৭. দূর্গ পতন


সাদিয়া প্রতিদিন দুই বেলা মসজিদের ইমামের জন্য খাবার নিয়ে আসে। মাহমুদ বিন আহমদও ধর্মীয় শিক্ষা লাভের কথা বলে সেখানেই অবস্থান করতে থাকে। ইমামের সাথে মাহমুদের খাবারও নিয়ে আসে সাদিয়া। অনেক কথা হয় তাদের । সময় পেলেই মাহমুদ চলে যায় সেই চারণভূমিতে, যেখানে সাদিয়া বকরী ও উট চরায় ।
জায়গাটা গ্রাম থেকে বেশ একটু দূরে। স্থানটি সবুজ শ্যামলে ভরা। সেখানে পানির ব্যবস্থা আছে, আছে উচু নিচু মাটির ঢিবি । সেখানে দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কেটে যায় তাদের। মাহমুদ একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দার চোখ দিয়ে সাদিয়াকে অনেক পরীক্ষা করেছে, কিন্তু শক্রদের সাথে তার কোন দূরতম সম্পর্কও আবিষ্কার করতে পারেনি।
এখন তাদের অবস্থা এমন, সাদিয়া মাহমুদকে তার মোহাফেজ মনে করে। সে বিশ্বাস করে, মাহমুদ তাকে কাফেরের হাত থেকে রক্ষা করবে। আর মাহমুদের অবস্থা হচ্ছে, তার ঘাড়ে চেপে আছে দায়িত্বের বোঝা। নইলে যে কোন সময় সাদিয়াকে নিয়ে সে পালিয়ে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু একজন মুজাহিদ রাষ্ট্ৰীয় দায়িত্বের চাইতে ব্যক্তিগত সমস্যাকে কখনো বড় করে দেখে না। ফলে সাদিয়াকে নিয়ে তার পালিয়ে যাওয়াও হয়না।
তাছাড়া আরো একটি বিষয় মাহমুদ ভেবে দেখেছে। সাদিয়ার বিষয়টি মসজিদের ইমাম সাহেব জানেন । তিনি উর্ধতন গোয়েন্দা অফিসার এবং এ অঞ্চলের দায়িত্বশীল কর্মকতা । তার নির্দেশেই সে এ মসজিদে আছে। সাদিয়ার সমস্যা নিয়ে তিনিও পেরেশান । সাদিয়ার হেফাজত করাকে তিনি তার ঈমানী ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসাবে নিয়েছেন। অতএব সাদিয়ার কোন বিপদ দেখা দিলে তিনি তার মোকাবেলা অবশ্যই করবেন। ফলে সাদিয়াকে নিয়ে মাহমুদের খুব বেশি দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।
একদিন রাতে সহসা গ্রামে আলোর ছড়াছড়ি দেখা গেল। অন্ধকার ভেদ করে অপূর্ব সব দৃশ্য দেখা যেতে লাগলো গ্রাম জুড়ে। লোকজন ছুটাছুটি করতে লাগলো মশাল হাতে । সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ল অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য। প্রত্যেকের মুখে একই কথা, তিনি আসছেন! আকাশ থেকে নেমে আসছেন জামানার পীর। তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন। মানুষের অসুখ সারাতে পারেন। তিনি সব অভাব দূর করতে পারেন! মানুষের মনোবাসনা পূরণ করতে পারেন। তিনি আসছেন!
গ্রামের প্রতিটি মানুষ খুশি । তারা বলাবলি করতে লাগল, আমাদের আশা পূরণকারী আসছেন!
রাতের অাঁধারের তোয়াক্কা না করেই সাদিয়া দৌড়ে গেল মসজিদে। মাহমুদকে বললো, শুনেছো, তিনি আসছেন! তুমি জান আমি তার কাছে কি চাইব? আমি তার কাছে আরজ করে বলবো, মাহমুদ যেন শীঘ্রই এখান থেকে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। ।
মাহমুদ এ কথার কোন উত্তর দিল না। কেন যেন এ পীরের কাছে কিছু চাইতে তার মন সায় দিচ্ছে না। তার বিবেক, বুদ্ধি, শিক্ষা বলছে, এর মাঝে কোথায় যেন একটু ফাঁক আছে। লোকটির আচরণ রহস্যময়, যদিও সবাই তাকে পয়গম্বরের মত ভক্তি করে ।

মাহমুদ এ অঞ্চলে আসার পর রহস্যময় পীরের এই প্রথম আগমন । তার কেরামতি ও মোজেজার কাহিনীতে তাই এখন মুখর এ অঞ্চল। মাহমুদ বলল, বাড়ি যাও, রাতের অাঁধারে মেয়েদের এভাবে একাকী বাইরে বেরোনো ঠিক নয়।’
সাদিয়াকে এগিয়ে দিতে বাইরে বেরিয়ে এল মাহমুদ। তাকিয়ে দেখল, যে প্রান্তরে সাদিয়া বকরী চরায় সেখানে অনেক মশাল । ওখান থেকে ভেসে আসছে লোকজনের শোরগোল ও কোলাহল । সাদিয়াকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মাহমুদ এগিয়ে গেল সেদিকে ।
ওখানে পৌছে সে দেখতে পেল অনেক অপরিচিত লোকের ভীড় সেখানে। এই ভীড়ের মধ্যে সে তার দুজন সহকমীকেও দেখতে গেল। এ দুজনের ডিউটি এ অঞ্চলে ছিল না, অন্য অঞ্চল থেকে এরা এসেছে। মাহমুদ তাদের জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা এ এলাকায় এসেছো কেন?’
