২১. ধাপ্পাবাজ

যদি তোমরা আমাকে পরাজয়ের জন্য শাস্তি দিতে চাও, সে শাস্তি মাথা পেতে নেয়ার জন্য আমি প্রস্তুত। আমার কানে এ কথাও এসেছে, আমার সৈন্যরা নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট, লুটপাট ও মদপানে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কেউ কেউ এ কথাও বলেছে, বাগদাদের খলিফার উপর বিভীষিকা আরোপের জন্য আমি স্বেচ্ছায় পরাজয় বরণ করেছি। কেউ আবার আমাকে অহংকারী ফেরাউন বলে অভিহিত করেছে।

আমি এসব অভিযোগের কোন উত্তর দেবো না। এসব দোষারোপের জবাব দেবে আমার তলোয়ার। এবং শীঘ্রই তা দেবে। আমি কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করবো, এ পাপ কে করেছিল, যার শাস্তি আমাকে ও আমার সেনাবাহিনীকে নিতে হচ্ছে।’

আইয়ুবীর বক্তব্য তখনো শেষ হীয়নি, প্রহরী ভেতরে ঢুকে এক অফিসারের কানে কানে কিছু বললো। অফিসার উঠে আউয়ুবীর কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো, ‘হিম্মত থেকে কাসেদ এসেছে।’

সুলতান আইয়ুবী কথা থামিয়ে জলদি তাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন। ধূলোবালীতে একাকার ও পথযাত্রায় ক্লান্ত শ্রান্ত কাসেদ সুলতান আইয়ুবীর সামনে এসে তকিউদ্দিনের চিঠি হস্তান্তর করলো। সুলতান আইয়ুবী চিঠিটি খুলে পড়তে শুরু করলেন। উপস্থিত সকলে তাকিয়েছিল সুলতান আইয়ুবীর চেহারার দিকে। তার চেহারা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছিল। কখনো উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিল আনন্দে, কখনো বিমর্ষতা গ্রাস করছিল সেই মুখ।

তিনি চিঢিটি পড়ে শেষ করলেন। তার চোখে তখন অশ্রু টলমল করছে। এ অশ্রু আনন্দ না বেদনার উপস্থিত কেউ তা জানে না। তারা অভিভূত হয়ে দেখছিল সুলতানকে। তিনি পত্রটি এক সেনাপতির হাতে দিয়ে বললেন, ‘এ চিঠি সকলকে পড়ে শোনাও।’

সেনাপতি পত্র পাঠ করতে শুরু করলো। যতই সে এগুচ্ছিল ততই আবেগ এসে চেপে ধরছিল তার কণ্ঠ। তার সে আবেগ সংক্রমিত হচ্ছিল ভর জলসায়। উপস্থিত সকলের চোখই অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।

চিঠি পড়া শেষ হলো সেনাপতির। দেখা গেল প্রায় সবার চোখ থেকেই গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। সেই কান্নাকাতর কম্পিত কণ্ঠে কেউ একজন কোনরকমে উচ্চারণ করলো, ‘জিন্দাবাদ।’ সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেকের সম্মিলিত আওয়াজ শোনা গেল, ‘জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!’

‘এওতো অপরাধী ও পাপীদের কৃতিত্ব!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তোমরা যারা কায়রো আছো, তারা জানো না তকিউদ্দিনের কাছে কি পরিমাণ সৈন্য ছিল। তোমরা এটাও জানো না, বিলডনের বাহিনী ছিল দশ গুণেরও বেশী। তার অশ্বারোহী ও পদাতিক উভয় বাহিনীই ছিল বর্মাচ্ছাদিত। তকিউদ্দিনের সৈন্যরা কি প্রমাণ করে দিল না, আমরা পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে পারি? এখনও কি তোমরা মনে করো, মাথায় হাত দিয়ে আমাদের বসে থাকতে হবে?’

সমস্বরে সবাই বলে উঠল, ‘না।’

‘তাহলে এবার তোমরা যুদ্ধের প্রস্তুতিতে লেগে যাও। প্রবল উৎসাহে নতুন সৈন্য ভর্তি করো। মুসলমানদের প্রথম কেবলা তোমাদের ডাকছে। আমি শত্রুদের সাথে কোন আপোষ-মীমাংসা বা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি নই।’

তকিউদ্দিনের সামান্য একটি পত্রই সুলতান আইয়ুবী ও তার সৈন্যদের মনোবল বাড়িয়ে দিল। তাঁর সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের আহত মনোবল তরতাজা করে দিল।

যুদ্ধে পরাজয় এবং বেশুমার গুজবের ফলে অনেকের মনে সুলতান আইয়ুবী ও তাঁর সেনাবাহীনির বিরুদ্ধে সন্দেহ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। এই পত্র সেই ক্ষোভ ও দুঃখ ধীরে ধীরে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিল।

তকিউদ্দিন বসে ছিলেন না। তিনি তার বাহিনীকে ত্রিশ-চল্লিশ জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে দিলেন। এসব খণ্ড দলগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে পাঠিয়ে দিলেন বিলডনের বাহিনী যেখানে গিয়ে ক্যাম্প করেছে সেখানে। এইসব বাহিনীকে তিনি বললেন, ‘কখনোই শক্তি ক্ষয় করবে না। ঝটিকা কমাণ্ড আক্রমণ চালাবে এবং চকিতে পালিয়ে আসবে। শত্রুকে সব সময় সন্ত্রস্ত রাখবে, যাতে তারা অভিযান চালাতে না পারে, আবার শান্তিতেও বসে থাকতে না পারে।’

এরই মধ্যে বিলডনের বাহিনীর অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তিনি এই আশা নিয়ে বিশাল বাহিনীসহ অভিযানে বেরিয়েছিলেন যে, তিনি দামেশক পর্যন্ত সমগ্র এলাকা তার অধিকারে নিয়ে নেবেন। কিন্তু তার সে আশা কল্পনা হয়ে উঠে গেল আকাশে। এখন তার অবস্থা এমন হলো, প্রত্যেক রাতেই কোন না কোন ক্যাম্পে তকিউদ্দিনের সৈন্যরা কমাণ্ডো আক্রমণ চালাতে লাগলো। এতে দিনদিনই তার ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে চলল।

বিলডন তার সৈন্য দলকে রাতে পাহারা জোরদার করার হুকুম দিল। তকিউদ্দিনের কমাণ্ডো বাহিনীকে ধরার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল ছড়িয়ে দিল বিভিন্ন দিকে। কিন্তু তাতে খুব লাভ হল না। প্রতি দিনই সকালে বিলডনকে শুনতে হয়, আজ রাতে অমুক ক্যাম্পে আক্রমণ হয়েছিল, অমুক ক্যাম্প আজ রাতে লুট হয়ে গেছে।

