৪. ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

 সেনাদলের অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল সীমান্তের দিকে দৃষ্টি রাখা। সীমান্ত রক্ষীদেরকেও এ দলের অন্তর্ভুক্ত করা হল। সেনাদলের প্রতিটি সদস্য ছিল নির্বাচিত। দামেশক থেকে আসা দু’শ অশ্বারোহী এ অভিযানে অংশ নিয়েছিল। অন্যরা ছিল সুলতান আয়ুবী র বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈনিক। অনেকেই কমান্ডো আক্রমণে পারদর্শী।

 সন্ধ্যায় কমান্ডো বাহিনী পড়োবাড়ীর গেটে পৌঁছল। সারি বেঁধে লোকজন ঢুকছে। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে তিনটে করে খেজুর এবং পানি। দর্শনার্থীদের সাথে মিশে ছয় ব্যক্তি এগিয়ে গেল। দাঁড়াল গেটে দাঁড়ানো দু’জন লোকের সামনে। গেটে একটি মশাল জ্বলছে। সামনেটা আলোকিত, কিন্তু দরজার ভেতরে অন্ধকার। কিছু দূরে গিয়ে আলোকিত বড় কক্ষ।

 ছ’জনের হাতে বেরিয়ে এল চকচকে খঞ্জর। দরজার অন্ধকারের আড়াল নিয়ে দাঁড়াল দু’জনের পেছনে। খঞ্জর ঠেকাল দু’জনের পিঠে। অনুচ্ছ কণ্ঠে বলল, ‘বাঁচতে চাইলে এখান থেকে সরে যাও। সেনাবাহিবী তোমাদেরকে ঘেরাও করে ফেলেছে।‘

 প্রতিবাদ না করে দু’জন সরে এল। দু’জন কমান্ডো দখল করল ওদের জায়গা। চার কমান্ডো সরে আসা দু’জনকে বলল, ‘ভেতরে চল।’ ওদের ভয়ঙ্কর চেহারার দিকে একপলক তাকিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়াল ওরা। দেখা গেল ভেতরের কক্ষে অনেক সুন্দরী তরুণী ঝলমলে কাপড় পড়ে আছে।

 একদিকে যুবক-যুবতী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, অন্যদিকে ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত পর্দা ঝুলানো। পর্দা একবার ডানে আবার বায়ে ঘুরছে। অন্যদিক থেকে ছুটে আসছে চোখ ধাঁধানো তীব্র আলো।

 ভেতরে কোন ভূতপ্রেত বা দৈত্য দানো নেই, পূর্বে কমান্ডো সদস্যদের এসব কথা বলা না হলে ওরা ভয়ে ছুটে পালাত। কমান্ডো দু’জককে দু’জন গেটের দায়িত্ব দু’জন এসব কথা বলা না হলে ওরা ভয়ে ছুটে পালাত। কমান্ডো দু’জন গেটের দায়িত্ব নেয়ার পার একদল কমান্ডো সৈন্য ভেতরে ঢুকল।১৪১

 সৈন্যদের দেখে ভয়ংকর প্রাণীগুলো বিকট শব্দ করতে লাগল। বিভিন্ন অংগভংগীর মাধ্যমে সৈন্যদের ভয় দেখাতে চাইল। ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে একজন তেড়ে এল সৈন্যদের দিকে। সৈন্যরা ওদের ঘিরে ফেলল। ধস্তাধস্তির সময় কয়েক জনের মুখোশ খুলে পড়ল। সৈন্যরা সবার মুখ থেকে নেকড়ে বা বিভিন্ন পশুর মুখোশ খুলে নিল। বেরিয়ে এল মানুষের চেহারা। একপাশে পড়ে আছে মদের পাত্র।

 সশস্ত্র প্রহরায় সৈন্যরা ওদের বাড়ীর বাইরে নিয়ে গেল। বাড়ীর অন্যপ্রান্তে তল্লাসী নেয়া হল। এক ব্যাক্তি একটি সুড়ংয়ের মুখে মুখ লাগিয়ে বলছে, ‘পাপের প্রায়শ্চিত্য কর। হযরত ঈসা (আঃ) আসছেন……….।’

 সুড়ংয়ের ওপর প্রান্ত শেষ হয়েছে আলোকিত প্রশস্ত কক্ষে। ওখানে দর্শনার্থীরা গায়েবী শব্দ শুনে আর পাপীদের শাস্তির ছবি দেখে আতংকিত হয়। লোকটাকে বেধে ফেলল সৈন্যরা।

একজন সৈন্য সুড়ংগ মুখে মুখ লাগিয়ে বলল, ‘পথভ্রষ্ট মানুষ আজ রাতে বাড়ী যাবে না। এতদিন যে রহস্যময় বাবাকে দেখার অপেক্ষা করছিলে, কাল ভোরেই তাকে দেখতে পাবে তোমরা।

