৩০. মহাসময়

আমি যেই আমীরের রক্ষিতা সেই আমীরের সহায়তায় তাদেরকে কায়রো থেকে পালানোর সুযোগ করে দিলাম। তারা চলে যাওয়ার পর সেখানে নতুন দায়িত্ব নিয়ে আরো দু’জন গোয়েন্দা এলা। তারা আমার সাহায্য চেয়ে বললো,‘আমরা সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছি।’

কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই তাদের কাছে হাতিন যুদ্ধের ফলাফল এসে পৌঁছালো। তারা এটাও জানতে পারলো, খৃষ্টানদের পবিত্র ক্রুশ চিনহটি এখন সুলতান আইয়ুবীর কাছে। আর সে ক্রুশের রক্ষক তাদের মহান পাদ্রী হাতিনের ময়দানে যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তারা আরো খবর পেলো, এই যুদ্ধে কয়েকজন খৃষ্টান স¤্রাট মারা গেছেন অন্য স¤্রাটরা সাবই বন্দী হয়েছেন। বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসক গে অব লুজিয়ানও আছেন এই বন্দীদের তালিকায়।

এই সব সংবাদ তাদের কাছে বজ্রাঘাতের মতই মনে হতে লাগলো। অবশেষে তাদের কাছে আরও দুটি সংবাদ পৌঁছলো। তারা জানতে পারলো, তাদের উস্তাদ হরমুনও বন্দী হয়েছেন এবং ইশ্বরের পুত্র মহান যিমুর স্মৃতিবিজড়িত জেরুজালেম খৃষ্টাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে।

পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের অধিকারে চলে গেছে এ খবর শুনে তাদের মাথা খালাপ হয়ে গেল।

তাদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে কায়রোতে পাঠানো হয়েছিল কায়রোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য । এ ধরনের শয়তানী কাজের সব শিক্ষাই তারা ভালভাবে রপ্ত করে নিয়েছিল।

তাদেরক ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতির পরিবর্তে ধোঁকা ও ছলনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। নীতি নয়, দুর্নীতিেিতই তারা ছিল দক্ষ ও পারঙ্গম। ধর্মীয় আচার পালনের ব্যাপারে তারা ছিল স্বাধীনস। কারণ গোয়েন্দাদের ধর্মীয় পরিচয় তাদের উপকারের চাইতে অপকার করে বেশী। এ জন্য ধর্মীয় বিধান পালনের কোন নির্দেশ তাদের ওপর ছিল না।

তাদের শুধু বলা হয়েছিল,‘ইশ্বরের পুত্র ঈসা মসীহের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তৈরী করা হয়েছে এক বিশাল ক্রুশ। এই ক্রুশ খৃষ্টানদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। যতোদিন এই ক্রুশ আমাদের হাতে থাকবে ততোদিন আমাদেরকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। তাবে শর্ত হলো, এই ক্রুশের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য ইশ্বর পুত্রের ভক্তদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে হবে।’

তাদের প্রশিক্ষণের পর সেই বিশাল ক্রুশের আশির্বাদ নেয়ার জন্য তাদেরকে আক্রায় পাঠানো হয়। সেখানকার বড় গির্জার মহান পাদ্রী ক্রুশ স্পর্শ করে তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান। শপথ অনুষ্টানে তিতিন বলেন,‘ক্রুশের শাসন শ্রেষ্ট শাসন। তার কেন্দ্র জেরুজালেম, সেখানে হযরত ঈসা মসীহকে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিল। ইসলাম কোন ধর্ম নয়। মুসলমানদের খৃষ্টান ধর্মে নিয়ে আসা এবং যারা আসবে না তাদেরকে হত্যা করা অসীম পূন্যের কাজ। যে সব মেয়েরা ক্রুশের জন্য তাদের সম্ভ্রম কোরবানী দেবে তাদেরকে পরকালে জান্নাতের হুর বানানো হবে।’

তিনি এইসব গোয়েন্দাদের এ রকম আরো অনেক নসীহত করলেন। তারাও পাদ্রীর সব কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সেই ক্রুশ স্পর্শ করে তার সম্মান রক্ষার শপথ করলো।

এ জন্য তারা শাষকদের হুকুমে যে কোন পাপ কাজ করাকে খুবই পূণ্যময় কাজ বলে গণ্য করতো । আর এসব পূণ্য কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল মুসলমানদের ধোঁকা ও প্রতারণা করা। তারা যখন জানতে পারলো, পবিত্র ক্রুশও নেই, ক্রুশের রক্ষকও নেই, আর ঈসা মসীহের স্মৃতি বিজড়িত জেরুজালেম, যা ক্রুসেড শাসনের মুলকেন্দ্র তাও খৃষ্টানদের দখলে নেই, তখন তাদরে এতদিনের সব বিশ্বাস ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল।

তারা আরও লক্ষ্য করলো, কায়রোতে যে সব পুরুষ গোয়েন্দা তাদের সাথী ছিল, তারা সবাই পালিয়ে গেছে।

একদিন এক গোয়েন্দা তার সাথীর খোঁজে বের হয়ে শুনতে পেলো, সেও নিখোঁজ। কায়রোতে যারা আমািদের সহযোগী ছিল তাদের একজন তাকে বললো,‘এখানে তোমাদের আর কোন সাহায্যকারী নেই। তুমি কোন মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে মুসলমান হয়ে যাও নইলে এখান থেকে পালাও।’

তখন সেই গোয়েন্দা পাগলের মত হয়ে গেল। সে আমার সাথে দেখা করে সব খুলে বললো আমাকে। সেই সাথে বললো তার পরিকল্পনার কথা । বললো,‘পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই আমাদের।’

