৯. উপকূলে সংঘর্ষ

o

আলী বিন সুফিয়ান কায়রো থেকে রওনা হচ্ছেন । যাওয়ার সময় কমান্ডো অভিযানে দক্ষ একশো লোককে বাছাই করলেন তিনি । তাদের বললেন, ‘ইসলামের সম্মান রক্ষার্থে নিজেদের জান কোরবান করার জন্য বাছাই করা হয়েছে তোমাদের ।’

তিনি সেই একশো গোয়েন্দাকে ব্যবসায়ীর পোষাকে সজ্জিত করলেন । আলী বিন সুফিয়ান নিজে এক বুড়ো ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে কাফেলার সরদার সাজলেন ।

এই বানিজ্য মিশন উটের ওপর বিভিন্ন প্রকার পণ্য ও সরঞ্জাম বোঝাই করলো । এসব পণ্যসামগ্রী দামেস্ক ও অন্যান্য বাজারে বিক্রি করে তার পরিবর্তে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করবে । মাই সামান নেয়ার জন্য সঙ্গে নিল অনেক উট ও ঘোড়া । এসব সরঞ্জামের মধ্যে গোপনে লুকিয়ে রাখলো অস্ত্রশস্ত্র, তলোয়ার, বর্শা ইত্যাদি । এমনকি বারুদ এবং আগুন ধরানোর যন্ত্রও । এই কাফেলা গভীর রাতে কায়রো থেকে রওনা হলো এবং সূর্য উঠার আগেই কায়রো থেকে বহু দূরে চলে গেল ।

পথে একবার সামান্য বিশ্রাম নিয়েই কাফেলা আবার রওনা হলো । আলী বিন সুফিয়ানের ইচ্ছা খুব তাড়াতাড়ি মঞ্জিলে পৌছা । সারাদিন একটানা পথ চললো কাফেলা । সূর্য ডুবে গেল, তবুও তিনি থামলেন না । ক্রমে রাত বাড়তে লাগল, কাফেলা তবু এগিয়েই চলেছে । শেষে অনেক রাতে কাফেলাকে থামতে বললেন তিনি ।

জায়গাটি চমৎকার । শস্য-শ্যামল অঞ্চল । বুঝা যায়, এখানে পানির কোন অভাব নেই । একটু দূর থেকে শুরু হয়েছে উঁচু নিচু পাহাড় ও পার্বত্য এলাকা । কাফেলা বিশ্রামের জন্য এখানেই অবস্থান নিলো ।

কাফেলার সবাই বণিকের বেশে থাকলেও আসলে তো সকলেই সৈনিক । তাই তাদের চলাফেরায় ছিল ডিসিপ্লিন । ছিল সৈনিকসুলভ সাবধানতাও । উট এবং ঘোড়াগুলোও ছিল প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত । মনে হলো তারাও সজাগ, সতর্ক ।

আলী বিন সুফিয়ান পাহাড়ের কোল বা টিলার দিকে না গিয়ে বাইরে খোলা মাঠেই ক্যাম্প করলেন । সামরিক কৌশল ও নিয়ম অনুসারে দু’জনকে পাঠানো হলো পানির অনুসন্ধানে । বিশ্রামের জন্য থামলেও কেউ অস্ত্র ত্যাগ করলো না, কারণ সে সময় সফরে দু’ধরনের ভয় দেখা দিত । একদিকে মরুভূমির বেদুঈন ডাকাতদের ভয়, অন্যদিকে খৃস্টান লুটেরা বাহিনীর আক্রমণের ভয় । মোটের ওপর এরাও ডাকাতই ছিল, তবে তারা শুধু মুসলমান কাফেলায় ডাকাতি করতো ।

দুই সঙ্গী পানির উৎস খুঁজতে খুঁজতে বেশ দূরে চলে গেল । এক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই তাদের নজরে পড়লো মশালের আলো । দূর থেকে আলো লক্ষ্য করে তাঁরা সেদিকে আরও একটু এগিয়ে গেল । শেষে কাছাকাছি এক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ফেললো নিচে । জায়গাটি খুবই সুন্দর, দৃষ্টি নন্দন । সমতল ভূমিতে শস্য ক্ষেত ও খেজুরের বাগান । সেখানে পানিও আছে ।

পানির কুপ থেকে সামান্য দূরে দু’টি মশাল আলো ছড়াচ্ছে । সেই আলোতে দেখা গেল, সাতজন পুরুষ ও চারজন মেয়ে আগুন জ্বালিয়ে বসে বসে সে আগুনে মাংস ঝলসে খাচ্ছে । মাঝে মাঝে পাশ থেকে পেয়ালা তুলে চুমুক দিচ্ছে তাতে, মনে হয়, শরাব পান করছে ।

একটু দূরে ঘোড়া ও তিন চারটি উট বাঁধা । তাদের পাশে স্তুপ হয়ে আছে জিনিসপত্র । আলী বিন সুফিয়ানের দুই সঙ্গী অতি সংগোপনে পা টিপে টিপে চলে এলো তাদের কাছাকাছি । অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে শুনতে লাগলো ওদের কথাবার্তা । রাতের নিস্তদ্ধতার কারণে ওদের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল এবং বুঝাও যাচ্ছিল।

মেয়েদের নির্লিজ্জ হাসি ঠাট্টাই বলে দিল, তারা মুসলমান নয় । তাদের সব কথাই ছিল রঙ্গ তামাশা ও হাসি ঠাট্টার । লোক দু’জন আর দাঁড়ালো না, ফিরে এসে আলী বিন সুফিয়ানকে খুলে বললো সব কথা ।

আলী বিন সুফিয়ান কালবিলম্ব না করে সেখানে ছুটে গেলেন এবং খুব কাছ থেকে তাদের দেখলেন । লোকগুলোর ভাষা স্থানীয় আরবদের মত ছিল না । তাদের ভাষার টান থেকেই আলী বুঝতে পারলেন, এরা খৃস্টান।

আলী বিন সুফিয়ান একবার চিন্তা করলেন এদের সামনে গিয়ে হাজির হবেন কিনা, জিজ্ঞেস করবেন কিনা ওরা কারা, কোথেকে এসেছে এবং কোথায় যাচ্ছে? তার সাথে আছে একশো লড়াকু সৈনিক, ওরা মাত্র এগারোজন, অতএব ভয়ের কোন আশংকা নেই।

তিনি টিলার উপর এক ঝোপের আরালে বসে তাদের গতিবিধি গভীরভাবে লক্ষ্য করতে লাগলেন। হঠাত তাঁর সন্দেহ হলো, এরা খৃস্টান গোয়েন্দা নয়তো! কোন মুসলিম রাষ্ট্রে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাতে যাচ্ছে নাতো এরা?

