২. সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান

অন্যায় প্রতিরোধ করার শক্তি।

তুমি স্বর্ণ এবং সুন্দরী যুবতী পাওয়ার জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করনি?’

না চাইতেই এ দু’টো খোদা আমায় দিয়েছেন। কিন্তু তার ওপর আমার কোন অধিকার নেই। হয়ত তিনি আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন।

তুমি কি মনে কর তিনি তোমাকে পাপের মোকাবিলা করার শক্তি দিয়েছেন?”

‘কেন, দেখনি। তোমার স্বর্ণ এবং তোমার রূপ যৌবন আমাকে আমার কর্তব্যচ্যুত করতে পারেনি। এ হল আল্লাহর অনুগ্রহ এবং আমি তার কাছে এটাই চাই।’

তিনি কি পাপ মোচন করেন?

হ্যা, তিনি পাপ মোচন করেন। তবে শর্ত হল সে পাপ বার বার করা যাবে না।”

মাথা নোয়াল মেয়েটা। ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। কমান্ডার ওর মাথায় হাত রাখলেন। ও আহমদ কামালের হাত দু’টো ধরে কয়েকবার চুমো খেল। কামাল হাত সরিয়ে নিলেন। ও বলল, ‘আজ আমায় পাঠিয়ে দেবে কায়রো, তোমার সাথে হয়ত আর কোন দিন দেখা হবেনা। যাবার আগে আমি কে, কোথেকে এসেছি তোমাকে বলে যেতে খুব মন চাইছে। তুমি অনুমতি দিলে আমার বর্তমান অবস্থা বলব।’

যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমি নিজেই তোমার সাথে যাচ্ছি। এ ধরনের বিপজ্জনক দায়িত্ব সাধারণত আমি অন্য কাউকে দেইনা।

‘আমি কে, কোথেকে এসেছি তাও শুনবে না?

‘চল, এ কথা শোনার দায়িত্ব আমার নয়।’ বলে কমান্ডার তাবু থেকে বেরিয়ে গেলেন। –

কায়রো অভিমূখে রওয়ানা হল দু’টি ঘোড়া। সামনে আহমদ কামাল। পেছনের ঘোড়ায় চেপেছে মেয়েটা। তার পেছনে আড়াআড়িভাবে চারজন রক্ষী সেনা। সব শেষ প্রয়োজনীয় খাবার দাবার সহ একটি উট। প্রায় ছত্রিশ ঘন্টার সফর। রেশমা দু’বার কমান্ডারের পাশাপাশি চলার চেষ্টা করল।

‘তোমার ঘোড়া সৈন্যদের মাঝখানে রেখো।’ কমান্ডার বললেন।

সূর্যাস্তের পর আহমদ কামাল কাফেলা থামিয়ে তাবু টানানোর নির্দেশ দিলেন। রাতে মেয়েটাকে শোয়ালেন নিজের তাবুতে। আলো জুলছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর রাতে কারো আলতো স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখেন মেয়েটা পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। –

তড়াক করে উঠে বসলেন কমান্ডার। মেয়েটার চোখে চোখ রাখলেন। ও কাঁদছে।

আহমদ কামালের হাত নিজের দুহাতে তুলে নিল বিদেশিনী। ঠোঁট ছোঁয়াল তার হাতে। এর পর শিশুর মত ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল।

তাকিয়ে রইলেন কমান্ডার। মেয়েটা আশ্র মুছে বলল, “আমি তোমার দুশমন। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য তোমার দেশে এসেছি। এসেছি বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাদের মাঝে শক্রতা সৃষ্টি করতে। সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে হত্যা করার জন্য আমাকে ফিলিস্তিন থেকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, এখন আমার মনে কোন শক্রতা নেই।’

তুমি খুব ভীতু মেয়ে। কেন আপন জাতির সাথে গাদারী করছ। শূলির কাঠে দাড়িয়ে বল, আমি ক্ৰশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিচ্ছি।

আমার মনে শক্রতা নেই কেন জান? তুমিই প্রথম পুরুষ যে আমার অনন্য রূপ যৌবনকে ঘৃণা করেছ। প্রত্যাখ্যান করেছ আমার আহবান। আপন পর সবাই আমাকে পাওয়ার জন্য উন্মুখ। পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে, ওদের সাথে প্রতারণা করে বিলাসিতার জীবনকেই জীবনের উদ্দেশ্য মনে করেছিলাম। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমাকে ংও দেয়া হয়েছে।

তোমাদের কাছে যা অশ্লীলতা, আমাদের কাছে তা শিল্প, এক মোক্ষম অন্ত্র। ধর্ম কি জানি না, খোদার বিধান বুঝি না। শৈশব থেকে পরিচিত হয়েছি ক্ৰশের সাথে। বলা হয়েছে ক্রশ হচ্ছে খোদার চিহ্ন। খৃষ্টানদের মর্যাদার প্রতীক। সমগ্র বিশ্ব শাসন করার অধিকার কেবল ক্রশধারীদের। মুসলমানরা হচ্ছে ক্ৰশের দুশমন। ওদের কাছে এই হচ্ছে ধর্মের মূলনীতি।

ওদের ধর্মের মূলনীতি আমরা জানি। তোমার কাহিনী আমাকে বলার দরকার নেই, যা বলার কায়রো গিয়ে ব’লো।

রজব নামের কোন কমান্ডারকে চেন!”

সে ছিল খলিফার রক্ষী ফৌজের কমান্ডার। সুদানী ষড়যন্ত্রের সাথে সেও শরীক ছিল।

“এখন কোথায়?’

জানিনা, আমাদের শুধু বলা হয়েছে রজব সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে গেছে। দেখা মাত্র যেন তাকে গ্রেফতার করি। পালাতে চাইলে তীর মেরে শেষ করে দেয়ার অনুমতিও আছে। কেন? তুমি কিভাবে তাকে চেন? সে এখন কোথায় তুমি জান কিছু?

‘সে এখন সুদানে কাফ্রীদের কাছে। ওখানে আছে এক মনোরম স্থান। কাফ্রীরা ওখানেই যুবতীদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়। রজব ওখানেই আছে। ফিলিস্তিন থেকে তার সাথেই আমাদের তিনজনকে পাঠানো হয়েছে।

‘অন্য দু’জন কোথায়?’

