৭. দূর্গ পতন


দুঃখিত হুজুর, আমাদের তো এসব কিছুই চাই না’, বললেন ইমাম সাহেব।
‘তাহলে আমাকে কি জন্য ধরে এনেছো? এসব পাগলামীর মানে কি? আমার ভক্তবৃন্দ টের পেলে তোমাদের কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো? যদি বাঁচতে চাও তবে জানাজানি হওয়ার আগেই আমাকে যেতে দাও।”
দুঃখিত, তাও তো পারছি না। আপনাকে এখন মুক্তি দেয়া সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে! এবারও জবাব দিলেন ইমাম সাহেব ।
তাহলে তোমরা কি চাও? কেন আমাকে ধরে এনেছো?
‘আমরা অনেকদিন ধরেই আপনার মত লোকদের খুঁজছিলাম। হাতের কাছে পেয়ে গেলাম, তাই ধরে আনলাম।
কিন্তু কেন খুঁজছিলে? আমি কি ক্ষতি করেছি তোমাদের? আপনি আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করেছেন। এত বড় ক্ষতি, যা কোনদিন পূরণ হবার নয়।’
কি সব হেয়ালী করছো! আমি এ সবের কিছুই বুঝতে পারছি না! বরার্টের চেহারায় চিন্তার ভাঁজ পড়ল ।
সবই বুঝবেন, একটু অপেক্ষা করুন।’
ইমাম সাহেব মাহমুদকে বললেন, মাহমুদ, উনার সাথে খোশগল্প করার সময় নেই আমার হাতে। তুমি জলদি যাও, সেনা ফাড়ি থেকে সমস্ত সৈন্য নিয়ে দ্রুত চলে আসবে।” |
তিনি ফাড়ির দূরত্ব, দিক এবং সংকেত বলে দিলেন। আর অন্য দু’জন গোয়েন্দার নাম ও ঠিকানা দিয়ে বললেন, ‘এদেরকে এখুনি আমার কাছে পাঠিয়ে দিও।’
এতক্ষণে রবার্টের টনক নড়লো। এরা কারা এবং কেন তাকে ধরে এনেছে বুঝতে আর কিছুই বাকী রইল না তার। তার সব জারিজুরি যে ফাঁস হয়ে গেছে এবং জীবনের অন্তিম লড়াই তার সামনে উপস্থিত। একথা মনে হতেই সে শিউড়ে উঠল।
মাহমুদ ইমাম সাহেবের ঘোড়ায় জুিন এঁটে লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়ল, বেরিয়ে গেল মসজিদের চত্বর থেকে। ইমাম সাহেবের সঙ্গী গোয়েন্দা দু’জনকে খুঁজে পেতে বেশীক্ষণ লাগল। না। তাদেরকে মসজিদে যেতে বলে সে ফাড়ির উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটালো ।
তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফাঁড়িতে পৌছে গেল সে। কিন্তু ওখানে পৌঁছেই তার মনে নতুন একটা সন্দেহ খচখচ করতে থাকল। একটু ইতস্ততের মধ্যে পড়ে গেল সে। ফাড়ির কমাণ্ডারকে সে ভাল করেই চিনতো। কমাণ্ডার যথেষ্ট নির্ভীক ছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে সে প্রচণ্ড রকম লোভীও ছিল ।
সে শুনেছিল, সীমান্তের এ সব কমাণ্ডাররা খৃষ্টান ও সুদানীদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে তাদের পক্ষে কাজ করে। কায়রো থেকেই তারা এ রিপোর্ট পেয়েছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত আশংকা জাগল, যদি সে বাহিনী না পাঠায়? কিংবা সময় নষ্ট করে শক্রদের জন্য সুযোগ করে দেয়? মাহমুদের আরও চিন্তা হল, যদি ফাড়ি থেকে সাহায্য না পাই, তখন কি করবো?
সকাল হওয়ার আগেই সেনা বাহিনী গ্রামে পৌছা দরকার। সেনা সাহায্য না পেলে ইমাম সাহেব ও সহকারী গোয়েন্দা দুজনের বিপদ অনিবার্য। কারণ ছদ্মবেশী পীরের বহু মুরীদ রয়েছে সেখানে। তারা পীরের জন্য জান কবুল করতে দ্বিধা করবে না।
ইমাম খঞ্জর হাতে রবার্টকে পাহারা দিচ্ছিল । সাদিয়া একটা চেয়ারের ওপর বসেছিল চুপচাপ। এ সময় দরজায় নক হলো। সাদিয়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। কামরায় প্রবেশ করল গোয়েন্দা দু’জন। তারা উভয়েই সশস্ত্র।
কামরায় ঢুকেই তারা দেখতে পেল ইমাম সাহেব একজন লোককে বন্দী করে তাকে পাহারা দিচ্ছে। তারা ইমাম সাহেবের কাছে এগিয়ে গেল এবং বলল, ‘কে এই বন্দী?
