২৯. রিচার্ডের নৌবহর


সুলতান আইয়ুবী যদিও ধৈর্যের সাথে কথা বলছিলেন, কিন্তু বালিয়ানের ধমকের চাইতেও তাঁর কণ্ঠ ছিল বলিষ্ঠ ও ভরাট। তিনি রূঢ়ভাবেই বললেন, ‘এখন তোমরাই আমার কয়েদী। তোমাদের সমস্ত সৈন্যই আমাদের যুদ্ধবন্দী। শহরে বসবাসকারী খৃষ্টানরা আমাদের কাছে বন্দী। এখন শহরের সে সব খৃষ্টান বেরিয়ে যেতে পারবে যারা আমার নির্ধারিত অর্থ জরিমানা দিতে পারবে। এখন যাও, দেখো এ শহর জেরুজালেম নাকি বায়তুল মোকাদ্দাস’।
সরদার বালিয়ান ও তার সাথীরা ভয় পেয়ে গেল। তাবু থেকে বেরিয়ে তারা দেখলো, সুলতান আইয়ুবীর অধিকাংশ সৈন্য শহরে প্রবেশ করেছে এবং শহরের প্রধান গেটে ইসলামী পতাকা উড়ছে।
এটা একটা আকস্মিক ঘটনা নাকি সুলতান আইয়ুবীর প্ল্যানই এমন ছিল অথবা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের এমনই ছিল ইচ্ছা বুঝতে পারলো না বালিয়ান।
সুলতান আইয়ুবী জুম্মার দিন ৬ অক্টোবর মুতাবেক ৬ই রজব ৫৮৩ হিজরী সনে শহরে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন। এই রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মেরাজে গিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌র এ এক অপার মহিমা যে সেই রজব মাসেই তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করার সুযোগ করে দিলেন মুসলমানদের।
সুলতান আইয়ুবী যখন শহরে প্রবেশ করলেন তখন মুসলমানরা সবাই ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এসেছিল। মেয়েরা খুশীতে তাদের মাথার চাদর ও ওড়না রাস্তায় বিছিয়ে দিতে লাগলো তাঁর সম্মানে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী সেগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে বললেন। কারণ তিনি মানুষ পুজা ও তোষামোদকে খুব ঘৃণা করতেন।
সুলতানের রক্ষী বাহিনী রাস্তা থেকে মেয়েদের ওড়নাগুলো উঠিয়ে দিল আর ওদের বললো, ‘ আল্লাহ্‌র প্রশংসা করো। এ বিজয় তাঁর দান। সুলতান এবং আমরা নিমিত্ত মাত্র’। তখন ওরাও মুক্তির আনন্দে পুরুষের মত উচ্চস্বরে তাকবীর ধ্বনি দিতে লাগলো। কেউ কেউ রাস্তার ওপরই সিজদায় পড়ে আল্লাহ্‌র শোকর আদায় করলো।
সুলতান শহরে পা দিতেই সেখানে এক অভাবিত দৃশ্যের অবতারনা হলো। আনন্দ বেদনার বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে গেল তাদের হ্রিদয়গুলো। সবার চোখে উছলে উঠলো আনন্দের অশ্রুধারা। সকৃতজ্ঞ নয়নে সবাই ছুটে এলো কিংবদন্তীর নায়ক তাদের এ মহান মুক্তিদূত কে এক নজর দেখার জন্য।
সেখানে সৃষ্টি হলো এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের! সুলতান আইয়ুবী নিজেও এতবেশী আবেগময় হয়ে উঠলেন যে, তিনিও সবার সাথে তাকবীর ধ্বনি দিতে লাগলেন।( ?)
শ্লোগানের তালে তালে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছিল জনতার মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো। তাতে প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের সংকল্প ও দৃঢ়তার বলিষ্ঠতা।
সুলতান আইয়ুবী হাত নেড়ে জবাব দিচ্ছিলেন জনতার এ স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনের। কিন্তু তার মুখে কোন হাসি ও আনন্দের আভা ছিল না, বরং তিনি ঠোঁট কামড়ে সংযত করার চেষ্টা করছিলেন নিজের আবেগ।
আবেগের উচ্ছাসে তাঁর বার বার কান্না পাচ্ছিল। এ কান্না কৃতজ্ঞতার কান্না। যে মহান সত্ত্বা এই অভাবিত বিজয় দান করলেন তাঁর জন্য বার বার কৃতজ্ঞতায় তাঁর মাথা নুয়ে আসছিল। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন নিজেকে সম্বরণ করতে। কিন্তু কান্না এসে বার বার তাঁর আবেগে ঝড় তুলছিল। খৃষ্টানরা দুয়ার এঁটে তাদের ঘরে বসে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। তারা তাদের যুবতী মেয়েদের লুকিয়ে রাখলো। মেয়েদেরকে পুরুষের লেবাস পরিয়ে দিল। তাদের ধারনা ছিল, মুসলিম বাহিনী যখন প্রতিশোধ নেয়া শুরু করবে তখন তারা কেউ রেহাই পাবে না। তারা মেয়েদের উপর অত্যাচার করবে। পুরুষদের হত্যা করবে।
কিন্তু ইউরোপের লেখক লেনপোল লিখেছেন, ‘সুলতান সালআউদ্দিন সেখানে যে উদার মনোভাব ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন তা সত্যি অভাবিত। এমন দৃশ্য ওখানকার কেউ আগে কখনোই দেখেনি।যখন তাঁর সৈন্যদল ক্রুসেড বাহিনীর কবল থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করে, তখন তিনি তাঁর বাহিনীর কমান্ডার ও সেনাপতিদের শহরে শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করতে কঠোর নির্দেশ দেন।
শহরে যেন কোন প্রকার অন্যায় অত্যাচার না হয় সে জন্য সৈন্যদের টহল দিতে আদেশ দেন তিনি। শহরের অধিবাসী মুসলমান, যারা এতদিন খৃষ্টানদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল তাদের কেউ যেন খৃষ্টানদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আক্রমণ চালাতে না পারে তিনি সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেও হুকুম জারী করেন’।
সুলতান আইয়ুবীর সমস্ত আদেশ ছিল ইনসাফ ও করুণা ভিত্তিক। কোন খৃস্টানকেই তিনি শহরর থেকে বিতাড়িত করেননি। কারো ওপর যেন কোন জুলুম অত্যাচার না হয় তা নিশ্চিত করে তিনি মসজিদুল আকসার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর পা যতই মসজিদুল আকসার দিকে যাচ্ছিল ততোই তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠছিলেন।
