৩০. মহাসময়

সুলতান আইয়ুবী তার জানবাজদের নিয়ে ময়দানে গেলেন্ তিনি এমন প্রচন্ড আক্রমণ চালালেন যা তার অতীতের সকল ইতিহাস অতিক্রম করে গেল।

এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাসে লেখে এমন কোন ঐতিহাসিকের আবির্ভাব ঘটেনি পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত। মানুষের চোখ ইতিহাসের পাতায় এমন রক্তপাত দেখেনি কখনো। এই সংঘর্ষের নির্মমতা মানুষের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। ঐতিহাসিকরা শুধু লিখেছেন,‘মানুষের বিবেক এত রক্ষের ¯্রােত কখনো কল্পনা করতে পারে না।’

বিরতিহীনভাবে যুদ্ধ চলেছে সারা দিন। পশ্চিম আকাশে সেই রক্তের আলপনা। টকটকে লাল রক্ত যেমন এক মসয় কালচে রঙ ধারণ করে তেমনি সেই আলপনা মুছে কালো হয়ে গেল আকাশের রঙ। সেই কালো রঙ ছড়িয়ে পড়লো বিশ্ব চরাচরে। ঘন কৃঞ্চ অন্ধকারে অতলে ডুবে গেল পৃথিবী। আক্রার শহর, খৃষ্টানদের ক্যাম্প, মুসলমানদের তাবু সব তলিয়ে গেল সেই অন্ধকারে।

রাত নেমে এলো। মেঘে ঢাকা অন্ধাকার রাত। আকাশে তারা নেই, চাঁদ নেই, আছে শুধু ভয়ংকর, ভীতিকর অন্ধকার । কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হলো না।

সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতি ও সৈনিকদের বললেন, ‘আমরা এখনো মারা যাইনি, বিজয়ও ধরা দেয়নি আমাদের হাতে। অতএব মুজাহিদরা! আজকের রাত আমাদের বিশ্রামের জন্য আসেন্ িআমরা হয় জয়ের নিশান নিয়ে ফিরে যাবো শিবিরে, সেখানে বিশ্রাম নেবো পরম প্রশান্তিতে, নতুবা যুদ্ধ করতে করতে চলে যাবো অনন্ত শান্তির রাজ্যে।

মুসলমান সৈন্যরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে কাঁপিয়ে তুললো যুদ্ধের ময়দান্ এই আওয়াজে ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল খৃষ্টান সৈন্যদের হৃদয়তন্ত্রীতে।

মধ্য রাত। সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধ করতে করতে এতটাই কাবু হয়ে গেলেন যে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেলেন ঘোড়া থেকে। তাকে এনে তাবুতে শুইয়ে দেয়া হলো। যুদ্ধ চলতে লাগলো।

এই যুদ্ধে তিনি ভীষণভাবে আহত হয়েছিলেন। যখন সংজ্ঞা ফিরলো দেখলেন বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। অসম্ভব ক্লান্তিতে হাত-পা অসাড় হয়ে আছে। তিনি দুর্বল কন্ঠে প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন তা হচ্ছে,‘যুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেছে’?

‘ না সুলতান! মুজাহিদরা এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আপনি আহত, তাই আপনাকে সরিয়ে আনা হয়েছে ময়দান থেকে।

ভোর। প্রভাতের আলোয় সুলতানকে দেখতে হলো এক বেদনাদায়ক দৃশ্য। এ দৃশ্য দেখার আগে মরে গেলে ভাল হতো, কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা তো বান্দার জানা থাকার কথা নয়। তিনি দেখলেন, আক্রার প্রাচীরে খৃষ্টানদের পতাকা উঠানো হচ্ছে।

খৃষ্টান সৈন্যরা প্রাচীরের ভাঙ্গা স্থান দিয়ে প্রবল বেগে প্রবেশ করছে শহরে। সেদিনটিও ছিল জুম্মাবার । তারিখটা ছিল ৫৮৭ হিজরীর ১৭ই জমাদিউস সানি মুতাবেক ১২ই জুলাই ১১৯২ সাল।

আল মাশতুত ও কারাকুশ খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে সর্ব শক্তি দিয়ে লড়াই করলেও তার সৈন্যরা এতটাই ক্লান্ত ও অবসন্ন হযে পড়েছিল যে, যুদ্ধ করার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল তাদের। খৃষ্টান সৈন্যরা বানের পানির মত শহরে প্রবেশ করা শরু করলে হাতিয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো তারা।

কিছুক্ষণ পর। সুলতান আইয়ুবী এমন এক দৃশ্য দেখলেন যার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি দেখতে পেলেন, ক্রুসেড বাহিনী প্রায় তিন হাজার মুসলমান বন্দীকে রশি দিয়ে বেঁধে শহরের বাইরে টেনে আনছে। তাদের মধ্যে সৈন্য এবং শহরের সাধারণ মানুষও ছিল।

তাদের এক স্থানে এনে দাঁড় করানো হলো। নিরস্ত্র তিন হাজার বনি আদম দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে মুখে মৃত্যুর আতঙ্ক। খৃষ্টান সেনারা চারদিক থেকে তাদের ঘিরে দাঁড়ালো। তার পর ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই নিরস্ত্র জনতার ওপর। সুলতান আইয়ুবী ও মুসলামন সৈন্যরা কল্পনাই করতে পারেনি, ক্রুসেড বাহিনী এমন অমানবিক বর্বরতায় মেতে উঠতে পারে।

যখন নিরস্ত্র বন্দীদের উপর ক্রুসেড বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো তখন বাইরের মুসলমান সৈন্যরা কোন রকম নির্দেশ ছাড়াই সে সব খৃষ্টান সৈন্যদের উপর মার মার কাট কাট করে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ততক্ষণে বন্দীদের অনেকেই শহীদ হয়ে গেছে। উভয়ের মধ্যে আরো এক দফা প্রবল সংঘর্ষ হলো।

যুদ্ধের তান্ডবতা, আহতদের আর্ত চিৎকার, লাশের দুর্গন্ধ এসব দেখে ইতিমধ্যে স¤্রাট রিচার্ডও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সুলতান আইয়ুবী আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। বিগত যুদ্ধে আহত হওয়ার পর তিনি এখন পুরোপুরি শয্যাশয়ী।

স¤্রাট রিচার্ডের ওপর বিশ্ব খৃষ্টান সম্প্রদায়ের আশা ও ভরসা ছিল, তিনি বিজয়ী না হয়ে ফিরবেন না। তারা তাকে দুঃসাহসী ও ব্যঘ্র হৃদয়ের অধিকারী জানতো।

কিন্তু আক্রার অবরোধ তার মনোবল একেবারে নিঃশেষ করে দিযেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হলেও যে বিভীষিকার মধ্য দিয়ে এই বিজয় অর্জিত হলো সেই বিভীষিকার কথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।

মাত্র কয়েক হাজার মুসলমানের এই বীরত্ব দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। এও কি সম্ভব? কয়েক হাজার সৈন্য বছরের পর বছর ঠেকিয়ে রেখেছে ছয় লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনীকে! অকাতরে জন দিয়েছে।

সামান্যতম ভয়-ভীতিও তাদের স্পর্শ করতে পারেনি! আক্রা জয় করতেই যদি এত মূল্য দিতে হয় তাহলে বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করতে কি পরিমাণ মূল্য দিতে হবে? চিন্তাটা মনে এলেই তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন।

কিন্তু জাতি তাকে বীর বলে জানে। নিজের আকাশচুম্বী মর্যাদাকে তিনি কি ধূলায় মিশিয়ে দিতে পারেন? না, পারেন না। যে বিজয় তিনি অর্জ ন করেছেন তাতে এখন বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হওয়া ছাড়া উপায় নেই তার । তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযাননের সিদ্ধান্ত নিলেন।

সাগরের উপকূল ধরে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন তিনি। পথে তাকে আসকালান ও হায়ফার মত গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বসতি পাড়ি দিতে হবে।

সুলতান আইয়ুবী স¤্রাট রিচার্ডের মনোভাব বুঝতে পারলেন। রিচার্ড এসব শহর ও লোকালয় দখল করে সেখানে তার ক্যাম্প করবে। তারপর এই দুই শহরকে নিজের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানিযে সেখান থেকে আক্রমণ করবে বায়তুল মোকাদ্দাস।

সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাসের জন্য আরও অনেক কোরবাণী দিতে রাজী ছিলেন। তিনি আগেশ দিলেন ‘আসকালান দুর্গকে ধ্বংস করে দাও। এই শহর ও কেল্লাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করো!