আমিও তার সাথে এক মত হলাম। সে আমাকে সঙ্গে নিতে রাজি হলো। তখন আমি তাকে আমার বান্ধবীর কথা বললাম। সে তাকেও সঙ্গে নিতে সম্মত হলো।

এই আলাপের পর সে আমাদের এক সহযোগী মুসলামন অফিসারের কাছ থেকে তিনটি ঘোড়া চেয়ে নিল। বললো,‘আমার এই দু’বোনের ভ্রমনের শখ হয়েছে। তুমি তিনটি ঘোড়া দাও, আমরা একটু ভ্রমন করি।’

 সেই অফিসার সরল বিশ্বাসে তার হাতে তিনটি ঘোড়া তুলে দিল। আমরা দু’বান্ধবী সন্ধ্যার একটু আগেই বাসা থেকে বের হলাম। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। আমরা সেই গোয়েন্দার বলে দেয়া জায়গায় গিয়ে তার সাথে দেখা করলাম।

আমরা তিনজন তিনটি ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। সন্ধ্যা যখন গভীর হলো তখন আমরা শহর থেকে অনেক দূরে।

আমরা সঙ্গে করে কিছু খাবার ও পানি নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু মরুভূমির সফর সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। আমাদের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, আগে কায়রোর সীমানা অতিক্রম করতে হবে।

আমাদের আশা ছিল, পথে হয়তো কোন খৃষ্টান বাহিনীর সন্ধান পেয়ে যাবো। কিন্তু আমাদের বড় দুর্ভাগ্য ও বোকামী হলো, আমরা রাস্তার কোন খোঁজ খবর না নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

সারা রাত পথ চললাম আমরা। ঘোড়া খুব জোরে না ছুটালেও কোথাও থামলাম না। রাত কেটে গেল। প্রাণপণ ঘোড়া ছুটিয়ে আমরা কায়রো থেকে অনেক দূরে চলে এলাম।

পরদিন। ভোর হতেই মাথার উপর সূর্য তাপ ছাড়াতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে মরুভূমি তপ্ত আগুনের কড়াই হয়ে গেল। ঘোড়াগুলো পিপাসা ও ক্লান্তিতে দুর্বল ও মরণাপন্ন হয়ে উঠলো। আমাদের অবস্থাও তখন সংকটাপন্ন।

সামনেই আমরা মরুভূমিতে পানি ও সবুজ মাঠ দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু ঘোড়া ছুটিয়ে ওখানে পৌঁছে দেখলাম, কোথায় পানি, কোথায় ঘাস? সবই বালি আর বালি। আমরা বালির এক অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে লাগলাম।

যেদিকেই আমরা ঘোড়া ছুটিয়ে যাই সেদিকেই বালি। এই বালির সমুদ্রে আমরা উদভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়লাম।

সে দিনটির কষ্টের কথা মনে পড়লে এখনো আমার গা কাটা দিয়ে উঠে। তারপরও সেদিনটি কোন মতে পার হয়ে গেল। মরণাপন্ন হওয়ার পরও কেউ আমরা মারা গেলাম না। না ঘোড়া, না আমরা।

রাত নেমে এলো। কমে এলো তপ্ত লু হওয়ার ঝাপটা। বাতাস ঠান্ডা হয়ে গেল। আমরা ঘোড়া থেকে নেমে সাথের শেষ পানিটুকু পান করে শুয়ে পড়লাম।

আমরা এতই ক্লান্ত ছিলাম যে, সারা রাত আমরা চেতনা পেলাম না। ভোরে যখন সূর্যের উত্তাপ আমাদের গায়ে লাগলো তখন আমরা ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।

রাতে আমরা সামান্য পানি পান করলেও ঘোড়া দু’টিকে কিছুই দিতে পারিনি। তারপরও আমরা আমাদের ঘোড়ায় চেপে বসলাম। ঘোড়া আবার রওনা হলো একদিকে। পানি ও আহারের অভাবে দুপুরের আগেই আমার ঘোড়াটি মারা গেল। আমি আমার বান্ধবীর ঘোড়ায় উঠে বসলাম।

তখনো পর্যন্ত আমাদের সাথে একজন পুরুষ সঙ্গী ছিল। আমরা আবার রওনা হলে ক্লান্ত ঘোড়া আমাদের দুই বান্ধবীর ভার সইতে না পেরে খুবই ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। পুরুষ গোয়েন্দার ঘোড়াটি আমাদের ছাড়িয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। তারপর এক সময় তাকিয়ে দেখি তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

তখন আমাদের নজরে আসে এই টিলাগুলো। আমরা টিলার দিকে এগুচ্ছি, এই সময় বান্ধবীর ঘোড়াটিও মাটিতে পড়ে গেল, আর উঠতে পারলো না।

টিলা ওখান থেকে খুব বেশী দূরে ছিল না। আমরা দু’জন টিলার দিকে হাঁটতে লাগলাম। কখন টিলার আড়ালে পৌঁছেছি মনে নেই আমার। তারপরের অবস্থা তো তুমিই ভাল জানো।’

এহতেশাম! তুমি তো ভাল করেই জানো নিষ্ঠুর মরুভূমি এমন অসহায় যাত্রীরদের কেমন পরিণতিতে নিযে পৌঁছায়। মেয়েটা নিজেই আমাকে বলেছে,‘আমি যেমন মানুষদের ধোঁকা ও ছলানা দিয়ে বিভ্রান্ত করেছি তার চেয়ে বেশী নিষ্ঠুর ধোঁকা ও ছলনা পেয়েছি আমি মরুভূমির কাছ থেকে।

