৪. ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

দীর্ঘদিন থেকে সুলতান মিসরে অনুপস্থিত। বেড়ে গেছে বিরোধীদের তৎপরতা। খ্রিস্টানরা উস্কে দিয়েছে পদচ্যুত ফাতেমী খেলাফতের অংশীদারদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন। খ্রিস্টান গোয়েন্দায় ভরে গেছে সমগ্র কায়রো। অর্থ আর নারী দেহের উষ্ণতায় নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছে সুলতানের বিশ্বস্ত কয়েকজন। গোয়েন্দা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইহুদি যুবতীদের কুটজালে ধরা ‍দিয়েছে প্রশাসনের উচ্চভিলাষী কতিপয় কর্মকর্তা। ওদের জাতীয় চেতনাবোধ নিঃশেষ হয়ে গেছে। ক্ষমতার মোহে বিভোর এসব ব্যাক্তিদের হারেমের শোভাবর্ধন করছিল খ্রিস্টানদের রুপসী গোয়েন্দা যুবতীরা।

 ঘাতক দলের সদস্যরা ছিল আরও তৎপর। মিসর এখন ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের লীলাভূমি। অবস্থা এমন যে, কেবলমাত্র কোন অলৌকিক ঘটনাই মিসরকে রক্ষা করতে পারে।

 খ্রিস্টানদের সহযোগিতায় সুদানীরা মিসর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। সেনাবাহিনীর এক অংশ বিদ্রোহের জন্য তৈরী। ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের চোখে ঘুম নেই। সালাহউদ্দীন আয়ুবী সময়মত না এলে মিশর রক্ষা করা যাবে না। একসঙ্গে ভেতরের এবং বাইরের মোকাবিলা করা ভারপ্রাপ্ত গভর্ণরের পক্ষে সম্ভব নয়।

 খিজরুল হায়াত। দ্বীনদার এবং বিশ্বস্ত। মিসরের অর্থ সচিব। সাদামাটা জীবন পছন্দ করেন, অমায়িক। সুলতান নিজেই তাকে অর্থ সচিবের পদে নিয়োগ দিয়েছেন। যোগ্যতা এবং আন্তরিকতার সাথে মিসরের অর্থনীতি পুনঃ বিন্যাস করেছেন তিনি। এক রাতে বাইরে থেকে ফিরেছেন হায়াত। সবেমাত্র বাড়িতে পা রেখেছেন। আঁধার ফুঁড়ে ছুটে এল একটা তীর। বিধঁল খিজরুল হায়াতের পিঠে। এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল। উপর হয়ে পড়ে গেলেন তিনি। কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এল ব্যথাভরা চিৎকার। চিৎকার শুনে চাকর বাকররা ছুটে এল। ছুটে এল পরিবার পরিজন। ঘটনার আকস্মিকতায় থ’ হয়ে গেছে সবাই। কারও মুখে কথা নেই। মারা গেছেন খিজরুল হায়াত। একজন চাকর লক্ষ্য করল মৃত্যুর পূর্বে তিনি মাটিতে কিছু লেখার চেষ্টা করছিলেন। চাকরটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মাটিতে লিখা মুসলেহ। ‘হ’ টা অর্ধেক লিখেছেন হত্যাকারীর পুরো নাম লিখার পূর্বেই মারা গেছেন তিনি। লিখাটা সংরখন করে লাশটা তুলে নেয়া হল। একজনকে পাঠিয়ে দেয়া হল পুলিশ প্রধান গিয়াস বিলকিসের কাছে। গিয়াস ছিলেন সুলতানের বিশ্বস্ত। আলী বিন সুফিয়ানের মত অপরাধ দমনে অভিজ্ঞ।

 সংবাদ পেয়েই ছুটে এলেন গিয়াস বিলকিস। গভীর মনযোগ দিয়ে নামটি দেখলেন। ততোক্ষণে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান মুসলেহ উদ্দিনও ছুটে এসেছেন। গিয়াস দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলেন তাকে। সন্তর্পণে মাটির লেখাটা পা দিয়ে মুছে ফেললেন।

 ‘যত তারাতাড়ি সম্ভব হত্যাকারীকে খুঁজে বের করুন।’ বললেন উপ-রাষ্ট্রপ্রধান। ‘আগামীকাল ভোরেই আমি অপরাধীকে দেখতে চাই।’

 ‘আমি অপরাধীকে খুঁজে বের করব স্যার।‘ পুলিশ প্রধানের কন্ঠ।

 সবাই ফিরে গেলেন। রাতে গিয়াস খিজরুল হায়াতের সহকারী অফিস স্টাফসহ তার নিকটস্থ লোকদের ডেকে পাঠালেন। ওদের কাছে জানা গেল, আজ হায়াত সচিবদের এক মিটিংয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন। সংগে ছিলেন সহকারি। মিটিংয়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে সামরিক বাজেটের প্রসংগ আসে। হায়াত বললেন, ‘সুলতান সুবাকে নতুন ফৌজ ভর্তি করেছেন। ওদের বেতনাদি দিতে হলে মিসরে অপ্রয়োজনীয় বাজেট কমাতে হবে।’

 এর বিরোধীতা করলেন উপ-রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি বললেন, ‘নতুন সৈন্য ভর্তি করার পূর্বে আমাদের সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই সেনাবাহিনী সাদা হাতীতে পরিণত হয়েছে। মিসরের ফৌজ অশান্ত হয়ে আছে। তাদের অভিযোগ, সুবাকে প্রাপ্ত গনিমতের মাল থেকে তাদেরকে কিছুই দেয়া হয়নি।’

 ‘আপনি কি জানেন না, গনিমতের সম্পদ ভাগ-বাটোযারা করে দেয়ার নিয়ম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে?’

