২. সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান

একজন কমান্ডো সদস্য লুকিয়ে পড়ল। আর একজন তার সামনে পাথর নিক্ষেপ করল।

আকস্মিক শব্দে চমকে উঠল কাফ্রী। এগুল পাথর নিক্ষিপ্ত স্থানের দিকে।

ঝোপের কাছে আসতেই কমান্ডো সদস্য জাপটে ধরে বুকে খঞ্জর সেধিয়ে দিল। নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ল কাফ্রীর লাশ। সতর্ক পায়ে আবার এগিয়ে চলল কমান্ডো বাহিনী।

উম্মে আমারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। পুরোহিত ওকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করল। এরপর হাত ধরে সিড়ির দিকে এগিয়ে চলল। চারজন উলঙ্গ যুবতী এবং চারজন কাফ্রী তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল মূর্তির মুখ। সিজদায় লুটিয়ে পড়ল ওরা।

পুরোহিত তার আগমন ঘোষণা করে বেরিয়ে এল। সঙ্গে উন্মে আমারা। ওকে চতুরে তুলে দেয়া হল। ঘিরে দাড়াল কাফ্রী এবং যুবতীরা।

মেয়েটা আরবী ভাষায় বলল, আমি আংগুকের সন্তানদের জন্য আমার মাথা কাটাচ্ছি। ওদের পাপের প্রায়শ্চিত করছি। আমার মাথা কেটে ফেল। দেবতার পদতলে রেখে দাও কাটা মস্তক। দেবতা এ মাথার উপর মিসর এবং সুদানের মস্তক স্থাপন করবেন।

যুবতী এবং কাফ্রীরা আবার সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। পুরোহিত উম্মে আমারাকে হাটু গেড়ে বসাল। মাথা নোয়াল ও। হাতে তরবার তুলে নিল পুরোহিত।

পর্বত চূড়া থেকে এক কমান্ডো সদস্যের দৃষ্টি পড়ল চত্বরে। অনুচ্চ কষ্ঠে সঙ্গীদের বলল সে, মেয়েটা মাথা নুইয়ে বসে আছে, উলংগ।

ঝকঝকে জোসনা আর মশালের আলোয় ওরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সবকিছু। পাহাড় চুড়া থেকে নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে। পাহাড়ের গা ঢালু নয়, খাড়া দেয়ালের মত।

হাতে সময় নেই। উড়ে গেলেও ওকে বাঁচানো সম্ভব নয়। চূড়া থেকে নীচে তাকাল ওরা। ঝিল। শুনেছে ঝিলে কুমির থাকে।

ডানদিক কিছুটা ঢালু হলেও মসৃণ দেয়ালের মত। কিছু ঝোপঝাড় রয়েছে। কমান্ডোরা একে অপরের হাত ধরে নামতে লাগল। সর্বশেষ আরোহীর দৃষ্টি পড়ল এক কাফ্রীর উপর। দাড়িয়ে আছে বর্শ নিয়ে। হাত উচিয়ে আছে নিক্ষেপের জন্য।

হয়ত সে সন্দেহ করেছে কিছু কমান্ডো সদস্যদের দেখা যাচ্ছেনা। একজন তীর ছুড়ল। শোঁ শোঁ শব্দ তুলে ছুটে গেল তীর। বক্ষ ভেদ করল কাষ্ট্রীর | পড়ে গিয়ে গড়াতে লাগল দেহটা ৷

কমান্ডোরা নেমে আসছে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে। যে কোন মুহুর্তে পা পিছলে পড়ে যেতে পারে অনেক নীচের টলটলে পানির ঝিলে।

পুরোহিত উম্মে আমারার মাথার উপর তরবার তুলল। সিজদা. থেকে সোজা হল কাফ্রী এবং যুবতীরা।

হাটু গেড়ে বসে ওরা গান ধরল। হালকা অথচ মিষ্টি সুর। সুরের আবহ সৃষ্টি করছিল এক অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশ।

‘পাহাড় ঘেরা এ ক্ষুদ্র উপত্যকা মানুষের নয় দেবতাদের আবাস’ কমান্ডোদের মনে হল যে কোন মানুষকে এ পরিবেশে এ কথা বিশ্বাস করানো সম্ভব।

