৩. সুবাক দুর্গে আক্রমণ

শেষ রাতে হটাৎ করেই যুবতীল চোখ খুলে গের। দু’হাতে চোখ তুলে সামনে তাকাল। আরমান নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে ক’কদম দূরে।

টিলার মাথঅয় শেষ রাতের চাঁদ। মরুর স্বচ্ছ জোৎস্নায় ঘোড়ার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল মেয়েটা। পিঠে জিন বাধা। ঘুমানোর পূর্বে আরমান ওগুরো খুলে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।

মেয়েটা আবার আরমানের দিকে তাকাল। সহসাজেগে উঠবে বলে মনে হয় না।

খাওয়া এবং বিশ্রামের ফলে নিজকে ঝরঝরে মনে হচ্ছে। যুবতী জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল চকচকে খঞ্জর। শ্কত করে মুঠোয় চেপে ধরল বাঁট।

ঝলমলে চাঁদনী রাতে আরমানকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যুবতী দৃষ্টি ফেরাল খঞ্জরের দিকে।

আরমান ঘুমের ঘোরে কি যেন বলছে। মেয়েটা ভঅবল হয়ত অবচেতন মনে জেগে থাকা আত্মীয়কে স্মরণ করছে ও।

মেয়েটার দৃষ্টি নিবন্ধ হল আরমানের বুকে। অনুমান করছে হৃদপিন্ড কোথায় হতে পারে। প্রথম আঘামের পর দ্বিতীয় আঘাত করা যাবে না। মরতে মরতেও সে তাকে মেরে ফেলতে পারবে।

খঞ্জরের বাটে মেয়েটার হাত আরও শক্ত হল। ঘোড়াগুলোর দিকে চাইল একবার। পরিকল্পনাটা মেন মনে ঝালাই করে নিল।

ওর বুকে খঞ্জর মেরে ছুটে যাবে ঘোড়ার কাছে। ঘোড়ার পিঠে চেপে দ্রুত পালিয়ে যাবে।

ও সৈনিক নয়, হলে এত কিছু ভাবতে হত না। নির্দ্বিধায় আরমানের বুকে খঞ্চর ঢুকিতে দিত। তাকে হত্যা করার বড় যুক্তি হচ্ছে সে মুসলমান এবং তার শত্রু। কিন্তু ও যতবারই আরমানের দিকে তাকিয়ে খঞ্জরের বাট শক্ত করে ধরত, শুরু হত হৃদস্পন্দন। ও শুনতে পেত হৃদয়ের ধুকপুক শব্দ।

ঘুমের ঘোড়ে আবার বিড়বিড় করতে লাগল আরমান। আগেরচে পরিষ্কার। স্বপ্নেই ও বাড়ী গেছে। ডেকেছে মাকে, বোনকে। এর পরের শব্দগুলোতে মনে হল ওদের কেউ হত্যঅ করেছে এবং তাকেও খুঁজছে।

কি এক অজানা অনুভূতি মেয়েটাক েবাধা দিচ্ছীল। ভয়ও হতে পারে, অথবা কাউকে হত্যা না করার মানসিকতা।

আনচান করতে লাগল ও। না, তাকে হত্যা করব না, মনে মনে ভাবল, আস্তে আস্তে ঘোড়ার কাছে গিয়ে একটা ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাব। খঞ্জর হাতে নিয়ে ও ঘোড়ার দিকে পা বাড়াল।

কিন্তু পা নড়ছে না। বালিতে আটকে গেছে যেন।

দাঁড়িয়ে আরমানের দিকে চাইতেই কতগুলো প্রশ্ন এসে ওকে জড়িয়ে ধরল । এক সুন্দরী যুবতীকে বিজন মরুতে নিঃসঙ্গ পেয়েও কি তার মনে কোন অনুভূতি সৃষ্টি হয়নি। সে একবারও ভাবল না খ্রীষ্টান মেয়েটা ঘুমের ঘোরেই তাকে হত্যঅ করতে পারে!

লোকটা ঘোড়ার জিন খোলেনি, অস্ত্রগুলোও সাবধানে রাখেনি। কেন? সে কি আমায় বিশ্বাস করে। তার অনুভূতি কি এতই ভোতা, আমার মত রূপসী তরুনী তার আবেগ জাগাতে পারল না। ওর মনে হল লোকটা তাকে ঘোড়ার চাইতে বেশী মূল্যবান মনে করেনি।

ও ধীরে ধীরে পৌঁছল ঘোড়ার কাছে। ডেকে উঠল একটি ঘোড়া। চমকে আরমানের দিকে চাইল ও। ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনিতেও আরমানের ঘুম ভাংগেনি।

ও এখন তিনটে ঘোড়ার আড়ালে। একটা ঘোড়ার পিঠি উঠতে যাবে আচম্বিত পেছন থেকে শব্দ ভেসে এল, ‘কে তুমি?’

