৩. সুবাক দুর্গে আক্রমণ

দস্যুদের কাছ থেকে ফিরে এল দু’জন রক্ষী সেনা। সবাই তাদের ঘিরে ধরল। কমান্ডার হাদিদ বলল, ‘ওরা মরু দস্যু। ওদের দু’জনের সাথে দেখা করেছি, পাহাড়ের আড়ালে আছে বাকীরা। ওদের সংখ্যা কত জানিনা। যে দু’জনকে তোমরা দেখেছ তাদের কথা অনুযায়ী ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে সকাল থেকে।

ওরা আমাকে বরর, ‘তোমরা সরকারী সৈন্য। মুসলমান। মেয়ে দোটো মুসলমান নয়। ওদের আমাদের হাতে তুলে দাও, আমরা তোমাদের আর বিরক্ত করবো না। আমি বলেছি, এ মেয়েগুলো যে ধর্মেরই হোক, ওরা এখন আমাদের হেফাজতে। তাদের ইজ্জত, সম্মান এবং জীবন সবকিছু আমাদের কাছে আমানত। দেহে প্রাণ থাকতে ওদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেবনা।

ওরা বলল, ‘দুটো মেয়ের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করোনা।’

আমি বলেছি, ‘আগে আমাদের মারবে তারপর মেয়েদের নেবে। তোমরা কি অস্ত্র চালাতে পার? ডিউককে প্রশ্ন করল কমান্ডার।

‘আমরা প্রতিটি মেয়েকেই অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেই। তোমাদের কাছে তারবারী, বর্শা এবং তীল ধনু আছে। এর যে কোন একটা আমাদের দাও।’

‘এখন নয়।’ কমান্ডার বলল, ‘ওদের সাথে সংঘর্ষ বাধলে দেব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ এলাকা ছেড়ে আমাদের চলৈ যাওয়অ উচিৎ। উটের সাথে ধোড়া দিয়ে এখানে আক্রশণ প্রতিহত করা যাবেনা।’

রওনা হল ওরা। রক্ষীরা হাতে নিল তীর ধনু। হাদিদ সবার আগে। একজন রক্ষী তাকে বলল, ‘গোয়েন্দাদের হাতে অস্ত্র দেয়া ঠিক হবে না। শত হলেও ওরা আমাদের শত্রু। ডাকাতদের সাথে মিশে আমাদেরকেই হত্যা করার চেষ্টা করতে পারে।’

ডিউক মেয়েদের বলল, ‘এদের উদ্দেশ্য খারাপ। নইলে আমাদের অস্ত্র দিতে অস্বীকার করত না। আসলে দস্যুরা ওদেরই লোক। তোমাদেরকে ডাকাতদের হাতে তুলে দেবে। আমাকেও মেরে ফেলবে।’

ডাকাত এবং রক্ষীদের ভয়ে ওরা ছিল পেরেশান। হাদিদ রক্ষীদের বলল, ‘মুখোশ পরা কাউকে দেখলে তীর মারবে। আমার অনুমতি নিতে হবেনা। ওদের সাথে অবশ্যই আমাদের সংঘর্ষ হবে। কখন এবং কোথায় তাই দেখতে হচ্ছে।’

দ্রুত চলছিল ওরা। মাঝে মাঝে উট ঘোড়াকে বিশ্রাম এবং দানাপানি দেয়ার জন্য থামতে হচ্ছে। বিপদসংকুল পথ আর ফুরোয় না। দীর্ঘ পার্বত্য এলাকার উঁচু-নীচু ও আঁকাবাঁকা পথ ধরে যথাসম্ভব দ্রুত ছুটছে ওরা। হাদিদের ভয় হচ্ছিল ওরা ওপর থেকে তীর ছোড়া শুরু করে দিতে পারে। তাই গোয়োন্দাদের তাড়া দিয়ে বলল, ‘উটগুলো ঘোড়ার গতিতে চালাও। পাহাড়ের ওপর নজর রেখে এগিয়ে চল।’

পাহাড়ী এলাকা পেরিয়ে গেল কাফেলা। কোন দস্যু নজরে আসেনি। পশ্চিমে নেমে যাচ্ছে সূর্য। অনেক দূরে দেখা গেল দু’টো উট ওদের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চলছে ওরাও।

পথে পানি পাওয়া গেল। উট ঘোড়াকে খাওয়ালো। নিজেরাও তৃষ্ণা নিবারণ করল। সামান্য বিরতি দিয়ে এগিয়ে চলল আবার।

সূর্য ডুবে গেল। আঁধারে ছেয়ে গেল মরু প্রকৃতি।

কমান্ডার থেমে গেল। বলল, ‘যুদ্ধের জন্য এ জায়গাটা উপযুক্ত। আশপাশ কোন বাঁধা নেই।’

ঘোড়ার পিঠে বাধা রইল জিন। খাওয়া শেষে মেয়েদেরকে ডেকে নিয়ে কমান্ডার বলল, ‘সতর্ক থেকো।’

ধনুতে তীর জুড়ে প্রস্তুত রইল রক্ষীরা। ঘুমাল না কেউ। তার দৃঢ় বিশ্বাস, দস্যুরা রাতে আক্রমণ করবেই।

নিঝুম রাত। আচম্বিত দেখা গেল চারপাশে কালো ছায়া মূর্তি। উটের ভারী পদশব্দে মাটি কাঁপছে। সংখ্যায় দশের অধিক। প্রতি উটে একজন আরোহী। কাফেলাকে আতংকিত করতে চাইছে ওরা।

তিন চার বার চার বার চারপাশ চক্কর দিয়ে এক আরোহী ধমকের সুরে বলল, ‘মেয়েদেরকে আমাদের হাতে তুলে দাও। তোমাদের আমরা কিছুই করব না।’

শুয়ে শুয়েই তীর ছুঁড়ল হাদিত। চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল একজন। হাদিদ মেয়েদের বরল, ‘পালিওনা। মাটির সাথে মিশে যাও। আমাদের কাছাকাছি থেকো। আমরা জায়গা বদল করলে তোমরাও অনুসরণ করো।’

উষ্ট্রারোহীদের মধ্য থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলল, ‘আক্রমণ কর, কাউকে জীবিত রেখোনা। মেয়েদের তুলে নাও।’

জোসনা না হলেও রাতের মরুভূমি বেশ ফর্সা থাকে। অনেক দুরের জিনিষও দেখা যায়।

উষ্ট্রারোহীরা লাফ দিয়ে নীচে নামল। শুরু হল দু’দলের সংঘর্ষ। রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে দিল তরবারীল ঝনঝনাৎ শব্দ। মেয়েদের পিছনে সরিয়ে দিয়ে মুখোমুখি লড়ছিল রক্ষীরা।

মেয়েদের পিছন থেকে বার বার বলতে লাগল, ‘আমাদেরও কিছু একটা দিন।’

হাদিদ একজনকে বলল, ‘আমার তরবারী খুলে নাও।’

তারবারী হাতে নিয়ে একজন মেয়ে সামনে না এসে পিছন দিকে সরে গেল। হাদিদ বলল, ‘দূরে যেয়োনা। তোমাদেরকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার জন্যই ডাকাতদের এ আক্রমণ। বিচ্ছিন্ন হলে আর রক্ষে থাকবে না।’