পুরোহিতের তলোয়ার আরও উপরে উঠে ধীরে ধীরে নেমে আসছে নীচে। আর মাত্র দু এক সেকেন্ড, হয়ত তারপরেই ভেসে আসবে মেয়েটার আর্ত চিৎকার।

তরবারী উম্মে আমারীর ঘাড় স্পর্শ করার আগেই একটা তীর এসে বিদ্ধ হল পুরোহিতের পাজরে। তরবাবী তার হাত থেকে খসে পড়ার আগেই পরপর তিনটে তীর বিধল তার দেহে।

চিৎকার করে উঠল মেয়েরা। কাফ্রীরা ডাক-চিৎকার শুরু করল। পুরোহিতের দেহটা একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল। তরবারী ছিটকে পড়ল দূরে।

কঠিন শিলায় পড়ে ঝনঝন শব্দ হলো তরবারীর। ঘাড় তুলে তাকাল মেয়েটা।

দু’জন কাফ্রী মুর্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একঝাক তীর এসে শুইয়ে দিল ওদের।

মেয়েরা যে দিকে পারল ছুটে পালাল। রক্তে তড়পাচ্ছে তিনটে দেহ। উম্মে আমারা নির্বিকার ভাবে মাথা নত করে বসে আছে। দৌড়ে চত্বরে এসে একজন কমান্ডো উন্মে আমারাকে তুলে নিল কাঁধে। ওকে নিয়ে গেল মুর্তির পেছনে।

তখনো তার নেশ কাটেনি। নিজের জামা খুলে মেয়েটাকে পরিয়ে দিল কমান্ডো। একদিক থেকে বারজন কাফ্রী ছুটে এল। হাতে বর্শা এবং ঢাল।

ছড়িয়ে গেল কমান্ডোরা। ওদের চারজনের হাতে রয়েছে তীর ধনু। তীর ছুড়তে লাগল ওরা। অন্যরা একদিকে লুকিয়ে পড়ল।

কাফ্রীরা এগিয়ে এলে ওরা পেছন থেকে আক্রমণ করল। পেছনে আরও কাফ্রী থাকতে পারে ভেবে পরিকল্পনা মত তীরের মাথার কাপড়ে আগুন জ্বেলে উপরের দিকে ছুড়ে দিল এক কমান্ডো।

মেলা তখনো জমজমাট। নিজস্ব বাহনে চড়ে পাঁচশ দর্শক মেলা থেকে খানিক দূরে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। ওদের চোখে পড়ল। আগুনের ফিতা বাধা তীর।

ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ওরা। একটু দূরে গিয়ে ঘোড়া ছুটাল তীব্র গতিতে |

মেলার আনন্দে ডুবে থাকা দর্শকরা ভাবতেও পারেনি কি বিপদে পড়েছে দেবতারা। দেবতাদের আবাসে পৌছুল পাঁচশ সওয়ার। কাফ্রীদের কয়েকটা লাশ পড়ে আছে। শহীদ হয়েছেন দু’জন কমান্ডো সদস্য। ভেতরে আর কোন কাফ্রী নেই।

কমান্ডোরা মুর্তির মুখপথে ভেতরে ঢুকল। হাতের কাছে যা পেল তুলে নিল। অন্যান্য জিনিসের সাথে পাওয়া গেল কাপড়ের তৈরী একটি ফুল। ফুলটি কাপড়ের হলেও সুবাসিত। হালকা, মোলায়েম কিন্তু ইন্দ্রিয় অবশ করা সুবাস।

কমান্ডো সদস্যরা উন্মে আমারাকে সাথে নিয়ে পাহাড় পেরোল। এরপর ঘোড়া ছুটাল কায়রোর দিকে।

মেলা শেষ হয়ে গেছে। মাতাল হয়ে পড়ে আছে অনেকে। ব্যবসায়ীরা মালপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে মেয়ে বিক্রেতার দল। মরুভূমিতে বাড়ীমুখো মানুষের সারি।

চুলের জন্য অপেক্ষা করছে পাশের গায়ের মানুষ। দুর গাঁয়ের মানুষজন তাকিয়ে আছে দেবতার আবাসের দিকে।

প্রবীণ বুড়োরা বলাবলি করছে, এখনি পুরোহিত এসে বলি দানের সুসংবাদ দেবেন। আমাদের দেবেন পবিত্র কেশ।

