৫. ভয়াল রজনী

জাহেদীন বললো, ‘আপনার কথা আমার মনে থাকবে সুলতান। এবার বলুন, ওখানে যে যুবক তৈরী হয়েছে ওদের আমরা কিভাবে ব্যবহার করবো’?

‘ওদের উত্তেজিত করো না। ওদের ভেতর সঠিক চিন্তা করার যোগ্যতা সৃষ্টি করো। কি করতে হবে অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা সেটা নিজেরাই ঠিক করে নেবে। আবেগ দিয়ে কোন কিছু করা যাবে না।

ওখানে আরও বেশী করে গোয়েন্দা পাঠাও। দুশমন আমাদের নয়, আমাদের যুবকদের কর্মধারা নষ্ট করে দিতে চাইছে। ওরা জানে কোন জাতিকে পরাভুত করতে চাইলে সে জাতির যুব সমাজের মন-মানসিকতায় বিলাসিতা ঢুকিয়ে দিলে ওরা তখন যুদ্ধ আর কর্মের ময়দান থেকে নিজেরাই সরে দাঁড়াবে।

আরাম আয়েশ আর বিলাশদ্রব্য তাদেরকে জনগন থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। স্বার্থ চিন্তা তাদের সাধারন মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। তারা তখন শুধু নিজেরা নয়, নিজেদের মেয়েগুলোকেও অন্যের হাতে তুলে দেবে প্রগতি আর সভ্যতার দোহাই দিয়ে।

তারা তখন কতটা খারাপ হতে পারে সে তুমি ভাবতেও পারবে না। তুমি যাকে ভাল মানুষ ও সম্মানিত মানুষ ব্যক্তি বলে সমীহ করবে, সে তাদের ততটুকু ভাল যে, সে মানুষকে ভাল কাজের উপদেশ দেবে। তার নিজের স্বার্থ ও আনন্দের ব্যাঘাত সৃষ্টি না হলে, সে মনে মনে পৃথিবীর সব মানুষ ভাল হয়ে যাক এটাও চাইতে পারে। কিন্তু নিজের স্বার্থে আঘাত লাহলে তাও করবে কিনা সন্দেহ। নিজের চোখের সামনে ওরা তখন নিজের যুবতী বোনদের উলঙ্গ নাচিয়ে গর্ভবোধ করবে’।

বলতে বলতে হঠাত সুলতান বলে উথলেন, ‘ক্রাকের যেসব যুবক অস্ত্র তৈরী করছে তাদের কাছে কোমায় ব্যবহৃত তরল জ্বালানী পৌছে দিয়ে তার ব্যবহার শিখাতে বলেছিলাম, তা কি করা হয়েছে’?

‘জী সুলতান, এ তরল জ্বালানি তৈরীর পদ্ধতি ওদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। খবর পেয়েছি, ওখানকার মুসলমানগন এরই মধ্যে তা তৈরী করা শুরুও করে দিয়েছে’।

ক্র্যাকে হঠাৎ এমন একটি ঘটনা ঘটলো যাতে সেখানকার যুবকরা উত্ততেজিত হয়ে পড়লো। অবস্থা এমন নাজুক পর্যায়ে গিয়েছিইল যে, যুব সমাজকে বাধ্য হয়ে এক কটিন সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হল।

খৃস্ট্রানরা তাদের অধিকৃত এলাকায় যে সব মুসলিম কাফেলা যাতায়াত করতো সে সব কাফেলা লুট করা শুরু করে দিয়েছিল। মুসলিম ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ভ্রমনকারীদের নিয়ে তৈরি হত এ সব কাফেলা। সংখায় দেড় থেকে দুইশ হলেই রওয়ানা করে দিত এই সব কাফেলা। কাফেলায় থাকতো উট, ঘোড়া এবং ব্যবসার মালপত্র। দুই চারটে পরিবারও থাকতো কাফেলার সাথে। খৃস্টানদের নির্যাতনের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে মুসলমান প্রধান অঞ্চলে হিজরতের জন্যই এরা কাফেলায় শামিল হতো।

প্রতিটা কাফেলায় সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা থাকত। ফলে, সাধারন ডাকাত দল এসে কাফেলা লুট করার সাহস পেত না। খ্রিইস্টানরা সেনাবাহিনীকে এসব কাফেলা লুন্ঠনের দায়িত্ব দিল। ফলে মুসলমানদের কোন কাফেলার কোন সন্ধান পেলেই খ্রিইস্টান সৈন্যরা বেদুইন ছদ্মবেশে লুটতরাজ করার জন্য কাফেলার উদ্দেশ্যে ছুটে যেত।

