২৭. ছোট বেগম

স্থলপথে যারা যাতায়াত করে তারাও এড়িয়ে চলে জায়গাটি। মানুষ জন সেখান থেকে বহু দূর ‍দিয়ে আপন গন্তব্যে এগিয়ে যায়। কেউ ভুলেও সেই ধ্বংসাবশেষের ‍দিকে পা বাড়ায় না।

এক লোক বললো, ’আমার এখন মনে হচ্ছে, তার মাথাটা যেন আমার হাতে এসে গেছে।’

অন্যজন বললো, ‘যদি না আসে তবে এখান থেকে তাকেও আর জীবিত বের হতে হবে না।’

’আমরা তাকে এ জন্য এখানে ধরে আনিনি যে, তাকে এখানেই হত্যা করবো।’

অপরজনকে উদ্দেশ্য করে আগের জন বললো, ‘যদি হত্যা করাই আমার উদ্দেশ্য হতো তবে তাকে বাড়ী থেকে উঠিয়ে আনার পর এত দূর ‍নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিল? তাকে তো আমরা পথেই হত্যা করতে পারতাম। তাকে আমাদের কাজের জন্য তৈরী করতে হবে। এখানে তাকে আনা হয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য।’

’হাশিশের ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।’ সঙ্গের লোকটি বললো।

’হ্যা, হাশিশ। এই হাশিশই এখন একজন পাক্কা মুসলমানকে গাদ্দার বানিয়ে দেবে। তুমি কাউকে নেশা পান করিয়ে তার সঙ্গে এমন কথা বলতে পারো, যা জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন কোন ব্যক্তির সাথে বলা সম্ভব নয়। হাশিশ ও নেশা দিয়ে তুমি কারো ঈমান ও মতাদর্শ পরিবর্তন করতে পার।

এ ব্যক্তি আইয়ুবীর বিশাল সামরিক শক্তির অধিকারী। আমার শুধু তাকে প্রয়োজন নয়, তার পুরো বাহিনীটিই দরকার। একটি সুশিক্ষিত বাহিনীর সাত হাজার সৈন্য কোন চাট্টিখানি কথা নয়। তার এই পুরো বাহিনীই আমার নিয়ন্ত্রনে দরকার।

তাদের দিয়ে আমি মিশরের বিরুদ্ধে করাবো। আইয়ুবীর বাহিনী লড়বে আইয়ুবীর বাহিনীর বিরুদ্ধে। অবশেষে মিশর একদিন আমাদের হবে। সালাউদ্দিন আইয়ুবীর অবস্থা হবে এমন, যেন খাঁচায় বন্দী বাঘ। অথবা অসংখ্য শিকারীর ঘেরে আটকে যাওয়া সিংহ।

তিনি ঘর কেটে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এই ঘর ফেঁড়ে ফুঁড়ে বের হওয়ার জন্য লম্ফঝম্ফ করবেন। কিন্তু তার ভাগ্যে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।

যদি সুলতান আইয়ুবীর এই সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস তার বাহিনীকে সামান্য ইঙ্গিত দেয়, তবে তারা কোন ‍কিছু চিন্তা না করেই তার আদেশ মান্য করবে। সেনাবাহিনীতে তার যে প্রভাব সেই প্রভাব আমরা এবার ব্যবহার করবো আমাদের স্বার্থে।’

হবিবুল কুদ্দুস ফেরাউনের মহলের সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এক বিরাট কামরায় বসে ছিলেন। কামরাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বাসের উপযোগী করা হয়েছে। সেখানে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে আরামদায়ক নরম গদি। সেই সাথে দেয়া হয়েছে বালিশ ও কুশন। কামরাটি সাজানো হয়েছে একজন বিলাসী মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে।

হাবিবুল কুদ্দুসের সামনে এসে এক লোক বসলো। লোকটির চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। সে হাবিবুল কুদ্দুসের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘মিশর আমার দেশ। সালাউদ্দীন আইয়ুবী ইরাকী এবং কুর্দি। তিনি এসে আমার দেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছেন। তিনি আমার দেশের সুন্দরী নারীদের নিয়ে তার অন্দরমহলের হেরেম পূর্ণ করছেন। দেশের এ অপমান আমরা কতদিন সইবো?’

আমদের কাছে সাত হাজার নিবেদিত প্রাণ সৈনিক রয়েছে। আমরা কি পারি না এই সৈন্য নিয়ে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে? আপনি কি মনে করেন আমাদের সৈন্যরা ভীরু কাপুরুষ? তারা আইয়ুবীকে ভয় পায়? লড়াই বাধলে তারা ময়দান থেকে পিঠ টান দেবে?’