বিলডন পালিয়ে গিয়ে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল, সে এলাকাটা ছিল পাহাড়ী পার্বত্য অঞ্চল। এতে বিলডনের চাইতে তকিউদ্দিনের কমাণ্ডো বাহিনীরই সুবিধা হলো বেশী। কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধই। কমাণ্ডো আক্রমণের জন্য তকিউদ্দিনকেও কম মূল্য দিতে হচ্ছে না। এমনিতেই তার বাহিনী ছোট। তার ওপর প্রতি রাতেই কমাণ্ডো আক্রমণ চালাতে গিয়ে দিন দিন তার সৈন্য সংখ্যাও অল্প অল্প করে কমে যাচ্ছিল। কমাণ্ডো আক্রমণ চালিয়ে তারা যখন শত্রু ক্যাম্পের ভেতর চলে যেত, তখন ফেরার পথে দেখা যেতো তাদের কোন না কোন সৈনিক শহীদ হয়ে গেছে।

তকিউদ্দিনের হাতে এমন সংখ্যাক সৈন্য ছিল না যে, তিনি কোন এলাকা দখল করে নিজের করায়ত্বে রাখতে পারেন। আবার এমন অবস্থাও ছিল না, শত্রুকে তার অবস্থান থেকে বিতাড়িত করতে পারেন। তাই এ কমাণ্ডো হামলা করা ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না।

এই কমাণ্ডো হামলার উপকার মোটেই তুচ্ছ ছিল না। কমাণ্ডোদের ভয়েই বিলডন কোন দিকে অভিযান চালাতে পারছে না। যদি বিলডন অগ্রাভিযান চালাতো তবে তকিউদ্দিনের এউ ক্ষূদ্র বাহিনী তাদের সামনে বেশী সময় টিকতে পারতো না। কিন্তু বিলডন জানতো না , তকিউদ্দিনের হাতে কি পরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট আছে।

তকিউদ্দিন আরো একটি কাজ করলেন। বিলডনের রসদপত্র সবই তিনি দখল করে নিলেন। বিলডন বাধ্য হয়ে খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ের জন্য স্থানীয় লোকদের দ্বারস্থ হলেন। এই সব সামগ্রী সরবরাহকারীদের মধ্যে তকিউদ্দিন গোয়েন্দা ঢুকিয়ে দিলেন। তারা শত্রুদের সর্বশেষ অবস্থাও প্রতিদিনই তকিউদ্দিনকে জানিয়ে দিতে লাগল।

একদিন এই গোয়েন্দারের একজন শত্রুদের বিরাট খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিল। এই খড় তারা সংগ্রহ করেছিল তাদের ঘোড়া ও উটের জন্য। এভাবেই চলছিল তকিউদ্দিনের অপারেশন।

একদিন তকিউদ্দিন সংবাদ পেলেন, দামেশক থেকে সামান্য সৈন্য ও কিছু রসদ আসছে। হলব থেকে কোন সাহায্য পাওয়অর আশা তাকে ত্যাগ করতে হলো। আল মালেকুস সালেহ পত্রের উত্তরে লিখলো, ‘সম্রাট ফ্রাঙ্ক হারান দুর্ঘ অবরোধ করতে চান। যদি তিনি তাই করেন, তবে বাধ্য হয়ে হলবের সৈন্যদেরকে তার মোকাবেলা করতে হবে। এই অবস্থায় আপনার সাহায্যে এখন কোন সৈন্য পাঠাতে অপারগ আমি।’

কমান্ডো বা গেরিলা অপারেশনে তকিউদ্দিনকে অনেক বেশী মূল্য দিতে হচ্ছিল। কিন্তু তার বাহিনীর মনোবল ও জোশ এমন ছিল, কোন বিপদকেই তারা পরোয়া করতো না। ডিউটির ব্যাপারে তার সৈন্যরা ছিল সজাগ ও সতর্ক। এক মুহূর্তের জন্যও তারা ময়দান থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে প্রস্তুত ছিল না।

অধীকাংশ সৈন্য ক্রমাগত জঙ্গল, পাহাড় ও প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়াতো দুশমন এবং তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার একটু সুযোগ। এমনকি তারা জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ক্যাম্পেও ফিরে আসতে চাইতো না। তারা চিতাবাঘের মতই শিকারের অন্বেষণে ব্যস্ত থাকতো। আর হাতের কাছে শিকার পেলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো চিতাবাঘের মতই ক্ষীপ্র ও বেপরোয়া। এতে তাদের জীবনের নিরাপত্তা আদৌ আছে কিনা সে কথা কেউ চিন্তা করতো না। তারা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তাদের মনে কোন দুঃখ বা চিন্তা ছিল না।

তাদের মাত্র একটাই লক্ষ্য, কেমন করে শত্রুর অধিক থেকে অধিকতর ক্ষতি সাধন করা যায়। দুশমনের মোকাবেলা করতে গিয়ে যদি তাদের জীবন যায় কিংবা গুরুতর আহত হতে হয়, তাহলে তাকে তারা বিপদ মনে না করে নিজের ওপর আল্লাহর রহমত মনে করতো। ভাবতো, আল্লাহ তাকে তার দ্বীনের জন্য কবুল করে নিয়েছেন।

এভাবেই তাদের রাতগুলো ময়দানে ও নির্জন পাহাড়ে, অরণ্যে অতিবাহিত হতো। ক্রুসেড বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা এতটাই মারমুখী হয়ে উঠেছিল যে, সময় মত নাওয়া খাওয়ার কথাও তারা প্রায়ই ভুলে যেতো।

ওদিকে কায়রোর অবস্থা ছিল ভিন্নরূপ। কায়রো ও তার আশপাশে এলাকাগুলোতে গুজবের তুফান বইছিল। কে যে এই গুজব ছড়াচ্ছিল তা সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। কারণ কম-বেশী সবাই গুজব ছড়াচ্ছিল। কেউ ছড়াচ্ছিল বুঝেশুনে আবার কেউ ছড়াচ্ছিল না বুঝে। কেউ কেউ এমনও ছিল, গুজব থামাতে গিয়ে সে আরো বেশী করে ছড়িয়ে দিচ্ছিল গুজব। যেমন, কারো সাথে দেখা হলো, আর সে লোকটিকে বলে দিল, ‘আর যাই বলো, আইয়ুবীর সৈন্যরা নারীদের ওপর হাত তুলেছে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।’

যে লোকটি এই কথা শুনলো, হয়তো আইয়ুবীর সৈন্যরা নারীদের ওপর হাত তুলেছে এ অভিযোগটিই সে উতিপূর্বে শোনেনি। অভিযোগটি বক্তার মত সএো বিশ্বাস করেনি, তাই ক্ষিপ্ত হয়ে সে তার পরিচিত কাউকে গিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, মানুষের আক্কেলটা কি বলো দেখি! একটা যুদ্ধে না হয় হেরেই গেছে, তাই বরে তারা নারী নির্যাতন করেছে ্মন মিথ্যা অভিযোগ কিভাবে মানুষ া্ইয়ুবীর ওপর আরোপ করে, বলো দেখী?’ এভাবে তৃতীয় ব্যক্তিটিও জেনে গেল আইয়ুবীর ওপর আরোপিত একটি মথ্যা অভিযোগ।

এভাবে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে গুজব ও অপ্রপ্রচার খুব জোরেশোরেই চলছিল। যে গুজবটি খুব তোড়েজোড়ে চলছিল তাহলো, মুসলিম মুজাহিদরা এখন পাপিষ্ট ও বিলাসপ্রিয় হয়ে গেছে। রমলার পরাজয় তাদের সে পাপের শাস্তি।