কিন্তু কেউ এলনা। দেবতার আস্তানা কবরের মত নিস্তব্ধ। এরা জানেনা দেবতার ঘোষণা আর কোনদিন আসবে না। দেবতার আস্তানা এখন মুসলিম ফৌজের দখলে।

রাত শেষে দিন এল, তারপর দেখা গেল দিনও পেরিয়ে যাচ্ছে। লোকজনের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। বলির কথা সবার মুখে মুখে। যুবকরা বলাবলি করতে লাগল, দেবতা না ছাই, সব ধোকাবাজি, সবই মিথ্যা।

ডুবে গেল সূর্য। দেবতার আস্তানায় গিয়ে কি ঘটেছে দেখার সাহস হলনা কারো।

Ο ΟΟ

‘ডাক্তার নিয়ে এসো। সুলতান আয়ুবী নির্দেশ দিলেন, ‘মেয়েটা এখনো নেশার ঘোরে রয়েছে।”

উম্মে আমারা সুলতানের সামনে বসে আছে। ও বলছে, আমি আংগুকের মা! তুমি কে? তুমিতো দেবতা নও। আমার স্বামী কোথায়? আমার মাথা কেটে দেবতার পায়ের কাছে রেখে দাও। আমাকে আমার সন্তানদের জন্য উৎসর্গ কর।”

ও নেশার ঘোরে বকে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে জড়িয়ে এল কষ্ঠ। ডাক্তার এসে ওকে ওষুধ খাওয়ালেন। একটু পর চোখ বন্ধ করল ও। তাকে শুইয়ে দেয়া হল, ও হারিয়ে গেল গভীর ঘুমের অতলে।

মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। সুলতানকে শোনানো হল আক্রমণের বিস্তারিত ঘটনা।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী সামরিক উপপ্রধান আল নাসের এবং বাহাউদ্দিন শাদ্দাদকে নির্দেশ দিলেন তোমরা এখনি পাঁঁচশ সৈন্য নিয়ে ওখানে যাও। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নেবে। সেনাবাহিনী জায়গাটা ঘিরে রাখবে। তোমরা মূর্তিটা ভেঙে ফেলো। আক্রমণ এলে মোকাবিলা করবে, এলাকার মানুষ সংঘর্ষে না এলে লড়াই করোনা। ওদের বুঝিয়ে বলবে এ ছিল স্রেফ ধোকা, শুধুই ভাওতাবাজি।

শাদ্দাদ তার ডাইরীতে লিখেছেন আমরা পাঁঁচশ সৈন্য নিয়ে ওখানে গেলাম। পথ দেখাল কমান্ডো বাহিনীর কমান্ডার। হাজার হাজার কাফ্রীরা দূরে দাড়িয়েছিল। এদের কেউ উটের পিঠে, কেউ ঘোড়ার পিঠে। হাতে বর্শা, তলোয়ার এবং তীর ধনুক।

আমরা পাহাড়ের দিকে পিঠ করে চারপাশে সৈন্যদের দাড় করালাম। যাদের তীর ছিলনা ওদের হাতে ছিল বর্শা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রস্তুতি। আমি এবং নাসের ভেতরে গেলাম। মূর্তি দেখে সে বলল, ফেরাউনের স্মৃতি।

চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কাফ্রীদের লাশগুলো পড়ে আছে দু’পাহাড়ের মাঝের সেই প্রাচীন বাড়ীতে।

ফেরাউনের সময় হয়ত এটা সুন্দর অট্রালিকা ছিল। দেয়ালের গায় প্রাচীন লিপি। পর্বতের পাদদেশে ঝিল। ঝিলে ছোট ছোট অনেকগুলো কুমির।

পাহাড় কেটে ভেতরে ঢুকে গেছে ঝিলের পানি। ঝিলের উপর পাহাড়কে ছাদের মত মনে হয়। ভয়ংকর স্থান।

অনেকগুলো কুমির কিনারে এসে আমাদের দেখতে লাগল। সৈন্যদের বললাম, কাফ্রীদের লাশ ঝিলে ফেলে দাও। কুমিরগুলো ক্ষুধার্ত।