সুলতান আইয়ুবীর সেনাপতি ও উপদেষ্টারা এই ঘোষনা শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেল। ‘এতবড় শহর! এত মজবুত কেল্লা? সব গুড়িয়ে দেবো?

সুলতান আইয়ুবী গর্জন করে বললেন, ‘শহর আবার আবাদ করা যাবে। নতুন করে আবার গড়ে তোলা যাবে কেল্লা। মানুষ জন্ম হতেই থাকবে, প্রয়োজনে তারাই গড়ে নেবে নিজেদের কেল্লা ও আবাস। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন এ মুহুর্তে বায়তুল মোকাদ্দাস রক্ষা করা।

ক্রুসেডদের বিশাল বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে। তারা এই কেল্লা ও জনপদকে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানিয়ে নিক তা আমি চাই না। তাদের আক্রমণ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসকে বাঁচাতে হলে এখন এ না করে উপায় নেই। বিকল্প কোন পথ থাকলে এমন হুকুম আমি দিতাম না।’

সবাই বুঝলো, সুলতান আইয়ুবী ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি যা বলছেন তাতে তার রণকুশলতাই প্রমাণিত হচ্ছে। এই রণক্লান্ত সিপাহসালার যুদ্ধের আইন শৃংখলা ও রণকৌশল সম্পর্কে কতটা সজাগ ও সর্তক এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি তাই আরেকবার প্রমাণ করলেন।

সুলতানা আইয়ুবীর নির্দেশে তার ক্ষুদ্র একটি কমান্ডো দল পিছু নিল খৃষ্টান বাহিনীর । তারা সুলতান আইয়ুবীর সেই বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত পথ ধরলো। তারা খৃষ্টান বাহিনীর ডানে বাযে ও পেছনে ঝটিকা আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো ক্রুসেডারদের।

কমান্ডোরা হঠাৎ আর্বিভূত হতো এবং ছো মেরে গোশত তুলে নেয়ার মত যতটুকু পারতো ক্ষতি করে অদৃশ্য হয়ে যেতো। তাদের আক্রমণ হতো আকস্মিক ও এলোপাথাড়ি। স¤্রাট রিচার্ডের বাহিনী তাদের ভয়ে অস্থির ও তটস্থ হয়ে গেল।

এই কমান্ডো বাহিনীর অধিকাংশ আক্রমণ হতো রাতে। কোন কোন রাতে একাধিকবার বা একাধিক জায়গায়ও এ আক্রমণ চালাতো কমান্ডোরা। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করে অদৃশ হয়ে যেতো।

এমনিভাবে ক্রুসেড বাহিনীর অগ্রগতি পদে পদে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তাদের রসদপত্রও নিরাপদ ছিল না। রিচার্ড স্বসৈন্যে আসকালান গিয়ে সাময়িক বিরতি ও বিশ্রাম নেয়ার কথা ভাবলেন।

তিনি তার বাহিনীকে দ্রুততর করে যখন আসকালান গিয়ে পৌঁছলেন তখন আসকালানের অবস্থা দেখে তিনি সীমাহীন বিস্ময়ে কাতর হয়ে গেলেন। তিনি দেখতে পেলেন আসকালান কেল্লা ও শহর বলে কিছু নেই। সবাই এক বিশাল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে আছে।

সেখানকার মুসলিম বাসিন্দাদের বায়তুল মোকাদ্দাস রক্ষায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। শিশু এবং নারীদেরও সরিয়ে নেয়া হয়েছিল অন্যত্র।

চরম বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলেন রিচার্ড। আর সামনে বাড়বেন নাকি পিছিয়ে যাবেন ভাবলেন খানিক। তিনি বুঝতে পারছিলেন, জেরুজালেমে তাকে অর্ভর্থনা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে মুসলিম বাহিনী।

আসকালানে রিচার্ডের আর বিশ্রাম নেয়া হলো না। তিনি বাহিনীকে যাত্রা করার হুকুম দিলেন। পথে তারা যতগুলো কেল্লা পেলো সেগুলোর সবাই ছিল ধ্বংসবিধ্বস্ত।

স¤্রাট রিচার্ড যতই এগিয়ে যাচ্ছিলেন ততোই তার মানসিক অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগলো।

তিনি  চিন্তা করে দেখলেন, মুসলমানরা এক অদ্ভুত জাতি। যে জাতি ধর্মের জন্য এতো কোরবাণী দিতে পারে তাদেরকে দুনিয়া থেকে উৎখাত করা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়।

তিনি বুঝতে পারলেন, সামনে তার জন্য কঠির সময় অপেক্ষা করছে। বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করা এতো সহজ হবে না।

আক্রা বিজয়ের পর ফ্রান্সের স¤্রাটের সাথে তার কথোপকথনের কথা স্মরণ করলেন স¤্রাট রিচার্ড। ফ্রান্সের স¤্রাট তাকে বলেছিল, ‘বায়তুল মোকাদ্দাসের অভিযানে আমিও আপনার সাথে থাকবো।’

‘তাহলে আমরা কি এখানে থেকে একত্রেই রওনা দেবো?’

‘তা বোধ করি ঠিক হবে না। আপনি ¦াগে রওনা হয়ে যান কযেকদিন পর আমি রওনা হই। এক সাথে রওনা হলে আইয়ুবীর বাহিনী আমাদের পিছু নিতে পারে। আর আলাদা রওনা হলে ওরা দ্বিধায় পড়বে। ভাববে, আমরা ওদের পিছু নিলে অবশিষ্ট খৃষ্টান সৈন্যরা আমাদেরও পিছু নিতে পারে। তারা বর্তমান অবস্থায় এমন ঝুঁকি নেবে বলে মনে করি না।’

আজ স¤্রাট রিচার্ড একটি দুঃসংবাদ শুনতে পেলেন। ফ্রান্সের স¤্রাট অগাষ্টাস আক্রা গে অব লজিয়ানের হাতে তুলে দিয়ে নিজে ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছেন। তিনি জেরুজালেম উদ্ধার অভিযানে আসবেন না। কারণ আক্রা দখল করতে গিয়ে তিনি নিজরে প্রচুর ক্ষতি করে ফেলেছেন। আক্রার জয়ও সে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে না। তিনি ক্ষতির পরিমাণ আর বাড়াতে চাচ্ছেন না বলেই দেশে ফিরে যাবেন। এ খবর স¤্রাট রিচার্ডের মনোবল আরো ভেঙে দিল।

খৃষ্টানরা আক্রা দখল করে নিযেছিল বটে কিন্তু মুসলমানরা তাদের কোমর ভেঙে দিয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী আক্রা হাতছাড়া হওয়ায় খুব আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু এই যুদ্ধে যে তারই পরিকাল্পনা সফল হয়েছিল ঐতিহাসিকরা তা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। সুলতানের পরিকল্পনা ছিল তিনি শত্রুদের সামরিক শক্তি আক্রাতেই শেষ করে দেবেন। বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। আক্রাতেই শেষ করে দেবেন। বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। আক্রা জয় করে মোটেও তারা খুশী হতে পারেনি। আক্রাতে তাদের যে পরিমাণ শক্তি ক্ষয় হয়েছে সে তুলনায় এটা কোন বিজয়ই ছিল না।

