২৭. ছোট বেগম

ওরা সেখানে পৌছে ঘাসের উপর লুটোপুটি খেল। হাসাহাসি ও খেলাধুলায় মেতে উঠলো।

’এখানে ফেরাউনের রাজকন্যারা খেলা করতো।’ এক মেয়ে বললো।

’আর তোমরা দু’জন যেন নব্য ফেরাউনের কন্যা।’ জোহরা হেসে বললো, ‘তাই তো বলি তোমাদেরকে রাজকন্যার মত লাগছে কেন?’

’তোমার রূপের কাছে আমরা তো নস্যি। অমন ঢলোঢলো অঙ্গ আর যৌবন নিয়ে আমাদের টিটকারী মারছো! আরে, তুমি যদি রাজকন্যা হও তবে বড়জোড় তার প্রেতাত্না হতে পারি।’ চোখ উল্টে বললো অন্য মেয়েটি।

’শোন জোহরা।’ এক মেয়ে তাকে বললো, ’নিশ্চয়ই তুমি জেনেছো, তোমার বৃদ্ধ স্বামী এখানে কেন ‍লুকিয়ে আছে এবং তোমাকেই বা কেন এখানে নিয়ে আসা হয়েছে?’

’সে তো তিনি প্রথম দিনেই জানিয়ে দিয়েছেন।’ জোহরা বললো, ‘আমিও তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এক পায়ে দাড়িয়ে আছি। কিন্তু তিনি কেন যে কাজে নামছেন না!

যখনি আমি তাকে তাড়া দেই, তিনি বলেন, ‘সবুর করো রাণী, কাজটা জটিল। সাবধানে এগুতে হবে। একবার ফেঁসে গেলে সব ভেস্তে যাবে। তখন তুমিও রাণী হতে পারবে না, আমার মাথায়ও রাজমুকুট জুটবে না। তাই ভালোমতো চিন্তা ভাবনা করে আটঁঘাট বেঁধে নামতে হবে।’

তিনি বলেছেন, পরিকল্পনা হয়ে গেছে। এখন আবার পুরো পরিকল্পনাটা খতিয়ে দেখছি কোথাও কোন ত্রুটি রয়ে গেল কিনা? ভেবো না, শিগগিরই কাজে নেমে পড়বো।’

’তাহলে তুমি এটাও জানো, আমরা স্বাধীন মিশরের রাজকুমারী হতে যাচ্ছি?’

’হ্যা। তা তো জানিই।’ জোহরা মুখ ভার করে বললো, ’তোমাদের কপাল ভালো, তোমরা হবে স্বাধীন মিশরের রাজকুমারী। আর আমাকে আমার বুড়োহাবড়া স্বামীর রংমহল আলো করে বসে থাকতে হবে।’

জোহরা মন খারাপ করে বললো, ‘তোমরা বলছো, তোমাদের কথা মত কাজ করলে আমাকে তার বন্ধন থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব? তিনি তো তখন হবেন দেশের সর্বেসর্বা। তার হাত থেকে তোমরা আমাকে কেমন করে রক্ষা করবে?’

’বোকা মেয়ে! এই নিয়ে ভাবছো তুমি? আরে আমরা যদি শাহজাদী হই তুমি আমাদের সাথে থাকবেনা ভাবলে কি করে? বরং তোমার যা রূপ তাতে তোমাকে শাহজাদী বানিয়ে আমরা হবো রাজকন্যার বান্ধবী, কি বলিস রে সই?’ ওদের সম্পর্ক এখন তুই-তোকারী পর্যায়ে নেমে এসেছে। জোহরা বললো, ‘কিন্তু কেমন করে? দেখ, আমাকে খুশী করার জন্য মিছেমিছি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবি না।’

’মিথ্যে গল্প বানাতে যাবো কেন? তাহলে শোন আমরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু ভাবছি, তোকে এখনি বিষয়টা বলা ঠিক হবে কি না? তুই তো আবার বুড়োর খাস প্রেমিকা, যদি মুখ ফসকে তার সামনে বলে ফেলিস?’

