২৮. রক্তস্রোত

উপস্থিত সবাই ছিলেন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সেনাপতি ও কমান্ডার। এদের মধ্যে ছিলেন সেনাপতি মুজাফফরউদ্দিন। যিনি একজন যোগ্য ও বীর সেনাপতি হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এক সময় তিনি সুলতানের সঙ্গ ছেড়ে তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন এবং সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াইতেও অংশ নিয়েছিলেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার ফিরে এসেছেন সুলতানের বাহিনীতে। এ ছাড়া ছিলেন সেনাপতি তকিউদ্দিন, আফজালউদ্দিন, ফররুখ শাহ এবং মালেক আদিলের মত বীর ও যোগ্য সেনাপতিবৃন্দ। এদের কেউ কেউ ছিলেন সুলতান আইয়ুবীর নিজ বংশের এবং রক্ত সম্বন্ধীয় আত্মীয়। আর ছিলেন সেনাপতি কাকবুরী, যিনি সুলতান আইয়ুবীর দক্ষিন হস্ত রূপে পরিচিত ছিলেন। এদের মধ্যে এমন কেউ ছিল না, যার কৌশল, দক্ষতা ও তেজস্বীতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এমনি একদল সুদক্ষ সেনাপতি নিয়ে সুলতান আইয়ুবী ফিলিস্তিন অভিমুখে অভিযান চালাতে যাচ্ছিলেন। তার চোখের সামনে তখন ভাসছিল মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস, যেখান থেকে আমাদের প্রিয় নবী মেরাজে গমন করেছিলেন।

এ অভিযান ছিল খুবই বিপদসঙ্কুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। ক্রুসেডদের সামরিক শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বই কেবল বেশী ছিল এমন নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিক দিয়েও ক্রুসেড বাহিনী ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে। ক্রুসেডাররা উল্লসিত ছিল এ জন্য যে, তারা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট মজবুত ও সংহত করে নিতে পেরেছে। তারা নিজেদের মাটিতে থেকে যুদ্ধ করবে, ফলে তাদের রসদের ঘাটতি পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তার এলাকা থেকে বহু দূরে যুদ্ধ করতে আসবে। অনেক বাঁধা মাড়িয়ে দীর্ঘ পথ তাদেরকে রসদপত্র বহন করে আনতে হবে।

যুদ্ধের স্বাভাবিক বিবেচনায় সামরিক কৌশলগত দিক থেকেও আক্রান্ত বাহিনীর চাইতে আক্রমণকারী বাহিনী থাকবে বেকায়দায়। এ জন্য আক্রমণকারী সৈন্য সংখ্যা আক্রান্ত বাহিনীর ছয়গুন না হলেও দ্বিগুণ তো অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী দ্বিগুন তো দূরের কথা, সমানও ছিল না। বরং খৃস্টান বাহিনীর চাইতে অনেক কম সৈন্য নিয়েই সুলতানকে যুদ্ধযাত্রা করতে হচ্ছিল।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, এ যুদ্ধ অনেক সময় নেবে। সুলতান পরাজয় মেনে না নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত রাখবেন খৃস্টানদের। আর খৃস্টানরা উন্নত অস্ত্র, বিপুল রসদসম্ভার, অধিক সৈন্য আর আপন ভুবনে যুদ্ধ করার সুবিধার কারণে পরাজয় মেনে না নিয়ে একের পর এক প্রতিহত করে যাবে সুলতানের প্রতিটি আক্রমণ। এই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আইয়ুবীর সৈন্যরা তৈরী হচ্ছিল। তারা ভাবছিল, হয়তো দীর্ঘ দিন আর বাড়ী ফেরা সম্ভব হবে না। হয়তো এ জীবনে আর কোন দিনই বাড়ী ফিরতে পারবে না তারা। কিন্তু তাতে কোন আফসোস ছিল না তাদের।

সুলতান আইয়ুবীও তাদেরকে এ কথাটিই বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি সৈন্য ও সেনাপতিদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, তারেক বিন জিয়াদের ইতিহাস। বলছিলেন, ‘বিজয় ছিনিয়ে আনতে হলে আমাদেরও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সমস্ত নৌযানগুলো আগুন লাগিয়ে পুড়ে ফেলার মত সাহস ও হিম্মত রাখতে হবে। পিছু হটার সব পথ বন্ধ না করলে বিজয় আমাদের পদচুম্বন করবে না। এই অনুভূতি নিয়ে ময়দানে পা বাড়াতে হবে আমাদের, এটাই আমার জীবনের শেষ যাত্রা, আর কোন দিন আমরা কেউ স্বদেশ ও স্বজনদের কাছে ফিরে আসতে পারবো না।’