চকিতে পেছন ফিরে চাইল ও। দু’জন সৈনিক। এক ব্যক্তি শিষ কেটে বলল, ‘আমাাদে সৌভাগ্য।’

হাসর দ্বিতীয় জন। ভাষায় বুজা যাচ্ছে এরা খ্রীষ্টান সৈন্য। একজন মেয়েটার হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষন করল। মেয়েটা বলল, ‘আমি খ্রীষ্টান।’

দু’জনই ওর কথায় শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, ;তবে তো তোমার পুরোটাই আমাদের।’

‘আগে আমার কথা শোন’, যুবতী বলল, ‘আমি সুবাক থেকে পালিয়ে এসেছি। নাম আইওনা। আমি গোয়েন্দা। ক্রাক যাচ্ছি। ওই দেখ একজন মুসলমান সৈন্য ঘুমিয়ে আছে। ও আমায় ধরে রেখেছে। ওকে ঘুমে রেখৈই আমি পালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে সাহায্য কর। এ ঘোড়াগুলো সাথে নাও আর আমাকে ক্রাক পৌঁছে দাও।’

খ্রীষ্টানদের জন্য ও কত দামী সৈন্যদের বুঝিয়ে বরল আইওনা। একজন সৈন্য ওকে বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে বলল, যেখানে বলবে পৌঁছে দেব।’

দ্বিতীয়জন একটা অশ্লীল মন্তব্য করল। দু’জনই ঠেলে ওকে টিলার অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগল।

খ্রীষ্টান বাহিনীর পদাতিক দুই সেপাই মুসলিম কমান্ডোদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। নিশ।চিন্তে বিশ্রাম করার জন্য ওরা এ পাহাড় কুচিতে ঢুকেছে। যুবতীল রূপ ওদর পশুতে পরিণত করে দিল। ও যকণ দেখল খ্রীষ্টানের দোহাই দিয়েও বাঁচা যাচ্ছৈ না, জোরে জোরে চিৎকার শুরু করল। তার চিৎকার শুনে আরমান হয়ত জেগে উঠবে।

হঠাৎ একজন ভয়ার্ত কণ্ঠে সংগীর নাম নিয়ে বলল, ‘সাবধান।’ সৈন্যটি সতর্ক হার পূর্বেই আরমানের বর্শা তার বুক এফোড় ওফোড়  করে দিল।

দ্বিতীয় লোকটির হাতে উঠে এল তরবারী। মেয়েটা তার পাঁজরে খঞ্জর সেঁধিয়ে দিল। পরপর কয়ৈকটা আঘঅত করে চিৎকার করে বলল, ‘তোমাদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তোমরা খ্রীষ্টান নামের কলংক।’

খ্রীষ্টান সৈন্যদের দু’টো লাশ পড়ে আছে। আইোনা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। আরমান তাকে শান্তনা দিয়ে বলল, ‘কেঁদোনা। এখানে বেশীকষণ থাকা ঠিক হবে না। ওদের দলের অন্যরা এসে পড়তে পারে। আমরা এখুনি সুবাকের পথ ধরব। ওরা কি তোমায় ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে?’

‘না, আমি জেগে ছিলাম। দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘোড়ার কাছে।’

‘ঘোড়ার কাছে কেন?’

ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তোমার সাথে যাবার ইচ্ছে ছিল না।’

এ খঞ্জর কোথায় পেয়েছ?’

‘আমার কাছেই ছিল। আগেই বের করে নিয়েছিলাম।’

‘আগেই বের করেছ! কেন? ও বুঝেছি, আমি যদি জেগে উঠি তাহরে মেরে ফেলবে?’

আইওনা আরমানের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আমি তোমায় হত্যা করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তুমি আমায় মেরে ফেলার আগেই বলছি, এ খঞ্জর তোমাকে হত্যঅ করার জন্যই বের করেছিলাম। কিন্তু পারিনি।

তোমায় কেন মারতে পরিনি জানি না। তোমার জীবন ছিল আমার হাতের মুঠোয়। আমি ভীতু নই। এর পরও তোমায় হত্যা করতে পারিনি। কেন, আমি বরতে পারব না। হয়ত তুমি বলতে পারবে।’

‘জীবন এবং মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তিনিই তোমার হাত স্তব্ধ করে রেখেছিলেন, তিনিই তোমার সম্ভ্রম রক্ষা করছেন, আমি তো এক উপলক্ষ মাত্র। এখন একটা ঘোড়ায় চেপে সব। আমরা রওয়ানা করব।’

মেয়েটা আরমানের দিকে খঞ্জর বাড়িয়ে বরল, ‘রাখ। নয়তো আমি তোমায় মেরে ফেলতে পারি।’

‘তার প্রয়োজন নেই। বরং আমার তারবারীও তুমি নিয়ে নিতে পার। তুমি আমায় হত্যা করতে পারবে না।’

উপহাস নয়, দু’জনের কণ্ঠেই ছিল দৃঢ়তা। দু’জন দু’টো ঘোড়ায় চেপে তৃতীয় ঘোড়াটা সাথে নিয়ে চলতে লাগল।

সুর্যোদয়ের আগেই ওরা অনেক দূর এগিয়ে গের। আশাপাশে কোন খ্রীষ্টান সৈন্য দেখা যায়নি। পথে একটা মুসলিম সেনাদলের দেখা পেয়েছিল ওরা। মুসলিম সেনাদলটির কাছে গিয়ে আরমান কি যেন বলে ফিরে এসে আবার চলতে লাগল।

এপ্রিলের উত্তপ্ত সূর্য উঠে এসেছে মাথার ওপর। মুখ মাথঅ ঢেকে ওরা চলা অব্যাহত রাখল। দূরের বালুকারাশি দেখে মনে হয় এক সাগর টলটলে স্বচ্ছ পানি। বায়ে পাথুরে পর্বত।

দু’জন নিরবে চলছৈ। কেউ কারো সাথে কথঅ বলছে না। এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ ওদের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। একটা লাশও অক্ষত নেই। শৃগাল শকুন খুবলৈ নিয়েছে ওদের মাংস। কোন কোন লাশের শুধু হাড়গুলো পড়ে আছে।