’যদি বলেই ফেলি তাহলে তোদের তো কোন ক্ষতি দেখি না। তোরা কি মনে করেছিস আমি এতই বোকা যে, আমার ফাঁসির দড়ি আমিই বাঁধবো? ভয় নেই, আমি অত কাঁচা মেয়ে নই। তোরা কি ভেবেছিস আমাকে খুলে বলতে পারিস।’

’আমরা যা ভেবেছি তা সফল করতে হলে তোকেও কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। প্রয়োজনে কিছুটা নিষ্ঠুরতা দেখাতে হবে। কাউকে হত্যা করতে হলে তখন তো আবার মায়া মমতা এসে তোর হাত খামছে ধরবে না?’

’সেটা সময় হলে দেখতে পারবি।’ জোহরা বললো, ‘আমি এক সৈনিক ‍পরিবারের কন্যা। আমার বাপ সৈনিক, ভাই সৈনিক। তারা আমাকে শিখিয়েছে, উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য কা্উকে খুন করা নিষ্ঠুরতা নয়, বরং ওটা কর্তব্য। আর যে সৈনিক নিজের কর্তব্য ঠিক মতো করে না, সে নিজেই নিজেকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট। আমি এই পৃথিবীতে আরো কিছুদিন বাচঁতে চাই, তাই নিজেকে খুন করার কোন ইচ্ছা আপাততঃ আমার নেই।’

’তাহলে সবুর কর। তোর মুক্তির ব্যবস্থা আমরা অবশ্যই করবো।’

পরের দিনও জোহরা মেয়েদের সাথে নদীর পাড়ে চলে গেল। প্রথমদিন মেয়েরা যে রাস্তায় তাকে নদীর তীরে নিয়ে গিয়েছিল, সে রাস্তাটি ছিল প্রাকৃতিক, বহু পুরানো এবং খুবই সংকীর্ণ।

অনেক কাল সে পথে লোক চলাচল করে না বলে রাস্তার চিহ্ন জায়গায় জায়গায় মুছে গিয়েছিল। এমন গোপন পথ সহজে কারো পক্ষে খুজে পাওয়া যেমন কষ্টকর তেমনি একবারের যাতায়াতে তা মনে রাখাও সহজসাধ্য ছিল না। পথটি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেছে। ঝোপঁঝাড় ও লতাপাতায় হারিয়ে গেছে পথের নিশানা।

জোহরা সে পথটি মনের আয়নায় গেথে নিতে চাচ্ছিল। তাই সে ‍দ্বিতীয় দিনের মত সে পথে তাদের নিয়ে নদী দেখতে এলো। এসে বুঝলো, একা এলে সে কিছুতেই রাস্তা খুজে নদী পর্যন্ত পৌছঁতে পারতো না।

নদী তীরে পৌছেঁ জোহরা তাদের বললো, ‘চলো নৌকায় চড়ে নদী ভ্রমণ করি।’

মেয়েরা তাকে বাঁধা দিয়ে বললো, ‘মেয়েদের একা নৌকায় চড়া বারণ আছে। এখানে কোন পুরুষ নেই যে কোন দুর্ঘটনায় পড়লে তারা এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে।’

ফলে জোহরার নৌকায় চড়া হলো না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল, মেয়েরা বললো, ‘চল ফিরে যাই।’

হাবিবুল কুদ্দুসের উপর এখন আর আগের মত নিষেধাজ্ঞা জারী নেই। তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন, তিনি এখন স্বাধীন মিশরের প্রত্যাশী এবং ‍সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর গদি দখল করতে বদ্ধপরিকর।

খৃষ্টান লোকটি বিদ্রোহের সময় নিয়ে কথা বলতে এলে তিনি বললেন, ‘চাঁদের দিকে খেয়াল রেখো। অমাবশ্যার রাতে বিদ্রোহ ঘটবে। এর তিন দিন আগে তুমি জোহরাকে নিয়ে কায়রো যাবে। তবে কায়রো ঢুকবে রাতের বেলা। আর জোহরাকে ছদ্মবেশে সজিয়ে নেবে।