ইমাম সাহেব তাদের কাছে সবকিছু খুলে বললেন। রবার্ট মুক্তির উপায় খুঁজছিল। সে আবারো মুক্তিপণের কথা তুলল। সে এতবেশি মুক্তিপণ-আদায়ের আশ্বাস দিল, যা গোয়েন্দারা কল্পনাও করেনি। ”
ইমাম সাহেব বললেন আমরা আল্লাহর ঘর মসজিদে বসে আছি। এ ঘরের কসম, পৃথিবীর সব সম্পদ দিলেও আমি তোমাকে মুক্ত করার কথা চিন্তা করবো না। আমি আমার দেশ, জাতি ও ধর্মের সাথে বেঈমানী করতে পারবো না।
সালাহউদ্দিন আমাদের মনে দেশপ্রেমের যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, সে আগুন সব লোভ পুড়ে ছারখার করে দেয়। কোন মুসলমান হুশ থাকা পর্যন্ত তার ঈমান বিক্রি করতে রাজি হয় না। অতএব প্রলোভন দেখিয়ে তুমি আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না।’
গভীর রাত। মাহমুদ বিন আহমদ সেনা ফাড়িতে প্রবেশ করলো। তখনও কমাণ্ডারের কামরায় আলো দেখে অবাক হলো সে ।
ঘোড়ার পায়ের শব্দ , শুনে কমাণ্ডার বাইরে এলেন । মাহমুদ তার পরিচয় দিল এবং কমাণ্ডারের সাথে ভেতরে প্রবেশ করলো। মাহমুদ দেখলো, এ কমাণ্ডার নতুন এবং তার অচেনা।
মাহমুদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, ‘গতকাল সন্ধ্যায় পুরাতন ব্যাচকে এখান থেকে বদলি করা হয়েছে। দায়িত্বে নিয়োগ করেছেন। তিনি পুরাতন সমস্ত প্রহরীকে সীমান্ত থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুন সৈন্য মোতায়েন করেছেন। এই সব সৈন্যরা ক্রাকের রণাঙ্গণ থেকে কায়রো এসেছিল এবং সেখান থেকে সুলতানের নির্দেশে সীমান্তের বিভিন্ন ফাঁড়িতে এসে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে।
মাহমুদ দ্রুত সব ঘটনা কমাণ্ডারকে খুলে বলল । কমাণ্ডার বললেন, তোমরা খুব বড় ধরনের শিকার ধরেছো।’
হ্যা। কিন্তু পুরো দলকে ধরতে হলে ফাড়ির সমস্ত সৈন্য অবিলম্বে সেখানে পাঠাতে হবে । দলনেতা গ্রেফতার হয়েছে জানতে পারলে ওরা মুহুর্তে পালিয়ে যাবে। এ জন্য ভোর হওয়ার আগেই সবকটা তাবুতে হানা দিতে হবে এবং তাদের গ্রেফতার করতে হবে ।”
কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গে সব সৈনিকদের জাগিয়ে জলদি তৈরী হতে নির্দেশ দিলেন ; নিজেও চটজলদি পোশাক পাল্টে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। জনাপঞ্চাশেক সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন অভিযানে।
এসব সৈনিকরা সবাই তলোয়ার চালনা, বর্শা নিক্ষেপ ও তীরন্দাজীতে পারদশী। প্রয়োজনীয় অস্ত্রপাতি নিয়ে ওরা রওনা হয়ে গেল, ফাড়িতে মাত্র আট-দশজন সৈন্য পাহারায় রইল।
রাতের অন্ধকার চিরে কমাণ্ডারের নেতৃত্বে প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে চললো পঞ্চাশজন সৈন্যের ক্ষুদ্র বাহিনী। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাহমুদ। দুশমন যাতে টের না পায় সেজন্যে গ্রামের কাছাকাছি গিয়ে তারা ঘোড়ার গতি কমিয়ে আনল।
তথাকথিত পীরের খাদেম ও ভক্তরা তখন ঘুমে বেহুশ । রাতের শানদার জলসার পর চলেছে শরাবের আসর। মদে মাতাল হয়ে ওরা যখন ঘুমিয়েছে তখন অনেক রাত । তাবুর ভেতর অচেতন হয়ে ঘুমিয়েছিল ওরা।
কমাণ্ডারের নির্দেশে সেনাবাহিনী ওদের তাবুগুলো এবং আশপাশের পুরো এলাকা ঘিরে ফেলল। কমাণ্ডারের কাছে ছুটি চাইল মাহমুদ, ইমাম সাহেবকে খবর দিতে হয়।
হ্যাঁ, তুমি জলদি উনাকে খবর দাও। ইমাম সহেবকে অবরোধের খবর দেয়ার জন্য ছুটল মাহমুদ। এখনো ফজরের আযান হয়নি। রাতভর ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের কোন লেশ দেখা গেল না তার চেহারায় । ইমাম সাহেবের হুজরাখানায় পৌছে মাহমুদ দেখল তখনও সাদিয় ওখানেই আছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু দুই চোখ, চেহারায় ক্লান্তির বিমর্ষ ছাপ |
মাহমুদকে দেখেই তার ঘুম ছুটে গেল। সারা রাতের ক্লান্তি ঝেড়ে সতেজ কণ্ঠে বলে উঠল, “তুমি ঠিক আছো মাহমুদ! কোন অসুবিধা হয়নি তো তোমার?’
মাহমুদ মৃদু হাসল। বলল, আল্লাহ মেহেরবান। সেনাবাহিনী এই পাপিষ্ঠের সঙ্গী সাথীদের এখনি পাকড়াও করতে যাচ্ছে । ইতিমধ্যেই তারা সবকটা তাবু ঘিরে ফেলেছে। আমি অভিযানের শেষ পর্যন্ত না থেকে তোমাদের খবর দিতে ছুটে এসেছি।
তোমাকে তোমার কষ্টের জাযা দিন । ভোর হয়ে এল প্রায়, এবার সাদিয়ার বাবাকে একটু ডেকে আনতে হয় যে!
জ্বী, আমি এখুনি যাচ্ছি।’ মাহমুদ কালবিলম্ব না করে সাদিয়ার বাবার উদ্দেশ্যে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল ।
ভণ্ড পীরের মুরীদান ও দূর দূরান্ত থেকে আগত দর্শকরা তার মোজেজা ও কেরামত দেখে মুগ্ধ, বিস্মিত, অভিভুত । পীর সাহেব বিদায় নেয়ার পর দীর্ঘক্ষণ তারা জিকির করে সময় কাটাল। তারপর এক সময় মুক্ত আকাশের নিচেই শুয় ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।

আগামীকাল রাতে পীর সাহেব তাদের আশা-আকাংখা পূরণ করবেন এ ঘোষণা শোনার পর তারা আর বাড়ি ফিরতে চাইল না। শেষ রাতে ফজরের আযানের সময় হতেই ঘুম থেকে জেগে উঠলো ওরা। ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর মন শান্ত, সমাহিত। শুয়ে শুয়েই চোখ মেলে তাকাল কেউ কেউ কেউ বা উঠে বসে চোখ রগড়ে আবার তাকাল। আবছা আলোর মাঝে তারা দেখতে পেল অসংখ্য ঘোড়ার আদল দেখা যাচ্ছে চারপাশে । আর সেই সব ঘোড়ার আরোহীরা সবাই সৈনিকের মত টান টান হয়ে বসে আছে ঘোড়ার ওপর।
লোকজন ভাবল, এটাও হয়তো পীর সাহেবের নতুন কোন কেরামতি । এ অবস্থায় তারা কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তারা ভাবল, হয়তো এখুনি তাদের করণীয় সম্পর্কে কোন ঘোষণা প্রচার করা হবে। এ অপেক্ষায় সবাই বসে রইল, কেউ জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াল না। কারো কারো প্রাতঃক্রিয়ার প্রয়োজন দেখা দিল, কিন্তু তবু জায়গা থেকে উঠার সাহস হলো না কারো।
লোকজন একে অন্যকে খোঁচা মেরে ফিসফিস করে। জানতে চাইল, ‘এসব কি?’