‘আমরা পীর সাহেবকে এক নজর দেখতে এসেছি।
মাহমুদ ওদের সাথে আলাপ করে বুঝলো, গোয়েন্দা হিসেবে নয়, পীরের প্রতি ভক্তিবশত ওরা তাকে দেখতে এসেছে।
তারা পীরের কেরামতির নানা কাহিনী মাহমুদের কাছে বলতে লাগলো। তাদের কথায় মাহমুদ বুঝলো, এরা দু’জনেই রহস্যময় পীরকে সঠিক ও কামেল পীর বলে বিশ্বাস করে । মাহমুদ চিন্তা করতে লাগলো, আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দারাও তার ভক্ত হয়ে গেছে। তবে কি তিনি আসলেই কোন কামেল দরবেশ?
পরদিন ভোর। ফজর পড়েই মাহমুদ দ্রুত সে প্রান্তরে গিয়ে হাজির হলো। প্রতিদিন সাদিয়া এ প্রান্তরে বকরী ও উট চরায় । মাহমুদ এসে তার সাথে দেখা করে, গল্প করে সময় কাটায়। কিন্তু আজ এখানে অনেক অপরিচিত লোকের ভীড়। লোকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলাফেরা করছে। তাবু খাটানোর সামগ্রী পড়ে আছে এখানে ওখানে। দু’জন লোককে সামনে পেয়ে মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো, এখানে কি হচ্ছে?”
একজন জবাব দিল, ‘পীর সাহেব এখানে থাকবেন, এ জন্য এ জায়গা আমরা পরিষ্কার করছি।
মাহমুদ দেখলো, একটু দূরে এক টিলার পাশে গর্ত করছে কয়েকজন লোক। মাঠের উচু নিচু জায়গা যতটা সম্ভব কেটে সমান করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট একটা এলাকায় সীমানা খুটি বসানো হচ্ছে। ওখানে এখন বাইরের কারো যাওয়ার অনুমতি নেই। |
গ্রামের লোকেরা কাজকর্ম ফেলে সেখানে জড়ো হয়ে তামাশা দেখতে লাগলো। অচেনা লোকগুলো ঘুরে ঘুরে ওদের কাছে পীর সাহেবের কেরামতির গল্প করতে লাগলো। লোকেরা এইসব গল্প শুনে আনন্দে পুলকিত হচ্ছিল, উত্তেজনার রোমাঞ্চ অনুভব করছিল। লোকজন ওদের প্রশ্ন করতে লাগল, পীর সাহেব কখন আসবেন?’
এ প্রশ্নের জবাবে লোকগুলো বলল, তিনি যে কোন সময় চলে আসবেন ।’
সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকেরা পীর দর্শনের উত্তেজনা নিয়ে সেখানে দাড়িয়ে থাকল। কিন্তু তিনি এলেন না।
পরদিন ভোর হওয়ার সাথে সাথেই লোকেরা আবার সেখানে গিয়ে ভীড় করলো। আগের ঘেরাও করা এলাকার বাইরে আরও একট বড়সর জায়গা ঘেড়াও করা হয়েছে। লোকজনকে সে ঘেরাও করা সীমানার বাইরেই থামিয়ে দেয়া হলো । উৎসুক জনতা গভীর আগ্রহ নিয়ে ওদের কাজকর্ম দেখতে থাকলো। বিকাল থেকে পীর সাহেবের লোকদের আনাগোনা ও সমাগম বাড়তে লাগল। কিছু কিছু লোক এলো উটের পিঠে চড়ে। সে সব উটের পিঠে মালপত্র বোঝাই করা। তারা উট থেকে নেমে মাল-সামান নামানো শুরু করলো। আরেকদল সেইসব মালপত্র, তাবুগুলোতে নিয়ে যেতে থাকলো । *.
সন্ধ্যা পার হয়ে রাত গভীর হতে লাগলো। মাঝ রাতেরও বেশ পরে আকাশে চাঁদ উঠলো। সেই চাদ পশ্চিম দিকে গড়িয়ে যেতে থাকলো। রাতের শেষ প্রহর। ক্ষীণ চাঁদ অনেক পথ অতিক্রম করে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকলো । চাঁদের আলো ঘোলাটে হয়ে এল। লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, “এই বার তিনি আসমান থেকে নেমে আসবেন । দেখা দেবেন ভক্তদের ‘
তারা এসব বলাবলি করছিল, কারণ পীরের খাদেমরা অাঁধারীতেই তিনি নিজেকে ভক্তদের সামনে হাজির করেন।’ কিন্তু আজও তিনি দেখা দিলেন না।
পরদিন দিনভর লোকজন পীরের লোকদের সাথে গল্প করে কাটালো। সন্ধ্যার পর আজ আর কেউ বাড়ি গেল না। তারা গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগল পীর সাহেবের লোকদের কাজকর্ম, আর অপেক্ষা করছিল, কখন পীর সাহেব তশরিফ আনবেন!