জোহরাকে বলে দেবো সে কেমন করে আমার লোকদের সাথে দেখা করবে এবং তাদেরকে তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমি কয়েকজন অফিসারের নামে চিঠি দেবো। তুমি সেই চিঠি দেখিয়ে বাকী কাজ তাদের পরামর্শ মত আঞ্জাম দেবে।’

এরপর থেকে সেই লোক আর তার সাথে বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করে না। তবে জোহরার সঙ্গে এ নিয়ে সেনাপতির আলোচনা হয় গভীর রাতে, খুবই গোপনে ও নিচুঁ কন্ঠে, যাতে তাদের এ আলোচনা আর কারো কানে না যায়।

দুদিন পরের কথা। ধ্বংসস্তুপের গোপন মহলে হাবিবুল কুদ্দুসের কক্ষে আরো দু’জন নতুন লোক এলো। তাদের একজন ‍সুদানী ও অপরজন মিশরী। তারা হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে সাক্ষাত করে বললো, ‘বিদ্রোহের ব্যাপারে আপনার সাথে কিছু আলাপ করতে চাই।’

তিনি লোক দু’জনকে চিনলেন না, তবে অনুমান করলেন তারা সামরিক বিশেষজ্ঞ। তাদের কাছে মিশর, সুদার ও আরবের ম্যাপ ছিল এবং কিছু কাগজপএও ছিল। তারা সেই ম্যাপ মেলে ধরে হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে দীর্ঘ সময় নিয়ে বিদ্রোহের বিষয়ে শলাপরামর্শ করলো।

হাবিবুল কুদ্দুস এ ব্যাপারে শুধু আগ্রহই প্রকাশ করলেন না, বরং তাদেরকে এমন সব পরামর্শও দিলেন, যা তারা চিন্তাও করেনি।

তারা হাবিবুল কুদ্দুসের আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে সুলতান আইয়ুবীর কয়েকজন সেনাপতি ও কমান্ডারের নাম বললো, যারা মিশরের সেনাবাহিনীতে থাকলেও গোপনে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ছিল। তারা জানালো, ‘এরা আমাদের সাথে আছে। আপনি অভিযানের সময় যে কোন ব্যাপারে এদের ওপর নির্ভর করতে পারবেন।’

হাবিবুল কুদ্দুসের কাছে এ তথ্যটুকুর মূল্য ছিল অনেক। তিনি চিন্তা করে পেলেন না, আলী বিন সুফিয়ানের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এরা কি করে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার সাহস পেলো।

তারা হাবিবুল কুদ্দুস কে আরো জানালো, মিশর সীমান্তে মিশরের যে সীমান্ত রক্ষীবাহিনী আছে সেখানেও আমরা ফাঁক খুজে পেয়েছি। সময় মত ওখানেও আমাদের লোকজন সক্রিয় হয়ে উঠবে। আপনি শুনে খুশি হবেন, সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর একটি ফাড়ির সৈন্যদের সেদিন এমন নির্দেশ দেয়া হবে যাতে তারা অন্যএ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এক ফাঁকে সুদানের কিছু সৈন্য ভেতরে প্রবেশ করবে এবং তারা আপনাকে সম্ভাব্য সাহায্য সহযোগিতা করবে।’

’বিদ্রোহ সফল হওয়ার পর মিশরের শাসক কে হবেন?’ হাবিবুল কুদ্দস জিজ্ঞেস করলেন।

’এ ব্যাপারে আমরা আলাপ আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, যেহেতু প্রধান সেনাপতি আপনি থাকবেন এবং আপনার নেতৃত্বেই এই বিপ্লব সাধিত হবে সে জন্য আমীরও আপনিই হবেন।’ মিশরের লোকটি বললো।