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘সুলতান আইয়ুবী বিশ্বাস করতেন, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ও দুনিয়ায় আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করা এমন ফরজ, যে দায়িত্ব আল্লাহ তাকে অর্পন করেছেন। আল্লাহ মুসলমানদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যে আদেশ দান করেছেন এটাই তার জীবনের সবচে বড় ফরজ। এ দায়িত্ব দুনিয়ার সকল কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। অধিকাংশ দেশ আল্লাহর আইনের শাসনে আনয়ন করা ও মানব জাতিকে আল্লাহর আনুগত্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করাই একজন মুমিনের প্রকৃত কাজ। তিনি সমস্ত সৈন্য বাহিনীকে একত্রিত করে তাদের মধ্যে এই চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন।

সুলতান আইয়ুবীর অন্তর দৃষ্টি ভবিষ্যতের আলো-অন্ধকার যেন পুরোটাই দেখতে পাচ্ছিলো। সেই আলোকে তিনি হাতিন অঞ্চলকেই আগামী যুদ্ধের মোক্ষম ক্ষেত্র বিবেচনা করলেন।

ফিলিস্তিনের এক অখ্যাত পল্লী ছিল হাতিন। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর সংকল্প ও পরিকল্পনার কারণে এই অঞ্চলটি পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন মহিমা ও ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। খৃস্টান ঐতিহাসিকরা সুলতান আইয়ুবীর চিন্তা ও দূরদর্শিতা দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন। ক্রুসেড বাহিনীর সম্মিলিত শক্তিকে হাতিন অঞ্চলে টেনে আনা, অভাবিত চাল ও রণ কৌশলের মাধ্যমে বিশাল খৃস্টশক্তিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে সুলতান আইয়ুবী নিজেকে এক দিগ্বিজয়ী সেনানায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। খৃস্টান রাজন্যবর্গের সম্মিলিত বাহিনীর মাত্র একটি দল ছাড়া সব কয়টি দল এ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে এবং পরাজিত বাহিনীর অসংখ্য সৈন্য বন্দীত্ব কবুল করে নিজেদের আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হয়।

সামরিক বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিকগণ এ যুদ্ধে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগ এবং তার কমান্ডো বাহিনীর বিস্ময়কর তৎপরতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে বাকার বিন মুহাম্মদ ও কুলসুমের তৎপরতা ছিল অবিস্মরণীয়। বাকার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও প্রয়োজনীয় গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তা সুলতান আইয়ুবীকে পৌঁছে দিয়েছিল। কুলসুম রাজকীয় বিলাসিতা ও সুখের জীবন উপেক্ষা করে আইয়ুবীর সৈন্যদের জন্য গোপন তথ্য সরবরাহ করেছে। তারা এবং তাদের মতো অসংখ্য গোয়েন্দা, যাদের নাম মানুষের দৃষ্টির অন্তরালেই রয়ে গেছে, তাদের ত্যাগ, কোরবানী ও শাহাদাতের বিনিময়ে রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। আল্লাহর রাহে জীবন বিলিয়ে দেয়ার তামান্না নিয়ে যেসব মুজাহিদ হাতিনের ময়দানে রক্ত দিয়েছে তাদের ত্যাগের বিনিময়ে হাতিনের মত নগণ্য গ্রাম ইসলামের ইতিহাসে স্মৃতির নিদর্শন হয়ে আছে।

সুলতান আইয়ুবী সর্বদা জুম্মার দিনে তার অভিযানের সূচনা করতেন। কারণ এ দিনটিকে তিনি আল্লাহর অধিক পছন্দনীয় ও পবিত্র দিন মনে করতেন। এই পবিত্র দিনে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর কাছে নতজানু থাকে। যখন এই দিনে সৈন্যরা অভিযানে বের হয় তখন সমগ্র জাতি আল্লাহর কাছে তাদের সফলতা কামনা করে দোয়া করতে থাকে।

হাতিনের ময়দানে যাওয়ার জন্যও তিনি জুমার দিন বেছে নিলেন। দিনটি ছিল ১১৮৭ সালের ১৫ মার্চ। সুলতান আইয়ুবী তার বিশাল বাহিনীর মাত্র একটি ব্যাটেলিয়ান সঙ্গে নিয়ে ক্রাকের কাছে ক্যাম্প করে বসলেন।

খৃস্টান গোয়েন্দারা দ্রুত এই খবর সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিল। গোয়েন্দারা বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী ক্রাকের কাছে অবস্থান নিয়েছেন। সম্ভবত তিনি ক্রাক শহর অবরোধ করবেন।’

কিন্তু সুলতানের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। এটা ছিল হজ্জের কাফেলা যাতায়াতের সময়। মিশর ও সিরিয়ার হজ্জ কাফেলাগুলো এই পথে যাতায়াত করতো। খৃস্টান দুর্বৃত্তরা এই সব কাফেলায় আক্রমণ চালাতো। এ সব আক্রমণ চালানো হতো ক্রাকের খৃস্টান সরকারের সহায়তায়। ক্রাকের সম্রাট শাহ আরনাত কুখ্যাত লুটেরা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল।