 বন্দীদের জিজ্ঞেস করে সৈন্যরা আলোর উৎসের কাছে পৌঁছল। এখানে জ্বলছে অনেকগুলো মশাল। পেছনে কাঠের পাটাতন। পাটাতনের ওপর স্থাপন করা হয়েছে বিশাল আয়না। মশালের আলো আয়নায় পড়ে তার প্রতিবিম্ব সামনে ছড়িয়ে পড়ে। কাঠের পাটাতন ঘুরিয়ে আয়নার প্রতিসরণ এদিকে ওদিক ঘোরানো যায়। কক্ষের দেয়ালে ঝুলানো পর্দার মাঝে মাঝে কাঁচ সেটে দেয়া হয়েছে। আয়নার প্রতিবিম্ব কাঁচে পড়লে মনে হয় আকাশে তারা জ্বলছে।

 দেয়ালের রঙের সাথে মিলিয়ে পর্দায় রং করা হয়েছে। একজন সচেতন ব্যক্তি দেখা মাত্রই বুঝতে পারত এ হল আলোর কারসাজি। কিন্তু নেশাযুক্ত খেজুর আর পানি পান করিয়ে দর্শনার্থীদের মোহগ্রস্থ করা হয় বলে এতদিন মনে করেছে সত্য।

 সুড়ং পথে আসা শব্দে দর্শনার্থীরা আরও হতবাক হয়। এজন্যই একবার বেরিয়ে এলে প্রতিটি লোক আবার ভেতরে যেতে চাইত। এ ছিল নেশার প্রভাব। এজন্যই এতদিন মানুষকে নেশাগ্রস্থ করে ধর্মীয় অনুভূতির নামে প্রতারিত করা হয়েছে সবাইকে।

 খেজুর এবং পানির মশক ‘সিজ’ করা হল। বন্দী করা হল ভেতরের সবাইকে। দুটো দলকেই জনগণের সামনে একটু উঁচুতে দাঁড় করানো হল। সেনা কমান্ডারের নির্দেশে মুখ থেকে মুখোশ খুলে ফেলল ওরা। বেরিয়ে এল মানুষের চেহারা।

 লোকজনকে বলা হল সারি বেঁধে ওদের অতিক্রম করতে। আশ্চর্য হল গ্রামবাসীরা, এরা আকাশের অধিবাসী নয়, ওদেরই গাঁয়ের লোক। মেয়েগুলোও চেনা জানা। মেয়েদের মধ্যে চারজন ইহুদী, সাতজন খ্রিস্টান আর অন্যরা মুসলমান।

 এরপর মূল অপরাধীদেরকে সামনে আনা হল। এদের ছ’জনই খ্রিস্টান। আরবদের মতই মিসরের ভাষায় পারদর্শী ওরা। এরা অর্থের লোভ দেখিয়ে এলাকার লোকদের হাত করেছে। চারটি মসজিদের ইমামও ওদের নিজস্ব লোক। ধর্মের নামে মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য এরা এসব ইমামদের নিয়োগ করেছিল।

 এ অঞ্চলের মানুষ যাতে সেনাবাহিনীতে ভর্তি না হয় এ জন্য খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দের নির্দেশে ওরা এ নাটকের অভিনয় করেছে। সফল হয়েছে ওরা। এলাকার মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে সুদানীদের প্রতি ভালবাসা। আয়ুবী র বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের হৃদয়ে। এমনকি ওদেরকে ফাঁদে জড়িয়ে মানুষ নিজের ধর্মকেও বিসর্জন দিয়েছে।

 কেউ পালিয়ে আছে কিনা দেখার জন্য খোঁজ করা হল প্রতিটি কক্ষ। বাইরে দু’শ ঘোড় সওয়ার বাড়ী ঘিরে রেখেছে। জ্বলছে শত শত মশাল। সেনাবাহিনীর এক অংশ সুদান সীমান্তে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।

 রাত গিয়ে ভোর হল। সুদানের দিক থেকে কোন আক্রমণ এল না। কোন বাধা এলনা পড়োবাড়ীর ভেতর থেকে। গ্রামের কেউ বাড়ী ফিরে যায়নি, ওরা প্রতারক সেই অদৃশ্য বাবাকে দেখতে চায়।

 – – – – – – – – – –

 সকালে গ্রামে খবর পাঠানো হলো যে, অদৃশ্য বাবা একটু পর দর্শন দেবেন। দলে দলে গ্রামবাসীরা ছুটল পাহাড়ের পাদদেশে জমায়েত হল প্রায় চার হাজার গ্রামবাসী। ওরা সবাই নতুন ধর্ম মতের অনুসারী। সবাই বাবাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল। বাবা তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবেন।

 সৈন্যরা লোকজনকে বসিয়ে দিল। সবাই তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে পড়োবাড়ীর দিকে। স্বর্গীয় জ্যোতিতে স্নাত দরবেশ এখনই বেরিয়ে আসবেন। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না।