ওরা লাশগুলো টেনে নিয়ে এল। ফেলে দিল ঝিলে। কুমিরগুলো ঝাপিয়ে পড়ল লাশের ওপর। ছোট বড় অগণিত কুমির। মনে হল লাশগুলো দ্রুত সাতরে পাহাড়ের ভেতর দিকে ছুটে যাচ্ছে।

এরপর এল পুরোহিতের লাশ। বহু মৃত মানুষকে কুমিরের মুখে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। আমরা তার দেহটাও ঝিলে ফেলে দিলাম।

দু’জন সিপাই চারজন সুদানী মেয়েকে ধরে নিয়ে এল। বিবস্ত্র। সিড়ির নীচে লুকিয়েছিল ওরা।

আমি এবং নাসের দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। সিপাইদের বললাম, ‘ওদের কাপড় পরাও।

কাপড়ে ঢেকে দেয়া হল ওদের দেহ। প্রতিটি মেয়েই অপূর্ব সুন্দরী। ওরা কাঁদছিল। দোভাষী ওদের কাহিনী বুঝিয়ে বলল আমাদের।

লজ্জাস্কর ও বেদনাদায়ক সে কাহিনী। কোন মুসলমান মেয়েদের এ অপমান সইতে পারে না। নারী যে কোন ধর্মের হোক, ইসলাম তার আব্রু রক্ষা করে।

এরা ফেরাউনকে খোদা মনে করত। ফেরাউনের অনুপস্থিতিতে গোত্র প্রধানকে পূজা করত খোদা হিসাবে।

আমরা পুরো এলাকাটাই ঘুরে ঘুরে দেখলাম। চমৎকার স্থান। মরুর বুকে যেন সবুজের মেলা বসেছে। পাহাড়ী ঝর্ণায় তৈরী হয়েছে ঝিল। ঝিলের ওপর বিশাল ছায়াবৃক্ষ।

স্থানটি কোন ফেরাউনের পছন্দ হয়েছিল, শখ করে সে এখানে বিনোদন কেন্দ্র বানিয়েছে। নিজের খোদায়ীত্ব প্রমাণ করার জন্য মূর্তি তৈরী করেছে। ভোগ বিলাসের জন্য মাটির নীচে তৈরী করেছে সুদৃশ্য কক্ষ।

সূর্য সরে গেছে। বদলে গেছে আকাশের রূপ ৷ খসে পড়েছে ফেরাউনের ক্ষমতার নক্ষত্র। মিসরে এসেছে অন্য ধর্ম, অন্য সম্রাট। শেষ পর্যন্ত কালিমার বিজয় হয়েছে।

সত্যের ফৌজ ঘিরে রেখেছে পার্বত্য এলাকা। ভেঙে ফেলা হল পাথরের মূর্তি। মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হল বেদী। মাটির নীচের কক্ষ ভরে ফেলা হল পাথর দিয়ে।

বাইরে হাজার হাজার কাফ্রী আতংকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। কি হচ্ছে ওরা বুঝতে পারছিল না কিছু। দেবতাদের আস্তানা আক্রান্ত হতে পারে এমনটি ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি। অথচ তাদের চোখের সামনে দেবতাদের সব স্মৃতি একদল লোক কেমন নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে।

দাঁড়িয়ে থাকা এসব কাফ্রীদের ডেকে ভেতরে নিয়ে দেখানো হল। খুলে দেয়া হল পুরোহিতের প্রতারণার মুখোশ। মেয়ে চারজনকে তুলে দেয়া হল ওদের হাতে।

চারজনেরই পিতা এবং ভাইয়েরা উপস্থিত ছিলেন ওখানে। ওদের বলা হল, এখানে থাকত এক বদমাশ। এখন সে কুমিরের পেটে।

হাজার হাজার কাফ্রীকে শোনানো হল উপত্যকার পাপের কাহিনী।

নীরবে শুনছিল ওরা। কখনও মনে হত ওদের চোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।

ওদের বলা হল, যদি সত্যিকার খোদাকে দেখতে চাও, দেখানো হবে। তোমরা যেখানে বসে আছ, মনে করছ দেবতার আস্তানা, আসলে তা ছিল ভন্ডদের আখড়া। আমরা মিথ্যা খোদার এ পাবর্তী এলাকা ধূলায় মিশিয়ে দেব। তারপর দেখবে কোন খোদা সত্য।”

