২৪. সামনে বৈরুত

 ‘কে তুমি? ‘ আবারও প্রশ্ন করলো ইসহাক।

 ‘বারবারা! ‘ মেয়েটি উত্তর দিল।

 ‘আমাকে আর প্রশ্ন করো না। জানতে চেও না, কেন তোমার প্রতি এত সমবেদনা জাগলো? আমি সেই মেয়ে, যে তোমাকে বলে দিয়েছিলাম, আমরা সবাই ক্রুসেড গোয়েন্দা। তোমাকে ওরা বুঝিয়েছিল, আমরা মুসলমান। সেটা যে ভুল ও প্রতারণা তার প্রমাণ তো তুমি এরই মধ্যে পেয়ে গেছো। আর সময় নসটট করোনা, ওরা সবাই শুয় আছে , জলদি পালাও।’

 মেয়েটি ইসহাককে অৃআর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁট ধরলো। ইসহাক তাবুর ভেতর বসেই শুনতে পেল তার পদধ্বনি দূরে সরে যাচ্ছে।

 ইসহাক বুঝতে পারলো না কি করবে? এটা কি কোন ফাঁদ? তাই বা হয় কি করে ?মেয়েটি আগেও তাকে সতর্ক করেছে। কিন্তু ইসহাকের প্রতি তার এ দূর্বলতা কেন, অনেক চিন্তা করেও ইসহাক তার কোন কারণ বের করতে পারলো না।

 ইসহাক আলতো পায়ে তাবুর বাইরে বেরিয়ে এলো।

 বারবারা তার তাবুতে চলে গেল। সেখানে তীর ও ধনুক ছিল। বারবারা ধনুকটা উঠিয় নিল হাতে। তারপর তীরের কোষটা উঠিয়ে নিয়ে তাবুর বাইরে চলে গেল। সে রাস্তার এক পাশে পজিশন নিয়ে বসলো, যে রাস্তা দিয়ে ইসহাক একটু পরেই পালিয়ে যাবে।

 ইসহাক দ্রুত ঘোড়ার পিঠে জীন এঁটে ঘোড়ার রশি ও লাগাম খুললো। তারপর ঘোড়ায় না চড়ে হাঁটিয় নিয়ে চললো, যাতে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা না যায়।

 কাফেলার সবাই তখন গভীর ঘুমে। ইসহাক তাবু থেকে কিছু দূর গিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো। তারপর সে প্রানের মায়া ছেড়ে এমন জোরে ঘোড়া ছুটালো যে কাফেলার কেউ টের পেলেও যেন তাকে আর ধরতে না পারে। মরুভূমির নিস্তব্ধতা ও রাতের শীতলআবহাওয়ায় হঠাৎ তীরের ‘শা শা ‘ শব্দ শোনা গেল। একটা তীর এসে ইসহাকের পিঠে বিঁধলো।

 একটু পরেই ছুটে এলো আরও একটি তীর। সেটাও সরাসরি তার পিঠে গিয়ে বিদ্ধ হলো। আর সেই সাথেই শোনা গেল একটি মেয়ের চিৎকার ধ্বনি, ‘পালিয়েছে! আসামী পালিয়ে যাচ্ছে! উঠো, জাগো সবাই।’

 ঘুমন্ত লোকদের কানে আঘাত করলো এ চিৎকার ধ্বনি। তারা সবাই জেগে উঠে মশাল জ্বাললো। বারবারা তখনো চিৎকার করছিল , ‘কয়েদি পালিয়ে গেছে! কয়েদি পালিয়ে গেছে! ‘

 লোকজন ছুটে তার ওখানে গিয়ে সমবেত হলো। তার হাতে তীর ও ধনুক। সে হাতের ইশারায় দেখালো বন্দী কোন দিকে পালিয়েছে।

 সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডোরা ঘোড়া ছুটিয়ে দিল সেদিকে।বেশিদূর যেতে হলো না তাদের। পিঠে দুই তীর বিদ্ধ হওয়ার পরই ইসহাক ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল। ঘোড়া সওয়ারহীন অবস্থায় কিছুদূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

 দুটো তীরই ইসহাকের শরীরে গভীরভীবে বিদ্ধ হয়ে আছে। দেখেই বুঝা যায়, তীর খুব কাছ থেকেই চালানো হয়েছে। কমান্ডোরা তীরবিদ্ধ ইসহাককে তুলে ক্যাম্পে নিয়ে এলো। ইসহাকের তখনো জ্ঞান ছিল। তাকে ক্যাম্পে এনে উদ্ধারকারী কমান্ডোরা জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো, কে তোমাকে পালাতে সাহায্য করেছিল ?’