পাশের জন ভয়ার্ত কণ্ঠে ফিসফিস করেই জবাব দিল, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! আমাদের কেউ কি কাল রাতে কোন বেয়াদবী করেছিল?’
কই, পীর সাহেব যখন বিদায় নিলেন তখন তো তাকে অসন্তুষ্ট মনে হয়নি!
কারো কারো বাইরে যাওয়ার বেগ বেশ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেদিকেই তাকায় বিকটদর্শন ঘোড় সওয়ারদের মুখগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে । ডান, বাম, সামনে, পৈছনে সবদিকে একই অবস্থা। কিছুই বুঝতে না পেরে লোকজন একে অন্যের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে লাগল।
কিন্তু তখনো কেউ জানল না বা এ কথা চিন্তাও করলো না, যে কামেল পীর মৃতকে জীবিত করে দেখিয়েছে তাদের, বুকে খঞ্জর ও তীর মেরেও যাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করা যায়নি, তিনি এখন হাত পা বাঁধা অবস্থায় মসজিদের এক হুজরাখনায় পড়ে আছেন। খোদার সাথে খাস সম্পর্কের দাবীদার ভণ্ড, প্রতারক পীর এখন খোদার সৈনিকদের হাতে বন্দী |
দামেশকের একজন সচ্ছল পরিবারের সন্তান কমান্ডার রুশদ বিন মুসলিম। জেহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল। তার সাহস, প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেম যে কোন মুজাহিদের প্রেরণার উৎস হতে পারে। নিবেদিতপ্রাণ এ আল্লাহর সৈনিক অল্পদিনেই সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সুনজরে পড়ে যায়। তিনি খুব ভেবেচিন্তে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব এই সাহসী ও বিচক্ষণ যুবকের ওপর অর্পণ করলেন ।
মুসলিম সমস্ত সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব নির্ভর করে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সঠিক ও বলিষ্ঠ ভূমিকার ওপর। সারা দেশের মানুষ তোমাদের ওপর আস্থা রেখে নিশ্চিন্তে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকবে । তোমার সামান্য অসতর্কতা ও ঠিলেমি তাদের সব স্বপ্ন ও আশা আকাংখা ধুলুিম্মাৎ করে দিতে পারে। ফলে দায়িত্বের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থাকবে। সব সময় চোখ কান খোলা রাখবে।
মনে রাখবে, তোমার সাফল্য নির্ভর করবে বিচক্ষণতা, সাহস ও ক্ষিপ্রতার ওপর। আরো মনে রাখবে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সবসময় তোমাদের সঙ্গে আছে। তার চর্ম চোখ সব সময় তোমাকে দেখতে না পেলেও তার অন্তর চোখ সর্বদা তোমাকে পাহারা দেবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মনে মনে ভাববে, আমিই সুলতান আইয়ুবী ।
কমাণ্ডারের চেতনায় সুলতানের এ বানী সারাক্ষণ জুলজুল করে জুলতো। তিনি তার সৈন্যদের বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ঈমান বিক্রি করার দুঃসাহস ও বোকামী করো তবে তার পরিণতি ভোগ করার কথা, মনে রেখেই করবে। কোন গাদারের জন্য আমার দীলে বিন্দুমাত্র রহম নেই। আমি তাকে হাত পা বেঁধে মরুভূমির মাঝে জীবন্ত পুতে রাখবো। কোন বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি নির্ধারণের জন্য আমি কায়রোর আদেশের অপেক্ষা করবো না। আল্লাহর আইনই আমার জন্য যথেষ্ট ।
একটু পরই সকাল হলো। আবছা আঁধার কেটে স্পষ্ট হলো সবকিছু। রুশদ বিন মুসলিমের দৃষ্টি তাবুর দিকে। বাসিন্দারা এত সকালে জাগার লোক নয়, বরং ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস তাদের ঘুমকে আরো গাঢ় ও মধুর করে তুলেছে।
রুশদ বিন মুসলিম জনসাধারণকে এক দিকে সরিয়ে নিলেন। কেউ যেন পালাতে না পারে এ জন্য কয়েকজনকে লাগিয়ে দিলেন পাহারায়। বললেন, ‘এদের প্রাতঃক্রিয়া ও নামাজের সুযোগ দেবে, কিন্তু খেয়াল রাখবে, কেউ যেন পালিয়ে যেতে না পারে।’
রুশদ বিন মুসলিমের বিচক্ষণতা বলছিল, যদি এই সরল লোকগুলোর সামনে ভণ্ডপীরের মুখোশ উন্মোচন করা না হয়, তবে চিরকালই এই লোকগুলো বিভ্রান্তির মাঝে ডুবে থাকবে । সত্য ওদের কাছে থাকবে মিথ্যা হয়ে আর মিথ্যা বেঁচে থাকবে সত্যের মত। যতক্ষণ এই মুখোশ উন্মোচনের কাজ শেষ না হবে ততক্ষণ কাউকে এখান থেকে যেতে দেয়া যাবে না। ।
কোন অপরাধী যাতে পালিয়ে যেতে না পারে এ জন্য কমাণ্ডার বিভিন্ন টিলার ওপরে তিন চারজন করে সৈন্য মোতায়েন করলেন। অবশিষ্ট সৈন্যদের ভাগ করলেন দুটি দলে ,একদল অস্ত্র তাক করে অশ্বপৃষ্ঠে বসে রইল, অন্য দলকে হুকুম দেয়া হলো চারদিক থেকে পায়ে হেঁটে তাবুর মধ্যে প্রবেশ করার ।
কমাণ্ডার তাদের বললেন, যদি কেউ বাঁধা দেয় বা পালিয়ে যেতে চায় তবে তাকে হত্যা করবে আর আত্মসমর্পন করলে বন্দী করবে তাকে ।
বাহিনী খোলা তলোয়ার হাতে তাবুর মধ্যে প্রবেশ করল। একটি তাবুতে ঢুকলেন রুশদ বিন মুসলিম। দেখলেন একটি অর্ধ উলঙ্গ মেয়ে এবং দু’জন লোক গভীর নিদ্রায় মগ্ন । তিনি তলোয়ারের খোচায় জাগাতে চাইলেন ওদের । কিন্তু তারা জাগার পরিবর্তে অসহিষ্ণু কণ্ঠে গালি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে রইল ।
