৮. ফেরাউনের গুপ্তধন


এখানে সে আরও কিছু লাশ দেখতে, পেল। তার মধ্যে পাঁচ ছ’টি শিশুদের। লাশগুলোর খােলা চােখে মুখে কষ্ট ও যন্ত্রণার চিহ্ন।
কস্তুরী ছিল আনন্দ-ভুবনের বাসিন্দা। এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য কোনদিন সে স্বপ্নেও দেখেনি। একটি ছােট শিশুর নিষ্পাপ ফুটফুটে লাশ দেখে কাতুরীর দু’চােখ জলে ভরে উঠল। সে ডুকরে কেঁদে উঠল।
মার্ক লীর তিন চার জন সঙ্গী কস্তুরীর কান্না শুনে ছুটে এলো সেখানে। কস্তুরী মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল, ইসমাইল তাকে ধরে ফেললো। মার্ক লীর সঙ্গীদের বললো, লাশ দেখে ওর মাথা ঘুরে গেছে।’
একজন পানি আনার জন্য ছুটে গেল। কস্তুরী আন্তে আস্তে সুস্থ্য ও স্বাভাবিক হয়ে এল। সে জিজ্ঞেস করলো, “এদের কে হত্যা করেছে? কেন এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে?”
মার্ক লীর এক সঙ্গী তাকে সব ঘটনা খুলে বললো। কস্তুরী ইসমাইলের দিকে তাকালো, তার চেহারা ফ্যাকাশে।
ইসমাইল বললো, “আমাদের চেয়ে এ লোকগুলো কতই না ভালো ছিল! যাদের আমরা অসভ্য, উলঙ্গ ও মানুষ খেকো বলছি, এরা কতই না দায়িত্বশীল ও আমানতদার! এই গুপ্তধন রক্ষার জন্য এরা জীবন দিয়েছে তবুও গোপনীয়তা প্রকাশ করেনি। যদি এরা ফেরাউনের কবর খুঁড়ে সব মালামাল ও ধনরত্ন উঠিয়ে নিয়ে যেতো, তবে কে তাদেরকে ধরতো? এরা ছিল আমানতদার, দায়িত্ববান ও সরল মানুষ। আমরা নিজেদের সুসভ্য ও ভালো মানুষ বলি, অথচ এই খুনখারাবী ও ধ্বংসযজ্ঞ আমরাই চালিয়েছি। আমরা ডাকাত ও খুনী। এ সবই মার্কালীর কাজ।’
‘আমি এই গুপ্তধনের এক কপর্দকও গ্রহণ করবাে না। এই নিষ্পাপ শিশু ও নিরপরাধ মানুষগুলোকে এমন নির্দয়ভাবে হত্যা করে আমরা যে অভিশাপ কুড়িয়েছি তার ভাগ আমি নেবো না।” মানুষগুলোকে অযথা কেন হত্যা করা হলো?”
মার্ক লী বৃদ্ধের সঙ্গে উপত্যকার ওপারে চলে গেল। মার্ক লী দেখতে পেল তার সামনে ছোট্ট একটি পাহাড় চূড়া। তার গায়ে রোদ লেগে স্ফটিকের মত চমকাচ্ছে।
বৃদ্ধ তাকে বললো, উপরে চলো, সেখানে তোমাকে একটা মস্ত বড় পাথর দেখাবো, যেটি এখান থেকেও দেখা যায়। পাথর তো নয়, যেন ছোটখাট উপত্যকা। যদি তুমি ওটাকে সেখান থেকে সরাতে পার তবেই তুমি সেই দুনিয়ার দরজা দেখতে পাবে, যেখানে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কফিন ও তার গুপ্তধন লুকোনো আছে। সেই উঠোনের মত পাথরকে সেখান থেকে আজ অবধি কেউ সরায়নি। পনেরো শ’ বছরের মধ্যে এই পাথর কেউ স্পর্শও করেনি।
আমরা পনেরো শ’ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এই কবরের দেখাশোনা করে আসছি। আমি তোমাকে ফেরাউন রিম্যান্সের মৃত্যু ঘটনা এমনভাবে শোনাচ্ছি যেন তিনি এই কাল-পরশু মারা গেছেন। এসব ঘটনা আমার বাপ-দাদা শুনিয়ে গেছেন। বাপ-দাদীকে তার বাপ-দাদা শুনিয়েছেন। এমনিভাবে পনেরো শ’ বছরের ইতিহাস আমাদের মনের মধ্যে গাথা রয়েছে। যে ইতিহাস আমি আমার কবিলার লোকদের শুনিয়ে থাকি।” আমি তোমার সে কথা পরে শুনবো।” মার্ক লী অস্থির হয়ে বললো, “এখন উপরে চলো?”
তারা মস্ত উঠোনের মত সমতল পাথরের ওপর উঠে এল। বুড়ো বলল, “এই তোমার কাঙ্খিত , দরজা। এই পাথরের নিচেই লুকানাে আছে সমস্ত ধনরত্ন। মার্ক লী বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এটা একটা পাথর। তার মনে হচ্ছিল, সে কোন প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। যে ছাদ পাথর, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে মজবুতভাবে তৈরী করা হয়েছে। মার্ক লী ছাদের চারদিক ঘুরে দেখল। সেখান থেকে * নিরেট ছাদ ছাড়া একে আর কিছুই মনে হলো না। এমন কোন ফাঁক খুঁজে পাওয়া গেল না যাতে একে পৃথক মনে হয়। কিভাবে এই পাথর সরানাে যাবে এ কথা ভাবতে ভাৰতে সে নিচে নেমে এলো।
‘আমি জানি, এই পাথর এখানে আলাদাভাবে বসানো হয়েছে। এ কথা তোমার বিশ্বাস হবে না। এখান থেকে দেখলে তা কারোরই বিশ্বাস হবে না। তবে তুমি যদি এর উল্টো পাশে যাও তাহলে দেখতে পাবে ছাদের একটি বুলি বারান্দা আছে। যেখানে পাহাড় ও ছাদের অংশ পৃথক বােঝা যায়। এটা মানুষের হাতেরই তৈরী। মানুষের কর্মকুশলতা ও নিপুণতার এ এক অপূর্ব নিদর্শন। এটাকে এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে এটাকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি বলে মনে হয়।
ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্স নিজের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় এটা বানিয়েছিলেন। এর নিচে পাহাড়ের বুকের ভেতর যে দুনিয়া আবাদ রয়েছে সেটিও ফেরাউন রিম্যান্স তার জীবদ্দশাতেই তৈরী করেছিলেন।
এই জগতকে বাইরের দুনিয়া থেকে কিয়ামত পর্যন্ত গোপন রাখার জন্য এই কৃত্রিম পাথরের ছাদ বানিয়েছিলেন। মরার আগ পর্যন্ত এর কারিগরদের তিনি কারাগারে বন্দী করে রেখেছিলেন।
পরে ফেরাউনের মৃত্যুর পর তাঁর লাশের কফিন এখানে আনা হয়। প্রয়োজনীয় সামান ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়, ধনরত্ন রাখা হয়। তারপর তার কফিন ভেতরে রাখার পর কারিগরদের সবাইকে হত্যা করা হয়। ফেরাউনকে যারা খোদা মানতো এমন নিবেদিতপ্ৰাণ বারো জন যুবককে এনে এর পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়। সে কালের মিশরের বারো জন সেরা সুন্দরী এনে সঙ্গিনী করে দেয়া হয় তাদের। সেদিন থেকেই তারা কবর ও সম্পদের পাহারা দেয়া শুরু করে। আজ তুমি যাদের হত্যা করেছে এবং এখনো আমরা যারা এখানে জীবিত আছি, ঐ বারো জন পুরুষ ও বারো জন নারীরই পরবতী বংশধর।
“এই বিশাল পাথর কেমন করে সরানো যাবে?” মার্ক লী চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো।
“এ, পাথর সরাতে হবে এই চিন্তা করে এখানে তা রাখা হয়নি। তবে এটা যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়নি, মানুষই এখানে রেখেছে, তখন মানুষ চেষ্টা করে তা সরাতেও পারবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার দায়িত্ব আমি শেষ করেছি। গুপ্তধন উদ্ধারের অসম্ভব মিশন নিয়ে তুমি এতদূর ছুটে এসেছে, এখন এই দরজা খোলার দায়িত্ব তোমার। তোমাকেই এ পাথর সরানাের বুদ্ধি বের করতে হবে।’ বলল বৃদ্ধ।
মার্ক লী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবরের মুখ মুক্ত করার জন্য অধীর ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল, “এর সাথে রশি বেঁধে সবাই মিলে টানলে কেমন হয়?’
