি অপরাধী হয়ে থাকি, যদি সবার কাছে আমি খুনী হয়ে থাকি, তবে এ তলোয়ার দিয়েই আমাকে হত্যা করা হোক’।

গাদ্দারদের মাথা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল, আলীর পায়ের কাছে পড়ে ছিল লোকটির রক্তাক্ত তলোয়ার, আলী তাকালেন ইমাম সাহেবের দিকে।

ইমাম সাহের ভরাট ও দরাজ কন্ঠে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, এ লোক খুনী নয়। এই হত্যা শরিয়তে জায়েজ!’

আলী বিন সুফিয়ান এবার উপস্থিত লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখনও কি কারো মনে কোন প্রকার সন্দেহ আছে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করার নাম করে এরা তোমাদের ঈমানকে ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছিল?’ সমস্বরে সবাই বললো, ‘না। আল্লাহর হাজার শোকর যে, আপনি সময় মত এসে আমাদেরকে গোমরাহীর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন’।

ভোর রাত। এক স্থানে ঘোড়া থামালেন উমরু দরবেশ। আলী এবং কমান্ডোদের বললো, ‘খানিক বিশ্রাম নিয়ে নাও। ঘোড়াগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, ওদেরও একটু বিশ্রাম প্রয়োজন’।

রাজধানীর পথে ছুটে চলা সুদানী  গোয়েন্দা মধ্য রাত পর্যন্ত একটানা পথ চললো। শেষে ঘুম আর ক্লান্তির কাছে পরাজিত হয়ে এক জায়গায় থেমে গেল বিশ্রামের জন্য। তাবু টানিয়ে শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। এ গোয়েন্দার তো আর জানা ছিল না, উমরু দরবেশ তার আগেই সদলবলে যাত্রা করেছে রাজধানী খার্তুমের দিকে। জানা থাকলে এমন বিশ্রামের কথা হয়তো সে চিন্তাও করতো না।

ফজরের নামাজ পর্যন্ত বিশ্রাম নিল উমরু দরবেশের দল। সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই কাফেলা নিয়ে তিনি আবার যাত্রা শুরু করলেন। উমরু দরবেশ ছিলেন একজন জাত সৈনিক। কমান্ডোরাও তাই। ফলে দুর্গম পথের কষ্ট সহ্য করা তাদের জন্য নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু আশী মেয়ে মানুষ। তার ওপর নবীন বয়স। প্রতিপালিত হয়েছে শাহী মহলের আদর সোহাগ ও বিলাসিতায়। যদিও কষ্ট সহ্যের ট্রেনিং ছিল কিন্তু তা কেবল ট্রেনিং পর্যন্তই, কোন দিন তার মুখোমুখি হতে হয়নি।

বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে কাফেলা। রোদের উত্তাপ গায়ে এসে কামড় বসাতে শুরু করেছে, আশীর দিকে তাকালেন উমরু দরবেশ। তার চেহারায় রাত জাগার ক্লান্তি,মুখটা মলিন। মেয়েটির এ বিমর্ষ রূপ দেখে মায়া হলো উমরু দরবেশের। বললো, ‘আশী! তোমার সুন্দর  মুখখানা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে’।

‘এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়িনি তো!’ আশীর সংক্ষিপ্ত জবাব।

‘তাছাড়া, তোমার তো রাত জাগার অভ্যাস নেই, তাই দু’চোখে লেগে আছে ক্লান্তি ও ঘুমের ঘোর। এক কাজ করো, তুমি চলে এসো আমার ঘোড়ার পিঠে, তাতে কষ্ট একটু লাঘব হবে’। আশী একটু হাসলো, কিন্তু মুখে কিছু বললো না।

একটু পর। আশীর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছিল। ঘুমিয়ে পড়লে ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে পারে। উমরু দরবেশ আবারও বললো, ‘আশী! তোমার ঘোড়া ছেড়ে চলে আসো। আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো, তাহলে পড়বে না ঘোড়া থেকে’।

আশী এবারও হাসলো, ম্লান হাসি। কিছু দূর গিয়ে এক কমান্ডো উমরু দরবেশকে বললো, ‘মেয়েটা তো পড়ে যাবে!’

