৮. ফেরাউনের গুপ্তধন


সে তাদেরকে মানসিকভাবে আরো শক্ত করে গড়ে তোলার জন্য প্রাচীর থেকে পড়ে যাওয়া সাখীর গল্প শোনাল নির্বিকার চিত্তে। তাদেরকে বলল, মঞ্চের মত উপত্যকার কান্নার শব্দের কথা।
সবাই অভিযানে বেরিয়ে পড়ার জন্য প্ৰস্তুত হলো। উটগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না বলে এগুলোর দেখাশুনা ও রাখালীর জন্য একজনকে রেখে যাওয়া প্রয়োজন। তার সাথে আপাতত কস্তুরীকেও এখানেই রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মার্ক।
মার্ক লীর আশা, ভিতরে যাওয়ার কোন একটা সহজ রাস্তা সে অবশ্যই পেয়ে যাবে। তখন কস্তুরীকে সে সেই পথে ভিতরে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে রকম কোন পথের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত তাকে এখানেই থাকতে হবে। সে কস্তুরীর দেখাশোনার জন্য ইসমাইলকে রেখে গেল তার সাথে।
মার্ক লী ইসমাইলকে বলল, তুমি কস্তুরীকে দেখাশোনা করার জন্য এখানেই থাকবে। তার আরাম আয়োশের প্রতি খেয়াল রাখবে। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে এসে তোমাদের দু’জনকে নিয়ে যাব।’,
মার্ক লী তার দলবল নিয়ে রওনা হয়ে গেলো। আগের পথ বদলে পার হলো পায়ে হেঁটে। আগের মত অনিশ্চিত অবস্থায় পা বাড়াতে হলো না তাদের। রাস্তাটি মার্ক লীর পূর্ব পরিচিত। আগে আগে নিৰ্ভয়ে হেঁটে গেলো ও, পুরো বাহিনী তার পিছনে তাকে অনুসরণ করল।
যতই লোকগুলো এগিয়ে যেতে লাগলো ততই ভয় ক্ৰমশ: বাড়তে লাগল তাদের। তারা জানতো পথটি দুৰ্গম, কিন্তু বিরান ও ভয়াবহ অঞ্চল বিকট পাহাড় ও টিলা তারা আগে কখনও দেখেনি। তারা যখন কান্না উপত্যকায় পৌঁছলো তখন সকলে আতংকিত চিত্তে এদিক ওদিকে দেখতে লাগলো। তারা বিশ্বাস করতে পারুল না, এটা স্রেফ বাতাসের খেলা। তাদের মনে হলো, নি:সন্দেহে একদল মেয়ে বা তাদের প্ৰেতাত্মা এখানে কান্নাকাটি করছে।
কাফেলার সবাই এ অঞ্চলের গল্প শুনেছিল মার্ক লীর কাছে। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বলচিত্তের, তারা ভাবল, তাদেরকে সাহস জোগানোর জন্যই মার্ক লী এ গল্প শুনিয়েছে। এ ভাবনা মনে হতেই তারা আরো আতংকিত হয়ে পড়ল। কিন্তু পুরষ্কারের লোভে এই আতংক ও ভয় দাবিয়ে রাখল। ওরা তবে এদের মধ্যে যারা ক্রুসেডের বেতনভুক গোয়েন্দা ও কমাণ্ডো ছিল তারা ততটা ভীত হলো না। তারা তাদের অফিসার মার্ক লীর নির্দেশ তামিল করে ঠিকমতই এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের দেখাদেখি এবং পুরস্কারের লোভে বাকীরাও “অগ্রসর হতে লাগল।
ভীত সন্ত্রস্ত চিত্তে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই তারা সবাই এসে জড়ো হল কান্না উপত্যকায়।
সবচে বিপদজনক এবং কঠিন অঞ্চল এখন তাদের সামনে। সেই গহীন খাদ ও তার মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ ভঙ্গুর দেয়াল এবার পার হতে হবে অভিযাত্রীদের। অতল গহীন খাদ ও চিকন দেয়াল দেখে দলের সবাই খুব ভয় পেয়ে গেল।
মার্ক লী বেশ অসুবিধায় পড়ে গেলো ওদের নিয়ে। বলল, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি এর আগেও এ দেয়াল পার হয়েছি। একটু সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে, এই যা।”
মার্ক লীই সবার আগে পা রাখলে সেই প্রাচীরে। তার পিছনে পা বাড়ালো তার এক কমাণ্ডো। তাদের দেখাদেখি সকলেই সেই দেয়াল পার হওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো। একটু পর দেখা গেল, মার্ক লী দেয়াল পার হয়ে ওপারে চলে গেছে।
আরো কয়েকজন ওপারে পৌঁছে গেল। এখানো যারা দেয়ালে চড়ার সুযোগ পায়নি এ দৃশ্য দেখে তাদের সাহস বেড়ে ‘ গেল।
এমন সময় একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল, কেউ একজন দেয়াল থেকে ছিটকে পড়ে গেল ‘অতল গহীন খাদের গভীরে। তার সাথে সাথে চিৎকারের ধ্বনিও নেমে গেল নিচের দিকে। এক সময় হারিয়ে গেল। সে বিকট চিৎকারের ধ্বনি।
এমনিভাবে কিছুক্ষণ পরপর একটি করে চিৎকার ভেসে আসতে লাগল এবং তা খাদের গভীরে হারিয়েও গেল। মার্ক লী গুণে দেখল, এ পর্যন্ত পাঁচটি চিৎকার ভেসে এসেছে। দলের সবাই যখন ওপারে গিয়ে একত্রিত হলো তখন দেখা গেল, তাদের পাঁচজন সাখী নেই।
মার্ক লী তাদের বললো, সামনে আর এমন ভীতিকর পথ নেই। আমরা আমাদের লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি এসে গেছি। আশা করছি, এই পথে আর তোমাদের ফিরে যেতে হবে না। একটি সহজ সরল পথ নিশ্চয়ই পেয়ে যাবো।’
ওখান থেকে আবার ওরা রওনা হলো। ওদের গন্তব্য নিম্নাঞ্চলের দিকে। পাথুরে পাহাড় অতিক্রমের পর মার্ক লী সেদিনের মত যাত্রা বিরতি করুল। বলল, “আজ দিনের মত এখানেই আমরা বিশ্রাম নেবো। এই ঢালু এলাকার শেষ প্রান্ত থেকেই শুরু হয়েছে সবুজ প্রান্তর। ওখানেই আছে ফেরাউনের সম্পদের পাহারাদার রক্ষীরা। রাতে ওখানে হানা দেবো আমরা।”