 হঠাৎ দেখা গেল পড়োবাড়ীর দিক থেকে সেনাবাহিনীর প্রহরায় একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। কারও চেহারা নেকড়ের মত, কারও বানর বা ভাল্লুকের মত। দর্শনার্থীরা বড় কক্ষের দেয়ালে এদের ছবি দেখেছিল। গায়েবী আওয়াজ বলেছিল পরকালে এদেরকে এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কারণ এরা যুদ্ধ করেছিল সেনা ফৌজে।

 প্রায় পনর জন সুন্দরী তরুণী আসছে আলাদা ভাবে। এদের সাথে রয়েছে সুদর্শন যুবক। লোকজনকে পড়োবাড়ীর ভেতর নিয়ে ওদের প্রতারণার পদ্ধতি দেখান হল। এতদিন কিভাবে ধোকা দেয়া হয়েছে নিজের চোখে দেখল মানুষ। ভেতরটা দেখা শেষ হলে আবার তাদেরকে পাহাড়ের পাদদেশে একত্রিত করা হল।

 ঈষৎ উঁচু জায়গায় দাঁড়ালেন মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিউদ্দীন। বললেন, ‘খেজুরের সাথে হাশিশ মিশিয়ে তোমাদেরকে নেশাগ্রস্ত করা হতো। দেখানো হতো স্বর্গ নরক। বলা হতো মুসা, ঈসা আর আল আযেদের কথা। এর সবই ছিল প্রতারণা। হাশিশের প্রভাবে তোমরা সবকিছুই বিশ্বাস করেছিল। এরা ধোকার জাল বিছিয়ে সমগ্র অঞ্চলকে বিভ্রান্ত করেছে।

 তোমাদের শোনানো হয়েছে এক দরবেশের কাহিনী। দরবেশ মানুষকে উট, ঘোড়া এবং টাকা দেন। আসলে মিথ্যা বলে এরা তোমাদের লোভ দেখিয়েছে। মিথ্যা বলার বিনিময়ে পেয়েছে অঢেল সম্পত্তি। এরা এসেছে তোমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে। এসেছে তোমাদের ঈমান নষ্ট করতে।’

 জনতার মাঝে দেখা দিল মৃদু গুঞ্জন উত্তেজিত মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। সেনাবাহিনী চেষ্টা করেও ওদের ঠেকাতে পারল না।

 জনতার সম্মিলিত ক্রোধ অপরাধীদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। যুবক-যুবতী আর পুরুষদের কেউ রক্ষা পেল না।

 সেনাবাহিনী ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র এলাকায়। বন্দী করা হল খ্রিস্টান গোয়েন্দা এবং চরদের। চারজন ইমামকেও গ্রেফতার করা হল। উত্তেজিত জনতা ভেংগে গুড়িয়ে দিল সে রহস্যময় বাড়ী।

 কায়রো ফিরে গেলেন তকিউদ্দীন। শারজা এবং ডাক্তারকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি দিলেন। সুদান আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হল।

 এ অভিযানে গিয়ে তিনি দেখেছেন মিসরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশটি কি ষড়যন্ত্র করছে। ওদের আক্রমণ না করলে এ যড়যন্ত্র বন্ধ করা যাবে না। তিনি বুঝতে পেরেছেন সুদানীরা এখন খ্রিস্টানদের সহযোগী। সুদানের কিছু এলাকা দখল করতে না পারলেও আক্রমণের ফলে ওদের ষড়যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাবে। কায়রোতে শুরু হলো যুদ্ধের প্রস্তুতি।

 * * * * * * * * * * * *

চুরমার করে দেয়া হল ষড়যন্ত্রের একটি কেন্দ্র। কিন্তু গভর্নর তকিউদ্দীন এতেও সন্তুষ্ট নন। খ্রিস্টানদের প্রত্যক্ষ মদদে সুদানীরা এ ষড়যন্ত্র বিস্তৃত করেছে। ওদের প্রতিহত না করলে নতুন ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করবে। এ জন্যেই তিনি সুদান আক্রমণ করতে চাইছিলেন। ওখানেও ছিল সুলতান আয়ুবী র গুপ্তচর। নিয়মিত ওরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠাচ্ছিল। এসব তথ্য দিয়ে সুলতান যেভাবে উপকৃত হতে পারতেন তকিউদ্দীনের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। দু’ভায়ের আবেগ এক হলেও বুদ্ধিমত্তা এবং ধীরশক্তিতে ছিল বিস্তর ফারাক। দু’জনই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু একজনের সিদ্ধান্তে থাকত দূরদর্শিতা এবং ধৈর্য, অন্যজনের থাকত আবেগ এবং তাড়াহুড়ো।

 সামরিক উপদেষ্টাগণ যখন গভর্নরকে বললেন, ‘সুদান আক্রমণ করার পূর্বে সুলতানের সাথে পরামর্শ করা উচিৎ।’

 এ প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন গভর্নর। বললেন, ‘আপনারা কি সুলতানকে বুঝাতে চাইছেন, তাকে ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। কি ঝড়ের মোকাবেলা করছেন সুলতান তা আপনাদের অজানা নয়। আমরা তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকলে সুদানীরাই মিসর আক্রমণ করে বসবে। এখনই ফৌজকে মার্চ করতে বলুন। রসদ সামান ছাড়াই সেনাবাহিনী রওয়ানা করবে।’