তিনি লোকগুলোর আরও কাছে যাওয়ার জন্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, হঠাত নিচের দিকে টিলার গোড়ায় দু’জন লোককে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন তিনি। লোক দু’জন তাঁর ঠিক বরাবর নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাথা ও মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। টিলার গোড়ায় ওরা মেয়েদের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে।

মুখোশধারী লোক দু’জন ছিল মরুভূমির ডাকাত। তাদের দৃষ্টি মেয়েদের দিকে। আলীর কাছ থেকে খুব বেশী দূরে নয় ওরা। ফিসফিস করে কথে বলছে নিজেদের মধ্যে। আলী কান পাতলো।

‘তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র আছে মনে হয়।’

‘হ্যা!’ অন্যজন বললো, ‘আমি তাদের তলোয়ার দেখেছি। মনে হয় এরা সবাই খৃস্টান।’

‘খৃস্টান হোক আর যে-ই হোক, এরা কোন সাধারণ অভিযাত্রী নয়।’

‘ঠিক আছে, আগে ওদের শুয়ে পড়তে দাও। পরে দেখবো এরা কতটা অসাধারণ।’

‘তা ঠিক, শুয়ে পড়ার পর এদের পাকড়াও করা কোন ব্যাপারই না।’

‘আরে! পাকড়াও করার দরকার কি? ঘুমানোর প ওদের শেষ করে মেয়েদের ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে নেবো।’

‘ঠিক আছে, চলো সবাইকে ডেকে নিয়ে আসি।’

‘চলো।’

ডাকাত দু’জন সঙ্গীদের ডাকতে চলে গেল। আলী বিন সুফিয়ান চুপিসারে তাদের পিছু নিল। কিছু দূর গিয়ে তারা উল্টো দিকের পথ ধরলো। দু’তিনটি টিলা পার হয়ে আলী দেখলো সামনে ডাকাতদের ঘোড়া দাঁড়িয়ে। ওরা ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

আলী বিন সুফিয়ানের কাফেলা ছিল বিপরীত দিকে। তিনি ভাবনায় পড়ে গেলেন, এখন তিনি কি করবেন? তিনি কি ক্ষুদ্র কাফেলাটিকে সতর্ক করবেন আগে, নাকি নিজের কাফেলায় ফিরে যাবেন? গভীর চিন্তা-ভাবনার পর তিনি নিজের কাফেলায় ফিরে এলেন। বিশজন কমান্ডোকে অস্ত্রসজ্জিত করে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন আগের জায়গায়। তাদেরকে বিভিন্ন পজিশনে দাঁড় করিয়ে ভালমত বুঝিয়ে বললেন, রাদের কি করতে হবে। এরপর ডাকাতদের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে লাগলেন।

তার জানা ছিল না ডাকাত দল কখন আসবে। তিনি তাকিয়ে দেখলেন, তাদের সবাই শুয়ে পড়েছে। শুধু এক লোক বর্শা হাতে পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে। তার পাহারার ধরণ দেখেই বুঝা গেল, এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তখনও মশালও জ্বলছে। আলী তাকিয়ে রইলেন মশালের আলোর দিকে।

o

অপেক্ষা করতে করতে আলীর লোকজন অস্থির হয়ে পড়ল। ডাকাতদের আসার কোন নাম নেই। চিন্তায় পড়ে গেল আলী, তবে কি ডাকাতরা আসবে না? শুধু শুধু রাতভর কমান্ডোদের কষ্ট দিলেন তিনি! নাকি এটা কোন ফাঁদ!

ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। টিলার ভেতর দিয়ে ঘোড়ার ঘুরের শব্দ ভেসে এলো। আলস্য ঝেড়ে টানটান হয়ে গেল কমান্ডোদের পঞ্চেন্দ্রিয়। সতর্ক ভাবে নিজ নিজ অবস্থানে পজিশন নিল তারা।

মেয়ে এবং লোকগুলো তখনো ঘুমিয়ে। শুধু পাহারাদারের পরিবর্তন ঘটেছে সেখানে। দ্বিতীয় জনের হাতে দায়িত্ব দিয়ে প্রথম জনও ঘুমিয়ে পড়েছে। এসে পড়েছে ডাকাত দল।

টিলার ওপর থেকে আলী ও তাঁর সঙ্গীরা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আট-নয়জন দাকাত টিলার কাছে পৌছে গেল। ডাকাতদের দেখেই ভয় পেয়ে প্রহরী চিৎকার করে সঙ্গীদের ডাকতে লাগলো। ধরমড়িয়ে ইয়ঠে বসলো ঘুমন্ত লোকগুলো। ডাকাত দল তাদের ঘিরে দাঁড়ালো। কয়েকজন ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লো নিচে।

কাফেলার লোকগুলো জেগে উঠলেও অস্ত্র হাতে নেয়ার সুযোগ পেলো না। নেমে পড়া ডাকাতরা অস্ত্র তাক করে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘তোমাদের জিনিসপত্র ও মেয়েদেরকে আমাদের হাতে তুলে দাও। আর তোমাদের জীবন রক্ষা কর।’

ডাকাতরা মেয়েদেরকে একদিকে সরিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘তোমরা সরে দাঁড়াও, নইলে মারা পড়বে।’

লোকগুলো ছিল নিরস্ত্র এবং সদ্য ঘুম জাগা। ফলে প্রতিরোধের কোন অবকাশ ছিল না তাদের। তবুও দু’জন লড়াই করার জন্য তলোয়ার বের করে রুখে দাঁড়াল। লড়াই দেখে বুঝা গেল, তারা খুবই দক্ষ যোদ্ধা। প্রাণপণে লড়ে চলল তারা ডাকাতদের সাথে।

আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গীরা টিলার ওপর থেকে বাজপাখীর মত ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের ওপর। ডাকাতরা কিছু বুঝে উঠার আগেই একেকটি বর্শা একেকজন ডাকাতের শরীরে বিদ্ধ হয়ে গেল। অবশ্য এর আগেই কাফেলার দুঃসাহসী সেই দুই লড়াকু ডাকাতদের হাতে খুন হয়ে গেল।

এতে আলী বিন সুফিয়ানের কোন আফসোস ছিল না। তিনিও চাচ্ছিলেন, তাদের দু’একজন লোক মারা যাক। তাতে অন্যান্যদের মনে আতংক সৃষ্টি হবে। এ ছিল বিজলী চমকের মত যুদ্ধ, যে মুহূর্তে শুরু সে মুহূর্তেই শেষ। আতংকগ্রস্থ মেয়ে এবং লোকগুলো বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল আলীর বাহিনীর দিকে। কারো মুখে কোন কথা নেই।

আলী তার লোকদের ইশারা করলো সরে যেতে। কমান্ডোরা টিলার পাশে সরে গেল মুহূর্তে। আলী ভীতচকিত লোকগুলোর পাশে গিয়ে বসলেন।

মেয়েরা ভয়ে কাঁপছিল। তাদের সামনে নিজেদের দু’টি ও ডাকাতদের নয়টি লাশ পড়েছিল। আলী বিন সুফিয়ান তাদের সঙ্গে কথা শুরু করলেন।

তারা কৃতজ্ঞচিত্তে তাকে বার বার ধন্যবাদ জানাতে লাগল। চোখ মুখ থেকেও ঠিকরে পড়তে লাগল কৃতজ্ঞতার আবেগ। বার বার বলতে লাগল, ‘আল্লাহ আপনার মঙ্গল করবেন। আপনি আমাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।’

তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কোথেকে এসেছো, কোথায় যাচ্ছো?’

তারা যে উত্তর দিল তা শুনে আলী বিন সুফিয়ান হেসে উঠলেন। বললেন, ‘যদি তোমরাও আমাকে এমন প্রশ্ন করতে তবে আমিও এরকম মিথ্যা উত্তরই দিতাম। আমি সত্যি তোমাদের প্রশংসা করছি, এত আতংকের মধ্যেও তোমরা তোমাদের গোপনীয়তা বজায় রেখেছো।’

‘আপনারা কোথেকে এসেছেন?’ তাদের একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘আর কোথায় যাচ্ছেন?’

‘যেখান থেকে তোমরা এসেছো।’ আলী বিন সুফিয়ান উত্তর দিল, ‘আর সেখানেই যাচ্ছি, যেখানে তোমরা যাচ্ছো। আমাদের কাজ ভিন্ন কিন্তু লক্ষ্যস্থল একই।’

লোকগুলো এবং মেয়েরা একে অন্যের দিকে প্রশ্নমাখা দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। আবার অবাক হয়ে আলী বিন সুফিয়ানকে দেখতে লাগলো। তিনি হাসছিলেন আর বলছিলেন, ‘তোমরা কি দেখোনি আমি কেমন প্রফেশনাল? কি অবলীলায় ডাকাতদের শেষ করে দিলাম? কোন মুসাফির বা বণিক কি এমন কুশলী যোদ্ধা হতে পারে? যে উস্তাদী আমি দেখিয়েছি তা কি আনাড়ি লোকের পক্ষে সম্ভব?’

‘না, তা সম্ভব নয়। আপনারা কি মুসলিম বাহিনীর লোক?’

‘আমি খৃস্টান সেনাকমান্ডার।’ আলী বিন সুফিয়ানের উত্তর।

‘তাহলে নিশ্চয়ই আপনার কাছে ক্রুশ আছে?’

‘তোমরা কি তোমাদের ক্রুশ দেখাতে পারবে আমাকে?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন আলী বিন সুফিয়ান। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি জানি তোমরা তা পারবে না। তোমাদের কাছে কোন ক্রুশ নেই, কেননা তোমরা যে কাজে যাচ্ছো তাতে সাথে ক্রুশ রাখা সম্ভব নয়। আমি তোমাদের নাম জানতে চাচ্ছি না। আমারও আর কোন পরিচয় তোমাদের কাছে দেবো না। শুধু এতটুকু বলবো, আমরা একই মঞ্জিলের মুসাফির। আর আমাদের মধ্যে কে কে বাড়ী ফিরে যেতে পারবে তাও বলতে পারি না।’

‘আমরা অবশ্যই সফল হবো। খোদওয়ান্দ ইসামসীহ যেভাবে আমাদের রক্ষা করার জন্য আপনাদের পাঠিয়েছেন তাতে প্রমাণ হয়, আমরা সঠিক পথে আছি এবং আমরা অবশ্যই সফল হবো।’

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো। নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যু দুনিয়াতে ক্রুশের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। মুসলমানদের এমন কোন শাসক আছে, যে আমাদের ফাঁদে পড়েনি এবং পড়বে না? আমি তোমাদের এই উপদেশই দেবো, তোমরা আপন দায়িত্ব নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সাথে পালন করবে।’

তিনি মেয়েদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমাদের কাজ সবচে কঠিন ও ঝুকিপূর্ণ। খোদাওয়ান্দ ইসামসীহ তোমাদের কোরবানীকে কখনও ভুলে যাবেন না। আমরা পুরুষ জাতি, আমরা মানুষের জীবন নেই এবং জীবন দেই। তোমাদের জীবন দিতে হয় না, কিন্তু যৌবন ও সম্ভ্রমের কোরবানী দিতে হয়। এটাই বড় কোরবানী। কারণ, এর সাথে জড়িয়ে থাকে দুঃসহ গ্লানি, যা আমাদের কখনো স্পর্শ করে না।’

আলী বিন সুফিয়ানের কথার যাদু স্পর্শ করলো ওদের। তার বলার ভঙ্গিতে এমন আন্তরিকতা ও যাদু ছিল যে, তাদের মনের সব সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়ে গেল। তারা স্বীকার করলো, তারা খৃস্টান। নাশকতামূলক কাজের জন্য তারা দামেস্ক ও অন্যান্য মুসলিম রাজ্যে যাচ্ছে।