আরমান মেয়েটাকে বরল, ‘এরা তোমার জাতির সৈনিক। বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী সহ বিভীন্ন দেশ থেকে এসে যে সব রাজরাজড়া মুসলিম বিশ্বকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে এরা তাদেরই ইচ্ছের বলী।’

মেয়েটা নিশ্চুপ। বার বার তাকাচ্চে আরমানের দিকে। মাথা ঝুকিয়ে কি যেন ভাবছে আবার।

আরমানে পাহাড়ের দিকে গতি ফেরাল। সে জানত, ওখানে পানি এবং ছায়া দুটোই পাওয়া যাবে।

পশ্চিম আকাশে নেমে এসেছে সূর্য।

ওরা পার্বত্য এলাকায় পৌঁছল। খুঁজে বের করল ঘেষো জমিন। আশাপাশে কিছু বৃক্ষও রয়েছে। পাহাড় কেটে বয়ে চলছে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা।

ঘোড়া থেকে নামল ওরা। নিজেরা পানি পান করল। ঘোড়াগুলৌকে পানি খাইয়ে ছেড়ে দিল ঘেসো মাঠে।

‘কে তুমি?’ যুবতী প্রশ্ন করল। ‘তোমার নাম কি? কোথায় থাক?’

‘আমি মুসলমান। নাম আরমান। থাকি সিরিয়া।’

ঘুমের ঘোরে তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?’

‘মনে নেই। হয়ত স্বপ্ন দেখছিলাম। সংগীরা বলে, আমি নাকি ঘুমের মধ্যে কথা বলি।’

‘তোমার মা আছে, বোন আছে? সম্ভবতঃ ঘুমে তাদেরকে স্মরণ করছিলে।’

‘এক সময় ছিল।’ আরমানের কণ্ঠে বিষন্নতা। ‘এখনও ওদের স্বপ্নে দেখি।’

মেয়েটা আরো অনেক কিছু জানতে চাইল। কিন্তু জবাব না দিয়ে আরমানের বলল, ‘তুমি নিজের ব্যাপারে মিথ্যে বলেছ। আর তোমার পরিচয় জানতে চাইব না। তোমাকে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দিয়ে ফিরে আসব। নিজের ব্যাপারে সত্য বলতে চাইলে বলতে পার। তবে তুমি খ্রীষ্টানদের গুপ্তচর নও একথা বলো না।’

‘তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি গোয়েন্দা, নাম আইওনা।’

‘তুমি কি কাজ কর তোমার পিতা মাতা জানেন?’

‘আমাদের পিতা মাতা নেই। কোনদিন আমি ওদের চেহারাও দেখিনি। গোয়েন্দা সংস্থা আমার মা, গোয়েন্দা প্রধান হরমুন আমার পিতা।’

মেয়েটা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আমার সংগী একটা মেয়ে একজন মুসলমান সৈন্যকে বাঁচানোর জন্য আত্মহত্যা করেছৈ। আমি তখন আশ্চর্য  হয়েছিলাম। একজন খ্রীষ্টান যুবতী এক মুসলমানের জন্য এতবড় ত্যাগ স্বীকার করতে পারে? এখন বুঝতে পারছি, এমনটি হতে পারে।

সেই মুসলমান সৈন্যটিও তোমার মত ডাকাতদের সাথে যুদ্ধ করে মেয়েটির জীবন রক্ষা করেছির। আহত হওয়ায় মেয়েটা তাকে সুবাক নিয়ে এসেছীর। তোমার মতই সে মেয়েটার রূপ যৌবনের প্রতি দৃষ্টিও দেয়নি। অথচ ও ছিল ভীষণ সুন্দরী। আমিও ওর মত তোমার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারি।’

‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করে থাকি। আমার কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে আগেও তোমায় কোথাও দেখেছি। হয়ত এ আমার আবেগপ্রবণ মনের কল্পনা, হয়তবা সত্যি।’

‘দেখে থাকবে। তুমি মিসর গিয়েছ না, ওখানেই দেখেছ হয়তো।’

 ‘মিসর আমি গিয়েছি ঠিক, কিন্তু তোমাকে আমি মিশরে দেখিনি।

মুচকি হেসে আইওনা বলল, ‘আমার ব্যাপারে তোমার কি ধারণা। আমি কি সুন্দরী নই?’

‘তুমি সুন্দরী অস্বীকার করিনা।’ আরমানের কণ্ঠে গাঢ়তা। ‘বুঝেছি কেন এ প্রশ্ন করেছ। ভেবে আশ্চর্য হচ্ছ, তোমার খ্রীষ্টান ভায়েরা তোমার সাথে যে ব্যবহার করতে চেয়েছে আমি কেন তা করিনি। এখনও হয়ত মনে করছ আমি তোমার সাথে প্রতারণা করছী। সুবাক নিয়ে তোমায় নষ্ট করব। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমায় বিয়ে করব অথবা বিক্রি করে দেব।

তোমার এ আশংকা অমূলক। নারী সে নিজের ধর্মেরই হোক বা অন্য ধ্যমের, আমি কাউকে খারাপ চোখে দেখতে অভ্যস্ত নই।

আমার বয় যখন চৌদ্দ, আমার এক বোনকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওর বয়স ছিল সাত বছর। ষোল বছর পেরিয়ে দেছে। ওকে অপহণ করেছে খ্রীষ্টানরা। জানিনা বেঁচে আছে কি মরে গেছে। বেঁচে থাকলেও আছে কোন আমীরের হারেমে বা হয়তো তোমার মত গোয়েন্দাগিরী করেই ফিরছে।