সুলতান আইয়ুবী চাচ্ছিলেন হজ্জ কাফেলাগুলো যেন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে। এ জন্যই তিনি ক্রাকের কাছে গিয়ে অবস্থান নিলেন। তিনি জানতেন, তার এ উদ্দেশ্যের কথা খৃস্টানরা ধারনা করবে না। তারা ভাববে, সুলতান তাদের ওপর আক্রমণ করার জন্যই ওখানে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে মুসলিম কাফেলায় আক্রমণ করার চিন্তা যেমন বাদ দেবে তেমনি আক্রান্ত না হওয়ায় তারা থাকবে অজানা আশঙ্কা ও পেরেশানীতে। এতে দুশমনের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে।

ক্রাকের সন্নিকটে অবস্থান নেয়ায় সুলতানের দুটো উদ্দেশ্যই পূরণ হলো। ক্রুসেড বাহিনী সুলতানের চালাকি বুঝতে পারলো না। তারা ক্রাকের প্রতিরক্ষা জোরদার করার জন্য তাদের বাহিনীকে সদা প্রস্তুত অবস্থায় বসিয়ে রাখলো কেল্লার ভেতর। এদিকে হজ্জ কাফেলাগুলো নির্বিঘ্নে এগিয়ে গেল কাবার দিকে। সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতি ও কমান্ডারদের বুঝিয়ে দিলেন, কাফেলাগুলো চলে গেলে তাদের কি করতে হবে।

সুলতানের ক্রাক অবরোধের ব্যাপারটি ছিল বেশ মজার। একদিন গভীর রাতে ক্রাকের রাজমহলে হঠাৎ যেন ভুকম্পন শুরু হয়ে গেল। শাহ আরনাতকে মাঝরাতে জাগানো হলো। তাকে বলা হলো, সুলতান আইয়ুবী ক্রাক শহর অবরোধ করে বসেছেন। শহর প্রাচীরের বাইরে সুলতানের বিশাল বাহিনী ক্যাম্প করে বসেছে। শাহ আরনাত হতচকিত হয়ে উঠে বসলেন। ভীতচকিত কণ্ঠে বললেন, ‘কি বললে? সুলতান আইয়ুবী শহর অবরোধ করেছেন?’

কুলসুম তখন তার পাশেই ছিল। সে শাহ আরনাতের সাথে দৌড়ে শহরের মেইন গেটে গেল। সেখানে দেয়ালের উপর উঠে দেখলো প্রাচীরের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে শত শত মশাল জ্বলছে। বেশীর ভাগ মশালই নড়াচড়া করছে, অর্থাৎ সেখানে তাবু টানানো হচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঘোড়ার চি হি হি শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

শাহ আরনাত আইয়ুবীর অবরোধ ঠেকাতে শহরের প্রাচীরের উপর সৈন্য সমাবেশ করলেন। শহরের মেইন গেটের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ় করলেন। শাহ আরনাত ছুটাছুটি করে সৈন্যদের নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছিলেন, কুলসুমের দিকে তার কোন খেয়াল ছিল না।

কুলসুম ফিরে গেল মহলে। শাহ আরনাতের রক্ষীরা তার নির্দেশে ছুটাছুটি করছিল। মহলের পাশে দাঁড়িয়েছিল শাহী গাড়ী। এ গাড়ীতে করেই কুলসুম প্রতিদিন ভ্রমণ করতে যায়। গাড়ীর পাশে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাকার বিন মুহাম্মদ। মোট কথা, ক্রাকের রাজমহলের প্রতিটি ব্যক্তিই তখন নিজ নিজ দায়িত্বে তৎপর ছিল।

কুলসুম আদেশের ভঙ্গিতে বললো, ‘সায়বল। গাড়ী এদিকে আনো।’

বাকার যখন গাড়ী আনলো, তখন কুলসুম তার ওপর উঠে বসলো ও গাড়ী একদিকে চালাতে হুকুম দিল। শাহ আরনাতের অন্দর মহলের মেয়েরা সবাই ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। তারা মহলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল রক্ষীদের ছুটাছুটি। হঠাৎ তারা দেখতে পেলো, প্রিন্সেস লিলি গাড়ীতে উঠে গাড়ী চালককে গাড়ী চালাতে হুকুম করছে। তাদের মধ্যে এক মেয়ে রাগে দাঁত পিষে বললো, ‘এ হতভাগী কোন মুসলমানের বেটি, অথচ সে নিজেকে রাজরাণী মনে করে। তাকে শায়েস্তা করতেই হবে।’

‘সময় এসেছে।’ অন্য এক মেয়ে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবীর অবরোধ খুব শক্ত ও ভয়ংকর হয়। তিনি অগ্নিবান নিক্ষেপ করবেন। মেনজানিক দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করবেন। তখন শহরের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে। সে সময় আমরা ওই মুখপোড়া ডাইনীকে শায়েস্তা করতে পারবো। দেখবে দু’দিনেই তার দেমাগ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’