তারাও বনিকের বেশেই যাচ্ছিল। আলী বিন সুফিয়ান খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের অনেক গোপন বিষয় ও আইন কানুন জানতেন। জীবনে তিনি অসংখ্য খৃস্টান অপরাধীকে ধরে তাদের অপরাধ স্বীকার করিয়েছেন। তিনি যখন সে সব আচরণ করলেন, তখন মেয়ে এবং তাদের সঙ্গী খৃস্টান গোয়েন্দারা তাঁকে শুধু বিশ্বাসই করেনি বরং তাকে খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের কমান্ডার মনে করলো।

তিনি তাদেরকে বললেন, ‘আমার সঙ্গে একশো লোক রয়েছে। এরা সবাই লড়াকু গোয়েন্দা। এদের মধ্যে মুসলিম ফেদাইন সন্ত্রাসীও আছে। আমরা যাচ্ছি দামেস্ক ও অন্যান্য শহরে বড় বড় অফিসারদের গুপ্তহত্যা করতে। বিশেষ করে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সমর্থক নেতাদের।’

‘আমাদের কাছে তাদের কিছু তালিকা আছে। দরকার মনে করলে আপনি তা নিতে পারেন।’

‘না, তার কোন দরকার নেই আমার। এতদিন আমি মিশরে ছিলাম। সেখান থেকে বিশাল এক তালিকা সংগ্রহ করেই আমরা রওণা দিয়েছি।’

এভাবে গল্প করতে করতে আলী বিন সুফিয়ান তাদের সব গোপন তথ্য জেনে নিলেন। তারা জানালো, ডাকাতদের হাতে তাদের কমান্ডার নিহত হয়েছে। এই এলাকায় তারা এই প্রথম এসেছে। কমান্ডারের মৃত্যুতে তাদের অবস্থা এখন দিশেহারা অন্ধের মত। তাদের একজন নেতা ও পথপ্রদর্শক প্রয়োজন।

আলী বিন সুফিয়ান তাদের সান্তনা দিলেন। বললেন, ‘দলের নেতৃত্ব দেয়ার মত অনেকেই আছে আমার সাথে। যদি প্রয়োজন মনে করো তবে তাদের মধ্য থেকে কাউকে দিয়ে দেবো তোমাদের সঙ্গে। অবশ্য আগে জানা দরকার তোমাদের মিশন কতটা গুরুত্বপুর্ণ এবং মিশনটা কি? তাহলে সেই অনুযায়ী একজন যোগ্য লোক তোমাদের দেয়া যেতে পারে। কারণ, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। বিশেষ কাজের জন্য দরকার বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন লোক। আরে ঘাবড়াও কেন? বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলে দলের দায়িত্ব অন্য কারো হাতে দিয়ে আমি নিজেই না হয় তোমাদের দায়িত্ব নেবো। আসল কথা হলো ক্রুশের সেবা। যেভাবে বেশী করা যায় সেটাই আমাদের করা উচিত।’

তারা তাদের মিশনের নাম বললো, ‘বন্ধু’ । কয়েকজন সেনাপতি ও আমীরের নাম উল্লেখ করে বললো, এসব সেনাপতিদের যে কোন উপায়ে আমাদের বন্ধু বানাতে হবে। এ জন্য এসব উপহার সামগ্রী ও মেয়েদের দেয়া হয়েছে। প্রয়োজন মত এদের ব্যবহার করে এসব আমীর ও সেনাপতি, যারা এখনো খৃস্টানদের শয়রু আছে তাদের বন্ধু বানানোই এ মিশনের কাজ।’

‘তোমাদের ও আমাদের উদ্দেশ্য এক, কিন্তু কাজ ভিন্ন। আমাদের তালিকায়ও এসব আমির ও সেনাপতিদের নাম আছে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এদের খুন করা। এ ক্ষেত্রে কাজ হাসিল করাই বড় কথা, কিভাবে তা হাসিল হলো তা বড় নয়। তোমরা যদি ওদেরকে আমাদের পক্ষে আনতে পারো সে হবে অতি উত্তম। আমাদের অনেক কাজ তখন তারাই করে দেবে। আর যদি তা না পারো তাহলে তাদের ভাগ্যে লেখা থাকবে মরণ। সে ব্যবস্থা আমিই করবো। তার মানে আমাদের উভয়ের কাজ এখন অভিন্ন। তা, তোমরা দামেস্কে কোথায় উঠবে?’

তাদের একজন উত্তর দিল, ‘দামেস্কে গিয়েই এসব মেয়েরা পোষাকে আশাকে মুসলমান হয়ে যাবে। প্রথমে আমরা আবাসিক হোটেলে গিয়ে উঠবো। সেখান থেকে বণিকের বেশে যোগাযোগ করবো আমীর ও সালারদের সাথে।’

o

একটু পর সূর্য উঠল। আলী বিন সুফিয়ানের কাফেলা নাশতা সেরা দামেস্কের দিকে যাত্রা করলো। খৃস্টান যুবতী ও লোকগুলোও শামিল হয়ে গেল তাদের কাফেলায়। সঙ্গে নিল ডাকাতদের বাড়তি ঘোড়াহুলোও।

খৃস্টানরা আলী বিন সুফিয়ানকে নেতা মেনে এগিয়ে চললো তাদের সাথে। তিনি ওদের বললেন, ‘কাফেলার অন্য যাত্রীদের সাথে এ নিয়ে কোন কথা বলো না। কারণ এ কাফেলায় মুসলিম গুপ্তঘাতক ফেদাইনরাও রয়েছে। তারা আমাদের হয়ে কাজ করছে ঠিকই, কিন্তু সব কথা তাদের বলতে নেই, কোন মুসলমানকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে নেই।’

আলীর কথা তাদের খুব মনপূত হলো। অধিকাংশ সময়ই তারা আলীর কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করলো। আলী বিন সুফিয়ানও এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগালেন। তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করে করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে নিলেন।