 ‘এতবড় এক অভিযানে যাওয়ার পূর্বে একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ।’ বললেন একজন কমান্ডার/

 ‘স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা প্রস্তুতি নিতে পারব।’

 ‘সুলতানকে এ ব্যাপারে জানানো উচিৎ যাতে তিনি সম্মানিত জংগীকে অবহিত করতে পারেন।’ বললেন আরেকজন।

 ‘আপনারা মিসরে একজন একজন করে গাদ্দার গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন, আমি গাদ্দারী এবং ষড়যন্ত্রের উৎসের উৎপাটন করতে চাই। এ জন্য আর কারও সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন নেই। আমার নির্দেশই যথেষ্ট।’ বললেন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর।

 তকিউদ্দীন এমন কতগুলো বিষয়ে মনযোগ দেননি যা তার জন্য পরাজয় বয়ে আনতে পারে। কায়রোতে ছিল খ্রিস্টান এবং সুদানের গুপ্তচর। সেনাবাহিনীর প্রতিটি নড়াচড়া ওরা লক্ষ্য করছিল। তকিউদ্দীনের দুর্ভাগ্য এসব গুপ্তচরের মধ্যে ছিল প্রশাসনের পদস্ত কর্মকর্তা এবং সুদানী অফিসার। কয়েক বছর পূর্বে মিসরের সুদানী বাহিনী ভেংগে এসব মেধাবী অফিসারদের রেখে দিয়েছিলেন সুলতান। সুলতানের যুদ্ধ পলিসি সম্পর্কে এরা ছিল অভিজ্ঞ। অন্যদিকে মুসলিম গোয়েন্দারা সুদানী ফৌজের যুদ্ধ পলিসি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। খ্রিস্টান সম্রাটগণ সুদানী বাহিনীকে উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত করে রেখেছিল।

 সুদান আক্রমণ করতে হবে বিশাল মরু পেরিয়ে। জংগল এবং পর্বত ঘেরা অঞ্চলে রসদ পৌঁছনো সহজ নয় ভাবেননি তকিউদ্দীন। দেশের স্বাধীনতা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে প্রচন্ড ক্ষোভ এসব দিকগুলো দৃষ্টির আড়ালে রেখেছিল।

 তকিউদ্দিনের সদিচ্ছার কোন অভাব ছিল না, কিন্তু সুলতান আয়ুবীর মত দূরদর্শী হতে পারেননি তিনি। শুরু হল যুদ্ধের প্রস্তুতি। সিদ্ধান্ত নেয়া হল এ ব্যাপারে সুলতানকে কিছুই জানানো হবে না।

 সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবীর অনুভূতি নিয়েই তিনি একক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুলতান প্রচন্ড ঝড়ের মোকাবেলা করছেন তার এ ধারণা অমুলক ছিল না। তার চিন্তাধারা ছিল সঠিক।

 তখন সুলতান ছিলেন ক্রাকের আট মাইল দূরে, অস্থায়ী ক্যাম্পে। তার হেড কোয়ার্টার ছিল বেদুইনদের মত। আজ এখানে তো কাল ওখানে। যে এলাকায় কমান্ডো আক্রমণ হবে তার আশেপাশেই থাকতেন তিনি। কোন সময় কোথায় থাকবেন কমান্ডাররা শুধু জানতেন।

 কমান্ডোর বাহিনী খ্রিস্টানদের সকল রসদ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ অদৃশ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল ওদের জন্য ছিল আতংক। যদিও খ্রিস্টানদের ক্ষতি হচ্ছিল, পাশাপাশাই মুসলিম শহীদদের সংখ্যাও কম ছিল না। কখনও দশজনের কমান্ডো দল থেকে ফিরে আসত তিন কি চার জন। খ্রিস্টানদের বাড়তি সতর্কতার ফলে জানের ক্ষতি হচ্ছিল বেশি। নতুন করে যুদ্ধ পলিসি পরিবর্তন করার জন্য সুলতান চিন্তা-ভাবনা করছিলেন।

 ‘মনে হয় মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য খ্রিস্টান আমাদের বাধ্য করছে’, সেনা অফিসারদের বললেন সুলতান। ‘ওদের এ ইচ্ছে পুরণ হবে না, মরতে দেব না এত বেশী কমান্ডো জওয়ান।’

 ‘এ জন্য কমান্ডো সৈনিকের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।’ একজন অফিসার বললেন। ‘শুধু আবেগের বশে দুশমনের শক্তিকে খাট করে দেখা ঠিক নয়। আবেগের বশে একজন সৈনিক যুদ্ধ করে জীবন দিতে পারে কিন্তু বিজয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। খ্রিস্টানদের তুলনায় আমরা অনেক কম। এ ছাড়া ওদের বেশীর ভাগ সৈন্যই বর্মাচ্ছাদিত।’