মসজিদের দৃশ্য যখন তাঁর চোখে দৃষ্টিগোচর হলো তিনি আল্লাহু আকবর বলে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠলেন। তখন তাঁর শরীর আবেগে থরথর করে কাঁপছিল। সুলতান আইয়ুবী মসজিদুল আকসায় পৌঁছেই আবেগের আতিশয্যে মসজিদের বারান্দায় বসে পড়লেন এবং সেখানেই সিজদায় পড়ে গেলেন।
সুলতান আইয়ুবীর চোখ দিয়ে তখন অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। যেন তিনি এ মসজিদের বারান্দা চোখের পানিতে ধুয়ে দিচ্ছেন।
মসজিদের অবস্থা ছিল তখন খুবই শোচনীয়। অতীতে মুসলিম শাসকরা যুগে যুগে এ মসজিদকে সোনার ঝাড়বাতি ও রৌপ্যের আগরবাতি এবং মুল্যবান উপহার ও উপঢৌকন দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলেন। সে সব জিনিশ খৃষ্টানরা সবই লুট করে নিয়ে গেছে।
মর্মর পাথরের মেঝেও জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে। দেয়ালের পলেস্তরা খসে গেছে। এসব দেখে বেদনায় তাঁর অন্তর ভেঙ্গে যাচ্ছিল। তিনি মসজিদটি পুনঃ মেরামতের সিদ্ধান্ত নিলেন। মসজিদ পুনঃ নির্মাণের আগে সুলতান আইয়ুবী শহরের প্রশাসনিক কাজের দিকে মনোযোগ দিলেন।

খৃষ্টানরা ছিল ভীত, শঙ্কিত, চিন্তাগ্রস্ত। তাদের ভাগ্যে কি আছে এই দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম হচ্ছিল না। তাদের মনে হচ্ছিল তারা এক অদৃশ্য জিন্দান খানায় বন্দী হয়ে পড়েছে।
সুলতান আইয়ুবী প্রথমেই এই পরাজিত খৃষ্টানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করতে চাইলেন। তিনি খৃষ্টানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাঁর উপদেষ্টাদের জরুরী সভা আহবান করলেন। পরামর্শ সভার সিদ্ধান্ত ক্রমে তিনি আদেশ জারি করলেন, ‘প্রত্যেক খৃষ্টান পুরুষ দশ দিনার, মেয়েরা পাঁচ দিনার এবং শিশুরা এক দিনার মুক্তিপণ দিয়ে শহর থেকে বের হয়ে যেতে পারবে’।
এ ঘোষণা খৃষ্টানদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করলো। তারা মানসিক বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেলো। যারা সেখানে থাকতে চাইলো না তারা মুক্তিপণ দিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
শহরের প্রধান ফটকে দাউদ গম্বুজের নিচে মুসলিম অফিসার বসলো মুক্তিপণ আদায় করতে। এখানে এসে মুক্তিপণ দিয়ে খৃষ্টান বাসিন্দারা শহর ছেড়ে চলে যেতে আরম্ভ করলো।
প্রথমেই মুক্তিপণ দিয়ে শহর থেকে বের হলো খৃষ্টান সরদার বালিয়ান। তাঁর কাছে ছিল ইংল্যান্ডের সম্রাট হেনরীর পাঠানো অনেক অর্থ। তিনি সেই অর্থ থেকে ত্রিশ হাজার দিনার ব্যয় করলেন শহরের খৃষ্টান দের মুক্ত করার কাজে। ফলে শুরুতেই দশ হাজার খৃষ্টান মুক্ত হয়ে গেল এই অর্থের বিনিময়ে।
দাউদ গম্বুজের প্রধান ফটকে বিদায়ী খৃষ্টানদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার বিরাট লাইন লেগে গেল। তারা প্রত্যেকে আপন বংশ ও পরিবারের মুক্তিপণ দিয়ে দলে দলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। চিরকালই এটা যুদ্ধের নিয়ম যে, বিজয়ী সৈন্যরা বিজয়ের পর সেই শহরে লুটতরাজ করে। বায়তুল মোকাদ্দাস ছিল এমন শহর যেখানকার অধিবাসীরা এর আগেও লুটতরাজের সম্মুখীন হয়েছিল। ক্রুসেড বাহিনী ও খৃষ্টানরা বিজয় লাভের পর পাইকারীহারে মুসলমান নিধন করেছিল এ শহরে। তারা মুসলমানদের অর্থ সম্পদ সবই লুট করে নিয়েছিল। তাদের স্ত্রী কন্যাদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছিল। মসজিদ অপবিত্র করেছিল। খৃষ্টানরা ধারনা করেছিল, এবার তাদের ভাগ্যে জুটবে সেই দুর্গতি ও লাঞ্চনা।
কিন্তু মুসলমানরা যখন শহর অধিকার করলো তখন ঘটলো এর বিপরীত ঘটনা। তারা লুটপাট বা অন্যায় অত্যাচার তো করলোই না বরং খৃষ্টানদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধানের জন্য জরুরী ব্যবস্থা গ্রহন করলো।
সুলতান আইয়ুবী মুসলমান ব্যবসায়ীদেরকে বললেন, ‘তোমরা উপযুক্ত মূল্য দিয়ে খৃষ্টানদের মালপত্র ক্রয় করবে যাতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং মুক্তিপণ আদায় করে শহর থেকে বের হতে পারে’।
এভাবে যেসব খৃষ্টানদের কাছে নগদ অর্থ ছিল না তারাও মালপত্র বিক্রি করে মুক্ত হয়ে গেল। মুক্তি পণের বাইরে খৃষ্টানদের কোন সম্পদেই হাত দেয়ার কোন অধিকার ছিল না মুসলমানদের জন্য।
এ সময়ের একটি ঘটনা পরবর্তী কালে জানাজানি হয়ে গেলে বিশ্বব্যাপী ধিক্কার ও নিন্দা কুড়িয়েছে। ঘটনাটি ছিল এরকম, বায়তুল মোকাদ্দাসের সবচেয়ে বড় পাদ্রী বেত্রিক হারকিউলিস এক কাণ্ড করে বসলেন। তিনি গির্জায় গচ্ছিত সমস্ত সোনা দানা ও অর্থ সম্পদ তার নিজস্ব ফান্ডে জমা করে নিলেন।
ঐতিহাসিকরা বলেছেন, এসব অর্থ এত বিপুল পরিমাণ ছিল যে এগুলো মুক্তিপণ হিসাবে দিয়ে তিনি অবশিষ্ট খৃষ্টানদের সহজেই মুক্ত করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার মুক্তিপণ দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান।
যে অফিসার মুক্তিপণ আদায় করছিলেন তিনি দেখলেন বহু অর্থ সম্পদ সাথে নিয়ে পাদ্রী সাহেব চলে যাচ্ছেন। তিনি খবরটি সুলতান আইয়ুবীকে জানিয়ে জানতে চাইলেন, এত বিপুল পরিমাণ সোনাদানা ও মুল্যবান সম্পদ নিয়ে তিনি তাকে যেতে দেবেন কিনা?
