২৯. রিচার্ডের নৌবহর

তিনি শুধু তাদেরকেই যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক করলেন যারা ক্রুসেড বাহিনীর সৈন্য ছিল এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। যুদ্ধে আহত সৈন্যদের তিনি উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। ক্রমান্বয়ে তিনি সমগ্র ফিলিস্তিনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করলেন।
সুলতান আইয়ুবীর প্রত্যেকে বাহিনী হেডকোয়ার্টার থেকে যত দুরেই থাকুক না কেন, তারা যথারীতি সুলতানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথ নিষ্ঠার সাথে পালন করছিল। যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল তখনো তিনি কব্জা করতে পারেননি সেগুলো দখল করার জন্য কমান্ডো বাহিনী প্রেরন করলেন। কমান্ডো সৈন্যরা তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাতো। তাদের সে আক্রমণ ছিল চিতা বাঘের মতই ক্ষিপ্র ও বেপরোয়া।
পাহাড়ে, জঙ্গলে, মরুভূমিতে সর্বত্র তারা ছুটে বেড়াতো শিকারী বাজের মতো সন্ধানী দৃষ্টি মেলে। খৃষ্টান বাহিনীর সন্ধান পেলে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিতো তাদের বাহিনী। তারা তাদের রসদপত্র কেড়ে নিতো। কেড়ে নিতো যুদ্ধের বাহন ঘোড়াগুলো আর সব অস্ত্রশস্ত্র।
এই কমান্ডো বাহিনীর বর্ণালী অভিযানের অসংখ্য ঘটনা ঠাই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তাদের ঘটনাবহুল, সাড়া জাগানো বীরত্বপূর্ণ কাহিনীগুলো আজও দুনিয়াব্যাপী প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করছে।
এই কমান্ডোদের দিয়েই সুলতান আইয়ুবী ফিলিস্তিনের প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করলেন। তারা সমগ্র ফিলিস্তিনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলো।
প্রতি দশ জনের একটি দল পরিচালিত হতো একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে। তারা আবার দুইজন বা চারজনের ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে টহল দিত অধিকৃত অঞ্চলে। কখনো কোন অভিযানে গেলে দশ জনের ছোট্ট কমান্ডো বাহিনী শতাধিক খৃষ্টান সৈন্যের কোন ক্যাম্প বা কাফেলায় আক্রমণ করতে কখনো দ্বিধা করতো না।
তারা রাতের অন্ধকারে আক্রমণ চালিয়ে রাতেই আবার অদৃশ্য হয়ে যেতো। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্ব শরীর রক্তাক্ত করেও শত্রুর কাছ থেকে কেড়ে নিত রসদপত্র।
মাঝে মাঝে তারা বেরিয়ে পড়তো শত্রুর সন্ধানে। চলে যেতো কোন পাহাড়ে। সেখানে টিলার পর টিলা পার হয়ে যেতো। উপত্যকা এবং গুহায় খুঁজে বেড়াতো দুশমন। কখনো পাড়ি জমাতো বিশাল মরুভূমিতে। কড়া রোদ বা তুহীন শীত আটকাতে পারতোনা তাদের।
এ ধরনের অভিযানে অনেক সময় ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়তে হতো ওদের। প্রাণপণ যুদ্ধ চালানো আর শত্রুশিবিরে আগুন দিতে গিয়েও মাঝে মধ্যে বিপদে পড়ে যেতো ওরা।
কখনো দেখা যেতো, জ্বলন্ত আগুন থেকে বেরোতে গিয়ে দুশমন বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। বেকায়দায় পড়ে অনেক সময় সেই আগুনে জ্যান্ত পুড়ে মরার ঘটনাও ঘটে যেতো। এ সব সৈন্যদের ভাগ্যে কখনো দাফন কাফন জুটতো না। এ রকমই ছিল কমান্ডোদের জীবন।
শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া গেরিলাদের দেখলে তারা আজরাইলের কথাও ভুলে যেতো। মনে হতো তাদের ওপর আল্লাহ্‌র গজব নেমে এসেছে। তারা চরম অভিশাপের মত চড়াও হতো দুশমনের ওপর।
এই জানবাজদের ওপর নির্ভর করেই সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাসে জয় লাভের পর তাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমস্ত ফিলিস্তিনে। তারা বাঘের মত শিকার খুঁজে বেড়াতো আর হামলা করতো সিংহের মতো।
সুলতান আইয়ুবীর এই কমান্ডো বাহিনী সম্পর্কে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক স্ত্যানলি লেনপোল লিখেছেন, ‘এই সব মুসলমান গেরিলারা আমাদের নাইটদের মত লোহার ভারী পোশাক পরতো না বটে, তবে আমাদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও নাইটদের নাকানি চুবানি খাওয়াতে ওরা ছিল ওস্তাদ। তারা থাকতো অদৃশ্য অবস্থায়। আঘাত করার জন্য তাদের খুঁজে পাওয়া যেতো না।
আবার তারা আক্রমণ চালালে পালানোর সুযোগও পেতো না আমাদের সৈন্যরা। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ঘোড়া গুলো ছিল তাদের দখলে।
এসব মুসলমান কমান্ডোরা কখনও উদাস বা দুর্বল হতো না। তারা মৌমাছির মতই ছিল অনন্ত পরিশ্রমী। যদি তাদের থেকে বাঁচতে চাও তবে তাদের চোখের আড়ালেই থাকবে। তারা পাহাড়ি ঢলের মতই খরস্রোতা বেগবান। তাদের সয়লাব ক্রুসেড বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো।
আমাদের নাইটদের প্রতিটি পদক্ষেপ তারা তছনছ করে দিত। আমাদের ক্রুসেড বাহিনীর অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়াতো তাদের সামনে পড়লে। এমন বেপরোয়া বাহিনীর সাক্ষাৎ পৃথিবী খুব কমই পেয়েছে।
বর্তমানে যে স্থানটি ইসরাইল নামে পরিচিত, সুলতান আইয়ুবীর যুগে সে অঞ্চলটি ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস। তিনি সে শহর ও এলাকা খৃষ্টানদের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য যে লড়াই করেন সে লড়াইয়ে আল্লাহ্‌র হাজারো সৈনিক তাদের রক্তের নজরানা পেশ করেছিল।
সুলতান আইয়ুবী ও তার সৈন্যরা যুদ্ধের ময়দানে যে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেন, যেভাবে মেতে উঠেন ধ্বংসের খেলায় তাতে মনে হতে পারে তাদের অন্তরে কোন দয়ামায়া নেই।
কিন্তু যখন প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করতো তখন তাদের প্রতি এমন দয়া মায়া প্রদর্শন করা হতো, প্রতিপক্ষও তা দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে উঠতো। ইসলামের এই সৌন্দর্য সত্যি পৃথিবী বাসীর জন্য বিস্ময়কর ব্যাপার।
ন্যায়নীতি, সততা, সত্য ও সুন্দরের জন্যই ইসলামের লড়াই। এখানে ব্যক্তিগত ঘৃণা, ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার কোন অবকাশ নেই। ইসলাম কোন ধর্ম, বর্ণ, বংশ বা জাতির কল্যাণের জন্য আসেনি, এসেছে সভ্যতার কল্যাণের জন্য, মানবতার কল্যাণের জন্য।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন জগতবাসীকে। তাই বলা হয় রাহমাতুল্লিল আলামীন সমগ্র বিশ্ব জগতের রহমত। সুলতান আইয়ুবী ও তার সৈন্যরা এই সত্যের বলিষ্ঠ পরাকাদ্রষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। তাই শত্রুরাও তাদের সেবা ও মমতার স্পর্শ পেয়েছিল।
