২৮. রক্তস্রোত

‘না, সুলতানে মুয়াজ্জম!’ হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘তিনি সহি সালামতেই ত্রিপলী পৌঁছে ছিলেন। কিন্তু পরের দিন তাকে তার কামরায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মনে হয় পরাজয়ের শোক সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।’

‘কিন্তু তাকে তো তেমন আত্মাভিমানী বলে মনে হয়নি!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আগেও তিনি কয়েকবার পরাজিত হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়েছিলেন। তিনি আমাকে হত্যা করার জন্য তিন বার ঘাতক বাহিনী ভাড়া করেছিলেন। এমন তো ঘটেনি, সেই ঘাতক বাহিনীর ছোবল খেয়েছেন তিনি? যাই হোক, তাঁর মৃত্যুতে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। আল্লাহর ফয়সালা পাল্টানোর সাধ্য আমাদের কারো নীই।  আমার দুঃখ হচ্ছে, বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে মরার ভাগ্যও লোকটার হলো না।’

ঐতিহাসিকগণ ত্রিপোলীর সম্রাট রিমান্ডের মৃত্যু সম্পর্কে একাধিক ভিন্নমত পোষণ করেছেন। কেউ বলেছেন, তিনি হার্টের রোগী ছিলেন। পরাজয়ের শোক সইতে না পেরে সম্ভবত হার্ট এ্যাটাকে মরেছেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বলেছেন, ফেদাইন খুনী গ্রুপের সাথে দেনা পাওনা নিয়ে তার বিরোধ ছিল। তারাই তাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছিল।

সম্রাট রিমান্ড হঠকারী ও হিংসুটে শাসক ছিলেন। ষড়যন্ত্রে ছিলেন ওস্তাদ। মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টিতে তার হাত ছিল। কেবল মুসলমান নয়, খৃস্টান শাসকদের পরস্পরের মধ্যেও ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে দ্বিধাবোধ করতেন না তিনি। তাই খৃস্টান সম্রাটরা কেউ তাকে বিশ্বাস করতেন না।

হাসান আল সাবাহর ফেদাইন খুনী চক্রের সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সুলতান আইয়ুবীকে একাধিকবার এই খুনী চক্রের মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করেছেন তিনি। একাধিক খৃষ্টান সম্রাটের বিরুদ্ধেও এই খুনী চক্রকে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, তারা সফল হতে পারেনি। কিন্তু তার হত্যা প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গিয়েছিল। এতে তিনি খৃস্টান শিবিরে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন।

কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বাহিনী গঠনের সময় তারা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তার অপকীর্তি ভুলে তাকে দলে টানে। সম্রাট রিমান্ড সম্মিলিত বাহিনীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মহান ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ নিয়ে হাতিনের রণাঙ্গনে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে যুদ্ধ শুরুর পরদিনই তিনি পালিয়ে আসেন। পরের দিন তাকে তার কামরায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার জীবনের শেষ রাতে ফেদাইন নেতা শেখ মান্নান তার কাছে ছিল বলে জানা যায়।

তার আগে আরেক প্রসিদ্ধ খৃস্টান শাসক সম্রাট বিলডনও মারা গিয়েছিলেন। এই সম্রাট ফ্রান্সের রণপ্রিয় শাসক ছিলেন। বায়তুল মোকাদ্দাস তাঁর শাসনাধীন ছিল। সম্রাট বিলডন যুদ্ধ বিদ্যায় খুব দক্ষ ছিলেন। তিনি ভাল করেই জানতেন, সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবেন।

তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসকে বাঁচানোর জন্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তার গোয়েন্দা বাহিনীকেও যথেষ্ট শক্তিশালী করে সমস্ত মুসলিম রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারা যে কেবল গোয়েন্দাগিরী করতো তাই নয়, সুযোগ পেলে নাশকতামূলক কাজও আঞ্জাম দিত। তারা মুসলিম অঞ্চল সমূহের দুস্কৃতকারীদের সার্বিক সহায়তা দিত যাতে সেখানে সর্বদা অস্থিরতা বিরাজ করে। তারা মুসলিম অঞ্চলের শাসকদের মধ্যেও গাদ্দার সৃষ্টির জন্য সর্বদা তৎপর থাকতো।