পরের দিন। দামেস্কে পৌছে গেল কাফেলা। আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশ মত হোটেলে যাওয়ার পরিবর্তে কাফেলা এক ময়দানে ক্যাম্প করলো। বাইরে থেকে কোন বণিকের কাফেলা এলে লোকেরা সস্তায় মালামাল কেনার আশায় সহজেই ভীড় জমায় সেখানে। ওদের ওখানেও রীতিমত লোকের ভীড় জমে গেল।

আলী বিন সুফিয়ান দশটি ঘোড়া বিক্রির ঘোষণা দিলেন। সেই ক্রেতার ভীরে দামেস্কের অনেক ব্যবসায়ী ও দোকানদারও ছিল। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেখানে মেলা বসে গেল। আলী বিন সুফিয়ান তার লোকদের বলে দিল, তারা যেন মাল ধরে রাখে। তাড়াতাড়ি বিক্রি না করে ফেলে।

কয়েকজন কমান্ডোকে ডেকে নিয়ে খৃস্টানদের ষড়যন্ত্রের কথা বললো তাদের। বললো, ‘তোমরা সব সময় ওদের উপর নজর রাখবে। ওরা যেন ভিড়ের মাঝে একেবারে মিশে না যায় এবং তাদের উদ্দেশ্যের কথা কাউকে বলে না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখবে।’

এসব কমান্ডোরা ছিল খুবই দক্ষ। তারা পোশাক পাল্টে ভীড়ের মাঝে মিশে গেল এবং খৃস্টানদের দিকে কড়া নজর রাখতে লাগলো।

আলী বিন সুফিয়ান ও তার সঙ্গীরা মাগরিবের নামাজের সময় কায়দা করে বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে নামাজ আদায় করে এলো। খৃস্টান যুবতী ও লোকগুলো এবং তাদের ওপর যারা নজর রাখছিল তারা রয়ে গেলো তাবুতেই।

মসজিদে মুসল্লীদের সাথে কথা প্রসঙ্গে তারা জনগণের চিন্তাধারা জেনে নিলো। জনগণের মনের আবেগ ছিল বড় আশাব্যঞ্জক। তাদের মধ্যে কিছু লোক নতুন খলিফা ও ওমরাদের কঠোর সমালোচনা করলো। তাদের আলোচনা থেকে বুঝা গেল, মুসলিম বিশ্ব এখন খৃস্টানদের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং খেলাফত বিলাসপ্রিয় আমীরদের হাতে চলে গেছে, এ সত্যও তারা বুঝতে পেরেছে। তাঁরা যে খুবই মানসিক অশান্তি ও দুশ্চিন্তায় আছে তাও প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের কথায়। অনেকে এমনও বললো, ‘নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর এখন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীই আছেন, যিনি এ সয়লাবের মোকাবেলা করতে পারেন, পারেন ইসলামের মর্যাদা ও গৌরব টিকিয়ে রাখতে।’

আলী তার বাহিনীর সবাইকে বলে দিয়েছিলেন, ‘এই মেয়ে ও খৃস্টানদের কাছে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করবে না। তোমরা যে মুসলমান, তাও ওদের জানানো চলবে না। তাদেরকে বলবে, আমরা সকলেই খৃস্টান, এক বিশেষ মিশনে এখানে এসেছি। তাদের মনে যেন কোন সন্দেহ না জাগে সে দিকে খেয়াল রাখবে।’

মসজিদ থেকে ফিরে আলী বিন সুফিয়ান সবাইকে বললেন, ‘আজ রাতে সবাই আরাম করো। এরপর কিম করতে হবে আগামীকাল বলে দেবো।’

সবাইকে এ কথা বলে আলী চুপিসারে বেরিয়ে এলেন তাবু থেকে। সবার অলক্ষ্যে গিয়ে পৌছলেন সেনাপতি তাওফিক জাওয়াদের বাড়ি। তার পরণে বণিকের বেশ, মুখে কৃত্রিম দাড়ি গোঁফ। দারোয়ানকে বললেন, ‘ভেতরে সংবাদ দাও, কায়রো থেকে আপনার এক বন্ধু এসেছেন।’

দারোয়ান ভেতরে সংবাদ দিতেই আলী বিন সুফিয়ানকে মেহমানখানায় ডেকে নেয়া হলো। কিন্তু তাওফিক জাওয়াদ তাকে চিনতে পারলেন না। আগন্তুকের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘চিনতে না পারারই কথা। এমন বুড়োকে কে আর মনে রাখে!’

গলার স্বর শুনেই তাওফিক জাওয়াদ চিনে ফেললেন তাকে। দ্রুত এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে পরিহাসতরল কন্ঠে বললেন, ‘এ যে দেখছি অর্ধেক বুড়ো! চুল দাড়ি পাকলেও গলার স্বর মোটেও পাকেনি।’ এ কথায় দু’জনেই হেসে উঠলেন।

এ লোকটির ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল আলী বিন সুফিয়ানের। তিনি তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন। বললেন, ‘আগে আমার জানা দরকার এখানকার আভ্যন্তরীণ অবস্থা। কায়রোতে এরই মধ্যে অনেক দুঃসংবাদ গিয়ে পৌছেছে।’

তাওফিক জাওয়াদ সমস্ত সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে বললেন, ‘আলী ভাই, তুমি একে গৃহযুদ্ধ বলবে। কিন্তু খৃস্টান ভীতি রোধ করতে হলে আইয়ুবীকে বর্তমান খেলাফতের বিরুদ্ধে অবশ্যই সামরিক অভিযান চালাতে হবে।’

‘যদি আমরা কায়রো থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে এখানে পৌছি, এখানকার সেনাবাহিনী আমাদের বাঁধা দেবে না?’ আলী বিন সুফিয়ান প্রশ্ন করেন।

‘তোমরা আক্রমণের গতিতে আসবে না।’ তাওফিক জাওয়াদ বললেন, ‘সুলতান আইয়ুবী আসবেন খলিফার সাথে সাক্ষাৎ করতে। খলিফার সম্মানে কিছু সৈন্য সঙ্গে আনবেন তিনি। যদি খলিফার নিয়ত ভালো হয়, তবে তাকে স্বাগত জানাবেন। খলিফার সামনে আইয়ুবী উপস্থিত থাকলে অন্য কোন আমীরই মাথা তুলতে সাহস পাবে না। যদি খলিফা আইয়ুবীকে বাঁধা দান করতে চান, তবে আমি নিশ্চিত, তিনি বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হবেন। এ অবস্থায় এখানকার কোন সৈন্য আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে রাজি হবে না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি।’

‘এতটা জোর দিয়ে বলা কি ঠিক হচ্ছে?’