সারাদিনের কাজের পর গ্রামের মেয়েরা রাতে একটু অবসর পেল। সেই অবসরে দল বেঁধে ওরা গেল সেই তামাশা দেখতে |
মাঠের একদিকে গ্রামের মেয়েরা জটলা বেধে দাঁড়িয়ে ছিল । অন্ধকারে কেউ কাউকে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিল না। সেই মেয়েদের সাথে মিশে সাদিয়াও দাড়িয়েছিল ওখানে । তাকিয়ে ছিল পীর সাহেবের জন্য ঘেরাও করা জায়গার দিকে । ওখানে অনেকগুলো মশালের আলো জ্বলছে।
ওরা ভাবছিল, গতকাল যখন পীর সাহেব আসেননি, তখন আজ নিশ্চয়ই আসবেন। ওরা পীর দর্শনের গভীর প্রত্যাশা নিয়ে ঘেরাওয়ের বাইরে দাঁড়িয়েই রইল। কিন্তু ওদের কারো জানা ছিলনা, একটু পর কি ঘটনা ঘটবে।
দু’জন অচেনা লোক পিছন থেকে মেয়েদের দিকে এগিয়ে গেলো। দু পাশ থেকে এলো দু’জন করে মোট চারজন। মেয়েরা তাদের আগমন খেয়াল করেনি। ওদের কাছে এসে তারা চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, এই, তোমরা এখানে কি করছো? সরো, সরে যাও এখান থেকে।
অন্ধকারে মেয়েরা হুড়োহুড়ি শুরু করল । একজন আগন্তুক ছোট একটা মশাল ধরিয়ে তাড়া করলো মেয়েদের । মেয়েরা ভয়ে চিৎকার চেচামেচি করে এদিক ওদিক পালাতে লাগলো। লোকটার মশালের আলোয় বাকী পাঁচজন মেয়েদের মধ্যে কাউকে খুঁজতে শুরু করলো। হঠাৎ একজন সাদিয়াকে দেখতে পেয়ে আস্তে চিৎকার দিল; এই এদিকে।
লোকগুলো খোঁজাখুজি বাদ দিয়ে ছুটে এল সেই চিৎকার লক্ষ্য করে । এই হট্টগোলের মধ্যে একজন সাদিয়ার ওপর একটা কম্বল ছুড়ে মারল । কালো কম্বলের নীচে ঢাকা পড়ে গেল সাদিয়া এক লোক দ্রুত কম্বল ঢাকা সাদিয়াকে তার শক্ত বাহু দিয়ে পেচিয়ে ধরে অন্য হাতে মুখ চাপা দিয়ে তাকে কাঁধের ওপর উঠিয়ে নিল ।
একে তো অন্ধকার, তার ওপর মেয়েরা সবাই পালিয়ে যাওয়ার হুড়োহুড়িতে ব্যস্ত থাকায় কেউ খেয়ালই করল সাদিয়াকে কেউ অপহরণ করছে।
পরদিন সকালে মানুষের ঢল নামলো সেখানে। সেই গ্রাম এবং আশপাশের অন্যান্য গ্রামের লোকেরা চারণভূমির দিকে ছুটে আসতে লাগলো দলে দলে। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল নির্জন চারণভূমি।
সতেরোটি উট মন্থর পায়ে এগিয়ে আসছে চারণভূমির দিকে। প্রত্যেক উটের পিঠে সুন্দর করে সাজানো পালকি । প্রত্যেক পালকিতে রেশমী কাপড়ের পর্দা ও সোনালী-রূপালী ঝালর লাগানো । এই সতেরো পালকির কোন একটাতে আছেন সেই মশহুর পীর।
মিছিলের অগ্রভাগে শানাই ও ঢোল বাজছে। পীরের খাদেম ও ভক্তকুল উটের সারির আগে পিছে মিছিল করে এগিয়ে চলেছে। ভাবগম্ভীর ভাবে গুণ গুণ করে দোয়া কালাম পড়ছে ওরা। উটগুলোর লম্বা গলায় ঝুলানো ঘণ্টার ধ্বনি ঐকতানে ঝংকৃত হয়ে অপূর্ব সুরের লহর তুলছে। ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে উট ও মানুষের বিশাল কাফেলা। কিন্তু কোন বিশৃংখলা নেই, শোরগোল বা হই হট্টগোল নেই। একটি পবিত্র ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করছে মিছিলের সর্বত্র।
লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এ শানদার মিছিলের দিকে। পীর সাহেবকে কেউ দেখতে পেলো না, তবে তার খাদেমবৃন্দ এবং একান্ত বিশ্বস্ত ভক্ত ও অনুরুক্ত মুরিদদের দেখেই অভিভূত হয়ে গেল সবাই ।
মিছিলকারীদের পরণে ঢিলেঢালা শাদা আলখেল্লা । তাদের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল, এরা এই ধুলির ধরণীর কেউ নয়।
কাফেলা সেই সবুজ প্রান্তরে চলে এল। সেখানে টিলার ফাঁকে ফাঁকে অনেক সমান্তরাল ভূমি। তারই একটি সমান্তরাল স্থানে তাবু টানিয়ে পীরের জন্য থাকার আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তার চারপাশে বসে গেল গ্রাম্য মেলা।
উটের আরোহীরা তাবুগুলোর কাছে গিয়ে থামলো। লোকজন ঘেরাও করা সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তাদের । শাদা চাদরের ঘেরাও দিয়ে আরোহীদের পালকি থেকে নামানো হলো। ফলে, কে কে নামলো এবং কে কোন তাবুতে আশ্রয় নিল জনগণ তা দেখতে পেল না।
উটের বহরের সাথে হেঁটে আসা মুরিদরা সীমানার বাইরে বসে পড়লো। গ্রামের লোকেরা মুরিদদের কাছ থেকে পীরের কেরামতি ও মোজেজার গল্প শুনতে ঘিরে ধরল ওদের |
রহস্যময় বিষয়ে মানুষের যে সহজাত কৌতুহল থাকে সে কৌতুহলে আন্দোলিত উপস্থিত লোকজন। পীর সাহেব ও তার সঙ্গী সাখীরা মানুষের এই সহজাত প্রবণতাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে অতিশয় পারঙ্গম । ফলে এক ধরনের রহস্যময়তা কাজ করছিল সেখানে।