‘ওরা মারা গেছে।’ তরুণীর কষ্ঠে বিষন্নতা। ওদের মৃত্যুই আমাকে বদলে দিয়েছে।’

‘কিভাবে ওরা মারা পড়ল?

কাফ্রীরা দু’টো মেয়েকে বলি দিতে চেয়েছে, রজব ওদের বাচানোর চেষ্টা করেনি থেকে শুরু করে ওখান থেকে পালিয়ে আসা এবং ঝড়ের কবলে দু’জনের মৃত্যুসহ সকল কাহিনী কমান্ডারকে খুলে বলল সে।

মেয়েটা আরো বলল, ‘একদিন এই আমি নিজকে শাহজাদী মনে করতাম। আমি ছিলাম সম্রাটদের হৃদয়রাণী। খোদা বা মৃত্যু আছে এ কথা কখনও ভাবিনি। আমাদেরকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল, আমরাও সানন্দে তাতেই ডুবেছিলাম। সে ছিল ভোগ বিলাসের এক মোহময় জগত।

আমাদেরকে কুমীর দেখানো হল, মস্তকবিহীন যুবতীদের দেহ যাদের আহার। কিণারে শুয়েছিল কুমীরগুলো। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। যে দেহের সামনে বড় বড় সম্রাটদের মাথা নুয়ে থাকে, সে দেহ হবে

কুমীরের খাদ্য!

আমার মাথা কাটার জন্য যে সব কুৎসিত কাফ্রীরা এসেছিল আমি তাদের দেখেছি। চোখের সামনে ভেসে উঠল মৃত্যর বিভীষিকা। আমার বিবেক জেগে উঠল। আত্মার ভেতর থেকে শব্দ হল, নিজের অনন্য রূপ আর মাদকতাময় দেহের পরিণাম দেখ।

মরণ পণ করেই বেরিয়েছিলাম আমরা। আমাদেরকে রজবের হাতে তুলে দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘এ লোকটি তোমাদের হেফাজত করবে। কিন্তু ও আমাদের দিকে লোভের হাত বাড়াল, আমরা পালালাম।

ঝড়ের কবলে পড়ে ঘোড়াগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ল। প্রথমে। একটা মেয়ে পড়ে গেল। তার ওপর পড়ল ঘোড়াটা। চেয়ে চেয়ে দেখলাম, কিছুই করার ছিল না। এরপর দ্বিতীয় মেয়েটা ঘোড়ার সাথে ঝুলতে ঝুলতে মারা গেল। ওর কলজে ফাটা চিৎকার এখনও আমি শুনতে পাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকব আমার কানে বাজতে থাকবে ওর সে বুকফাটা আর্তচিৎকার।

আমার ঘোড়াটা ছুটছিল, কিন্তু আমার বশে ছিল না। আমি তখন একা। দুটি মেয়েকে মেরে খোদা আমাকে আমার পরিণতি বুঝিয়ে দিলেন। ওরা ছিল আমারচে সুন্দরী এবং হাসি খুশী ৷ রূপ যৌবন নিয়ে ওদের অহংকার ছিল। কত রাজা বাদশাকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচিয়েছে ওরা। কিন্তু মরার পর কেউ জানলওনা, বালির পরিচয়হীন কবরে ওরা সমাহিত হয়ে আছে।

আমি নিঃসঙ্গ। ঝড়ের ভেতর থেকে ভেসে এল মৃত্যুর অট্টহাসি। ডানে বায়ে ওপরে এবং নীচে প্রেতাত্মা আর ভূতপ্রেতের ক্রুর হাসি শোনা যাচ্ছিল।

আমি বুঝতে পারছিলাম, এ সবই আমার পাপের ফল। খোদাকে মনে পড়ল। পাপের জন্য তার কাছে বার বার ক্ষমা চাইলাম। বেঁচে। থাকার জন্য সাহায্য চাইলাম তার কাছে। এরপর অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমি তোমার কবজায়।

তোমার সাদা চামড়া দেখে খুশী হয়েছিলাম। তুমি ইউরোপীয়, আমি ফিলিস্তিনের। নিজের ভাষায় নিজের পরিচয় দিলাম। যখন বুঝলাম মুসলমানের হাতে পড়েছি, দমে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঝড় থেকে বেঁচে এলাম শক্রর কাছে!

আমাদের বলা হয়েছিল, মুসলমানরা মেয়েদের সাথে পশুর মত ব্যবহার করে। কিন্তু আমি ধারণাও করিনি তুমি এমন ব্যবহার করবে। ফিরিয়ে দিয়েছ আমার দেয়া স্বর্ণ। গ্রহণ করনি আমার দেহের সৌরভ।

আমি ছিলাম আতংকিত। যে কেউ আমাকে আশ্রয় দিলে তাকে বুকে স্থান দিতাম। তোমার উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে তখনও আমার ধারণা ছিল না। ভেবেছিলাম রাতে বিরক্ত করবে।

স্বপ্নে কুমীর দেখলাম, কাফ্রী এবং ঝড় দেখলাম। জেগে গেলাম আতংকে। তুমি শিশুর মত আমায় অভয় দিলে। তোমার গল্প শুনতে শুনতে আমার সব ভয় দূর হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন জাগলাম তুমি নামাজ পড়ছ। দোয়া করার জন্য হাত তুললে, তোমার নিমিলীত চোখে আমি দেখেছি এক অনাবিল প্রশান্তি, এক অবিশ্বাস্য আলোর ঝলক। সন্দেহ হল তুমি মানুষ না দেব-দূত। কোন মানুষ সোনা আর আমার মত নারীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এ আমার কাছে অবিশ্বাস্য।

তোমার চেহারার প্রশান্তি এবং আনন্দের দ্যুতি আমার চোখে অশ্রু এনে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম, তোমাকে কে দিয়েছে এ প্রশান্তি!