 সে উত্তর দিল , ‘কেউ না। আমি এক তাবুর কাছে ঘোড়া ও জীন দেখে সুযোগ পেয়ে নিজেই পালাতে গিয়েছিলাম।’

 এ গটনার কিছুক্ষন পর। সুলতান আইয়ুবীর অসম সাহসী ও বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কী জ্ঞান হারালো এবং অজ্ঞান অবস্হায়ই শহীদ হয় গেল।

 ‘তখন অনেক রাত। প্রকৃতির ডাকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি তাবুর বাইরে এসেই দেখতে পেলাম, সে এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝে গেলাম, বন্দী পালিয়ে যাচ্ছে।’

 কমান্ডারের প্রশ্নের জবাবে বারবারা বললো, ‘আমার তাবুতে তীর ও ধনুক ছিল। আমি সেই তীর ও ধনুক উঠিয়ে নিয়ে তার পিছনে ছুটলাম এবং পর পর দুটি তীর তার দিকে ছুঁড়ে মারলাম। দুটি তীরই যে তার পিঠে বিদ্দ হয়েছিল, বুঝতে পারিনি। বন্দী পালিয়ে যাচ্ছে ভেবে আমি চিৎকার শুরু করলাম। কিন্তু দেখলাম, লোকজন আসার আগেই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। আমি যদি তীর না লাগাতে পারতাম তবে বন্দী তো পালিয়েই যেতো।’

 ‘তোমার তাবুতে তো তীর দনুক থাকার কথা নয়। তীর আর ধনুক তো পুরিষদের তাবুতে থাকার কথা! আজ কেমন করে পুরুষদের তাবু থেকে তীর ধনুক তোমার তাবুতে চলে এলো? ‘ মেরিনা বারবারাকে জেরা শুরি করলো।

 এ প্রশ্নের জবাব দিল মার্টিন। সে বললো, ‘রাতে আমি তীর ধনুক সহও ওর তাবুতে এসেচিলাম। পরে যখন বেরিয়ে যাই, নিতে মনে ছিল না। ‘

 ‘আর এ ঘোড়াটাও তো তোমার? ‘ কমান্ডার বললো, ‘ঘোড়াটা কোথায় ছিল? বন্দী জীনই বা পেল কেমন করে ?’ প্রশ্নটা মার্টিনের উদ্দেশ্যে।

 মার্টিন বললো, ‘ঘোড়া আমার তাবুর কাছেই বাঁদা ছিল।’

 ‘আর জীন? ‘

 ‘জীনটা কেমন করে বন্দীর কাছে গেল বুঝতে পারছিনা। হয়তো আমি যখন বারবারার ওখানে ছিলাম তখন চুরি করেছে।’

 বারবারা বললো, ‘আমি একটা সফল কাজ করলাম, সে জন্য তোমরা আমায় বাহবা দেবে, তা না, তোমরা আমার কাজটাকে মলিন ও ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য অহেতুক নানা রকম প্রশ্ন তুলছো? ‘

 ‘অহেতুক নয় নয় বারবারা, যা জানতে চাচ্ছি প্রয়োজনেই চাচ্ছি। এর মাঝে কিছু রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। সেই রহস্যটা কি তা আমাদের জানতে হবে।’ কমান্ডার রুঢ় কন্ঠে বললো।

 বারবারা রাগের মাথায় বললো, ‘এই গোয়েন্দা কোন গোপন খবর কায়রো নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে পালাতে দেইনি, বরং একটা গোপন তথ্য কায়রো পৌঁছা থেকে বাঁচিয়েছি, এই অপরাধে আমাকে জেরা করা হচ্ছে? ‘

 ‘ব্যাস ব্যাস! থামো।’ কমান্ডার বললো, ‘ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আসল ঘটনা বুঝা হয়ে গেছে আমার। এই নাটকটা মার্টিন সাজিয়েছে। কয়েদীকে পালানোর ব্যবস্হা করেছে সে। তোমার ওপর দায়িত্ব ছিল তীর মেরে তাকে ঘায়েল করার, যাতে এই কৃতিত্বটা তোমার খাতেই লেখ হয়।!

 এই কমান্ডার বড়ই ঝানু দক্ষ গোয়েন্দা ছিল। স মার্টিন্র দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘মার্টিন! আমি এই পেশাতে তোমার চেঞে অনেক আগে এসেছি। আমার ওপর টেক্কা দেয়া তোমার উচিৎ হয়নি।’

 কমান্ডার একটু চিন্তা করে নিয়ে বললো, ‘বৈরুত পৌঁছার আগ পর্যন্ত সময় দিচ্ছি তোমাদের।এর মধ্যেই তোমাদের বাঁচার একটি পথ খুঁজে নিতে হবে। তোমরা কেন এমন কাজ করলে তা আমৈকে খুলে বলতে হবে।’

 মেরিনা বললো, ‘তোমাদের বোকামীর কারণে তার কাছে কোন তথ্য আদায় করতে পারলাম না আমরা। নইলে বৈরুত পৌঁছে তাকে টর্চার সেলে নিলেই অনেক গোপন তথ্য বেরিয় আসতো।’

 ‘হ্যাঁ, মেরিনা ঠিকই বলেছে। এই ঘটনায় আমরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আশা করছি বুঝতে পারছো। আমি চাই, তোমর দু’জনেই নিজেদের মহ্গলের কথা চিন্তা করে সত্য কথা খলে বলবে আমাকে।’ রায় ঘোষণার মতো করে কথাগুলো বললো কমান্ডার।

 কমান্ডার তকনো জানতো না, এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাফেলার লোকদের ব্যক্তিগত হিংসা ও রেষারেষীর কারণেই ঘটেছে।দুই মেয়ের চাওয়া পাওয়া ও পররতিহিংসার শিকার হয়ে জীবন দিয়েছে সুলতান আইয়ুবীর একজন বিশিষ্ট গোয়েন্দা।

 সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী দুর্বার বেগে এগিয়ে যাচ্ছিল বৈরুতের দিকে। পথ অনেক দীর্ঘ ও বিপদসঙ্কুল। কিন্তু সব বিপদ বাঁধা মাড়িয়ে ছুটছিল দুরন্ত বাহিনী।