ডিউকের কোন সাড়া শব্দ নেই।

দু’দলই ছড়িয়ৈ ছিটিয়ে পড়ছে এদিক-ওদিক। লড়াই করতে করতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দল থেকে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, বিক্ষিপ্ত হাতাহাতি যুদ্ধ। এ অবস্থা চলল অনেকক্ষণ। রক্ষীরা পরস্পরকে ডেকে ওরা যে এখনো টিকে আছে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল। একসময় থেমে গেল ডাকাডাকির শব্দ। যুদ্ধ শেষ।

হাদিদ সংগীদের ডাকল, জবাব এলনা। একটু পর শোনা গেল এক নারী কণ্ঠ, অনেক দূর থেকে তাকেই নাম ধরে ডাকছে।

হাদিদ কান পাতল। ভেসে এল মৃদু অশ্ব ক্ষুরধ্বনি। হাদিদ বুঝল, ডাকাতরা উটের পরিবর্তে রক্ষীদের ঘোড়ায় করে কোন মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছে। হাদিদ দৌঁড়ে নিজের ঘোড়ার কাছে গেল। এরপর পালিয়ৈ যাওয়া ঘোড়ার শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল।

অন্য মেয়েটা কোথায় তিনি জানেন না।

তার উন্নত জাতের তাজি ঘোড়া তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। সামনের ঘোড়া উন্নত জাতের হলেও ওতে আরোহী দু’জন। ফলে হাদিদ আশঅ করল দ্রুতই ওদের ধরতে পারবে সে।

কিছু দূর যাওয়ার পর মাইল খানেক দূরে ওদের দেখতে পেল হাদিদ। গতি বাড়িয়ে দিয়ে দোুত কমিয়ে আনল দূরত্ব। হাদিদের মনে হল পেছনে আরেকটা ঘোড়া আসছে। পেছনের ঘোড়াটি রক্ষী না দস্যুদের বুঝার উপায় নেই।

হাদিদ পেছনে তাকাল। ঘোড়া এগিয়ে এসে কাছাকাছি হল।

‘কে?’ গলা চড়িয়ে জানতে চাইল হাদিদ। জবার এলনা।

হাদিদ সামনের ঘোড়সওয়ারকে ধরার জন্য ঘোড়া ছোটাল আবার। সামনের দস্যুটা সোজা এগিয়ে যাচ্ছীর, ও কাছাকাছি হতেই বার বার ডানে বায়ে ঘুরে এগুতে লাগর।

কমে যেতে লাগল গতি। সম্ভবত মেয়েটি বলগা হাতে নিয়েছে।

দস্যুর কাছে পৌঁছলেন হাদিদ। হাতের বর্শা দিয়ে আঘাত করলেন দস্যুর পিঠে। ঘোড়া একদিকে সরে গেল। দস্যুটা বেঁচে গেলেও আঘাত লাগল ঘোড়ার পিঠে।

ঘুরলেন হাদিদ। দস্যুটা ঘাড়ো ঘোরাতে চাইল। মেয়েটা বাধা দিচ্ছে।

হাদিদ মেয়েটাকে ডাক দিল। ও আরো সাহসী হয়ে উঠল।

যুবতীকে সাথে নিয়ে ঘোড়া থেকে লাফ দিল দস্যু। ঢাল হিসাবে ব্যবহার করল নিজের ঘোড়া। হাদিদ আঘাত করতে চাইলেই যুবতিকে সামনে এগিয়ে ধরছে।

ঘোড়া থেকে নেমে এলো হাদিদ। ততোক্ষণে পৌঁছে গেছে পেছনের আরোহী। রক্ষী নয় দস্যু। সে্টো ঘোড়া থেকে নামল।

হাদিদ ধমকের সুরে বললেন, ‘তোমরা যুবতীকে নিয়ে যেতে পারবে না।’

এক ডাকাত ওকে ধরে রেখেছে। লড়ছে দ্বিতীয় জন। মেয়েটা নিরস্ত্র। হাদিদের সামনে টিকতে পারছেনা দস্যুটা। তিই দেখে মেয়েটাকে ছেড়ে দু’জন একত্রে হাতিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল।

হাদিদ মেয়েটাকে বললেন, ‘ঘোড়া নিয়ে তুমি সুবাকের দিকে পালিয়ে যাও। এদের আমি ঠেকাচ্ছি।’

নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল তরুনী।

দস্যু দু’জন বার বার বলছিল, ‘একপা রমনীল জন্য নিজের জীবন হারিও না। তুমি পালাতে চাইলে আমরা তোমাকে বাধা দেবনা।’

‘অসম্ভব। ওকে নিতে হলে আগে আমাকে মারতে হবে, তারপর ওকে পাবে।’ হাদিদের স্পষ্ট জবাব।

তিনি কয়েকবারই যুবতীকে পালিয়ে যেতে বললেন। ও বলল, ‘তোমাকে একা ফেলে রেখে আমি যাবনা।’

আহত হলেন হাদিদ। আবার যুবতীকে বললেন, ‘আমি আহত, মারা যাচ্ছি আমি। আমি আবারো বরছি, পালাও তুমি। আমি আরো কিছুক্ষণ ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবো দেরী করোনা, এখনো বলছি, পালাও।’

যুবতী পালিয়ে যায় কিনা তা দেকার জন্য ওদিকে ফিরল এক দস্যু। এ সুযোগে তার পাজরে বর্শা মারলেন হাদিদ। পড়ে গেল সে। অন্য দস্যুটার তরবারীর আঘাত লাগল তার কাঁধে।

তরুণী পড়ে যাওয়া ডকাতের তারবারী তুলে নিয়ে পেছন দিক থেকে দ্বতীয় ডাকাতের পিঠে আমূল বাসিয়ে দিল। আহত কাঁধ নিয়েই পাঁই করে ঘুরল হাদিদ।

পেছন থেকে যুবতীর তারবারী যখন আঘাত করছিল দস্যুটাকে তখন হাদিদের বর্শাও তার বুক ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছে। দু’দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দস্যু।

যুদ্ধ শেষ। ডাকাত দু’জন নিহত। দাঁড়াতে পারছিল না হাদিদ। পড়ে যাচছিল, ধরে ফেলল যুবতী।

হাদিদ বললেন, ‘তুমি সুস্থ? আমায় ছেড়ে একটা ঘোড়া নিয়ে এক্ষুণি সুবাক রওয়ানা কর। সংগীদের দিকে যেয়োনা। ওদের কেউ হয়ত বেঁচে নেই।’

‘কোথায় আঘাত লেগেছে আপনার?’

আমাকে মরতে দাও, চলে যাও তুমি। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তুমিই পালন কর। ডাকাতদের কেউ আবার এদিকে এসে পড়লে আর পালতে পারবে না।’

যুবতীর মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। ও বুঝেছে তার জন্যই লোকটা নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

সে তাকে একা রেখে যেতে অস্বীকার করল। দৌড়ে গেল ঘোড়ার কাছে। জিনের সাথে বাধা মথক এনে হাদিদকে পানি পান করাল। বলল, ‘দেখি, আপনার আঘাতটা কোথায় লেগেছে?