 হায়াত বললেন, ‘চমৎকার সিদ্ধান্ত। যারা গনিমতের জন্য যুদ্ধ করে তাদের ভেতর জাতীয় চেতনাবোধ বা ধর্মীয় মূল্যবোধ থাকে না।’

 এক পর্যায়ে এ আলোচনা বিতর্কে রূপ নিল। উত্তেজিত হয়ে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান বললেন, ‘সুলতান মিসরীয় সৈন্যদের সাথে ভাল ব্যবহার করেন না, যেমনটি করেন সিরীয় এবং তুর্কি সৈন্যদের সাথে।’

 ‘মনে হচ্ছে খ্রিস্টান এবং ফাতেমীরা আপনার মুখ দিয়ে কথা বলছে।’

 উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে মিটিং সমাপ্ত করে দেয়া হল। অর্থ সচিবের সহকারী জানালেন, মিটিং শেষে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান স্যারের অফিসে এলেন। এখানেও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হল। স্যার উপ-রাষ্ট্রপ্রধানকে বললেন, ‘আমি সুলতানের কাছে এ প্রসংগ তুলব। বলব, আপনি ভর জলসায় সবাইকে বুঝাতে চেয়েছেন যে সেনাবাহিনী অশান্ত। আপনি বলেছেন, সুলতান সবার সাথে সমান ব্যবহার করেন না এবং গনিমতের মাল মিসরের সৈন্যদের না দিয়ে অন্য সৈন্যদের দিচ্ছেন। এছাড়া আপনি আমাকেও আপনার দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছেন। উপ-রাষ্ট্রপ্রধান কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় বললেন, ‘তুমি বেঁচে থাকলে তো সুলতানকে এসব জানাবে।’

 উপ-রাষ্ট্রপ্রধানকে গিয়াস কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। কারণ পুলিশ বিভাগ তার অধীন। উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোলার পূর্বে অবশ্যই প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে। পুলিশ প্রধান বুঝলেন এ হত্যা ব্যাক্তিগত কারণে হয়নি। তিনি গোপনে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা করতে লাগলেন।

 পুলিশ প্রধান বিভিন্ন প্রমাণে যা জানলেন, তা হল, হত্যা ঘটনার দু’দিন পর মুসলেহ উদ্দীন রাতে বাসায় ফিরলেন। প্রথম স্ত্রী তাকে ডেকে নিলেন নিজের কক্ষে। তিনি ঢুকতেই স্ত্রী বিশটা আশরাফি তার সামনে রেখে বললেন, ‘খিজরুল হায়াতের হত্যাকারী এ বিশ আশরাফি ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।’ স্ত্রী এক টুকরা কাগজ স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। তাতে লেখা ছিল- ‘পঞ্চাশ আশরাফি এবং দু’টুকরা স্বর্ণ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিয়েছেন বিশ আশরাফি। আপনার স্ত্রীর কাছে দিয়ে গেলাম। আমাদের ধোকা দিয়েছেন। এখন একশ আশরাফি এবং দু’টি স্বর্ণের টুকরা দিতে হবে। তা নয়তো একটা তীর খিজরুল হায়াতের মত আপনার হৃদপিন্ডেও গেঁথে যাবে।’

 মুসলেহ উদ্দীনের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কিছুটা সংযত হয়ে বললেন, ‘তুমি কি বলছ? ওরা কারা? কাউকে আমি কোন আশরাফি দেয়ার কথা বলিনি। বিশ্বাস কর, হায়াতের হত্যার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’

 তুমিই হায়াতকে হত্যা করেছ। কি কারণে জানি না, তবে তুমি যে তার হত্যাকারি এতে কোন সন্দেহ নেই।’

 মুসলেহ উদ্দীনের প্রথম স্ত্রী সাবেরা। বয়স ত্রিশের কোঠায়, সুন্দরী। দেহের গাঁথুনি এখনও অটুট। পুরুষকে আকর্ষণ করার মত রূপ এখনও তার রয়েছে। মাস খানেক পূর্বে অপরূপা একজন তরুনীকে বাড়ী নিয়ে এসেছেন মুসলেহ উদ্দীন। এরপর থেকেই প্রথম স্ত্রীর কক্ষে যাওয়া বন্ধ। কয়েক দিনই তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সাবেরা, কিন্তু তিনি যাননি। তখন একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা বেআইনী ছিল না। স্ত্রীরাও এতে কিছু মনে করতেন না। হত্যাকারীদের চিঠি পেয়ে ভড়কে গেলেন সাবেরা। স্বামীর অকল্যাণ কল্পনায় কেঁপে উঠল তার মন। এজন্যই তাকে ‍নিজের কক্ষে ডেকে এনেছিলেন।

 ‘মুখ বন্ধ রাখবে সাবেরা।’ গম্ভীর কন্ঠে বললেন মুসলেহ উদ্দীন। ‘এ হচ্ছে আমার দুশমনের একটা চাল। তারা তোমার এবং আমার মাঝে শত্রুতা সৃষ্ঠি করতে চাইছে।’

 ‘আমার বিরুদ্ধে শত্রুতা ছাড়া তোমার মনে কি অন্য কিছু আছে?’

 ‘তোমায় আমি ভালবাসি সাবেরা। সেই প্রথম দিনের মত। তুমি কি ওদের কাউকে চিনতে পেরেছ?’

 ‘ওরা মুখোশ পরেছিল। তবে তোমার মুখোশ খুলে গেছে। তোমায় আমি চিনে গেছি।’

 স্বামী কিছু বলতে চাইছিলেন। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে সাবেরা বলল, ‘সম্ভবতঃ তুমি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ আত্মসাৎ করেছ। জেনে ফেলেছে সচিব। এ জন্যই গোপন আততায়ীর মাধ্যমে তাকে খুন করেছ।’

 ‘কেন আমায় মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ। কোষাগারের অর্থ আমি কেন আত্মসাৎ করতে যাব?’