ইমাম সাহেব জনতার ভিড়ের মাঝে মিশে গিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন। গভীর মনযোগ দিয়ে তিনি লক্ষ্য করছিলেন জনগণের মতিগতি । তার সাথে ছিল মাহমুদও। মাহমুদের বিশ্বাসের ভীতে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছিল, তাই সে পীর সাহেবের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোন মন্তব্য করলো না ।
সে কায়রো থেকে নির্দেশ পেয়েছে, সীমান্ত এলাকায় মানুষের মাঝে যে নতুন বিশ্বাস ছড়ানো হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাও। সেখানে কি হচ্ছে জানার জন্য কেন্দ্র উদগ্রীব। কারা এগুলো করছে এবং কিভাবে করছে। বিস্তারিত জানাবে। কায়রোতে এখনও এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ কোন রিপোর্ট আসেনি।
কায়রোতে কেন এখনো কোন রিপোর্ট যায়নি মাহমুদ তা জানে। পীর সাহেবের রহস্যময় তৎপরতায় সাধারণ লোকের মত এখানকার গোয়েন্দারাও অভিভূত হয়ে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে গেছে। যারা ভক্ত হয়নি তারাও ভয়ে পীরের বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট দিতে সাহস পায়নি। এ জন্যই সীমান্ত থেকে পীরদের তৎপরতা সম্পর্কে কেন্দ্ৰ আজো সঠিক রিপোর্ট পায়নি ।
এখন এর পুরো দায়িত্ব চাপলো ইমাম সাহেবের ওপর। এ জন্যই তিনি মাহমুদকে নিয়ে এখানে এসেছেন। তাঁর বিশ্বাস, পীর সাহেব যাদু বা ভিলকিবাজি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
ইমাম সাহেব দেখলেন, অধিকাংশ লোক মুরিদদের মুখে পীরের প্রশংসা শুনেই তার বশীভূত হয়ে যাচ্ছে।
তারা পীরের কেরামতি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। কেউ ওখান থেকে সরতে নারাজ, পাছে কেরামতি দেখার সৌভাগ্য থেকে যদি বঞ্চিত হতে হয়!
সাদিয়ার অপহরণের খবর এখনো জানেন না ইমাম সাহেব ও মাহমুদ। হঠাৎ সাদিয়ার বাবা তাদের দেখতে পেয়ে । ছুটে এল সেখানে। সাদিয়ার বাপের বিপন্ন ও বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে অজানা আশংকায় কেপে উঠল মাহমুদের হৃদয় । ইমাম সাহেব ত্রস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “কি ব্যাপার, কি হয়েছে তোমার? তার কণ্ঠে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
সাদিয়ার পিতা ম্লান চোখে তাদের দিকে চাইল । সে চোখে বেদনার অথৈ সাগর। বললো, সাদিয়া গত রাতে বাড়ী ফেরেনি। গ্রামের মেয়েরা বললো, রাতে সাদিয়া তাদের সাথে এখানেই ছিল। হঠাৎ চার পাঁচ জন লোক এসে তাদের তাড়া করে। সবাই হুলুস্কুল করে পালিয়ে যায়, কিন্তু তারপরে আর সাদিয়ার সাথে তাদের দেখা হয়নি। তার কি হয়েছে তারা কেউ জানে না।’
সকাল থেকেই সাদিয়ার পিতা পাগলের মত মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আশপাশের বাড়িতে খোঁজ নেয়ার পর মেয়েকে না পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মসজিদে। ওখানে ইমাম সাহেব বা মাহমুদ কাউকে না পেয়ে ছুটে এসেছেন এখানে ।
হঠাৎ করে এ দুঃসংবাদ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ইমাম সাহেব । মেয়ে হারানোর বেদনায় শোকার্ত পিতাকে কি বলে শান্তনা দেবেন ভেবে পেলেন না। মাহমুদও চুপচাপ । কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন ইমাম সাহেব, তার আগেই মেয়ের খোঁজে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল সাদিয়ার পিতা ।
সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদ পিছু নিল তার। দু’জনেই ভীড়ের মধ্যে সাদিয়াকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু এই ভীড়ের মধ্যে সাদিয়া থাকলে তো তাকে খুঁজে পাবে তারা পুরো এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো, কিন্তু সাদিয়াকে কোথায় পাওয়া গেল না। তবুও বাপের মন বুঝ মানে না, সে এদিক ওদিক ঘুরতেই থাকে। তার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে মাহমুদও।
তাদেরকে এখানে ওখানে উকিঝুকি মারতে দেখে এক অচেনা লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি কাউকে খুঁজছো?