আক্রার অবরোধ না থাকলে সুলতান আইয়ুবী তার কমান্ডো বাহিনীকে আবার তার বিশেষ রণকৌশ গ্রহণ করতে বললেন। সেই পুরনো রণকৌশল, ‘আঘাত করো আর পালিযে যাও।’

রাত হলেই শুরু হতো এ অতর্কিত আক্রমণ। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, মুসলিম কমান্ডোরা রাতে ঝড়ের মতো আঘাত হানতো ক্রুসেড শিবিরে। তারা ওদের পিছন থেকে বা পাশ থেকে আক্রমণ চালাতো। বহু ক্ষয়-ক্ষতি সাধন করে নিরাপদে আবার পালিযে যেতো।

এভাবে তারা ক্রুসেড বাহিনীর কেবল জানমালের ক্ষতি করতো তা নয়, বরং রাতের পথ পথ চলায় কমান্ডো ভীতি থাকার কারণে তাদের একমাসের পথ পাড়ি দিতি লেগে যেতো তিন মাস। সুলতান আইয়ুবী ক্রুসেড বাহিনীকে পথে দেরী করিয়ে দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো জোরদার করে তুলতে চাচ্ছিলেন।

‘জিয়ান! কিছু একটা করো! পবিত্র ক্রুশের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করো।’ রিচার্ড তার বোন জিয়ানকে বললেন, ‘তকিউদ্দিনকে মুঠোর মধ্যে নিযে নাও। আমরা যুদ্ধ করে বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করতে পারবো না। তকিউদ্দিনকে নিয়ন্ত্রণে এনে আরেকটি রক্তাক্ত সংঘাত থেকে রক্ষা করো যিশুর পুত্রদের।’

‘তুমি বলেছিলে তাকে ভালবাসার লোভ দেখোতে, যেনো সে ভালবাসার জন্য পাগল হয়ে যায় । আমি তোমাকে মা মেরীর কসম খেয়ে বলতে পারি, তার মনে আমি ভালবাসার যে ঝড় তুলে দিয়েছি তাতেসে দিওয়ানা হয়েই আছে । আমি হলফ করে বরতে পারি , সে আমাকে প্রচন্ড ভালবাসে।’

জিয়ান বললো, ‘এই অভিযানের মধ্যেও সে আমার সাথে দেখা করেছে। সে যদি আমাকে পাগলের মত ভাল না বাসতো তবে কিছুতেই তা সম্ভব হতো না। কিন্তু তাকে যখনই বলি তুমি খৃষ্টান হয়ে যাও, সে তখন বলে, ‘না, জিয়ান, বরং তুমি মুসলমান হয়ে যাও।

সে আমার শর্ত আমাকেই ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তুমি বলছো, তুমি খোদার পথে আমাকে ডাকছো। আমি বলছি, ‘আমি তোমাকে খোদার পথে ডাকছি।’ তাহলে তো দেখা যাচ্ছে আমরা উভয়ে একই পথে চলতে চাই। সুতরাং এসো আমরা এক কাজ করি, আমরা দু’জনেই এক সাথে আল্লাহর পথ আঁকড়ে ধরি।

তোমার ধর্ম অনেক পুরনো কিন্তু আমারটা টাটকা, নতুন। এমন তরতাজা ধর্ম রেখে পুরনো ধর্ম কেন আমরা আঁকড়ে ধরে রাখবো? আল্লাহর সর্বশেষ বাণীই হোক আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল।’ এবার বুঝো, সে কতটা ফাজিল হয়েছে।’

সুলতান আইয়ুবী তকিউদ্দিন ও তার দুই পুত্রকে কাছে ডেকে তাদের আদর করে বললেন, ‘আমি তোমাদের মনে দুটো শব্দ গেঁথে দিয়ে যেতে চাই। শব্দ দুটো হলো, ইসলাম ও বায়তুল মোকাদ্দাস।’

তিনি তার সেনাপতিদের ডেকে বললেন,‘এতদিন আমরা আক্রার যুদ্ধ করিনি, যুদ্ধ করেছি বায়তুল মোকাদ্দাস প্রতিরক্ষার। আমি খৃষ্টানদের আক্রায় ডেকে না নিলে এই দু’বছর ওরা কি করতো? ওরা কি বসে থাকতো? ফিরে যেতো নিজেদের দেশে? কখনোই না। তারা সম্মিলিত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো বায়তুল মোকাদ্দাসে। অতএব আমরা খৃষ্টানদের অগ্রযাত্রা দু’বছরের জন্য পিছিয়ে দিতে পেরেছি। সেই সাথে আমরা ওদের শক্তি ও মনোবল শুষে নিয়েছি।’

তকিউদ্দিন একদিন সুলতানের সাতে একাকী দেখা করলেন। বললেন, ‘স¤্রাট রিচার্ড তার বোনকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চান।’

‘কিন্তু কোন শর্তে, কেন?’ জানতে চাইলেন সুলতান।

‘তার শর্ত বড় মারাত্মক ও ভয়ানক। তিনি আমাকে ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে বলেছেন।’

‘তোমার কি ইচ্ছা? তুমি কি তোমার ধর্ম ত্যাগ করে রিচার্ডের বোনকে পেতে চাও?’

‘আমি দুটোই পেতে চাই।’

‘তবে তাকে ইসলামে দীক্ষিত করো। সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে তবে তার সাথে তোমার বিয়েতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না।’

‘আমি আপনার কাছে বিয়ের প্রশ্ন নিয়ে আসিনি।’ তকিউদ্দিন বললেন,‘আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি, আমি বিস্মিত হচ্ছি, রিচার্ডের মত বীর ও সাহসী যোদ্ধা কেমন করে এই চালাকী ও ধূর্তামীর পথ ধরতে পারে। তাকে আমি একজন সম্মানিত স¤্রাট বলেই জানতাম। কিন্তু একজন সাহসী স¤্রাট এতদূর নামতে পারে আমার ধারণা ছিল না। বিষয়টি আমি আপনাকে জানাতে চাচ্ছিলাম।’

‘কেন, তুমি কি রিচার্ডের বোন কে ভালবাস না?’ সুলতান তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘আমি স্বীকার করি তার বোনকে আমি ভালবাসি।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘কিন্তু আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমি আমার ধর্মের সাথে কোন গাদ্দারী ও মুনাফেকী করবো না।’

‘জাহান্নামে যাক সে।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘এই যুদ্ধ রিচার্ড কখনও বায়তুল মোকাদ্দাস দখল নিতে পারবে না।’

তখন সুলতান আইয়ুবীর মুখে ফুটে উঠলো এক টুকরো হাসি। সেই হাসি বলছিল, মানুষের হৃদয় বড় অদ্ভুত জিনিস। ও যে কখন কাকে ভালবাসবে  এই খবর দুনিয়ার কেউ বলতে পারে না। নইলে তুমি কি জানতে না, জিয়ান ভিন্ন ধমেৃর এবং তোমার জাতির দুশমন, যার সাথে তুমি এখনো লাড়াই করছো। তাহলে এ অবস্থায় তাকে ভালবাসতে গেলে কেন?