 তারা সেই অঞ্চল প্রবেশ করলো যেখানে কৃস্টানরা তাদের আসার খবর পেয়ে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে বসেছিল। দুশমন বাহিনীর এই ওঁৎ পেতে থাকার খবর জানা ছিলনা আইয়ুবীর বাহিনীর। তারা নির্বিকার চিত্তে আগের মতই প্রচন্ড গতিতে ছুটছিল।

 তাদের চেহারা তখন দেখার মত। ধুলায় ধূসরিত সর্ব শরীর। মুখ দেখে কাউকে চিনার ুপায় নেই।

 মে মাসের প্রচন্ড গরমে মরুভূমি তখন লোহার মত উত্তপ্ত। উপরে জ্বলন্ত সূর্য, নিচে তপ্ত বালি। সৈন্যরা অসহ্য গরম থেকে বাঁচার জন্য সারা শরীর ও মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। এই গরমেও অনুমতি ছাড়া কারো এক ফোটা পানি পান করার সুযোগ ছিলনা

বাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়া ও উটের আরোহীরা পালা করে পদাতিক বাহিনীকে উট ও ঘোড়ার পিঠে তুলে নিচ্ছিল। চারদিকের রৌদ্রকরোজ্জল পরিবেশ ওদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল।

 ওরা পথ চলছিল আর গুন গুন কর জিকির করছিল। সবার কন্ঠে একই সুর -‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।’ তাদের সে গুঞ্জন দ্বনি দূর দূরান্ত পর্যন্ত শোনা যাচ্চিল।

::

 সৈন্যদের সেই সম্মিলিত কন্ঠের ধ্বনি গানের মত এক অপূর্ব ছন্দ দোলা সৃস্টি করছিল মরিভূমির খোলা প্রন্তরে। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা ঈমানী জযবা ও আবেগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল বৈরুতের দিকে আর গুন গুন করে গানের মত সুর কর জিকির করছিল -‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।’

 সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীর সাথে রওয়ানা দিলেও অচিরেই তিনি তাদের সাথে গিয়ে মিলিত হলেন। অন্য দশজন সৈনিকের জন্য যে আইন তার জন্যও তিনি একই বিধি মেনে চলছিলেন। তিনি নিজেও অতিরিক্ত পামি পান করার সুযোগ নেননি।

 সহসা তিনি থেমে গেলেন। এবং ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকিয়ে দেখলেন। তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ঘোড়াকে ডানদিকে তাড়া করলেন।

 তাঁর সঙ্গের সেনাপতিগন, বিভিন্ন সহকর্মী ও কাসেদর তার পিছনে ছুটল। ডান দিকেই ছিল সেই এলাকা, যেখানে ইসহাক তুর্কী শহীদ হয়েছিল। ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি সেই ভয়াবহ আকৃতির টিলার কাচে গেলেন। দানবাকৃতির টিলাগুলোর মাঝখানে গিয়ে গোড়া থামালেন সুলতান আইয়ুবী। তারপর কমান্ডো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সালেম, বন্ধু! এখান থেকেই তোমার কাজ শুরু করো। তোমার কমান্ডো বাহিনীকে গ্রুপ গ্রুপ করে চারদিকে ছড়িয়ে দাও। তোমাদের প্রত্যেক গ্রুপ যেন পরষ্পরের সাথে সংযোগ রাখে এবং দূরে দূরে গেরিলা তৎপরতা চালায়। সামনের গ্রুপ জলদি সামনে চলে যাক। সেনাবাহিনীর গতির সাথে তাদের তাল মেলাবার দরকার নেই। তারা তাদের মত চলবে এবং সেনাবাহিনীক ছাড়িয়ে তাদের আগে চলে যাবে।’

 এরপর অন্যান্ সেনাপতিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আর সমস্ত বাহিনী একই গতিতে চলতে থাকবে। কমান্ডোদের গতির সাথ তাল মেলাবার দরকার নেই তাদের।’

 সালেম মিশরী সুলতানক সালাম জানিয় চলে গেল নিজের বাহিনীর কাছে। সুলতান আইয়ুবী অন্য সেনাপতিদের তখন বলছিলেন, ‘পথ যা কিছুই ঘটুক আমাদের অগ্রাভিযান চলতেই থাকবে। কারণ আমর এখন শত্পুদের এলাকাই এসে গেছি। যে কোন সময় আমরা আক্রান্ত হতে পারি।’

 তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘ আক্রান্ত হলে সবার তাতে জড়িয় পড়ার দরকার নেই।যে বাহিনী আক্রান্ত হবে তারাই ওদের মোকাবেলা করবে , বাকীরা এগিয় যাবে সামনে।’সুলতান আইয়ুবী প্রয়োজনীয় নির্দেশনামা জারিী করে ধীরে ধীর ঘোড়া চালিয়ে এই দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলটা ঘুরে ঘুরে দেখচিলেন। সহসা তাঁর চোখে এমন এক দৃশ্য ভেসে উঠল, যা তিনি আশা করেননি। দূরে তিনি অচেনা এক মুসাফিরকে দেখতে পেলেন। মনে হলো, মুসাফির মৃত।লাশটি যদিও বালির মাঝে বেশ খ নিকটা দেবে আছে কিন্তু তার অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

 তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেলেন সেই লাশের কাছে। এক সৈনিক লাশটি সোজা করলো। দেখ গেল , তার পিঠে দুটি তীর বিদ্ধ হয়ে আছে। রোদে তার চেহারার মাংস শুকিয়ে গেছে। এখন আর এই চেহারা দেখ লোকটিকে সমাক্ত করার উপায় নেই।

 ‘যেতে দাও ওসব! ‘ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কোন কাফেলার মৃত যাত্রী হবে। মরুভূমিতে এসে মানুষ কতভাবে মারা পড়ে ! কেউ কেউ তো পাগলও হয়ে যায়।’

 সুলতান আইয়ুবী বুঝতে পারলেন না, এ লাশটি তার নিজেরই এক বিশ্বাসী ও নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দার।যে ইসহাক তুর্কীকে তিনি বৈরত পাঠিয়েছিলেন সেখনকার খবর নিয়ে জলদি পিরে আসতে, এটা সেই বিশ্বস্ত গোয়েন্দার লাশ। যদি লাশ কতা বলতে পারতো তবে এখন সে চিৎকরর করে বলতো, ‘সম্মানিত সুলতান, দয়া করে এমুহূর্তে বৈরুত যাবেন না। ওখানে আপনাকে অভ্যার্থনা জানানোর জন্য সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে।’

 খৃস্টানরা বৈরুতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তার পূর্ণাঙ্গ সংবাদ ও নকশা তার অন্তরে সুরক্ষিত ছিল কিন্তু ইসহাকের দেহ পিঞ্জিরা সেই সংবাদ কিছুই বলতে পারলো না।

সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী এমনভাবে ছড়িয়ে িয়েছিল যে, অগ্রাভিযানে অংশগ্রহনকারী সৈন্য বাহিনীর দুই পাশের দুই তিন মাইল দূর পর্যন্ত তারা তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিয়েছিল।

 কয়েকটি কমান্ডো দল সামনে বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। পিছনেও কমান্ডো বাহিনী মূল সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার দাযিত্ব পালন করছিল।

 বৈরুত থেকে অনেক দূরে তাকতেই এই কমান্ডোদের সাথে খৃস্টানদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

 যুদ্ধটা শুরু হল এক বয়ংকর এলাকায়। দুর্গম পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক দল খৃস্টান বাহিনী। সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো দল ওখানে পৌঁছতেই সম্রাট বিলডনের কথ ভুলে গেল ওরা। এই ক্ষুদ্র বাহিনি নিকেশ করা কোন ব্যাপারই নয় ভেবে তারা হামলা করে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয় গেল সুলতানের কমান্ডোরা।

 পাল্টা আক্রমণ করে ওদের কবল থেকে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে নিতে সন্ধা ধনিয়ে এলো। ততক্ষনে আইয়ুবীর মূল বাহিনী সেখানে চলে এসেছে। কমান্ডোরা তাদেরকে এই ঘটনার কিছুই জানালো না। মূল সেনাবাহিনী সামনে চলতেই লাগলো।

 রাত যখন অর্ধেক অতীত হয়ে গেছে তখন ক্যাম্প করার অনুমতি পেল ওরা। ক্যাম্প করার আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে সৈন্যরা থেমে গেল। তারা বাকী রাতটুকু বিশ্রাম করার জন্য থামলেও কমানেড বাহিনী থামলো না সেখানে। তারা সারা রাত বিরতিহীন পথ চলে সামনে এগিয়ে গেল।

 এসব কমান্ডোদের জন্য নির্দেশ ছিল, ‘পথে কোন সন্দেহজনক লোক চোখে পড়লে তাকে পাকড়াও করবে। যদি সে পালাতে চেষ্টা করে তবে তাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করবে না। যদি পথে কোন কাফেলার সাক্ষাত পাও তবে তাদেরও গতি থামিয় দেবে। একমাত্র আমাদের সেনাবাহিনীকেই তোমাদের অতিক্রম করে অগ্রসর হতে দেবে। তাদের অগ্রাভিযানে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। তবে সব সময় চেষ্টা করবে তোমরা যেন তাদের থেকে এগিয়ে থাকতে পারো।’

 সেমাবাহিনীর কোন দল বিশ্রাম নিতে থককলেও দেখা গেল অন্য দল চলছে তো চলছেই। এভাবেই এগিয় যাচ্ছিল মৃত্যুভয়হীন সেই সামরিক কাফেলা।

 রাত শেষ হয়ে সূর্য আবার উদয় হচ্ছিল। মুজাহীদ বাহিনীর এই কাফেলা সূর্যের অনেক উদয় অস্ত দেখতে দেখতে বৈরুতের কাছাকাছি চলে এলো।

 তারা তাদের অগ্রাভিযানের খবর নিয়মিত সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছিল। খৃস্টানদের অনেক সীমান্ত ফাড়ি কমান্ডোদের রাতের অতর্কীত আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে। মরুভূমিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

অনেক দূর থেকে দ’একটা গাছপালা চোখে পড়ছে সৈনিকদের। কোথাও কোথাও সবুজ মাঠও দেখা যাচ্ছিল। শহরের বাইরের ছোট ছোট গ্রামও দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল ওদের।

বৈরুত সম্রাট বিলডন তার বিভিন্ন সৈন্য বাহিনীর তৎপরতার রাপোর্ট সংগ্রহ করছিলেন। তিমি সংবাদ পেলেন, সুলতান আইয়ুবী বৈরুতের উপকন্ঠে চলে এসেছেন। অচিরেই তিনি বৈরুত অবরোধ করতে যাচ্ছেন।