তোমাকে ভুলের মধ্যে রাখতে মন চাইল না। ইচ্ছে হল আমার ব্যাপারে সব কথা তোমাকে খুলে বলি। বিনিময়ে তুমি আমাকে তোমার সে প্রশান্তি দাও, দূর করে দাও আমার সকল ভীতি, যে আতংক এখনো আমাকে পিষ্ট করছে। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে না। কর্তব্যবোধ তোমার কাছে সবচে’ প্রিয়।”

রেশমা আহমদ কামালের হাত ধরে বলল, হয়ত এসব কথা তুমি প্রতারণার নতুন কৌশল মনে করছ। তুমি যা ইচ্ছে ভাবতে পার, কিন্তু আমি আমার আত্মার সাথে প্রতারণা করতে পারব না।

আমার হৃদয়ের গভীরে তোমার জন্য যে ভালবাসা জন্ম নিয়েছে সে জন্য কি আমি দায়ী? আমি তো তোমাদের খুন করতেই এসেছিলাম, কিন্তু তোমার ব্যবহারে এবং তোমার হৃদয়ে প্রশান্তি দেখে আমারও লোগ  জাগল সে প্রশান্তিময় জীবনের প্রতি।

আমার মনে হয়, এ জীবনে আমি তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কখনো বাঁচতে পারব না। কাল তোমাকে পাপের জন্য আহবান করেছিলাম। এখন! জীবন ভর তোমার পায়ের কাছে বসে থাকব। আমায় দাসী হিসেবে গ্রহণ কর, বিনিময়ে সে প্রশান্তি দাও, যা নামাজ পড়ার সময় তোমার মধ্যে দেখেছি।”

আহমদ কামাল মুখ খুলল। বলল, আমি বলব না, তুমি আমার সাথে প্রতারণা করছ। তবে এটুকু তোমাকে জানিয়ে দেয়া দরকার মনে করছি যে, আমি আমার জাতি এবং ফৌজকে ধোকা দিতে পারব না। তুমি আমার কাছে আমানত। এ আমানতের খেয়ানত আমি করতে পারি না। তোমার সাথে যে ব্যবহার করেছি তা ছিল আমার কর্তব্য কায়রোর নির্দিষ্ট সংস্থার কাছে তোমাকে তুলে দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব শেষ। এরপর আমাকে নির্দেশ দেয়া হবে, কামাল, এবার তুমি ফিরে যাও।

রেশমার চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। কান্না একটু সামলে ওঠে মিনতি ঝরা চোখে তাকাল কামালের দিকে। বলল, তোমার কাছে আমার ছোট্ট আবেদন তোমাদের সুলতান আমাকে যখন মৃত্যুদন্ড দেবেন তখন তুমি আমার হাত ধরে পাশে শুধু দাড়িয়ে থেকো।”

রেশমার চোখ আবারো জলে ভরে উঠল। কান্নাভেজা কষ্ঠে বলল, ‘এখন আর ফিলিস্তিন পৌছে দিতে তোমাকে অনুরোধ করব না। বাধা হয়ে দাড়াব না তোমার কর্তব্যের সামনে। শুধু একবার বল, তুমি আমার ভালবাসা গ্রহণ করেছ।

এ অপবিত্র দেহ নিয়ে তোমার কাছে স্ত্রীর মর্যাদা চাইনা, ট্রেনিং দিয়ে আমাদের হৃদয়টাকে পাথরে পরিণত করা হয়েছিল। ভাবতাম, আমাদের মধ্যে মানবিক অনুভূতি বলে নেই। কিন্তু খোদা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, মানুষ পাথর নয়, কোন একদিন কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়, মুসাফির, পথ আর কতদূর ঠিক পথে চলছি তো! এসো না দু’জনে হাতে হাত রেখে আরো কিছু পথ চলি নীরবে।’

রাত এগিয়ে যাচ্ছে, কথা বলছে দু’জন। আহমদ কামাল প্রশ্ন করলেন, “তোমাদের মত মেয়েদেরকে ওরা আমাদের দেশে পাঠায় কেন? মেয়েরা কি কাজ করে এখানে?”

‘অনেক কাজ। মুসলমান আমীর ওমরাদের হারেমে মুসলমানের ছদ্মবেশে ঢুকিয়ে দেয়া হয় মেয়েদের। ওরা আমীর ওমরা এবং মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের হাত করে নেয়। খ্রিস্টানদের মনোমত লোককে ক্ষমতায় বসাতে সহযোগিতা করে। খ্রিস্টান বিরোধী আমীর ওমরাদের হত্যা করতে বা ক্ষমতাচ্যুত করতে প্ররোচিত করে।

মুসলিম যুবতীদের রূপের অহমিকা থাকলেও ওরা ততোটা চতুর নয়। ইহুদী বা খ্রিস্টান মেয়েরা কৌশলে ওদের দাসীবাদীতে পরিনত করে। ওদের কারণে আমীর, মন্ত্রী এবং কেল্লাদারদের অধিকাংশ থাকে আমাদের পক্ষে। কোন কোন মেয়ে পদস্থ ও বড় লোকদের রক্ষিতা হয়ে থাকে। এরা যুবক-যুবতীদের চরিত্র নষ্ট করে। যুবকদেরকে অশ্লীলতার পথে টেনে নিয়ে আসে। সংস্কৃতির নামে নারী পুরুষকে বেহায়াপনার শেষ সীমানায় পৌছে দেয়।

আমার মত অভিজাত ও রূপসী খ্রিস্টান মেয়েরা তোমাদের পদস্থ লোকদের কাছে আসে গোপনে। তখন কর্মকর্তারা হয় খ্রিস্টানদের হাতের পুতুল। গোপন অভিসারে আমরা ওদের প্রেম নিবেদন করি, ভালবাসারজনকে দেই নানা উপহার, মূল্যবান সামগ্ৰী আর স্বর্ণমূদ্রা। কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে এজন্য মেয়েদের লুকিয়ে রাখা হয়।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী এবং নুরুদ্দীন জংগীর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির জন্যও ওরা কাজ করছে। আমাদের তিনজনকে এ উদ্দেশ্যেই রজবের হাতে দেয়া হয়েছিল।