আমি মরুভূমিতে নদীর ¯্রােত দেখেছি। সেই ¯্রােত দেখে যতই নদীর দিকে ছুটে গেছি ততোই নদী সরে গেছে দূরে। আমরা দু’জন ছুটতে ছুটতে খেজুর বাগান দেখতাম, ফুলের বাগান দেখতাম, পাল তোলা নৌকা ও সামুদ্রিক জাহাজ দেখতাম। আমরা হাত নেড়ে চিৎকার করতাম একটু সাহায্যের আশায়। প্রাণপণে দৌড়ে যেতাম ওদের দিকে। যতই ছুটতাম ততোই ওরা সরে যেতো দূরে। কিভাবে যে সে সময়গুলো কেটেছে তা কাউকে বর্ণনা করে বুঝানো সম্ভব নয়।’

মেয়েটি আমাকে বললো,‘মরুভূমিতে সেই দুঃসহ জীবনের ঘূর্ণিপকে পড়েই বোধোদয় ঘটলো আমার। যে ক্রুশের জন্য সতীত্ব বিসর্জন দিলাম, জীবন দিতে গেলাম, মনে হলো তার সবই ছিল ভুল। খোদার পুত্র বলে কেউ ছিল না, থাকলে আল্লাহ তার পুত্রের খাদেমদের অবশ্যই সাহায্য করতেন। ক্রুশ মিথ্যা, বাইবেল মিথ্যা, মিথ্যা পাদ্রীদের বাণী। খৃষ্টান ধর্মের মধ্যে যা আছে তার সবটাই মিথ্যা। নইলে কোন ধর্ম কি অন্য মানুষের অনিষ্ট করার জন্য শিক্ষা দিতে পারে তার সন্তানদের? আমার হরেন হলো, এতকাল আমি এক মহা মিথ্যার মধ্যে বসবাস করেছি।

মরুভূমির সেই গোলকধাঁধাঁয় পড়ে আমার এতদিনের অস্তিত্বের মৃত্যু ঘটলো। মৃত্যু ঘটলো খৃষ্টানদের বহু প্রশংসিত সার্থক এক অনুপম গোয়েন্দার। যে অস্তিত্ব নিয়ে আমি কায়রো ছিলাম, যে অস্তিত্বের বলে গোলাম বানাতাম মুসলমান আমির ও শাসকদের, সেই নারী হারিয়ে গেল সেই গোলকধাঁধাঁয় পড়ে। আমার অন্তর তখন ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো অনুশোচনায়, যাতনায়। অতীতের স্মৃতি যতই মনে হতে লাগলো ততোই কাটার মত বিঁধতে লাগলো একেকটি ঘটনা। হায়! মহান ক্রুশের রক্ষকরা এতো খারাপ! তারা তাদের নিজের সন্তানদের প্রতারণা শিক্ষা দেয়! ফুলের মত মেয়েদের নষ্টামী শিক্ষা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় অন্য মানুষের ক্ষতি করতে! হিংসা, ঘৃণা, লোভ, শঠতা, ষড়যন্ত্র, পাপাচার এসব কি কখনো ধর্মের অঙ্গ হতে পারে? হাহলে কিসের মোহে এতদিন আচ্ছন্ন ছিলাম আমি?

জীবনের সুবর্ণ সময়গুলো আমি ব্যয় করে দিলাম মানুষের অনিষ্ট করে, ক্ষতি করে! এ পাপ সইবে কেন আল্লাহ! তাইতো আল্লাহ এই ভংকর মরুভূমিতে এনে ফেলেছেন আমাকে সেই পাপের শাস্তি দিতে। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্য আমাকেই করতে হবে।

আমি তখন বুঝতে পারলাম, যৌন সম্ভোগের লোভ দেখিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়া মোটেই পূণ্যের কাজ হতে পারে ন্ াএ জন্যই মুসলমানরা তাদের কন্যা ও যুবতী মেয়েদের এভাবে ব্যবহার  করে না। তারা জানে, খৃষ্টানরা তাদের মেয়েদের লেলিয়ে দিয়ে সর্বনাশ করেছে মুসলামানদের। কিন্তু প্রতিশোধ হিসাবেও তারা কোন মেয়েকে এ কাজে নিয়োজিত করেনি।

এর মানে হচ্ছে মন্দের জবাব তারা মন্দ দিয়ে দিতে চায় না। যে ধর্ম তার অনুসারীদের প্রতিহিংসার অনুমতি দেয় না সেটাই তো আসল ধর্ম! খৃণা দিযে আমরা সংঘাত সৃষ্টি করে সভ্যতার যে সংকট তৈরী করেছি ওরাও যদি আমাদের মতো খৃণারই চাষ করতো তাবে পৃথিবীতে মানবতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো? তাহলে ইসলামই কি সেই ধর্ম যা মানবতার রক্ষক, সভ্যতার রক্ষক?

তার পর এলো সেই হৃদয়বিদারক দুঃসময়। আমার বান্ধবী মরুভূমির প্রতারণা সইতে পারলো না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো মৃত্যুর বিভীষিকা। পিপাসার যাতনা, ক্ষুধার যাতনা সবকিছুই স্লান হয়ে গেল এই মৃত্যুভীতির কাছে।

দুর্বলতা গ্রাস করে ফেলেছিল আমাকেওঅ কখন চেতনা হারিয়েছি, কখন আমার দুঃসময়ের সঙ্গী প্রাণের বান্ধবীটি মারা গেছে কিছুই জানতে পারিনি আমি। তোমরা আমার মুখে পানির ফোটা দিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনোছো আমাকে। হয়তো আরেকটু আগে এলে তাকেও বাঁচাতে পারতে। তার মৃত্যু আমার কাছে এক ভংকর দুঃস্বপ্ন হয়ে রইলো। এখনো ভাবতে পারছি না, সে মারা গেছে।

আমরা তো একই বয়সী ছিলাম, এক সঙ্গে কায়রো এসেছিলাম, এক সাথেই সব অপকর্ম করেছি, এক সাথেই মরুভূমিতে প্রবেশ করেছিলাম।

কোন দুশমন আমাদের তাড়া করেনি, কারো তীর লাগেনি গায়ে, কেউ তুলে দেয়নি তার হাতে বিষের পেয়ালা। আমরা এক সাথেই সেই টিলার রাজ্যে প্রবেশ করেছিরাম, এক সাথে পাশাপাশি শুয়েছিলাম। অথচ এখন আমি তোমার সাথে কথা বলছি, কিন্তু সেই নেই। কি অদ্ভুত কথা!’