 তিনি আইয়ুবীর এ হামলার প্রতিকার ব্যবস্হা আগেই সেরে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি সুলতান আইয়ুবীর অগ্রাভিযানের নকশাটি তকনো হস্তগত করতে পারেননি। এই সময় কায়রো থেকে আগত খৃস্টান গোয়েন্দা কাফেলাটি বৈরুত এসে পৌঁছে।

 এই কাফেলাই ইসহাক তুর্কীকে ন্দী করেছিল। পরে সে ওদের এক মেয়রর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিহত হয়।

 গোয়েন্দা দলটি বৈরুত পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই সম্রাট বিলডন ওদের কাছে আইয়ুবীর অগ্রাভিযানের নকশা জানতে চান। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। ফলে সম্রাটকে তারা নকশা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়।

 সম্রাট বিলডন সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের অবস্হা জামার জন্য পঁচিশ নের একটি অশ্বারোহী দলকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু দেখ গেল, তারা আর ফেরত আসেনি। একটা সময় পরে তিনি বুঝলেন, তারা আর কোন দিনই ফিরে আসতে পারবে না।

অশ্বারোহীদের এই দলটি অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। তারা দূরে ধুলি ঝড় উড়ে আসতে দেখলো। ধুলিঝড়টি কোন কাফেলার না অন্য কিছু তা দেখার জন্য তারা এক টিলার ওপর চড়লো। মাটি থকে উঠে আসা এই ধুলিঝড় সৈন্যগেরই তে পারে ভেবে তারা টিলার মধ্যে অবস্হান নিল।

 তাদের এক কমান্ডার টিলার ওপর উঠ চারদিকে লক্ষ করতে লাগলো। কোথা থেকে এক তীর এসে কমান্ডারের গর্দানে বিদ্ধ হলো।

 কমান্ডারের চিৎকার শুনে আরেক অশ্বারোহী ব্যাপার কি দেখার জন্য উপরে উঠলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই সেও তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গেল।

 বাকী আরোহীরা নিচেই ছিল। হঠাৎ তীরের বর্ষণ টের পেয়ে তারাও পজিশন নিল এবং পাল্টা তীর ছুঁড়তে াগলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের , লড়াইটা তাদের বিপক্ষে গেল।

 অবস্হা বেগতিক দেখে তাদের দু’একজন পালাত চেষ্টা করলো। কিন্তু সালেম নিশরীর কমান্ডো বাহিনী তাদের ককাউকে জীবিত ফেরত যেতে দেয়নি। মূল বাহিনী সেখানে পৌঁছরর আগেই তাদের অশ্ব ও অস্ত্রশস্ত্র সব নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিল আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী।

 কোন সংবাদ না পেলেও সম্রাট বিলডন এবং তার জেনারেলরা বেশ নিশ্চন্ত ছিল। আইয়িুবীে স্বাগত জানানোর যে ব্যাবস্হা তারা নিয়েছে তাতে তারা সন্তষ্ট।

কারণ বৈরুত শহর এমনিতেই যথেষ্ট সুরক্ষত। সহজে একে কেউ কব্জ করতে পারবেনা। তাছাড়া বৈরুতের সুরক্ষার জন্য শহরে সম্রাট বিলডনের নিজস্ব বাহিনী ছাড়াও রয়েছে দক্ষ কয়েকজন নাইটের নেতৃত্বে শক্তিশালী এক বাহিনী।

 অপর দিকে সুলতানকে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য মূল বাহিনী বিভিন্ন নাইটের নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গা ওঁৎ পেতে বসে আছে। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া আছে, তারা যেন মুসলিম বাহিনীকে বৈরুতের উপকন্ঠ পর্যন্ত আসার সুযোগ দেয়। যাতে ল়ড়াই শুরু হলে এবার আর সুলতান আইয়ুবী পালিয়ে যেতে না পারেন।

 সুলতান আইয়ুবীর সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলার যাবতীয় ব্যবস্হা সুসম্পন্ন করে রাখ ছিল বলে তারা এবার বেশ নিশ্চিত ছল।

 খৃস্টান গোয়েন্দাদের ে দসটি বৈরুত এসেছিল তারা সম্রাট বিলডনকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী এখনো কায়রো। আমরা নিজের চোখে তাকে কায়রো দেখে এসেছি। এ বাহিনীর সাথে সুলতান নেই। হয়তো আপনাকে ব্যতিব্যস্ত ও বিভ্রান্ত করার জন্ তিনি কোন বাহিনী পাঠিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু এরাা সুলতানের মূল বাহিনী নয়।’

 গোয়েন্দাদের মন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার পর তা অবিশ্বাস করার কোনঅ কারণ নেই। এখবরে সম্রাট বিলডনের নিশ্চিন্ত বিশ্বাস জন্মে গেৱ,সুলতান আইয়ুবী এখনও কাযরোতেই আছেন। তিনি যখন ময়দানে আসেননি তখন ূল যুদ্ধ শুরু হতে এখনও অনেক দেরী।

 কিন্তু প্রকৃত অবস্হা ছিল ভিন্ন। শহরের বাইরে প্রকৃত যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে।

 সুলতান আইয়ুবী যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন ততোই কমান্ডো বাহিনীর আক্রমণ ও সফলতার খবর পাচ্ছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি ভিন্নরকম একটি সংবাদ পেলেন।