উম্মে আমারার জ্ঞান ফিরে এসেছে। সে তার ওপর দিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলল। ও যা বলল, মনে হয় তা এক দুঃস্বপ্ন।

উম্মে আমারা বলে যাচ্ছে পুরোহিত দিন রাত কয়েকবার করে আমার ইজ্জত হরণ করেছে। পুরোহিত কিছুক্ষণ পরপর আমাকে ফুল শুকতে দিত। সে ফুল শুকলে আমি ভুলে যেতাম আমার অতীত।

ওকে যখন বলা হল, “তোমার শিরচ্ছেদ করা হচ্ছিল। কমান্ডো বাহিনী সময়মত না পৌছলে এতক্ষণে থাকতে কুমীরের পেটে, তখন ভয়ে কাঁপতে লাগল মেয়েটা।

কী ভয়ংকর অবস্থায় ও পড়েছিল বুঝতে পেরে কাঁদতে লাগল উম্মে আমারা। সুলতানের হাতে চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ আমায় পাপের শাস্তি দিয়েছেন। আমি প্রায়শ্চিত্য করব। আপনি আমার আশ্রয় দিন।’

উম্মে আমারা ছিল বিত্তশালী ব্যবসায়ী পিতার সন্তান। তার পিতার সাথে সিরিয়ার আমীরদের ছিল গভীর হৃদ্যতা।

এসব আমীররা কেন্দ্রের অধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা শাসন করত। দশম শতাব্দীর পর এরা ডুবে গেল ভোগের সাগরে। অর্থের প্রয়োজনে সম্পর্ক গড়ে তুলল বড় বড় ব্যবসায়ীর সাথে। হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত সুন্দরী যুবতীরা। রাতভর মদে মাতাল হয়ে পড়ে থাকত রঙমহলে।

উম্মে আমার বার বছর বয়সেই পিতার সাথে আমীরদের নৃত্যের আসরে অংশ নিয়েছিল। ও ছিল অসম্ভব সুন্দরী।

পিতা কৈশোর থেকেই তাকে আমীর ওমরাদের আসরগুলোতে নাচ-গানে অভ্যস্ত করে তুলল।

উম্মে আমারা বলল, আমার বয়স তখন চৌদ্দ। আমার ওপর আমীরদের লোলুপ দৃষ্টি পড়তে লাগল। দু’জন আমীর আমাকে মূল্যবান উপটৌকন দিল। তাদের সাথে আমার গড়ে উঠল গভীর সম্পর্ক। ধীরে ধীরে আমি পাপের মধ্যে ডুবে গেলাম।

ষোল বছর বয়সে এক আমীরের রক্ষিতা হলাম বাবাকে না জানিয়ে। থাকতাম নিজের বাড়ীতে। অর্থ বিত্তের মাঝেই আমি বড় হয়েছি। আমার পরিবেশে লাজলজ্জা বলে কিছু ছিলনা।

দু’তিন বছর পর বাবার সংসার থেকে সরে গেলাম। সম্পর্ক গড়লাম আরও দু’জন আমীরের সাথে। পুরুষ আমার চোখের ইশারায় উঠাবসা করতে লাগল।

এর পর বাবা আমার সাথে সমঝোতা করলেন। গত দু’বছর থেকে তিনজন আমীর এবং বাবা আমাকে নতুন এক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। মুসলিম খেলাফতের মূলোৎপাটন করার জন্য তারা আমাকে ব্যবহার করতে চাইলেন। কদিন পর বাবার এ ষড়যন্ত্রে শরীক হল এক খ্রিস্টান।

আমীররা চাইছিল স্বাধীন শাসক হতে, খ্রিস্টানদের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। আমাকে বলা হল নুরুদ্দীন জংগী এবং খেলাফতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির করতে হবে। এ কাজে সহযোগিতার জন্য সাথে দেয়া হল খ্রিষ্টানদের তিনজন গুপ্তচর মেয়েকে।

আমাকে আরো বলা হল, সালাহউদ্দীন আয়ুবী মিসরে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। তার তৎপরতায় জনগণ তাকে রাজার মত সম্মান করে।

