৪. ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

 শিশুর মত ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল শারজা। ‘আমি তখনই আপনাকে বাঁধা দিয়েছিলেম। এসব লোকের পাল্লায় পড়তে। কিন্তু আপনি বললেন আয়ুবী কে হত্যা করা বৈধ। আপনি ওদের লোভের ফাঁদে পা দিলেন। আমার কথা একবারও ভাবলেন না। এখন আমার কি হবে? আপনি ছাড়া কে আশ্রয় দেবে আমায়?’ আকিলের ভেতর চলছিল মানসিক দ্বন্দ্ব। কখনও ওর কণ্ঠে ধ্বনিত হত অনুশোচনা, ‘ওদের ফাঁদে পা দিয়ে ভুল করেছি। শারজা! সালাহউদ্দীন মানুষ নয়, ফেরেস্তা। আমরা চারজন তাগড়া যুবক তার কিছুই করতে পারিনি। একটু আঁচড়ও লাগেনি তার দেহে। অথচ শূন্য হাতে সে একা আমাদের তিনজনকে মেরে ফেলল। আর আমি মৃত্যুর দুয়ারে।’

 ‘লোকে যে বলে, সালাহউদ্দীনের ঈমান অত্যন্ত মজবুত। কোন পাপী তাকে হত্যা করতে পারে না, এ কথা তাহলে মিথ্যে নয়। আপনারা চারজনই মুসলমান। তাকে মারতে যাওয়ার আগে একবারও ভাবলেন না, আয়ুবী একজন মুসলিম।

 ‘আয়ুবী খলিফাকে অপমান করেছে।’ আকিলের কণ্ঠে উত্তেজনা। ‘তুমি জান না আল আযেদ আল্লাহর খলিফা।’

 ‘খলিফা যেই হোন আর আয়ুবী তার সাথে যে ব্যবহারই করুক তাতে আমার কুছু যায় আসে না। কিন্তু এখন আপনি যে আপনার একমাত্র বোনকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে যাচ্ছেন, এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় বের করা যায় না না?’

 ‘হয়ত যায়। আমার শাস্তি মওকুফ করার আশ্বাস পেয়েই সব গোপন তথ্য প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমার পাপ এত মারাত্মক যে ক্ষমা না-ও করতে পারে।

 এতক্ষণে আকিলের ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ ছিল। কিন্তু বোনকে কাছে পেয়ে আবেগে ও উত্তেজনায় অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল সে। এতে পেটের ক্ষতস্থানের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তবুও কথা বন্ধ করল না বন্দী।

 হঠাৎ ক্ষতস্থানে ব্যথা হতে লাগল। পেট চেপে ধরে বোনকে বলল, ‘শারজা! সম্ভবত আমি মরে যাব। বাইরে লোক আছে, ওকে বল ডাক্তার ডেকে দিতে।’

 ছুটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল শারজা। বেরোতেই সামনে পড়ল এক সেন্ট্রির, বাইরে দাঁড়িয়ে অও পাহারা দিচ্ছিল। শারজা বলল, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ। প্লিজ, একটু একটু দেখুন।’

 সেন্ট্রি শারজাকে ডাক্তারের বাসা দেখিয়ে বলল, ‘আমি যেতে পারছি না, ডাক্তারকে বললেই তিনি চলে আসবেন।’

 কাছেই ডাক্তারের বাসা। শারজা তাকে ভায়ের কথা জানাল। ডাক্তারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, বন্দীকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। দৌড়ে বন্দীর কাছে পৌঁছলেন ডাক্তার। পেটের ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বন্দীকে দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার ঔষধ খাওয়ানো হল। তারপর ডাক্তার অনেক সময় নিয়ে পুরনো ব্যান্ডেজ খুলে নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন।

 ঔষধের প্রভাবে আকিল ঘুমিয়ে পড়ল। অবাক চোখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল শারজা।