এ জন্য প্রতিটি মেয়েকেই আমার বোন মনে হয। তাকে খারাপ চোখে দেখিনি। সে আমার বোনও তো হতে পারে।

শুধু নিরাপত্তার জন্যই তোমায় সুবাক নিয়ে যাচ্ছী। আমি জানি মরুভূতিমে একা ছেড়ে দিলে তোমার কি অব্সথা হবে। কারো হাতে পড়লে তোমার খ্রীষ্টান ভায়েরা যা করতে চেয়েছিল তাই হত।

আমাকে রূপের ফাঁদে জড়ানোর চেষ্টা করোনা। সে অনুভূতির দিক থেকে আমি মৃত। খ্রীষ্টানদের পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে ওদের রক্ত দিয়ে মরুর বালুকারাশি ভিজিয়েই শুধু আমি আনন্দ পাই।’

হতবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল আইওনা। চোখে মদির আবেশ। তার সাথে তো এভাবে কেউ কথা বলেনি।

ওকে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। ও নিজে এক চমৎকার প্রতারণা।

মদ্যপ হয়ে ওর রূপের মোহে ডুবে যায় মানুষ। ও নৈতিকতা আর সতীত্ব বঞ্চিত। ট্রেনিং শেষে অন্য মেয়েদের মত ও নিজেকে পুরুষের হৃদয়রানী ভেবেছে।

পিতা মাতার কথা ওর মনে নেই। বাড়ী কোথায় জানেনা। আরমানের আবেগপ্রবণ কথাগুলো ওর ভেতর উসকে দিল নারীত্বের অনুভূতি। ভাবনার অতলে হারিয়ে গেল ও। ভুলে গেল আরমানের উপস্থিতি।

চিন্তার গহীন সাগরের অতল থেকে ও বরল, ‘এক ভয়ংকর স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। আমাকে কোন এক বাড়ী থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। তখন বয়স কত ছিল মনে নেই।’

দু’হাতে মাথঅ চেপে ধরল ও। দু মুঠোয় চুল চেে মাথা ঝাকুনি দিতে লাগল। হারানো অতীত স্মরণ করার চেষ্টা করছে।

শেষে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কিছু মনে আসছে না। মদ, বিলাসিতা আর অশ্লীলতার গহীনে হারিয়ে গেছে আমার অতীত। আমার পিতা মাত কে, কেমন ছিলেন কখনও ভাবিনি। বাবা মায়ের প্রয়োজনই হয়নি।

কোন কালে আমার ভেতর মানবিক অনুভূতি ছিল না। পুরুষ যে পিতা এবং ভাইও হতে পারে জানিনা।

পুরুষ আমাকে মনে করে ভোগের সামগ্রী। আমি ওদের ব্যবহার করি। আমার রূপ যৌবন দিয়ে যাকে বশ করতে না পারি তার জন্য রয়েছে মদ এবং হাশিশ।

তুমি আমার ভেতর এমন অনুভূতি সৃষ্টি করেছ, যা মা, বাবা এবং ভঅউ বোনের স্নেহের পিয়াসী।’

ওর অস্থিরতা বেড়ে গেল। কথঅ বলতে লাগল থেমে থেমে। শেষে একদম চুপ হয়ে গের। কখনও তাকাচ্ছে আরমানের দিকে কখনও দু’হাতে ধরে মাথা ঝাকুনি দিচ্ছে।

ও ঘুরে ফিরছিল হারানো অতীত আর বর্তমানের মাঝে। আরমান বলল, ‘চল রওয়ানা হই।’

সহজ সরল বারীকার মত ও ঘোড়ায় চেপে বসল। পার্বত্য এলাকা ছৈড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেল ওরা। তখনও ও আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে।

একবার শুধু হেসে বলল, ‘পুরুষের কথা এবং প্রতিশ্রুতি আমি কখনই বিশ্বাস করিনি। বুঝতে পারছি না কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার সাথে যাওয়া উচিৎ।’

আরমান ওর দিকে চেয়ে মৃদু হাসল শুধু।

পরদিন সূর্যোদয়ের সময় ওরা সুবাক পৌঁছল। মরুভূমিতে কেটেছে একরাত একদিন্

ফটকে পৌঁছে আরমান নিজের পরিচয় দিল। এরপর গোয়েনদা সংস্থার অফিসে যাবার কথা বলে ওরা এগিয়ে চলল।

শহরের রাজপথ মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। পথে দু’পাশের লোকেরা আইওনাকে দেখছে।

চরতে চলতে হঠাৎ একটা বাড়ীর সামনে থেমে গেল আরমান। বাড়ীর ফটক বন্ধ।

আইওনা প্রশ্ন করল, ‘থালে কেন?’

জবাব না দিয়ে দরজার কাছে এল আরমান। ঘোড়ার পিঠে বসে বসেই দু’তিনবার করাঘাত করল। একজন সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ দরজা খুললেন।

‘এখানে কে থাকে?’ আরমান আরবী ভাষায় প্রশ্ন কর।

‘কেউ না। একটা খ্রীষ্টান পরিবার ছিল। আমাদের সেনাবাহিনী আসার পর সবাই পালিয়ে গেছে।’

‘এরপর আপনি দখল করেছেন?’