কায়রো ইন্টেলিজেন্স এসব গুজবের উৎপ্তিস্থল আবিষ্কারের জন্য হন্যে হয়ে ছুটাছুটি শুরু করল। এই গুজব কোথা থেকে উদয় হয় জানা নেই কারো। গোয়েন্দারা অনেক ভেবে দেখল, নতুন সৈন্যদের অসাবধান কথাবার্তা থেকে এসব গুজব জন্ম নিতে পারে। আর পারে শত্রুদের সুরপরিকল্পিত তৎপতরার মাধ্যমে। দুশমনদের এজেন্টরা কোথায় ঘাপটি মেরে আছে জানা নেই আমাদের। এই গুজবের উৎস খুঁজে বের করার জন্য অন্তত একজন এজেন্ট এখন হাতে পাওয়া দরকার।

আইয়ুবীর পক্ষ থেক নতুন সৈন্য ভর্তি করার ঘোষণা প্রচার করা হলো। আশা করা গিয়েছিল, পরাজয়ে প্রতিশোধ নিতে জেহাদের জযবা নিয়ে অনেকেই নতুন করে সেনাবহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য ছুটে আসবে। কিন্তু দেখা গেল, জনতার মধ্যে জেহাদের সেই প্রেরণা নেই। সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য দলে দলে লোক ছুটে আসার পরিবর্তে জনতার মধ্যে বিরাজ করছে এক ধরনের অনাগ্রহ ও অনীহা। কিন্তু পরাজয়ের আগে মিশরের জনমনে এমন ভাব ছিল না।

আইয়ুবী বুঝলেন, জনগণের এ অনাগ্রহের পেছনে কাজ করছে গুজবের ঘুনপোকা। এই পোকা সবার অলক্ষ্যে সমাজদেহকে ভেতর থেকে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলছে। যদি অচিরেই এ পোকা নিধন করা না যায় তবে যে কোন সময় তাসের ঘরের মতই এ সমাজ তছনছ হয়ে যাবে।

গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী পরিস্থিতির নাজুকতা উপলব্ধি করে শিউরে উঠলেন। তিনি আবার তলব করলেন গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান ও পুলিশ প্রধান গিয়াস বিলকিসকে। তাদের সামনে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘যে কোন মূল্যে এই গুজবের তুফান ঠেকাও, নইলে কোন কাজই সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়া সম্ভব হবে না।’

চিন্তিত মনে কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন আলী বিন সুফিযান। তাঁর চৌকস গোয়েন্দা কমাণ্ডারদের ডেকে বললেন, ‘শহর নয়, শহরের আশপাশের গ্রামগুলোতে তীক্ষ্ণ নজর ফেলো। এটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। কেউ বা কোন সংঘবদ্ধ চক্র এ গুজব ছড়াচ্ছে। কেন ছড়াচ্ছে তা আমরা জানি, কিন্তু কারা ছড়াচ্ছে তা জানি না। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। অবশ্যই এই দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করতে হবে। আজ, এখন, এই মুহূর্ত থেকে এর হদিস না পাওয়া পর্যন্ত কারো ঘরে ফরা হারাম। গ্রুপ হবে মাত্র দু’জনের পালা করে চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি অব্যাহত রাখতে হবে। তোমরা গ্রুপ ঠিক করে নাও এবং এলাকা নির্দিষ্ট করে কাজে নেমে পড়ো।’

তিনি বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, তোমরা যদি পরিপূর্ণ একাগ্রতার সাথে কাজে লাগতে পারো নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন। সুলতান বড় অস্থির অবস্থায় আছেন। তোমরা সফল হরেই কেবল তার অস্থিরতা কমতে পারে।’

এক কমাণ্ডার বললোন, ‘আপনি দোয়া করুন, আল্লাহ সহায় হলে আগামী চব্বিশ ঘন্টার ভেতরই  আমরা সুলতানের পেরেশানী দূর করার দাওয়াই নিয়ে আপনার কাছে হাজির হয়ে যাবো।

চৌকস গোয়েন্দারা এবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আলী শহল এবং শহরের আশপাশের গ্রামগুলোতে জালের মত বিছিয়ে দিলেন তার গোয়েন্দাদের। দিন চলে গেল, কিন্তু একজন গোয়েন্দাও নতুন কোন সংবাদ নিয়ে ছুটে এলো না তার কাছে। সুলতান আইয়ুবী এবং তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ণাম ছড়ানোও বন্ধ হল না।

সেই কালো দাড়িওয়ালা হুজুর, যে তার দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে শহরতলীর এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন, বহার তবিয়তেই তিনি তার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গ্রামবাসীরা তাকে একটি বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছে। তিনি সেই বাড়ীতে বসে নিত্যনতুন গুজব জন্ম দিচ্ছিলেন আর তার ভক্ত সৈনিকেরা সেই গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছিল মুখ থেকে মুখে।

হুজুর খুব সতর্কতা অবলম্বন করে কাজ করছিলেন। জনসমক্ষে না এসে তিনি তার সব কথাই তুলে দিচ্ছিলেন তার একান্ত ভক্ত অনুরক্তদের কাছে। ভক্তদের তিনি বললেন, ‘মিশরে পাপী সৈনিকদের পাপ মোচনের জন্য আমি তিন মাসের চিল্লা শুরু করেছি। এ সময় আমি একান্ত ভক্ত কয়েকজন ছাড়া আর কারো সথে দেখা সাক্ষাত করবো না। তাতে আমার ধ্যানের ক্ষতি হবে।’

হুজুর এখন বাড়ী থেকে সামান্যই বের হন। কোন দর্শনার্থী এলেও তাদের সাথে কথা বলেন না। সারাক্ষণ ধ্যানমগ্ন থাকেন। নিরবে এবাদত বন্দেগী করেন আর কেউ ছালাম দিলে ইশারায় ছালামের উত্তর দিয়ে আবার মগ্ন হয়ে পড়েন ধ্যানে।

তার বিশেষ সঙ্গীদের মধ্যে সেই দু’জনও রয়েছে যারা রাস্তায় টিলার মাঝে তাকে সিজদা করেছিল। তারা এবং গ্রামের যেসব সৈন্যরা তার সাথে রমলা থেকে কায়রো ফিরেছিল সবাই হুজুরের সুখ্যাতি ছড়াতে লাগলো।

হুজুরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনে দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা তার সাক্ষাণ লাভের আশায় সেই বাড়ী এসে ভীড় জমাতে লাগলো। হুজুরের পরিবর্তে এইসব জনতাকে সামাল দেয়ার দায়িত্ব পালন করতো সেই দুই লোক।

সেদিন সন্ধ্যায় আলী বিন সুফিয়ানের এক গোয়েন্দা তার ডিউটি চালাতে গিয়ে কায়রোর সন্নিকটে সেই গ্রামে গিয়ে পৌঁছলো। গোয়েন্দাটি ছদ্মবেশে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে গ্রামের বড় মসজিদের কাছে চলে এলো।

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। গোয়েন্দাটি মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে প্রবেশ করলো। নামাজ শেষে মুসল্লীদের নিয়ে ইমাম সাহেব দোয়া করলেন।

মোনাজাত শেষ হলে এক মুসল্লী রমলার পরাজয়ের প্রসঙ্গ তুলল। বলল, ‘হুজুর আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। হুজুর ঠিকই বলেছেন, জয়-পরাজয় আল্লাহর হাতে। আইয়ুবীর ওপর নাখোশ হয়েছেন বলেই আল্লাহ এই জিল্লতি ও গজব চাপিয়ে দিয়েছেন আমাদের ওপর। কারণ আমাদের টাকা দিয়েই প্রতিপালিত হয় তার সেনাবাহিনী। আমরা টাকা দেই দ্বীনের তরক্কীর জন্য, আর সেই টাকায় প্রতিপালিত সেনাবাহিনী ময়দানে গিয়ে মেতে উঠে বর্বরতায়। ফলে তাদের পাপ তো আমাদেরকে স্পর্শ করবেই! আর পাপ করলে গজব যে নেমে আসে এ কথা কার না জানা?’