খৃষ্টান ঐতিহাসিকরা সুলতান আইয়ুবীর এই মমতা পূর্ণ আচরণের জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন তাদের গ্রন্থে। তাদের লেখায় পাওয়া যায় তাঁর মহত্ব ও করুণার অসংখ্য বিবরণ। এই মহত্ব থেকে যেমন বঞ্চিত হয়নি কোন সম্রাট বা রাণী, তেমনি বঞ্চিত হয়নি কোন সাধারন সৈনিক, খৃষ্টান জনসাধারণ, নারী, শিশু বা তরতাজা যুবক।
খৃষ্টানদের এক রাণী। তার নাম ছিল সাবিলা। তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ খৃষ্টান সম্রাট রিমান্ডের স্ত্রী। হাতিনের যুদ্ধের সময় তিনি তিব্বিয়ার শাসক ছিলেন। সম্রাট রিমান্ড হাতিনের যুদ্ধের সময় ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী সাবিলা তিবরিয়ার কেল্লা সুলতান আইয়ুবীর হাতে তুলে দিলেন। সুলতান আইয়ুবী এই মহিলাকে বন্দী না করে সসম্মানের সাথে তাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
হাতিনের যুদ্ধেই সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসক গে অব লুজিয়ানকে যুদ্ধবন্দী করেছিলেন। বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয়ের পর যখন সুলতান আইয়ুবী আক্রাতে এসে ইতি টানলেন এই পর্বের যুদ্ধের, তখন তিনি সংবাদ পেলেন, রাণী সাবিলা তাঁর সাথে দেখা করতে আসছেন। সুলতান আইয়ুবী তাঁর পথ আটকে ধরার পরিবর্তে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সম্বর্ধনা জানালেন।
‘সালাউদ্দিন! রাণী সাবিলা পরাজয় বরণ করার পরও নিজেকে রাণীই দাবী করতেন। কারণ তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ত্রিপোলীর রাণী ছিলেন।
তিনি সুলতানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার কি জানা আছে, যুদ্ধে কত হাজার বা কত লাখ খৃষ্টান তাদের ভিটামাটি থেকে বঞ্চিত হয়েছে? তারা ভিটা ছাড়া ও গৃহহীন হয়েছে আপনার আদেশে, আপনি কি তা অস্বীকার করতে পারেন?’
‘আর যে পরিমাণ মুসলমানকে খৃষ্টানরা পাইকারী হারে হত্যা করেছে তাদেরকে কার আদেশে হত্যা করা হয়েছে?’ সুলতান আইয়ুবী তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন। তিনি এ প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বললেন, ‘যদি আমি রক্তের প্রতিশোধ রক্ত দিয়েই নিতে চাইতাম, তবে আপনিও স্বীকার করবেন, এ মুহূর্তে একজন খৃস্টানও আর বেঁচে থাকতো না’। সুলতান আইয়ুবী রাণী সাবিলাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি এই অভিযোগ করতেই এখানে এসেছেন?’
‘না, আমি কোন অভিযোগ নিয়ে আসিনি’। রাণী উত্তর দিলেন, ‘আমি একটি আবেদন নিয়ে এসেছি। গে অব লুজিয়ান আপনার কাছে যুদ্ধবন্দী হিসাবে আছে, আমি তাঁর মুক্তির আবেদন নিয়ে এসেছি’।
‘আমি আপনাকে এ কথা জিজ্ঞেস করবো না, আপনি তাকে কেন মুক্ত করতে এসেছেন?’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তবে আমার জানা প্রয়োজন, আপনি তাকে কোন শর্তে মুক্ত করতে চান?’
‘যদি আপনার সন্তান বা ভাই বন্দী থাকে তবে কি আপনি তাদের মুক্ত করতে চেষ্টা করবেন না?’ রাণী সাবিলা জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমার যে সব কমান্ডার, অফিসার ও সৈন্যরা আপনাদের কাছে যুদ্ধবন্দী আছে তারা সবাই আমার ভাই’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যদি আমি নিজেও কয়েদী হয়ে যাই তবুও আমি আপনার কাছে মুক্তির আবেদন করবো না। আমার কোন ছেলে বা ভাই আপনার কাছে আমার মুক্তির জন্য যাবে না’।
‘সালাউদ্দিন! রাণী সাবিলা বললেন, ‘আপনি নিজেও একজন বাদশাহ। আপনি কি বুঝেন না, একজন সম্রাটের বন্দী হয়ে পড়ে থাকা কত বড় অপমানের কাজ? তিনি জেরুজালেম তার আশেপাশের অঞ্চলের শাসক ছিলেন’।
‘জেরুজালেম নয়, বলুন বায়তুল মোকাদ্দাস। কারণ এখন আর ওই অঞ্চল জেরুজালেম নেই’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আগ্রাসনের মাধ্যমে যারা ওই অঞ্চলের স্বাধীনতা হরন করে ক্ষমতা দখল করেছিল গে অব লুজিয়ান তার শাসক ছিলেন। কোন আগ্রাসীকে আমি বাদশাহ বলতে পারি না।
হ্যাঁ, আপনি যদি বলেন, তিনি ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য মুসলমানদের পরাজিত করে সেখানে খৃষ্টান শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তবে আমি তা অস্বীকার করবো না। এ ক্ষেত্রে আমি তাকে এবং আপনাকেও সম্মান করবো।
আমি সেই লোককে মনে প্রাণে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি যিনি তার আপন বিশ্বাস ও ধর্মকে রক্ষা ও যত্ন করেন। তার সে ধর্ম ভিত্তিহীন বা মিথ্যা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন। আর আমি নিজেকে বাদশাহ মনে করি না, অন্য কোন ব্যক্তিকে ও বাদশাহ মনে করি না। বাদশাহ শুধু একমাত্র আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন, যিনি আমাদের স্রষ্টা ও মালিক, মুনীব। আমরা তাঁর বান্দা এবং শুধু তারই সৈনিক ও মুজাহিদ। আমরা আল্লাহ্‌র সৈনিক হিসাবে দায়িত্বশীলতার সাথে নিজের কর্তব্য সম্পন্ন করার চেষ্টা করি’।
‘আমরাও খোদার শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই সচেষ্ট আছি’। রাণী বললেন।
‘যদি আপনি খোদার শাসনে বিশ্বাসী হতেন, তবে আপনি কোন বাদশাহর মুক্তির আবেদন নিয়ে আমার কাছে আসতেন না। খোদার কাছেই তার মুক্তি চাইতেন। আপনি যদি বলতেন, ‘বাদশাহর সৈনিক কে মুক্ত করে দাও, সেটাই হতো যুক্তিযুক্ত’।
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আপনার একথা অস্বীকার কড়া উচিত নয়, আরবের এ অঞ্চল আমাদের, আপনাদের নয়। এখানে খৃষ্টানরা অনুগত নাগরিক হিসেবে শান্তিতে থাকতে পারবে, বাদশাহ হয়ে নয়। আপনার খৃষ্টান বন্ধুদের বলে দিন, তারা যেন মানুষ হত্যার খেলা বন্ধ করে এবং অকারণ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো থেকে বিরত থাকে। আর তারা যদি শান্তিতে এখানে থাকতে না পারে তবে যেন এখান থেকে চলে যায়। ব্যর্থ আক্রমণকারী ও পরাজিত সৈনিকদের কর্তৃত্ব এ দেশের মানুষ কখনোই মেনে নেবে না’।
‘আপনার এ আদেশ কি বিদ্বেষপ্রসুত নয়। কেবলমাত্র খৃষ্টান হওয়ার অপরাধে আপনি এখান থেকে ওদের তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন?’