‘অবশ্যই। আমি তো বলতে চাই, এখানকার সৈনিকরা তোমাদের সহযোগীতাও করবে। কিন্তু এটা এখনকার পরিস্থিতি। দিন যত যাবে ততই পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। মনে রেখ, তোমরা যত দেরী করবে এখানকার সৈন্যরা ততই তোমাদের থেকে দূরে সরে যাবে। কারণ, সৈনিকদের মাঝে যে ইসলামী প্রেরণা ও জোশ আছে তা শেষ করার চেষ্টা চলছে। তুমি তো জানো আলী ভাই, শাসকশ্রেণী যদি আরাম আয়েশ ও বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে যায়, তখন তারা প্রথমে শত্রুর সাথে আপোষরফা করে, যাতে স্থায়ী যুদ্ধ ও সংঘাতের আশংকা দূর হয়। তারপর তারা সৈন্য বিভাগকে দুর্বল করতে থাকে। তখন তারা এমন সেনাপতি খোজে, আল্লাহর বিধানের চাইতে যাদের কাছে সুলতানের ইচ্ছা অধিক গুরুত্ব পায়। আর স্বার্থের গোলাম পাওয়া এ পৃথিবীতে কোন কঠিন কাজ নয়।

আল্লাহর গোলামীর চাইতে নিজের খাহেশ যাদের কাছে অধিক গুরুত্ব পায়, সে সুলতান হোক আর সেনাপতি, তারা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মত মর্দে মুজাহিদকে পছন্দ করবে না। এখানে এখন এই মানসিকতারই চাষ শুরু হয়েছে। আমাদের কয়েকজন সম্মানিত সামরিক অফিসার তাদের ঈমানী জযবা ও প্রেরণার জন্য বরখাস্ত হয়েছেন। আমার মত সেনাপতি, যারা খৃস্টানদের কখনও বন্ধু বলবে না, যারা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নূরুদ্দিন জঙ্গীর জ্বালিয়ে দেয়া জিহাদী আগুন বুকে ধরে রাখবে, বেশী দিন তারা এখানে টিকতে পারবে না।’

‘তবে কি আমি সুলতান আইয়ুবীকে গিয়ে বলবো, এখানকার সৈন্যরা আপনার সহযোগিতা করবে?’ আলী বিন সুফিয়ান প্রশ্ন করলেন।

‘অবশ্যই বলবে।’ তাওফিক জাওয়াদ উত্তর দিলেন, কিন্তু খলিফার গার্ড রেজিমেন্ট ও আমীরদের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত রক্ষীরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে পারে। আই গ্রুপেও সৈন্য সংখ্যা কম নয়। জঙ্গীর ইন্তেকালের পর এই বাহিনীকে গৃহযুদ্ধের মোকাবেলা করার জন্য নানাভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।’

‘এখানে জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ আশাব্যঞ্জক। আমরা এখানে এলে জনগণ আমাদের পক্ষে থাকবে বলেই আমার ধারণা।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন।

‘জাতি এত তাড়াতাড়ি অনুভূতিহীন হতে পারে না।’ তাওফিক জাওয়াদ বললো, ‘যে জাতি তার জোয়ান সন্তানকে শহীদ হতে দেখেছে, তারা শত্রুকে কখনও ক্ষমা করবে না। আর যে সৈন্যরা শত্রুর সাথে শক্তি পরীক্ষা করেছে তাদেরকে এত তাড়াতাড়ি ঠান্ডাও করা যাবে না।’

‘কিন্তু প্রশাসনের কাছে এমন লোভনীয় বস্তু আছে, যা জাতি ও সেনাবাহিনীকে নিস্প্রাণ এবং অনুভূতিহীন করে দিতে পারে।’ বললেন আলী।

‘ঠিকই বলেছেন আপনি। প্রশাসন এখন জাতি ও সৈন্য বাহিনীর মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করছে। জাতির কাছে সামরিক বাহিনীকে খাটো করা হচ্ছে।’

‘আমি মুহতারাম নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন। ‘তিনি খলিফার মাতাও। তিনি সুলতান আইয়ুবীকে দূত মারফত চিঠি পাঠিয়েছিলেন এই কথা লিখে যে, তিনি যেন ইসলামের সম্মান রক্ষা করেন। তাঁকে এখানে ডাকা কি সম্ভব?’

‘গতকালই তার সঙ্গে কথা হয়েছে।’ তাওফিক জাওয়াদ বললেন, ‘হ্যা, আমি এখানে ডেকে আনতে পারি, তোমার নাম শুনলে জলদি চলে আসবেন।’

তাওফিক জাওয়াদ তার চাকরানীকে ডেকে বললেন, ‘এখনি খলিফার মাতার কাছে যাও, তাকে আমাদের সালাম দিয়ে চুপি চুপি বলবে, কায়রো থেকে মেহমান এসেছেন। ওনার জন্য তিনি আমার এখানে অপেক্ষা করছেন।’

o

যখন আলী বিন সুফিয়ান তাওফিক জাওয়াদের সাথে আলাপ করছিলেন, তখনো তার তাবুতে আলো জ্বলছিল। অনেক রাত। খরিদ্দারের ভীড় কমতেই অনেক দেরী হয়েছিল। আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গীরা দীর্ঘ সফর শেষে ছিল ক্লান্ত। তারা বাজার থেকে দুম্বা ও বকরী কিনে এনে সেগুলো ভুনা করে খাচ্ছিল।