‘তুমি আর বাহাদুরী করো না। তুমি না বলেছিলে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে যে জেনারেল তাকে দিয়ে ঐ মেয়ের দেমাগ ঠাণ্ডা করে দেবে? কই, কিছুই তো করতে পারলে না।’ বললো অন্য আরেক মেয়ে।

‘তিনি সুযোগ করে উঠতে পারেননি। এবার দেখো ঠিকই সুযোগ এসে যাবে।’ আগের মেয়েটি বললো, ‘আগামীকাল সন্ধ্যা নাগাদ শহরের কি অবস্থা হয় দেখে নিও। সম্রাট আর শাহজাদী লিলির দিকে তাকাবারও ফুসরত পাবে না।’

কুলসুম গাড়ী নিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি এক স্থানে পৌঁছলো। গাড়ী দাঁড় করিয়ে সে বাকারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের কোন লোক ভেতর থেকে কি ফটক খোলার ব্যবস্থা করতে পারবে?’

‘সময় মতো চেষ্টা করে দেখা যাবে।’ বাকার বললো, ‘এই সৈন্য বাহিনী আমাদের কিনা তা আমি নিশ্চিত নই। আমি বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে যে, যদি এরা আমাদের বাহিনীই হবে তবে তারা আগে কেন সংবাদ দেয়নি। সুলতান আইয়ুবী তো এমন ভুল করেন না। সকাল হলেই স্পষ্ট জানা যাবে, এ বাহিনী আসলে কার?’

‘যদি এরা সুলতানের বাহিনী হয় তবে কি আমরা এখান থেকে পালাতে পারবো?’ কুলসুম জিজ্ঞেস করলো।

‘সেটা অবস্থার ওপর নির্ভর করবে।’

‘এই বিশৃংখল অবস্থায় আমি আরনাতকে সহজেই হত্যা করতে পারি।’

এমন কাজ খবরদার করবে না।’বাকার বললো, ‘সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করার সময় আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তিনি পালাতে না পারেন।’

‘তাহলে আমি এখন কি করবো? এ অবস্থায় আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই?’

‘আছে। তবে তার আগে দেখতে হবে এটা সুলতানের বাহিনী কিনা? আর শাহ আরনাত কোন দিক থেকে কিভাবে অভিযান চালান তাও আমাদের দেখতে হবে।’

কুলসুম আবেগ ও উত্তেজনায় টগবগ করছিল। ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। তার অস্থিরতা লক্ষ্য করে বাকার বললো, ‘এখন অবস্থা অন্য রকম হয়ে গেছে। আমি খবর পেয়েছিলাম তিনি সৈন্যদের নিয়ে গেলিলি সাগরের দিকে যাবেন। কিন্তু…’

‘কিন্তু তিনি ক্রাক অবরোধ করে ঠিক কাজই করেছেন। এখন আমাদের উচিত তাকে সহায়তা করা।’

‘থামো। এতো উতলা হয়ো না। নিজেকে সংযত করো। কি করতে হবে সময় মতো আমি তোমাকে বলবো। চলো। এখানে আর বেশীক্ষণ দেরী করা ঠিক হচ্ছে না।’ বাকার বললো, ‘চলো ফিরে যাই।’

এই হট্টগোলের মধ্য দিয়েই কেটে গেল রাত। প্রভাতের আলো ফুটতে শুরু করলো পূর্ব দিগন্তে। ক্রাকের প্রাচীরের উপর দূরপাল্লার কামানগুলো অগ্নিবর্ষণ করার জন্য মুখ হা করে বসেছিল। মেনজানিকগুলো প্রস্তুত হয়েছিল পাথর ও অগ্নিবান নিক্ষেপের জন্য। সৈন্যরা প্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল সম্রাট আরনাতের নির্দেশের অপেক্ষায়।

সম্রাট শাহ আরনাত প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলেন সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর দিকে। যখন তিনি দেখতে পেলেন ওখানে মুসলিম বাহিনীর নিশান উড়ছে তখন তিনি নিশ্চিত হলেন এটা সুলতান আইয়ুবীরই বাহিনী। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না, সুলতান আইয়ুবী এই বাহিনীর সাথে আদৌ আছেন কি নেই।

তিনি বাহিনীর সজ্জা দেখে বিস্মিত হলেন। বাহিনীর সজ্জা মোটেও অবরোধের মত নয়। তারা তাবু টানিয়ে ক্যাম্প করেছে ঠিক, কিন্তু সৈন্যরা প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছে। হামলা করার কোন তৎপরতাই তাদের মধ্যে নেই।