সুলতান আইয়ুবীর সাথে তকিউদ্দিনের এসব কথা হচ্ছিল তখন, যখন স¤্রাট রিচার্ড বায়তুল মোকাদ্দাসের অদূরে সামরিক ঘাঁটি করে বসে আছেন। এখানে আক্রার চেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনা, কারণ খৃষ্টা ও মুসলমান উভয়েই বায়তুল মোকাদ্দাসকে মনে করে তাদের ধর্মীয় তীর্থস্থান। পবিত্রভূমির জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত উভয় জাতি।

স¤্রাট রিচার্ড এখানে এসেই যুদ্ধ করার পরিবর্তে  আবার দূত পাঠালেন আইয়ুবীর দরবারে। জানালেন, শর্ত মানলে তিনি যুদ্ধ করে অযথা লোক ক্ষয় করতে চান না।

সুলতান আইয়ুবী রিচার্ডের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে দূতকে বিদায় করে দিলেন। এর দু’দিন পর সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা খবর দিল, ‘স¤্রাটা রিচার্ড ভীষণ অসুস্থ। এমন অসুখ যে তাঁর জীবনের আশংকা রয়েছে।

সুলতান আইয়ুবী রাতে তাবু থেকে বের হলেন এবং স¤্রাট রিচার্ডের তাবুর দিকে যাত্রা করলেন। একমাত্র তকিউদ্দিন ছাড়া তিনি কোথায় যাচ্ছেন এ কথা কাউকে জানালেন না। তকিউদ্দিন সুলতানের অভিপ্রায় জেনে হেসে বললেন, ‘অমুক স্থানে রিচার্ডের বোন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি তাকে সঙ্গে নিলে স¤্রাটের কাছে সহজেই পৌঁছাতে পারবেন।’

রাজকুমারী জিয়ান তার যেখানে দাঁড়ানোর কথা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে যখন ঘোড়ার পদধ্বনি শুনলো দৌড়ে গেল ঘোড়ার কাছে। ব্যাকুল কন্ঠে বললো, ‘তুমি এসেছো তকিউদ্দিন?’

সুলতান আইয়ুবী ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। জিয়ানকে বললেন, ‘অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বসো। আমি তকিউদ্দিন নই সালাহউদ্দিন।’

বিস্মিত জিয়ান বললো, ‘আপনি!’

‘হ্যাঁ, শুনলাম তোমার ভাই গুরুতর অসুস্থ। ভয় নেই, আমি তাকে একটু দেখতে চাই। তিনি হয়তো আমার পরিচয় জানতে পারলে আমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেবেন না। তাই আমি তোমার সহযোগিতা চাই। আমাকে তুমি তার তাবুতে পৌঁছে দাও।’

বিস্মিত জিয়ান বললো, ‘কিন্তু. ……!’

‘না, কোন কিন্তু নেই। বললাম তো তোমর ভয়ের কিছু নেই। আমি এক এবং নিরস্ত্র। স¤্রাটের রক্ষী বাহিনীর ওপর তোমর আস্থা থাক উচিত।

জিয়ান আর কথা বাড়ালো না। বললো, ‘চলুন।’

জিয়ান ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে চাইলো। তিনি বললেন, ‘না, তুমি ওখানেই বসে থাকো।’

জিয়ানকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে লাগাম ধরে নিরবে হেঁটে চললেন আইয়ুবী। গন্তব্য স¤্রাট রিচার্ডের তাবু। জিয়ান কিছু বললো, কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তা বুঝতে পারলেন না। বললেন, ‘তোমার ভাষা আমার ভাই বুঝতে পারে, আমি বুঝি না।’

সুলতান আইয়ুবী স¤্রাট রিচার্ডের তাবুতে প্রবশে করলেন। রিচার্ড সত্যিই কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি সুলতান আইয়ুবীর সাথে কথা বলার জন্য দোভাষীকে ডেকে আনালেন।

সুলতান আইয়ুবীই আগে বললেন, ‘আপনার বোনকে সামলান। আমার ভাই তার ধর্ম ত্যাগ করবে না। আর আপনি আমাকে বলুন, আপনার অসুখটা কি? আমি আপনার অসুখের কথা শুনে দেখতে এসেছি।

আপনি মোটেই ভাববেন না, আপনার অসুখের খবর পেয়ে আমরা কোন অন্যায় সুযোগ নেবো। যুদ্ধ আপাতত মুলতবী থাকবে। যতোদিন আপনি সুস্থ হয়ে না উঠবেন ততোদিন আমার সৈন্যরা আপনার উপর কোন আক্রমণ চালাবে না। আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন, পরে যুদ্ধ হবে।’

বিস্মিত স¤্রাট রিচার্ড অবাক হয়ে উঠে বসলেন বিছানায় । চোখে তার বিস্ময়ের ঘোর। বললেন, ‘সালাহউদ্দিন, আপনি!’

তার বিস্ময়মাখা কন্ঠ থেকে সহসা বেরিয়ে এলো, ‘সত্যিই আপনি মহান! সালাহউদ্দিন! সত্যি আপনি এক অনন্য যোদ্ধা।’

তিনি তার অসুখের কথা বললেন। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমাদের এলাকার অসুখ আমাদের এলাকার ডাক্তার চিকিৎসা করতে পারে। আপনাদের এলাকার সৈন্যরা এখানে এসে অসুখে পড়লে ইংল্যান্ডের ডাক্তার কিছুই করতে পারে না। আমি আপনার চিকিৎসার জন্য আমার নিজস্ব ডাক্তারকে এখানেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘সালাহউদ্দিন! আমারা একে অপরের রক্ত আর কতোকাল ঝরাবো?’ রিচার্ড বললেন, ‘এসো আমারা মিমাংসা ও আপোস করে ফেলি।’

‘কিন্তু আমি বন্ধুত্বের বিনিময়ে সে মূল্য দিতে পারবো না যা তুমি চাচ্ছো।’ নসুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তুমি রক্ত ঝারাতে ভয় পাচ্ছো, কিন্তু আমার জাতি বায়তুল মোকাদ্দাসের জন্য জীবনের শেষ কোরবাণী দিতে প্রস্তুত।

স¤্রাট রিচার্ড তাবু থেকে ফিরে এলেন সুলতান আইয়ুবী। এসেই তার নিজস্ব ডাক্তার কে বললেন, ‘স¤্রাট রিচার্ড গুরুতর অসুস্থ। তুমি তাড়াতাড়ি ওখানে যাও।’

চিকিৎসক দেখলেন স¤্রাটকে। তার রোগ আসলেই গুরুতর ছিল। দীর্ঘ দিন লেগে গেল স¤্রাট রির্চাডের সুস্থ হতে।

সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু স¤্রাট রিচার্ডের তরফ থেকে যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি ও মিমাংসার নতুন প্রস্তাব এলো। তিনি সুলতানকে জানালেন, ‘বায়তুল মোকাদ্দাস আমি মুসলমানদের ছেড়ে দিয়ে যাবো। কিন্তু আমার একটি দাবী আপনাকে রাখতে হবে, খৃষ্টান তীর্থযাত্রীদের জেরুজালেম যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে। আর সমুদ্র উপকূলের কিছু এলাকা খৃষ্টানদের ছেড়ে দিতে হবে।’

সুলতান আইয়ুবী এ শর্ত মেনে নিলেন। তার এ শর্ত মেনে নেয়ার পেছনে কারণ ছিল, সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী ক্রমাগত যুদ্ধ করতে রণক্লান্ত। যুদ্ধে প্রচুর সৈন্য শাহাদাত বরণ করায় সৈন্য সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। এই অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করার চাইতে সন্ধি করাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

তিনি ভেবে দেখলেন, দুই বছরের অধিক সময় ধরে তার সৈন্যরা রাতদিন যুদ্ধ করেছে। তারা মানসিক দিক থেকে দুর্বল না হলেও শারীরিক দিক দিয়ে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে।

তাছাড়া তিনি নিজেও শারীরিক দিক দিয়ে অসুস্থ ও ক্লান্ত । এ অবস্থায় খৃষ্টানরা বায়তুল মোকাদ্দাসের দাবী ছেড়ে দিলে সেটা মুসলমানদের বিজয় বলেই গণ্য হয়। তাই তিনি সন্ধি প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন।