সুদর্শন যুবক ডাক্তারের জন্য তার হৃদয়ে সৃষ্টি হতে লাগল শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মিশ্রিত অনুভূতি। এত রাতে একজন অপরাধীকে চিকিৎসা করার জন্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে ডাক্তার ছুটে আসবেন, শারজা এতটা আশা করেনি। ব্যান্ডেজ বাধার সময় ডাক্তারের আন্তরিকতা ও লক্ষ্য করেছে। ব্যান্ডেজ শেষে দু’হাত ওপরে তুলে ডাক্তার অনুচ্চকণ্ঠে রোগীর জন্য প্রার্থনা করলেন। ‘জীবন এবং মৃত্যুতো তোমারই হাতে প্রভু! এ হতভাগাকে রহম কর। মালিক আমার, ওর জীবন ফিরিয়ে দাও। সুস্থ করে দাও ওকে।’

 শারজার চোখ ভিজে উঠল। ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল ওর মন। হাটু গেড়ে বসে ডাক্তারের দু’হাতে চুমো খেল শারজা।

 ‘বন্দীর সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’ ডাক্তারের প্রশ্ন করলেন।

 ‘আমি ওর বোন। ডাক্তার সাহেব! আমার ভায়ের জন্য আপনাদের এত দরদ, এ ভালবাসা কেন? তিনি আপনাদেরকে সব গোপন কথা বলে দিয়েছেন এই জন্য কি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন?’

 ‘ও কাকে কি গোপন তথ্য দিয়েছে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি ডাক্তার। ওকে সুস্থ করে তোলা আমার কর্তব্য। আমার কাছে মুমিন আর অপরাধীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।’

 ‘ও কি অপরাধ করেছে হয়ত আপনি জানেন না। জানলে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ না করে ওখানে লবণ ছিটিয়ে দিতেন।’

 ‘আমি সব জানি। তবুও আমি ওকে বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টা করব।’

 শারজা ডাক্তারের কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজের সব কথা ওকে খুলে বলল।

 ‘বাবা-মা মারা গেছেন, আমি তখন খুব ছোট। ভায়ের বয়স দশ কি এগার। তিনিই আমায় লালন-পালন করেছেন। আমি যুবতী হয়েছি। ভাইজান না থাকলে কেউ আমাকে হয়ত অপহরণ করে নিয়ে যেত। তিনি তার জীবন আমার জন্য উৎসর্গ করেছেন।’

 গভীর মনযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছেন ডাক্তার। ওদের কথার শব্দে আহত লোকটা জেগে উঠতে পারে ভেবে দু’জন বারান্দায় চলে এলেন। অনেকক্ষণ পর যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার। হাত ধরল শারজা, ‘আপনি চলে গেলে আমার ভয় করবে।’

 ‘কিন্তু তোমাকে আমি সাথে নিতে পারছি না, কারণ আমি একা থাকি। আবার এখানে তোমার সাথে রাতও কাটাতে পারছি না। ঠিক আছে, আরো কিছুক্ষণ থাকি।’

 আবার বসে পড়লেন ডাক্তার। কথায় কথায় রাতের দুই প্রহর কেটে গেল। ডাক্তার শেষরাতে বাসায় ফিরলেন। পরদিন সূর্য উঠার আগেই আহত বন্দীকে দেখার জন্য আবার ফিরে এলেন ডাক্তার। নতুন করে ওষুধ দিয়ে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। বন্দীকে দুধ এবং খাবার দেয়া হল। হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল শারজা। এমন খাবার কেউ বন্দীকে দিতে পারে ও জীবনে কখনও কল্পনাও করেনি।

 নাস্তা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর এলেন আলী বিন সুফিয়ান। বন্দীকে দেখে ফিরে গেলেন আলী। থেকে গেলেন ডাক্তার।

 শারজা আবার কথার ঝাপি খুলে দিল। তার জীবন-পাতা মেলে ধরল ডাক্তারের সামনে। অনেক বেলা করে ঘরে ফিরলেন ডাক্তার।

 আকিল লক্ষ্য করল, সন্ধ্যা পর্যন্ত ডাক্তার তিন বার বন্দীকে দেখতে এসেছেন, অথচ আগে দিনে একবারের বেশী আসতেন না। ডাক্তার ফিরে গেলে আকিল বোনকে বলল, ‘শারজা! এই ডাক্তারের হাতে আমার জীবন। বুঝতে পারছি তোমাকে দেখার পর সে আমার চিকিৎসার ব্যাপারে বেশী আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি মরতে রাজি, কিন্তু ও তোমার কাছে যা চায় তা হতে দেব না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার জীবনের বিনিময়ে ও তোমার ইজ্জত নষ্ট করতে চাইছে।’