সম্রাট বিলডনের যোগ্যতার সবচে বড় মাপকাঠি, তিনি ইয়াজউদ্দিন, সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীনকে একত্রিত করে তাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই তিন মুসলিম শাসক সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সামরিক জোট গড়ে তুলেছিল। বিলডন তাদের সব রকম যুদ্ধের অস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম সরবরাহ করে তাদের চাঙ্গা করে রাখতেন। শাসকদের অনুগত রাখার জন্য নিজের গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে নিয়মিত তাদের সরবরাহ করতেন মদ, সোনা-রূপা ও সুন্দরী নারী। এই মেয়েরা সেই সব শাসকদের মন-মগজ সর্বদা আচ্ছন্ন করে রাখতো। মুসলিম শাসকদের একান্ত বাধ্য করে রাখার তার এ কৌশল যথেষ্ট কার্যকর হয়েছিল।

সম্রাট বিলডনের বয়স হয়েছিল। হাতিন যুদ্ধের কিছুদিন আগে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মারা যান। তার স্থলে গে অব লুজিয়ান বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

সুলতান আইয়ুবী পৃথিবীর ইতিহাসে কমান্ডো ও গেরিলা আক্রমণে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আজ পর্যন্ত সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী এ জন্যই ইতিহাস হয়ে আছে। কিন্তু কমান্ডো আক্রমণের দুর্বল দিক হচ্ছে, এ আক্রমণ করে শত্রুর বিস্তর ক্ষতি সাধন এমনকি শত্রুকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব হলেও কোন এলাকা দখল করা বা দীর্ঘ সময় সে এলাকা দখলে রাখা সম্ভব হয় না। কারণ কমান্ডো বাহিনী থাকে ক্ষুদ্র। তারা ঝড়ের বেগে এসে আবার ঝড়ের বেগেই হারিয়ে যায়। যাওয়ার আগে হয়তো সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়।

সুলতান আইয়ুবী কমাণ্ডো বাহিনীর জন্য নতুন করে যুদ্ধের ছক তৈরী করলেন। এই পরিকল্পনায় তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসের আশপাশের দূর দূরান্ত পর্যন্ত কমান্ডো বাহিনী ছড়িয়ে দিলেন। তাদেরকে নির্দেশ দিলেন, ‘তোমরা ওইসব এলাকা থেকে খৃস্টানদের বেদখল ও বিতাড়ন করবে। সাগর তীরের কেল্লাগুলো দখল করে নেবে। কেল্লাতে যে সব অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যশস্য পাবে সেগুলো কোন নিরাপদ স্থানে হেফাজত করবে। আমাদের গোয়েন্দারা প্রতি মুহূর্তে তোমাদের তৎপরতা ও অগ্রগতির খবর রাখবে।

কোন কেল্লা দখল হয়ে গেলেই তা হেফাজত করার মতো সৈন্য আমি সেখানে পাঠিয়ে দেবো। ওরা পৌঁছে গেলে কেল্লা ওদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে তোমরা এগিয়ে যাবে অন্য এলাকায়। এভাবে নিয়মিত যুদ্ধে না গিয়ে ফিলিস্তিনের আশপাশের সমস্ত এলাকা যতটুকু সম্ভব আমি আগেই দখল করে নিতে চাই।’

সুলতান আইয়ুবী তাঁর সৈন্যদের সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে দিলেন। এটাই ছিল সুলতানের আসল শক্তি। তিনি কি করতে চান সেটা প্রতিটি সেনাপতি ও সৈন্যের অন্তরে গেঁথে দিতেন তিনি। তখন সুলতানের মতোই স্থির লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলতো কাফেলার প্রতিটি সৈনিক। চিন্তার এ ঐক্য তাদের মধ্যে গড়ে তুলতো শীশাঢালা দৃঢ়টা।

তিনি সেনাপতিদের বলে দিলেন কে কোন এলাকা দখল করবে এবং কোথায় অবস্থান করবে। ওই সব এলাকা ও শহরের বর্তমান অবস্থাও তিনি তাদের সামনে তুলে ধরতেন। তিনি সেনাপতিদের বললেন, ‘বিজয়ের পর তোমাদের কাজ হবে ওই এলাকার মুসলমানদের দুর্দশার অবস্থা সৈন্যদের সামনে তুলে ধরা। তোমরা তাদের নিয়ে যাবে মুসলিম পল্লীগুলোতে। নিজের চোখে ওরা দেখবে সেখানকার মুসলমানরা এতদিন কি দুঃসহ জীবন যাপন করেছে। তাদের দেখাবে সেখানকার বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদগুলো, যেগুলো খৃস্টানরা ধ্বংস ও পদদলিত করেছে। সেখানকার মুসলমান নারীদের দুর্দশার করুণ চিত্র তাদের দেখতে দেবে, যাদের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করেছে অসভ্য খৃস্টানরা। ভাল করে দেখাবে, আমাদের শত্রুরা কত নিষ্ঠুর, তারা কত অমানবিক।’

সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনী অল্প সংখ্যক হওয়ার পরও তারা যে বড় বড় বাহিনীর উপর বিজয় লাভ করতো তার মূলে কাজ করেছে সুলতানের এই টেকনিক। মুসলিম মুজাহিদরা যখন সচক্ষে দেখতো খৃস্টানদের অপকর্ম, তখন তাদের মধ্যে জেগে উঠতো ক্ষোভ ও ঘৃণা। এই অন্যায়ের প্রতিবিধান ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তারা পাগলপারা হয়ে যেতো। এভাবেই তাদের অন্তরে জ্বলে উঠতো প্রেরণার নতুন চেরাগ। স্বজাতির এই করুণ দৃশ্য দেখার পর এই সব সৈন্যরা যখন খৃস্টানদের মুখোমুখি হতো তখন শত্রুর ওপর তারা সাক্ষাত অভিশাপ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো।

এই পরিকল্পনা দিয়ে সৈন্যদের পাঠিয়ে দেয়ার পর সুলতান আইয়ুবী প্রতিদিনই খবর পেতে লাগলেন, ‘আজ অমুক এলাকার পতন ঘটেছে। অমুক এলাকা মুজাহিদরা পরিপূর্ণ দখল করে নিয়েছে। অমুক জায়গায় খৃস্টান বাহিনী মুসলিম সৈন্যদের ধাওয়া খেয়ে পিছু হটছে।’

এভাবেই সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য ও কমান্ডোরা সব রকম আরাম হারাম করে, ঘুম ও বিশ্রাম ত্যাগ করে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।

একদিন সুলতান আইয়ুবী নকশার ওপর চোখ রেখে গভীর মগ্ন হয়ে তাঁর পরিকল্পনা খতিয়ে দেখছিলেন। কখনো সেই পরিকল্পনায় সামান্য রদবদল করছিলেন। তিনি নকশাটি তাঁর তালুতে নিয়ে উপস্থিত কমান্ডার, সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের পরবর্তী প্ল্যান বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এমন সময় বাইরে শোরগোল শোনা গেল।

‘আমি তোমাদের সুলতানকে হত্যা করবো। তোমরা খৃস্টানদের পূজারী। আমাকে ছেড়ে দাও। নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার।’

এ সব কথা এক লোকই বলছিল। এ সময় ভেসে এলো আরেকটি কণ্ঠ, ‘ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও। সুলতান বিরক্ত হবেন।’

অন্য একটি কণ্ঠ চিৎকার করে বললো, ‘মেরে ফেলো ওকে। জীবনের মত শেষ করে দাও। বেয়াদপ। কত বড় আস্পর্ধা তার, সুলতানকে কটাক্ষ করে কথা বলে। সুলতানকে হত্যা করতে চায়।’

‘ওর মাথায় পানি ঢালো।’ কয়েকজন মিলিত কণ্ঠে বললো, ‘বেচারা পাগল হয়ে গেছে।’

সুলতান আইয়ুবী দৌঁড়ে বাইরে গেলেন। তিনি মনে করেছিলেন, কোন খৃস্টান কয়েদী হবে। কিন্তু তিনি দেখলেন, এ লোক তারই সেনাবাহিনীর এক কমান্ডার। ওর দুটি হাতই রক্তাক্ত, কাপড়গুলো রক্তে রঞ্জিত। তিনি দেখতে পেলেন, কমান্ডারের চোখ রক্তের মতো লাল। তার ঠোঁটের পাশ দিয়ে জাবরের ফেনা বের হচ্ছে। তাকে কয়েকজন সৈন্য শক্ত করে ধরে রেখেছে, তবুও তাকে কাবু করা যাচ্ছে না।

‘ছেড়ে দাও ওকে।’ সুলতান আইয়ুবী গর্জন করে বললেন।

‘সুলতান! এখানে এসে আপনার সমস্ত সৈন্য লজ্জাবোধ হারিয়ে ফেলেছে। জাতির যে গুরু দায়িত্ব তারা কাঁধে তুলে নিয়েছে সে সম্পর্কে তারা বেখেয়াল হয়ে পড়েছে। নইলে কাফেররা কেমন করে জীবিত ফিরে যায়? আপনি আমাদের সুলতান হয়ে বসে আছেন। এদিকে মুসলমান নারী ও শিশুদের কি অবস্থা আপনি কি দেখেছেন? যারা খৃস্টানদের কাছে বন্দী ছিল শুনেছেন তাদের কান্না? তাহলে কিসের সুলতান আপনি। আপনার কি অধিকার আছে জাতির সুলতান হয়ে বসে থাকার?’