 ‘তোমার না হলেও যে ফিরিংগী মেয়েটাকে বিয়ে ছাড়া সাথে রেখেছ তার প্রয়োজন আছে। তোমার মদ কেনার জন্য টাকার দরকার। যদি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে চাও তবে বল ঘোড়াগাড়ী বোঝাই করে কি এনেছ? তোমার হারেমে প্রতিদিন নতুন নর্তকী আসছে বিনে পয়সায়? তোমার মদের আসরে যে টাকা খরচ হয় তা কোত্থেকে আসে?’

 ‘চুপ কর সাবেরা। ওরা কারা আমাকে একটু খোঁজ নিতে দাও। ইস! কি ভয়ংকর চাল চেলেছে। ক’দিন পরই সত্যি ঘটনা তুমি বুঝতে পারবে।’

 ‘না, আমি চুপ থাকব না। আমার বুকে তুমি প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছ। মিসরের সব লোককে ডেকে ডেকে একথা বলব। অলি-গলিতে চিৎকার করে বলব তুমি খিজরুল হায়াতের হত্যাকারী। হত্যা করেছ আমার ভালবাসা। এ হত্যার প্রতিশোধ আমি নিব।

 স্ত্রীকে অনেক অনুনয় বিনয় করে মুসলেহ উদ্দীন বললেন, ‘আমাকে দু’দিন সময় দাও। দু’দিনের মধ্যেই আমি ওদের খুঁজে বের করে প্রমাণ করব হায়াতকে আমি হত্যা করিনি। পুলিশ প্রধান সন্দেহজনক কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যে আসল খুনীকেও পাকড়াও করতে পারবে।’

 পেরিয়ে গেল রাত। পর দিনও। মুসলেহ উদ্দিন বাড়ী ফেরেননি। ফিরিংগী মেয়েটাকেও কোথাও দেখা গেল না। সন্ধায় বাড়ী ফিরলেন মুসলেহ উদ্দিন। সোজা চলে গেলেন স্ত্রীর কক্ষে। আদুরে গলায় কথা বললেন। শোনালেন ভালবাসার কথা। সাবেরা তার ধোকার জালে পা দিতে চাইলেন না। কিন্তু জাত খেলুড়ে মুসলেহ উদ্দীনের কপট ভালবাসার ফাঁদে এক সময় ধরা দিলেন স্ত্রী।’

 ‘আমি দু’দিন পর্যন্ত ওই দু’জন কে খুঁজছি। এখনও পাইনি। আশা করি পেয়ে যাব। আমি যে হত্যাকারী নই তখন তোমায় আশ্বস্ত করতে পারব।’

 আরও অনেক কথা বললেন মুসলেহ উদ্দীন। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন সাবেরা। কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। চাকর-বাকরদের ছুটি দিয়ে দিলেন। সমগ্র বাড়ীতে নেমে এল কবরের নিরবতা। পাহারাদার কুকুরটাকে বাড়ীর এক কোণে বেঁধে রেখে নিজের কক্ষে ফিরে এলেন মুসলেহ উদ্দিন।

 মাঝ রাত। বাইরের পার্টিশন ঘেঁষে দাঁড়াল এক মুখোশধারী। তার কাঁধে পিঠে দাঁড়াল দ্বিতীয় জন। তৃতীয় ব্যাক্তি তার কাঁধে উঠে পার্টিশনের ভেতর লাফিয়ে পড়ল। খুলে দিল প্রহরীহীন ফটক। বাড়ীর করিডোরে উঠে এল তিনজনে। এগিয়ে চলল বিড়ালের মত নিঃশব্দে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওরা সাবেরার কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে ঢুকল তিনজন। একজন হাত ছোঁয়াল সাবেরার মুখে। স্বামীর হাত ভেবে আকড়ে ধরে সে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

 কোন জবাব না দিয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেলল একজন। বেঁধে দিল হাত। পাজা কোলা করে একটা বস্তায় ঢুকিয়ে কাঁধে তুলে নিল। চাকর বাকর কেউ নেই। বিনা বাধায় ওরা বেরিয়ে গেল। খানিক দূরে একটা গাছের সাথে তিনটে ঘোড়া বাঁধা ছিল। রশি খুলে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল তিনজন। বস্তা তুলে নিল একজন। মিসর পিছনে ফেলে ইস্কান্দারিয়ার দিকে ছুটে চলল ঘোড়াগুলো।

 সকালে চাকর-বাকররা ফিরে এল। মুসলেহ উদ্দীন ওদেরকে সাবেরার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তন্ন তন্ন করে সারা বাড়ী খোঁজা হল। সাবেরা কোথাও নেই। এক চাকরাণীকে একান্তে ডেকে নিলেন মুসলেহ উদ্দীন। অনেকক্ষণ কথা বললেন দু’জন। এরপর তাকে নিয়ে গেলেন পুলিশের কাছে। মুসলেহ উদ্দীন বললেন, ‘আমার স্ত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বিশ্বাস হায়াতকে ওই হত্যা করিয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি যে মুসলেহ উদ্দীনের স্ত্রী। কিন্তু পারেননি। এই চাকরাণীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।’

 পুলিশ প্রধানের প্রশ্নের জবাবে চাকরাণী বলল, ‘পরশু রাতে দু’জন লোক এসেছিল। আমার মুনিব তখন ছিলেন না। দেখলাম মুখোশ পরা দু’ব্যাক্তি, ওরা বেগম সাহেবের সাথে দেখা করতে চাইল। বাড়ীতে কোন পুরুষ না থাকায় আমি বললাম, এখন দেখা হবে না। ওরা বলল, ‘বেগম সাহেবের এই বিশটি আশরাফি ফেরত দিতে এসেছি।’ আমি বেগম সাহেবকে বলতেই তিনি দু’জনকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমাকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। বললেন, ‘কেউ এলে যেন তাকে সতর্ক করে দেই।’