‘না, আমার এ আদেশের মধ্যে বিদ্বেষের কোন ছোঁয়া নেই। দেখুন, আপনি নিজেকে খোদার শাসনে বিশ্বাসী মনে করেন অথচ আপনারা নিষ্পাপ মেয়েদের পাপের শিক্ষা দান করেছেন আর তাদের সম্ভ্রম বিকিয়ে দিতে শিখিয়েছেন।
আপনারা আমাদের ধর্মীয় নেতাদের ছদ্মবেশ ধারন করে জনসাধারণকে প্রতারিত এবং ধর্মীয় মুল্যবোধ আহত করতে চেষ্টা চালিয়েছেন। আপনারা অর্থকড়ি, সুন্দরী মেয়ে ও মাদক বিলিয়ে আমাদের জাতির মধ্যে গাদ্দার ও বিশ্বাসঘাতক সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছেন এবং আমাদের নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে ফায়দা লুটতে চাচ্ছেন।
কিন্তু আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে এমন কিছুই করিনি। তবে হ্যাঁ! ক্রুসেড রাণী! আমি স্বীকার করছি, আপনারা এসব ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছেন। আপনারা ঐক্যবদ্ধ ইসলামী সালতানাতকে খণ্ড বিখণ্ড করতে পেরেছেন। মুসলমানদের দিয়ে মুসলমানদের হত্যা করাতে পেরেছেন’।
‘হে আমার প্রিয় সুলতান!’ রাণী সাবিলা তাঁকে গভীর স্বরে বললেন, ‘আমি আপনার কাছে জটিল ও দীর্ঘ তত্ত্বকথা শুনতে আসিনি। আমি শুধু একটি আবেদন নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, আর তা হচ্ছে আপনি গে অব লুজিয়ানকে মুক্ত করে দিন’।
‘হ্যাঁ, আমি জানি আপনার আবেদন পূরণ হলে আপনি আর আমার কাছে আসবেন না’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি আপনাকে এ কথাও বলে দিতে চাই, আপনি শুধু আমার এই সামিয়ানার মধ্য থেকে বিদায় হচ্ছেন না বরং আমাদের এলাকা ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় হয়ে যাচ্ছেন। আর কখনও এদিকে আসার চেষ্টা করবে না। যদি কখনও এদিকে আসার দুঃসাহস করেন, তবে ভূমধ্যসাগরের পানি আপনার জাহাজকে আলিঙ্গন করবে। আমি আর আপনাকে বেশী উপদেশ দিতে চাইনা। আমি আপনার কাছে একটি আবেদন জানাচ্ছি, যা আপনি আপনার সকল খৃষ্টান ভাইদের জানিয়ে দেবেন।
কোথায় আপনাদের সেই বিশাল ক্রুশ যা ছুঁয়ে শপথ করে আপনারা সকলেই আরব ভূখণ্ডে এসেছিলেন আরববাসীদের নির্মূল করতে? কোথায় সেই ক্রুশ, যার সাহায্যে আপনারা মসজিদুল আকসা ও খানায়ে কাবা’কে ধ্বংস করে সেগুলোকে আপনাদের গির্জা বানাতে চেয়েছিলেন?
সেই ক্রুশ এখন আমার কাছে। আপনার সংকল্পের কথা ভুলে যান। এখন আপনাদের বাঁচা- মরা আমাদের করুণার উপর নির্ভর করছে। আপনারা যাকে জেরুজালেম বলেন এখন সেটা বায়তুল মোকাদ্দাস আর চিরকাল বায়তুল মোকাদ্দাসই থাকবে’।
‘সুলতান! ইতিহাসের চাকা এক জায়গায় বসে থাকে না। আর আপনার জাতি যেভাবে গাদ্দার হওয়ার জন্য হা করে বসে থাকে সেখানে এমন উক্তি আপনি করতে পারেন না। আজ যা সত্য কাল তা সত্য নাও থাকতে পারে’। রাণী সাবিলা বললেন, ‘আমাদের সৈন্যের অবস্থা চিরকাল এমন দুর্বল থাকবে এ কথা আপনি বলতে পারেন না’।
‘সত্যকে অস্বীকার করে লাভ কি রাণী!’ সুলতানা আইয়ুবী বললেন, ‘এতকাল আমাদের ধোঁকা দিয়েছেন আর এখন নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছেন? এই ধোঁকাই আপনাদের পরাজয়ের কারণ। আমার সৈন্যরা কোনদিনই ক্রুসেড বাহিনীর চেয়ে বেশী ছিল না, অস্ত্রসম্ভারেও কোনদিন অধিক উন্নত ছিল না। আমার সৈন্যদের ভাগ্যে এমন কোন সুন্দরী মেয়েও জোটেনি যেমন আপনাদের সেনাপতিদের কাছে জোড়ায় জোড়ায় থাকে। সুতরাং গোপন কথা কিছু আপনাকে বলে দেই, আমার সৈন্যদের মাঝে যে শক্তি আছে সে শক্তি আপনার সৈন্যদের মধ্যে নেই। সে শক্তিকে আমরা বলি প্রিয় নবীর ভালবাসা ও ঈমান। যদি আপনার বিশ্বাস সঠিক হতো তবে আপনার জাতি খোদার প্রিয় হতো। কিন্তু খোদা এক লা-শরীক আপনারা তাঁকে এক সন্তানের পিতা বানিয়ে রেখেছেন। আপনারা খোদাকে মানুষের স্তরে নামিয়ে এনেছেন এবং তার শাসন ক্ষমতাকে অস্বীকার করে নিজেকে বাদশাহ বলে প্রচার করছেন’।
‘আপনি কি আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন?’ রাণী বললো।
‘রাণী সাবিলা!’ সুলতান আইয়ুবী তার কণ্ঠে রুক্ষতা লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমার খোদা কোরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা তাদেরকে বুদ্ধি দিয়েছি বোঝার জন্য, কিন্তু তারা লক্ষ্য করে না। আমি কান দিয়েছি শোনার জন্য, কিন্তু তার শ্রবণও করে না। কারণ আমি যখন কাউকে শাস্তি দিতে চাই তখন তার অন্তরে ও বুদ্ধি বিবেকের উপর সিল মেরে দেই। আমি আপনাকে ইসলাম গ্রহন করতে বলছি না। আমি শুধু এ কথাই বলছি, বিজয় সেই জাতিরই হাতের মুঠোয় থাকে, যে জাতির অন্তরে ইমানী শক্তি প্রবল থাকে।
আপনারা আমাদের জাতির নেতাদের অন্তর থেকে ধন সম্পদ, নারী ও মদের নেশা জাগিয়ে ঈমান শেষ করে দিয়েছিলেন। তখন আমরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছি। সে জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের শাস্তি দিয়েছেন।
