৯. উপকূলে সংঘর্ষ

ইতি- তোমার এক হতভাগী বোন।

চিঠি পড়া শেষ করে মাথা তুললেন আইয়ুবী। কাসেদকে বললেন, ‘তুমি এখনি ফিরে যাও। জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীকে আমার সালাম দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করে বলবে, আইয়ুবী আপনার চিঠির মর্মার্থ ও গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। মুসলিম মিল্লাতের জন্য এ বড় নাজুক সময়। এ সংকটময় মুহূর্তে ধৈর্যহারা হলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। এ সংকট নিরসনে আমি আমার সাধ্যমত পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবো না। কিন্তু এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হলে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। তাঁর চিঠির প্রতিটি শব্দ আমি আমার বুকে খোদাই করে নিয়েছি। তাঁকে শুধু বলবে, তিনি যেন আমার জন্য এবং এ জাতির হেফাজতের জন্য দোয়া করতে থাকেন।’

কাসেদকে পাঠিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সুলতান আইয়ুবী পড়লেন আলী বিন সুফিয়ানকে নিয়ে। বললেন, ‘আলী, দামেস্ক, মুসাল, হলব, ইয়েমেন এবং সমস্ত ইসলামী রাজ্যগুলোতে গুপ্তচর পাঠাও। দ্রুত তদন্ত করে সেখানকার সঠিক অবস্থা জেনে আসবে তারা। পারলে তুমি নিজেই এক চক্কর দিয়ে এসো দামেস্ক থেকে।’

এটা কোন সরকারী শুভেচ্ছা স্ফর ছিল না। আলী বিন সুফিয়ান বা তার নিয়োজিত গোয়েন্দাকে সে সব এলাকায় বহুরুপী সাজতে হবে, তদন্ত করতে হবে বিচিত্র এলাকায়।

প্রথমেই জানতে হবে, যে সকল শাসকরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, তারা কতটা অনড়, কতটা আবেগের বশে এ পথে পা বাড়িয়েছে। এরপর জানতে হবে, খৃস্টানদের সাথে তাঁদের সম্পর্ক আছে কি নেই, থাকলে কতটা গভীর। খলিফার সৈন্য বাহিনীর সাথে তাদের মিল বা অমিল কতটুকু। জানতে হবে সৈন্যদেরকে এমন কাজে ব্যবহারের প্রস্তুতি আছে কিনা, যা ইসলামের জন্য ক্ষতিকর ও শত্রুদের জন্য লাভজনক?

আরও জানতে হবে, সে সকল অঞ্চলের জনমত কেমন? জনগণের আবেগ ও নীতি-বিশ্বাস ক রকম? এ সব অঞ্চলে ফেদাইনরা কতটা তৎপর?

এটাও পর্যবেক্ষণ করতে হবে, সুলতান আইয়ুবী দামেস্ক অথবা কোন মুসলিম এলাকাতে সৈন্য সমাবেশ ও অভিযান চালালে তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?

 ১১৭৪ খৃস্টাব্দের মে মাসের দিনগুলো, মুসলিম জাহানের জন্য গভীর অন্ধকারের দিন, নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃতদেহকে তখনও গোসলই দেয়া হয়নি, অনেকের মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা গেল। যাদের মুখে এ ঝিলিক দেখা গেল এরা কিন্তু কেউ খৃস্টান নয়, এরা সবাই মুসলমান। জঙ্গীর মৃত্যুতে এরা যেন খৃস্টানদের চেয়েও বেশী উৎফুল্ল। এরা সেই সব লোক, যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন মুসলিম রাজ্য ও পরগণার আমীর, জায়গীরদার বা শাসক। তারা সকলেই একত্রিত হয়েছে জঙ্গীর বাড়ীতে। তারা এসেছে তাঁর জানাজায় শরীক হওয়ার জন্য।

জানাজ্য শরীক হওয়ার জন্য যারা এসেছে তাদের মধ্যে আরেকদল ছিল, যাদের চেহারায় গভীর দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ পাচ্ছিল। জঙ্গীর মৃত্যুতে সত্যিকার অর্থেই তারা ছিল অস্থির ও বেদনাবিধুর। যারা উৎফুল্ল তাদের মধ্যেও এক ধরণের অধীরতা দেখা গেল, তাদের অধীরতার কারণ, সন্ধ্যার আগেই যেন দাফন-কাফন শেষ করা যায়।

জানাজ্য বহু লোকই শরীক হয়েছিল বটে, তবে তাদের মন মানসিকতায় ছিল বিচিত্র অনুভূতি। তারা একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। যদিও তাদের ধর্ম এক, আল্লাহ এক, রাসূল এক, কোরআন এক, এবং তাদের শত্রুও এক, তবু তাদের চিন্তাধারা এক ও অভিন্ন ছিল না। এই জনসমুদ্রকে এমন এক গাছের সাথে তুলনা করা চলে, যে গাছের বিভিন্নন ডালপালা বৃক্ষের মূল কাণ্ড থেকে কেটে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে আর প্রতিটি ডালপালা নিজেকে এখন স্বাধীন মনে করে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।