হাবিবুল কুদ্দুসের চোখে সুদূরের হাতছানি। তিনি যেন দেখতে পাচ্ছেন তার বাহিনী আইয়ুবীর সৈন্যদের দলিত মথিত করার জন্য তার একটু ইশারার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছে।

লোকটির কথা শেষ হলে হাবিবুল কুদ্দুস মুখে মুচকি হাসি নিয়ে তার দিকে তাকালেন। সে চেহারায় খেলা করছে প্রফু্ল্লতা। তিনি বিড় বিড় করে বললেন, ‘কখনোই না। আমি আমার বাহিনীকে তেমন শিক্ষা দেইনি। তারা লড়াকু। তারা সাহসী। তারা কুশলী। আমার সামান্য ইশারায় তারা জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত।

আমার তলোয়ার কোথায়? তুমি আমার অশ্ব সাজিয়ে দাও। আমিই সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করবো। আমার সাত হাজার জানবাজ সৈন্য একদিনেই মিশরের বাহিনীকে পরাজিত করে তাদেরকে মিশরের মাটি থেকে হটিয়ে দিতে পারবে।’

’খৃষ্টানরা আমাদের বন্ধু’। লোকটি তার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘বন্ধু তো তাকেই বলে যে বিপদের সময় সাহায্য করে। তারা বলেছে, আমাদের এই দুর্দিনে তারা সাহায্য করবে। আমরা ডাকলেই তারা চলে আসবে।’

’ডাকো তাদের। বিপদে যে পাশে দাড়ায় তার মতো বন্ধু আর কে আছে? আমার বন্ধুদের ডাকো। আমার তলোয়ার দাও।’

হাবিবুল কুদ্দুস স্পষ্ট স্বরে ‍যুদ্ধের উন্মাদনা প্রকাশ করতে লাগলেন।

’আপনি মহান সেনাপতি। মিশরবাসী তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। আপনি মিশরবাসীকে বিদেশী শাসকের হাত থেকে উদ্ধার করুন। মিশরবাসী আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে।’

’হ্যা আমি তাই করবো। আইয়ুবীর কবল থেকে রক্ষা করবো আমার দেশবাসীকে। তোমরা কোন চিন্তা করো না। হায় মিশর! কি সুন্দর এই দেশ। এই দেশের আকাশ সুন্দর। প্রকৃতি সুন্দর। মানুষ সুন্দর। সুন্দর এ দেশের মেয়েরা। মিশর আমার। আমিই তাকে মুক্ত করবো। আইয়ুবীকে হত্যা করবো আমি।’ একটি মেয়ে এসে ঢুকলো কামরায়। তার পরণে হাল্কা পোষাক। মাথায় মসৃণ খোলা এলোচুল। উজ্জল গোলাপী তার গায়ের রং। দেহে লাবন্যের ছটা। খাপখোলা তলোয়ারের মত ঝকমক করছে তার উন্মুক্ত ফর্সা বাহুদ্বয়।

মেয়েটি হাবিবুল কুদ্দুসের পাশ ঘেঁষে বসলো। তার কোমল বাহু ‍দিয়ে জড়িয়ে ধরলো হাবিবুল কুদ্দুসের কাঁধ। বললো, ‘কতদিন ধরে আমরা মুক্তির প্রহর গুনছি। আমাদের কোন নেতা ছিল না। আমাদের কোন সেনাপতি ছিল না। আমরা ভাবতাম, কবে আসবে সেই রাজপুএ, যে আমাদের মুক্তি দেবে অসুর দানবের হাত থেকে?’

হাবিবুল কুদ্দুস মেয়েটির নরম চুলে তার গাল ঘষতে ঘষতে বললো, ‘আমিই সেই রাজপুএ। দানবের হাত থেকে আমিই মিশরকে মুক্ত করবো।’

সে তার নেশাগ্রস্ত কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘ভেবো না সুন্দরী, তুমি পাশে থাকলে মিশরকে আমি বেহেশত বানিয়ে দিব।’

মেয়েটি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একদিকে সরে গিয়ে বললো, ‘কবে? কবে তুমি মিশরকে বেহেশত বানাবে? এদিকে আমরা যে সুলতান আইয়ুবীর অত্যাচারে অসহায়, অতিষ্ঠ।’

হাবিবুল কুদ্দুস থাবা মেরে তার বাহু ধরে কাছে টেনে বললো, ‘তোমার উপরে কেউ অধিকার বিস্তার করতে পারবে না। তুমি অসহায় নও। আমি আছি তোমার সাথে। তুমি আমার। মিশর আমার।’

’যতদিন সালাউদ্দিন আইয়ুবী মিশরের উপর কর্তৃত্ব করবে ততদিন না আমি তোমার, না মিশর তোমার।’

’আমি তাকে হত্যা করবো।’ হাবিবুল কুদ্দুস দৃঢ়তার সাথে বললো, ‘আমি তাকে হত্যা করবোই।’

’থামো!’ এক কঠিন ও গম্ভীর আওয়াজ শোনা গেল, ‘আইয়ুবীকে হত্যা করবো বললেই তাকে হত্যা করা যায় না। তাকে হত্যা করতে হলে চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা।’

এই আওয়াজ সেই ব্যক্তির, যে ধ্বংসপ্রাসাদের ভেতর বসে বলেছিল, ‘এখন আমার বিশ্বাস হচ্ছে, তাদের পরিকল্পনা আমাদের হাতে এসে গেছে।’

লোকটি কামরায় প্রবেশ করে কামরার পুরুষ লোকটিকে বললো, ‘তুমি আমার সাথে বাইরে এসো আর মেয়েটিকে তার সাথেই থাকতে দাও।’

ওরা বাইরে এলে আগন্তুক খৃষ্টান লোকটি বললো, ’তাকে হাশিশ ছাড়াই নিয়ন্ত্রন করতে হবে এবং আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এ পর্যন্ত তোমরা তাকে যে পরিমান হশিশ খাইয়েছো তাতে তার শুধু মন-মগজই ধোলাই হয়নি, সে নিজেও ধোলাই হয়ে গেছে। দেখছো না, সে কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে?’