আল আস! বললো,‘মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো,‘আচ্ছা আল-আস! বলো তো ও এখন কি করছে? তাকে কি জাহান্নামের আগুনে ফেলে দেয়া হয়েছে? নাকি সে এখন প্রেতাত্মা হয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলছে?’

আল-আস বললো,‘আমি এ কথার কোন জবাব দিতে পারলাম না। মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। হয়তো সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিল তার বান্ধবীকে।

সে দেখছিল, একদল দোজখের ফেরেশতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দোজখের দিকে। মেয়েটি কিছুতেই দোজখে যাবে না। সে দোজখের ফেরেশতাদের পা ধরে কান্নাকাটি করছে। কিন্তু তাতে মন গলছে না ফেরেশতাদের। তারা তাকে ডান্ডা দিয়ে পিটাচ্ছে আর বলছে,‘যাবি না কেন? ওটাই তো তোর ঠিকানা। দুনিয়ায় তো তোর সব কাজই ছিল এ ঘরের জন্য। তুই যা কামিয়েছিস তাইতো আমরা দিচ্ছি তোকে। আমরা প্রত্যেকের পাওনা বুঝিয়ে দিতে বাধ্য। তুই চাইলেও তা পাবি, নিতে না চাইলেও পাবি। এখানে বে-ইনসাফীর কোন সুযোগ নেই। নিজের জিনিস বুঝে না নিয়েও কোন উপায় নেই।’

এক সময় মেয়েটি আবার মুখ তুলে বলতে মুরু করলো। সে বললো,‘অজ্ঞান অবস্থায় সেই টিলার রাজ্যে আমরা কয়দিন ছিলাম বলতে পারবো না। যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন রাত।

আমি আমার অতীত কাজের জন্য অনুতপ্ত ছিলাম। জ্ঞান ফেরার পরও টের পেলাম, সেই অনুতাপেই দগ্ধ হচ্ছে আমার হৃদয়। আমার বান্ধবী তখনো অজ্ঞান বা ঘুমে ছিল। আমি তাকে ডাকলাম, কিন্তু সে কোন সাড়া দিল না।

আমার মধ্যে সেই অনুতাপের আগুন তখনো দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আমি বান্ধবীকে ওখানে রেখে তার থেকে একটু দূরে চলে গেলাম। সেখানে গিয়েই আমি সিজদায় পড়ে গেলাম। অনেক্ষণ সিজদায় পড়ে থাকার পর মন কিছুটা সুস্থির হলো। আমি সিজদা থেকে মাথা তুলে আল্লাহর কাছে আমার অতীত পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগলাম।

সারা রাত আমি আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে কাটিয়ে দিলাম। এই সিজদা ও মোনাজাত ছাড়া মুসলমানদের আর কোন ইবাদতের নিয়ম আমার জানা ছিল না। সেই রাতেই আমার বিবেকের ইশারা পেয়ে গেলাম, আমি আসল খোদাকে পেয়েছি।’

সে বললো,‘আমার সামনে ধোঁয়ার মত এক মেঘ এসে থামলো তার মধ্যে এক বুজুর্গ লোককে দাঁড়ানো দেখতে পেলাম। তিনি বললেন,‘যদি তুমি অন্তর থেকে তওবা করো তবে এ মরু নির্জনেও মানুষের সন্ধান পাবে। তুমি সেই লোকদের সাক্ষাত পাবে, যে খোদাকে তুমি ডেকেছো, তারা তাঁর প্রিয় ও অনুগত বান্দা। তখন তুমি এখান থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্ত হয়ে আবার লোকালয়ে ফিরে যেতে পারবে।’

আমি তাকে  প্রশ্ন করলাম,‘কিন্তু তোমরা এমন উলঙ্গ অবস্থায় ছিলে কেন? এমন বেশরম হতে লজ্জা লাগলো না তোমাদের?’ ‘এ ব্যাপারটা আমার কাছেও রহস্যময় হয়ে আছে। আমি একবার শুনেছিলাম, মরুভূমির দিকভ্রান্ত মুসাফিররা যখন সূর্য তাপে জ্বলতে থাকে তখন প্রথমে তারা সব আসবাবপত্র ফেলে দিতে থাকে। এরপর তারা সঙ্গের অস্ত্র ফেলে দেয়। শেষ পর্যন্ত নিজের শরীরের সব কাপড় চোপরও খুলে ফেলে। তখন তার এমন অবস্থা হয় যে, নিজের শরীরে এক খন্ড কাপড়ও আর অবশিষ্ট থাকে না।

মানুষ এ সব কাজ সজ্ঞানে করে না, বরং অর্ধ জ্ঞান অবস্থায় সে যখন টলতে টলতে চলতে থাকে, তখন করে। এবং শেষ পর্যন্ত সে কোথাও লুটিয়ে পড়ে মারা যায়।

তখন সে কথা আমার বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমরাও সেই বিভ্রমে পড়েছিলাম। কখন আমরা শরীর থেকে কাপড় ছুঁড়ে ফেলেছি সে কথা আমি এখনও মনে করতে পারছি না।’

আল-আস বললো,‘আমরা দশ বারো দিন পর বায়তুল মোকাদ্দাস এসে পৌঁছলাম। তার শরীর ততোদিনে সুস্থ হয়ে উঠেছে। চাপাকলির মতো তার সৌন্দর্য ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো।  কিন্তু তার মধ্যে যে মতিভ্রম ঘটেছিল তা ভালো হলো না। সে কখনো ভাল কখনো উদভ্রান্ত হয়ে যায়।