হাদিদ ক্ষতস্থান দেখালেন। যুবতী তাড়াতাড়ি তার ওড়না ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিল।

‘আপনি আমার জন্য আপনার জীবন বিপন্ন করেছেন। আপনাকে একা রেখে আমি কিছুতেই এখান থেকে যাবোনা। যদি আমার ভাল চান তবে উঠুন। ভাগ্য ভাল হলে আমরা বেঁচে যেতেও পারি।’

‘তুমি. . .’

‘আমার নাম সিনথিয়া।’

হাদিদ তাকিয়ে দেখলেন যুবতীকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, ও যা বলেছে তাই করবে। বললেন, ‘কিন্তু সিনথিয়া, আমার যে যাওয়ার শক্তি নেই।’

যুবতী হাদিদকে ধরে দাঁড় করাল। ধীরে ধীরে নিয়ে গেল ঘোড়ার কাছে। এরপর অনেক কষ্টে ঘোড়ার পিঠে বসাল। নিজে অন্য ঘোড়ার উঠতে গেলে হাদিদ বলল, ‘আমি একা বসতে পারব না।’

দু’টো ঘোড়ার রশি একটার জিনের সাথে বেঁধে তরুনী হাদিদের পেছনে উঠে বসল। যুবতী হাদিদের মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সুবাক কোন দিকে?’

হাদিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে ডানদিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওদিকে চলো।’

এগিয়ে চরল ঘোড়া। হাদিদ আবার বললেন, ‘হয়ত আমি বাঁচবনা । ক্ষতস্থান থেকে এখনো রক্ত ঝরছে। যেখানেই আমার মৃত্যু হয় মাটি চাপা দিয়ে রেখো। আমার ব্যাপারে কোন সন্দেহ হয়ে থাকলে তা দূর করে আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি আমানতের খেয়ানত করিনি। আল্লাহ তোমাকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিন।’

‘আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে তুলুন। দয়া করে এখন আর কথা বলবেন না।’

ঘোড়া এগিয়ে যাচ্ছে! এগিয়ে যাচ্ছে সময়। জনমানবহীন সুনসান দুস্তর মরুভূমিতে শেষ রাতের হিমেল ঠাণ্ডা। সে শীতার্ত ঠাণ্ডা মাড়িয়ে ঘোড়ার পিঠে আহত মুসলিম কমান্ডার হাদিদের মাথা কোলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সিনথিয়া নামের এক খ্রীষ্টচান গোয়েন্দা যুবতী। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার কাছে মনে হচ্ছিল এক দুঃস্বপ্ন।

** *

হাদিদের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু অত্যাধিক রক্ত ঝরায় দুর্বল হয়ে পড়েছেন জ্ঞান হারাচ্ছিলেন বার বার। মাথা ঝাকিয়ে তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলেন।

ছোট এক খেজুর বাগানের কাছে এসে থামল তরুণী। আলগোছে নামাল তাকে। পানি পান করাল। জিনের সাথে বাঁধা থলে থেকে খাবার এনে দিল। আচ্ছন্নভাবটা কেটে গেল হাদিদের। স্বগতোক্তি করে বললেন, ‘আগে ছিলাম যুবতীর রক্ষী, এখন ওর বন্দী।’

সিনথিয়া তাকে শুইয়ে দিল। বিশ্রামের পর অনেকটাই সুস্থ বোধ করলেন হাদিদ।

‘আমরা সুবাকের কাছে চলে এসেছি। আর মাত্র একদিনের পথ।’ হাদিদ বললেন, ‘একটা ঘোড়া নিয়ে তুমি চলে যাও। আমি এখান থেকেই ফিরে যাব।’

‘তুমি একা যেতে পারবে না। মরে যাবে। এখান থেকে ফিরে যেতে চাইলে আমাকে সাথে নাও। তুমি আমায় একা ছাড়নি, আমিও তোমাকে নিঃসঙ্গ যেতে দেব না।’

‘আমি পুরুষ। একজন নারী আমার হেফাজত করছে এ কথা মানতে পারছিনা। এরচে মরে যাওয়াই ভাল।’

‘যারা ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকে আমি তেমন মেয়ে নই। ওরা পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া একপাওচ লতে পারেনা। মনে কর আমি এক পুরুষ সৈন্য। পার্থক্য, আমার অস্ত্র আমার রূপ, যৌবন, চোখের কটাক্ষ, মুখের হাসি আর কণ্ঠের মধু। তোমার মত আমিও কষ্ট সইতে পারি। ইচ্ছে করলে পায়ৈ হেঁটেও সুবাক যেতে পারব।’

‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। সিনথিয়া, তোমার এ আবেগকে আমি সম্মান করি। আমার প্রতি তোমার এ সহৃদয়তার কারণ কৃতজ্ঞতাবোধ। দস্যুরা আমাদের দু’জনকে অনেক কাছে নিয়ে এসেছে। অথচ আমরা উভয়েই জানি আমাদের দু’জনের পথ ভিন্ন। তুমি আমার জাতির মূল উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছো, আর আমি ক’দিন পর তোমার দেশ আক্রমণ করার স্বপ্ন দেখছি।’

‘আপাততঃ আমার বন্ধুত্ব গ্রহণ কর। তুমি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গিয়ে শত্রুতার কথা ভেবো।’

হাদিদের ঘাড়ের নীচে হাত দিয়ে যুবতী তাকে শোয়া থেকে তুলল। হাদিদ এখন হাঁটতে পারছেন।

ঘোড়া পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন তিনি। সিনথিয়া তাকে ঘোড়ায় চড়তে সাহায্য করল। উঠে বসলেন হাদিদ। সিনথিয়া তার পেছনে উঠতে চাইল। হাদিদ বাধা দিলেন।

‘তুমি অন্য ঘোড়ায় উঠ। আমি এখন একা চলতে পারব।’

‘না’ যুবতীর কণ্ঠে সিদ্ধান্তের সুর, ‘আমি এ ঘোড়ায়ই উঠব। তুমি লেগে থাকবে আমার বুকের সাথে।’

যুবতী হাদিদের পেছনে উঠে বসল। এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল যুবতী। বাধা দিল হাদিদ।

‘আমাকে আমার শক্তিতে বসতে দাও।’

সিনথিয়া তার এ কথায় মোটেই আমল দিল না। জোর করে তাকে ধরে রাখল। হাদিদের মাথা রাখল নিজের কাঁধে। বলল, ‘জানি, বাজে মেয়ে মনে করে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছ।’

‘না, তা নয়। তুমি এক যুবতী। বাজে হও, আর ভাল হও সব অবস্থায় তোমার থেকে দুরে থাকা আমার কর্তব্য। আমি আমার পৌরুষের হেফাজত করতে চাই। ভেবে দেখো, তোমাকে কাছে পেতে চাইলে যে দু’রাত তুমি আমার বন্দিনী ছিলে সে সময় যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম। কিন্তু আমি শয়তানকে কাছে আসতে দেইনি। এখন মনে হচ্ছে আমি আমানতের খেয়ানত করছি। আমার ভেতর পাপের বীজ অংকুরিত হচ্ছে। তাই তোমার কাছ থেকে সরে থাকতে চাচ্ছি।’

‘তুমিতো আর পাথর নও। প্রতিটি পুরুষই আমার দিকে তাকায় কামনার দৃষ্টি নিয়ে। সামান্য বিনিময়ের পরিবর্তে তোমার জাতির লোকদের ঈমান কিনে নেয়ার অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। কিন্তু তোমার কাছে তো আমি কোন বিনিময় দাবী করছিনা।’

‘কিসের বিনিময়ে ঈমান ক্রয় কর তুমি?’