তিনি তলোয়ারের খোঁচা একটু জোড়ালো করলেন। যখন তলোয়ারের মাথা চামড়া কেটে ভেতরে প্রবেশ করলো, তখন চরম বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে চাইল এবং চোখের সামনে অস্ত্রধারী আগন্তুককে দেখে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল ওদের চেহারা। রুশদ বিন মুসলিম তিনজনকেই উঠে বসতে ইঙ্গিত করলে আতংকে হুড়মুড় করে উঠে বসলো ওরা। কেউ কোন রকম প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ না করে নিঃশব্দে হুকুম তামিল করে কমাণ্ডারের সাথে বাইরে বেরিয়ে এলো।
অন্যান্য তাবুতেও প্রায় অনুরূপ ঘটনাই ঘটল। প্রতিটি তাবুতেই নগ্ন ও অর্ধনগ্ন মেয়ে পুরুষকে বেহাল অবস্থায় পাওয়া গেল। তাবুর মধ্যে যেসব জিনিসপত্র পাওয়া গেল তার মধ্যে বাজনার সাজ-সরঞ্জামই বেশি।
ও সবাইকে বাইরে নিয়ে আসা হলো। কমাণ্ডার নির্দেশ দিলেন, পিছমোড়া করে হাত বাঁধো সবার। একেক রশিতে দশজন করে আটকাবে। প্রতিটি দলের পেছনে সেই রশির এক মাথা থাকবে আমাদের কোনু সৈনিকের হাতে।
নির্দেশমত বেঁধে ফেলা হলো ভণ্ডপীরের সঙ্গী সাথীদের। এ অভিযানে রুশদ বিন মুসলিম দুশমনের উট, ঘোড়া, বহু সৌখিন মালামাল এবং পাহারাদারদের অস্ত্রশস্ত্র সবই অক্ষত অবস্থায় দখল করার সুযোগ পেলেন।
একটু পরই মাহমুদ সাদিয়ার পিতাকে নিয়ে ফিরে এল। সাদিয়াকে তার বাপের হাতে তুলে দিয়ে ইমাম সাহেব বললেন, মাহমুদ আমাদের আর এখানে অপেক্ষা করা ঠিক নয়। বন্দীকে নিয়ে চলো ঘটনাস্থলে যাই।

তারা ভণ্ডপীরকে নিয়ে সেই প্রান্তরে চলে এল। রুশদ বিন মুসলিম ইমাম সাহেবের সাথে কোলাকুলি করে বললেন, ‘গতরাতে এই প্রতারক সরলপ্রাণ, মুসলমানদের কিভাবে বিভ্রান্ত করেছে এবার তা প্রকাশ করার সময় হয়েছে। ওকে এখানে নিয়ে এসে ভালই করেছেন।
মিথ্যা পীরের দাবীদার রবার্টের দুই হাত পিঠমোড়া করে বাধা ছিল। যে মঞ্চে গতরাতে সে ভেলকিবাজি দেখিয়েছিল তাকে সেখানে দাড় করিয়ে দেয়া হলো। পিছনে তখনও সেই তারাখচিত পর্দা লাগানো । তার সঙ্গী সাথীদেরকে মঞ্চের সামনে বসিয়ে দেয়া হলো । এদের সকলের হাতই পিছনে বাঁধা। বাদ্যযন্ত্রগুলো, যেগুলো একটু আগে তাবু থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলোও রাখা হলো তাদের পাশে ।
সাদিয়া ও সাদিয়ার বাপ গ্রামে ফিরে গাঁয়ের লোকদের ডেকে ডেকে বলতে লাগল, কে কোথায় আছো, জলদি চলো, পীরের উপত্যকায় ভয়ানক নাটক হচ্ছে। দেরী করলে সে নাটক আর দেখতে পাবে না।”
লোকজন ওদের ডাক চিৎকারে ছুটে এল এবং সকালের গিয়ে দেখল, ইমাম সাহেব সবাইকে ডেকে মঞ্চের সামনে বসিয়ে দিচ্ছে।
গতরাতে এই সব লোক যেখানে বসেছিল ইমাম সাহেব তাদেরকে ডেকে এনে সেখানেই বসাল। আতংকিত জনগণ । ভয়ে ভয়ে সেখানে এসে চুপচাপ বসে পড়ল। তাদের দেখাদেখি গাঁয়ের লোকেরাও এসে বসল সেখানে।
ইমাম সাহেব তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘উপস্থিত সরলপ্রাণ মুসলমান ভাইয়েরা, এই ব্যক্তি গতরাতে তোমাদের কাছে নিজেকে খোদার দূত বলে দাবী করেছিল। সে মৃত তোমাদের। নানা অসাধ্য সাধন করতে পারে বলে তোমাদের বুঝিয়েছে। এখন তাকে বলো, সে যেন তার কেরামতির সাহায্যে দড়ির বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ।
ইমাম সাহেব আরো বললেন, আমি এখন তার দলের একজনকে হত্যা করবো। একে তোমরা বলো, পারলে সে আমার হাত থেকে তার সাথীকে ছাড়িয়ে নিক। আর তা যদি না পারে হত্যা করার পর যেন সে ওকে আবার জিন্দা করে দেয় ।”
ইমাম সাহেব ভণ্ড পীরের এক খাদেমকে দল থেকে আলাদা করে মঞ্চে নিয়ে এলেন। মাহমুদ তলোয়ার নিয়ে অগ্রসর হল তাকে হত্যা করতে।
লোকটি চিৎকার দিয়ে বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করুন। দোহাই খোদার, আমাকে মারবেন না। এ লোক মৃতকে জীবিত করতে পারে না। সব ভাওতাবাজি, সব প্রতারণা। এ লোক আমাদের মতই সাধারণ মানুষ, খোদার দূত হওয়ার দাবী মিথ্যা ও বানোয়াট। আমাকে হত্যা করলে আমি স্রেফ খুন হয়ে যাবো। কোনদিন সে আমাকে জীবিত করতে পারবে না, বিশ্বাস না হয় এ কথা তোমরা তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখো।’
জনসাধারণ লোকটার ব্যাকুল কণ্ঠের চিৎকার ধ্বনি শুনল, কিন্তু তবু তাদের সন্দেহ দূর হলো না। ইমাম সাহেব ভণ্ডপীরের আলখেল্লা, কাপড় চোপড় এবং চামড়ার গায়ে এসেছিলেন। তিনি মঞ্চের পিছনে গিয়ে এই পোষাক পরে নিলেন । কাউকে না দেখিয়ে শোলা কাঠের বক্ষ বন্ধনীও পরলেন এবং তার ওপর আলখেল্লা জড়িয়ে আবার মঞ্চে এলেন।
মঞ্চে এসে উপস্থিত জনতাকে তিনি বললেন, ‘এই লোক তোমাদের খেলা দেখাতো রাতের আধারে । এখন আমি সেই খেলাই দেখাবো এই উজ্জল দিনের আলোয়।
তিনি চারজন তীরন্দাজকে ডাকলেন এবং বললেন, ত্রিশ কদম দূরে গিয়ে আমার বুকে তীর চালাও।
তীরন্দাজরা অনুমতির জন্য রুশদ বিন মুসলিমের দিকে তাকালো। রাতে মাহমুদ রুশদকে তীর ও খঞ্জর চালানোর ঘটনা বলেছিল। রুশদ ইশারায় তাদের তীর চালাতে আদেশ দিলেন ।
