৬. আবারো সংঘাত

 সে অস্পষ্ট আলোতেই সুলতান দেখলেন খৃস্টান বাহিনী তৎপর হয়ে উঠেছে। ঢিলেঢালা ভাব কাটিয়ে ওরা তৈরী হচ্ছে যুদ্ধের জন্য। অশ্বারোহীরা চেপে বসছে ঘোড়ায়। ওদের হাতে বর্শা ও তলোয়ার। ওরা সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালো। রিমান্ত দেখলেন তার বাহিনী প্রস্তুত। বললেন, ‘যিশুর সৈনিকরা, সামনে বাড়ো।’

 নড়ে উঠলো বাহিনী। ঘোড়াগুলো পা তুললো সামনের দিকে, ঠিক এই সময় আইয়ুবী বললেন, ‘তীর ছুঁড়ো।’

 সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো মুজাহিদদের তীর বর্ষণ। আইয়ুবীর হুকুম মত প্রথম পশলা গেল পিছন সারির ওপর দিয়ে। ঘোড়ার পিঠেই মুখ থুবড়ে পড়লো খৃস্টান সৈনিকদের সে সারিটি। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘোড়ার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ল নিচে।

 বিরতি ছাড়াই ছুটে এল দ্বিতীয় পশলা। আঘাত করল সাওয়ারহীন ঘোড়াগুলোকে। গায়ে তীর বিদ্ধ হতেই লাগামহীন ঘোড়াগুলো ছুট লাগালো এদিক ওদিক। ডানে, বায়ে, সারির মাঝখান দিয়ে, যেদিক পারলো ছুটলো উর্ধ্বশ্বাসে। বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়লো পুরো বাহিনী জুড়ে। বাহিনীর সামনে থেকে খৃস্টান কমান্ডার বুঝতেই পারলো না, ব্যাপারটা কি? কেন এত বিশৃংখলা?

 সে রাগের মাথায় চিৎকার করে গালাগালি শুরু করে দিল। এর পরের আঘাতটা এল উটের বহরের ওপর। ঘোড়ার মতই উটগুলোও দৌড় লাগালো দিশেহারা হয়ে। ফলে মুহূর্তে সমস্ত সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ল সীমাহীন আতংক।

 এরপর কখনো তীর ছুটে আসতে লাগলো ডান দিক থেকে, কখনো বাম দিক থেকে, কখনো পেছন থেকে। দলে দলে খৃস্টান ফৌজ তীরবিদ্ধ হতে লাগল। তাদের আর্ত চিৎকার প্রভাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিল। যখন ভোরের আলো ফুটে উঠল পাহাড় ও টিলার ফাঁক-ফোকর তখন রিমান্ত পরিষ্কার বুঝতে পারল, খৃস্টান বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর কঠিন বেষ্টনীর মধ্যে আটকা পড়ে গেছে।

 সে জানতে পারল না, কি পরিমান মুসলমান সৈন্য এ অভিযানে অংশ নিয়েছে! তাদের সংখ্যা কি খুবই বেশি? তার মনে হলো, জীবনের অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে তার। জীবনে অনেকবারই মুসলমানদের মুখোমুখি হয়েছে রিমান্ত, কিন্তু এতটা অসহায় অ অনিশ্চয়তা আর কখনো তাকে গ্রাস করেনি। এ যেন এক অবধারিত মৃত্যু ফাঁদ। যে পথে তারা এই গিরি অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল সে পথ আগলে রেখেছে মুজাহিদরা। ডানে-বায়ে পাহাড়ে টিলায় মুসলিম তিরন্দাজ বাহিনী। পাহাড় ও টিলার ফোঁকড় গলে সামনে বেরিয়ে যাবার যে সংকীর্ণ পথ, সে পথও মুজাহিদদের দখলে। খোলা ও সমতল জায়গায় দাঁড়িয়ে মুসলিম তীরন্দাজদের নিশানা হওয়া ছাড়া যেন এখন তাদের আর কিছুই করার নেই।

 রিমান্ত যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরে যাওয়ার জন্য একবার ছুটে গেল সেদিকে, কিন্তু মুজাহিদদের প্রচন্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হলো। যাবার চেষ্টা করলো সংকীর্ণ পথে সামনের দিকে বেরিয়ে যাওয়ার, কিন্তু তাড়া খেয়ে সেখান থেকেও ফিরে এল বাঘের মুখে পড়া ভয়ার্ত হরিনীর মত। ময়দানের মাঝখানে ছুটে এলেই পাহাড়, টিলার পাথর অ ঝোপের আড়ালে থেকে ছুটে আসতো ঝাঁক ঝাঁক তীর।

 মুজাহিদদেরকে আগেই আইয়ুবী সবকিছু বুঝিয়ে সাবধান করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘রিমান্ত আসছে বিপুল শক্তি নিয়ে এবং চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। অতএব তাকে তোমাদের সেভাবেই অভ্যর্থনা জানাতে হবে।’

 সুলতানের কথায় মুজাহিদরা এই আক্রমণকে সানন্দে গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়েই প্রস্তুত হয়েছিল। ফলে রিমান্তের বাহিনীর বিশালতা দেখে তারা মোটেও ঘাবড়ে যায়নি।

 অবরোধকারী মুজাহিদরা এবার খৃস্টানদের সামনে যাওয়ার পথ থেকে সরে গেল। বিজয়ের আশা ছেড়ে ওই পথে পালিয়ে যাওয়ার জন্য রিমান্ত ঘোড়া ছুটালো। পাথর ও ঝোপের আড়ালে বসে মুজাহিদরা যখন দেখলো ধূলির মেঘ তুলে খৃস্টানরা ছুটছে বেস্টনী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তখন তারা সংকেত পাঠালো বেস্টনীর বাইরের মুজাহিদদের কাছে। প্রস্তুত হয়েই ছিল মুজাহিদরা। ধূলার মেঘ নিয়ে যখন অশ্বারোহী দল সেই ফাঁক গলে পরবর্তী বেস্টনীতে বেরিয়ে এল, দু’পাশ থেকে মুজাহিদরা টুটে পড়ল তাদের ওপর। তারা কোথা দিয়ে কেমন করে আক্রান্ত হলো, এ কোথা বুঝার আগেই চোখের পলকে বিপুল সংখ্যক খৃস্টান সৈন্য ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। খৃস্টান সৈন্যরা অনুভব করলো, তারা খাঁচায় বন্দী শিকারের মত অসহায়। এগুনোর পথ রুদ্ধ দেখে আবার পিছনে হটলো ওরা, চলে এল মাঠের ঠিক মধ্যিখানে।