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যদি সে তার মুক্তিপণ দিয়ে থাকে তবে তাকে আর বাঁধা দিওনা। আমি তো বলেই দিয়েছি, যে যতটুকু সঙ্গে নিতে পারে তা সে নিয়ে যেতে পারবে। এই সম্পদ তার নাকি গির্জার সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমি আমার কথার বিরুদ্ধে যেতে পারবো না’।
পাদ্রী মহাশয় গির্জা থেকে চুরি করা সমুদয় অর্থ সম্পদ ও দামী পন্য সামগ্রী নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সুলতান আইয়ুবী মুক্তি পণ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য খৃষ্টানদের চল্লিশ দিন সময় ধার্য করে দিয়েছিলেন। চল্লিশ দিন শেষ হয়ে গেল। দেখা গেল তখনও কয়েক হাজার গরীব খৃষ্টান শহরে রয়ে গেছে।
নব্বই বছর আগে যখন খৃষ্টানরা শহরটি দখল করেছিল তখন দেশ বিদেশ থেকে বহু খৃষ্টান এই শহরে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তারা কোনদিন আশা করেনি, আবার তাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। চল্লিশ দিন শেষ হয়ে যাওয়ার পর সুলতান আইয়ুবী এই গরীব খৃষ্টানদের কি করবেন ভাবছিলেন। তখন তাঁর ভাই সুলতান তকিউদ্দিন সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে এক আবেদন নিয়ে হাজির হলেন।
‘সম্মানিত সুলতান’। তকিউদ্দিন বললেন, ‘আপনি জানেন এই শহর জয় করতে আমি ও আমার বাহিনী কেমন ত্যাগ স্বীকার করেছি। তার বিনিময়ে আমাকে এক হাজার খৃষ্টান দাস হিসেবে দান করুন’।
‘এত দাস দিয়ে তুমি কি করবে?’ সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।
‘সেটা আমার ব্যাপার! আমি মনে মনে কোন পরিকল্পনা স্থির করেই আপনার কাছে এ আবেদন করেছি’।
সুলতান আইয়ুবী তাকে এক হাজার খৃষ্টান দাস হিসাবে দেয়ার আদেশ দান করলেন। তকিউদ্দিন এক হাজার খৃস্টানকে বেছে নিলেন। তিনি তাদের নিয়ে দাউদ গেটে গেলেন এবং সবাইকে মুক্ত করে ফিরে এলেন।
‘সম্মানিত সুলতান’। তকিউদ্দিন ফিরে এসে সুলতানকে বললেন, ‘আমি তাদের সকলকে মুক্ত করে গেটের বাইরে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। তাদের কাছে মুক্তিপণের কোন অর্থ ছিল না’।
‘আমি জানতাম তুমি তাই করবে’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘নতুবা তোমার হাতে একজন খৃষ্টানকেও দাস হিসেবে দিতাম না। মানুষ মানুষের দাস হতে পারে না, আল্লাহ্‌ তোমার এ পুণ্য কাজ গ্রহন করুন’।
এ ঘটনা কোন গল্প কথা নয়। এমন আরো অনেক ঘটনা ঐতিহাসিকরা তাদের বইতে বর্ণনা করেছেন।
এ রকম আরেকটি ঘটনাঃ খৃষ্টান মেয়েদের একটি দল সুলতান আইয়ুবীর কাছে গেল। এরা সকলেই সেই সব ক্রুসেড সৈন্যদের স্ত্রী, মা ,বোন ও কন্যা ছিল যারা এই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল বা যুদ্ধবন্দী হিসাবে সুলতানের কাছে বন্দী ছিল। তাদের কাছে মুক্তিপণের কোন টাকা ছিল না।
তারা সুলতানের কাছে তাদের দুঃখের কথা তুলে ধরলো। সুলতান আইয়ুবী তাদের বললেন, ‘তোমাদের মুক্তি পণের টাকা দিতে হবে না। আমি দাউদ গেটে বলে দিচ্ছি, তোমাদেরকে যেনো মুক্তিপণ ছাড়াই বাইরে যেতে দেয়া হয় এবং আরো বলে দিচ্ছি, তোমাদের প্রত্যেককেই যেনো কিছু অর্থ সাহায্য হিসেবে দেয়া হয়’। তারা ফটকে পৌঁছলে সেখানকার অফিসার তাদের নাম ধরে ডাকলো এবং প্রত্যেকের হাতে কিছু নগদ অর্থ দিয়ে তাদের বিদায় করলো।
এরপর তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘যে সব খৃষ্টান এখনও শহরে রয়ে গেছে তাদের কোন মুক্তিপণ লাগবে না। তাদের মুক্তিপণ মাফ করে দেয়া হলো। তারা বিনা বাধায় নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেতে পারবে। যুদ্ধবন্দী হিসাবে থাকবে শুধু সৈন্যরা, যারা যুদ্ধের সময় আত্মসমর্পণ করেছিল’।
এরপর সুলতান আইয়ুবী মনোনিবেশ করলেন মসজিদুল আকসার মেরামত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে। এই কাজে তিনি নিজেও সৈন্যদের সাথে মিলেমিশে সাধারন শ্রমিকের মতই চুনসুরকি ও ইট বহনের কাজ করেছেন।
১১৮৭ সালের ১৯ অক্টোবর। সেদিনটি ছিল জুম্মাবার। সুলতান আইয়ুবী জুম্মার নামাজের জন্য মসজিদে গেলেন। তিনি সেই মিম্বারটি, যেটি মরহুম সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি তৈরি করে রেখেছিলেন এবং তাঁর বিধবা স্ত্রী ও কন্যা বহন করে এনে সুলতানকে দিয়েছিলেন সেটি তিনি নিজ হাতে মসজিদুল আকসায় স্থাপন করলেন। সেদিন জুম্মার খোৎবা দান করেছিলেন দামেশকের খতিব।
এরপর সুলতান আইয়ুবী মসজিদের সাজসজ্জার প্রতি মনোনিবেশ করলেন। মর্মর পাথর এনে মসজিদের মেঝেতে সুন্দর ভাবে লাগিয়ে দিলেন এবং মসজিদটিকে এক মনোমুগ্ধকর ভবনে রূপান্তরিত করলেন।
যে সব মূল্যবান ও সুন্দর পাথর সুলতান আইয়ুবী নিজ হাতেই ওখানে স্থাপন করেন আজও সেই পাথরগুলো সেখানেই আছে এবং তার সৌন্দর্য আজও ম্লান হয়নি।