মেয়েরা ছিল আলাদা তাবুতে। খৃস্টান পাঁচ গোয়েন্দা আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গীদের সাথেই একত্রে খানা খাচ্ছিল। তারা তাদের শরাবের পাত্র বের করলো যাতে আহারের মজলিশ আলোকিত হয়ে উঠে। তারা যখন শরাবের পিয়ালা সবার সামনে রাখলো, সবাই তা গ্রহন করতে অস্বীকার করলো। তাতে খৃস্টানরা খুবই অবাক হলো। আলী বিন সুফিয়ান তাদের বলেছিলেন, তাঁর সাথীদের মধ্যে মুসলমানও আছে, খৃস্টানও আছে। যারা মুসলমান তারা আবার ফেদাইন গ্রুপের গুপ্তঘাতক। ফেদাইন মানে, হাসান বিন সাব্বাহর দলের লোক, এরাতো শরাবকে হারাম জানে না।

খৃস্টানদের মনে প্রবল সন্দেহ দানা বেঁধে উঠলো, কারণ তারাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। তারা দু’চারটি এমন নমুনা দেখতে পেলো, যার দরুণ তাদের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। তারা একে একে সেখান থেকে এমনভাবে উঠে যেতে লাগলো, যেন তাদের তাবুতে শুতে যাচ্ছে।

তারা মেয়েদের তাবুতে ঢুকে তাদের সন্দেহের কথা বললো। বললো, ‘এদের আসল পরিচয় বের করতে হবে। এরা কেউ খৃস্টান নয়। কিন্তু কারা এরা?’

মেয়েরা তাদের শান্তনা দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে, এ দায়িত্ব আমাদের ওপর ছেড়ে দাও। পুরুষের পেট থেকে কথা বের করার যে ট্রেনিং এতদিন পেয়েছি, দেখি তা কতটুকু কাজ দেয়। কৌশলে কথা আদায় করা কোন ব্যাপারই না। একটু অপেক্ষা করো, কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারবে, এরা আসলে কারা?’

খৃস্টান গোয়েন্দারা চলে গেল নিজ নিজ তাবুতে। এক মেয়ে বেরিয়ে এলো তাবু থেকে। সে মাঠের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কমান্ডোদের কেউ কেউ তাকে দেখেই অন্য দিকে সরে গেল। অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে মেয়েটি এমন জায়গায় গিয়ে বসলো, যে জায়গাটা নির্জন কিন্তু তাবু থেকে কেউ বাইরে এলে ঠিকই তাকে দেখতে পায়।

অনেক রাত পর্যন্ত মেয়েটি একাকী সেখানে বসে রইল। গভীর রাত। আলী বিন সুফিয়ানের এক পাহারাদার তার কাছে গিয়ে বললো, ‘এতো রাতে আপনার একাকী বাইরে থাকা ঠিক না। তাবুতে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’

মেয়েটি উঠে আড়মোড় ভেঙে বললো, ‘কিছুতেই ঘুম আসছে না। তাবুতে থাকতে থাকতে মনটা অস্থির হয়ে গেছে। বার বার কেবল তার কথাই মনে পড়ছে। আপনার অসুবিধা হলে আমি দূরে গিয়ে বসি।’

‘না, না, আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না।’

‘না, দূরে গিয়ে বসাই ভালো, নইলে আবার কার না কার নজরে পড়ে যাই।’ মেয়েটি এই বলে হেঁটে তাবু থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো।

পুরুষ মানুষকে আঙ্গুলের ওপর নাচাতে পারে এমন ট্রেনিং দিয়েই পাঠানো হয়েছিল তাদের। মেয়েটি একাকী হেঁটে দূরে চলে যাচ্ছে দেখে পাহারাদার প্রথমে একটু ইতস্তত করলো, তারপর তার কন বিপদ হতে পারে ভেবে তার পিছু নিল। হাঁটতে হাঁটতে তাবু থেকে বেশ দূরে চলে এলো তারা। মেয়েটি পেছন ফিরে পাহারাদারকে বললো, ‘আপনি আবার কোথায় যাচ্ছেন?’

‘না, মানে, আপনার কোন বিপদ হয় কিনা ভেবে আপনার পিছু নিয়েছি।’

‘বিপদের কথা বলছো! বিপদ তো আমাদের তাবুর ভেতর। আমাদের সঙ্গী পুরুষগুলো একেকটা বদের হাড্ডি। ওদের খাই খাই আর মেটে না। ওদের জ্বালা সইতে না পেরেই তো তাবু থেকে বেরিয়ে এসেছি।’

‘এ কথা আগে বলোনি কেন? চলো, এখন থেকে আমরা দৃষ্টি রাখবো যেন ওরা তোমাদের আর জ্বালাতন করতে না পারে।’

মেয়েটি তার সাথে ফিরে চললো। হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘আজ বুঝি রাত জাগার ডিউটি পড়েছে তোমার?’

‘হ্যা।’ বললো পাহারাদার।

‘এক কাজ করো, আমার তাবুতে চলে এসো তুমি। তাহলে ঐ শয়তানরাও আসার সাহস পাবে না, আবার তোমারও ঘুমিয়ে পড়ার ভয় থাকবে না। গল্প করে বেশ সময় কাটিয়ে দেয়া যাবে।’

পাহারাদার এ কথার কোন জবাব দিল না।

চুপচাপ আরো কিছু পথ এগিয়ে এলো ওরা। মেয়েটি পাহারাদারের একদম পাশ ঘেঁষে চলতে চলতে বললো, ‘কি ব্যাপার, আমার কথায় মন খারাপ করলে? জবাব দিলে না যে।’

মেয়েটি এমন অভিনয় শুরু করলো, লোকটি শেষ পর্যন্ত তার অভিনয়ে গলে গেল। তাবুর কাছে এসে মেয়েটি আবার বললো, ‘এসো, ভেতরে এসো।’

মেয়েটির পীড়াপীড়িতে অনেকটা ভদ্রতার খাতিরে সে মেয়েটির তাবুতে প্রবেশ করলো।

তাবুতে ছোট একটি প্রদীপ জ্বলছিল। সেই আলোতে ওরা পরস্পরকে ভাল করে দেখলো। মেয়েটি আবেগমাখা কন্ঠে আকর্ষনীয় হাসি হেসে বললো, ‘বাহ! তুমি তো বেশ সুপুরুষ হে! আমাকে তুমি সয়তানের হাত থেকে আগলে রাখতে পারবে বলেই মনে হয়। কি বলো, পারবে না?’