 ‘আপনি কি বলছেন ভাইয়া! আমি তো তাকে ফেরেস্তার মত পবিত্র মনে করি। আমি বড় হয়েছি। সবকিছু বুঝার বয়স হয়েছে। এই পর্যন্ত সে খারাপ ইশারা তো দূরের কথা, খারাপ কোন কথাও বলেনি। তার সাথে অনেক কথা বলেছি। তাকে আমার খারাপ মনে হয়নি।’

 শারজার কথায় দ্বন্ধের মধ্যে পড়ে গেল আকিল। ডাক্তারের প্রতি তারও আগ্রহ বেড়ে গেল।

 SSSS SSSS SSSS SSSS SSSS SSSS SSSS SSSS SSSS SSSS SSSS

রাতে ডাক্তার আবার এলেন। আকিল ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে শারজা। বারান্দায় চলে এল দু’জন। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বললেন, ‘তোমার ভাইকে যে ওষুধ দিয়েছি সকালের পূর্বে জাগবে না। আমার সাথে বাসায় চল।’

 খানিকটা সংকোচ করলেও শারজা ডাক্তারের প্রস্তাব অস্বীকার করতে পারল না। ডাক্তার সুদর্শন যুবক। এখনো বিয়ে করেননি। বাসায় একা থাকেন। শারজা যুবতি এবং সুন্দরী। মনে মনে ভাবল, আজ রাতেই হয়ত ডাক্তার নিজের মুখোশ খুলে দেবে।

 বাসায় ফিরে দু’জন দু’টো চেয়ার টেনে বসল। ডাক্তারের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছিল নিরেট আন্তরিকতা এবং স্নেহ। আশ্চর্য হল শারজা। ডাক্তার এখনও তাকে খারাপ কোন প্রস্তাব দিচ্ছে না কেন? নিজের অজ্ঞাতেই প্রশ্ন করল, ‘আমি একজন মরুচারী বেদুইন। গরীব যুবতী। এমন এক অপরাধীর বোন যে সম্রাটকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছে। আপনি কেন আমার সাথে এত সুন্দর ব্যবহার করছেন? একজন বন্দীর বোন এ স্নেহ পাওয়ার উপযুক্ত নয়।’

 মৃদু হাসলেন ডাক্তার। কোন জবাব দিলেন না।

 ‘আমি একজন তরুণী এবং রূপসী, এই জন্যেই কি আমার জন্য এ আন্তরিকতা।’

 ‘তুমি রূপসী এবং যুবতী। তোমার তৃতীয় সৌন্দর্যের কথা তুমি জান না। তোমার বয়সী আমার একটা বোন ছিল। দেখতে অবিকল তোমার মত। তোমার মতই আমাদের পিতা-মাতা শৈশবে মারা গেছেন। সংসারে দু’জন ছাড়া কেউ ছিল না। বোনটাকে আমিই লালন-পালন করেছিলাম। আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলাম তার জন্য। বেঁচে ছিলাম ওর ভালবাসা নিয়ে। একবার ওর অসুখ হল। অনেক চিকিৎসা করলাম, কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি। নিজের হাতেই ওকে কবর দিতে হয়েছে। আমি হয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ, একা।

 যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলাম, চমকে উঠেছিলাম। মনে হল, আমার বোনটা আবার ফিরে এসেছে। তুমি দেখতে অবিকল আমার বোনের মত। যদি তুমি তোমার রূপ-যৌবনকে ভয় পাও, আমাকে সন্দেহ কর, তবে আর কখনও তোমার কাছে আম্র স্নেহময় আবেগ প্রকাশ করব না। কথাও বলব না তোমার সাথে। ভয় নেই, পূর্বের আন্তরিকতা নিয়েই তোমার ভায়ের চিকিৎসা করব। তাকে সুস্থ করে তোলা আমার দায়িত্ব। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

 শারজাকে বন্দীর কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলেন ডাক্তার। শারজার মনে এখন কোন সন্দেহ নেই। ডাক্তার তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না নিশ্চিত সে।’

 পরদিন নিয়ম করে ডাক্তার এলেন। বন্দীকে ওষুধ দিয়ে ফিরে গেলেন। শারজার সাথে একটি কথাও বললেন না। শারজা বারান্দায় এসে ডাক্তারের সামনে দাঁড়াল।

 ‘আপনি কি আমার সাথে রাগ করে চলে যাচ্ছেন?’ আমার সাথে একটি কথাও বলেননি কেন?’