বায়তুল মোকাদ্দাসের বিজয় ইসলামের ইতিহাসে এক বিরাট সফলতার মাইলফলক। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে সুলতান আইয়ুবীর সংগ্রাম ও সাধনা শেষ হলেও তিনি যে ক্রুসেডের মোকাবেলা করেছিলেন সেই ক্রুসেড এখনও শেষ হয়নি। আজো পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে ঘোষিত ও অঘোষিত ক্রুসেড।
তিনি আরব ভূমি ও ফিলিস্তিনকে ক্রুসেড বাহিনীর রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার অবর্তমানে ফিলিস্তিন, ইরাক এবং আরবের বিভিন্ন দেশে চলছে ক্রুসেড বাহিনীর নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ।
শুধু আরব দেশই নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত মুসলমানদের জানমালও আজ নিরাপত্তাহীন। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঘাড়ে আজো চেপে আছে বেহায়া সাম্রাজ্যবাদের সিন্দাবাদী দৈত্য।
তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসকে এক মজবুত কেল্লা ও মুজাহিদদের সুদৃঢ় ঘাঁটি বানাতে চেয়েছিলেন। এ জন্য এই পবিত্র স্থানে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক সমৃদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র। কিন্তু আজ সেখানে আবার গেড়ে বসেছে নাসারাদের দোসর ও উপদেষ্টা অভিশপ্ত ইহুদীরা।
৫ রমজান ৫৮৩ হিজরী মুতাবেক ৮ নভেম্বর ১১৮৭ খৃষ্টাব্দ। সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে স্বসৈন্যে যাত্রা করলেন। তাঁর গতি ছিল উত্তরের দিকে।
বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে বেরিয়েই তিনি তাঁর সন্তান আল মালেক আল জাহেরকে সংবাদ পাঠালেন খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর কাছে চলে আসে। সুলতান তাকে আরো জানালেন, ‘আমি টায়ারে যাচ্ছি। পথে দেখা না হলে তুমি সেনাবাহিনীসহ টায়ারে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে’।
সুলতান তখন টায়ারে আক্রমণ করতে যাচ্ছিলেন। টায়ার ভুমধ্যসাগর তীরের এক সমৃদ্ধ সমুদ্র বন্দর। বন্দরটি ছিল খৃষ্টানদের মজবুত ঘাঁটি। এখানে তাদের একাধিক রণতরীও ছিল।
সুলতান আইয়ুবী তাঁর নৌবাহিনীর কমান্ডার এডমিরাল আল ফারেসকে সংবাদ পাঠালেন, সে যেন টায়ার বন্দরের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। তিনি যখন টায়ারে আক্রমণ ও অবরোধ করবেন তখন যেন আল ফারেস টায়ারে বন্দরে অবস্থানরত খৃষ্টান নৌবহরের উপর আক্রমণ করে।
দুটি মেয়েই তখনো আল ফারেসের জাহাজে ছিল। হাসান বিন আবদুল্লাহর গোয়েন্দা তখন সেখানে ছিল না।
বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয়ের পর হাসান বিন আব্দুল্লাহ আবার তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন তাঁর মনে পড়ে গেলো, আল ফারেসের জাহাজে তাঁর এক গোয়েন্দা রয়েছে। তিনি আবার এক কাসেদকে রউফ কুর্দির কাছে পাঠালেন।
কাসেদকে বললেন, ‘ওখানে আমাদের যে গোয়েন্দা আছে এখনো সে কি করছে দেখে এসো। রউফ কুর্দিকে বলবে, প্রয়োজন না থাকলে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে’।
সে লোক হুকুম পেয়ে জাহাজে পৌঁছলো। রউফ কুর্দির কাছে জানতে চাইলো গোয়েন্দার খবর। রউফ কুর্দি তাকে জানালো, ‘ হাসান বিন আবদুল্লাহ যে গোয়েন্দাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন সে তো অনেকদিন আগেই চলে গেছে’।

কিছুদিন আগের কথা। সেই গোয়েন্দা রউফ কুর্দিকে একদিন জানালো, সে মেয়ে দুটিকে আর এখানে থাকতে দেবে না। কারণ সে এখন নিশ্চিত, এরা খৃষ্টানদের গোয়েন্দা।
তার এমন ধারনার কারণ, সে লক্ষ্য করেছে, যখন জাহাজ কুলের দিকে নোঙ্গর করা থাকে তখন জেলের বেশে ছোট ছোট নৌকায় করে কিছু লোক সেখানে আসে ফলমূল ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করতে। তাদের মধ্যে এক লোককে সে তিন চার জায়গায় দেখতে পেলো। মেয়ে দুটি প্রতিবারই তাকে রশির মই নামিয়ে উপরে তুলে নেয়। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে জিনিশ কেনার পরিবর্তে তার সাথে কি যেন পরামর্শ করে।
জাহাজ দশ বারো মাইল দূরে থাকলেও লোকটি ঝুঁকি নিয়ে সেখানে যায়। ফলে লোকটাকে গোয়েন্দার সন্দেহ হলো। ফ্লোরী ততো দিনে রউফ কুর্দির বুদ্ধি বিবেক পুরোপুরিই কিনে নিয়েছিল। সে তার কাছে নানা রকম গোপন তথ্য জানতে চাইতো। রউফ কুর্দি তাকে আপন মনে করে সব কিছু বলে দিত নির্ভয়ে।
আল ফারেস তখন খুব ব্যস্ত। তিনি নিয়মিত অন্য জাহাজে চলে যান তাদের খোঁজ খবর নিতে। সেদিন রাতেও তিনি তার দায়িত্ব পালনের জন্য অন্য জাহাজে চলে গিয়েছিলেন।
সেই রাতে রউফ কুর্দি যখন ফ্লোরীর প্রেমে মত্ত তখন সে ফ্লোরীকে বললো, ‘জাহাজে এক বিপজ্জনক লোক আছে। তার সাথে কোন কথা বলবে না’।
ফ্লোরী জানতে চাইল, ‘কে সেই বিপজ্জনক লোক?’