সেদিনটি কেটে গেল নির্বিঘ্নে। কোন দিক থেকেই কোন হামলা হলো না। এভাবেই কাটলো আরও পাঁচটি দিন। আরনাতের অপেক্ষা অস্থিরতায় পরিণত হলো। কিন্তু তিনি জানতে পারলেন না, রাতে সুলতান আইয়ুবী অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করে তার বিশ্বস্ত কমান্ডো সৈন্যদের রাস্তায় দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন, যে রাস্তায় হাজীরা যাতায়াত করবে।

কয়েকদিন পর প্রথম কাফেলা আসতে দেখা গেল। এটি ছিল মিশরের কাফেলা। কমান্ডো অশ্বারোহীরা তাদের সাথে মিশে গেল। কাফেলা যখন সুলতান আইয়ুবীর তাবুর কাছে এসে পৌঁছলো, তখন সুলতান আইয়ুবী ছুটে গিয়ে হাজীদের সাথে দেখা ও মুসাফা করলেন। তিনি সম্মানের সাথে সবার হস্তচুম্বন করে হাজীদেরকে তাঁর ক্যাম্পে বিশ্রাম ও আহারের জন্য নিয়ে গেলেন। পরে কমান্ডো বাহিনীর পাহারায় তারা নিরাপদে ক্রাকের সীমানা অতিক্রম করলো। তার একদিন পরেই এলো সিরিয়ার কাফেলা। তাদেরকেও তিনি যথাসাধ্য আদর আপ্যায়ন করলেন। বিশ্রাম ও আহারাদির পর তাদেরও তিনি নিরাপদে ক্রাকের সীমানা পার করে দিলেন।

যে কোন সময় সুলতান আইয়ুবী হামলা করতে পারে এ আশঙ্কা নিয়ে কয়দিন ধরেই ক্রাক শহরের ভেতর খৃস্টান সৈন্যরা টানটান উত্তেজনা নিয়ে প্রস্তুত অবস্থায় অপেক্ষা করছিল। শহরের নাগরিকদের মধ্যে বিরাজ করছিল সীমাহীন ভীতি ও আতংক। সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগ এই অবস্থায়ও সুলতানকে সম্রাট শাহ আরনাতের তৎপরতার খবর সরবরাহ করছিল অত্যন্ত গোপনে ও সুকৌশলে।

একদিন স্কালে সম্রাট আরনাত খবর পেলেন, সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা চলে যাচ্ছে। আরনাত বিস্মিত হয়ে দেখলেন সে দৃশ্য। দুটি হজ্জ কাফেলা সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের পাহারায় বিদায় হয়ে যাওয়া ছাড়া অবরোধকালীন সময়ে আর কোন ঘটনায় ঘটেনি। আরনাত এ রকম অবরোধের কোন কারণ বুঝতে পারলেন না। শুধু সুলতানের গোয়েন্দারাই জানতো আসল ব্যাপার, কিন্তু সে রহস্য জানার কোন উপায় ছিল না আরনাতের।

অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার সময় সুলতান গোয়েন্দাদের জানিয়ে দিলেন সৈন্যদের নিয়ে তিনি কোথায় যাচ্ছেন। গোয়েন্দাদের তিনি বললেন, ‘আমি যখন যেখানেই থাকি না কেন, ক্রাকের অবস্থা ও সম্রাট শাহ আরনাতের গতিবিধি সব সময় আমাকে অবহিত করবে।’

১১৮৭ সালের ২৭ মে সুলতান আইয়ুবী ইশতার নামক স্থানে সৈন্য সমাবেশ করলেন। সেখানে মিশর ও সিরিয়ার সৈন্য বাহিনী গিয়ে সুলতান আইয়ুবীর সাথে মিলিত হলো। সুলতান আইয়ুবীর জ্যৈষ্ঠপুত্র মাত্র ষোল বছরের বালক আল আফজাল তার বাহিনী নিয়ে সুদক্ষ সেনাপতি মুজাফফরউদ্দিনের সাথে মিলিত হলো।

এভাবে সুলতানের সকল সৈন্য একত্রিত হলো ইশতারে। তিনি সমস্ত সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের একত্রিত হওয়ার হুকুম দিলেন। ইশতারের ময়দানে সমবেত হলো সব সেনাপতি ও কমাণ্ডারবৃন্দ। তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে, আমার বন্ধুগণ! আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। অন্তর থেকে প্রিয়জন ও গৃহের কথা ভুলে যাও। অন্তরে শুধু গেঁথে নাও আমাদের প্রথম কেবলা উদ্ধারের কথা। মনে মনে জপতে থাকো সেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাম, যিনি আমাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন প্রথম কেবলা মুক্ত করার। মনে রেখো, আমরা পররাজ্য গ্রাস করতে যাচ্ছি না, আমরা যাচ্ছি আমাদের বোন ও কন্যাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে। কাফেরদের হাতে নির্যাতীত আমাদের ভাইদের উদ্ধার করতে।