 সমতল এলাকাটি ছিল বেশ বড়সড়। মাঝখানের অনেকটা অংশ দু’পাশের পাহাড় থেকে মারা তীরের আওতার বাইরে থাকায় ওখানে আশ্রয় নিল ওরা।

 সুলতান আইয়ুনী এই যুদ্ধের পরিচালনা ও তদারক নিজেই করছিলেন। সুলতান আইয়ুবীর কৌশল এবারও তাদেরকে ভয়, আতঙ্ক এবং নিরাশার অন্ধকারে ছুঁড়ে মারল। তারা যেদিকেই যায় দেখতে পায় সামনে বাঁধার পাহাড়। মধ্যিখানের ওই নিরাপদ অঞ্চলটুকু থেকে সামান্য এদিক ওদিক হলেই পাশ থেকে ছুটে আসতো ঝাঁক ঝাঁক তীর।

 খৃস্টান সেনাপতি রিমান্ত তার বাহিনীকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ে চড়ার নির্দেশ দিল। হঠাৎ একযোগে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ওরা ছুটল পাহাড়ের দিকে। কিন্তু মুজাহিদদের তীর বৃষ্টি সব কটি দলকেই আবার ফেরত পাঠাল মাঠের মাঝখানে। সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডাররা তাঁর নির্দেশ অনুসারে সামনাসামনি যুদ্ধ করার কোন সুযোগই দিল না খৃস্টানদের।

 বেলা গড়িয়ে চলল। রোদের উত্তাপ বাড়ল। সূর্য উঠে এল মাথার ওপর। খৃস্টানদের ঘোড়াগুলো ক্ষুধা অ পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। সৈনিকরা হয়ে পড়ল ক্লান্ত অ বিপর্যস্ত। তারা চারণভূমি অ পানির সন্ধানে তৎপর হল। দুপুর পর্যন্ত কোন রসদ পৌঁছলো না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল রিমান্ত। কমান্ডারদের ডেকে বৈঠকে বসল। বলল, ‘খাদ্য শস্য তো সকালেই এসে যাওয়ার কথা ছিল!’

 কয়েকজন অশ্বারোহী রসদ নিয়ে আসা বাহিনীর খবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মুসলমান তীরন্দাজদের হাতে মারা পড়ল। কিন্তু যদি তারা জীবিত বেরিয়েও যেতে পারতো, তবু কোনদিন আর তাদের রসদ সামগ্রী নিয়ে আসা বাহিনীর সাক্ষাৎ পেতো না তারা। কারণ রাতের অন্ধকারেই সুলতানের পাঠানো টহল বাহিনী পথিমধ্যে তাদের পাকড়াও করে। তাদের অভিযান ছিল খুবই সফল। রসদবাহী দলটিকে তারা সহজেই ঘায়েল করতে সক্ষম হয়। কাফেলার রক্ষীদের হত্যা করে রাতের অন্ধকারেই তারা খৃস্টানদের সমস্ত রসদপত্র কব্জা করে নিয়ে আসে মুজাহিদ শিবিরে।

 দুপুরের একটু পর সুলতান আইয়ুবী তার সংরক্ষিত সৈন্যদলকে ডেকে পাঠালেন এবং রিমান্তের বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে ঘিরে রাখার নির্দেশ দিতে রাত থেকে যে বাহিনী যুদ্ধ করছিল তাদের নিয়ে তাবুতে ফিরে গেলেন।

 যদি মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা খৃস্টানদের সমানও হতো তবু তিনি সামনাসামনি খৃস্টানদের আক্রমণ করে নিঃশেষ করে দিতেন তাদের। কিন্তু বাহিনী স্বল্পতার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত রইলেন সুলতান। তিনি মুজাহিদ বাহিনীর শক্তি ও সৈন্য অপচয় করতে চান না। তাই শত্রু সেনাদেরকে তিনি আতংকিত ও ব্যতিব্যস্ত রাখলেন ঠিকই কিন্তু তাদের জীবন বায়ু নিভিয়ে দেয়ার জন্য কোন বেপরোয়া পদক্ষেপ ও চূড়ান্ত যুদ্ধে জড়ালেন না। বরং বাঘ যেমন বাগে পাওয়া শিকার নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে থাকে তেমনি তিনিও ময়দানে দুশমনকে সম্পূর্ণ বেষ্টনীর মধ্যে রেখে টিলা ও পাহাড় অঞ্চলের ঝোপের আড়ালে ওঁৎ পেতে বসে রইলেন। তিনি জানতেন, যতই সম্য অতিবাহিত হবে খৃস্টানরা ধীরে ধরে অকেজো হয়ে যাবে।

 কিন্তু খৃস্টানদের এভাবে অবরোধ করে রাখতে গিয়ে তাদের নিজেদেরেও যতেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল। খৃস্টানদের বৃহৎ শক্তিকে বেঁধে রাখতে গিয়ে সুলতানও তার সমস্ত রিজার্ভ আটকে ফেলেছিলেন। এখন এসব সৈন্যদেরকে আর অন্য কোন কাজে ব্যবহার করার সুযোগ থাকল না।