 কয়েক মাইল দূরে শত্রুদের এক বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অনেক কমান্ডো শহীদ হয়ে গেছে , আহতের পরিমাণও কম নয়।

 খবরটি শুনে সুলতান আইয়ুবী শুধু বললেন , ‘ শহীদদের কোথাও দাফন করে দাও আর আহতদের নিরাপদ স্হানে সরিয়ে নিয় এসো।’

 এটাই সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধ বিদ্যার অনন্য কৌশল। তিনি একটি নির্দিষ্ট টার্গেট নিয়ে ময়দানে নামেন। পথে যত রকম বাঁধাই আ ুক না কেন, তিনি মূল টার্গেটের কথা কখনো ভুলে যান না। দুশমনের বাঁধাগুলো যতটা সম্ভব পাশ কাটিয়ে তিনি গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যান। কখনো আক্রাম্ত হলে দিশেহারা হয়ে যান না।

 এখানেও তিনি দক্ষতার সঙ্গে সৈন্য পরিচালনা করছিলেন। তিনি তার সৈন্যদেরকে এমন এলাকা দিয়ে অক্ষত ও নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যাখানে সর্বত্রই শত্রু সেনারা ওদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে ছিল। তিনি তাদের মোকাবেলার জন্য কমান্ডো বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন।

 এই কমান্ডো বাহিনী মূল বাহিনীর অগ্রযাত্রার পথের দুই পাশের শত্রু শিবিরগুলো রাতের আঁধারে অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে তচনচ করে দিত। কোথাও শত্রুদের কেবল বিছিন্ন ও অকেজো করে দিয়েই তারা পথ করে দিত মূল হাহিনীর জন্য। কোথাও শত্রুদের ছিন্নভিন্ন ও নিশ্চহ্ন করে দিত। আবার কোথাও কমান্ডো বাহিনী বিরাট বাঁধার সম্মুখীন হয়ে লড়াই অব্যাহত রাখতো, সেই ফাঁ মূ বাহিনী এগিয়ে যেত সামনে।

 মূল বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে না বলে তাদের অগ্রগতি ছিল ধারনার অধিক।তাদের পথ নিষ্কন্টক রাখার জন্য কমান্ডোসা ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছ দুশমনের সঙ্গে। তারা মরছে, মারছে, পালাচ্ছে, দৌড়াচ্ছ। কখনও প্রবল আঘাত ানছে। কখনো প্রবল আঘাতের মোকাবিলা করছে সাহসিকতার সঙ্গে। কিন্তু এইসব আক্রমণ ও খুনোখুনি সবই ঘটছিল সুলতান আইয়ুবীর মূল বাহিনী থেকে দূরে।

 আলেকজান্দ্রিতে হেশামুদ্দিন লুলুর সমুদ্র জাহাজগুলো প্রস্তুত ছিল। নৌবাহিনী সব সৈন্য ও অফিসাররা অবস্হান নিয়েছিল জাহাজগুলোতে।

হেশামুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর দূরত্ব ও গতির একটা হিসাব অনুমান করে রেখেছিলেন। একদিন তিনি সৈন্যদেরকে জাহাজগুলোর পাল তুলতে আদেশ দিলেন। রাতের আঁধারে জাহাজে পাল তুলে জাহাজগুলো সম্দ্র যাত্রা শুরু করলো।

 জাহাজগুলো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে এগিয়ে চললো ৈরুতের দিকে। সাগরের মাঝখানে গিয়ে হেশামুদ্দিন জাহাজগুলোকে দূরে দূরে ছড়িয় পড়তে বললেন।

 তিনি একজন অভিজ্ঞ এ্যাডমিরাল ছিলেন। জাহাজের সৈন্য ও সেনাপতিরা সবাই সুলতান আইয়ুবীর কাছে প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের জানিয়েছিলেন কোন্ মহান উদ্দশ্য হাসিসের জন্য তারা লড়াই করছে।

 তাদের অন্তরে বিরাজ করছিল আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে দেয়ার আকল আকুতি। শাহাদাতের তামান্না ছিল প্রটিতি অন্তরে। এমনি এক জিন্দাদীল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হেশামুদ্দিন।

 বৈরুতের উপকন্ঠে পৌঁছে গভীর সমুদ্রে তিনি জাহাজগুলো থামিয়ে িলেন। তারপর াহাজ থেকে নামালেন ছোট ছোট জেলে নৌকা। একদল নৌ-কমান্ডোকে ওসব নৌকায় তুলে দিয়ে তীরের অবস্হা দেখার জন্য পাঠিয়ে দিলেন তিনি।

 কমান্ডোরা জেলেদের পষাক পরে ছোট ছোট নৌকায় পাল উঠিয়ে উপকুলের দিকে রওনা হয়ে গেল।

সমুদ্রে তারা একাধিক দিন ও রাত কাটিয়েছে। পাড়ি দিয়ে এসেছে দুস্তর উত্তাল সাগর। জাহাজের ডকে দাঁড়িয়ে ওরা দেখতে পাচ্ছিল বৈরুত শহরের আবছা আভাস। কিন্তু যে নৌকাগুলোকে উপকূলের খবর আনার জন্য পাঠানো হয়েছিল দীর্ঘ সময় পরও তারা কেউ ফির এলো না।