সুলতানের এক রক্ষী ছুটে গিয়ে কমান্ডারের মুখ চেপে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে গেলো কমান্ডারের। কমান্ডার রক্ষীর বাহু ধরে এমন জোরে মাথার উপর তুলে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারলো যে, রক্ষী সুলতান আইয়ুবীর সামনে গিয়ে আছড়ে পড়লো।

‘ওকে বলতে দাও। খবরদার! কেউ ওর কথায় বাঁধা দিতে যেয়ো না।’ সুলতান আইয়ুবী আর একবার গর্জন করে উঠলেন। তারপর কণ্ঠস্বর নরম করে বললেন, ‘সামনে এসো বন্ধু। বলো, কেন এরা তোমাকে ধরে এনেছে?’

এই কমান্ডার উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল এ জন্য যে, খৃস্টানদের হাতে বন্দী মুসলমানদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব পড়েছিল তার উপর। মুক্ত মুসলমানদের খাবার পৌঁছানো, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া এসব কাজে যে শত শত সৈন্য ব্যস্ত ছিল, সে ছিল তেমনি এক বাহিনীর কমান্ডার।

এই কমান্ডার নির্যাতিত মুসলমানদের ঘরে ঘরে গেছে, তাদের মুখ থেকে শুনেছে খৃস্টানদের নির্যাতনের লোমহর্ষক বিবরণ, দেখেছে তাদের অশ্রুভরা বেদনার্ত চোখ। এসব দেখেশুনে এমনিতেই তার মন ছিল বিষন্ন। কষ্টে তার বুকের ভেতর ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তারপর দেখল সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য, যা দেখে তার মাথা খারাপ হয়ে গেল।

সেদিন কমান্ডার তার সৈন্যদের নিয়ে একটি পরিত্যক্ত মসজিদ পরিস্কার করতে গেল। মসজিদে ঢুকেই দেখতে পেলো মসজিদের ভেতর পড়ে আছে দুই মুসলিম মেয়ের উলঙ্গ ও ক্ষতবিক্ষত লাশ। এই বীভৎস দৃশ্য কমান্ডার সইতে পারলো না।

যে সব সৈন্যরা মসজিদ পরিস্কার করছিল, লাশ দুটো বের করার সময় তাদের চোখ অশ্রুতে ভরে উঠলো। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলো, ‘আমাদের বোন ও কন্যাদের যেখানে এমন অবস্থা সেখানে সুলতান কি করে কাফেরদেরকে এখান থেকে নিরাপদে চলে যাওয়ার আদেশ দিতে পারেন? কিসাসের নিয়ম কি পাল্টে গেল? খুনের বদলে খুন করার হক কি আমাদের নেই? তাহলে আমরা কেন খৃস্টানদের নিরাপদে আপনজনদের কাছে চলে যাওয়ার সুযোগ দেবো?’

কমান্ডারের মাথা আগে থেকেই গরম হয়ে ছিল। সৈনিকের এ কথায় তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। চোখ হয়ে উঠলো রক্তাভ। সে সগতোক্তি করে বললো, ‘না, না, এ হতে পারে না। আমরা এর বদলা নেবো। কোন খুনী খৃস্টানকেই এখান থেকে জীবন নিয়ে পালাতে দেবো না। রক্তের বদলে রক্ত চাই।’

সে যখন এসব বলছিল তখন মসজিদের সামনের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল পনেরো বিশজনের একটি ছোট্ট কাফেলা। কাফেলার সবাই মেয়ে। একদল সৈনিক তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সৈনিকদের পাহারায় মেয়েদের এগিয়ে যেতে দেখেই সে বুঝলো, এরা সবাই খৃস্টান মেয়ে। কোন উত্তেজিত মুসলমান যেন তাদের গায়ে হাত তুলতে না পারে সে জন্যই তাদের পাহারা দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