‘গত রাত থেকে আমার মেয়ের খোজ পাচ্ছি না। গাঁয়ের মেয়েদের সাথে এখানেই ছিল সে কাল রাতে । কিন্তু সবাই বাড়ি ফিরলেও সে বাড়ি যায়নি।”
‘অ, তুমিই মেয়েটির বাবা! লোকটি সাদিয়ার বাপকে না। এখন হয়তো তারা মিশরের সীমানা পার হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে।’
কি বলছে তুমি? আমার মেয়ে কেন মিশর ছেড়ে যাবে?’ । তার আমি কি জানি!’ লোকটি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘গতকাল সন্ধ্যায় আমি এক ঘোড়সওয়ারকে দেখলাম মেয়েদের দিকে এগিয়ে যেতে। তার চলাফেরায় কেমন একটা সতর্ক ভাব । লোকটার আচরণে সন্দেহ হওয়ায় আমার কৌতুহল হলো। দেখলাম, ঘোড়সওয়ার মেয়েদের জটলা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
এসে ঘোড়সওয়ারের পাশে দাঁড়ালো। ওরা নিচু স্বরে কি কথা বলেছে আমি শুনতে পাইনি। এরপর দেখলাম, মেয়েটি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেই আরোহীর সামনে উঠে বসলো। তারপর আরোহী ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল ওখান থেকে। আমি দেখছিলাম আর চিন্তা করছিলাম, আল্লাহ জানে এ মেয়েটি কার! নিশ্চয়ই সে বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে পালাচ্ছে ।”
লোকটির কথা শুনে পাশে দাঁড়ানো একজন বলে উঠলো, তুমি কেমন বাপ হে! নিজের মেয়ে কার সাথে প্রেম করে বেড়ায় খবর রাখো না? এখন বসে বসে কপাল চাপড়াও, অযথা আর তাকে খোজার বৃথা চেষ্টা করো না।’
লোকটি চলে গেল। সাদিয়ার বাবার চোখে নেমে এল অশ্রুর ধারা। কিন্তু মাহমুদের প্রতিক্রিয়া হলো অন্য রকম। কারণ সে ছিল গোয়েন্দা। সে চিন্তা করে দেখলো, এ লোক যা বলেছে তা ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। তার বর্ণনায় একবিন্দু সত্য থাকতে পারে না। কেমন করে সে বলতে পারল, সাদিয়া এক ঘোড়সওয়ারের সাথে পালিয়ে গেছে! এত ভীড়ের মধ্যে সে একাই এ ঘটনা দেখতে পেলো আর কেউ কিছু টের পেল না! অসম্ভব, এ হতেই পারে না।
কারো কথা যাচাই বাছাই না করে চট করে বিশ্বাস করা গোয়েন্দাদের প্রশিক্ষণের পরিপন্থী। গোয়েন্দা ট্রেনিংয়ের মূল কথা হলো, কারো কথা চট করে বিশ্বাসও করবে না, অবিশ্বাসও করবে না। আগে খতিয়ে দেখবে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে। সম্ভব হলে সরেজমিনে তদন্ত করবে। তারপর নিরূপণ করবে তার কথা সত্য না মিথ্যা। গোয়েন্দাদের সন্দেহপ্রবণতা ও বিশ্বাসের বিশেষ মানদণ্ড আছে, সবকিছুই তারা সেই চোখ দিয়ে দেখে। মাহমুদ ঐ অচেনা লোকটির পিছনে লেগে গেল ।
লোকটি হাঁটতে হাঁটতে ভীড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে টিলার দিকে এগিয়ে গেল। মাহমুদ দূর থেকে ফলো করে এগিয়ে গেল সেই টিলার দিকে । টিলার পেছনে পীর সাহেব ও তার খাদেমদের তাবুর সারি। মাহমুদ টিলায় চড়ে লোকটাকে আর দেখতে পেল না। নিশ্চয়ই টিলা থেকে নেমে সে এই তাবুর সারির কোন একটিতে ঢুকে পড়েছে।
লোকটা তাবুর সারির মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় মাহমুদের বিশ্বাস হল নিশ্চয়ই সাদিয়া এখানেই কোন এই তাবুতে আছে। তাকে অপহরণ করার পেছনেও এ লোক জড়িত ।
লোকটা সাদিয়ার খরিদ্দারের কেউ নয়তো। সাদিয়ার বাবাকে হুমকি দিয়ে রাজি করিয়েছিল ওরা হঠাৎ অপহরণের সুযোগ পেয়ে টাকা খরচের হাত থেকে বাঁচার জন্য এ কাজ করেনি তো ওরা!