কিন্তু মনে রাখবেন, সমস্ত জাতিই পাপিষ্ঠ হতে পারে না। জাতির নেতা ও শাসক গোষ্ঠী বিপদগামী হলে তার শাস্তি জাতিকে বহন করতে হয় বটে, কিন্তু একটা সময় আসে যখন জাতির সন্তানদের আত্মোপলব্ধি ঘটে। তখন তাদের আর দাবিয়ে রাখা যায় না’।
‘এ কথার কোন জবাব এখন আমার কাছে নেই সুলতান। তবে কোনদিন যদি সুযোগ আসে তখন আমি এর জবাব দেবো’। রাণী বললেন, ‘আপনাদের প্রকৃত শক্তি কোথায় আমরা তা অনুসন্ধান করছি’।
এতো কষ্ট করার দরকার কি? আমিই বলে দিচ্ছি আমাদের প্রকৃত শক্তির ঠিকানা। যখন আমরা পরাজয় বরণ করি তখন সে পরাজয়ের দায়িত্ব আমরা নিজেদের কাঁধে তুলে নেই। আমি আমার সেনাপতিদেরও বলেছি, যদি ভুল হয়ে যায় তবে সে ভুল আমাদের। যদি ভাগ্যের পরিণাম হয় তবুও তা সবারই ভাগ্যের যোগফল। যদি পরাজয়ের গ্লানি আমরা একে অপরের উপর চাপিয়ে নিজেকে নিরপরাধ মনে করি তবে তা আমাদের জন্য আরও পরাজয় বয়ে আনবে।
এখন মুসলিম দেশগুলো দুটি দেহে বিভক্ত হয়ে আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরবর্তীতে তা আরও বহু খণ্ডে রূপান্তরিত হবে। আর কাফেররা তা একটা একটা করে গ্রাস করবে। আমাদের এ পরাজয়কে আবার বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হলে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তুলতে হবে আমাদের।
সম্মানিতা রাণী! আমাদের গৃহযুদ্ধের কারণ ছিল আল মালেকুস সালেহ, ছাইফুদ্দিন গাজী ও গুমাস্তগীনের মত কতিপয় গাদ্দার! তখন আমার সেনাপতিদের বলেছিলাম, জাতিকে এক করা আমাদের দায়িত্ব। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তবে আমাদের বিজয় কেউ রুখতে পারবে না।
বিজয়ের জন্য আমরা প্রথমে গাদ্দারদের শায়েস্তা করেছি। তারপর যখন সমগ্র জাতিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ময়দানে নেমেছি তখন প্রতিটি যুদ্ধই আমাদের জন্য বিজয়ের পয়গাম নিয়ে এসেছে। এরপর আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি এবং রক্ত শপথের মধ্য দিয়ে জাতির প্রতিটি আত্মাকে আজ এক সুত্রে গেঁথে নিতে সক্ষম হয়েছি। হাজারো শহীদের রক্তে গড়া এ ঐক্য আর কোনদিন ফাটল ধরতে দেবে না আল্লাহ্‌র সৈনিকরা। অতএব হে রাণী! আপনি দেখতে পাবেন জীবন দিয়ে গড়া ঐক্য আর কোনদিন ছিন্ন হবে না’।
‘সুলতান! ভবিষ্যৎ কারো মুঠোর মধ্যে বন্দী থাকে না। সময়ের সন্তানেরা তাদের যোগ্যতা দিয়ে সময়কে বশ করে নেয়। কিন্তু ইতিহাস বলে, পরাজিতরা নিজেদের ভাগ্য গড়ার জন্য যেভাবে সচেষ্ট থাকে ক্ষমতাসীনরা ততোটাই উদাস থাকে নিজেদের ব্যাপারে। ফলে ক্ষমতার চাকা আবার ঘুরে যায়। আপনি সালাউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন বলে আপনার জাতি আজ বিজয়ের আসনে। কিন্তু আপনার মৃত্যুর পর? আপনার এ বিজয়কে ধরে রাখতে হলে দরকার হবে আপনার মতই আরেক মুজাহিদ। কিন্তু আইয়ুবী কোন জাতির মধ্যে প্রতিদিন জন্ম লাভ করে না। সুতরাং ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোন মন্ত্যব্য না করাই ভালো’।
‘তাহলে অতীতের কথা বলি’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘সে সময়ের কথা স্মরণ করুণ, যখন আপনারা সৈন্য নিয়ে মদীনা মনোয়ারার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন।
তখন যিনি ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাট আজ তারই মুক্তির আবেদন নিয়ে আপনাকে হাজির হতে হয়েছে আমার সামনে। কেন? এটা হচ্ছে সে সব সম্রাটদের অপকর্মের ফল। আমি বিশ্বাস করি, আইয়ুবী এ বিজয়ের মূল ফ্যাক্টর নয়, নিমিত্ত মাত্র। এই সময়ের মুসলমানদের ঈমান আল্লাহ্‌র রহমত লাভের যোগ্যতা অর্জন করেছে। সেই রহমত তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য আল্লাহ্‌ আমাকে বাছাই করেছেন তাঁর সামান্য এক গোলাম হিসাবে।
আল্লাহ্‌ জাল্লে শানুহু আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, সে দায়িত্ব আমি জান প্রাণ দিয়ে পালনের চেষ্টা করেছি। এই বিজয় আমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির প্রমাণ। বিজয় তাঁর হাতে এবং তিনি যখন যাকে ইচ্ছা সে বিজয় দান করতে পারেন’।
রাণী সাবিলা সুলতান আইয়ুবীর কথা গভীর মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন। সুলতানের কথা শুনে তাঁর ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি এসে গেল। তিনি ঠোঁটে সে হাসি ধরে রেখেই বললেন, ‘আপনি সেনাপতি না হয়ে মুবাল্লিগ হলেও ভাল করতেন। আপনি যথেষ্ট কৌশলে দাওয়াত দিতে পারেন। আপনি এত কথা না বলে কেন বলছেন না, রাণী সাবিলা, আপনি ইসলাম কবুল করলে আমি খুব খুশী হবো?’