 মৃদু হেসে সুলতান বললেন, ‘যে লৌহবর্ম ওরা পরে থাকে তা তাদের নয়, আমাদের সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই দেখেছেন ওরা রাতে বা ভোরে মার্চ করে। কারণ, সূর্যের উত্তাপে ওদের লৌহবর্ম আগুনের মত উত্তপ্ত হয়ে যায়। সৈন্যরা তখন ছুড়ে ফেলে দিতে চায় পরিধেয় বর্ম। বর্মের অত্যাধিক ওজন কমিয়ে দেয় ওদের চলার গতি। আমি ঠিক দুপুরে ওদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করব। ঘাম ঝরে ঝাপসা হয়ে যাবে ওদের দৃষ্টি। আমরা সংখ্যায় কম, আবেগ এবং স্থান বদলে সে ঘাটতি পূরণ করব।’

 আলীর সহকারী জাহেদীন এসে সালাম করল। সাথে দু’জন লোক। সুলতানের চোখে ফুটে উঠল আলোর দ্যুতি। দু’জনকেই পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদিককার কি খবর?’

 জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দু’জনেই বের করে আনলেন গলায় ঝুলানো কাঠের তৈরী ক্রুশ। একটানে ঝুলানো রশি ছিড়ে ক্রুশ ছুড়ে ফেললেন দূরে। দু’জনই মুদলিম গোয়েন্দা। একজন বিস্তারিত রিপোর্ট দিলেন সুলতানের কাছে।

 গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে সুলতান যুদ্ধের নতুন পরিকল্পনা তৈরী করলেন। আক্রমণের স্থান নির্দেশ করে মানচিত্র তৈরী করলেন। গোয়েন্দা যখন ক্রাকে মুসলমানদের ওপর খ্রিস্টানদের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করছিল সুলতানের চেহারার রং তখন বদলে গেল। উঠে দাঁড়ালেন তিনি, কপাল কুঞ্চিত। তাবুর ভেতর পায়চারী করলেন খানিক।

 গোয়েন্দারা বলল, ‘সুবাক থেকে পালিয়ে যাওয়া খ্রিস্টানরা ক্রাকের মুসলমানদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। ব্যবসায়ীগণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কোন অমুসলিম তাদের দোকানে যায় না। মুসলমানরা গেলেও তাদের ওপর খবরদারী করা হচ্ছে। মসজিদের বারান্দাকে ওরা উট, ঘোড়ার বাথান বানিয়েছে। আজান শুরু হলে হুল্লোড় করে গান গায় রেলিংয়ে বসে।’

 মুসলমানদের মানসিক অবস্থা দুর্বল করার জন্য নানা গুজব ছড়নো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘আয়ুবী গুরুতর যখম হয়ে দামেশক গিয়ে মারা গেছেন। তার নেতৃত্বহীন যার যেদিকে ইচ্ছে পালাচ্ছে। সমগ্র মরুভূমির কোথাও মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে আসছে। এদিকে সুদানীরা মিসর আক্রমণ করেছে। মিসরের সেনাবাহিনী ওদের সাথে হাত মিলিয়েছে।’

 প্রতিদিন সকালে পাদ্রীরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে এসব গুজব ছড়িয়ে মুসলমানদের জন্য দোয়া করে। ভালবাসার কথা বলেন।

 এতে একদিকে মুসলমানদের মানসিক শক্তি দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে খ্রিস্টানদের মনের জোর বেড়ে যাচ্ছে। যুবতী মেয়েরা মুসলিম মেয়েদের বলে বেড়াচ্ছে, ‘আয়ুবী র সৈন্যরা অধিকৃত এলাকায় যুবতীদের নষ্ট করছে। তোমাদেরকেও ছাড়বে না। দেশ শত্রুমুক্ত হলে আমরা এবং তোমরা সবাই নিরাপদে থাকতে পারব।’

 এর আগেও ক্রাকের মুসলমানদের দুর্দশা সম্পর্কে সুলতানকে বলা হয়েছে। ওরা সুলতানের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে প্রস্তুত নয়, তবুও শুনতে হচ্ছে। দেয়ালেরও কান আছে, এ জন্য ওরা থাকে নির্বাক। দু’জন একস্থানে বসে কথা বলতেও ভয় পায়। মসজিদে, এমনকি শব যাত্রীদের সাথেও থাকে খ্রিস্টানদের গুপ্তচর।

 ওদের দুর্ভাগ্য, মুসলিম ভায়েরাও খ্রিস্টানদের চর হিসেবে কাজ করে। নিজের বাড়ীতে কথা বললেও ফিসফিসিয়ে বলতে হয়। ‘এরা খ্রিস্টান শাসকের বিরোধী’ বেগার ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য এ কথাটুকু যথেষ্ট।