রউফ কুর্দি তার পরিচয় দিয়ে বললো, ‘ এ লোক আমাদের গোয়েন্দা। তাই তার কাছ থেকে সাবধান থাকবে’।
রউফ কুর্দি তখনো মেয়ে দুটিকে যাযাবরের কন্যা মনে করতো। তাই সে গোয়েন্দা লোকটির পরিচয় তার কাছে ফাঁস করে দিল।
ফ্লোরী ছিল ঝানু গোয়েন্দা। সে বুঝে নিল, রউফ কুর্দি যার কথা বলছে, তাকে সে সহ্য করতে পারছে না। লোকটি যদি গোয়েন্দা হয় তাহলে সে তাদেরকে জাহাজে থাকতে দেবে না। আর রউফ কুর্দিও চাইবে না মেয়েরা জাহাজ থেকে বিদায় হয়ে যাক। হয়তো এটাই তাদের দ্বন্দের মূল কারণ।
পরের রাতের ঘটনা। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আল ফারেস ডিউটি তদারক করার জন্য অন্য জাহাজে চলে গেলেন। রউফ কুর্দি তখন জাহাজের দায়িত্বে।
মাঝ রাতের একটু পর। রউফ কুর্দি ও ফ্লোরী জাহাজের ছাদের এক কোণায় গোপন অভিসারে মেতে ছিল। ওখানে জড়ো করে রাখা ছিল বিভিন্ন জিনিসপত্র। ওগুলোর আড়ালে বসেছিল ওরা।
হাসান বিন আবদুল্লাহর গোয়েন্দা ছাদে উঠছিল ঘুরে দেখতে। ছাদে উঠেই তার মনে হলো জঞ্জালের আড়ালে কাড়া যেন ফিসফাস কথা বলছে। সে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে গেল এবং হঠাৎ করেই উদয় হলো তাদের সামনে।
রউফ কুর্দি ভয় পেলেও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠলো, ‘আরে, এত রাতে তুমি এখানে?’
তারপর তার হাত ধরে তাকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে বললো, ভালই হয়েছে তুমি এসেছো। তুমি বলেছিলে, এরা গোয়েন্দা হতে পারে। তাই মেয়েটাকে লোভ লালসা দেখিয়ে জানতে চাচ্ছিলাম ওদের আসল পরিচয়। কিন্তু না, তেমন কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না’।
সে গোয়েন্দাকে বললো, ‘তুমি যখন এসেছো এবার আমি চলে যাই। তুমি চেষ্টা করে দেখো কৌশলে কিছু জানতে পারো কিনা? তুমি তো অভিজ্ঞ গোয়েন্দা, তোমার জেরার মুখে পড়লে হয়তো গোপন কোন তথ্য বেরিয়েও আসতে পারে’।
সে গোয়েন্দাকে ফ্লোরীর কাছে পাঠিয়ে দ্রুত রোজীর কাছে চলে গেল। তাকে বললো, ‘আরেকটু হলে ফেঁসে গিয়েছিলাম’।
‘কেন? কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো রোজী।
কি ঘটেছে সে সব খুলে বললো রোজীকে। রোজী বললো, ভালই শিকার যোগাড় করেছো। তুমিও মরবে, আমাদেরও মারবে’।
রোজী, তুমি ওখানে যাও। ওকে বুঝানোর চেষ্টা করো আমি তোমাদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করার চেষ্টা করেছিলাম। সে যদি টের পায় তোমাদের সাথে আমার কোন রকম সম্পর্ক আছে তবে আমার প্রেম করার শখ মিটিয়ে দেবে’।
‘ঠিক আছে, তুমি এদিকে পাহারা দাও কেউ যেন উপরে যেতে না পারে। আমি যাচ্ছি ছাদে’।
রোজী উপরে চলে গেল। রউফ কুর্দি এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে পাহারা দিতে লাগলো যেন কেউ উপরে যেতে না পারে।
রোজী যাওয়ার আগে একটুকরো শক্ত রশি নিল সাথে। তারপর সেই রশি ওড়নায় ঢেকে চলে গেল যেখানে গোয়েন্দাটি ফ্লোরীর কাছে বসেছিল সেখানে। জঞ্জালের আড়াল থাকায় জায়গাটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। রোজীও তাদের পাশে বসে গেল।
গোয়েন্দা গল্প গুজবের মাধ্যমে তাদের আসল পরিচয় জেনে নিতে চেষ্টা করছিল। রোজী হঠাৎ গোয়েন্দার গলায় রশি পেঁচিয়ে শক্ত করে টেনে ধরলো।
ফ্লোরীও ফাঁসের ওপর প্রান্তে টেনে ধরলো শক্ত করে। তারা উভয়েই ছিল ট্রেনিংপ্রাপ্ত সাহসী গোয়েন্দা। সেই ট্রেনিং এবার কাজে লাগাচ্ছে তারা।
হাসান বিন আবদুল্লার গোয়েন্দা নিজেকে বাঁচানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালালো। কিন্তু দু’জনের দু’দিক থেকে রশি টানাটানির ফলে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। দেহ শিথিল হয়ে গেল এবং এক সময় সে ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে।
মেয়ে দুটি গোয়েন্দার লাশটি ধরাধরি করে নিয়ে গেল জাহাজের কিনারে। তারপর তা গড়িয়ে ফেলে দিল গভীর সমুদ্রে। এভাবেই সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দার সলিল সমাধি ঘটলো সবার অজান্তে। সে হয়ে গেল ভূমধ্যসাগরের সামান্য মাছের খোরাক।
লাশটা পানিতে ফেলেই রোজী নিজের ক্যাবিনের দিকে হাঁটা ধরলো। ফ্লোরী দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই।
রউফ কুর্দি রোজীকে দেখেই তার কাছে এগিয়ে এলো। বললো, ‘খবর কি?
‘প্রেম করতে হলে মাথায় কিছু বুদ্ধিও রাখতে হয়। যাও, এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিলাম। তোমার প্রতিপক্ষ এতক্ষণে নিশ্চয়ই মাছের পেটে চলে গেছে। ক্যাবিনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই বললো রোজী।
রউফ কুর্দি দ্রুত উঠে এলো ছাদে। দেখলো রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ফ্লোরী। তাকিয়ে আছে সমুদ্রের অনন্ত ঢেউ রাশির দিকে, আলতো পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো রউফ কুর্দি। বললো, ‘কি দেখছো?’