 বাইরে থেকে আমি শুনলাম দু’জন কঠোর ভাষায় কথা বলছে আর বেগম সাহেবা অনুনয় বিনয় করছেন। তিনি আরও বললেন, আলি বিন সুফিয়ানের সহকারী হাসানকে হত্যা করতে পারলে পঞ্চাশ আশরাফি এবং দু’টি স্বর্ণের টুকরা দেবেন। এই বিশ আশরাফি বেগম সাহেবা কিভাবে দিয়েছেন আমি জানি না। ওরা পঞ্চাশ আসরাফি দাবী করছিল। বেগম সাহেবা বললেন, ‘তোমরা ভুল লোককে মেরেছ। হাসানকে মারতে পারনি।’

 ওরা বলল, ‘তুমি যে সময়ের কথা বলেছ ঠিক সে সময় এ লোকটি বাড়ীতে ঢুকেছিল। লোকটি হাসান না অন্য কেউ আমরা দেখিনি। আমরা তীর ছুঁড়ে পালিয়ে গেছি।’

 পঞ্চাশ আশরাফি দেয়ার জন্য ওরা বেগম সাহেবাকে চাপ দিচ্ছিল। বেগম সাহেবা বললেন, ‘আসল লোককে হত্যা করতে পারলে পঞ্চাশ আশরাফি এবং দুটো সোনার টুকরা দেব।’ কিন্তু ওরা বলল, ‘যে কাজ করেছি আগে তার বিনিময় দাও, তারপর অন্য কাজ।’ বেগম সাহেবা অস্বীকার করায় ওরা বলল, ‘টাকা কিভাবে ওসুল করতে হয় আমরা জানি।’ এরপর ওরা দু’জন চলে গেল। বেগম সাহেবা আমায় ডেকে বললেন, ‘খবরদার, এসব কথা কাউকে বলবে না। আমাকে তিনি দুটো আশরাফিও দিয়েছেন। আজ সকালে তার কক্ষে গিয়ে দেখি তিনি নেই। আমার মন বলছে টাকা না দেয়ায় সে দু’জন লোকই তাকে অপহরণ করেছে।’

 পুলিশ প্রধান মুসলেহ উদ্দীনকে বসিয়ে রেখে চাকরাণীকে নিয়ে অন্য কক্ষে চলে এলেন।

 ‘এবার বল এ কথা তোমায় কে শিখিয়েছে, মুসলেহ উদ্দীন, না সাবেরা?’

 ‘এ জবানবন্দী আমার নিজস্ব।’

 ‘সত্যি করে বল সাবেরা কোথায়? কার সাথে গিয়েছে?’

 চাকরাণী ভয় পেয়ে গেল। পুলিশ প্রধানকে কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না। গিয়াস বললেন, ‘কিভাবে সত্যি কথা বের করতে হয় আমি জানি। তুমি এখন ফিরে যেতে পারবে না। পুলিশের শাস্তি সেলের কথা শুনেছ?’

 বিবর্ণ হয়ে গেল চাকরাণীর চাহারা। সে জানত, পুলিশের শাস্তি সেলে সত্য মিথ্যা আলাদা হওয়ার আগে দেহের হাড়গোড় আলাদা হয়ে যায়। সে কাঁদতে লাগল।

 ‘দেখুন, আমি এক গরীব মেয়ে। সত্যি কথা বললে মুনিব শাস্তি দেবেন। মিথ্যা বললে আপনারা।’

 ‘তোমার কোন ভয় নেই। তোমার নিরাপত্তার জিম্মা আমি নিচ্ছি।’

 চাকরাণী বলল, ‘হত্যার দ্বিতীয় দিন একজন মুখোশধারী এসেছিল। মুনীব বাড়ী ছিলেন না। লোকটা ছিল ফটকের বাইরে। বেগম সাহেবা ভিতরে। কি কথা হয়েছে আমরা কেউ শুনিনি। মুখোশধারী চলে গেলে বেগম সাবেরা ফিরে এলেন। হাতে ছিল একটা প্যাকেট। একরাত পর মুনীব আমাদের সবাইকে একরাতের জন্য ছুটি দিলেন।’

 ‘ইতিপূর্বেও কি সবাইকে সারা রাতের জন্য ছুটি দিয়েছিলেন?’

 ‘কখনও না। একজন ছুটিতে গেলে অন্য সবাই থাকত। আরো আশ্চর্য হল, কুকুরটাকে কখনও বেঁধে রাখা হয়না। ভয়ংকর কুকুর। অপরিচিত লোক দেখলেই ঝাপিয়ে পড়ে। সে রাতে মুনিব নিজেই গেলেন কুকুরটাকে বেঁধে রাখতে।’

 ‘মুসলেহ উদ্দীনের সাথে সাবেরার সম্পর্ক কেমন ছিল?’

 ‘ইদানীং খুব খারাপ। মুনিব একটা সুন্দরী ফিরিংগী মেয়েকে বাড়ী আনার পর থেকে বেগম সাহেবার সাথে কথা বলেন না।’

 চাকরাণীকে বসিয়ে রেখে পুলিশ প্রধান উঠে গেলেন। ফিরে এলেন দু’জন সিপাই নিয়ে। সিপাইরা মুসলেহ উদ্দীনের দু’বাহু ধরে নিয়ে যেতে চাইল। প্রতিবাদ করলেন তিনি। পুলিশ প্রধান বললেন, ‘একে জেলে নিয়ে যাও। তার বাড়ী সীল করে পাহারার ব্যবস্থা কর। কাউকে বাইরে যেতে দেবে না।’