স¤্রাট রিচার্ড মুসলমানদের নির্ভীকতা ও জাতীয় চেতনা দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্বাস্থ্যও ভেঙ্গে গিয়েছিল। ওদিকে খবর যা পাচ্ছে তাতে বুঝা যাচ্চে দেেশর অবস্থাও ভাল না। বিরোধী পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে এবঙ তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিযে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে। মোট কথা, ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসন বিপদের সম্মুখীন।

এই সন্ধি চুক্তি ১১৯২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত হয়। স¤্রাট রিচার্ড ৯ অক্টোবর তার সমস্ত সৈন্যসামন্ত নিয়ে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন।

স¤্রাট রিচার্ডের স্বদেশ যাত্রার পর সুলতান আইয়ুবী ঘোসণা করলেন, ‘সৈন্যদের মধ্যে যারা হজ্জে যেতে ইচ্ছুক, তারা যেন নাম লিষ্ট করায়। তাদের সরকারী ব্যবস্থায় হজ্জের জন্য পাঠানো হবে।’

হজ্জ যাত্রীদের লিষ্ট তৈরী হয়ে গেল। দেরী না করে তাদের সবাইকে হজ্জে পাঠিয়ে দিলেন সুলতান। তার নিজেরও হজ্জ করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু জিহাতদ তাকে সে সুযোগ দেয়নি।

তার কাছে সফরের খরচ পরিমাণ নিজস্ব অর্থ ছিল না। সরকারী খরচে যেতেও আপত্তি ছিল তার। তিনি বলেন, ‘সরকারী অর্থ আমার নিজস্ব অর্থ নয়। এর থেকে আমার হজ্জের জন্য এক পয়সা নেয়াও আমি ঠিক মনে করি না।’

মিশরের লেখক মুহাম্মদ ফরিদুল ওয়াহেদিন লিখেছেন, ‘মৃত্যুর সময় সুলতান আইয়ুবীর মাত্র ৪৭ দিরহাম রৌপ্য ও এক ভরির মত সোনা ছিল। তার নিজস্ব কোন বাড়ীও ছিল না।’

সুলতান আইয়ুবী ৪ঠা নভেম্বর বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে দামেশকে গিয়ে পৌঁছেন। তার মাত্র চার মাস পরেই তিনি মহান ¯্রষ্টার সাথে মিলিত হন।

দামেশকে পৌঁছার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনার চাক্ষুস বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, সেখান তিনি তার সন্তান ও পরিবার নিয়ে অবস্থান করেন।

সুলতান আইয়ুবী বাকী জীবন বিশ্রামের জন্য এ শহরকেই বেছে নিয়েছিলেন। তার সন্তানরা তাকে একান্তভাবে কাছে পেযে যারপনাই খুশী। দামেশক ও আশপাশের লোকজন বিজয়ী সুলতানকে একনজর দেখার জন্য এসে ভীড় জমাতো তার মহলের সামনে। সুলতান আইয়ুবীও তার প্রতি জাতির এমন বিশ্বাস ও ভালবাসা দেখে অভিভূত। তিনি তার দুয়ার সর্ব সাধারণের সাক্ষাতরে জন্য সারাক্ষণ খোলা রাখার হুকুম দেন। সাক্ষাতের ব্যাপারে সবার জন্য ছিল সমান অধিকার । পুরুষ, নারী, বৃদ্ধ, শিশু, আমীর, গরীব, শাসক ও শাসিত সকলেই সাক্ষাত লাভে উন্মুখ ছিল, তিনি কাউকে নিরাশ করতেন না। দেশের কবি, সাহিত্যক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরাও আসতেন সুলতানের সাথে দেখা করতে।

তিনি তাদের যথেষ্ট সম্মানের সাথে অর্ভ্যথনা জানাতেন। কবিরা তার কৃতিত্ব ও গুণগান বর্ণনা করে লম্বা লম্বা কবিতা লিখে পেশ করতো তার দরবারে।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত থাকয় দিন রাত কোন সময়ই বিশ্রাম ও শান্তির ঘুমের সুযোগ ছিল না তার। এই বার যেন তিনি সামান্য বিশ্রামের সুযোগ পেলেন। তাছাড়া বয়সের কারণে তিনি শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন।

দৈহিক অবসাদ কাটাতে এবং দেহকে আগের মত চাঙ্ড়া করে তুলতে তিনি ভাই ও সন্তানদের নিযে মাঝে মাঝে হরিণ শিকারে বের হতেন। তার ধারণা ছিল, কিছুদিন বিশ্রাম নিলেই তিনি  আগের মতো পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। তখন তিনি মিশর চলে যাবেন। কিন্তু দামেশকের প্রশাসনিক ও সরকারী কাজ তাকে আটকে দিল।

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দান বলেন, ‘আমি সে সময় বায়তু মোকাদ্দাসের উজির ছিলাম। একদিন দামেশক থেকে সুলতান আইয়ুবীর চিঠি পেলাম। তিনি চিঠিতে আমাকে দামেশকে ডেকে পাছিয়েছেন।

আমি শিঘ্রই যেতে চাইরাম কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি ঝরায় রাস্তারয় কাদা জমে গিয়েছিল। ফলে চিটি পাওয়ার পরও দু সপ্তাহের বেশী সময় আমাকে বায়তুল মোকাদ্দাসেই থাকতে হলো।

১৩ মুহাররম শুক্রবার আমি দামেশকের দিকে রওনা হলাম। ১২ সফর মঙ্গলবার দামেশকে গিয়ে পৌঁছলাম। সে সময় সুলতান আইয়ুবীর সাথে সাক্ষাতের জন্য বৈঠকখানায় কতিপায় আমীর ও অফিসারবৃন্দ অপেক্ষা করছিলেন।

সুলতান আইয়ুবী আমার আগমন সংবাদ জানানো হলে শিঘ্রই তিনি আমাকে তার খাস কামরায় ডেকে নিলেন। তার সামনে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই তিনি বাহু বাড়িয়ে মুসাফা করলেন ও উঠে কোলাকুলি করলেন। আমি তাকে খুব প্রশান্ত চিত্ত ও উৎফুল্ল হৃদয়ের অধিকারী দেখতে পেলাম। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম তার চোখে অশ্রু দেখে।

পরের দিন  আবার তার খাস কামরায় গেলাম। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাক্ষাতের জন্য বাইরের কামরায় কে কে বসে আছে?’

তিনি তার দরবারের খাদেমদের ইনচার্জ জামালুদ্দিন ইকবালকে বললেন, ‘তুমি আমার পক্ষ থেকে ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। বলবে, ব্যক্তিগত দুর্বলতার জন্য তিনি আজ দেখা করতে পারবেন না।’

তিনি আমার সাথে অনেক জরুরী কথা বললেন। আলোচনা শেষ হলে সেদিনের মত চলে এলাম আমি।

পরের দিন। তিনি আমাকে খুব ভোরে দেখা করার জন্য খবর পাঠিয়েছিলেন। আমি তখন গেলাম তখন তিনি বাগানে শিশুদের সাথে গেলছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৈঠখানায় কোন লোক অপেক্ষা করছে?’