তারা ইমামের বুক নিশানা করে তীর চালালো। চারটি তীরই ইমামের বুকের মাঝখানে বিদ্ধ হয়ে গেল। ইমাম সাহেব বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না, বরং হাসি মুখে তাদের বললেন, ‘এবার সামনে এগিয়ে এসে আমার বুকে ছুরি চালাও।
ওরা এগিয়ে এসে ইমাম সাহেবের বুকে ছুরি চালালো। ছুরি গেথে রইল ইমামের বুকে, কিন্তু তিনি আগের মতই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন ।
উপস্থিত জনতা রুদ্ধশ্বাসে এ ঘটনা দেখছিল। যখন তীর ও খঞ্জর চালানো হয় তখন তারা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। কিন্তু এতে ইমাম সাহেবের কিছু হয়নি দেখে তারা যারপরনাই বিস্মিত হলো ।
ইমাম সাহেব এবার তীরন্দাজদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা তীর ধনুক রেখে এবার আমার পাশে এসে দাঁড়াও।
তারা মঞ্চে উঠে এলে তিনি রহস্যময় লোককে দেখিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ‘এই লোক নিজেকে অমর বলে দাবী করেছিল। আমি এবার আপনাদেরকে তার অমরত্বের রহস্য দেখাবো ।”
তিনিই তীরন্দাজদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা মঞ্চের এক কোণে সরে যাও এবং ওখান থেকে তার বুকে তীরের নিশানা করো।
তীরন্দাজরা মঞ্চের এক পাশে সরে গিয়ে ধনুকে তীর জুড়ল। লোকটি এ দৃশ্য দেখে ছুটে এসে ইমামের পিছনে পালিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। মৃত্যু ভয়ে তখন সে থরথর করে কাপছিল আর ইমাম সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে ভিক্ষুকের মত প্রাণ ভিক্ষা করছিল।
ইমাম সাহেব তাকে বললেন, সামনে এসো, লোকজনের কাছে তোমার আসল পরিচয় বলো। তুমি যে খৃষ্টানদের লেলিয়ে দেয়া এক ধোকাবাজ এ কথা সবাইকে জানিয়ে দাও ।
লোকটি করুণ চোখে চাইল ইমামের দিকে। সেখানে দয়া মায়ার কোন চিহ্ন নেই। উঠো, দাঁড়াও । জনতার সামনে তোমার আসল পরিচয় বলে দাও।”
লোকটি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দু’কদম হেঁটে মঞ্চের মাঝখানে জনতার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। বললো, ‘হে প্রতারিত জনগণ! আমি স্বীকার করছি আমি অমর নই। আমি তোমাদের মতই একজন সাধারণ মানুষ। আমি খৃস্টান, আমার নাম জেমস রবার্ট। মুসলমানদের সাথে খৃষ্টানদের যে ক্রুসেড চলছে আমি তার একজন যোদ্ধা । আমার জাতি পাঠিয়েছে। আমি যা করেছি, আমার জাতির স্বার্থে করেছি। তোমাদের ইমান কিনে তোমাদের পরাজিত করার জন্য করেছি।
আমি জানি, আমি যখন ধরা পড়েছি তখন আমার মৃত্যু অবধারিত। এ জন্য আমার কোন আফসোস নই। আমার জাতি যুগে যুগে তোমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য, তোমাদের ইমান ক্রয়ের জন্য আমার মত হাজার হাজার যুবককে পাঠাবে। কখনো আমরা নিজেরা এ কাজ করবো, কখনো তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে কিনে নেবো এ কাজ করার জন্য । যতদিন আমরা বিজয়ী না হবে ততদিন এ ক্রুসেড অব্যাহত থাকবে। কতজনকে ধরবে তোমরা, কতজনকে হত্যা করবে?
রবার্ট তার বক্তৃতা শেষ করে ইমাম সাহেবের দিকে ফিরে বলল, আমার যা বলার আমি বলেছি। এবার তুমি যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যেতে পার।
ইমাম সাহেব বললেন, ‘দাঁড়াও । আগে আমার কথা শেষ করতে দাও, তারপর তোমার ব্যাপারে ফয়সালা করা যাবে।
তিনি উপস্থিত লোকজনদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই লোকই সামাউনের কন্যা সাদিয়াকে কিডন্যাপ করেছিল। গতরাতে আমি তাকে উদ্ধার করেছি।
তিনি শরীর থেকে আলখেল্লা খুলে ফেললেন। এরপর খোললেন আলখেল্লার নিচে পরা কাপড় চোপর। সব শেষে জামা কাপড়ের নিচে পরা শোলা কাঠের নরম বক্ষ আবরণী খুলে এক লোকের হাতে দিয়ে বললেন, এটা সমস্ত দর্শকের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাও। সব তীর ও ছুরি এই নরম কাঠে বিদ্ধ হতো।
লোকজনের সামনে পীরের সব রহস্য ও জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল । তিনি দর্শকদেরকে পর্দার পিছনে নিয়ে গিয়ে সেই । গর্ত দেখালেন, যেখানে বসে রাতে রাজনাদাররা সুরের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে বিমোহিত করতো মানুষকে। তাবুর এলাকায় যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার ফলে লোকজন কৌতুহলী হয়ে ওখানে গেল। এলাকাটা শরাবের দুর্গন্ধে ভরা। দর্শকরা তাবুগুলো ঘুরে ঘুরে দেখল। এ সময় ইমাম সাহেব তাদের ডাকলেন, লোকজন বসলে তিনি তাদের বললেন, কাল রাতের আরো একটি তামাশার কাহিনী শোন।
তিনি বন্দীদের মধ্যে সেই লোকটিকে চিনতে পেরেছিলেন, যাকে কাল রাতে মৃত বলে দেখানো হয়েছিল। লোকটি রশি বাধা অবস্থায় কয়েদীদের মধ্যে বসেছিল। ইমাম সাহেব তাকে কাছে ডাকলেন।
যে ব্যক্তি বৃদ্ধ বাবা সেজেছিল তাকেও ডাকলেন। এরপর ডাকলেন ঐ চারজন তীরন্দাজকে যারা রাতে তীর । চালিয়েছিল। তারপর তারাই উপস্থিত লোকজনকে রাতে “ তারা কিভাবে কি করেছিল সব কথা খুলে বলল। পীর সাহেব সম্পর্কে জনগণের সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল।