ফ্লোরী ঘুরে দাঁড়ালো। আচমকা জড়িয়ে ধরলো তাকে। তার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কান্নাকাতর কণ্ঠে বললো, ‘তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে শেষে লোকটাকে মেরেই ফেললাম’। যেন অনুশোচনায় মরে যাচ্ছে সে।
রউফ কুর্দিও তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এসবই নিয়তির খেলা। নইলে এত রাতে মরার জন্য সে ছাদে উঠে এসেছিল কেন? মন খারাপ করো না। যা হবার হয়ে গেছে, এখন সব ভুলে যাও’।

আল ফারেস যেমন জানতো না, তার জাহাজে কোন গোয়েন্দা আছে আর রউফ কুর্দি তাকে কোন কাজে লাগিয়ে দিয়েছে তেমনি তার করুণ পরিনতির কথাও সে জানতে পারেনি। জাহাজীদের জীবন আগেও যেমন ছিল তেমনি চলছিল। গোয়েন্দার আগমন যেমন কোন আলোড়ন তুলতে পারেনি জাহাজে তেমনি তার অস্তিত্বও নিঃশব্দে মুছে গেল দুই খৃষ্টান মেয়ের হিংস্রতার কবলে পড়ে।
গোয়েন্দা নিহত হওয়ার দুই দিন পর। আল ফারেস তার ক্যাবিনে বসে চিন্তা করছিল। নিজেরও আরও পাঁচটি জাহাজের মাল্লা ও নৌসেনারা মাসের পর মাস সমুদ্রে কাটিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের একঘেয়েমি পেয়ে বসেছে সবাইকে। সবাই কেমন নির্জীব ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ডাঙার স্বাভাবিক আলো বাতাস থেকে দূরে মাটির স্পর্শহীন মানুষগুলোর জীবন ক্রমেই তিক্ত ও বিরক্তিকর হয়ে উঠছে।
যদি ওরা সংঘাত ও যুদ্ধে জড়িয়ে থাকতো তবে তাদের মানসিক অবস্থা এমন হতো না। সে জন্য আল ফারেস ভাবলো, সৈনিক ও মাল্লাদের উজ্জীবিত করার জন্য কোন আনন্দ অনুষ্ঠান করা উচিত। বিষয়টি নিয়ে সে রউফ কুর্দির সাথে পরামর্শ করলো। রউফ কুর্দি তাকে বললো, ‘রাতে সবকটা জাহাজকে একত্রিত করে মাল্লা ও নৌসেনাদের নিয়ে ভোজ সভার আয়োজন করা যেতে পারে’।
এ আনন্দ সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে সময় নিল না। জাহাজের মাল্লা ও সৈনিকদের কানে পৌঁছে গেল এ খবর। মেয়েদের কানেও গেল। মেয়ে দু’জন বললো, ‘আমরা ভোজসভায় নাচবো ও গান করবো’।
আল ফারেস ফুর্তিবাজ লোক, এ প্রস্তাবে তিনিও তাল দিলেন। কিন্তু কোন রাতে এ অনুষ্ঠান করা হবে এখনও তা নির্ধারণ করেননি। তিনি সুলতান আইয়ুবীর কাসেদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সুলতানের কাছ থেকে কোন শুভ সংবাদ এলে সেই উপলক্ষেই এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। আল ফারেসের এ ঘোষণার দু’দিন পরেই কাসেদ এসে গেল।
সে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী টায়ার থেকে সামান্য দূরে আছেন। সুলতান আপনাকে নৌবহর নিয়ে টায়ারের কাছে চলে যেতে বলেছেন। রাতে তিনি যখন টায়ার আক্রমণ করবেন তখন নৌবাহিনী যেন টায়ারের সমুদ্র বন্দরে অবস্থিত ওদের যুদ্ধ জাহাজগুলোর ওপর দ্রুত আক্রমণ করতে পারে’।
কাসেদ বিশেষ করে আরো বললো, ‘সুলতান আপনাকে এখন থেকে সদা সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলেছেন। সুলতানের ধারনা, তার আগমনের খবর পেলে খৃষ্টান রণতরী আপনাদের ওপর আগাম আক্রমণ করে বসতে পারে’।
আল ফারেস কাসেদকে বিদায় জানিয়ে সেই রাতেই তার সমস্ত জাহাজকে একত্র হওয়ার আদেশ দিলেন। রউফ কুর্দিকে বললেন, ‘সম্ভবত কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। তাই কাল রাতেই ভোজ সভার আয়োজন করো’। রউফ কুর্দি সব কটা জাহাজে এ ঘোষণা প্রচার করে দিল।
এন্ডুর কিস্তি নিয়মিতই আসতো জাহাজে। হাসান বিন আবদুল্লাহর গোয়েন্দা তাকে কয়েকটি স্থানে দেখেছিল। কিন্তু সে কোন ব্যবস্থা নেয়ার আগে নিজেই দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেল। ফলে এন্ডুকে সনাক্ত করার আর কেউ রইলো না জাহাজে।
জাহাজ উপকূলের কাছে এসে থামলো। এন্ডুও তার নৌকা নিয়ে হাজির হয়ে গেল সেখানে। মেয়েরা আগের মতই তাকে উপরে ডেকে নিয়ে গেল। তারা তার কাছ কিছু কেনার বাহানায় এন্ডুর কানে কানে বলে দিল, ‘কাল রাতে জাহাজ সব একত্রিত হবে। জাহাজের উপরে ভোজ সভা হবে, নাচ গান হবে’।
সে মেয়েদের বললো, ‘আমি রাতে যথাসময়ে নৌকা নিয়ে হাজির হয়ে যাবো। তোমরা তাকে তাকে থাকবে এবং সুযোগ মত সিঁড়ি ফেলে নেমে আসবে নৌকায়। তারপরের কাজ করবে আমাদের কমান্ডো বাহিনী’।