যেসব খ্রীষ্টান সম্রাটগণ ইতিহাসের পাতায় আজো হিরো সেজে বসে আছেন, এসব লুণ্ঠন ছিল তাদেরই পরিকল্পনার ফসল। লুটের মাল থেকে তারাও নিয়মিত ভাগ পেতো।

কিছু কিছু মুসলমান আমীর ওমরাও এসব অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। এরা ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম প্রদেশের শাসক। ওদের ছিল নিজস্ব সেনাবাহিনী।

লুণ্ঠিত কাফেলার কেউ এসে এ সব মুসলিম শাসকের কাছে অভিযোগ করলে তারা তা শুনেও না শোনার ভান করতো। কারণ লুণ্ঠনকারী খ্রীষ্টানদের পক্ষ থেকে ওদেরকে দেয়া হতো মদ, নারী ও স্বর্ণমুদ্রা।

ইচ্ছে করলে এসব শাসকরা খ্রীষ্টানদের লুটতরাজ বন্ধ করতে পারতো। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে মোটেই আগ্রহ প্রকাশ করল না।

শাসকদের মনোভাব জানতো বলেই কখনও কখনও এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্যের ভেতরে এসেও খ্রীষ্টান সন্যরা মুসলিম কাফেলার ওপর হামলা করতে দ্বিধা বোধ করতো না।

মুসলিম শাসকদের এ দুর্বলতার সুযোগে খ্রীষ্টান সম্রাটগণ এবার মুসলিম রাজ্য সমূহের সীমান্ত হজম করতে শুরু করলো। কোন কোন মুসলিম শাসক এ অবস্থায় খ্রীষ্টানদের আনুগত্য স্বীকার করে তাদেরকে কর দেয়া শুরু করলো। এভাবেই ক্রমে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে আসতে লাগলো মুসলিম রাজ্যের সীমানা।

নূরুদ্দীন জংগী এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবী এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো খ্রীষ্টানদের হাতে তুলে দেয়ার পরিবর্তে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। তাদের কাছে এসব মুসলিম শাসকরা ছিল খ্রীষ্টানদের চাইতেও বিপজ্জনক।

সুলতান আয়ুবীর কাছে লেখা এক চিঠিতে নূরুদ্দীন জংগী লিখলেন, ‘বিলাসিতা এব ভোগের জন্য এসব মুসলিম শাসকবর্গ ইসলামী রাজ্যগুলো খ্রীষ্টানদের কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছে।

খ্রীষ্টনরা ওদেরকে ধন-সম্পদ এবং অপহৃত মুসলিম যুবতী উপহার দিয়ে অন্ধ করে ফেলেছে। এদের হাতেই এখন বেশী করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান পবিত্র ইসলাম। এরা কাফের বেঈমানদের চাইতেও ইসলামের জন্য বেশী বিপজ্জনক এবং অপবিত্র।

ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে এরা। এ সুযোগে খ্রীষ্টান শক্তি ইসলামের মূল উৎপাটনের তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে।

খ্রীষ্টানদেরকে পরাজিত করার পূর্বে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো মুসলিম বিশ্বের সাথে একীভূত করা প্রয়োজন। কারণ, এদের হাতে মুসলমানদের জীবন ও সহায় সম্পদ খ্রীষ্টানদের মতই সমান নিরাপত্তাহীন। এ ছাড়া দ্বীন ও ঈমানকে টিকিয়ে রাখার অন্য কোন পথ নেই’।

এ কারণেই খ্রীষ্টানদের দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার পরও দেখা যেতো, খ্রীষ্টান অধ্যুষিত এবং খ্রীষ্টান প্রভাবিত কাফেলা নিরাপদ এলাকাগুলো থেকে বিরাট বিরাট মুসলিম কাফেলা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে নিয়মিত মরুভূমির বিশাল পথ অতিক্রম করে চলেছে।