সে তাড়াতাড়ি তার লোকদের কাছে ছুটে গেল। তাদের ডেকে বলল, ‘জলদি রশি আনো’
তার লোকজন রশি নিয়ে ছুটে এল। তারপর তার নির্দেশ মত উপরের ছাদের এক প্রান্তের আংটার সাথে শক্ত করে বাধলো সেই মোটা রশি। একটা দুটো নয়, অনেকগুলো। এরপর সবাই নিচে নেমে এল।
মার্ক লী সবাইকে বললো, “এসো এবার নিচে থেকে রশি ধরে জোরে টানতে থাকি ৷”
তার হুকুম পেয়ে চল্লিশ পঞ্চাশজন শক্তপােক্ত লোক সে রশি ধরে টানতে শুরু করল। কিন্তু তাতে পাথর বিন্দুমাত্র নড়লো না।
কিছুক্ষণ টানাটানির পর পাথরের নড়াচড়া বুঝতে না পেরে সে বলল, ‘দাঁড়াও, আমি এই ছাদের ওপর উঠে দাঁড়াই। তাতে করে সামান্যতম নড়াচড়া হলেও বুঝতে পারবো।’
সবাইকে নিচে রেখে মার্ক লী এৰার উপরে উঠে এল। সে উঠে আসার পর নিচ থেকে সবাই আবার ‘হোঁইয়ো জোরে বলে হেচকা টানে চেষ্টা করতে লাগল পাথরটি সরানাের। সকলের মিলিত টানে এক সময় মার্ক লীর মনে হলো, পাথরটি নড়ছে। সে চিৎকার করে বলল, ’সাবাস নওজোয়ান, পাথর নড়ছে। জোরে টানাে, পারবে, তোমরা পারবে এ পাথর সরাতে। গুপ্তধন অবশ্যই তোমরা উদ্ধার করতে পারবে।” আনন্দে সে নাচছিল তখন।
যারা পাথর টানছিল তাদের মধ্যে নতুন জোশের জন্ম হল।
সেই উত্তেজনায় তারা এমনভাবে টান মারল যে পাথর কেবল নড়লেই না, সামান্য একটু সরেও গেল। তাতে চুল পরিমাণ হলেও একটু ফাক তৈরি হল। মনোবল বেড়ে গেল মার্কালী ও তার সাথীদের তারা সবাই আনন্দ ধ্বনি দিতে শুরু করলো এবং আরো জোরে টানতে থাকল। পাথরটি আরও টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল লোকগুলো। এত টানাটানির পরও পাথরটি সামান্যই সরাতে পেরেছে তারা। কিন্তু সে জন্য কারো আফসােস নেই।
মার্ক লী নিচে নেমে এল এবং সবাইকে একটু আরাম ও বিশ্রামের জন্য দুটি দিল।
সূর্য্য কাল পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। মার্ক লীর কাছে শরীবের বিশাল মজুত ছিল। সে সেই শরীবের ভাণ্ডার খুলে দিয়ে বললো, “তোমরা প্ৰাণ ভরে পান কর, আর ওই পাথর টেনে নামিয়ে আনার শক্তি সঞ্চয় কর।
সবাই মদের বােতল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মার্ক লী আনন্দ উত্তেজনায় নাচছিল তখন। দীলদারিয়া বাদশার মত সে আবেগদীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করল, “আমি আজ রাতে তোমাদেরকে দুটি উট জবাই করে শাহী ভোজ দেব।
মদের প্রভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলের সারাদিনের ক্লান্তি ও কষ্ট দূর হয়ে গেল। তাদের মনে ফিরে এলো শক্তি ও সজীবতা।
এই আনন্দ কোলাহলের মধ্যেই সূর্য অস্ত গেল। পাহাড় থেকে একটু দূরে এক মাঠের মধ্যে কয়েকটি মশাল জ্বলিয়ে আনন্দ সাগরে ডুব দিল মার্ক লী ও তার সাথীরা। সন্ধ্যা রাত পার হলো খাওয়া দাওয়া আর বিশ্রামে।
রাতের দ্বিতীয় প্রহর।
মার্ক লী ডাকলো সবাইকে। এই রাতের আঁধারেও পাথর সরানোর কাজে নেমে পড়তে আগ্রহী সবাই। মার্ক লী বলল, ঠিক আছে চলো তাহলে।” সকলে মিলে আর একবার জোরেশোরে রশি টানতে শুরু করলো। মার্ক লী উপরে দাঁড়িয়ে ছিল। মশালের টিম টিমে আলোয় কবরের মুখ থেকে অল্প অল্প করে পাথর সরে যেতে দেখল সবাই। তারা আরও জোরে নানা রকম উৎসাহব্যঞ্জক ধ্বনি দিয়ে বিরতিহীনভাবে টানতে থাকলো পাথরটি। একটু পরে তারা দেখতে পেল পাথরটি হেলে পড়ছে।
উৎসাহ আরো বেড়ে গেল তাদের। মার্ক লী নেমে এল নিচে। সে একপাশে সরে গিয়ে অভিযাত্রীদের উৎসাহ দিতে লািগল। লোকগুলোও প্ৰচণ্ড আবেগ ও উচ্ছাস নিয়ে রাশির প্রান্ত ধরে টেনে যেতে লাগল অব্যাহতভাবে।
সহসা বিকট আওয়াজ করে নিচের দিকে উল্টে পড়ল বিশাল ছাদ।
যেখানে দাঁড়িয়ে মার্ক লীর লোকেরা রশি টানছিল। সে জায়গাটা ছিল সংকীর্ণ। তাদের পিছনে ছিল আরেকটি খাড়া পাহাড়। ওপর থেকে ছাদটি এমন গজবের মত নোমে এল তাঁদের মাথায়, নিচের লোকগুলো সরে যাওয়ারও সময় ‘পেল না। ছাদের তলে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেল সব ক’জন মানুষ।
যে সব মশািল জেলে রাখা হয়েছিল আশেপাশে, কিছু পড়ল তার নিচে, কিছু নিভে গেল বাতাসের ঝাপটায়। মার্ক লীর পায়ের নিচের পাহাড় দুনিয়া কােপানো ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠল।
সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। ছাদ ও নিচের পাথুরে জমিনের ভীষণ সংঘর্ষে এমন তীব্ৰ ও ভয়ংকর আওয়াজ হলো যে, স্তব্ধ হয়ে গেল মার্ক লী। সেই সংঘাতের তীব্ৰতা সইতে না পেরে ক্ষণিকের জন্য জ্ঞান হারালো সে।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে উঠে বসল, দূরে একটা মশাল টিমটিম করে জ্বলছিল তখনো, সে এগিয়ে গিয়ে সেই মশালটি তুলে আনল।
চারদিকে সুনসান নিরবতা। কোথাও কোন চিৎকার চেচামেচি নেই। নিস্তব্ধ নির্বক ধ্বংসস্তুপের সামনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল মার্ক লী। তারপর মশাল নিয়ে এগিয়ে গেল। সেই ধ্বংসস্তুপের কাছে। উল্টেপাড়া ছাদের নিচ থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পা বেরিয়ে আছে, কারো মাথার অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। এ সময় মার্ক লীর কানে হঠাৎ কয়েকজন মানুষের দৌড়ানোর শব্দ এল। মার্ক লী ভাবল, তাহলে কি কেউ কেউ বাঁচতে পেরেছে! ওরাই কি কোন সাহায্য নিয়ে ছুটে আসছে?
সে পায়ের আওয়াজ লক্ষ্য করে এক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল। কারা আসছে। ততোক্ষণে ছুটন্ত লোকগুলো টিলার কাছে পৌঁছে গেল। সে দেখতে পেল চার জন লোক ছুটে আসছে তার দিকে।
ওরা আরেকটু কাছে আসতেই সে চিনতে পারলো লোকগুলোকে। প্রথমেই আছে সেই বৃদ্ধ, যে তাকে গুপ্তধনের গুহামুখের সন্ধান দিয়েছিল। তার পিছনে ইসমাইল ও কস্তুরী, সবশেষে সেই সাথী যে তাদের তাবু ওপশুর পাহাড়ায় ছিল।
মার্কালীর কাছে এসে থামল ওরা। সবাই খুব হাপাচ্ছে। কস্তুরীর দিকে তাকাল মার্ক লী। ভয়ে তার আপাদমস্তক থারথার করে কাপছিল! মার্ক লী নীরবে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চারজনই প্রথমে মার্ক লী ও পরে ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকাল। সকলেই হতবাক, কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
প্রথমেই কথা বললো, বৃদ্ধ, আমি তােমাকে সাবধান করেছিলাম, বলেছিলাম তোমার চোখে আমি মৃত্যুর ছায়া দেখতে পাচ্ছি। তুমি এ অসম্ভব অভিযানের সংকল্প ত্যাগ করে ফিরে যাও। আমার কথায় তুমি কান দাওনি। তুমি আমাকে বাধ্য করেছ, ফেরাউন রিম্যান্সের কবর ও গুপ্তধন উদ্ধারের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করতে।
আমি জানতাম, এর পরিণতি কত মারাত্মক ও মর্মান্তিক। মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার নেই তোমাদের। ভাগ্যগুণে এখনাে বেচে আছ তুমি। কিন্তু আরেকটু আগানোর চেষ্টা করলে খোদার গজব নামবে তোমার ওপরও। কেউ তোমাকে তার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। এখন বলো, তোমরা কি এখন ফিরে যাবে?”