এ যুগটাই ছিল প্রকৃতপক্ষে জায়গীরদারীর যুগ। কয়েকজন মুসলিম সুলতানের রাজ্য একটু বিস্তৃত ছিল, অন্যসব রাজ্যগুলো ছিল ছোট ছোট। এর শাসকদের বলা হতো আমীর। এ সকল আমীররা কেন্দ্রীয় খেলাফতের অধীন ছিল। ইসলামের যে কোন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলে, আমীররা খলিফাকে অর্থ ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতো। কিন্তু এ সাহায্য শুধু সাহায্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তার মধ্য কোন জাতীয় চেতনাবোধ ও আবেগ থাকতো না। তারা বিলাস ও আরামের জীবন যাপনের জন্য ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চাইতো। প্রকাশ্যে এরা খলিফাকে সাহায্য করতো, আর গোপনে জাতীয় শত্রু খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে আরাম আয়েশের সামগ্রী সংগ্রহ করতো। এদের কেউ কেউ গোপনে শত্রুদের সাথে শান্তি চুক্তিও করে রাখতো।

নূরুদ্দিন জঙ্গীর শাসনকাল খৃস্টানদের জন্য ছিল দুঃসহ আতঙ্কের। ইসলামী চেতনা বিনাশের যে কোন প্রচেষ্টাকেই তিনি রুখে দাঁড়াতেন। খৃস্টানদের সাথে সখ্যতা করার কারণে তিনি বহুবার মুসলমান ওমরাদের সতর্ক করেছেন। তাদের তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন যে, খৃস্টানরা মুসলমানদের বন্ধু হতে পারে না। আমরা একতার বন্ধন ছিন্ন করলে তারা একে একে আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে।

খৃস্টানদের আমদানী করা ইউরোপীয় মদ, মেয়ে, ও সোনার টুকরোগুলর এত শক্তি ছিল যে, তারপরও তারা বিভ্রান্ত হয়ে যেতো। নিজের বিবেক বুদ্ধিকে বন্ধক রেখে পাপের সাগরে ডুবে যেতো যখন তখন। কিন্তু জঙ্গীর সতর্কবাণী বার বার তাদের ফিরিয়ে আনতো চেতনার রাজপথে।

তারা ‘মুসলমান’ এটা তাঁদের বড় পরিচয় ছিল না, তাঁদের প্রথম পরিচয় ছিল তারা জায়গীরদার বা আমীর। তারপরে যদি ধর্মের পরিচয় প্রয়োজন হতো তবে তাঁরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দিত। তাঁদের দ্বীন-ধর্ম সব কিছুই ছিল তাদের রাজ্য, ক্ষমতা ও জায়গীরদারী। ক্ষমতার দম্ভই ছিল তাদের ঈমান ও বিশ্বাসের বস্তু। ইসলামী চেতনা ও ঐক্যের প্রতি এদের কোন মমত্ববোধ ছিল না। যুদ্ধকে এরা ভয় পেতো, ঘৃণা করতো। তাদের বড় ভয়, যদি খৃস্টান শক্তি তাদের জায়গীরদারী কেড়ে নেয়! তারচে বড় ভয়, প্রজারা ইসলামের সঠিক চেতনায় উজ্জীবিত হলে তাদের অপকর্ম, অন্যায়, বিলাসিতা ও বেহায়াপনার বিরুদ্ধে যদি রুখে দাঁড়ায়! জনগণের মনে এ জাগরণ এলে তা ক্ষমতার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে যাবে যে!

জঙ্গী মুসলমানদের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ ও সম্মান জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে বলে তারা জঙ্গীকে ভয় পেতো। জঙ্গীর সেনাবাহিনীতে যারা যোগ দেয় তারা তো তাদেরই প্রজা! এই প্রজারা একবার রুখে দাঁড়ালে কি উপায় হবে তাদের!

প্রকৃত ইসলামী জযবা থাকার কারণে মুজাহিদরা দশগুণ শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতেও ভয় পায় না। মুজাহিদদের এই জযবা আমীরদের কাছে ছিল অসহ্যের ব্যাপার! এ কারণেই তারা জঙ্গীকে এবং সুলতান আইয়ুবীকে একদম দেখতে পারতো না। জঙ্গীর মৃত্যুর সাথে সাথে তার জিহাদী জযবাও কবরস্থ হয়ে গেছে এ কথা মনে করেই তারা আজ খুশী। নূরুদ্দিন জঙ্গীর দাফন শেষ হয়েছে। মুসলমানদের ওপর খৃস্টানদের যে আতংক ছিল, সে আতংক আর নেই। এখন শুধু একটি কাঁটাই রয়ে গেছে, সে হলো সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। তার ব্যাপারে খৃস্টানরা তেমন উদ্বিগ্ন নয়। কারণ এতদিন জঙ্গী ও আইয়ুবী মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হয়েছে। এখন আইয়ুবী সম্পুর্ণ একা। তাকে সাহায্য করার জন্য জঙ্গী আর নেই। একা আইয়ুবী আর কতক্ষণ লড়বে, কতদিক সামলাবে?