গোয়েন্দাটি মুসল্লীদের সাথে মিশে তার কথা শুনছীল, হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো, ‘কোন হুজুরের কথা বলছেন?’

‘কেন, আপনি জানেন না, আমাদের গ্রামের সৈন্যরা যখন রমলা থেকে ফেরার পথে মরতে বসেছিল তখন এক কামেল হুজুর তাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি গায়েবের খবর জানেন। জ্বীনেরা তার খাবার পৌঁছে দেয়।’

লোকটি কালো দাড়িওয়ালা হুজুর কি করে তাদেরকে বিরাণ মরুভূমি থেকে উদ্ধার করেছিল তার পূর্ণ কাহিনী বর্ণনা করে বলল, ‘হুজুর যদি সেদিন গায়েবী শক্তির দ্বারা খাবার ও পানি সরবরাহ না করতেন, তবে মরুভূমিতেই আমাদের মৃত্যু হতো। তিনা না থাকলে আমরা কোনদিনই আর বাড়ী ফিরে আসতে পারতাম না।’

গোয়েন্দা লোকটি তো বটেই এমনকি উপস্থিত সকল মুসল্লী তার কথা প্রচণ্ড আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে শুনলো। তার কথা যখন শেষ হলো তখন মুসল্লীরা তাকে ঘিরে ধরে নানা প্রশ্ন করতে লাগলো। কেউ বললো, ‘তিনি কি মানুষের মনের আশা পুরণ করতে পারেন?’

অন্য একজন বললো, ‘দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের কি তিনি আরোগ্য করতে পারেন?’

কেউ হয়তো বললো, ‘তিনি কি সত্যি গায়েব জানেন? ভবিষ্যতের কথা বলতে পারেন?’

অন্য জন প্রশ্ন করে বসলো, ‘তিনি কি বন্ধ্যা নারীকে সন্তান দিতে পারেন?’

লোকটি জবাবে বলছিল, ‘তিনি সব পারেন, সব পারেন।’

গোয়েন্দা আবার প্রশ্ন করলো, ‘আইয়ুবীর পরাজয় সম্পর্কে তিনি ঠিকই বলেছেন। কথায় বলে না, পাপ বাপকেও ছাড়ে না।’

লোকটি বললো, ‘হুজুর বলেন, সুলতান আইয়ুবী ও তার সৈন্যদের মাঝে ফেরাউনী চাল চলন শুরু হয়ে গেছে। সে জন্য আল্লাহ তাদের ওপর নাখোশ হয়েছেন। আইয়ুবীর পরাজয়ের এটাই নাকি মূল কারণ। এখন যারা আইয়ুবীর পক্ষে যাবে তারা সবাই আল্লাহর ক্রোধের মধ্যে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই আমি ঠিক করেছি আমি নিজেও সেনা দলে থাকবো না এবং কাউকে সেনা দলে ভর্তিও হতে দেবো না।।’

‘আপনি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অস্তমিত সূর্যের সংগী হওয়া উচিত নয় কারো। ডুবন্ত তরীতে কে থাকতে চায়? কেউ এখন সুলতানের সেনাদলে ভর্তি হলে সে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। যার সামান্য বুদ্ধি আছে সে কেন এমনটি করবে?’

‘তবে হুজুর বড়ই মেহেরবান। তিনি মিশরবাসীর পাপ মোচনের জন্য তিন মাসের চিল্লায় বসেছেন। হুজুরের চিল্লা এখনো শেষ হয়নি। চিল্লা শেষ হলে তিনি বলতে পারবেন আমাদের পাপ ক্ষমা হয়েছে কিনা?’

লোকটি মসজিদ থেকে বের হয়ে বাড়ীর দিকে হাঁটা দিল। আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা লোকটিকে অনুসরণ করে পথে তাকে পাকড়াও করে বললো, ‘ভাই, আমার একটু উপকার করবেন? আমি হুজুরের সথে একটু দেখা করতে চাই, একটু ব্যবস্থা করে দেবেন?’

‘হুজুরের সাথে দেখা করবেন? কিন্তু তিনি তো সারাক্ষণ ধ্যাণমগ্ন থাকেন, কোন কথা বলেন, না।’

‘ভাই, আপনি জানেন না আমি কি বিপদে আছি।’ সে তার অভিপ্রায় বর্ণনা করে বললো, ‘আমি এখনও সেনাবাহিনীতে আছি। আপনার কথা শুনে আমার মনে খুব ভয় হচ্ছে।যে সৈন্যদলের পাপের কারণে এ গজব নেমে এসেছে সে শাস্তিতো আমাকেও ভোগ করতে হবে। আমিও হলবের রণাঙ্গনে গিয়েছিলাম। আমিও সে পাপ করেছি যে কথা আপনি বলেছেন। এখন আমার কি হবে? আমার তো বাঁচার কোন উপায় নেই। আমার ওপর একটু সহম করুন। আমাকে সেই মহান হুজুরের কাছে নিয়ে চলুন, যিনি আপনাদেরকে মরুভূমিতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন।

লোকটি থমকে দাঁড়াল। আনিসের দিকে ফিরে বলল, ‘বলো কি! তোমার মাথার ওপর তো তাহলে সাক্ষাত যম ঘুরাফেরা করছে!’

‘হ্যাঁ, সেজন্যই তো আমি হুজুরের মদদ চাই। তিনি যদি বলেন, তাহলে আমি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যাবো। আমার পাপের কাফফারা হিসাবে তিনি যা করতে বলবেন, আমি তাই করব। যদি তিনি আমাকে প্রাণে বাঁচাতে পারেন এবং পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন তবে আমি সারা জীবন তার খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দেবো। আল্লাহর গজবের কথা শুনে আমার অন্তরে এমন ভয় ঢুকে গেছে যে, এখন আমি আর কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। আপনি আমাকে বাঁচান, আমাকে হুজুরের কাছে নিয়ে চলুন।’

তার কণ্ঠ থেকে করুণ অনুনয় বেরিয়ে এলো, চোখ দিযে বেরিয়ে এলো অশ্রু ধারা।

গোয়েন্দাটির কণ্ঠের করুণ অকুতি দেখে লোকটির মায়া হলো। বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি আমার সাথে চলো। কিন্তু একটা কথা, কাউকে বলবে না যে তুমি তাঁর সাথে দেখা করেছো। কারণ তিনি এখন চিল্লাতে আছেন। চিল্লায় থাকা অবস্থায় সাধারণত তিনি কারো সাথে কথা বলেন না। তবে জরুরী কিছু হলে ভিন্ন কথা।’

‘তিনি আমার জন্য দোয়া করবেন কিনা এটা কেমন করে বুঝবে?’