এখন আমরা আমাদের স্বপ্ন নিয়ে আর কথা বলবো না, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমরা জানি, আমাদের সৈন্য সংখ্যা শত্রুদের তুলনায় অনেক কম। খৃস্টান সম্রাটরা সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করবে আমাদের। তাদের বাহিনীর সাথে আছে হাজার হাজার নাইট, যাদের আপাদমস্তক লৌহ পোষাকে আবৃত। তাদের আছে উৎকৃষ্ট ঘোড়া ও অস্ত্র। তারা নিজেদের মাটিতে যুদ্ধ করবে বলে পাবে পরিবেশের সুবিধা। তাদের খাদ্য ও রসদপত্রের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু তাদের সাথে নেই আল্লাহর সাহায্য ও মজবুত ঈমানের শক্তি। এই শক্তি নিয়েই আমরা দাঁড়াবো বিশাল প্রতিপক্ষের সামনে। একদিকে সরাসরি শত্রুদের সাথে লড়াই করতে হবে আমাদের, অন্যদিকে দূর করতে হবে পরিবেশের বাঁধা।’

তিনি নকশা টানিয়ে তলোয়ারের মাথা দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে কোথায় কারা অবস্থান নেবে। বলছিলেন কিভাবে কোন পথে তারা পৌঁছবে নির্দিষ্ট জায়গায়। মূল লড়াইয়ের ক্ষেত্রটি দেখে চমকে উঠলেন সেনাপতিরা। তারা বিস্মিত হয়ে তাকালেন সুলতান আইয়ুবীর দিকে। সুলতান আইয়ুবী তাদের বিস্মিত হবার কারণ বুঝে হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এটাই হাতিনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।’

সুলতান আইয়ুবী তাকালেন সেনাপতিদের দিকে। বললেন, ‘তোমরা চিন্তা করছো এ তো এক শুকনো মরুভূমি! গাছের শুকনো ছালের মত কঠিন মাটি। উঁচু নিচু দুর্গম পাথুরে পর্বত। এখন সময়ও খুব খারাপ। প্রকৃতিতে চলছে কাকফাটা খরার মৌসুম। এই শুকনো মাটি মুহূর্তেই চুষে নেবে মানুষ ও পশুর রক্ত। আশপাশের উঁচু নিচু শুষ্ক টিলাগুলো পানির তৃষ্ণায় ভুগছে। রোদে এগুলো লোহার মত উত্তপ্ত হয়ে যায়। তোমরা ভাবছো, কেন আমি যুদ্ধের জন্য এমন কঠিন ময়দান বেছে নিলাম।

এর উত্তর খুব সোজা। খৃস্টান সৈন্যদের মধ্যে এমন কে আছে, যে এই জাহান্নামের এলাকায় যুদ্ধ করতে চাইবে? সে সৈন্য আমাদের আছে। আমাদের হালকা পাতলা সৈন্যরা এখানে ফড়িং-এর মত উড়তে থাকবে, চিতাবাঘের মত লাফাতে থাকবে। আর শত্রুরা? তারা লৌহশিরস্ত্রাণ ও লোহার পোশাক পরে ময়দানে নামবে। তাদের নাইট বাহিনীর জমকালো পোশাকগুলো তাদের টানবে মাটির দিকে। পোশাকের ভারে অল্পতেই তারা হাঁপিয়ে উঠবে।

রোদের তাপে তাদের লোহার পোশাকগুলো যখন আগুনের মতো গরম হয়ে যাবে তখন তার ভেতর তারা সেদ্ধ হয়ে মরবে। তাদের সুসজ্জিত বাহিনী অল্পতেই পিপাসা ও ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়বে। লোহার ভারে তাদের গতি হয়ে পড়বে শ্লথ। তারা তখন চোখে শুধু সর্ষে ফুল দেখতে থাকবে। আর আমাদের জানবাজরা তাদের নাকের ডগা দিয়ে ছুটে বেড়াবে বিদ্যুৎবেগে।

আপনারা জানেন, আমি প্রত্যেক বিশেষ কাজ পবিত্র ও বরকতময় জুমার দিনে শুরু করি। আমরা সেই সময় অগ্রসর হবো যখন সকল মসজিদে আমাদের জন্য দোয়া ও প্রার্থনা শুরু হবে। মসজিদের ইমাম সাহেবানরা আমাদের বিষয়ে মুসল্লীদের সামনে ভাষণ দেবেন। তাদের বক্তৃতায় উদ্বেলিত হয়ে মুসল্লিরা আমাদের সফলতার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রাণ খুলে দোয়া করবে। তাদের সেই দোয়ার বরকতে আমাদের ওপর নেমে আসবে আল্লাহর রহমত।

আজ সেই পবিত্র দিন। আমি প্রত্যেক গ্রাম ও এলাকায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছি, সবাই যেন জুম্মার নামাজের পর মুজাহিদদের সফলতার জন্য দোয়া করে।’