দেখতে দেখতে এসে গেল কাঙ্খিত রাত। ছয়টি জাহাজ পাল তুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেল। জাহাজের ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য অফিসাররা সবাই আল ফারেসের জাহাজে সমবেত হলো।
এশার নামাজের পর শুরু হলো আহারাদি পরিবেশন। মাল্লা ও সিপাইরা নিজ নিজ জাহাজে আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছিল। আল ফারেসের জাহাজেই মেয়ে দুটি নাচগান করছিল। অফিসাররা উপভোগ করছিল সে নাচগান।
মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করে তোলা হয়েছিল সব কটি জাহাজ। মাল্লারা অফিসারদের থেকে আলাদা হয়ে গান বাজনা ও আমোদ ফুর্তি করছিল।
এই আনন্দ উৎসব যখন তুঙ্গে তখন রাত গভীর। খৃষ্টানদের দশ বারোটি জাহাজ আলো নিভিয়ে আল ফারেসের জাহাজের দিকে অগ্রসর হলো। তারা নতুন চাঁদের হালকা আলোতে ছিল বলে দূর থেকে তাদের দেখার উপায় ছিল না।
তারা যখন কাছে এলো তখন শেষ রাত। ক্লান্ত সিপাইরা অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। অফিসাররাও ফিরে গেছে নিজ নিজ ক্যাবিনে। কেউ জানতে পারলো না তাদের অলক্ষ্যে এগিয়ে আসছে মৃত্যু।
শেষ রাতের বিসন্ন প্রহরে একটি ছোট নৌকা আল ফারেসের জাহাজের দিকে অগ্রসর হলো। সবার অলক্ষ্যেই তা ভিড়লো আল ফারেসের জাহাজের সাথে। সন্তর্পণে সিঁড়ি নামিয়ে তাতে চড়ে বসলো সেই দুই মেয়ে। একটু পরেই চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
সহসা আল ফারেসের জাহাজের দিকে অগ্নিবান ও গোলা নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল। ঘুমন্ত সৈন্য ও মাল্লারা জেগে উঠলো গোলার আওয়াজ পেয়ে। দাউ দাউ করে জাহাজে জ্বলে উঠলো আগুন।
মাল্লা ও সৈন্যরা ছুটে বেরিয়ে এলো ডেকে। আর তখন এমন তীর বর্ষণ শুরু হলো যে, তীরের আঘাতে ডেকের ওপর লুটিয়ে পড়তে লাগলো জাহাজের সৈন্যরা। আল ফারেস ও জাহাজের ক্যাপ্টেনরা আকস্মিক আক্রমনের আওতা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু তখন আর তা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু এরা ছিল আইয়ুবীর সৈন্য। ভড়কে যাওয়ার শিক্ষা তিনি তাদের দেননি। এই অবস্থায়ও তারা পাল্টা জওয়াব দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। তারাও মেঞ্জানিক দিয়ে অগ্নি নিক্ষেপ শুরু করলো শত্রুর জাহাজের ওপর।
খৃষ্টানরা পাল্টা আক্রমনের সম্মুখীন হবে ভাবতে পারেনি। তারা সতর্ক হওয়ার আগেই খৃষ্টানদের একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কিন্তু খৃষ্টান বাহিনীর কাজ তখন শেষ পর্যায়ে। তারা বেপরোয়া ভঙ্গিতে আরো কিছুক্ষণ গোলা বর্ষণ করে ফিরে গেল।
যুদ্ধ যেভাবে শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই শেষ হয়ে গেল। আল ফারেসের পাঁচটি জাহাজই পুড়ে গিয়েছিল। মুসলিম বাহিনীর বহু সৈন্য নিহত হয়েছিল। যেহেতু জাহাজ জ্বলছিল, সেই আলোতেই সৈন্যদের দেখে দেখে তীর বিদ্ধ করছিল খৃষ্টানরা।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আল ফারেস দেখতে পেলেন, একটি নৌকা তাদের কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাতে একজন পুরুষ ও দু’জন মেয়ে মানুষ। আল ফারেস দ্রুত জাহাজ থেকে একটি নৌকা নামিয়ে তাতে একদল নৌসেনাকে তুলে দিয়ে বললেন, ‘ছুটে যাও। ওদেরকে ধরতে চেষ্টা করো’।
ওরা ধাওয়া করলো সে নৌকাকে। টের পেয়ে ওরা তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। বাধ্য হয়ে পাল্টা তীর ছুঁড়লো মুসলিম নৌ সেনারা।
প্রথমেই তীরবিদ্ধ হলো নৌকার চালক এন্ডু। এরপর একটি মেয়ে। নৌকা থেমে গেল। তীর চালনা বন্ধ করে ওরা গিয়ে ধরে ফেললো নৌকাটি।
একটি মেয়ে তখনো বেঁচে আছে। তাকে বন্দী করা হলো। যুদ্ধের পর যখন আল ফারেসের কাছে তাকে হাজির করা হলো তখনই তিনি জানতে পারলেন, তার এ শোচনীয় পরিণতির জন্য দায়ী কে?
মেয়েটি পড়ে সবই স্বীকার করলো। তার মুখ থেকেই আল ফারেস জানতে পারলেন এ ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে ছিল তাদেরই হাত। মেয়েটি আরো জানালো। তারা এর আগে এক মুসলিম গোয়েন্দাকে হত্যা করে জাহাজ থেকে সাগরে ফেলে দিয়েছে। সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আল ফারেস।
এই জাহাজে কোন গোয়েন্দা ছিল এটা তো তার জানাই ছিল না। তার মনে পড়লো হাসান বিন আবদুল্লাহর সতর্কবাণী। কথার এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শরীয়ত পাল্টে দেয়ার অধিকার কবে থেকে পেলে?’