‘তোমাকে দেখে যদি তাঁর দয়া হয় তবে নিজ থেকেই তিনি তোমার সাথে কথা বলবেন। তিনি যা জিজ্ঞেস করবেন শুধু তারই উত্তর দেবে। আজেবাজে কিছু জিজ্ঞাসা করে তাঁকে বিরক্ত করবে না।’

‘না, বিশ্বাস করুন, তিনি রাগ করতে পারেন এমন কিছুই আমি করবো না। শুধু ভয় পাচ্ছি, আমি তো পাপী মানুষ, তিনি না আবার আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেন!’

‘আরে না, তুমি জানো না, তিনি কেমন রহমদীল মানুষ। তাঁর মহত্ব আর মোজেযা দেখেছি আমরা যারা রমলার রণাঙ্গন থেকে তার সাথে একত্রে ফিরে এসেছি। আমাদের বাঁচার কোন আশাই ছিল না। আমরা সবাই ছিলমা পাপী। কিন্তু তিনি আমাদের ঘৃণা না করে যেভাবে আমাদের বুকে টেনে নিয়েছিলেন, সেটা কেবল তাঁর মত মহৎ লোকের পক্ষেই সম্ভব। তুমি পাপী বলেই তো তিনি তোমাকে আশ্রয় দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বেশী করে উপলব্ধী করবেন।’

‘আপনি তো এই গ্রামেরই বাসিন্দা? তাছাড়া আপনি তাঁর সাথে কঠিন সময়ে সফর করে বেরিয়েছেন। ফলে হুজুরকে আপনি যত গভীর ভাবে জানেন সবার পক্ষে কি হুজুরকে সেভাবে চেনা সম্ভব? হুজুরের যত কেরামতি তার খবর আপনার চাইতে আর কে বেশী জানবে!’

‘এ জন্যই তো আমি কোরআন স্পর্শ করে বলতে পার, এই হুজুর আল্লাহর অতি প্রিয় সঙ্গীদের একজন।’ লোকটি আরো বললো, ‘আমি যুদ্ধক্ষেত্রের অভিশাপ দেখেছি, হয়তো অনেকেই আমার মত তা দেখেছে। কিন্তু এই হুজুর যেভাবে মরুভূমিকে শস্যক্ষেত বানিয়ে দেখিয়েছেন, আমি হলপ করে বলতে পারি, তেমনটি আর কেউই দেখেনি। সেজন্যই তো আমি আর সেনাবাহিনীতে ফিরে না গিয়ে এই হুজুরের খেদমতে জীবন পার করে দেয়ার মনস্থ করেছি।’

মসজিদ থেকে গ্রাম বেশী দূরে ছিল না। তারা কথা বলতে বলতে গ্রামে পৌঁছে গেল। ততক্ষণে গ্রাম জুড়ে নেমে এসেছে রাতের অন্ধকার।

একটি বাড়ীর দরজায় গিয়ে লোকটি আনিসকে বল, ‘তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি হুজুর কি অবস্থায় আছেন। তাঁর অনুমতি পেলেই আমি এসে তোমাকে ভেতরে নিয়ে যাবো।’

বাইরে রাতের আঁধারে দাঁড়িয়ে রইলো আনিস। সঙ্গের লোকটি বাড়ীর মধ্যে চলে গেল। হুজুরের সাথে লোকটির কি কথা হলো শুনতে পেলো না আনিস। সে চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল।

একটু পর ফিরে এলো লোকটি। তাকে বললো, ‘তোমার ভাগ্য ভাল, হুজুর তোমার সথে কথা বলতে সম্মত হয়েছেন।’ তার পর বললো, ‘এদিকে এসো।’

লোকটি নিজে আগে আগে চললো আর তাকে অনুসরণ করলো গোয়েন্দা আনিস। একটু পর দু’জনেই উঠান ও বারান্দা পার হয়ে এক কামরার মধ্যে প্রবেশ করলো।

বারান্দায় আলো জ্বলছিল। হুজুরের কন্যা পরিচয়ে যে মেয়ে দু’টি তার সঙ্গে এসেছিল তারা ছিল অন্য কামরায়। হুজুরের কামরায় যাওয়ার জন্য উঠান পেরিয়ে ওরা বারান্দায় উঠে এলো। তাদের পায়ের ধ্বনি শুনতে পেয়ে মেয়েরা জানালা দিয়ে দেখতে গেলো কে আসছে, আর তখনি একটা মেয়ে তাদের দেখে এমনভাবে চমকে উঠলো যে, তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো বিস্ময়সূচক ধ্বনি, ‘হ্! হায়!’

অন্য মেয়েটি তাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি হলো? এ লোক কে?’

‘মনে হয় আমার ধাঁধাঁ লেগেছে।’ মেয়েটি উত্তরে বললো, ‘আমি এই লোককে কোথায় যেন দেখেছি।’ এই বলে সে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল।

গোয়েন্দা কামরায় ঢুকে কালো দাড়িওয়ালা হুজুরের সামনে সিজদায় পড়ে গেল এবং তাঁর পায়ের উপর কপাল ঠেকিয়ে ওভাবেই পড়ে রইল।

হুজুর বিছানায় মখমলের চাদরের ওপর বসেছিলেন। আনিস হুজুরের পায়ের ওপর মাথা রেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার চোখের পানির স্পর্শ পেলেন হুজুর। তিনি আস্তে আস্তে তার একটি হাত আনিসের মাথায় ওপর দিয়ে স্নেহের কণ্ঠে বললেন, ‘ভয় পাসনে। আল্লাহ তওবাকারীকে খুবই পছন্দ করেন। উঠ্ বল তোর কি সমস্যা।’

গোয়েন্দা হুজুরের পায়ের ওপর থেকে মাথা তুলে গদগদ কণ্ঠে বললো, ‘হুজুর, আমি পাপী। আল্লাহর গজব আমাকে ঘিরে ফেলেছে। আমাকে বাঁচান।’ তার কণ্ঠে ব্যাকুলতা।

গোয়েন্দা নিজেকে সেনাবাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমরা জঘন্য পাপে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেই পাপের শাস্তি দেয়া শুরু হয়ে গেছে। আপনার দোয়া ছাড়া এই পাপের শাস্তি থেকে কেউ রেহাই পাবে না। একমাত্র আপনিই পারেন শাস্তির হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে, যেমন মরুভূমিতে আপনি দয়া করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন এই প্রামের পাপী সৈনিকদের। আপনি যদি আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচান, সারা জীবন আমি আপনার গোলাম হয়ে থাকবো। আল্লাহরওয়াস্তে আমার ওপর রহম করুন। আমাকে মুক্ত করুন আমার পাপ থেকে।’ তার চোখে অশ্রু টলমল করছিল।