আল্লাহর পথে সে নিজেকে একজন ফানাফিল্লা ব্যক্তি মনে করে। অধিকাংশ সময় সে এবাদত বন্দেগী করে কাটায়। রাতে তার এবাদত বন্দেগীর পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। ইদানিং সে আর ঘরে বন্দেগী করে তৃপ্তি পায় না। সে একদিন এই বাড়ীর মালিক বুজুর্গ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলো,‘আমি যদি মসজিদুল আকসায় গিয়ে এবাদত করি তবে কি পাপ হবে? মেয়েদের মসজিদে যাওয়া কি অবৈধ?’ বুজুর্গ তাকে বললো,‘না, অবৈধ হবে কেন? মসজিদ আল্লাহর সকল বান্দার জন্য। ওখানে নারীও এবাদত করতে পারে, পুরুষও।’

সেই থেকে সে প্রতিদিন মসজিদে চলে যায়। সারা রাত মসজিদে এবাদত করে সকালে ফজরের নামাজ পড়ে তারপর বাড়ী ফেরে। লোকজন যাতে তাকে মেয়ে বলে চিনতে না পারে সে জন্য সে মোটা কালো কাপড়ে নিজেকে ঢেকে রেখে মসজিদে অবস্থান করে। সে যখন উদভ্রান্ত হয়ে যায় তখন সে নানা রকম ভবিষ্যতবানী করতে থাকে। কখনো বলে,‘বায়তুল মোকাদ্দাসের উপর খৃষ্টানদের অধিকার আর কখনো প্রতিষ্ঠা হতে পারবে না। খোদা তাদেরকে পথেই ধ্বংস করে দেবেন।’

কখনো বলে,‘মুসলমানরা যদি রাতভর এমন ঘুমিয়ে কাটায় তবে আল্লাহর রহমত পাবে কি করে? সুলতান আইয়ুবী, আপনি কোথায়? ঘুমন্ত মুসলমানদের আবার জাগিয়ে তুলুন। আপনি কোনদিন পরাজিত হবেন না। সারা দুনিয়া আপনার পায়ের তলে এসে যাবে। পৃথিবীতে কোন খৃষ্টান আপনার ক্ষতি করার জন্য তখন আর বেঁচে থাকবে না।’

এভাবে সে অনেক রকম ভবিষ্যতবাণীই করতে থাকে। তারপর সে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।’

‘এই বাড়ীর মালিক কখন বাড়ী ফেরেন? নামাজের পর প্রতিদিনই কি তিনি এমন দেরী করেন?’

‘তিতিন এখনই এসে যাবেন।’ আল-আস বললো,‘তিনি নামাজের পর সকালের মুক্ত বাতাসে একটু হাঁটাহাঁটি করেন, তারপর বাসায় এসে কোরআন পড়তে বসেন।

তারা যখন এসব বলাবলি করছিল তখনই বাড়ীর মালিক সেখানে এসে হাজির হলেন। বয়ষ্ক এক দরবেশ ধরনের লোক। দেখলেই তাকে ভক্তি করতে ইচ্ছে করে।

এহতেশামের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন,‘এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এই মেয়ে আল্লাহর ছায়াতলে আশ্রয় পেয়ে গেছে। যে অন্তরের সমস্ত আবেগ অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর সাধনায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে সে একসময় না একসময় আল্লাহকে পেয়ে যায়। জানি না বান্দার কোন প্রার্থনা আল্লাহ কখন কবুল করেন। হয়তো তার হৃদয় থেকে এমন কোন আবেদন বের হয়েছে যা আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন। ফলে এক পাপী মেয়ে হয়ে গেছে আল্লাহর এক প্রিয় বান্দী।’

‘আপনি কি মনে করেন সে আসলেই ইসলাম গ্রহণ করেছে, নাকি এটাও তার এক ধরনের অভিনয়?’ বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইল এহতেশাম।

‘আমার বিশ্বাস, সে পাগলও নয়, প্রতারণাও করছে না। সে তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ইসলামের প্রতি আস্থাশীল হযে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহন করেছে।’

‘কিন্তু তার এবাদত তো আনাড়ীর এবাদত। ইসলামী এবাদতের সঠিক পদ্ধতি শেখার কোন আগ্রহ তার মধ্যে আপনি কখনো লক্ষ্য করেছেন?’

‘না, মরুভূমিতে তার মাথায় যে ভীতি ঢুকেছে তাই হয়তো এখনো তাকে তাড়া করে ফিরছে। আমি তাকে অনেক চেষ্টা করেছি নামাজ শিক্ষা দিতে, কিন্তু সে তার মতই এবাদত করে যাচ্ছে। তবে সে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সা. কে গভীরভাবে ভালবাসে ও সম্মান করে। যখন সে কথা বলে তখন মনে হয় গায়েবী শক্তি তাকে মদদ যোগাচ্ছে।’

‘সে কি মসজিদুল আকসায় নিয়মিত যায়? এহতেশাম প্রশ্ন করলো।

‘না।’ পরহেজগার লোকটি বললো, ‘আজ রাতেই সে প্রথম মসজিদে গিয়েছে। আল-আস সকাল বেলা যখন তার সন্ধানে এলো তখন আমি তাকে জানালাম, সে মসজিদে চলে গেছে। আল-আস তার সন্ধানে মসজিদের দিকে চলে গেল। সম্ভবত তোমার সাথে তার রাস্তাতেই দেখা হয়েছে।’

এ কথা শুনে সে আল-আসের দিকে তাকাল। বললো,‘আল-আস, তুমি যে বললো সে রোজ রাতেই মসজিদে চলে যায়?’