এমনি এক ক্রাকের কয়েক মাইল দূর দিয়ে যাচ্ছিল। যাত্রীদের সাথে ছিল অনেক ঘোড়া এবং ব্যবসায়িক মালপত্র। ছিল কয়েকটি পরিবার। শিশু-কিশোর ছাড়াও কাফেলার ছিল দু’জন যুবতী। যুবতীরা দুই আপন বোন।

পথ চলছে কাফেলা। খ্রীষ্টানরা খবর পেয়ে সৈন্যদের একটা দল পাঠিয়ে দিল। দলটি দিনে দুপুরেই কাফেলায় আক্রমণ করে বসল।

কাফেলার যাত্রীরা প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ করল এ হামলা। আক্রমণের প্রথম ধাক্কা কেটে গেল দেখা গেল উভয় পক্ষেই বেশ হতাহত হয়েছে। সৈন্যরা এবার কাফেলাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করল। কাফেলাও সংহত হয়ে আস্তে আস্তে পেছনে সরে যেতে লাগল।

নারী ও শিশুদের নিয়ে কয়েকজন পেছনের পাহাড়ের দিকে সরে গেল। বাকীরা লড়ে যেতে লাগল প্রাণপণে। কিন্তু সৈন্যরা ছিল সংখ্যায় বেশী এবং নিয়মিত যোদ্ধা। ফলে এসব সৈন্যদের সামনে বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারল না ওরা। মরুর বালুকা রাশি লাল হয়ে যাত্রীদের তাজা রক্তে।

নারী ও শিশুদের নিয়ে যারা পাহাড়ের পাদদেশে জমা হয়েছিল ওদের দিকে এগিয়ে গেল সৈন্যরা। ওরা রা ততোক্ষণে পাহাড়ের ওপর গিয়ে বিভিন্ন পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। ঘাতকরা তীরের আওতায় আসতেই ওরা তীরের আঘাতে পড়ে গেল ঘোড়া থেকে।

থমকে দাঁড়িয়ে গেল  সৈন্যরা। সামান্য পেছনে সরে চলে এল নিরাপদ দূরত্বে। সৈন্যদের একদল চলে গেল পাহাড়ের উল্টো দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পিছন থেকে হামলা করে বসল লুকিয়ে পড়া যাত্রীদের ওপর।

সাথে সাথেই সামনে থেকে ছুটে এলো সৈন্যদের মূল বাহিনী। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইত ঘটলো লড়াইয়ের। ঘাতকদের তরবারী থেকে নারী ও শিশুরা পর্যন্ত রক্ষা পেল না। কাফেলার দু শ জন যাত্রীর অধিকাংশই নিহত হলো।

লড়াই শেষে দেখা গেল পনরজন আহত যুবক এবং দু’জন যুবতী ছাড়া কেউ বেঁচে নেই।

এদের বন্দী করে মাল সামান নিয়ে ডাকাত দল ক্রাকের পথ ধরল। ডাকাত দল যখন ক্রাকে প্রবেশ করছিল সামনে ছিল বন্দীরা। দুটো ঘোড়ার পিটে বসে ছিল যুবতী দু’জন।

ক্রাকের জনসাধারণ তাকিয়ে দেখল কাফেলাকে। যুবতী দুজনের পোষাক আশাক মুসলমানদের মত। মেয়ে দুটোর পেছনে মুখোশ পরা খ্রীস্টান সৈন্যদের সশস্ত্র পাহারা। তাদের পেছনে লুণ্ঠিত মাল সামানাসহ উট এবং ঘোড়ার বিশাল সারি।

মেয়ে দু’জন কাঁদছিল। ক্রাকের লোকজন বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলো তামাশা দেখার জন্য। মুসলিম কাফেলা লুণ্ঠিত হয়েছে এ জন্য ওরা খুশী। হাততালি দিয়ে সবাই আনন্দ প্রকাশ করছে।

বন্দীদের মধ্যে এক যুবকের নাম ছিল আশফাক। মেয়ে দু’জন ওরই বোন। কপালে এবং কাঁধে আঘাতের চিহ্ন যুবকের। এখনও রক্ত ঝরছে আহত স্থান থেকে।

রাস্তার দুপাশে দর্শকদের দেখ আশফাক চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ডুবে মর তোমরা। এই অসহায় মেয়ে দু’জনকে দেখো। এরাও মানুষ। তোমরা মানুষ হলে ওরা একা আমার নয় তোমাদেরও বোন। যদিও ওরা মুসলমান’।