কমান্ডার এগিয়ে গেল কাফেলার দিকে। সৈন্যদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই মেয়েগুলো কারা? তোমরা ওদের পাহারা দিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’

এক মুসলিম কমান্ডার তাদের পথ আগলে দাঁড়ানোয় সৈন্যরা ভাবনায় পড়ে গেল। এ ধরনের প্রশ্নেরও কোন হেতু খুঁজে পেলো না ওরা। ওরা তাকালো কমান্ডারের রক্তচক্ষুর দিকে। এরপর তাকালো ভীতশঙ্কিত মেয়েদের দিকে।

রক্ষীদের একজন কমান্ডারের প্রশ্নের জবাবে বললো, ‘এই মেয়েগুলো খৃস্টান গোয়েন্দা। এরা মিশর ও সিরিয়ায় গাদ্দার ও মুনাফেক সৃষ্টিতে লিপ্ত ছিল। এদেরকে আক্রা থেকে বের করে দেয়ার হুকুম হয়েছে। আমরা ওদের এলাকার সীমানা পার করে দিতে যাচ্ছি।’

কমান্ডার বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কি বলছো তুমি? ওরা গোয়েন্দা জানার পরও তোমরা ওদের ছেড়ে দেবে? তুমি ঠিক জানো, এরা খৃস্টান?’

‘জানবো না কেন? আমাদের রক্ষীরা এদের পাকড়াও করে সুলতানের দরবারে হাজির করেছিল। এদের সরদার হরমনও ধরা পড়েছে এদের সাথে। এরা সবাই খৃস্টান। সুলতান আইয়ুবী এদের নেতা হরমনকে বন্দী করে রেখেছেন। তবে মেয়েদের ব্যাপারে আদেশ দিয়েছেন, তাদেরকে শহর থেকে দূরে কোন খৃস্টান এলাকায় রেখে আসতে। তিনি চান না, এই মেয়েদের কেউ আক্রায় থাকুক।’

‘তোমরা কি তাদেরকে সত্যি জীবিত রেখে আসবে?’ কমান্ডার জিজ্ঞেস করলো।

‘হ্যাঁ, আমাদেরকে তাই আদেশ করা হয়েছে’

‘এরা কি আমাদের সেই বোনদের চেয়ে বেশী পবিত্র ও সম্মানিত, যে বোনদের উপর নির্বিচারে বর্বর অত্যাচার চালানো হয়েছে। যাদেরকে বন্দী করে পশুরা ওদের বিবস্ত্র করেছে, সম্ভ্রম নষ্ট করেছে এবং পরে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে?’

সিপাইটি দুঃখিত স্বরে বললো, ‘এ প্রশ্নের কোন জবাব আমার কাছে নেই আর এটা আমার বিষয়ও নয়। আমি শুধু জানি, আমাকে হুকুম করা হয়েছে ওদের নিরাপদে শহর পার করে দিতে, আমি তাই করছি।’

কমান্ডার সহসা তলোয়ার উন্মুক্ত করে মেয়েদের দিকে ছুটে গেল এবং চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘খোদার কসম, আমি কাউকে ছাড়বো না, আমি কারো হুকুমের গোলাম নই।’

সে তরোয়াল এত দ্রুত চালালো যে চোখের পলকে তিন চার জন মেয়েকে হত্যা করে ফেললো। রক্ষীরা দৌড়ে তাকে বাঁধা দিতে গেল। মেয়েরা চিৎকার করে এদিক ওদিক পালাতে লাগলো। ক্ষিপ্ত কমান্ডার এক মেয়ের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল, এক সৈন্য তাকে বাঁধা দিতে গেল। উন্মত্ত কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গে সে সৈন্যের পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য রক্ষীরা সাবধান হয়ে গেল। তারা কয়েকজন মিলে তাকে ঘিরে ফেললো।

মেয়েরা যে যেদিকে পারে ছুটে পালাচ্ছিল। কয়েকজন রক্ষী ছুটে গিয়ে তাদের তাড়িয়ে এনে আবার একত্রিত করলো। কমান্ডার সৈন্যদের সাথে মোকাবেলা করতে না পেরে একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

কমান্ডারকে হত্যা করা সৈন্যদের উদ্দেশ্য ছিল না, তারা বেহুশ কমান্ডারকে ওভাবে ফেলে রেখে মেয়েদের নিয়ে সরে পড়ল ওখান থেকে।