‘না’!’ মার্ক লী বলল, “আমার এই সাথীরাও আমার সাথে থাকবে। এরাই হবে এখন আমার সহযাত্রী।’ সে বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইলো, “আমার আর কোন সাথী কি বেঁচে নেই? কেউ কি পালাতে পারেনি?’

বৃদ্ধ বললে, “তােমার চার সাথী আমার লোকদের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। আমার লোকরা তাদের পথ দেখাবে না। তাদের শেষ পর্যন্ত পথে পথে ঠোকর খেয়ে বেড়াতে হবে এবং দারুন কষ্ট করে মরতে হবে। তারচে যদি
পাথর চাপা পড়ে মারা যেতাে তবেই ভাল করতাে। এই মৃত্যু অনেক সহজ ছিল।
আজ বন্ধ রাখ এই কাজ। ভিতরে যদি যেতেই চাও, আগামীকাল ভোরে তোমাদেরকে আঁমি ভেতরে নিয়ে যাব।

মার্ক লীর উপর দুর্ঘটনার কোন প্রভাব পড়ল না। বৃদ্ধকে নিয়ে তাবুতে ফিরল। ইসমাইল বৃদ্ধকে একটি চাদর দিল। সে চাদর দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়ল। কস্তুরী তখনও নির্বাক। সে সেই নারীদেরও দেখেছে, যাঁদের মার্ক লী নিরাপত্তা বন্দি করেছিল। এখন তারা বন্দি নেই অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল।
তোমরা আমাদের একজন সাথীকে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলেছিলে। মার্ক লী জিজ্ঞেস করলো, এর আগেও তোমরা নরমাংশ খেয়েছ? তার মত তোমরা কতজনকে পেয়েছিলে এরকম ভোজ করার জন্য।
‘যতজনকে আমরা ধরেছি সবাইকেই একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে’ বৃদ্ধ উত্তরে বলল, ‘আমরা বলতে পারব না আমাদের পূর্ব পুরুষরা কবে থেকে মানুষের মাংশ খাওয়া শুরু করেছিল।
তোমরা তো ইচ্ছা করলে সব গুপ্তধন নিয়ে যেতে পারতে! সভ্য সমাজে গিয়ে শাহানশাহের মত জীবনযাপন করতে পারতে। যাওনি কেন?”
“একটি ভবিষ্যতবাণী আমাদেরকে এ ধরনের অপকর্ম থেকে রক্ষা করেছে। ভবিষ্যতবাণীটি হলো, যে ব্যক্তি রিম্যান্সের কবর হেফাজত করবে, তাকে মরুভূমিও শীতল ছায়া দান করবে। আহার, পানি ও ছায়া থেকে কোনদিন বঞ্চিত হবে না তারা। দুনিয়ার লোভ লালসার দরকার হবে না তাদের। তাদের দেহে আবরণের দরকার হবে না। তাদের অন্তরে থাকবে অফুরন্ত ভালবাসা, পরষ্পর প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকেই জীবন পার করে দেবে তারা। এই সুখী জীবন তারা ততদিন ভোগ করবে, যতদিন সোনা, রূপা ও মদের প্রতি তাদের আসক্তি না আসবে। যতদিন লোভ-লালসা তাদের। আচ্ছন্ন না করবে। কারণ লোভই মানুষকে খুনী, ডাকাত, স্বার্থপর ও নীতিহীন বানিয়ে দেয়।’
তুমি ঠিকই বলেছ লোভই সমাজ ও সভ্যতা ধ্বংসের কারণ। সে কখনো ধন-সম্পদের লালসা করে, কখনো নারীর লালসা করে, কখনো মদ ও নেশায় আসক্ত হয়ে মানব সমাজে ডেকে আনে বিপর্যায়। তাদের কোন ধর্ম থাকে না।
এই ভবিষ্যতবাণী আমাদেরকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। ভবিষ্যতবাণীতে আরও বলা হয়েছিল এমন সময় আসবে যখন রিম্যান্সের রক্ষীরা মানুষের মাংশ খাবে। প্রয়োজনে মানুষ শিকারের জন্য তারা বাইরেও যাবে। সভ্য সমাজের মানুষ যখন পশু স্বভাবে আক্রান্ত হবে তখন তারা মানুষকেও পশু জ্ঞান করবে এবং পশুর মতই তাদের শিকার করে খাবে। যদি না খায় তবে তাদের বংশধারা শেষ হয়ে যাবে।’ বলল বৃদ্ধ।
‘তোমরা কি আজও ফেরাউনকে খোদা মনে কর?’ কস্তুরী প্রশ্ন করলো বৃদ্ধকে।
মানুষ খুব দুর্বল প্রকৃতির। সে তাদের খোদা পরিবর্তন করে থাকে, বৃদ্ধ বললো, ‘আবার মানুষ কখনও নিজেই খোদা বনে যায়। এখন এই সময়ে তোমরাই আমাদের খোদা! কারণ আমাদের জীবন ও আমাদের মেয়েদের ইজ্জত-সন্ত্রম তোমাদের হাতে বন্দী। আমি তোমাদের কাছে শতাব্দী ধরে সংরক্ষিত গোপন রহস্য বলেছি তোমাদের প্রভুত্ত্ব স্বীকার করে। মানুষ মাত্রই মরণকে ভয় পায়, আমিও মৃত্যুর ভয়ে নারীদের ইজ্জত হারানোর চয়ে তোমাদের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছি।”
‘ফেরাউনও আমাদের মতই মানুষ ছিলেন। তিনি সে, যুগের মানুষদের ওপর ক্ষুধা, দারিদ্র ও বেকারত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি তোমাদের খোদা! মানুষ বাধ্য হয়ে বলেছিল, ‘হ্যা! তুমিই আমাদের খোদা! ক্ষুধা ও দারিদ্র মানুষকে সত্য থেকে সরিয়ে বহু দূরে নিয়ে যায়। তাকে দাসত্বের শিকলে বন্দী করে। প্ৰেমময় দরদী মানুষটি তখন মরে যায়।
মানুষের আসল খোদা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত বলেছেন। যখন মানুষের পেটে আগুন জ্বলতে থাকে, তখন সে তার এই মহত্বের কথা ভুলে যায়। সে সময় তার পেটের এই ক্ষুধা ও যন্ত্রণা যে দূর করতে পারে, মানুষ তার আনুগত্য কবুল করতে দ্বিধা করে না। মানুষের এই দুর্বলতাকে সম্বল করে জন্ম হয়েছে সম্রাট ও রাজার।
এই আনুগত্যলোভী যারা সম্রাট বা রাজা হতে পারে না, তারা হয় ডাকাত, সন্ত্রাসী, মহাজন। তারা তাদের শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য শুরু করে অত্যাচার। ছলে বলে কৌশলে মানুষকে করে অসহায়।এভাবেই সমাজে সৃষ্টি হয় শাসক ও শাসিত, জালিম ও মজলুম। এই ক্ষুধাই মানুষকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দেয়।’ কস্তুরী তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরল বুড়োর সামনে।
বৃদ্ধ কস্তুরীর এই কথা মেনে নিল না, বলল, “না, তোমার এই কথা ভুল, মানুষকে অমানুষ বানিয়েছে অর্থ ও সম্পদ। অমানুষ বানিয়েছে সোনারূপা ও ধনরত্বের লোভ-লালসা ‘
বৃদ্ধ এরই মধ্যে কস্তুরীর পরিচয় জেনে নিয়েছিল। সে জেনেছি, কস্তুরী মিশরের রাজধানী কায়রোর নামকরা নর্তকী। বৃদ্ধ তার যুক্তি প্রমান করার জন্য কস্তুরীকে বলল, ‘কে তুমি? তুমি কি কর? এদের মধ্যে ভূমি কি কারো স্ত্রী? কিংবা এদের কেউ কি তোমার আপনজন হয়?