চিন্তাটা মাহমুদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল, টিলা থেকে নেমে এল মাহমুদ। দেখা যাচ্ছে, সাদিয়ার বাবা লোকটিকে না চিনলেও তারা তাকে ভাল করেই চেনে। মাহমুদ নিশ্চিন্ত, সাদিয়ার বাবাকে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত করার জন্যই লোকটি এই কাহিনী বানিয়েছে, যেন তিনি তার মেয়েকে এখানে আর খুঁজে না বেড়ান।
মাহমুদ বিন আহমদের মনে সাদিয়ার জন্য ছিল গভীর ভালবাসা। সাদিয়াও তাকে ভালবাসে, আর ভালবাসে বলেই এখান থেকে তাকে নিয়ে সরে পড়তে চেয়েছিল। সে ভালবাসার পরীক্ষায় পড়ল মাহমুদ। এ পরীক্ষায় তাকে যে উত্তীর্ণ হতেই হবে!
মাহমুদ ইমাম সাহেবকে খুজে বের করে তাকে সন্দেহের কথা বললো। ইমাম সাহেব একজন বিচক্ষণ গোয়েন্দা কমাণ্ডার। তিনি মাহমুদের সাথে এক মত হয়ে বললেন, ‘ঠিকই ধরেছ তুমি, সাদিয়ার বাবাকে ধোকা দেয়ার জন্যই তার মেয়ে অন্য কারো সাথে পালিয়ে গেছে বলে প্রচারণা চালানো হয়েছে।’
মাহমুদ বলল তাহলে তাকে উদ্ধার করার জন্য আমাদের এখনি কিছু করা দরকার।’
হ্যাঁ, তুমি এক কাজ করো, ভীড়ের মধ্যে আমাদের আরো যে দুজন সহকারী আছে তাদের খুঁজে বের করো। ওদের সাথে আলাপ করেই তাকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেবো আমরা ”
মাহমুদ ওদের খুঁজে বের করলো। তারপর জটলা থেকে দূরে এক টিলার আড়ালে ওরা পরামর্শ সভায় বসলো।
মাহমুদ সব খুলে বললো ওদের । সবাই সাদিয়াকে উদ্ধার করার ব্যাপারে একমত হলো। কিন্তু কাজটি এত সহজ ছিল না। পীরের আস্তানা এবং তার লাগোয়া তাবুগুলোর কাছে কারো যাওয়ার অনুমতি ছিল না। এমনকি পীরের খাস মুরিদরা ছাড়া আশেপাশের টিলা মাড়িয়ে সেই সমতল ভুমিতে নামারও অনুমতি ছিল না কারো। পীরের মুরিদরা চারদিক থেকে এলাকাটা ঘিরে রেখেছিল। চাইলেই তাদের অনুমতি পাওয়া যাবে এমন নয়, আবার তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে সেখানে প্রবেশ করাও ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার।
নূরুদিন জঙ্গী ক্রাক অবরোধে সৈন্যদের লাগিয়ে দিয়ে দুর্গ ভাঙ্গার কৌশল চিন্তা করছিলেন। যুদ্ধের অবস্থা জটিল। প্রথম দিনই তিনি বুঝেছিলেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যে দুর্গের পতন ঘটাতে পারেননি তার পতন ঘটানো কোন সহজ ব্যাপার নয়। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, কিন্তু সে ক্রাকের পতন ঘটাতে পারেনি। এতেই এ যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
নুরুদ্দিন জঙ্গির ভরসা সালাউদ্দিন আইয়ুবীর দেয়া কিছু তথ্য। তিনি তাঁর সালারদের বললেন, এ দুর্গের পতন ঘটানোর সম্ভাব্য কৌশল সে-ই আমাকে বলে গেছে। সে আমাকে বলেছে, এ দুর্গের অভ্যন্তরে কোথায় কি আছে এবং আমরা কি ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হবো। কোথায় রসদ আছে, কোথায় যুদ্ধের বাহন ঘোড়া আর উট, কোথায় সেনাবাহিনীর ব্যারাক, সব সে বলেছে আমাকে । শহরের খৃষ্টান প্রধান আবাসিক এলাকা এবং মুসলিম প্রধান আবাসিক এলাকাও সে আমাকে চিনিয়ে দিয়ে গেছে। তার জানবাজ গোয়েন্দারা এসব তথ্য খুব নিখুঁত ও যত্ন সহকারে সংগ্ৰহ করেছে বলেই আমার বিশ্বাস । আমাদের অভিযানে এ সব তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।” –
তিনি দুর্গের মধ্যে অগ্নি বর্ষণ করার কথা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু তার মেনজানিক ছিল ছোট এবং কম শক্তিসম্পন্ন। ক্রুসেডদের ছিল ভারী মেনজানিক। এর সাহায্যে ওরা বহু দূর পর্যন্ত অগ্নিগোলা ছুড়ে মারতে পারতো। সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর মেনজানিকের ক্ষমতা কম বলে এ চিন্তা তিনি মাথা থেকে বিদায় করলেন।
আইয়ুবীর মুজাহিদরা যেখান দিয়ে দেয়াল ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিল আর ক্রুসেডাররা দেয়ালের ওপর থেকে ড্রামের আড়াল নিয়ে জ্বলন্ত কাঠ নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মেরেছিল মুজাহিদদের, জঙ্গী অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন। সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের ডাকলেন ।