আনিসের কথা আর কণ্ঠের কাকুতি শুনে হুজুর হাতের তসবিহ তার মাথার ওপর রেখে হেসে উঠে বললে, ‘যুবক, প্রায়শ্চিত্য না করলে যে তোমার পাপ মোচন হবে না।’

‘আপনি আমাকে যা খুশী শাস্তি দিন।’ আনিস চোখের অশ্রু ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘আপনি আমাকে আদেশ করুন যাতে আমি আপনার আদেশ পালন করে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে পারি। আমার একটি মাত্র সন্তান আছে, আপনি হুকুম দিলে আমি তাকে আপনার পদতলে সোপর্দ করবো। আপনি আদেশ দিলে আমি সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য ছুটে যেতেও দ্বিধা করবো না। আমাকে আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন জানতে পারলে আমি আপনার যে কোন আদেশ ও শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত। আপনার আদেশ পালনে আমি কখনোই কোন অবহেলা করবো না।

আপনি কিছু বলুন! কিছু আদেশ করুন! দেখুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি।’

গোয়েন্দা যখন কথা শুরু করেছিল, সে সময় এক লোক কামরায় প্রবেশ করে দেখলো আনিস হুজুরের পা  ধরে বসে আছে। আনিসের কথা শুনে সে লোক বললো, ‘তুমি এত উতলা হচ্ছো কেন? এখন তো তুমি মুরশিদের ছায়ায় বসে আছো।’

‘আমার পাপ এত বেশী যে, পাপের চিন্তায় রাতে ঘুমাতেও পানি না।’ আনিস বললো, ‘আমি হিম্মতের কাছে এক গ্রামের এক মুসলিম পরিবারের সুন্দরী এক মেয়েকে কিডন্যাপ করতে গিয়ে তার ছোট ভাইকে হত্যা করে ফেলি। যদি আমি সেনাবাহিনীর লোক না হতাম তবে গ্রামের লোকেরা আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতো। কিন্তু আমার হাতে অস্ত্র আর পরণে সেনাবাহিনীর পোশাক থাাকায় আমাকে কেউ কিছু বলার সাহসও পায়নি।’

তার কথা শুনে হুজুর চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আনিস তাকিয়ে দেখলো হুজুরের ঠোঁট নড়ছে। সহসা তিনি তার হাত দু’টি উপরে তুলে গুম মেরে বসে রইলেন।

একটু পর তিনি হাত নামিয়ে চোখ খুললেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন আনিসের দিকে। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে একটু হেসে বললেন, ‘অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তুমি আমার কাছে এসেছো। এবার আমার কথা মনো যোগ দিয়ে শোন। আমি তোমার গোনাহখাতা মাফ করিয়ে দেবো, তবে এখন নয়। তুমি আগামী কাল আবার এখানে আসবে। কিন্তু তুমি যে এখানে এসেছো এ ব্যাপারে কারো সাথো কোন আলোচনা করবে না। যদি তেমন কিছু করো তবে তুমি তো ধ্বংস হবেই, সেই সাথে তোমার বংশও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’

হুজুর আরও বললেন, ‘কাল সন্ধ্যায় এই লোকের সথে গ্রামের বাইরে মসজিদের ওখানে দেখা  করবে। সে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। তোমার কপালে স্পষ্ট লেখা আছে, তোমার পাপরাশি ক্ষমা হয়ে যাবে এবং তোমার ও তোমার বংশের সবার উপার্জন ও রুজি এত বেড়ে যাবে, যা তুমি স্বপ্নেও কল্পনা করোনি। এখন তুমি চলে যাও, কাল আসলে আমি তোমার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করবো।’

কথা শেষ করে হুজুর আবার মুরাকাবাতে চলে গেলেন। রমলা থেকে ফিরে আসা সৈনিক ও অন্য লোকটি আনিসকে নিয়ে বাইরে এলো। তাকে উঠানে দাঁড় করিয়ে অনেক্ষণ হুজুরের মহিমা ও মোজেজার কথা বলে তাকে একেবারে অভিভূত করে ফেলল।

এই ফাঁকে মেয়ে দু’টি জানালার পাল্লার আড়াল থেকে তাকে আবারো দেখলো। যে মেয়েটি প্রথম তাকে দেখে আৎকে উঠেছিল সে তার সঙ্গী মেয়েটিকে আবারো বললো, ‘একে আমি আগেও কোথাও দেখেছি। এটা আমার দৃষ্টিভ্রম নয়, এই সে ব্যক্তি, যার ছবি আমার বুকে এখনো খোদাই করা আছে। কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না।’

ব্যাপারটা ঠিক সেই আগের ঘটনার মতই মনে হচ্ছে, যে কেসটা আমরা পূর্বেও ধরেছিলাম।’ গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান  আনিসের কাহিনী শুনে বললেন, ‘ঠিক সেই মুরাকাবা, সেই চিল্লা ও জ্বীন বশীভূত করে লোকদের মনে ভয় ও ভক্তি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তাদের তাবেদার বানানোর খেলা।’

গোয়েন্দা বলল, ‘সে মসজিদের মুসল্লীদের জড়ো করে সৈন্যদের বিরুদ্ধে এমন সব উস্কানীমূলক কথা বলছিল, যা শুনলে যে কেউ বুঝবে, এ লোক পরিকল্পিতভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।’

‘এতেই প্রমাণ হয়ে গেয়ছে, সে একা নয়। তার সাথে আরও অনেকেই আছে, যারা মসজিদে গিয়ে তার মতই মুসল্লীদেরকে সৈন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। এটা একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। নাটের গুরু ও হুজুর। আর তার শাগরেদ হয়ে এ কাজ করছে দুশমন গোয়েন্দারা। আর এদের টোপ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধে ফেরত মূর্খ কিছু সৈনিক ও হুজেরুর অন্ধ ভক্তকূল। যারা আবেগ তাড়িত এবং হয়তো অনেকেই জানেও না তারা কি করছে।’

‘যারা যুদ্ধক্ষেত্রের মিথ্যা বর্ণনা শুনাচ্ছে আর কেউ যেন সেনাবাহিনীতে ভর্তি না হয় সে জন্য মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে তাদেরকে এ কথা বলে আপনি তাদের পাপ কমাতে পারবেন না।’

‘আমি তাদের পাপ কমোনা বা বাড়ানোর কথা বলছি না। আমি তাদের বুদ্ধির তারিফ করছি।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘মসজিদে মানুষ যে কথা শোনে তাকেই তারা অহীর মত বিশ্বাস করে। মানুষ আবেগের দাস। মানুষ তাকেই মুরশিদ মান্য করে যে তার আবেগের উপর প্রথমে পা রাখতে পারে। ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য তারা ইসলামী লেবাসকেই বেছে নিয়েছে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিধর্মীরা মুসলিম সমাজের নেতৃত্বও অবলীলায় কাঁধে তুলে নিয়েছে।