রাত গভীর হলো। মার্ক লী তার বাহিনী নিয়ে রওনা হলো আবার। উপত্যকার এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পাথুরে মূর্তি। ওরা সেগুলো অতিক্রম করে প্রান্তরের শেষ মাথায় এসে পৌছলো। এখান থেকেই শুরু হয়েছে শ্যামল সবুজ গভীর নিম্নাঞ্চল! মার্ক লী সেখান থেকে একটু দূরে সবাইকে লুকিয়ে থাকতে বলে মাত্র দু’জন লোককে সঙ্গে নিয়ে নিচে চলল। অন্যান্যদের বলে গেলো, “তোমরা রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়। দুজন পাহারায় থাকবে। আমরা ইঙ্গিত দিলে বাকীদের জাগিয়ে দেবে।’

নিচে তখন মৃত্যুর নিরবতা বিরাজ করছে। কোথাও কোন সামান্য আলোও দেখা যাচ্ছে না। তারা অনেক কষ্টে নিচে নেমে এল। তারপর এগিয়ে চলল সবুজ শ্যামল গ্রামের ভেতর। কিন্তু কিছু দূর এগুনোর পর কি হলো, মার্ক লী সঙ্গীদের বলল, “না, আজ আর যাবো না, অভিযানের আগে দিনের বেলায় এলাকাটা আরেকবার দেখে নিতে চাই।’

কস্তুরী পেশাদার নর্তকী, সব সময় আমোদ প্রমোদ ও মজলিশী মেজাজে থাকায় অভ্যস্থ। শরাব পান, আড্ডা দেয়া ও পানির মত টাকা খরচ করে সময় কাটানো তার অভ্যাস। মার্ক লীরা চলে যাওয়ায় সে বলতে গেলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। এই ভয়ানক নির্জনতায় মার্ক লী তাকে এমন একটি লোকের সাথে রেখে গেল যাকে সে চেনে না।
মশহুর নর্তকী হিসাবে অনেকের মত ইসমাইলও তাকে চিনতো, কিন্তু সে ইসমাইলকে চিনতো না বা তার সম্পর্কে তার কোন ধারনাও ছিল না। ইসমাইল অপরাধ জগতের লোক হলেও তার চেহারায় তার ছাপ ছিল না। তার চেহারা ছিল সুশ্ৰী ও সুন্দর। আচরণ ছিল ভদ্র ও মার্জিত। স্বাস্থ্য ছিল সুঠাম ও সুগঠিত। তাই অপরাধ জগতের লোক হওয়ার পরও বাইরে থেকে তাকে অভিযাত ঘরের সম্মানিত লোক বলে মনে হত। ফলে কস্তুরী তার আসল পরিচয় জানতে পারল না।
ইসমাইল কস্তুরীর সঙ্গে কথা বলতে ইতস্ততঃ করছিল। সারাদিন সে কস্তুরীর ভালমন্দের খেয়াল রাখলেও একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখল। কস্তুরীর মনে হল লোকটা অতিশয় ভদ্র। সন্ধ্যার পর সে কস্তুরীকে ভুনা মাংস গরম করে দিল। খাওয়ার পর উৎকৃষ্ট শরাব দিল পান করতে। বলল, “পানাহারের পর শুয়ে পড়ুন। যদি কোন প্রয়ােজন হয় তাবুর মধ্য থেকে ডাক দিলেই আপনি আমাকে হাজির পাবেন।”
ইসমাইল বাইরে বেরিয়ে গেল। কস্তুরী খাওয়ার পর শরাবও পান করল, কিন্তু শোয়ার পর কিছুতেই তার ঘুম এল না। নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা তাকে ভীষণ রকম অস্থির করে তুললো।
কস্তুরী তার সৌন্দর্য্য এবং অভিনয় দক্ষতা নিয়ে গর্ব অনুভব করতো। নৃত্যপটিয়সী হিসাবে লোকজন তার প্রশংসা করলে অহংকারে ফুলে উঠত তার বুক। সে দেখেছে, পুরুষমাত্রই তার চারপাশে ঘুর ঘুর করে আনন্দ পায়। সবাই তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করে। বিশেষ করে অভিজাত ঘরের লোকদের কাছে তার কদরই আলাদা। ফলে তার ধারণা ছিল, ইসমাইলও সে রকম কিছু চেষ্টা করবে। এই গর্ব ও অহংকার নিয়েই সে অপেক্ষা করছিল ইসমাইলের চাটুকারিতার। কিন্তু ইসমাইল তার ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ প্ৰকাশ করেনি দেখে কাতুরীর আহমে আঘাত লাগল।
শুয়ে শুয়ে এ নিয়েই চিন্তা করছিল সে, কিন্তু এ চিন্তার কোন শেষ ছিল না। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরও যখন কতুরীর কিছুতেই ঘুম এল না তখন সে তাবু ছেড়ে বাইরে এল এবং ইসমাইলের তাবুতে এসে দেখল, সেও তখনো ঘুমায়নি। কস্তুরীর আগমনে ইসমাইল উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার, কোন অসুবিধা হচ্ছে?”।
“এই নিশুতি রাতে নির্জন প্রান্তরে একটা মেয়ে একা একা থাকতে পারে বুঝি! তাঁর ভয় লাগে না?” সে তার কাছে বসে পড়ে বললে, “তুমি মনে হয় মুসলমান?”
“কি ব্যাপার! ধর্ম নিয়ে আবার মেতে উঠলে কেন? ইসমাইল উত্তর দিল, “তোমার আগ্রহ তো থাকার কথা শুধু অর্থের সাথে, সম্পদের সাথে, কোন ধর্মের সাথে নয়। আমার নাম ইসমাইল, তবে এখন আর আমার কোন ধর্ম নেই।”
কস্তুরী হেসে একটু বিস্মিত কণ্ঠে বললো, কিন্তু কোন ইসমাইল তুমি? আহমদ দরবেশের বিশেষ পছন্দের কেউ?” সে প্রশ্ন করলো, “এই লোকটি কে, যে এ দলের নেতৃত্ব করছে? আমাকে সে তার নাম সুলায়মান সিকান্দার বলেছে, কিন্তু তাকে আমার মুসলমান বলে মনে হয় না।”
‘তোমার সন্দেহ অমূলক নয়, লোকটি আসলেই মুসলমান নয়।
‘তাহলে বলো, লোকটা এ দেশেরওঁ নয়”।
‘হ্যাঁ, এ ব্যক্তি মিশরীয় নয়, সুদানীও নয় এবং তার প্রকৃত নাম সুলায়মান সিকান্দারও নয়।”
‘তবে সে কে?” কিন্তুরী প্রশ্ন করলো, “তার আসল নাম কি? কোথাকার লোক?”