 ‘তোমার সাথে রাগ করিনি শারজা। তবে তোমাকে কোন সন্দেহে ফেলতে চাই না।’

 রাতে আকিল ঘুমিয়ে পড়ল। আলতো পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল শারজা। কি এক আকর্ষণে ছুটে গেল ডাক্তারের কাছে। তার মনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। হয়ত ডাক্তারই এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন।

 ‘খলিফা কি আল্লাহর প্রেরিত দূত।’ প্রশ্ন করল ও।

 ‘খলিফাও একজন মানুষ। আল্লাহর প্রেরিত দূত হলেন নবী এবং রাসূলগণ। আমাদের নবী (সা.) পর্যন্ত এসে আল্লাহ্‌ প্রেরিত নবীর আগমন ধারা শেষ হয়ে গেছে।’

 ‘সালাহদ্দীন আয়ুবীও কি আল্লাহর দূত।’

 ‘না তিনিও আমাদের মত মানুষ। তবে উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। আল্লহ এবং নবীর (সা.) বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা যাচ্ছেন।

 ‘সুলতান যে যুদ্ধ করছেন, মানুষ মারছেন, এটা কি বৈধ?’

 ‘মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর বিধান পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করা। এ প্রচেষ্টায় কেউ যদি বাঁধা দেয়, তা দূর করা ফরজ। সুলতান শুধু এ ফরজ আদায় করছেন। তিনি করও ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেননি, বরং ইসলামকে ঠেকাতে চাইছেন।’

 এভাবেই অনেক প্রশ্ন করল শারজা। এখন সে সন্দেহ মুক্ত। সুলতান আয়ুবী সম্পর্কে তার এতদিনের ধারণা বদলে গেছে।

 ‘তা হলে আমার ভাই তো মহা অন্যায় করেছেন। আপনি যেভাবে বলছেন, এভাবে তাকে বললে তিনিও এ পাপের পথে পা দিতেন না। এখন তো তাকে ক্ষমা করা হবে না।’

 ‘হবে। সুলতান তাকে বাঁচিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, তাকে শাস্তি দেয়া হবে না। তার উচিৎ পাপের প্রায়শ্চিত্য করা। আমার বিশ্বাস, সুলতান তাকে কোন শাস্তি দিবেন না।’

 ‘আমি জীবনভর আয়ুবী এবং আপনার খেদমত করব।’ কেঁদে বলল শারজা। ‘আমার ভাই আপনাদের গোলাম হয়ে থাকবে।’

 ডাক্তারের একটা হাত দুহাতে তুলে নিয়ে ও বলল, ‘আপনি আমার কাছে যে মূল্য চাইবেন, আমি দেব। আপনার বাদী হয়ে থাকব সারা জীবন। বিনিময়ে আমার ভাইকে সুস্থ করে দিন। ওকে বাঁচিয়ে তুলুন।’

 ‘বিনিময় নেয়া হয় আল্লাহর কাছ থেকে।’

 শারজার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক্তার বললেন। ‘বোনকে ভায়ের পাপের শাস্তি দেয়া হয় না। ভায়ের স্বাস্থের মূল্য বোন থেকে উসুল করা হয় না। পাপের প্রায়শ্চিত্য পাপ দিয়ে নয়। আমাদের সবার রক্ষক আল্লাহ্‌। প্রতিটি মুসলমান সকল নারীর ইজ্জতের রক্ষক। তোমরা আমাদের কাছে আমানত। তোমার ভাইয়ের সুচিকিৎসা করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর আমি যেন আমানতের খেয়ানত না করি। অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারি। তোমার ভায়ের সুস্থতার জন্য দোয়া কর একজন অসুস্থ ভায়ের জন্য বোনের দোয়া আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই কবুল করবেন।’