একটু পর কমান্ডারের হুশ ফিরে এলো। সে তলোয়ার তুলতে গেলে তার এক সৈনিক তা কেড়ে নিতে গেল। কিন্তু সে ক্ষিপ্রগতিতে তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়ে এক দিকে ছুটে পালালো। পাগলের মত সে শহরময় ছুটছিল আর চিৎকার করছিল, ‘আমি বেঈমান নই। কাউকে ক্ষমা করবো না আমি।’

পথে সে আরো কয়েকজন খৃস্টানের ওপর আক্রমণ চালালো। সামনে যাকে পেলো তাকেই হত্যা করলো।

এ অবস্থা দেখে তার সঙ্গী সৈন্যরা জড়ো হয়ে তাকে ঘিরে ফেলে তার কাছ থেকে তলোয়ার কেড়ে নিলো। তারপর তারা তাকে টেনে হিঁচড়ে সুলতান আইয়ুবীর অফিসের দিকে নিয়ে গেল।

সুলতান আইয়ুবী তখন অফিসারদের সাথে যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সুলতানের রক্ষীরা তাকে আটক করলো। সৈন্যদের কাছ থেকে শুনলো, এ লোক আইন লংঘন করেছে। সুলতানের আদেশ অমান্য করেছে। নিরস্ত্রদের ওপর হাত উঠিয়েছে। বিনা কারণে খৃস্টানদের হত্যা করেছে।

তারা ক্ষিপ্ত কমান্ডারকে শান্ত হতে বললো। কিন্তু কমান্ডার তখনো চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘আমি সুলতানকে হত্যা করবো। তোমরা খৃস্টানদের পূজারী। আমাকে ছেড়ে দাও। নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার।’

তার চিৎকার শুনে সুলতান আইয়ুবী বের হয়ে এলেন। তিনি সমস্ত ঘটনা মনযোগ দিয়ে শুনলেন। কমান্ডারের উত্তেজিত গালাগাল ও কথাবার্তা শুনে সবাই ভয় পেয়ে গেল। তারা ভাবছিল, সুলতান তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। যদি মৃত্যুদণ্ড নাও দেন, তাকে যে কারাগারে পাঠাবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি এর কিছুই করলেন না, বরং তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভেতরে চলো।’

তিনি তাকে কামরায় নিয়ে ঠাণ্ডা সরবত পান করতে দিলেন। বললেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য তোমার বুঝতে হবে যুবক। খৃস্টানদের সাথে অহেতুক ঝগড়া করা বা খুন খারাবী করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিলিস্তিন থেকে খৃস্টানদের বিতাড়িত করা, পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করা এবং সমস্ত আরব অঞ্চল থেকে খৃস্টানদের বের করে দিয়ে নির্যাতীত মুসলমানদের উদ্ধার করা। এ কাজ করতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে’

ক্ষিপ্ত কমান্ডারের মাথা তখনও গরম ছিল। সুলতান আইয়ুবী তাকে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

‘সৈন্যদের এত আবেগময় হওয়া উচিত নয়।’ সুলতান আইয়ুবী সেনাপতি ও কমান্ডারদের বললেন, ‘কিন্তু ঈমান আবেগের এই উন্মাদনা দিয়েই দৃঢ় হয়। তবে আবেগকে রাখতে হয় সংযত ও সংহত। তখন তা অপরিসীম শক্তি হিসাবে কাজ করে। আমাদের এই কমান্ডারের আবেগ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেক গুলিয়ে ফেলেছে সে। যদি দ্বীনের শত্রুদের দেখে মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত জযবা সৃষ্টি হয় তবে ইসলামের পতাকা পৃথিবীর শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।’

ক্ষিপ্ত কমান্ডার হরমনের সঙ্গী যে মেয়েদের ওপর আক্রমণ করেছিল হট্টগোলের মধ্যে তাদের দু’জন পালিয়ে গেলো। রক্ষীদের দৃষ্টির আড়ালে গিয়েও তারা উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটলো কিছুক্ষণ। তারপর এক সময় কমিয়ে দিল চলার গতি। হাঁটতে হাঁটতে তারা সমুদ্র উপকূলে গিয়ে পৌঁছলো। কারণ সমুদ্র ওখান থেকে বেশী দূরে ছিল না।