ভড়কে গেল বৃদ্ধ। একজন সৈনিক তাকে জিজ্ঞেস করছে কেন এ বাড়ী দখল করেছেন। সুলতান ঘোষণা করেছেন কোন মুসলমান যদি কোন খ্রীষ্টানকে কষ্ট দেয় কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।

বৃদ্ধ বলল, ‘এ বাড়ী আমি দখল করিনি, মেফাজত করার জন্য এসেছি। এখনি বন্ধ করে দেব। এ বাড়ীল মালিক মুসলমান। এখনও বেঁচে আছেন। পনর ষোল বছর ছিলেন খ্রীষ্টানদের বেগার ক্যাম্পে।’

‘সুলতান কি তাকে ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেননি?’

‘সবাই মুক্ত। কিন্তু এখনও তিনি ক্যাম্পেই আছেন। অসুস্থ, দুর্বল। ওখানেই সুলতান ওদের জন্য ভাল খাবার এবং ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করেছেন। ডাক্তার সবসময় দতেখাশোনা করেন। সুস্থ হলেই তাকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’

‘তা আপনি এখানে কেন?’

‘ওখানে যারা আছে তাদের আত্মীয় স্বজন প্রতিদিন ওদের সাথে দেখা করে। এ বাড়ীর মালিকও ক্যাম্পেই আছেন। একে তো বৃদ্ধ, তার ওপর দীর্ঘদিনের যন্ত্রণায় বেচারা শুধু বেঁচে আছে। আমি প্রতিদিনই দেখতে যাই। আশা করি কিছু দিনের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। বাড়ীটা খালি হয়েছে আমি তাকে বলে এসেছি।’

 ‘তার আত্মীয় স্বজনরা কোথায়?’

‘কেউ বেঁচবে নেই।

বৃদ্ধ হাত তুলে বা দিকে দেখিয়ে বললনে, ‘এখান থেকে চারটা বাড়ীর পরের বাড়ীটা আমার। এরা আমার প্রতিবেশী। আত্মীয়ও বলতে পারেন।

ঘোড়া থেকে নেমে আরমান ভেতরে গিয়ে একটা কক্ষের ঢুকল। আআিওনাও নেমে এল ঘোড়া থেকে।

আরমানের দিকে তাকাল ও। চোখ মুছছে।

আইওনা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করায় ও বলল, ‘আমার শৈশবকে খুঁজছি। একদিন এ বাড়ী থেকেই পালিয়ে গিয়েছিলাম। এ-ই আমাদের বাড়ী।’

সাথে সাথে ওর চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশুর বন্যা।

ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা আবার উঠোনে এল। বৃদ্ধ তখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে।

আরমান কান্না ভেজা কণ্ঠে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, ‘আত্মীয় স্বজন মরে গেছে। এর কোন ছেলে মেয়ে ছিল না?’

‘একটা মাত্র ছেলে বেঁচে ছিল। খ্রীষ্টান ডাকাতদের হাত থেকে পালিয়ে উঠেছিল আমার বাড়ীতে। আমি গোপনে তাকে সিরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখানে থাকলে সেও মারা যেত।’

আরমানের মনে পড়ল সে দুঃসহ রাতের কথা। পালিয়ে প্রতিবেশীর বাড়ীতে উঠেছিল। এই সেই প্রতিবেশী।

বৃদ্ধকে সে বলল না, যে বালককে আপনি সুবাক থেকে গোপনে সিরিয়া টপাঠিয়ে দিয়েছীলেন সে বালকই আপনার সাথে কথা বলছে।

উদগত কান্না রোধ করা আরমানের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ল। কিন্তু ও কঠিন হৃদয় সৈনিক। বৃদ্ধকে বলল, ‘আমি বাড়ীল মালিকের সাথে দেখা করব। তার নামটা বলুন।’

বৃদ্ধ তাকে তার পিতার নাম বলল। এ নামটি তার হৃদয়ের মনি কোঠায় অযত্নে রক্ষিত আছে।

‘ছেলেটার এক বোন ছীল’, বৃদ্ধ বললেন, ‘ছোট। খ্রীষ্টানরা ওকে অপহরণ রকে নিয়ে গেছে। তার কারণেই এ বাড়ীর সবাই নিহত হয়েছে।’

আইওনার দিকে ফিরল আরমান।

‘পবিত্র ক্রুশের পূজারীদের কাহিনী তো নিজের কানেই শুনলে।’

আইওনা এর কোন জবাব দিল না।

ও ছাদে দিকে তাকাতে লাগল। দরজার একটা পাল্লা বন্ধ করে দেখল কি যেন। কিছু আঁকি বুকি খোদাই করা।

বসে ও মনযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। আরমান তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

আইওনা আঁকাগুলো তাহ দিয়ে স্পর্শ করল। তারর উঠে দাঁড়াল ধীরে ধীরে। হঠাৎ কি হল, ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ও ছুটে গেল অন্য কক্ষে। ওখানকার দরজার পাল্লায়ও কি যেন খুঁজছে।

আরমান এগিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কি দেখছ?’ মেয়েটা মৃদু হেসে বলল, ‘তোমার মত আমিও আমার শৈশব খুঁজছি। এটাই কি তোমাদের বাড়ি ছিল? তুমি কি এখান থেকেই পালিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, এ বাড়ী থেকেই আমি পালিয়েছিলাম।’

আরমান ওকে শুনাল তার পালানোর কাহিনী।

কিভাবেখ্রষ্টানরা এ বাড়িতে আক্রমণ করে তার পিতা এবং ভাইকে হত্যা করেছিল তাও বলল। বলল, ‘ভেবেছিলাম আব্বাকেও ওরা মেরে ফেলেছে। কিন্তু এ বৃদ্ধ বললেন তিনি বেঁচে আছেন।’

‘বৃদ্ধকে কি বলেছ, যাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তুমিই সেই বালক?’