একজন খ্রীষ্টান সৈন্য পেছন থেকে তার ঘাড়ে ঘুসি মারল। উপুড় হয়ে পড়ে গেল আশফাক।

অন্য একজন বন্দী তাকে আবার তুলে নিল। আবার চিৎকার দিয়ে বললো ছেলেটা, ‘ক্রাকের মুসলমানেরা, এ দু’জন তোমাদের মেয়ে। ওরা এখন খ্রীষ্টান ডাকাতদের হাতে বন্দী। একটু পর হয়তো তাদের সতীত্ব লুণ্ঠন করা হবে। তাদের আর্ত চিৎকারে বিষাক্ত হয়ে যাবে ক্রাকের বাতাস। সে বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে তোমরা কতক্ষণ বাঁচতে পারবে আমার জানা নেই’।

দু’জন মুখোশধারী ডাকাত এগিয়ে এসে তাকে পিটাতে লাগল। তাই দেখে মেয়েরা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে বলতে লাগল, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, আমাদের ভাইকে মেরো না। আমাদের সাথে যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করো, দয়া করে ওকে ছেড়ে দাও’।

এক বোন চিৎকার দিয়ে বললো, ‘আশফাক, চুপ করো। তুমি এদের কিছুই করতে পারবে না’।

মুসলিম দর্শকরা অনেক কষ্টে এ দৃশ্য হজম করছিল। ওদের বিবেক, ওদের আত্মমর্যাদা দৃষ্টির সামনে ধূলায় গড়াচ্ছে কিন্তু ওরা কিছুই করতে পারছে না।

যুবক দর্শকদের মধ্যে ওসমানও ছিল। সংগীতের দিকে তাকাল ও। সবার চোখে মুখে ক্রোধের আগুন। দ্রুত লাফাচ্ছে হৃদপিণ্ড। যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।

ওদের পেছনে পেছনে কিছু দূর এগিয়ে গেল ওসমানরা। সামনে রাস্তার পাশে একজন মুচি জুতো সেলাই করছে।

ওসমান মুচির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জুতা খুলে বসে পড়ল তার সামনে।

মুচিও আশফাকের কথা শুনেছে এবং মেয়েদের দুর্দশা দেখেছে। কিন্তু বেচারা গরীব মুচির কিই বা করার আছে! একজন মুসলমান অনুগ্রহ করে তাকে বারান্দায় থাকতে দিয়েছে, এই তার চরম সৌভাগ্য।

তাকে কেউ কোনদিন মসজিদ, গীর্জা বা ইহুদীদের উপাসনালয়ে যেতে দেখেনি। জুতা মেরামতের দরকার হলেই লোকেরা তার দিকে তাকায়। তাকে কেউ কোনদিন কথা বলতে দেখেনি। মনে হয় সংসার বিবাগী একজন লোক খ্রীষ্টানদের সাথেও কোন সম্পর্ক নেই, মুসলমানদের ব্যাপারেও কোন আগ্রহ নেই।

বন্দীর দল চলে গেছে।

মুচি জুতা সেলাই করছে। মাথা তুলে একবারও ওসমানের দিকে তাকাচ্ছে না।

ওসমান এদিক ওদিক তাকিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, ‘এ দু’জন মেয়েকে আজ রাতে মুক্ত করতে হবে’।

‘জান এরা আজ রাতে কোথায় থাকবে?’ মাথা না তুলেই ফিসফিসিয়ে বললো মুচি।

‘জানি। ওরা আজ রাতে খ্রীষ্টান সম্রাটের কাছে থাকবে। কিন্তু আমি কখনও ভেতরে যাইনি। ভেতরটা দেখিওনি’।

‘আমি দেখেছি। ওখান থেকে মেয়েদের বের কের আনা সম্ভব নয়’।

‘তাহলে তুমি কোন কাজের কাজী?’

ওসমানের কন্ঠ ঝলকে উঠল আবেগ এবং ক্ষোভে।

‘আমাদের পথ দেখাও। মেয়েদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই হলো।

মুক্ত করার সুযোগ না পেলে ওদের হত্যা করবো। তবুও বদমায়েশ রাজাদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না। আমাদের দুই অসহায় বোনকে’।

‘এ জন্য ক’জন যুবকের জীবন উৎসর্গ করতে পারবে?’