যে লোকটি হবিবুল কুদ্দসের দেমাগ ধোলাই করতে তাকে নেশা ও হাশিশ পান করাচ্ছিল তাকে ধমক দিয়ে খৃষ্টানটি আরো বললো, ‘তুমি ফেদাইন নেতা হাসান বিন সাবাহর শিক্ষা কতটা রপ্ত করতে পেরেছো? শুধু হাশিশ পান করানো ও গোপনে হত্যা কারা ছাড়া কি আর কিছুই জানো না তুমি? কি করে একজনের মগজ ধোলাইয়ের পর কাজে লাগাতে হয় তা আমার কাছ থেকে শিখে নাও। মেয়েটা এখন তার পাশেই থাকুক। তুমি এদিকে আসো, বসো আমার পাশে।’

ওরা এক জায়গায় গিয়ে পড়ে থাকা এক গাছের গুড়ির ওপর বসলো। খৃষ্টানটি তাকে বললো, ‘এখন তাকে আর হাশিশ পান করাবো না। তার নেশার উন্মাদনা শেষ হতে দাও। ওকে দিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করানো শুধু নয়, তার বাহিনী ‍দিয়ে আইয়ুবীর বাহিনীতে বিদ্রোহ করাতে হবে।

আমি অনেক দেরীতে এখানে পৌছেছি, নইলে তার এ অবস্থা করতে দিতাম না। স্বজ্ঞানে রেখে তাকে সালাউদ্দিন আইয়ুবীর শএু বানাতে হবে।

তোমরা তাকে অপহরণ করে আনতে পেরেছো এ জন্য তোমাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি তোমাদের সাহসিকতা ও কৌশলের প্রশংসা করি। আর এ জন্য তোমাদের এতো অধিক মূল্য দেবো যা তোমরা এর আগে কোথাও পাওনি।

আমার শুধু আফসোস, তোমরা তাকে হাশিশ পান করিয়ে অসম্ভব দুর্বল করে ফেলেছো। এতে আমার কাজের অসুবিধা হবে। এখন তাকে সেই সরবত ও গুড়ো ঔষধ পান করাও, যাতে তার নেশা ছুটে যায়।’

খৃষ্টানরা গোয়েন্দাগিরী ও সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতায় আনাড়ী ছিল না। আইয়ুবী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম শাসকদের আনুগত্য আদায়ের দিকে মনোযোগ দিলে এ ক্ষেত্রে তারা আরো সুযোগ পেয়ে যায়। তারা আইয়ুবীর বাহিনীর কৌশল ও দক্ষতা সম্পর্কে যেমন অবগত ছিল তেমনি জানতো সাধারণ মুসলমান ও আমীর ওমরাদের স্বভাব দুর্বলতা ও চাহিদা সম্পর্কে।

তারা তাদের দৃষ্টি সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর উপর যেমন নিবদ্ধ রেখেছিল তেমনি বিভিন্ন ছোটো রাজ্যের মুসলিম শাসকদের এুটিগুলো সম্পর্কেও সজাগ ছিল। তারা এইসব শাসকদেরকে তাদের ষড়যন্ত্র ও লোভের শিকার বানানোর প্রচেষ্টায় আরো কুশলী হলো, যেন সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকে।

এইসব খৃষ্টানদের সার্বিক সহযোগিতা ‍দিয়ে যাচ্ছিল ইহুদী জাতি। তারা তাদের অঢেল অর্থ ও সুন্দরী মেয়েদেরকে এ কাজের জন্য প্রশিক্ষন দিয়ে যাচ্ছিল। ইহুদী বিশেষজ্ঞরা বুদ্ধি, পরিকল্পনা, অর্থ ও মেয়ে দিয়ে খৃষ্টানদের অপূর্ণতা পূর্ণ করে ‍দিচ্ছিল।

মুসলমান শাসক গোষ্ঠীকে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত করে নিল। এক দলের পিছনে লেলিয়ে ‍দিল সুন্দরী মেয়েদের। তারা তাদের যৌবন, মদ ও সম্পদের বিনিময়ে তাদের ঈমান কিনে নিচ্ছিল।

অপর দলটিকে উস্কানী দিচ্ছিল তাদের পৃথক রাজ্য গঠনের জন্য। তাদের মনে জাগিয়ে তুলছিল স্বাধীন থাকার বাসনা ও শাসক হওয়ার স্বপ্ন।

আর তৃতীয় দল ছিল যারা দেশ ও জাতির স্বার্থে নিবেদিতপ্রান ও খাঁটি মুসলমান। এদেরকে কোন প্রলোভনে জড়ানো যাবে না ভেবে ওদের নামে নানা মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো, যাতে জনগনের কাছে তারা ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়। দ্বিতীয় পথ হিসাবে তারা বেছে নিয়েছিল গুপ্তহত্যা, অপহরণ এইসব অন্তর্ঘাতমূলক কাজ।

সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর মধ্যে কারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, যাদেরকে ছলে বলে কৌশলে নমনীয় করা সম্ভব তাদেরও একটি তালিকা করে নিয়েছিল তারা। আরেক দলকে তারা কপট বিপ্লবী বানিয়ে ভিড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছিল সুলতানের দলে।