সে আরো বললো, ‘সালাউদ্দিন আইয়ুবী অবশ্যই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন। প্রথম ধাক্কায় ক্ষমতা দখল করতে না পারলে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সে জন্য এমন একজনের নামে এই স্বাধীনতার ডাক দিতে হবে যার প্রতি সেনাবাহিনী ও জনগন আস্থাশীল হতে পারে।

আমরা গভীর পর্যালোচনা করে সবাই এ ব্যাপারে একমত হয়েছি, মিশরে এ ক্ষেত্রে আপনার কোনো বিকল্প নেই। তাই আমরা সবাই চাই, আমাদের প্রথম আমীর আপনিই থাকবেন।’

’যুদ্ধকালীন অবস্থায় কোনো বেসামরিক লোককে গদীতে বসানো ঠিক নয়। তাই আপনার ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি।’ বন্ধুর কথার সূএ ধরে বললো সুদানী লোকটি।

এ কথা শুনে হাবিবুল কুদ্দুসের বুক ফুলে উঠলো এবং বলিষ্ঠ প্রত্যয় নিয়ে তিনি ঘাড় সোজা করে বসলেন।

’আশা করি এ ব্যাপারে আপনার কোন আপওি থাকবে না। খৃষ্টানরা আইয়ুবীর চির শএ্রু। সেই হিসাবে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যারাই দাড়ায় তাদেরকে তারা সাহায্য করে কোন শর্ত ছাড়াই। আমরা খৃষ্টানদের সাথেও যোগাযোগ করেছি। তারাও আমাদের সাহায্য করবে বলে ওয়াদা করেছে।’ সুদানী বললো।

’বিনিময়ে ওরা কি মূল্য নেবে?’ হাবিবুল কুদ্দুস প্রশ্ন করলেন।

’বিনিময়ে ওরা কিছুই চায় না। আমরা সম্মিলিত ভাবে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মিশরের স্বাধীন করলেই ওরা খুশী।’ মিশরের লোকটি বললো, ‘তারা মিশর চায় না, চায় মিশরকে ঘাটি বানিয়ে আইয়ুবী যে ফিলিস্তিন দখলের পাঁয়তারা কষছে তার হাত থেকে রক্ষা পেতে। আমরা যে পরিমাণ সাহায্য চাইবো তাই নিয়ে তারা মিশর ছুটে আসতে প্রস্তুত। তবে তাদের সাথে কথা হয়েছে, মিশরের বিদ্রোহ সফল হলে অর্থাৎ মিশর আইয়ুবীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে গেলে তারা ফিরে যাবে।

তাদের বলা হয়েছে, যদি তারা মিশরের উপর সামরিক অভিযান চালানোর চিন্তা মাথায় নিয়ে আসে তবে মিশরের সৈন্যরা তা বরদাশত করবে না। এমনটি করলে মিশরের সৈন্যরা আইয়ুবীর সাথে মিলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।’

সব শুনে হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘প্রস্তুতি মোটামুটি ভালই মনে হচ্ছে। এখন বাকী কাজ সুচারু রূপে সমাধা হলেই হয়।’

হাবিবুল কুদ্দুস তাদের দু’জনকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আমার অধীনে যে সাত হাজার সৈন্য আছে তারা আমার ইশারায় যে কোন সময় জীবনবাজি রাখতে প্রস্তুত। সময়মত বিদ্রোহের সূচনা তারাই করবে। আমাদের যারা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত তাদের সাথে কিভাবে সমন্বয় করা যায় এখন সেটাই ঠিক করা দরকার।’

’হ্যা, এটা করতে হলে আগে ‍সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার আপনি কোথায় থেকে এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবেন এবং কি পদ্ধতিতে বিদ্রোহ পরিচালনা করবেন?’

’সবচেয়ে উওম হতো যদি আমি সশরীরে ফিরে গিয়ে সরাসরি নেতৃত্ব হাতে নিতে পারতাম।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেনম, ‘কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, আমার সেখানে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ আমাকে পেলেই প্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো, এতদিন আমি কোথায় ছিলাম?