‘আমার কাঁধে মাথা রাখার, একটু পাশে বসার সুযোগ দিয়ে।’

‘ওদের কাছে ঈমানই ছিল না।’

‘যা-ই ছীল আমি নিয়ে নিয়েছি। ওদের রক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েছি গাদ্দারী। আপন জাতির বিরুদ্ধে ওদের হৃদয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি ঘৃণা।’

‘ওরা কারা?’

‘এখন বলব না। তোমাদের কর্তব্য তোমার কাছে যেমন প্রিয় আমার কর্তব্যও আমার কাছে।’

হাদিদ চুপ করে রইলেন। ক্রমশঃ আবার তিনি দুর্বল হয়ে ড়পছিলেন। ক্লান্তি অনুভব করলেন তিনি। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল, তিনি চোখ বন্ধ করে নিলেন।

সিনথিয়া তাকে শক্ত করে ধরে আছে। যুবতীল দেহের উষ্ণ পরশ অনুভব করলেন তিনি। ওর রেশত কোমল চুল বাতাসে উড়ছিল। ছুয়ে যাচ্ছিল হাদিদের গাল, মুখ।

ঝিমুতে লাগলেন হাদিদ। অনেকক্ষণ পর চোখ খুললেন। দেখলেন, সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছে।

তিনি তৃষ্ণা অনুভব করলেন। বললেন, ‘সিনথিয়া, একটু পানি।’

সিনথিয়া পানি এগিয়ে দিল। পানিটুকু পান করে তিনি আবার তাকালেন সূর্যের দিকে। বললেন, ‘সিনথিয়া ঘোড়া জোরে ছুটাও। আরেকটু দ্রুত গেলে আশা করি সূর্যান্তের পরপরই আমরা সুবাকে পৌঁছতে পারব।

ঘোড়া ছোটাল যুবতী। দ্রুত পেছনে সরে যেতে লাগর মরুভূমির বিশাল বিস্তার।

* * *

সূর্য ডুবে গেছে। দরবার কক্ষে খ্রীষ্টান সম্রাট এবং সেনাপতিগণ বসে আছেন। ডিউক মুখ খুলল, ‘মেয়ে দু’টোর কি হেয়েছে জানিনা। আমি ওদের রক্ষা করার চেষ্টা করিনি। আপনাদের কাছে মূল্যবান তথ্য পৌঁছানো জরুরী মনে করে সুযোগ পাওয়ামাত্র একটা ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ডাকাতদের আক্রমণের পর মেয়েদের দিকে একবারও তাকাইনি। তাকানোর কোন সময় ও পরিবেশ ছিলনা। আমি যে আপনাদের কাছে পৌঁছতে পারব তারও কোন আশা ছিল না। যিশুর অসমী দয়ায় ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছি। নইলে এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসার কথা আমি কল্পনাও করতে পারিনা।

কেউ আমাকে অনুসরণ করেনি। আমার মনে হয় ওরা দস্যু নয়, সুলতানের পাঠানো লোক। ভেবে পাইনা তিনি কেন আমাদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে মেয়েদেরকে নষ্ট করার এ পথ বেছে নিলেন। এখন বুঝতে পাছি, এর পুরোটাই ছিল সাজানো নাটক। মেয়েদের জন্যই এ নাটক সাজানো হয়েছিল। এদেরকে হত্যা না করে এখনো হয়ত ওদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে পশুগুলো।’

‘ডিউক, ওদের মুক্ত করার কোন ব্যবস্থা এখন আমরা নিতে পারছিনা। এ ত্যাগ আমাদের স্বীকার করতেই হবে। আমাদের কাছে তো মেয়ের অভাব নেই। যুবতীদের ব্যবহার করে আমরা যে সাফল্য লাভ করেছি সে কথা বিবেচনা করে আমরা আরও অনেক মেয়েকে ট্রনিং দিয়ে তৈরী করেছি। ওদের কথা বাদ দিয়ে এবার তোমার মূল্যবান গোপন সংবাদের কথা বল।’ বললেন এক সেনাপতি।

ডিউক সব কথা খুলে বরল। সুলতানে আক্রমণের তারিখ উল্লেখ করে বলল, ‘সালাহউদ্দীন ক্রাক আক্রমণ করবে শুনে একজন কমাণ্ডার বলেছিল, ‘আগে সুবাক দখল করা উচিৎ।’

কিন্তু সালাহউদ্দীন এখানে শক্তি ক্ষয় করতে চাইছেন না। ক্রাককে দুর্বল মনে করে আগে ক্রাক দখল করবেন। ক্রাক হবে তার কেন্দ্র। ওখান থেকেই চারদিকে আক্রমণ পরিচালনা করবেন। আমাদের অজ্ঞানে তিনি আক্রশন করতে চাইছেন। কারণ, তার সৈন্য সংখ্যা কম। অস্ত্রশস্ত্র ওদের চেয়ে আমাদের বেশী।

তিনি সকলকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘খ্রীষ্টান ফৌজ পথে বাধা দিলে পরাজয় অনিবার্য। কোন অবস্থাতেই খোলা মাঠে যুদ্ধ করবেনা। সম্মুক লড়াইয়ের পথ এড়িয়ে আমরা ক্রাকে ঝটিকা হামলা করবো। ওরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই আমাদের বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।’ ডিউক থামল।

এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে মেয়েদের প্রসংগ চাপা পড়ে গেল। আয়ুবীকে প্রতিরোধের ব্যাপারে আলাপ শুরু হল। ওরা স্বীকার করল, আয়ুবী নিঃসন্দেহে দূরদর্শী এবং যুদ্ধবাজ। ক্রাক আক্রমণের পরিকল্পনা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পথে যুদ্ধ করে শক্তিক্ষণয় করতে না চাওয়াও তার যুদ্ধ পলিসির উজ্জ্বল দিক।

‘পবিত্র যিশুর দয়ায় আমরা আগে ভাগেই তার পরিকল্পনা টের পেয়েছি। নয়তো ক্রাক দখলৈ রাখা আমাদের জন্য সমস্যা হতো।’ বলল এক সেনাপতি।

আয়ুবীর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পরিকল্পনা তৈরী হতে লাগর। সিদ্ধান্ত হল, সুবাকে থাকবে কেন্দ্রীয় কমাণ্ড। রসদও থাকবে এখানে। ক্রাকে আরও সৈন্য পাঠিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোরা হবে। ক্রাক থেকে অনেক দূরে পার্বত্য স্থানে আয়ুবীকে বাধা দেয়া হবে। অশ্বারোহী এবং উষ্ট্রারোহী সৈন্যের পরিমাণ থাকবে বেশী। পানির ঝর্ণাগুলো আগে ভাগেই দখল করে নিতে হবে। আয়ুবীর বাহিনীকে ঘেড়রাও করে শেষ করে ফেলতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হল। সবাই ভীষণ খুশী। এই প্রথম সুলতান আয়িবীর গোপন পরিকল্পনা ওর াআগেভাগে জানতে পেরেছে। তার মত একজন দূরদর্শী যোদ্ধাও যে সময়ে ভুল করতে পারে তার প্রমাণ এবারের অসতর্কতা। সুলতানের এ অসতর্কতার সুযোগে মূল্যবান গোপন তথ্য পাওয়ার আনন্দে ওরা বিভোর সবাই।