 সুলতান আইয়ুবী রিমান্তের বাহিনীকে আটক করার পর তানুতে ফিরে এসে মূল বাহিনীকে শহর অবরোধ আরো কঠোর ও জোরালো করার আদেশ দিলেন। খৃস্টানরা আর বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেল না। প্রতিদিন কোন না কোন স্থানে মুজাহিদদের আক্রমণ হতেই থাকলো। এভাবেই অতিবাহিত হতে লাগলো একেকটা দিন। সুলতান আইয়ুবী শহর ও কেল্লার চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। কোন স্থান থেকেই দেয়াল ভাঙার কোন সুযোগ দেখা যাচ্ছিল না।

 অবরোধ করার পর ষোল দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় সুলতান নিজের তাবুতে বসে অফিসার ও সহকর্মীদের সাথে কথা বলছিলেন। আলোচনা হচ্ছিল কেল্লায় প্রবেশ করার কি উপায় বের করা যায় এই নিয়ে। সুলতানের এক দেহরক্ষী তাবুর ভেতরে প্রবেশ করে সংবাদ দিল, ‘সুদান থেকে এক দূত এসেছে।’

 আইয়ুবী বললেন, ‘তাকে জলদি ভেতরে নিয়ে এসো।’

 রক্ষী বেরিয়ে যেতেই সুলতান স্বগতোক্তি করে বললেন, ‘আল্লাহ করুন যেন সংবাদ ভাল হয়।’

 কাসেদ ভেতরে এলে সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারলেন। সে কোন সংবাদ বাহক নয়, একটি সেনাদলের কমান্ডার! সুলতান আইয়ুবী অস্থির হয়ে বললেন, ‘কি খবর, তুমি কি কোন সুসংবাদ নিয়ে এসেছো?’

 কমান্ডার না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো, ‘প্রধান সেনাপতি যে সুসংবাদ প্রত্যাশা করছেন তেমন কোন সুখবর এখনো আনতে পারিনি, কারন সুদানে এখনও আমাদের বিজয় অর্জিত হয়নি। আবার এ কারণে সংবাদ খারাপও নয় যে, আমরা এখনও পরাজিত হইনি এবং পিছুও হটিনি।’

 ‘তার মানে পরাজয় অ পিছু হটার আলামত দেখা যাচ্ছে, তাই না?’ সুলতান প্রশ্ন করলেন।

 ‘অনেকটা সে রকমই।’ কমান্ডার উত্তরে বললো, ‘এ অবস্থায় এখন আমরা কি করব এ ব্যাপারে আপনার আদেশ জানার জন্যই আমি এসেছি। আমাদের এখন সেনা সাহায্য ভীষণ প্রয়োজন। যদি আমাদের এই প্রয়োজন পূরণ না হয় তবে পিছু হটা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না আমাদের।’

 সুলতান আইয়ুবী ময়দানের বিশদ বিবরণ শোনার আগেই তার জন্য খাবার আনলেন এবং বললেন, ‘তুমি খেতে থাকো এবং খেতে খেতে ময়দানের খুঁটিনাটি সব আমাকে খুলে বলো।’

 সুলতান আইয়ুবীর অনুপস্থিতিতে তাঁর ভাই তকিউদ্দিন মিশরের শাসক রূপে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি মিশর ও সুদানের সীমানার কাছে ফেরাউনের শাসনকালের কিছু ধ্বংসাবশেষের খবর পান। খৃস্টানরা তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য জঘন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। তারা প্রচার করে যে, ‘এসব প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ দখল করার জন্য সুদান শিঘ্রই মিশর আক্রমণ করতে যাচ্ছে।’

 এ গুজন শোনার পর তিনিই আগ বাড়িয়ে সুদান আক্রমণ করার সংকল্প ঘোষণা করলেন। তাঁর সেনাপতি অ উপদেষ্টাগণ তাকে তাঁর ভাই সুলতান আইয়ুবীর অনুমতি নিয়ে আক্রমণ করতে পরামর্শ দেন। কিন্তু তকিউদ্দিন বললেন, ‘ভাই এখন ক্রুসেডের বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছেন, এ অবস্থায় আমি তাঁকে বিরক্ত করতে চাই না।’ এই বলে তিনি সুদানের ওপর আক্রমণ করে বসলেন।

 তকিউদ্দিন আবেগের উন্মাদনায় আক্রমণ করে বসলেন ঠিকই কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য যে বিচক্ষণতা অ দক্ষতা থাকা দরকারর তা তার ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি, বিচক্ষণতা থাকলে তিনি এই অনাহুত যুদ্ধে জরিয়েও পড়তেন না! যাই হোক, যখন তকিউদ্দিন দেখলেন যুদ্ধের অবস্থা সুবিধের নয় তখন তিনি এই কমান্ডারকে ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। একজন কাসেদ না পাঠিয়ে কমান্ডারকে পাঠানোর কারণ, সে যুদ্ধ ক্ষেত্রের সবিশেষ বর্ণনা সুলতান আইয়ুবীর কাছে বুঝিয়ে বলতে পারবে।

 সুলতান আইয়ুবী আগেই এই যুদ্ধের খবর পেয়েছিলেন। শুধু এতটুকু জানতে পেরেছিলেন, তকিউদ্দিন সুদানের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।

 কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীকে শোনাল যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ। বললো, ‘তকিউদ্দিন বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু আবেগ ও উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে সুদাম আক্রমণের আদেশ দিয়েছিলেন।’

 সুলতান জানতেন, তকিউদ্দিনের চেতনা ও আবেগ সুলতান আইয়ুবীর থেকে ভিন্ন ছিল না, ভিন্ন ছিল দুই ভাইয়ের বিচার-বিবেচনা ও বিচক্ষণতা। তকিউদ্দিন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা সৎ উদ্দেশ্যে এবং ইসলামী প্রেরণা থেকেই নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছিলেন। নিজের গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট এবং উপদেষ্টাদের মতামতের ওপর পূর্ণ গুরুত্ব ও খেয়াল দেননি।