‘মেয়েটি নিজেই আমাকে সে কথা বলেছে। আমি তার কথা বিশ্বাস করেই তোমাকে তা বলেছি।’

‘এ থেকে প্রমাণ হয়ে গেল মেয়েটি তোমাকে মিত্যা বলেছে। সে আগে যেমন প্রতারণা করতো আমীরদের সাথে এখনো তেমনি প্রতারণা করছে, তবে আমীরের পরিবর্তে সে প্রতারণার শিকার হয়েছো তুমি।

যাক, এখান থেকেই সন্দেহ সৃষ্টি হয়, এ মেয়ে তাহলে কে? এখানে তার কি কাজ? এতদিন সে বায়তুল মোকাদ্দাসে আছে, কোনদিন মসজিদুল আকসায় যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। আজ রাতে যখন সুলতান আইয়ুবী মসজিদে ইবাদত বন্দেগীতে মগ্ন ছিলেন তখনই শুধু সে মসজিদে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো কেন?’

‘আমি সে উত্তর দিতে পারবো না।’ বললো আল-আস। এহতেশাম তাকালো পরহেজগার লোকটির দিকে, তিনিও বললেন,‘কি জানি! এর কোন উত্তর জানা নেই আমার।’

এহতেশাম বললো,‘আমার দায়িত্ব এখন মেয়েটাকে হাসান বিন আবদুল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া। তখন তিনিই বুঝবেন তাকে তিনি নিজের কাছে রাখবেন নাকি সুলতান আইয়ুবরি কাছে পাঠাবেন।’

মেয়েটাকে যখন বলা হলো, তাকে এহতেশামের সাথে যেতে হবে তখন সে নিরবে তার সাথে যাত্রা করলো। আল আসও গেল তাদের সাথে। হাসান বিন আবদুল্লাহ তার কাহিনী প্রথমে এহতেশাম ও পরে আল-আসের কাছ থেকে শুনলেন পরে মেয়েটিও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলেন।

হাসান বিন আবদুল্লাহর প্রশ্নের জাবাবে মেয়েটি অসংলগ্ন ও এলোমেলো কথাবার্তা বলতে লাগলো। হাসান বিন আবদুল্লা বললেন,‘দেখো, ভনিতা বাদ দাও। পাগলামীর জায়গা এটা নয়। যা জিজ্ঞেস করি তার ঠিক ঠিক জবাব দাও। ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করো না।’

মেয়েটি বললো,‘এখন তো সমুদ্র পথে কোন জাহাজ এসে তোমাদের ক্ষতি করার ভয় নেই। তবে কেন আমাকে ভয় পাচ্ছো? আমাকে তোমাদের সুলতানের কাছে নিয়ে চলো, আমি তার সাথে কথা বলবো। তিনি রাতে যে দোয়া করেছেন সে দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন।’

অনেক চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে কোন তথ্যই উদ্ধা করা গেলো না। তখন তার বিষয়টি সুলতান আইয়ুবীরকে জানানো হলো।

সুলতান আইয়ুবী সেনা অফিসাদের নিযে বৈঠক করছিলেন। তিনি সামগ্রিক পরিস্থিতি অফিসারদের সামনে তুলে ধরে বললেন,‘মুসলিম উম্মাহ আজ ভয়ানক এক সংকটময় কাল অতিক্রম করছে। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদী ও খৃষ্টানদের চক্রান্ত বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। সারা বিশ্বে পদদলিত হচ্ছে মানবতা। মুসলমানদের নিশ্চিহ্ণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ক্রুসেড বাহিনী।

শুধু মুসলিম দেশগুলোতেই তারা হামলা চালাচ্ছে এমন নয়, বরং ইউরোপীয় দেশগুলোতে যে সব মুসলমান বাস করছে তাদেরও নিশ্চিহ্ণ করা হচ্ছে।

আমাদের গোয়েন্দারা জানিয়েছে, মুসলামানদের হত্যা করার জন্য তারা নানা রকম বাহানা ও অজুহাত সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি ‘ইউরোপের একটি গীর্জায় মুসলমানরা হামলা করেছে’ এই অজুহাতে সেখানকার কয়েকশ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, মুসলমানদের হত্যা করার জন্য তারা নিজেরাই গীর্জার ক্ষতি সাধন করে তার দায় চাপিযে দিয়েছে নিরীহ মুসলমানদের ওপর।

ইসলাম শুধু মুসলমান নয় গোটা মানবজাতির নিরাপত্তা, শান্তি ও মানবাধিকারের একমাত্র গ্যারান্টি। অথচ এই ইসলামকে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ আখ্যায়িত করে এর অনুসারীদের ওপর চালানো হচ্ছে জুলুম ও নির্যাতন। নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে কালেমায় বিশ্বাসী, মানবতায় বিশ্বাসী সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মানবতাবাদী বিশ্ব সম্প্রদায়কে আবার এক কাতারে এসে দাঁড়াতে হবে।

এ জন্য যুদ্ধের পাশাপাশি আমাদের কুটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। বিপদ দেখে মুসলমানরা ভয় পেয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার শিক্ষা পায়নি। আমরাও এবার এই পাশবিক  শক্তির দম্ভ ও অহংকার গুড়িয়ে দেয়ার জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবো।

কুটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসাবে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মুসলিম দেশে আমার দূত পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাদের বলেছি ক্রুসেড বাহিনী চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। তারা আমাদের পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ণ করে দেয়ার জন্য ছুটে আসছে সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে। এ অবস্থায় তোমাদের কি করতে হবে তা আমি তোমাদের আগেই বলে দিয়েছি। আমি তোমাদের বলেছি, বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও ঈমান এই তিনটি অস্ত্রে যদি তোমরা নিজেদের সজ্জিত করতে পারো তবে এ অবস্থায়ও আমরাই বিজয়ী হবো। বিজয়ের মালিক আল্লাহ তার গায়েবী মদদ দিয়ে আমাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে আমাদেরকে তার যোগ্য হতে হবে। যদি মুসলিম উম্মাহ কোরআনকে আঁকড়ে ধরতে পারে তবে আমি তোমাদের গ্যারান্টি দিতে পারি, দুনিয়ার সমস্ত পাশবিক শক্তি এক হয়েও আমাদের পরাজিত করতে পারবে না। কারণ পৃথিবীতে মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এর জলবায়ু, আকাশ, বাতাস, বৃক্ষলতা, পাহাড়, নদী, মরুভূমি সবাই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।