 ‘মাননীয় সেনাপতি’, অপর গোয়েন্দা বলল, ‘ক্রাকে খ্রিস্টানদের নতুন চাল শুরু হয়েছে। মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার করছে ওরা। ক’দিন পূর্বে সরকারী খরচে একটা ভাংগা মসজিদ মেরামত করা হয়েছে। বেগার ক্যাম্প থেকে মুসলমানদের মুক্ত না করলেও শ্রমের সময় কমিয়ে দিয়েছে। ওদের বলা হচ্ছে, ‘তোমরা সরকারের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছ এরপরও তোমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করা হচ্ছে।’

 এ প্রেম এবং ভালবাসার অস্ত্র অত্যন্ত মারাত্মক। অমুসলিম যুবকরা মুসলিম যুবকদের চরিত্র নষ্ট করার কাজে লিপ্ত।

 ক্রাক আক্রমণের দেরী হলে ওরা নামমাত্র মুসলমানে রূপান্তরিত হবে। কোরআন বাদ দিয়ে গলায় ঝুলাবে ক্রুশ। তখন ওরা আমাদের কোন সাহায্য করবে না।

 প্রেমের কথা বললেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি আরও জোরদার করা হয়েছে। গ্রেফতার হচ্ছে প্রতিদিন। এখন পর্যন্ত মুসলমানদের আবেগ টিকে আছে। দু’একজন ছাড়া ওদের ভালবাসার ফাঁদে এখনো পা দেয়নি। কিন্তু কতদিন পর্যন্ত এ আবেগ নিয়ে টিকে থাকতে পারবে ওরা তাই ভাববার বিষয়।’

 সুলতানকে উদ্বিগ্ন দেখাল। তিনি জাহেদীনকে বললেন, ‘তোমরা কি মুসলমানদের সাথে কথা বলেছ? প্রেমের টোপ যেমন ভয়াবহ, চরিত্র হনন তারচে বেশী মারাত্মক। ১৫৩/১৫৫

আলীকে কি কায়রো থেকে ডেকে আনবো না তুমিই তার স্থান পূরণ করতে পারবে? মুসলমানদেরকে গুজব এবং ভালবাসার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে।’

 কায়রোর অবস্থা ভাল নয়। আলীকে ডাকার দরকার নেই, তিনি ওখানেই থাকুন। তার পরিবর্তে হাসান বিন আব্দুল্লাহ আমাদের সাথে থাকলেই চলবে। ক্রাকের ব্যাপার আমিই সামাল দেব।’

 ‘এ ব্যাপারে কি ভেবেছ তুমি?’

 জাহেদীন আলীর স্থান পুরণ করতে পারবে কি না সুলতান তা বুঝতে চাইছিলেন। জবাবের প্রতীক্ষা না করে তিনি আবার বললেন, ‘জাহেদীন! আমি কখনও যুদ্ধের ময়দানে পরাজির\ত হইনি। এ ক্ষেত্রেও পরাজয় চাই না। খ্রিস্টান শক্তি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক অংগনে আক্রমণ করেছে। আমি খ্রিস্টানদের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আগ্রাসন থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে চাই।’

 ‘আপনি জানেন ক্রাকে আমাদেরও গোয়েন্দা কর্মী রয়েছে। ওরা ওখানকার অধিবাসীকে আপনার ব্যাপারে, আমাদের ফৌজ এবং মিসরের ব্যাপারে সঠিক তথ্য দেবে, আপনার বাণী পৌঁছাবে প্রতিটি মুসলমানের কানে।’

 ‘ওখানকার নারীদের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধের অভাব রয়েছে।’ বলল একজন গোয়েন্দা।

 ‘আমরা যুবতী মেয়েদের বলব, প্রতিটি বাড়ীতে গিয়ে যেন মুসলিম নারীদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। আমি দেখেছি, ওখানকার মেয়েরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।’

 ‘মেয়েরা যদি সন্তানের শিক্ষা দীক্ষার দিকটা ঠিক মত দেখে তাহলে মুসলিম জাতি আরও উন্নত হবে।’ বললেন সুলতান। ‘প্রতিটি শিশু ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হলে অমুসলিমরা তাদের অপচেষ্টায় ব্যর্থ হবে। শিশুদের কচি মনে ইসলাম এবং নবীর ভালবাসা সৃষ্টি হলে বড় হয়ে ওরা অন্য কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। এ জন্য ওদের সঠিক ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা কর। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্রোক আক্রমণ করব। সুবাকের মুসলমানদের মত ক্রাকের মুসলমানদেরকেও মুক্ত করব ইনশাআল্লাহ। জাহেদীন, এ জন্য কাকে ক্রাক পাঠাতে চাও।’

 ‘এ দু’জনকে। এরা ক্রাকের নিয়ম নীতি যেমন জানে; পথ ঘাটও চেনে। এরা মেধাবী এবং বুদ্ধিমান।’

 QQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQQ

 ক্রাকের মুসলমানদের উপর ভালবাসার বিষাক্ত অস্ত্র চালানো হচ্ছিল গোয়েন্দা প্রধান হরমুনের পরামর্শে। সুবাক হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর হরমুন খ্রিস্টান সম্রাটদের বলেছিল, প্রেমের অভিনয় করে ক্রাকের মুসলমানদেরকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব। পক্ষে না এলেও আয়ুবীর ওপর ওদের মন বিষিয়ে তোলা যাবে। কিন্তু খ্রিস্টান সম্রাটগণ মুসলমানদের ঘৃণা করতেন। ভালবাসার অভিনয় করতেও তারা রাজী নান। তাদের ধারণা, শক্তি প্রয়োগ করেই এদের জাতীয় চতনা নিঃশেষ করা যাবে।

 হরমুন ছিলেন একজন মনোবিজ্ঞানী। তার মতে মন জয় করতে পারলে গোটা জাতি হাতের মুঠোয় এসে যাবে। শেষ পর্যন্ত তিনি সম্রাটগণকে তার স্বমতে আনতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গোপনে গ্রেফতার করে গায়েব করে দিন, কিন্তু অন্যান্য মুসলমানদের আতংকিত করা যাবে না। মেয়েদের দিয়ে মেয়েদের বেপর্দা করতে হবে। যুবকদের করতে হবে মাদকাসক্ত। মানসিক গোলামীর মাধ্যমে ওদের বিলাসপ্রিয় করে তুলতে হবে।

 সংস্কৃতির নামে যুবক-যুবতীদেরকে ঘর থেকে বের করে বেহায়াপনার তামিল দিতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, প্রগতির জন্য এসব নাচগান প্রয়োজন। ধর্মান্ধরা তোমাদের নিষেধ করবে, কিন্তু সংস্কৃতিবান না হলে উন্নতির শিখরে উঠা যাবে না।

 হরমুন বললেন, একদিন দেখা যাবে, এরা নামে মুসলমান থাকলেও কথাবার্তা, আচার-আচরণ এবং চিন্তা-ধারায় থাকবে খ্রিস্টান। ওরা ওদের সমাজে আমাদের হয়ে কাজ করবে।’

 সেদিন থেকেই হরমুনের এ প্রস্তাবের বাস্তবায়ন শুরু হল। প্রস্তাব মতে নির্বাচিত করা হবে একজন সুদর্শন মুসলিম যুবক। তাকে দেয়া হবে শক্ত সামর্থ্য ঘোড়াগাড়ী, মুল্যবান পোশাক এবং সম্পদ। তাকে এবং তার পরিবারকে রাজ দরবারে নিমন্ত্রণ করে সম্মান দেয়া হবে। এভাবে তাদের মন থেকে উপরে ফেলতে হবে ইসলামী আবেগ এবং ভালবাসা।

 হরমুন খ্রিস্টান সম্রাটদের বললেন, মুসলমানদেরকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করতে চাইলে ওদের মাথায় রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পোকা ঢুকিয়ে দিন। অমনি আপনাদের চোখের ইশারায় সে নাচবে। মদপান করবে, নিজ জাতির যুবতীদেরকে নিজের হাতে উলংগ করে আপনাদের হাতে তুলে দেবে।

 মুসলমানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে চাইলে আমার এ ফর্মূলা পরীক্ষা করে দেখুন। নৈতিক চরিত্র নষ্ট করার জন্য ইহুদীরা পূর্ব থেকেই নিজের যুবতী মেয়েদেরকে মুসলমানদের হাতে তুলে দিচ্ছে। মুসলমানরা ইহুদীদের সবচেয়ে পুরনো শত্রু তা আপনাদের অজানা নয়। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইহুদীরা মেয়েদের আব্রু এবং শেষ সম্বলটুকুও ত্যাগ করাতে প্রস্তুত। লড়াই জারী রাখতে হবে, তবে লড়াই দিয়ে ইসলামকে শেষ করা যাবেনা।

 ইহুদী জাতি মুসলিম নিয়ম-নীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ। ওদের মেয়েদের গড়ন প্রায় মুসলমানদের মত। কোন ইহুদী নারী বোরকা পরে ওদের বাড়ীতে প্রবেশ করলে কেউ সন্দেহ করে না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে ইহুদীরা। মুসলিম সমাজ এবং সংস্কৃতিতে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।

 জাহেদীনকে বিদায় করার বিশ দিন পর ক্রাকের রাস্তায় একজন নতুন পাগলের আবির্ভাব ঘটল। মুখে দাড়ি, গায়ে লম্বা জুব্বা, মাথায় পাগড়ী, কাঁধে ঝুলানো রুমাল। চেহারা এবং পোশাক ময়লা। দেখলে মনে হয় দূর থেকে এসেছে। হাতে কাঠের তৈরী ক্রুশ।

 ক্রুশ উপরে তুলে পাগল চিৎকার দিয়ে বলছে ‘মুসলমান ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে গেছে। সুবাকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মুসলিম যুবতীদের ইজ্জত আব্রু নিধনের পালা। মিসরের সব মুসলমান মদে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রভু যিশু বলেছেন, এ জাতি পৃথিবীতে আর বেশীদিন থাকবে না। নূহের দ্বিতীয় প্লাবন না হলে ইহুদীদের খোলাকে সিজদা কর। মসজিদের সিজদা তোমাদের কোন কাজে আসবে না।’