কস্তুরী তাঁর ঐ প্রশ্নে খুবই বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেল। সে এ প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে ভিতরে ভিতরে ঘেমে নেয়ে উঠল। বৃদ্ধ তাকে নিরুত্তর দেখে বলল তুমি তোমার অনুপম সৌন্দর্য এবং ফুটন্ত যৌবনের জন্য নিজেকে খোদা মনে করো। আর তোমাকে পাওয়ার আশায় যার চেয়ে থাকে তারাও তোমাকে খোদা মনে করে। আমাকে বন্য ও পশু মনে করো না। আমার কাছে কাপড় আছে, সে কাপড় পরে কখনো কখনো আমি কায়রো যাই। তোমাদের সভ্য দুনিয়া ও সমাজকে চেয়ে দেখি। তারপরে আবার নির্জন ও সরল পৃথিবীতে ফিরে এসে কাপড় খুলে রাখি।
আমি তোমাদের সভ্য দুনিয়ার পালকী গাড়িতে রাজকন্যাকে ভ্রমণ করতে দেখেছি! তোমার মতই রূপসী শাহজাগী দেখেছি। নাচগান করা নর্তকী ও গায়িকাকে দেখেছি। আর তাদের যারা নাচায় ও গান করায় তাদেরকেও দেখেছি।
আমি ফেরাউনের যুগের কথাও শুনেছি আর আজকের ফেরাউনদের কর্মকাণ্ডও দেখছি। আমি এ সকল লোকদের পরিণামও দেখেছি। তােমাদের পরিণাম এখন তোমাদের চােখে পড়ছে না, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি।
তোমরা, গুপ্তধন লাভের লালসায় এতগুলো নিরপরাধ লোকদেরকে হত্যা করলে এ পাপের প্রায়শ্চিত্য তোমাকে করতেই হবে। এর থেকে কখনও রেহাই প্লাবে না। যে ফেরাউন গরীবদের অত্যাচার করে খোদা হয়ে বসেছিল সে ফেরাউনরাও কেউ অমর হয়নি। তারাও আসল খোদার হুকুমে কবরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তোমরাও কেউ বাচবে না, সময় তোমাদের কবরে নিয়ে যাবে।
তোমরা চাইলে কাল সকালে আমি তোমাদের গুপ্তধনের ভাণ্ডারের কাছে নিয়ে যাবাে। সেখানে তোমরা ফেরাউনের পরিণাম স্বচক্ষে দেখতে পাবে। তারা যদি খোদাই হত তাহলে তাদের এ পরিণাম হত না। আসল খোদা তিনিই যিনি এই সকল পরিণতি ঘটান! অথচ তাঁর কখনো এ রকম পরিণতি ঘটে না।
তুমি জানতে চাচ্ছিলে, আমি এখনও ফেরাউনদের খোদা মানি কি না। যদি সঠিক ও সত্য খবর শুনতে চাও, তাহলে বলবো, আমি ঐ লোকদের কখনও খোদা মানি না, যারা পাহাড়ের নিচে হাড়-হাড্ডির স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে।
আমি ও আমার কবিলার লোকেরা দুনিয়ার লালসা থেকে বাঁচার জন্য নিজস্ব একটি মতবাদ ও বিশ্বাস সৃষ্টি করে নিয়েছি। আমরা সেই বিশ্বাসেরই অনুসরণ করে থাকি।”
বৃদ্ধ থেমে থেমে ধীরস্থির কণ্ঠে কথা বলছিল। কস্তুরী তাকে দেখছিল আর বৃদ্ধের কথার মধ্যে তার জীবনের পরিণতি অনুসন্ধান করছিল। মার্ক লীর ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখায় তিরষ্কারের আভাস প্রকাশ পাচ্ছিল। সে শরাব পান করছিল আর বৃদ্ধের কথা শুনছিল।
বৃদ্ধ থামলে সে বৃদ্ধিকে উদ্দেশ্য করে বললে, “তুমি এখন তোমার নারীর কাছে চলে যাও। সকালে একটু আগেই উঠবে, আমাদের ভেতরে যেতে হবে।’
বৃদ্ধ চলে গেলে মার্ক লী কস্তুরীকে বললে, ‘এসো, আমরাও শুয়ে পড়ি।”
‘না, আমি তোমার সাথে যাবো না। আমি আজ আলাদা শোব।” কস্তুরী বললো।
মার্ক লী তার দিকে ঝুঁকে এলো। কস্তুরী পিছনে সরে গেল। মার্ক লী তাকে ধমক দিল। তখন ইসমাইল এসে তাদের দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। মার্ক লী তার চোখের দিকে তাকাল এবং সে চোখে দেখতে পেল ভয়ংকর খুনের নেশা জ্বলজ্বল করছে সেখানে।
মার্কলী আর কথা না বাড়িয়ে পিছনে সরে গেল। সে যখন চলে গেল, কস্তুরী ইসমাইলের বুকে মাথা, গুজে শিশুর মত কেদে উঠলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মার্ক লী গুহায় প্রবেশের জন্য অস্থির হয়ে উঠল। সে বৃদ্ধকে ভোরেই চলে আসার জন্য বলেছিল, কিন্তু বেলা উঠার পরও বৃদ্ধের দেখা মিলল না। অস্থিরতা দমন করতে না পেরে সে বৃদ্ধিকে খুঁজতে বেরোলো, কিন্তু আশেপাশে কোথাও বৃদ্ধকে দেখতে পেল না।
সে তখন বৃদ্ধকে ডাকতে শুরু করল, কিন্তু কোথাও থেকে কোন প্রতিউত্তর এল না।
আশংকা ও উত্তেজনায় মার্ক লীর চেহারা বিভৎসরূপ ধারন করলো। যেখানে সে জংলী নারী ও পুরুষদের বন্দী করে রেখেছিল সেখানে ছুটে গেল মার্ক লী। কিন্তু এ কী, মার্ক লী অবাক হয়ে দেখল, সেখানে কোন মানুষের চিহ্ন নেই। তারা সবাই পালিয়ে গেছে।
গ্রামের এক প্রান্ত-থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত মার্ক লী তাদের খুঁজে বেড়ালো। অনেক ডাকাডাকি করল, কিন্তু সবই বৃথা চেষ্টা। লোকগুলো গ্ৰাম থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে।
এবার ভয় ঢুকলো দুঃসাহসী মার্ক লীর মনেও। লোকগুলোকে সে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ওরা কি তাকে দেখছে? ওরা কি এমন কোন গোপন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে, যেখান থেকে ওরা তাকে দেখতে পাবে কিন্তু সে তাদের দেখতে পাবে না? সে এখন একা, ওরা কি এই সুজোগ নিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করবে? এক অনিশ্চিত যন্ত্রনা এসে ঘিরে ধরল তাকে।
হয়রান পেরেশান হয়ে সে আবার ফিরে এল তাবুর কাছে। নিজেকে সংযত ও সংহত করার চেষ্টা করল। মনে মনে ভাবল, ওদের আর আমার এখন কি দরকার? কবরের মুখ তো খােলাই আছে। বৃদ্ধ না থাকলেও ভেতরে প্রবেশ করতে. তাে। এখন আর কোন বাঁধা নেই।
তার আরও মনে হল তার হাতে যে নকশা আছে সেখানে ভেতরে কোথায় কি আছে সব বর্ণনা করা আছে। এ নকশা দেখে সে সব গুপ্তধন খুজে পেতে পারবে।
মার্ক লী ইসমাইল ও কস্তুরীকে বলল, “চলো ভেতরে ঢুকে দেখি।
ঈসমাইল নিরাসক্ত কন্ঠে বলল, ‘চলো’।
অগত্যা কস্তুরীকেও তাদের সঙ্গী হতে হল। তিনজন এক সঙ্গে উঠে এল উপত্যকায়। কবরের খোলা মুখের পাশে এসে দাড়াল তিনজন।
মার্ক লীই প্রথমে সে মুখ গহবর দিয়ে নিচে এলো। এটা একটা সুড়ং পথ। এ পথ কোথা দিয়ে কতদূর গেছে জানা নেই তার। ভেতরে বেশ অন্ধকার। মার্ক লী ওদের দিকে মুখ তুলে বলল, ভেতরে অন্ধকার। মশাল- জ্বেলে তোমরাও চলে এস। সবাই মিলে এক সঙ্গে এগিয়ে যাব।
মশাল জ্বেলে ইসমাইল এবং কস্তুরীও নেমে এল নিচে। তিনজন রওনা হলো সে সু্রং পথ ধরে। কিছু দূর গিয়েই ওরা দেখতে পেল সুড়ং পথ বন্ধ।
মার্ক লীর কোমড়ে ঝুলছিল তলোয়ার, হাতে শাবল। সে শাবল দিয়ে আঘাত করলো বন্ধ পথে, ফাঁপা শব্দ হলো তাতে। মার্কালী বলল, “এটা একটা পাথরের দরজা। ওপাশটা ফাঁকা।
পাথরের এ দরজা ভাঙার জন্য মার্ক লী ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল এর উপর। এক পাশে সামান্য ফুটা সৃষ্টি হল। ইসমাইল শুরু করল হাতুড়ী পেটা।