ফ্রান্সের সৈন্য ছিলঅনেক দূরে। সিদ্ধান্ত হল, ওদেরকে নুরুদ্দীন জংগীল আসার পথে পাঠিয়ে দিতে হবে।

একজন অফিসার ভেতরে এসে গোয়েন্দা প্রধানের কানে কানে কি যেন বলল। তিনি সকলকে শুনিয়ে বললেস, ‘দু’জন মেয়ের একজন ডাকাতের হাত থেকে বেঁচে এসেছে। সাথে রয়েছে একজন মুসলমান রক্ষী সেনা।’

সর্ব প্রথম ডিউক কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। কামরা থেকে বেরিয়ে ও দেখতে পেল বারান্দায় হাদিদকে শুইয়ে পাশে বসে আছে মেয়েটা। দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে হাদিদের ক্ষতস্থান থেকে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে।

খ্রীষ্টান কমাণ্ডারদের কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। তাদের বলা হয়েছিল ডাকাতের আক্রমণ ছিল এক নাটক।

একজন সেনা অফিসার এগিয়ে গেল। মেয়েটাকে বলল, ‘সিনথিয়া, ভেতরে এসো।’

সিনথিয়া বলল, ‘এর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ না বাঁধা পর্যন্ত আমি ভেতরে যাবনা।’

গোয়েন্দা প্রধান হরমুন ছিলেন একজন জার্মান। কামরা থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন তিনি। সিনথিয়ার কথা শুনে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমি ও সাপের বাচ্চার ব্যান্ডেজ করতাে চাইছ? জীবন নিয়ে ফিরে এসেছ এ-তো তোমার সৌভাগ্য। এ জানোয়ার তোমাদেরকে ডাকাতদের হাতেই তুলে দিতে চাইছিল।

‘মিথ্যে কথা।’ যুবতীর কণ্ঠে দৃঢ়তা। ‘প্রথমে আমিও তাই মনে করেছিলাম। এ যুবক আমার সব সন্দেহ দূর করে দিয়েছে। একা দু’জন দস্যুকে হত্যা করে সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে।’

যুবতী হরমুনকে সব ঘটনা খুলে বলল। ‘দেখুন! লোকটা বার বার আমাকে বলেছে, আমায় এখানেই মরতে দাও। পালিয়ে যাও তুমি।’

মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রীষ্টানদের হৃদয়ে ছিল প্রচণ্ড ঘৃষা। হাদিদের চিকিৎসার কথঅ কেউ বলল না। বলল না ডিউকও। মেয়েটা ওর চিকিৎসা ছাড়া ভেতরে যাবে না।

এক অফিসার বলল, ‘মুসলমানটাকে নিয়ে ব্যান্ডেজ করে দাও।’

হাদিদকে নিয়ে গেলে যুবতী হাঁটা দিল অফিসারের সাথে। অফিসার তাকে নিয়ে কামরায় ঢুকলেন। সম্রাট ও কয়েকজন সেনাপতি তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওরা কামরায় ঢুকলে একজন বরল, ‘বলতো মেয়ে কিভাবে বেঁচে এলে?

মেয়েটা পথের সব ঘটনা বর্ণনা করল ওদের সামনে।

‘তুমি খুব ইন্টারেষ্টিং গল্প শোনালে।’ বলল এক সেনাপতি। ‘এমন মজাদার কাহিনী শোনার পর একটু আনন্দ না করলে গুণাহ হবে।’

সম্রাট বললেন, ‘সত্যিই আজ বড় আনন্দের দিন। এসো, সবাই মিলে প্রাণ ভরে খাও এবং পান করো।’

ওদের সামনে খাবার এবং মদ পরিবেশন করা হল। মেয়েটা বলল, ‘আহত লোকটির খাওয়া হলে আমি খাব। আমি ওকে একটু দেখে আসি।’

উঠতে যাচ্ছিল সিনথিয়া, হরমুন কণ্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে বললেন, ‘দাঁড়াও নিসথিয়া। তুমি এ নিয়ে দ্বতীয়বার ফৌজি নির্দেশ অমাণ্য করলে। প্রথববার তোমাকে ভেতরে আসতে বরা হল, তুমি বললে, আহত ব্যক্তির চিকিৎসা না হলে আমি ভেতরে যাব না। এখন কারো অনুমতি ছাড়াই বাইরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছ। এখানে সম্মানিত সেনাপতিগণ ছাড়াও উপস্থিত রয়েছেন মহামান্য সম্রাট। তুমি জান তোমার এ নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি কি?’

‘দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।’

‘শত্রুর সামান্য একজন কমাণ্ডারের জন্য তুমি আমাদের নির্দেশ অমান্য করেছ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।’

‘লোকটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রু শিবিরের একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দার জীবন বাঁচিয়েছে, খ্রীষ্টান সম্রাট এবং সেনা অফিসারগণ কি তাকে এর জন্য কোন প্রতিদান দেবেন না? আমি জািন যে ও শত্রুদের সেনা কমাণ্ডার। আমি তখনই তাকে দুশমন ভাবব, যখন সে নিজ সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবে।’

‘দুশমন সব সময়ই দুশমন থাকে।’ একজন কমান্ডার চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা ফিলিস্তিনে ক’জন মুসলমানকে বাঁচতে দিয়েছি? ওদের বংশ কেন শেষ করেছি আমরা? কারণ ওরা আমাদের শত্রু, ওরা আমাদের ধর্মের শত্রু। পৃথিবীতে শধু খ্রীষ্টানদের শাসন থাকবে। আমাদের কাছে একজন আহত মুসলমানের কোন মূল্য নেই। তুমি বস।’

বসে পড়ল যুবতী। তার দু’চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা।

সুবাকের কাজকর্ম চলছে স্বাভাবিক গতিতে। সেনাবাহিনীতে চলছে অন্য তৎপরতা। কেল্লা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দলে দলে সৈন্য। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে উট। ওদের পিঠে চাপানো হচ্ছে যুদ্ধাস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী। অফীসাররা সবাই ব্যস্ত, কারো হাতে একদণ্ড সময় নেই। উর্ধতন ক’জন সামরিক অফিসার ইতিমধ্যেই ক্রাক রওয়ানা হয়ে গেছেন। সিনথিয়া নির্লিপ্ত। যেন এ তৎপরতার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।

গতকালের সেনা সম্মেলন শেষ হয়েছিল মাঝ রাতে। সিনথিয়া ছিল ক্লান্ত-শ্রান্ত। একজন অফিসার ওকে বলেছিল, ‘আহত ব্যক্তিকে ডাক্তারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দুশ্চিন্তার কারণনেই।

ফেরার পথে দেখা হল গোয়েন্দা বাহিনীল প্রধান হরমুনের সংগে। তিনি সিনথিয়াকে বললেন, ‘সিনথিয়া, তোমার আচরণ সত্যি খুব আবেগপ্রবণ। তোমার টওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হলে এ ধরণের আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না।’

‘আমাকে মাফ করবেন। হয়তো আমি সত্যি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। কিন্তু সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। এ কথঅ আমি ভুলব কেমন করে? তবে আমি আমার দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন আছি। ও নিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। এখন আপনার অনুমতি পেলে আমি ওকে একটু দেখতে চাই।’

‘সিনথিয়া, তুমি জান কোনার্ড এবং লুজিনাম কাউকে ক্ষমা করেন না। রাতের ব্যাপারে না হলে ওরা তোমাকে তখনই জেলে পাঠিয়ে দিতেন। তোমার রক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোমার জন্য নির্দেশ হল, তার সাথে দেখা করতে পারবে না।’

‘কেন?’ সিনথিয়ার হতবাক কণ্ঠ। ‘আমি কি তাকে কৃতজ্ঞতাও জানাতে পারব না!’