‘না, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি আবারও বলছি, আপনাকে ইসলাম গ্রহনের অনুরোধ করা আমার দায়িত্ব নয়। আমার দায়িত্ব আপনার চোখের আবরণ খুলে দেয়া’।
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আপনার হাসিই বলে দিচ্ছে, আপনি আমার এখান থেকে বের হয়েই আমার কথাগুলো মন থেকে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলবেন, যেভাবে আপনার সৈন্য ও কমান্ডাররা হাতিনের যুদ্ধে অস্ত্র ত্যাগ করেছিল। আমি এসব কথা আপনাকে শুধু এ জন্যই বলছি যে, এটা আমার আল্লাহ্‌ ও আমার প্রিয় রাসুলের নির্দেশ। আমার আল্লাহ্‌ আমাকে হুকুম দিয়েছেন, যার চোখে পর্দা পড়ে গেছে তাঁর চোখের পর্দা খুলে দাও, আর তাঁকে বলে দাও, সত্য কোনটি আর বাতিল কোনটি। সম্মানিতা রাণী, আপনার স্বামী ভাড়াটে খুনী চক্র হাসান বিন সাবাহর লোক দিয়ে চার বার আমাকে হত্যা করার জন্য চেষ্টা চালিয়েছিল। একদিন যখন খুনীরা আমাকে আক্রমণ করলো তখন আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। কিন্তু তাতে কি হলো? তারা নিজেরাই নিজেদের হত্যাকারী হয়ে গেল। আরেকবার তারা আমাকে ঘিরে ফেলেছিল। কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাকে অক্ষতভাবে রক্ষা করলেন, অথচ তাদের একজনও বাঁচতে পারেনি।
সম্মানিতা রাণী! জীবন মৃত্যু আর ক্ষমতার মালিক আল্লাহ্‌ এখনো কি এ কথা আপনার কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি এ সত্যকেও কি অস্বীকার করবেন, আপনার স্বামী বার বার আমাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন যাদের দিয়ে, শেষে সেই খুনী চক্রের হাতেই তিনি নিহত হয়েছিলেন? যাকে আল্লাহ্‌ মারতে চান তাঁকে কেউ বাঁচাতে পারে না আর আল্লাহ্‌ যাকে রক্ষা করেন কেউ তাঁকে মারতে পারে না’।
‘মাননীয় সুলতান! আপনি এখন বিজয়ের আনন্দে বিভোর। চোখে রঙিন স্বপ্ন। এ সময় গল্প করতে সবারই ভাল লাগে। বলুন আর কি বলবেন? ক্রুশটি আপনি কি করেছেন?’
‘ওটি আমার কাছেই আছে রাণী’। সুলতান বললেন, ‘হাতিনের যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আপনার স্বামী পালিয়ে গেলে ক্রুশটি আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসি। আপনি আমার সাথে যুদ্ধ না করেই তিবরিয়া দুর্গ সমর্পণ করে দেয়ার সময় ক্রুশের ব্যাপারে কিছু জানতে চাননি বলে আমিও কিছু জানাইনি আপনাকে। আপনারা সকলেই যে ক্রুশের উপর হাত রেখে যুদ্ধ করার শপথ নিয়েছিলেন সে ক্রুশটি আপনাদের পাদ্রীর হাতেই ছিল। তিনি যখন আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তখন ক্রুশটি আমি তুলে নেই। সেই ক্রুশটি এখনো আমার কাছে সযত্নে রক্ষিত আছে’।
সুলতান বললেন, ‘আমি খুব অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, আপনি শুধু গে অব লুজিয়ান অব লুজিয়ানকে মুক্ত করতে এসেছেন, অথচ আপনাদের পবিত্র ক্রুশের ব্যাপারে আপনি কিছুই বলেননি’।
‘আমি যখন এ কথা তুলিনি তখন আপনি কেন তা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন? রাণীর ক্ষুব্ধ কণ্ঠ।
‘এ জন্য যে, আপনি যাতে খোদার স্পষ্ট ইঙ্গিত বুঝতে পারেন’। সুলতান আইয়ুবী তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললেন, ‘আপনার চোখের উপরও সপ্ন ভাসছে। যে সপ্নে আছে শাসন ক্ষমতা লাভের অলীক লোভ। কিন্তু রাণী! আপনি এ সত্যকে অস্বীকার করতে পারবেন না, আপনার মধ্যে আছে নারীর সৌন্দর্য। আপনাকে এ বলে খুশী করতে পারি, আপনি সত্যি একজন সুন্দরী রমনী’। সুলতান বললেন, ‘কিন্তু আপনার জন্য দুঃসংবাদ কি জানেন? এ সৌন্দর্য আমাকে মোটেই প্রভাবিত করতে পারবে না। আপনার এ অর্ধ উলঙ্গ দেহ আমাকে আমার পথ থেকে সরাতে পারবে না। আমার বিবেচনা বোধকে মোটেও টলাতে পারবে না’।
রাণী সাবিলা একজন সাধারন নারীর মতই হেসে বললেন। বললেন, ‘আমাকে আগেই বলা হয়েছিল, আপনি পাষাণ’।
সুলতান আইয়ুবীও হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এমন অবস্থায় আমি পাথর! কিন্তু আমি এমন নরম যে, ঈমানের পরশে গলে মোম হয়ে যাই। তখন আমার দয়ার সাগরও উথলে উঠে। দৈহিক সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বা সাজসজ্জা মানুষকে তার কাজে সাহায্য করে না, জাতির কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। এ ধরনের রুপের প্রদর্শনীতে খোদাও অসন্তুষ্ট হন’।
‘আমি আপনার মনে দয়ার আবেগ জাগাতে এসেছি’। রাণী সাবিলা বললেন, ‘আপনি গে অব লুজিয়ানকে মুক্তি দিন। আমি জানি, আপনি একজন খাঁটি মুসলমান। আর এও জানি, খাঁটি মুসলমানের কাছে আশ্রয় চাইলে শত্রুও আশ্রয় এবং নিরাপত্তা পেয়ে যায়। আমি আপনার কাছে সেই ক্ষমা ভিক্ষা করতে এসেছি’।
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি আপনার আবেদন এই শর্তে মঞ্জুর করতে পারি, তিনি আমার বিরুদ্ধে আর কখনো অস্ত্রধারণ করবেন না এ ব্যাপারে লিখিত অঙ্গীকার করবেন’।