‘এ মুহূর্তে একথা বলতে চাই না।’

আইওনা গভীর চোখে আরমানকে দেখতে লাগর। বৃদ্ধ দূর থেকে ওদেরকে আশ্চর্য হয়ে দেখছিল। আরমান আনমনা হয়ে পড়ল।

বৃদ্ধ এগিয়ে গেল ওদের কাছে। বলল, ‘আমার জন্য কি হুকুম?’

চমকে বাস্তবে ফিরে এল আরমান। নির্দেশৈর ভঙ্গিতে বলল, ‘এ বাড়ী এখন আপনার অধিকাের, এর হেফাজত করবেন। চল, আইওনা।’

‘তোমার পিতার সাথে দেখা করবে না?’ অনুচ্চ কণ্ঠে বরল আইওনা।

‘আগে আপন কর্তব্য পালন করব। মরুভূমিতে কমান্ডার নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজছেন। এতক্ষণে হয়ত ভেবেছেন আমি মরে গেছি। ওখানে আমার প্রয়োজন রয়েছে। আমার সাথে এসো। এ আমানত নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেব।

‘নারী, নারী, নারী’, সুলতান আয়ুবীর উত্তেজিত কণ্ঠ। গোয়েন্দা প্রধান আলীকে বললেন, ‘বদমাশ খ্রীষ্টানগুলো কি পেয়েছে? ওরা কি আমার সামনে নারীদেহের প্রাচীর তৈরী করতে চায়? আমার সা মনে যুবতীদেরকে নাচিয়ে কি সুবাক দুর্গ ফিরিয়ে নেবে?’

‘সম্মানিত আমীর’, আলী বললেন, ‘মেয়েরা দেয়াল নয় নিষিদ্ধ গন্ধম। আপনার এবং জংগীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করা হয়েছে ওদের মাধ্যমে। এ নারীই মুসলিম আমীল ওমরাদের হাতে তুলৈ দিচ্ছে মদ আর হাশিম। ওদের দেঞের উত্তাপে গলে যাচ্ছে আমীর ওমরার দল। ব্যবহৃত হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে।’

‘এ প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। থাক ওসব কথা। এ মেয়েগুলোর ব্যাপারে কিছু বল। ওরা আটজনই তো গোয়েন্দা। ওদের কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে পারলে?’

‘ওরা বলেছে সুবাকে খ্রীষ্টানদের অনেক গুপ্তচর এখনও কাজ করছে। কারও ঠিকানা জানা নেই। ট্রেসও করা যাচ্ছৈ না। এদের তিজনক ক’দিন মিসরে ছিল। কি কাজ করেছে তা তো আপনাকে বলেছি।’

‘এদেরকে কোথায় রেখেছ? জেলে?’

‘না, আগের জায়গায়ই আছৈ। তবে পাহারার ব্যবস্থা করেছি।’

প্রহরী ভেতরে এসে স্যালুট দিয়ে বলল, ‘আরমান নামে একজন কমান্ডার একন খ্রীষ্টান  মেয়েকে সাথে নিয়ে এখানে এসেছেন। মেয়েটাকে পেয়েছেন ক্রাকের পথে। ও নাকি গুপ্তচর।’

‘দু’জনকেই ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’

আরমান এবং আইওনা ভেতরে ঢুকল। সুলতান আরমানকে বললেন, ‘মনে হয় দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছ। তুমি কার সাথে ছিলে?’

‘আমি সিরিয়ার ফৌজে ছিলাম। আমার কমান্ডারের নাম এহতেশাম বিন মুহম্মদ। আমি কমান্ডো বাহিনী ‘আল বারক’-এর কমান্ডার।’

‘আল বারক এখন কি অবস্থায় আছে?’

প্রশ্ন করেই সুলতান আলিকে বললনে, ‘আল বারক’ অর্থ বিদ্যুৎ। আসলেই ওরা বিদ্যুৎ। আমরা যখন সুদানীদের আক্রমণ করেছিলাম, তখন কমান্ডো হামলায় ছিল আর বারক। ওরা তুলনাহীন।’

‘মাননীয় সেনাপতি। গ্রুপের সবাই আল্লার পথে জীবন উৎসর্গ করেছে। বেঁচে আছি শুধু আমি।’

‘তোমার কারণে তো এতগুলো জীবন নষ্ট হয়নি? মৃত্যু আর উৎসংর্গের মধ্যে অনেক তফাৎ।’

‘না, মাননীয় সেনাপতি! আল্লাহ সাক্ষী, আমরা প্রতিটি জীবনের বিনিময়ে অন্তত বিশজনকে হত্যা করেছি। ওদের দলের দু’একজন ক্রাক পৌঁছলেও আহত অবস্থায় পৌঁছেছে। খ্রীষ্টানদের রক্কে ফিলিস্তিনের মাটি রঙীন হয়ে গেছে।

 আমাদের দ্বিতীয় দলটিও শত্রুর জন্য ছিল আতংক। খ্রীষ্টানদের মধ্যে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ক্ষমতা নেই।’

‘আর তুমি?’ যুবতীর দিকে তাকিয়ে সুলতান বললেন, ‘তোমার ব্যাপরে সব কথা কি আমাদের খুলে বলবে?’