‘না, পাবরে না। কারণ সে শত্রু বাহিনীর তোমার দায়িত্বের কথঅ তুমি জান। আমি তার সাথে দেখা করার অনুমতি তোমাকে দিতে পারি না। তোমার কাছে সংস্থার দাবীও তাই। আমি দেখতে পাচ্ছী তার ব্যাপারে তুমি মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছ। তোমাকে আমি এতটা আবেগপ্রবণ হওয়ারও অনুমতি দিতে পারি না।’

‘আমায় শুধু বলুন তার চিকিৎকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিৎকার পর তাকে নিরাপদে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’

‘সিনথিয়া!’ হরমুনের কণ্ঠে ক্রোধ। ‘তোমার সে ইচ্ছে পূরণ করা হবে। তুমি এক বিপজ্জনক অভিযান থেকে এসেছ। এখন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। তোমাকে এক মাস ছুটি দেয়া হল। এখন গিয়ে আরাম কর।’

কনফারেন্স শেষে হরমুনের সংগে এসব কথা হওয়ার পর রাতে নিজের কামরায় ফিরে গেল সিনথিয়া। গোয়েন্দা মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা ছিল সেনা হেডকোয়ার্টার থেকে অনেক দূরে। এদের অভিযান ছিল বিপজ্জনক, দায়িত্ব পালন কালে ধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত। তাই এদর জন্য সব রকম বিলাস উপকরণের ব্যবস্থা চিল। বলতে গেলে ওরা থাকত রাজকুমারীর মত!

রুমে গিয়েই শুয়ে পড়ল সিনথিয়া। ক্লান্ত দেহটা বিছানায় ঠেকাতেই ঘুমিয়েও পড়ল। ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে।

বিছানা ছাড়তে মন চাইছিল না তার। তবুও উঠে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ল। বেরোতেই দেখা হয়ে গেল লুজিনার সাথে। লুজিনা ওর পাশের কামরায় থাকে। ও কায়রোর অভিযানের কথা শুনতে চাইর।

‘লুজি, আমাকে এখনই একটু বাইরে যেতে হচ্ছে। ঘুরে আসি, তারপর সব বলল তোকে।’

একটু এগুতেই সিনথিয়া ওর এক বান্ধবীর সামনে পড়ল। সেও থাকে পামের কক্ষেই। দূল থেকে ওকে দেখেই নেমসি চিৎকার করে ডাকল, ‘হ্যালো সিন!’

সিনথিয়া হেসে বলল, ‘হাই।’

নেমসি এগিয়ে এল ওর কাছে। বলল, ‘আরে সিনথিয়া! কখন ফিরলি? যাচ্ছিস কোথায়? তোকে কেমন উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। একি ক্লান্তি না অন্য কিছু! ছুটি পাসনি?’

হেসে ফেলল সিনথিয়া। ‘এক মাস ছুটি পেয়েছি। তবে. . ‘তার চেহারায় আবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল।

‘তবে কি?’ উদ্বেের স্বরে জানতে চাইল সে।’

‘একটা বিশেষ কারণে আমি আসলেই চিন্তিত।’

‘কি ব্যাপার! কী ঘটেছে বলতো শুনি।’

সব কথা ওকে খুলে বলল সিনথিয়অ। অফিসাররা যে শাসিয়েছে তাও বলল। সবশেষে বলল, ‘আমি হাদিদের সাথে দেখা করতে চাই। মনে হয় ওরা তার চিকিৎসা করেনি?।? না হয় শহর থেকে বের করে দিয়েছে। এমনও হতে পারে, মারার জন্য কোন কক্ষে বন্দী করে রেখেছে।’

‘তোকে না তার সাথে দেখা করতে নিষেধ করা হয়েছে? ধরা পড়লে কি শাস্তি দেবে তা জানিস?’

‘ওর জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত। তোকে তো বলছি, আমার জন্যই ও নিজের জীবন বিপন্ন করেছে। আমার তো জীবনের কোন ভয় ছিল না। ডাকাতরা ক’দিন ব্যবহার করে কোন আমীরের কাছে হয়তো বিক্রি করে দিত। এ কথা হাদিদও জানত। আমার ইজ্জতের জন্যই নিজেকে বিপদে ফেলেছিল সে। দস্যুরা বলেছিল,

‘মেয়েটাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে তুমি চলে যাও। আমরা তোমাকে কিছুই বলবনা।’ আমি যে খারাপ মেয়ে তাও ওর জানা ছিল। কিন্তু তবু আমার ইজ্জত রক্ষা করাকে ওর আমানত মনে করেই ও নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাকে রক্ষা করেছে।’

‘মনে হয় ওকে তুই ভালবেসে ফেলেছিস?

‘হ্যাঁ, কথাটা তুই মিথ্যে বলিসনি। হরমুনের সামনে আমার এ আবেগ প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু আমার  মনে সব কথাই তো তোকে বলতে পারি। তুই আমার বান্ধবী। নারী হৃদয়ের আবেগ তুই বুঝিস। আমাদের জীবনটা কি? চোখ ধাঁধাঁনো তরবারী, মিষ্টি বিষ। পুরুষদের ধোকা দেয়াই আমাদের পেশা। আমরা ট্রেনিং নিয়েছী প্রতারণার ফাঁদ পাতার।

কিন্তু একথা আগে কখনও ভাবিনি, আমরাও মানুষ। আমাদের যে হৃদয় আছে ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর সংস্পর্শে এসে আমি যেন নতুন জীবন পেয়েছি। ওকে দেখে আমার আবেগের দারিয়ায় ঝড় উঠল। ওর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভাবাসায় গলে গেল আমার ও ছোট্ট হৃদয়। এ প্রথমবার মনে হল আমি কারও মেয়ে। আবার আমি কারো মা- ও হতে পারি।

এতদিন আমি নিজেকে রাজকুমারী মনে করতাম। ওর পরশ পেয়ে আমি মানুষের মধ্যে ফিরে এসেছি।

আমাদের গোয়েন্দাবৃত্তির ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। সম্রাটগণ আমাদের চোখের ইশারায় উঠাবসা করে। কিন্তু এতে খুশী হওয়ার কিছু দেখিনা আমি। এরাতো আমাদেরকে পণ্যে পরিণত করেছে।

আমি অন্ধগলির মেয়ে না হলেও যেসব মেয়েরা প্রতিরাতে নতুন নতুন খদ্দের খোঁজে আমি তো তাদেরই মত একজন।