ঈমাম সাহেব সমবেত জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে মুসলিম জাতি! এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্রুসেডাররা মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার জন্য যে সর্বগ্রাসী পরিকল্পনা নিয়েছে এটা তারই অংশ মাত্র। এ কথা সবারই জানা, কোন মানুষই মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারে না। স্বয়ং আল্লাহও কোন মৃতকে জীবিত করেন না, কারণ আল্লাহ শানুহু তার বানানো আইন-কানুন মেনে চলেন। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনই শরীক নেই। খৃষ্টানরা আল্লাহর এই একত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বানীকে স্তব্ধ করতে এই সব অপকৌশল
ওরা মুসলমানের ঈমানী শক্তি ও জেহাদী জযবা দেখে ভয় পায়। মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের ময়দানে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা এ ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। তাদের মিষ্টি কথা ও মন ভুলানো কার্যক্রমের উদ্দেশ্য তোমাদের বিভ্রান্ত করা। তোমাদের মনে সন্দেহ ও ধোকার বীজ বপণ করে জেহাদের ময়দান থেকে সরিয়ে রাখা ।
এই মিশরেই একদিন ফেরাউন নিজেকে খোদা বলে দাবী করেছিল। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন হযরত মূসা (আ.)। ফলে আল্লাহ ইসলামের দুশমন ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছে। হে আমার প্রিয় বন্ধুগণ। আজ যদি তোমরা দ্বীন ও ঈমানের স্বপক্ষে মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মত দৃঢ় পায়ে দাঁড়াতে পারো তবে এই সব ভণ্ড ও প্রতারকদের ঠিকানাও হবে নীল নদ।
উপস্থিত মুসলমানদের মাঝে জেগে উঠল ইমানী জোশ ও জযবা। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারনার অভাবে তারা যতই নফসের গোলামী করুক, দ্বীনের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার ডাক এলে তারা সেই ডাকে সাড়া দিতে কখনো দেরী করেনি।
ধোকাবাজদের মুখোশ খুলে যেতেই সমবেত উত্তেজিত হয়ে উঠল। যারা তাদের ধোকা দিয়ে ঈমানের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল তাদের খতম করে দেয়ার জন্য উত্তেজিত জনতার রক্ত টগবগ করে উঠল।
গ্রামের এক যুবক উঠে দাঁড়াল। উপস্থিত জনগণকে সম্বোধন করে সে বলল, ভাইসব, যারা ধোকা দিয়ে আমাদেরকে দ্বীনের পথ থেকে সরিয়ে রেখেছিল তারা ক্ষমার অযোগ্য। তাদের কাজ তারা করেছে, এবার আমাদের পালা। বেঁচে থাকলে আবারও ওরা আমাদের মত সরলপ্রাণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করবে। সে সুযোগ আর আমরা ওদের দেবো না ”
সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু উত্তেজিত জনতার গগনবিদারী শ্লোগানের নীচে চাপা পড়ে গেল তার কণ্ঠ। নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে ক্ষিপ্ত জনতা ভণ্ড পীর ও তার দলের লোকদের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো।
রুশদ বিন মুসলিম এই বন্দীদের কায়রো নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতবড় ক্ষিপ্ত জনতার হাত থেকে তাদের উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে উঠল। তিনি জনগণকে বুঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষে জনতার ওপর লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে জনতার ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল।
অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বুঝতে পেরে ইমাম সাহেব বললেন, রুশদ! লাঠি চার্জ করে এই উত্তেজিত জনতাকে তুমি কিছুতেই ফিরাতে পারবে না। তোমার লাঠির আঘাতে ওরা আহত হবে, রক্তাক্ত হবে, কিন্তু তাতে তাদের ক্ষোভ ও ক্রোধ আরো বেড়ে যাবে। এতদিন যাকে ওরা খোদার দূত বলে ভক্তি করে এসেছে সেই পাপিষ্ঠের মরণ যদি আল্লাহ ওদের হাতেই লেখে থাকেন, তুমি তা ফেরাতে পারবে না।’
বন্দিদের বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ছেড়ে দিয়ে ইমাম সাহেব ও রুশদ বিন মুসলিম একদিকে সরে গেলেন। রুশদ এক টিলার ওপর দাড়িয়ে সৈন্যদের বললেন, ‘এই জনতাকে তোমরা আর তাদের ঈমানের দাবী পূরণে বাধা দিও না।
কিছুক্ষণ পরের কথা। ময়দানে সেনাবাহিনী, ইমাম সাহেব, কমাণ্ডার রুশদ ও মাহমুদ ছাড়া আর কেউ নেই। জনগণ তাদের ঈমানের ওপর আঘাতকারীদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে সরে পড়েছে সেখান থেকে। যাওয়ার আগে তাদের তাবু, পর্দার কাপড় ও অন্যান্য যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছে সব একত্রিত করে তাতে আগুন ধরিয়ে পুড়ে ছাই করে দিয়েছে।
গত রাতে যেখানে তামাশা দেখিয়েছিল রবার্ট ও তার লোকেরা, সেখানেই পড়েছিল ওদের লাশগুলো। মনে হচ্ছিল, হঠাৎ কোন ঝড় এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে।