উমরু দরবেশ নিজের ঘোড়া নিয়ে গেলেন আশীর ঘোড়ার পাশে এবং লাগাম টেনে ধরে থামিয়ে দিলেন তার ঘোড়া। আশী জেগে উঠলো। উমরু দরবেশ বললো, ‘আমার সামনে এসে বসো’। ‘আমি কারো সাহায্য চাই না’। আশী বললো, ‘আমিই বরং সাহায্য করবো তোমাদের। আমাকে আমার অঙ্গীকার পূরণ করতে দাও। আমার মা-বাবার হত্যা ও আমার মান সম্ভ্রম নষ্টের প্রতিশোধ নিতে হবে আমাকে। আমি জেগে থাকার চেষ্টা করছি’।

ঘোড়া আবার চলতে লাগলো। কিছু দূর গিয়ে এক সময় আশী ঠিকই ঘুমিয়ে পড়লো। উমরু দরবেশ পাশেই ছিলেন, নইলে মাটিতে পড়ে যেত আশী।

তিনি ঘোড়া থামিয়ে আশীকে কিছু না বলেই তার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের ঘোড়ার সামনে বসিয়ে দিলেন। এক কমান্ডো তার ঘোড়ার জ্বীনের সাথে আশীর ঘোড়া বেঁধে নিল। আবার  যাত্রা করলো কাফেলা।

ঘোড়া ছুটছে পূর্ণ গতিতে। আশী এবার আর ঘুমকে তাড়াতে চেষ্টা করলো না। সে মাথাটি আস্তে করে উমরু দরবেশের বুকে ঠেকিয়ে গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়লো।

আশীর খোলা চুল উমরু দরবেশের চোখে মুখে আঘাত হানছিল। দেহ ও চুলের ঘ্রাণ আছড়ে পড়ছিল তার নাসারন্ধ্রে। কিন্তু এমন চুল ও দেহের পরশ তাঁর মনের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি, যেমন এক যুবতী ও যুবকের মনে প্রভাব  ও ক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাঁর মনে আশীর সেই কথা গুলো বাজতে লাগলো, ‘তোমার কোলে বসে আমার ছোট বেলায় বাবার কোলে বসার আনন্দ ও নিরাপত্তার কথা মনে পড়ছে। আজ যেমন তুমি আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আগলে রেখেছিলে, সেদিনও আমার বাবা আমাকে এমনিভাবে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে চেপে রেখেছিল’।

আশী কিছুদিন আগে যখন এ পথে পাহাড়ী অঞ্চলে যাচ্ছিল তখন মরুভূমিতে রাতে নেকড়ে বাঘের ডাক শুনে ভয়ে উমরু দরবেশের বুকে লাফিয়ে পড়ে এ কথা বলেছিল। উমরু দরবেশের মনে এখন সে কথাগুলোই নীরবে বার বার ভেসে উঠছিল। উমরু দরবেশের মনে হলো, সে তাকে আরো বলছে, ‘উমরু দরবেশ! আমি মুসলমানের মেয়ে, আমাকে আর খৃস্টানদের হাতে তুলে দিও না। আমার চোখের সামনে রক্ত! রক্ত! রক্ত! সে রক্ত আমার বাবার! সে রক্ত আমার মায়ের! বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্র মাটিতে মিশে আছে সে রক্ত। উমরু দরবেশ! তোমার শিরাতে কি হাশেম দরবেশের রক্ত বইছে না? তাহলে তোমাকে সে রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হবে, যে রক্ত বাইতুল মুকাদ্দাসের মাটি একদিন চুষে নিয়েছিল আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। তোমাকে ফিলিস্তিনের সম্মান ও সম্ভ্রম ডেকে বলছে,

হে আল্লাহর বান্দা! হে আখেরী নবীর খোশ-নসীব উম্মত! তোমাদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে মন থেকে মুছে ফেলো না! জীবন তো কল্যাণের পথে ব্যয় করার জন্যই! সেই প্রথম কেবলাকে নাপাক দুশমনের হাত থেকে উদ্ধার করো। ওরে হাশিম দরবেশের বেটা! এ কাজে তুমি যদি এগিয়ে না যাও তবে মরেও যে তুমি শান্তি পাবে না!’

উমরু দরবেশের ঘোড়ার গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। কমান্ডোরাও গতি বাড়ালো তাদের ঘোড়ার। বাতাসের বেগে ছুটছে ঘোড়াগুলো। এক কমান্ডো তার ঘোড়া নিয়ে গেল উমরু দরবেশের কাছে। বললো, ‘উমরু দরবেশ! সামনে কোন ফাঁড়ি থেকে ঘোড়া বদলানোর যদি সুযোগ থাকে তবে কিছু বলতে চাই না। আর যদি তা সম্ভব না হয় তবে ঘোড়াগুলোকে এভাবে শেষ করা উচিৎ হবে না! বলি কি! দয়া করে একটু আস্তে চালান!’