হাদিদ আমাকে এ পর্যায় থেকে অনেক উপরে তুলে দিয়েছে। আমি ছিলাম ওর বন্দিনী। ইচ্ছে করলে ও আমাকে সহজেই ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু ও আমাদের এড়িয়ৈ গেছে। আমার ইজ্জত রক্ষার জন্য ও যখন আহত হল আমি নিজকে ধরে রাখতে পারিনি। ওকে জায়গা করে দিয়েছি বুকের মধ্যে। আমি হয়ে গেছি এক সাধারণ মেয়ে। যার হৃদয় আছে, আবেগ ও উচ্ছাস আছে।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কোন সম্মানিত লোককে বিয়ে করছ না কেন?’ তখন মনে হয়েছিল ও মুসলমান সম্রাট কত গবেট। এখন অনুভব করছি, আমাদের শত্রু কত মূল্যবান কথা বলেছেন।

আমি আর গোয়েন্দার কাজ করতে পারব না। শৈশব থেকে দেয়া আমার সব ট্রনিং হারিয়ে গেছে মরুভূমির ভয়ংকর রাতের আঁধারে। ডাকাতদের ভয়, ওর শরীরের উষ্ণতা আর রক্ষৈর গন্ধ আমার এতদিনের সব শিক্ষা মুছে দিয়েছে।’

‘এত কথা না বললেও তোর মনের অবস্থঅ আমি বুঝতে পারছি। তবু চরম বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যায় না। ওকে চলে যেতে হবে। আর ও এখানে কোন কষ্টের মধ্যে থাকলেও তোর করার কিছুই নেই। তার সাথে দেখা না করার জন্য তোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশ অমান্য করার পরিণাম কত ভয়াবহ তা কি তোর অজানা?’

‘ধরা পড়লে এক সংগে দু’জনই মরব, তবু তার সংগে আমার দেখা করতেই হবে। আমাকে ভুল বুভিস না বোন, তুই আমাকে একটু সাহায্য কর।’

মিনতি ঝরে পড়ল সিনথিয়ার কণ্ঠ থেকে।

‘বুঝেছি সিন তুই মরেছিস। কিন্তু তবু বলল, এমন কিছু করিস না, যাতে দু’জনকেই বিপদে পড়তে হয়। যা-ই করিস ভেবেচিন্তে করিস। আমার মনে হয়না এ অবস্থায় তার সাথে তোর দেখা করা ঠিক হবে।’

‘কিন্তু ওর কোন খোঁজ না নিয়ে চুপচাপ আমাকে বসে থাকতে বলিস?’

‘আচ্ছা, আমি খোঁজ নিচ্ছি।’

‘প্লিজ, খোঁজ নিয়ে দেখ ও কোথায় আছে। সুস্থ হয়ে ও ফিরে গেছে শুনলেও আমি স্বস্তি পাব।’

‘ঠিক আছে। তুই রুমে ফিরে যা, আমি ওর খোঁজ নিচ্ছি।’

উঠে দাঁড়াল দু’জন। পরস্পর বিদায় নিয়ে দু’দিকে হাঁটা দিল। হাসপাতালে না গিয়ে সিনথিয়া ফিরে এল তার রুমে।

* * *

কায়রোর সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ছাউনীর বাইরে সৈন্যদের ট্রনিং চলছিল। তৈরী করা হচ্ছিল কমান্ডো বাহিনী। শেখানো হচ্ছিল গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম  কানুন।

সুলতান নিজে সব দেখাশোনা করছেন। তিন চার দিন পর অফিসারদের দরবার বসেছে। যুদ্ধৈর মানচিত্র নিয়ে যুদ্ধ পলিসি ব্যাখ্যা করছেন আয়ুবী।

তিনি বললেন, ‘যুদ্ধের মূলনীতি হবে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমণ করা। অস্ত্রের চাইতে বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে বেশী। সামনাসামনি আক্রমণ করবে না। একশ জন সৈন্য দু’তিনটে যুদ্ধে যে সাফল্য লাভ করতে পারে দশবারো জনের একটা কমান্ডো বাহিনী ঠিকমত আঘাত করতে পারলে সফলতা লাভ রকতে পারে তারচে’ বেশী।’

দুর্গ অবরোধ এবং প্রাচীর ভাংগার পদ্ধতি শিখান হলো সৈনিকদের। দুর্বল, উট, ঘোড়া এবং খচ্চরগুলো বাছাই করে সরিয়ে রাখা হল।

ফিলিস্তিন পুনর্দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আয়ুবী। অন্যদিকে আয়ুবীকে পথে বাধা দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিল খ্রীষ্টান বাহিনী। প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছিল দু’দলই পরস্পরকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

খ্রীষ্টান বাহিনী তাদের সৈন্য ছড়িয়ে দিয়েছিল সুবাক থেকে মিসর সীমানা পর্যন্ত। বাহ্যত মনে হচ্ছিল সুলতান আয়ুবীর বেঁচে আসার সকল পথ রুদ্ধ। আগে ভাগে সুলতানের পরিকল্পনা জানার কারণেই এভাবে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়েছে।

সেনা প্রস্তুতির বাইরে সুবাকে চলছিল অন্য এক তৎপরতা। হাদিদের সংবাদের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিল সিনথিয়অ। নিজের কক্ষে ছটফট করছিল ও। নেমসি মেয়েটা দু’দিন থৈকে হাদিদকে খুঁজছে। হাদিদ অফিসারদের হাসপাতালে নেই। সাধারণ সৈন্যদের হাসফাতালেও পাওয়া যায়নি তাকে।

গোয়েন্দা হওয়ায় সেনা অফিসাররা ওদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখত। মেয়েটা হাদিদের কথা অনেককে জিজ্ঞেস করেছে। কেউ কিছু বলতে পারেনি।

তৃতীয় দিন একজন অফিসার ওকে গেপনে বলল, ‘ব্যান্ডেজ করে তাকে মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’

নেমসি ছুটে এল সিনথিয়ার কাছে। সংবাদ শুনে সিনথিয়া থ’ মেরে বসে রইল। কোছ মুখে ফুটে উঠল আতংক।

মুসলমানদের বেগার ক্যাম্প এক ভয়ংকর স্থান। যুদ্ধবন্দী ছাড়াও বিজিত এলাকার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে এখানে জড়ো করা হয়েছিল। মুসলমানেদর কাফেলর লুট করে ওদেরকেও এখানে এনে রাখা হত।

কারাগার নয় বলে ক্যাম্পে পাহারার কড়াকড়ি ছিল না। এখানে রাখা বন্দীদের কোন তালিকা করা হতো না।

এদের সাথে আচরণ করা হত পশুর মত। কোথাও সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হলে এদেরকে পশুর মতই তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত। খাবার দেয়া হত বেঁচে থাকার মত। রাখা হত তাবুতে। সাধারণ রোগে চিকিৎসা করা হত। বেশী অসুস্থ হলে মেরে ফেলত বিষ খাইয়ে।

এখানে বন্দী হওয়ার জন্য কোন অপরাধ করার দরকার হতো না। ও মুসলমান এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে!