‘আপনি যা চাইবেন’।

‘ঠিক আছে, কাল রাতে দেখা যাবে’।

‘না আজ রাতে’। ওসমানের দৃঢ় কণ্ঠ। ‘যা করার আজ রাতেই করতে হবে’।

‘ইমামের কাছে যাও’।

‘ক’জন যাবো?’

‘আটজন। অস্ত্র হবে খঞ্জর এবং কোমর ব্যবহৃত জ্বালানী’।

ওসমান জুতা পরে চলে গেল।

সূর্য এখনও ডুবেনি। সাতজন বন্ধুর সাথে দেখা করল ওসমান। ওদেরকে ইমাম সাহেবের কাছে যেতে বলে নিজেও মসজিদের দিকে পা বাড়াল।

পাগলের সাথে কথা বলার পর ওসমান ইমাম সাহেবকে নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেছিল। দলের সবাই কাজ করছিল তার নেতৃত্বে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাড়ীতে দলের গোপন বৈঠক চলত।

অপহৃত দু’জন যুবতীকে উদ্ধার করতে হবে, ওসমানের এ সিদ্ধান্ত ছিল আত্মহত্যার শামিল।

মুচির পরামর্শ অনুযায়ী ওমান ইমাম সাহেবের বাড়ী চলে এল। তিনি অস্থিরভাবে বারান্দায় পায়চারী করছিলেন, থেকে গেলেন ওসমানকে দেখে।

‘ওসমান! বন্দী ছেলেটার চিৎকার তুমি শুনেছো? সম্ভবতঃ মেয়ে দু’জন ওর বোন’।

‘তার চিৎকারের জবাব দিতেই এখানে এসেছি সম্মাতি ইমাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সাতজন বন্ধুও এখানে পৌঁছে যাবে’।

‘কি করবে তোমরা?

‘কি করবে তোমরা? আর কিইবা করতে পারি।……. জানি, আমাদের অনেক মেয়েই ওদের কাছে রয়েছে। কিন্তু এ দু’টো মেয়ে আমাকে পরীক্ষায় ফেলে দিল’।

পায়চারী করতে করতে বললেন ইমাম।

মুখ উপরের দিকে তুলে ইমাম সাহেব বেদনা মাখা কণ্ঠে বললেন, ‘খোদা, শুদু একটি রাতের জন্য আমার যৌবন ফিরিয়ে দাও। এক রাত পর আমার জীবন ছিনিয়ে নিয়ো। যদি বেঁচে থাকি মৃত্যু পর্যন্ত মেয়ে দুটোর অসহায় বিলাপধ্বনি আমার কানে বাজবে। আমি পাগল হয়ে যাবো’।

‘আপনি আমাদেরকে পরামর্শ দিন। আশা করি আজকের এ রাতের পর আর আপনাকে মেয়েদের নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে না’।

ওসমানের দু’জন সংগী ভেতরে ঢুকল। পাশাপাশি তিনজন বসলো ইমাম সাহেবের বিছানায়।

ইমাম সাহেব বললেন, ‘আজকে মনে হয় আমার বুদ্ধি গুলিয়ে ফেলেছি। এতটা অধৈর্য্য হওয়া আমার সাজে না। কিন্তু কোন বিবেকবান মানুষ এ চিৎকার শুনে বসে থাকবে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই তার ভেতরের আবেগ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ আবেগকে কাজে লাগানোর জন্য যুবক হতে হয়। কিন্তু আমার সন্তানেরা! আমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছি। সহ্য শক্তিও কমে গেছে। তোমরা যাই করতে চাও সাবধানে করো’।

একে একে সাতজন যুবক এসে পৌঁছল। কিছুক্ষণ পরই এল মুচি।

মুচির মাথায় টুকরিতে পুরতো জুতা এবং জুতা মেরামতের যন্ত্রপাতি। টুকরিটা এক পাশে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই হেসে উঠলেন তিনি। এখন কে বলবে এই লোকটা সারাদিন কুঁজো হয়ে বসে পৃথিবীর সাথে সম্পর্কহীনভাবে বসে বসে জুতো সেলাই করে।

ইমাম সাহেব দরবা বন্ধ করে দিলেন।

বারজেস একণ আর মুচি নন, গোয়েন্দা সংস্থার একজ অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান গুপ্তচর।

বারজেস ইমাম সাহেবকে বললেন, ‘এ যুবকেরা আজই যে মেয়ে দুটোকে ছাড়িয়ে আনতে চাইছে, এ কাজে শুধু ধরা পড়ার ভয় নয়, নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে’।