 ডাক্তার মেয়েটাকে যেন যাদু করেছেন। তার মিষ্টি ব্যবহারের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে। শারজা যা ভাবছিল ডাক্তার তা নন। ডাক্তারের নৈতিকতাই ওকে বেশী প্রভাবিত করেছে। নিঃসঙ্গ রাতে এমন এক সুন্দরী তরুণীকে একা পেয়েও ডাক্তার অশালীন কোন ইঙ্গিত করেননি। ডাক্তার চাইলে তাকে বাঁধা দেয়া সম্ভব ছিল না। ভায়ের চিকিৎসার জন্য হলেও তাকে ডাক্তারের প্রস্তাবে রাজি হতে হত। কিন্তু ডাক্তারের চোখে কামনার আগুন নেই। স্নেহ ভালোবাসার এক অব্যক্ত অনুভূতি তার চেহারায় আলো হয়ে জ্বলছে। মোহিত হল শারজা। কখন যে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে টের পেল না। ও হারিয়ে গেল ভাবনার অতলে। সম্বিত ফিরল ডাক্তারের ডাকে।

 ‘চল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার ভাইকেও দেখে আসব।’

 দু’জন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আকাশে চাঁদ উঠেনি। আবছা অন্ধকার। ওরা হাঁটছে ধীরে ধীরে। ওরা দু’বাড়ীর মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলছে। সামনের ছোট্ট গলিপথ পেরোলেই আকিলকে যেখানে রাখা হয়েছে সে বাড়ী। বাড়ীটাতে সব সময় সশস্ত্র সেন্ট্রির প্রহরা থাকে। দু’জনের কারো মুখে কোন কথা নেই। হাঁটছে নিঃশব্দে।

 গলির মুখে এসে পড়েছে ওরা। আকস্মাত ওদেরকে পেছন থেকে জাপটে ধরল কেউ। কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হল চোখ-মুখ। ওরা এখন শব্দ করতে পারছে না। ডাক্তার একজন শক্তিশালী যুবক। আচমকা আটকে পড়ায় কিছুই করতে পারছেন না। আক্রমণকারীরা চারজন। ওরা দু’জনের হাত-পা বেঁধে ফেলল। এরপর দুটো দেহ কাঁধে তুলে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

 খানিক দূরে দু’টা ঘোড়া দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তারকে একটা ঘোড়ায় চপিয়ে ওদের একজন পেছনে উঠে বসল। শারজাকে উদ্দেশ্য করে একজন বলল, ‘শব্দ করোনা শারজা। তোমার কাজ হয়ে গেছে। পঞ্চম ঘোড়াটায় উঠে বস।’

 শারজার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে হাত পায়ের বাধন খুলে দেয়া হল।

 ‘ওকে ছেড়ে দাও।’ আক্রমণকারীদের বলল শারজা। ‘ওর কোন দোষ নেই, ও খুব ভাল মানুষ।’

 ‘ওকে আমাদের প্রয়োজন।’ বলল ওদের একজন।

 ‘ওকে তোমাদের কি দরকার?’

 ‘শারজা!’ ভেসে এল অন্য কণ্ঠ। ‘চুপচাপ ঘোড়ায় উঠে বস।’

 চকিতে ওদিকে ফিরে শারজা বলল, ‘আপনি!’

 ‘উঠে বস। সময় নষ্ট করো না।’ ও খুব ভাল সওয়ারী। কায়রো পেছনে ফেলে ঘোড়াগুলো এগিয়ে চলল মর‍্যভূমির বালি মাড়িয়ে।

 প্রভাত সূর্য উঁকি মারছে আকাশে। এখন সেন্ট্রি পরিবর্তনের সময়। নতুন প্রহরী ডিউটিতে এসে দেখল রাতের প্রহরী নেই। জানালা দিয়ে উঁকি দিল কক্ষের ভেতরে। আহত বন্দী কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। গেটে গিয়ে দাঁড়াল নতুন সেন্ট্রি। সে জানত, বন্দীকে দেখার জন্য সকালেই ডাক্তার আসবেন। তারপরে গোয়েন্দা প্রধান। বন্দীর সাথে আছে তার বোন। তার অনুমতি ছাড়া ভেতরে যাওয়া নিষেধ। কিন্তু বোনকে কোথাও দেখা করল না। কিছুক্ষণ পর আলী এসে সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাক্তার কি প্রহরী দেখে চলে গেছে?’