সেনাপতিদের বিদায় দিয়ে তিনি তার রক্ষীকে বললেন,‘মেয়েটাকে নিয়ে এস্’ো

মেয়েটা যখন সুলতান আইয়ুবীর সামনে গেল তখন সে পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহ সুলতানকে সালাম করলো। সুলতান আইয়ুবী তার চোখে চোখ রেখে বললেন,‘তুমি এখানে কি করছো? কেন এসেছো?’

সে নির্ভয়ে সুলতানের চোখে চোখ রেখে বললো,‘আমি আপনার ভবিষ্যত দেখছি।’

‘ভষ্যিত সম্পর্কে তুমি কি জানো?’

মেয়েটি সুলতানের দিক থেকে চোখ সরিযে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগলো,‘কাল সারা রাত আমি দেখেছি অশ্রুর নদী ও সাগর। তোমার ওই চোখ থেকে সারা রাত অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরেছে। আমি দেখলাম, শত্রুর জাহাজগুলো তোমার অশ্রুজলের সাগরে ডুবে যাচ্ছে। বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রাচীরের কাছেও তোমার দুশমনরা কেউ আসতে পারবে না।’

মেয়েটি বলে যেতে লাগলো, ‘রক্ত! রক্ত! রক্ত! চারিদিকে  রক্তের সাগর বয়ে যাবে। পথেই মারা যাবে পবিত্র ঘরের দুশমনরা। আমি দেখতে পাচ্ছি তারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’

থামলো মেয়েটি। তাকালো সুলতানের চোখের দিকে। বললো,‘আল্লাহর হুজুরে সিজদায় পড়ে যে চোখ অশ্রু ঝরায়, আল্লাহর ফেরেশতারা সে অশ্রু মুক্তার মত কুড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সে অশ্রুর মতি কখনও নষ্ট করেন না। যদি নিয়ত পরিষ্কার থাকে তবে পথও সুগম ও সরল থাকে।’

সুলতান  অনেক ভাবে তাকে পরীক্ষা করলেন। কিন্তু মেয়েটিকে তার আসল সত্ত্বায় কোনভাবেই ফিরিয়ে আনা গেল না। সে এমন সব কথা বলতে লাগলো যেন তার চোখে ভবিষ্যতের দৃশ্যগুলো ফুটে রয়েছে।

মেয়েটি আসলে মরুভূমিতেই তার আসল সত্ত্বা হারিয়ে ফেলেছিল। তার অবচেতন মনে খেলা করছিল তার কল্পনার বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাই সে বলে যাচ্ছিল প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে।

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘একে সেই বুজুর্গ লোকের আশ্রয়েই রেখে দাও। তবে এর ওপর সারাক্ষণ নজর রাখার ব্যবস্থা করবে।’

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মসজিদুল আকসায় আল্লাহর দরবারে যে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন ফেরেশতারা সে অশ্রু বিন্দু সত্যি সত্যি মুক্তার মতো কুড়িয়ে নিয়েছিল, সেই অশ্রু যে আল্লাহপাক কবুল করে নিয়েছিলেন অচিরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। একে একে তার কাছে এমন সব সংবাদ আসতে লাগলো, আল্লাাহর গয়েবী মদদের নমুনা দেখে তিনি নিজেই তাজ্জব হয়ে গেলেন।

প্রথমেই তার কাছে খবর এলো, জার্মানীর স¤্রাট ফ্রেডারিক মৃত্যু বরণ করেছেন। তার কয়েকদিন পর তিনি সংবাদ পেলেন, খৃষ্টানদের আরেক স¤্রটা কাউন্ট হেনরীও মৃত্যু বরণ করেছেন। এই স¤্রাট ক্রুসেড বাহিনীর ঐক্যফ্রন্টের শক্তিশালী সংগঠক ছিলেন। তিনি শপথ নিয়েছিলেন, বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুসলিম আধিপত্য থেকে মুক্ত না করে তিনি কোন নারী স্পর্শ করবেন না।

স¤্রাট কাউন্ট হেনরীর মৃত্যুর ঘটনা ক্রুসেড বাহিনী গোপন রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু একটি ঘটনা তা প্রকাশ করে দেয়। ঘটনাটি ছিল এরকম: সুলতান আইয়ুবীর নৌবাহিনীর কমান্ডোরা সমুদ্রে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। একদিন তারা ক্রুসেড বাহিনীর দুটি সামুদ্রিক জাহাজ দেখতে পেলো।

হাজাহ দুটো ছিল ফিলিস্তিন উপকূলের সামান্য দূরে। কমান্ডোরা বেপরোয়া আক্রমণ চালিয়ে জাহাজ দুটি আটক করে ফেললো। তারা জাহাজে অভিযান চালিযে পঞ্চাশজন ক্রুসেড নৌসেনাকে বন্দী করলো।

এই জাহাজে তল্লাশী চালাতে গিয়ে কমান্ডোরা জাহাজে একটি দামী কোট আবিষ্কার করলো। কোটের সাথে লাগানো ছিল হীরা ও জহরতের নানা রকম ইগনিশিয়া। দেখলেই মনে হয় এটা কোন স¤্রাট বা রাজার পোশাক।

কামান্ডার জানতে চাইলো,‘এই কোট কার?’