খ্রিষ্টানদের গোপন তৎপরতার কাহিনী বলে যাচ্ছিল মেয়েটা, নীরবে শুনছিলেন আহমদ কামাল।

সূর্য ডোবার খানিক আগেই-কায়রো পৌছল কাফেলা। কমান্ডার গোয়েন্দা প্রধানের সাথে দেখা করলেন। মেয়েটার ব্যাপারে সব কথা বলে তাঁর হাতে তুলে দিলেন। আরও বললেন, রজব কাফ্রীদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। থাকে দেবতার আশ্রমে। অনুমতি দিলে তাকে জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য অভিযান চালাব।’

আলী চারজন কমান্ডো সৈন্য তাকে দিয়ে বললেন, ‘এখন বিশ্রাম করগে।

গোয়েন্দা প্রধান আলী মেয়েটাকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন। প্রশ্নের জবাবে ও বলল, আহমদ কামাল আমার সামনে বসে থাকলে সব প্রশ্নের জবাব দেব। তা না হলে আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিলেও মুখ খুলব না।

আলী আহমদ কামালকে ডাকলেন। বললেন, তুমি ওর পাশে বসো।

মৃদু হেসে রেশমা বলতে শুরু করল। সবকিছুই খুলে বলল সে, কিছুই গোপন করলনা। শেষে বলল, আমাকে মৃত্যুদন্ড দিন দুঃখ নেই, কিন্তু আমার একটা শেষ ইচ্ছে পুরণ করতে হবে। আমি আহমদ কামালের হাতে মরতে চাই।”

আহমদ কামাল তোমার কাছে একজন শত্রু সৈন্য, তার হাতে মরতে চাচ্ছ কেন?

আহমদ কামালকে কেন এত ভালবাসে তা খুলে বলল ও। আলী ওকে জেলে না পাঠিয়ে আহমদ কামালের হাতে তুলে দিলেন। নিজে ছুটলেন সুলতানের কাছে। মেয়ের বলা কথাগুলো সুলতানকে শোনালেন। বললেন, ‘সুলতান! আপনার বিশ্বস্ত ফয়জুল ফাতেমী আমাদের দুশমন। মেয়েরা তার কাছেই আসছিল।

“মিথ্যে কথা।’ সালাউদ্দীন আয়ুবীর কষ্ঠে ঝাঁঝ। মেয়েটা মিথ্যে কথা বলে তোমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। ফয়জুল ফাতেমী এমন হতেই পারেন না।”

সম্মানিত সুলতান সে ফাতেমী বংশের, আপনি তা ভুলে গেছেন। সম্ভবত এও ভুলে গেছেন, ফাতেমীরা ঘাতকদলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা আপনার অনুগত হতেই পারে না। খলিফা আল আযেদ তাকে আপনার শক্ৰ বলে উল্লেখ করেছিল।”

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী। কাকে আর তিনি বিশ্বাস করবেন! কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘আলী, প্রমাণ ছাড়া ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করার অনুমতি তোমাকে দেব না। প্রমাণসহ সুযোগ মত ধরতে হবে তাকে, সে সুযোগ সৃষ্টি করা তোমার দায়িত্ব। আমি হাতে নাতে ধরতে চাই তাকে। ফয়জুল সেনা প্রশাসনের প্রধান কর্মকতা। যুদ্ধের সব গোপন পরিকল্পনা সে জানে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রমাণ পেশ কর।

সুলতান, এ জন্য আমি এক পরিকল্পনা পেশ করছি। মেয়েটার উপর দিয়ে ভয়ংকর ঝড় বয়ে গেছে। আতংক জড়িয়ে আছে ওর মন মস্তিষ্কে। আহমদ কামালের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে সে। আহমদ কামাল তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, এ জন্য কৃতজ্ঞ সে। তা ছাড়া তার ব্যবহারেও সে চমৎকৃত হয়েছে। আহমদ কামালের অনুপস্থিতিতে সে কথাই বলতে চায়নি। আশা করি মেয়েটার এ দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ওকে ব্যবহার করতে পারব |”

‘চেষ্টা করে দেখ। তবে মনে রেখ, বাস্তব প্রমাণ ছাড়া ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করার অনুমতি দেবনা।’

আলী বিন সুফিয়ান মেয়েটার কাছে গেলেন। বুঝিয়ে বললেন উদেশ্য।

কামাল বললে আমি আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারব।

আলী চাইলেন আহমদ কামালের দিকে। চোখে চোখে কথা হলো দু’জনের।

‘হ্যাঁ, উনি যেভাবে বলেন কর। আহমদ কামাল বললেন, “কি করতে হবে বুঝে নাও।

আমি সফল হলে আমাকে কি পুরষ্কার দেয়া হবে?

“তোমাকে নিরাপদে ফিলিস্তিনের শুবাক কেল্লায় পৌছে দেয়া হবে।’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান। এখানে যতদিন থাকবে সম্মানের সাথে রাখা হবে।’

না, এ বিনিময় খুবই নগণ্য। আমি আরও বড় পুরষ্কার চাই। আমি মুসলমান হব। আমায় বিয়ে করবে আহমদ কামাল।

আহমদ কামাল এ প্রস্তাব সরাসরি অস্বীকার করলেন। তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান। বুঝিয়ে বললেন প্রস্তাবে রাজি হতে।

আহমদ কামাল বললেন, ‘জানি ও মুসলমান হবে। এরপরও ওকে আমি ইসলামের শক্রই মনে করব।”

ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে নয়, আল্লাহর ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকাই একজন মুমিনের বৈশিষ্ট। ও আমার চাইতেও খাঁটি ঈমানদার হবেনা এমন কথা আমি বলতে পারিনা। দীলের মালিক আল্লাহ, ও ইসলামে ফিরে এলে শক্রর অনেক গোপন খবর জানতে পারব আমরা। বিয়েটা যদিও তোমার একান্ত নিজের পছন্দের ব্যাপার, তবু দেশ এবং জাতির স্বার্থে তোমাকে এ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

গোয়েন্দা প্রধানের কথা মেনে নিলেন আহমদ কামাল। ওরা আবার। ভেতরে গেলেন। আহমদ কামাল মেয়েটাকে বললেন, “তোমাকে এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। যদি তুমি আমার জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পার, আমার ধর্মের প্রতি অনুরাগী হও, তোমাকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি নেই।’

মেয়েটা আলীকে বলল, বলুন কি করতে হবে। দেখব মুসলমান প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে কিনা। তবে ওকে আমার সাথে থাকতে হবে?