তাদের কাজ ছিল সুলতানের গোপন পলিসি সম্পর্কে অবগত হয়ে সে ব্যাপারে খৃষ্টানদের সতর্ক ও সজাগ করা। সুযোগ পেলে অতি বিপ্লবী আচরণের মাধ্যমে সৈন্যদের বিভ্রান্ত করে তাদেরকে খৃষ্টানদের পাতা ফাঁদে ফেলে দেয়া।

এসব কাজ তারা চালিয়ে যাচ্ছিল পরিকল্পনা মতো এবং বিরামহীনভাবে। শেষোক্ত দলের কিছু সদস্য বিশ্বস্ততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সেনা বিভাগের উপর মহলেও আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছিল। তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মুসলিম সৈন্যদের ‍দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করানোর চেষ্টা করছিল।

যদিও অপহরন ও হত্যার পরিকল্পনা তাদের ছিল কিন্তু বাস্তবে তার দৃষ্টান্ত খুবই কম ছিল। এ কাজের জন্য তারা ব্যবহার করতো হাসান বিন সাবাহর পেশাদার ভাড়াটিয়া খুনীদের।

সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস এমন সামরিক অফিসার ছিলেন যাকে প্রলোভন বা ভীতির মাধ্যমে কব্জা করা সম্ভব ছিল না। অথচ তাকে হত্যা করার চেয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে তাদের লাভ হবে প্রচুর।

খৃষ্টানরা ভেবে দেখলো, তাকে হত্যা করলে সে একা নিহত হবে, আর যদি তাকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায় তবে মিশরের সেনাবহিনীর সাত হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্যকে কাজে লাগানো যাবে তাদের নিজেদের বাহিনীর বিরুদ্ধে। এই সাত হাজার সৈন্য যে সাফল্য বয়ে আনতে পারবে খৃষ্টানদের পঞ্চাশ হাজার সৈন্য ‍দিয়েও তা সম্ভব নয়, এটা তারা ভালো করেই জানতো।

খৃষ্টান গোয়েন্দাদের রিপোর্ট হচ্ছে, ’এ ব্যক্তি ঈমান বিক্রি করার লোক নয়। এ লোক জীবন দেবে কিন্তু আপোষ করবে না, বশও মানবে না। তার ঈমান এত মজবুত, জেহাদী জোশ এত তীব্র যে, যদি তার নেতৃত্বে তার বাহিনীকে এক লাখ সৈন্যের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে বলা হয়, তবে সন্ধার সূর্য যত তাড়াতাড়ি আসে তারচেয়েও তাড়াতাড়ি তার সামনে শত্রুর লাশের পাহাড় জমে যাবে।’

সুলতান আইয়ুবী যেভাবে মুসলিম রাজ্যগুলোর আনুগত্য আদায় করে নিচ্ছে তাতে খৃষ্টানরা প্রমোদ গুনলো। তারা ভেবে দেখলো, যদি সুলতান আইয়ুবীর দৃষ্টি অন্য দিকে ‍ফেরানো না যায় তবে তার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ফিলিস্তিন।

এ সময় তাকে পেছনে টেনে আনার একটাই উপায়, মিশরে বিদ্রোহ ঘটানো। কাকে দিয়ে এ কাজ করানো যায় তার অনুসন্ধানে লেগে গেল তারা। এ জন্য তারা কয়েকজন সেনাপতিকে টার্গেট করলো।

যুবতী ও অসাধারণ সুন্দরী মেয়েদেরকে অসহায় ও মজলুমের ছদ্মবেশে সাহায্যের নাম করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিল। আবার কোন সুন্দরীকে পাঠালো তার নিজস্ব প্রয়োজনের উছিলায়। সুন্দরী মেয়েদের অনুষ্ঠানে তাদের দাওয়াত পাঠালো। কিন্তু কিছুতেই তাদের কাউকে জালে আটকাতে পারলো না মেয়েরা। যেন এসব অফিসাররা মানুষ নয়, এক একটা পাথর। কিন্তু মিশরে একটি বিদ্রোহ ঘটানো না গেলে আইয়ুবীর অগ্রযাএা প্রতিহত করার কোন উপায় নেই।

খৃষ্টানরা এবার মরিয়া হয়ে উঠলো। এখনি একটা বিদ্রোহ ঘটাতে না পারলে সুলতান আইয়ুবী আরব সিরিয়া ও ফিলিস্তিন অঞ্চলের একচ্ছএ অধিপতি হয়ে বসবে। এরই মধ্যে অধিকাংশ মুসলিম শাসক তার তলোয়ারের ঝলক দেখে তার বশ্যতা মেনে নিয়েছে। এখন যে কোন মুহূর্তে তিনি বায়তুল মোকাদ্দসের পথ ধরতে পারেন।

ইতিপূর্বে খৃষ্টানরা সুদানীদেরকে মিশর বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তাদের উস্কানীতে সুদানী বাহিনী মিশর আক্রমনও করেছিল, কিন্তু সুদানী সেনাবাহিনীতে অধিকাংশ ছিল সেখানকার হাবশী সেনা। হাবশীরা সাধারণত আত্মপূজারী হয়। ফলে জীবনের মায়া তাদের বেশী।