আমি বললাম, ‘ এক ফিরিঙ্গী দুত বসে আছে।’

সুলতান বললেন, ‘তাকে এখাইে ডেকে নিয়ে এসো।’

তার ছোট শিশুটি সেখান থেকে চলে গেল। কিন্তু কোলের  বাচ্চাটি রয়ে গেল তার কোলে। সুলতান আইয়ুবী এই শিশুটিকে বুকে নিযে পরম প্রশান্তি পেতেন।

শিশুটি ফিরিঙ্গীকে দেখেই ভয়ে কেঁদে উঠলো। কারণ শিশুটি এমন অদ্ভুত পোশাকের লোক আগে কখনো দেখেনি।

সুলতান আইয়ুবী দুতের কাছে ক্ষমা প্রার্তনা করে বললেন, ‘তোমার এমন পোশাক ও চেহারা দেখে শিশুটি কাঁদছে।’

তিনি শিশুটিকে বুকের সাথে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে দুতকে বললেন, ‘আজ আর আলোচনা সম্ভব নয়। তুমি আাগামীকাল এসো।’ বিদায়ের পর তিনি বললেন, ‘কি রান্না হয়েছে? এখানে নিয়ে এসো।

খুব হালাকা খাবার । সামান্য ক্ষীর ও রুট।ি নাস্তা নয়িে আসা হলো। তনিি অল্প কছিু খলেনে। আমওি তার সঙ্গে নাশতা করলাম। তনিি বললনে, ‘কথা বলতওে অসুবধিা হয়। কারণ অর্জীণ রোগে খুব র্দুবল হয়ে গছে।ি হাজীরা কি এসে গেছে?’

আমি বললাম, ‘রাস্তায় ভীষন কাদা। সম্ভবত কাল এসে পৌঁছতে পারবে। ‘সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তাদের অভ্যর্থনা জানাতে যাবো।’

তিনি এক সামরিক অফিসারকে ডেকে বললেন, ‘হাজীরা আসছেন। রাস্তা পরিস্কার করো।’ আমি সুলতানের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে চলে এলাম।

পরের দিন তিনি অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে হাজীদের অভ্যর্থনা করতে বের হলেন। আমরাও তার পিছনে ঘোড়ায় সওয়ার হলাম। তার ছেলে আল আফজাল এসে উপস্থিত হলো। জনসাধারণ বিজয়ী সুলতানকে একদম কাছ থেকে দেখার জন্য ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। সকলেই তাঁর সাথে মুসাফা করতে চায়।

সুলতান আইয়ুবী জনগণের ভীড় ও চাপ দেখে সন্ত্রস্থ হয়ে উঠলেন। আততায়ী ও খুনী চক্র এর সুযোগ নিতে পারে। কারণ তিনি কোন দেহরক্ষী সঙ্গে আনেননি।

আমি জনতার ভীড় ঠেলে সুলতানের কাছে গেলাম ও তাকে বললাম, ‘আপনি রাজকীয় পোশাকে বের হয়েছেন অথচ সঙ্গে কোন প্রহরী আনেননি। আমি খুবই ভয় পাচ্ছি। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়?’

তিনি আমার কাথার গুরুত্ব দিলেন। চমকে আমার দিকে তাকিয়ে নিজেই ঘোড়া ঘুরিয়ে অন্য পথে কেল্লার দিকে চললেন। আমি ও আল ফজল তার সাতে ছিলাম। আমরা ঝর্ণার পাশ দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করলাম।

শুক্রবার সন্ধ্যা। সুরতান আইয়ুবীর শরীর খুবই দুর্বল হয়ে পড়লো। মাঝ রাতে জ্বর শুরু হলো।

২১ ফেব্রুয়ারী ১১৯৩। তিনি বার বার মুর্ছা যেতে লাগলেন। তার শরীর শীতল হয়ে আসতে লাগলো। সে সময় তার ছেলে আল আফজাল তার কাছে ছিল। তিনি জ্ঞান ফিরলেই বলতেন, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’

আল আফজাল খবর দিল আমাকে। তিনি সারা রাত যন্ত্রণায় ছটফট করে কাটালেন। আমরা কযেকজন তাকে ঘিরে বসে রইলাম। এতে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেন। ভোরে তার কষ্টের প্রকোপ কমে গেল। তিনি অনেক সুস্থ বোধ করলেন। আমি সেখান থেকে বিদায় নিতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘আল আফজালকে সঙ্গে নিয়ে নাস্তা করে যাও।

আমার সাথে কাজী আল ফজলও ছিলেন, তিনি অন্যখানে দাওয়াত আছে বের চলে গেলেন। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, সুলতান আইয়ুবীকে এ অবস্থায় রেখে যেতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমরা খাবার কামরায় গেরাম। সেখানে অনেক লোক। সকলের চোখেই অশ্রু টলমল করছে।

পরের দিন থেকে সুরতানের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যেতে লাগলো। কাজী আল ফজল প্রতিদিনই সুলতানকে দেখতে আসেন। সুলতানের অসুখ কিচু কম থাকলে তিনি আমাকে সাথে কথা বলেন, নইলে চোখ বন্ধ করে সুলতানের পাশে বসে থাকেন। সুলতানের চিকিৎসায় চারজন ডাক্তার নিয়োজিত ছিলেন। তাদের কারো মুখেই হাসি নেই । তাদের মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় তারা কতটা নিরাশ।

আজ চারদিন ধরে সুলতানের শরীর খুব বেশী খারাপ। তার শরীরের যখন তখন অবস্থা।

ষষ্ঠ দিনে আামরা তাকে ধরে উঠালাম ঔষধ পান করানোর জন্য। পানি ঈষৎ গরম প্রয়োজন ছিল, তিনি পানি মুখে নিতে গিয়ে বললেন, ‘বেশী গরম। একটু ঠান্ডা করে দাও।’

যখন পানি ঠান্ডা করে তার হাতে দেয়া হলো, তিনি বললেন, ‘একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে।’ তিনি রাগ বা অভিমান না করে শুধু ক্ষীণ স্বরে বললেন,‘হে আল্লাহ, এরা কেউ আমার উপকার করতে পারবে না।’

বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ বলেন, ‘আামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল আল আফজাল। তার চোখে অশ্রু দেখে আমারও চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। হায়, সমস্ত খৃষ্টান জগতকে কাঁপিয়ে দেয়া মানুষটি আজ এত অসহায়।!

আমরা ডাক্তারের কামরায় গেলাম। কাজী আল ফজল আমাদের দেখে বললেন, ‘ আমি দেখতে পাচ্ছি, জাতি এক মহান নেতার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।

অষ্টম ও নবম দিনে তিনি অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রইলেন। তিনি আর পানিও পান করতে পারলেন না। এ খবর শুনে সমস্ত শহরে যেন মৃত্যুর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। শহরের সব মসজিদে সুলতানের আরোগ্যের জন্য দোয়া হতে লাগলো। মেয়েরা ঘরের কোণায় বসে জায়নামাজ ভিজিয়ে দিচ্ছিল আপন অশ্রুতে।

আমি ও কাজী আল ফজল রাতের প্রথম দিকে তার কাছে থাকতাম। শেষ রাতে থাকতো তার ছেলে ও পরিবারে লোকজন। আমরা লক্ষ্য করতাম, তিনি তাকাতেন ও কথা বলতে পারছেন না।

শেষ রাতে যখন তার পরিবারে লোকজন তার কাছে থাকতো তখনো আমরা সেখান থেকে চলে যেতে পারতাম না। অবশিষ্ট রাত আমারা কামরার বাইরে বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিতাম। কেউ তার কামরা থেকে বের হলে তার কাচে থেকে জেনে নিতাম তার অবস্থা।

বাইরের লোকজন আমাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারতো সুলতানের অস্থা ভাল নয়। তারা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো কিন্তু কিচু জিজ্ঞেস করতো ন্

াদশ দিনের দিন ডাক্তার তার পেট পরিস্কারের ঔষধ দিল। তাতে রোগ কিছুটা কমলো। তিনি চোখ মেলে চাইলেন এবং পানি পান করলেন। লোকজন যখন এ খবর শুনলো তখন সবার মনে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলো।

রাতে আমরা তার কাছেই বসে ছিলাম। ডাক্তার এলেন। তার নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন, ‘তার শ্বাসকষ্ট কমেছে। এখন তিনি স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন।’