 তিনি শুধু সেই রিপোর্টের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, যাতে সুদানীদের ট্রেনিং নেওয়া এবং আক্রমণের প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে। তকিউদ্দিন শত্রুদেরকে প্রস্তুত হওয়ার আগেই বশীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু এর শেষ পরিণাম কি তা জানার চেষ্টা করেননি। সুদানীদের সামরিক শক্তি কেমন ও কত বেশি তাও খতিয়ে দেখতে চেষ্টা করেননি তিনি। বুঝতে চেষ্টা করেননি, তারা যুদ্ধে কত শক্তি প্রয়োগ করবে এবং কত শক্তি রিজার্ভ রাখবে। তাদের কি পরিমাণ অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম আছে তারও খবর নেননি। জানতে চাননি তাদের অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী কত? তার চেয়েও বড় কথা, ময়দানে কি ধরণের প্রতিরোধের মোকাবেলা তাকে করতে হনে সে কথা না জেনেই তিনি আক্রমণের হুকুম দিয়েছিলেন। এমনকি মিশরের রাজধানী থেকে সে অঞ্চল কর দূরে এবং কেওম করে সেখানে নিজেদের রসদপত্র পাঠাবেন এর কিছুই না ভেবেই তিনি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

 সুদানীরা তকিউদ্দিনের বাহিনীকে সীমান্তে কন বাঁধা প্রদান করল না। তারা তাকে সুদান সীমান্ত থেকে দূর পর্যন্ত ভেতরে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দিল। শেষে এমন এক স্থানে এনে ফেললো, যেখানে নিষ্ঠুর মরুভূমি তাদের মৃত্যুর জন্য ভয়াল ফাঁদ পেতে রেখেছে। যেখানে প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই, নেই এক ফোটা পানির ব্যবস্থা।

 তকিউদ্দিনের বাহিনী প্রকৃতপক্ষে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর রণ কৌশল অনুযায়ী যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার এবং সংখ্যায় কম হয়েও শত্রুর বড় বড় বাহিনীকে তছনছ করে দেয়ার সামর্থ্য রাখতো। তবে এ জন্য কুশলী সেনানায়কের নেতৃত্বের প্রয়োজন। এ সৈন্যদলকে শুধুমাত্র সুলতান আইয়ুবীই কমান্ড ও ব্যবহার করতে পারতেন।

 সুলতান আইয়ুবী সম্মুখ যুদ্ধের সংঘর্ষ সবসময় এড়িয়ে চলতেন। তিনি সৈন্যদের প্রস্তুত করেছিলেন কমান্ডো লড়াইয়ের উপযুক্ত করে। ক্ষিপ্রতা, গতিশীলতা ও অতর্কিতে আঘাত হানা (_______) এ বাহিনীর কোন জুড়ি ছিল না। কিন্তু তকিউদ্দিন কৌশলবিহীন শুধু সৈন্য সমাবেশ করে যুদ্ধ করায় অভ্যস্ত ছিলেন। এ বাহিনীতে দক্ষ, পরীক্ষিত ও জানবাজ সৈন্য ছিল। কিন্তু তাদের সঠিক ব্যবহার করার নেতা একমাত্র সুলতান আইয়ুবীই ছিলেন।

 সুদানে আক্রমণ করা মানে, সুলতান আইয়ুবীর এক বিরাট বাহিনীকে বেহুদা বন্দী করে রাখা। খৃস্টানরা এটাই চাচ্ছিল। আর এ জন্যই তারা এরকম চাল চেলেছে। তকিউদ্দিনের বাহিনীকে কৌশলে সুদানের গভীর অভ্যন্তরে নিয়ে তাদের মনোপুত স্থানে কার্যত বন্দী করে রেখেছে। আর তাদের ওপর সুলতান আইয়ুবীর কৌশল অবলম্বন করে রাতের অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণ চালাচ্ছে। তকিউদ্দিন উট, ঘোড়া এবং সৈন্যদের জন্য এক ফোটা পানিও পাচ্ছে না কোথাও।

 কমান্ডো বাহিনীর সালার অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করে এক সময় বললো, ‘আমাদেরকে আপনি মরুভুতিতে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিন। আমরা মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের মত সরে পড়বো। এরপর অতর্কিত হামলার মোকাবেলায় আমরাও ওদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাবো এবং কাছ থেকেই ছিনিয়ে আনবো আমাদের খাদ্য ও পানীয়।’

 কিন্তু তকিউদ্দিন এতে বাহিনী সংকোচিত হয়ে পড়বে বলে আশংকা করলেন। ভাবলেন, এতে কেন্দ্রীয় কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সম্মিলিত শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে। ফলে, তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং এ ধরনের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিতে বললেন তাকে।

 যখন রসদপত্র বা খাদ্যশস্যের প্রশ্ন উঠে তখন তাদের মনে জেগে ওঠে অজানা শংকা। তারা বর্ডার থেকে এত দূরে চলে এসেছে যে, স্বাভাবিক অবস্থায়ও এখানে রসদ পৌছতে কয়েক দিন লেগে যাওয়ার কথা। আর এখন তো রাস্তায় রসদ বহর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ষোলআনা। যে কোন জায়গায়, যে কোন সময় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা আছে। এ আতংকজনক অবস্থায় পথ চলা নিরাপদ নয় বলেই বহরের প্রতিটি সৈনিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।

 কমান্ডো বাহিনীর এ আশংকা অচিরেই সত্য প্রমাণিত হলো। একদিন তারা খবর পেলো, তাদের খাদ্যশস্যবাহী বহর আক্রান্ত হয়ছে এবং শত্রুরা সমস্ত খাদ্যশস্য, রসদপত্র ও বাহনের জন্য নিয়ে আসা পশু লুট করে নিয়ে গেছে। এ ঘটনার পর কমান্ডো বাহিনীর প্রধান আবারো তকিউদ্দিনের কাছে তার প্রস্তাব পেশ করল। কিন্তু তকিউদ্দিন এ প্রস্তাব তো গ্রাহ্যই করলেন না বরং এ জন্য তাকে তিরষ্কার করলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও তকিউদ্দিনের সাথে তার বাকবিতণ্ডা হলো এবং তকিউদ্দিন তাকে কড়া ধমক লাগালেন।