আর আমাদের আলেমরা? আমাদের আলেমরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে নিজেদের ঈমান বাঁচানোর চেষ্টা করছে। যে আলেমদের দায়িত্ব মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দিক নির্দেশনা দিয়ে সত্য সঠিক পথে পরিচালিত করা, সেই আলেম সমাজই এখন বিভ্রান্ত। দুশমনের প্ররোচনায় পড়ে ইসলামের অবিভাজ্য সত্ত্বাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করেও ভাবছে, তারা সত্য-সঠিক পথে আছে। তারা দ্বীন ও দুনিয়াকে আলাদা করে ইসলামের একক সত্ত্বাকেই দু’টুকরো করে ফেলেছে। তাদেরকে কে বুঝাবে, দুনিয়ার জন্যই দ্বীন এসেছে। দুনিয়ার জীবন মানুষকে কিভাবে চালাবে দ্বীনের বিধান শুধু তাই বলা আছে। পরকালে কিভাবে চলতে হবে সে কথা দ্বীনের বিধি-বিধানে নেই, কেননা পরকালে স্বাধীনভাবে চলার কোন অধিকার মানুষের থাকবে না।’

আলী বিন সুফিয়ানের হঠাৎ সম্বিত ফিরে এলো। তিনি তত্ত্বকথার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন। আনিসের দিকে ফিরে বললে, ‘থাক এস কথা, এবার কাজের কথায় আসি। তুমি কাল সময় মত আবার সেখানে যাও। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। যেভাবে অভিনয় করছো, সেভাবেই অভিনয় চালিয়ে যাও। তাদের আরো গভীরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করো। যত বেশী সম্ভব তথ্য ও নিদর্শন জোগাড় করো। তোমার সংগৃহীত তথ্য ও নিদর্শনই আমার অভিযানের পথ খোলাসা করে দেবে। আর তার আগে তুমি আমাকে সেই বাড়ী ও গ্রাম চিনিয়ে দাও, যাতে আমি প্রয়োজনে সেখানে কমাণ্ডো অভিযান চালাতে পারি।’

আমার ভয় হয়, কমান্ডো অভিযান চালালে যদি জনগণ ক্ষেপে যায়?’ আনিস বললো, ‘রমলার সেই সৈনিক বলেছে, গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই তার মুরিদ হয়ে গেছে। এমনকি দূরদূরান্ত থেকেও লোকেরা তার দর্শন লাভের জন্য আসে।’

‘জনগণকে আমিও ক্ষ্যাপাতে চাই না। কিন্তু প্রয়োজনে কিছু ঝুঁকি নিতেই হবে। আমাদের এ কথা চিন্তা করলে চলবে না, লোকেরা কি বলবে। বরং আমাদের চিন্তা করতে হবে, লোকদের দিয়ে কি বলাতে হবে।’

আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘জনগণের আবেগ ও চেতনার মূল্য অবশ্যই দিতে হবে। তবে জনগণের সাথে কখনোই আমরা সেই আচরণ করতে চাই না, যেমনটি করে কোন ক্ষমতালোভী সরকার। ক্ষমতার স্বার্থে গণ আবেগকে নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য সত্যকে তারা মিথ্যা বলতে পারে, আবার মিথ্যাকেও সত্য বলে চালিয়ে দিতে পারে। এমনটি শুধু সেই সরকারই করতে পারে, শাসন ক্ষমতা যাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

কিন্তু মনে রেখো, আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এ জন্য তিক্ত সত্যকেও দরকার হলে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে আল্লাহর ভয়কে সামনে রেখে। জনগণকে খুশী রাখতে গিয়ে এমন কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভ হবে না, যাতে আল্লাহ নাখোশ হন।’

গোয়েন্দা বললো, ‘আপনার নসিহত আমার মনে থাকবে।’

‘আমাদেরকে যেকথাটি সব সময় মনে রাখতে হবে, তা হলো, ইসলামী রাষ্ট্র ও কোরআনী শাসনতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব চেপে আছে আমাদের কাঁধে। আমরা জনগণকে বাস্তবতা বুঝাতে চাই, সত্যের পথে পরিচালিত করতে চাই। কিন্তু আমরা কখনোই তাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর মুরীদ বা গোলাম বানাতে চাই না।

আমাদের কাছে মানুষ হিসাবে সুলতান আইয়ুবী যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ দেশের অন্য যে কোন জনগণ আমরা তার হাতকেই শক্তিশালী করতে চাই যিনি ইসলামের অনুসারী ও খাদেম। তেমনি আমাদের কাজ ইসলামের শত্রুদের চিহ্ণিত করা এবং তাদের প্রতিহত করা।

আমরা জাতির বুকে হাত বুলিয়ে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাই না, আমরা জাতিকে বাস্তবতার ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিতে চাই। তুমি গিয়ে সেই সূত্র অন্বেষণ করো যা তুমি দেখোনি। আমার বিশ্বাস, তুমি এমন কোন নিদর্শন পেয়ে যাবে, যা জনসমক্ষে তুলে ধরলে এসব ভণ্ড হুজুরদের বিরুদ্ধে তোমাকে কিছুই করতে হবে না, বরং ইসলামের প্রতি সামান্য মোহাব্বত পোষণকারী যে কোন ব্যক্তি তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলার জন্য জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত হয়ে যাবে।’

সন্ধার পর গোয়েন্দাটির সেখানে পৌঁছার কথা। দুপুরে আলী বিন সুফিয়ান তার পোষাক পরিবর্তন করে সেই গ্রামের দিকে যাত্রা করলেন। তাকে দূর থেকে পথ দেখিয়ে চললো সেই গোয়েন্দা।

বাড়ীটার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন তারা। ইশারায় বাড়ীটি দেখিয়ে দিল আনিস। আলী বিন সুফিয়ান বাড়ীটির অবস্থান ও চৌহদ্দি ভাল করে মনের ভেতর গেঁথে নিলেন। চারদিকটা ঘুরে ফিরে দেখার জন্য আপন মনে পা চালালেন।

বাড়ীর আশপাশের লোকালয়, দোকানপাট দেখলেন। টের পেলেন বাড়ীতে যারা আসা যাওয়া করছে তাদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে।

তিনি রাস্তার ধারের এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লোকজনের কথা বার্তা শোনলেন। তাদের কথাবার্তা শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এখানেও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনমনে ঝড় তোলার জন্য নানা রকম কুৎসা রটনা করা হচ্ছে একই কায়দায়।

আলী বিন সুফিয়ান দূর থেকে বাড়ীর পেছন দিকটা লক্ষ্য করলেন। বাড়ীর পেছন দিকে ছোট একটা খিড়কি দরজা। দরজাটা বন্ধ। এ পর্যন্ত একবারও কাউকে খুলতে দেখা যায়নি। দরজার পাশেই একটা গাছ। গাছটা বাড়ীর দেয়াল ছাড়িয়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে।

বাড়ীটির ডানে এবং বামেও দু’টি বাড়ীর পেছনে আঙ্গিনা। সেদিকে কোন মানুষজন নেই। মানুষের ভীড় সামনের দিকে। তখনো তাঁর দৃষ্টি বাড়ীর পিছন দরজা ও তার আশপাশের এলাকাতেই ছিল। হঠাৎ তাঁকে অবাক করে দিয়ে বাড়ীটির পেছন দরজা খুলে গেলো। তিনি তাকিয়ে দেখলেন, সাদা দাড়িওয়ালা এক লোক ময়লা একটা পুরণো জোব্বা পরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে।