সবকিছু বুঝিয়ে আমাকে খলিফা আল আযেদের কাছে উপটৌকন হিসেবে পাঠান হল। উদ্দেশ্য ছিল নুরুদ্দীন জংগী, আয়ুবী এবং খলিফার মধ্যে শক্রতা সৃষ্টি করা এবং সুদানীদেরকে আরেকবার বিদ্রোহের জন্য উসকে দেয়া |

উম্মে আমারা সুলতানকে আরো জানাল, সে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছে। তার পিতাই তাকে মুসলিম শক্তি ধ্বংস করার ট্রেনিং দিয়েছে। ও-ই খলিফার হৃদয়ে আয়ুবীর প্রতি শক্রতা সৃষ্টি করেছিল। রজবও ছিল এ ষড়যন্ত্রের একজন। রজব খলিফার দেহরক্ষী দলে মিসরীদের পরিবর্তে সুদানীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

খলিফার কাছে ও এসেছে মাত্র আড়াইমাস। এর মধ্যেই সে হয়ে উঠেছিল মহলের রাণী। ও স্বীকার করল, ‘খলিফা আয়ুবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। রাজব এজন্য ঘাতক দলের সাথে চুক্তি করেছে।’

খলিফার ভোগ বিলাসে বিরক্ত হয়েই সালাউদ্দিন তার বিরোধিতা করেছিলেন। উম্মে আমারার অপহরণ, উদ্ধার এবং গোপন তথ্য প্রকাশ হওয়া ছিল কাকতালীর ব্যাপার। সুলতান উম্মে আমারাকে নিজের আশ্রয়ে রাখলেন।

এ ঘটনায় ওর চিন্তা চেতনা বদলে গেল। ও চাইছিল পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে। দেশ এবং জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেবেন সুলতান ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগলেন।

ফেরাউনের শেষ চিহ্ন ধুলায় মিশিয়ে পরদিন শাদাদ এবং আল নাসের সসৈন্যে কায়রো ফিরে এলেন।

ooo

আটদিন পর।

রাতের শেষ প্রহর। সালাউদ্দিন আয়ুবী গভীর ঘুমে অচেতন। চাকর তাকে ডেকে তুলে বলল, আল নাসের, আলী বিন সুফিয়ান এবং দু’জন নায়েবে সালার এসেছেন।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী বিছানা ছেড়ে বৈঠক রুমে চলে এলেন। অভ্যাগতদের একজন পেট্রোল ডিউটিরত সৈন্যদের কমান্ডার।

সুলতানকে বলা হল, ‘ছ’হাজার সুদানী ফৌজ মিসর সীমান্তে ছাউনি ফেলেছে। এদের সাথে রয়েছে মূর্তি ভেঙে ফেলা গোত্রের কাফ্রী এবং বিদ্রোহী সুদানী সৈন্য।

কমান্ডার দু’জন উষ্ট্রারোহীকে পাঠিয়েছিলেন সংবাদ নেয়ার জন্য। ওরা সুদানী হলেও সুলতানের বিশ্বস্ত ছিল। সুদানীরা পরাজিত হওয়ার পর সুলতানের সাধারণ ক্ষমা এবং পূনর্বাসনের প্রস্তাব ছিল তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত। আয়ুবী আগ্রহী সুদানী সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে যোগদানের অনুমতি দিলে তারা সুলতানের কাছে আত্মসমর্পন করে ফৌজে যোগ দিয়েছিল।

ওরা সুদানী সেনাপতির সাথে দেখা করল। কথা বলল সুলতান আয়ুবীর বিরুদ্ধে। জানাল, ওরা কায়রো আক্রমণ করলে তাদেরকে তারা। সব রকমের সাহায্য দেবে।

তোমরা শহরের অবস্থা এবং সালাউদ্দীন আয়ুবীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যতটুকু পার খবরাদি সংগ্রহ করে আমাকে জানাতে পারবে? জানতে চাইলেন সেনাপতি।

তারা সেনাপতিকে আশ্বস্ত করল। বলল, কখন আপনাকে রিপোর্ট করব?”