হাতুড়ী ও শাবলের সাহায্যে এক সময় পাথরের এই ছোট্ট দরজার এক পাশ ভেঙ্গে ফেললো ওরা। এবার অন্য পাশে মনযোগ দিল ওরা। অনেক পরিশ্রম ও কষ্টের পর দরোজা ভেঙে উল্টো দিকে পড়ে গেল।
দরজাটি ছিল নিরেট পাথরের এবং অসম্ভব ভারী। উল্টো দিকে ভেঙে পড়ার সাথে সাথে ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠলো পুরো গুহা।
ভেতর থেকে পনেরশ, ষোলশ বছরের আটকে থাকা গ্যাস ও দুৰ্গন্ধ এসে ঝাপটা দিল ওদের নাকে মুখে। সে গন্ধের চাপ সইতে না পেরে ইসমাইল ও কস্তুরী পিছন সরে গৈল। কিন্তু মার্কালী নাকে মুখে কাপড় জড়িয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
একটু পর গ্যাস বেরিয়ে গেলে ওরা এসে শামিল হলো মার্ক লীর সাথে। কয়েক কদম অগ্রসর হওয়ার পর নিচে নামার একটি সিঁড়ি পড়ল ওদের সামনে। কোন কথা না বলে ঘাড় ফিরিয়ে চােখে নিচে নামার ইঙ্গিত করে মার্ক লী পা বাড়াল সিড়ির দিকে।
সিঁড়ির ওপরে মানুষের মাথার খুলি, হাড়-হাড্ডি ও কংকাল পড়ে থাকতে দেখলো। তার সাথে দেখলো বর্শা ও ঢাল তলোয়ার পড়ে আছে। বুঝা যায়, এগুলো প্রহরীদের হাড় ও কংকাল। জীবন্ত অবস্থায় এদেরকে পাহারায় রেখেই এই বিশাল কবরের মুখে পাথর চাপা দেয়া হয়েছিল।
সিঁড়ি ভেঙে অনেক নিচে নেমে এল ওরা। প্রবেশ করল চারদিকে নিরেট পাথরের দেয়াল ঘেরা এক বিশাল হলরুমে। হলরুমটি এমন সুন্দর ভাবে আস্তর ও পালিশ করা যে, এখনো ঝকঝাক তকতক করছে। মনে হয়, গতকালই এতে নতুন করে রঙ করা হয়েছে। কারিগররা কত দীর্ঘ সময় ও কাল ধরে পাথর কেটে এই বিশাল হলরুম বানিয়েছে ভাবতে গিয়ে কোন থৈ পেল না তারা।
মার্ক লী অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল হল রুমে রাখা একটি সুন্দর নৌকার দিকে। নৌকার সাথে মাল্লাদের বেঁধে রাখা হয়েছিল যাতে ওরা পালিয়ে যেতে না পারে। এখনো নৌকায় ওদের মাথার খুলি ও কংকাল পড়ে আছে।
ইসমাইল ও কস্তুর বিন্বিত হয়ে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল এর কারুকাজ। হলরুমের একপাশে একটি অন্ধকার দরজা দেখতে পেল ওরা। ইসমাইল বলল, “মাক লী, ওই যে দরজা!”
ওরা সেই অন্ধকার দরজা দিয়ে করিডোরে পা রাখল। করিডোরের মেঝে অসম্ভব মসৃন৷ করিডোর ধরে ওরা অন্য একটি কামরায় এসে পৌছল। এ কামরায় ওরা দেখতে পেল অপূর্ব সুন্দর ও সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ী। গাড়ীর সামনে আটটি ঘোড়ার মাথার খুলি ও হাড় বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। গাড়ীর পালকি ও চালকের আসনেও মানুষের হাড় ও মাথার খুলি পড়েছিল।
ওরা এ কামরা অতিক্রম করে আরো সামনে বাড়ল। কিছুদূর এগুতেই একটি অপূর্ব সুন্দর কামরায় প্রবেশ করল ওরা। এটি সেই শিশমহল, যার দেয়াল কাচের মত মসৃণ ও স্বচ্ছ। এর মনোমুগ্ধকর নকশা ও ছবি। একপাশে একটি মঞ্চ। মঞ্চে উঠার জন্য কয়েক ধাপ সিড়ি।
সেই সিঁড়ি বেয়ে ওরা মঞ্চের ওপর উঠে এল। মঞ্চের ওপর শ্বেত পাথরের কারুকার্যময় বিশাল চেয়ার। দু’পাশের হাতলের মাথায় কেশর ফোলানো সিংহ মূর্তি। সেই বিশাল চেয়ারের ওপরে রিম্যালের মূর্তি বসানো, মূর্তিটিও মূল্যবান পাথরে গড়া।
তার পাশে একই রকম আরেকটি চেয়ার। চেয়ারটির কাছে এগিয়ে গেল ওরা। সেই চেয়ারে মাথার খুলি ও কংকাল পড়ে আছে।
কস্তুরী সেই মাথার খুলির দিকে ঝুকে দাঁড়ালো। দেখলো, সেই খুলির সাথে পড়ে আছে মহামূল্য মতির হার। হারে নীলা ও হীরার জ্যোতির্ময় পাথর বসানাে। শুধু হার নয়, কানের বহুমূল্য গহনা এবং হাতের আংটিও পড়ে আছে চেয়ারে। মূল্যবান হীরা জহরত ও পান্নার পাথরগুলো চমকাচ্ছে তখনো।
মার্ক লী একটি হার হাত দিয়ে উঠালো। কয়েক হাজার বছর অতীত হওয়ার পরও হীরা ও মতির চমক বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়নি। মশালের আলোয় হীরার দ্যুতি চমকাচ্ছিল।
মার্ক লী হারটি কস্তুরীর গলায় পরিয়ে দিতে গেল, কিন্তুরী চিৎকার করে ইসমাইলের পিছনে গিয়ে লুকালো।
মার্ক লী হো হাে করে হেসে উঠে বললে, আমি তো তোমাকে বলেই ছিলাম, আমি তোমাকে রানী ক্লিওপেট্রা বানাবো। ভয় পেয়ো না। কস্তুরী ! এসব হার সবই তোমার ”
“না।” কস্তুরী থরে থরো কম্পিত কণ্ঠে বললে, “না, আমি এই কংকাল ও খুলির মধ্যে আমার জীবনের পরিণাম দেখতে পাচ্ছি। এরাও তো আমার মতই জৌলুস ভরা জীবনের অধিকারী ছিল। কিন্তু কোথায় আজ সেই জৌলুস?
এটা তো সেই মিথ্যা খোদার দাবীদার অহংকারী এক বাদশাহর প্ৰেয়সীর কণ্ঠের মালা, যে খোদা আজ কংকাল হয়ে এখানে পড়ে আছে শত শত বছর ধরে। আমি এদের পরিণাম থেকে শিক্ষা নিয়েছি, যাদেরকে তাদের অহংকার খোদা বানিয়ে নিয়েছিল। আমিও আমার অন্তরের অহংকারী খোদাকে দেখতে পাচ্ছি।
কস্তুরী ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের গুহায় প্রবেশের পর থেকেই ভয় পাচ্ছিল। এই কংকাল ও অলংকারাদি দেখার পর এমন মারাত্মকভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল যে, সে ইসমাইলের হাত ধরে তাকে টেনে হেচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে চাইল। কী এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিল সে।
টানতে টানতে কস্তুরী ইসমাইলকে অস্থির কন্ঠে বলছিল, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো! চলো আমরা বেরিয়ে যাই! আমিও এই হাড়ের কংকাল ছাড়া আর কিছু নই!’
সে তার গলার বহুমূল্য হার টান মেরে ছিড়ে ফেলল এবং চােখ বন্ধ করে একদিকে ছুড়ে মারল। হারটি কংকালের মধ্যে গিয়ে পড়লো। সে তার আঙ্গুলের অমূল্য আংটিও খুলে ফেলে দিল আর চিৎকার করতে থাকলে, “আমি আমার পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। আমি মিথ্যা খোদাদেরও দেখে নিয়েছি। আমার আর কিছু দেখার নেই, এখান থেকে আমার কিছু নেয়ারও নেই। চলো, আমাকে এখান থেকে বাইরে নিয়ে চলো। এই গুহায় আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি মরে যাবো। আমিও কংকাল হয়ে যাবো এখানে থাকলে। চলো, জলদি চলো, আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।”
তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ছিল সীমাহীন আকুতি ও কান্না।
সে ইসমাইলকে টানতে টানতে রুমের বাইরে বারান্দায় নিয়ে এল।
ইসমাইল কস্তুরীকে সান্তনা দিতে চাইল। বললো, “তুমি শান্ত হও, কস্তুরী, স্বাভাবিক হও। আমরা চলে গেলে তো সবকিছু এই খৃস্টান একাই নিয়ে যাবে!’