কিন্তু কোন ক্রুসেড বন্দী এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হলো না।

এই জাহাজেই ছিল একজন সম্ভ্রান্ত বন্দী। তাকে ক্রুসেডদের এই বাহিনীর কমান্ডার মনে হচ্ছিল। কিন্তু লোকটি নিজেই তা অস্বীকার করে বললো, ‘আমাদের কমান্ডার স¤্রাট কাউন্ড হেনরী।

‘আর তুমি?’

‘আমি স¤্রাট কাউন্ট হেনরীর ভাতিজা।’ লোকটি জবাব দিল।

‘তাহলে উনি কোথায়?’

‘উনি গতকাল মারা গেছেন।’ জবাব দিল স¤্রাট কাউন্ট হেনরীর ভাতিজা।

‘এই কোট কি তবে তার?’

স¤্রাট কাউন্ট হেনরীর ভাতিজা স্বীকার করলো, ‘হ্যাঁ, এটা আমার চাচার কোট।’

ক্রুসেড বাহিনী না চাইলেও এভাবেই স¤্রাট কাউন্ট হেনরীর মৃত্যুর খবর পেয়ে গেলো কমান্ডোরা। তারা সঙ্গে সঙ্গে এ সংবাদ সুলতানকে দেয়ার জন্য কাসেদ পাঠিয়ে দিল।

কিভাবে স¤্রাট কাউন্ট হেনরীর মৃত্যু হয়েছে তা তদন্ত করতে গিয়ে সুলতানের বাহিনী দুটি ভিন্ন মতামত জানতে পারে। তার ভাতিজার কাছ থেকে প্রথমে জানা যায়, তিনি সাগরে ডুবে মারা গেছেন।

পরে সৈন্যদের সাথে আলাপ করে গোয়েন্দারা যে তথ্য পান তা হচ্ছে, তিনি নদীতে গোসল করতে নেমেছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে তাড়াতাড়ি জাহাজে তুলে আনা হয়। কিন্তু জাহাজে তুলে আনার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তিনি মারা যান।

সুলতান আইয়ুবী যাকে নিয়ে বেশী উৎকন্ঠিত ও চিন্তিত ছিলেন তিনি ইংল্যান্ডের স¤্রাট রিচার্ড। রিচার্ড খুব যুদ্ধবাজ স¤্রাট ছিলেন। তিনি কালো রাজকুমার (ইষধপশ চৎরহপব) নামে খ্যাত ছিলেন। তাকে সিংহপ্রাণ স¤্রাটও বলা হতো। তিনি খুব দুঃসাহসী এবং রণকুশলীও ছিলেন।

প্রকৃতি তাকে দিযেছিল বিশাল শরীর। তার বাহু ছিল দীর্গ ও বলিষ্ঠ। সে জন্য যুদ্ধের ময়দানে তিনি পেতেন অতিরিক্ত সুবিধা। তার তলোয়ার যখন শত্রুর গর্দানে গিয়ে পৌঁছাতো শত্রুর তলোয়ার তখনো তাঁর নাগালই পেতো না।

খৃষ্টান জগতের সকলের দৃষ্টি ছিল তাঁর উপর। তার সামরিক শক্তি যেমন বিশাল ছিল তেমনি তার নৌশক্তি ছিল বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দী।

সুলাতন আইয়ুবীর শুধু তাকে নিয়েই ভয় ছিল। সুলতান আইয়ুবীর মনে পড়লো তার জাদরেল এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলুর কথা। কিন্তু তিনি নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন না। সুলতান আইয়ুবীর নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন এ্যাডমিরাল আব্দুল মুহসিন।

সুলতান আইয়ুবী যখন শুনতে পেরেন, স¤্রাট রিচার্ড তার শক্তিশালী বিশাল নৌবহর নিয়ে ধেয়ে আসছেন, তখন তিনি তাঁর নৌবাহিনী প্রধান মুহসিনকে খবর পাঠালেন, সে যেন স¤্রাট রিচার্ডের সম্মুখীন না হয়। তিনি তাকে পরামর্শ দিলেন তার নৌবহর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে।

এরপর এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলুকে কতগুলো যুদ্ধ জাহাজ ও কিছু দ্রুতগামী নৌকা নিযে আসকালান ডেকে পাঠালেন। তাকে বললেন,‘শত্রুর জাহাজ ছুটে আসছে। কিন্তু সাবধান, তুমি তাদের সাথে সামনাসামনি লড়াই করতে যেয়ো না। তুমি শত্রুর জাহাজের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। যখনই তাদের কাউকে একা পাবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। সঙ্গে সামুদ্রিক কমান্ডো বাহিনী রাখবে। প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাবে দক্ষতার সাথে কিন্তু ওদের ফাঁদে পা দেবে না। শত্রুর কোন জাহাজ একা পেলে তাকে যখন আক্রমণ করবে তখন কোন দয়ামায়া দেখাবে না। আপাততঃ ওদের বন্দী করার চেষ্টা না করে জাহাজ ধ্বংস করে দিতে চেষ্টা করবে।’

এটা সেই সময়ের কথা যখন সুলতান আইয়ুবী নিদারুণ সমস্যায় জর্জরিত থাকর কারণে রাতের অধিকাংশ সময়ই ঘুমাতে পারতেন না। তিনি তার উপদেষ্টাদের বললেন, ‘আমাদের একটি উপকূলীয় শহর কোরবানী দিতে হবে, আর সে শহরটি হবে আক্রা। আমি শত্রুদের এমনভাবে প্রভাবিত করতে চাই যে, আমাদের যা কিছু আছে সব আক্রাতেই আছে। যদি আক্রা দখল করে নেয়া যায় তবে মুসলমানদের মেরুদন্ডই ভেঙ্গে যাবে। তখন বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কোন সমস্যাই হবে না।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top