‘এখন আমাদের কায়রো যেতে হবে।’ ইমাম সাহেব রুশদ ও মাহমুদকে বললেন, ‘এই ঘটনা অবিলম্বে রিপোর্ট করতে হবে সরকারের কাছে।”
অন্তহীন ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটছে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর । গাদারদের প্রেফতার ও ধর্মীয় ফেতনা সামাজিক অনাচার ও বেহায়াপনা নির্মূলের দিকে। তিনি এমন সব খেল তামাশা ও অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন যার মধ্যে যৌনতা ও জুয়া জড়িত। মদ এবং নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেন। গোয়েন্দা প্রধান আলীকে বললেন, যেখানে যত মদের আখড়া পাও, গুড়িয়ে দাও।”
সুলতানের আদেশ পেয়ে আলী, বিন সুফিয়ান ও তার গোয়েন্দা বাহিনী চিত্ত বিনোদনের সেই সব কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালালো, প্রদর্শনীর নামে যেখানে অবাধ যৌনতার হাট তৈলচিত্রগুলো আটক করলো। এর সাথে জড়িতদুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করলো।
এসব অপরাধ দমনে আলীকে পূর্ণ এখতিয়ার ও দায়িত্ব দিয়ে সুলতান আইয়ুবী এবার প্রেফতারকৃতদের বিচারের দিকে মনযোগ দিলেন। যাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলো অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদী কারাদণ্ড দেয়া হলো। গুরুতর অপরাধীদের দেয়া হলো যাবজীবন কারাদণ্ড ।
সুলতান আইয়ুবী মানুষের বিনোদনের বিরোধী ছিলেন না। অশ্লীল বিনোদনের মোকাবেলায় সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা ঘোড় সওয়ারী, কুস্তি ও পাঞ্জা লড়াই এসব খেলার জন্য বিভিন্ন ক্লাব গড়ে তোললেন। মসজিদ ও মাদ্রাসায় কেরাত, হামদ, নাত ও আযান প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যবস্থাপনায় ধমীয় জলসা এবং ইসলামী কবিতা পাঠের আসর ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। ।
খেলাধুলাসহ সকল প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের জন্য আকর্ষণীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা করলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খেলোয়ারদের দেয়া হতো উন্নত জাতের ঘোড়া ও অস্ত্র । অন্যান্য বিজয়ীরা পেতো মূল্যবান কিতাবাদি।
সীমান্ত এলাকা। এখানেও এসে লাগল সেই প্রতিযোগীতার ঢেউ। সুলতান প্রশাসনকে হুকুম করলেন, শহর ও রাজধানী শুধু নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এই প্রতিযোগিতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দাও ।
সুলতান এই গ্রামের লোকদের নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি জানতেন, গ্রামের এই সব অশিক্ষিত লোকরাই প্রথম শক্রদের আক্রমণের শিকার হয়। বিশেষ করে সীমান্তবতী এলাকার লোকদেরই তারা প্রথম টার্গেট করে। তাই এদের নিরাপত্তার জন্য তিনি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।
তিনি নতুন করে সীমান্তে যে বাহিনী পাঠালেন তাদের কমাণ্ডারকে এ ব্যাপারে নজর দিতে বিশেষভাবে নির্দেশ দিলেন। সমস্ত সৈন্যদের মধ্য থেকে এসব কমাণ্ডারদের তিনি বিশেষভাবে বাছাই করেছিলেন।
রুশদ বিন মুসলিম ছিলেন সেই বাছাইকৃতদের একজন। মাহমুদের কাছ থেকে ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র তিনি দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংসের জন্য সীমান্তের ফাড়ি থেকে সৈন্য নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। যদি রুশদ না হয়ে পুরোনো কমাণ্ডার থাকতো সে ফাঁড়িতে, তবে দেখা যেতো সুদানী ও খৃষ্টানদের দেয়া শরাবে মাতাল কমান্ডারদের হুশ ফেরাতেই দিন সাবার হয়ে গেছে তার। ততক্ষণে দুষ্কৃতকারীরা সারা গ্রাম ছারখার করে পালিয়ে গেছে।
কায়রো। আলী বিন সুফিয়ানের কামরায় বসে আছেন কমাণ্ডার রুশদ বিন মুসলিম, মাহমুদ বিন আহমদ ও ইমাম ইউসুফ বিন বাজ। তারা আলী বিন সুফিয়ানকে শোনাচ্ছিলেন সেই রহস্যময় পীরের কাহিনী যাদেরকে উত্তেজিত জনতা হত্যা করেছিল।
তিনি ওদের কাছ থেকে সমস্ত কাহিনী শুনে তাদের নিয়ে গেলেন সুলতান আইয়ুবীর কামরায়। সুলতান আইয়ুবী সব কাহিনী শুনে খুশি হয়ে বললেন, “আল্লাহ এই জাতির ওপর রহমত নাজিল করুন। এক ভয়াবহ ফেতনার হাত থেকে জাতিকে বাচিয়েছো তোমরা।
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ফেতনার মূল উপড়ে ফেলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার জের এখনো শেষ হয়নি। এখনো ওইসব এলাকা থেকে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তি হওয়া শুরু হয়নি।
জ্বী ইমাম সাহেব বললেন, সীমান্তের লোকেরা অধিকাংশই এখনো সুদানীদের বন্ধু। তারা মিশর সরকারের প্রতি আস্থাশীল নয়। দুশমনের ক্রমাগুত মিথ্যা প্রচারণা ও নানা রকম ফেতনা তাদের অন্তর থেকে জিহাদের প্রেরণা নিঃশেষ করে দিয়েছে।
সুলতান প্রশ্ন করলেন, তারা কি এখনো তাদের ফসল ও পশু আমাদের না দিয়ে খুশি মনে সুদানীদের দিয়ে দিচ্ছে?