আলী তার এ শর্ত মেনে নিলেন। একজন অফিসারকে ডেকে ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে বললেন। দরজা বন্ধ করে আহমদ কামালের সামনে ওকে দায়িত্ব বুঝাতে লাগলেন আলী বিন সুফিয়ান।

তিন দিন পর। উটে চড়ে দেবতার আশ্রমে পৌছুল ছ’জন সৈন্য। পরনে সামরিক পোশাক। হাতে তীর ও বর্শা। কোমরে ঝুলানো তরবারী। মেয়েটার বর্ণনা শুনে এভাবে এদের পাঠিয়েছেন আলী।

আশ্রম প্রাঙ্গনে ঢুকতেই একটা বর্শা এসে ওদের সামনে মাটিতে গেথে গেল। থেমে গেল ওরা। এগিয়ে এলেন পুরোহিত। সাথে তিনজন কাফ্রী। হাতে বর্শা।

কাফ্রীরা বলল, “তোমরা এখন তীরন্দাজদের আওতার মধ্যে। নড়াচড়া করলে সবাইকে হত্যা করা হবে।’

কাফ্রীদের সামনে ওরা অস্ত্র ফেলে দিল। নেমে এল উটের পিঠ থেকে। দলনেতা পুরোহিতের সামনে এসে বলল, আমরা তোমাদের বন্ধু। বন্ধুত্ব নিয়ে এসেছি, ফিরে যাব বন্ধুত্ব নিয়ে। তোমরা কি তিনটে মেয়েকে বলি দেয়ার কাজ শেষ করেছ?”

‘আমরা কোন মেয়ে বলি দেইনি!’ পুরোহিতের কন্ঠে ক্ষোভ। ‘তোমরা এ প্রশ্ন করছ কেন?

আমরা মিসরের বিদ্রোহী সৈন্য, মুসলমানরা তোমাদের দেবতার অপমান করেছে, এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যে ফৌজ তৈরী হয়েছে আমরা সে দলের। আমরা পরাজিত হয়েছি। তোমাদের লোকেরা বলেছে, মেয়ে বলি দেয়া হয়নি বলে দেবতা আমাদের অভিশাপ দিয়েছেন।

আমরা ছিলাম রজবের সংগী। একটার পরিবর্তে তিনটা ফিরিংগী মেয়ে অপহরণ করে তার হাতে তুলে দিলাম। অনেক দূর থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লোভ দেখিয়ে ওদের এনেছি। রজব ওদের এখানে নিয়ে এসেছে। গত পরশু ওর ফিরে যাবার কথা ছিল। ও ফিরে না যাওয়ায় মেয়েদেরকে বলি দেয়া শেষ হয়েছে কিনা আমরা তা দেখতে এসেছি।”

দল নেতার কথায় গলে গেলেন পুরোহিত। বললেন, রজব আমাদের সাথে বজ্জাতি করেছে। মেয়েদের এখানে এনে তার নিয়ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে ওদের এখান থেকে ভাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে পালাতে দেইনি, শাস্তি দিয়েছি। মেয়েরা আমাদের হাত থেকে পালিয়ে গেছে। তোমরা কি আরও দুটা মেয়ের ব্যবস্থা করতে পার? দেবতা আমাদের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট।

অবশ্যই করব। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা নতুন দু’টো মেয়ে হতে চাইনা। রজব বেঈমানী করে থাকলে ওকে আমরা খুন করে ফেলব। আমাদেরকে রজবের কাছে নিয়ে চল। দেখি বেঈমানটা কি বলে?”

পুরোহিত সকলকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। মাটির তৈরী একটা ভাঁড়ের কাছে গিয়ে থামলেন তিনি। অন্য একটা পাত্র দিয়ে ঢাকা ভাঁড়, আনলেন হাত।

হাতে রজবের কাটা মাথা। অক্ষত চেহারা, আধখোলা চোখ, মুখ বন্ধ। চুল থেকে পানি ঝরছে। নষ্ট না হওয়ার জন্য মাথাটা ওষুধে ডুবানো হয়েছে।

পুরোহিত বললেন, ‘ওর দেহটা কুমীরকে খেতে দিয়েছি। সংগী দুটোকে ঝিলে ছেড়ে দিয়েছি জীবন্ত। আমার কুমীরগুলো ক্ষুধার্ত।

মাথাটা আমাদের দিতে হবে। আমরা এ মাথা আমাদের সকল সংগীকে দেখাব। ওদের বলব, আংগুকের দেবতার অপমান করলে এই পরিণতিই হবে। ভবিষ্যতে আর এমন কাজ করতে সাহস পাবেনা কেউ।

নিতে পার, তবে আগামীকাল সুর্যাস্তের আগেই ফেরত দিতে হবে। ংগুকের দেবতা এ মস্তিষ্কের মালিক। ফিরিয়ে না দিলে তোমাদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’

দুদিন পর সৈনিকরা ফিরে এসে সুলতানের পায়ের কাছে রেখে গেল রজবের কাটা মাথা।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সুলতান আয়ুবী। গভীর রাত। আহমদ কামাল ঘুমিয়েছিল নিজের কামরায়। তার পাশের বিছনায় শুয়ে আছে রেশমা। এ কক্ষে তাদের দুদিন কেটে গেছে। রেশমা বার বার বলেছে, আমি মুসলমান হব। তুমি আমায় বিয়ে কর।

আগে কর্তব্য পালন কর। আহমদ কামালের স্পষ্ট জবাব।

আহমদ কামাল ওর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন এ দু’দিন। রেশমা তাই তার সাথে প্রতারণা করা হতে পারে বলে কয়েকবার সন্দেহ প্রকাশ করল।

তোমার এ সন্দেহ ভিত্তিহীন। যে নীতি-নৈতিকতার কারণে তোমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছি সে নীতিই ওয়াদা পালনে আমাকে বাধ্য করবে। তুমি তোমার কাজ শেষ কর, আমি আমার ওয়াদা পালন করব।”