রাণী সাবিলা বললেন, ‘সে লিখিত অঙ্গীকার নামাই দেয়া হবে আপনাকে। আমি আপনাকে আরো বলতে চাই, যদি গে অব লুজিয়ান কখনো তার অঙ্গীকার থেকে সরে দাঁড়ায় তবে তাকে আপনি যে কোন সময় হত্যা করতে পারবেন। প্রয়োজনে তাকে ধরার ব্যাপারে আমি আপনাকে সহযোগিতা করবো’।
এ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, সুলতান আইয়ুবী সম্রাট গে অব লুজিয়ানকে মুক্তি দিয়ে রাণী সাবিলার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আলোচনা শেষে সন্তুষ্ট মনে রাণী সাবিলা চলে গেলেন নিজের রাজ্যে।
সুলতান আইয়ুবী সে দিনই গে অব লুজিয়ানকে মুক্তির সংবাদ দিতে দূত পাঠালেন দামেশকে।
চারদিন পর। গে অব লুজিয়ানকে সুলতান আইয়ুবীর সামনে এনে হাজির করা হলো। সুলতান আইয়ুবী দোভাষীর সাহায্যে ইউরোপীয় খৃষ্টান সম্রাট গে অব লুজিয়ানকে জানালেন তাঁর শর্তের কথা। বললেন, আগে শর্তের বিষয় ভাল করে বুঝে নিন’।
দোভাষীকে বললেন, ‘এই অঙ্গীকারনামা তার ভাষায় অনুবাদ করে শুনিয়ে দাও। আর যদি তিনি চান যে অঙ্গীকারনামা তার ভাষায় লিখা হোক তবে তাই লিখে দিয়ে সাক্ষর করে নাও’।
গে অব লুজিয়ান শর্ত শুনে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। সুলতান দোভাষীকে বললেন, ‘তাকে একথাও বলে দাও, এই শর্তের বাইরে তার সাথে আর কোন কথা নেই আমার। আমি তার সম্পর্কে জানি। যদি সে অঙ্গীকার বিরুদ্ধ কিছু করে ও আমার সাথে যুদ্ধ করে তার পরিনাম হবে ভয়াবহ। তাকে আরও বলে দাও, আমি তাকে রাণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মুক্ত করছি না। আমি তাকে বুঝিয়ে দিতে চাই, তার মত অপরাধীকেও মুসলমান ক্ষমা করতে পারে’।
তিনি বললেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আমি কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে চাই না। তিনি যেখানে যেতে চা্ন আমাদের রক্ষীরা তাকে সম্মানের সাথে ও নিরাপদে সেখানে পৌঁছে দেবে’।
গে অব লুজিয়ান বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসক ছিলেন। তিনি হাতিন রণাঙ্গন থেকে যখন যুদ্ধবন্দী হন তখন ভাবতেও পারেননি আবার কোনদিন তিনি মুক্ত পৃথিবীর মুখ দেখতে পারবেন।
মুসলমানদের ওপর তিনি যে নির্যাতন চালিয়েছেন এবং সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যেভাবে সক্রিয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাতে সুলতান যদি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সুলতান তাকে কোন বিনিময় ছাড়া ‘শুধু তার বিরুদ্ধে আর কোনদিন যুদ্ধ করবো না’ এটুকু অঙ্গীকার নিয়েই মুক্ত করে দেবেন এ কথা তখনো তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি মুখ তুলে সুলতানের দিকে চাইলেন। সুলতান দোভাষীকে বললেন, ‘শর্তে সম্মত থাকলে তাকে অঙ্গীকার নামায় সাক্ষর করতে বলো’।
দোভাষীর কথা শুনে উঠে দাঁড়ালেন গে অব লুজিয়ান। এগিয়ে গেলেন সুলতান আইয়ুবীর দিকে। সুলতান আইয়ুবী হাত বাড়িয়ে দিলেন, গে অব লুজিয়ান স্বসম্মানে করমর্দন করে বললেন, ‘সুলতান আইয়ুবী, আপনি সত্যি মহান! সত্যি মহানুভব!’
অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর করে সুলতানের ক্যাম্প থেকে বিদায় নিলেন গে অব লুজিয়ান।

গে অব লুজিয়ানের মুক্তির ঘটনা ইউরোপের ঐতিহাসিকদের প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। এ ঘটনা তারা তাদের বইতে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। যদিও সবার বিশ্লেষণ এক রকম নয় কিন্তু ঘটনার বর্ণনা সবার একই রকম। কেউ কেউ বলেছেন, ‘তার মুক্তি রাণী সাবিলার কৃতিত্ব’। তারা এ কথা বলতেও দ্বিধা করেননি যে, ‘সুলতান আইয়ুবী রাণী সাবিলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গে অব লুজিয়ানকে মুক্ত করেছেন’। তাদের এ বিশ্লেষণ মেনে নিলে বলতে হয়, সুলতান আইয়ুবী মহত্বের কারণে তাকে মুক্তি দেননি। কোন মায়া মমতা বা মানুষের প্রতি দরদও এ ক্ষেত্রে কাজ করেনি।
কেউ কেউ বলেছেন, ‘নিজেকে মহৎ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই তিনি একজন সম্রাটকে মুক্তি দিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন’। এতে মনে হতে পারে, সাধারন মানুষ ও গরীবদের প্রতি তাঁর কোন দরদ নেই। কিন্তু প্রকৃত সত্য সুলতান আইয়ুবী তাঁর বক্তব্যে নিজেই পরিষ্কার করেছেন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘তাকে আরও বলে দাও, আমি রাণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে মুক্ত করছি না’।
সুলতান আইয়ুবী কেবল সম্রাট গে অব লুজিয়ানকে মুক্তি দিলে তাঁর মহত্ব ও মানবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতো। কিন্তু ঐতিহাসিকরা তাঁর দয়া ও মমত্ববোধের আরো অনেক কাহিনী তাদের লেখায় তুলে ধরেছেন। এসব কাহিনীই প্রমাণ করে তিনি ছিলেন এক উদার ও মানবপ্রেমিক সমরনায়ক।