“আমি তার নাম ও পরিচয় তোমাকে বলতে পারবো না।” ইসমাইল বলল এই গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই আমি মূল্য পাই। তোমার তো লোকটি কে, এ নিয়ে কোন আগ্রহ থাকার কথা নয়? তুমি তোমার দাবী মত মূল্য পেয়েই তাকে আনন্দ দান করতে এসেছে ; আর এটাই তোমার পেশা। সে তোমাকে গুপ্তধনের কিছু অংশ দেয়ার অঙ্গীকার করে থাকলে হয়তো তাও পেয়ে যাবে। কিন্তু এ জন্য তার পরিচয় জানা তোমার জন্য জরুরী নয়।”
গুপ্তধন!! সে তো আমার পাওনা!” কিন্তুরী বললে, “সে আমাকে যে মূল্য দিয়েছে, সে মূল্য এই ভয়াবহ মরু নির্জনে আসার জন্য অতি নগন্য। আমি তো গুপ্তধনের অংশ নিতেই তার সঙ্গে এসেছি!”
‘তুমি কি মনে করে, যে গুপ্তধন লাভের আশায় তুমি এখানে এসেছে, সেই কাংখিত গুপ্তধন এত সহজেই পাওয়া যাবে? আর তা পাওয়া গেলে তার অংশ সে তোমাকেও দান করবো?” ইসমাইল প্রশ্ন করলো।
‘কেন, তোমার এতে সন্দেহ আছে? মনে রেখো, আমি এমন মূল্যবান এক মেয়ে, লোকেরা যাকে গুপ্তধনের মূল্য দিয়েও কিনতে আগ্রহী।” কস্তুরী একটু অহংকারের স্বরেই বললো, “এই লোক আমার কি মূল্য আদায় করবে! আমি এমন সব আমীরজাদা, শাহজাদাদেরকে গোলাম বানিয়ে রাখি, সে তুলনায় এ তো কিছুই নয়।”
‘সে আর কত দিন?” ইসমাইল হেসে বললো, ‘খুব বেশী হলে আর দু’ বছর, চার বছর! তারপর তোমার কানাকড়ি মূল্যও থাকবে না। তুমি পাগলিনীর মত অলিতে গলিতে ছুটে বেড়ালেও কেউ জিজ্ঞেসও করবে না। যার কাছে গুপ্তধন আছে, তার কাছ থেকে এক কস্তুরী গেলে দশ কস্তুরী ছুটে আসবে। শোনো কিন্তুরী, বেশী অহংকার করো না।”
‘কেন করবো না?” কস্তুরী বললো, “এই লোক আমার রূপের যাদুতে এমন ফেসে গেছে যে, সে আমার কাছে কসম খেয়ে বলেছে, সে শুধু আমাকে পাওয়ার জন্যই গুপ্তধনের খোজে বেরিয়েছে। সে আমাকে আলেকজান্দ্ৰিয়া নিয়ে যাবে। সেখানে আমরা সাগর তীরে এক আলীশান মহল পড়বো।
তারপর আমি আর নর্তকী থাকবো না। এতেও কি তোমার সন্দেহ আছে?”
‘তাতে আমার কোন সন্দেহ করার দরকার নেই। তবে যে আশ্বাস তোমাকে সে দিয়েছে তাতে মস্ত বড় এক ফাঁক রয়ে গেছে।’ ইসমাইল বললে, “আমাকেও উপযুক্ত মূল্য দিয়েই এখানে পাঠিয়েছেন আহমদ দারিবীশ। তার কথাই আমার কাছে হুকুম। তিনি আমাকে বলেছেন, তুমি ওর সাথে যাও, তাই আমি এসেছি। এটাই আমার পেশা, আমি একজন ভাড়াটে খুনী। উপযুক্ত মূল্য পেলে আমি খুন করি, কিন্তু মিথ্যা কথা কখনও বলি না। আমি কখনও ধরা পড়ি না, কারণ আহমদ দরবেশ আমাকে বাঁচিয়ে দেন।
আমার মধ্যে আর একটি জিনিস আছে, সে হলো আমি নারীকে সম্মান দেই। আমি জানি না, কেন আমি এমনটি করি। নারী সে পর্দানশীল ভদ্র মহিলা হোক অথবা নর্তকী বা বিলাস সুন্দরী, আমি সকলকেই সম্মান করি। আমি কখনো কোন মেয়েকে ধোঁকা দেই না, তোমাকেও ধোঁকার মধ্যে রাখবো না। তোমাকে বলতে বাঁধা নেই, এ গুপ্তধন কারো মহল তৈরীর জন্য তালাশ করা হচ্ছে না, এর অর্থ মিশরের মূল উৎপাটনে ব্যবহার হবে। এ অর্থ দিয়ে এখানে খৃস্টীয় শাসন কায়েম করা হবে, মসজিদগুলোকে গীর্জা বানানো হবে। আর যদি তা সম্ভব না হয় তবে এ গুপ্তধন দেশের বাইরে চলে যাবে। আমি জানি, মিশরের প্রতি তোমার কোন ভালবাসা বা দরদ নেই, আমারও নেই। আমরা দু’জনেই পেশাদার! পাপ আমাদের পেশা।
আর একবার শুনে নাও! তোমার সৌন্দর্য ও যৌবনের কাল আর অল্পই বাকী আছে, আর এই লোক তোমাকে সাথে নিয়ে এসে শুধু আমোদ-স্ফুর্তি ও আরাম-আয়েশের জন্য। তার দৃষ্টিতে তুমি এক বিলাস কন্যা ছাড়া কিছু নও। যদি তোমার ওপর তার দয়া হয়, তবে দু’একটা হীরার টুকরো হয়তো দিতে পারে, কিন্তু কোন মহল তৈরি করবে না। সে যদি কোন মহল তৈরীই করে তবে তা তোমার জন্য নয়, সে এক নব যৌবনা রূপসীর জন্য ; যে নব যৌবনা তুমি হতে পারবে না। তোমার চেহারায় এখনই ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। আজ হয়তো সে ভাঁজ সুন্দর লাগছে, কিন্তু আরেকটু গভীর হলে এ ভাঁজই তোমার সৌন্দর্যের চাহিদা শেষ করে দেবে।’
ইসমাইলের মুখে ছিল হাসি, ভঙ্গিতে ছিল আন্তরিকতার ছোঁয়া। সেখানে ধোঁকা বা মিথ্যার লেশ ছিল না। কস্তুরী কাউকে চােখে আঙ্গুল দিয়ে এমনভাবে সত্যকে তুলে। ধরতে আগে কখনও দেখেনি। তার ধারণা ছিল, ইসমাইল তার পিছনে দৌড়াতে শুরু করবে। কিন্তু তার পরিবর্তে সে তার যৌবনের ভাটির টানের কথা কি অবলীলায় বলে দিল! যে কস্তুরী তার সৌন্দর্যের প্রশংসা শোনায় অভ্যস্থ, যে নিজেকে মিশরের রাণী কল্পনা করতো, ইসমাইলের কথায় তার সে স্বপ্নের প্রাসাদ চূৰ্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। ইসমাইলের বলার ভঙ্গিতে যে যুক্তি ও বাস্তবতা ছিল, কস্তুরী তা অস্বীকার করতে পারল না। বরং সে সত্য অবলোকন করে তার অন্তরের অতল তলে হাহাকারের সুর বেজে উঠল।