 কমান্ডার বললো, ‘আমরা আপনার নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে এসেছি, যুদ্ধ করবো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, শত্রুরা রাতের আঁধারে এসে আমাদের খাদ্যশস্য লুট করে নিয়ে যাবে আর আমরা তা চুপ করে দেখবো। লড়াইয়ের স্বার্থে আপনাকে কোন পরামর্শ দিতে পারবো না।’

 তকিউদ্দিন ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘তুমি সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছো। তোমার কাছ থেকে আমার যুদ্ধ করা শিখতে হবে না।’

 কমান্ডার উত্তরে বললো, ‘আমাকে মাফ করবেন, আপনি সুলতান তকিউদ্দিন, সুলতান সালাহউদ্দিন নন। আমরা যুদ্ধ করতে শিখেছি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছ থেকে, আপনার কাছ থেকে নয়। সিপাহসালার হিসেবে তিনি আমাদেরকে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছেন আমরা সে ভাবেই যুদ্ধ করতে চাই। সা জীবন আমরা কমান্ডো ট্রেনিং পেয়েছি। আমরা শিখেছি কি করে শত্রুর পেটের মধ্যে ঢুকে তাদের পেট কেটে বেরিয়ে আসতে হয়। আপনার সৈন্যরা ক্ষুধায় মরছে আর তাদের খাবার ও রসদপত্র শত্রুরা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা শত্রুদের রসদ ছিনিয়ে নিয়ে নিজের সৈন্যদেরকে পেট ভরাতে অভ্যস্থ।’

 তকিউদ্দিনের চোখে পানি এসে গেল। তিনি জানতেন কমান্ডার কি প্রেরণা ও আবেগ নিয়ে কথা বলছে। রাগের পরিবর্তে তার মাঝেও এসে ভর করলো আবেগ। তিনি সেই আবেগ দমন করে বললেন, ‘আমি সেই জাতি বারিতালাকে ভয় করি। নিজে নিরাপদ অবস্থানে থেকে আমি এই জানবাজদের কি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেই বলো?’

 ‘এ কথা আপনার আগেই ভাবা উচিত ছিল। এভাবে আপনার আক্রমণ করা উচিত হয়নি। কিন্তু এখন আর এ কথা ভেবে লাভ নেই। আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে আল্লাহর নামে জীবন কুরবানী করতে ভয় পায়। মুজাহিদ যতবেশী মৃত্যুর কাছাকাছি হয় ততই সে আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করে। আমরা এখন দুশমনদের ফাঁদে পড়ে আছি। এ অভিযানে আমরা যদি বিজয় অর্জন করতে না পারি তবে শাহাদাতের গৌরব থেকে কেউ আমাদের বঞ্চিত করতে পারবে না।’

 তকিউদ্দিন আগেবপ্রবণ হলেও বুদ্ধি বিবেক সবটাই গুলিয়ে ফেলেননি। তার মনে পড়ল সুলতান আইয়ুবীর নসিহত, ‘নিজেকে একজন বাদশাহ মনে করে কারও ওপর আদেশ চাপিয়ে দিও না। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে নিজের ভুল গোপন করো না।’

 তিনি কমান্ডারের রূঢ় আচরণে অপরাধ নিলেন না। বরং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সালাদের ডেকে পরামর্শে বসলেন। যুদ্ধের অবস্থা ও পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে খোলাখুলি আলোচনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, যে কোন আকস্মিক হামলার যথাযথ জওয়াব দেয়া হবে। এ জন্য কমান্ডো বাহিনীকে মূল বাহিনী থেকে সরিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া হবে। তারাই মোকাবেলা করবে অতর্কিত আক্রমণের। রসদ আসার রাস্তা কমান্ডো বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া হবে। পুরো রাস্তায় টহল বসাবে কমান্ডো বাহিনী।

 সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হবে। তিন দিক থেকে তারা আক্রমণ চালিয়ে যাবে শত্রুদের ওপর। তকিউদ্দিনের সাথে থাকবে রিজার্ভ বাহিনী। রিজার্ভ বাহিনীতে সৈন্য থাকবে খুবই কম।

 এই বিভক্তি ও ব্যবস্থাপনায় উপকার হলো এই যে, সেনাবাহিনী দুর্গম ঊষর মরু এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ পেল। যে দুর্গম টিলা, পাহাড় ও বালির সমুদ্রে আটকা পড়ে পানির অভাবে মারা পড়ার অবস্থা হয়েছিল তাদের তীর থেক্র বাঁচার সম্ভাবনা উঁকি দিল এর ফলে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যার যার গ্রুপে শামিল হয়ে সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়ল মরুভূমিতে। শত্রুরা তিনটি দলের সাথেই মোকাবিলায় নামল এবং তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল। মুজাহিদরাও শত্রুর সাথে তাল রেখে সুবিধাজনক অবস্থানের দিকে সরে যেতে লাগল।

 কমান্ডো বাহিনী এবার নিজেদের ফর্মে চলে এল। তারাও বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে দুশমনের ওপর আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী তাদের শিখিয়েছিলেন কেমন করে ঝটিকা হামলা চালাতে হয়। কেমন করে বিশাল বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে মুহূর্তে সবকিছু তছনছ করে আবার ফিরে আসতে হয় নিরাপদ দূরত্বে। কমান্ডো বাহিনী এবার সেভাবেই আঘাত হানতে শুরু করল দুশমনদের ওপর। কিন্তু তারপরও স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল, সুদানীদের বিশাল বাহিনীর সাথে এ যুদ্ধে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