তাইতো! শরীয়তের বিধান মেনে এই মেয়েদের যদি তিনি জায়গা না দিতেন তবে এই বিপর্যয়ের মুখে তাকে পড়তে হতো না। অনুশোচনায় তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত ও দগ্ধ হতে লাগলো। কিন্তু সর্বনাশের কোন হেরফের হলো না। মুসলমানদের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেলো।
এ সময় সুলতান আইয়ুবী টায়ার থেকে সামান্য দূরে এক জায়গায় ক্যাম্প করে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি সোজা টায়ারের উপর আক্রমণ চালাতে চাচ্ছিলেন।
তিনি আক্রমণ করার আগের দিন জানতে পারলেন, আল ফারেসের নেতৃত্বাধীন ছয়টি জাহাজের পাঁচটিই পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। এ খবরে সুলতান আইয়ুবী একেবারে থ মেরে গেলেন।।
তিনি এমন দুঃসংবাদ শোনার আশা কখনও করেননি। এই খবরে তিনি এতটাই স্তম্ভিত হলেন যে, তিনি অভিযান চালানো স্থগিত করলেন। অভিযান স্থগিত করে তিনি আল ফারেস ও অন্যান্য ক্যাপ্টেনদের ডেকে পাঠালেন। আল ফারেস সুলতানের সামনে হাজির হয়ে যা সত্য তাই তুলে ধরলেন। নিজের দুর্বলতা ও ত্রুটি স্বীকার করে বললেন, ‘নৌবাহিনীর সকল কর্মচারী, মাল্লা ও সৈন্যরা কেমন নির্জীব ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের একঘেয়েমী দূর করার জন্য সে রাতে ভোজ সভার আয়োজন করেছিলাম।
কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, আমাকে বোকা বানিয়ে আমারই জাহাজে দুই খৃষ্টান গোয়েন্দা যাযাবরের পরিচয়ে অবস্থান করছিল। আমাদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে তারা এই বিপর্যয় সৃষ্টি করে’।
সুলতান আইয়ুবী এই পরিস্থিতিতে টায়ারে অভিযান চালানো ঠিক হবে কিনা এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি তার সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন।
সৈন্যদের অবস্থা সবার কাছেই পরিষ্কার ছিল। তদুপরি কঠিন শীত পড়তে শুরু করেছে। সেই সাথে বৃষ্টিও হচ্ছে। সবাই বুঝতে পারছিল, এমন মওসুমে যুদ্ধ চালু রাখা খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
সৈন্যরা দ্রুত ও ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সুলতান বললেন, ‘এ অবস্থায় নতুন করে তাদের ময়দানে পাঠালে তা তাদের জন্য জুলুম হয়ে যাবে। ক্রমাগত সাফল্যের পর একবার পরাজিত হলেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। পরাজিত শত্রু নতুন করে মনোবল ফিরে পাবে আর আমাদের সৈন্যদের মধ্যে জন্ম নেবে পরাজয়ের গ্লানি’।
তিনি নৌবাহিনীর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বললেন, ‘ওরা এ জন্যই ধ্বংস হলো যে, দীর্ঘদিন ওরা বাড়ী ছাড়া ছিল। ফলে তাদের উদ্যমে ভাটা পড়েছিল। বায়তুল মোকাদ্দাসের মহান বিজয়ের পর এমন কিছু করা ঠিক নয়, যাতে মুসলিম বিশ্বে নতুন করে যে আবেগ ও জাগরণ সৃষ্টি হচ্ছে তা বাঁধাগ্রস্ত হয়। যদি জাহাজে নতুন বিপর্যয় দেখা না দিত তবে আমরা আগামীকাল টায়ারে আক্রমণ চালাতাম। এখন এই দুর্ঘটনার পর আদৌ অভিযান চালানো ঠিক হবে কিনা তোমরা ভেবেচিন্তে মতামত দাও’।
সুলতান আইয়ুবী সকলের মতামত গ্রহন করলেন। সম্মিলিত মতামতের প্রেক্ষিতে তিনি আদেশ দিলেন, ‘অভিযান আপাতত স্থগিত করা হলো। অধিকৃত অঞ্চল ছাড়া বাইরের যে সব সৈন্য আছে তাদের বেতন বোনাস দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দাও’। তিনি তার রক্ষী বাহিনীর কিছু সৈন্যকেও ছুটি দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। এরপর তিনি অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে আক্রার দিকে যাত্রা করলেন।
২০ জানুয়ারী ১১৮৮। আক্রায় পৌঁছে তিনি আরো কিছু সৈন্যকে ছুটি দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। নিজেও সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুদিন বিশ্রাম করবেন। মার্চ পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকলেন এবং পরবর্তী অভিযানের নকশা ও পরিকল্পনা তৈরি করতে লাগলেন।

ক্রুসেড যুদ্ধ শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিল। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয় সমস্ত ইউরোপকে একটা কঠিন ধাক্কা দিয়ে কাপিয়ে দিল।
সুলতান আইয়ুবী তার জীবনের লক্ষ্য ও সপ্ন পূরণ করেছিলেন এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ইসলামের সুরক্ষার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাস খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করাই যথেষ্ট ছিল না, বিশ্বব্যাপী ইসলামী চেতনার বিস্তার ও তা সংরক্ষণও জরুরী ছিল।
সুলতান আইয়ুবী প্রথমেই এই পবিত্র শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ় করলেন। শহরের প্রাচীর সুদৃঢ় করার সাথে সাথে বায়তুল মোকাদ্দাসকে ক্রুসেড বাহিনীর আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখার জন্য আশেপাশের এলাকা দূর দুরান্ত পর্যন্ত নিজ অধিকারে নিয়ে নেয়ার কথা ভাবলেন। উপকূলবর্তী এলাকা নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়ার কথাও উপলব্ধি করলেন তিনি।
সুলতান আইয়ুবী আগেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন। অবশিষ্ট যে দু’একটি স্থান ছিল সেখানেও তিনি তার কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন। তারা একের পর এক আক্রমণ করে ওই সব অঞ্চল দখল করে চলছিল।
বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে খৃষ্টান বাসিন্দারা পালিয়ে যাচ্ছিল। যে সব স্থানে খৃষ্টান শাসন ছিল সেখানে মুসলমানদের জান-মাল ও জীবন ছিল দুর্বিষহ। মুসলমানদের পাইকারীভাবে হত্যা করা ছিল তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর এই হত্যাকাণ্ড চালাতো তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে।
কিন্তু সুলতান আইয়ুবী প্রতিশোধ পরায়ন আচরণ থেকে বিরত রইলেন। এমনকি ক্ষিপ্ত মুসলমানরা যেন কেউ কেবল খৃষ্টান হওয়ার কারণে কারো ওপর চড়াও হতে না পারে তা নিশ্চিত করলেন।
তিনি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সেনাপ্রহরা বসালেন। অধিকৃত এলাকার খৃষ্টান বাসিন্দারা যাতে নিরাপদে তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারে সে জন্য তাদের সঙ্গে নিরাপত্তা প্রহরী দিলেন।
এ অধিকার কাউকে আন্দোলন বা দাবী করে আদায় করতে হয়নি। বরং সুলতান আইয়ুবী নিজে থেকেই এসব ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন। যুদ্ধের পর কোন বেসামরিক লোককে তাদের অতীত অপকর্মের জন্য শাস্তি না দিয়ে তিনি তাদের ক্ষমার চোখে দেখলেন।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top