আজ রাতেই আমাদের আরো ফৌজ এসে আমাদের সাথে মিলিত হবে। তোমরা যদি রাতের মধ্যেই খবর দিতে পার তবে আগামী কালই আমরা কায়রোর দিকে রওয়ানা করব।”

ওরা সেনাপতিকে আশ্বস্ত করে ফিরে এল শহরে।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, খলিফার দেহরক্ষী ফৌজে পঞ্চাশজন সৈন্য এবং একজন কমান্ডার থাকবে। বাকীদের ছাউনিতে নিয়ে এস। খলিফা বাধা দিলে বলবে, এ আমার হুকুম।

আলী! তোমার সংস্থায় যারা সুদানের ভাষায় কথা বলতে পারে এমন একশ লোক উট্রারোহী দু’জনের সাথে ওদের কাছে পাঠিয়ে দাও। ওরা যাবে বিদ্রোহীদের পোশাকে। ওদের সেনাপতিকে বলবে এরা সুদানী ফৌজে যোগ দিতে এসেছে। এদের কাজ হবে ফৌজের গতিবিধি কেন্দ্রকে অবহিত করা। রাতে ওদের পশু এবং রসদ কোথায় থাকে তাও জেনে নেবে।

নাসের, তুমি ছোট ছোট মেনজানিক কামান সহ কমান্ডো বাহিনীকে প্রস্তুত রেখো।’

‘আমি ভেবেছিলাম মুখোমুখি আক্রমণ করে শহরের বাইরেই ওদের শেষ করে দেব |”

না! মনে রেখো নাসের, শক্ৰ যত কমই হোক মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলবে। রাতে কমান্ডো হামলা করবে। ডানে বাঁয়ে পেছনে আঘাত করে গেরিলারা পালিয়ে যাবে। শক্রর রসদ এবং পশু ধ্বংস করে দেবে। ব্যতিব্যস্ত করবে ওদের। ওদের শৃংখলা ভেংগে দেবে।

ওদেরকে আর সামনে এগোতে দেবে না। ডানে বাঁয়ে ছড়িয়ে যেতে বাধ্য করবে। যদি সামনাসামনি যুদ্ধ করতে হয়, পানি রাখবে নিজেদের দখলে।

সূর্য এবং বাতাস থাকবে ওদের প্রতিকূলে। যুদ্ধ করার জন্য তোমার পছন্দ করা ময়দানে নিয়ে আসবে ওদের। ওরা কায়রো এসে সেনাবাহিনীর সাথে সামনাসামনি লড়াই করতে চায়, আমি তাদের সে ইচ্ছা পূরণ হতে দেব না।

আলী! তোমার পাঠানো লোকদের বলবে, ওরা সুদানী বাহিনীতে প্রচার করবে সুলতান ছ’সাত দিনের মধ্যে ফিলিস্তিন আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। এ জন্য তার অনুপস্থিতিতে কায়রো আক্রমণ করতে হবে।’

প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার পর সুলতান বললেন ‘আজ সন্ধ্যায় আমি কায়রো থাকব না।’ কায়রো থেকে দূরে একটা স্থানের উল্লেখ করে বললেন ওখানেই হবে আমার হেড কোয়াটার।

বৈঠকখানায় সবাই ফজর আদায় করলেন। নামায শেষে বেরিয়ে গেলেন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য। নিজের কক্ষে ঢুকলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী। –

○○○

সুদানী সেনা ছাউনিতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিপূর্বে সুদানী বিদ্রোহ দমনের পর তারা আরেকটি বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিয়েছিল। খ্রিস্টান সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও পেয়েছিল ওরা। ওদের গুপ্তচর কাজ করছিল মিসরে। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে আয়ুবীর প্রস্তুতির খবর পেয়ে সে অভিযান ওরা মুলতবী করেছিল।

আয়ুবী জানতেন আবার একদিন পরাজিত সুদানীরা আক্রমণ করবে। ওদের একটা গোত্রের দেবতার আশ্রম ধ্বংস করেছেন সুলতান। এটা মামুলি কথা নয়। মিসরে সুলতান বিরোধীরা এ সুযোগ কাজে লাগাল। সুযোগ পেল পরাজিত বিদ্রোহী কমান্ডাররা।

সুদানের মুসলমানও আক্রমণের জন্য ওদের উত্তেজিত করছিল। দেবতাদের অপমান করা হয়েছে, প্রতিশোধ নিলেই কেবল দেবতার অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