খৃস্টানরা আনন্দিত এ জন্য যে, নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পরে তাঁর ওমরা ও উজীররা জঙ্গীর অল্পবয়স্ক শিশুসন্তান আল মালেকুছ সালেহকে সিংহাসনে বসিয়েছে। যার বয়স সবেমাত্র এগারো বছর। এটা তাদেরই কাজ, যারা গোপনে খৃস্টানদের বন্ধু ছিল! এভাবেই সুলতান জঙ্গীর গদী খৃস্টান ক্রীড়নকদের হাতে চলে গেলো।

এই ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিল গুনাশতগীনও, যিনি জঙ্গীর দূর্গের অধিপতি ছিলেন। আর ছিল মুশালের শাসক সায়ফুদ্দিন, দামেস্কের শামসুদ্দিন আব্দুল মালেক। আল জাজিরা ও আশেপাশের অঞ্চলের শসনের কর্তৃত্ব ছিল নূরুদ্দিন জঙ্গীর ভাতিজাদের হাতে। এ ছাড়া ছোট ছোট আরও কিছু জায়গীরদার ছিল, যারা সকলেই সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। সুলতান বেঁচে থাকতে এরা প্রকাশ্যে খলিফার অধীন থাকলেও কার্যত ছিল খৃস্টানদের বন্ধু।

নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্বের যে ক্ষতি হয়েছিল, সে ক্ষতি নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্ত্রী মর্মে মর্মে অনুভব করছিলেন। সুলতান আইয়ুবীও এই শূন্যতা অনুভব করছিলেন তীব্রভাবে। আর অনুভব করছিলেন তারা, যারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। জঙ্গীর শিশু পুত্র গদীনশীল হওয়ায় এরা সবাই ছিলেন সীমাহীন পেরেশানীর শিকার।

o

এই ঘটনার পর বেশ কিছু দিন অতীত হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী তাঁর কামরায় পায়চারী করছিলেন। কামরায় মোস্তফা জুদাত নামে জঙ্গীর এক উর্ধতন সামরিক অফিসার বসা। মোস্তফা জুদাত তুরস্কের অধিবাসী। তিনি নূরুদ্দিন জঙ্গীর সেনাবাহিনীর মেনজানিক বিভাগের ইনচার্জ ছিলেন। জঙ্গীর মৃত্যুর পর ইসলামী দুনিয়ার দূরাবস্থা লক্ষ্য করে তিনি সীমাহীন অস্থিরতায় পড়লেন। কি করে মিল্লাতকে এ সংকট থেকে উদ্ধার করা যায় ভেবে কোন কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না তিনি। প্রচণ্ড অস্থিরতায় ভুগতে ভুগতে এক সময় তার মনে হলো, যদি কেউ জাতিকে এ সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারে, তিনি একমাত্র আইয়ুবী। আইয়ুবীই পারেন এ সংকটময় মুহূর্তে ঝুঁকি গ্রহন করতে।

কালবিলম্ব না করে আইয়ুবীর সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দীর্ঘদিনের ছুটি চাইলেন তিনি। কয়েক বছর দেশে যাননি বলে সহজেই তার ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেল। তিনি তাঁর দেশ তুরস্কে যাওয়ার কথা বলে দামেস্ক ত্যাগ করলেন। কিন্তু দামেস্ক থেকে বেরিয়েই তিনি সোজা চললেন কায়রোর অভিমুখে। সুলতান আইয়ুবীর দরবারে গিয়ে হাজির হলেন তিনি।

মোস্তফা জুদাত ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক সেনা অফিসার। তার কাছে নূরুদ্দিন জঙ্গীর পরে সুলতান আইয়ুবী ছাড়া ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখায় উপযুক্ত সেনাপতি আর কেউ ছিল না। তাঁর ধারণা, জঙ্গীর অবর্তমানে মিল্লাতের যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে আইয়ুবী তা পুরোপুরি অবহিত নন। এ জন্য তিনি দেশে না গিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে সামগ্রিক অবস্থা জানানোর কায়রো ছুটে আসেন।

‘আর সেনাবাহিনী এখন কি অবস্থায় আছে?’ সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন। ‘মুহতারাম, সুলতান জঙ্গী সেনাবাহিনীতে যে আবেগ ও প্রেরণা সৃষ্টি করে গেছেন, সে প্রেরণা এখনও টিকে আছে। কিন্তু এই আবেগ আর বেশীদিন টিকে থাকবে বলে মনে হয়না। আপনি ভাল মতই জানেন, খৃস্টানদের প্লাবন বাঁধের মত ঠেকিয়ে রেখেছে শুধু সেনাবাহিনী। মুহতারাম জঙ্গীর সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা সবই ছিল সামরিক বাহিনীর পরামর্শের ভিত্তিতে। কিন্তু এই পদক্ষেপ বর্তমান খেলাফতের কার্যবিধির পরিপন্থী। আমরা এখন আমাদের নিজ সিদ্ধান্তে কোন কিছু করতে পারিনা। খলিফা যদি আমাদের যুদ্ধের ময়দান থেকে সরিয়ে রাখে তবে সামরিক বাহিনীর কিছুই করার নেই।

খৃস্টানরা ভালমতই জানে, মুসলমান আমীরদের মধ্যে সে চেতনাবোধই নেই, যে চেতনা থাকলে মানুষ জেহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ে। জনগণ কার পেছনে দাঁড়িয়ে কিসের প্রেরণায় জীবন কোরবানী করবে? খৃস্টানরা মুসলিম শাসক ও আমীরদের ক্রয় করে নিয়েছে। এখন তারা সেনাপতিদের পিছনে লেগেছে। সেনাপতি ও কমান্ডারদের ক্রয় করার জন্য হেন চেষ্টা নেই যা তারা করছে না। তাদের এ অপততপড়তা আমাদের সামরিক বিভাগ ও জাতীয় জীবনকে বিষিয়ে তুলবে। যদি অচিরেই এসব বন্ধ করা না যায়, তবে খৃস্টানরা সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই মুসলিম জাহানের মালিক হয়ে যাবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের আমীরদের আর সঠিক পথে আনা সম্ভব নয়। তারা খৃস্টানদের মদের নেশায় ডুবে আছে।