ঐতিহাসিকরা এক দরিদ্র খৃষ্টান মহিলার বর্ণনা লেখে গেছেন তাদের গ্রন্থে। এ ঘটনা সেই সময়ের , যখন গে অব লুজিয়ানের মুক্তির পর সাগর তীরের শহর আক্রাতে সুলতান অবস্থান করছিলেন এবং পরাজিত খৃষ্টান বাহিনী আবার সংগঠিত হয়ে আক্রা অবরোধ করে রেখেছিল।
খৃষ্টান সৈন্যরা একত্রিত হয়ে ইউরোপীয় খৃষ্টানদের সহযোগিতায় আক্রা অবরোধ করে। সুলতানের সৈন্যরা তখন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অধিকাংশই ছুটিতে বাড়ী গিয়েছিল। সুলতান তাঁর সীমিত শক্তি নিয়ে অবরোধ আটকে দেন। আক্রায় ঢুকতে না পেরে খৃষ্টানরা শহর ঘেরাও করে অবস্থান নেয়। দীর্ঘ দুই বছর তাদের এ অবরোধ অব্যাহত ছিল।
সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী অবরোধকারী খৃষ্টানদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালাতো। এ আক্রমণের তীব্রতা সইতে না পেরে পিছিয়ে যেতো খৃষ্টান বাহিনী। কিন্তু কমান্ডোরা চলে গেলে আবার তারা আগের জায়গায় এসে অবস্থান নিত। এভাবেই আগুপিছু করে সময় কাটাচ্ছিল ওরা। ওদের ধারনা ছিল, খাদ্য ও রসদের ঘাটতি পড়লে এক সময় মুসলমানরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু কমান্ডোদের তৎপরতার ফলে খাদ্য ও রসদ আসার পথ তারা কোনদিনই বন্ধ করতে পারেনি। এভাবে আক্রাতে দুই বাহিনীই সহাবস্থান করতে শুরু করে এবং এ অবস্থা চলে দীর্ঘদিন।
কমান্ডোরা খৃষ্টান বাহিনীর বিভিন্ন অংশে আঘাত হেনে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো। এসব গেরিলা আক্রমনে প্রচুর ক্ষতিও হতো তাদের। নতুন খৃষ্টান সেনা এসে সেই ক্ষতি তাদের পুষিয়ে নিতো।
আক্রায় যেসব বেসামরিক মুসলমান ছিল তারাও খৃষ্টানদের উত্যক্ত করতো। কমান্ডোদের সহযোগিতা করতো। একইভাবে খৃষ্টান বাসিন্দারা সহযোগিতা করতো খৃষ্টান বাহিনীকে। মাঝে মধ্যে খৃষ্টান- মুসলমান দাঙ্গাও হয়ে যেতো। মোটের ওপর আক্রার জনজীবনে এক অসহনীয় অবস্থা বিরাজ করছিল।
দেখা যেতো, কোন এক রাতে খৃষ্টান বসতির উপর মুসলমান বেসামরিক লোকেরা সহসা আক্রমণ করে বসেছে। তারা তাদের মালামাল লুট করে, কখনও কখনও লোকজনকেও ধরে নিয়ে আসতো ও তাদের বন্দী করে রাখতো।
খৃষ্টান বাসিন্দারা তখন খৃষ্টান সৈন্যদের কাছে গিয়ে অভিযোগ করতো, ‘মুসলমানরা সব চোর ডাকাত! রাতে তারা মহল্লায় এসে আমাদের জিনিসপত্র চুরি করে বা কেড়ে নিয়ে যায়’।
খৃষ্টান সৈন্যরা তাদের ওখানে পাহারার ব্যবস্থা করে। এরপর ঘটে উল্টো ঘটনা। খৃষ্টান যুবকদের কোন দল মুসলিম মহল্লায় একইভাবে হামলা করে বসে। এভাবে বেসামরিক এলাকায় চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা চলতেই থাকে।
এক রাতে এক উত্তেজিত মুসলমান খৃষ্টান এলাকা থেকে তিন মাসের এক শিশুকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। এ শিশুটি মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল। এই দুধের বাচ্চাকে তুলে আনলে মহিলা চিৎকার ও ক্রন্দন শুরু করলো।
মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে খৃষ্টান সেনা কমান্ডারের কাছে গেল। তার অবস্থা তখন পাগলিনীর মতো। কিন্তু এ ব্যাপারে কমান্ডারের কিছু করার ছিল না।
মহিলা এবার খৃষ্টানদের উচ্চপদস্থ এক সেনা অফিসারের কাছে গেলো। অফিসার তার কথা শুনে মহিলাকে বললেন, ‘তুমি সুলতান আইয়ুবীর কাছে যাও। তিনি খুবই রহমদীল মানুষ। নিশ্চয়ই তোমার কান্না দেখে তার দয়া হবে’।
মহিলাটি ছুটে গেলো মুসলিম ক্যাম্পে। ক্যাম্পটি ওখান থেকে বেশী দূরে ছিল না। সুলতানের রক্ষীরা তার পথ আটকে দাঁড়ালে সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমাকে শুধু একবার সুলতানের সাথে কথা বলতে দাও’।
রক্ষীদের দয়া হলো। তারা মহিলাকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দিল। সুলতান আইয়ুবী তখন কোথাও যাওয়ার জন্য অশ্ব পৃষ্ঠে চড়ে বসেছেন। এক রক্ষী বললো, ‘এক দরিদ্র খৃষ্টান মহিলা ক্রন্দনরত অবস্থায় আপনার কাছে এসেছে। সে আপনার সাথে দেখা করতে চায়’।
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তাকে জলদি নিয়ে এসো। নিশ্চয়ই তার উপরে আমাদের কেউ অন্যায় আচরণ করেছে’।
মহিলাটিকে যখন সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির করা হলো তখনো সে বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করছিল। সে সুলতানের অশ্বের সামনে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলো আর মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগলো। সুলতান বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘উঠো, আমাকে বলো তোমার কি হয়েছে?’
মহিলা উঠে বসলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমাকে আমাদের সেনা কমান্ডার বললেন, ‘তুমি সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে যাও। তিনি খুব দয়াবান লোক। তিনি তোমার করুণ আবেদনের বিহীত করতে পারবেন’।
‘তা তোমার আবেদনটি কি?’