 কারণ ইতিমধ্যেই মুজাহিদদের খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেনা সংখ্যাও নেহায়েতই অপ্রতুল। এ সময় বাইরে থেকে সেনা সাহায্য পাওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। বাধ্য হয়ে কমান্ডোরা রাতে আক্রমণ চালাতো আর খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহ করে মুহূর্তেই সরে পড়তো সেখান থেকে। দুশমনদের বিনাশ করার চেয়ে তাদের দৃষ্টি থাকতো দুশমনদের খাদ্য ও রসদের দিকে। ফলে দুশমনকে ঘায়েল করার মত অবস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব হতো না তাদের পক্ষে। তারা যে খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহ করতে পারতো তা পৌঁছে দিত অন্যান্য গ্রুপ ও সৈন্য দলে।

 তকিউদ্দিনের আশংকা ক্রমেই সত্যে পরিণত হতে লাগল। কেন্দ্রীয় কমান্ড শেষ হয়ে গেল এরই মধ্যে। তকিউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলেন এখান থেকে ওখানে। এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন, মুজাহিদরা তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মরুভূমির বালুকারাশি শিক্ত করবে কিন্তু কোন একটি ক্ষুদ্র দলও শেষ পর্যন্ত আস্ত্র সমর্পণ করবে না।

 লড়াই বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। মুজাহিদরা আরো ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেল এবং লড়াই অব্যাহত রাখলো। ফলে সুদানের ব্যাপক এলাকায় এ খন্ড খন্ড লড়াই চলতেই থাকলো। কিন্তু কোন সেক্তর থেকেই এমন কোন সংবাদ এলো না, কোন সৈন্যদল অমুক জায়গায় অস্ত্র সমর্পণ করেছে।

 মুজাহিদ বাহিনীর কমান্ডাররা নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকলো। নিয়মিত বাহিনীও এবার অতর্কিত আক্রমণের পথ ধরলো। সবারই অটুট সংকল্প, যে করেই হোক যতক্ষণ তারা বেঁচে থাকবে ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, কিন্তু কেউ সুদান ছেড়ে যাবে না বা আত্নসমর্পণ করবে না।

 এ ধরণের আক্রমণের ফলে শত্রুদের সমূহ ক্ষতি হচ্ছিল। শেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে গেল যে, শত্রুরা মুসলিম সেনাদের সুদান থেকে বের করে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। মুসলিম সেন দল মরুভূমি, পাহাড়, জঙ্গল এমনকি লোকালয়েও ছড়িয়ে পড়লো। তবে বাহিনীর কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আর বজায় থাকল না। কোন গ্রুপ কোথায় কিভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বা আঘাত হানছে অন্য গ্রুপ সে খবর জানতে পারছে না। বিশেষ করে তকিউদ্দিন যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি বেখবর হয়ে পড়লেন। তার কাছে এখন আর যুদ্ধের কোন সংবাদ আসছে না। সৈন্যদের জান-মালের ক্ষতির পরিমাণ কত, কত সৈন্য বেঁচে আছে এ ব্যাপারেও তিনি এখন আর কিছুই জানেন না। কিন্তু শত্রুদের পেরেশানি দেখে বুঝা যায়, তারা এখন মুজাহিদদের সামাল দিতে গিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে। তারা যে আর মিশর আক্রমণ করবে না তাদের অবস্থা দেখেই এ কথা বলে দেয়া যায়। কিন্তু এ পদ্ধতির যুদ্ধে কোন বড় ধরনের লাভের আশা করা সম্ভব না। কারণ, এভাবে কোন এলাকায় নিজেদের দখল কায়েম করা যায় না, অথচ যুদ্ধে সৈন্য সংখ্যা ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যায়।

 এই অবস্থায় এসেই তকিউদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর কাছে জরুরী খবর পাঠানোর তাগিদ অনুভব করেন। ফলে একজন কমান্ডারকে সবকিছু বুঝিয়ে সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

 কমান্ডার সুলতানকে বললো, ‘সুদানে সফলতা তখনি সম্ভব যখন ওখানে সেনা সাহায্য পাঠানো যাবে। ওখানকার সমস্ত সৈন্যই এখন পরষ্পর বিচ্ছিন্ন। সবাই কমান্ডো স্টাইলে লড়াই চালিয়ে গেলেও সম্মিলিত বাহিনী হিসাবে তাদের এখন একত্রিত করা সম্ভব নয়। বিক্ষিপ্ত এ বাহিনীকে রক্ষা করতে হলে অনতিবিলম্বে ওখানে একটি সেনাদল পাঠানো প্রয়োজন।’

 কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীকে আরো জানালো, ‘তকিউদ্দিন এ কথাও জেনে যেতে বলেছেন, যদি সেনা সাহায্য পাওয়া সম্ভব না হয় তবে কি তিনি এই বিচ্ছিন্ন বাহিনীকে মিশরে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন?’

 মিশরে যে সৈন্য ছিল সে সৈন্য দ্বারা মিশরের অভ্যন্তরীণ ও বর্ডার নিয়ন্ত্রনই যথেষ্ট নয়। ফলে সেখান থেকে সৈন্যদের সমর সেক্টরে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আবার সুলতান আইয়ুবী সৈন্যদের পিছু হটারও সমর্থক নন। ফলে তাঁর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে গেল যে, তিনি তাঁর ভাইকে পিছু হঠার আদেশ দেবেন্ম না দেবেন না। যেখানে এখন তাঁর নিজেরই সেনা সাহায্য প্রয়োজন সেখানে তিনি কিছুতেই তাঁর ভাইকে সেয়া সাহায্য দিতে পারেন না। আর যদি তাই হয় তাহলে তাদের পিছু হটার আদেশ দেয়া ছাড়া এ মুহূর্তে তিনি আর কি করতে পারনে? বাস্তবতা বলছে, মুজাহিদ কখনো ময়দানে পিঠ দেখাতে পারে না, এমন হুকুম তিনি কিছুতেই দিতে পারেন না। তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন।