সবাই এসে পৌছলে তিনি বললেন, যত কঠিনই হোক, দুর্গ আমাদের দখল করতেই হবে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বলে গেছে, শক্তিশালী ও বড় ধরনের মেনজানিক ব্যবহার করতে পারলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। আমি তার সাথে একমত, কিন্তু তাতে ভেতরের মুসলমানদের ক্ষতি হওয়ার আশংকা আছে। এতে একজন সাধারণ মুসলমান মারা গেলেও তা হরে আত্মঘাতি অপারেশন। সারা জীবন এ জন্য আমাকে অনুতপ্ত থাকতে হবে।
একজন অফিসার বললেন, আমি মনে করি আইয়ুবীর চিন্তা ও পরিকল্পনা আবার নতুন করে খতিয়ে দেখা দরকার। আমি ইচ্ছে করলে বড় ও শক্তিশালী মেনজানিক বানানোর ব্যবস্থা করতে পারি।
কিন্তু তাতে মুসলমানদের ক্ষতির আশংকা থেকেই যায়, বললেন আরেক অফিসার।
নুরুদ্দিন জঙ্গি বললেন, ‘বন্ধুরা আমার তোমরা যদি ভিতরের মুসলমানদের অবস্থা জানতে তাহলে বলতে তাদের জন্য এখন মরণও ভাল। কারণ, সেখানকার কোন মুসলমানেরই জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু এখন আর নিরাপদ নেই। মুসলমান নারী ও শিশুরা খৃস্টানদের করুণার শিকার। । আর যুবক ও পুরুষেরা তাদের জেলখানায় পড়ে থেকে বেগার হয় আমাদের মুক্ত করো না হয় মৃত্যু দাও।”
মাননীয় সুলতান! একজন কমাণ্ডার আবেগদীপ্ত কণ্ঠে বলল, আমাদের অবরোধ যত দীর্ঘ হবে ততই তাদের দুঃখ দুর্দশা বাড়বে। আমরা যদি অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করি তবে সব মুসলমান পুড়ে যাবে এমন নয়। যদি কেউ মারা যায় তবে জীবন কুরবান করে শাহাদাতের গৌরবে ধন্য হয়েছে। আমরা কেন এই রণাঙ্গণে মরতে এসেছি? এসেছি এ জন্য যে, ইসলামকে জিন্দা রাখতে হলে কিছু জীবন সব সময় কুরবানীর জন্য প্রস্তুত রাখতে হয়। আমি আপনাদের সামনে এই পরামর্শ রাখতে চাই, দুর্গ অধিকারের জন্য কিছু নিরপরাধ মুসলমানের জীবনের ঝুঁকি নিতে হলে আমাদের তাও নেয়া উচিত ।
আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করেন না।” এক সেনাপতি বললো, আমরা এখানে এসেছি এখানকার মুসলমানদেরকে জালিমের হাত থেকে রক্ষা করতে। এই ফিলিস্তিন মুসলমানদের আবাসভূমি। এখানেই আমাদের প্রথম কেবলা অবস্থিত। আজ সে কেবলা দুশমনের কজায়। আমরা এখানে আবার দ্বীনের পতাকা উড়াতে চাই। আমাদের প্রথম কেবলাকে খৃস্টান ও ইহুদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে চাই। কয়েকটি প্রাণের রিনিময়ে আপনি যদি জাতির এ স্বপ্ন সফল করতে পারেন জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে আপনার কথা স্মরণ করবে এবং আপনার জন্য দোয়া করবে।’
ফিলিস্তিন ইহুদীদের জন্মভূমি, এ দাবী কখনও বরদাশত করার মত নয়। অন্য একজন বললেন, আমরা সবাই তাদের এ দাবী মিথ্যা প্রমাণ করতে জীবন বাজি রেখেছি, প্রয়োজনে আমাদের সন্তানদেরও কুরবানী দিতে প্রস্তুত আছি।
নূরুদিন জঙ্গীর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো, সে হাসি আনন্দের না বেদনার ঠিক বুঝা গেল না । তিনি বললেন, আমি তোমাদের এ আবেগ ও চেতনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ক্ষমতা ও যুদ্ধের কৌশল। তারা ফিলিস্তিনে তাদের আধিপত্য করেছে। এ জন্য তারা তাদের সব সম্পদ এবং এমনকি তারা কেবল অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করছে না, তাদের সম্পদ এবং কোমলমতি মেয়েদেরও ব্যবহার করছে আমাদের বিরুদ্ধে ।
তারা এই ধন সম্পদ ও মেয়েদের দিয়ে আমাদের দলের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টি করছে। তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও মিশর। মিশরের বড় বড় শহরে এই সব নির্লজ্জ মেয়েদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বড়ই অনুতাপের বিষয়, মুসলিম নেতৃবৃন্দ, শাসকবর্গ ও ধনী বণিকেরা ইহুদী খৃস্টানদের এই জালে আটকে পড়েছে। তারা আমাদের মধ্যে বিভেদ ও মতপার্থক্য সৃষ্টি করছে। এর পরিণতি কত ভয়াবহ তা ভাবলেও আমার গা শিউরে উঠে । তারা এমন একটি দিনের আশায় কাজ করছে, যখন তাদের আর আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে না, বরং আমরাই ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করে পরম্পর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। অত্যন্ত সুকৌশলে এবং সুক্ষ্মভাবে এ কাজ করছে তারা। আফসোস, আমাদের জাতির কর্ণধার ও প্রভাবশালী লোকজন এ ব্যাপারে উদাসীন । এ উদাসীনতা না কাটলে এ জাতির ধ্বংস ও বরবাদী কেউ ঠেকাতে পারবে না !