মেয়েটির অনিন্দ্য রূপের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পাহারাদার। মেয়েটি শরাবের ছোট একটি পাত্র উঠিয়ে বললো, সামান্য একটু পান করবে?’

‘না!’

‘কেন?’

‘আমি মুসলমান!’

‘যদি এত জোরের মুসলমান হও তবে খৃস্টানদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছো কেন?’

লোকটি চমকে উঠলো। সতর্ক হয়ে বললো, ‘তার মূল্য আমরা পেয়ে থাকি।’

মেয়েটি যেমন সুন্দরী তেমনি চতুর। তার মদির কটাক্ষ আর চটুল বাক্যবাণে লোকটি ক্রমেই বশিভূত হতে লাগলো। মেয়েটি তাকে বললো, ‘আচ্ছা, শরাব পান না করো, শরবত তো পান করবে?’

সে পাশের তাবু থেকে এক গ্লাস শরবত নিয়ে এলো। লোকটি গ্লাস হাতে নিয়ে মুখে লাগালো, কিন্তু চুমুক না দিয়েই গ্লাসটি আবার নিচে নামিয়ে হেসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এতে কি পরিমাণ হাশিশ মিশিয়েছো?’

মেয়েটিও চমকে উঠলো এবার। তবে কি ও বুঝে ফেলেছে তার চালাকি? দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সংযত কন্ঠে বললো, ‘বেশি না, সামান্যই।’ তারপর একটু বিরতি দিয়ে তার দিকে কটাক্ষ হেনে চটুল কন্ঠে বললো, ‘যতটুকু দিলে তুমি কিছুক্ষণ আত্মহারা হয়ে থাকবে।’

‘কেন?’

‘কারণ আমি তোমাকে পেতে চাই। তুমি কি বুঝো না কতটা উতলা হলে কোন যুবতী তাবু ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে?’

‘তবে যে বললে তোমার সঙ্গীরা তোমাকে বিরক্ত করছে?’

‘ও কথা না বললে তুমি কি আসতে আমার তাবুতে? প্লিজ, হয় আমাকে গ্রহন করো, নইলে তোমার খঞ্জর আমার বুকে আমূল বসিয়ে দাও।’ মেয়েটি আবেগভরা কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘আমি দিনের বেলাতেই তোমাকে দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, কি করে তোমাকে পাওয়া যায়। রাতে তোমার ডিউটি পড়ায় আমার মনে হলো, আল্লাহ আমার গোপন ইচ্ছা সফল করার জন্যই এ ব্যবস্থা করেছে। আমি তোয়াকে ডিউটিতে দেখেই তাবু থেকে বের হয়ে তোমার চোখের সামনে দিয়ে ঘোরাফিরা করতে লাগলাম। তুমি যখন আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলে তখন গভীর দৃষ্টিতে আমি দেখছিলাম তোমাকে। মনে হচ্ছিল, যুগ যুগ ধরে আমরা পরিচিত। আমরা দু’জন বহু কাল ধরে একে অপরের ঘনিষ্ট হয়ে বেঁচে আছি। তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি প্রাণ। তুমি তো দেখেছো, আমি তোমাকে শরাব সাধলেও নিজের জন্য নেইনি। কারণ শরাব আমি পান করি না, আমি যে মুসলমান।’

পাহারাদার অবাক হয়ে বললো, ‘তুমি এই কাফেরদের খপ্পরে কেমন করে পড়লে?’

‘বারো বছর ধরে আমি এদের সাথে আছি।’ মেয়েটি উত্তর দিল। ‘আমি জেরুসালেমের বাসিন্দা! সে সময় আমার বয়স বারো বছর। বাবা আমাকে এদের কাছে বেঁচে দিলেন। আমার জানা ছিল না আমার ক্রেতা খৃস্টান। তারাই আমাকে এ পথে নামিয়েছে। কোন উপায় নেই বলেই আমি এদের সাথে এখানে এসেছি।

দামেস্ক ও বাগদাআ আমার স্বপ্নের শহর। জীবনে বহু বার নাম শুনেছি এসব শহরের, শুনেছি এর শানশওকতের কথা। মুসলিম রাজত্বের প্রাণকেন্দ্র এ শহর! কত আশা ছিল তা দেখার! এখানে আসার পর মনে হচ্ছে আমি বারবার আমার ভাই-বোন আত্মীয়দের মাঝে ফিরে এসেছি। এ মাটিতে পা দিতেই এর আকাশ, বাতাস, মাটি আমার মনে জাগিয়ে দিল ধর্মের সেই পুণ্য স্মৃতি, আমি এক মুসললমান। মুসলমান হয়ে মুসলমানের ধ্বংশের জন্য আমি কি করে কাজ করি বলতো!’

আবেগে কেঁদে ফেললো মেয়েটি। গাঢ় স্বরে বললো, ‘আমার মন কাঁদছে! প্রাণ কাঁদছে!’

হঠাত সে যুবকের হাত চেপে ধরে বললো, ‘তুমি না মুসলমান! এ কাজ করতে তোমার বিবেকে বাঁধে না?’ তারপর গলার স্বর নামিয়ে বললো, ‘চলো আমরা দু’জন পালিয়ে যাই। তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাও, আমি সেখানেই যাবো। যদি মরুভূমিতেও নিয়ে বেড়াও, আমি খুশি মনেই তোমার সাথে থাকবো। নিজের জাতিকে এভাবে ধোকা দেয়ার পাপ থেকে তুমিও বাঁচো, আমাকেও বাঁচাও। আমার কাছে সোনার অনেক মোহর আছে, সে মোহর ভেঙে খেলেও আমাদের চলে যাবে বহুদিন।’

আলী বিন সুফিয়ানের এই কমান্ডো খুবই হুশিয়ার ছিল। সে হুশিয়ার ছিল বলেই হাশিশ মেশানো শরবত পান করেনী, হাশিশের গন্ধ সে ভালমতই চিনতে পেরেছিল। কিন্তু তারপরও সে মেয়েটির ছলাকলার প্রভাব এড়াতে পারলো না।

সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা এখানে কি করতে এসেছো?’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top