আমরা বললাম, ‘তার শরীর খুব ঘামছে।’

তিনি বললেন, ‘ঘাম বের হওয়া ভালো।’

আমরা আশ্বস্ত হয়ে বসে রইলাম।

এই অসুস্থতার ১১তম দিনে সুলতান আইয়ুবীর অবস্থা আবার দ্রুত খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তার দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিলেন তার কামরায়।

তার জীবনী শক্তি দ্রুত নিঃশেষ হয়ে আসছিল। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পুত্র আল আফজাল দেখলেন যে, সুলতানের আর বাঁচার আশা নেই। আল আফজাল সমস্ত আমীর ওমরাহ ও উজিরদের ডাকলেন। বললেন, ‘আব্বার মৃত্যুর পর তার গড়া এই সালতানাত আবার টুকরো টুকরো হয়ে যাক তা আমি চাই না। যে ঈমান ও একতার বন্ধনে তিনি আমাদের হৃদয়গুলোকে বেঁধে দিয়েছিলেন সেই বন্ধন দঅটুট রেখেই আগামী দিনগুলোতে আমাদের পথ চলতে হবে।

কোন রকম প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বিশৃঙ্খলার অবকাশ তৈরী হোক তা আমি চাই না। তাই আমি আবেদন জানাচ্ছি, আব্বার স্থলে আপনারা নতুন একজনকে সুরতান মনোনীত করুন এবং আসুন আমরা সাবাই শপথ বাক্য পাঠ করে তার আনুগত্য মেনে নেই।

সবাই সর্বস্মতভাবে আল-আফজালকেই এ দায়িত্ব গ্রহণের আবেদন জানালে তিনি নিজে প্রথমে হলফনাম পাঠ করলেন। তারপর সমস্ত আমীর, উজির, সেনাপতি সকলেই তার আনুগত্য মেনে নিয়ে হলফনামা পাঠ করলেন।

এ ছাড়া উপস্থিত সকলেই সুলতান আইয়ুবীর মৃত্যুর পর তার রাজ্যের একতা ও শক্তি অটুট রাখতে তার পুত্র আল আফজালের আনুগত্যের পক্ষে শপথ গ্রহণ করলো।

হলপ করার সময় আমীররা এমন দৃঢ় উক্তিও করলো, ‘যদি আমাদের মধ্যে কেউ পরবর্তীতে অঙ্গীকার ভঙ্গ করি তবে তার বিবি তালাক হয়ে যাবে। সে আইনত: শাসন ক্ষমতা ও দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে।’

৩ মার্চ ১১৯৩ সাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা। অসুস্থতার আজ ১১তম দিন। রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এখন এ মহলেই অবস্থান করছেন। একটু আগে শপথনামা পাঠের মধ্যে দিয়ে দেশের শাসনভার সুলতান আইয়ুবীর বড় ছেলে আল আফজালের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। তিনি সুলতানের সারা জীবনের সঙ্গী কয়েকজনকে নিযে সুলতান যে রুমে শয্যাশয়ী ছিলেন সে কামরায় এলেন। তারা সবাই সুলতানের জীবনের আশা ত্যাগ করেছিল। রাতে কাজী আবুল ফজল ও ইবনে জাকীকে ডাকা হলো। ইবনে জাকী বিজ্ঞ পন্ডিত ও আইনজ্ঞ লোক ছিলেন। জেরুজালেম বিজয়ের পর সুলতান আইয়ুবী মসজিদুল আকসায় প্রথম জুম্মার খোৎবা দেয়ার জন্য তাকেই নির্বাচন করেছিলেন। তিনি ছিলেন দামেশকের প্রধান বিচারক।

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ বলেন, ‘রাতে আল আফজাল আমাদের দু’জনকে মুমূর্ষ সুলতানের পাশে থাকতে বললেন্ আমরা মানে আমি ও ইবনে জাকি। সারা রাত বাইরে সুলতানের সংবাদের জন্য জনগণ উৎকন্ঠা নিযে দাঁড়িয়ে থাকলো। ইমাম আবু জাফর সুলতানের শিয়রে বসে কোরআন তেলাওয়াত শুরু করলেন। ইমাম আবু জাফর তার স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘আমি সুলতানের শিয়রে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছিলাম। তখন তিনি প্রায়ই বেহুশ । অনেকটা ঘোরের মধ্যে সময় কাটছিল তাঁর। আমি পবিত্র কোরআনের শুরু থেকে তেলাওয়াত আরম্ভ করলাম।’

৪ মার্চ ১১৯৩ তারিখের মধ্য রাত। ইমাম আবু জাফর বলেন, ‘আমি ২২পারা সুরা হজ্জের এই আয়াত পাঠ করছিলাম, ‘আল্লাহই সব কিছুর উপর ক্ষমতাশীল। আল্লাহই সত্য! তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন, তিনি ক্ষমতাশীল।’ এ সময় সুলতান আইয়বী ক্ষীণ স্বরে কিছু বললেন। কিন্তু তিনি কি বললেন আমি বুঝতে পারলাম না।

ফজরের আজান হলো। আমি কোরআন পাঠ বন্ধ করলাম। দেখলাম সুলতানের ঠোঁট সামান্য নড়ছে। কি বলছেন স্পষ্ট বুঝা গেল না, মনে হলো তিনি কালেমা পাঠ করছেন।

আমি তাকালাম সেখানে উপবিষ্ট কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ ও ইবনে জাকির দিকে। তারা ঝুঁকে এলেন সুলতানের মুখের ওপর। তারা টের পেলেন, আজান শেষ হওয়ার সঙ্গে সেঙ্গই সুলতান আইয়ুবী তার প্রভু মাহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর দরবারে হাজিরা দেয়ার জন্য রওনা হয়ে গেছেন। তারা একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ বলেন, মুসলিম বিশ্বে খোলাফায়ে রাশেদীনের পর কঠিন আঘাত পড়েছিল সুলতান আইয়বীর মৃত্যুতে। মানুষের ঢল নেমে এসেছিল রাস্তায়। শোকে তাদের অন্তরগুলো ছিল মুহ্যমান। মিছিলের পর মিছিল আসছিল মহলের দিকে। তাদের কন্ঠে শোক ও মাতমের ধ্বনি। সবাই জোরে জোরে পড়ছির কালেমায়ে শাহাদত, ‘আশহাদু আল্লাইলা ইল্লাল্লাহু……………’

জোহরের সময় সুলতান আইয়ুবীর মরদেহ গোছল করানো হয়। মৃতদেহ বাহিরে আনা হলো কাফনের কাপড় পরিয়ে। সুলতানের কফিনটি যে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল সেটি দান করেছিলেন কাজী আল ফজল।

কফিন যখন মহলের চার দেয়ালের বইরে আনা হচ্ছিল তখন নারী, পুরুষ ও শিশুর কান্না ও আহাজারিতে আসমান বিদীর্ণ হচ্ছিল। দামেশকের স্বজনহারা মানুষের বুক ফাটা ক্রন্দন সহ্য করার মতো ছিল না।

নামাজে জানাজায় ইমামতি করলেন কাজী মহিউদ্দিন ইবনে জাকী। জানাজায় কত লোক হয়েছিল সে সংখ্যা নির্ণ করার সাধ্য ছিল না কারো। শুধু অসংখ্য মানুষের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল দূর দূরান্ত পর্যন্ত।

নামাজে জানাজার পর তার মৃতদেহ বাগানের একটি ঘরে রাখা হলো সামান্য সময়ের জন্য। এখানে তিনি অসুস্থ অবস্থায় কয়েকদিন কাটিয়েছিলেন। আছর নামাজের আগেই সুলাতান আইয়ুবীর মৃতদেহ কবরস্থ করা হলো।