‘সুলতান!’ মহিলা বললো, ‘আমি আমার সন্তানকে ফেরত চাই। আপনার লোকেরা আমার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে’।
মহিলার কাছে থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনে সুলতান আইয়ুবীর চোখও অশ্রুসজল হয়ে গেল। তিনি হিসাব করে দেখলেন শিশুটি চুরি হয়েছে আজ ছয়দিন। সুলতান আইয়ুবী অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে নেমে এলেন। তাঁর লোকদের বললেন, ‘জলদি খোঁজ করো কে শিশুটিকে উঠিয়ে এনেছে’।
তিনি মহিলাকে শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘আপনি একটু অপেক্ষা করুণ। আমি আপনার সন্তান আপনার কোলে তুলে না দিয়ে অন্য কোথাও যাবো না’। তিনি তাঁর লোকদেরকে মহিলাটির জন্য আহারাদির ব্যবস্থা করতে বললেন।
সুলতান আইয়ুবী ঘোড়া থেকে নেমে আবার তাঁর ক্যাম্পে ফিরে গেলেন। যেখানে যেতে চেয়েছিলেন সেখানে আর গেলেন না তিনি। সৈন্যরা মুসলিম মহল্লায় খোঁজ নিয়ে বের করে ফেললো, কে শিশুটি অপহরণ করেছিল। তারা তাকে ধরে সুলতানের কাছে সোপর্দ করে দিল।
লোকটি সুলতান আইয়ুবীর কাছে স্বীকার করলো, সে শিশুটি অপহরণ করেছে সত্য কিন্তু এখন শিশুটি তার কাছে নেই।
‘কি করেছো তুমি শিশুটি?’ সুলতানের চোখ রাগে ও ক্ষোভে লাল হয়ে গেল।
‘আমি শিশুটি বিক্রি করে দিয়েছি’। অপরাধ স্বীকার করে বসলো লোকটি।
সুলতান আইয়ুবী তার সৈন্যদের আদেশ দিলেন, ‘এ লোক যার কাছে শিশুটি বিক্রি করেছে একে তার কাছে নিয়ে যাও’। তারপর লোকটিকে বললেন, ‘তুমি যে মুল্যে শিশুটি তার কাছে বিক্রি করেছো সেই মুল্যে শিশুটিকে ফেরত দিতে বলবে। যদি এতে সে রাজী না হয় তবে সে যে মুল্য দাবী করে সেই মূল্য দিয়েই শিশুটিকে তুমি ছাড়িয়ে আনবে’।
তিনি আবার সৈন্যদের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমরা সঙ্গে করে কিছু টাকা নিয়ে যাও যাতে শিশুটি ছাড়িয়ে আনতে কোন অসুবিধা নাহয়’।
সুলতান শিশুটিকে না আনা পর্যন্ত তাঁর তাবুতেই অপেক্ষা করলেন। শিশুটি বেশী দূরে ছিল না। শিঘ্রই তাকে পাওয়া গেল এবং সৈন্যরা তার দাম মিটিয়ে দিয়ে নিয়ে এলো শিশুটি।
সুলতান আইয়ুবী নিজ হাতে শিশুটিকে তার মায়ের হাতে তুলে দিলেন। মা শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে এমন পাগলিনীর মত আদর করতে লাগলো যে তা দেখে সবারই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। সুলতান আইয়ুবী মহিলাকে একটা ঘোড়া উপহার দিয়ে বিদায় জানালেন।

বায়তুল মোকাদ্দাসে মুসলমানদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফিলিস্তিনের মাটিতে খৃষ্টানদের বিপর্যয় ঘটে গেছে। তারা সবখানেই পরাজিত হয়েছে। পরাজিত সৈন্যরা অন্যান্য খৃষ্টান রাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এই বিপর্যয় সমগ্র খৃষ্টান জগতে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো। মনে হলো প্রবল ভুমিকম্পে তছনছ হয়ে গেছে খৃষ্টানদের সাম্রাজ্য। সর্বত্র যেন ধ্বস নেমেছে।
এই সময় খৃষ্টান বিশ্বে তিনটি দেশ ছিল সবচে শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর। এ দেশগুলো শুধু অর্থ সম্পদেই বড় ছিল না তারা সামরিক শক্তিতেও শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হতো। এদের মধ্যে প্রথমেই ছিল ইংল্যান্ড, দ্বিতীয় ফ্রান্স ও তৃতীয় জার্মানি।
তৎকালীন খৃষ্টান পোপ দ্বিতীয় আরবানুস খৃষ্টান শক্তির এই বিপর্যয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ভেবে দেখলেন, আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যদি এখন শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায় তবে সুলতান আইয়ুবী ফিলিস্তিন জয় করে বসে থাকবে না, সে এমনকি ইউরোপের মাতিতেও পা বাড়াতে পারে। ফলে একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তিনি এই তিন খৃষ্টশক্তিকে একত্রিত করার উদ্যোগ নিলেন।
প্রথমেই তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি দেশ সফর করলেন এবং সেখানকার সম্রাটের সাথে দেখা করে বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে তাদের প্রত্যেকের আশু করণীয় কি তা তুলে ধরলেন। তাদেরকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সর্বত্র তিনি একই ধরনের বক্তব্য দিতে লাগলেন। সম্রাটদের সাথে সাক্ষাতে তিনি বললেন, ‘যদি যুদ্ধে না নামো তবে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী সমস্ত ইউরোপ থেকে ক্রুশের শাসন উচ্ছেদ করে দেবে। তোমাদের দু’চোখ যেদিকে যায় সবখানেই তোমরা ইসলামী পতাকা পতপত করে উড়তে দেখতে পাবে’।
তিনি তাদের বললেন, ‘এ যুদ্ধ সুলতান আইয়ুবীর নিজস্ব সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ নয়, এটা খৃষ্টান ও ইসলামের ধর্ম যুদ্ধ। অর্থাৎ ক্রুশ টিকে থাকলে তুমি থাকবে আর হেলাল টিকে থাকলে থাকবে আইয়ুবী। তাই এটা ক্রুশ ও হেলালের যুদ্ধ। বাইবেল ও কোরআনের যুদ্ধ। সেই সাথে এটা তোমার আমার অস্তিত্বের যুদ্ধ।
তুমি জানো, আমাদের পবিত্র ক্রুশ এখন মুসলমানদের হাতে। জেরুজালেম মুসলমানদের পতাকা উড়ছে। হাজার হাজার খৃষ্টান মেয়ে মুসলমানদের হাতে বন্দী রয়েছে। তাদেরকে মুসলমান সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হচ্ছে। এরপরও কি তোমরা ঘরে বসে থাকবে?
মুসলমানদের এই তুফানের গতি কি তোমরা এভাবেই প্রতিরোধ করতে চাও? তোমরা কেমন করে এটা সহ্য করছো, যে ক্রুশে প্রভু যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিল সেটি এখন মুসলমানদের হাতে থাকবে?
পোপ দ্বিতীয় আরবানুস এমন সব কথা শুনিয়ে খৃষ্টান সম্রাটদের উত্তেজিত করে তুললেন। যুদ্ধের উন্মাদনা নতুন করে ছড়িয়ে পড়লো খৃষ্টান শিবিরে।
উত্তেজিত সম্রাটরা নতুন করে সৈন্য সমাবেশ ঘটালো ঈশ্বরের প্রতীক ক্রুশের মর্যাদা রক্ষার জন্য। তারা সুলতান আইয়ুবীর কাছ থেকে তাদের পবিত্র ক্রুশটি উদ্ধার করতে চায়। এ জন্য রক্তের নদী বইয়ে দিতেও আপত্তি নেই তাদের। পোপ দ্বিতীয় আরবনুসের আহবানে শুরু হলো নব উদ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রবল এক যুদ্ধের প্রস্তুতি। সুলতান আইয়ুবী তখন আক্রায় আস্তান গেড়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

পরবর্তী বই
ক্রুসেড-৩০
মহাসমর

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top