এইসব আমীরদের পিছনে এখন আর তারা মেয়েও লেলিয়ে দিয়েছে। আপনি শুনে অবাক হবেন, খৃস্টান সুন্দরী ললনারা এখন আমীরদের বাসায় বাসায় আস্তানা গেড়ে বসেছে। তাদের চাহিদা মত মহলে আনন্দ উৎসব হয়। সে উৎসব বিশিষ্ট সামরিক অফিসারদের দাওয়াত করা হয়। আর তাদেরকে এই মেয়েরা ফাঁদে ফেলে বিনষ্ট করার চেষ্টা চালায়।’ থামলেন মোস্তফা জুদাত।

‘তারপর কি হবে আমি বলছি।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন ‘সৈন্যদের নেশাগ্রস্থ ও ব্যভিচারে অভ্যস্ত বানানো হবে।’

‘এলরেডী বানানো হচ্ছে!’ মোস্তফা বললেন, ‘এখন তাদের নিয়মিত হাশিস সরবরাহ করা হয়। শুধু তাই নয়, এরপরও যে সব সেনাপতি ও কমান্ডার খৃস্টানদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করবে, আর জিহাদের প্রেরণা ধরে রাখবে অন্তরে, তাদেরকে পেশাদার খুনী দিয়ে গোপনে হত্যা করার পরিকল্পনাও আছে তাদের।’

মোস্তফা সুলতান আইয়ুবীকে আরো বললেন, ‘যে সব আমীররা খেলাফতের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে শাসন চালানোর জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, খৃস্টান গোয়েন্দারা তাদের মনে বুনে দিচ্ছে উচ্চাশার বীজ। ইন্ধন জোগাচ্ছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য আক্রমণের। আশ্বাস দিচ্ছে সাহায্য সহযোগিতার। ফলে এক আমীর অন্য আমীরকে শত্রু ভাবতে শুরু করেছে। একে অন্যের বিরুদ্ধে সৈন্য বাহিনী গড়ে তুলছে। খৃস্টানরা এই বিভেদ বাড়িয়ে তোলার জন্য ঠিক মত হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ভাইয়ে ভাইয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলে সাহায্যের বাহানায় সৈন্য পাঠিয়ে এক সময় অবলীলায় সুযোগ বুঝে গ্রাস করে নেবে উভয়ের এলাকা। এমনি নানা কূটকৌশল ও চক্রান্তে মেতে উঠেছে খৃস্টানরা। ফলে অবস্থা খুবই নাজুক।’

‘আমাকে সঠিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে আপনি খুব সময়োচিত উপকার করেছেন।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আপনি না এলে এসব সঠিক তথ্য থেকে আমি বঞ্চিত থাকতাম।’

‘তথ্য পাওয়াটাই বড় কথা নয় সুলতান! এখন প্রয়োজন দ্রুত একশান। যদি আপনি ত্বরিত কোন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন, তবে মনে করে রাখবেন, ইসলামী সামাজ্যের সূর্য ডুবে যাবে আপনার চোখের সামনে। সুলতান! নিরব দর্শকের ভূমিকা পালনের কোন অবকাশ নেই এখন। এখন প্রয়োজন, জঙ্গীর মত দুঃসাহসী পদক্ষেপের।’

সুলতান আইয়ুবীর কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো একরাশ বেদনামাখা দীর্ঘশ্বাস, ‘হায়! আমাকে এমন দিনও দেখতে হলো, ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা চিন্তা করতে হচ্ছে! আমার শুধু ভয়, আমার মৃত্যুর পর বিশ্বাসঘাতকরা ইতিহাসের পাতায় না লিখে রাখে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী গৃহযুদ্ধের অপরাধে অপরাধী।’

‘যদি আপনি এই ভয়ে কায়রোতে বসে থাকেন, তবে ইতিহাস আপনার ওপর এই অভিযোগ পেশ করবে যে, সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর খবর শুনে সুলতান আইয়ুবীও পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। তার শিরায় যে রক্ত প্রবাহিত হতো তা পানি হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যু হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুর অধিক নির্জীব হয়ে গিয়েছিলেন। মিশরের উপরে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ইসলামী সামাজ্যকে কোরবানী দিতেও প্রাণে বাঁধেনি তার।’

‘হ্যা! তুমি ঠিকই বলেছো মোস্তফা।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এই অভিযোগটি হবে অতিশয় নিকৃষ্ট ও লজ্জাকর। আমি চিন্তা করে দেখলাম, আল্লাহর পথে জিহাদ করতে বের হয়ে এটা দেখার বিষয় নয় যে, আমার ঘোড়ার পদতলে আল্লাহর কোন দুশমন পিষ্ট হলো। আমার দৃষ্টিতে কালেমা পড়া দুশমন কাফেরের চেয়েও জঘন্য। আর কালেমা পড়া দুশমন তারাই, যারা নিজের স্বার্থে কাফেরের সাথে বন্ধুত্ব রাখে।’

সুলতান আইয়ুবী মোস্তফা জুদাতকে বললেন, ‘আপনি আবার দামেস্ক ফিরে যান। সেখানে আমি আলী বিন সুফিয়ানকে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মনে রাখবেন, তিনি সেখানে গোয়েন্দা বেশে গিয়েছেন। সেখানে কেউ জানতে অয়ারবে না, আলী বিন সুফিয়ান তাদের মাঝে ঘোরাফেরা করছে ও সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। সেখানে কেমন তৎপরতা চালানো উচিত সবই সে লক্ষ্য করছে। আপনি গিয়ে খোঁজ নিন, কোন কোন সেনাপতি ও কমান্ডার সন্দেহজনক।