প্রতিশোধের লক্ষ্যে জংলী উপজাতিও যোগ দিল বিদ্রোহীদের সাথে। এক হস্তার মধ্যে সৈন্য জমা করে ওরা কায়রো অভিমুখে রওয়ানা করল।

পথে সংবাদ পেলেই বিভিন্ন গোত্র থেকে সুদানীরা এসে ওদের সাথে যোগ দিত।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী ওদের ছাউনির কাছাকাছি চলে এসে আত্মগোপন করলেন।

উষ্ট্রারোহী দু’জন সুদানী সেনাপতিকে বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই আয়ুবী ফিলিস্তিনের দিকে যাবেন।

সেনাপতি ভীষণ খুশী। আয়ুবীর অনুপুস্থিতিতে মিসর আক্রমণ করা যাবে এ আশায় ছাউনিতে অবস্থানের মেয়াদ আরও কদিন বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

পরের রাতে পাঁচটি মেনজানিক কামান এবং তরল দাহ্য পদার্থ সহ পাঠিয়ে দেয়া হল পঞ্চাশ জন কমান্ডো সদস্য। মাঝরাতে ঘুমিয়ে আছে সৈন্যরা। রসদের স্থানে তরল পদার্থের ভান্ড এসে পড়তে লাগল। এর পরেই উড়ে এল আগুনের সলতে বাঁধা তীর।

জ্বলে উঠল আগুন। ছুটাছুটি শুরু হল ছাউনিতে, সাজোয়া বহর পেছনে সরিয়ে দিল কমান্ডোরা। তিন চার ভাগ হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল ছাউনির ভেতর দিয়ে।

সুদানী সৈন্যরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আয়ুবীর লোকদের বর্শার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হল। ওদের দলিত মথিত করে কমান্ডোদের ঘোড়াগুলো পৌছে গেল অন্য প্রান্তে। মিশে গেল মরুর অন্ধকারে।

আগুনের লেলিহান শিখায় ভয় পেয়ে ছাউনির উট ও ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল। সুলতানের সওয়ার দল তীর ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে গেল।

রাতে আর আক্রমণ করল না। আগুনে পুড়ে, ঘোড়ার পায়ে পিষে এবং তীরের আঘাতে নিহত হল সুদানীদের চারশ’ লোক। রসদ এবং তীরের স্তুপ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

রাতেই সেনাবাহিনী অন্যস্থানে গিয়ে ছাউনি ফেলল। চারপাশে মাটির ঢিবি। এখানে কমান্ডো হামলার ভয় নেই। পোট্রাল ডিউটির জন্য দূর দূরান্ত পর্যন্ত সৈন্যদের ছড়িয়ে দেয়া হল। এরপরও আক্রমণ হল গতরাতের মত।

পেট্রোল ডিউটিরত দু’টি দল কমান্ডো সদস্যদের হাতে মারা গেছে সেনাপতি তা জানত না। আগুনের সলতে বাধা তীর নিক্ষেপ করে পালিয়ে গেল গেরিলারা।

থেকে থেকে আক্রমণ চলল ভোর পর্যন্ত। গতরাতের চেয়ে এ রাতে ওদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশী।

সন্ধ্যায় আলী সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে বললেন, ‘ওরা কমান্ডো বাহিনীর আস্তানা খুঁজে বের করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে।

সুলতান সে রাতে কোন আক্রমণ করলেন না। এ রাতে ওরা সতর্ক থাকবে।”

পরদিন। চারশ করে পদাতিক ওদের ডানে এবং বায়ে আধা মাইল দূরে পাঠিয়ে দিলেন। ওদেরকে সামনে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হল। সুদানীদের দু’পাশ দিয়ে ওরা মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছিল।

যতই এগুচ্ছিল ততই দুদিকে সরে যাচ্ছিল ওরা। পেছন থেকে এবং দু’পাশ থেকে আক্রমণের ভয়ে সুদানীরাও ফৌজ দুদিকে ছড়িয়ে দিল।

অকস্মাৎ টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সুলতানের পাঁচশ অশ্বারাহী। ঝাঁপিয়ে পড়ল সুদানী বাহিনীর মধ্যখানে। আক্রমণের তীব্রতায় ওদের মধ্যে ছুটাছুটি শুরু হল। দু’পাশ থেকে তীর ছুড়তে লাগল পদাতিক ফৌজ।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top