 কায়রোর উত্তরে এক সবুজ শ্যামল প্রান্তর। দুরত্ব অনেক। চারপাশে উঁচুনিচু পাহাড়। পাহাড় থেকে প্রান্তর ছুয়ে বয়ে গেছে ঝর্ণা ধারা। পূব আকাশ রাংগা হয়ে উঠেছে। অপহরণকারীরা ঘোড়া থামাল। নেমে এল তিনজন। বস্তার মুখ খুলে সাবেরাকে বের করে আনল। মুখের কাপড় সরিয়ে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সাবেরা অচেতন না হলেও অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল। চিৎকার করারও শক্তি নেই। ওরা তাকে পানি পান করাল। খেতে দিল খেজুর আর রুটি। শীতল বাতাসে ওর শক্তি ফিরে এল। আচম্বিত সাবেরা উঠে দাঁড়াল। দৌড়ে টিলার আড়ালে চলে গেল। একজন মুখোশধারী ঘোড়ায় চেপে ছুটল ওর পেছনে। ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল সাবেরা। মুখোশধারী তাকে ঘোড়ায় তুলে সংগীদের কাছে ফিরে এল।

 ‘পালিয়ে যেতে চাইলে যাও।’ বলল একজন। ‘কোথায় যাবে? এখান থেকে একজন শক্তিশালী পুরুষও এভাবে কায়রো পৌঁছাতে পারবে না।’

 সাবেরা কেঁদেকেটে ওদের গালাগালি করতে লাগল।

 ‘কায়রো ফিরে যেতে চাইলে যাও। কিন্তু ওখানে গেলেও মরবে। তোমার স্বামীই তোমাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।’

 ‘মিথ্যে কথা।’

 ‘মিথ্যে নয়, সত্য। মজুরী হিসেবে তোমায় দিয়েছে। তোমার হাতে আমরাই আশরাফি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি তাকে বলেছ সে সচিবকে হত্যা করেছে। তুমি আরও বলেছ, এসব কথা পুলিশ প্রধানকে বলে দেবে। আগে থেকেই সে তোমার ওপর বিরক্ত। ফিরিংগী মেয়েটা তার মন দখল করে রেখেছে। মেয়েটা কে, কোথা থেকে এসেছে তোমাকে তা বলা যাবে না। পরদিন তোমার স্বামী আমাদের কাছে এল। আস্ত বেঈমান। বলেছিল কাজটা করলে পঞ্চাশ আশরাফি আর দু’টি সোনার টুকরা দেবে। কিন্তু কাজ শেষে পাঠাল বিশ আশরাফি। আমরা তোমাকে ব্যবহার করলাম। তোমার কাছে টাকা দেয়ার অর্থ যেন তুমিও ব্যাপারটা জানতে পার। বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে। পরদিন পঞ্চাশ আশরাফি দিল। স্বর্ণের টুকরা দিল না। আমরা বললাম, ‘এখন পঞ্চাশে চলবে না। আরও বেশী দিতে হবে। না দিলে খবরটা পুলিশ প্রধানের কানে তুলে দেব।’

 তার জন্য সমস্যা ছিল ব্যাপারটা তুমি জেনে ফেলেছ। সে বলল, ‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাও। ওকে বিক্রি করে অনেক টাকা পাবে।’

 সাবেরার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সে হতভম্বের মত তিন অপহরণকারীকে দেখতে লাগল। মুখোশের মাঝখান দিয়ে দুটো করে চোখ দেখা যাচ্ছে। হিংস্র এবং ভয়ংকর। ওদের কণ্ঠে কোন হিংস্রতা ছিল না। ওরা বরং তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে, এখান থেকে পালানো সম্ভব নয়।

 ‘আমি তোমাকে একবার দেখেছিলাম’, বলল একজন।

 ‘তোমার স্বামীর প্রস্তাব শুনে ইস্কান্দারিয়ার বাজারে তোমাকে কত বিক্রি করা যাবে মনে মনে হিসাব করলাম। তুমি যুবতী, সুন্দরী। তোমাকে অনেক দামে বিক্রি করা যাবে। আমরা রাজি হলাম।’ তোমার স্বামী বলল, ‘রাতে আমার চাকর-বাকররা থাকবে না। কুকুরটাকেও বেঁধে রাখা হবে। রাতে এসে ওকে তুলে নিও।’ এ পারশ্রমিক না পেলে আমরা তাকে হত্যা করতাম। অপহরণ করতাম ফিরিংগী মেয়েটাকে। আমরা রাতে তোমাকে তুলে নিয়ে এলাম।’

 ‘তোমাকে এসব কথা বলার কারণ, তুমি স্বামীর ঘরের কথা ভুলে যাও।’ বলল দ্বিতীয় জন। ‘আমরা অসহায় কোন নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করিনা। আমরা ব্যবসায়ী। অপহরণ এবং টাকার বিনিময়ে হত্যা করা আমাদের পেশা। তিনজন পুরুষ একজন নারীকে অপহরণ করে ভোগ করার মধ্যে কোন গর্ব নেই।’

 ‘তোমরা কি আমাকে ইস্কান্দারিয়ার বাজারে বিক্রি করবে?’ কাঁপা কণ্ঠে সাবেরা জিজ্ঞেস করল। ‘শেষ পর্যন্ত এই কি হবে আমার কপালের লিখা?’

 ‘না, খারাপ কাজের জন্য জংলী এবং বেদুইন মেয়েদের ক্রয় করা হয়। তুমি সম্মানিতা গৃহ বধু। কোন আমীরের ঘরেই তুমি যাবে। আমরাও দামটা বেশী পাব। এখন কান্নাকাটি বন্ধ কর। কাঁদলে চেহারার লাবণ্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে বাজারে-মেয়ে হিসাবেই বিক্রি করতে হবে। এবার শুয়ে পড়। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও।’