আহমদ কামালের এসব কথায় ওর মনের ভয় ও সন্দেহ দূর হয়ে গেল। তার মাঝে ফিরে এল স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার শক্তি। গভীর ভাবনায় ডুব দিল ও।

এক রাতে দু’জন বারান্দায় শুয়ে আছে। বাইরে সেন্ট্রি। মাঝ রাতে সেন্ট্রি হাটতে হাটতে একদিক থেকে আরেক দিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।

সহসা পেছন থেকে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল কেউ। সাথে সাথে অন্য দু’জন এসে কাপড় দিয়ে তার মুখ বেঁধে ফেলল। শক্ত করে বেঁধে ফেলল হাত-পা।

অন্ধকারে চারজন বাড়ীর ফটকে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধ। একজন দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অন্যজন তার কাধে পা রেখে দেয়াল টপকাল। ভেতর থেকে খুলে দিল ফটক। ভেতরে ঢুকল তিনজন।

একজন মেয়েটার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলল। তুলে নিল কাঁধে। অন্য তিনজন আহমদ কামালকে রশি দিয়ে খাটের সাথে শক্ত করে বাধল। প্রতিরোধ করার কোন সুযোগই তিনি পেলেন না।

বাইরে গিয়ে মেয়েটার গায়ে কম্বল চাপিয়ে দিল। একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল চারটি ঘোড়া। চারজন চারটি ঘোড়ায় চেপে বসল। একজন তার সাথে তুলে নিল মেয়েটাকে। কেউ যেন সন্দেহ না করতে না পারে সে জন্য নির্জন পথ ধরে ওরা শহর থেকে বেরিয়ে এল।

শহরের পাঁচ মাইল দূরে ফেরাও পাহাড়ে ফেরাউনের আমলের পতিত ভাঙা বাড়ী। বাড়ীটা বিশাল এক পাথুরে টিলায়। টিলা কেটে বানানো হয়েছে কামরা, একটা দুটো নয় অনেকগুলো।

এ কামরাগুলোর নীচের দিকে এগিয়ে গেছে সিড়ি। সে সিড়ি ভেঙে নীচে গেলে ওপরের মতই পাওয়া যাবে সারি সারি কামরা, পেচানো বারান্দা, এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাওয়ার অপ্রশস্ত পথ। অচেনা লোক কখনো ওখানে গেলে পথ চিনে ফিরে আসা কষ্টকর।

বাড়িটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ভয়ংকর সব কথা প্রচলিত আছে বাড়িটি সম্পর্কে। ভয়ে কেউ ও পথ মাড়ায়না। কাছে গেলেই কেমন গা ছমছম করে। সবাই মনে করে ওখানে জিন ভুতের আড্ডা। বিষাক্ত সাপের ভয়ে ভেতরে ঢোকার সাহস করেনা কেউ। এমনকি দিনের বেলায়ও কেউ বাড়িটার ধারে কাছে যায়না।

অপহরণকারীরা মেয়েটিকে নিয়ে ভূতুড়ে বাড়ীটার ভেতর প্রবেশ করল। ওরা এমন ভাবে হাটতে লাগল যেন ওটা ওদের নিজের বাড়ী। অবলীলায় পথ ভেঙে অতিক্রম করছে কামরার পর কামরা। সামনে মশালের আলো ধরে হাঁটছে একজন। পায়ের শব্দে চামচিকা, বাদুর, টিকটিকি ছুটে পালাচ্ছে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে মাকড়সার জাল।

পাথরের তৈরী বিশাল এক কামরায় প্রবেশ করল ওরা। মশালবাহী লোকটি দেয়ালের এক জায়গায় হাত রাখল। এক কোণার মেঝের খানিকটা জায়গার পাথর সরে গেল।

বেরিয়ে এল সুড়ংগ সিড়ি। নীচের দিকে নেমে গেছে সিড়ি। সিড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা। ওপরের কামরার মত বিশাল কামরা এখানেও। কামরায় ফরাশ বিছানো। ফরাশে চমৎকার চাদর। সাজানো গুছানো কক্ষ।

কামরায় পৌছে মেয়েটার মুখের কাপড় খুলে দেয়া হল।

মুখ খুলতেই রাগের সাথে চেচিয়ে উঠল ও, কেন আমাকে ধরে এনেছ তোমরা? কি চাও আমার কাছে? বদমতলব থাকলে শুনে রাখ, মরে যাব, তবুও কাউকে কাছে আসতে দেব না।।

‘এভাবে তুলে না আনলে আগামীকাল ভোরে ওরা তোমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিত। আমার নাম ফয়জুল ফাতেমী। আমার কাছেই তোমাদের আসার কথা ছিল। অন্য দু’জন কোথায়? রজব কোথায়? তুমি একা ধরা পড়লে কিভাবে?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটা বলল, ‘খোদার শোকর তিনি আমাকে. এক ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আমি নির্দিষ্ট স্থানে পৌছতে পেরেছি।’

এরপর ফয়জুল ফাতেমীকে রজব এবং কাফ্রীদের কথা, ঝড়, আহমদ কামালের হাতে ধরা পড়া, সব ঘটনা খুলে বলল ও। শোনাল দু’টাে মেয়ের মৃত্যুর করুণ কাহিনী। ফয়জুল তাকে শান্তনা দিলেন।

অপহরণকারী চারজনকে ছ’টি করে স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে বললেন, যে যার স্থানে চলে যাও। আমিও বেরিয়ে যাব একটু পর। ও এখানে তিন চার দিন থাকবে। প্রতিরাতেই আমি আসব। বাইরে ওর খোঁজাখুজি শেষ হলে নিয়ে যাব নিরাপদ আশ্রয়ে।

লোক চারজন বেরিয়ে গেল। লুকিয়ে রইল বাড়ীর পাশে। ফয়জুল ফাতেমীর সাথে রইল একজন সেনা কমান্ডার।

ফয়জুলের খুশীর অন্ত নেই। তার অভিযান সফল হয়েছে।

মেয়েটার কাছ থেকে দুটাে মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে যদিও তিনি দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলেন না।