উমরু দরবেশ কমান্ডোর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ঘোড়ার গতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনলেন। বললো, ‘আল্লাহ জাল্লে শানুহু আমাদের সঙ্গে আছেন। ঘোড়া ক্লান্ত হবে না’।

তাদের কথার শব্দ এবং গতিতে ছন্দপতন ঘটায় আশীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে ভীত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম!’

‘ভালই ঘুমিয়েছো!’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আরো ঘুমুবে?’

‘না, আর কোন ঘুমের প্রয়োজন নেই আমার। তোমার স্পর্শ আবার আমার মনে নতুন করে ঈমানী জোশ পয়দা করে দিয়েছে। এখন আমি আগেই চাইতেও তীব্র গতীতে ছুটতে পারবো’।

‘তাহলে যাও! নিজের ঘোড়ায় আরোহণ করো। ইনশাআল্লাহ সন্ধ্যা নাগাদ আমরা পৌছে যেতে পারবো’।

আলী বিন সুফিয়ান সেই গ্রামে গেলেন, যে গ্রামে উমরু দরবেশ প্রথম রাতে কেরামতি দেখিয়ে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করেছিল। তিনি তার কমান্ডো বাহিনীকে দায়িত্ব দিলেন, তারা যেন সমস্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং উমরু দরবেশের ভিলকিভাজীর মুখোশ উন্মোচন করে আসল তথ্য জনগনকে অবহিত করে। গোয়েন্দা বাহিনী গ্রামের সাধারণ মানুষের পোশাকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং উমরু দরবেশের ভন্ডামী ধরা পড়ার কাহিনী লোকজনকে বলে বেড়াতে লাগলো। ইমাম সাহেব তার মসুল্লীদের সামনে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে উজ্জীবিত করে তোললেন মুসল্লীদের। তিনি বললেন, ‘সুদানীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তোমাদের প্রস্তুত ও সতর্ক থাকতে হবে। সামরিক অভিযানে ব্যর্থ হয়ে ওরা এখানকার মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। আমাদের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারো নেই। আমরা এ পাহাড়ী অঞ্চলকে স্বাধীন মুসলিম রাজ্য মনে করি। এখানে দীর্ঘকাল ধরে যে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শাসন চালু আছে তাই বহাল থাকবে। যদি এখানে নতুন করে কোন গাদ্দার ও গোয়েন্দা পয়দা হয়, তাহলে তাদের করুণ ও দুঃখজনক পরিণতির জন্য তারা নিজেরাই দায়ী থাকবে’।

আলী বিন সুফিয়ান বিরাট ঝুঁকি নিয়ে এ অঞ্চলে পা দিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে এবং তাঁর বিচক্ষণ ও সাহসী পদক্ষেপের ফলে অল্পতেই এ ষড়যন্ত্রের মূল উৎপাটিত হয়েছে। আলী বিন সুফিয়ান এবার তার কমান্ডো বাহিনীকে দু’ভাগে বিভক্ত করলেন।

সুদানের কারাগার থেকে মুক্ত করে ইসহাককে একটি সুন্দর বাড়ীতে রাখা হয়েছিল। তাঁকে সেখানে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হতো। তার সেবাযত্নের জন্য ছিল পর্যাপ্ত দাসদাসী। লোকজন তাকে যথেষ্ট সম্মান ও সমীহ করতো। নির্যাতন তো দূরের কথা, কেউ আর নতুন কোন প্রস্তাব নিয়ে এসে তাকে বিরক্তও করতো না! মনে মনে বেশ স্বস্তি অনুভব করলেন তিনি।

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর ইসহাক তার কামরায় একাকী বসেছিলেন। ভাবছিলেন উমরু দরবেশের কথা। সে এখন কি করছে? সেকি ফাঁকি দিতে পেরেছে সুদানীদের ? নাকি ওদের হাত থেকে মুক্ত হতে গিয়ে নতুন করে বিপদের জড়িয়ে পড়েছে? তাঁর গোপন ইচ্ছা ফাঁস হয়ে গেলে তাঁর ভাগ্যে কি ঘটবে মনে হতেই শিউরে উঠলেন তিনি।