‘আমরা জেনে বুঝেই মৃত্যুর এ ঝুঁকি নিচ্ছি সম্মানিত বারজেস’। বললো এক যুবক। ‘আপনি এ পথের গুরু। আমাদের পথ দেখান’

‘আমরা পরামর্শ চাইলে বলি, খ্রীষ্টানদের কাছে আমাদের অনেক মেয়ে রয়েছে। কাউকে এনেছে চুরি করে। কাউকে আবার কাফেলা থেকে লুট করেছে।

ওদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাবৃত্তিতে ব্যবহার করছে। কাউকে পাঠাচ্ছে তোমাদের চরিত্র নষ্ট করতে। প্রতিটি মেয়েকে তো তোমরা ছাড়িয়ে আনতে পারবে না।

যতি আমার অভিজ্ঞতা কাছে লাগাতে চাও তো বলবো, দু’টি মেয়ের জণ্য আটজন যুবককে উৎসর্গ করা ঠিক হবে না। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে ধৈর্য ধারণ কর’।

‘এ অবস্থায় কি করে ধৈর্য ধরতে পারি?’ ঝাঁঝের সাথে বললো ওসমান।

‘আমার মত’। বললেন বারজেস।

‘আমি কি সত্যি সত্যি মুচি? মিসরে আমার রয়েছে উৎকৃষ্ট আরবী ঘোড়া। রয়েছে নিজের বাড়ী, রয়েছে অনুগত চাকর-বাকর। একজন সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী ব্যক্তি হয়েও এখানে বসে সারাদিত আমি মানুষের ময়লা ছেড়া জুতা সেলাই করি।

তোমরা তোমাদের ঈমানী দাবী পুরণ করেছো দুটো মেয়ের মুক্তির জন্য নিজেদের  জীবনকে পেশ করে। কিন্তু এ দু’জন মেয়েসহ অসংখ্য মেয়ের মুক্তি এবং ক্রাকসহ বিশাল এলাকা মুক্ত করার জন্য তোমাদের বেঁচে থাকা দরকার। এ জন্য ধৈর্যের সাথে উপযুক্ত সমেয়র অপেক্ষা করা উচিত তোমাদের’।

ইমাম সাহেব বললেন, ‘সম্মানিত বারজেস অভিজ্ঞ ব্যক্তি। আমি মেয়েদের মুক্তি অবশ্যই চাই, তবে বারজেসের যুক্তিও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শের বাইরে আমাদের কিছু করা উচিত নয়’।

ওসমান এবং তার সঙ্গীদের সহ্যের সীমা শেষ হয়ে গেল। বারজেস ও ইমাম সাহেবের কথা-বার্তা শুনেও তাদের মনে কোন প্রবোধ এলো না। ইমাম ও বারজেসের কথা ছাপিয়ে তাদের কানে বাজতে লাগল আশফাকের চিৎকার ও মেয়ে দুটোর করুণ চাহনি।

মেয়ে দুজনকে উদ্ধার করার অভিযান থেকে বিরত থাকার শত যুক্তি তাদের কাছে মেয়ে দুটোর চাহনির তুলনায় নিষ্প্রভ মনে হলো।

ওরা বলল, ‘মেয়েরা যেখানেই থাকুক, যে অবস্থায়ই থাকুক, আর তাদের উদ্ধার অভিযান চালাতে যত বড় ত্যাগই স্বীকার করতে হোক, আমরা সেখানে আক্রমণ করবোই’।

‘আপনাদের দেহের খুন বাসি হয়ে গেলেও আমাদের শিরায় তাজা খুনের অভাব নেই। আপনাদের খুনের দিকে তাকিয়ে নয়, সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের দিকে তাকিয়ে’।

বলল আরেক যুবক।

ওসমান বললো, ‘অপারেশনে আপনারা নন আমরা যাবো, আপনারা শুদু বলুন, কোন পথে গেলে আমরা বেশী সফলতার আশা করতে পারি’।

ইমাম সাহেব ও বারজেস তৎক্ষণাত কোন জবাব দিতে পারল না।

কক্ষে দশ জন প্রাণী, কেউ মুখ খুলছে না। গুমোট নীরবতায় ছেয়ে গেল কক্ষ।এ যেন বিস্ফোরণের পূর্ব মুহুর্ত। আটজন যুবকের চেহারায় আগুন ঝরা দৃঢ়তা। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ওরা।