তাদের ব্যর্থতার দ্বিতীয় কারন ছিল, তারা দল বেঁধে যুদ্ধ করে এবং দল বেঁধেই পলায়ন করে। প্রতিরোধের তীব্রতা দেখে একজন যেই পালাতে গেল, দলে হলে তার পিছু নিল অন্যরা। তাই খৃষ্টানরা তাদেরকে মিশরের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে সুবিধা করতে পারেনি।

অতীত অভিজ্ঞতার কারনে খৃষ্টানরা মিশরের সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহ করানো ছাড়া বিকল্প কিছু চিন্তা করতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত তারা এই বিদ্রোহের জন্য বেছে নিল সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দসকে।

তারা জানে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। কিভাবে হাবিবুল কুদ্দুসকে হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় সে উপায় খুঁজতে গিয়ে অবশেষে খৃষ্টান গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা তাকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নিল। এ কাজের দায়িত্ব ‍দিল হত্যা ও অপহরণে পারদর্শী পেশাদার খুনীচক্র হাসান বিন সাবাহর ফেদাইন দলকে। তাদের চাহিদা মতো মূল্য দিয়েই হবিবুল কুদ্দুসকে হাতে পেতে রাজি হল খৃষ্টানরা।

ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা পাকা করে এক সন্ধায় দুই লোক তাঁর বাড়ী গেল। তারা একটি গ্রামের নাম নিয়ে বললো, ‘সেখানকার মসজিদের ছাদ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পুরো মসজিদটা মেরামত বা পুননির্মাণ করতে হবে। সন্ধার পর সেখানে গ্রামের লোকেরা সমবেত হবে। আপনি সেখানে চলুন যাতে সকলেই মুক্ত মনে মসজিদে দান করার উৎসাহ পায়।’

আগত দুই ব্যক্তিকে বেশভূষায় মসজিদের ইমাম ও খাদেম মনে হচ্ছিল। তিনি ইতস্তত করলে তারা মসজিদ নির্মাণ ও মেরামতে সহযোগিতা করলে ইহ ও পরকালে কি সওয়াব ও কল্যাণ পাওয়া যাবে তার এক আবেগময় বক্তৃতা দিয়ে ফেলল তার সামনে। তিনি এই দুই বুজুর্গের আবদার ফেলতে না পেরে অনিচ্ছাসও্বেও রাজি হলেন।

তারা যখন শহরের বাইরে এলো তখন আরো চার ব্যক্তি এসে যোগ দিল তাদের সাথে। চেহারা সুরতে তাদেরও আলেম বলে মনে হচ্ছিল। সবাই গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চললো মসজিদের ‍দিকে।

রাতের অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছিল প্রকৃতি। তারা এক পুরাতন ও বিধ্বস্ত মহলের কাছাকাছি চলে এলো। এলাকাটা ছিল নির্জন। রাতের অন্ধকারে ছয়জন তাকে জাপটে ধরলো। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন তার নাকে চেপে ধরলো একটি ভেজা রুমাল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞান হারান।

তারা তাকে ধরাধরি করে সেই বিধ্বস্ত নির্জন কামরায় নিয়ে গেল। তারপর যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন একজন বললো, ’এখন কেমন বোধ করছেন? এ ঔষধটুকু খেয়ে নিন, ভালো হয়ে যাবেন’।

এভাবে ছলনার আশ্রয় নিয়ে তাকে প্রথম ডোজ হাশিশ পান করানো হলো। নেশার রাজ্যে ডুবে গেলেন তিনি।

সেই রাতেই তাকে নিয়ে আসা হলো এই নির্জন পরিত্যক্ত শহরে। এখানে আগে থেকেই ফেদাইনরা তাদের ঘাঁটি বানিয়ে নিয়েছিল। নিরাপদ ঘাঁটিতে এনে অপহরণকারীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

ফেদাইন নেতা এখানে তাকে ক্রমাগত হাশিশ পান করাতে লাগলো। নেশার ঘোরে চলছিল তাকে সম্মোহিত করার প্রচেষ্টা। এই বিরান কামরায় তার আরাম আয়েশের দিকেও ছিল ছিনতাইকারীদের পূর্ণ মনযোগ।

বিলাসিতার যাবতীয় সামগ্রী এনে জমা করেছিল তার জন্য। তার সেবার জন্য ছিল দুইজন যুবতী মেয়ে। তারা শুধু সুন্দরী ছিল না, মানুষের মন ভুলিয়ে তাদের মধ্যে পশু স্বভাব জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও তারা ছিল সমান পারদর্শী।

তারা জানতো, এই সেনাপতিকে কেন এখানে ধরে আনা হয়েছে। তারা পুরস্কারের আশায় নিজে থেকেই তার মন মগজ ধোলাই করার কাজে লেগে গেল।

মানুষকে হাশিশ পান করিয়ে সম্মোহিত করার বিশেষ পদ্ধতি আছে। হাশিশ পরিবেশনেরও বিশেষ মাএা আছে। তারা নিয়ম মাফিক সেই প্রক্রিয়ায় তাকে হাশিশ পান করাতো এবং চেতনার একটি বিশেষ অবস্থানে এলে তার উপর প্রয়োগ করতো সম্মোহন বিদ্যা।