 সাবেরা আশ্চর্য হয়েছে এতক্ষণ সময়ের মধ্যে এদের কেউ তার সাথে অশালীন আচরণ করেনি দেখে। মনে মনে স্বস্তিও পেয়েছে। রাতভর বস্তাবন্দী থেকে সমস্ত শরীর ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমিয়ে পড়ল ও। ঘুম ভেংগে গেল হঠাৎ। তার মাথায় চাপে আছে ভয় এবং আতংক। মনের দিক থেকে সে এ পরিণতিকে গ্রহণ করতে পারছে না। আড়চোখে তাকাল তিনজনের দিকে। ঘুমুচ্ছে ওরা। একবার ভাবল খঞ্জর বের করে ওদের হত্যা করে। বাতিল করে দিল চিন্তাটা। একা তিনজনের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। চোখ পড়ল পাশে বাঁধা ঘোড়ার ওপর। পিঠে জিন বাঁধা। ও উঠে পড়ল। আলতো পায়ে এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে। সূর্য নেমে গেছে টিলার ওপাশে। কায়রো কোন দিকে জানে না ও। তবুও বাঁচতে হলে পালাতে হবে ওকে। প্রয়োজনে বিশাল মরুর বিস্তারে ধুকে ধুকে মরবে, তবুও এদের হাতে সম্ভ্রম নষ্ট হতে দেবে না। আলগোছে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল সাবেরা। ছুটিয়ে দিল ঘোড়া।

 ঘোড়ার পদশব্দে তিনজনের ঘুম ভেংগে গেল। দু’জন দুটো ঘোড়ায় চেপে ছুটল তার পেছনে। টিলার বেষ্টনী থেকে বের হবার পথ জানা নেই সাবেরার। সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল এক পাহাড়। পেছনে তাকাল ও। ধাওয়াকারীরা কাছে চলে এসেছে। ঘোড়াসহ পাহাড়ে উঠতে লাগল সাবেরা। উপরে উঠে তাকাল বিপরীত দিকে, পথ পেয়ে গেল। নেমে এল নীচে। ধাওয়াকারীরাও তার পেছনে আসছে। কাছে চলে এসেছে ওরা। সামনে সমুদ্র। সমুদ্রের দিক থেকে আসছে চারজন উস্ট্রারোহী। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না ও। সাবেরা চিৎকার শুরু করলঃ ‘বাঁচাও, বাঁচাও, ডাকাতের হাত থেকে বাঁচাও।’

 ঘোড়া পৌঁছে গেল উস্ত্রারোহীদের কাছে। উস্ট্রারোহীদের দেখে মুখোশধারীরা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল। ওদের পিছু নিল উটের আরোহীরা। একজন ধনুকে তীর জুড়ে দু’জনকে লক্ষ্য করে ছুড়ল। বিঁধল এক ঘোড়ার ঘাড়ে। ঘোড়ার লাফালাফিতে পড়ে গেল সওয়ার। চার জন মিলে ওপর অশ্বারোহীকে ঘিরে ফেলল। একজনের পক্ষে চারজন তীরন্দাজের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, সে আত্মসমর্পণ করল। সাবেরা ওদের বলল, ‘এদের একজন ওপাশে রয়েছে।’ ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া আরোহীসহ তিনজনকেই গ্রেপ্তার করা হল।

 এ চারজন উস্ট্রারোহী ছিল সুলতান আয়ুবীর সেনা বাহিনীর সদস্য। সাগর উপকূল এবং সমগ্র মরুভূমিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেনা দল পেট্রোল ডিউটিতে রত ছিল। আচম্বিত শত্রুর আক্রমণ যেন না আসতে পারে এ জন্যই এই ব্যবস্থা। এরা কয়েক বারই বিপজ্জনক খ্রিস্টান গোয়েন্দাদের ধরে সুলতানের সামনে হাজির করেছে। সাবেরা সৈন্যদেরকে অপহরণের পুরো কাহিনী শোনাল। সে বলল, ‘উপ-রাস্ট্রপ্রধান আমার স্বামী। এ তিন ভাড়াটে খুনীদের দিয়েই তিনি অর্থ সচিবকে হত্যা করিয়েছেন। আমাকেও তুলে দিয়েছেন এদের হাতে।’

 তিন অপহরণকারীর অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হল। হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দুটো ঘোড়ায় করে ওদেরকে সৈন্যরা কমান্ডারের কাছে নিয়ে গেল। সাবেরা বসল উটের পিঠে। সূর্য ডোবার পূর্বেই এরা চার মাইল পথ অতিক্রম করল। সামনের মরুদ্যানে তাবু টানানো। ডিউটিরত সেনা দলের হেড কোয়ার্টার। ওরা সাবেরাকে নিয়ে গেল কমান্ডারের সামনে। কঠোর প্রহরায় তিন অপহরণকারীকে বসানো হল তাবুর বাইরে। আগামীকাল এদের কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে।

 খ্রিস্টানদের পদতলে পিষ্ট হচ্ছিল প্রিয় ফিলিস্তিন। মুসলমানদের রক্তে ভিজে যাচ্ছিল পবিত্র ভূমির বালুকারাশি। দুর্দশার কালো মেঘ থেকে ঝরে পড়ছিল অত্যাচারের অগ্নি বৃষ্টি। অসহনীয় নির্যাতনের দুঃসহ ব্যথায় কাৎরাচ্ছিল তৌহিদী জনতা। এমনি এক দুঃসময়ে সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী পা রাখলেন ফিলিস্তিনের মাটিতে।

 সুবাক এখন মুসলমানদের দখলে- দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এ সংবাদ ফিলিস্তিনের মুসলমানদের হৃদয়ে জ্বেলে দিল আশার প্রদীপ। অনাগত মুক্তির আনন্দে হিল্লোলিত হল প্রাণ। কিন্তু ওদের এ অব্যক্ত আনন্দ দুর্বিসহ বেদনা হয়ে দেখা দিল। খ্রিস্টানরা প্রতিশোধের আগুনে পুড়িয়ে দিল জেরুজালেম এবং আশপাশের জেলাগুলোর মুসলিম বসতি। এভাবেই মুসলমানদের ওপর সুবাক দুর্গ হারানোর শোধ তুলতে লাগল ওরা।

 মুসলমানদেরকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ঘৃণ্য তৎপরতায় মেতে ওঠা খ্রিস্টানরা সুবাকের পর ক্রাক নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ল। আয়ুবী যেন ক্রাক আক্রমণ করতে না পারে এ জন্য ক্রাকে চলল নির্বিচারে মুসলিম হত্যা। বুদ্ধির খেলায় হেরে গেছে ওরা। হাতছাড়া হয়েছে সুবাক দুর্গ। ক্রাক হাতছাড়া করা যাবে না। স্তব্ধ করে দিতে হবে আয়ুবীর অগ্রযাত্রা। ক্রাকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করার পাশাপাশি তাই ওরা স্থানীয় মুসলমানদের শিরদাড়া ভেংগে দেয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠল। এখানেও খোলা হল বেগার ক্যাম্প। সামান্য সন্দেহ হলেই মুসলমানদেরকে নিক্ষেপ করতে লাগল সে ক্যাম্পে।

 ‘ফিলিস্তিন বিজয় আমাদের মহান উদ্দেশ্য। কিন্তু ক্রাক থেকে নির্যাতিত মুসলমানদেরকে বের করে আনা তারচে বড় উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।’ সুলতান আয়ুবীকে বলল গোয়েন্দা সংস্থার একজন গ্রুপ কমান্ডার, নাম তালাত চেঙ্গিস। তালাত একজন তুর্কী মুসলমান। সুবাক থেকে পালিয়ে যাওয়া খ্রিস্টানদের ছদ্মবেশে ক্রাকে পৌঁছে ছিল সে। ফিরে এসেছে তিন মাস পরে। গোয়েন্দা প্রধানের সামনেই তালাত সুলতানকে ক্রাকের রিপোর্ট দিচ্ছিল। ‘যে সব খ্রিস্টান সৈন্য’ লুকিয়ে ক্রাক পৌঁছেছে ওদের অবস্থা ভাল নয়। সহসা যুদ্ধের জন্য তৈরী হতে পারবে না ওরা। তবে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে ওরা স্থানীয় মুসলমানদের ওপর। পুরুষদেরকে এলোপাথাড়ি গ্রেপ্তার করছে। মেয়েরা বাড়ী থেকে বের হতে পারছে না। আমরা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য ওখানকার মুসলিম যুবকদেরকে গোপনে সংগঠিত করতে শুরু করেছিলাম। কিছু যুবক পালিয়ে এসে ভর্তিও হয়েছে। কিন্তু চারদিকে খ্রিস্টান সৈন্য থাকায় অধিকাংশই ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আসতে পারছে না। তাছাড়া পরিবার-পরিজন ছেড়ে আসতে অনেকের অসুবিধা হচ্ছে।

 সবচে বিপদের কথা হল, কারো ওপর সন্দেহ হলেই তাকে বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এখনই ক্রাক আক্রমণ করে মুসলমানদেরকে এ নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি দেয়া আমাদের কর্তব্য।’

 এর আগে গোয়েন্দারা বলেছিল সুলতান ক্রাক আক্রমণ করলে রিমান্ড তার বাহিনী নিয়ে পেছন থেকে আক্রমণ করবে। সুলতানও সেনা অফিসারদের কাছে পূর্বেই এমন আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন। এ জন্য সেনা সদস্য বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল।

 সুলতান আয়ুবী তালাতকে বিদায় দিয়ে আলীকে বললেন, আবেগের দাবী হচ্ছে এ মুহূর্তে ক্রাক আক্রমণ করা। ওখানকার মুসলমানরা কি কষ্টের মধ্যে আছে আমি বুঝি। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, শক্তি সঞ্চয় না করে আক্রমণ করো না। নিশ্চিত না হয়ে আক্রমণ করা যুদ্ধনীতির পরিপন্থী। আলী! আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে পুরুষদের। ইসলামের ইতিহাসে ওরা হচ্ছে নামহারা শহীদ। যে কোন জাতিকেই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এমন কোরবানী দিয়ে যেতে হয়। ওদের আব্রু, জীবন এবং ওদের দ্বীনের হেফাজতের জন্যই আমি ফিলিস্তিন শত্রুমুক্ত করতে চাই। সাধারণভাবে যুদ্ধের উদ্দেশ্য আক্রমণ ও লুটপাট ছাড়া কিছুই নয়। যারা স্বীয় জাতির সন্তানদের ভুলে যায়, মুখ বুজে সহ্য করে শত্রুর নির্যাতন, তারা হয়ে যায় ডাকাত ও দস্যুদের সহযোগী। শত্রুর ওপর প্রতিশোধ না তুলে পরস্পরের সম্পদ লুণ্ঠন করে ওরা। প্রতারিত করে অন্যকে। ওদের শাসকরা গরীবের সম্পদ লুটে ভোগ বিলাসে মত্ত হয়। শত্রুরা আক্রমণ করলে অমূলক হম্বিতম্বি করে জনগণকে ধোকা দেয়। শত্রুর সংগে গোপন আঁতাত করে। দেশের কোন অংশ ওদেরকে ছেড়ে দিয়ে রক্ষা করে গদী। ভোগ বিলাসের জন্যই ওরা শুষে নেয় জনগণের শেষ রক্তবিন্দু।