আমি এরই মধ্যে সকল আমীরদের কাছে পয়গাম পাঠিয়েছি, হে আমীর! এই সংকটময় অবস্থায়, যখন খৃস্টানরা মাথার ওপর চড়ে আছে, তখন আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ কল্পে নিজেদের মধ্যকার সব বিরোধ মিটিয়ে ঐক্যবধ্য হতে চেষ্ঠা করি। আমার মনে হয় না, তারা আমার চিঠিকে আমল দেবে। কিন্তু তাদেরকে সরল ও সঠিক পথে চলার শেষ সুযোগটুকু দিতে চাই আমি। যদি তারা আমার এ আবেদনে সাড়া না দেয় তবে এ নিয়ে আমি আর তাদের একটি কথাও বলব না। আতখন আমি কি পথ বেছে নেব সে কেবল আমিই জানি।’

মোস্তফা জুদাতকে বিদায় করে সুলতান আইয়ুবী তাঁর দারোয়ানকে ডেকে কয়েকজন সেনাপতি ও সভাসদের নাম উল্লেখ করে বললেন, ‘তাদেরকে খুব জলদি আমার কাছে ডেকে আনো।’

এরা সবাই ছিলেন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য।

o

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ ছিলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দক্ষিণ হস্ত, সহকর্মী এবং বন্ধুও। তিনি মজলিশে শুরার প্রভাবশালী সদদ্য ছিলেন। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে আল্লাহতায়ালা ইস্পাত দৃঢ় চির যৌবন দান করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব এমন সুদৃঢ় ছিল, পাহাড় সমান আঘাতও তিনি হাসিমুখে সহ্য করতে পারতেন। তিনি ছিলেন সংকল্পে দৃঢ়, দুরদর্শী এবং দুঃসাহসী। আমীর গরীব সকলকেই তিনি সমান ভাবে ভালবাসতেন, উপযুক্ত মর্যাদা দিতেন, যথাযথ সম্মান করতেন।

যারা তার পাশে থাকতেন তারা সবাই তাঁর দৃঢ়তা ও ভালবাসায় সিক্ত হতেন। সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে তাঁর দৃঢ়তা দেখে শত্রুর ওপর প্রবল বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়তো। একদিনের ঘটনা, তাঁর এক চাকর অন্য চাকরের সাথে ঝগড়া করতে গিয়ে তাকে জুতা ছুঁড়ে মারলো। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তখন কামরা থেকে বেরুচ্ছিলেন, জুতা গিয়ে লাগলো তাঁর গায়ে। দুই চাকরই থর থর করে কাঁপতে লাগলো। কিন্তু সালাহউদ্দিন তাদের কিছুই না বলে অন্যদিকে মুখ করে বের হয়ে গেলেন। তাঁর এ ধরণের মহানুভবতার জন্যই কেবল বন্ধু নয় শত্রুও তার সংস্পর্শে এলে ভক্ত মুরীদ হয়ে যেতো। নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যু ইসলামী সালতানাত জুড়ে যে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল সেই বিপর্যয়ের সবচে ভয়ংকর দিক ছিলো, সালতানাতের গভর্ণর ও উজিররা খৃস্টানদের বন্ধু ও ইসলামের শত্রু হয়ে গিয়েছিলেন। মিশরের আভ্যন্তরীণ অবস্থাও তখন ঝুঁকি মুক্ত ছিল না। এ অবস্থায় সুলতান আইয়ুবীর পক্ষে মিশর ত্যাগ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। মিশরের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির দাবী ছিল, ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষার চিন্তা অন্তর থেকে মুছে দিয়ে মিশরের প্রতিরক্ষার সুদৃঢ় ব্যবস্থার দিকে নজর দেয়া।

কিন্তু আইয়ুবী এসব কিছুই চিন্তা করলেন না। তিনি আমার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘যদি আমি ইসলামের হেফাজতের দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নেই, তবে আমাকে কাল কেয়ামতে হাশরের ময়দানে খৃস্টানদের সাথে উঠানো হবে।’

ইসলামের হেফাজত ও উন্নতিকে তিনি আল্লাহতায়ালার আদেশ ও ফরমান মনে করতেন। তিনি নিজেকে কখনও একজন শাসক ও আমীর মনে করতেন না। আমার স্মৃতিতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর যৌবনকাল স্পষ্টভাবে গাঁথা আছে। তখনো তিনি নিজেকে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করেননি। আরাম ও বিলাসিতায় পূর্ণ মাত্রায় ডুবে থাকতেন।

কেউ এটা চিন্তাও করেনি, তার এ যৌবনের উন্মাদনা কয়েক বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে এবং তিনি ইসলামের এক নিঃস্বার্থ খাদেম হয়ে যাবেন। তিনি হবেন ইসলামের বিশ্ব বরেণ্য নেতা এবং শত্রুর জন্য ভয়ংকর এক তুফান।

তিনি তাঁর চাচার সঙ্গে প্রথম খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করেন। এই প্রথম যুদ্ধেই তিনি সকলকে অভিভূত করে দেন। তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে প্রথমেই বিলাসিতা ও আনন্দ স্ফূর্তির উপকরণে পদাঘাত করলেন আর সমস্ত জীবন ইসলামের জন্য ওয়াকফ করে দিলেন। তিনি মিল্লাতে ইসলামিয়াকে বললেন, ‘এ তামাম দুনিয়া আল্লাহর। আল্লাহর এ দুনিয়ায় আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব প্রতিটি মুসলমানের। আল্লাহর বান্দা হিসেবে নিজেকে দাবী করার পর কেউ যদি এ দায়িত্ব পালন না করে তবে হিসাবের দিন আল্লাহ কাউকে ছাড়বেন না।’