 এ্যাডমিরাল চিন্তিত হলেন। এমন অভ্যার্থনা তিনি আশা করেননি। তিনি অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করলেন। সেনাপতিদের পরামর্শে তিনি আরো কয়েকটি নৌকাকে নতুন কর পাঠালেন উপকূল অভিমুখে।

 সতর্কতার সাথে আরও কয়েকটি ছোট ছোট নৌকা রাতের আঁধারে এগিয়ে গেল। তারা এক সাথে না গিয়ে পর পর সারিবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। উপকূলে পৌঁছার আগেই আক্রান্ত হলো তারা। সামনের দুটো নৌকা উল্টে গেল। আহত সৈন্যরা সমুদ্রে সাঁতার কেটে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে লাগলো। বাকী নৌকাগুলোকে ওরা সামান্য পিছনে সরিয়ে নিয়ে এক সারিতে দাঁড়সকরালো।এরপর আক্রমণ প্রতিহত করে উপকূল পর্যন্ত পৌঁছার সংকল্প নিয়ে ওরা আবার এগিয়ে গেল।

 বেশী দূর যেতে হলো না, একটি নির্দিষ্ট সীমানায় পৌঁছতেই আবার আক্রান্ত হলো ওরা। ওরাও পাল্টা হামলা করলো। দু’পক্ষের মধ্যে তীর বিনিময় হতে লাগলো থেমে থেমে।

একটি নৌকা এই খবর নিয়ে ছুটলো গভীর সমুদ্রের দিকে। জাহাজের কাছে পৌঁছে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘রশি ফেলো ! রশি ফেলো! জাহাজ নোঙ্গর করো। ওরা সমুদ্র উপকূলে আমাদের কমাম্ডোদের ওপর হামলা করে দিয়েছে।’

 নৌকা থেকে এক কমান্ডোকে আধ মরা অবস্হায় জাহাজে তোলা হলো। দুশমনের পর পর তিনটি তীর বিদ্ধ হয়েছিল তার শরীরে।

 নৌকা নিয়ে ফিরে আসা কমান্ডো বললো, ‘আমাদের দুটো নৌকা প্রথম ধাক্কাতেই উল্টে যায়। খৃস্টানরা আমাদের একটি নৌকা আটক করতে সমর্থ হয়েছে। বাকীরা লড়াই করছে ওদের সাথে।’

‘তোমরা কি টহল বাহিনীর পাল্লায় পড়েছিলে? ‘

‘এরা কোন টহল বাহিনী নয়। খৃস্টান নৌবাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্য ওরা। তাদের নৌকাগুলো সবই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।’

 হেশামুদ্দিন এবার তার নিয়মিত বাহিনীর একটি বড়সড় দলকে পাঠালেন আক্রান্ত নৌকাগুলোকে উদ্ধার করতে। বললেন, ‘ওদের বিতাড়িত করে তীরে নামার ব্যাবস্হা আমাদের করতেই হবে। তোমরা চেষ্টা করে দেখো, না পারলে আমি অন্য ব্যবস্হা করবো।’

 এই বাহিনী যুদ্ধরত বাহিনীর সাথে গিয়ে মিলিত হলো। তারা দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে পাশ থেকে আক্রমণকারীদের ওপর আঘাত হানলো। ডানে বায়ে এবং সামনে থেকে একযোগে আক্রান্ত হয়ে খৃস্টান নৌসেনারা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লো আত্মরক্ষার্থে। এ যুদ্ধে ওদের কিছু সৈন্য মারা পড়লো এবং কিছু লোক ধরা পড়লো।

 ওদেরকে নিয়ে আসা হল জাহাজে। ওদের কাছ থেকে জানা গেল, হেশামুদ্দিন প্রথমে যে দলটিকে পাঠিয়েছিলেন, অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রায় সবাইকে বন্দী করা হয়।

 এতে বোঝা গেল, মুসলিম নৌবহরের আগমন সংবাদ তারা আগে থেকেই জানতো। এখন বন্দীদের কাছ থেকে মুসলিম নৌবাহিনীর শক্তি সম্পর্কেও তারা একটি পরিষ্কার ধারমা নিয়ে নিতে পারবে।

 হেশামুদ্দিন তার নৌবহরকে সমুদ্রের এতটা গভীরে নিয়ে গেলেন যে, সন্ধায় জাহাজ ছাড়লে অর্ধ রাতের একটু পর যেন জাহাজগুলো বৈরুতের কূলে ভিড়তে পারে। তিনি শেষ রাতের দিকে খৃস্টান বাহিনীর অগোচরে তার বাহিনী তীরে নামিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।

 খৃস্টানরা মুসলিম বাহিনীকে বাঁধ দেয়ার জন্য আগে থেকেই সমুদ্র উপকূল হালকা ও ভারী মেনজানিক স্হাপন করে বসেছিল। জাহাজের অগ্রযত্রা রোধে এ এক পরীক্ষিত পদ্ধতি। মেনজানিক দ্বারা অগ্নি গোল নিক্ষেপ করলে জাহাজ এগুতে পারে মা।কারণ জাহাজে গোলা পড়লে সেই জাহাজ বাঁচানো মুস্কিল।

হেশামুদ্দিন সবই বুঝতে পারলেন। কৃস্টানরা যে তাদের অগ্রগতি রোধ করার জন্য মেনজানিক কামান ব্যবহার করবে একথা বুঝার জন্য বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। এই সহজ প্রতিরোধ পদ্ধতির কথাই প্রথমে সবার মনে পড়বে।