 ডাক্তার এখন আসেননি। আমি এসে রাতের প্রহরীকে পাইনি। বন্দীর বোনকেও কোথাও দেখছি না।

 আলী ভাবলেন, বন্দীর অবস্থা খারাপ বলে মেয়েটা হয়ত ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। শুধু মিসর নয়, মুসলিম বিশ্বের জন্য বন্দী অত্যন্ত মুল্যবান। তাকে দিয়ে ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের রহস্য উদঘাটন করতে হবে।

 কক্ষের ভেজানো দরজা ঠেলে দ্রুত ভেতরে ঢুকলেন আলী। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে বন্দী। এক ঝটকায় বন্দীর মুখের কম্বল সরিয়ে ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে এলেন। যেন মানুষ নয়, কম্বলের নীচে শুয়ে আছে এক বিষধর সাপ।

 সেন্ট্রিকে ডাকলেন আলী। দৌড়ে ভেতরে ঢুকল প্রহরী।

 ‘ওকে চিনতে পারছ? রাতের সেন্ট্রি নয়তো!’

 আতংকে বিবর্ণ হয়ে গেল সেন্ট্রির চেহারা। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘রাতে ও-ই ডিউটি করেছে। ও এখানে ঘুমিয়ে আছে কেন? বন্দী কোথায়?’

 ‘ও ঘুমায়নি, মারা গেছে।’

 কম্বল তুলে একদিকে ফেলে দিলেন আলী। বিছানা রক্তে লাল হয়ে গেছে। প্রহরীর বুকের মাঝ বরাবর খঞ্জরের দুটো আঘাত। বারান্দা এবং বাইরের অবস্থা গভীর মনযোগ দিয়ে দেখলেন আলী। এক ফোটা রক্ত নেই কোথাও। তার অর্থ সেন্ট্রিকে জীবিত কক্ষে ঢোকানো হয়েছিল। খঞ্জর মারা হয়েছে বিছানায় শুইয়ে। চেপে ধরার কারণে দাপাদাপি করতে পারেনি, তা নয়তো এদিক ওদিক রক্তের ছিটে ফোঁটা দেখা যেত। মৃত্যুর পর গায়ের ওপর কম্বল চাপিয়ে বন্দীকে তুলে নেয়া হয়েছে। এ অপহরণে বোনটা সাহায্য করেছে। রূপের লোভ দেখিয়ে হয়ত সেন্ট্রিকে ভেতরে নিয়ে এসেছিল। মেয়েটার সংগীরা ওকে হত্যা করে ভাই-বোন দু’জনকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। বন্দীর গ্রাম থেকে আসা চারজন লোককে দেখা করার অনুমতি দিয়ে ভুল করেছেন বলে আফসোস হল আলীর। নইলে ওরা এখানকার অবস্থা, পাহারা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারত না। মেয়েটাকে তার সাথে থাকার অনুমতি দেয়াও ঠিক হয়নি। ও আসলেই বন্দীর বোন কিনা কে জানে? এখন মনে হচ্ছে, মেয়েটাও ওদের দলেরই সদস্য।

 নিজের ওপর ক্রোধ হচ্ছিল তার। অনুতাপ করছিলেন ভুলের জন্য। অনুতাপ করছিলেন ভুলের জন্য। দক্ষ একজন গোয়েন্দা হিসেবে আলীকে ধোকা দেয়া সহজ নয়, অথচ এরা তাকে বোকা বানিয়ে গেল! এক প্রশ্নের জবাবে সেন্ট্রি বলল, ‘আগের রাতে আমার ডিউটি পড়েছিল। দেখেছি মেয়েটা ডাক্তারের বাড়ী গিয়ে অনেক রাতে ফিরে এসেছে।

 আলীর মনে সন্দেহ জাগল। মেয়েটা রূপ যৌবন দিয়ে ডাক্তারকে হয়ত হাত করে নিয়েছিল। সেন্ট্রিকে বললেন, ‘ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসো। দ্রুত যাবে।’

 চলে গেল সেন্ট্রি। আলী বাইরে পায়ের চিহ্ন পরীক্ষা করতে লাগল। বন্দী আহত। নিশ্চয়ই একা পালাননি। অস্পষ্ট পায়ের ছাপ থেকে আলী কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না। বন্দীর গ্রামে কমান্ডো অভিযান চালানো যায়। কিন্তু কায়রো থেকে সে গ্রাম অনেক দূরে। কি করণীয় কোন কুল কিনারা পেলেন না আলী।