 তকিউদ্দিনের কাসেদ সুলতান আইয়ুবীর কাছে যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলো। কিন্তু সেখানে যে এরই মধ্যে গুপ্ত হত্যা শুরু হয়ে গেছে সে কথা তার জানা ছিল না, ফলে এ ব্যাপারে সে সুলতানকে কিছুই বলতেও পারেনি। এসব কথা আরো অনেক পড়ে সুলতানের গোচরে আসে।

 তকিউদ্দিনের বাহিনী তখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কোথাও এক জায়গায় সুস্থির হয়ে বসে না থেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওরা। কখনো তাদের সামনে পড়তো যাযাবরদের ঝুঁপড়ি ও তাবু। কোথাও সবুজ শ্যামল মাঠ ও শস্য ক্ষেত। তবে অধিকংশ এলাকাই ছিল অনুর্বর, জনবসতিহীন এবং নিরেট মরুময় অঞ্চল।

 এক সন্ধ্যায় মুজাহিদ বাহিনীর তিনজন কমান্ডো তাদের এক সিনিয়ির অফিসারের কাছে ফিরে এলো। তাদের মধ্যে দুজন আহত। তারা বললো, ‘একুশজন মুজাহিদ ও একজন কমান্ডার নিয়ে মোট বাইশজনের একটি দল ছিল ওদের। দিনের বেলা দলটি এক জায়গায় লুকিয়ে ছিল। দলের কমান্ডার পাহারা দেয়ার ছলে এদিকে ওদিক টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল।

 এক সুদানী উষ্ট্রারোহী সেখান দিয়ে যাবার সময় কমান্ডারকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কমান্ডার তার কাছে গেলে তারা পরস্পর কথা বলল। কিন্তু দলে থেকে অনেক দূরে থাকায় তারা কি কথা বলেছে জানা গেল না। উষ্ট্রারোহী চলে গেলে দলের কমান্ডার এসে সুসংবাদ দিলো, দুই মাইল উত্তরে নাকি একটি গ্রাম আছে, সেখানে শুধু মুসলমানরাই বসবাস করে। উটের আরোহী সে গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনি আমাদের সবাইকে তাদের গ্রামে দাওয়াত করেছেন। বলেছেন, গ্রামের কাছেই নাকি দুশমনের একটি ঘাঁটি আছে। আমরা গেলে শত্রুর সে ঘাঁটি নাকি তারা চিনিয়ে দেবে। আমি তার দাওয়াত কবুল করেছি।’

 ‘তাহলে তো ভালই। পেটও ভরবে হাতও লড়বে।’

 ‘হ্যাঁ, রাতে গ্রামবাসী সবাইকে মেহমানদারী করার পর অভিযানের সময় যুবকরা নাকি আমাদের সঙ্গ দিতেও রাজি হবে।’

 মুজাহিদরা সকলেই খুব খুশি হলো এই ভেবে যে, সেখানে খাওয়া-দাওয়া, আদর-আপ্যায়ন ছাড়াও শত্রুদের ওপরে আক্রমণের সুযোগও থাকবে।

 সূর্য ডোবার সাথে সাথেই তারা সেই গ্রামের দিকে রওনা হলো। সেখানে দিয়ে দেখতে পেল শুধু তিনটি যাযাবার ঝুঁপড়ি। ঝুঁপড়ির আশেপাশে গাছপালা ও পানির ব্যবস্থাও আছে। সৈন্যদেরকে ঝুঁপড়ির বাইতে তাবু টানাতে বলা হলো।

 সুদানী লোকটি কমান্ডারকে একটি ঝুঁপড়ির মধ্যে নিয়ে গেল। বাইরে মশাল জ্বালিয়ে দেয়া হলো এবং সকলকে বেশ আদর আপ্যায়ন করেই খাওয়ানো হলো। দলের কমান্ডার বললো, ‘তোমরা সবাই শুয়ে পড়ো। যখন আক্রমণের সময় হবে তখন তোমাদের জাগিয়ে দেয়া হবে।’

 ক্লান্ত সৈনিকরা শুয়ে পড়লো। এই আগত তিনজনের মধ্যে একজনে তখনও ঘুম আসেনি, হঠাৎ পাশের ঝুঁপড়ির মধ্যে নারী কণ্ঠের হাসির ঝংকার শুনতে পেয়ে সে উঠে বসলো। উঁকি মেরে দেখলো, তাদের কমান্ডার সুন্দরী দুই নারীর সাথে হাসাহাসি করছে আর শরাব পান করছে। মেয়েরা যাযাবরদের পোশাক পড়ে থাকলেও স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল, তারা যাযাবর কন্যা নয়।

 এ সময় সৈনিকটির কানে ভেসে এল দূর থেকে লোকজনের কথা বলার অনুচ্চ শব্দ। সেদিকে তাকাতেই চাঁদের আলোতে সে দেখতে পেল, মরুভূমির ঠাণ্ডা বালি মাড়িয়ে কিছু লোক বর্শা ও তলোয়ার হাতে এদিকেই আসছে। একবার ভাবলো অভিযানে অংশ নেয়ার জন্য আসছে ওরা, তারপরই তার মনে কেন যেন সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সে ঝুঁপড়ির পিছনে গাছের ছায়ায় অন্ধকারে দিয়ে লুকিয়ে পড়লো। দেখতে দেখতে লোকগুলো ঝুঁপড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো।

 যে ঝুঁপড়িরতে কমান্ডার মদপান করছিল তার থেকে একটু দূরে আরেকটা ঝুঁপড়িতে ঢুকল একজন লোক। ওখানে কি হচ্ছে দেখার কৌতূহল জাগলো লুকিয়ে থাকা সৈনিকটির মনে, সে গাছের ছায়ার আড়াল নিয়ে অন্ধকারে সন্তর্পনে তার কাছে গিয়ে বেড়ার ফুটোতে চোখ রাখল।