স্ত্রীর মাধ্যমে আমি জানতে পেরেছি, আমি যে স্বেচ্ছায় শত্রুদের দলে চলে গেছি এ কথা আলী বিন সুফিয়ান গিয়াস বিলবিসকে রিপোর্ট করেছেন। ফলে কায়রো গেলে তারা আমাকে বন্দী করে ফেলবে। তাতে আমাদের খেলা শুরু হওয়ার আগেই সব পন্ড হয়ে যাবে।

আমি আসলে একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছি। আমার স্ত্রীকে এখানে ডেকে আনা ঠিক হয়নি। যদি সবার এরকম সহযোগিতা পাবো জানতাম তবে তাকে ডেকে আনতাম না। এখন তাকে ফেরত পাঠালে তার সঙ্গেও ভাল ব্যবহার করা হবে না। সে জন্য আমাকে এখানেই থাকতে হবে।

তোমরা যে তথ্য দিলে তাতে আমাকে নতুন করে একটু চিন্তা করতে দাও। তোমাদের সাথে কোন কোন কমান্ডারকে ভিড়িয়ে দিলে ভালো হবে ভেবে দেখি।’

হাবিবুল কুদ্দুসের এ আলোচনা শোনার পর তার ব্যাপারে আর কারো কোন সন্দেহ রইল না যে তিনি অচিরেই বিদ্রোহ করবেন।

’হলবের অবরোধ কোন খেল তামাশার ব্যাপার নয়।’ সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী ফোরাত কূলে বসে তার সেনাপতিদের বললেন, ‘তোমাদের সকলেরই মনে থাকার কথা, আমরা আগেও একবার এ শহর অবরোধ করতে গিয়ে হলবের বাসিন্দাদের দিয়ে প্রচন্ড বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছিলাম। শেষে বাধ্য হয়ে আমাদের অবরোধ উঠাতে হয়েছিল। সেটা হলবের বাসিন্দাদের বীরত্ব। তারা আমাদের ফিরে আসতে বাধ্য করেছিল।

এখন আর সে অবস্থা নেই, তবুও আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এখান থেকে যাদের সৈন্য দলে ভর্তি করা হয়েছে তাদের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা যায় না। মিশর থেকে সামরিক রসদ ও সাহায্য চাইতে হবে। ভাবছিলাম হাবিবুল কুদ্দুসের বাহিনীই নিয়ে আসবো।’

এই কথা বলে সুলতান আইয়ুবী নিরব হয়ে গেলেন। তার চেহারার রঙ পাল্টে গেল। তিনি ধীরস্থির কন্ঠে বললেন, ‘আমি মেনে নিতে পারছি না, হাবিবুল কুদ্দুসের মত বিশ্বস্ত সেনাপতি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তবে সে গেল কোথায়?

আমি যখন মিশর থেকে যাএা করলাম তখন সে আমাকে বলেছিল, ‘আপনি মিশরের চিন্তা মন থেকে দূর করুন। খৃষ্টান ও সুদানীরা যদি আপনার অনুপস্থিতিতে মিশরে আক্রমণ চালায় তবে আমার তিন হাজার পদাতিক ও দুই হাজার অশ্বারোহী বাহিনীই তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে।’

সে আরো বলেছিল, ‘আর ‍যদি কেউ মিশরে বিদ্রোহ করে তবে তার মাথা আর দেহের সাথে থাকবে না। আমরা আল্লাহর সৈনিক, কিন্তু সে আল্লাহর দুশমন।’

’মনে হয় তার এ সব গুণ লক্ষ্য করে শত্রুরা তাকে অপহরণ করেছে।’ এক সেনাপতি বললো, ‘কারন তার সৈন্যদের উপর তার গভীর প্রভাব রয়েছে। এই কারণে তিনি নিজেকে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে করেন। শত্রুরা আমাদেরকে সেই শক্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে।’

’যদি তাকে পাওয়া না যায় তবে তার বাহিনীকেই আমি এখানে নিয়ে আসবো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাদের নিয়ে আসা সম্ভব না। কারণ মিশরের প্রতিরক্ষা তাতে দূর্বল হয়ে পড়বে। সেখানে নতুন ফৌজ পাঠাতে হবে।