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মানচিত্রের এক জায়গায় তলোয়ালের অগ্রভাগ স্পর্শ করে বললেন, ‘এই দেখো, এটা গ্যালিলি সাগর। এখানে সাগরের সাথে মিশেছে নদী।’ তিনি নকশার ওপর তলোয়ালের অগ্রভাগ সরিয়ে দেখাতে লাগলেন, ‘আর এটা এ অঞ্চলের একমাত্র হ্রদ যেখানে পানি আছে। অবশিষ্ট বিল ঝিলগুলো শুকিয়ে গেছে। এটা সেই মাস, যাকে খৃষ্টানরা জুন মাস বলে। যখন সর্বত্র পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। আমরা থাকব শত্রু ও পানির মাঝামাঝি। আমরা শত্রুদের এই ময়দানে টেনে আনবো এবং তাদেরকে পানি থেকে দূরে রাখবো। তাদেরকে আমরা এমন অবস্থায় ফেলবো যাতে তারা পিপাসায় ছটফট করতে করতে মারা যায়।

আমি জানি, শত্রুরা সমর ক্ষেত্র হিসাবে হাতিনে এসে যুদ্ধ করতে আপত্তি করবে। কিন্তু আমরা তাদের এখানেই যুদ্ধ করাবো। আমাদের সেনাবাহিনীকে আমি চারটি ভাগে ভাগ করেছি। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, সেনাপতি মুজাফফরউদ্দিন ও আমার ছেলে আল আফজাল আমাদের কাছে নেই। তারা বিরাট এক বাহিনী নিয়ে গ্যালিলি সাগরের দক্ষিণে জর্দান নদী পার হয়ে গেছে। এই বাহিনী জাবালুত তাবুর পর্যন্ত পৌঁছবে। হয়তো এতক্ষণে তারা সেখানে পোঁছেও গেছে। এটা একটা ধোঁকা যা আমি শত্রুদের দেখাচ্ছি।’

তিনি সৈন্যদের অবশিষ্ট তিনটি দলকে তাদের অবস্থান ও করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বললেন। এই তিন বাহিনীরই একটি দলকে তিনি নিজের কমান্ডে বেছে নিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে এই দলটি ছিল রিজার্ভ বাহিনী। এটা ছিল একটা চুড়ান্ত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত ছিল।

এই তিনটি বাহিনীই পরিকল্পনা মতো বিভিন্ন স্থান দিয়ে নদী পার হলো। খৃষ্টানরা গোয়েন্দা মারফত সুলতানের এসব বাহিনীর অগ্রগতির সংবাদ নিয়মিতই পাচ্ছিল। কিন্তু তারা জানতে পারলো না, সুলতান আইয়ুবীর প্রকৃত প্ল্যানটি কি? সুলতান আইয়ুবী গ্যালিলি সাগরের পশ্চিম পাড়ে তিববিয়া নামক এক পাহাড়ে আরোহন করলেন।

খৃষ্টানদের জন্য আরও একটি বিপদ ওঁৎ পেতে ছিল। নিয়মিত বাহিনীর চাইতেও সুলতান গোয়েন্দা ও কমাণ্ডোদের বিশেষভাবে কাজে লাগাতেন প্রতিটি যুদ্ধে। সুলতান আইয়ুবীর এসব কমাণ্ডো বাহিনীর অবস্থান ও অগ্রগতি সম্পর্কে মোটেই ধারণা ছিল না খৃষ্টানদের। এই বাহিনীর অল্প সংখ্যক সৈন্য বিশাল বাহিনীর ওপর অতর্কিতে আঘাত হানতো। ‘আঘাত করো আর পালিয়ে যাও’ এই ছিল তাদের যুদ্ধনীতি।

খৃষ্টানরা সুলতানের এই ধরনের যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত ছিল। তাই তাদের অস্তিত্ব টের না পেলেও এ ধরনের যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল।

মুজাফফরউদ্দিন ও আল আফজালের নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা খৃষ্টানদের সেনা ফাঁড়ির ওপর কমাণ্ডো স্টাইলে আঘাত শুরু করলো। তাতে খৃষ্টানদের ধারণা হলো, এরাই সুলতান আইয়ুবী কমাণ্ডো সেনা এবং সুলতান আইয়ুবী এবারও এই বিশেষ ধরনের যুদ্ধই চালাবেন। কিন্তু অচিরেই তারা উপলব্ধি করলো, সুলতান আইয়ুবী কৌশল পাল্টানোয় ওস্তাদ। তার কমাণ্ডো বাহিনী নিত্যনতুন ও অভিনব সব পদ্ধতি ব্যবহার করলো এই যুদ্ধে।

সুলতানের বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য খৃষ্টান সৈন্যরা শহরের বাইরে এসে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী ক্ষিপ্রগতিতে সৈন্য চালনা করলেন। যে পাশে গ্যালিলি সাগর ও পানির উৎস ছিল প্রথমেই তিনি তা দখল করে নিলেন।