তাঁর এই পরিবর্তিত অবস্থা দেখে বুঝারই উপায় ছিল না, তিনি জীবনে কখনো বিলাসপরায়ন ছিলেন। নফসের উতকর্ষ সাধনের মাঝেই নিহিত থাকে মানুষের কর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও নৈপূণ্য। নফসের খাহেশকে কোরবানী দিয়েই মানুষ পূর্ণতা লাভ করে। মানুষ যখন নফসের দাবীকে অগ্রাহ্য করতে পারে তখনি সে হাছিল করে ইনসানিয়াত ও কামেলিয়াত। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এই কামেলিয়াত ও ইনসানিয়াত হাসিল করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর চরিত্রে পরিপক্কতা ও নৈপূণ্য এসেছিল।

তিনি বন্ধু মহলে প্রায়ই বলতেন, ‘আমাকে কাফেররাই মুসলমান বানিয়েছে। যদি আমরা আমাদের যুবকদেরকে, যারা ধর্ম থেকে দূরে সরে গেছে, তাদের বিবেকের সামনে কাফেরদের ভন্ডামী ও নষ্টামী তুলে ধরতে পারি, তবে তাদের বিবেকই তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে দেবে।’

তিনি বলতেন, ‘আমি আমার জাতিকে রাসূলের সেই হাদীসটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যেখানে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তুমি নিজেকে ভালমত চিনে নাও, তুকি কে ও কি? আর দুশমনকেও ভাল মত চিনে নাও, সে কে ও কি? এবং সে তোমার সম্পর্কে কি ধারণা রাখে?’

শত্রুরাই তাঁর কর্মের গতি ও মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছিল। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাঁর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং সংকল্পে শেষ পর্যন্ত নিমগ্ন ও অটুট ছিলেন। তিনি কখনো নিজেকে ইসলামী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতা ভাবেননি, ভাবেননি তিনি মিশরের আজীবন শাসক। জিহাদই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। যুদ্ধ ও সমর কৌশলে তিনি এমন উস্তাদ ছিলেন যে, খৃস্টান কমান্ডাররা সম্মিলিতভাবে তাঁর ভয়ে ভীত থাকতো। জিহাদে তিনি এমনভাবে নিমগ্ন ছিলেন, জীবনে তিনি হজ্জ করারও অবসর পাননি। জিহাদ সে সুযোগ তাঁকে দেয়নি।

শেষ জীবনে তাঁর এই একটি আশা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল যে, তিনি হজ্জ করতে যাবেন। কিন্তু তখন তাঁর কাছে হজ্জ করার মত অর্থ ছিল না। যখন তিনি ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁর নিজস্ব সম্পদ ছিল মাত্র ৪৭ দেরহাম রৌপ্য আর এক টুকরো সোনা। তাঁর সম্পত্তি বলতে ছিল শুধুমাত্র একটি বাড়ি, যে বাড়িটি তিনি পৈতৃকসুত্রে পেয়েছিলেন। সুলতান আইয়ুবীর বাস্তব জীবনের এ এক বিস্ময়কর সততার নমুনা। অর্থ সম্পদের মোহকে তিনি ইসলামের সৈনিকদের জন্য গযব মনে করতেন। সম্পদের কালিমা থেকে আশ্চর্যরকম ভাবে মুক্ত ছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ইসলামের জন্য স্বর্ণালী ভবিষ্যত নির্মাণ করা।

সুলতান আইয়ুবী তাঁর পরিষদবর্গ, সরকারী পদস্থ কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর অফিসার ও মিশরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এক সভা আহবান করলেন। সবাই দরবার কক্ষে উপস্থিত হলে সুলতান আইয়ুবী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বন্ধুগণ! জাতির এক সংকটময় মুহূর্তে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। সুলতান জঙ্গীর  অবর্তমানে ইসলামী সালতানাত আজ যে গভীর সংকটে পড়েছে সে ব্যাপারে কম বেশী আপনারা সকলেই অবগত আছেন। জাতির প্রতিটি জটিল অবস্থায় আপনারা আমার পাশে ছিলেন। সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই আমরা সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছি, আজও সেই আশা নিয়েই আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি।

বন্ধুগণ!

আজ এমন এক সংকটময় অবস্থা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, যে অবস্থার মোকাবেলা করা আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু আমরা যদি এই অবস্থার মোকাবেলা করতে না পারি, তবে আমাদের সকলের জন্যই দুনিয়া হবে লাঞ্ছনাময় আর আখেরাতে আল্লাহর দরবারে আমরা হবো চরম অপমানিত।

ইসলামের ইতিহাস এ দুনিয়াতে আমাদের কবরের ওপর অভিশাপ দেবে, আর হাশরের দিনে শহীদগণ, যারা ইসলামের গৌরব ও ইজ্জত রক্ষার্থে জীবন কোরবানী করেছেন, তারা আমাদের লজ্জিত করবে। এখন আমাদের সামনে সেই সময় এসেছে, যখন আমদেরও জীবন কোরবানী করা ফরজ হয়ে গেছে।’