নিস্তব্ধ নিরব রাত থমকে থাকল না, সে ক্রমশঃই এগিয়ে চলল। কস্তুরীর চােখে ঘুম এলো না। ইসমাইলের সাথে কথা বলেই রাত পার করে দিতে চাইল কিন্তুরী। সে তার এই মনােভাব গোপন রাখলে না। ইসমাইলও নিরাশ করলো না তাকে।
কথা বলতে বলতেই শেষ রাতের দিকে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল কস্তুরী। যখন ঘুম ভাঙল, দেখল, ইসমাইলের তাঁবুতে শুয়ে আছে সে।
ইসলামিল তাবুর বাইরে কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিল। তাকে ডেকে তুলে বললো, “আমি এক বিচিত্র স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম, কেউ একজন আমাকে বলছে, সুলায়মান সিকান্দারের গুপ্তধনের চেয়ে ইসমাইলের কথা অনেক দামী।”
সে হাসতে লাগলো। তার সে হাসিতে নর্তকীর কৃত্রিম অভিনয় ছিল না, ছিল এক ছোট্ট খুকীর সরলতা।
সূৰ্য উদয় হতে এখনাে কিছু সময় বাকি। মার্ক লী নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী তার লোকদের একটি নিরাপদ ও উপযুক্ত স্থানে লুকিয়ে রাখল। সকাল যখন ফর্সা হয়ে গেল, তখন তারা সেই গোপন জায়গা থেকে নিচে বিবস্ত্ৰ নারী পুরুষকে চলাফেরা করতে দেখল। মার্ক লী তার দলের একজন সাহসী লোক নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। সে তাকে বলল, “এই ঢাল দিয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে যাও ৷”
দলনেতার নির্দেশ পেয়ে লোকটি জংলীগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে গেল এবং সমতল ভূমিতে গিয়ে পৌঁছলো। মার্ক লী তাকে ইঙ্গিতে সবুজ গাছপালার আড়ালে গা ঢাকা দিতে বলল। ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র সে উঠে দাঁড়াল এবং গাছের আড়ালে গা ঢাকা দেয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করলো। এ সময় হঠাৎ করে তিন চারজন মানুষখেকো লোক তাকে দেখে ফেললো এবং তাকে ধরার জন্য দৌড়ে এলাে। তারা আনন্দে চিৎকার করছিল। তাদের মনে পড়ে গেল, কদিন আগেই এ রকম একটি শিকার তারা পেয়েছিল এবং সবাই খুব তৃপ্তির সাথে ভোজনপর্ব সমাধা করেছিল সে রাতে।
তারা যখন লোকটার কাছে এসে তাকে ঘিরে ধরলো, তখন ওপর থেকে তাদেরকে তীরের নিশানা বানালো মার্ক লী ৷ জংলী লোকদের চিৎকার ধ্বনি শুনে আরও দু’জন দুটে এলো সেদিকে। তারাও তীরবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল।
মার্ক লী উপরে এক পাথরের সাথে লম্বা রশি বাঁধতে বলল সঙ্গীদের। রাশি বাঁধা হলে সবাইকে বললো, “তোমরা একের পর এক রশি ধরে নিচে নেমে যাও।”
সবাই একে একে রশি বেয়ে নিচে নেমে গেল। মার্ক লী ওপর থেকে রশি খুলে নিচে ফেলে দিল এবং প্রথম জনের মত গড়িয়ে নিচে নেমে এল। তারপর সকলেই দল বেঁধে তলোয়ার উচিয়ে সামনের দিকে দৌড়ে গেল। কয়েকজন জংলী খালি হাতে অসুরের মত ছুটে এলো উদ্ধত তলোয়ারের সামনে, মুহুর্তে তাদের হত্যা করলো মার্ক লী ও তার বাহিনী। দূর দৌড়ে পালিয়ে গেল।
মাইলখানেক দীর্ঘ এ সবুজ উদ্যানটি কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। জংলীরা যেদিকে ছুটে গেল মার্ক লীর বাহিনী এবার ছুটিল সেদিকে। পলাতক লোকদের ধাওয়া করে তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে চায় মার্ক লী। দেখতে চায় এখান থেকে বোরোনোর কোন গোপন পথে তারা প্ৰবেশ করে কি না।
জংলীদের চিৎকার ও ডাকাডাকির স্বর লক্ষ্য করে তাদের পিছু ধাওয়া করছে মার্ক লীরা। মার্ক লীর সামনে ছুটছে দুজন জংলী। সে তাদের অনুসরণ করে ছুটলো ওদের পিছু পিছু। মার্কালীর সামনে এখন দু’জন নয়, তিনজন জংলী ছুটে যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতে জংলী তিনজন সবুজ উদ্যানের এক প্রান্তে এসে পৌঁছল এবং তিনজনই পড়িমরি করে এক পাহাড়ী উপত্যকায় উঠতে শুরু করলো।
মার্ক লী কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করে তাদের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিল। তিনজনই ছোট্ট উপত্যকাটি পেরিয়ে অপর দিকে নেমে গেল। মার্ক লী অনুসরণ করল তাদের। উপত্যকার পাহাড়ী অঞ্চল। সেখানে একটি পর্বত গহবরের মুখ ছিল, যার মধ্যে মাথা নত করে ঢুকে যাওয়া যেত। মার্ক লীর চোখের সামনে লোক তিনজন সেই পর্বত গহকবরে প্রবেশ করল এবং তার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। মার্ক লী তলোয়ার হাতে সেই পর্বত গহব্বরের মুখে গিয়ে দাঁড়াল।
ভিতর দিকে গহবর ক্রমশ প্ৰশস্ত মনে হলো। মার্ক লী কালবিলম্ব না করে সেই গহব্বরে ঢুকে গেল। তার কানে এল জংলীদের দৌড়ানোর শব্দ। সেই শব্দ লক্ষ্য করে সাবধানে এগুতে শুরু করল মার্ক লী। এটা কোন প্রাকৃতিক সুড়ং নাকি ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্স মরার আগে এটা বানিয়ে ছিল স্পষ্ট বুঝা গেল না।