চকিতে আলী বিন সুফিয়ানের দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়লো খোলা দরোজার ভেতর। সেখানে এক সুন্দরী যুবতী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি বেরিয়ে যেতেই মেয়েটি চটজলদি দরজা বন্ধ করে দিল।

সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লাঠি ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে ঝুঁকে পথ চলে গ্রাম থেকে বের হয়ে গেল। আলী বিন সুফিয়ান লোকটির পিছু নিলেন।

গ্রামের বসতি এলাকার বাইরে এসে বুড়ো এক কাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেল। তার পর অনুসন্ধানী চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।

একটু পর একদিক থেকে এক অশ্বারোহী এসে সেই গাছের ছায়ায় থামলো এবং ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে ঘোড়াটি তুলে দিল বৃদ্ধের হাতে। সধা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধা সেই ঘোড়ায় চড়ে কায়রোর দিকে রওনা হয়ে গেল।

যে লোক ঘোড়া এনেছিল সে এবার হাঁটা ধরলো এবং হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেল।

আলী বিন সুফিয়ান দূর থেকেই বৃদ্ধকে অনুসরণ করছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে সব দেখলেন। লোকটি গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেলে আলী বিন সুফিয়ান ছুটলেন তার ঘোড়ার কাছে। তিনি ঘোড়ার কাছে পৌঁছেই লাফিয়ে চড়ে বসলেন ঘোড়ায়। সাদা দাড়িওয়ালাকে অনুসরণ করার জন্য নিজেও ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে ধরলেন কায়রোর দিকে।

আলীর বুঝতে বাকী রইলো না, এই বৃদ্ধ আসলে ঝানু গোয়েন্দা। লোকটি বৃদ্ধ নয়, কিন্তু বুড়োদের আচরণ সে নিখুঁতভাবেই করে দেখিয়েছে। গোয়েন্দাবৃত্তিতে সব ধরনের ট্রেনিংই আছে লোকটির। অতএব সতর্কতার সাথেই তাকে অনুসরণ করা দরকার।

আলী বিন সুিফিয়ান নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পথ চলছেন। তার চালচলনে কোন অস্থিরতা বা তাড়াহুরো নেই।

সেই সাদা দাড়িওয়ালা কয়েকবার পিছনে তাকালো। দু’একবার থেমে গভীরভাবে পেছনে লক্ষ্য করে দেখলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা। কি বুঝলো সেই জানে আবার চলতে শুরু করলো।

আলী বিন সুফিয়ান তাকে অনুসরণ করা অব্যাহত রাখলেন।

কায়রো এখান থেকে আর বেশী দুরে নেই। দূর থেকে দেখা যায় শহরের প্রসাদ চূড়া। হঠাৎ সাদা দাড়িওয়ালা কায়রোর রাস্তা ছেড়ে ডান দিকের অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তায় নেমে গেল। ঘোড়ার গতি স্বাভাবিক। তার চালচলনেও কোন অস্বাভাবিকতা নেই।

এটা কি পেছনের অশ্বারোহী তাকে অনুসরণ করছে কিনা দেখার জন্য, নাকি এটাই তার গন্তব্য পথ বুঝতে পারলেন না আলী বিন সুফিয়ান। তিনি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলনে। যদি তাকে পরীক্ষা করার জন্য লোকটি রাস্তা ছেড়ে থাকে তবে তার পিছু নিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। আবার পিছু না নিলে লোকটিকে হারাতে হবে। কি করবেন খানিক ভাবলেন তিনি, শেষে নিজেও অশ্বের গতি ও মুখ বৃদ্ধের ফেলে যাওযা পথেই ঘুরিয়ে ধরলেন।

কায়রো শহর দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সেদিকে গতি ছিল না ওদের কারো। ওরা যে পথে এগুচ্ছিল তার দু’পাশ এদিক ওদিক একটি দু’টি কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে। কোথাও যাযাবরদের অস্থায়ী তাবু।

সাদা দাড়িওয়ালা একাধিকবার রাস্তা পরিবর্তন করলো। বার বার পিছন ফিরে দেখলো আলী বিন সুিফিয়ানকে। আলী বিন সুফিয়ানের লুকোবার কোন পথ ছিল না, বাধ্য হয়ে তিনি লোকটির পিছনেই লেগে রইলেন।

সাদা দাড়িওয়ালার মধ্যে অস্থিরতা জন্ম নিল। সেই অস্থিরতা প্রকাশ পেতে লাগলো তার তৎপরতায়। অনেক হিসেব করে দেখলো, যত দ্রুতই ঘোড়া ছুটানো হোক না কেন, অনুসরণকারীকে কিছুতেই খসানো যাবে না।

শেষে লোকটি তার চলার গতি আবার কায়রোর দিকে ফিরালো এবং গতি বাড়িয়ে দ্রুত ছুটতে শুরু করলো। আলী বিন সুফিয়ানও ঘোড়ার লাগামে ঝটকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল ঘোড়ার গতি। দ্রুত ঘোড়া দু’টি দিক পরিবর্তন করে কায়রোর দিকে ছুটতে লাগলো।

আলী বিন সুফিয়ান লোকটিকে ধরার জন্য প্রচণ্ড জোরে চাবুক কষলেন ঘোড়ার পিঠে। ক্রমে উভয়ের মাঝখানের দূরুত্ব কমে আসতে লাগলো। ছুটতে ছুটতে তারা শহরের একদম কাছে এসে গেল। আরেকটু পরেই সাদা দাড়িওয়ালা শহরে প্রবেশ করবে।

ওদের মাঝে তখন দূরত্ব মাত্র পনেরো বিশ গজ। সাদা দাড়িওয়ালা লোকটি শহরে ঢুকার আগ মুহূর্তে ঘোড়া থামিয়ে মোকাবেলার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

আলী বিন সুফিয়ানের পথ রোধ করে ধরতেই তিনিও দ্রুত তার অশ্বের লাগাম টেনে ধরলেন।

‘তোমাকে কোন ডাকাত বলে মনে হচ্ছে।’ সাদা দাড়িওয়ালা এই বলে খঞ্জর বের করলো আর বললো, ‘তুমি ভুল ঠিকানায় পা দিয়েছো। আমার কাছে তেমন মূল্যবান কিছু নেই। আমার পিছনে কেন লেগেছো?’

আলী বিন সুফিয়ান বুড়োকে কাছ থেকে দেখলেন। দাড়ি দেখে মনে হয় লোকটি সত্তর আশি বছরের হবে। কিন্তু তার চেহারা, চোখ ও দাঁত বলছে, এ লোকের বয়ষ ত্রিশ, চল্লিশ বছরের বেশী নয়।

আলী বিন সুফিয়ানও তখন ছদ্মবেশে। গিয়েছিলেন এক শিষ্যের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুশমন গোয়েন্দাদের একটি ঘাঁটির প্রকৃত অবস্থা জানতে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েও গিয়েছিলেন তিনি।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top