এ ভূমিকার পর তিনি সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরে বললেন, ‘এখন সময় দাবী করছে নিজের ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ।’

এটুকু বলে তিনি সামান্য চুপ করলেন এবং সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। আইয়ুবীর কাছ থেকে বিশদ বর্ণনা শুনে সকলের মুখের রঙ পরিবর্তিত হয়ে গেল। প্রতিটি চেহারায় খেলা করতে লাগল দৃঢ়তার অমল বিভা।

কয়েকজন দাঁড়িয়ে বললো, ‘জিহাদের ময়দানে আপনি কখনো আমাদের পেছনের সারিতে পাবেন না। যতদিন আপনি ইসলামের জন্য লড়াই করবেন, ততদিন আপনি আমাদেরকে আপনার পাশে পাবেন।’

তিনি বুঝতে পারলেন উপস্থিত সকলেই সর্বাবস্থায় তাঁর সঙ্গে থাকবেন।

এবার তিনি বললেন, ‘এ জন্য আমি প্রথমেই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চাই। কারণ কেন্দ্রীয় খেলাফতের অধীনে থেকে কোন বিপ্লবী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়। সে অনুমতি কেন্দ্র আমাকে দেবে না। কিন্তু আপনাদের অনুমতি ছাড়া এই সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি না। ভেবে দেখুন, বর্তমান খলিফা মাত্র এগারো বছরের এক বালক। তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে তিন চারজন ওমরা। আর এই ওমরারা সবাই খৃস্টানদের বন্ধু। এ কথা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, খেলাফত এখন খৃস্টানদের কোলে রয়েছে।

সুতরাং এখন আমাদের প্রথম সংঘর্ষ খেলাফতের বিরুদ্ধে। যদি আমরা স্বাধীন না হই, তবে আমাদের খলিফার আদেশ ও শাসন মানতে হবে। আর এ আদেশ ইসলামী সাম্রাজ্যের জন্য হবে ধ্বংসাত্বক ব্যাপার। এ সংকটময় অবস্থায় এ পদক্ষেপই কি সঠিক নয়, প্রথমে মিশরকে খেলাফতের আওতা থেকে মুক্ত করে নেই? এরপর আমরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবো, ইসলামের স্থায়িত্বের জন্য আমরা কি করবো?’

‘আপনি কি খেলাফতের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে চান?’ এক সেনাপতি প্রশ্ন করলো ।

‘এখনও সে সিদ্ধান্ত নেয়নি ।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আগামী দু’এক দিনের মধ্যেই আমার দূত বিভিন্ন রাজ্যগুলো থেকে ঘুরে আসবে । সালতানাতের অধীন সব আমীরের কাছেই দূত পাঠিয়েছি আমি । ওরা এলেই বুঝবো, আমাদের যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে কিনা ।’

‘আপনি মিশরকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করুন ।’ এক অফিসার বললো, ‘আমরা এগারো বছরের শিশুকে খলিফা মেনে নিতে পারি না ।’

‘তবে কি তোমরা আমাকে আমাকে মিশরের সুলতান মেনে নিচ্ছো?’ আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন ।

উপস্থিত সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, ‘আমরা আপনাকে মিশরের সুলতান মেনে নিলাম। আপনার প্রতিটি সিদ্ধান্তে আপনার পাশে থাকার ওয়াদা করলাম ।’

সে অনুষ্ঠানেই সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মিশরকে স্বাধীন রাষ্ট্র এবং নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, ‘আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আমি ওয়াদা করছি, যতদিন মিশরের জনগণ আমাকে ইসলামের খাদেম মনে করে কেবল ইসলামের জন্যই আমার আনুগত্য করবে ততদিন আমি তাদেরকে আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালনা করে যাবো। আমি কোনদিন নিজেকে বাদশাহ মনে করিনি, এখনো করি না, আর কোনদিন যেন ক্ষমতার মোহ আমাকে পেয়ে না বসে সে জন্য আল্লাহর কাছে মদদ চাই । আমার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ইসলামের মঙ্গলের জন্য হয় এ ব্যাপারে আমি আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা চাই ।’

সুলতান আইয়ুবী আরো বললেন, ‘আমি খৃস্টান বাহিনীর বিশালতা দেখে ভয় পাই না। দশজন জানবাজ মুজাহিদ নিয়ে দশ হাজার শত্রুর মোকাবেলা করতে আমার বুকে বিন্দুমাত্র কাপন জাগবে না । কিন্তু আমার ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা যখন চিন্তা করি তখন যুদ্ধের সমস্ত কৌশল আমার মাথা থেকে হারিয়ে যায়। আমার তলোয়ার খাপ খাপ থেকে মুক্ত হতে চায় না। আফসোস! আমাদেরকে আজ ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করার কথা চিন্তা করতে হচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত থাকবো আর খৃস্টানরা তামাশা দেখবে, এরচে বদনসীব আমাদের জন্য আর কি হতে পারে !’