সুড়ঙ্গের পথ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, বাকের কাছে তা ঘুটফুটে আঁধারের রূপ নিল। এভাবে কয়েকীটি বাঁক পেরিয়ে আসার পর সামনের পথ কিছুটা আলোকিত মনে হল। মার্ক লী এখন আর লোক তিনজনকে দেখতে পাচ্ছিল না, তবে তাদের কথা বলার স্বর শুনতে পাচ্ছিল। সে দ্রুত এগিয়ে গেল এবং সামনেই জংলী তিনজনকে গুহার গোলাকার মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে দেখল।
জংলী তিনজনকে সে হত্যা করতে চাইল না, কারণ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এদের বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।
জংলী তিনজন গহবর থেকে বেরিয়ে গেলে মার্ক লীও গহবর থেকে বেরিয়ে এল। তিনজনের মধ্যে একজন আর ছুটতে পারছিল না, লোকটি পথের মাঝেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মার্কলী এগিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াল। দেখলো, লোকটি ঐ বুড়ো, যাকে সেদিন সাপের ফানা যুক্ত লাঠি হাতে দেখেছিল। গতবার তার সাখী যখন মানুষ খেকোদের হাতে নিহত হয় তখন এ বুড়োই ওদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
এ লোক খুবই বৃদ্ধ ছিল, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না। গহব্বরের বাইরে টিলা ও পাহাড়ী পথ। এ পথ গিয়ে মিশেছে বালি এবং কাঁকড় বিছানো এক উচু উপত্যকায়। উপত্যকার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটু আগের দেখা কালাে পাহাড়টি।
মার্ক লী বৃদ্ধকে ধরে উঠালো এবং তার পালিয়ে যাওয়া দুই সঙ্গীকে ডেকে থামতে ইশারা করলো। সে বৃদ্ধিকে বুঝাতে চেষ্টা করল, যেন তিনি তার দুই সঙ্গীকে ফিরে আসতে বলেন।
বৃদ্ধ তাদের ডাকলো। বৃদ্ধের ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল জংলী দু’জন। বৃদ্ধ তাদেরকে কাছে আসতে বললো। মার্ক লীকে সে মিশরীয় ভাষায় বলল, আমি তোমাদের ভাষা বলতে ও বুঝতে পারি, আমাকে হত্যা করে তোমার কোন লাভ নেই।’
মার্কলী মিশরী ভাষা ভালই বলতে ও বুঝতে পারতো। সে বৃদ্ধকে বললো, “আমি তােমাকে হত্যা করতে চাই না। তোমার সঙ্গীদেরও হত্যা করব না। তোমরা শুধু বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা দেখাও।”
‘কেন, তোমরা কি এখান থেকে বের হতে পারছে না?” বৃদ্ধ প্রশ্ন করলো।
হ্যা!” মার্ক লী উত্তর দিল, “আমি তোমাদের রাজত্ব থেকে বের হয়ে যেতে চাই, কিন্তু পথ পাচ্ছি না।”
বৃদ্ধ তার দু’জন সাথীকে কিছু বললো, তারা দুজন খুব ভয় পেয়ে গেল বৃদ্ধের কথা শুনে। বৃদ্ধ মার্ক লীকে বললে, “এদের সাথে যাও, এরা তোমাকে বেরিয়ে যাওয়ার সোজা রাস্তা, দেখিয়ে দেবে।’
‘তুমিও আমার সাথে চলো, এরা আমাকে ভুল পথ দেখাতে পারে।” মার্ক লী বৃদ্ধকে বললো।
বৃদ্ধ তার সাথে যেতে বাধ্য হল। দুই পাশে দু’টাে টিলার মধ্য দিয়ে সরু একটি পথ ধরে চলতে লাগলো তারা। কিছু দূর গিয়ে নতুন একটি টিলার ওপরে চড়ল। ওই টিলা পার হয়ে আঁকাবাকা পেঁচানাে রাস্তা ধরে কিছুদূর এগুতেই খোলা মরুভূমিতে পৌছে গেল।
এমন জায়গা দিয়ে মরুভূমিতে পৌঁছল ওরা, কেউ ধারণাও করতে পারবে না এখানে কোন রাস্তা আছে, যা ভিতরের রহস্যময় গোপন পৃথিবীতে নিয়ে যেতে পারে।
বৃদ্ধ বলল, “তুমি এখন চলে যাও, নইলে খোদার অভিশাপে তুমি পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে।’
মার্ক লী বললো, কিন্তু আমার সঙ্গীদের কি হবে? ওরা তো ভেতরে আটকা পড়ে আছে! ওদের ফেলে রেখে আমি কিছুতেই যেতে পারি না। ঠিক আছে, চলো, ভেতরে গিয়ে ওদের খুঁজে বের করি। তারপর ওদের নিয়ে চলে যাবো আমি।”
আমরা ওদেরকেও তোমার মত বেরিয়ে যাওয়ার পথ চিনিয়ে দেবাে। তুমি না হয় এখানেই অপেক্ষা করো, আমরা ওদেৱ পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“কিন্তু ওরা তোমাদেরকে সে সুযোগ নাও দিতে পারে। এই অভিশপ্ত পাহাড়ে আটকা পড়ে ওরা পাগল হয়ে গেছে। ওরা তোমাদের হত্যা করে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারচে আমাকে নিয়ে চল, তাতেই তোমাদের লাভ।
অগত্যা তাকে সঙ্গে নিয়ে উলঙ্গ তিন জংলী আবার সেই পথে ফিরে চলল। ফেরার পথে মার্ক লী রাস্তার প্রতিটি বাঁক ও চড়াই উতরাই ভালমত দেখে নিল। আবার ওরা গর্তের মুখে এসে পৌঁছল এবং গুহাপথে হেঁটে সেই ভয়ংকর সবুজ প্রান্তরে প্রবেশ করলো। বৃদ্ধ তাকে সেখানে নিয়ে গেল, যেখানে মার্ক লীর সঙ্গীকে তারা আগুনে ভুনে খেয়েছিল।
মার্ক লীর সাথীরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কয়েকজন জংলীর লাশ পড়ে থাকতে দেখল ওরা। শিশুদের লাশও ছিল তার মধ্যে। বৃদ্ধ এমন গণহত্যা আগে আর কখনও দেখেনি। তার চেহারা কঠিন হয়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে সে খুব ধৈর্যের সাথে মার্ক লীকে জিজ্ঞেস করলে, “এই নিষ্পাপ শিশুদের তোমরা কেন হত্যা করলে?