কিন্তু ভয় ও আশংকার কারণ হচ্ছে এটাই যে, বাইরের আক্রমণের চেয়ে ভেতরে কেউ বিদ্রোহ করে বসে কিনা। কারণ অচেনা বেঈমান গাদ্দারের দল ভেতরে বসে আছে। তারাই তো ফিলিস্তিনকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।’

সুলতান যখন ফোরাতের কূলে বসে এই আলাপ করছিলেন, সুলতানের বিশ্বস্ত সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস তখন কায়রো থেকে দূরে পাহাড় ঘেরা এক ভয়ংকর স্থানে পুরাতন মহলের ধ্বংসস্তুপের এক কামরায় বসে মিশরে বিদ্রোহ ঘটানোর পরিকল্পনা করছিলেন।

পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে সেই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে সে রাতে তারা আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠছিল। যদি বাইরের কেউ সে সময় সেখানে আসতো তবে তারা ভয়ে পালিয়ে যেতো। তারা ভাবতো, জ্বীন পরীরা সেখানে আনন্দ নৃত্য করছে। যে সুন্দরী মেয়েরা নাচছিল তাদের কেউ মানুষ না ভেবে ভাবতো পরী।

ওখানে মানুষ ছিল মাএ আটজন। হাবিবল কুদ্দুস ও এক খৃষ্টান তো প্রথম দিন থেকেই ছিল। আর ছিল দুই রূপসী ও এক পাহারাদার। মিশরী ও সুদানী দু’জন যোগ দিলে তাদের সংখ্যা দাড়ায় সাত-এ। আর আছে হাবিবুল কুদ্দুসের স্ত্রী জোহরা।

বিদ্রোহের নীল নকশা ও পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। হবিবুল কুদ্দুস ও জোহরা সবার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সেখানে কেউ শএু নেই। ফলে সেখানে পাহারায় সতর্কতারও কোন প্রয়োজন বোধ করলো না কেউ।

তাদের একজনকে হাবিবুল কুদ্দুস শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু এটা তখনকার ঘটনা যখন হাবিবুল কুদ্দুস তাদের পরিকল্পনা জানতেন না। এখন আর সেখানে পাহারার প্রয়োজন ছিল না, কারণ এই সেনাপতি এখন তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু। তাঁকে তারা গোপনে পরীক্ষা করে দেখেছে, বিদ্রোহের ব্যাপারে তিনি সত্যি দৃঢ়সংকল্প।

রাতে পুরো দলটিই আনন্দে মেতে উঠলো। একেবারে উৎসবের আমেজ। রাজকীয় খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে সবার জন্য। মদের পাএ গুলো হাতে হাতে ফিরছে। দুই মেয়ে প্রাণ খুলে নাচছে, গাইছে।

হাবিবুল কুদ্দুসও উৎসবে শরীক হয়েছেন। তার সামনে তুলে ধরা হলো সুরার পাএ। তিনি অবজ্ঞা ভরে ফিরিয়ে ‍দিলেন সে পাএ। এ নিয়ে আর জোরাজুরি করলো না কেউ।

উৎসবে হাজির জোহরাও। মেয়েরা হাতে তুলে নিল সুরাপাএ। পানপাএ তুলে দেয়া হলো জোহরার হাতেও। সে হাত পেতে তা গ্রহণ করলো কিন্তু পান না করে কৌশলে তা ফেলে দিল সবার অলক্ষে।

খৃষ্টান লোকটি মিশর ও সুদান থেকে আগত লোক দু’জনের সাথে কথা বলছিল। সুদানী বললো, ‘জোহরা মেয়েটাকে বলে দাও, ও যেন খুব সতর্কতার সাথে হাবিবুল কুদ্দুসের দিকে নজর রাখে। নইলে যে কোন সময় মত বদলে ফেলতে পারে সেনাপতি।’