যদি আমরা এখনও সজাগ না হই তবে ইহুদীরা একদিন ফিলিস্তিনের মাটি থেকে মুসলমানদেরকে উচ্ছেদ করবে। তাদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দেবে, ভেড়ার পালের মত হাঁকিয়ে নিয়ে তুলবে উদ্বাস্তু শিবিরে। আর ফিলিস্তিনকে বানিয়ে নেবে নিজেদের মাতৃভূমি। আমাদের প্রথম কেবলা আল আকসা’কে তাদের আস্তাবল বানাবে।
মুসলিম দেশগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করতে থাকবে। অথচ এ কথা কেউ ভাববে না, এই যুদ্ধের পিছনে রয়েছে ইহুদী ও খৃষ্টানদের গোপন চক্রান্ত ।
অর্থ, নারী ও শরাব দিয়ে ওরা যুদ্ধে বিজয়ী হতে চায়। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের আলোকিত জীবন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের বর্তমান প্রজনকে এ লড়াইয়ে জিততেই হবে।
আমি চাই, আকাশে যখন নতুন মাসের চাদ উঠবে তখন যেন সে ক্রাবের দুর্গে আর খৃস্টানের পতাকা দেখতে না পায়।
তার আগেই আমি ক্রাক অধিকার করতে চাই । আমাদের এ অগ্রযাত্রায় যদি দুর্গের পাঁচিল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সে পাঁচিল আমরা গুড়িয়ে দেবো । যদি আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায় খৃষ্টান ফৌজ, আমরা লাশের স্তুপ মাড়িয়ে কেল্লায় ইসলামের ফটক খুলে দেবে সে জন্য আমরা আর অপেক্ষা করবো না। প্রয়োজনে ক্রুসেডদের লাশগুলো আমরা ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে দিয়ে এই মাটিকে পবিত্র করবো। এরপর আমরা নজর দেবো আমরা গাদ্দার ও খৃস্টানদের হাতে ভূলুষ্ঠিত হতে দেবো না।
সুলতান নূরুদ্দিনের সেনাবাহিনীতে ছিল কুশলী অস্ত্র কারিগর। তিনি হুকুম করলেন খেজুরের বড় বড় বৃক্ষ কেটে মেনজানিক তৈরী করো।’
কারিগররা রাতদিন পরিশ্রম করে মেনজানিক তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সৈনিকরা সেই সব মেনজানিক দিয়ে ছুড়ে মারার জন্য ভারী ও বড় বড় পাথর জমা করতে লাগল। তাদের কাছে ছিল সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর রেখে যাওয়া বারুদের স্তুপ। সৈনিকরা সেই বারুদ দিয়ে গোলা তৈরী করতে লাগল ।
ইতিমধ্যে মিশর থেকে সুলতান আইয়ুবীর পাঠানো সেনাবাহিনী এসে রিপোর্ট করল নূরুদ্দিন জঙ্গীর কাছে। এই সৈন্যদের সম্পর্কে বলা হয়েছিল এরা সেনাবিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সুলতান জঙ্গী এদের মধ্যে বিদ্রোহের কোন আলামত দেখতে পেলেন না। বরং তিনি দেখতে পেলেন তাদের চোখে মুখে জেহাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ।
সুলতান জঙ্গীও সুলতান আইয়ুবীর মত দুরদশী ও বিচক্ষণ সেনানায়ক ছিলেন। তিনি সৈন্যদের সামনে আরো আবেগময় বক্তব্য দিয়ে তাদের সে আগুনকে আরো উস্কে দিলেন ।
সূর্য অস্ত গিয়ে রাত নেমেছে ক্রাকের দুর্গে। ক্রুসেড বাহিনীর সেনানায়করা দুর্গের মধ্যে এক গোপন সম্মেলনে বসেছে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার কোন ছাপ নেই। খোশ মেজাজে কথা বলছে সবাই। বুঝা যাচ্ছে, এ অবরোধে তাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তাদের এ খুশির কারণ সালাউদ্দিন আইয়ুবি ময়দান ছেড়ে মিশরে চলে গেছে। শুধু সে একাই যায়নি, সেই সাথে তার পুরো বাহিনীও সে মিশর ফেরত নিয়ে গেছে। তার বদলে এখন অবরোধে নেতৃত্ব দিচ্ছে সুলতান নূরুদিন জঙ্গী এবং তার বাহিনীই এখন লড়াই চালাচ্ছে।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top