 অনেক জাতির শাসকগণ কেবল রাজ্য বিস্তারের মোহে যুদ্ধ করেছে। বিলাসিতার সময়টা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বইয়ে দিয়েছে রক্তের বন্যা। আজ পৃথিবী থেকে ওদের নামও মুছে গেছে। খ্রিস্টানদের মত আমরাও লড়াইকারী। কিন্তু দু’জনের মধ্যে বিরাট পার্থক্য। ওরা অনেক দূর থেকে এসেছে আমাদের ধর্মের অস্তিত্ব মুছে ফেলার জন্য। এসেছে আমাদের নারীদের অধিকার করে ওদের গর্ভ থেকে খ্রিস্টান জন্ম দেয়ার জন্য। আমরা আত্মরক্ষার জন্য এবং আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্য লড়াই করছি। খ্রিস্টানদের এ ঝড়কে প্রতিরোধ করতে না পারলে আমরা বিবেকহীন, আত্মমর্যাদা শূন্য বলে পরিচিত হবো। আর যদি আমরা বাড়ীতে বসে ওদের আক্রমণের অপেক্ষা করি তবে নিশ্চয়ই আমরা ভীত ও কাপুরুষ বলে চিহ্নিত হবো। প্রতিরোধর নিয়ম হলো, যখনি দুশমন তোমাকে হত্যা করার জন্য তরবারী কোষমুক্ত করবে, আঘাত করার পূর্বেই তোমার তলোয়ার তার শিরোচ্ছেদ করবে। সে আগামী কাল আক্রমণ করতে আসবে জানলে আজই তার মোকাবেলায় নেমে যাও যাতে সে আর আঘাত করার সুযোগ না পায়।’

 ‘নূরুদ্দীন জাংগীর কাছে কি সাহায্য চাওয়া যায় না?’ আলী বললেন, ‘সাহায্য পেলে সাথে সাথেই আমরা ক্রাক আক্রমণ করতে পারতাম।’

 ‘না, তাঁর কাছে সবসময় এমন সৈন্য থাকা দরকার, আমরা পেছন থেকে আক্রান্ত হলে তিনি যেন ওদেরকে পাল্টা আক্রমণ করতে পারেন।’ আয়ুবী বললেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার পক্ষপাতি নই, বরং গেরিলাদের পাঠিয়ে আমরা ওদের ঘুম হারাম করে দিতে পারি। আমার বিশ্বাস, আমাদের গুপ্তচর এবং গেরিলারা মিলে শত্রুর মূল উপড়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু ওখানকার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে এর শাস্তি ভোগ করতে হবে। কারণ, কমান্ডো বাহিনী কাজ শেষে এদিক ওদিক পালিয়ে যাবে। কিন্তু ওখানকার নিষ্পাপ মুসলমান ভাই-বোনগুলো পালাতে পারবে না, তারা শত্রুর হাতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। বিকল্প হিসেবে ওদেরকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসা যায় কিনা দেখ। আক্রমণ করার জন্য আরও কিছু সময় প্রয়োজন। এর মধ্যে আমরা অনেক নতুন রিক্রুটও পেয়ে যাব।’

 ‘আমার মনে হয় এখানকার মুসলমানদের ব্যাপারে আমাদের পলিসি পরিবর্তন করা প্রয়োজন।’ বলল খ্রিস্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।

 ক্রাকের এক দুর্গে ক’জন খ্রিস্টান সম্রাট, উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মিটিং চলছিল। পরাজিত সেনাবাহিনীর দিকে তাকাতেই ওদের ক্রোধ বেড়ে যাচ্ছিল। এ পরাজয়কে ওরা বদলে দিতে চাইছিল বিজয় দিয়ে। এদের মধ্যে কেবল হরমুনই ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করছিলেন। ক্রাকের মুসলমানদের ওপর চলছিল অবর্ণনীয় নির্যাতন। তিনি বললেন, ‘আপনারা এখানকার মুসলমানদের সাথে যেমন ব্যবহার করেছেন আমরাও সুবাকে তেমন করেছিলাম। ফলশ্রুতিতে আমাদেরই এক গুপ্তচর মেয়ে বিপজ্জনক এক বন্দীকে পালাতে সাহায্য করেছিল। সে সুবাক দুর্গের সব কিছু দেখে গেছে। তাছাড়া সালাহউদ্দীন দুর্গপ্রাচীর যেভাবে ভেংগেছে এতে ভেতরের মুসলমানদেরও হাত ছিল। আমাদের ব্যবহারে ওরা এতটা বিরক্ত ছিল যে, জীবন বাজি রেখে ওরা সালাহউদ্দীনের সাহায্য করেছে। এরাই ছিল আয়ুবী সেনাবাহিনীর পথ প্রদর্শক।’

 ‘এ জন্যই আমরা এখানকার মুসলমানদের সাহস এবং আবেগ নিঃশেষ করার জন্য এরূপ নির্যাতন করছি।’ বলল এক সেনা কমান্ডার।

 ‘তার পরিবর্তে ওদেরকে আপনাদের বন্ধুতে রূপান্তরিত করুন, ওরা আপনাদের সাহায্য করবে।’ বলল হরমুন। ‘আমায় অনুমতি দিলে ধর্মান্তরিত না করেই ওদেরকে খ্রিস্টানদের বন্ধুতে রূপান্তরিত করব। তখন ওরা মুসলমানদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে।’

 ‘ভুলে যাচ্ছ হরমুন!’ মুখ খুললেন সম্রাট রিমান্ড। ‘দু’একজন মুসলমানকে নারী দেহ আর টাকার লোভ দেখিয়ে গাদ্দারে পরিণত করা যায় কিন্তু গোটা সেনাবাহিনীকে গাদ্দার বানানো যায় না। হরমুন, ওদের ওপর নির্ভর করো না। ওদের আমরা বন্ধু বানাতে চাইনা, আমরা মুসলমানদেরকে নির্বংশ করতে চাই। কোন অমুসলিম কোন মুসলমানকে ভালবাসলে এর অর্থ হচ্ছে সে ইসলামকেই ভালবাসে। অথচ আমরা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে চাই। ক্রাক, জেরুজালেম, ওফা এবং আদলিসা যেখানেই খ্রিস্টানদের শাসন রয়েছে সেখানেই মুসলমানদের ওপর এতটা নির্যাতন কর যেন ওরা মরে যায়। না মরলেও খ্রিস্টানদের সামনে মাথানত করে রাখে।’

পেজঃ ১ম পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top