খৃষ্টান বাহিনীর একটি দল সিফুরিয়া নামক স্থানে সমবেত হলো। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তাদের দিকে অগ্রসর না হয়ে তিববিয়া শহরের দিকে পিছু হটলেন এবং তিববিয়ার কাছে ক্যাম্প করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।

এর মাধ্যমে তিনি আসলে খৃষ্টানদেরকে হাতিনের ময়দানের দিকে টেনে আনতে চাইলেন। ক্রুসেড বাহিনী তার চাল বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। খৃষ্টানরা অগ্রসর হচ্ছে না দেখে তিনি তার পদাতিক বাহিনীর কিছু সৈন্যকে এগিয়ে গিয়ে হামলা করতে বললেন খৃষ্টান বাহিনীর ওপর। তারা এগিয়ে গেল খৃষ্টান বাহিনীর দিকে। এই অবসরে সুলতান নিজে একটি ক্ষুদ্র অশ্বারোহী দল নিয়ে তিববিয়ার ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালেন। তিনি কমাণ্ডো বাহিনীর একটি দলকে আদেশ দিলেন, ‘তিববিয়াকে ধ্বংস করে দাও, শহরে আগুন ধরিয়ে দাও।’ তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হলো।

তিববিয়ার সেনা ছাউনি ও কেল্লা শহর থেকে সামান্য দূরে ছিল। সেখানে খৃষ্টানদের অল্প সংখ্যক সৈন্যই মজুত ছিল। শহর বাঁচানোর জন্য সৈন্যরা কেল্লা ছেড়ে বাইরে এলো। তারা শহর উদ্ধারে এগিয়ে এলে সুলতান আইয়ুবী তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। শহর রক্ষার আশা ছেড়ে দিয়ে তারা মুখোমুখি হলেন সুলতান আইয়ুবীর।

খৃষ্টানদের যে সৈন্যরা কেল্লা থেকে বেরিয়ে এসেছিল তার কমান্ড করছিলেন সম্রাট রিমান্ড। তিববিয়ার উপত্যকায় সম্রাট রিমান্ড ও সুলতান আইয়ুবীর মধ্যে শুরু হলো সামনাসামনি তুমুল লড়াই।

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার সচক্ষে দেখা যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘দু’দল সৈন্যই অশ্বে আরোহন করে একে অপরের ওপর প্রবল আক্রমণ চালালো। সামনের অশ্বারোহী দল তীর চালিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। তাদের পেছনে অগ্রসর হচ্ছিল পদাতিক বাহিনী। সুলতানের বাহিনী এত তীব্র গতিতে অগ্রসর হলো যে, খৃস্টান বাহিনীর চোখের সামনে ভয়াল মৃত্যু নাচতে লাগলো। মুসলমানদের পিছনে নদী ও সামনে শত্রু, তাই পিছনে সরে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না তাদের। সে রকম কোন ইচ্ছেও ছিল না তাদের। তাই মুসলমানদের অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী মার মার কাট কাট রবে আক্রমণ চালালো। সে আক্রমণের তীব্রতা এত প্রকট ছিল যে তা আমি ভাষায় বর্ণনা করতে অক্ষম।’

দিনভর যুদ্ধ চললো। রাতেও মুসলিম কমান্ডো বাহিনী খৃষ্টানদের অতিষ্ঠ করে রাখলো। খৃষ্টান সৈন্য এবং তাদের ঘোড়াগুলো সারাদিনের যুদ্ধে ছিল পিপাসায় কাতর। কিন্তু পানির উৎস মুসলমানদের অধিকারে থাকায় রাতেও একটু পানি তারা পান করার জন্য পেলো না। খৃষ্টান সৈন্যরা যতোবার পানির কাছে যেতে চেয়েছে ততোবারই সুলতানের কমান্ডো বাহিনী তাদের বাধ্য করেছে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে।

পরের দিন। খৃষ্টান বাহিনী টিকতে না পেরে পেছনের টিলার দিকে সরে গেল। তারা টিলার ওপর উঠে যুদ্ধ করেই বুঝলো, এতক্ষণে তারা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে যেতে পেরেছে। মুসলমান সৈন্যরা তখনো ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুঁড়ছে। তাদের আক্রমণে বিন্দুমাত্র ঢিল পড়েনি। কিন্তু খৃষ্টানরা উঁচুতে থাকায় তারা অধিক সুবিধা পাচ্ছিল।

মুসলমান সৈন্যরা হালকা পোষাকে থাকায় তারা টিলা অবরোধ করে এবার উপরে উঠতে শুরু করলো। তীরন্দাজ বাহিনীর ছত্রছায়ায় পদাতিক বাহিনী টিলার ওপর তরতর করে উঠে যাচ্ছে। তাদের মাথার উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তীরের বন্যা। হঠাৎ ক্রুসেড বাহিনী দেখলো, টিলার ওপর তাদের কমান্ডারের পতাকা দেখা যাচ্ছে না।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top