“তোমরা আমার সাথীকে আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছিলো|” মার্ক লী জিজ্ঞেস করলে, “সে তােমাদের কি ক্ষতি করেছিল?’
‘সে পাপ-দুনিয়ার লোক ছিল। বৃদ্ধ বললো, “সে আমাদের পবিত্র ভূমিতে এসে এখানকার মাটিকে নষ্ট ও নাপাক করেছিল।”
“তোমরা এখানে কেন থাকো?” মার্ক লী জিজ্ঞেস করলো,
‘আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।” বৃদ্ধ বললো।
মার্ক লী তার লোকদের বলল, “এদের নারীদের ধরে নিয়ে এসো।’ আক্রমণের আগেই সে সবাইকে বলে দিয়েছিল, তারা যেন কোন নারীকে হত্যা না করে এবং তাদের লাঞ্ছিতও না করে। তাদেরকে শুধু নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে রাখে।
মার্ক লীর সাথীরা দশ বারোজন নারীকে নিয়ে এলো সেখানে। তাদের মধ্যে দু তিনজন বৃদ্ধা আর সব যুবতী। কিশোরী ও শিশু বালিকাও ছিল। এরা সবাই ছিল বস্ত্ৰহীন উলঙ্গ। কিন্তু এ জন্য কারো মধ্যে কোন সঙ্কোচ ছিল না। তাদের গায়ের রঙ গমের মত উজ্জ্বল ফর্সাঁ! শরীরের গঠন সুঠাম সুডৌল, মুখের আকৃতি সুশ্ৰী ও সুন্দর! মাথার চুল তাদের কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। মেদহীন নিটোল অবয়বগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মার্ক লী!
“তোমরা কি চাও, তোমাদের নারীদেরকে তোমাদের সামনেই অপমানিত ও হত্যা করি।” মার্ক লী বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো।
“তার আগে কি তুমি আমাকে হত্যা করবে না?” বৃদ্ধ বললো।
‘না’!” মার্কালীর সোজা উত্তর।
“শোন পাপিষ্ঠরা” বৃদ্ধ বললে, “তােমাদের নারীরা কাপড়ের আবরণে দেহ ঢেকে রাখে, কিন্তু মনের ওপর কোন আবরণ দেয় না। পর্দার মধ্যে লুকিয়ে থেকেও তারা হয় নির্লজ্জ ও বেহায়া। তাদের নিয়ে তোমরা নাচের আসর বসাও, গানের জলসা করে আর হৃদয়কে করো কলুষিত। নারীদের দেখলেই তোমাদের চোখে জাগে কামের নেশা, ভোগের আগুন। নারীর জন্য তোমরা খুনােখুনি করো, রাজ্য ত্যাগ করো। নারী হয় তোমাদের ধ্বংসের কারণ।
কিন্তু আমাদের নারীরা উলঙ্গ থাকে কিন্তু বেহেয়াপনা করে না। কোন পুরুষ তার জন্য নির্ধারিত নারী ছাড়া অন্য স্ত্রীলোকের দিকে কামের নজরে তাকায় না। নারীরা আমাদের পবিত্রতা ও সৌভাগ্যের প্রতীক। তোমরা আমাদের খোদা রিম্যান্সের সব গুপ্তধন নিয়ে যাও কিন্তু আমার অনুরোধ, আমাদের বউ-বেটির গায়ে হাত দিও না।’
গুপ্তধন পাওয়ার রহস্য বলে দিলে আমরা তোমাদের কোন নারীর অসম্মান করবো না, তোমাদের কারো ওপর কোন অত্যাচারও করবো না। যত তাড়াতাড়ি পারি আমরা গুপ্তধন নিয়ে এখান থেকে চলে যাবো, আর কোনদিন এ পথে পা বাড়াবো না।”
ভালোই বলেছ হে দাকাত সর্দার। কিন্তু দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় কান দিতে নিষেধ আছে আমাদের আইনে। ডাকাতের কোন কথা বা অঙ্গীকারে বিশ্বাস করি না আমরা।’
বৃদ্ধের ঠোঁটে তিরস্কারের বিদ্রুপ, যার অন্তরে অর্থের লোভ আছে সম্পদের মোহ আছে তেমন প্রতিটি মানুষকেই আমরা তঙ্কর বা ডাকাত মনে করি। এই লোভ ও মোহ তাকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক বানায়। তোমাদের দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ এই তস্কর বা ডাকাত দলের। অর্থের জন্য, যেখানে তোমরা নিজের স্ত্রী কন্যাদের ইজ্জত বিসর্জন দিতে পারো, বন্ধুকে খুন করতে পারো, নিজের জীবন বিপন্ন করতে পারো সেখানে এই ওয়াদা বা অঙ্গীকারের কোন মূল্য নেই। তুমি সেই দুনিয়ার লোক, যেখানে অর্থের জন্য মানুষ নিজের ঈমান পর্যন্ত বিকিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের পক্ষে বেঈমানী করা সম্ভব নয়। ভয় বা লোভ কিছু দিয়েই তোমরা আমাদের কাবু করতে পারবে না। আমরা কিছুতেই তোমার অপকর্মের দোসর হবো না।
এ কোন অপরাধ নয়। এ সম্পদ মিশরের। আমি সরকারী কর্মকর্তা আহমদ দরবেশের নির্দেশে এ অভিযানে এসেছি।”
“শোন আমার অচেনা বন্ধু! তুমি মিশরী নও। তোমার চােখে সমুদ্রের লোনা পানির চমক রয়েছে। নীল নদের পানির চমক নয়। তোমার শরীর থেকে সমুদ্র পারের গন্ধ আসছে।’
আমি কে সে পরিচয় নেয়ার দরকার নেই তোমার। আমি ফেরাউন রিম্যান্সের কবরের অনুসন্ধানে এসেছি। আমাকে সে কবর দেখিয়ে দাও।” মার্ক লী তার রূপ পাল্টে ফেলল, রাগত স্বরে বললো তাকে, নইলে তোমার চোখের সামনে এ নারীদের আমি লাঞ্ছিত করবো।”
‘না, এ কাজ তুমি করতে যেয়ো না। এতে তোমার ক্ষতি হবে।”

আমার লাভ ক্ষতি আমি বুঝব, তুমি কবরের সন্ধান বলবে কি না বলে?”