রজবের পরিণতি তিনি জানেন না। বললেন, রজবকে ওখান থেকে বের করে আনতে হবে। সে সালাহউদ্দীন এবং আলীকে হত্যা করার ব্যবস্থা করেছে। ঘাতক দলের সাথে কি কথা হয়েছে আমি জানিনা। যতশীঘ্র সম্ভব এ দুটো লোককে হত্যা করতে হবে।’

তারপর রেশমার দিকে ফিরে বললেন, ‘এখন নতুন করে পরিকল্পনা করব, অন্যদের সাথে কথা বলে তোমাকে কি করতে হবে কাল বলব তোমায়। এখন বিশ্রাম কর, আমাকে জরুরী কাজে ফিরে যেতে হচ্ছে। তোমার দেখাশোনার জন্য লোক থাকবে এখানে, কোন অসুবিধা হবে না।”

সালাহ উদ্দীন আয়ুবী আপনাকে কতটা বিশ্বাস করেন?’ প্রশ্ন করল রেশমা।

নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও আমার সাথে পরামর্শ করেন।’

শুনেছি উধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে সুলতান আয়ুবীর অনুগতদের ংখ্যা বেশী। সেনাবাহিনীও তার অনুগত।

একথা ঠিক!’ কমান্ডার কথা বলল এবার। তার গোয়েন্দা সংস্থা অত্যন্ত সতর্ক। কেউ কোথাও মাথা তুললে সাথে সাথে ওরা টের পেয়ে যায়। উধ্বতন কর্মকর্তাদের যারা সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বিরুদ্ধে কাজ করছে সম্মানিত ফয়জুল ফাতেমী আপনাকে বলবেন।

ফয়জুল ফাতেমী ওদের নাম উল্লেখ করে মৃদু হাসলেন।

তোমাকে উচু পর্যায়ে কাজ করতে হবে। দু’জনের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে হবে। দু’জনকে খাওয়াতে হবে বিষ। এ দু’টাে কাজই তোমার জন্য সহজ। তবে সমস্যা হল, তোমাকে কোন জলসা বা সভায় নেয়া যাবে না। পর্দানসীন মুসলমান মেয়েদের মত বোরকা না পরলে ধরা পড়ে যেতে পার। তা না হয় তোমাকে ফিলিস্তিন ফেরত পাঠিয়ে অন্য কোন অপরিচিত মেয়ে নিয়ে আসতে হবে। তবে একটু সমঝে চললে আশা করি কোন অসুবিধা হবে না।

আমার গ্রুপ অত্যন্ত তৎপর এবং চৌকস। ওরা সবাই প্রায় কমান্ডার পর্যায়ের। যে চারজন সাহসের সাথে তোমাকে তুলে এনেছে ওরাও আমার নিজের লোক। আয়ুবীর সেনাবাহিনীতে আমরা অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি। ফৌজের বিরুদ্ধে জনগণের মাঝে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেয়ার কাজ চলছে।”

সিরীয় এবং তুকী সৈন্যদেরকে মানুষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছে। সুদানীদের পরাজিত করায় শহরের লোকজনও সেনাবাহিনীকে শ্রদ্ধা করে বলে শুনেছি।”

সাধারণ মানুষের এ অনুভূতিকে আহত করতে হবে। সেনা অফিসারদের অপদস্ত করতে হবে। তা না হলে খ্রিস্টান বা সুদানীরা আমাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না। এ ব্যাপারেও আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে, তবে এখনি সব বলা যাবে না।’

‘আমি এ কয়দিন ওদের হাতে থেকে বুঝেছি, আয়ুবীর বাহিনী বাইরের যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে একদিক থেকে খ্রিস্টান বাহিনী অন্যদিক থেকে সুদানীরা আক্রমণ করলেও পরাজিত হবে। জনগণ সেনাবাহিনীর সাথে মিশে কায়রোকে এমন দূর্গে পরিণত করবে যা জয় করা সম্ভব হবে না ’।

তুমি ঠিকই বলেছ। কায়রো জয়ের জন্য আমাদেরকে ময়দান তৈরী করতে হবে। সাধারণের মাঝে বিদ্বেষ ছড়াতে হবে। ধ্বংস করে দিতে হবে যুবকদের চরিত্র এবং নৈতিকতা।

আমাকে বলা হয়েছে দু’বছর থেকেই এ কাজ চলছে।’

আমরা যথেষ্ট সফলতা লাভ করেছি। বেহায়াপনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আয়ুবী দেশে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। খোতবা থেকে খলিফার নাম সরিয়ে ইসলামের সত্যিকার রূপ তুলে ধরছে। তা ছাড়া মেয়েদেরকে সামরিক ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। তার এসব তৎপরতা আমাদের কিছুটা ক্ষতি করছে।

‘এখন বাইরে যাবেন না। পাহারাদারদের একজন ভেতরে এসে বলল, মনে হয় কিছু সমস্যা হয়েছে।

ভয় পেয়ে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। মশাল নিভিয়ে লোকটার সাথে বেরিয়ে এলেন কি হয়েছে দেখার জন্য।

ফকফকা জ্যোৎস্না বাইরে। একটা উচু বেদীর ওপর লুকিয়ে তিনি চারদিকটা দেখলেন ভাল করে। বললেন, ‘তোমরা যথেষ্ট সতর্কতার সাথে কাজ করতে পারনি। মনে হয় সৈন্যরা ঘেরাও করে ফেলেছে বাড়ি। ঘোড়াও আছে, দেখো, আমি কোন দিক দিয়ে বেরোতে পারি।”

আমরা চারদিকই ভাল করে দেখেছি। ওরা আমাদের ঘেরাও করে ফেলেছে। আপনি ভেতরে যান। আলো জ্বালাবেন না। কক্ষ থেকে বের হবেন না। ওরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেব আমরা, কেউ ওখান যেতে পারবে না।”

বাড়ীর ভেতর চলে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। ওপর থেকে নেমে এল পাহারাদার। ভেতরে না ঢুকে অন্ধকারে পা টিপে টিপে দেয়াল ঘেষে বেরিয়ে এল বাইরে।