 দেখল, লোকটা ঘরে ঢুকেই সেই সুদানীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুদানী বললো, ‘তোমরা এসে পড়েছো?’ ভালই হল, সবাই ঘুমিয়ে আছে। যাও, শেষ করে দাও সব কজনকে।’

 কমান্ডারের ঘর থেকে মেয়েদের হাসির ফোয়ারা ছুটছে যেন। রিনিঝিনি চুড়ির আওয়াজ ও হাসির কলাকাকলিতে মনে হয় ওখানে উৎসব জমে উঠেছে। মেয়েদের হাসির সাথে কমান্ডারের হাসিও বেরিয়ে আসছে বাইরে

 লোকটি বেরিয়ে এল বাইরে। সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘুমন্ত মুজাহিদদের ওপর। কেউ কেউ ঘুমন্ত অবস্থায়ই ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। কেউ হয়তো হাঙ্গামা শুনে জেগে উঠে বিস্ময়বিস্ফারিত চোখ মেলে রেখেই পাড়ি জমাল পরপারে। যারা এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারল, মুহূর্তেই তারা তলোয়ার বের করে প্রতিহত করল আততায়ীদের আঘাত। পুরো ঘতনাটি ঘটে গেল যেন চোখের পলকে। সৈনিকটি তার সঙ্গীদের সতর্ক করারও সময় পেল না।

 ঘটনার আকস্মিকতায় সৈনিকটি সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিল। তলোয়ারের ঠোকাঠুকি, আহতদের চিৎকার ও আততায়ীদের অট্টহাসি শোনা ছাড়া সে এখন কি করবে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না। হঠাৎ দেখল, দুজন আহত মুজাহিদ তাবু থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে পালিয়ে যাবার জন্য ভো-দৌড় লাগিয়েছে একদিকে। সম্বিত ফিরে এল তার। সেও ছুটলো তাদের পিছু পিছু। যখন সে তাদের সাথে মিলিত হলো ততক্ষণে তারা অনেক দূরে চলে এসেছে। ও দেখল, সঙ্গীরা দু’জনই আহত, তবে কেউ তাদের অনুসরণ করছে না দেখে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।

 অফিসারের এক প্রশ্নের জবাবে সে আরো বললো, ‘কমান্ডার উটের আরোহীর দেয়া লোভ লালসায় পড়ে গিয়েছিল, নাকি সে আগে থেকেই শত্রুদের এজেন্ট ছিল এবং নিজের বাহিনীকে ধংস করার সুযোগ খুঁজছিল এ ব্যাপারে আমার কোন ধারনা নেই।’

 অফিসার বুঝল, ঘটনা যা-ই হোক, শত্রুরা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সৈন্যদেরকে নির্মূল করতে বাঁকা পথ ধরেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সম্মুখ লড়াই রূপান্তরিত হয়েছিল চোরাগুপ্তা হামলায়, এবার সে হামলা রূপান্তরিত হলো কুটিল সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্রে। এ লড়াইয়ের অস্ত্র এখন মেয়ে আর মদ। মুজাহিদ তীর, তলোয়ার আর বর্শার আঘাত মোকাবেলা করতে পারে, কিন্তু মেয়ে আর মদের মোকাবেলা করবে কি দিয়ে?

 এ বড় কঠিন যুদ্ধ। সুলতান আইয়ুবী এ লড়াই সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাই তার বাহিনীতে অস্ত্র প্রশিক্ষণের সাথে সাথে নৈতিকতারও প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। কিন্তু ক্ষুধা সহ্য করা বড় কঠিন কাজ। পেটের খিদে আর দেহের খিদে বার বার মানুষকে আক্রমণ করে। শত্রুরা মানুষের এই প্রাকৃতিক দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করছে পাশবিক ক্ষুধা উস্কে দেয়ার কাজে। মুজাহিদদেরকে তারা প্রাণে না মেরে ঈমানে মারার ফন্দি এঁটেছে। এ ভয়ংকর যুদ্ধে আত্নরক্ষার একমাত্র অস্ত্র শাণিত ঈমান। ইমানের বর্মে দেহকে আবৃত করতে না পারলে এর থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কোন অফিসার যাতে এ বর্ম দেহ থেকে খুলে রাখতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন সুলতান।

 অফিসার ভাবলেন, আমাদেরও এবার এদিকে নজর দেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ এরই মধ্যে এ ধরনের আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথম ঘটনাটি শোনার পর সালার এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করেছিলেন। কিন্তু একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকাই প্রমাণ করে এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আতাউল হাশেমের ঘটনাটিও তেমনি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।

 আতাউল হাশেম কমান্ডো গ্রুপের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন। সেদিন তিনি এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তার বাহিনী কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে আরাম করছিল। এ রাস্তাটিই মিশর থেকে রসদ নিয়ে আসার রাস্তা। রসদ নিয়ে আসার পথের নিরাপত্তা বিধানের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছিল ওদের। ইতিমধ্যে কয়েকবারই রসদবাহী দলের ওপর চোরাগুপ্তা হামলা হয়েছে। তাদের নিরাপত্তা বিধান করাই ছিল দলটির কাজ।

 রসদ বহনকারী দলের ওপর শত্রুরা হামলা করলে তাঁর জানবাজ কর্মীরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করতো তাদের। সুদানীরা অনেক চেষ্টা করেও এই কমান্ডোদের নিঃশেষ করতে পারেনি। বর্তমানে আতাউল হাশেমের নেতৃত্বে একশোর কিছু কম কমান্ডো কাজ করছে। রাস্তার একটি দীর্ঘ এলাকায় তারা টহল দেয়ারও ব্যবস্থা নিয়েছে।

 আতাউল হাশেম রাস্তা থেকে একটু দূরে টিলার মধ্যে এক গোপন আস্তানা গেড়েছিলেন। আস্তানার বাইরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে তাঁর ছয় সাতজন জানবাজ সৈনিক। আস্তানাটিকে তিনি আঞ্চলিক ফাঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করছিলেন।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top