কথা বলতে বলতে ইসমাইলের নজরে পড়ল আরেকটি দরজা। মশালটি ইসমাইলের হাতেই ছিল, সে কস্তুরীকে নিয়ে সেদিকে গেল এবং দরজা দিয়ে ঢুকে একটি খোলা কামরায় প্ৰবেশ করলো।
এ কামরার মাঝখানেও একটি মঞ্চ। মঞ্চের ওপরে শবদেহের কফিন রাখা। শবদেহের মুখটা খোলা।
এই সে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের শবদেহ, যার সামনে লোকেরা একদিন সিজদা করতো। তার লাশ সুগন্ধি মশলা ও অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান আরক দিয়ে এমন জমাটবদ্ধ করা ছিল যে আজ পনেরো শ’ বছর পরও তার চেহারা অবিকল ও অবিকৃত ছিল।
দু’জনই মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়েছিল সে লাশের দিকে। সাধারণত মানুষ মারা গেলে তার চোখ বন্ধ করে দেয়া হয়, কিন্তু ফেরাউনের চোখ দুটাে ছিল খোলা। ইসমাইল সেই চেহারার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। কস্তুরীও। কারো মুখে কোন কথা নেই, যেন বোবা হয়ে গেছে তারা।
অনেকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ যেন সন্বিত ফিরে এল উভয়ের, একই সাথে একে অপরের দিকে তাকালো ওরা। কিন্তু সে কেবল ক্ষণিকের, আবার ফেরাউনের চেহারায় ছুটে গেল ওদের দৃষ্টি। তারপর সে দৃষ্টি কফিন থেকে নেমে কামরার এদিক-ওদিক দুটাছুটি করতে লাগলো। চারদিকে কংকালের অজস্র হাড়।
ওরা কামরার ভেতর ঢাকনাবদ্ধ কফিনের মত আরো কয়েকটি কারুকার্য খচিত বাক্স দেখতে পেল। একটি বাক্সের ঢাকনা খোলা।
ইসমাইল এগিয়ে গেল বাক্সটির কাছে। চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। ” মশালের আলোয় দু’জনেই অবাক চোখে দেখলো, বাক্সটি হীরা-জহরত ও সোনার গহনায় পরিপূর্ণ। তার ওপর একটি মানুষের হাতের কংকাল পড়ে আছে, অপর হাতের কংকাল পড়ে আছে বাক্সের বাইরে। একজন মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কালের হাড়গুলোও পড়ে আছে বাক্সের পাশে।
‘হায়রে মানুষ!” ইসমাইল বললো, “এই লোকটি মরার আগেও গহনা ও হীরার টুকরো উঠাতে চেষ্টা করছিল। তার হয়তো আশা ছিল, এইসব ধনরত্ব নিয়ে সে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি, তার আগেই তার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং লোকটি এই গুপ্তধনের উপরেই পড়ে মারা যায়।”
কন্তুরী বলল, “বৃদ্ধ ঠিকই বলেছিল, মানুষের দুশমন ক্ষুধা নয়, মানুষের দুশমন তার সীমাহীন লোভ লালসা।
ইসমাইল সে বাক্সের উপর হাত রেখে বললে, ‘কস্তুরী, তুমিও তো লোভে পড়েই এসেছ, কিছু এখান থেকে নিয়ে যাও।”
“আমার লোভ মরে গেছে। আর সে কস্তুরীও মারা গেছে।”
ইসমাইল আবারও বাক্সের দিকে হাত বাড়ালো। কস্তুরী চিৎকার দিয়ে বললে, “বাঁচাে! ইসমাইল বাঁচাে।
তার এ চিৎকারে এমন কিছু ছিল যা মানুষের ইন্দ্রিয় রাজ্যে আঘাত হানে। ইসমাইল ছিল সদাসতর্ক ও উস্তাদ এক খুনী। কস্তুরীর আচমকা এ কানফাটা চিৎকার তাকে সতর্ক করে দিল। সেই চিৎকারের মর্ম বুঝতে পেরে সে মুহূর্তে একদিকে কাত হয়ে সরে পড়লো এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো, মার্ক লী উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তাকে আক্রমণ করে বসেছে।
আঘাত গিয়ে পড়লো বাক্সের ওপরে। মার্ক লী চিৎকার করে বলে উঠলো, “এই গুপ্তধন আমার!’
ইসমাইলের কাছে ছিল খঞ্জর। খঞ্জর দিয়ে তলোয়ারের আঘাত ঠেকাতে পারবে না, জানে ইসমাইল।
সে দেখলো কস্তুরীর পাশেই একটি বর্শা পড়ে আছে। সে দ্রুত ছুটে গেল বর্শার পাশে এবং চকিতে তা উঠিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। মার্ক লী ইসমাইলের ওপর আবার আঘাত হানার জন্য। ঘুরে দাঁড়িয়ে তলোয়ার তুলল, ইসমাইল বর্শা দিয়ে সে আঘাত ঠেকালো।
ইসমাইলের হাত থেকে মশাল পড়ে গিয়েছিল, কস্তুরী ছুটে গিয়ে মশাল তুলে নিল হাতে।
মার্ক লী আবারো ইসমাইলের উপর বেপরোয়া আক্রমণ চালালো, যেন সে গুপ্তধনের লোভে অন্ধ বা পাগল হয়ে গেছে।
ইসমাইল একদিকে সরে গিয়ে সে আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করল এবং মার্ক লীকে আর আঘাত করার সুযোগ না দিয়ে পাশ থেকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বর্শা দিয়ে আঘাত করল মার্ক লীকে।

শ্বেত পাথরের কারুকার্যময় বিশাল চেয়ার। দু’পাশের হাতলের মাথায় কেশর ফোলানো সিংহ মূর্তি। সেই বিশাল চেয়ারের ওপরে রিম্যালের মূর্তি বসানো, মূর্তিটিও মূল্যবান পাথরে গড়া।
তার পাশে একই রকম আরেকটি চেয়ার। চেয়ারটির কাছে এগিয়ে গেল ওরা। সেই চেয়ারে মাথার খুলি ও কংকাল পড়ে আছে।
কস্তুরী সেই মাথার খুলির দিকে ঝুকে দাঁড়ালো। দেখলো, সেই খুলির সাথে পড়ে আছে মহামূল্য মতির হার। হারে নীলা ও হীরার জ্যোতির্ময় পাথর বসানাে। শুধু হার নয়, কানের বহুমূল্য গহনা এবং হাতের আংটিও পড়ে আছে চেয়ারে। মূল্যবান হীরা জহরত ও পান্নার পাথরগুলো চমকাচ্ছে তখনো।
মার্ক লী একটি হার হাত দিয়ে উঠালো। কয়েক হাজার বছর অতীত হওয়ার পরও হীরা ও মতির চমক বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়নি। মশালের আলোয় হীরার দ্যুতি চমকাচ্ছিল।
মার্ক লী হারটি কস্তুরীর গলায় পরিয়ে দিতে গেল, কিন্তুরী চিৎকার করে ইসমাইলের পিছনে গিয়ে লুকালো।
মার্ক লী হো হাে করে হেসে উঠে বললে, আমি তো তোমাকে বলেই ছিলাম, আমি তোমাকে রানী ক্লিওপেট্রা বানাবো। ভয় পেয়ো না। কস্তুরী ! এসব হার সবই তোমার ”
“না।” কস্তুরী থরে থরো কম্পিত কণ্ঠে বললে, “না, আমি এই কংকাল ও খুলির মধ্যে আমার জীবনের পরিণাম দেখতে পাচ্ছি। এরাও তো আমার মতই জৌলুস ভরা জীবনের অধিকারী ছিল। কিন্তু কোথায় আজ সেই জৌলুস?
এটা তো সেই মিথ্যা খোদার দাবীদার অহংকারী এক বাদশাহর প্ৰেয়সীর কণ্ঠের মালা, যে খোদা আজ কংকাল হয়ে এখানে পড়ে আছে শত শত বছর ধরে। আমি এদের পরিণাম থেকে শিক্ষা নিয়েছি, যাদেরকে তাদের অহংকার খোদা বানিয়ে নিয়েছিল। আমিও আমার অন্তরের অহংকারী খোদাকে দেখতে পাচ্ছি।
কস্তুরী ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের গুহায় প্রবেশের পর থেকেই ভয় পাচ্ছিল। এই কংকাল ও অলংকারাদি দেখার পর এমন মারাত্মকভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল যে, সে ইসমাইলের হাত ধরে তাকে টেনে হেচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে চাইল। কী এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিল সে।
টানতে টানতে কস্তুরী ইসমাইলকে অস্থির কন্ঠে বলছিল, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো! চলো আমরা বেরিয়ে যাই! আমিও এই হাড়ের কংকাল ছাড়া আর কিছু নই!’