‘সব কিছুই বলব।’ ওড়নায় চোখ মুছে বলল আইওনা।

‘আরমান?’ সুলনাতন বললনে, ‘তুমি যাও। খাওয়া গোসল সেরে বিশ্রাম কর। কাল আবার নিজের দলের কাছে ফিরে যেতে হবে।’

‘শত্রুর দুটি ঘোড়া এবং অস্ত্রও নিয়ে এসেছি।’

‘ঘোড়াগুলো আস্তাবল আর তীর তরবারী অস্ত্রাগারে জমা দাও।

একটু ভেবে সুলতান বললেন, ‘ওগুলো তোমার ঘোড়ার চাইতে  ভাল হলৈ বদলে নিও। ময়দানের ঘোড়াগুলো কি অবস্থায় আছে?’

‘চিন্তার কোন কারণ নেই। আমাদের একটা ঘোড়া নষ্ট হলে খ্রীষ্টানদের কাছ থেকে দু’টো ঘোড়া পেয়ে যাই।’

সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল আরমান। আমানত নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়েছে ও। কিন্তু ওর হৃদয়ে এক অব্যক্ত বেদনাভারে পিষ্ট হচ্ছিল। এ ছিল আবেগের ভার। শৈশবের হারানো স্মৃতির বেদনা। পিতা পুত্রের ভালবাসার ব্যথা।

যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও পিতার সাথে দেখা করতে চাইছিল না। আশংকা ছিল পিতৃস্নেহ, আর অতীত বেদনা কর্তব্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ঘোড়াগুলো সাথে নযৈ ও আস্তাবলের দিকে হাঁটা দিল। আশপাশের কোন খেয়াল নেই।

ও আনমনে হাঁটছে। সামনে সুবাকের অলিগলি। ওর জন্মস্থান। এখানে ওর শৈশব কেটেছে। দুরন্ত কৈশোর পেরিয়েছে। কিন্তু তাকে দেশছাড়া করা হয়েছিল। ওর উদাস চোখ দুটো বিষন্ন ব্যথায় ছলছল করে উঠল।

‘পথ ছাড় অশ্বারোহী!

কারো ডাকে চমকে উঠল ও। ঘুরে পেছনে তাকাল। একদল ঘোড়সওয়ার আসছে।

ও দ্রুত রাস্তার পাশে সরে গেল। শেষ আরোহীটি অতিক্রম করার সময় ও বলল, ‘বাইরে থেকে এসেছ? ময়দানের কি খবর?’

‘আল্লাহর রহমতে সব ভাল দোস্ত। প্রতিদিনই শত্রু নিঃশেষ হচ্ছে। সুবাকের জন্য কোন বিপদ নেই।’

অশ্বারোহীর দল সামনে চলে গেলে ডান দিকে মোড় নিল আরমান।

‘আমি আপনার সামনে কিছুই লুকাইনি।’

সুলতান এবং আলীর সামনে বসে আইওনা বলল। কোন প্রশ্ন ছাড়াই ও শুনাল গোয়েন্দাবৃত্তির বিস্তারিত কাহিনী।

নির্যাতনের পরও গোয়েন্দারা যা বরে না ও বরল তারচে বেশী। সন্দেহে পড়ে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান।

‘আইওনা!’ আলী বললেন, ‘আমিও তোমার বিষয়ে পারদর্শী। স্বীকার করি তুমি উঁচু স্তরের গোয়েন্দা। আমাদের নির্যাতন এবং জেল থেকে বাঁচার জন্য তোমার পদ্ধতি প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু আমি তোমার প্রতারণার জালে পা দেব না।’

‘আপনার নাম কি?’

‘আলী বিন সুফিয়ান। হরমুনের কাছে আমার নাম শুনে থাকবে।’

আইওনা দাঁড়াল। আলী রকাছে গিয়ে বলল হাঁটু গেড়ে। আলীর ডান হাত তুলে নিল নিজের হাতে।

চুমো খেয়ে বলল, ‘আপনাকে জীবিত দেখে আমি ভীষণ খুশী হয়েছি। আপনার সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু বলা হয়েছে। হরমুন বলত, আলী মরে গেলে যুদ্ধ ছাড়ই আমরা মুসলমানদের নিঃশেষ করে দিতে পারি।’

যুবতী আবার নিজের স্থানে গিয়ে বসল।

‘কায়রোতে আিম আপনাকে দেখার অনেক চেষ্টা করেছি। দেখা হয়িন। আমার সামনেই আপনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছির। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছিল কিনা জানার আর সুযোগ হয়নি, কারণ আমাকে তখনই সুবাক ডেকে আনা হয়েছিল।’

‘আমরা কিভাবে বিশ্বাস করব তুমি যা বলেছ সত্য বলেছ?’ আলী বললেন।

‘আমাকে বিশ্বাস করছেন না কেন?’ আইওনার কণ্ঠে ঝাঁঝ।

‘কারণ তুমি খ্রীষ্টান।’ বললেন সুলতান আয়ুবী।

‘যদি বলি আমি খ্রীষ্টান নই মুসলমান, তাও হয়ত বিশ্বাস করবেন না। আমার কাছে এর কোন প্রমাণ নেই। ষোল বছর পূর্বে এ শহর থেকেই আমি অপহৃত হয়েছিলাম। এখানে এসে শুনেছি আমার পিতা ক্যাম্পে আছেন।’

আইওনা পিতার নাম উল্লেখ করে বলল, ‘তার নামটাও এখানে এসে জেনেছি। আমি তো বলেছি আরমানকে হত্যা করতে গিয়ে আমা রহাত উঠেনি। দিনে ওর চেহারা এবং চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল ওকে আমি কোতায় যেন দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করায় ও বলেছে এ সম্ভব নয়। দু’জন খ্রীষ্টান সৈন্য আমার সম্ভ্রম লুটে নেয়ার চেষ্টা করছে। তখনও ওরাই আমার আপন।