তার চেতনা যখন উপলব্ধি করার পর্যায়ে এসে পৌঁছতো তখন আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথার যাদু দিয়ে তার মাথার মধ্যে এক নতুন ধারনা সৃষ্টি করা হতো। একেই বলে হিপনোটিজম।

অর্ধ উলঙ্গ সুন্দরী মেয়েরা এ সময় তার সামনে নাচতো। এক ইন্দ্রজালিক আবহ তৈরী করা হতো ঘরের মধ্যে। নতুন এক দুনিয়ায় পদার্পন ঘটতো সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির।

কয়েকদিন ধরে হাবিবুল কুদ্দুসের উপর এই প্রক্রিয়া চালানোর পর দেখা গেল তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। তারা তার মধ্যে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো। তাদের সাথে কাজে নেমে পড়লো ফেদাইন নেতা। সে হাবিবুল কুদ্দুসকে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলতে লাগলো।

কয়েকদিন পর তারা ধরে নিল, তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। হাবিবুল কুদ্দুসের চিন্তা চেতনা কব্জা করে নিতে পেরেছে তারা।

ওদিকে মিশরের গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশের গোয়েন্দারা অধীরভাবে ছুটাছুটি করছিল তার সন্ধানে। তাদের কারো কারো ধারণা, তিনি হয়তো সুদানী বা খৃষ্টানদের কাছে চলে গেছেন।

আলী বিন সুফিয়ান তাকে অপহরণ করা হয়েছে এমন সন্দেহ পোষণ করলেও তার কোন প্রমান তার কাছে নেই। তাই তিনিও ধরে নিলেন, ‍তিনি হয় অপহৃত হয়েছেন নয়তো নিজেই দল বদল করে চলে গেছেন দুশমন শিবিরে।

কিন্তু যখনি তার মানসপটে ভেসে উঠতো দ্বীনের প্রতি হাবিবুল কুদ্দুসের অনুরাগ, জেহাদের ব্যাপারে তার নিষ্ঠা ও তৎপরতা, তখনি তিনি কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে যেতেন।

সেনাবাহিনীর এমন একজন বিশ্বস্ত গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তার কোন সন্ধান অবশ্যই পেয়ে যাবেন। গোয়েন্দারা তাঁর খোঁজে চারদিকে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। কিন্তু যতই সময় গড়াচ্ছিল ততোই এটা বুঝা যাচ্ছিল যে, মিশরের মাটিতে তার আশা করা বৃথা।

আলী এটাও গভীরভাবে লক্ষ্য রাখছিলেন, আইয়ুবীর সেনাদলের আর কোন কমান্ডার বা অফিসার নিখোঁজ হয় কিনা? কিন্তু এতদিনেও এ ধরনের আর কোন ঘটনা ঘটেনি।

খৃষ্টান নেতা হাবিবুল কুদ্দুসের সেই বিরান কামরায় ফিরে এলো। এসেই খবর নিল তাকে হাশিশের ক্রিয়া নষ্টকারী ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে কিনা?

মেয়েটি জানালো, তাকে সে ঔষধ সেবন করানো হয়েছে। লোকটি হাবিবুল কুদ্দুসের নেশা ছুটে যাওয়ার অপেক্ষায় সেখানে বসে রইলো।

রাত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাবিবুল কুদ্দুসের নেশার ঘোর কাটছিল না। খৃষ্টান নেতা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে তার নেশার ঘোর কাটার অপেক্ষা করলো। রাত অধিক হয়ে যাওয়ায় শেষে সে শুতে চলে গেল। যাওয়ার সময় মেয়েদের বলে গেল, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে তাকে যেন খবর দেয়া হয়।

পরের দিন। হাবিবুল কুদ্দুসের পাশে এসে বসলো খৃষ্টান নেতা। তিনি তখনও নেশার ঘোরে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছেন। খৃষ্টান নেতা চিন্তায় পড়ে গেল। সে ফেদাইন নেতাকে অতিরিক্ত হাশিশ পান করানোর জন্য গালাগালি করে মনের ঝাল ঝাড়তে লাগল।

ফেদাইন নেতা কাচুমাচু হয়ে বললো, ‘আমার কি দোষ? একজন সেনাপতি যে এত দুর্বল তা আমি কেমন করে জানবো?’

অনেক বেলায় ঘুম ভাঙলো হাবিবুল কুদ্দুসের। তিনি চোখ খুলে এুদিক ওদিক দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলেন। যখন তার দৃষ্টি খৃষ্টান নেতার উপর পড়লো সঙ্গে সঙ্গে তিনি উঠে বসলেন এবং গভীরভাবে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।

’আমার বড়ই দুঃখ যে, এই লোকেরা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে।’ খৃষ্টান নেতা বললো, ‘আপনি বেশী অধীর ও বিস্মিত হবেন না। এই হতভাগারা আপনাকে হাশিশ পান করাচ্ছিল এবং আপনাকে মজার মজার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।

আপনি ফেদাইনদের কার্যকলাপ ও হাশিশের ক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চয় অবগত আছেন? ফেদাইনরা মুক্তিপণের লোভে আপনাকে অপহরণ করেছিল। খবরটা জানতে পেরেই আমি ছুটে এসেছি।

এখন থেকে আপনি আর নিজেকে বন্দী মনে করবেন না। আমি তাদের পাওনা মিটিয়ে দেবো এবং আপনার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবো। আগে জানতে পারলে আপনার ওপর যে অত্যাচার হয়েছে সেটুকুও করতে ‍দিতাম না।’

’এই লোকেরা আমাকে ধোঁকা ‍দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘এরা সম্ভবত আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছিল।’

তিনি দৃষ্টি ঘুরিয়ে চারদিকে দেখলেন এবং বিস্ময়ের সাথে বললেন, ‘সেই জায়গাটা খুব সুন্দর ছিল। কে আমাকে এখানে এনেছে?’