ইসহাক এখন কি করবেন সে কথাই চিন্তা করছিলেন। তিনি তাঁর সামনে দু’টি নতুন বিপদ দেখতে পেয়ে আঁৎকে উঠলেন। প্রথমতঃ উমরু দরবেশ কারাগারের কঠিন শাস্তির ভয়ে সুদানীদের খেলনায় পরিণত হতে পারে। দ্বিতীয়তঃ উমরু দরবেশ তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ধরা পড়তে পারে ওদের হাতে। দুই অবস্থাতেই ইসহাকের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা রয়েছে। উমরু দরবেশের কথা ভাবতে গিয়ে এ আশংকা মনে উদয় হতেই এক ধরণের ভয়, শিহরণ ও ব্যস্ততা অনুভব করলেন তিনি। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন এবং ঘরময় পায়চারী করতে লাগলেন। শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, উমরু দরবেশের জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। যা করার তার নিজেকেই করতে হবে। ইসহাক নিজস্ব পরিকল্পনায় পালানোর কথা ভাবতে লাগলেন। কিন্তু কিভাবে পালাবেন তার কোন পথ খুঁজে পেলেন না।

সুদানীদের জন্য তিনি এক মূল্যবাদ কয়েদী! সে জন্য সুদান সরকার তার ওপর কড়া পাহারার ব্যবস্থা রেখেছে। উমরু দরবেশ তাঁর কাছ থেকে পৃথক হওয়ার সময় বলেছিল, সুদানী মুসলমানদেরকে সুদান সরকারের অনুগত বানানোর প্রস্তাবে রাজি হলে সরকার তাকে মুক্ত করে দেবে। তাহলে উমরু দরবেশ কি এখন মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার কাজ করে যাচ্ছে! ইসহাক জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিল। ভাবছিল, এ জাহান্নাম থেকে মুক্তির তবে কি কোন পথ নেই? সূর্য অস্ত গিয়েছে খানিক আগে। চারজন অশ্বারোহী সুদানের রাজধানী খার্তুমে প্রবেশ করলো। ডানে বায়ে না তাকিয়ে ওরা সোজা সামরিক হেডকোয়ার্টারে গিয়ে থামলো। উমরু দরবেশ জানেন, কোথায় যেতে হবে ও কার সঙ্গে দেখা করতে হবে। তাকে নতুন চিন্তাধারার ট্রেনিং এখানেই দেয়া হয়েছিল। রক্ষীদের কাছে পৌছেই উমরু দরবেশ বললো, ‘জলদি আমাকে সেনাপতির কাছে পৌছে দাও’।

রক্ষী কমান্ডার দ্রুত তাকে সেনাপতির কাছে নিয়ে গেল।

‘ব্যর্থ হয়ে ফিরেছ নাকি সফল হয়েছ?’ উমরু দরবেশকে দেখতে পেয়েই সেনাপতি প্রশ্ন করলো।

‘ভাল সংবাদ এর কাছেই শোনো!’ উমরু দরবেশ আশীর দিকে ইশারা করে বললো, ‘হয়তো আমার কথা তোমার বিশ্বাস নাও হতে পারে’।

ক্লান্তি ও অবসাদে কামরায় প্রবেশ করেই আশী পালংকের ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে পড়লো। উমরু দরবেশের কথা শুনে মদির কটাক্ষ হেনে তৃপ্তির হাসি হেসে বললো, ‘ভনিতা রাখো তো দরবেশ! সব কিছু দ্রুত খুলে বলো। এখনো অনেক কাজ বাকী আছে, জলদি করো। কারন আমাদের হাতে সময় বেশী নেই’।

‘আমাদের মিশন এত তাড়াতাড়ি সফল হবে, এমন আশা আমাদের মোটেই ছিল না’। উমরু দরবেশ বললেন। তিনি কিভাবে কি করেছেন সব খুলে বললেন। কেমন করে ভেজা কাপড়ে আগুন ধরালেন, কেমন করে তুরের তাজাল্লি দেখালেন, সব।

‘আর তাঁর কথা বলার সময় সম্মোহনের যে আবেগ তৈরী হতো, সবকিছু জানা না থাকলে আমিও তো মজে যেতাম!’ আশী উমরু দরবেশের কাজের প্রশংসা করতে গিয়ে অভিভূত কন্ঠে বললো, ‘লোকেরা তাঁর কথা মুগ্ধ বিস্ময়ে গিলতো। মনে হতো, লোকগুলোর আলাদা কোন অস্তিস্ব নেই, সবকিছু নিস্প্রাণ,নির্জীব। কেবল প্রাণময় সত্তা উমরু দরবেশ। সে যদি রহীমকে বলতো, তোমার নাম রাম,  লোকগুলো হয়তো তাই বিশ্বাস করতো’।

 ‘কেন,কেউ কি এ পর্যন্ত আপনাকে আমাদের সাফল্যের সংবাদ দেয়নি?’ উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন।

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top