একজনকে আরমান হত্যা করল। অন্যজনকে আমি। ওকে মেরে আমার সম্ভ্রম রক্ষা করেছি এজন্য নয় বরং খুশী হয়েছি আরমানের জীবন বাঁচাতে পেরেছি বলে।

পথে ওর মুখে আবেগভরা কিছু কথা শুনে এই প্রথম আমার হৃদয়ে অনুভূতি জন্ম নিল। সমস্ত পথেই আমি ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। স্মৃতির পাতা হাতড়ে এদ্দুর মনে হয়েছে, শৈশবে কেউ আমায় অপহরণ করেছিল।

আপনি তো জানেন মেয়েদেরকে কিভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়। মন থেকে হারিয়ে যায় শৈশবের স্মৃতি। আমারও তাই হয়েছে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হতে লাগল আমি আরমানকে চিনি।

এ ছিল রক্ত সম্পর্কের দাবী। চোখ চোখকে এবং হৃদয় চিনেছে হৃদয়কে।

হয়ত আরমানের হৃদয়েও এমন অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। তা নয়তো আমার মত অপরূপা যুবতীকে আমলেই আনেনি। যেন সে একা। তার সাথে কেউ নেই। আমার দিকে অেকবারই সে গভীর চোখে তাকিয়েছে।

সুবাক এসে আরমান একটা বাড়ীতে ঢুকল। আমিও পিছু নিলাম। ভেতরে ঢুকে আমার স্মৃতি জেগে উঠল। ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দরজার পাল্লায় খোদাই করা আঁকিবুকি চোখে পড়ল। দেখলাম।

বড় ভাইজানের খঞ্জর দিয়ে আমি নিজেই দরজার পেছনে এভাবে খোদাই করেছিলাম।

আবার আরমানের দিকে তাকালাম গভীর চোছে। দাড়ি থাকলেও ষোল বছর পূর্বের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম।

ওকে বলিনি আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন। ও এত পবিত্র আর আমি কত অপবিত্র। ওকে বলৈ দিলে ও কি করত জানিনা।’

মেয়েটির বলার মাঝে আলী কয়েকবারই সুলতানের দিকে তাকালেন। একনও ও স্দেহের উর্দে নয়। কিন্তু উচ্ছাসিত আবেগ, উদগত অশ্রু এবং বেদনামাখা বর্ণনায় দু’জনই প্রভাবিত হচ্ছিল।

তার ফোপানির শব্দে ম নে হচ্ছিল ও সত্য কথাই বলছে।

শেষ পর্যন্ত তার বলা কথা বএং তথ্যাবলী যাচাই বাছাই করার জন্য মেয়েটির দেয়অ প্রস্তাব দু’জনেই মেনে নিলেন।

ও বলল, ‘আপনারা আমাকে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, জেলে পাঠান বা যা ইচ্ছে তাই করুন, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমি বেঁচে থাকতে চাই না, যদি আপনারা অনুমতি দেন পাপের প্রায়শ্চিত্য করে মরতে চাই।

‘কি করবে?’ সুলতান প্রশ্ন করলেন।’

যদি আমাকে ক্রাক পৌঁছে দেন তবে খ্রীষ্টানদের চারজন সম্রাট এবং গোয়েন্দা প্রধান হরমুনকে হত্যা করতে পারি।’

‘আমরা তোমাকে ক্রাক পৌঁছে দিতে পারি। তবে কাউকে হত্যা করার জন্য নয়। ইতিহাস ব লবে সুলতান আয়ুবী মেয়েদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যা করে নিজে দুর্গে বসেছিলেন। না মেয়ে, এ অপবাদ নিয়ে আমি মরতে চাই না।

যদি সংবাদ পাই কোন খ্রীষ্টান সম্রাট অসুস্থ আমি তার কাছে আমার ডাক্তার পাঠিয়ে দেব। তাছাড়া তোমাকে আমরা বিশ্বাসও করতে পারছি না। অবশ্য তুমি যদি ইচ্ছে কর তোমায় ক্ষমা করে ক্রাক পাঠিয়ে দেব।

 ‘না। এমন কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি এখানেই মরব। তবে আমার অনুরোধ আরমান যেন জানতে না পারে আমি তার বোন। আমার পিতাকে দেখতে যাব। তাকেও বলব না আমি তার মেয়ে।’

ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকল আইওনা।

আলী বিন সুফিয়ান ওকে প্রয়োজনীয় কয়েকটি প্রশ্ন করে সুলনাতের দিকে তাকালেন।

‘ওকে এখন কি করব?’

কিছুক্ষণ ভেবে সুলতান বললেন, ‘ওর আরাম আয়েশৈর প্রতি লক্ষ্য রোখো। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেব।’

আলী ওকে সাথে নিয়ে গেলেন। অন্যান্য গোয়েন্দা মেয়েরা যেখানে থাকে তার একটা কক্ষ দিলেন ওকে।

আইওনা সেখানে থাকতে সরাসরি অস্বীকার করে বলল, ‘এ কক্ষগুলোকে আমি ঘৃষা করি। যেখান থেকে আমি অপহৃদ হয়েছিলাম সে বাড়ীতে কি আমায় রাখা যায়না?’

‘না, আবেগের কারণে আমি নিয়ম কানুন বদলে দিতে পারি না।’

প্রহরী এবং চাকরবাকরদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ওকে রেখে ফিরে গেলেন আলী।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top