জোহরা অন্য মেয়েদের মতো নির্লজ্জ আচরণ না করলেও আনন্দ উৎসবে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছে যাতে তার ব্যাপারে কারো মনে কোন সন্দেহ সৃষ্টি না হয়।

মধ্যরাত পর্যন্ত সবাই এ আনন্দ মাহফিলে কাটিয়ে দিল। মদের নেশায় যখন চোখগুলো ঢুলুঢুলু তখন একে একে উঠতে শুরু করলো জলসা থেকে।

মিশরী ও সুদানী দু’জন চলে গেল তাদের কামরায়। মেয়েরাও নিজেদের কামরার দিকে পা বাড়াল। কেউ কেউ নেশায় বেহুশ হয়ে ওখানেই পড়ে রইলো। জোহরা হাবিবুল কুদ্দুসকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো।

তিনিও সেখান থেকে উঠে গেলেন। জোহরা সেখান থেকে বেরিয়ে মেয়েদের কামরার দিকে গেল। কামরা খালি, দু্’জনের কেউ কামরায় নেই।

জোহরা মিশরী ও সুদানী লোক দু’জন যেখানে থাকে সেখানে গেল। কামরা ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে নারী ও পুরুষের জড়িত কন্ঠ। সমস্ত পরিবেশটাই বেহুশ মাতালদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।

জোহরা জানতো এই দুস্কৃতকারীদের অস্ত্রসস্ত্র কোথায় থাকে। সে একটি বর্শা, একটি তলোয়ার, দুটি ধনুক ও ব্যাগ ভর্তি তীর উঠিয়ে নিল।

হাবিবুল কুদ্দুস তার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল নির্দিষ্ট জায়গায়। জোহরা সেখানে পৌছলে তিনি জোহরার হাত থেকে তলোয়ারটি নিয়ে নিলেন। একটি ধনুক ও তীর কোষ নিজে কাধেঁ নিয়ে অপর ধনুক ও তীর কোষ জোহরার কাধে লটকে দিলেন। বর্শাটা জোহরার হাতেই রইলো।

’চলো এদেরকে হত্যা করে ফেলি।’ জোহরা হাবিবুল কুদ্দুসকে বললো।

’না, এখন এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেড়িয়ে যাওয়া উচিত।’ তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে নদী পর্যন্ত নিয়ে যাও।’

জোহরা নদী পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা ভাল করে দেখে রেখেছিল। ‍যদি এ রাস্তা তার দেখা না থাকতো তবে তাদের পক্ষে সেখান থেকে বের হওয়া সম্ভব হতো বলে মনে হয় না।

জোহরা আগে, হাবিবুল কুদ্দুস তার গা ঘেঁষে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছিল নদীর দিকে। তাদের কান দুটো বনের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছিল। হাবিবুল কুদ্দুস তার তলোয়ার খাপে না ভরে হাতে নিয়ে এগুচ্ছিল। জোহরা এগুচ্ছিল তার হাতের বর্শা বাগিয়ে।

জোহরা তার স্বামীকে নৌকা পর্যন্ত নিয়ে গেলো। নৌকাটি পাহাড়ের আড়ালে নালার খানিকটা ভেতরে যেখানে পানি জলাশয়ের রূপ নিয়েছিল সেখানে বাধা ছিল।

দু’জনেই নৌকা খুলে শান্তভাবে তাতে চড়ে বসলো। তারা অতি ধীরে ধীরে বৈঠা মারতে লাগলো যেন শব্দ না হয়। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের কাটছিল ভয় ও আতঙ্ক এর মধ্যে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি টের পেয়ে গেল ষড়যন্ত্রকারীরা। এই বুঝি অদৃশ্য থেকে ছুটে এলো কোন তীর।

কিন্তু না, সব আশঙ্কাকে ভিওিহীন ও অমূলক প্রমাণ করে নৌকা পাহাড়ের সংকীর্ণ নালা বেয়ে নদীর দিকে এগিয়ে চললো।

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top