’আপনি নিজেকে সজাগ করুন।’ খৃষ্টান নেতা বললো, ’আগে যা দেখেছেন সেটা হাশিশের প্রভাব। আপনি প্রথম থেকেই এখানে আছেন।’

’আপনি বলছেন আমাকে ছিনতাই করা হয়েছিল এবং ছিনতাই করেছিল ফেদাইনরা।’ হাবিবুল কুদ্দুস সত্য উদঘাটনের জন্য গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কে?’

’আমি আপনার এক মুসলমান ভাই।’ খৃষ্টান লোকটি বললো, ‘আমি আপনার কাছ থেকে কিছু চাই না, বরং আপনাকে কিছু ‍দিতে চাই।’

’যদি আমি দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করি?’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন।

’তবে আপনি এখান থেকে কোনদিনই জীবিত বেরোতে পারবেন না।’ খৃষ্টানটি তাকে বললো, ‘আপনি কায়রো থেকে এত দূরে যে, যদি আপনাকে মুক্তি দেয়া হয় তবুও আপনি রাস্তাতেই মারা যাবেন।’

’সেই মৃত্যুই তো আমি চাই। তাতেই আমার জীবন ধন্য হবে।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘কিন্তু আমি শএু ‍শিবিরে বন্দী অবস্থায় মরতে চাই না।’

’আপনি বন্দী নন আর আমিও আপনার শএু নই।’ খৃষ্টানটি বললো, ‘এই শয়তানেরা আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আপনার মনে অহেতুক ভয় ও সন্দেহ ঢুকিয়ে ‍দিয়েছে।

আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন, আপনাকে অপহরণ করেছে ফেদাইনরা। আর আপনি ভাল করেই জানেন ফেদাইনরা পেশাদার খুনি ও সন্ত্রাসী। আপনাকে অপহরণ করার উদ্দেশ্য কিছু মুক্তিপণ আদায় করা। এরাও আপনার দুশমন নয়, আমি তো নই-ই। আপনার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা ছিল।’

’সে কথা বলার জন্য আমাকে ছিনতাই করে এত দূরে নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিল?’

’আমি ছিনতাই করিনি বরং ছিনতাইকারীদের থেকে আপনাকে মুক্ত করতে এসেছি।’

’কেন আপনি আমাকে মুক্ত করবেন? তাতে আপনার লাভ?’

’লাভ তো অবশ্যই কিছু আছে। সে কথাই আপনাকে বলতে চাই। সে জন্যই তো আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’

’তাতে বুঝা যাচ্ছে, অপহরণকারীরা জানতো আমাকে তোমার দরকার। তাই তারা অপহরণ করে তোমাকে খবর দিয়েছে। তাতে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে, তুমিই তাদের দিয়ে আমাকে অপহরণ করিয়েছো?’

’যদি আপনি এমনটি মনে করেন তাতেও আমার করার কিছু নেই। সত্যি আপনাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন। আমার বুকে এমন কিছু কথা আছে যা আপনার বুকে দেয়া দরকার।’

’সে কথা তুমি আমাকে কায়রোতেও বলতে পারতে!’

’যদি আমি সে কথা কায়রোতে আপনার সঙ্গে বলতাম তবে দু’জনেই কায়রোর কারাগারে বন্দী থাকতাম।’ খৃষ্টান বললো, ‘কারণ সেখানে আলী বিন সুফিয়ান ও পুলিশ সুপার গিয়াস বিলকিসের গোয়েন্দারা দ্বারে দ্বারে ও পদে পদে তল্লাশী চালাচ্ছে।’

হাবিবুল কুদ্দুসের চেতনা ও জ্ঞান সম্পূর্ণ ফিরে এসেছিল। তাঁর মস্তিষ্ক নেশার ঘোর থেকে মুক্ত হয়ে আবার স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি এখন খৃষ্টান দৃর্বওদের হাতে পড়ে কোন দুর্গম স্থানে অবস্থান করছেন। তিনি গলার স্বর ও ভঙ্গি পাল্টে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি ক্রুসেডার, নাকি সুদানী?’

’আমি মিশরের লোক।’ লোকটি উওর দিল, ‘আর আপনিও মিশরী। আপনি ইরাকী, সিরিয়ান বা আরবী নন। মিশর মিশরীয়দের। এটা নূরুদ্দীন জঙ্গী বা সালাউদ্দীন আইয়ুবীর বংশগত জায়গীরদারী নয়। এটা ইসলামী রাজ্য, এখানে আল্লাহর শাসন থাকবে। তবে তার দায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং শাসনকার্য পরিচালনা করবে মিশরীয় মুসলমানরা। আপনি কি মনে করেন, মিশরের উপর শাসন চালানোর জন্য বাগদাদ বা দামেশক থেকে লোক আমদানী করতে হবে?