 কিন্তু তাই বলে তো চুপ করে বসে থাকা যায় না। সুলতান আইয়ুবী এখন যুদ্ধের ময়দানে। এ যুদ্ধে জিততে হলে সমুদ্রের দিক থেকেও তার বিশেষ সাহায্য দরকার। উপরে যুদ্ধ হবে আর সাগরে বসে বসে মুজাহিদরা সেই দৃশ্য দেখবে, তাতো হয় না। মনে মনে ঝুঁক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এ্যাডমিরাল হেশামিদ্দিন।

 এ সময় দেখা গেল তীরের দিক থেকে একটা নৌকা এগিয়ে আসছে। নৌকাটা মুসলিম নৌবাহিনীর। নৌকা আরো কাছে এলে দেখ গেল, মুসলিম নৌসেনারা দু’জন খৃস্টান নৌসেনাকে ধরে এনেছে। এর সেই খৃস্টান সেনা, জেলে সাজা মুসলিম মৌকমান্ডোদের ধরে যারা বন্দী করেছিল।হেশামুদ্দিনের পাঠানো নৌবহরের সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে ওর যখন দেখলো অবস্হা বেগতিক, তখন এরাও অন্যান্যদের সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরা সাঁতার কাটতে কাটতে বহু দূরে সরে যাওয়ায় মুসলিম বাহিনী আগে তাদের দেখা পায়নি। পরে অনেক দূর থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়।

 ওদেরকে যখন হাত পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া হলো তখন তারা বললো, ‘সমুদ্র উপকূলে বিলডনের সৈন্যরা প্রস্তুত হয়ে আছে। আর জাহাজে আগুন লাগানোর জন্য মেনজানিক কামান পাতা হয়েছে উপকূলে।’

 এই সৈন্যদের কাছ থেকেই হেশামুদ্দিন জানতে পারলেন, ‘শহর রক্ষার জন্য বৈরুতের অভ্যান্তরে অল্প সংখক সৈন্য রেখে বাদবাকি সব খৃস্টান সৈন্য শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন সম্রাট বিলডন। বিপুল সংখক সৈন্য এখন সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর পেছনে এবং তার রাস্তার দুই পাশে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে। সুলতানকে ফাঁদে ফেলে পিষে মারতে চায় তারা।’

 এই সংবাদ মারাত্মক এক বাপদের বার্তা বহন করছিল। এই ভয়ংকর সংবাদে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন ও তার সেনাপতিগণ। তারা গভীরভাবে বিষয়টি চিন্তা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, খৃস্টানরা আমাদের আগমনের সংবাদ আগেই পেয়ে গেছে। আমরা জানি না, সুলতান আইয়ুবী এ লংবাদ জানেন কিনা।

 হেশামুদ্দিন সেনাপতিদের বললেন, ‘সুলতান আইয়ুবী এ সংবাদ জানেন কিনা আমরা জানি না। আমরা যখন বিষয়টি জানতে পেরেছি তখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এ খবর অবিলম্বে সুলতানকে পৌঁছানো। এখ তাকে বৈরুতের কাছাকাছি পাওয়ারই সম্ভাবনা। আমি তাঁর কাছে এ খবর পাঠানোর জন্য এখুনি কাসেদ পাঠাতে চাই।’

সেনাপতিরা এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হলো। তারাও বললো, ‘আপনার চিন্তা নির্ভুল। আমরাও কাসেদ পাঠানোর পক্ষে।’

 সঙ্গে সঙ্গে একটি নৌকায় দুটি ঘোড়া ও দু’জন কাসেদকে তুলে দিয় তাদের বললেন, ‘এখন তোমরা এ উপকূলে নামতে পারবেনা। তোমরা নৌকা নিয়ে গভীর সমুদ্র পথে উজানের দিকে চলে যাও। রাত নামার পর অন্ধকারে কোন গ্রামের পাশে নির্জন উপকূলে নেমে যাবে। সেখান থেকে ঘোড়া নিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যাবে বৈরুতের কাছাকাছি।

 বৈরুত শহরের বাইরে আমাদের যে বাহিনী আছ সাবধানে তাদের কাছে পৌঁছ যাবে তোমরা। তারপর সুলতানকে সমস্ত গটনা খুলে বলবে।’

 এক সেনাপতি সেইসাথে যোগ করলো, ‘বিশেষ করে তাকে জানাবে, আপনার পেছনে শত্রুদের বিশাল বাহিনা ওঁৎ পেতে আছে। তারা যেকোন সময় আপনার ওপর বড় ধরনের হামস করে বসতে পারে। আপনার এ অভিযানের খবর খৃস্টানরা আগেই পেয়ে গেছে। তাই তারা এবার আপনাকে পিষে মারার ফন্দি এঁটেছে।’

 এ ছাড়া তারা সুলতানকে আরো কি কি বলবে সবসবুঝিয়ে দিয়ে কাসেদকে হুকুম করলেন, ‘এবার বেরিয়ে পড়ো অভিযানে। মনে রেথো, যুদ্ধের মোড় পাল্টে দেয়ার জন্য এ খবর সুলতান আইয়ুবীর কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। যে করেই হোক, সুলতানের কানে এ খবর পৌঁছাতে হবে তোমাদের।’

 হেশামুদ্দিন তামলে কাসেদ দু’জন তাকে সালাম জানিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল।

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top