সে তার গলার বহুমূল্য হার টান মেরে ছিড়ে ফেলল এবং চােখ বন্ধ করে একদিকে ছুড়ে মারল। হারটি কংকালের মধ্যে গিয়ে পড়লো। সে তার আঙ্গুলের অমূল্য আংটিও খুলে ফেলে দিল আর চিৎকার করতে থাকলে, “আমি আমার পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। আমি মিথ্যা খোদাদেরও দেখে নিয়েছি। আমার আর কিছু দেখার নেই, এখান থেকে আমার কিছু নেয়ারও নেই। চলো, আমাকে এখান থেকে বাইরে নিয়ে চলো। এই গুহায় আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি মরে যাবো। আমিও কংকাল হয়ে যাবো এখানে থাকলে। চলো, জলদি চলো, আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।”
তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ছিল সীমাহীন আকুতি ও কান্না।
সে ইসমাইলকে টানতে টানতে রুমের বাইরে বারান্দায় নিয়ে এল।
ইসমাইল কস্তুরীকে সান্তনা দিতে চাইল। বললো, “তুমি শান্ত হও, কস্তুরী, স্বাভাবিক হও। আমরা চলে গেলে তো সবকিছু এই খৃস্টান একাই নিয়ে যাবে!’
কথা বলতে বলতে ইসমাইলের নজরে পড়ল আরেকটি দরজা। মশালটি ইসমাইলের হাতেই ছিল, সে কস্তুরীকে নিয়ে সেদিকে গেল এবং দরজা দিয়ে ঢুকে একটি খোলা কামরায় প্ৰবেশ করলো।
এ কামরার মাঝখানেও একটি মঞ্চ। মঞ্চের ওপরে শবদেহের কফিন রাখা। শবদেহের মুখটা খোলা।
এই সে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের শবদেহ, যার সামনে লোকেরা একদিন সিজদা করতো। তার লাশ সুগন্ধি মশলা ও অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান আরক দিয়ে এমন জমাটবদ্ধ করা ছিল যে আজ পনেরো শ’ বছর পরও তার চেহারা অবিকল ও অবিকৃত ছিল।
দু’জনই মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়েছিল সে লাশের দিকে। সাধারণত মানুষ মারা গেলে তার চোখ বন্ধ করে দেয়া হয়, কিন্তু ফেরাউনের চোখ দুটাে ছিল খোলা। ইসমাইল সেই চেহারার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। কস্তুরীও। কারো মুখে কোন কথা নেই, যেন বোবা হয়ে গেছে তারা।
অনেকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ যেন সন্বিত ফিরে এল উভয়ের, একই সাথে একে অপরের দিকে তাকালো ওরা। কিন্তু সে কেবল ক্ষণিকের, আবার ফেরাউনের চেহারায় ছুটে গেল ওদের দৃষ্টি। তারপর সে দৃষ্টি কফিন থেকে নেমে কামরার এদিক-ওদিক দুটাছুটি করতে লাগলো। চারদিকে কংকালের অজস্র হাড়।
ওরা কামরার ভেতর ঢাকনাবদ্ধ কফিনের মত আরো কয়েকটি কারুকার্য খচিত বাক্স দেখতে পেল। একটি বাক্সের ঢাকনা খোলা।
ইসমাইল এগিয়ে গেল বাক্সটির কাছে। চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। ” মশালের আলোয় দু’জনেই অবাক চোখে দেখলো, বাক্সটি হীরা-জহরত ও সোনার গহনায় পরিপূর্ণ। তার ওপর একটি মানুষের হাতের কংকাল পড়ে আছে, অপর হাতের কংকাল পড়ে আছে বাক্সের বাইরে। একজন মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কালের হাড়গুলোও পড়ে আছে বাক্সের পাশে।
‘হায়রে মানুষ!” ইসমাইল বললো, “এই লোকটি মরার আগেও গহনা ও হীরার টুকরো উঠাতে চেষ্টা করছিল। তার হয়তো আশা ছিল, এইসব ধনরত্ব নিয়ে সে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি, তার আগেই তার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং লোকটি এই গুপ্তধনের উপরেই পড়ে মারা যায়।”
কন্তুরী বলল, “বৃদ্ধ ঠিকই বলেছিল, মানুষের দুশমন ক্ষুধা নয়, মানুষের দুশমন তার সীমাহীন লোভ লালসা।
ইসমাইল সে বাক্সের উপর হাত রেখে বললে, ‘কস্তুরী, তুমিও তো লোভে পড়েই এসেছ, কিছু এখান থেকে নিয়ে যাও।”
“আমার লোভ মরে গেছে। আর সে কস্তুরীও মারা গেছে।”
ইসমাইল আবারও বাক্সের দিকে হাত বাড়ালো। কস্তুরী চিৎকার দিয়ে বললে, “বাঁচাে! ইসমাইল বাঁচাে।
তার এ চিৎকারে এমন কিছু ছিল যা মানুষের ইন্দ্রিয় রাজ্যে আঘাত হানে। ইসমাইল ছিল সদাসতর্ক ও উস্তাদ এক খুনী। কস্তুরীর আচমকা এ কানফাটা চিৎকার তাকে সতর্ক করে দিল। সেই চিৎকারের মর্ম বুঝতে পেরে সে মুহূর্তে একদিকে কাত হয়ে সরে পড়লো এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো, মার্ক লী উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তাকে আক্রমণ করে বসেছে।
আঘাত গিয়ে পড়লো বাক্সের ওপরে। মার্ক লী চিৎকার করে বলে উঠলো, “এই গুপ্তধন আমার!’
ইসমাইলের কাছে ছিল খঞ্জর। খঞ্জর দিয়ে তলোয়ারের আঘাত ঠেকাতে পারবে না, জানে ইসমাইল।
সে দেখলো কস্তুরীর পাশেই একটি বর্শা পড়ে আছে। সে দ্রুত ছুটে গেল বর্শার পাশে এবং চকিতে তা উঠিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। মার্ক লী ইসমাইলের ওপর আবার আঘাত হানার জন্য। ঘুরে দাঁড়িয়ে তলোয়ার তুলল, ইসমাইল বর্শা দিয়ে সে আঘাত ঠেকালো।
ইসমাইলের হাত থেকে মশাল পড়ে গিয়েছিল, কস্তুরী ছুটে গিয়ে মশাল তুলে নিল হাতে।
মার্ক লী আবারো ইসমাইলের উপর বেপরোয়া আক্রমণ চালালো, যেন সে গুপ্তধনের লোভে অন্ধ বা পাগল হয়ে গেছে।
ইসমাইল একদিকে সরে গিয়ে সে আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করল এবং মার্ক লীকে আর আঘাত করার সুযোগ না দিয়ে পাশ থেকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বর্শা দিয়ে আঘাত করল মার্ক লীকে।

নিয়ে এসেছে সেও ওদের সাথেই ছিল। এই গোয়েন্দা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সংবাদ এনেছে।”
একজন গোয়েন্দার শাহাদাত ও অপরজনের গ্রেফতারীর খবর সুলতান আইয়ুবীকে অস্থির করে তুললো। আলী বিন বুঝতে পারলেন এ খবরে সুলতান আইয়ুবী একটু বেশীই পেরেশান হয়ে পড়েছেন। নিহত গোয়েন্দা আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বাহিনীর একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সদস্য ছিল। আলী নিজেও তার মৃত্যুতে শোকাকুল ছিলেন, সুলতানের শোক দেখে তিনি আরো শোকার্তা হলেন। এই সদস্য সামরিক গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং এই তথ্যের সত্যতা নিরুপণে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন।
গোয়েন্দা বিভাগের একজন দক্ষ ব্যক্তির শাহাদাতে সুলতান যে পরিমাণ পেরেশান হলেন, নিয়মিত বাহিনীর শত শত সৈন্যের শাহাদাতেও তিনি এতটা আফসোস করেন না। আলী কমীর শাহাদাতে তিনি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান। এ ধরনের খবর পেলেই তাঁর চেহারা মলিন ও বিষন্ন হয়ে যায়। এ ধরনের খবরে তিনি কতটা দুঃখ পান, তা তাকে কেউ না দেখলে উপলব্ধি করতে পারবে না। ’
একজন গোয়েন্দার শাহাদাত ও অপর একজনের গ্রেফতারীর সংবাদে আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইয়ুবীর মুখে দুঃখ ও বেদনার গভীর ছাপ দেখে বললেন, “আমীরে মুহতারাম! আপনার চেহারা যখন বিষন্ন হয়, তখন মনে হয় সমস্ত মুসলিম জাতটাই বিষন্ন হয়ে পড়েছে। ইসলামের সম্মান। ও গৌরব জীবনের কুরবানী চায়। একদিন আমাদের দু’জনেরও শহীদ হতে হবে। আমাদের দুটি গোয়েন্দার ক্ষতি হয়েছে, আমি আরও দুজন গোয়েন্দাকে পাঠিয়ে দিব, এই ধারা তো আর বন্ধ থাকবে না।”
“এই ধারা বন্ধ হয়ে যাবে আমার মনে এমন কোন সন্দেহ বা আশংকা নেই আলী।”
গোয়েন্দার শাহাদাতে আমার মনে একই সাথে দুটি চিন্তার জন্ম হয়। ভাবি, দ্বীনের এমন একজন মুজাহিদ, আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেল, যে আমাদের ভাই হয়েও আমাদের কাছ থেকে ছিল বহু দূরে।
দ্বীনের জন্যই সে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। দেশ থেকে দূরে, বিবি বাচ্চা থেকে দূরে, বোন-ভাই ও মা-বাবা থেকে দূরে।
সেই দূর বিজনে চারদিকে শক্ৰ পরিবেষ্টিত অবস্থায়ও সে তার দায়িত্বের কথা ভুলেনি। নিঃসঙ্গতার যাতনা সয়েছে, একাকীত্বের বেদনায় ভুগেছে, কিন্তু দায়িত্বে গাফলতি করেনি। আর এমন নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করেছে যে, দায়িত্বের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত কুরবানী দিয়েছে।
অথচ এ জাতিতেই আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে যায় কেবল একটু আরাম আয়েশে জীবন যাপন করার জন্য নিজের ঈমান বিক্রি করে দেয়। এসব বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকরা সামান্য বিলাসিতার জন্য শত্রুর যড়যন্ত্রে পা দিয়ে ইসলামের মূল কাটে। অনেকে না বুঝে, আবার কেউ কেউ জেনে বুঝেই ইসলামের ধ্বংস সাধনে শক্রকে সহযোগিতা করে।”
আপনি কি চান, সেনাবাহিনীর অফিসাররা এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার কাজে নেমে পড়ুক? আলী বিন সুফিয়ান বললো, অথবা আপনি নিজে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্রুসেডদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জনগনকে সচেতন করতে আত্মনিয়োগ করতে চান?