সালাউদ্দীন আইয়ুবী নিজে ইরাকী, শাসক হয়েছেন মিশরের। এখন সিরিয়ার সাথে তাকে যুক্ত করে নিজের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাচ্ছেন।’

’তুমি কি মিশরকে সালাউদ্দীন আইয়ুবীকে পয়গম্বর মনে করেন না। তবে তাকে আপনি নিজের মুরশিদ বা নেতা মনে করেন।’ খৃষ্টান লোকটি বললো, ‘আমি তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলবো না। কারন সুলতান আইয়ুবীর মধ্যে অনেক ভাল গুন আছে। আমিও তাঁকে আপনার মতই যোগ্য মনে করি।

কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হবে, তিনি আর কতকাল জীবিত থাকবেন? তাঁর পরে তাঁর সন্তান বা ভাইয়ের হাতে শাসন ক্ষমতা যাবে। তারা তো আর সালাউদ্দীন আইয়ুবীর মত হবে না, তখন মিশরের ক্ষমতা চলে যাবে আরেক ফেরাউনের হাতে।’

’আমাকে দিয়ে তুমি কি কাজ উদ্ধার করতে চাও?’

’যদি আপনি আমার কথা বুঝে থাকেন তবে আমি আপনাকে বলবো, আপনি কি করতে পারেন।’ খৃ্ষ্টান লোকটি বললো, ‘যদি আপনার মনে আমার সম্পর্কে সন্দেহ থাকে তবে তা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। প্রথমে আপনার মনের সন্দেহ দূর হওয়া দরকার। আপনি ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে নিন।’

লোকটি বললো, ‘আপনি এইমাএ জেগেছেন। ফেদাইন হতভাগাদের দেয়া হাশিশের ক্রিয়া এখনও আপনার উপরে কাজ করছে। আগে আপনি সুস্থ হোন, তারপর ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন আমার কথা।

এখন আর কথা নয়। আমি আপনার কাছে খাবার পাঠাচ্ছি, আগে খেয়ে নিন। কয়েকদিন ধরে শয়তানরা আপনার গোসলেরও কোন ব্যবস্থা করেনি দেখছি।

আমি আপনাকে এক ঝর্ণার ধারে পাঠাচ্ছি। আগে পুরোপুরি সুস্থ হোন। ভালভাবে চিন্তাভাবনা করেই যে কোন কাজের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তাতেই মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত থাকে বলে আমার বিশ্বাস।’

লোকটি সেখান থেকে উঠে অন্য কোথাও চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে এক লোক এসে বললো, ‘আমার সাথে চলুন, আহারের পূর্বে গোসলটা সেরে নিবেন।’

বিরান মহলের সেই কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। তাকে এমন এক রাস্তা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো যে রাস্তা দুই পাহাড়ের সংকীর্ণ ফাটলের মধ্য দিয়ে চলে গেছে।

তারা কিছু দূর যাওয়ার পর একটু ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল এবং তার সামনেই দেখা গেল স্বচ্ছ এক ঝরণা। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানি যেখানে পড়ছিল সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে তৈরী হয়েছিল একটি গভীর জলাশয়। তারপর সেই পানি জলাশয় থেকে একটি প্রশস্ত নালা বা খাল দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল ফোরাতের দিকে।

ঝর্ণার পানি ছিল খুবই স্বচ্ছ। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন পাহাড়ী ঝর্ণার পানি যেখানে পড়ছে সেখানে দুটি মেয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় একে অন্যের দিকে হাত ‍দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে।

এ দৃশ্য দেখে হাবিবুল কুদ্দুস থেমে গেলেন এবং নিজের মুখ অন্য ‍দিকে ফিরিয়ে নিলেন। হাবিবুল কুদ্দুসের সঙ্গে লোকটি বললো, ‘কি হলো, থামলেন কেন? চলুন।’

মেয়ে দুটি আওয়াজ শুনে ওদের দেখতে পেয়েই চিৎকার ‍দিয়ে লাফিয়ে পাড়ে উঠে এলো এবং পড়িমড়ি করে ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।

তিনি এই নির্জন ও বিরান অঞ্চলে এমন ‍সুন্দরী পরীর মত মেয়েদেরকে জ্বীন পরী বা ভূত বলে ধারনা করলেন। সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস মেয়েদের চিৎকার শুনে নিজের অজান্তেই আবার ফিরে তাকালেন ওদিকে। কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন সেখানে কোন মেয়ে নেই।

তিনি চারদিকে তাকালেন। সর্বএই শুধু পাহাড় ও বিরান মহলের ধ্বংসাবশেষ। নিজের সাথে আসা লোকটিকে ছাড়া আশেপাশে তিনি আর কাউকে দেখতে পেলেন না।

তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সাথে আসা লোকটি ‘চলুন’ বলেই খানিকটা এগিয়ে ‍গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। হাবিবুল কুদ্দুস দ্রুত এগিয়ে গেলেন তার কাছে এবং তাকে কোন কিছু বুঝার সুযোগ না ‍দিয়েই ঝট করে নিজের দৃঢ় বাহু ‍দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরলেন।

লোকটি ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমত ঘাবড়ে গেল। হাবিবুল কুদ্দুসের দৃঢ় হাতের চাপে তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top