‘যতই দুঃসহ হোক, এ পথে আমাদের পা বাড়াতেই হবে সুলতান ।’ একজন সেনাপতি বললেন, ‘যখন কথার প্রভাব বা উপদেশে কাজ হয় না, তখন শক্তি প্রয়োগ করতেই হয়। ইসলামের ঘরে যদি আপন ভাইও আগুন দিতে আসে, তাকে প্রতিহত না করলে সে ঘর তেমনি পুড়বে, যেমন পুড়তো শত্রু আগুন দিলে। আপনি জানেন, আমাদের মধ্যে কেউ খেলাফতের গদীর লালসা করে না। আমরা যা কিছু করবো তা ইসলামের জন্যই করবো, নিজের স্বার্থে নয় ।’

o

সুলতান আইয়ুবী দামেস্ক, হলব, মুসালে এবং আরো যে সব জায়গায় দূত পাঠিয়েছিলেন, সকলেই ফিরে এলো। সুলতানের সতর্কবানীকে কোন আমীরই আমল দেয়নি, কেউ গ্রহন করেনি তাঁর পয়গাম । কেউ কেউ তামাশা করেছে, কেউবা করেছে উপহাস । দামেস্কের দূত জানালো, খলিফা আপনার পয়গাম পড়েও দেখেননি । যাদের হাতের তিনি পুতুলমাত্র, যারা তাকে খলিফা নিযুক্ত করেছে এবং গদীতে বসিয়েছে, সেই আমীররা আপনার পয়গাম পড়ে হাসাহাসি করেছে, কানাঘুষা করেছে ।

একজন বলেছে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বাহানা করে সমস্ত মুসলিম রাজ্যগুলোকে নিয়ে অখণ্ড সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন দেখছে। আর তা সফল হলে তিনিই হবেন সেই বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি।

অন্য এক আমীর এগারো বছরের খলিফাকে আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য বলেন, ‘আপনি আইয়ুবীকে জানিয়ে দিন, যুদ্ধ করা ও না করার এখতিয়ার শুধু খলিফার উপরই ন্যাস্ত। যদি আইয়ুবী আপনার আদেশ অমান্য করে, তবে আপনি তাকে বরখাস্ত করে মিশরের শাসনভার অন্য কারো হাতে অর্পণ করুন ।’

বালক খলিফা দূতকে এই আদেশই দিলেন আর বললেন, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বলবেন, তিনি যেন আমার পরবর্তী আদেশের অপেক্ষা করেন। ইসলামী ঐক্যের প্রয়োজন আছে কি নেই এবং সালতানাতের প্রয়োজনে এখন কি করা দরকার সে চিন্তা আমি করবো ।’

সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সেনাবাহিনীতে মরহুম জঙ্গীর প্রেরিত অনেক সৈন্য ছিল । এক আমীর সে কথা স্মরণ করিয়ে খলিফাকে বললো, ‘তাঁকে আদেশ করুন, তিনি যেন আমাদের সব সৈন্য পাঠিয়ে দেন । খলিফার হুকুম ছাড়া ইচ্ছামত সেনাবাহিনী ব্যবহার করার অনুমতি নেই কোন রাজয়ের ।’

খলিফা দূতকে বললো, ‘খেলাফতের তরফ থেকে যে সব সৈন্য আইয়ুবীর কাছে পাঠানো হয়েছিল সেগুলো তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে বলবে ।’

দূত খলিফার দরবার থেকে বেরিয়ে আসতে যাবে এমন সময় অন্য এক আমীর বললো, ‘আর শোন, আইয়ুবীকে বলবে, আগামীতে খলিফার কাছে এ ধরণের কোন প্রস্তাব পাঠানোর যেন সাহস না করে ।’

দূতরা নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে, তাতে সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় কোনই ভাবান্তর দেখা গেল না । তিনি আলী বিন সুফিয়ানের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে লাগলেন। আলীকে তিনি গোপনে দামেস্ক পাঠিয়েছিলেন।

সুলতানের গোয়েন্দারা বণিকের বেশে কাফেলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বিভিন্ন রাজ্যে । আলীর মতো তারাও অনেকে ফিরে আসেনি । সুলতান তাদেরও ফিরে আসার প্রতীক্ষা করছিলেন।

সুলতান আইয়ুবীর বিস্বয়কর সাফল্যের গোপন রহস্য ছিল, তিনি কখনো অন্ধকারে পথ চলতেন না। কোথাও যাওয়ার দরকার হলে গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে সেখানকার অবস্থা ও পরিস্থিতি, অসুবিধা ও ভীতির কারণগুলো আগেই জেনে নিতেন । তার গোয়েন্দা বিভাগও ছিল একটু ব্যতিক্রমধর্মী । তারা যেমন ছিল বিশ্বস্ত তেমনি ছিল চৌকস । তাদের কেবল গোয়েন্দাগিরিই শেখানো হতো না, বরং ছদ্মবেশ ও অভিনয়ে তারা যেমন নিপূণ হতো তেমনি গেরিলা যুদ্ধ বা কমান্ডো লড়াইয়েও হতো অসম্ভব পারদর্শী । এ জন্য তাদেরকে বলা হতো লড়াকু গোয়েন্দা । খালি হাতের যুদ্ধেও তারা ছিল খুবই দক্ষ ।

আলী বিন সুফিয়ানকে আল্লাহ গোয়েন্দাগিরি ও তথ্য অনুসন্ধানের নোইপূণ্য দিয়েই সৃষ্টি করেছিলেন । সুলতানের নির্দেশে তিনি যখন তার বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তখন বাহিনীকে তিনি বললেন, ‘অন্যান্য বারের চাইতেও এবার তোমাদের বেশী সতর্ক থাকতে হবে, নির্ভুল তথ্য আনতে হবে । তোমাদের দেয়া রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এবার সুলতান যে পদক্ষেপ নেবেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । ইসলামের স্থায়িত্বের জন্য এই অভিযানের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করবে তোমাদের সঠিক তথ্যের ওপর ।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top