 পোষাকে এবং কথাবার্তায় লোকটাকে পাগল মনে হচ্ছিল। কেউ ডাকলে থেমে যেত, কিন্তু কোন প্রশ্নের জবাব দিত না। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে আগের কথাগুলোই বলে যেত। লোকটা কে, কোথাকে এসেছে জানতে চাইল না কেউ।

 তার হাতে ক্রুশ এ জন্য খ্রিস্টানরা খুশী। ইহুদীদের কথা বলছে বলে তারাও সন্তুষ্ট। মুসলমানদের ধ্বংসের সংবাদ দিচ্ছে বলে দু’দলই আনন্দিত। ক’জন টহল সৈনিক তার ধমক শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। পাগল ভেবে এড়িয়ে গেল পুলিশের লোকেরা। কোন মুসলমান সাহস পেল না পাগলটার মুখ বন্ধ করে দিতে। ক্রোধে ফেটে যাছিল মুসলিম হৃদয়গুলো, কিন্তু ওরা অসহায়।

 লোকটি শহরের অলিতেগলিতে ঘুরে একই কথা বলে যাচ্ছিল। কখনও আগের কথার সাথে নতুন কথা যোগ করত। ‘মুসলিম বাহিনী আর ক্রাকে আসবে না। তাদের সালাহউদ্দন মরে গেছে।’ আবার কখনও এমন অর্থহীন কথা বলত যাতে মনে হচ্ছিল লোকটা আসলেই পাগল। তার পেছনে হাঁটছিল একদল শিশু-কিশোর। বয়স্করা খানিক গিয়ে ফিরে আসত। অনেকক্ষণ থেকে এক যুবক তাকে বলল ‘ওসমান, ক্রুশের আশ্রয়ে চলে এসো।’

 ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে চুপ রইল ওসমান। ওসমানের কাপড়ের নীচে লুকানো খঞ্জরের কথা ওরা জানে না। পাগলটাকে হত্যা করার জন্যই তার পিছু নিয়েছে।

 ওসমান সালেমের পিতামাতা বেঁচে আছেন। ছোট বোন আল নূরের বয়স কুড়ি। ওসমানই সংসারে বড়। দারুণ আবেগপ্রবণ ছেলে। ইসলামের নামে জীবন দিতে প্রস্তুত। খ্রিস্টান গোয়েন্দাদের সন্দেহভাজনদের তালিকায় তারও নাম আছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুসলিম যুবকদেরকে খ্রিস্টান সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে এ যুবক। তবে গোয়েন্দারা এখনও তাকে হাতেনাতে ধরতে পারেনি।

 পাগলের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। পাগলটা ক্রুশ হাতে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলছে দেখে রক্ত গরম হয়ে গেল ওসমানের। লোকটা আসলেই পাগল কিনা তাও ভাবে দেখল না। বাড়ী ফিরে খঞ্জর তুলে নিল। জামার নীচে কোমরে গুঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছু নিল পাগলটার।

 পথে দুইজন খ্রিস্টান যুবকের কথায় রক্ত চড়ে গেল মাথায়। কিন্তু নীরব রইল সে। পাগলটাকে হত্যা করার ইচ্ছে আরও জোরালো হল। পাগলটার পেছনে অনেক শিশু-কিশোর। বড়রাও রয়েছে। এখানে কিছু করা যাবে না।

 বিকেল হয়ে এসেছে, কমে এসেছে পাগলের গলার জোর। তার পেছনের জটলাও হালকা হয়ে এসেছে। সূর্য ডোবার আর একটু বাকী।

 গলির মোড়ে মসজিদের কাছে গিয়ে পাগলটা বসে পড়ল। এখনও ক্রুশ উঁচিয়ে রেখেছে। বলল, ‘এটা এখন থেকে গির্জা, মসজিদ নয়।

পাশে এসে দাঁড়াল ওসমান। সে জানত পাগলটাকে হত্যা করলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। কারণ তার হাতে রয়েছে ক্রুশ, কথা বলছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ওসমান পাগলের আরও কাছে এসে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘ক্রুশসহ এখনি এখান থেকে পালিয়ে যাও। নয়তো খ্রিস্টানরা তোমার লাশ তুলে নেবে।’

 পাগল অনেকক্ষণ ওসমানের দিকে তাকিয়ে রইল। সামনে এখনও কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওসমানের কথার কোন জবাব না দিয়ে কিশোরদের ধমক দিল। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল ওরা। পাগল মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়ল। হত্যা করার সুবর্ণ সুযোগ। কিছু না ভেবেই ওসমান ভেতরে ঢুকে গেট বন্ধ করে দিল। দ্রুত খঞ্জর বের করল। পেছনে ফিরে চাইল পাগল লোকটি।

 ওসমানের খঞ্জর দিয়ে আক্রমণ করেছে। কাঠের ক্রুশ দিয়ে আঘাত ঠেকাল পাগলটা। ‘থাম যুবক। ভেতরে চল। আমি মুসলমান।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top