ইমাম সাহেব বললেন, ‘হ্যা, সীমান্ত এলাকায় ইসলামী চেতনা লোপ পেয়েছে। সেখানকার মসজিদগুলো এখন বিরান। লোকেরা পীর পূজা, ব্যক্তি পূজা ও নানা তন্ত্ৰে মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে গেছে। এই লোকদের সঠিক পথে ফিরে আনার জন্য আমাদের মিশনারী তৎপরতা শুরু করা দরকার। যদি উন্মত্ত জনতা এই পীরকে হত্যা না করতো তবে তাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের বিভ্রান্তি আরো কিছুটা দূর করা যেতো।’
একদল মোবাল্লিগকে সীমান্তবতী এলাকায় পাঠিয়ে সুলতান আইয়ুবী এবার মনযোগ দিলেন তকিউদিনের দিকে। চোখ কান খোলা রেখে প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করতে লাগলেন তিনি। রাতের ঘুম পর্যন্ত হারাম করে দিলেন।
কিন্তু তকিউদ্দিনকে সুদান থেকে বের করে আনা কোন সহজ ব্যাপার ছিল না। মিশরের আভ্যন্তরীণ অবস্থা প্রতি মুহুর্তে সুলতানের উপস্থিতি দাবী করছে। অসংখ্য জটিলতার গিট খোলায় ব্যস্ত তিনি। কোথাও একটু ভুল করলে, সামান্য একটু ফুটো পেলে যে কোন সময় দাবার ছক উল্টে যাওয়ার মত অবস্থা হতে পারে। এ অবস্থায় তিনি নিজে কিছুতেই সুদানের রণাঙ্গণে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারছেন না।
তিনি কায়রো এসেই তকিউদ্দিনকে জানিয়েছিলেন এ খবর। সেই কাসেদ খবর দিয়ে ফিরে এসেছে। তার কাছ থেকেই সুলতান জানতে পেরেছেন তকিউদিনের বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা। তার সৈন্যরা এখনও ছত্রভঙ্গ। কিছু সৈন্য যুদ্ধের সঙ্গীন অবস্থা দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে।
কাসেদ বলেছে, তকিউদ্দিন অবশিষ্ট সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কিন্তু শক্ররা তাদের ঘাড়ের ওপর চেপে আছে। দুশমনের আঘাতের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানার কোন সামর্থ নেই তকিউদিনের । তার এতটুকুই সাহায্য প্রয়োজন, যেন তিনি শক্ৰদের ওপর আঘাত হেনে নিজের সৈন্যদের ফিরিয়ে আনতে পারেন।
সুলতান সালাউদ্দিন তড়িঘড়ি তিন চারটি ছোট ছোট কমাণ্ডো গ্রুপ ও একটি ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন তকিউদ্দিনের সাহায্যে। তিনি তাদের বললেন তকিউদ্দিনের কাছে রিপোর্ট করে তোমরা স্বাধীনভাবে কাজ করবে। তোমাদের কাজ হবে সুদানীদের উপর যত্রতত্র আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত রাখা।
রাতের অাঁধারে তারা সুদানে প্রবেশ করল। তকিউদিনের কাছে রিপোর্ট করে সরে পড়ল ওখান থেকে। এরপর চলে গেল সুদানী বাহিনীর পেছনে। বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন দিক থেকে একযোগে তীব্র আক্রমণ চালালো। অসম্ভব দ্রুত গতিতে জায়গা বদল করে আক্রমণ অব্যাহত রাখায় শক্রদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। ক্রাকের রণাঙ্গণ থেকে আইয়ুবী ফিরে এসেছে এ খবর তারা আগেই পেয়েছিল।
তার বাহিনী নিয়ে ছুটে এসেছে। এ হামলা তারাই চালিয়েছে। ভয়ে তারা লড়াইয়ের ধারা পাল্টে ফেলল। আইয়ুবী কত সৈন্য নিয়ে ময়দানে এসেছে এ ব্যাপারে কোন ধারনা না থাকায় তারা পিছু হটা শুরু করল। কমাণ্ডো বাহিনী যুদ্ধের ধারা বুঝতে পেরে আক্রমণ আরো তীব্রতর করল। ভীত সন্ত্রস্ত সুদানী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সৈন্য প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে রণে ভঙ্গ দিয়ে এদিক ওদিক সরে পড়ল।
কমান্ডোদের উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুদের ভীত সন্ত্রস্ত্র করে তকিউদ্দিনের সরে পড়ার পথ উন্মুক্ত করা। তকিউদিনের সাথে দেখা করে তারা বলেছিল, শক্রদের চাপ কমে এলে আপনাদের কাজ একটাই, আস্তে আস্তে পেছনে সরে যাওয়া । খবরদার, অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করবেন না, আবার স্থবির হয়ে বসেও থাকবেন না। যতটুকু সুযোগ পান কাজে লাগিয়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
প্রথম রাতের লড়াইয়ে কমাণ্ডো বাহিনী আশাতিরিক্ত সাফল্য লাভ করল। তাদের যোগ্যতা ও বীরত্ব ছাড়াও এ সফলতার অন্যতম কারণ ছিল, শক্ররা ছিল ক্লান্ত এবং একনাগাড়ে মরুভূমিতে থাকতে থাকতে প্রচণ্ড উত্তাপে তাদের ঘোড়াগুলোও ছিল ক্লান্ত, অবসন্ন।
তকিউদ্দিন এবার আর কোন ভুল করলেন না, সুযোগ পাওয়া মাত্র তার অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে পিছু হটা শুরু করলেন। তকিউদ্দিন যখন মিশর সীমান্তে প্রবেশ করলেন, তখন মাত্র অর্ধেক সৈন্য তার সাথে ছিল। বাকী অর্ধেক সুদানের ময়দানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল। এক ব্যর্থ অভিযান শেষে কমান্ডো বাহিনীর সহযোগিতায় তুকিউদ্দিন কায়রো ফিরে এলেন।
ওদিকে ক্রাক রণাঙ্গণে চলছিল তীব্র লড়াই। নূরুদিন জঙ্গীর ক্রমাগত ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপে দাউ দাউ করে জ্বলছিল ক্রাক শহর ।
নুরুদ্দিন জঙ্গির প্রকৌশলীরা পরীক্ষামূলক মেনজানিক নিক্ষেপের সাফল্য ও ব্যর্থতা খতিয়ে দেখে এর ক্রটিগুলো সারিয়ে তুলেছিল। এরপর চললো তাকে আরো উন্নততর করার অব্যাহত প্রচেষ্টা। এখন অল্প পাথর দিয়েও বেশি আগুন নিক্ষেপ করা যাচ্ছিল ।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দুর্গের আভ্যন্তরীণ মানচিত্র তুলে দিয়েছিলেন নূরুদ্দিন জঙ্গীর কাছে। এই মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু ও নিশানা চিহ্নিত করা ছিল। সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী মানচিত্র থেকে রসদের গুদাম খুঁজে বের করলেন। সৈনিকদের হুকুম করলেন আগুনের গোলা সেই গুদামে নিক্ষেপ করতে।
রসদের গুদামে মেনজানিক দিয়ে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করলো জঙ্গীর বাহিনী। আগুনের প্রথম গোলা গিয়ে আঘাত হানলো খাদ্য গুদামে। গোলার আঘাতে আগুন জ্বলে উঠল খাদ্য দ্রব্যে। লকলকিয়ে আগুনের শিখা ছুটল উপর দিকে। জঙ্গীর সৈন্যদের মনোবল ও আস্থা বেড়ে গেল এতে।
মুসলিম বাহিনীর অস্ত্র নির্মাতারা আরো একটি সাফল্যের খবর দিল নুরুদ্দিন জঙ্গিকে। তারা জানাল তারা এমন এক তীর ধনুক বানিয়েছে যা বহু দূর নিক্ষেপ করা যায়। ।
জঙ্গীর সামনে হাজির করা হলো সেই তীর । এগুলো ব্যবহারের জন্য অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন সৈন্যের দরকার। দেখা গেল আট দশটি তীর নিক্ষেপের পরই সৈন্যরা কাহিল হয়ে পড়েছে। সুলতান জঙ্গী শারীরিকভাবে বলিষ্ঠ একদল সৈন্যের হাতে তুলে দিলেন সেই তীর।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top