হাদিদকে এ ক্যাম্পেই পাঠানো হয়েছিল। হরমুন বুঝেছিলেন সিনথিয়া তার জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। এজন্য হাদিদের সাথে সিনথিয়ার দেখা সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন্

সিনথিয়া মনে প্রাণে এ নির্দেশে গ্রহণ করতে পারেনি। যখন ও শুনল হাদিদ বেগার ক্যাম্পে, বান্ধবীকে বলল, ‘আমি ওকে মুক্ত করব।’

ওকে সহযোগিতা করতে রাজি হল মেয়েটা।

সিনথিয়া শহরের এক প্রাইভেট ডাক্তারের সাথে দেখা করল। বলল, ‘একজন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা করতে হবে। শর্ত হচছে এ কথা কাউকে বলা যাবে না।’

‘কেন?’

‘কারণ লোকটি একজন গরীব মুসলমান। ও আমার বংশের অনেক উপকার করেছে। কোথাও ঝগড়াঝাটি করে আহত হয়েছে চিকিৎসা করার মত সামর্থ নেই। ডাক্তারদের সবাই খ্রীষ্টান। বিনে পয়সায় কেউ ওর চিকিৎসা করতে চাইছে না।

ব্যাপারটা গোপন করার দ্বিতীয় কারণ হল, প্রশাসন যদি জানতে পারে মুসলমানরা ঝগড়াঝাটি করেছে তবে ওদের বেগার ক্যাম্পে পাঠায়ে দেবে। ওদের বন্দী করার জন্যত একটা বাহানামাত্র প্রয়োজন্

সে আমার পরিবারের যে উপকার করেছে আমি তার প্রতিদান দিতে চাইছি। আমি তাকে নিয়ে আসব রাতে। বলুন আপনাকে কত দিতে হবে? গোপনীয়তা রক্ষার মূল্য আমি দেব।’

ডাক্তার সিনথিয়ার মাথঅ থেকে পা পর্যন্ত দেখর। চোখে জ্বলজ্বলে কামনা।

সিনথিয়া এক ভদ্রঘরের মেয়ে হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। ডাক্তার ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। রূপসী তরুনীর কাছে বিনিময় চাওয়া রভাষা হারিয়ে ফেলল ডাক্তার।

ডাক্তারের চোখের ভাষা বুঝে ফেলল সিনথিয়া। নিজের প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাল। গলে গেল ডাক্তাল।

সিনথিয়া তার হাতে চারটি স্বর্ণ মুদ্রা ধরিয়ে দিল। ডাক্তার সিনথিয়ার হাত ধরে বলল, ‘তোমাপর চাইতে দামী মূদ্রা আর কিছুই হতে পারেনা।’

মৃদু হাসল সিনথিয়া। ‘আপনি যা চাইবেন দেব, আগে আমার কাজ করুন।’

ডাক্তার বুঝল ব্যাপার বিপদজনক। কিন্তু সিনথিয়াকে দেখে যে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি হল সে। বলল, ‘আজ রাত বা কাল রাত যখনই ইচ্ছা নিয়ে এস। এ দু’দিন আমি কোন বাইরের কলে এটেন্ড করবো না। আমি ঘুমিয়ে থাকলে জাগিয়ে দিও।’

ডাক্তার এক হাতে স্বর্ণ মুদ্রা এবং অন্য হাতে সিনথিয়ার হাত ধরে ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

হাদিদকে ক্যাম্প থেকে বের করাটাই ছিল বড় সমস্যা। ক্যাম্পে পাহারার কড়াকড়ি নেই ঠিক, কিন্তু সিনথিয়াকে সেখানে দেখলে বিপর্যৈল সম্ভাবনা ষোল আনা।

ওকানে যারা থাকে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ওদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। ক্যাম্পে আনা হয় সূর্যাস্তের পর।

একজন প্রহরী প্রতিদিন পাশের ডাক্তারখানায় নিয়ে যেত আহত বা অসুস্থ বন্দীদের।

পরদিন নেমসিকে নিয়ে ক্যাম্পের কাছে গেল সিনথিয়া। পচিশ ত্রিশজন রোগীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডাক্তারের কাছে। প্রহরীর হাতে লাঠি। দ্রুত চলার জন্য সে রোগীদের পিটাচ্ছিল।

মেয়ে দু’জন চলে এল রোগীদের কাছে। ভাব দেখাচ্ছে যেন এ দৃশ্য উপভেগ করছে ওরা। সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  দেখছে।

হঠাৎ করেই চমকে উঠল সিনথিয়া। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাদিদ। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার। চেহারায় আগের সেই জৌলুস নেই। ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে। কাপড়ে চটচটে রক্তের দাগ।

কান্না পেল সিনথিয়ার। অশ্রু এসে জমা হতে লাগল দু’চোখ ভরে।

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল হাদিদ। সামনে চলে গেল রোগীর দল। নেমসি প্রহরীর সাথে কথা জুড়ে দিল। কথার মাঝে প্রকাশ পাচ্ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা।

ওদের বাকচাতুর্যে পটে গেল প্রহরী। দুই যুবতীল কান্ডকারখানা দেখছিল প্রহরী, সিনথায়া হঠাৎ করেই বলল, ‘এই, ওদের সাথে আমাদের একটু মজা করতে দেবে?’

নেমসি বলল, ‘ও মাই গড, কি বিচ্ছিরি! তুই যা, আমি ওদের কাছে যাবো না।’

সিনথিয়া এগিয়ে গেল রোগীদের পাশে। প্রহরী কোন আপত্তি করল না। নেসমি প্রহরীল সাথে গল্পে মেতে উঠল।

ডিসপেনসারিতে রোগীর প্রচণ্ড ভীড়। বন্দীদেরকে বাইরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। নেমসি তখনো প্রহরীল সাথে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। বন্দীদের নিয়ে তামাছা করছে সিনথিয়া।

দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে হাদিদ। ফ্যকাশে চেহারা। সিনথিয়া তাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকল। নিয়ে গেল আড়ালে। বলল, ‘কর্তৃপক্ষ তোমার সাথে দেখা করতে আমাকে নিষেধ করেছেন। বসো, আমরা যে কথা বলছি কেউ যেন বুঝতে না পারে।’

‘তোমার কর্তৃপক্ষ আর তোমার ওপর গজব পড়ুক।’ ক্ষোভের সাথে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল হাদিদ। ‘কোন প্রতিদানের আশায় তোমাকে দস্যুদের কবল থেকে রক্ষা করনিি। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। কর্তব্যপরায়ণ সব লোকদের সাথেই কি তোমরা এমন ব্যবহার কর?’

‘চুপ কর হাদিদ।’ সিনথিয়ার কান্না ভেজা কণ্ঠ, ‘এসব কথা পরে হবে। রাতে তুমি কোথায় থাক? আজই তোমাকে এ নরক থেকে বের করতে হবে।’

হাদিদ ওর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল না। সিনথিয়ার চোখে বেদনার সুনীল টলমলে জল দেখে বুঝল, ও আসলেই প্রতারণা করছে না।

হাদিদ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করল ওকে। রাতে কোথায় থাকে বলল, বলল, ‘এখান থেকে পালানো কোন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু যাব কোথায়?

এর পর পালানোর একটা পরিকল্পনা তৈরী করল ওরা, যা এ দু’জন ছাড়া আর কেউ টেরও পেল না।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top