 ফিরে এল প্রহরী। বলল, ‘ডাক্তার বাসায় নেই। তার বাসার চাকর বলেছে, কিছুদিন থেকে একটা মেয়ে ডাক্তারের কাছে আসত। অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলত। গত রাতেও মেয়েটা এসেছিল। অনেক রাতে দু’জনই বাসা থেকে বেরিয়েছে। আর ফিরে আসেনি।’

 আলীর দৃঢ় বিশ্বাস জমল, ডাক্তারও বন্দীকে পালাতে সাহায্য করেছে। মেয়েটার রূপই ের জন্য দায়ী।

 গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ডাকলেন আলী, বন্দীর পালিয়ে যাওয়ার কথা বললেন ওদের গোয়েন্দা কর্মীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। একস্থানে পাওয়া গেল অনেকগুলো ঘোড়ার পদচিহ্ন। আশ-পাশের লোকজন বলল, ‘গতরাতে অনেকগুলো ঘোড়ার পদশব্দ শোনা গেছে। ঘোড়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করে শহরের শেষ সীমা পর্যন্ত গেল গোয়েন্দা দল। সামনে যাওয়া অনর্থক। রাতের ঘোড়ার পদচিহ্ন এখন অনেকটা মুছে গেছে। তবে ওরা কোন দিকে গেছে বুঝা যাচ্ছে।

 সংবাদটা মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের কানে তোলা দরকার। আলী ভাবলেন, বন্দীর দেয়া তথ্য নিশ্চয়ই ভুয়া। পালানোর পথ করার জন্যেই বন্দী অভিনয় করেছে। শুধু তাকে নয়, সুলতানকেও লোকটা বোকা বানিয়ে গেল। দুপুরের দিকে সংবাদ দেয়ার জন্য বেরিয়ে গেলেন আলী।

 কায়রো থেকে অনেক দূরে ছ’টি ঘোড়া তীব্র গতিতে ছুটে চলছে। একটার পিঠে আকিল, অন্যটায় ডাক্তার। ডাক্তারের হাত পা বাঁধা। আড়াআড়িভাবে উপুড় করে তাকে শোয়ানো হয়েছে। একদিকে মাথা এবং অন্যদিকে পা ঝুলছে। নিঃসাড় পড়ে আছেন তিনি। চোখ বাঁধা বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। ঘোড়া যখন মোড় ঘুরছে, উঁচু নীচু টিলা অতিক্রম করছে, অমনি শুধু অনুভব করছেন।

 ডাক্তারের সাথে রয়েছে অপহরণকারীদের একজন। খুরের শব্দে মনে হচ্ছে পেছনে আরো ঘোড়া আসছে। একই গতিতে ঘোড়া ছুটেছে রাতভর। পথে কোথাও বিশ্রাম নেয়নি অপহরণকারীরা।

 আকাশে উঠে এসেছে মরু সূর্য। কিন্তু থামার কোন লক্ষণ নেই। রোদের তেজ বাড়ছে। সূর্য এখন মাথার উপরে। পেছন থেকে ভেসে এল কানফাটা চিৎকার। কেউ পড়ে গেছে ঘোড়ার পিঠ থেকে।

 তার ঘোড়াটিও থামল। পেছনে গেল খানিক। কেউ একজন বলল, ‘তুলে ছায়ায় নিয়ে চল। অজ্ঞান হয়ে গেছে। হায়, হায়! রক্তক্ষরণ হচ্ছে।’

 ‘ডাক্তারের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দাও।’ মেয়েলী কণ্ঠ। ‘রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে আমার ভাই মরে যাবে।’

 রাতভর তীব্র গতিতে ঘোড়া ছুটেছে। ঝাকুনিতে ফেটে গেছে আকিলের ক্ষতের সেলাই। লোকটি দাঁত কামড়ে ব্যথা সহ্য করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অত্যাধিক রক্তক্ষরণে অজ্ঞান হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে।

 একটা গাছের ছায়ায় চলে এল ওরা। পানি দেয়া হল আকিলের মুখে। ভেতরে না গিয়ে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। রক্তে লাল হয়ে গেছে তার কাপড়।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top