ঠিক আছে, কবরের সন্ধান আমি তোমাকে দেবাে।” বৃদ্ধ বলল কিন্তু তোমাকে বলতে চাই তুমি ওখানে গেলে জীবিত আর ফিরে আসতে পারবে না। এ কথা জানার পরও তুমি সেখানে যাবে কি না বলো।”
“তোমাদের লোকেরা কি ওখানে আমাকে হত্যা করার জন্য লুকিয়ে আছে?”
‘না’!’ বৃদ্ধ বললো, “তোমাদের হত্যা করার মত আমার কাছে আর কোন লোক নেই। তোমার লোকেরাই তোমাকে হত্যা করবে। এবং এটাও জেনে রেখো, তোমার লাশ এখান থেকে কেউ নিতে আসবে না।”
“কি আমার ভবিষ্যত বক্তারে!’ মার্ক লী ব্যঙ্গ করে বললো, “এতই যদি ভবিষ্যত জানো তবে নিজেদের বাঁচাতে পারলে না। কেন?”।
না! আমি ভবিষ্যত বক্তা নই। তবে অভিজ্ঞতার যদি কোন দাম থাকে তাহলে আমার কথা তোমার বিশ্বাস করা উচিত। এ জীবনে এমন অনেক ঘটনা দেখেছি আমি, যে ঘটনাবলী মানুষের অন্তরদৃষ্টি খুলে দেয়। আমি দেখতে পাচ্ছি, মৃত্যু তোমার ঘাড়ে এসে বসে আছে।”
মার্ক লী হো হাে করে হেসে উঠলো। বললো, জংলী বুড়ো, আমার মৃত্যু একটু পরে দেখলেও চলবে। আগে বলে সে কবরটা কোথায়, যার সন্ধানে এই দুস্তর মরু পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি আমি।”
ঠিক আছে, চলো তাহলে!’ বৃদ্ধ বলল, “সেটা কাছেই আছে, এসো আমার সঙ্গে।”
মার্ক লী বলল, “একটু অপেক্ষা করো।
বুড়োকে অপেক্ষা করতে বলে সে সঙ্গীদের দিকে ফিরল এবং একটু চিন্তা করে ওদের বললাে, “এই নারীদের কোন রকম অসম্মান করবে না। এই বৃদ্ধ ও তার সাখীদের প্রতি নজর রাখবে। যতটা সম্ভব এদের সঙ্গে গল্পগুজব করে বন্ধুত্ব করে নাও। আমি কস্তুরী ও ইসমাইলকে আনতে যাচ্ছি।” সে পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসার নতুন চেনা সোজা রাস্তায় যাত্রা করলো এবং গুহার ভেতর এসে প্ৰবেশ করলো।
গুহা অতিক্রম করে মার্ক লী বেরিয়ে এল। বাইরে। চার পাশে ভাল করে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল, কিন্তুরীদের সে কোন দিকে রেখে গিয়েছিল। তারপর আন্দাজের ওপর ভর কৰে হাঁটা দিল সে।
মাথার ওপর প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে সুর্য। সে উত্তাপ মাথায় নিয়ে একাই হেঁটে চলেছে মার্ক লী। প্রায় মাইল দুই রাস্তা অতিক্রম করার পর সে জায়গাটা চিনতে পারল। ঠিক এখান থেকেই দলবল নিয়ে যাত্রা করেছিল সে। এবার সে নিশ্চিন্ত হয়ে পাহাড়ের খাঁজে তাবুর দিকে এগিয়ে গেল।
ওখানে পৌঁছেই সে কস্তুরী ও ইসমাইলকে একই তাঁবুতে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখলাে। তার চেহারার রঙ পাল্টে গেল। সে ধমকের স্বরে ইসমাইলকে বললো, “আমি তোমাকে বলে গিয়েছিলাম, তুমি ওর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করে চলবে। তুমি কোন সাহসে ওর পাশে গিয়ে বসছে?” ”
ওর কোন দােষ নেই। বললাে কস্তুরী, ‘আমিই ওকে ডেকে এনেছি। এই নিঃসঙ্গ নির্জন মরুভুমিতে একা একা বেশীক্ষণ থাকলে, যে কেউ পাগল হয়ে যাবে! একাকীত্ব অসহ্য হওয়ায় কথা বলার জন্য আমি নিজেই তাকে আমার কাছে। ডেকে এনেছি।”
“তোমাকে এ সফরে সাথে এনেছি শুধু আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য।” মার্ক লী রাগের সাথে বললো, “এ জন্য চাহিদামত তোমাকে আমি মূল্য দিয়েছি। সে মূল্য পরিশোধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি আর কারো সাথে মিশতে পারো না। তোমার ঘরে তুমি শত জন বাদী রাখলেও এখানে তুমি আমার দাসী।’
গত রাতে ইসমাইল তার সরল মনে মার্ক লী সম্পর্কে যে ধারন, দিয়েছিল, মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার প্রমাণ পেল কস্তুরী। বিদায়ের আগে যে সব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সে তার মন জয় করতে চেষ্টা করেছিল, সে সব মনে পড়ে গেল তার। ছি! এই কি সেই মার্ক লী! এখনো গুপ্তধন পায়নি, তার আগেই অহমিকার মগডালে উঠে বসে আছে! ঘৃণায় রি রি করে উঠল তার মন।
কস্তুরী মৰ্মে মৰ্মে অনুভব করল, মার্ক লীর কাছে এখন সে একজন গ্রাহক ছাড়া আর কিছু নয়। আর তাই মার্ক লী তাকে দাসী বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারল। মুহুর্তে কত্ত্বরীর রাণী হবার স্বপ্ন খান খান হয়ে গেল।
তার জীবন খুব দীর্ঘ নয়, তবু এতটুকু জীবনেই সে বহু মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছে। সে যে পরিমাণ লোকের সাথে মিশেছে। একজন নারী একশো বছর বেঁচে থেকেও এত লোকের দেখা পায় না। তার এ অভিজ্ঞতাই তাকে দিয়েছে ভালো-মন্দ মানুষ চেনার এক অদ্ভুত ক্ষমতা।
ইসমাইল তাকে একবারও বলেনি, সে ভাল লোক। বরং সে অকপটে স্বীকার করেছে, সে একজন ভাড়াটে খুনী। অর্থের বিনিময়ে মানুষ খুন করা তার পেশা। এই অকপটতাই প্রমাণ করে মার্ক লীর চাইতে মানুষ হিসাবে সে বেশী নির্ভরযোগ্য।