পঞ্চাশজন পদাতিক ও জনাপচিশেক ঘোড়সওয়ার ঘিরে রেখেছে বাড়িটা। লোকটা একজন সৈন্যকে জিজ্ঞেস করে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে গেল। আলীর সাথে দাঁড়িয়েছিল কমান্ডার আহমদ কামাল।

লোকটি বলল, ভেতরে কোন সমস্যা নেই। আপনার সাথে দু’জন লোকই যথেষ্ট, আমার সাথে আসুন।

আলী দু’টো মশাল জ্বালালেন। হাতে কোষমুক্ত তরবারী। আহমদ কামাল এবং চারজন সিপাইকে সাথে নিয়ে বাড়ীর ভেতর ঢুকে পড়লেন তিনি।

একজন পাহারাদার ভেতরের দিকে দৌড় দিল। আলীর সংগী লোকটি বলল, “এ লোকটা তার নিজস্ব। ওদেরকে সাবধান করার জন্য গেছে।’

তাড়াতাড়ি চল।

ছুটে যাওয়া পাহারাদারের পিছু নিয়ে ছুটলেন ওরাও। সংগী লোকটি না থাকলে আকাবাঁকা পথে এতক্ষণে ওরা হারিয়ে যৈত।

একদিক থেকে ভেসে এল ছুটন্ত মানুষের পায়ের আওয়াজ। কেউ একজন অনুচ্চ কষ্ঠ বলল, আমি আগে আগে যাচ্ছি, আপনারা দ্রুত আসুন।

দলটি পাথুরে কক্ষে পৌছুল। এখান থেকে সিড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। কেউ একজন বলছে, আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এ দু’জন ওদের লোক।

তলোয়ারে তলোয়ার টক্কর খেতে লাগল। সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল দু’দল। ভেতর থেকে শব্দ এল, ‘ওকেও শেষ করে দাও। যেন সাক্ষী দিতে না পারে |

আলী এবং আহমদ কামাল লাফিয়ে সিড়ি ভাঙলেন। কক্ষের মেঝেয় রক্ত বইছে। দুহাতে পেট চেপে ধরে বসে আছে রেশমা। তার মুখ ঢেকে রেখেছে তার এলোমেলো রেশমী চুল।

ফয়জুল ফাতেমীর সংগী কমান্ডার এবং অন্য একজন ফয়জুল ফাতেমী আর এক পাহারাদারের সাথে লড়ছে। বিপক্ষের তলোয়ারগুলো দেখে দমে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। অস্ত্র ছেড়ে দিলেন।

রেশমার কাছে গেলেন আহমদ কামাল। পেট চিরে ফেলা হয়েছে তার। বিছানার চাদর চিরে কষে বেঁধে আলীকে বললেন, অনুমতি দিলে ওকে বাইরে নিয়ে যাব।’

রেশমাকে কোলে তুলে নিলেন আহমদ কামাল। ব্যথা ভূলে গেল সে। মুচকি হেসে বলল, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি, ধরিয়ে দিয়েছি অপরাধীকে।

অপহরণকারী দলের দু’জন সহ ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করা হল। বাকী দু’জন ছিল আলীর লোক।

সুলতান আয়ুবী বলেছিলেন, ‘খোঁড়া অজুহাত দিয়ে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।’

আলী বিন সুফিয়ান রেশমার কাছ থেকে পারস্পরিক পরিচিতির নির্দিষ্ট সংকেত জেনে নিয়ে তিনজন চৌকস গোয়েন্দা পাঠালেন ফয়জুল ফাতেমীর কাছে। তিনজনের একজন কমান্ডার।

ওরা নির্দিষ্ট সংকেত ব্যবহার করে ফয়জুল ফাতেমীর সাথে দেখা করল। বলল, ‘একটা মেয়ে ধরা পড়েছে। ওরা তাকে একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছে। একটু চেষ্টা করলেই মেয়েটাকে বের করে আনা যায়। ওরা আরও বলল, ‘মেয়েটাকে উদ্ধার করার জন্য রজব আমাদের পাঠিয়েছেন।

গোয়েন্দাদের বিশ্বাস করলেন ফয়জুল ফাতেমী। তিনি ভাবলেন নির্যাতনের মুখে মেয়েটা তাদের পরিচয় প্রকাশ করে দিতে পারে। আত্মরক্ষার স্বার্থেই ওকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কমান্ডারকে রাখলেন নিজের কাছে।

আলীর পাঠানো দু’জনের সাথে অন্য দু’জন সহ চারজনকে অপহরণের দায়িত্ব দেয়া হল। মেয়েটাকে তুলে ওরা ভাঙা বাড়িটায় চলে পাশে বসে থাক।

সুলতানের সামনে ওর কাছে বসতে আহমদ কামাল দ্বিধা করছিলেন। সুলতান বললেন, তুমি ওর পাশে বস।”

সুলতান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন সুস্থতার জন্য।

তৃতীয় রাতে যুবতীর পাশে বসে আছেন আহমদ কামাল। আবেগ জড়িত কন্ঠে ও বলল, আহমদ! তুমি আমায় বিয়ে করেছ? না, আমি আমার প্রতিশ্রুতি পুরণ করেছি, তুমিও তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছ। পাঠাতেন না। আমি কি ভাগ্যবতী, আমার সব আশা ও স্বপ্ন আল্লাহ পূরণ ” করেছেন। তুমি আমার পাশে বসে থাকলে মরতে আমার মোটেই কষ্ট  হবে না।’

কথা জড়িয়ে গেল ওর। আহমদ কামালের হাত মুঠোয় চেপে ধরল ও। ধীরে ধীরে ঢিলে হয়ে গেল তার হাতের বাধন।

আহমদ কামাল ইন্নালিল্লাহ’ বলে ঢেকে দিলেন ওর মৃতদেহ। হল।

দু’দিন পর ফয়জুল ফাতেমী এবং তার সংগীরা অন্য সদস্যদের নাম বলে দিতে বাধ্য হল। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রেফতার করা হল ওদের।

ফয়জুল ফাতেমীর মৃত্যুদন্ডের কাগজে দস্তখত দেয়ার সময় সুলতান সালাহউদ্দিন আয়ুবী কান্নায় ভেংগে পড়লেন।

(সমাপ্ত)

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top