আমার মনে হয়, অনেকে ঝোঁকের বশে শক্ৰদের সহযোগিতা করে। এতে যে দেশ ও জাতির কি মারাত্মক ক্ষতি হয় তা তারা বুঝতে পারে না। অনেক সময়, এতে যে শক্ৰদের সহযোগিতা করা হয়, তাও তারা বুঝতে পারে না। বুঝতে পারলে হয়ত অনেকেরই চিন্তায় পরিবর্তন আসবে এবং তারা এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবে।”
‘না’!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, “যখন মানুষ তার ঈমান বিক্রি করতে চায়, তখন তার সামনে কোরআন রাখলেও সে যখন কারো সামনে অর্থ-সম্পদ, নারী ও শরাব রাখা হয় তখন কথার ফুলঝুরিতে মন ভরে না তাদের। যারা অর্থ-সম্পদ, নারী ও শরাবের নেশায় আচ্ছন্ন হয়, সদুপদেশ তাদের মনে নেশা ধরাতে পারে না। ওরা হতে চায় সুখের রাজ কুমার, বিপ্লবের সৈনিক হওয়ার আকাঙ্খা থাকে না তাদের।
গাদাররা শিশু নয়, মুর্থ, আহাম্মক বা অবুঝও নয়। এরা সবাই কোন না কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা অফিসার। এরা শাসন ও সেনা বিভাগের উচ্চ পদের লোক ! এরা সাধারণ সৈনিকও নয়।
শক্ৰদের সাথে যোগসাজশ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সামরিক অফিসাররাই করে থাকে। সৈনিকরা যুদ্ধ করে মরে, তারা গাদ্দার হয় না, বড়জোর ধোকায় পড়ে বিদ্রোহের পথে ধাবিত হয়। কেউ ধোঁকায় পড়লে তাকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া যায়, কিন্তু গাদ্দাররা জেনেবুঝেই গাদ্দারী করে।
গাদ্দারদের সুপথে আনার জন্য আমি ওয়াজ নসিহত করে বৃথা সময় নষ্ট করতে চাই না। কোন শাসক দুর্বল বা দায়িত্বহীন হলে এ পথ অবলম্বন করে। শুধু কথা ও আবেগময় বক্তৃতায় সে জাতিকে তুলিয়ে রাখতে চায়। প্রশাসনিক অদক্ষতা ঢাকা দেয়ার জন্য বাগাড়ম্বরকেই সে একমাত্ৰ হাতিয়ার বানিয়ে নেয়।
এ কথা কেবল সরকারের বেলােয়ই প্রযোজ্য নয়, তুমি দেখবে, মানুষ যত বড় বিপদে পড়ে তত জোরে চিৎকার দেয়। বড় রকমের চিৎকার, সে যে বেশী রকম অসহায় তাই প্রমাণ করে। ,
প্রতিপক্ষের মোকাবেল চিৎকার দিয়ে হয় না, উপযুক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে তার মােকাবেলা করতে হয়। ওরা কোন পথে কেমন করে কত জোরে আঘাত হানছে সে খবর নিয়ে প্রত্যাঘাত করে জবাব দিতে হয় তার।
আমি জাতির কাছে চিৎকার করে আমার অসহায়ত্ব ঘোষণা করতে চাই না। তাতে জনগণ আরো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। আমাদের অসহায় ভেবে তারা আমাদের দিক থেকে মুখও ফিরিয়ে নিতে পারে। আমি কাজের মধ্য দিয়েই অবস্থার পরিবর্তন করব। জাতি আমার কাছে খাদ্য চাইলে আমি তাদেরকে কথা ও উপদেশ দিয়ে পেট ভরাতে পারব না। গাদ্দারদের আমি তাদের পাওনা শান্তি থেকে বঞ্চিত করবো না। তুমি মনে রেখো, শক্ৰদের আগেই গাদ্দার তার বেঁচে থাকার অধিকার হারায়।
আলী বিন সুফিয়ান!! আমাকে শাসনের কাজ রেখে ভাষণের কাজে ব্যস্ত হতে বলে না। যারা বেশী কথা বলে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না। মনে রেখো, মিথ্যাবাদীরাই বেশী কথা বলে।”
মিশরে যে বিদ্রোহের আশংকা ছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। উচ্চপদস্থ কিছু অফিসার ও প্রশাসক ধরা পড়েছে। তাদের শাস্তিও দেয়া হয়েছে। দুজন নিজেরাই সুলতান আইয়ুবীর কাছে এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। সুলতানও তাদের ক্ষমা করেছেন।
আইয়ুবীর কথাই সত্যি, গাদ্দার ও দেশে অশান্তি সৃষ্টিকারীরা প্ৰশাসন ও সামরিক বাহিনীর অফিসার পর্যায়ের লোকই ছিল। গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল।
মিশরে ১১৭৪ খৃস্টাব্দের আগে সৈন্যদের মাঝে বিদ্রোহের নাম নিশানাও ছিল না। ক্রুসেডদের গোয়েন্দা সংস্থা ও দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতার ফলেই মিশরে এ বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছিল। এখনও তাদের কার্যকলাপ অব্যাহত আছে, যদিও তা খুবই গোপনে চলছে।
সুলতান জানেন, সহজে এই ধাঁরা বন্ধ করা যাবে না। এ জন্যই সুলতান আইয়ুবী তার গোয়েন্দাদের খৃস্টানদের দেশে নিয়োগ করে রেখেছেন, যেন ছােবলকারীদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়া যায়। এই সচেতনতা ও পাল্টা আঘাত হানার কৌশল প্রয়োগের ফলেই সুলতান আইয়ুবী বিশ্ব ইতিহাসের শ্ৰেষ্ঠতম ও নিপূণ যোদ্ধা হিসাবে আজো সমানভাবে স্বীকৃত।
আক্রা ফিলিস্তিন রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ, সেখানে ক্রুসেডদের সবচেয়ে বড় পাদ্রী, তাদের মহান রক্ষক থাকে। সেখান থেকেই ক্রুসেডার ও তাদের কমান্ডাররা নির্দেশনা, উৎসাহ ও প্রেরণা পেয়ে থাকে।
বলতে গেলে আক্রাই ছিল ক্রুসেডদের হাইকমান্ডের ঠিকানা। আক্রাকে হেড কোয়ার্টার বানিয়ে তারা মুকাদ্দাসকে সুলতান আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গীর কবল থেকে রক্ষা করার পরিকল্পনা নিত।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top