এদিকে মার্ক লীকেও উপেক্ষা করতে পারছে না কস্তুরী। উপযুক্ত মূল্য দিয়েই মার্ক লী তার সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। সে টাকা এখনো তার ঘরেই পড়ে আছে! এ টাকা ফেরত না দিয়ে মার্ক লীর অবাধ্য হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। গুপ্তধনের যে লোভ তাকে দেখানো হয়েছে মার্ক লী যদি তা নাও দেয়, তবু এখন সে মার্ক লীরই সম্পত্তি। কস্তুরী তাই আর কথা বাড়ালো না, চুপ করে রইল।
ইসমাইলও এতক্ষণ কোন কথা বলেনি, চুপচাপ দু’জনের কথা শুনছিল আর নিরবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল মার্ক লীকে।
দু’জনই চুপ করলে সে উঠে মার্ক লীর বাহু ধরে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল আহমদ দরবেশ মনে হয় তোমাকে আমার ব্যাপারে কিছুই বলেননি। আমার সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না। কিন্তু আমি তোমাকে ভাল মতই জানি। তুমি আমার দেশের ও জাতির মূল কাটতে এসেছে। আমি এতবড় পাপী, ভাড়ার বিনিময়ে তোমার সাথে এসেছি। তার মানে এ নয় যে, আমি তোমাকে আমার বাদশা মানি ; আমি আমার মূল্য ষোল আনা তো বুঝে নেবই, যদি গুপ্তধন উদ্ধার হয় তবে তার অংশও আদায় করে নেবো।”
“এসব কথা তুমি আমাকে নয়, আহমদ দরবেশের কাছেই বলবে।’ মার্ক লী তাকে কমান্ডারের ভঙ্গিতে বললো, “এখানে তুমি আমার অধীনস্ত কর্মচারী। গুপ্তধন যা বের হবে সেগুলো আমার তহবিলেই জমা থাকবে। আমি সেগুলো যেখানে চাইব সেখানেই নিয়ে যাব, কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না।”
বললো, “আমি জানি তুমি মার্ক লী! সুলায়মান সিকান্দার নিও। আমি এক নাম করা অপরাধী তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, গোয়ার্তুমি করে তুমি আমাকে মিশরী মুসলমান বানিয়ে দিও না। আর তোমাকে আরও সাবধান করে দিচ্ছি, কোন মুসলমানের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ জেগে উঠলে সে যদি লাশও হয়ে যায় তবু তার জাতীয় চেতনাবােধ বিসর্জন দেয় না। কোনঠাসা হয়ে পড়লে সে সিংহের চেয়েও সাহসী হয়ে যায়। তোমার ভালোর জন্যই বলছি, আমাকে অপরাধী হয়েই থাকতে দাও, বাড়াবাড়ি করো না।”
মার্ক লী বুঝতে পারলো, এ লোক গভীর জলের মাছ। একে শক্ৰ বানিয়ে নেয়া ভালো নয়। সে ইসমাইলের কাধের ওপর হাত রেখে বন্ধুর মত হেসে উঠে বললে, “তুমি অযথা ভুল ধারণা করছ, আমি চাই না, এক বিলাস সুন্দরী আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করুক। এ নারী ভয়ানক চালাক, সে আমাদের দু’জনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে গুপ্তধনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। তুমি আমাকে আর শক্ৰ মনে করো না। আহমদ দরবেশ কি তোমাকে বলেনি, সে তোমার সম্পর্কে কি চিন্তা-ভাবনা করে রেখেছে?”
“তোমার কি বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত তুমি গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবে?” “আরো পারবো কি ! পেয়েই তো গেছি!” মার্কালী উত্তর দিল।

“আমি তোমাদের দু’জনকে সেখানেই নিয়ে যেতে এসেছি।”
ইসমাইল তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। কস্তুরীও তাকে দেখতে লাগল। তার চেহারায় ঘূণা ও রাগের ভাব স্পষ্ট।
মার্ক লী তার লোককে ডাকলো, যাকে উটগুলোর দেখাশোনায় রেখে গিয়েছিল। সে তাকে বললো, উটগুলো একটা অপরটার সাথে বেঁধে নিয়ে এসো, তবুও গুটিয়ে নাও।”
মার্ক লী তাদের সেখানে নিয়ে গেল, যেখানে ফেরাউনের গোপন কবরের পাশে অন্যরা তাদের জন্য অপেক্ষা করহিল। কস্তুরী কঠিন এই পাহাড়ের মাঝে এমন শস্য-শ্যামল উদ্যান ও মনােরম জায়গা দেখে খুবই বিস্মিত হলো। উচু এক পাহাড়ের তলদেশে ছোট ঝিলে টলমল করছে স্বচ্ছ পানি। পাহাড়ের বুক থেকে পানির ঝরনা ফুটে বেরুচ্ছে। সারি সারি খেজুর বৃক্ষের কচি পাতা দােল খাচ্ছে বাতাসে। কস্তুরী এই প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়লো।
সে ইসমাইলকে সাথে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। একটু এগুতেই তার চােখে পড়ল একটি ছোট শিশুর লাশ। শিশুটির সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা।
কস্তুরী ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। আরেকটু এগিয়ে দেখল, আছে। লাশ দুটি বড়দের। এদের বুকে এখনাে বিধে আছে তীর।
সে ইসমাইলকে সাথে নিয়ে এক খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকেই সে দেখতে পেল এক বিবস্ত্ৰ বৃদ্ধকে সাথে নিয়ে মার্ক লী উচু চূড়ার দিকে উঠে যাচ্ছে।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top