সুলতান আইয়ুবীর একটি স্বপ্ন ছিল, ফিলিস্তিন বিজয়ের পর তিনি হজ্জের ফরজ আদায় করবেন। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি। ঐতিহাসিকরা বলছেন, এর কারণ ছিল অসুস্থতা ও আর্থিক অনটর। তার নিজস্ব অর্থ শেষ হয়ে গিয়েছিল। বায়তুল মালের অর্থে হজ্জ করার ব্যাপারে তার আপত্তি থাকায় তাঁর এ স্বপ্ন পূরণ হয়নি। যে মর্দে মুজাহিদের পতাকাতলে দাঁড়িয়ে শত্রুর চক্রান্ত ছিন্নভিন্ন করেছে হাজারও মুজাহিদ, যার হাতে সৈন্য ও সম্পদ তুলে দিয়েছিল মিশর, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের শাসকবৃন্দ সেই সুলতান একটার পর একটা বিজয় ছিনিয়ে এনেও এতই নিঃস্ব ছিলেন যে, শেষ জীবনে হজ্জ করার প্রয়োজনীয় অর্থটুকুও তার হাতে ছিল না।

স¤্রাট রিচার্ডের সাথে সুলতান আইয়ুবীর চুক্তির মেয়াদ ছিল তিন বছর স্থায়ী। বিদায়ের সময় স¤্রাট রিচার্ড সুলতান আইয়ুবীকে একটি চিঠি দিয়ে যান্ তাতে তিনি বলেন, ‘তিন বছর পর আবার আমি জেরুজালেম উদ্ধার করতে আসবো।’ কিন্তু তারপর শত শত বছর কোন খৃষ্টান স¤্রাট শত চেষ্টা করেও বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করতে পারেনি।

১৯৬৭ সালের জুন মাস। এই ঘটনার পৌণে আটশো বছর পর মুসলিম বিশ্ব আবার প্রত্যক্ষ করলো এক বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা। আরব ও মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক অনৈক্য ও দুর্বলতার ফলে পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস ও মসজিদুল আকসা আবার চলে গেলে কাফের দের হাতে। খৃদষ্টানদের মদদে তার কর্তৃত্ব নিল অভিশপ্ত ইহুদী জাতি।

বেদনারয় মুষড়ে পড়লো মুসলিম বিশ্ব। আটশো বছর আগের ইতিহাসের পূনরাবৃত্তি ঘটরো পবিত্র মাটিতে। মুসলমানদের রক্তে নতুন করে ভিজতে শুরু করলো ফিলিস্তিনের মাটি।

ইতিহাস আগের মতোই থাকলো । ইহুদী ও খৃষ্টানরা একজোট হয়ে শুরু করলো বিংশ শতাব্দীর নতুন ক্রুসেড। কখনো ঘোষণা দিয়ে কখনো ঘোষনা ছাড়া সেই ক্রুসেড চলতেই থাকলো। আবার শুরু হলো মুসলিম জাতিত্ত্বা বিনাশের ষড়যন্ত্র।

চক্রান্তের ধরনের কোন পরিবর্তন নেই। সেই অভিন্ন রূপ, অভিন্ন চালচিত্র। মুসলিম যুবকদের চরিত্র হননের সেই অভিন্ন কৌশল। মুসলমানদের ঈমান ক্রয় করে গাদ্দার বানানোর জন্য আজো ব্যবহৃত হচ্ছে সেই নিষিদ্ধ গন্ধম। নারীর মোহ, ক্ষমতার লোভ, গদির মায়া, সম্পদের আকর্ষণ, মদের নেশা কি নেই সেখানে?

শিয়া-সুন্নীর বিরোধ, নানা রকম ফেরকা ও উপদল সৃষ্টি, ভৌগলিক জাতীয়তার উন্মাদনা জাগানো এবঙ এ ধরনের নানা উপায় অবলম্বন করে মুসলিম জাতিসত্ত্বাকে খন্ডবিখন্ড করার চক্রান্ত, সেই ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধের বিষাক্ত ছোবল, সবকিছুই পরিবেশন করা হচ্ছে আরও উন্নততর পদ্ধতিতে , আধুনিক  প্রযুক্তির উৎকর্ষতার নিত্য-নতুন মোড়কে।

সভতার সবচে বড় ট্রাজেতি, যে পাশবিক  শক্তি পৃথিবীর শান্তি বিঘœ করছে তার কন্ঠেই শোনা যাচ্ছে মানবতার অদ্ভত মায়াকান্না। এই ষড়যন্ত বা আদুনিক ক্রুসেড এখন আর কেবল ফিলিস্তিন নয়, কেবল আরব বিশ্ব নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করার জন্য সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে ছোবলের পর ছোবল হেনে চলছে। পৃথিবী এখন এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন।

এ বির্পযয় থেকে  বাঁচতে হলে কেবল মুসলামন নয় মানবতার স্বপক্ষ শক্তিকে আবার পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মানবিক শক্তিকে আবার নামতে হবে সভ্যতা ও মানবতার অস্তিত্ব রক্ষার অনিবার্য সমরে।

এ লড়াই হবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার লড়াই। বিজ্ঞান ও প্রযুতি হবে যুদ্ধের হাতিয়ার। রুখেতে হবে পাশবিক সংস্কৃতির সর্বনাশা ছোবল। মানুসের মনে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে মানুষ ও মানবতার প্রতি মতত্ববোধ; পারস্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সৌরভ।

আজ শুধু ফিলিস্তিন নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নির্যাতীত মানবাত্মা ক্রন্দ করছে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবরি মত এক মহান নেতার জন্য । যার বুক ভরা থাকবে ¯িœগ্ধ ভালবাসার কোমল মায়ায়। যার হৃদয়ের আকাশ জুড়ে থাকবে মহত্বের সুউচ্চ মিনার। অন্তর জুড়ে থাকবে অনন্ত সুবাসিত পুস্প-পরাগ।

কিন্তু সেই নেতা তখন আসবেন যখন মানবতার স্বপক্ষ শক্তি আবার যুথবদ্ধ হবে। ঈমানের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে রাসূলের প্রেমিকেরা। সব নীচতা, হীনতা, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার ও কুপমন্ডকতা মাড়িয়ে সত্যকে ধারন করার জন্য উন্মুখ হযে উঠবে আলোর পাখীরা।

জমিন তৈরী না হওয়া পর্যন্ত যেমন বীজ ফেললে সেই জমিতে ফসল ফলে না, তেমনি মানবতার স্বপক্ষ শক্তির হৃদয়ে ততোক্ষণ সেই মহান নেতার আবির্ভাব কি করে আমরা আশা করতে পারি? তাইতো সভ্যতার স্বপক্ষ শক্তি আবার দাঁড়িয়েছে পাশবিকতার বিরুদ্ধে। মানবতার স্বপক্ষে উচ্চারিত হচ্ছে উচ্চকিত জনকল্লোল । একদিন এই জনরবে হারিযে যাবে আমাদের আত্মার ক্রন্দন।

জানি, একদিন নতুন আইয়ুবীর আগমন ঘটবে রক্তাক্ত বিশ্বের কান্না থামাতে। কিন্তু কে হবেন সে আইয়ুবী? এখন তিনি কোথায়? কার ঘরে? তার বাহিনীতে থাকবে কি আমার নাম? আমার সন্তানের ? জানি না।

শুধু জানি, তিনি আসবেন। তিনি আসবেন সত্যের মশাল হাতে। যে মশালের আলোয় উদ্ভাসিত হবে মানুষের হৃদয়। ঘুচে যাবে অন্তরের অনন্ত অন্ধকার। চাঁদ উঠবে। ফুল ফুটবে। প্রেমের সুবাসে আবার সুবাসিত হবে পৃথিবীর মায়াকানন।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top