অনেকক্ষণ পর নিরবতা ভেংগে বারজেস বললেন, ‘খ্রীষ্টান রাজাদের পানশালায় আমাদের দু’ন গোয়েন্দা সাধারণ চাকরের কাজ করে। সুবাক বিজয়ের পর খ্রীষ্টানদের ছদ্মবেশে ওরা চলে এসেছিল। এখানে এসে পানশালায় চাকরি নিয়ে গুপ্তচরের কাজ করছে।

বৃটেন, ইটালী, ফ্রান্স, জার্মানী এবং অন্যান্য দেশের সম্রাটগণ যেখানে বসে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করে তোমরা নিশ্চয়ই সে প্রাসাদ দেখেছে। সে প্রাসাদের বিশাল এক কক্ষ ওদের পানশালা।

রাতে সেখানে নৃত্য গীতের আসর বসে। আনন্দ স্ফুর্তি করার জন্য মেয়ে থাকে।মাঝ রাত পর্যন্ত মদ পান ও আনন্দ স্ফুর্তির জলসা চলে।

কক্ষটা উপর তলায়। ওখান থেকে সমগ্র শহর চোখে পড়ে।

কক্ষের চারপাশে কড়া সেনা প্রহরা। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সম্রাটরা ছাড়া অন্য কোন মহা সম্মানিত ব্যক্তিও সে কক্ষের কাছে যেতে পারে না।

মেয়ে দু’জন রাতে কোথায় থাকবে আমি এ তথ্য সংগ্রহ করতে পারবো। কিন্তু ওরা সেখানে থাকলে সে পর্যন্ত যাওয়া তোমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না’।

‘সেখানে পৌঁছার কোনই উপায় কি আছে?’

‘না নাই। তবে বাইরে সেনাবাহিনী আক্রমণ করলেই কেবল ওখান পর্যন্ত যাওয়া যাবে।

সেনাবাহিনী আক্রান্ত হলে সম্রাটগণ কক্ষের বাইরে চলে আসবে আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। কক্ষেরপ্রহরীরাও হয়তো তখন সরে আসবে সেখান থেকে। কিন্তু আজ রাতে ক্রাকে কোন সেনা অভিযান হচ্ছে না।  সুলতান আয়ুবী কবে নাগাদ ক্রাক আক্রমণ করবেন তাও বলা যায় না’।

‘বাইরের দিক থেকে শুধু আক্রমণ করা দরকার?’

জানতে চাইল ওসমান।

‘আপনি বলতে চাইছেন, আক্রান্ত হলে লোকজন মেয়েদেরকে রেখে ওখান থেকে চলে আসবে। এসুযোগে এ ছেরো মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে আসতে পারবে, এই তো?’

বরজেসের কাছে ইমাম সাহেব জানতে চাইলেন।

‘হ্যাঁ। আমি তাই বলতে চাইছি’।

‘শহরে বড় কোন ঝামেলা বা আক্রমণ হলে অথবা যুদ্ধের রসদে আগুন লাগলেও কি সবাই ওখানে ছুটে আসবে?’

‘হ্যাঁ’। জবাব দিলেন বারজেস।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন ইমাম সাহেব। ইসলামী ইতিহাসের একটি ঘটনা ভেসে উঠল তার মনের পর্দায়। একে একে বারজেস এবং আটজন যুবকের দিকে তাকালেন তিনি।

বললেন, ‘সম্মানিত বারজেস ও আমার মুজাহিদ বন্ধুরা! আমাদের সামনে আজ এক কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মোকাবেলায় আমাদের করণীয় কি সে ব্যাপারে আপনারা নিজ নিজ মতামত পেশ করেছেন।

বারজেসের বক্তব্যে আছে বাস্তবতা ও যুক্তি, যুবক বন্ধুদের বক্তব্যে আবেগ। কিন্তু কোন সচেতন মুসলমান কেবল যুক্তি বা আবেগ দিয়ে এ ধরনের সমস্যার ফায়সালা করে না। তার সামতে থাকে কোরআন ও সুন্নাহ। কোরআন ও সুন্নাহর মূলনীতিই এ ক্ষেত্রে স্টান্ডার্ড হিসাবে আমাদের পথ দেখাতে পারে।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top