তারা ভয়ে কাঁপছিল আর নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিল। সমুদ্র তীরে একটি পরিত্যক্ত টং দেখে ওরা সেখানেই গিয়ে লুকিয়ে রইলো। শিঘ্রই ওরা দেখতে পেলো এক বিশাল নৌকা কূলে এসে ভিড়ছে। ওরা টংয়ের ভেতর থেকে তাকিয়ে দেখলো নৌকায় মাত্র দু’জন মাল্লা আর একজন আরোহী। পোষাক দেখে মনে হচ্ছে লোকটি নৌবাহিনীর কোন সামরিক অফিসার হবে।

তাদের ধারণা সত্যি ছিল। এ লোক ছিল সুলতান আইয়ুবীর নৌবাহিনীর এক বড় অফিসার। নাম আলফারেস। সুলতান আইয়ুবীর নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন এ্যাডমিরাল আবদাল মুহসিন। ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের হাইকমান্ড ছিলেন এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলু।

সুলতান আইয়ুবীর নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার ছিল আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে। ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরে হেশামুদ্দিন লুলুর নেতৃত্বে নিয়মিত টহল দিত নৌরক্ষীরা। তাদের মূল কাজ ছিল ইউরোপ থেকে খৃস্টানদের কোন সামরিক সাহায্য যেন না আসতে পারে তা নিশ্চিত করা।

সুলতান আইয়ুবী হেশামুদ্দিন লুলুকে লোহিত সাগরের দায়িত্ব দেয়ার সময় বলেছিলেন, ‘লুলু, উপকূল এলাকা যে কোন মূল্যে আমাদের অধিকারে রাখতে হবে। তুমি ছয়টি সামুদ্রিক যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুত অবস্থায় উপকূল এলাকায় সব সময় মজুত রাখবে যাতে কোন খৃস্টান নৌবহর এলে তাদের সময় মতো বাঁধা দিতে পারে’

এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলু প্রখ্যাত নৌকমান্ডার আলফারেসের নেতৃত্বে সঙ্গে সঙ্গে ছয়টি যুদ্ধজাহাজ উপকূল অঞ্চলে পাঠিয়ে দিলেন। একদিন আলফারেস সুলতান আইয়ুবীর খবর পেয়ে জাহাজের বহরটি মাঝ সমুদ্রে রেখে নৌকায় করে উপকূলে নেমে এলেন। উদ্দেশ্য, সুলতান আইয়ুবীর সাথে দেখা করা।

মেয়েরা টংয়ের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। সাগর পাড়ে নেমেই আলফারেস দেখতে পেলেন নির্জন সাগর তীরে দাঁড়িয়ে আছে দুই অনিন্দ্য সুন্দরী।  তাদের পরণে উপজাতীয় যাযাবর কন্যার পোষাক। তারা আলফারেসের পথের ওপর দাঁড়িয়েছিল।

আলফারেস তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। মেয়ে দুটি তখনো ভীতা হরিণীর মতো কাঁপছিল। তাদের চোখে কাতর অনুনয়।

আলফারেস তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কে, এখানে কি করছো?’

মেয়ে দুটি বললো, ‘আমরা মরু কন্যা। যাযাবর পল্লীতে থাকি। খৃস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে যে ভীষণ যুদ্ধ হয় সে যুদ্ধের কবলে পড়ে মারা গেছে আমাদের অধিকাংশ পুরুষ ও নারী। যারা বেঁচে যায় তারা এদিক ওদিক পালিয়ে গেছে। কে কোথায় গেছে আমরা কিছুই জানি না। আমরা দু’জন পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আশ্রয় নিয়েছি নির্জন এই সমুদ্র তীরের ওই টংয়ে।’

‘এখন তো যুদ্ধ শেষ, এবার ফিরে যাও। নিশ্চয়ই গোত্রের কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবে। এখন আর ভয় কি!’

‘ভয়!’ এক মেয়ে বললো, ‘খৃস্টানদের ভয় করি, কারণ তারা আমাদের মনে করে মুসলমান, আর মুসলমানরা আমাদের মনে করে খৃস্টান।’

‘আসলে তোমরা কি? তোমরা কি মুসলমান, না খৃস্টান?’

‘আমাদের তো কোন ধর্ম নেই। যখন যিনি আমাদের প্রভু হন তার ধর্মই আমাদের ধর্ম।’ মেয়েটি বললো, ‘আমাদের গোত্রের নিয়ম হচ্ছে, বয়স হলে উপযুক্ত খরিদ্দার দেখে মেয়েদের কারো না কারো কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top